৭২. বাল্মীকির সহিত লব কুশের শ্রীরামের নিকট গমন ও লব কুশ কর্ত্তৃক রামায়ণ গান

বাল্মীকির সহিত লব কুশের শ্রীরামের নিকট গমন ও লব কুশ কর্ত্তৃক রামায়ণ গান

এ সব গাইল গীত জৈমিনী ভারতে।
সম্প্রতি যে কিছু গাই বাল্মীকির মতে।।
ঘোড়া আনি করিলেন যজ্ঞ সমাপন।
নানা দেশী ব্রাহ্মণে দিলেন রাম ধন।।
বড় পরিপাটী যজ্ঞ করেন দুষ্কর।
শিষ্য সহ আইল বাল্মীকি মুনিবর।।
মুনিরে দেখিয়া রাম সম্ভ্রমে উঠিয়া।
বসিতে আসন দেন পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়া।।
বারশত শিষ্য এল মুনির সংহতি।
লব কুশ দুই ভাই মিশাইল তথি।।
মুনির মিশালে আছে নাহি পরিচয়।
বিষ্ণু-অবতার দোঁহে রামের তনয়।।
শ্রীরাম বলেন শুন ভরত এখন।
মুনি রহিবারে দেহ দিব্য-আয়োজন।।
লব কুশ দুই ভাই মুনির সংহতি।
দুই ভাই লৈয়া মুনি করেন যুকতি।।
মুনি বলে লব কুশ শুন সাবধানে।
ধনুক-সঙ্গীত-বিদ্যা পেলে মম স্থানে।।
ধনুর্ব্বিদ্যা দেখাইলা আমার গোচর।
বিক্রমে দুর্জ্জয় হও দুই সহোদর।।
স্বয়ং বিষ্ণু রঘুনাথ ত্রিভুবন জিনে।
শিশু হইয়া তাঁহারে জিনিলা দুইজনে।।
ধনুর্ব্বিদ্যা তোমরা যে করিলে সুশিক্ষা।
সাক্ষাতে পেলাম আমি তাহার পরীক্ষা।।
গীত-বিদ্যা রামায়ণ শিখিরে দুজন।
শ্রীরামের আগে কালি গাও রামায়ণ।।
অনেক দেশের রাজা আইল এ স্থানে।
রামায়ণ গীত কালি গাহিবে দুজনে।।
দুই ভাই কর মোর কবিত্ব প্রচার।
ঘুষিবারে থাকে যেন সকল সংসার।।
যাঁহারে প্রসন্না হন সরস্বতী দেবী।
আমি আদি করিয়া সকলে তাঁরে সেবি।।
সভা করি বসিবেন শ্রীরাম যখন।
সাবধানে গাহিবে তোমরা রামায়ণ।।
পর জিজ্ঞাসিবে রাম সভার ভিতর।
বাল্মীকির শিষ্য হেন করিও উত্তর।।
আর যুক্তি বলি শুন তোমরা দুজন।
মিষ্ট স্বরে উভরে গাহিবে রামায়ণ।।
যখন গাহিবে গীত সীতার বর্জ্জন।
না বলিও শ্রীরামেরে কোন কুবচন।।
জগতের নাথ রাম পরম পূজিত।
কুকথা কহিতে তাঁরে না হয় উচিত।।
যখন যাইবে শুন রামের সভায়।
তখন করিবে বেশ তপস্বীর প্রায়।।
বীরবেশ দেখিয়া পাবেন রাম ত্রাস।
আরবার এড়েন কি জীবনের আশ।।
বিভাবরী প্রভাতা উদিত ভানুমান।
দুই ভাই করেন বাকল পরিধান।।
শিরে জটা বান্ধিলেন দেখিতে সুঠাম।
পূর্ণচন্দ্র মুখ বর্ণ দূর্ব্বাদল-শ্যাম।।
হাতে বীণা করি দোঁহে করেন গমন।
মধুর ধ্বনিতে গান বেদ-রামায়ণ।।
হাটে মাঠে গীত গান নগরে বাজারে।
শুনিয়া সুস্বর সবে আপনা পাসরে।।
কহিল সুস্বর সবে আপনা পাসরে।।
কহিল অমাত্যগণ রামেরে ত্বরিত।
শিশু-মুখে মিষ্ট গীত শুনিতে উচিত।।
অমাত্যের প্রতি রমা করেন আদেশ।
যজ্ঞস্থানে দুই ভাই করিল প্রবেশ।।
বীণা হাতে করিয়া বসিল যে সভায়।
রামায়ণ শুনিতে সকল লোক ধায়।।
অবসর পাইয়া যজ্ঞের অবশেষে।
বসিলেন শ্রীরাম সভায় শুদ্ধবেশে।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল নিবাসী যত জন।
আগমন করিল শুনিতে রামায়ণ।।
বসিল পণ্ডিতগণ জ্ঞানেতে পূরিত।
গন্ধর্ব্ব কিন্নর যক্ষ রক্ষ চারিভিত।।
দুই ভাই গীত গায় বাজাইয়া বীণা।
দুই ভাই গীত শুনে অমৃতের কণা।।
বীণাযন্ত্র বাজে আর গীত গায় স্বরে।
শুনিয়া সকল লোক আপনা পাসরে।।
চারি ভাই রঘুনাথ গীতে দেন মন।
মোহিত সকল লোক শুনি রামায়ণ।।
সর্ব্বলোক সভায় করিছে কাণাকাণি।
রামের আকৃতি দুই শিশু কি না জানি।।
জটা আর বাকল যে এটা মাত্র আন।
আকৃতি প্রকৃতি দেখি রামের সমান।।
এই দুই শিশু সহ করিলেন রণ।
শ্রীরাম লক্ষ্মন আর ভরত শত্রুঘ্ন।।
যুদ্ধ করে ত্রিভুবন না পারে সহিতে।
সংসার মোহিত করে রামায়ণ-গীতে।।
তপস্বীর বেশ দোঁহে ধরিল এখন।
শিশু নহে দুইজন সাক্ষাৎ শমন।।
শ্রীরাম হইতে দুই বালক দুর্জ্জয়।
শ্রীরামেরে ইহারা করিল পরাজয়।।
কোন্ বিধি নির্ম্মাণ করিল দুই জনে।
এত গুণ ধরে কোথা আছে ত্রিভুবনে।।
এই যুক্তি তারা সবে করে সর্ব্বক্ষণ।
ভুবন মোহিত হৈল শুনে রামায়ণ।।
যতেক সভার লোক অনুমান করে।
শ্রীরামের দুই পুত্র কভু নাহি নড়ে।।
গাহিল প্রথম দিনে বিংশতি শিকলি।
সুরস সুচ্ছন্দ সুপ্রসন্ন পদাবলী।।
দুইভায়ের গীত যদি হৈল অবসান।
শ্রীরাম বলেন কর গায়কের মান।।
লক্ষ্মণ শুনিয়া সে শ্রীরামের বচন।
অশীতি সহস্র তোলা আনেন কাঞ্চন।।
গায়কেরে দিলেন পূরিয়া স্বর্ণথালা।
পীতাম্বর অলঙ্কার আর পুষ্পমালা।।
উভয় গায়ক বলে শ্রীরঘুনন্দন।
বস্ত্র-অলঙ্কারে মোর নাহি প্রয়োজন।।
কি করিব ধনে বস্ত্রে আর অলঙ্কারে।
বস্ত্র অলঙ্কার রাখ আপন ভাণ্ডারে।।
শ্রীরাম বলেন হে জিজ্ঞাসি এক বাণী।
কাহার কবিত্ব রামায়ণ কহ শুনি।।
ইহা যদি শুনে লোক কিবা হয় ফল।
বিশেষ জানহ যদি কহ এ সকল।।
এত যদি জিজ্ঞাসা করেন রঘুনাথ।
উঠে দুই গায়ক যে যোড় করি হাত।।
দুই শিশু বলে শুন শ্রীরঘনন্দন।
জিজ্ঞাসিলে যত কিছু কহি বিবরণ।।
চতুর্ব্বেদ বিংশতি শ্লোক যে নির্ম্মাণ।
এগার শত সহস্র কাব্যের বাখান।।
যেই জন শুনিবারে করে অভিলাষ।
সর্ব্ব পাপ ঘুচে তার স্বর্গে হয় বাস।।
অপুত্রক শুনিলে সে পায় পুত্রবর।
যে যাহা বাসনা করে পূর্ণ হয় তার।।
অশ্বমেধ করিলেন যে শ্রীরাম এখন।
এই ফল পায় সে যে শুনে রামায়ণ।।
তুমি না জন্মিতে ষাটি হাজার বৎসর।
অনাগত পুরাণ রচিলা মুনিবর।।
অবতার না হইতে বাল্মীকির গাথা।
আদিকাণ্ডে শ্রীরাম তোমার জন্মকথা।।
শ্রীরাম অযোধ্যাকাণ্ডে পেলে ছত্রদণ্ড।
রাজ্য হারাইলা তাহে কৈকেয়ী পাষণ্ড।।
তব পিতা দশরথ স্ত্রীর অতি বাধ্য।
পাঠায় তোমারে বনে অতি সে দুঃসাধ্য।।
অযোধ্যা ছাড়িয়া তুমি গেলা বনবাসে।
শিরে হাত কান্দে রাম স্ত্রী আর পুরুষে।।
সংসার দেখিয়া শূন্য কান্দে সর্ব্বলোক।
মরিলেন দশরথ পেয়ে তব শোক।।
তুমি বনে গেলে, ভরত মাতুলের পাড়া।
চারিপুত্র থাকিতে রাজা হৈল বাসি মড়া।।
বাসি মড়া তৈলের ভিতরে দশরথ।
অগ্নিকার্য্য কৈল দেশে আসিয়া ভরত।।
অরণ্যকাণ্ডেতে সীতা হরে লঙ্কেশ্বর।
বধিলা রাক্ষস বহু সেনা মুখ্য খর।।
দুই শোকে শ্রীরাম পাইলে বড় তাপ।
কিষ্কিন্ধ্যায় বালি মারি সুগ্রীবের লাভ।।
সুন্দরাতে শ্রীরাম সাগর হৈলে পার।
লঙ্কাকাণ্ডেতে রাবণ করিলা সংহার।।
সীতার পরীক্ষা আর রাজা বিভীষণ।
স্বর্গ-পিতা সম্ভাষিয়া দেশেতে গমন।।
আসিয়া হইলে তুমি পৃথিবীর রাজা।
অযোধ্যায় থাকিয়া পালিছ তুমি প্রজা।।
দশ হাজার বর্ষ তব প্রজার পালন।
নয় হাজার বৎসরে বৃদ্ধ রাজার মরণ।।
হাজার বৎসর ছিল পিতৃ-পরমাই।
পরমায়ু পিতার পাইলে চারি ভাই।।
এগার হাজার বর্ষ করিবে পালন।
সাত হাজার বর্ষে কর সীতারে বর্জ্জন।।
গীত গায় যখন মায়ের বনবাস।
তখন দোঁহার হয় গদ গদ ভাষ।।
তাহারা শিখিল গীত বাল্মীকির স্থানে।
সংসার মোহিত হয় সে গীতের তানে।।
দুর্ব্বাসা আসিয়া দ্বারে রহিবেন কোপে।
লক্ষ্মণেরে বর্জ্জিবেন সেই মুনিশাপে।।
স্বর্গবাসে যাইবেন লইয়া সংসার।
ইহা বিনা বাল্মীকি না লিখিলেন আর।।
শ্রীরাম শুনিয়া সেই রামায়ণ গান।
নিজ পুত্র বলিয়া করেন অনুমান।।
লব কুশ সঙ্গীত গাহিল এক মাস।
রচিল উত্তরকাণ্ড কবি কৃত্তিবাস।।