৯. ট্যানাসের মৃত্যুর পর

ট্যানাসের মৃত্যুর পর থেকে কোনো প্রধান সেনাপতি ছিলো না আমাদের, যুদ্ধ-সভা বসলো গোপন স্থানে। যদিও সেখানে যাওয়ার অনুমতি ছিলো না আমার, কিন্তু লসট্রিসের কাছে সব কথাই শুনেছিলাম।

বহুসময় ধরে তর্ক-বিতর্ক শেষে সমরনায়কের পদে ক্ৰাতাসকে মনোনীত করা হলো। সমস্ত লোকজনের সমানে দাঁড়িয়ে বুড়ো সিংহের মতোই হুঙ্কার দিয়ে হেসেছিলো ক্ৰাতাস। সে বলেছিলো, আমি একজন সৈনিক। আমি নির্দেশ পালন করি। নেতৃত্ব দেওয়া আমার কাজ নয়। তলোয়ার খাপমুক্ত করে মেমননের দিকে তাক করে ধরে সে, ওই সেই ব্যক্তি, যার নির্দেশ পালন করবো আমি। জয় হোক, মেমননের! তিনি চিরজীবি হোন।

তিনি চিরজীবি হোন! চেঁচিয়ে উঠে সবাই। হাসি ফুটে উঠলো আমার মিসট্রেসের ঠোঁটে। আমি আর ও মিলেই মূলত এই পরিকল্পনা করেছিলাম।

বাইশ বছর বয়সে মিশরের সাহসী সিংহ পদে পদোন্নতি পেয়ে প্রধান সেনাপতির দায়িত্বভার পেলো মেমনন । সাথে সাথেই মিশর ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলো সে।

যদিও আমার পদ ছিলো রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালক, আমি রাজপুত্র মেমননের সভাসদের তালিকায় স্থান পেলাম। মাঝে-মধ্যেই যাত্রা পথের বাহন নিয়ে আমার পরামর্শ চাইতো রাজপুত্র। দিনের বেলায় ওর রথ চালিয়ে সৈন্যদের প্রশিক্ষণে নিয়ে যেতাম।

কতো রাত আমরা তিনজন, ক্ৰাতাস, আমি এবং মেমনন, সুরার পাত্র হাতে ফিরে যাওয়া নিয়ে কথা বলেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সেই রাতগুলোতে রাজকুমারী মাসারা থাকতো আমাদের সাথে। সবার পাত্র পূর্ণ করে দিতো সে। এরপর মেমননের পায়ের কাছে, ভেড়ার চামড়ায় তৈরি মাদুরের উপর বসে মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি কথা শুনতো সে। আমার উদ্দেশ্যে হাসতো মাসারা, চোখাচোখি হলে।

আমাদের মূল উদ্বেগ ছিলো নদীর ভাটিতে দুর্গম জলপ্রপাতগুলো অতিক্রম না করে ফিরে যাওয়া। ওই জলপ্রপাতগুলো কেবলমাত্র বন্যার সময়ে পার হওয়া সম্ভব। এতে করে আমাদের যাত্রাপথে অনেক সময় নষ্ট হবে।

আমি পরামর্শ দিলাম, পঞ্চম জলপ্রপাতের নিচে আরো একটা নৌবাহিনী তৈরি করতে পারি আমরা; তাতে চড়ে আমাদের সেনাবাহিনী মরুর সেই এলাকায় চলে যেতে পারবে, যেখান থেকে মরুর উপর দিয়ে সংক্ষিপ্ত রাস্তা ধরে এগুনো সম্ভব। প্রথম জলপ্রপাতের উপরে, নদীর কাছে পৌঁছে আবারো গ্যালি প্রস্তুত করে বাকি পথ পাড়ি দিয়ে গজদ্বীপে পৌঁছানো যাবে।

আমি নিশ্চিত ছিলাম, যদি আমাদের সময়জ্ঞান সঠিক থাকে, জলপ্রপাত এড়িয়ে গিয়ে যদি আমরা গজ-দ্বীপে নোঙর ফেলা হিকসস্‌ বাহিনীকে চমকে দিতে পারি, সেক্ষেত্রে তাদের গ্যালি দখল করে নিয়ে আমাদের বাহিনীকে শক্তিশালী করা সম্ভব। একবার, ঘঁটি গেলে ফেলতে পারলে আমাদের পদাতিক বাহিনী আর রথবহর প্রথম জলপ্রপাত অতিক্রম করে নীল নদের সমভূমিতে লড়তে পারবে।

পরবর্তী বন্যার মৌসুমে আমাদের প্রত্যাবর্তন শুরু হলো। কেবুই-এ, বহু বছর ধরে যা ছিলো আমাদের ঘাঁটি, একটা বাহিনী মোতায়ান রাখলাম আমরা। কেবুই আমাদের রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ঘাটি হিসেবে বিবেচিত হবে। কুশ এবং ইথিওপিয়ার মূল্যবান পণ্য এখন সহজেই আমাদের বন্দরে যেতে পারবে।

আবারো যখন মূল নৌ-বাহিনী উত্তরে যাত্রা শুরু করলো; পাঁচহাজার রাখাল এবং রথবহর সহ আমি এবং হুই নৃ-এ পালের স্থানান্তর অভিযানের অপেক্ষায় ছিলাম। আগের মতোই ঝাঁকে ঝাকে এলো তারা। রথ নিয়ে ওগুলোর মাঝে ছুটলাম আমি এবং

ধীরগতির এই প্রাণীগুলোকে ধরতে কোনো বেগ পেতে হলো না। রথ নিয়ে দৌড়ে দড়ির ফাঁস পরিয়ে খুব সহজেই ধরা গেলো, দ্রুতগামী ঘোড়ার সাথে দৌড়ে পেরে উঠলো না । নীল নদের তীরে প্রস্তুত করা খোয়ারে দশ দিনের মধ্যে প্রায় ছয় হাজার ন্যূ র স্থান হলো ।

সেই খোয়াড়ে থাকার সময়ই এই প্রাণীগুলোর নাজুক স্বাস্থ্য এবং দুর্বলতা পরিষ্কার হলো আমাদের কাছে। কোনো কারণ ছাড়াই শ য়ে শ য়ে মরলো তারা।

অর্ধেক প্রাণী মারা গেলো যথেষ্ট পরিমাণ যত্ন-আত্তির পরেও। শেষমেষ অল্প কয়েকটি প্রাণী আমরা নিয়ে যেতে পেরেছিলাম গ্যালিতে করে ।

*

রানি লসট্রিসের মিশর প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা দেওয়ার ঠিক দুই বছর পর, চতুর্থ জলপ্রপাতের উপরে নীল নদের পুব তীরে জড়ো হলো আমাদের লোকেরা। আমাদের নিচে, নদীর উপর দিয়ে চলে গেছে মরুপথ।

গত বছরের প্রায় পুরোটা সময় এখান থেকে ওয়াগনের কাফেলা রওনা হয়েছে। কাদামাটির পাত্রে কানায় কানায় নীলের জলভর্তি করে মুখবন্ধ অবস্থায় ওয়াগনে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ধুলোময় পথের দশ মাইল অন্তর অন্তর পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ এবং প্রায় সমসংখ্যক প্রাণী রয়েছে আমাদের সাথে। প্রতিদিন পানি ভর্তি ওয়াগন চরে যেতে থাকলো মরুপথ ধরে এর যেনো কোনোদিন শেষ হবে না।

নতুন চাঁদের অপেক্ষায় নদী তীরে বসে রইলাম আমরা, যাতে রাতে চাঁদের আলোয় এগুতে পারি। যদিও বছরের ঠাণ্ডা সময়ে এই যাত্রা করতে হচ্ছে, কিন্তু মরুর সূর্যের প্রখর তাপ আমাদের বাহিনীর লোকজন এবং প্রাণীগুলোর জন্যে অসহনীয়।

পথ-চলার দুই দিন আগে, আমার কী হঠাৎই বললো আমাকে, টাইটা, শেষ কবে তুমি আর আমি নদীতে মাছ ধরেছি? নৌকা আর সরঞ্জাম তৈরি করো গে, যাও।

বুঝলাম, বিশেষ কোনো ব্যাপারে কথা বলতে চায় সে। সবুজ জলে ভেসে চললো আমাদের ছোটো নৌকা; দূরের তীরের আগাছার সাথে দড়ি বেঁধে নৌকা স্থির করলাম আমি। এখন আর আমাদের কথা শুনতে পাবে না কেউ।

প্রথমে, মরুপথ ধরে আমাদের আসন্ন যাত্রা নিয়ে কথা বললাম আমরা দু জন। থিবেস প্রত্যাবর্তন নিয়ে উত্তেজিত হয়ে আছি সবাই।

ওই ঝকঝকে দেয়ালগুলো কবে আবার দেখতে পাবো, টাইটা? দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো আমার কর্ত্রী। এ এমন এক প্রশ্ন যার উত্তর জানা নেই আমার।

যদি দেবতারা সদয় থাকেন, আগামী বছর এই সময় গজ-দ্বীপে থাকবো আমরা। বন্যার পানিতে আমাদের জাহাজবহর প্রথম জলপ্রপাত অতিক্রম করতে সক্ষম হবে। এরপর, এই নদীর মতোই ঝড়-ঝঞ্ঝা সইতে হবে আমাদের–বড়ো এক যুদ্ধ অপেক্ষা করছে সামনে।

কিন্তু, এসব নয়, আমি জানি অন্য কিছু নিয়ে আলাপ করতে এখানে এসেছে লসট্রিস।

কতোদিন হলো ট্যানাস আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, টাইটা? জলভরা চোখে জানতে চাইলো সে।

রুদ্ধ স্বরে উত্তর দিলাম, তিন বছর আগে স্বর্গের ময়দানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে সে, মিসট্রেস।

বহুমাস হয়ে গেছে তবে, ওর বুকে শুয়েছি আমি, ধীর কণ্ঠে বলে লসট্রিস। মাথা নেড়ে সায় দিলাম, কোন্ দিকে যাচ্ছে কথা-বার্তা ঠিক বুঝছি না।

প্রতিরাতে ওকে স্বপ্ন দেখেছি আমি, টাইটা। এমন কী হতে পারে, ঘুমন্ত অবস্থায় এসে আমার গর্ভে তার বীজ রেখে যেতে পারে ট্যানাস?

দেবতার ইচ্ছে হলে সবকিছুই সম্ভব, সতর্কস্বরে উত্তর দিলাম আমি। আমরা তেহুতি আর বেকাথার জন্ম সম্পর্কে সবাইকে এমন কথাই শুনিয়েছি। কিন্তু সত্যি বললে, এমন কিছু কখনো ঘটতে শুনিনি আমি।

বেশ কিছু সময় নীরব হয়ে রইলাম আমরা দু জন। নৌকার ধার দিয়ে নদীর পানিতে হাত ডুবিয়ে উঁচু করে ধরে রেখে টপটপ পড়তে থাকা ফোঁটাগুলোর দিকে চেয়ে রইলো লসট্রিস। এরপর আমার দিকে না তাকিয়ে বলে চলে সে, আমার ধারণা, বাচ্চা পেটে আমার, ফিসফিস করে বললো ও। আমার রজঃচক্র অনিয়মিত হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।

মিসট্রেস, শান্তস্বরে বললাম আমি। তুমি জীবনের এমন সময়ে চলে এসেছে, যখন গর্ভের নদী শুকিয়ে আসতে শুরু করে। আমাদের মিশরীয় মেয়েরা মরু ফুলের মতোই; আগে জন্মে, আবার দ্রুতই ঝরে যায়।

মাথা নাড়লো লসট্রিস। না, টাইটা। এটা সে রকম নয়। আমি টের পাই, আমার ভেতরে বড়ো হচ্ছে একটি শিশু।

নীরবে ওর দিকে চেয়ে থাকলাম আমি। আবারো, কেনো জানি না, মনে হলো মর্মান্তিক কোনো ঘটনা যেনো অদৃশ্য পাখায় ভর করে আমার কাঁধের পাশ দিয়ে উড়ে গেলো। হাতের রোম দাঁড়িয়ে গেছে আমার।

অন্য কোনো পুরুষের ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে না তোমার, এবারে সরাসরি আমার চোখে তাকিয়ে বললো লসট্রিস। তুমি জানোতা কোরি নি আমি।

তা আমি ভালো করেই জানি। কিন্তু কোনো ভূত এসে তোমাকে গর্ভবতী করে দিয়ে গেছে, এ আমি বিশ্বাস করি না। যতো প্রিয় ভূত-ই হোক না কেনো। সম্ভবত, আরো একটি সন্তান-প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা তোমার মধ্যে কল্পনার জন্ম দিয়েছে।

আমার পেট অনুভব করে দেখো, টাইটা, নির্দেশের সুরে বললো মিসট্রেস। আমার অভ্যন্তরে এ কোনো জীবিত বস্তু। প্রতিদিন বাড়ছে ওটা।

আজ রাতে পরীক্ষা করে দেখবো তোমার শয্যাকক্ষে। এখানে, এই নদী তীরে সম্ভব নয়।

*

লিনেন চাদরের উপর নগ্ন শুয়ে থাকলো আমার কর্মী, প্রথমে তার মুখ এবং পরে সমস্ত দেহ পরীক্ষা করে দেখলাম আমি। একজন পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এখনো যথেষ্ট আকর্ষণীয়া লসট্রিস; কিন্তু চিকিৎসকের চোখে দেখলে বুঝতে পারা যায় দীর্ঘ বছরগুলোর কষ্ট কী নির্মম পরিবর্তন এনেছে তার মধ্যে। রুপালি হয়ে গেছে চুল, ভুর কুঞ্চন স্থায়ী রূপ পেয়েছে। বয়স তার ছাপ ফেলেছে চেহারায়।

তিন তিনটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে ওর শরীর। বুকজোড়া শুকিয়ে গেছে এখন, গর্ভাবস্থার চিহ্ন দুধে ভারী হয়ে নেই ও দুটো। এ অবশ্য অস্বাভাবিক রুগ্ন আকার–চর্বি-মাংস কিছু নেই ওখানে। কিন্তু পাতলা হাত পার সাথে অসামাঞ্জস্যপূর্ণভাবে সামনে বেরিয়ে এসেছে বিশাল পেট।

সন্তান জন্মানোর চিহ্ন বহনকারী রুপালি-সাদা ডোরাকাটা দাগ ভরা পেটটা যখন হাতিয়ে দেখলাম, কিছু একটা অনুভব করলাম হাতের নিচে। আমি জানি, জীবন নয় ওটা। এ যে মৃত্যু স্বয়ং।

কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওর পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, খোলা পাটাতনে গিয়ে আকাশের তারাদের দিকে চেয়ে রইলাম নির্বাক। ঠাণ্ডা, কতো শত মাইল দূরে ওরা। কোনোকিছুতেই কিছু আসে-যায় না ওদের দেবতাদের মতোই। নক্ষত্ররাজীই হোক বা দেবতা–ওঁদের কাছে প্রার্থনা করে কোনো লাভ নেই।

আমার কর্ত্রীর দেহে বড়ো হতে থাকা বস্তুটি আমি চিনি। অন্যান্য অনেক মহিলার দেহে এই রোগ দেখেছি আমি। মৃত্যুর পর বহু নারী শবদেহ কেটে ওটা বের করে এনে পরীক্ষা করে দেখেছি। ভয়ঙ্কর, বিচিত্র আকৃতির মানুষ বা প্রাণীর কোনো কিছুর সাথে মিল নেই এর। লাল-ভয়ঙ্কর এক মাংসপিণ্ড ওটা। সেথ্‌-এর জিনিস।

অনেকটা সময় লাগলো শয্যাকক্ষে ফিরে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে।

আলখাল্লা দিয়ে শরীর ঢেকে ফেলেছে মিসট্রেস। বিছানার মধ্যিখানে বসে, চিরসজীব বড়ো বড়ো গাঢ় সবুজ চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলো সে। মনে হলো, আমার পরিচিত সেই ছোট্ট মেয়েটি যেনো।

মিসট্রেস, ব্যথার কথা আমাকে বলো নি কেনো? মৃদুকণ্ঠে জানতে চাইলাম।

কেমন করে ব্যথার কথা জানলে তুমি? ফিসফিস করে উচ্চারণ করে আমার কর্ত্রী । ওটা যে লুকিয়ে রাখতে চাইছিলাম আমি।

.

চাঁদের আলোয় রুপালি মরুপথ ধরে রওনা হলো আমাদের কাফেলা। কখনো কখনো মিসট্রেস আমার পাশে পাশে হেঁটে চলতো, সাথে থাকতো দুষ্ট দুই রাজকুমারী। অভিযানের আনন্দে মশগুল তারা। মাঝে-মধ্যে যখন অসহনীয় হয়ে উঠতো পেটের ব্যথা, ওয়াগনে শুয়ে আরাম করতো লসট্রিস। ঘুমের গুড়ো ওর চোখ ভারী করে না আসা পর্যন্ত হাত ধরে বসে থাকতাম আমি।

প্রতিরাতে এক একটি পানি বহনকারী ওয়াগন পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রম করলাম আমরা। বহু বাহনের চলাচলে ততক্ষণে দাগ পরে গেছে বালুর বুকে। লম্বা দিনগুলোতে ওয়াগনের ছায়ার নিচে গরমে হাঁফাতাম।

তিরিশ দিন-রাত চলার পর একদিন সকালে স্মরণীয় দৃশ্য চোখে পড়লো। মরুর উপরে যেনো ভেসে চলেছে একটা পাল, কোনো বাহন নেই। আরো বহু মাইল পথ পাড়ি দেয়ার পর বোঝা গেলো, বোকা বনেছি আমরা। নীল নদের তীর আমাদের চোখের আড়াল করে রেখেছিলো গ্যালির কাঠামো, বালিয়ারির নিচে বয়ে চলেছে। নদী সেই গ্যালিরই পাল দৃশ্যমান হয়েছিলো দূর থেকে। নদীর বাঁক পেরিয়ে এসেছি আমরা।

রাজপুত্র মেমনন এবং তার বাহিনীর সবাই ওখানে আমাদের অভিনন্দন জানানোর জন্যে অপেক্ষায় ছিলো। ইতিমধ্যেই, নতুন গ্যালিবহরের কাজ পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। এর একটির পাল আমাদের ধোকা দিয়েছিলো দূর থেকে। নিঃসন্দেহে কুশ দেশ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিলো সমস্ত কাঠ। সমস্ত রথ এখন তৈরি। মরুর উপর ঘোড়াগুলোকে দেখভাল করেছে হুই। নদীর তীরে খোয়াড়ে আছে ন্যূ-এর পাল।

মহিলা আর শিশুদের নিয়ে আরো ওয়াগন আসতে লাগলো আমাদের পিছনে। জাতির মূল অংশ ইতিমধ্যেই মরু পাড়ি দিয়ে চলে এসেছে। অবিশ্বাস্য এক কীর্তি ছিলো এটা, দেবতার সমতুল্য পরিশ্রমের প্রয়োজন ছিলো এ ধরনের একটি পরিকল্পনায়। কেবলমাত্র ক্রাতাস, রেমরেম এবং মেমননের মতো মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিলো এতো কম সময়ে এটা অর্জন করা।

এখন, আমাদের এবং আমাদের এই মিশরের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেবল প্রথম জলপ্রপাত।

আবারো উত্তর অভিমুখে চললাম আমরা। তার এবং রাজকুমারীদের জন্যে প্রস্তুত করা রাজকীয় জলযানে চড়লো মিসট্রেস। বিশাল, খোলামেলা শয্যাকক্ষ তৈরি করা হয়েছে তার জন্যে। কারুকাজ করা ইথিওপিও উলের পর্দা ঝুলছে দেয়াল থেকে, কালো একাশিয়া কাঠের তৈরি আসবাব আইভরি আর কুশ দেশীয় স্বর্ণে নকশা করা। জাহাজের দেয়ালগুলো নানান রঙের পাখি আর ফুলের ছবি একে ভরে দিলাম আমি।

সব সময়ের মতো কর্ত্রীর বিছানার পায়ের কাছেই ঘুমোতাম আমি। পাল তোলার তিনদিন পর একদিন রাতে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। নিঃশব্দে কাঁদছিলো আমার রানি। বালিশে মুখ ঢেকে দমিয়ে রাখছিলো শব্দ, তবুও কাঁধের ঝাঁকুনিতে জেগে গেছিলাম আমি। ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে কোমল স্বরে শুধালাম, ব্যথা বেড়েছে?

তোমাকে জাগাতে চাই নি, টাইটা। আমার পেটে যেনো তলোয়ার সেঁধিয়ে গেছে।

ভীষণ শক্তিশালী ঘুমের গুঁড়ো দিলাম আমি ওকে। ধীরে ধীরে ওষুধের চেয়েও তীব্রতর হয়ে উঠছিলো ওর ব্যাথাটা।

মিশ্রণটা পান করে নিয়ে নীরবে শুয়ে থাকলো লসট্রিস। এরপর ও বললো, ওটা আমার পেট থেকে কেটে বের করে আনতে পারবে না তুমি, টাইটা?

না, মিসট্রেস, পারবো না।

তবে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখো না, টাইটা। ছোটোকালে যেমন করে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়াতে।

ওর বিছানার কাছে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম লসট্রিসকে। আমার আলিঙ্গনে বাচ্চা মেয়ের মতোই রুগ্ন ঠেকলো তার দেহ। একটু একটু করে দোলা দিয়ে ধীরে ঘুম পাড়িয়ে দিতে লাগলাম ওকে।

*

গজদ্বীপে উপরে, প্রথম জলপ্রপাতের মাথার কাছে পৌঁছুলো নৌবহর। শান্ত নদীর জলধারায় তীরে নোঙর করলো জাহাজবহর।

সেনাবাহিনীর বাকি সদস্যদের আগমনের অপেক্ষাই রইলাম আমরা। কাতাসের নেতৃত্বে থাকা রথ বহর, শিলুক পদাতিক বাহিনী তখনো পৌঁছে নি। এছাড়া, বন্যার জলে নীল নদীর স্তর উঁচু না হওয়া পর্যন্ত জলপ্রপাত বেয়ে মিশরে নেমে যাওয়া সম্ভব নয়।

অপেক্ষার দিনগুলোতে নিচে গুপ্তচর পাঠিয়ে দিলাম আমরা। কৃষক, পুরোহিত অথবা বণিকের ছদ্মবেশে মিশরে পৌঁছে গেলো তারা। ক্রাতাসের সঙ্গে নিচের ফুঁসে উঠা জলরাশির আগ পর্যন্ত গিয়ে মানচিত্র এঁকে পথ বুঝিয়ে দিলাম আমি। পানি কম থাকায় ভয়ঙ্কর বিপদজনক নদীবক্ষ উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। ডুবো পাহাড়ের উচ্চতা সমান চিহ্ন দিয়ে রাখলাম আমরা তীরের মাটিতে, যাকে করে বন্যার সময়ও নিমজ্জিত বিপদ সম্পর্কে অবগত থাকতে পারি।

বহু সপ্তাহের পরিশ্রম শেষে নৌবাহিনীর কাছে ফিরে এলাম আমি। তততদিনে চলে এসেছে আমাদের পুরো সেনাবাহিনী। পাথুরে মরু এলাকার ভেতর দিয়ে রথ চলাচলের পথ খুঁজে দেখার জন্যে প্রহরী বাহিনী পাঠানো হলো। জলপ্রপাতের বিক্ষুব্ধ জলরাশির উপর দিয়ে রথ আর ঘোড়া পারাপারের উপায় নেই।

ওদিকে, গজ-দ্বীপ থেকে ফিরে আসতে লাগলো আমাদের গুপ্তচরেরা। একা একা, রাতের অন্ধকারে একজন দু জন করে এলো তারা। বহু বছর পর আমাদের মাতৃভূমির খবর পেলাম।

এখনো শাসন করছেন রাজা স্যালিতিস, তবে বুড়ো হয়ে গেছেন তিনি। হিকসস্‌ বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছে তার দুই ছেলে। রাজকুমার বিউন সেনাবাহিনীর দায়িত্বে আছে, আর রথ বহরের নেতৃত্বে রয়েছে রাজকুমার আপাচান।

আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি হিকসস্‌ দের ক্ষমতার পরিধি। গুপ্তচরদের খবর মোতাবেক, বারো হাজার রথ আছে আপাচানের বাহিনীতে। অপরদিকে, আমরা কেবল চার হাজার রথ নিয়ে এসেছি। বিউনের কাছে আছে চল্লিশ হাজার পদাতিক এবং তীরন্দাজ সৈন্য। কাতাসের শিলুক বাহিনী সহ আমাদের পদাতিক বাহিনীর সংখ্যা পনেরো হাজারের বেশি নয়।

অবশ্য, ভালো খবরও আছে। হিকসস্‌দের বাহিনীর বেশিরভাগই এই মুহূর্তে ডেল্টায়, স্যালিতিস মেমফিস নগরীকে তার রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করছে। গজ দ্বীপে আর থিবেসে তাদের সরে আসতে বহু মাস সময় লাগবে। বন্যার পানি না নামা পর্যন্ত নদীর উজানে তার রথ বহর আনা সম্ভব হবে না। গজ-দ্বীপে এই মুহূর্তে মাত্র একশ রথবাহিনী পাহারায় আছে। ভারী চাকার পুরোনো রথ সেগুলো, ততোদিনেও স্পোক সহ চাকার ধারণা পায় নি হিকসসেরা।

নিজের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করলো মেমনন। বন্যার মৌসুমে জলপ্রপাত পেরিয়ে গজ-দ্বীপের দখল নিয়ে নেবো আমরা। এরপর, যখন দক্ষিণে তার বাহিনী নিয়ে ধেয়ে আসবে স্যালিতিস, থিবেসের পথে এগিয়ে যাবে মিশরীয় বাহিনী। পথে পথে জনতার জাগরণ আমাদের সঙ্গী হবে।

থিবেস-এর আগেই বন্যা উদ্রুত সমতলে সমস্ত শক্তি নিয়ে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে স্যালিতিস, কেবল পানি নেমে যাওয়ার অপেক্ষা। ততোদিনে আমরা শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারবো পথে পথে সৈন্য সগ্রহ করে।

গুপ্তচরদের থেকে জানা গেলো, সীমান্তে কোনো রকম আক্ৰমণ আশা করছে না তারা। কাজেই প্রথম চোটে বিস্ময়ের আঘাত দিতে সক্ষম হবো আমরা। জানা গেলো, মিশরীয় জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে রাজা স্যালিতিস। আমাদের প্রাসাদে থেকে, আমাদেরই দেব-দেবীর পূজো করে সে আজকাল। এমনকি, তাদের দেবতা সুখে পর্যন্ত সে-এ পর্যবসিত হয়েছে।

যদিও এখনো তার বাহিনীর সেনাপতিরা সবাই হিকসস্‌, কিন্তু অর্ধেক সৈনিক আমাদের দেশী। আমাদের নির্বাসনের সময় এরা নিশ্চই ছোট্ট বাচ্চা ছিলো। ভাবলাম, রাজকুমার মেমনন যখন মিশরের দখল ফিরে পেতে চাইবেন, এদের আনুগত্য কোন্ ভাগে পড়বে।

সবকিছু এখন তৈরি। প্রহরীরা মরুর ভেতর দিয়ে পশ্চিম তীর ধরে একটা পথ আবিষ্কার করেছে। সুপেয় পানি বহনকারী ওয়াগনগুলো যাত্রাপথে বিভিন্ন স্থানে মোতায়ান আছে, কাজেই আমাদের বাহিনীর লোকজনের মরু পেরুতে পানির অভাব হবে না। প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে গ্যালিবহরেরও। নীলে বান ডাকামাত্র রওনা হবো আমরা। কিন্তু ইত্যবসরে, একটি আচার সম্পন্ন করার আছে।

পাহাড় বেয়ে নদীর উপরে সেই স্থানে চলে এলাম, দুই দশক আগে যেখানে আমার কর্ত্রী তার স্মারকচিহ্ন রেখে গেছেন। মেঘমুক্ত নীল আফ্রিকার আকাশপানে এখনো গর্বোদ্ধত মস্তক খাড়া করে রেখেছে ওটা।

পাহাড় বেয়ে চলার শক্তি নেই লসট্রিসের দেহে। দশজন দাস কাঁধে করে বয়ে। চূড়ায় নিয়ে গেলো তাকে। রাজকুমার মেমননের হাতে ভর দিয়ে বহু কষ্টে হেঁটে সেই স্তম্ভের পাদদেশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। আমাদের পুরো জাতি, প্রতিটি চোখ চেয়ে রইলো তার দিকে।

জোরে জোরে খোদাই করা বাক্যগুলো পড়লো মিসট্রেস। ক্ষীণ হতে পারে, কিন্তু এখনো তার কণ্ঠস্বরে মধুর; মহৎপ্রাণ এবং সেনাপতিদের পিছনে থেকেও পরিষ্কার শুনতে পেলাম আমি।

আমি, রানি লসট্রিস, এই মিশরের শাসনকর্ত্রী এবং ফারাও মামোসের বিধবা পত্নী, যিনি ছিলেন ওই নামধারী অষ্টম ফারাও; আমার পরে যে এই দুই রাজ্য শাসন করবে–সেই রাজকুমার মেমননের মাতা, এই স্তম্ভ তৈরির নির্দেশ দিয়েছি…

পড়া শেষ হতে, জনতার দিকে ফিরে দুই হাত প্রসারিত করলেন রানি।

আমি আমার প্রতিজ্ঞা রেখেছি। তোমাদের নেতৃত্ব দিয়ে দেশের সীমান্তে পৌঁছে। দিয়েছি। আমার কাজ আজ শেষ হলো। একটুক্ষণের জন্যে বিরতি দিলো ও। আমার চোখে চোখ পড়তেই, মাথা নেড়ে উৎসাহ দিলাম। বলে চললো সে।

হে মিশরের অধিবাসী! সত্যিই, এই মূহুর্তে একজন সত্যিকারের ফারাও প্রয়োজন তোমাদের, যে নেতৃত্ব দিয়ে নিজ-বাসভূমে পৌঁছে দিবেন। আমি তোমাদের উদ্দেশ্যে পবিত্র ফারাও টামোসকে নেতৃত্বভার অর্পণ করলাম–যে স্বয়ং এই মিশরের রাজকুমার মেমনন। তিনি চিরজীবি হোন!

ফারাও চিরজীবি হোন! এক স্বরে চেঁচিয়ে উঠে পুরো জাতি। তিনি চিরজীবি হোন।

এক পা এগিয়ে নিজের জনগোষ্ঠীর সামনে দাঁড়ালেন ফারাও টামোস। খাপ থেকে কিংবদন্তির নীল তলোয়ার খুলে সালামের ভঙ্গিতে মেলে ধরলেন জনতার উদ্দেশ্যে।

পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনিত হলো তার কণ্ঠস্বর।

এই পবিত্র দায়িত্ব আমি মাথা পেতে নিলাম। আমার পুনরুজ্জীবনের নামে শপথ–আমার দেশ এবং তার অধিবাসীদের সেবায় জীবনের প্রতিটি দিন ব্যয় করবো। এই দায়িত্ব থেকে কখনো, কোনোমতেই পিছ পা হবো না–সমস্ত দেবতারা সাক্ষী।

*

বন্যা এসে গেলো। পানির স্তর উঁচু হয়ে জলপ্রপাতের প্রবেশমুখের পাথরশ্রেনী ঢেকে দিতে লাগরো। সবুজ থেকে ধূসরে পাল্টে গেলো পানির রঙ।

খাঁচায় বদ্ধ কোনো জানোয়ারের মতো ফুঁসে উঠলো জলপ্রপাত। তার ফেনা উপরের আকাশ আর চারিপাশ ঘিরে থাকা পাহাড় ছুঁতে চাইছে যেনো।

ক্রাতাস এবং ফারাও-এর সঙ্গে সামনের গ্যালিতে রইলাম আমি। নোঙর তুলে ফেলে জলস্রোতে ভেসে চললাম আমরা। প্রাণপণ মুঠিতে দাঁড় ধরে রাখলো যোদ্ধারা।

গলুইয়ে, রাজার পাশে থাকলো দুই দল নাবিক; সামনের পাথর খণ্ডে লগি দিয়ে ধাক্কা মেরে জাহাজের আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করবে তারা। পাটাতনের উপর জলপ্রপাতের মানচিত্র বিছিয়ে কাতাসের পাশে থাকলাম আমি, প্রতিটি বাঁকের আগে চিৎকার করে বলে দিচ্ছি। আসলে মানচিত্রের কোনো প্রয়োজন নেই আমার, সব মুখস্ত হয়ে গেছে। এছাড়াও, নদীপথের দ্বীপে বা তীরে আগেই পতাকা হাতে লোক মোতায়ান করে রেখেছিলাম, ওরা সতর্ক করে দিতে লাগলো।

খোলের নিচে দ্রুততর হলো স্রোতের বেগ, পিছনে এক নজর ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, পুরো বাহিনী এক সারিতে ভেসে চলেছে। আবার যখন সামনে তাকিয়ে দেখলাম, ভয়ে বুকের ভেতরটা যেনো খামচে ধরলো। ঠিক উনুনের মুখের মতো উন্মত্ত সামনের ঢালু প্রবেশ পথ।

প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চললো আমাদের গ্যালি। কেবল ভেসে থাকার জন্যে আলতো করে দাঁড় ছোঁয়াতে হচ্ছে পানিতে। এতো হালকাভাবে নদীর উপর দিয়ে ছুটে চলছিলাম, দাঁড় টানার কোনো প্রয়োজন নেই। তীরের কঙ্কালসার পাহাড় দ্রুত গতিতে পেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। ক্রাতাসের ঠোঁটের হাসি দেখে বুঝলাম, কঠিন বিপদ রয়েছে সামনে।

তিনটি দ্বীপ নদীর স্রোতধারাকে বিভক্ত করে ফেলেছে সামনে।

বামে থাকো! নীল পতাকার দিকে চাকা ঘোরাও। চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। এমন সময় পায়ের নিচে কেঁপে উঠলো পাটাতন, আঁকড়ে ধরে সামলে নিলাম আমি।

বনবন ঘুরছে আমাদের গলুই। ইতিমধ্যেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাথুরে দ্বীপের সঙ্গে সংঘর্ষে গুড়ো গুড়ো হতে যাচ্ছি আমরা আমি নিশ্চিত। এরপরই ধীরে সোজা হতে লাগলো গলুই।

ক্রাতাসের কর্কশ ভাষার নির্দেশে প্রাণপণ দাঁড় টেনে কোনোক্রমে সংঘর্ষ এড়ানো গেলো। আর একটা মাত্র বাঁক ঘুরলেই খাড়া পতন। পেটের ভেতরে শূণ্য অনুভূতি জলপ্রপাতের ধার থেকে নিচে খসে পড়লো আমাদের গ্যালি। নিচে পরে ভীষণ জলস্রোতে দিক হারিয়ে ঘুরতে শুরু করলো।

বামে টানা! চিৎকার করে বললো ক্ৰাতাস, দাড়ীদের উদ্দেশ্যে। প্রাণপণে টানো! জাহাজ স্থির হয়ে কোনোরকমে এগিয়ে গেলো পরের বাকের কাছে।

একবার মাত্র আমাদের খোল ঘষা গেলো নিচের পাথরে, পায়ের নিচে কেঁপে উঠলো পাটাতন। ভয়ে চিৎকার করতে পর্যন্ত ভুলে গেছিলাম। গলুইয়ে দাঁড়ানো নাবিকের দল রক্ষা করলো সে যাত্রা।

পিছনের প্রচণ্ড শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম, ধসে গেছে একটি গ্যালি। সাহস হলো তাকিয়ে দেখার, ওদিকে পরবর্তী বাকের কাছে চলে এসেছি আমরা। চারপাশের পানিতে ধ্বংসপ্রপাত গ্যালির ভাঙ্গা অংশ আর কালো কালো মাথা দেখা গেলো; ভীষণ স্রোতে পরে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিছু করার নেই ওদের জন্যে। নিজেদের প্রাণ নিয়ে ছুটছি আমরা ।

সেই ঘন্টায়, কত শতোবার যে মরলাম আর বাঁচলাম–গুনে শেষ করা যাবে না। অবশেষে, জলপ্রপাতের তলা থেকে শান্ত নদীতে পৌঁছুলো আমাদের গ্যালি।

উল্লাস করার ফুরসত নেই; সামনেই চিরপরিচিত গজ-দ্বীপ, নদীর দুই তীরে অনেক আপন সব স্থাপনা।

তীরন্দাজেরা! ধনুক হাতে তুলে নাও! রাজা টামোস হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন গলুইয়ে দাঁড়িয়ে। নীল পতাকা উত্তোলন করা হোক! ঢাক বাদকেরা আমার, আক্রমণের ছন্দ বাজাও!

গজ-দ্বীপের পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাক জাহাজ বহরের উদ্দেশ্যে ছুটে চললো আমাদের ছোট্ট বাহিনী। বেশিরভাগই বাণিজ্যিক, অথবা পরিবহন জাহাজ। এগুলো পেরিয়ে হিকসস্‌ গ্যালির উদ্দেশ্যে ধেয়ে গেলাম আমরা। মিশরীয় নাবিকদের দিয়ে নিজেদের গ্যালি সজ্জিত করেছে তারা, নদী সম্পর্কে যাদের জ্ঞান অসীম। কেবলমাত্র নৌ-অধিনায়কেরা হিকসস্, তাও এই মুহূর্তে তীরে আছে তারা। প্রাসাদে, প্রমোদপল্লিতে আরামরত।

গুপ্তচরদের মাধ্যমে আমরা জেনে গেছি, নৌবাহিনীর নেতার জাহাজ কোনটি। নিমিষে ওটার কাছে ভিড়ে বিশজন যোদ্ধা সহ লাফিয়ে চড়ে বসলো মেমনন।

হিকসস্‌ বর্বরদের থেকে মুক্তি! হুঙ্কার দিতে দিতে চললো তারা। আমাদের এই মিশরের পক্ষে এসো!

অবাক বিস্ময়ে তাদের দিকে চেয়ে থাকে মিশরীয় নাবিকেরা। একেবারে হকচকিয়ে গেছে তারা, বেশিরভাগের কাছেই কোনো অস্ত্র নেই। হিকসস্‌ অধিনায়কেরা এদের বিশ্বাস করতো না, কাজেই সমস্ত অস্ত্র জাহাজের নিচে তালাবদ্ধ প্রকোষ্ঠে আছে।

আমাদের বাহিনীর প্রতিটি গ্যালি একটি করে শত্রু জাহাজ দখল করে নিতে শুরু করেছে। প্রতিটি জাহাজের নাবিকদের প্রতিক্রিয়া হলো অভিন্ন। প্রথম বিস্ময়ের থাকা সামলে তারা প্রশ্ন করলো, কারা তোমরা?

উত্তর দিলো হাজারো কণ্ঠ। মিশরীয়! সত্যিকারের ফারাও টামোসের লোক আমরা। আমাদের সাথে এসো, হে দেশবাসী! বর্বরদের উৎখাত করি চলো?

হিকসস্‌ নেতাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো তারা। আমরা কিছু করার আগেই নিকেশ হয়ে গেলো সব ক টা।

মাতৃভূমির জন্যে! গর্জন করে উঠলো মিশরীয় নাবিকের দল। টামোসের জন্যে। মিশর আর টামোসের জয় হোক!

এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে বয়ে যেতে লাগলো সেই সুর। হিকসস্‌ পতাকা ছিঁড়ে ফেলে খুশিতে পাগলের মতো লাফাতে লাগলো আমাদের লোকেরা। অস্ত্রশালা খুলে, জাহাজের নিচ থেকে ধনুক আর তলোয়ার বিতরণ শুরু হলো।

এরপর, তীরে নেমে গেলো তারা। টেনে-হিঁচড়ে হিকসস্‌ যোদ্ধাদের বের করে এনে রক্তাক্ত লাশে পরিণত করতে লাগলো মিশরীয় জনতা। বন্দরের পানি লাল হয়ে গেলো রক্তে। রাজ্যের পথে পথে যতো সেনাসদর আছে, তার সবগুলোতে একে একে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো ঐক্যবদ্ধ মিশরীয় বীরেরা।

মিশর আর টামোসের জন্যে! তাদের কণ্ঠে ছিলো একই চিৎকার।

কোনো কোনো স্থানে জড়ো হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইলো হিকসস্‌ নেতারা। তখন ক্ৰাতাস আর মেমনন অভিজ্ঞ যোদ্ধাদের নিয়ে নেমে এলো সমরাঙ্গনে। দুই ঘণ্টার মধ্যে শহর দখর করে নিলাম আমরা।

বেশিরভাগ হিকসস্‌ রথ পরিত্যক্ত পড়ে আছে রাস্তায়। তবে অর্ধেক বাহিনী ইতিমধ্যেই পুব প্রবেশদ্বার পেরিয়ে বন্যাপ্লাবিত নিচু জমিনের উপর দিয়ে ছুটছে।

জাহাজ ছেড়ে চিরপরিচিত গলি-উপগলি ধরে ছুটলাম আমি। উত্তর খাম্বায় চড়ে সবচেয়ে ভালো দেখতে পাবো চারিদিকের অবস্থা। তিক্তমনে লক্ষ্য করলাম, পালিয়ে যাচ্ছে হিকসস্‌ রথ। প্রতিটি পালিয়ে যাওয়া রথের অর্থ হলো, ভবিষ্যতে এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে লড়তে হবে আমাদের। আর তাছাড়া, ঘোড়াগুলো চাই আমার । হঠাই পশ্চিমের পাহাড়ের পাদদেশে থেকে ছোট্ট একটা ধুলোর ঘূর্ণি নজরে পড়লো।

চোখের উপরটা আড়াল করে সেদিকে তাকালাম। ভিতরে ভিতরে দানা বাঁধছে উত্তেজনা। দ্রুত কাছে চলে আসছে ধুলোর মেঘ এখন আকৃতিগুলো পরিচিত মনে হচ্ছে।

হোরাসের কসম! ওটা রেমরেম! আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম আমি। বুড়ো যোদ্ধা ঠিকই উঁচু-নিচু পথের উপর দিয়ে নিয়ে এসেছে প্রথম রথ বহর। মাত্র দুই দিনের মধ্যে কেমন করে এটা পারলো সেভেবে কোনো কূলকিনারা পেলাম না। আমার ধারণা ছিলো, ওই পথে রথ চলাচল সম্ভব নয়।

চার সারিতে বিন্যস্ত হলো মিশরীয় রথ বহর। হুই আর আমি যথার্থ প্রশিক্ষণ দিয়েছি ওদের। চমৎকার ভাবে আক্রমণ শানালো রেমরেম। তখনো অর্ধেক পথ পেরোও নি হিকসস্ রথ। শত্রু চালকেরা তখনো টের পায় নি, তাদের ভোলা পাশ থেকে ধেয়ে আসছে মিশরীয় রথবহর। একেবারে শেষ মুহূর্তে রেমরেম-এর আক্রমণের প্রতুত্তর করতে চাইলো সে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। বরঞ্চ পালিয়ে গেলো ভালো করতো শক্ত রথবহর নেতা।

একটা ঢেউয়ের মতো তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো রেমরেম-এর দুরন্ত যোদ্ধারা। নীলের স্রোতধারায় খড়-কুটোর মতো উড়ে গেলো দখলদার বর্বরেরা। হিকসস্‌ ঘোড়গুলোকে অবশ্য ধরতে সক্ষম হলো রেমরেম। ওটা নিশ্চিত করে, নিচে শহরের দিকে তাকালাম আমি।

মুক্তির আনন্দে যেনো পাগল হয়ে গেছে জনতা। রাস্তায় নেচে নেচে হাতের কাছে পাওয়া সমস্ত নীল কাপড় উড়াতে লাগলো তারা নীল হলো ফারাও টামোসের রঙ। মেয়েরা নীল রঙের ফিতা দিয়ে সাজিয়েছে চুল, ছেলেরা কোমরে ঝুলিয়েছে নীল কোমড়বন্ধনী।

এখনো বিচ্ছিন্ন কিছু লড়াই চলছে এখানে সেখানে। শীঘ্রই অবশ্য স্মিমিত হয়ে গেলো তা–কল্লা হারালো হিকসস্‌ যোদ্ধারা। বেশ কিছু যোদ্ধা সমেত আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো একটি হিকসস্‌ সেনা ক্যাম্পে। মাংস পোড়ার গন্ধে ভারী হয়ে গেলো বাতাস।

লুটপাটও চলছিলো সমানে। রাস্তার ধারে মদের দোকান থেকে একের পর এক পাত্র চুরি করে নিয়ে গেলো ভবঘুরের দল।

আমার অবস্থান থেকে দেখতে পেলাম, তিনজন ছেলে মিলে একটা মেয়েকে টেনে নিয়ে চলেছে গলির ভিতরে । মেয়েটাকে শুইয়ে দিয়ে কোমড়ের স্কার্ট খুলে ফেললো তারা; দুই জনে মিলে ধরে রাখলো হাত-পা, তৃতীয়জন চড়ে বসলো মেয়েটার উপর। বাকি অংশ আর দেখতে পারি নি আমি।

হিকসস্‌দের শেষ প্রতিরোধ যতক্ষণে চুরমার করে দিয়েছে কাতাস এবং মেমনন, শহরের ভিতরের শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালালো ওরা। অস্ত্র হাতে রাস্তায় নেমে এলো মিশরীয় বাহিনী, লাঠির গুতোয় পরিস্থিতি শান্ত করার অভিপ্রায় পেলো।

ধর্ষণ এবং লুটপাটের সময় হাতে-নাতে ধরা পড়াদের জায়গার ফাঁসির আদেশ এবং শাস্তি পালিত হলো। তাদের শবদেহ গোড়ালিতে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো শহরের প্রধান ফটকে। রাত নামার আগেই স্বাভাবিক হয়ে আসলো পরিস্থিতি, নিঃস্ত ব্ধতা জেঁকে বসলো গজ-দ্বীপে।

ফারাও মামোসের প্রাসাদে নিজের আস্তানা গাড়লো মেমনন। একদা এটাই ছিলো আমাদের আবাসস্থল। প্রাসাদে প্রবেশ করেই সোজা হারেমের উদ্দেশ্যে চললাম আমি।

লুটপাটকারীরা এখানে প্রবেশ করতে পারে নি। যে বা যারাই ছিলো এখানে, আমার আঁকা দেয়ালচিত্রের পরিপূর্ণ মর্যাদা দিয়েছে সে বা তারা। জলবাগানে ফুটে আছে নানান রঙের চমৎকার ফুল, পুকুরে মাছের ঝাঁক।

মিশরীয় বুড়ো মালি আমাকে জানালো, যে হিকসস্‌ সেনাপতি ছিলো এখানে, মিশরীয় জীবনধারা পছন্দ করে ফেলেছিলো সে। নিজেও চেষ্টা করেছে সেই মান বজায় রাখার। তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

কয়েকদিনের মধ্যেই আমার কর্ত্রীর পছন্দমতো কক্ষগুলো গোছগাছ করে ফেললাম। এরপর, মেমননের কাছে গিয়ে রানিকে নিয়ে আসার অনুমতি চাইলাম আমি।

রাজ্যের শাসভার হাতে নেওয়ার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ইতিমধ্যেই চিন্তান্বিত হয়ে পড়েছে রাজা। এক বিষয়ে ভাবনা শেষ না হতে অন্য একটা জরুরি বিষয় এসে পড়ে। অবশ্য, আমাকে দেখে আলিঙ্গন করলো মেম।

সবকিছু ভালোয় ভালোয় হয়েছে, টাটা।

শুভ প্রত্যাবর্তন, ম্যাজেস্টি, আমি বললাম উত্তরে। কিন্তু অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে এখনো।

এ হলো আমার নির্দেশ–যখন এ রকম একা থাকবো আমরা দু জন, আমাকে মেম বলে ডাকবে তুমি। হাসলো ফারাও। ঠিকই বলেছো, এখনো অনেক কাজ বাকি। স্যালিতিস তার বাহিনীর নিয়ে অগ্রসর হওয়ার আগে খুব অল্প সময় আছে আমাদের হাতে। একটা খণ্ডযুদ্ধ জিতেছি আমরা। মূল লড়াই এখনো শুরুই হয় নি।

আর একটি দায়িত্ব পালন করতে পারলে দারুন আনন্দিত হবো, মেম। রানি মাতার জন্যে তার প্রকোষ্ঠ প্রস্তুত করেছি আমি নিজে। নদীর উজানে গিয়ে, তাকে কী গজ-দ্বীপে নিয়ে আসতে পারি আমি? মিশরের মাটিতে পা রাখার জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছে সে।

এই মুহূর্তে রওনা দাও, টাটা, নির্দেশ দিলো রাজা। রানি মাসারা কেও সাথে নিয়ে এসো।

নদীর পানি অনেক বেড়েছে। মরুর রাস্তাও বেশ কর্কশ। নীল নদের তীর ধরে দুই রানিকে বহনকারী পালকি কাঁধে করে বয়ে নিয়ে এলো একশ দাস। অবশেষে, জলপ্রপাতের এধারে, মিশরের সবুজ উপত্যকায় পা রাখলো তারা।

এ কোনো দৈবাৎ ঘটনা নয়, প্রথম যে স্থাপনা আমাদের সামনে পড়লো, তা ছিলো একটি মন্দির। আমি নিজেই এই পথে আসার পরিকল্পনা করেছিলাম।

কিসের শ্রাইন ওটা, টাইটা? পালকির পর্দা সরিয়ে বললো আমার কর্ত্রী।

এটা আকহ্-হোরাসের মন্দির, মিসট্রেস। প্রার্থনা করতে চাও তুমি?

ধন্যবাদ, ফিসফিস করে বললো ও। জানতো, আমিই নিয়ে এসেছি এই পথে।

আমার দেহের উপর ভর দিয়ে বহু কষ্টে পালকি থেকে নামলো লসট্রিস। ধীরে এগিয়ে ঢুকরো শান্ত বাতাসের সেই মন্দিরে।

একসঙ্গে প্রার্থনায় বসেছিলাম আমরা দু জন । আমি জানি, এই পৃথিবীতে যে দু টি প্রাণ তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো, তাদের প্রার্থনা সেদিন শুনেছিলো ট্যানাস। যাওয়ার আগে, সঙ্গের সমস্ত স্বর্ণ মন্দিরের পুরোহিতদের উদ্দেশ্যে দান করে গেলো আমার কর্ত্রী।

গজ-দ্বীপে, আমাদের প্রাসাদে যতক্ষণে পৌঁছুলাম, অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ও। প্রতিদিন তার পেটের ভেতরের সেই বস্তু বেড়ে চলেছে আকৃতিতে, শুষে নিচ্ছে ওর জীবনসূধা। জলবাগানে, বারজ্জায় একটা তাকিয়া টেনে ওকে বসতে দিলাম আমি। চোখ বন্ধ করে কিছুসময় নিঃসারে পড়ে রইলো মিসট্রেস। এরপর, চোখ খুলে নরম করে হাসলো আমার উদ্দেশ্যে। এখানে এক সময় কতো সুখের সময় কাটিয়েছি। আমরা, তাই না টাইটা? মৃত্যুর আগে কি আর থিবেস নগরীকে দেখতে পাবো না আমি? এর উত্তর নেই আমার কাছে। এমন কোনো প্রতিজ্ঞা কেমন করে করবো, যা আমার সাধ্যের ভেতর নেই।

যদি আগেই মারা যাই, প্রতিজ্ঞা করো, আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে পাহাড়ের উপরে কবর দেবে; যেনো উপর থেকে প্রিয়তম থিবেসকে সব সময় দেখতে পাই?

আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে এই শপথ করলাম তোমাকে, আমি বললাম উত্তরে।

*

পরবর্তী দিনগুলোতে আতন এবং আমি, আমাদের পুরোনো গুপ্তচরদের দলকে আরো সংগঠিত করতে লাগলাম উচ্চ-রাজ্যে। ফারাও মামোসের শাসনামলে যারা আমাদের হয়ে কাজ করেছে, তাদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। কিন্তু অনেকে আবার টিকেও আছে। স্বর্ণের লোভে, না হয় দেশপ্রেমের কারণে প্রতিটি শহর আর গ্রামে আমাদের হয়ে কাজ করলো অনেক তরুণ ছেলেরাও।

দ্রুতই, থিবেস-এ শত্রুর ঘাটিতে গুপ্তচর পেয়ে গেলাম আমরা। নিম্ন-রাজ্যের ডেল্টা থেকেও খবরাখবর আসতে লাগলো। তাদের কাছ থেকে পাওয়া সংবাদে জানা গেলো, বিভিন্ন শহর থেকে একত্র হচ্ছে হিকসস্‌ বাহিনী, একসঙ্গে এগিয়ে আসছে তারা। তাদের শক্তিমত্তা, দুর্বলতা, প্রতিটি বাহিনীর নেতাদের নাম জানা হয়ে গেলো আমাদের। আরো জানতে পারলাম, ঠিক কতোটি জাহাজ বা রথ রয়েছে হিকসস্‌ শিবিরে; নীল নদে বন্যার পানি কমে আসতে বিশাল সেই সেনাবাহিনী আর জাহাজ, রথ নিয়ে দক্ষিণে রওনা হওয়ার পরিকল্পনা করছে রাজা স্যালিতিস।

ফারাও টামোসের নামে বিভিন্ন বার্তা গোপনে হিকসস্‌ বাহিনীর মিশরীয় সৈনিকদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম আমি। আরো গুরুত্বপূর্ণ খবর আসতে লাগলো চারিদিক থেকে। কিছুদিনের মধ্যেই হিকসস্‌ বাহিনী থেকে একজন দু জন করে আমাদের দলে যোগ দিতে শুরু করলো মিশরীয় দেশপ্রেমিক সেনারা। সশস্ত্র অবস্থায় পুরো দুই বাহিনী তীরন্দাজ, নীল পতাকা হাতে যোগ দিলো আমাদের সাথে। তাদের কণ্ঠে ছিলো একই চিৎকার, টামোস! মিশর!

একশ হিকসস্‌ যুদ্ধ গ্যালির নাবিকেরা বিদ্রোহ শুরু করলো। নদীর উজানে, আমাদের সাথে যখন যোগ দিলো তারা, থিবেস বন্দর থেকে দখল করা বেশ কিছু নৌযান ছিলো তাদের সাথে । খাদ্য-শস্য, তেল, লবণ আর গাছের গুঁড়িতে বোঝাই ছিলো প্রতিটি শত্রু জাহাজ।

ততোদিনে জলপ্রপাতের নিচে নেমে এসেছে আমাদের পুরো বাহিনী। কেবল পোষ মানানো নৃ-দের ছোট্ট পাল ছাড়া। একেবারে শেষমুহূর্তের জন্যে ওগুলোকে রেখে দিয়েছি আমি। উত্তর খাম্বায় আমার অবস্থান থেকে নদীর দুই তীরে যেদিক চোখ গেলো, মাইলের পর মাইল ঘোড়ার সারি দেখা যায়। ক্যাম্পের ধোয়া আকাশে এঁকে বেঁকে উড়ে যাচ্ছে।

প্রতিটি দিনই ক্ষমতা বাড়ছিলো আমাদের। সমগ্র মিশরে যেনো উত্তেজনা আর প্রত্যাশার সুবাতাস বইছে। চারিদিকে স্বাধীনতার সুবাস। নতুন জাগরণ ঘটছে আমাদের এই কেমিট-এ। রাস্তায় রাস্তায়, গলি-উপগলিতে, ছাপড়ায়, পতিতাপল্লিতে, সুরার দোকানে শুধু স্বাধীনতার গান।

আতন আর আমি বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে থাকা সংবাদ এক করে ভিন্ন ছবি পেলাম। হিকসস্‌ দৈত্য নিজের গা ঝাড়া দিয়েছে এবারে, থাবা বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে। মেমফিস, এবং ডেল্টার সমস্ত শহর থেকে এগুতে শুরু করেছে স্যালিতিসের পদাতিক বাহিনী। প্রতিটি পথ তার রথে বোঝাই, নদীর পানিতে গিজগিজ করছে তার জাহাজ বহর। দক্ষিণে, থিবেস-এর পথে রয়েছে তারা।

আপাচান হিকসস্‌ বাহিনীর রথবহরের অধিনায়ক নিজে সমরাঙ্গণে না পৌঁছা পর্যন্ত অপেক্ষায় রইলাম আমি। থিবস-এ, শহরের দেয়ালের বাইরে তার ঘোড়া এবং রথ সমেত ক্যাম্প করবার সংবাদ পাওয়ার পর মিশরের সম্রাটের যুদ্ধ সভায় উপস্থিত হলাম।

সম্মানিত ফারাও, আমি জানতে পেরেছি এই মুহূর্তে শত্ৰু বহরে একশ বিশ হাজার ঘোড়া এবং বারো হাজার রথ রয়েছে। থিবেস-এ ঘাঁটি গেড়েছে তারা। আগামী দুই মাসের মধ্যে বন্যার পানি সরে গিয়ে তাদের আক্রমণের পথ উন্মুক্ত করে দেবে।

এমনকি, ক্ৰাতাসকে পর্যন্ত চিন্তিত দেখালো। এর চেয়েও খারাপ অবস্থায় লড়েছি–শুরু করেছিলো সে, কিন্তু রাজা থামিয়ে দিলেন তাকে।

ওর চেহারা দেখে বুঝতে পারছি, রাজকীয় আস্তাবলের পরিচালকের আরো কিছু বলার আছে। তাই না, টাইটা?

ফারাও সবসময় সঠিক, আমি একমত হলাম। জলপ্রপাতের ওপার থেকে আমার ন্যূ-এর পাল নিয়ে আসার অনুমতি চাইছি আপনার কাছে।

কর্কশ হাসে ক্ৰাতাস। সেথ্‌-এর টাক মাথার কসম! টাইটা, হিকসস্‌দের বিরুদ্ধে তোমার ওই হাস্যকর প্রাণী নিয়ে লড়তে চাও নাকি? বিনীতভঙ্গিতে তার কথার প্রত্যুত্তরে হাসলাম আমিও। তার অধীন জংলী শিলুকদের মতো ক্রাতাসের রসবোধও অত্যন্ত বাজে।

পরদিন সকালে আমি এবং হুই নদী ছেড়ে চললাম ন্যূ-এর পাল ফিরিয়ে আনতে। তততদিনে কেবল তিনশো প্রাণী রয়েছে আমাদের খোঁয়ারে, একদম পোৰা ঘোড়ার মতো আমাদের হাত থেকে খায় এখন ওরা। ধীরে, ওগুলোকে একত্র করে রওনা হলাম আমরা।

শুধু রেমরেম-এর উদ্ধার করা ঘোড়াগুলোকে আমার নির্দেশে আলাদা রাখা হয়েছিলো আমাদের ঘোড়াগুলো থেকে–কুশ দেশ থেকে যেগুলো নিয়ে এসেছিলাম আমরা। হুই এবং আমি একই আস্তাবলে ওগুলোর সাথেই রাখলাম ন্যূ-এর পাল। প্রথম কয়েক মুহূর্তের অস্বস্তি শেষে একসাথে মিশে গেলো দুই ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। রাতে একই খোয়ারে রাখলাম নূ্য এবং হিকসস্‌দের থেকে উদ্ধার করা ঘোড়াগুলো। হুইকে প্রহরায় রেখে, গজ-দ্বীপে রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলাম আমি।

এখন স্বীকার করি, সেই দিনগুলো চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটিয়েছিলাম। প্রাকৃতিক সেই মহামারীর উপর সমস্ত কিছু বাজী ধরেছিলাম, যা ছিলো মূলত এমন এক ঘটনা যার সবটুকু আমার কাছে পরিষ্কার ছিলো না। যদি এটা ব্যর্থ হয়, সংখ্যায় অনেক বেশি শত্রুর বাহিনীর মুখোমুখি হতে হবে আমাদের।

প্রাসাদের গ্রন্থাগারে আতনের সাথে স্ক্রোল নিয়ে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এমন সময় কর্কশ এক জোড়া হাতের ধাক্কায় জেগে উঠলাম। চিৎকার করছিলো হুই, উঠো, বুড়ো গর্দভ! উঠো! খবর আছে আমার কাছে!

নিচের মাঠে ঘোড়া নিয়ে এসেছে সে। নদী পেরুতেই, উধ্বশ্বাসে ঘোড়া দাবড়ালাম দু জন। চাঁদের আলোয় নদীর তীর ধরে আমাদের ঘোড়ার পালের কাছে ফিরে চললাম। আলো জ্বালিয়ে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছে রাখালেরা।

সাতটি হিকসস্‌ ঘোড়া ইতিমধ্যেই শায়িত অবস্থায় আছে, নাক-মুখ দিয়ে হলুদ পুঁজ বেরিয়ে আসছে সেগুলোর। দম বন্ধ করে মরার আগেই তাদের শ্বাসনালী কেটে প্যাপিরাসের নলখাগড়া ঢুকিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার বন্দোবস্ত করছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাখালেরা।

কাজ হয়েছে! উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে, আমাকে ঘিরে এক পাক নেচে নিলো হুই। হলুদ-ফাঁস! কাজ হয়েছে ওটায়! কাজ হয়েছে।

আমি তো ভেবেছিলাম ওটা, তাই না? গম্ভীরভাবে তার উদ্দেশ্যে বললাম আমি। অবশ্যই কাজ হয়েছে এতে।

আজকের দিনটির জন্যেই নদীর ধারে নোঙর করে ফেলে রাখা হয়েছে জাহাজগুলো। ওগুলোতে চড়ে দাঁড় টেনে উত্তরে রওনা হলাম আমরা। পঞ্চাশজন দাড়ীর প্রাণান্ত পরিশ্রমে, এবং পিছনে অনুকূল বাতাস পেয়ে তরতর করে থিবেস-এর উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললো গ্যালি। আপাচানের জন্যে মূল্যবান উপহার নিয়ে যাচ্ছি আমরা।

*

কম-ওম্বোতে পৌঁছুনোর সাথে সাথে নীল পতাকা নামিয়ে নিলাম আমরা। হিকসস্‌দের পতাকা উত্তোলন করা হলো জাহাজের মাস্ট হেডে। গ্যালির বেশিরভাগ নাবিকই ছিলো হিকসস্‌ শাসনের বন্দী। এদের মধ্যে কেউ কেউ এমনকি অনর্গল বিদেশী বর্বরদের

ভাষায় কথাও বলতে পারে। কম-ওম্বো থেকে দুই রাত পর, একটি হিকসস্‌ গ্যালি তেড়ে এলো আমাদের জাহাজ দেখতে পেয়ে। পাশেই থেমে, পরীক্ষা করে দেখার জন্যে একটা দল পাঠালো তারা আমাদের নৌযানে।

প্রভু আপাচানের রথের জন্যে ঘোড়া নিয়ে এসেছি, আমাদের অধিনায়ক জানালো তাদের। তার বাবা ছিলো হিকসস্ কিন্তু মা সম্ভ্রান্ত মিশরীয় মহিলা। খুবই আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে কথা বলে গেলো সে। দায়সারা গোছের পর্যবেক্ষণ শেষে আমাদের যেতে দিলো হিকসস্ গ্যালি। থিবেস-এ পৌঁছানোর আগে আরো দুইবার তল্লাশির সম্মুখীন হয়েছিলাম আমরা। প্রতিবারই আমাদের অধিনায়ক বোকা বানাতে সক্ষম হলো হিকসস্‌ নেতাদের ।

ততক্ষণে আমার একমাত্র দুশ্চিন্তা ঘোড়াগুলোর অবস্থা নিয়ে। আমাদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, মারা যাচ্ছে ওগুলো। অর্ধেক প্রাণী অবশ্য বেঁচে আছে করুণ হালে। লাশ পানিতে ফেলে এগিয়ে চললাম আমরা।

আমার প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিলো থিবেস বন্দরে নিয়ে ঘোড়াগুলোকে বিক্রি করে দেয়া। কিন্তু এমন অবস্থায় কেউ ঘোড়া কিনতে সম্মত হবে না। কাজেই, অন্য চিন্তা করলাম হুই এবং আমি।

ঠিক সূর্যাস্তের সময় থিবেস-এ পৌঁছুনোর বন্দোবস্ত করা হলো। পরিচিত স্থাপনা দেখতে পেয়ে কেমন যেনো করে উঠলো বুকের ভেতরটা। মন্দিরের দেয়াল দিনের শেষ সূর্যরশিতে চমকাচ্ছে। ইনটেফের জন্যে আমার তৈরি করা তিনটি খাম্বা এখনো আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। হোরাসের আঙুল বলা হয় ওই তিনটিকে।

পশ্চিম তীরে রয়েছে মেমননের প্রাসাদ, অর্ধ-সমাপ্ত রেখে গিয়েছিলাম ওটা; হিকসসেরা নিজেদের মতো করে নির্মাণকাজ শেষ করেছে। এমনকি আমি পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হলাম, এশীয় ধাচের নির্মাণশৈলী চমৎকার। ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু আলোয় পেঁচানো সিঁড়িকোঠা, প্রহরী-পিঠ কেমন রহস্যময় আভিজাত্য এনে দিয়েছে প্রাসাদের ভবনে। যদি মিসট্রেস এই মুহূর্তে উপস্থিত থাকতো ভেবে আফসোস হলো। বহুদিন ধরে এখানে আসার জন্যে প্রাণ আনচান করছে তার।

শহরের দেয়ালের বাইরে বিশাল ঘোড়ার পাল, রথ আর লোকজনের উপস্থিতি চোখে পড়লো। যদিও আগে থেকেই জেনে গেছিলাম, আপচান তার বাহিনী নিয়ে অপেক্ষায় আছে সেখানে, নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না, সংখ্যায় এতো বেশি পরিমাণে তারা । আমার ভেতরটা যেনো দমে গেলো।

এমন শত্রুর সঙ্গে জিততে হলে দেবতাদের সমস্ত কৃপা প্রয়োজন হবে আমাদের, সামান্য ভাগ্য এদের বিরুদ্ধে কোনো কাজেই আসবে না। দিনের শেষ আলোয় একে একে জ্বলে উঠতে লাগলো হিকসস্‌ ক্যাম্পের আগুন-যেনো তারার মেলা বসেছে। এর যেনো কোনো শেষ নেই- দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত।

কাছাকাছি চলে আসতে গন্ধ পেলাম আমরা। ক্যাম্প ফেলা সেনাবাহিনীর গন্ধ একেবারেই স্বতন্ত্র। বিভিন্ন ব্রানের এক মিশ্রণ এটা-রান্না-বান্না, নতুন কাটা খড়, ঘোড়ার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ, উন্মুক্ত ময়দানে ত্যাগ করা মানুষের বিষ্ঠার, চামড়া এবং পিচ-এর, ঘোড়ার ঘাম আর কাঠের পাত্র রাখা মদের গন্ধ সব মিলেমিশে একাকার। হাজার হাজার মানুষ গায়ে গায়ে লেগে থাকা তাঁবুতে আস্তানা গেড়েছে এরা।

আরো এগিয়ে চললো আমাদের জাহাজ। দূর থেকে ভেসে আসতে লাগলো নানান শব্দ। ঘোড়ার হেষারব, ধাতুর অস্ত্রের ঝনঝনানি, প্রহরীদের চিৎকার, তর্ক-বিতর্ক, হাসি-ঠাট্টা, গানের শব্দ।

নেতৃত্বে থাকা গ্যালির অধিনায়কের সঙ্গে দাঁড়িয়ে পুব তীরে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলাম আমি। শহরের দেয়ালের বাইরে কাঠ-বণিকদের ঘাটে নিয়ে চলেছি আমাদের জাহাজগুলো। ওখান থেকে ঘোড়ার পাল নামানো সহজ হবে।

বন্দরের প্রবেশমুখ চিহ্নিত করলাম, দাঁড়ের টানে ধীরে ভেসে চললাম আমরা। ঠিক আমার স্মৃতির মতোই আছে জাহাজ-ঘাটা। কাছাকাছি এসে পড়তেই শশব্যস্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো বন্দরের কর্তৃপক্ষ কাগজ-পত্র পরীক্ষা করে দেখবে তারা।

তার সামনে ঝুঁকে সম্মান দেখালাম আমি। সম্মানিত প্রভু। দারুন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। বাতাসে উড়ে পানিতে পড়ে গেছে আমার কাগজ, সেথ-এর চাল কোনো সন্দেহ নেই!

রাগে ফেটে পড়লো লোকটা। কিন্তু স্বর্ণের একটা আংটি তার হাতে গুঁজে দিতেই হাসিমুখে বিদায় নিলো সে।

একজন রাখাল পাঠিয়ে ঘাটের মশালগুলো নিভিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করলাম আমি। কোনো উৎসাহী চোখের সামনে ঘোড়ার পাল নামাতে চাই না। বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে প্রাণীগুলো, নাক-মুখ থেকে শ্লেষা ঝরছে। বাধ্য হয়ে ঘোড়াগুলোর মাথার চারপাশে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হলো। শেষমেষ, মাত্র একশ ঘোড়া পাওয়া গেলো যেগুলো হাঁটার ক্ষমতা রাখে।

ওয়াগন রাস্তা ধরে উঁচু জমিনের উদ্দেশ্যে চললাম আমরা। গুপ্তচরদের খবর অনুযায়ী, ওখানেই রয়েছে হিকসস্‌ ঘোড়ার মূল পাল। হিকসস্‌দের প্রথম রথবাহিনীর গুপ্তবাক্যও জানিয়েছে আমাদের চরেরা; সঙ্গে আসা মিশরীয় নাবিকেরা চিৎকার করে প্রহরীর প্রশ্নের প্রতুত্তর করলো।

শত্রু বাহিনীর অভ্যন্তরে ঘোড়ার পাল নিয়ে ঘুরে ফিরলাম আমরা। চলার উপরই একটি একটি করে ঘোড়া ছেড়ে দিতে শুরু করলাম শত্রু আস্তাবলে। বিশটি হিকসস্‌ রথবহরে একে একে ছাড়া হলো ঘোড়ার পাল। এতো সহজ-স্বাভাবিকভাবে ঘুরে ফিরলাম আমরা কেউ কোনো বাধা দিলো না। এমনকি, শত্রু রাখালদের সাথে ঠাট্টা তামাশায়ও মেতে উঠলো আমাদের নাবিকেরা।

পুব দিগন্তে যতক্ষণে দিনের প্রথম রশ্মি ফুটে উঠতে শুরু করেছে, কাঠ-বণিকদের জাহাজ-ঘাটে ফিরে এসেছি আমরা ততক্ষণে। একটি মাত্র গ্যালি আমাদের অপেক্ষায় আছে। অসুস্থ ঘোড়ার পাল নামিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে ফিরে গেছে বাকি নৌবহর।

জাহাজে চড়ে বসলাম আমরা। হুই আর রাখালেরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো বিছানায়। তরুণ সূর্যালোকে প্রিয় থিবেসকে যতোক্ষণ দেখা গেলো, জাহাজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি।

দশদিন পর, গজ-দ্বীপের বন্দরে নোঙর করলাম আমরা। ফারাও টামিেসকে অভিযানের খবর জানিয়েই ছুটলাম হারেমে। বারাজ্জার ছাউনির নিচে শুয়ে ছিলো আমার কর্ত্রী। এতো ফ্যাকাসে, এতো রুগ্ন দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো আমার। আমাকে দেখতে পেয়ে কেঁদে ফেললো লসট্রিস।

তোমাকে অনেক মনে পড়েছে, টাইটা। আর মাত্র অল্প সময় একসাথে থাকতে পিরবো দু জন।

*

নীল নদের পানি নেমে গেছে। বন্যা প্লাবিত জমিন আবার দেখা দিলো পানির নিচ থেকে। গাঢ়, ঘন পলি পড়ে আছে ওগুলোর উপর। ধীরে ধীরে শুকিয়ে আসলো এক সময়ের জলমগ্ন রাস্তা–উত্তরের যোগাযোগ আবারো শুরু হলো। অল্প দিনের মধ্যেই বীজ বপনের সময় এসে যাবে, এসে যাবে যুদ্ধের সময়ও।

আতন এবং আমি উদ্বিগ্ন মনে উত্তরের বিভিন্ন গুপ্তচরের খবরাখবর শুনতে লাগলাম। আমাদের আকাঙ্ক্ষিত সংবাদ এলো অবশেষে, যার জন্যে এতো প্রার্থনা আর অপেক্ষা। উত্তরে বাতাসে প্রায় উড়ে আসা একটা ফেলুচা সেই সংবাদ বয়ে নিয়ে এলো। রাতের তৃতীয় প্রহরে পৌঁছুলো বার্তাবাহক-তখনো প্রদীপ জ্বালিয়ে কাজ করছিলাম আমি এবং আতন।

ময়লা প্যাপিরাসের টুকরোটা রাজকক্ষে নিয়ে চললাম আমি। যে কোনো সময়ে আমাকে প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়ার নির্দেশ দেওয়া আছে প্রহরীদের। কিন্তু রাণী মাসারা রাজার শয্যাকক্ষের প্রবেশদ্বারে আমার পথ আগলে দাঁড়ালো।

এখন ওকে জাগাতে দেবো না আমি, টাইটা। রাজা ক্লান্ত। পুরো মাসের মধ্যে কেবল আজ রাতেই একটু ঘুমোতে পেরেছে ও।

মহারাণী, আমাকে তার সাথে দেখা করতেই হবে। সরাসরি তারই নির্দেশে

যখন তর্ক করছিলাম আমরা, ভারী একটা তরুণ কণ্ঠস্বর পর্দার ওপাশ থেকে সাড়া দেয়। কে ওটা, টাটা নাকি? একপাশে সরে গেলো পর্দা। নগ্ন দেহে সামনে এসে দাঁড়ালেন রাজা। তার মতো সুঠাম দেহের পুরুষ আমি খুব কম দেখেছি শক্ত, হালকা-পাতলা, নীল সেই তলোয়ারের মতোই ধারালো; পৌরুষের আভিজাত্য শরীরে। নিজের অপ্রাপ্ততা নিয়ে আরো একবার কুণ্ঠিত হয়েছিলাম সে রাতে।

কী হয়েছে, টাটা?

উত্তর থেকে বার্তা এসেছে। হিকসস্‌ ক্যাম্প থেকে। তাদের এলাকায় এক অদ্ভুত মহামারী দেখা দিয়েছে। অর্ধেক ঘোড়া ইতিমধ্যেই মারা গেছে, প্রতিদিন আরো হাজারে হাজারে প্রাণী আক্রান্ত হয়ে পড়ছে।

তুমি একজন জাদুকর, টাটা। কেমন করে তোমার ন্যূ-এর পালকে উপহাস করেছিলাম আমরা। আমার কাঁধ আঁকড়ে ধরে, সরাসরি চোখে তাকালো মেমনন। চলো, যাবে আমার সাথে বিজয়ের পথে?

আমি তৈরি, ফারাও।

তবে অজেয় আর শেকলকে রথে জুড়ো। উঁড়িয়ে দাও নীল নিশান। বাড়ি ফিরছি আমরা– থিবেস-এ।

*

কাজেই, একশ দরোজার নগরী থিবেস-এর সামনে চার বাহিনী রথ এবং ত্রিশ হাজার পদাতিক সৈন্য নিয়ে পৌঁছুলাম আমরা। রাজা স্যালিতিস-এর বাহিনী আমাদের সামনে; অসংখ্য শত্রু সৈন্যের পিছনে থেকে হোরাস যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাদের। প্রথম সূর্যালোকে ঝকমক করছে থিবেস-এর দেয়াল। আমাদের সামনে প্যাঁচ খুলতে থাকা বিশাল অজগরের মতো সারির পর সারি হিকসস্‌ বহর বিন্যস্ত হচ্ছে। চকমক করছে তাদের বর্শার ডগা, তরুণ সূর্যালোকে জ্বলছে তাদের সোনালি শিরস্ত্রাণ।

আপাচান আর তার রথবহর কোথায়? রাজা জানতে চাইলেন। নদীর ধারেই স্থাপিত হোরাসের আঙুলের দিকে চাইলাম আমি। উঁচু সেই টাওয়ারের মাথায় বিন্দু বিন্দু কাঠামো চোখে পড়ছে।

আপাচানের পাঁচ বহর রথ রয়েছে কেন্দ্রে, আরো ছয় বাহিনী মজুদ রেখেছে সে বিপদের কথা ভেবে। শহরের দেয়ালের ওপারে আছে তারা। লম্বা টাওয়ারের উপরে আমার গুপ্তচরদের উত্তোলন করা পতাকা সংকেতের পাঠোদ্ধার করে বললাম।

এতো কেবল এগারো বাহিনী হলো, টাটা, রাজা উন্মা প্রকাশ করলেন। আমরা জানি, বিশটি বাহিনী আছে তার। বাকিরা কোথায়?

হলুদ-ফাঁসে মরেছে, উত্তরে জানালাম আমি।

হোরাসের কসম! তোমার কথাই যেনো সত্যি হয়। আমরা ধারণা, আপাচান আমাদের জন্যে কোনো একটা বিস্ময় উপহার দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। আমার কাঁধ ছুঁলো মেমনন। এখন আর কিছু করার নেই, টাটা। দেবতাদের সাহায্য কামনা করে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া গতান্তর নেই এখন।

লাগাম আঁকড়ে ধরে সেনাবাহিনীর সামনে রথ চালিয়ে নিলাম আমি। নিজের বাহিনীর কাছে উপস্থিতি জাহির করছেন রাজা। তার উপস্থিতিতে সাহস বাড়বে তাদের, জান দিয়ে লড়বে তারা। সারি সারি রথ বহরের সামনে দিয়ে রথ ছুটিয়ে নিলাম আমি। অজেয় আর শেকল ঘেমে নেয়ে উঠলো । স্বর্ণের পাতার মতো করে নকশা করা হয়েছে। রাজকীয় রথের।

প্যাপিরাসের পাতার মতো পাতলা করে তৈরি করা হয়েছে স্বর্ণের পাতগুলো। কাজেই মাত্র এগারো ডেবেন স্বর্ণের ওজন হয়েছে রথের, অত্যন্ত দ্রুতগামী। বন্ধুই হোক বা শত্রু দেখামাত্রই যে কেউ বুঝে নেবে এটা ফারাও-এর রথ। আমাদের মাথার উপরে বাতাসে পতপত করে উড়ছে নীল পতাকা। হর্ষধ্বনিতে মুখর হয়ে হুঙ্কার দেয় সৈনিকেরা।

প্রত্যাবর্তন অভিযান যেদিন শুরু হয়েছিলো সেই কেবুই-এ, সেদিনই থিবেস-এ হোরাসের মন্দিরে পূজো না দেওয়া পর্যন্ত চুল না কাটার পণ করেছি আমি। এখন কোমড় পর্যন্ত লম্বা হয়েছে ওগুলো। ইন্দুস নদীর ওপার থেকে আমদানি করা হেনায় ওগুলোকে রাঙিয়েছি আমি। শ্বেত-শুভ্র লিনেনের আঁটো জামা কোমড়ে, নগ্ন বুকে ঝুলছে প্রশংসার স্বর্ণ শেকল। কোনো প্রসাধনি বা গহনা পরি নি গায়ে ।

বাহিনীর কেন্দ্রে থাকা শিলুক বর্শাধারীদের সামনে চলে এলাম আমরা। রক্তপিপাসু এই বর্বরেরা আমাদের বাহিনীর বড়ো সম্পদ। ফারাও-এর রথ এগিয়ে যেতে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো তারা, কাজান! ট্যানাস! কাজান! টামোস! জলপ্রপাতের ফেনার মতোই সাদা তাদের মাথার অসট্রিচের পালক। বর্শা উঁচিয়ে রাজাকে সালাম জানালো তারা। সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার উদ্দেশ্যে চেঁচালো ক্ৰাতাস। হাজার কণ্ঠের শোরগোলো হারিয়ে গেলো তার কথা, কিন্তু ঠোঁটের নড়াচড়া থেকে বুঝলাম, ও বলছে, আজ রাতে, থিবেস-এ মদ পান করে মাতাল হবো আমরা দুজন। বুড়ো জোচ্চর কোথাকার!

সারি সারি শিলুক বাহিনী সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে। চমৎকার প্রশিক্ষণ দিয়েছে কাতাস ওদের। লম্বা বর্শা ছাড়াও ভারী গোলক বহন করছে তারা, চামড়ার ফিতে আর কাঠের তৈরি গুলতি রয়েছে সেগুলোকে ছুঁড়ে দেওয়ার জন্যে। বাহিনীর সামনে মাটিতে কাঠের প্রতিবন্ধক পুঁতে রেখেছে শিলুকেরা। ওই বাধা পেরিয়ে আসতে হবে শক্র রথ বহরকে।

তাদের পিছনেই রয়েছে মিশরীয় তীরন্দাজেরা। সুযোগ পেলেই সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণে যাবে, নয়তো পিছিয়ে আসা বাহিনীকে তীরের বৃষ্টি দিয়ে প্রতিরক্ষা প্রদান করবে তারা যখন যেটার প্রয়োজন। প্রান্ত-বাঁকানো ধনুক মাথার উপর তুলে ধরে ফারাও-এর উদ্দেশ্যে সম্মান জানায় তারা। টামোস! মিশর এবং টামোস!

নীল যুদ্ধ-মুকুট পরেছেন ফারাও, স্বর্ণের বৃত্তাকার ইউরিয়াস ভ্র-এর চারপাশে। দুই রাজ্যের প্রতীক, শকুন এবং কোব্রার জড়াজড়ি করে থাকা অবয়ব জ্বলছে সেখানে। নীল তলোয়ারের মুক্ত ফলা খাড়া রেখে সৈন্যদের অভিভাদনের প্রত্যুত্তর করলেন তিনি।

বাম ধারের দিকে রথ ঘুরিয়ে নিলাম এবারে আমরা। ফিরে যাওয়ার আগে আমার কাঁধে হাত রেখে রথ থামলো মেমনন। এক মুহূর্তের জন্যে পিছনের মাঠের দিকে তাকালাম দু জন। ইতিমধ্যেই সামনে এগুতে শুরু করেছে হিকসস্‌ বাহিনী। আমাদের দ্বিগুন আকৃতির তাদের সম্মুখসারি ।

তোমার নিজের কথা টাটা, আউড়ালো মেমনন।  শত্রুরা এগিয়ে আসার আগে সতর্ক প্রতিরক্ষা, এরপর দ্রুত, ভয়ঙ্কর আক্রমণ । 

তোমার জ্ঞানার্জন যথার্থ হয়েছে, মহান ফারাও।

এতে কোনো সন্দেহ নেই, আমরা সংখ্যায় অনেক কম। প্রথমে, আপাচান তার পাঁচ বহর রথ পাঠাবে–আমার ধারণা।

আমি একমত, মেম। কিন্তু আমরা আমাদের কাজ জানি, নয় কি? তার ইশারায় পিছনে, আমাদের রথ বহরের কাছে ফিরে চললাম।

প্রথম রথবহরের নেতৃত্বে আছে রেমরেম, আসূতেস দ্বিতীয়টির, লর্ড আকের তৃতীয় বাহিনীর দায়িত্বে আছে। সদ্য দশ হাজারের সেরা উপাধিপ্রাপ্ত, হুই রয়েছে চতুর্থ বাহিনীর নেতৃত্বে। দুই বাহিনী শিলুক আমাদের মালামাল এবং বাড়তি ঘোড়ার দায়িত্বে আছে।

বেজে উঠলো রণ দামামা।

শুরু হলো, সামনের দিকে হাত তুলে দেখালো মেমনন। ধুলোর ঘূর্ণি তুলে ছুটে আসতে শুরু করেছে হিকসস্‌ রথবহর। আপাচান তার প্রথম চাল চেলেছে।

আমাদের বাহিনীর দিকে ফিরে তাকালাম। নিজের তলোয়ার উঁচু করে ধরে রেমরেম। প্রথম বাহিনী তৈরি, ম্যাজেস্টি। ব্যগভঙ্গিতে বলে সে। কিন্তু তাকে উপেক্ষা করে লর্ড আকেরের উদ্দেশ্যে ইশারা করলো মেমনন। চার সারিতে বিন্যস্ত হয়ে সামনে এগিয়ে গেলো তৃতীয় রথবহর। ফারাও রইলেন নেতৃত্বে।

ভারী, কারুকার্যখচিত হিকসস্‌ রথ গড়িয়ে এগিয়ে আসে, ঠিক আমাদের সারির কেন্দ্রে নিশানা করেছে তারা। সামনে, তাদের বাধা দিতে এগিয়ে যায় মেমনন, বিশাল শত্রু সৈন্য এবং আমাদের সংখ্যায় কম বাহিনীর মধ্যখানে। এরপর, তার নির্দেশে, শত্রু বাহিনীর উদ্দেশ্যে সজোরে রথ হাঁকালাম আমরা। অবস্থাদৃষ্টে আত্মহত্যারই নামান্তর মনে হলো এই ধাওয়া।

এগিয়ে যাওয়ার মাঝেই, হিকসস্‌দের উদ্দেশ্যে তীরের ঝাঁক বর্ষণ শুরু করলো আমাদের তীরন্দাজেরা। তীরের আঘাতে হুড়মুড় করে ঘোড়া উল্টে পড়তে শত্রু বহরের সামনের সারিতে ফাঁকা স্থান তৈরি হতে লাগলো। শেষমুহূর্তে, বাতাসে নাড়া খাওয়া ধোয়ার পর্দার মতো অনায়াসে ঘুরে গেলো আমাদের রথ বহর। অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতি এবং ভালো প্রশিক্ষণ পাওয়া আমাদের রথ চালকেরা নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করলো আরো একবার। শত্রু বহরের সামনের সারির ফাঁক গলে ভিতরে ঢুকে পড়তে লাগলো তারা। সব রথ অবশ্য সেই ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে পারলো না, কিছু কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো উল্টে গিয়ে, তবে প্রতি পাঁচটির চারটিকে বাঁচাতে সক্ষম হলো লর্ড আকের।

হিকসস্‌ বাহিনীর পিছনে চলে এসেছি এখন আমরা। পুরো এক পাক ঘুরে, অপেক্ষাকৃত দ্রুত গতি কাজে লাগিয়ে আবারো পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমাদের রথ বহর। তীরের বৃষ্টি দিয়ে সহযোগিতা করে চললো তীরন্দাজ বাহিনী।

সামনে থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে হিকসস্‌ রথে; তাদের তীরন্দাজেরাও পাদানীর সম্মুখ দিকে তীর ছুঁড়তে পারে শুধু। দ্বিধা ছড়িয়ে পড়লো তাদের মাঝে, তাড়া খেয়ে পিছন ফিরে আমাদের সামনা-সামনি মোকাবেলা করতে চাইলো কোনো কোনো চালক; পাশের সহযোগী রথের সাথে সংঘর্ষ ঘটলো তাদের। কাছাকাছি ঘোড়ার পায়ে সেঁধিয়ে যেতে থাকলো ভয়ঙ্কর ঘুরন্ত ফলা–হেরব করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো অসহায় জানোয়ারগুলো ।

মেমননের নির্দেশে হিকসস্‌দের তাড়া করে শিলুক বাহিনীর সামনে মাটিতে গাঁথা প্রতিবন্ধকের উদ্দেশ্যে নিয়ে চললাম আমরা। ভয়ঙ্কর ধারালো সেই কাটা যুক্ত পিপের সামনে পরে খোঁড়া বা পঙ্গু হলো অর্ধেক হিকসস্‌ ঘোড়া। যেগুলো বেঁচে গেলো, তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো শিলুকেরা হাতে গুলতি, বর্শা নিয়ে হিংস্র আক্রোশে হুঙ্কার ছেড়ে শত্রুর কচুকাটা শুরু হলো।

এখনো অক্ষত রথবহর এবারে শিলুক বাহিনীর দিকে ধেয়ে যায়। কিন্তু লম্বা, কালো অবয়বের এই জংলীগুলো এক একজন দক্ষ শরীর কসরকারী। চলন্ত রথের পাদানীতে এক লাফে চড়ে বসে তারা, হাতের ছোরা আর বর্শা দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকে রথ-চালক আর তীরন্দাজদের। অনায়াস দক্ষতায় প্রথম বহর রথ গিলে নিলো যেনো তারা।

রথ বহরের আক্রমণের সাহায্যে সামনে এগিয়ে এসেছিলো হিকসস্‌ বর্শধারীরা। এবারে অরক্ষিত হয়ে পড়লো তারা। লাগাম ছেঁড়া ঘোড়া বা পালিয়ে যাওয়া রথ তাদের উপর চড়াও হলো, উপায়ান্তর না দেখে পিছু হটতে শুরু করলো তারা। যুদ্ধের ময়দানের মাঝখানে এলোমেলো ভাবে ছুটলো।

সুযোগটা নিলো মেমনন। লর্ড আকেরের ঘোড়াগুলোকে ফিরে আসার নির্দেশ দিলো সে। ও আর আমি জায়গা বদল করলাম এবারে। দ্রুততার সাথে নতুন ঘোড়া

জুড়ে দেওয়া হলো রথে। বাহিনীর পিছনে ছয়হাজার তাজা ঘোড়া তৈরি আছে আমাদের। হিকসস্‌দের কয়টি ঘোড়া হলুদ-ফাঁস থেকে বেঁচে ফিরে তৈরি আছে তাই নিয়ে ভাবলাম আমি।

আবার যখন সামনে এগিয়ে গেলো আমাদের রথ, রেমরেম চিৎকার করে আবেদন জানালো, মহান ফারাও! প্রথম বহর! আমার প্রথম বহরকে আক্রমণের অনুমতি দিন!

তাকে উপেক্ষা করে আসতেস-এর উদ্দেশ্যে ইশারা করলেন ফারাও। আমাদের রথের পিছনে এক সারিতে ছুটে এলো দ্বিতীয় রথ বহর।

তখনন, মাঝ ময়দানে জটলা পাকিয়ে আছে বর্বর হিকসস্‌ বাহিনী। অভিজ্ঞ সমরনায়কের চোখে তাদের বাহিনীর অপেক্ষাকৃত দুর্বল বাম কোণা চিহ্নিত করলো মেমনন।

দ্বিতীয় রথ বহর আক্রমণে এগোও! ছুটে চলো! এগোও?

দুর্বল শত্রু সারিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা। ঝাঁকে ঝাঁকে রথ এগিয়ে গিয়ে ছিঁড়ে ফালাফালা করতে থাকে শত্রুর প্রতিরোধ। ওদিকে তাদের ডান কোণা তখনো আক্রমণে এগিয়ে চলেছে। কেন্দ্রের দিকে অবিন্যস্ত হয়ে পড়েছে হিকসস্‌ বাহিনী। তৃতীয় রথ বহর একত্র করে শত্রু বাহিনীর কেন্দ্রের দিকে লেলিয়ে দিলো এবারে মেমনন।

আক্রমণে যাওয়ার প্রাক্কালে শহরের উপরে চোখ বুলিয়ে নিলাম পিছনে তাকিয়ে। ধুলোর কারণে দৃষ্টি চলেনা, কিন্তু হোরাসের আঙুলের চূড়ায় সাদা পতাকা ঠিকই দেখতে পেলাম আমি।

ফারাও! চিৎকার করে পিছনে দেখলাম। দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে পূর্ণোদ্যমে ছুটে আসছে নতুন এক শত্রু রথ বহর, ঠিক যেনো কালো পিঁপড়ের দল।

আপাচান তার সংরক্ষিত বাহিনী পাঠিয়েছে শেষ রক্ষার জন্যে। মেমনন চিৎকার করে উঠে। আর এক মুহূর্ত! এরপর তাকে পেয়ে যাবো আমরা ভালো দেখিয়েছে, টাটা!

পদাতিক বাহিনীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম আমরা। আপাচানের রথ বহরের মোকাবেলা করতে ছুটলাম। ভাঙাচোরা রথ আর আহত-নিহত ঘোড়া এবং মানুষের জটলার উপর দিয়ে পরস্পরের দিকে ছুটলো দুই বাহিনী। কাছাকাছি এসে পড়তে, পাদানীর উপর দাঁড়িয়ে সামনে তাকালাম আমি। কিছু একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে শত্রু রথ বহরে। এরপরই বিষয়টা বুঝতে পারলাম।

ফারাও! চেঁচিয়ে উঠলাম। ঘোড়াগুলো দেখুন! অসুস্থ ওগুলো! আগুয়ান শত্রু রথের ঘোড়াগুলোর বুকে মাখামাখি হয়ে আঝে হলুদ পুজ, শ্লেষা। নাক-মুখ থেকে ঝরেছে ওগুলো। আমার দৃষ্টির সামনেই হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলো একটা ঘোড়া।

মিষ্টি আইসিস! ঠিক বলেছো তুমি! শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেছে তাদের ঘোড়া। সাথে সাথেই ইতিকর্তব্য বুঝে নিয়েছে মেমনন। একেবারে শেষমুহূর্তে সরাসরি সংঘর্ষ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলো সে।

ফুলের পাপড়ির মতোই আগুয়ান হিকসস্‌ বহরের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে তাদের ঘিরে ফেলতে লাগলাম আমরা। টেনে-হিঁচড়ে, রথের ধাক্কায় আরো চাপ প্রয়োগ করে সঙ্গে করে চলতে বাধ্য করলাম অসুস্থ ঘোড়ার পালকে। একের পর এক আছড়ে পড়তে লাগলো হাঁপাতে থাকা ঘোড়াগুলো । কতোগুলো স্রেফ দাঁড়িয়ে পড়ে মাথা ঝুলিয়ে মাটি আঁচড়াতে শুরু করলো। একটি তীরও খরচ করলাম না আমরা।

লর্ড আকের-এর রথ বহর এতোক্ষণে ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। বিশ্রাম ছাড়াই একটানা দুইটি লড়াই লড়েছে তারা। হুই-এর চতুর্থ বাহিনীর কাছে ওদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসলো মেমনন। রেমরেম-এর প্রথম বহরের পাশেই অপেক্ষায় আছে হুই।

ফারাও! প্রথম বহর তৈরি! দয়া করে অনুমতি দিন! হতাশায় কেঁদে ফেললো রেমরেম।

মেমনন এমনকি তার দিকে ভালো করে তাকালোও না। হুই-এর রথের কাছে ফারাও-এর রথ চালিয়ে নিয়ে গেলাম আমি। দ্রুত বদলে দেওয়া হলো আমাদের রথের ঘোড়াদুটো।

তুমি তৈরি, হুই? জানতে চায় মেম। ওদিকে লর্ড আকের-এর ঘর্মাক্ত রথ বহর আমাদের পাশ দিয়েই বিশ্রামে চলে যাচ্ছে।

মিশর এবং টামোসের নামে! হুঙ্কার দিয়ে উঠে হুই।

তবে, এগোও! সামনে। আক্রমণে যাও! হেসে নির্দেশ দেয়। লাফ দিয়ে আগে বাড়লো আমাদের নতুন ঘোড়া ছুটে চললো ফারাও-এর রথ।

আমাদের সামনে যুদ্ধের ময়দানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আপাচানের ছয় বিভাগ রথ বহর। অর্ধেক ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে; মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে ওগুলোর ঘোড়া। হলুদ ফাঁস রোগে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে। কিছু ঘোড়া আহত। তবে এখনো অনেকগুলো রথই পূর্ণ মাত্রায় সক্ষম।

মুখোমুখি তাদের সঙ্গে লড়তে ছুটলাম আমরা। ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা রথ, তার কাঠামো চকচকে তামার তৈরি। পাদানীতে দাঁড়ানো পুরুষ ভীষণ লম্বা, চালকের মাথার উপর উঁচু হয়ে আছে। হিকসস্‌ রাজ-পরিবারের স্বর্ণমণ্ডিত শিরস্ত্রাণ মাথায়; গাঢ় দাড়িতে রঙে-বেরঙের ফিতে বাতাসে প্রজাপতির পাখার মতোই উড়ছে ওগুলো।

আপাচান! মেমনন সরাসরি হুমকি জানায়, তুমি শেষ হয়ে গেছে।

তার কণ্ঠস্বর কানে গেছে আপাচানের। আমাদের সোনালি রথ চিনতে পেরেছে সে, ঘোড়া ঘুরিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে ধেয়ে এলো সে। আমার কাঁধে চাপড়ে দিলো মেম।

দাড়িমুখো বর্বরটার পাশে নিয়ে চলো আমাকে! এবারে সময় হয়েছে তলোয়ারের খেলা দেখানোর!

আমরা কাছাকাছি চলে আসতেই দুটো তীর ছুঁড়ে দেয় আপাচান । বৰ্ম আঁকড়ে ধরে মেম, মাথা নিচু রেখে তীর এড়িয়ে গেলাম আমি, একটুও নিয়ন্ত্রণ হারালাম না রথের।

আমার পিছনে গর্জে উঠে খাপ থেকে নীল কিংবদন্তির তরবারি বের করলো মিশরের সম্রাট।

ঘোড়া ঘুরিয়ে নিলাম, ডানে যাওয়ার ভান করে, হঠাৎ করে উল্টো দিকে মোড় নিলো রথ। চতুরতার সাথে হিকসস্‌ রথের পিছনে চলে এলাম। পাশাপাশি ছুটছে এখন দুটো রথ, আমারটা একটু পিছনে। এক হাত বাড়িয়ে দড়ি সমেত আংটা লটকে দিলাম হিকসস্‌ রথের পেছনের কাঠামোতে। এক যোগে ছুটছে এখন দুটি রথ-কিন্তু পিছনে থাকায় সামান্য সুবিধা ভোগ করছি আমি। কিছুতেই আর শক্র রথের চাকার ঘুরন্ত ফলা আমাদের নাগাল পাবে না।

ঘুরে, আমার উদ্দেশ্যে তলোয়ার চালালো আপাচান। ঝট করে মাথা নামিয়ে নিলাম, পিছন থেকে মেমনন বর্মে ঠেকিয়ে দিলো আঘাতটা। এবারে নীল তলোয়ার চালালো সে। বড়ো এক চলতা তামা খসে গেলো আপাচানের অস্ত্র থেকে। রাগে, অবিশ্বাসে হুঙ্কার দিয়ে উঠে সে; বর্ম হাতে কোনো রকমে ঠেকায় পরবর্তী আঘাত।

আপাচান সুদক্ষ তলোয়ারবাজ। কিন্তু নীল সেই অস্ত্রের কোনো জুরি নেই। ঢাল সামলে নিয়ে, পরবর্তী আঘাত হানলো মেমনন। নীল তলোয়ারের ফলা আপাচানের অস্ত্রের ফলায় বাড়ি খেলো। সাথে সাথে তামার ফলা সম্পূর্ণ ভেদ করে বেরিয়ে গেলো ওটা; শুধুমাত্র তার অস্ত্রের হাতল রইলো আপাচানের হাতে।

অবাক বিস্ময়ে বিকট গর্জন ছাড়লো সে। ধ্রুপদি ঢঙে লড়াই শেষ করলো মেম। আপাচানের খোলা মুখে সোজা সেঁধিয়ে দিলো তলোয়ারের ডগা-গলা ছিঁড়ে ফুড়ে বেরিয়ে গেলো সেটা। রক্তের স্রোতে বন্ধ হয়ে গেলো এশীয় বর্বরের শেষ আর্তনাদ।

আংটা খুলে দিতে মুক্ত হয়ে গেলো হিকসস্‌ রথ। এলোমেলো ভঙ্গিতে ছুটতে লাগলো নিয়ন্ত্রণহীন রথ। রক্তের জলপ্রপাত ঝরছে যেনো আপাচানের মুখ থেকে, রথের কাঠামো আঁকড়ে ধরে মরে গেলো সে।

অসহনীয় সেই দৃশ্য সহ্য করতে পারলো না হিকসস্‌ রথ চালকেরা। ঘোড়া থামিয়ে লড়াই ছেড়ে দিলো।

এখনো শেষ হয়নি লড়াই, মেমননকে সতর্ক করে দিয়ে বললাম। আপাচানের রথ বহর ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু বিউন-এর বাহিনী বাকি আছে এখনো।

ক্রাতাসের কাছে নিয়ে চলো আমাকে।

শিলুকদের বাহিনী নিয়ে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষায় আছে ক্ৰাতাস।

কী খবর হে? ফারাও জানতে চাইলেন।

ভয় হচ্ছে, মহান ফারাও, কোনো কাজ না পেলে আমার বাহিনী ঘুমিয়ে পড়তে পারে।

তবে চলো, তোমার বাহিনীর গান শোনা যাক এবারে।

এবারে, আক্রমণে নেমে পড়লো শিলুক পদাতিক বাহিনী। বিউন-এর পদাতিক বাহিনীর সাথে মুখোমুখি লড়াই হলো তাদের। পিছনে থেকে রথ বহর নিয়ে সাহায্যে থাকলাম আমরা।

সবার মাঝখানে থেকে বীরের মতো লড়লো ক্ৰাতাস। গোলমালের ভেতর কখনো কখনো হারিয়ে ফেলছিলাম তাকে, ভয় হচ্ছিলো, হয়তো আর দেখতে পাবো না, কিন্তু তখনি তার অসট্রিচের পালকখচিত শিরস্ত্রাণ গর্বিত ভঙ্গিতে নিজের অবস্থানের কথা জানান দিলো ।

কেন্দ্রে যেখানে লড়ছিলো ক্ৰাতাস, প্রথমে সেখান থেকেই পরাজয় মেনে পিছু হটতে লাগলো হিকসস্‌ পদাতিক বিভাগ। শক্তিশালী শত্রু বাঁধে সেই ছিলো প্রথম ফাটল। প্রচণ্ড চাপের মুখে পিছনে, নিজেদের সৈন্যদের উপরই জেঁকে বসলো হিকসস্‌ পদাতিক।

হোরাসের কৃপায়, আর সমস্ত দেবতার ইচ্ছেয়, শেষপর্যন্ত বিজয়ী হতে চলেছি আমরা, টাটা। আমার আগেই মেমনন টের পেলো বিজয়ের ক্ষণ।

ঘোড়া দাবড়িয়ে, রেমরেম-এর প্রথম রথ বহরের কাছে ফিরে চললাম আমরা। তখনো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে সে।

তুমি তৈরি, সেনাপতি রেমরেম?

সেই সূর্যোদয় থেকে, মহান ফারাও।

শত্রু বুহ্যে ফাটল ধরেছে, পিছু হটছে তারা। যাও, তোমার রথ বহর নিয়ে তাদের মেমফিস পর্যন্ত তাড়িয়ে দিয়ে এসো!

আপনি চিরজীবী হোন, ফারাও! চেঁচিয়ে উঠে, রথের পাদানীতে চড়ে বসে রেমরেম। লড়াইয়ের তৃষ্ণায় অধীর তার বাহিনী, ঘোড়াগুলো একদম তাজা ।

হিকসস্‌দের ডান কোণা দিয়ে ভেঙেচুড়ে ঢুকে গেলো তারা। মুহূর্তের মধ্যে ছত্র ভঙ্গ হয়ে গেলো হিকসস্‌ পদাতিক। ধসে পড়লো সমস্ত প্রতিরোধ। একজন সৈন্যকেও জীবিত ছাড়েনি শিলুক। এ লড়াই ছিলো ফারাও টামোসের অসাধারণ সমরকৌশলের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শেষ মুহূর্তের মারণ-আঘাতের জন্যে নিজের সেরা যোদ্ধাদের সংরক্ষণ করে রেখেছিলো সে। অনায়াস পেশাদারিত্বের সঙ্গে, সংখ্যায় কম হয়েও শেষমুহূর্তে বিজয় ছিনিয়ে আনলো রেমরেম-এর প্রথম রথ বহর।

সত্যিই, রাত নামার আগ পর্যন্ত পলায়নরত হিকসস্‌ সেনাদের তাড়িয়ে নিয়ে চললো রেমরেম। ত্রিশ মাইল দূর পর্যন্ত তাদের ভাগিয়ে দিয়ে এসেছিলো সে, যদি ঘোড়া ক্লান্ত না হয়ে পড়তো, তবে হয়তো মেমফিস পর্যন্তই চলে যেতোকে বলতে পারে?

*

শহরের প্রধান ফটক পর্যন্ত ফারাও-এর সোনালি রথ চালিয়ে নিয়ে গেলাম আমি। পাদানীতে পিঠ খাড়া রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি, ফটকের প্রহরীদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠলেন, দরোজা খোলো! যেতে দাও আমাদের!

কে প্রবেশ করতে চায় থিবেস নগরীতে? পাল্টা জানতে চায় তারা।

আমি টামোস–দুই রাজ্যের শাসনকর্তা।

জয় হোক ফারাও-এর! আপনি চিরজীবী হোন!

খুলে যায় প্রবেশদ্বার। আমার কাঁধে হাত ছোঁয়ালো মেম। ভিতরে নিয়ে চলো আমাকে, টাটা।

তার দিকে ফিরলাম আমি। ক্ষমা করুন, ফারাও। আমি শপথ করেছি, আমার কর্ত্রী, রাণী লসট্রিসের সঙ্গেই প্রবেশ করবো এই শহরে। বাকি পথটুকু আপনি নিজে চালিয়ে যান।

ঠিক আছে, নির্দেশ ধ্বনিত হলো ফারাও-এর কণ্ঠে। যাও, তোমার মিসট্রেসকে নিয়ে এসো।

তার হাতে ঘোড়ার লাগাম তুলে দিয়ে ধূলিময় পথে নেমে এলাম আমি। সোনালি রথ চালিয়ে প্রধান ফটক গলে শহরের ভেতরে প্রবেশ করলো মিশরের সম্রাট, উৎসাহের ধ্বনি শোনা গেলো শহরে।

ফারাও-এর পিছু পিছু প্রবেশ করছে যুদ্ধক্লান্ত সেনাবাহিনী। কী চরম মূল্য দিতে হয়েছে আমাদের এই লড়াইয়ে–তখন বুঝলাম। এই সেনাবাহিনীকে আবারো ঢেলে সাজিয়ে নিতে হবে হিকসস্‌দের সাথে লড়াইয়ের আগে। ততোদিনে সময় পেয়ে যাবেন রাজা স্যালিতিস, হলুদ–ফসের কবল থেকে মুক্তি পাবে তার ঘোড়ার পাল। একটি লড়াই হয়তো জিতেছি আমরা, কিন্তু আমি জানি, এই মিশর থেকে দখলদার বাহিনীকে তাড়িয়ে দেওয়ার আগে আরো অনেক যুদ্ধ লড়তে হবে আমাদের।

শিলুকরা হেঁটে ফিরছে শহরে। ক্রাতাসের খোঁজে এদিক-সেদিক তাকালাম আমি।

একটা রথ আর তাজা ঘোড়া ব্যবস্থা করে দিলো হুই। আমি তোমার সাথে যাই, টাইটা? অনুমতি প্রার্থনা করলো সে।

না,মাথা নেড়ে বাঁধা দিলাম। একা বরঞ্চ দ্রুত যেতে পারবো। যাও, শহরে গিয়ে আনন্দ করো তুমি। হাজারো কুমারী মেয়ে তোমার অপেক্ষায় আছে ওখানে! যাও!

দক্ষিণের রাস্তা ধরার আগে প্রথমে যুদ্ধক্ষেত্রে রথ চালিয়ে গেলাম আমি। শিয়াল আর হায়েনার দল ইতোমধ্যেই তাদের ভোজ শুরু করে দিয়েছে, আহতের আর্তনাদ ছাপিয়ে উঠছে তাদের গোঙানি আর হুঙ্কার ।

যেখানে শেষ দেখেছিলাম ক্ৰাতাসকে, সেইদিকে রথ চালিয়ে যেতে চাইলাম আমি। কিন্তু সবচেয়ে মর্মান্তিক অবস্থা এখানকার ময়দানে। রথের চাকার সমান উঁচু হয়ে আছে নিহতের দেহ। রক্তে ভেঁজা, থকথকে কাদামাটির মধ্যে পরে থাকতে দেখলাম ওর শিরস্ত্রাণ। রথ থেকে নেমে, ওটা হাতে তুলে নিলাম আমি। তুবড়ে, বেঁকে-চুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে জিনিসটা।

ছুঁড়ে ফেলে, ক্রাতাসের খোঁজে পাগলের মতো এদিক-সেদিক চাইতে লাগলাম। এক স্তূপ মরদেহের নিচ থেকে বিবাট একাশিয়া শাখার মতো বেরিয়ে আছে একটা পা। শিলুক আর হিকসস্ জড়াজড়ি করে মরে পরে আছে। পা ধরে টেনে বের করলাম দেহটা–এ যে ক্ৰাতাস। শুকনো বক্তে মাখামাখি, মুখে-চুলে শক্ত হয়ে কাঁদার মতো লেপ্টে আছে রক্ত।

পাশে ঝুঁকে বসে, বিড়বিড় করে বললাম, সবাইকে মরতে হবে–প্রতিটি প্রাণ, যা ভালোবাসি আমি? ঝুঁকে পরে ক্রাতাসের রক্ত লেপ্টানো ঠোঁটে চুমো খেলাম।

বসে পড়ে, আমার দিকে তাকালো সে। চওড়া হাসছে। সেথ্‌-এর বাম নাকে জমে থাকা ময়লার কসম! একেই বলে লড়াই!

ক্ৰাতাস! অবিশ্বাসে গর্জে উঠলাম । তুমি আসলেই বেঁচে আছো?

এ নিয়ে সন্দেহ করো না, ব্যাটা বর্বর। তবে এই মুহূর্তে একটু মদ প্রয়োজন!

ছুটে, রথের ভেতর থেকে সুরার পাত্র নিয়ে এসে ওর ঠোঁটে তুলে দিলাম। পুরোটা পানীয় ঢকঢক করে গিলে ফেলে, বিরাট এক ঢেঁকুর তুললো ক্ৰাতাস।

এখনকার মতো চলবে, আমাকে চোখ মেরে বললো বর্বরটা। এবারে, সবচেয়ে কাছের মেয়েদের ভেঁরাটা কোথায় আছে, একটু চিনিয়ে দেবে?

*

দ্রুতগতির গ্যালির চেয়েও দ্রুত গজদ্বীপে আমাদের বিজয়ের সংবাদ নিয়ে গেলাম আমি। একজন মানুষ নিয়ে প্রাণপণ ছুটলো ঘোড়া দুটো। পথিমধ্যে প্রতিটি গ্রামে চিৎকার করে পৌঁছে দিলাম সেই সংবাদ, বিজয়! আমরা জিতেছি! ফারাও-এর জয় হয়েছে। থিবেস-এ! তাড়িয়ে দিয়েছি আমরা হিকসস্ দের!

সমস্ত প্রশংসা দেবতাদের জন্যে! অভিভাদন জানালো জনতা। মিশর আর টামোস!

ছুটে চললাম আমি। আজো সেই ঘোড়দৌড়ের কথা স্মরণ করে মিশরের জনতা। তারা বলে, রক্তলাল চোখে, রুগ্ন এক ঘোড়সওযার শুকনো রক্তমাখা আলখাল্লা পরে, বিশাল চুল বাতাসে উড়িয়ে বিজয়ের খবর পৌঁছে দিয়েছিলো গজদ্বীপে।

দুই দিন এবং দুই রাত দৌড়ে থিবেস থেকে গজদ্বীপে পৌঁছেছিলাম আমি। শেষমেষ যখন প্রাসাদের সামনে এসেছিলাম, আর শক্তি ছিলো না শরীরে। বহু কষ্টে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে জলবাগানে, আমার কর্ত্রীর শয্যাপাশে গিয়ে পরে গিয়েছিলাম।

মিসট্রেস, শুকনো গলায়, ফাটা ঠোঁটে কোনোমতে বললাম। বিজয় অর্জণ করেছেন ফারাও। আমি বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছি তোমাকে।

*

জাহাজে চড়ে নদীর ভাটিতে থিবেস-অভিমুখে চললাম আমরা। দুই রাজুমারী সাথে ছিলো তাদের মায়ের যত্ন-আত্তির জন্যে। খোলা পাটাতনে ওর সঙ্গে বসে গাইলো তারা। বুকের গভীরে অসুস্থ মায়ের জন্যে শোক আগলে রেখে হাসি মুখে ধাঁধা আর গল্পের হাস্যরস বইয়ে দিলো।

আহত পাখির মতোই দুর্বল তখন রাণী লসট্রিস। কোনো ওজন নেই তার দেহে; শুকিয়ে গেছে শরীরের সমস্ত হাড়-মাংস। স্বচ্ছ, ফ্যাকাসে ত্বকে কোনো প্রাণ নেই । দশ বছর বয়সী ওর মতো সহজেই বহন করতে পারি আমি তার দেহ। ঘুমের গুঁড়ো আর তার ব্যথা কমাতে পারে না। পেটের গভীরের সেই মাংসপিন্ড শেষ করে দিয়েছে। তাকে।

নদীর শেষ বাঁকে যখন থিবেস-নগরীর দেয়াল দেখা যেতে শুরু করলো, কোলে তুলে ওকে বয়ে নিয়ে গেলাম গলুইয়ে । এক হাত দিয়ে অবলম্বন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলাম। তরুণ বয়সের কতো শতো না স্মৃতি খেলে যাচ্ছিলো মানসপটে।

একটু নড়াচড়াতেই ক্লান্ত হয়ে পড়লো লসট্রিস। মেমননের প্রাসাদের ঘাটে যখন নোঙর ফেললাম আমরা, থিবেস-এর সমস্ত জনতা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো রাণীকে অভিবাদন জানাতে। সবার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফারাও টামোস।

খাঁটিয়ায় করে তাকে বয়ে নিয়ে চললো যোদ্ধারা। যদিও এর আগে থিবেস-এর অনেকেই দেখেনি আমার কর্ত্রীকে, কিংবদন্তি হয়ে আছে রাণী লসট্রিসের গল্প। ওর আশীর্বাদ পাবার জন্যে ছোটো ছোটো বাচ্চাদের উচিয়ে ধরলো মায়েবা, যেনো লসট্রিসের এতোটুকু ছোঁয়া পেলে দেবতার কৃপা পাবে।

মাতা হাপির কাছে আমাদের জন্যে প্রার্থনা করবেন, আবেদন ঝরে পড়লো তাদের কণ্ঠে। আমাদের আশীর্বাদ করুন মিশর-মাতা।

প্রধান সমরনায়কের সন্তানের মতো খাঁটিয়ার পাশে পাশে হেঁটে চললেন ফারাও টামোস, তেহুতি এবং বেকাথা থাকলো একটু পিছনে। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে উজ্জ্বল হাসলো ওরা।

আতন শয্যাকক্ষ প্রস্তুত করে রেখেছিলো রাণীর জন্যে। দরোজার কাছে এসে সবাইকে, এমনকি রাজাকেও তাড়িয়ে দিলাম আমি। চাতালে, বিছানা টেনে এনে শুইয়ে দিলাম আমি ওকে। ওখান থেকে শহরের দেয়াল আর প্রিয় নীলনদ দেখতে পাবে আমার কর্ত্রী।

রাত নেমে আসতে শয্যা কক্ষে নিয়ে গেলাম ওকে। লিনেন চাদরের উপর মাথা রেখে আমার দিকে চাইলো ও, ফিসফিস করে বললো, টাইটা, শেষবারের মতো, একবার আমার জন্যে আমন রা ইন্দ্রাজাল অনুশীলন করবে?

মিসট্রেস, তোমার জন্যে যে কোনো কিছু করতে রাজী আমি। মাথা ঝুঁকিয়ে ওষুধের বাক্স আনতে চললাম।

ওর পাশে এসে বসলাম আমি, ধীরে প্রস্তুত করতে শুরু করলাম লতা-গুলোর মিশ্রন। পানিতে ঢেলে, একটা পাত্রে নিয়ে গরম করতে লাগলাম।

গরম হতে, পাত্র উঁচিয়ে সালাম জানালাম আমার রাণীকে, এরপর পান করে নিলাম মিশ্রণটা।

ধন্যবাদ, ফিসফিস স্বরে বললো লসট্রিস। চোখ বন্ধ করে, আতঙ্কের সাথে এই বাস্তব জগৎ ছেড়ে আত্মার নির্গমণের অপেক্ষায় বসে রইলাম আমি। সেই  জগতে যেখানে স্বপ্নরা ভবিষ্যৎ দেখায়–ঘুরে ফিরলাম।

যখন ফিরে এলাম আমি ঘোর ভেঙে, প্রদীপের আলো নিভে গেছে। নিস্তব্ধ পুরো প্রাসাদ। বাগানের নাইটিঙেলের গান ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। সিল্কের বালিশে মাথা রেখে মৃদু স্বরে শ্বাস নিচ্ছে আমার মিসট্রেস।

ভেবেছিলাম, বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছে সে। কিন্তু মুখের ঘাম মুছে নিতে, চোখ মেলে চাইলো সে। ওহ্ টাইটা, খুব কষ্ট হয়েছে না?

আগের যেকোনো বারের চেয়ে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি আমি। মাথা ব্যথায় যেনো ছিঁড়ে যাবে। চোখে দেখছি না ঠিকমতো। শেষবারের মতো এই অনুশীলন করলাম আমি। আর কখনো, কোনে দিনও করবো না।

আমি দেখলাম নদীর দুই তীরে দাঁড়িয়ে আছে শকুন আর কোব্রা। জলরেখা বিভক্ত করে রেখেছে তাদের। একশ বার পানির স্তর উঁচু আর নিচু হলো আমার সামনে। আমি দেখলাম, একশ থলে শস্যদানা, একশ পাখি উড়ে গেলো নদীর উপর দিয়ে। ওদের নিচে, যুদ্ধে সৃষ্ট ধুলোর মেঘ আর তরবারীর ঝনঝনানি। শহরের পর শহরে জ্বলছে আগুন।

শেষমেষ, একত্র হলো শকুন আর কেব্রা। বিশুদ্ধ নীল কাপড়ের উপর সঙ্গমে মিলিত হলো তারা। শহরের দেয়ালে দেয়ারে শোভা পেলো নীল পতাকা, মন্দিরের ছাতে উড়লো নীল তোড়ন।

রথের শীর্ষে উড়লো নীল পতাকা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো সেই রথ। এতো লম্বা আর শক্তিশালী মূর্তি দেখলাম, এক হাজার বছরেও যার ক্ষয় হবে না। আমি দেখেছি, পঞ্চাশ জাতির মানুষজন মাথা ঝোকায় তার সম্মুখে।

মাথার চুল খামচে ধরলাম আমি ব্যথায়। বহুকষ্টে উচ্চারণ করলাম, এই ছিলো আমার স্বপ্ন।

বহুক্ষণ কথা বললাম কেউ। এরপর, শান্ত স্বরে আমার কর্ত্রী বললো, একশ বছর পরে একত্র হবে দুই রাজ্য। একশ বছরের যুদ্ধ আর বঞ্চনা শেষে আমাদের এই পবিত্র মিশর থেকে চলে যাবে হিকসস্‌। আমার লোকেদের জন্যে দারুন কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।

কিন্তু নীল পতাকাতলে এক হবে তারা, আর তোমারই বংশধারা এই পৃথিবী শাসন করবে একদিন। এই পৃথিবীর সমস্ত জাতি সম্মান জানাবে তাঁকে। স্বপ্নের শেষটা শোনালাম আমি ওকে।

আমি তৃপ্ত ওটা জেনে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো লসট্রিস। ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলো সে।

আমি ঘুমালাম না। জানি, আমাকে প্রয়োজন মিসট্রেসের।

সূর্যোদয়ের ঠিক আগে, রাতের সবচেয়ে অন্ধকার সময়ে জেগে উঠলো ও। চিৎকার করে বললো, ব্যথা! দয়াময়ী আইসিস, কী ব্যথা!

লাল শেপেনের গুড়ো দিলাম ওকে। কিছুসময় পর ও বললো, ব্যথা নেই আর। কিন্তু ঠাণ্ডা হয়ে গেছি আমি। আমাকে ধরে থাকো, টাইটা, তোমার শরীর দিয়ে উষ্ণতা দাও।

আমার বাহুবন্ধনে আবারো ঘুমিয়ে পড়লো মিসট্রেস।

চাতালে যখন প্রথম সূর্যরশ্মি চমকাচ্ছে, জেগে উঠলো লসট্রিস।

জীবনে কেবল দু জন মানুষকেই ভালোবেসেছিলাম আমি, ফিসফিস করে উচ্চারণ করলো শব্দ কটা। তুমি ছিলে তাদের একজন। হয়তো, পরের জীবনে আমাদের এই ভালোবাসায় দেবতারা আরো একটু সদয় হবেন।

কোনো উত্তর জোগালো না ঠোঁটে। শেষবারের মতো চোখ মুদলো আমার মিসট্রেস। শান্তভাবে, কিছু বুঝতে না দিয়ে চলে গেলো ও। শেষ নিঃশ্বাসের কোনো পার্থক্য রইলো না তার আগেরটির সঙ্গে। ঠোঁটে চুমো খেতে গিয়ে ঠান্ডা স্পর্শ টের পেলাম আমি ।

বিদায়, মিসট্রেস, বিড়বিড় করে বললাম। বিদায়, ভালোবাসা।

*

রাজকীয় শবদেহপ্রস্তুতির সত্তর দিবস-রজনীতে এই স্ক্রোলগুলো লিখেছি আমি। এ হলো মিসট্রেসের প্রতি আমার শেষ নিবেদন।

মৃতের পরিচর্যাকারীরা আমার কাছ থেকে ওকে নিয়ে যাওয়ার আগে, ট্যানাসের মতো ওর দেহের একপাশ কেটে, গর্ভের ভেতর থেকে বের করে আনলাম সেই বিষাক্ত মাংসপিন্ড–যা ওর মৃত্যুর জন্যে দায়ী। রক্তমাংসের সেই বস্তু মানবসৃষ্ট নয়–নৃশংস দেবতা সেথ-কে অভিসম্পাত দিয়ে ওটাকে আগুনে ছুঁড়ে ফেললাম।

এই স্ক্রোলগুলো সংরক্ষণের জন্যে দশটি অ্যালাবাস্টারের পাত্র তৈরি করেছি আমি। ওর সাথেই থাকবে এগুলো। ওর সমাধির দেয়ালচিত্র আঁকছি এখন, আমার সৃষ্টি সেরা চিত্রকর্ম হবে সেগুলো। তুলির প্রতিটি ছোঁয়া, লসট্রিসের প্রতি আমার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।

ইচ্ছে হয়, চিরকাল ওর সাথে শুয়ে থাকি কবরে; দুঃখ-শোক আমাকে অসুস্থ করে ফেলছে। কিন্তু এখনো রাজা আর রাজকুমারীরা রয়েছে যে।

ওদের আমাকে প্রয়োজন।

-: (শেষ) :-

*

অনুবাদকের পাদটিকা : রিভার গড-এর কাহিনীর এখানেই পরিসমাপ্তি। রাণীর মৃত্যুতে দুঃখ-শোকে পাথর টাইটা পরবর্তীতে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে বেছে নিয়েছিলো সন্ন্যাস জীবন। বহু বছর আধুতিক শক্তির আরাধনা করে নিজেকে উন্নিত করেছিলো অতিন্দ্রিক শক্তির অধিকারী জাদুকর হিসেবে। পরবর্তীতে অবশ্য রাণী লসট্রিসের নাতী, নেফারের আহ্বানে মিশরে প্রত্যাবর্তন করেছিলো সে। ও হ্যাঁ, উদ্ধার করা হয়েছিলো ফারাও মামোসের বিপুল পরিমাণ সমাধি-সম্পদও। কিন্তু সে ভিন্ন গল্প, ভিন্ন কাহিনী। সময় সুযোগ হলে পরে কখনো না হয় বলা যাবে পাঠককে!
–অনুবাদক।

*

লেখকের বক্তব্য

১৯৮৮ সালের ৫ জানুয়ারি, মিশরীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডুরেইদ-ইবনে-আল সিমা নীলনদের পশ্চিম তীরে, ভ্যালি অব নোবলস্ এ একটি প্রাচীন সমাধি খুঁড়ে ভেতরে প্রবেশ করেন। খ্রিস্টের মৃত্যুর পরবর্তী নবম শতকের একটি ইসলামিক মসজিদ সেই সমাধির উপরে নির্মিত হওয়ায় ধার্মিক নেতাদের সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতা শেষে অনুমতি মিলেছিলো কবর খোঁড়ার ।

সমাধির যে গলিপথ মূল সমাধি-প্রকোষ্ঠে চলে গিয়েছিলো, তার দেয়াল এবং ছাদের অপূর্ব চিত্রকর্ম দেখে তাক লেগে গিয়েছিলো ড, ডুরেইদ-এর। চিরজীবন ভাস্কৰ্য্য এবং দেয়ালচিত্র নিয়ে কাজ করেও এতো অসাধারণ এবং নিখুঁত শিল্পকর্মের দেখা পাননি তিনি এর আগে।

পরে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, তৎক্ষণাৎ তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আবিষ্কারের বোধ জেগেছিলো। দেয়ালে আঁকা হায়ারোগ্লিফিকস–এর মধ্যে রাজকীয় বর্ণমালায় উল্লেখ ছিলো তখনো পর্যন্ত অনাবিস্কৃত এক মিশরীয় রাণীর কথা।

সমাধি-প্রকোষ্ঠে ঢোকার পর তার আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে। কিন্তু প্রকোষ্ঠের সীল করা দরোজা ভাঙা অবস্থায় আবিষ্কার করেন তিনি। প্রাচীন সময়ে সমাধি-চোরদের উৎপাত ছিলো বেশ।

যা হোক, ড : সিমা সাফল্লের সাথে সেই সমাধির নির্মাণ-তারিখ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৭৮০ সালের কোনো এক দিন দুর্যোগ নেমে এসেছিলো মিশরের ভাগ্যাকাশে। পরবর্তী দুই শতক আলাদা হয়েছিলো এর দুই রাজ্য। সেই সময়ের ঘটনাবলির ভালো কোনো রেকর্ড নেই, তবে কথিত আছে, সেই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকেই জন্ম নিয়েছিলো রাজকুমার এবং ফারাও-দের এক নতুন বংশধারা, যারা পরবর্তীতে হিকসস্‌ জবরদখলকারীদের উৎখাত করেছিলো মাতৃভূমি থেকে। ফিরিয়ে এনেছিলো তার প্রাক্তন গৌরব। এটা ভেবে আমি আন্দোলিত হই যে, লসট্রিস, ট্যানাস এবং মেমননের রক্ত বইছে তাদের দেহে।

সমাধি আবিষ্কারের প্রায় এক বছর পরে যখন ড. সিমা এবং তার সহকারীরা দেয়ালের হায়ারোগ্লিফিকস্-এর ছবি তুলে রাখছিলেন, দেয়ালের এক অংশের প্লাস্টার ধসে পড়ে লুকোনো ছোট্ট একটা প্রকোষ্ঠর দ্বার উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। সেই প্রকোষ্ঠের ভেতরে দশটি অ্যালাবাস্টারের ভাস খুঁজে পান তারা।

তার ভেতরে সংরক্ষিত স্ক্রোলগুলো অনুবাদের সময় ড. সিমা আমার সাহায্য কামনা করায় আমি সম্মানিত বোধ করেছি। আগ্রহও কাজ করছিলো খুব। কায়রো জাদুঘর এবং বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ঈজিপ্টলজিস্টদের সহায়তায় পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিলো মূল স্কোলগুলোর।

বর্তমান সময়ের উপযোগী করে সেই স্ক্রোলগুলোর কাহিনী নতুন করে বলার জন্যে আমাকে অনুরোধ করেছিলেন ড. সিমা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাব্যিক স্বাধীনতা নিয়েছি আমি, উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, দূরত্ব এবং ওজনের হিসেব উল্লেখের সময় বর্তমানে প্রচলিত মাপ ব্যবহার করেছি বিভিন্ন স্থানে। টাইটার ব্যবহার না করা কিছু শব্দও ব্যবহার করা হয়েছে, যেমন, বর্বর, পতিতা, যৌতুক; তবে আমার ধারণা, টাইটার শব্দভান্ডার বড়ো হলে সে নিজেও এই শব্দগুলো ব্যবহার করতো।

লেখার কাজ শুরু করার পর প্রাচীন এই লিপিকারের কাহিনীতে পুরোপুরি ডুবে গিয়েছিলাম আমি। অনর্থক গর্ব আর অতিশয়োক্তি সত্ত্বেও যুগ যুগ আগে বেঁচে থাকা ক্রীতদাস টাইটা প্রতি গভীর স্নেহ বোধ করেছি।

অবাক লাগে ভাবলে, মানুষের আবেগ এবং অনুপ্রেরণার উৎস এতো হাজার বছরেও একটুও পরিবর্তন হয়নি। হয়তো, আজকের দিন পর্যন্তও আবিসিনিয়ার পর্বতে, নীলনদের উৎসমুখের সন্নিকটে কোনো স্থানে, ফারাও মামোসের অলঙ্খিত সমাধিতে শায়িত আছে ট্যানাসের মমিকৃত দেহ।

-উইলবার স্মিথ।

1 Comment
Collapse Comments
বাবর চৌধুরী May 19, 2021 at 12:38 pm

হৃদয় জুড়ে হু হু করে কান্না আসছে ট্যানাসের জন্যে লস্ট্রিসের জন্যে। আহা ভালোবাসা !!!
টাইটা অসাধারণ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *