০৯.
কোথায় নিয়ে চললেন আমাকে? বলি দেবেন নাকি? মন্দির-টন্দির আছে ওপরে?
এখানে সব জায়গাতেই মন্দির, সব জায়গাতেই মসজিদ। শুধু দেখার চোখ থাকা চাই।
ভারি উঁচু কিন্তু, যাই বলুন আর তাই বলুন।
তোমার জুতোটার জন্যে আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে। ভীরাপ্পান যদি আজ আসে তো তোমার জন্যে একজোড়া জুতো আনিয়ে নেব পোর্ট ব্লেয়ার থেকে কালকেই ভোরে।
যদি আসে মানে?
মানে, যদি আসে।
নাও আসতে পারে নাকি?
আসার কথা তো ছিল গতকালই। কথার খেলাপ তো করে না ও। নিশ্চয়ই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এই সময়ে আন্দামান আর্কিপোলোগোতে একটা ভাইরাল ফিভার এসেছে। একবার পটকালে সাত দিন মিনিমাম।
কীসের ভাইরাস?
ডাক্তারেরা যে-জ্বরই ডায়োগনাইজ করতে পারেন না, তারই নাম দেন ভাইরাল ফিভার। সত্যই সেলুকাস। বিচিত্র এই দেশ।
ডাক্তারেরা আপনার এই ব্যাখ্যার কথা কি শুনেছেন?
আমার মুখে হয়তো শোনেননি। তবে নিজেরা কি আর জানেন না? যাই এল আর তাই এল, আগেকার দিনই ভালো ছিল।
কবেকার দিন?
আরে যখন দেশের তাবৎ মানুষ মরত শুধু একটিমাত্রই রোগে।
কী রোগ তা?
সন্ন্যাস। যে-ই মারা যান না কেন, পরদিন খবরের কাগজে বেরোত তিনি সন্ন্যাস রোগে মরিয়া গিয়াছেন।
জীবদ্দশাতেই ডাক্তার, প্যাথলজিস্ট, সার্জেন, ই ই জি, ই সি জি, এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এম আর আই ইত্যাদি ইত্যাদি করে রোগীর আর্থিক অবস্থা সন্ন্যাসীর মতো হওয়ার আগেই সন্ন্যাস রোগ স্বয়ং এসে তাকে উদ্ধার করত। রক্ষিতার বা নিজের চেয়ে পনেরো বছরের ছোটো স্ত্রীর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে গহরজান বাইজির রেকর্ড শুনতে শুনতে আদরে-গোবরে মানুষ তার স্বাভাবিক পরিণতিতে পৌঁছোতে পারত নিশ্চিন্তে। ডাক্তারদের বিন্দুমাত্র সাহায্য ছাড়াই। বিজ্ঞানের এই দুর্দান্ত অগ্রগতির দিনে ল্যাবরেটরির ইঁদুরের মতো তাকে তিলে তিলে জীবদ্দশাতেই মরতে হত না।
হেসে উঠল রংকিনী খুব জোরে।
বলল, বলছেন। ভালোই। কিন্তু আর কত দূর?
এই তো! সামনে একটা বাঁক ঘুরলেই দ্য ভিউ-পয়েন্ট-এ পৌঁছে যাব।
চুমকির মুখে শুনেছি যে, জলদস্যুরা নাকি এই পাহাড়-চুড়োতে বসে দূরবিন দিয়ে চেন্নাই, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার এবং থাইল্যাণ্ড থেকে যাতায়াত করা বাণিজ্য-জাহাজের ওপরে নজর রাখত।
চুমকি জানল কী করে?
ওর ঠাকুমার কাছে গল্প শুনেছিল।
দ্বীপটির নাম দ্য হর্নেটস নেস্ট তো এইজন্যেই। এটি ছিল জলদস্যুদের আড্ডা। এর তটভূমিও আশ্চর্য সুন্দর। পাহাড়টার অবস্থান এমনই যে, কোনো দিকের হাওয়াই এসে এতে আছড়ে পড়ে না। তা ছাড়া সবচেয়ে বড়ো কথা যে, এই দ্বীপে একটি মিষ্টি জলের পুকুর আছে যা কখনো শুকোয় না।
স্বাভাবিক পুকুর?
তা বলতে পারব না। হয়তো জলদস্যুরাই খুঁড়েছিল। কিন্তু তিন-শো পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে দু-শো পঁয়ষট্টি দিনই বৃষ্টি হওয়াতে এই পুকুরের জল কখনো শুকোয় না। এই দ্বীপের মধ্যে একটিই অশান্তি ঘটিয়েছি আমি। একটি ডিজেল পাম্প বসিয়েছি। তবে বাংলো থেকে অনেক দূরে। যাতে, বাংলোতে বসে শব্দ না শোনা যায়। পলিথিনের পাইপলাইন বসিয়েছি বাংলো অবধি। ওভারহেড ট্যাঙ্কে জল জমে। তুমি তো কাল রাতে সে-জলেই চান করলে। তবে আমরা দুজনে ওই জলে চান করি না।
কেন?
ভয়ে। যদি যথেষ্ট বৃষ্টি না হওয়াতে জলে টান পড়ে যায়। এই জলই তো খাই আমরা। চমৎকার স্বাদ। তাই-না? হজমও খুব ভালো হয়। খাওয়ার জল আনতে ও যেতে-আসতে সাত ঘণ্টা লাগবে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে। সে কি কম ঝক্কি?
তার পর বললেন, ভীরাপ্পান আবার কই আর শিঙি মাছ ছেড়েছে ওই পুকুরে। রুই কাতলাও ছেড়েছে কিছু। গরমের সময়ে কই-শিঙি ধরে আমার জন্যে। ও শুঁটকির ভক্ত।
আর রুই-মাছ ধরেন না?
না। যেদিন চুমকি অথবা তোমার বিয়ে হবে, বরের সঙ্গে হানিমুন করতে আসবে এখানে, সেদিন পাকা লাল মাছ তুলে মাছভাজা, মাছেরও তেলভাজা, মাছের ঝাল, দই-মাছ, রেজালা, কালিয়া, মুড়িঘণ্ট, মাছের মাথা দেওয়া মুগের ডাল এবং মাছের টক রাঁধা হবে। আমিই রাঁধব।
ততদিনে সব মাছ মরে যাবে। তা ছাড়া, চুমকির বরের ডেডবডি কিন্তু এখানেই পড়ে থাকবে যদি সত্যিই সব পদ খাওয়ান আপনি? গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল।
এলাম কি?
রংকিনী ঘেমে-নেয়ে বলল।
ইয়েস।
কিন্তু তুমি যে সত্যি হাঁপাচ্ছ। বসে পড়ো ওই পাথরটাতে। দেখেছ! কত বড়ো পাথরের চাঙড়। কত জলদস্যু বসেছে এখানে, কত অপহৃতা মেয়েরা ধর্ষিতা হয়েছে। পাথরটা কীরকম মসৃণ হয়ে গেছে দেখেছ ব্যবহারে।
মানে, ধর্ষিতা মেয়েদের পশ্চাতদেশের ঘর্ষণে পাথর ক্ষয়ে গেছে বলছেন? ব্যোপদেবের গল্পই জানতাম শুধু পাথর ক্ষয়ের, এ এক নতুন গল্প শোনালেন আপনি যা হোক! কী পাথর এটা? এইসব দ্বীপে তো পাথর বিশেষ দেখিনি, মানে পোর্ট ব্লেয়ারে, রস আইল্যাণ্ডে, ভাইপার আইল্যাণ্ডে।
আহুক হেসে বললেন, না। এগুলো স্যাণ্ডস্টোন। বোসো। এবারে দেখো চারদিকে তাকিয়ে সত্যিই তুমি রানি কি না।
পরের ধনে পোদ্দারি করতে চাই না আমি। এমনিতেই খুশি। সত্যি! ভাবা যায় না। পৃথিবীতে এমন জায়গাও আছে!
এমন জায়গা থাকবে না কেন। হয়তো অনেকই আছে কিন্তু সেই টঙে হাজার হাজার ট্যুরিস্ট হাঁচোর-পাঁচোর করে চড়ে ক্যাচর-ম্যাচর করে সব শান্তি নষ্ট করে দেয়। এখানের সবচেয়ে বড়ো সৌন্দর্য এই নির্জনতা। নির্জনতা তোমাকে কখনো খালি হাতে ফেরায় না। কী বনে, কী জীবনে।
রংকিনী চুপ করে রইল। এবং আশ্চর্য! দ্য হর্নেটস নেস্ট-এর চুড়োতে উঠে ওর পাশের পাথরটার ওপরে বসে, আহুক বোসও যেন সমাধিস্থ হলেন।
রংকিনী আস্তে আস্তে মুখ ঘুরিয়ে চারদিক দেখতে লাগল। ওর চোখ দুটি যেন প্যানারোমিক লেন্স হয়ে গেল। তটভূমির ওপরে কোথাও নারকোল গাছ ঝুঁকে পড়েছে, কোথাও অন্য নাম-না-জানা গাছ। কোথাও জলকে ছাই-রঙা দেখাচ্ছে আর তটভূমিকে গেরুয়া, কোথাও বা তটভূমিকে ছাই-রঙা আর জলকে হলদেটে, জলের নীচের প্রবালের জন্যে। এক এক জায়গাতে জলের রং এক একরকম। বনের মধ্যে অনেক জায়গাতেই প্রকান্ড বড়ো বড়ো সব গাছ। কতগুলোর কান্ডর রং সাদা। প্রত্যেক বড়োগাছের গায়েই লতা উঠেছে জড়িয়ে-মড়িয়ে। দিনের বেলাতেই ঘনান্ধকার সেই বনের ভেতরে। তার মধ্যে বাঘ থাকার কথা। কিন্তু আশ্চর্য! নেই। বড়ো শান্তি চারিদিকে। চারদিকেই হাজার মাইল সমুদ্র। বাঁয়ে বঙ্গোপসাগর, ডানে আন্দামান উপসাগর। কোথাও এতটুকু কলুষ নেই। না জলে, না হাওয়ায়, না বনে, না তটে। দু-নাক ভরে নিঃশ্বাস নিল রংকিনী। খোলা হাওয়াতে গায়ের ঘাম শুকিয়ে গেছে। ঘর্মাক্ত মুখে ঠাণ্ডা হাওয়া লাগাতে খুব আরাম লাগছে।
রংকিনী ওই বড়ো গাছগুলোর দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আহুককে জিজ্ঞেস করল, ওগুলো কী গাছ?
ওইগুলোই তো প্যাডক। এখানে বসেই সব গাছ চিনিয়ে দেব এক এক করে তোমাকে। নারকোল গাছ তো খুব বেশি নেই। অথচ চুমকির ঠাকুমা তো নারকোল বন-এর দ্বীপই কিনেছিলেন, যখন কিনেছিলেন।
তা ঠিক। তবে নারকোল থেকে কোপরা করে তা কলকাতা কি চেন্নাইয়ে পাঠাতে যা খরচ পড়ে তাতে লোকসানই হয়। চুমকি একেবারে অন্য লাইনে চলে গেছে। ব্যাবসাটাও বোঝে।
কী? মানে, কোন লাইন?
এখানে আমরা ডায়াস্কোরিয়ার চাষ শুরু করেছি। পাহাড়ের ওই দিকের ঢাল-এ। পরে দেখাব।
ডায়াস্কোরিয়াটা কী জিনিস?
একরকমের মূল।
কী হয় তা দিয়ে?
জন্মনিরোধক বড়ি তৈরি হয়। চাইনিজ বেশ্যারা নাকি বহুযুগ ধরে এই মূল খায় যাতে তাদের অনভিপ্রেত গর্ভাধান না হয়।
তাই?
হ্যাঁ। এই দ্য হর্নেটস নেস্ট-এ ডায়াস্কোরিয়ার গাছ প্রচুর আছে।
তা ওষুধ বানাবেন কারা? চুমকিরাই?
মা, না। কলকাতার দেজ মেডিক্যাল, মুম্বাই-এর সিপলা, চেন্নাই-এর প্যারি সকলের সঙ্গেই চুমকি এগ্রিমেন্ট করছে। প্রথম শিপমেন্ট কলকাতাতে পৌঁছোবে নিরানব্বই-এর জানুয়ারিতে। সেখানে দেজকে দেওয়া হবে। তার পর ট্রান্সপোর্টে যাবে মুম্বাই এবং চেন্নাই।
একটু চুপ করে থেকে বললেন, আরও একটা দারুণ ব্যাবসাতে নেমেছি আমরা। খরচ বলতে কিছুই নেই।
কীসের ব্যাবসা?
পাখির বাসার।
অ্যাঁ?
হ্যাঁ। পাখির বাসার। এখানে অনেকরকম পাখি আছে যাদের বাসা চিনেরা আহামরি করে খায়। Edible Bird-nests কেন? Bird-nest soups খাওনি কখনো? খেয়ে দেখবে।
চিনে রেস্তরাঁতে?
তাজ বেঙ্গলে চেয়ে হয়তো পাবে। ওবেরয়তেও পেতে পারো। তবে বে-আইল্যাণ্ড-এর ম্যানেজার বলছিলেন। ওবেরয় গ্র্যাণ্ড নাকি নতুন থাই রেস্তরাঁ চালু করছে। কলকাতাতে না পেলেও মুম্বাই-দিল্লির বড়ো হোটেলে পাবে অবশ্যই।
থাই খাবার আমার দারুণ লাগে। ব্যাংককে গেলেই খাই। মুম্বাই-এর তাজ গ্রুপ-এর The President হোটেলেও একটা ভালো থাই রেস্তরাঁ আছে।
তার পর বললেন, চায়নাতে এইসব পাখির বাসার খুব ভালো দাম পাওয়া যায়। ওজনও কম। রপ্তানি করাও সম্ভব খুবই কম খরচে।
বাঃ। দারুণ বুদ্ধি তো চুমকির।
তোমারই তো বন্ধু। বুদ্ধি তো হবেই। জঙ্গল একটুও নষ্ট হল না। আরও অনেক পাখিও এল দ্বীপে।
তার পর বললেন, মিষ্টি জলের জন্যেও এই দ্বীপে গ্রীষ্মকালে পাখির মেলা বসে যায়। আমি ওকে আইডিয়া দিয়েছিলাম এখানে বার্ড-ওয়াচিং-এর ট্যুরিস্টদের টোপ দিতে। কিন্তু চুমকির ভীষণই আপত্তি। ও বলে, আমার দুর্দান্ত সাহসী ঠাকুমা ঠাকুরদার সঙ্গে ঝগড়া হলে ওই হর্নেটস নেস্ট-এ এসে গোসাঘর নিয়ে থাকতেন। তাঁর নারায়ণ আসত এখানে, রাঁধুনি, আয়া, তেলমালিশ করার মেয়েটি। ঠাকুমা নাকি বলতেন যে, এটি হয় ভালোবাসার ঘর হয়ে থাকবে নয়তো গোসাঘর। এই দ্বীপকে নষ্ট করা চলবে না।
চুমকি আরও পয়সা দিয়ে করবেটাই বা কী? খাবে কে ওর পয়সা? দশ জীবনেও তো শেষ করতে পারবে না, যা আছে।
রংকিনী বলল।
পয়সার জন্যে শিল্পপতিরা নতুন নতুন আয়ের পথ খোঁজেন না। Lack of expansion means decay. সবসময়ে তুমি যদি তোমার সাম্রাজ্য বিস্তৃত করার চেষ্টাতে না থাকে, তবে সে-সাম্রাজ্য সংকুচিত হতে বাধ্য। সংকুচিত হতে হতে একদিন তা আর থাকবেই না। বাঙালিরা এই জিনিসটা বোঝে না। কিন্তু চুমকি বোঝে। আ গ্রেট গার্ল। শি ইজ রিমার্কেবল ফর হার এজ। আমি তো বিদেশেও অনেক মহিলা আম্রোপ্রানর দেখেছি। শি রিয়্যালি ইজ গ্রেট।
এই অবধি বলেই, হঠাৎ আহুক চেঁচিয়ে উঠলেন, নোড়ো না। একটুও রংকি। সিট স্টিল।
রংকিনী কিছুই না বুঝে চমকে উঠেই স্থির হয়ে গেল।
কিছু বোঝার আগেই গুড়ম করে একটা আওয়াজ হল। আর সঙ্গে সঙ্গে এক পালটি খেয়ে পড়ল বিরাট একটা হলদে-সবুজ সাপ। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা গুলি করলেন আহুক। তাঁর কোমরে যে, ওটা বেল্ট-এর সঙ্গে বাঁধা ছিল তা বুঝতেই পারেনি রংকিনী।
অনেকক্ষণ পরে শান্ত হল সাপটা। তার আগে লন্ডভন্ড করল পুরো জায়গাটাকে, লতা পাতা ঘাস মাটি সবের ওপরে যেন ঝড় বয়ে গেল। তখন যেন মনে পড়ল রংকিনীর যে, আহুক তাকে চেঁচিয়ে সাবধান করার আগে একটা জোর সড়সড় আওয়াজ শুনেছিল কিন্তু কীসের আওয়াজ তা বুঝতে পারেনি।
বুকে হাত ছুঁইয়ে রংকিনী বলল, বাবাঃ। আমার বুকে এখনও ধড়ফড় করছে। কী সাপ ওটা? বিষ ছিল?
বিষ ছিল মানে? শঙ্খচূড়। কামড়ালে ওয়েলার ঘোড়া মরে যায়, বনের বড়ো বাঘ মরে যায়। তার পর বললেন, ভীরাপ্পানটা খুব খুশি হবে।
কেন?
এই সাপটাকে ওর ভীষণই ভয় ছিল।
চেনা সাপ নাকি আপনাদের ভালো বন্ধু-বান্ধবী নিয়েই থাকেন দেখছি। প্রেমিকা মাছ, বন্ধু সাপ।
হ্যাঁ। তবে সাপটা বন্ধু ছিল না, শত্রু ছিল। ভীরাপ্পান বলে, এই সাপটাও আসলে একটা পেতনি। একটি অপরূপ সুন্দরী কুমারী থাই মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছিল নাকি এই দ্বীপে আরাকানি জলদস্যুদের দ্বারা। এই পাথরেরই ওপরে। এবং এখানেই সে নাকি মারা যায়। তারই আত্মা এই সাপটি।
এই সাপের তো তাহলে বয়েসের গাছ-পাথর নেই। তা ছাড়া ভীরাপ্পান তো আরাকানি নয়। বিশুদ্ধ বুলশিট। গগনভেদী গুল।
হাসতে হাসতে বলল, রংকিনী।
তার পর বলল, সাপটার বয়েস কত বছর? তিন-শো?
কে বলতে পারে? তার চেয়ে বেশিও হতে পারে। এ গল্প তো ভীরাপ্পান বানায়নি। একজন আন্দামানিকে নিয়ে এসেছিল তিন বছর আগে, পাখির বাসা সব যাতে তার কাছ থেকে চিনে নিতে পারে, সেজন্যে। এক বুড়ো ছিল ওখানে দিন পনেরো আমাদের উপদেষ্টা হিসেবে। থাকত ভীরাপ্পানের সঙ্গেই আর কষে শুঁটকি খেত। সেই বুড়োই বংশপরম্পরাতে এই কাহিনি শুনেছে। রূপকথার গায়ে বয়েসের মালিকানা লাগে না যে!
তাই?
ভীরাপ্পান এলে শুনো তুমি তার কাছেই।
সে আর এসেছে।
আসবে। আসবে। আর না এলেই বা কী?
বেশ লোক যা হোক আপনি।
ভালো লোক যে, তেমন দাবি তো করিনি কখনো। করেছি কি?
রংকিনী চুপ করে রইল।
এখন দেখো গাছগুলো, তখন যে, জিজ্ঞেস করছিলে।
হ্যাঁ।
আমাদের এই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে সবসুদ্ধ পায় দু-শো প্রজাতির গাছ আছে। তার মধ্যে চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশরকমের পরিচর্যা করা হয়। তারমধ্যে আবার উনত্রিশ-ত্রিশরকমের গাছ যা শিল্পে বা বাণিজ্যে লাগে। চুমকির এই ছোট্ট দ্য হর্নেটস নেস্ট,-এর মধ্যেই প্রায় পঞ্চাশরকম গাছ আছে। অভাবনীয়। তাই-না?
হবে। রংকিনী বলল। আমি তো আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে চাকরি করি না, বটানিস্টও নই। অত তত্ত্ব ও তথ্য দিয়ে আমি কী করব! মোটামুটি কটি গাছ চিনিয়ে দিন-না আমাকে।
এই মোটামুটি আর ভোটাভুটি সমার্থক। এই দুই শব্দই অর্থহীন। আশ্চর্য। আমরা ভারতীয়রাই এইরকম অপার ঔৎসুক্যহীন। একজন অশিক্ষিত ইংরেজ বা জার্মান পুলিশ বা মিলিটারির নীচুতলার অফিসারেরও তীব্র ঔৎসুক্য দেখেছি তার পরিবেশ ও প্রতিবেশের গাছগাছালি, পাখপাখালি এবং মানুষজনের সম্বন্ধে। অথচ তুমি একজন গড়পড়তা উচ্চশিক্ষিত ভারতীয়কে, (তিনি হয়তো নামি অর্থনীতিবিদ, বা দামি ইঞ্জিনিয়র বা প্রগাঢ় পন্ডিত ইতিহাসের অধ্যাপকও হতে পারেন অথবা অনেক পুরস্কার পাওয়া গুমোর-ভরা সাহিত্যিক) জিজ্ঞেস করে দেখো, এটা কী গাছ? সম্ভবত জবাব পাবে, গাছ। এটা কী পাখি? জবাব পাবে, পাখি। ছোটো কোনো নদী দেখিয়ে প্রশ্ন করো (সেই নদী হয়তো তিনি গড়ে দিনে দশ বার গাড়িতে বা হেঁটে পারাপার করছেন) কী নাম? জবাব পাবে, নদী। সবাই যে ওরকম তা বলছি না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, থাকে। নিজভূমে কিন্তু অধিকাংশই ওরকম। বুঝলে রংকিনী, ডিগ্রি আর শিক্ষা, পেশাগত যোগ্যতা আর সাধারণ জ্ঞান এসবের মধ্যে আমাদের দেশে কোনো সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া অনেক সময়েই কঠিন হয়।
হবে। তবে আপনি বড়ো জ্ঞান দেন। এখন বলুন, যা জানতে চেয়েছিলাম।
এখানে চিরহরিৎ গাছ আছে অনেক। আবার পর্ণমোচীও আছে।
পর্ণমোচীটা আবার কী জিনিস? কোনো বিশেষরকম মোচা? অথবা মুচি?
হায় ঈশ্বর! ডিসিডুয়াস বললে বুঝবে কি মেমসাহেব?
হ্যাঁ।
লজ্জার কথা। বাংলা শব্দটি জানো না, ইংরেজি বললে বোঝে।
তার পর বলুন। নো-জ্ঞান।
যে-গাছেরা প্রতিবছরই পাতা খসিয়ে মানে মোচন করে আবারও নতুন পাতা গজিয়ে নিয়ে নিজেদের নবীকৃত করে, তাদের বলে পর্ণমোচী। এখানে নারকোল, বা সেগুন গাছ কিন্তু মূলভূখন্ড থেকে এনে লাগানো। স্থানীয় নয়। স্থানীয় গাছের ভেতরে চিরহরিৎ প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে আগে যে-নাম দুটি করতে হয় তা প্যাডক আর গুর্জন-এর। ওই দেখো, ওইগুলো প্যাডক।
কত বয়েস হবে ওগুলোর?
তা আমার প্রপিতামহর চেয়ে বেশি বই কম তো নয়। আর ওই দেখো, ওইগুলো গুর্জন। এদিকে-ওদিকে ছড়ানো-ছিটানো। তবে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে চিরহরিৎ-এর চেয়ে পর্ণমোচীদের রবরবাই বেশি।
কী কী পর্ণমোচী গাছ আছে এখানে?
বাদাম। ওই যে, নীচের দিকে, দেখছ? ওই যে পাখিগুলো উড়ে গেল যে-গাছগুলোর উপর দিয়ে দল বেঁধে….
ওগুলো কী পাখি? পুঁটকে পুটকে পাখি। কালো পিঠ সাদা বুকের। ছেলেবেলায়, থুড়ি মেয়েবেলায়, আমাদের চন্দননগরের গঙ্গাপাড়ের বাড়ির কম্পাউণ্ডের মধ্যে মস্ত বড়ো নিম গাছের চারদিকে এইরকমই পাখির মস্ত মস্ত ঝাঁকেরা গ্রীষ্মের বিকেলে ঘুরে ঘুরে উড়ত আর ডাকত। মা বলতেন, দেখ দেখ চাতক পাখি। ওরা ডাকছে ফটিক জল! ফটিক জল!
বাঃ। আহুক বললেন।
তার পর বললেন যে-পাখিগুলোকে দেখলে তাদের নাম ইণ্ডিয়ান সুইফটলেট। ঘাস, শ্যাওলা পালক আর থুথু মিশিয়ে এরা তাদের বাসা বানায়। আরও একরকমের এডিবল নেস্টস বানানো পাখি দেখা যায় আন্দামানে তবে দ্য হর্নেটস নেস্ট-এ সে পাখি নেই। সেই অন্য পাখিরা বাসা-বাঁধে উঁচু পাহাড়ের গুহা বা গর্তে। এই হর্নেটস নেস্ট-এ যারা আছে তাদের নাম ইণ্ডিয়ান সুইফটলেট। অগণ্যই আছে। আকাশে যখন একসঙ্গে ওড়ে বগারি পাখির মতো, মনে হয় মেঘখন্ডই দমকা হাওয়াতে ভেসে যাচ্ছে বুঝি। এরা আবার কিছু নীড় বানায় শুধুই এদের লালা দিয়ে। যেগুলোর কদরই বেশি, খাবার হিসেবে, বিশেষ করে চিনেদের কাছে।
কখন বাসা বানায় এরা?
মার্চ থেকে জুন মাস অবধি। চার মাস থাকে বাসা। যেসব গাছে এরা বাসা বাঁধে, যে যে ফুল-ফল পাতা এরা খেতে ভালোবাসে, সেইসবের দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছি আমরা। যাতে ধীরে ধীরে দ্য হর্নেটস নেস্টকে আমরা দ্য সুইফটলেটস নেস্ট করে তুলতে পারি একদিন, এই পাখিদের কলোনি এবং অভয়ারণ্য হিসেবে।
সুইফট নামের পাখির কথা তো জানি। এদের নাম তো বললেন সুইফটলেট।
হ্যাঁ। Star আর Starlet এর মতোই swifft Let। তুমিই তো বললে, এরা পুঁচকে পুঁচকে।
হেসে ফেলল রংকিনী। বলল, বুঝলাম।
তার পর বলল, এটা কী গাছ?
ওটা বাদাম। তার মানে বাদাম ভাজার বাদাম নয়। Hardwood। আরও Hardwood আছে। দেখো, সাদা চুগলাস, টঙ্গপিন, লাল ধূপ, সমুদ্র-মওহা। আরও নানারকম হার্ডউড আছে তবে হর্নেটস নেস্ট-এ নেই।
মওহা মানে? মহুয়া?
তাই হবে। এখানে উচ্চারণ বদলে গেছে হয়তো। তবে ওই গাছ আমি নিজে দেখিনি।
দেখতে মহুয়ার মতো কি না তাও বলতে পারব না।
আর ওই দেখো, Softwood। সাদা ধূপ, বাকোটা, ডিডু। শিমুলের নাম এখানে ডিডু। পপিতা। আর ওই দেখো লম্বাপাত্তি। দারুণ দেখতে-না পাতাগুলো? উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে এইরকম গাছ আছে, হাতিরা তাদের পাতা ভালোবেসে খায়।
এখানে Ornamental wood-এর গাছও আছে কিন্তু।
কাঠও আবার Ornamental হয় নাকি?
হয়। হয়। মেমসাহেব, এখানে সবই হয়।
হয়? না হওয়ান আপনি?
না, না এরা সব এমনি হয়। আমি যা হওয়াই বা হওয়াব সেসব অন্য হওয়া।
বুঝেছি। তা চিনিয়ে দিন Ornamental wood গুলোকে। মানে গাছগুলোকে।
সবচেয়ে আনন্দের কথা হচ্ছে এই যে, এই দ্বীপটি ছোটো হলে কী হয় এখানে আন্দামানে যতরকম Ornamental wood দেখা যায় তার সবই আছে। এটা একটা দারুণ ব্যাপার তাই নয়?
বলেই আহুক বললেন, ওই দেখো উত্তরে, তাকাও ভালো করে, আমার আঙুল দেখো। দেখেছ, সুন্দর রুপোলি-ছাই-রঙা গাছটি। কান্ডর একাংশর রং। এদের নাম-ই Silver Grey। আমার মাছ-প্রেমিকা টুনা, টুনির মতো এর গায়ের রং। আর ওই পুবের ঢালে দেখো Satin Wood। আমার মাছ-প্রেমিকার তলপেটের মতো পেলব, মসৃণ। আর দক্ষিণে দেখো Marble Wood। আর ওই গাছটার নাম কী বলতে পারো? বলতে গেলে একেবারে তোমার মাথার ওপরে যে ছাতা ধরে আছে।
বাঃ রে! আমি কী করে বলব?
এর নাম চুল।
কী? আবারও গুল!
সত্যি বলছি। এটাও Ornamental গাছ। বিশ্বাস না হলে এর Botanical নামসুদ্ধু বলে দিতে পারি।
কী?
Sageraca Eliptics
এই অর্নামেন্টাল গাছগুলো বিক্রি করে তো আপনাদের খুব লাভ হয় তাই না?
রংকিনী বলল।
বিক্রি করলে অবশ্যই হত। শুধু এগুলোই বা কেন? প্যাডক, গুর্জন এবং অন্যান্য গাছের কাঠেরও দামও তো কিছু কম নয়। কলকাতাতে ফিরে যাওয়ার আগে চ্যাথাম আইল্যাণ্ডে গিয়ে দেখে নিয়ে সরকারি Sawmill। তবে সেখানে গাছেদের এই সুন্দর নয়নমোহন রূপ তো দেখতে পাবে না। সব উলঙ্গ, ধর্ষিতা তারা সেখানে। চিরে ফালাফালা করা। ওইজন্যে আমি এখানে পাঁচ বছর আসা সত্ত্বেও একবারও যাইনি চ্যাথাম আইল্যাণ্ডে। গাছেদের মর্গ-এ কি যেতে ইচ্ছে করে কারো? যারা প্রকৃতিকে ভালোবাসে?
বিক্রি করেন না আপনারা?
না:।
কেন?
চুমকির ঠাকুমা, দ্য হর্নেটস নেস্ট-এর ওরিজিনাল মালকিন-এর মানা ছিল! উনি যখন এই দ্বীপ কিনেছিলেন দেড় লাখ টাকাতে, উনিশ-শো বত্রিশ-এ তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ছাব্বিশ। বড়োলোকের মেয়ে, বড়লোকের বউ। যেমন বিদুষী, তেমন বিষয়বুদ্ধি সম্পন্না। তখন দেড় লাখ টাকার মূল্যও ছিল অনেক। ইনকাম ট্যাক্স ছিল না তো! মানুষ মনের সুখে ছিল।
ছিল না ইনকাম ট্যাক্স?
ছিল কোথায়? ইংরেজদের ইনকাম ট্যাক্স আইনত প্রথম আসে এদেশে উনিশ-শো তেত্রিশে।
তাই বুঝি? ইশ। তার আগে যদি জন্মাতাম।
আর উনি মারা গেছেন উনিশ-শো পঁচানব্বই-এর কালীপুজোর দিন। অষ্টআশি বছর বয়েসে। সধবা।
আহা ভাগ্যবতী মহিলা। সতীলক্ষ্মী।
কেন?
বা: দীপাবলীর দিনে গেলেন তো ভাগ্যবতী নন! আপনি দেখি কিসসুই জানেন না।
বাবা। এদিকে মেমসাহেব আর ওদিকে দেখি…।
তার পরেই আহুক বললেন, অশ্লেষা, মঘা এসবও মানো নাকি? খনার বচনও? নীলের উপোস করো?
তা করতে হয় বই কী মায়ের জন্য।
আচ্ছা প্যারাডক্স যা হোক তোমরা, এই নব্যযুগের মেয়েরা। ভাবা যায় না। দু-নৌকোয় পা তোমাদের।
তার পর? বলুন।
রংকিনী বলল।
তা চুমকির ঠাকুমা নাকি বলে গেছিলেন যে, নিজেদের প্রয়োজনে যেটুকু দরকার সেটুকু ছাড়া একটা গাছও কাটা চলবে না। লাগানো চলবে, কিন্তু কাটা চলবে না। ফলে দ্বীপটার অবস্থা দেখছ না? সবুজে-সবুজ ফুল-ফলন্ত, জঙ্গলমে-মঙ্গল, শান্তির নীড়। শুধু ডায়াস্কোরিয়ার জন্য যতটুকু জঙ্গল সাফাই করতে হয়েছে ব্যস। দ্য হর্নেটস নেস্ট-এর অবস্থা আমার দাড়িরই মতো।
মানে?
আমারও আয়না নেই, দ্য হর্নেটস নেস্ট-এরও আয়না নেই। নিজের নিজের চেহারা দেখতে পেলে দুজনে হাত ধরাধরি করে ডুবে মরতাম।
দুজনে মানে?
মানে এই জংলি আমি আর এই জংলা-দ্বীপ।
তাই বলুন।
এই ডায়াস্কোরিয়ার কথা তো আগে শুনিনি। আমার এক ডাক্তার বন্ধু আছে তার সঙ্গেও কদিন আগেই প্লেনে দেখা, সিঙ্গাপুরে যাচ্ছিল। অনেক গল্প হল। কোন কোন প্ল্যান্ট বা হার্ব থেকে কন্ট্রাসেপশানের জন্যে পিল তৈরি হয় তা বলছিল ও কিন্তু তারমধ্যে ডায়াস্কোরিয়া বলে কিছুর নাম তো সে উল্লেখ করল না।
সাম্প্রতিক অতীতে হয়তো আবিষ্কৃত হয়েছে। না হলে কলকাতার দেজ মেডিক্যাল, মুম্বাই-এর সিপলা বা চেন্নাই-এর প্যারিরাই বা নিতে রাজি হবে কেন?
তা নিক। ডায়াস্কোরিয়া বানানটা কী?
Dioscorea৷ উচ্চারণ ডিসকোরিয়াও হতে পারে। ডিকশনারিতে শব্দটা থাকলে উচ্চারণের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যেত।
ঠিক আছে। কলকাতা ফিরে ওকে একটা ফ্যাক্স পাঠাব বেঙ্গালুরুতে জানতে চেয়ে। কে জানে! এও হয়তো আপনার আর এক গুল।
.
১০.
দুপুরে আবার ঘনঘটা করে মেঘ সাজল। হাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ গুমোট। কিন্তু এই দ্বীপে গরম নেই।
আহুক কিচেনে রান্না করছিলেন। সত্যিই আশ্চর্য মানুষ। রংকিনীকে কিচেনে ঢুকতেই দিলেন না একবারও কাল থেকে। ইগুয়ানো-টিগুয়ানো যে মারেননি, ভালোই হয়েছে। ও খেতেও পারত না। বমি করেই দিত হয়তো। একবার সিঙ্গাপুরে এক ক্লায়েন্ট সবচেয়ে এক্সপেনসিভ রেস্তরাঁতে খাওয়াতে নিয়ে গিয়ে জ্যান্ত বাঁদরের ঘিলু খাইয়েছিল। চাকা লাগানো রুপোর একটি খাঁচাতে করে বাঁদরটাকে টেবল-এর পাশে নিয়ে এসে রুপোর হাতুড়ি দিয়ে তার মাথার খুলিটা টুক করে ফাটিয়ে তার পর তালুর একটি পাশ উঠিয়ে রুপোর চামচে করে ঘিলু তুলে একটি রেকাবিমতো রুপোর পাতে রাখল। আর তা খেতে হয়েছিল নিট কনিয়াক এর সঙ্গে। ফ্রেঞ্চ ভি. এস. ও. পি.।
মানুষের ধারণা যে, যেসব মেয়েরা চাকরি বা ব্যাবসা-বাণিজ্য করে তাদের একমাত্র বিপদ আসে বহুপুরোনো ও চিরচেনা একটিই সূত্র থেকে। কিন্তু মেয়েদের যে হাজার-রকম অন্য বিপদেও পড়তে হয় তা খুব কম মানুষেই জানেন। বাঁদরটা চিচি করছিল। এখনও মাঝে মাঝে সেই করুণ মৃত্যুচিৎকার যেন শুনতে পায় রংকিনী। একচামচ মুখে দিয়ে গিলে ফেলেই হাসি হাসি মুখে বাথরুমে গিয়ে বমি করেছিল।
খুবই ইম্পর্ট্যান্ট ক্লায়েন্ট। তাকে অসন্তুষ্ট তো করা যায় না।
আহুক রান্নাঘর থেকে বললেন, গন্ধটা কেমন ছেড়েছে বলো তো? কাঁকড়ার ঠ্যাং-এর চচ্চড়িও করব। আন্দামানি চালের ভাত দিয়ে কবজি ডুবিয়ে খাবে। কিন্তু তুমি রান্না কিছু না করতে পারো একটা বর্ষার গান তো করতে পারো।
ডিসেম্বরে বর্ষার গান?
আকাশের মেঘ বড়ো, না ক্যালেণ্ডার বড়ো? গাও-না!
আপনি গান জানেন?
না। তবে শুনতে খুব ভালোবাসি। যারা গান জানে তাদের ঈর্ষা করি। গীতবিতান-এর প্রত্যেকটি গানের বাণীই আমার মুখস্থ। কিন্তু বিধাতা গলাতে সুর দেননি। এ যে কী কষ্ট কী বলব।
আমি যা জানি তাকে গান জানা বলে না।
আগেকার দিনই ভালো ছিল।
আহুক বললেন।
কেন, একথা?
তখন প্রত্যেক কুমারী মেয়েকেই অন্তত গোটা ছয়েক গান শিখে রাখতেই হত, পাড়া প্রতিবেশী তাতে তিতি-বিরক্ত হলেও।
কেন?
বাঃ। বরপক্ষ মেয়ে দেখতে এলে, গান ওজ আ মাস্ট। বড়োলোক-গরিএলক শিক্ষিত অশিক্ষিত কারোরই ছাড় ছিল না। মেয়ে অথচ গান গাইতে জানে না, এ তো একেবারে অভাবনীয় ছিল সেই সময়ে। বড়োলোকের মেয়েরা অর্গান বাজিয়ে কাননবালা দেবীর স্টাইলে দু-বিনুনি ঝুলিয়ে ছোটোহাতা ব্লাউজ পরে গাইত ওই মালতীলতা দোলে, পিয়ালতরুর কোলে।
সফিস্টিকেটেড হলে, গাইত রবীন্দ্রনাথের পূজার গান অথবা ব্ৰহ্মসংগীত। নিম্নবিত্ত বা অল্প শিক্ষিত হলে, মেঝেতে মাদুর পেতে, কনে-দেখা আলোতে পাড়াতুতো বউদির সিঙ্গল-রিড এর, সিঙ্গল স্কেল-এর হারমোনিয়ম-এ হিমাংশু দত্তের ছিল চাঁদ মেঘের পারে-এ-এ-এ অথবা নজরুল-এর সখী জাগো, রজনী পোহায়, মলিন কামিনী ফুল, যামিনী গলায় গাইতে হত। নইলে বিয়েই হত না।
আমাদের তো বিয়ে এমনিতেই হয়নি। থুড়ি, আমরা বিয়ে করিনি। এখন দিন পালটে গেছে স্যার। এখন মেয়েপক্ষই ছেলে দেখতে যায়। ছেলে আপনার মতো ভালো রান্না করতে পারে কি না, ওয়েস্টার্ন ছবির নায়কের মতো মুহূর্তের মধ্যে কোমর থেকে পিস্তল পুল করে শঙ্খচূড়রূপী থাইল্যাণ্ডের পেতনির স্পর্ধিত মাথা ভূলুণ্ঠিত করতে পারে কি না, দুর্গম, বুক হিম করা সমুদ্রমেখলা নির্জন দ্বীপে এক অচেনা যুবতীর ঘুম নির্বিঘ্নে করতে পারে কি না, তাকে কিছুই না-পরে থাকার লজ্জা থেকে বাঁচাতে পারে কি না ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়। পাত্র রবীন্দ্রসংগীত জানে কি না, নাচ জানে কি না পাত্রীর সঙ্গে কলকাতার ওবেরয় গ্র্যাণ্ড-এর Pink Elephant বা তাজ বেঙ্গলের Incognito-তে সুছন্দে ব্রেক-ডান্স বা সুন্টুনি-মুন্টুনি খিচুং-পিচুং নাচ নাচতে পারে কি না, এসবেরও পরীক্ষা দিতে হয়। রবীন্দ্রসংগীত জানলেও সে-গান যেন পীযূষকান্তি সরকারের গানের মতো গিমিকসর্বস্ব, ঠমকময় বুকনি-বাটা গান না হয়, এতসব শর্ত পালন করতে হবে। আজকাল ছেলেদের বিয়ে হওয়া অত সোজা কথা নয়। ঘরে ঘরে অরক্ষণীয় ছেলে দেখা যায় আজকাল। The table is turned sir. পুরুষেরা অনেকদিন মেয়েদের হরেকরকম অপমান করে এসেছে। চুলটা খোলো তো মা, একটু হেঁটে দেখাও তো মা, দেখি, তুমি খোঁড়া কি না, কখনো-কখনো বুকেও হাত দিয়ে পরখ করেছে পাত্রর ট্যারা-পিসিমা বা খোনা-জেঠিমা, মেয়ের বুকটা সত্যি, নাকি ন্যাকড়ার পুঁটলি বা রাবারের দলা গোঁজা। কী অপমান! কী অপমান! ওই সমস্ত অপমানেরই শোধ তোলবার সময় এসেছে এখন। হাঃ হাঃ।
খুব জোরে হেসে উঠলেন আহুক। বললেন, তা তোলো শোধ। এত সুযোগ সত্ত্বেও আজ অবধি তুমি বা চুমকি বিয়ে করার মতো এমন একটা সোজা কাজও করে উঠতে পারলে না।
তার পরে বললেন, যাকগে। গাও তো এবারে একখানি গান।
রংকিনী বলল, ইচ্ছে করছে না এখন। রাতে শোনাব। লজ্জা করছে। গায়িকা তো নই! আমার মায়ের গানের খাতাতে এক রসিক ভদ্রলোক লিখে দিয়েছিলেন লজ্জা নারীর ভূষণ অবশ্যই কিন্তু গানের বেলা নহে। তবে সেসব লজ্জাশীলা নারী, সেই যুগের নারী।
বলেই, আবারও হেসে উঠলেন আহুক।
রংকিনী বলল, বাঃ। কিন্তু আজকালকার আমরা কি নির্লজ্জ?
জানো ম্যাডাম, দ্য হর্নেটস নেস্ট-এর এই পর্ণকুটিরে একটিও আয়না যে কেন রাখিনি তা ভেবে সত্যিই আপশোস হচ্ছে।
কেন?
তোমাকে এই পোশাকে কেমন যে লাগছে, তা তুমি নিজে তো দেখতে পারলে না। ভীরাপ্পানটা যদি আজও না আসে তবে সে মুখপোড়াও এই বিনি পয়সার অদ্ভুত দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হবে।
রংকিনী হাসল। বলল, আয়না থাকলে, আমার অস্বস্তিটা পরিপূর্ণ হত। তাই তো এত উৎসাহ? আয়না না থাকায় অসুবিধে হচ্ছিল অবশ্যই কিন্তু এখন মনে করছি, আয়না না থাকাতে বেঁচেই গেছি।
রংকিনী দ্বীপ ঘুরে ঘেমেনেয়ে ফিরে এসে চানঘরে চান করার সময়ে আণ্ডারগার্মেন্টস এবং সালোয়ার-কামিজ সব আহুক-এর দেওয়া গুঁড়ো সাবান দিয়ে কেচে একটু দূরের একটি ঝাঁকড়া গাছের আড়ালের নাম-না-জানা ঝোঁপ-এর ওপরে মেলে দিয়েছে, যাতে রোদ পড়ে, এমন জায়গা দেখে। এখন মেঘ সরলে বাঁচে। পুরুষদের চোখের সামনে অন্তর্বাস শুকোতে দিতে বড়ো লজ্জা করে। কে জানে কেন! এখনও এসব সংস্কারমুক্ত কেন যে হতে পারেনি। তাদের আণ্ডারওয়ার, লাল-নীল ল্যাঙ্গোট, চেক-চেক লুঙ্গি, বুক-কাটা গেঞ্জি এসব মেয়েদের চোখের সামনে শুকোতে দিতে পুরুষদের লজ্জা না করলে ওদেরই বা অন্তর্বাস শুকোতে দিতে লজ্জা করবে কেন?
আহুক-এর একটি টাইট সাদা টেরিকট-এর শর্টস রংকিনীর বারমুডা হয়ে গেছে। ফ্রেড পেরির একটা সবুজ-রঙা গেঞ্জিও অভাবনীয়ভাবে ফিট করে গেছে। যদিও লম্বাতে প্রায় হাঁটু ছুঁই-ছুঁই। ভাগ্যিস একজন ছিপছিপে কিন্তু ভালো ফিগারের মেয়ের বুকের মাপ আর স্বাস্থ্যবান পুরুষের বুকের মাপ একই হয়!
দুটি পায়ে গলিয়েছে আহুকেরই একজোড়া বাথরুম স্লিপার। সবুজ-রঙা। যদিও পেছনটা তার গোড়ালি থেকে দু-ইঞ্চি বেরিয়ে আছে, পা ফেললেই ফট-ফট শব্দ হচ্ছে। তবু, আহুক প্রথমে যেরকম ঘাবড়ে দিয়েছিলেন কিছুই না পরে থাকতে হবে বলে, সেই আতঙ্ক যে কাটিয়ে উঠেছে এই ঢের।
সত্যি! ভারি চমৎকার, অসাধারণ একজন মানুষ এই আহুক বোস। বয়েসটা যদি একটু কম হত তবে..কী ভালোই না হত। তবে আহুক বোস খেলুড়ে পুরুষ। আজ রাতে সমুদ্রস্নানে যেতে রাজি হয়েছে রংকিনী। সেখানে বেলাভূমি, এই গা-ছমছম আদিগন্ত নির্জনতা, মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি-খেলা ভূতুড়ে চাঁদ আর চারধারের পাহাড় থেকে ঝুঁকে-পড়া জঙ্গল এবং বড়ো বাঘের মতো অপ্রতিরোধ্য, ভালোলাগার মতো পুরুষ আহুক বোস।
এইসব উপাদান মিলে যে রংকিনীর শরীর-মনে কী রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটাবে সে সম্বন্ধে সে নিজে আদৌ নিশ্চিত নয়। একটা অনুভূত প্রচ্ছন্ন আনন্দ ভারতীয় মূলভূখন্ডর রোমশ উষ্ণ গরম কাঠবিড়ালির মতো এবং এই দ্বীপের অদেখা ইগুয়ানোরই মতো এক অননুভূত ঠাণ্ডায় ঘিনঘিনে ভয়ও মাঝে মাঝেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে। টেনশান হচ্ছে, টেনশান। মনে মনে প্রার্থনা করছে, আজ যেন দিনটি না ফুরোয়। আর প্রার্থনা করছে, সেই ঝাঁকড়া-চুলের শুঁটকি-মাছ খেকো নারীবিদ্বেষী ভীরাপ্পান নামক অদেখা মানুষটি যেন সন্ধে নামার আগেই ফিরে আসে দ্য হর্নেটস নেস্ট-এ, দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে।
কী হল গান-এর?
আহুক আবার বললেন, কিচেন থেকে।
তার পরেই বললেন, তুমি ঝাল খাও তো?
খাই। আমরা তো বাঙাল। বদ্যি। দেখছেন না, সেনগুপ্ত?
বদ্যি তো কী হল?
আরে পূর্ববঙ্গ ছাড়া বদ্যি আর কোথাওই তো ছিল না। এখন না হয় উদবাস্তু হয়ে সারাপৃথিবীতেই ছড়িয়ে গেছি আমরা।
তাই? জানতাম না তো। তবে জানতাম যে, বদ্যিরা খুব মেধাবী হন পড়াশুনোয় এবং অধিকাংশই দেখতে ভালো হন না। বিশেষ করে, মেয়েরা। তবে সুন্দর হলে তারা হয় সুচিত্রা সেন, নয় অপর্ণা সেন, নয় রংকিনী সেনগুপ্ত।
কেন লেগপুল করছেন মিছিমিছি। এখানে আয়না নেই বলে কি, আমি জানি না আমি কেমন দেখতে?
তোমার বাবা কী করেন? তাঁর নাম কী?
আমার বাবা নেই।
সে কী! তুমি কি কনিষ্ঠ সন্তান?
না। আমি বড়ো।
কম বয়েসেই গেছেন?
হ্যাঁ। তবে খুব অল্প বয়েসে নয়।
কী করতেন তোমার বাবা?
বলবার মতো তেমন কিছু নয়। হি ওয়াজ নট ওয়েল-অফ ইদার। বোহেমিয়ান ছিলেন। লেগে থেকে কিছু করা তাঁর চরিত্রে ছিল না। তবে, করতেন অনেক কিছুই। লিখতেন, গান গাইতেন, ছবি আঁকতেন। এসব করে সামান্যই টাকা পেতেন। আমাদের সংসার চালাতেন মা-ই। বলতে পারেন উই আর আ সর্ট অফ আ ম্যাট্রিয়ার্কল ফ্যামিলি। বাংলাতে যেন কী বলে?
মাতৃতান্ত্রিক পরিবার।
কী করতেন, মা?
অধ্যাপনা করতেন তিনি। এখনও করেন।
তোমার বাবার নাম বললে না?
অসমঞ্জ রায়।
কী বললে? উত্তেজিত হয়ে বললেন আহুক।
তার পরই স্বগতোক্তি করলেন, ও, না না। তিনি তো সেনগুপ্ত ছিলেন না।
আমরা সেনগুপ্তই কিন্তু বাবা আমাদের জমিদারির খেতাব রায়ই লিখতেন। ঠাকুরদারই মতো।
কোথাকার জমিদার ছিলে তোমরা?
ছাড়ুন তো! জমিদার না জমাদার তা কে জানে! থাকলে-না প্রমাণ দিতে পারতাম।
তার মানে, তার মানে… বলতে বলতে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলেন। চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, আরে আমি তো তোমার বাবার একজন আর্ডেন্ট অ্যাডমায়ারার। হি ওয়াজ আ গ্রেট ম্যান। আ ভারসেটাইল জিনিয়াস।
তাই?
অবিশ্বাসের গলাতে বলল, রংকিনী।
তার পরই বলল, কাঁকড়াটা খারাপ হয়ে যাবে, সম্ভবত প্রসঙ্গ বদলাবার জন্যেই।
একটুক্ষণ অবাক চোখে রংকিনীর চোখে চেয়ে থেকে আহুক আবার কিচেনে চলে গেলেন। গিয়েই, কিচেন থেকেই আহুক আবৃত্তি করলেন :
সামান্য যে ছোট্ট সাদা পাখি
তারও আছে মনের মানুষ কোনো,
তারও আছে ফাগুন দিনের ঘর,
আর তোমার?
তোমার শুধুই অনন্ত যৌবন,
তোমার শুধুই অন্তত যন্ত্রণা
লক্ষ হাতে বৃথাই খুঁজে মরা।
আপন হবে, এমন নেইকো কেউ
ফোঁসফোসানি সাঙ্গ করে তটে
নেতিয়ে পড়ে সাপের মতো ঢেউ।
শোনো শোনো, নীল বারিধি শোনো
দিকদিগন্তে মেলে সুনীল কান,
সুখী যারা, তারা সবাই ছোটো,
আমার মতো মানুষ,
কিংবা পাখি।
কবিতার নাম সমুদ্রকে।
বাঃ বাঃ। আপনি দেখছি ভারসেটাইল জিনিয়াস। কবিতাও লিখতে পারেন, কাঁকড়াও রান্না করতে পারেন, ডায়াস্কোরিয়ার চাষ করেন এবং পাখির নীড়ও রপ্তানি করেন, সত্যি!
কবিতাটা তোমার বাবার লেখা।
তাই? মুখস্থ করে রেখেছেন আপনি?
কী করব? যাদের মুখস্থ করার কথা ছিল, তারা যখন করল না তখন…
বলেই, আবার আবৃত্তি করলেন আহুক তাঁর প্রিয় কবিতাটি। তার আগে বললেন, কবিতার নাম আছে।
আছে। আছে। আছে।
সবই আছে।
ঝিনুকের বুকের ভিতরে মুক্তোর মতন,
জীবনের প্রথম সংগমের সুখস্মৃতির মতন,
আমার নবতম প্রেমিকার ফুটি-না-ফুটি।
ফুলগন্ধি প্রেমেরই মতন,
স্বপ্নে দেখা তার ফলসাবরণ শাড়ির মতন,
অদেখা তার আগুন-পারা নগ্নতার মতন
সবই আছে।
বনে, বালুতটে, স্থলে,
আছে মৎসগন্ধি জলে, মাছে,
আছে, আছে, আছে।
সবই আছে।
বাঃ। এটি যে আপনি একেবারে দ্য হর্নেটস নেস্ট-এ বসেই লিখেছেন তা বোঝা যায়। চমৎকার।
রংকিনী বলল।
এটাও তো তোমার বাবারই কবিতা। তিনি তো এই দ্বীপে কখনো আসেননি। অসমঞ্জ রায়ের মূল্যায়ন এই টাকা-সর্বস্ব, কম্পিউটার-সর্বস্ব, স্বার্থ-সর্বস্ব পৃথিবী করবে কী করে! এই পৃথিবী কি মির্জা গালিবেরই যথার্থ মূল্যায়ন করতে পেরেছিল? তাঁর জীবদ্দশাতে? কাব্য সাহিত্য-শিল্পের বিচার কোনো দিনই তাৎক্ষণিক নয়। এসবের বিচারক মহাকাল। সময়কে সময় দিতে হবে বই কী।
রংকিনী কোনো মন্তব্য করল না।
বাবাঃ। কী মেঘ করেছে! এ যে একেবারে অন্ধকার করে এল। দিন না রাত বোঝারই উপায় নেই।
রংকিনী জানালা দিয়ে সমুদ্র আর আকাশের দিকে চেয়ে বলল।
কোথায়?
বলে, আহুক কিচেন ছেড়ে পেছনের বারান্দায় বেরিয়ে দেখে বললেন, তাতে কী?
দ্য হর্নেটস নেস্ট-এর রাতকেও যে রাত বলে বোঝা যায় না এখন চাঁদের আলোতে। এখানের রাতে-দিনে ভেদ নেই।
কী ভয়ানক-দর্শন মেঘ রে বাবা। টর্নাডো বা সাইক্লোন-টাইক্লোন হবে না তো?
না। এই মেঘপুঞ্জর নাম Cumulo-nimbus.
মানে? মেঘের আবার নাম হয় নাকি?
হয় না? কালিদাস-এর মেঘদূত-এ বিরহী যখন তার প্রিয়ার খোঁজ করতে মেঘপুঞ্জকে পাঠাতেন তখন কি মেঘের নাম জানতেন না? কুরিয়ার-এর নাম না জেনে কেউ কি চিঠি পাঠায়?
অনেকরকমের মেঘ হয় বুঝি?
নিশ্চয়ই হয়। তবে আমি তো আবহাওয়াবিদ নই, প্লেনের পাইলটও নই, তাই আমি আর কতটুকু জানি? তবে কিছু কিছু নাম অবশ্যই জানি। যেমন Nimbus এক ধরনের মেঘের নাম। সেই মেঘই যখন পুঞ্জীভূত হয় তখন তাদের বলে Cumulo-nimbus. নীচে ঘন কালো মেঘপুঞ্জ থাকে। ওপরে সাদা। আবার পাতলা পাতলা পেঁজা-তুলোর মতো ঊর্ধ্বমুখী সাদা মেঘকে বলে Cirrus। তাদেরই যখন আবার ছানার ডালনার কাটা-ছানার মতো ছাড়া ছাড়া দেখায় তখন তাদের বলে Cirrocumulos। যখন সমান্তরাল গড়নে দেখা যায় তখন তাদের নাম হয়ে যায় Cirro-stratus। বুঝলে তো? Strata থেকে Stratus। Stratus-এরও নীচের দিকে জলবাহী কালো মেঘ থাকে আর ওপরে সাদা। Strato যখন পুঞ্জীভূত হয় তখন তা হয়ে যায় Cumulus Strato Cumulus। খুব কালো যখন দেখায় Stratus-কে তখন তাদের বলে Alto-stratus Stratus থাকে সবচেয়ে নীচে, ধরো, পনেরো-শো ষোলো-শো ফিট। তার ওপরে ছ-হাজার ফিট অবধি দেখা যায় অন্যদের। হাজার থেকে প্রায় কুড়ি হাজার ফিট of cash ato Alto-cumulos, Cumulo-nimbus, Alto-stratus 97 Cirro-stratus-6751 তারও ওপরে উঠলে চল্লিশ হাজার ফিট অবধি দেখা যায় Cirrus আর Cirrocumulus দের। চল্লিশ হাজার ফিটের ওপরে, দিনের বেলা হয়তো দেখে থাকবে অনেক সময়ে জেট প্লেনের জানালা দিয়ে বহুরঙা, রামধনুর মতো স্বপ্নময় কিন্তু সমান্তরাল মেঘপুঞ্জ-তাদের নাম Iridiscent Clouds।
বাবাঃ। আপনি কি পাইলট ছিলেন নাকি?
ছিলাম কী? এখনও আছি। তবে প্লেন কখনো চালাইনি। আমি মেঘের উড়োজাহাজ চালাই। কল্পনাতে।
বাঃ। রংকিনী বলল। অ্যাডমায়ারিং চোখে।
আফ্রিকাতে যখন পেশাদার শিকারির কাজ করতাম, সুয়েড, অস্ট্রেলিয়ান, অ্যামেরিকান, কানাডিয়ান, সুইস সব শিকারিদের নিয়ে সাফারিতে যেতাম, তখন রাতের বেলা তাঁবুর বাইরে ক্যাম্প ফায়ারের সামনে বসে মেঘনবিশ হয়ে উঠেছিলাম নানা বই নেড়েচেড়ে।
বৃষ্টি হত না?।
না:। অধিকাংশ সাফারিই তো হতে জুলাই-এ।
সে কী! জুলাইয়ে বৃষ্টি হবে না তো কোন সময়ে হবে?
আহুক হেসে ফেললেন। বললেন, বিদুষী, সুন্দরী নারী, এই পৃথিবীটা মস্ত বড়ো। জুলাইতে ভারতে বর্ষার ঘনঘটা থাকে অবশ্যই কিন্তু আফ্রিকার, বিশেষ করে পুব আফ্রিকার কেনিয়া ও তানজানিয়ার সেরেঙ্গেটি, গোরোউগোরো, ওইসব অঞ্চলে জুন-জুলাই মাসই শীতকাল। আকাশ নির্মেঘ থাকে তখন, সুনীলও। রাতে কনকনে ঠাণ্ডা। দিনে প্লেজেন্ট।
সত্যি। আপনার সঙ্গে দিনকয়েক থাকতে পারলে কত বিষয়ে যে, বিশারদ হয়ে যাব। ভাবা যায় না।
কে বলতে পারে! গুল-বাঘও হতে পারো।
বলেই বললেন, যাই। কাঁকড়ার ঠ্যাংগুলো কাঁদছে, তাদের সুশ্রুষা করি গিয়ে। খারাপ হলে তো তুমি আবার আমার মালকিন-এর কাছে বদনাম করবে আমার।
হেসে উঠল রংকিনী।
তার পর বলল, মেগাপড পাখিদের সম্বন্ধে বলতে গিয়েও তো পুরো বললেন না। ওদের সম্বন্ধে আর কী জানেন বলুন-না। কলকাতাতে গিয়ে ভাইকে জ্ঞান দেব।
ও তাহলে তুমিও জ্ঞান দাও।
তার পর বললেন, মেগাপডদের কী বিশেষত্ব জান? তারা ডিমে তা দিতে বসে না। এমন সব পাতা-পুতা, উদ্ভিদ, বালির ওপরে ডিম পাড়ে যে, এইসব জিনিসের উষ্ণতাতেই ইনকিউবেশন হয়ে যায়। ডিম ফোটে। আর অকালপক্ক বাচ্চারা ডিম ফুটেই স্বাবলম্বী হয়ে হিজ-হিজ হুজ-হুঁজ জিম্মাদারি নিয়ে পৃথিবী দেখতে বেরিয়ে পড়ে।
তার পর বললেন, তুমি রয়্যাল আলবাট্রস পাখির নাম শুনেছ তো? রয়্যাল আলবাট্রসের ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোনোর পরে সেইসব রাজকীয় বাচ্চারা সব ন্যাকা-খোকা ন্যাকাখুকু হয়ে থাকে আট মাসেরও ওপরে। তার পরে তারা স্বাবলম্বী হয়ে মায়ের আঁচল ছাড়ে। এই পৃথিবী যে শুধুই বিরাট তাই নয় রংকিনী, তুমি কি জানো, এই পৃথিবী কী বিচিত্র, ঈশ্বরের কী আশ্চর্য সৃষ্টি। অগণ্য এই গাছ-গাছালি, পাখপাখালি, পোকামাকড়, জীবজন্তু, জলচর, স্থলচর, আবার ইগুয়ানোনার মতো উভচর? এই পৃথিবী, এই ব্রহ্মান্ড।
এ বাবা! আপনি আবার ঈশ্বর-ফিশ্বরে বিশ্বাস করেন নাকি? এ কী প্রি-হিস্টরিক মানুষ আপনি!
করি। গভীরভাবে করি। ঈশ্বরবোধ ব্যাপারটা একজন মানুষের ভেতরে আসতে অনেক গভীরতা, অনেক জন্মের পুণ্য লাগে রংকিনী। তুমি হয়তো গতজন্মে তেলাপোকা বা কাঁকড়া ছিলে। বা, ইগুয়ানো। তার পরের জন্মেই কোনো দৈবদুর্বিপাকে মানুষ হয়ে জন্মালে তো তোমার মধ্যে ঈশ্বরবোধ জন্মাতে পারে না। ঈশ্বরবোধ এই কারণেই সকলের মধ্যে থাকে না। ধৈর্য ধরতে হবে। যখন আসার, যদি আসে, তখন ঠিকই আসবে। তবে কত জন্ম পরে, তা কে জানে!
কী জানি বাবা। এই বিজ্ঞানের যুগে কী করে একজন শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মানুষ এমন ঈশ্বর ঈশ্বর করেন ভাবা যায় না।
অন্য কথা ভাবো। তা ছাড়া, আমি বুদ্ধিজীবী নই, দুর্বুদ্ধিজীবী। তোমাকে একটা কথা বলি। নিরীশ্বরবাদী হওয়ার মধ্যে সপ্রতিভ আছে, তা অবশ্যই ফ্যাশনেবলও বটে, বিজ্ঞান-বিশ্বাসী হতেও অসুবিধে দেখি না। কিন্তু বিজ্ঞানের সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো বিরোধ নেই। আমি মূর্তিপুজোর কথা বলছি না। যদিও তারমধ্যে দোষেরও কিছু দেখি না। তুমি বিবেকানন্দ পড়েছ কি? পড়ে দেখো। আমি কী বলছি, তা তখন বুঝতে পারবে। আইনস্টাইন, পাকিস্তানের নোবেল প্রাইজ পাওয়া পদার্থবিদ কালাম সাহেব, ওয়াল্ট হুইটম্যান, লিও টলস্টয়, রবীন্দ্রনাথ, সকলেই ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন। আমি তো তাঁদের চেয়ে অনেকই নিকৃষ্ট। ঈশ্বরকে মানার মধ্যে, স্বীকার করার মধ্যে কোনো লজ্জা বা অগৌরব নেই। বরং অস্বীকার করার মধ্যেই আছে। বিজ্ঞান আজ অবধি কিছুমাত্র উদ্ভাবন করেনি, শুধু আবিষ্কারই করেছে মাত্র। অনেক কিছুই আবিষ্কার করেছে। এই অতিমাত্রায় বিজ্ঞান-বিশ্বাসী মানুষেরাই একদিন পৃথিবীর সর্বনাশ ডেকে আনবে। ফ্যাশানেবল, এবং আপাত-সপ্রতিভ হওয়ার চেয়েও সত্য এবং শাশ্বতকে স্বীকার করতে অনেকই বেশি সাহসী হতে হয়। ব্যতিক্রম হওয়ার চেষ্টা করাটাই কি ভালো নয় জীবনে? সহজে সাধারণ নিয়ম হয়ে ওঠার চেয়ে?
রংকিনী চুপ করেই রইল। বাইরে চেয়ে রইল। আকাশের ঘনঘটা পরিপূর্ণ হল। ঘন কালো বেনারসি পরেছে আকাশ। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ তাতে চকিতে রুপোলি জরির পাড় বসিয়ে দিচ্ছে, আর গলাতে ওড়িশি ফেলিগ্রি কাজের রুপোর গয়না পরিয়ে দিয়েই খুলে নিচ্ছে পরমুহূর্তে। এমন সময়ে হঠাৎ-ই পুব দিক থেকে একটা জোর হাওয়া উঠল।
আহুক বলল, পুব হাওয়াতে দেয় দোলা মরিমরি।
বলেই বললেন, জানো গানটা? জানলে গাও-না রংকিনী। তোমার একজন এমন অনুরাগীকে এমন পরিবেশে এই দ্য হর্নেটস নেস্ট-এ বসে গান শোনাবার সুযোগ হয়তো আর আসবে না। জীবনে কোন সুযোগটি, কোন মানুষটি, কখন যে কোন মানুষের দুয়ারে এসে করাঘাত করে তা আমরা বুঝতে পারি না বলেই সারাজীবন হাহাকার করে মরি। যা পড়ে-পাওয়া, তা পড়ে-পাওয়া বলেই তাকে হেলা করতে নেই। যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়ে দেখো তাই, মিলিলে মিলিতে পারে অমূল্য রতন পড়োনি কি? গাও গাও, যদি গানটি জানো, তবে গাও। এই পুবালি হাওয়াতে এই কিউমুলাস-নিম্বাস মেঘের স্থূপ এখুনি উড়ে যাবে, আজ জ্যোৎস্নারাতেই আমরা সমুদ্রে নাইব মনে হচ্ছে। এইরকমই ইচ্ছা ঈশ্বরের। গাও, প্লিজ।
রংকিনীর মধ্যে থেকে হঠাৎ-ই কে যেন নিরুচ্চারে বলে উঠল, গাও, গাও, কিন্তু গাইবার সময়ে ও, অন্য গান ধরল :
আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে
তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণ গগনতলে।
সেদিন যে রাগিণী গেছে থেমে,
অতল বিরহে নেমে গেছে থেমে,
আজি পূবের হাওয়ায় হাওয়ায় হায় হায় হায় রে কাঁ
পন ভেসে চলে।
আহুক কিচেন থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। গায়ের গাঢ় হলুদ-রঙা রান্না করার অ্যাপ্রনের কোনাগুলি হাওয়াতে উড়ছিল। কাঁচা-পাকা দাড়ি, ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা পেছনের চুল এলমেলো হচ্ছিল। এই গান, এই সমুদ্র, এই আকাশ, এই মেঘ, এই পাখি-দ্বীপ সব কিছুকেই যেন আহুক একইসঙ্গে এক নীরব অদৃশ্য মন্থনে তার হৃদয়ে টেনে নিতে চাইছিলেন –হাওয়ায়-খসা ফুল-পাতা, হরজাই-গাছ থেকে আমচকা খসে-যাওয়া মিশ্র গন্ধ, নানা পাখির কিচির-মিচির, ফুট-অস্ফুট আওয়াজ, এসবে তিনি যেন পুরোপুরি আবিষ্ট হয়ে গেছেন।
রংকিনী ভাবছিল, পেছন-ফেরা মানুষটার দিকে চেয়ে এখানে বছরের পর বছর একা থেকেও এত ভালোলাগা-ভালোবাসা বেঁচে আছে প্রকৃতির প্রতি, পরিবেশের প্রতি মানুষটার। আশ্চর্য! পরমুহূর্তেই ভাবল, এই গভীর ভালোবাসা তাঁর বুকে না থাকলে কি এমন আনন্দে এই নিভৃত ভয়াবহ নির্জনতাতে তিনি এত দীর্ঘদিন আদৌ থাকতে পারতেন? তার পর ভাবল, কে জানে! মানুষটা হয়তো কোনো খুন-টুন করেছেন। স্মাগলার-টাগলার, নয় ফেরারি আসামি। সেলুলার জেল থেকেই পালানো নয়তো? জেলখানা থেকে না হলেও হয়তো পালাতে চাইছেন কোনো মানুষের কাছ থেকে, কোনো বিশেষ কোলাহলের জীবন থেকে। অথবা কে জানে! হয়তো নিজেরই কাছ থেকে। নইলে কী করে সম্ভব হয় এমন করে থাকা?, খবরের কাগজ, না রেডিয়ো, না টিভি, না বিজলি আলো এমনকী না সৌরশক্তি। মানুষটা হয় কোনো মেন্টলকেস, নয় দেবতা। ভূতও হতে পারেন। তা হওয়ার সম্ভাবনাই হয়তো বেশি। সে-কথা মনে হতেই ওই কালো-করা আকাশ আর ঢেউ-লাগা সমুদ্রের দিকে চেয়ে ভীষণই ভয় করতে লাগল রংকিনীর।
আহুক বললেন, আমার ফরমায়েশি গানটা শোনালে না আমাকে?
শোনাচ্ছি, শোনাচ্ছি, বলল, রংকিনী। যেন ভূতের হাতের থাপ্পড় খাওয়া থেকে পরিত্রাণ পাওয়ারই জন্যে।
বলেই, ধরে দিল গানটি। কিন্তু ধরল সঞ্চারী থেকে। কেন জানে না।
ব্যথা আমার কুল মানে না, বাধা মানে না।
পরান আমার ঘুম জানে না, জাগা জানে না।
মিলবে যে আজ অকূল পানে, তোমার গানে আমার গানে
ভেসে যাবে রসের বানে আজ বিভাবরী।
পূব হাওয়াতে দেয় দোলা, মরি মরি…
আহুক একবার রংকিনীর দিকে একটা রহস্যময়, চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার কিচেনে ঢুকে গেলেন।
রংকিনীর ভীষণই ভয় করতে লাগল। কে জানে, কী হবে আজ রাতে! মিথ্যে বলবে না, কিছু যে হবে, হতে পারে- একথা ভেবে ভয় যেমন হচ্ছিল, একটা আনন্দময় চাপা উত্তেজনাও বোধ করছিল ও ভেতরে ভেতরে।
.
১১.
ওরা পাকদন্ডী পথে বাংলো থেকে নামছিল সমুদ্রতটের দিকে। এই পথ দিয়ে গতকাল ও জেটি থেকে উঠে আসেনি বা দ্বীপটি ঘুরে দেখার সময়ও এ-পথে যায়নি। এটি একেবারে অন্য পথ। শুধুই তটে যাওয়ার। তটে চান করার জন্যে আর সান এবং মুন বেদিং করার জন্যে।
আহুক বলছিলেন।
ঘুরে ঘুরে নেমেছে পথটা গুর্জন গাছের ছায়ায় ছায়ায়। একটা গাছ দেখিয়ে আহুক বললেন, দেখো, এটা বাকোটা গাছ। আর এটা বাদাম। আর ওটা কোকো। এসবই হার্ডউড। আর একটু নামলেই, সমুদ্রতটের থেকে বেশ কিছুটা ওপরে দেখবে শুধুই সিলভার-গ্রে গাছ। কান্ডর অনেকখানি সিলভার গ্রে। চাঁদ উঠলে দেখবে, এই বনের শোভা। বিশেষ করে পূর্ণিমার দিনে।
পূর্ণিমা কবে?
আর ঠিক সাত দিন পরে।
তার পর দিনই সকালে আমি চলে যাব এখান থেকে।
হ্যাঁ তার পর থেকে আর চাঁদ উঠবে না দ্য হর্টেস নেস্ট-এ।
তার পর স্বগতোক্তির মতোই আহুক বললেন, এই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ কি একবারে এসে ভালো করে দেখা যায়? আমাদের এই ছোট্ট দ্বীপটিকেই এত বছরে রাত-দিন থেকে তবুও পুরো জানলাম না। প্রকৃতির রহস্য বড়ো গভীর রহস্য। এরমধ্যেই কিন্তু আমাদের জীবনের এবং হয়তো মৃত্যুরও সব রহস্য। সব কিছুর রহস্য। প্রকৃতিই যে আমাদের ভূত-ভবিষ্যৎ। এরমধ্যে থেকেই আমাদের গান, আমাদের দর্শন, আমাদের অধ্যাত্মবাদ সব কিছুই উদ্ভূত। জানো তো রংকিনী, এই দ্বীপপুঞ্জে পাঁচ-শোর বেশি দ্বীপ এবং দ্বীপাণু আছে তারমধ্যে মাত্র উনচল্লিশটি দ্বীপেই শুধু মানুষের বসবাস। দ্য হর্নেটস নেস্ট কিন্তু উনচল্লিশটির মধ্যে পড়ে না। কোনো ম্যাপেও পাবে না একে। মাত্র দুজন বনমানুষ যদি কোনো দ্বীপে বাস করে তবে তাকে Inhabitated বলবে না তো কেউই। একবার চলে এসো বছরখানেকের জন্যে। তখন আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে পারবে এই দ্বীপকে, খুঁজতে পারবে নিজেকে।
বছরখানেকের জন্যে? আপনি কি পাগল?
কেন? ছুটি জমিয়ে বা চাকরি ছেড়ে দিয়েও চলে আসতে পারো। তুমি যদি আসবে বলে কথা দাও, তবে আমিও চুমকির চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্য একটি আনচার্টেড দ্বীপে গিয়ে আস্তানা গাড়ব। সেখানে ভীরাপ্পানও থাকবে না। থাকব শুধু আমি আর তুমি।
তাই? ইশ। ভাবতেই কী ভালো লাগছে।
গলায় শিহর তুলে বলল রংকিনী।
তার পর বলল, আজ দুপুরে যেমন কাঁকড়া রান্না করে খাওয়ালেন তেমন কাঁকড়া খাওয়াবেন তো?
নিশ্চয়ই। আর কি শুধুই কাঁকড়া? সুরমেই, ম্যাকারেল, টুনা মাছ। বাগদা আর গলদা চিংড়ি এবং অক্টোপাসও খাওয়াব। খাওয়াব ইগুয়ানো, আর ফল-খাওয়া স্বাদু বাদুড়ের রোস্ট। সামুদ্রিক সি-কুকুর, সি আর্চিনস। মুসেলস খেয়েছ কি কখনো? জার্মান আর স্প্যানিশরা খুব তরিবত করে খায়। মুসেলস এখানেও পাওয়া যায়। আমি এমন রান্না করব যে, তা ফেলে আর অন্য কিছুই খেতে ইচ্ছে করবে না।
তার পর বললেন, আরে। আমিই যদি সব কিছু করব, তুমি সেই দ্বীপে কী করবে? আপনার দেখাশোনা করব। আপনাকে আদর করব, আপনার আদর খাব। আমাদের বেশ একটা গাঁট্টা-গোঁট্টা ছেলে হবে। আপনার মতো হবে সে।
না না। সন্তান যদি হতেই হয় তবে একটি মেয়ে। তোমার মতো সুইটি-পাই।
তাই?
বলেই। হো হো করে হেসে উঠল রংকিনী।
বলল, স্বপ্নেই যখন রাঁধছি পোলাউ, তখন ঘি ঢালতে কঞ্জুষিই বা করব কেন?
আহুকও খুব হাসছিলেন।
বললেন, বাবা। তুমি ড্রাঙ্ক না হয়েই মাতালের মতো কথা বলছ দেখি।
বলছি, কারণ, স্বপ্ন তো স্বপ্নই! রোজ রোজ কি স্বপ্ন দেখা যায়? স্বপ্ন দেখা দেয় কারোকে?
তোমার থলেটা বইতে কষ্ট হচ্ছে না তো? জিনিস তো কম নেই। তোয়ালে দুটোর ওজনই কি কম?
হাতের ব্যাগের ভারে ডান দিকে নুয়ে পড়া রংকিনীকে বললেন আহুক।
না, না।
আহুকের দু-হাতেও দুটি ব্যাগ। কী করে এখানে এই হাওয়ার মধ্যে আগুন জ্বালাবেন আহুক, তা আহুকই জানেন। ভাবছিল রংকিনী। আজ রাতের মেনু নাকি প্রন ককটেইল, আনারস আর ম্যাকারেল ভাজা। আহুক বলেছেন, বোনলেসই করবেন। কাঁটা থাকলে একেবারেই খেতে পারে না রংকিনী, তাই। তার পর ব্যানানা-ফ্রিটারস। এবং তারও পরে রেড ওয়াইন, অনেক গল্প করতে করতে চাঁদের আলো আর ফেনায় ভেজা তটভূমিতে শুয়ে আহুক বলেছিলেন, মুনলাইট পিকনিক তো দেশে-বিদেশে অনেকই করেছ, দ্য হর্নেটস নেস্ট-এরএই মুনলাইট পিকনিক-এর কথা তুমি সারাজীবন মনে রাখবে।
তাই? দেখাই যাক।
তার পরেই রংকিনী বলল, আন্দামানে ওয়াইন কোথায় পেলেন? এখানে কি স্প্যানিশ বা ফ্রেঞ্চ বা অন্য কোনো ভালো ওয়াইন পাওয়া যায়?
না। বিদেশি ওয়াইন নয়। আমাদের দেশে যেসব ওয়াইন তৈরি হয়, তাই। মন্দ কী? দেশির মতো ভালো কি, অন্য কোনো কিছুই? রুবি, গোলকোণ্ডা রিভিয়েরা, বসকা রেড ওয়াইন রাখি এখানে। কারণ, এখানে তো ফ্রিজ নেই। হোয়াইট ওয়াইন তো ঠাণ্ডা না করে খাওয়া যায় না। তা ছাড়া মাছ-মাংসই তো খাই বেশি তাই রেড ওয়াইনই রাখি।
রোজ খান?
পাগল! বছরে হয়তো চার-পাঁচ দিন। ক্কচিৎ কেউ এখানে এলে যদি কারো জন্মদিন এখানে পড়ে যায় সেই জন্মদিনে। দোলপূর্ণিমা, শ্রাবণীপূর্ণিমা আর বুদ্ধপূর্ণিমার রাতে। রিলিজিয়াসলি!
কেন?
চাঁদের সঙ্গে আমার নাড়ি বাঁধা। বলতে পারো, দাড়িও বাঁধা। চাঁদের আলো যেমন এই সমুদ্রমেখলার জোয়ার-ভাটা, ভরা-কোটাল মরা-কোটালকে নিয়ন্ত্রিত করে, তেমন তা করে আমাকেও। পূর্ণিমাতে আমার শিরা-উপশিরাতে রক্ত অনেকই বেশি দ্রুত চলাচল করে। পাগল-পাগল লাগে আমার।
আপনার জন্মদিন কবে?
জেনে কী হবে? কার্ড আসবে না এখানে। এখানে ওয়েব-সাইট, ই-মেইল, টেলিফোন কিছুই নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু টেলিপ্যাথি। যেদিন তুমি আমাকে, তোমাদের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, উইশ করবে, সেদিন আমি সঙ্গে সঙ্গেই জানতে পাব।
বলবেন তো জন্মদিনটা কবে? না, বলবেন না?
আমি জন্মাইনি। মানে, কী বলি! আমার মা ইছামতী নদীতে জ্যৈষ্ঠর এক পূর্ণিমার রাতে নাইতে নেমেছিলেন, এমন সময়ে দেখলেন একটা হাঁড়ি ভেসে আসছে আর তার ভেতর থেকে শিশুর কান্না। মা আমাকে পেলেন। আমি মাকে। আমার মায়ের কোনো সন্তান ছিল না, জানো। তবে আমি তো কানীনই।
কানীন কাকে বলে জানি না তবে আপনার গল্প যদি সত্যি হয় তবে বলব যে, আপনার আসল মা ও বাবা অনেক পুণ্যবান পুণ্যবতী। তবে, আপনার একটি কথাও আমি বিশ্বাস করি না।
কেন? এ কী অন্যায় কথা।
কেন আবার কী? আপনি গুলবাঘ তাই।
তার পর রংকিনী বলল, এমন অদ্ভুত নাম কেন হল আপনার বলুন তো? আহুক। আপনার যদি ছেলে হয় তবে তার নাম রাখবেন ডাহুক। বেশ মিল হবে।
আর মেয়ে হলে, যদি কখনো হয়?
তার নাম রাখবেন জলপিপি।
বাঃ। দারুণ নাম।
এই নামের জন্যই আপনার একটি মেয়ে হতেই হবে। যাক এবারে আপনার নামের মানেটা বলুন।
মানে নেই। প্রপার নাউন। তুমি বেতাল পঞ্চবিংশতি অবশ্যই পড়োনি। তোমাদের এসব বলেই বা কী লাভ? ভোজরাজ-এর বংশে একজন পরাক্রমশালী স্বচ্চরিত্র রাজা ছিলেন। তাঁরই নাম ছিল আহুক। আহুকের স্ত্রীর নাম ছিল কাশ্যা।
কী?
কাশ্যা।
ও!
এবারে তোমার অদ্ভুত নামের মানেটা এল। রংকিনী নামে কোনো শব্দ তো বাংলা ভাষায় নেই বলেই জানি। তবে সম্ভবত রংকিনী, রঙ্গিনীরই সমার্থক। তবে রঙ্গিনীর যা মানে তার সঙ্গে তোমার চরিত্রর তো কোনো মিল নেই।
কী স্ত্রী আর কী পুরুষ তাদের যখন নামকরণ করা হয় শৈশবাবস্থাতে, তখন তো তাদের স্বভাব-চরিত্র পরে কেমন হবে না হবে তা জানা যায় না। তাই নামের সঙ্গে মানুষ অনেক সময়েই মেলে না। যার নাম সুধীর সে অত্যন্ত চঞ্চল, যার নাম ক্যাবলা সে অত্যন্ত স্মার্ট।
তোমার নাম নিশ্চয়ই দিয়েছিলেন তোমার বাবাই।
না। আমার এবং আমার ভাইয়ের নাম দিয়েছিলেন আমার মা-ই। বলেছিলাম না যে, আমাদের পরিবারে আমার বাবার প্রায় কোনোরকম ভূমিকাই ছিল না।
তাই? বোধ হয়, ভালোই হয়েছিল। তাই তিনি মুক্ত হয়ে নিজের কাজ করতে পেরেছিলেন সারাজীবন। যদিও তাঁর আয়ু ছিল না খুব বেশিদিন।
মুক্ত হওয়ার প্রশ্ন আসে বন্ধন থাকলেই। বাবা তো কোনো দিনও কোনো বন্ধন স্বীকার করেননি। দায়িত্বও নয়। কবি বা লেখক হয়তো উনি বড়ো ছিলেন, আপনারাই জানবেন, যাঁরা ওঁর লেখা পড়েছেন, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন ছিলেন বাবা।
তাঁর দায়িত্ব-কর্তব্য আসলে আমার মতো লক্ষ লক্ষ অচেনা মানুষের প্রতি ছিল। তাই নিজের পরিবারের কথা ভাবেনইনি হয়তো। আসলে ব্যাপারটা কী জানো? সূর্যর কাছে গেলে, বা থাকলে তো সূর্যকে সূর্য বলে চেনা যায় না। তাই তোমরাও…
আহুক বললেন।
তা হবে হয়তো। রংকিনী বলল।
নামের কথাতে ফিরি। আমার নামের কোনো মানে আছে কি না, তা নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামাইনি। আমি আমারই মতো হতে চেয়েছিলাম, নামের মতো নয়। মাও কোনো দিন নামের মানে ব্যাখ্যা করে বলেননি আমাকে। হয়তো রঙ্গিনী করেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তা যে হয়নি, তাতে মা দুঃখিতই হয়েছেন হয়তো। জানি না। আমার মায়ের মধ্যে একজন সুপ্ত রঙ্গিনী ছিলেন যিনি মাঝে মাঝেই আছেন বলে জানান দিতেন।
বলেই, বা:। বলে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রংকিনী।
এমন শেষবিকেল এখানে রোজই আসে। আহুক বললেন। আমি রোজই সকাল হওয়া দেখি পাহাড়ে বসে আর সন্ধে হওয়া দেখি এখানে। আশ্চর্য! কোনো সকালের সঙ্গে কোনো সকালের এবং কোনো সন্ধের সঙ্গে কোনো সন্ধের একটুও মিল নেই। ভাবা যায়?
এটা কী গাছ? দু-রকম গাছ একইসঙ্গে? বাঃ।
হ্যাঁ। প্লান্ট-লাইফ-এ একেই বলে সিমবায়োসিস। গুর্জন গাছটার দু-ডালের সংগমে ফোকর হয়েছিল কখনো একটা। তাতে বছরের পর বছর গ্রীষ্ম-বর্ষাতে বাকল, ঝড়ে-ওড়া ফুল-পাতা, ধুলো-বালি-খড়কুটো উড়ে এসে পড়ে পড়ে জমির সৃষ্টি হয়েছিল। তাতে ফ্ল্যামবয়ন্ট গাছের ফুলের পরাগ বা বীজ কোনো পাখি এনে ফেলেছিল গত বর্ষার আগে। আর দেখো, ফ্ল্যামবয়ান্ট গাছ গজিয়ে গেছে ফোকরে। যখন ফুল ফুটবে কী দারুণ যে দেখাবে।
কী গাছ বললেন?
ফ্ল্যামবয়ান্ট। এই গাছের বীজ আমি এখানে আসার পরই আনিয়েছিলাম সেশেলস দ্বীপপুঞ্জের ভিক্টোরিয়া থেকে। কৃষ্ণচূড়ার চেয়েও অনেক বেশি ঝলমলে এরা। সেশেলস এর Endemic গাছ। কিন্তু এখানে কী চমৎকার মানিয়ে নিয়েছে দেখো। যদি আর পাঁচটা বছর থাকি এখানে, তবে পুরো হর্নেটস নেস্টকে ফ্ল্যামবয়ান্টে ভরে দেব। দেশ-বিদেশ থেকে মানুষে এডিবল হোয়াইট-নেস্ট স্যুইটলেট পাখি, তাদের বাসা আর ফ্ল্যামবয়ান্ট গাছ দেখতে আসবে। তার পর বললেন, এই গাছকে কিন্তু ফ্ল্যামবয়ান্ট ছাড়া অন্য কোনো নামেই মানাত না। তাই না?
ঠিক তাই।
ওরা এবারে ফিকে-গেরুয়া তটে নেমে এসেছে। কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পরই তটভূমি প্রায় একটি সমকৌণিক বাঁক নিয়ে বাঁ-দিকে ঘুরে গেছে। আর সেই বাঁকের মুখে, পাহাড়ের গায়ে, স্যাণ্ডস্টোনের একটি চাঙড় তটমুখী একটি প্রস্তরাশয়ের সৃষ্টি করেছে। সেইখানেই সব জিনিসপত্র নামিয়ে রাখতে বললেন আহুক রংকিনীকে। নিজেও নিজের দু-হাতের বোঝ নামালেন।
সূর্যটা এবার পশ্চিমের দিগন্তরেখাতে নেমে জলের একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে। নীলচে কালো জলে নেমে পড়বে এবারে কমলা-রঙা একটি অতিকায় নরম বল।
আহুক বললেন, এইসব পরে তো তুমি সাঁতার কাটতে পারবে না। সব খুলে ফেলল। এইখান থেকে বাঁ-দিকের তটভূমি তোমার আর ডানদিকেরটা আমার। আমরা যে যার দিকে থাকলে কেউই কাউকে দেখতে পাব না। এবং দেখার চেষ্টাও করব না। প্রমিস। আকাশ তোমাকে দেখবে, বাতাস, নগ্নিকা তোমার সর্বাঙ্গে চুমু খাবে, সমুদ্রের ফেনা তোমার জঘনে ফেনার লেস বুনে তোমার লজ্জাহরণ করবে। সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে তোমার গ্রীবাতে চুমু খেয়ে বলবে, গুড নাইট ইয়াং লেডি। তার পর চাঁদ, অরমিতা তোমাকে জলের মধ্যে রমণ করবে। ভাবো তো একবার। এমন অভিজ্ঞতা দ্য হর্নেটস নেস্ট-এ না এলে কি হত?
বলেই বলল, ঠিক আছে তাহলে। কিন্তু সাঁতার ভালো জানো তো? নাকি ডুবে-টুবে গিয়ে আমার সর্বনাশ করবে!
জানি। জানি। কত সমুদ্রে সাঁতার কেটে এলাম।
দূর থেকে সব সমুদ্রকেই এক মনে হয়, আসলে তা নয়। প্রত্যেকেরই স্বভাব-চরিত্র আলাদা। সাঁতার কাটলে বেশি ভেতরে যেয়ো না সমুদ্রের। কখনো-কখনো আণ্ডারকারেন্ট থাকে। নইলে এ-দিকে ঢেউ প্রায় নেই বললেই চলে। চান করার জন্যে আইডিয়াল। চান করে খুবই আরাম। কাল দিনের বেলা এলে দেখতে কী স্বচ্ছ জল। নীচে নানা-রঙা মাছ সাঁতরে যাচ্ছে, নানা-গড়নের নানা-রঙের প্রবালের মধ্যে মধ্যে। কোনোরকম প্রয়োজন হলেই আমাকে ডেকো। না ডাকলে আমি ও-দিকে যাব না। এই নাও তোমার তোয়ালে। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
এই লক্ষণ-গন্ডি দিয়ে দিলাম। দেখো। বলেই, বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বালির ওপরে একটি লম্বা দাগ কেটে দিলেন আহুক।
রংকিনী চলে গেলে, আহুক সব জিনিসপত্র গোছগাছ করে রাখলেন। ডিশ, কাপ, কাঁটা, চামচ, জলের গ্লাস, জলের বোতল, ওয়াইন গ্লাস, রেড ওয়াইনের বোতল, কাগজের ন্যাপকিন, ভিনিগারে ডোবানো নুন-লঙ্কা-হলুদ-মাখা ম্যাকারেল, আনারস ফালি-ফালি করে কাটা, একটা বড়ো টেবল-ক্লথ, যাতে করে খাওয়া-দাওয়ার পরে সব কিছু ওপরে নিয়ে যেতে হবে পরিষ্কার করে তটভূমি থেকে, যাতে তা এমন সুন্দরই থাকে। আগুন, এই প্রস্তরাশ্রয়ের মধ্যেই জ্বালাবে। কাঠ এখানে এনে রাখাই আছে। ফুরিয়ে গেলেই ভীরাপ্পান নিয়ে এসে রাখে। জ্বালানি কাঠ। কাঠ-পোড়া ছাই ভেতরেই পড়ে থাকে। যে-দিন বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়া থাকে, সেদিন ধুয়ে যায় রান্নার জায়গাটা। আগুন জ্বালবার বা ছাইয়ের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত থাকে না। আর্থ টু আর্থ, অ্যাশেস টু অ্যাশেস, ডাস্ট টু ডাস্ট হয়ে যায়।
সব গোছগাছ করে নিয়ে আহুক শুয়ে পড়লেন চিত হয়ে। এই আসন্ন সন্ধের সামুদ্রিক শান্তির সবটুকু নিঃশেষে নিংড়ে নিতে চাইলেন নিজের বুকে। এই শান্তি ধরা থাকবে কাল ভোর অবধি। ভোরে উঠে আবার প্রাণায়াম করবেন।
একা যখন থাকেন তখন জামাকাপড় পরেনই না। বাংলো থেকেই নগ্ন হয়ে আসেন। তোয়ালে একটা আনেন, পেতে শোওয়ার জন্যে, চানের পরে। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে প্রকৃতিকে গ্রহণ করলে প্রকৃতি নিঃশেষে কিছুমাত্র বাকি না রেখে নিজেকে ধরা দেন। তবে আজ রংকিনী আছে বলেই নগ্ন হবেন না। প্রাণীর মধ্যে মানুষের বেলাই বিধাতা উলটোটা করলেন কেন কে জানে! নগ্ন হলে, নারীর সৌন্দর্য এক ভিন্ন মাত্রা পায়। আর পুরুষকে কুৎসিত দেখায়। অন্তত তাঁর চোখে। নারীরা কোন চোখে পুরুষের নগ্নতা দেখেন তা তাঁরাই বলতে পারবেন। সমস্ত প্রাণী, পাখি, পোকাদের, এমনকী মাছেদের মধ্যেও পুরুষেরাই সুন্দর। শুধু মানুষের বেলাই উলটো। ভারি খারাপ লাগে ভাবলে।
সূর্যটা ডুবে গেছে কিন্তু সমুদ্রপারে এইরকম কলুষহীন আবহাওয়াতে কম করে আরও পনেরো মিনিট আলো থাকবে। জলের ওপরে এবং পাশে আলো অনেকক্ষণ বেশি বেঁচে থাকে।
সূর্যটা ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই পুবাকাশে চাঁদ উঠল। আর মিনিট দশেক পরে আশ্চর্য সুন্দর এক বিভাতে ভরে যাবে এই সমুদ্রমেখলা তটভূমি ও পাহাড়। তখনই তিনি জলে নামবেন। মিনিট পনেরো সাঁতার কেটে এসে রান্নার জোগাড়যন্ত্র করবেন।
ভাবছিলেন আহুক, কাল সকালেই তো এসেছে রংকিনী অথচ মনে হচ্ছে যেন কত বছর সে আছে দ্য হর্নেটস নেস্ট-এ। একথা হয়তো রংকিনীরও মনে হচ্ছে। প্রকৃতির এই জাদু। শহরে যে-সখ্য, যে-নৈকট্য হতে দশ বছর সময় লাগে তাই এখানে দশ মিনিটে হয়। কেন যে হয়, তা জানেন না আহুক। কিন্তু হয় যে, তা জানেন।
তিনি চান করে যখন তীরের দিকে সাঁতরে আসছেন সেই সময় হঠাৎই যেন রংকিনী চিৎকার করে উঠল মনে হল। একমুহূর্ত কান খাড়া করে শুনেই তড়িৎ গতিতে নিজের দিক পরিবর্তন করে ফ্রি-স্টাইলে যত জোরে পারেন জলের ওপর দিয়ে সেই লক্ষণ-সীমা পেরোলেন।
না, রংকিনী তো গভীর জলে নেই, সে যে আণ্ডারকারেন্টে পড়েছে তাও মনে হল না, চাঁদের অস্পষ্ট আলোতে কিন্তু মনে হল, ভীষণই ভয় পেয়ে সে তীরের দিকে সাঁতরে আসছিল। পায়ের তলায় বালি পাওয়ামাত্র সে, সাঁতার কাটা থামিয়ে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে দৌড়ে গিয়ে আরও দেরি করে ফেলল তীরের দিকে আসতে। আহুক সাঁতরে তার কাছে। গিয়ে পৌঁছোলেন এবং পোঁছোতেই রংকিনী জ্ঞান হারিয়ে তাঁর প্রসারিত হাতের ওপরে মূৰ্ছা গেল। আহুক তাকে দু-হাতে বেষ্টন করে তুলে ধরে হেঁটে তীরের দিকে আসতে লাগলেন। তিনি রংকিনীর চেয়ে অনেকই লম্বা। যেখানে সে মূৰ্ছা গেছিল সেখানে আহুকের কোমর জল। হঠাৎ কী একটা আওয়াজ হল যেন পেছনে। রংকিনীকে বুকে ধরে পেছন ফিরে চাইতেই জলের গভীরে একটি কালো ছায়া যেন নড়ে উঠেই সরে গেল গভীরতর জলে। মনে হল। মনে হল, কে যেন হাসল। হি:। হি:। হি:।
ঠিক তিন বার।
কে?
টুনি কি?
রংকিনীকে পিঠের ওপরে ফেলে বাঁ-হাতে তার ছাড়া জামাকাপড় এবং তোয়ালেটা তুলে নিয়ে সেই স্যাণ্ডস্টোনের প্রস্তরাশ্রয়ের সামনে এসে তোয়ালে পেতে ওকে শুইয়ে দিলেন আহুক। চাঁদের আলোয় রংকিনীকে একটি মসৃণ, পেলব, সুন্দর সিলভার গ্রে গাছের মতো, নাকি একটি টুনা মাছেরই মতো দেখাচ্ছিল।
রংকিনী ধবধবে ফর্সা নয়। তবে তার শরীরের যে যে অংশ আবৃত থাকে সেইসব অংশ তার মুখ এবং হাত ও গলার চেয়ে অনেকটাই ফর্সা। এক উজ্জ্বল আভাতে মার্জিত তার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। অনেক অনেকই বছর পরে এই গা-ছমছমে নির্জন পাহাড়বেষ্টিত সমুদ্রের তটভূমিতে শুস্কা-অষ্টমীর জ্যোৎস্নাতে ফিকে গেরুয়া বালিতে শায়িতা নগ্না রংকিনীকে দেখে তাঁর মধ্যে তীব্র কাম ভাবের উদ্রেক হল। তীব্রতর অস্বস্তির মধ্যে বুঝতে পেলেন যে, তিনি এখনও যুবকই আছেন। যেকোনো যুবতীকে শারীরিকভাবে সুখী করার ক্ষমতা তাঁর অবশ্যই আছে। জেনে, পুলকিত হলেন।
শুধুমাত্র পুরুষেরাই জানেন, এমনটা না হলে কতবড়ো হীনম্মন্যতা জাগত তাঁর মনে নিজের সম্বন্ধে।
তাঁর নিজের তোয়ালেটা এনে রংকিনীর গায়ের ওপরে মেলে দিলেন, যাতে জ্ঞান ফিরলে সে লজ্জা না পায়। তার পর রংকিনীর পাশে বসে তার দু-হাতের এবং দু-পায়ের পাতা তাঁর নিজের দু-হাতের পাতা দিয়ে ঘষে ঘষে গরম করে দিতে লাগলেন। নাড়ি দেখলেন একবার। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু শ্লথ। এ ছাড়া উদবেগের কোনো কারণ নেই।
এদিকে তো বড়ো হাঙর নেই। একটা এসেছিল বছর তিনেক আগে গভীর সমুদ্র থেকে। টাইগার শার্ক। নইলে এখানে যে ছোটো ছোটো হাঙর আছে তারা মানুষকে এড়িয়েই চলে এবং প্রায় প্রতিদিনই জেলেদের জালে তাদের প্রজাতির কিছু ধরাও পড়ে এবং বাজারে বিক্রিও হয়। ভয় যে পেয়েছে রংকিনী তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু ভয়টা পেল কী দেখে?
আলো যখন ছিল, তখন দেখেছিলেন যে, একটা সার্পেন্ট-ইগল-এর পায়ের দাগ জলের পাশ বরাবর ভেজা বালির ওপরে ওপরে গেছে ওই দিকে, মানে রংকিনী যে-দিকে সাঁতার কাটছিল। কোনো সার্পেন্ট ইগলকে তটে নামতে দেখেননি উনি আজ অবধি। কোনো বড়ো সামুদ্রিক সাপকে কি দেখেছিল সে? সেই সাপই কি তাড়া করেছিল রংকিনীকে? নাকি কোনো জিন-পরিই নেমে এল জলের মধ্যে রংকিনীর ক্ষতি করার জন্যে দ্য হর্নেটস নেস্ট থেকে?
এমন এমন সময়ে আহুক ভীরাপ্পানের অভাব খুবই বোধ করেন। বুদ্ধিতে যা কিছুরই ব্যাখ্যা চলে না, সেইসব দুরূহ প্রশ্নর জট ভীরাপ্পান একনিমেষে খুলে জলবত্তরলং করে বুঝিয়ে দেয়। সত্যি কথা বলতে কী, ভীরাপ্পান আছে বলেই এই দ্বীপে তিনি একা আছেন অনায়াসে। প্রকৃতিকে তার ভালো-মন্দ এবং অতিপ্রাকৃত ক্রিয়াকলাপসমেত ভীরাপ্পান যেমন বোঝে, তিনি তেমন আদৌ বোঝেন না। কোনো জান্তব নারীরই মতে, জান্তব, সর্বগ্রাসী, ভয়ানক প্রকৃতিকে ভীরাপ্পানের মতো জান্তব এবং প্রকৃতিলালিত ভয়ংকর পুরুষই শুধু বশ করতে পারে।
রংকিনীর ঠেটি নড়ল দু-বার। এবার জ্ঞান ফিরবে মনে হচ্ছে। জ্ঞান ফিরলেই ওকে একগ্লাস ওয়াইন দেবেন আস্তে আস্তে খেতে। ব্রাণ্ডি থাকলে ভালো হত। কিন্তু আহুক সমস্ত কু এবং হয়তো সু-অভ্যেসকেই কলকাতাতেই ছেড়ে এসেছেন। দ্য হর্নেটস নেস্ট-এ এসে নিজের জীবনকে একেবারে অন্য মাত্রা দিয়েছেন। এখানে আয়না থাকলে তাঁর হয়তো নিজেকে চিনতে পর্যন্ত কষ্ট হত–যতটুকু তাঁকে আয়নাতে দেখা যেত। আর যেটুকু আয়নাতে কখনোই প্রতিফলিত হয় না, হত না, সেটুকুকে দেখতে রংকিনীর মতো কোনো নারীর চোখের আয়নার প্রয়োজন হত।
পাছে জ্ঞান আসামাত্রই আহুকের সামনে ওর নগ্নতা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয় রংকিনী, তাই আহুক উঠে লক্ষণের গন্ডির ওইদিকে চলে গেলেন। একটু পরই গলা শুনলেন রংকিনীর। কোথায়? আপনি কোথায়?
এই তো এখানে। কেমন আছ? ভালো তো এখন?
কোথায় গেছেন? শিগগির আসুন।
আহুক কাছে যেতেই রংকিনী তোয়ালেটা জড়িয়েই আহুকের বুকে এল। খুব জোরে জড়িয়ে ধরল আহুককে। তার পর ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল। আহুকের পিঠের ওপর দিয়ে রংকিনীর দু-চোখের গরম জল বয়ে যেতে লাগল।
রংকিনী তাঁর পিঠে তার ছোটো ছোটো নরম মুঠি দিয়ে কিল মারতে মারতে বলল, আপনি খারাপ। খারাপ। ভীষণই খারাপ। খারাপ..
আহুক অস্ফুটে বললেন, জানি তা।
সমুদ্রে জোয়ার লেগেছে। ঢেউয়েদের তটে আসা দ্রুততর হয়েছে। চাঁদে ভাসছে। বিশ্বচরাচর। মাথার ওপরে কালো, ভূতুড়ে, দ্য হর্নেটস নেস্ট ছায়া ফেলেছে। আন্দামানি পেঁচাটা ডাকল গুড়ুম! গুড়ুম! গুড়ুম!
আহুকের বুকের মধ্যেই কেঁপে উঠল রংকিনী ভয়ে।
খুবই ভালো লাগল আহুকের। পুরুষের চওড়া রোমশ বুকেই তো নারীর চিরকালীন আশ্রয়।
লক্ষণের গন্ডির ওপাশে একটা একলা স্যাণ্ড-পাইপার কেঁদে বেড়াচ্ছিল। এ পাখিগুলোকে রাতে দেখা যায় না। সেও বুঝি সঙ্গী খুঁজছে।
রংকিনীর মুখটিকে দু-হাতের পাতাতে ধরে তার দু-ঠোঁটে দু-ঠোঁট রেখে আহুক বহু বছর বাদে কোনো নারীকে পরিপূর্ণভাবে চুমু খেলেন। সেই চুমু পরিপূর্ণতর করে ফিরিয়ে দিল রংকিনী।
কেন জানে না রংকিনী, এই মানুষটার মধ্যে যে তার হারিয়ে যাওয়া বাবাকে কেন খুঁজে পেল। যে-আদর, যে ভালো-ব্যবহার তাঁকে কখনো দেওয়া হয়নি, তাই যেন দেওয়ার জন্যে উদগ্রীব হল ও।
.
১২.
খাওয়া-দাওয়া এবং অনেক আদর খাওয়া এবং করার পরে একটি বড়ো তোয়ালে পেতে ওঁরা দু-জনে শুয়েছিলেন। রংকিনী এমনভাবে আহুককে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছিল যে, মনে হচ্ছিল যে, আর ছাড়বে না তাঁকে কখনো।
আহুক জানেন যে, ও অপাপবিদ্ধা যুবতী। তাই জীবনের গতি-প্রকৃতিকে জানে না। মৃত প্রেমিককেও অন্য মানুষে প্রেমিকার বাহুবন্ধন ছিন্ন করে নিয়ে যায়, মৃতবৎসা মায়ের কোল থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় শ্মশানে আত্মীয়রা। সংসারের সব বাঁধনই খুলে দেওয়ার জন্যেই। সেই মুক্তিই আসল প্রেম। যে-মুক্তি রংকিনীর মা দিয়েছিলেন তার লেখক বাবাকে।
রংকিনী ঘুমিয়ে পড়ার পর আহুক উঠে সমুদ্রতটে পায়চারি করছিলেন। সেই বড়ো পেঁচারা ডাকল। অত ওপর থেকে ডাকা সত্ত্বেও এই সমুদ্রপারের হু-হু হাওয়া আর ঢেউয়ের শব্দ ছাপিয়ে সেই ডাক কানে এল আহুক-এর। একজোড়া আছে। প্রায় প্রতিসন্ধেতেই দাম্পত্য কলহ হয় একপ্রস্থ খুব জোর। তার পরই খুব ভাব। সব দাম্পত্যই এরকম।
কাল কী হবে জানেন না উনি। রংকিনী হয়তো ওঁর সঙ্গে ঘর পাততে চাইবে। কিন্তু তা তো হয় না। ও অনভিজ্ঞা বলেই তো অনেক পোড়-খাওয়া আহুক বোস ওকে ঠকাতে পারেন না। তবে রংকিনীর যখন চুল পেকে যাবে, দাঁত নড়ে যাবে, তখন যদি সে এখানে এসে থাকতে চায় তবে আহুক, যদি তিনি নিজে তখনও বেঁচে থাকেন, বাধা দেবেন না। আজকে ওঁর বয়েসে পৌঁছে উনি যা জানেন, তা রংকিনীর বয়েসে রংকিনী জানবেই বা কী করে!
ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যৎ-ই জানে। কিন্তু এখন যা হয় না, তা হয় না। জীবন বড়ো আনরোমান্টিক। সকলের জীবনই। গল্প-উপন্যাসের কাহিনি খুব কমক্ষেত্রেই জীবনে সত্যি হয়। আর হয় না বলেই মানুষ-মানুষী তা এত ভালোবেসে পড়ে, সারারাত ধরে। কৃষ্ণমূর্তির কোনো লেখাতেই কি পড়েছিলেন আহুক অনেকদিন আগে? মনে পড়ছে না ঠিক :
If you love something or someone, set it free. If it comes back to you, it is yours!
If it does not, it was never meant to be!
চাঁদের আলোটা ক্রমশ জোর হচ্ছে। হাওয়াটাও জোর হচ্ছে। হাওয়াতে দ্য হর্নেটস নেস্ট এর হরজাই গাছগাছালির পাখপাখালির বৃষ্টিভেজা গায়ের গন্ধ ভেসে আসছে।
এবারে রমিতা রংকিনীকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যেতে হবে কটেজে। ফুলশয্যার রাত যেমন চিরদিনের নয়, ডাইনি-জ্যোত্সাতে আর সমুদ্রের জলে গা-ছমছম করা সিক্ততাতে অভিষিক্ত তটশয্যাও চিরদিনের নয়।
আজ সারারাত ধরে কী করে শরীরে আর মনে আতর মাখতে হয় তা ওকে শেখাবেন আহুক। যৌবন যে বড়ো সুন্দর সময় এবং বড়োই ক্ষণস্থায়ী তা বোঝাবেন আহুক রংকিনীকে।