রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর » বর্ণানুক্রম » স
স
সিন্ধুভৈরবী কেন বাজাও কাঁকন কনকন, কত ছলভরে! ওগো, ঘরে ফিরে চলো, কনককলসে জল ভ’রে। কেন জলে ঢেউ তুলি ছলকি ছলকি কর খেলা! কেন চাহ খনে খনে...
ছায়ানট যদি বারণ কর, তবে গাহিব না। যদি শরম লাগে, মুখে চাহিব না। যদি বিরলে মালা গাঁথা সহসা পায় বাধা, তোমার ফুলবনে যাইব না। যদি বারণ কর, তবে গাহিব না। যদি থমকি...
পুজোর পরব কাছে। ভাণ্ডার নানা সামগ্রীতে ভরা। কত বেনারসি কাপড়, কত সোনার অলংকার; আর ভাণ্ড ভ’রে ক্ষীর দই, পাত্র ভ’রে মিষ্টান্ন। মা সওগাত পাঠাচ্ছেন। বড়োছেলে বিদেশে রাজসরকারে কাজ করে; মেজোছেলে সওদাগর, ঘরে থাকে না; আর-কয়টি ছেলে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া ক’রে পৃথক পৃথক বাড়ি করেছে;...
সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায় বিদেশী নায়ে, তাহারি রাগিণী লাগিল গায়ে॥ সে সুর বাহিয়া ভেসে আসে কার সুদূর বিরহবিধুর হিয়ার অজানা বেদনা, সাগরবেলার অধীর বায়ে বনের ছায়ে॥ তাই শুনে আজি বিজন প্রবাসে হৃদয়মাঝে...
আলেয়া সখী, প্রতিদিন হায় এসে ফিরে যায় কে! তারে আমার মাথার একটি কুসুম দে। যদি শুধায় কে দিল, কোন্ ফুলকাননে, তোর শপথ, আমার নামটি বলিস নে। সখী, প্রতিদিন হায় এসে ফিরে যায় কে! সখী, তরুর তলায় বসে...
সখি রে, পিরীত বুঝবে কে! আঁধার হৃদয়ক দুঃখকাহিনী বোলব, শুনবে কে। রাধিকার অতি অন্তরবেদন কে বুঝবে অযি সজনি। কে বুঝবে, সখি, রোয়ত রাধা কোন দুখে দিনরজনী। কলঙ্ক রাটায়ব জনি, সখি, রটাও— কলঙ্ক নাহিক...
সখি লো, সখি লো, নিকরুণ মাধব মথুরাপুর যব যায় করল বিষম পণ মানিনী রাধা রোয়বে না সো, না দিবে বাধা, কঠিন‐হিয়া সই হাসয়ি হাসয়ি শ্যামক করব বিদায়। মৃদু মৃদু গমনে আওল মাধা, বয়ন‐পান তছু চাহল রাধা, চাহয়ি রহল স চাহয়ি রহল— দণ্ড দণ্ড, সখি, চাহয়ি রহল— মন্দ...
সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান, সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ। মুক্ত করো ভয়, আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়। দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো, নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।...
সজনি সজনি রাধিকা লো, দেখ অবহুঁ চাহিয়া মৃদুলগমন শ্যাম আওয়ে মৃদুল গান গাহিয়া॥ পিনহ ঝটিত কুসুমহার, পিনহ নীল আঙিয়া। সুন্দর সিন্দুর দেকে সীঁথি করহ রাঙিয়া॥ সহচরি সব নাচ নাচ মিলনগীত গাও রে, চঞ্চল মঞ্জরীরাব কুঞ্জগগনে ছাও রে। সজনি, অব উজার’ মঁদির কনকদীপ জ্বালিয়া,...
সতিমির রজনি, সচকিত সজনী, শূন্য নিকুঞ্জ‐অরণ্য। কলয়িত মলয়ে, সুবিজন নিলয়ে বালা বিরহবিষণ্ণ॥ নীল আকাশে তারক ভাসে, যমুনা গাওত গান। পাদপ‐মরমর, নির্ঝর‐ঝরঝর, কুসুমিত বল্লিবিতান। তৃষিত নয়ানে বনপথপানে নিরখে ব্যাকুল বালা— দেখ ন পাওয়ে, আঁখ ফিরাওয়ে, গাঁথে বনফুলমালা! সহসা রাধা চাহল...
আমি তার সতেরো বছরের জানা। কত আসাযাওয়া, কত দেখাদেখি, কত বলাবলি; তারই আশেপাশে কত স্বপ্ন, কত অনুমান, কত ইশারা; তারই সঙ্গে সঙ্গে কখনো বা ভোরের ভাঙা ঘুমে শুকতারার আলো, কখনো বা আষাঢ়ের ভরসন্ধ্যায় চামেলিফুলের গন্ধ, কখনো বা বসন্তের শেষ প্রহরে ক্লান্ত নহবতের পিলুবারোয়াঁ; সতেরো...
এখানে নামল সন্ধ্যা। সূর্যদেব, কোন্ দেশে, কোন্ সমুদ্রপারে, তোমার প্রভাত হল। অন্ধকারে এখানে কেঁপে উঠছে রজনীগন্ধা, বাসরঘরের দ্বারের কাছে অবগুণ্ঠিতা নববধূর মতো; কোন্খানে ফুটল ভোরবেলাকার কনকচাঁপা। জাগল কে। নিবিয়ে দিল সন্ধ্যায়-জ্বালানো দীপ, ফেলে দিল রাত্রে-গাঁথা...
প্রথম পরিচ্ছেদ ঝিঁকড়াকোটার কৃষ্ণগোপাল সরকার জ্যেষ্ঠপুত্রের প্রতি জমিদারি এবং সংসারের ভার দিয়া কাশী চলিয়া গেলেন। দেশের যত অনাথ দরিদ্র লোক তাঁহার জন্য হাহাকার করিয়া কাঁদিতে লাগিল। এমন বদান্যতা, এমন ধর্মনিষ্ঠতা কলিযুগে দেখা যায় না, এই কথা সকলেই বলিতে লাগিল। তাঁহার পুত্র...
প্রথম পরিচ্ছেদ অপূর্বকৃষ্ণ বি. এ. পাস করিয়া কলিকাতা হইতে দেশে ফিরিয়া আসিতেছেন। নদীটি ক্ষুদ্র। বর্ষা-অন্তে প্রায় শুকাইয়া যায়। এখন শ্রাবণের শেষে জলে ভরিয়া উঠিয়া একেবারে গ্রামের বেড়া ও বাঁশঝাড়ের তলদেশ চুম্বন করিয়া চলিয়াছে। বহুদিন ঘন বর্ষার পরে আজ মেঘমুক্ত আকাশে রৌদ্র...
প্রথম পরিচ্ছেদ বৃন্দাবন কুণ্ড মহাক্রুদ্ধ হইয়া আসিয়া তাহার বাপকে কহিল, “আমি এখনই চলিলাম।” বাপ যজ্ঞনাথ কুণ্ড কহিলেন, “বেটা অকৃতজ্ঞ, ছেলেবেলা হইতে তোকে খাওয়াইতে পরাইতে যে ব্যয় হইয়াছে তাহা পরিশোধ করিবার নাম নাই, আবার তেজ দেখ-না।” যজ্ঞনাথের ঘরে...
আমার স্ত্রী-বর্তমানে প্রভা সম্বন্ধে আমার কোনো চিন্তা ছিল না। তখন প্রভা অপেক্ষা প্রভার মাতাকে লইয়া কিছু অধিক ব্যস্ত ছিলাম। তখন কেবল প্রভার খেলাটুকু হাসিটুকু দেখিয়া, তাহার আধো আধো কথা শুনিয়া, এবং আদরটুকু লইয়াই তৃপ্ত থাকিতাম; যতণ ভালো লাগিত নাড়াচাড়া করিতাম, কান্না আরম্ভ...
সাধন কি মোর আসন নেবে হট্টগোলের কাঁধে? খাঁটি জিনিস হয় রে মাটি নেশার পরমাদে॥ কথায় তো শোধ হয় না দেনা, গায়ের জোরে জোড় মেলে না— গোলেমালে ফল কি ফলে জোড়াতাড়ার ছাঁদে?। কে বলো তো বিধাতারে তাড়া দিয়ে ভোলায়?...
সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে। সার্থক জনম, মা গো, তোমায় ভালোবেসে॥ জানি নে তোর ধনরতন আছে কি না রানীর মতন, শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে॥ কোন্ বনেতে জানি নে ফুল গন্ধে এমন করে আকুল, কোন্ গগনে ওঠে রে চাঁদ এমন হাসি হেসে।...
ফাল্গুনের সূর্য যবে দিল কর প্রসারিয়া সঙ্গীহীন দক্ষিণ অর্ণবে, অতল বিরহ তার যুগযুগান্তের উচ্ছ্বসিয়া ছুটে গেল নিত্য-অশান্তের সীমানার ধারে; ব্যথার ব্যথিত কারে ফিরিল খুঁজিয়া, বেড়ালো...
স্বর্গের অধিকারে মানুষ বাধা পাবে না, এই তার পণ। তাই, কঠিন সন্ধানে অমর হবার মন্ত্র সে শিখে নিয়েছে। এখন একলা বনের মধ্যে সেই মন্ত্র সে সাধনা করে। বনের ধারে ছিল এক কাঠকুড়নি মেয়ে। সে মাঝে মাঝে আঁচলে ক’রে তার জন্যে ফল নিয়ে আসে, আর পাতার পাত্রে আনে ঝরনার জল। ক্রমে তপস্যা এত...