পলাশি অভিমুখে: ইংরেজ পরিকল্পনা
পলাশির ষড়যন্ত্র পাকা হয়ে যাওয়ার পরও কিন্তু পলাশি বিপ্লবের পথ খুব সহজ বা সোজা ছিল না। ইংরেজরা অস্থির হয়ে পড়েছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিপ্লব ঘটাতে। তাই সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে সমন্বয় করা এবং তা সংগঠিত করার দায় বর্তায় তাদের ওপরই কারণ দেশীয় ষড়যন্ত্রীদের ওপর খুব একটা ভরসা করা যাচ্ছিল না। ওয়াটস বেশ চতুর ও বিচক্ষণ বলে দেশীয় চক্রান্তকারীদের অবস্থাটা ভাল বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি লিখেছেন:১
এদের কাছ থেকে খুব বেশি আশা করা ঠিক নয়। বড় জোর যুদ্ধ বাধলে এরা নিরপেক্ষ থাকবে, তার বেশি নয়। আমরা যদি সফল হই, এরা তার ফায়দা তুলবে। আর আমরা হারলে এরা যেমন ছিল তেমনই থাকবে। আমাদের সঙ্গে যে এদের কোনও সম্পর্ক ছিল তা বুঝতেই দেবে না।
মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত (৫ জুন ১৭৫৭) হওয়ার পরও কিন্তু সিলেক্ট কমিটি বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। ১১ জুন কমিটি বিস্তারিত আলোচনা করল—‘তখনই সোজা মুর্শিদাবাদ অভিমুখে অভিযান করা সমুচিত হবে, না মীরজাফরের কাছ থেকে আরও বিস্তারিত খবর এবং কার্যোদ্ধারে কী ভাবে এগুনো যাবে সে-সম্বন্ধে তাঁর কাছ থেকে খসড়া পরিকল্পনা পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে।’ আলাপ-আলোচনার পর কমিটি সিদ্ধান্ত নিল যে:২
মীরজাফরকে মসনদে বসাবার যে পরিকল্পনা সেটা সফল করার জন্য এর চেয়ে সুবর্ণসুযোগ আর আসবে না কারণ আর বেশি দেরি করলেই সিরাজদ্দৌল্লা ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটা জেনে ফেলতে পারেন। আর তা হলে নবাব তখন মীরজাফরকে কোতল করবেন এবং ফলে আমাদের পুরো পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে। তখন আমাদের পক্ষে এদেশের সঙঘবদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে একাই লড়াই করা ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না।
বস্ততপক্ষে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পরই ওয়াটস ক্লাইভ ও সিলেক্ট কমিটিকে নবাবের বিরুদ্ধে অভিযান করার জন্য পীড়াপিড়ি করতে থাকেন।৩ ১২ জুন তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে পালাবার আগে ক্লাইভকে আবার তাড়াতাড়ি অভিযান করার জন্য অনুরোধ জানান কারণ ‘সামান্যতম দেরি হলেই আমাদের সর্বনাশ হতে পারে।’৪ এদিকে তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল। ৯ জুন নাগাদ৫ নবাব মীরজাফরকে বক্সির পদ থেকে বরখাস্ত করেন, ফলে নবাবের সঙ্গে মীরজাফরের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ হয়ে যায় এবং এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যা স্ক্র্যাফ্টনের মতে, ইংরেজদের সব আশা-আকাঙক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারত। নিজের প্রাণনাশের ভয়ে মীরজাফর দরবারে যাওয়াই বন্ধ করে দিলেন। তিনি ক্লাইভকে লিখে পাঠালেন যে এই মুহূর্তে নবাবের বিরুদ্ধে ক্লাইভের অভিযান ছাড়া অন্য কিছু তাকে বাঁচাতে পারবে না।৬
সিরাজদ্দৌল্লা যথারীতি মীরজাফরের বিরুদ্ধে কোনও চরম ব্যবস্থা নিতে দোনামনা করতে লাগলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ শুভার্থীরা তাঁকে বোঝাতে চাইল যে মীরজাফরের যোগসাজশেই ইংরেজরা মুর্শিদাবাদ অভিযান করার পরিকল্পনা করছিল। তাই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়াই উচিত। কিন্তু দরবারে মীরজাফরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি গোষ্ঠী সিরাজকে আপাতত মীরজাফরের সঙ্গে একটা রফা করা ও পরে সুযোগ বুঝে তাঁকে একহাত নেওয়ার পরামর্শ দিল। ফলে দু’জনের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়ে গেল। দুজনেই কোরাণ নিয়ে শপথ করলেন—সিরাজের দিক থেকে মীরজাফরের প্রাণনাশের কোনও চেষ্টা হবে না আর মীরজাফর প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত তিনি নবাবের জন্য লড়াই করে যাবেন। এর পর ‘দু’জনে হাসিমুখে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিলেন কিন্তু মনে মনে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস ও ঘৃণা নিয়ে গেলেন।’ এখানেই সিরাজদ্দৌল্লা মস্ত বড় ভুল করে বসলেন, মীরজাফরকে বরাবরের মতো নিস্তব্ধ না করে দিয়ে। এ প্রসঙ্গে স্ক্র্যাফ্টনের মন্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য:৭
If the Soubah (Sirajuddaulla) erred before in abandoning the French, he doubly erred now, in admitting a suspicious friend…to continue in charge of a great body of troops, when self-defence would have taught him to make use of for his own preservation.
জাঁ ল’-রও অভিমত, সিরাজদ্দৌল্লা ছাড়া অন্য যে-কোনও কেউ, যার মনের জোর আছে, এ সময় মীরজাফর, রায়দুর্লভ এবং শেঠদের কারাগারে বন্দি করে রাখত। এঁদের এভাবে জব্দ করা গেলে ইংরেজরা খুব সম্ভবত আর মুর্শিদাবাদের দিকে এগুতে সাহস করত না।৮
এদিকে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে মীরজাফরের আপাত বোঝাপড়ার ফলে মীরজাফর ইংরেজদের চোখে সন্দেহের পাত্র হয়ে দাড়ান। তাই ওয়াটস লিখছেন যে মীরজাফর নবাবের সঙ্গে আবার হাত মেলাবার ফলে, যদিও তাদের মধ্যে সত্যিকারের কোনও বোঝাপড়া হয়নি, তাঁর ওপর ভরসা করা যায় কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এর পরের ঘটনাক্রম থেকে দেখা যাবে যে এ-সন্দেহ খুব অমূলক নয়।’৯ কিন্তু তার মধ্যে ইংরেজরা সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে অভিযান করার জন্য সব প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। মুর্শিদাবাদ রওনা হওয়ার আগে ক্লাইভ হুগলির ফৌজদার আমিরুল্লাকে ১২ জুন লিখলেন যে সন্ধির শর্তগুলি যাতে পালিত হয় তা দেখার জন্য ইংরেজ বাহিনী রাজধানীর দিকে অভিযান শুরু করছে।১০ চিঠি পেয়েই আমিরুল্লা ক্লাইভকে জানালেন যে ‘নবাবের সঙ্গে শেষ যখন তাঁর দেখা হয় তখনও নবাব ইংরেজদের প্রতি তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সদিচ্ছার কথা বলেছেন এবং চুক্তির শর্তাবলী পালন করতে তাঁর সম্মতির কথা জানিয়েছেন। ব্যাপারটা অত গুরুত্বপূর্ণ বলেই তাতে কিছুটা দেরি হয়তো হচ্ছে। কিছু বদলোকের প্ররোচনায় ক্লাইভের পক্ষে এরকমভাবে হঠাৎ একটা অভিযান করা নিতান্তই অনুচিত।’১১
কিন্তু ইংরেজদের পরিকল্পিত পলাশির বিপ্লব ত্বরান্বিত করতে তাদের কিছু একটা অজুহাত দেখাবার প্রয়োজন ছিল। তাই ক্লাইভ ১৩ জুন সিরাজদ্দৌল্লাকে লিখলেন যে, যেহেতু নবাব চুক্তির শর্তাবলী পালন করেননি এবং যেহেতু তিনি আগের প্রতিশ্রুতি আপনার শত্রু আমার শত্রু, আমার শত্রু আপনার’১২ না মেনে ফরাসি নৌ সেনাপতি বুসির [Bussy] সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলেন, সেজন্য তিনি মুর্শিদাবাদ অভিমুখে অভিযান করছেন। মুর্শিদাবাদের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সামনে ব্যাপারটি তুলে ধরা হবে, তাদের সুবিচারের জন্য।১৩ সিরাজ কিন্তু এপ্রিলের শেষ দিক থেকে বারবার জানিয়েছেন যে আলিনগরের সন্ধির চুক্তির শর্তগুলি বরাবরই মেনে চলা হয়েছে এবং তাঁর দিক থেকে কোনও বিচ্যুতি কখনও হয়নি। তিনি ইংরেজদের এটাও বারবার পরিষ্কার করে জানিয়েছেন যে, তারা মুর্শিদাবাদ অভিমুখে অভিযান শুরু করলে তা চুক্তিভঙ্গের সামিল হবে।১৪ মুর্শিদাবাদ থেকে ওয়াটসের পালানোর পর নবাব ক্লাইভ ও ওয়াটসন দু’জনকে জানালেন যে এটা তাঁদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং চুক্তি ভাঙার উদ্দেশ্যেরই পরিচায়ক।
ক্লাইভ যখন মুর্শিদাবাদ অভিযান শুরু করেন তখনও পর্যন্ত মীরজাফরের কাছ থেকে শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কোনও চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তাঁর সঙ্গে মীরজাফরের সাক্ষাৎ পরিচয়ই ছিল না। তিনি ১৯ জুন কাটোয়া দখল করলেন। সেখানে ‘নিদারুণ অস্বস্তি’র মধ্যে তাঁকে দু’দিন কাটাতে হয়। কারণ তখনও পর্যন্ত মীরজাফর বা তাঁর সঙ্গীদের কাছ থেকে কোনও খবর বা নির্দেশ কিছুই পাওয়া যায়নি। খবর যখন পৌঁছুল তখন দেখা গেল যে, ওয়াটসের মন্তব্য অনুযায়ী, তাতে সন্তোষজনক বা পরিষ্কারভাবে কিছুই বলা নেই।১৫ ফলে ক্লাইভ বেশ ভীত ও হতাশ হয়ে পড়লেন। তিনি সিলেক্ট কমিটিকে লিখলেন যে মীরজাফরের কাছ থেকে কোনও রকমের স্পষ্ট সংকেত না পেয়ে তিনি ‘খুবই উদ্বিগ্ন।’ তিনি আরও লিখলেন যে মীরজাফর ইংরেজদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করলেও যেভাবে তিনি সতর্কতার সঙ্গে এগুতে চাইছেন তাতে পুরো ব্যাপারটাই ভেস্তে যাবার আশঙ্কা। একইভাবে তিনি কমিটিকে জানালেন যে, তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে মীরজাফর যাতে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেন তার একটা শেষ চেষ্টা তিনি করছেন। কমিটিকে এটাও জানানো হল, মীরজাফর তাঁর সঙ্গে যোগ না দিলে তিনি নদী পেরোবেন না। কোনওরকমে আট-দশ হাজার মন খাদ্যশস্য জোগাড় করতে পারলে তার সঙ্গে কাটোয়ায় যা তাদের হাতে এসেছে, সব মিলিয়ে বর্ষা পর্যন্ত ওখানে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। তারপর প্রয়োজন হলে মারাঠারা বা বীরভূমের রাজা বা এমনকী দিল্লির উজির গাজিউদ্দিন খান কারও না কারও সঙ্গে সমঝোতা করে কার্যোদ্ধার করা যাবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটিকে লিখছেন যে, তাঁর ইচ্ছা খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোনো যাতে ইংরেজ বাহিনীর কোনও বড় রকমের ক্ষতি না হয় ‘কারণ এই ফৌজ অক্ষত থাকলে আমাদের বর্তমান পরিকল্পনা সফল না হলেও ভবিষ্যতে যে-কোনও সময় বিপ্লব সংগঠিত করার শক্তি আমাদের বজায় থাকবে।’১৬
এ থেকে বোঝা যায় মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গীরা সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠাতে ইংরেজদের শেষপর্যন্ত সাহায্য করতে এগিয়ে না এলেও, ইংরেজরা অন্য কারও সহায়তায় এ-কাজ সম্পন্ন করতে দ্বিধাগ্রস্ত হত না এবং সেই অন্য কেউ দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যই যে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। ইংরেজদের পরিকল্পনা অনুযায়ী যে কেউ হলেই চলত। আসলে তখনও পর্যন্ত ক্লাইভ মীরজাফর সম্বন্ধে ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। তাই তিনি সিলেক্ট কমিটির কাছে জানতে চাইলেন যদি মীরজাফর সাহায্য করতে এগিয়ে না আসেন তা হলে কী করা যাবে।১৭ তবে বিপ্লব ঘটাতে তিনি এতই উদগ্রীব ছিলেন যে মীরজাফরের ওপর আশা পুরোপুরি ছাড়তে পারেননি এবং তাঁকে ইংরেজ ফৌজের সঙ্গে যোগ দিতে বারবার প্ররোচিত করতে লাগলেন। কাটোয়া থেকে ১৯ জুনও তিনি মীরজাফরকে লিখলেন:১৮
আপনার পক্ষে বিশেষ করে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেও আপনি খুব একটা গা করছেন না দেখে আমি খুবই উদ্বিগ্ন হচ্ছি। এ ক’দিনের মধ্যে আমি যখন ফৌজ নিয়ে অভিযান করছি তখন আমি ঠিক কী করব বা কী ব্যবস্থা নেব সে-সম্বন্ধে আপনার কাছ থেকে কোনও ইঙ্গিত বা নির্দেশ পাইনি। আপনার কাছ থেকে কোনও সদুত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমি এখানেই অবস্থান করব আর এগুব না। আমার মনে হয় অতি সত্বর আমার ফৌজের সঙ্গে আপনার যোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
ওপরের এই চিঠি থেকে স্পষ্ট, ইংরেজরা সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাবার জন্য কতটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মীরজাফর ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা কিন্তু এ-ব্যাপারে পুরো মনস্থির করে ইংরেজদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েননি—তাঁরা দোনামনা করছিলেন। ২১ জুনও ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটির কাছে জানতে চাইলেন, এ-অবস্থায় তিনি কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। যুদ্ধক্ষেত্রে মীরজাফর যদি শুধু নিরপেক্ষ থাকতে চান, তার বেশি কিছু করতে রাজি না হন, তা হলে তিনি কী করবেন তা নিয়ে খুব চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাঁর ভয় হল ইংরেজরা যদি নবাবকে আগে আক্রমণ করে তা হলে তাদের সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসবে না এবং ফলে ইংরেজ ফৌজ নবাবের সঙ্গে যুদ্ধে আটকে পড়বে। সুতরাং ওই অবস্থায় গাজিউদ্দিন খান বা মারাঠাদের বাংলা অভিযান করার জন্য আমন্ত্রণ জানানোই উচিত হবে।১৯
সে যাই হোক, সিলেক্ট কমিটিকে লেখা ক্লাইভের চিঠি ২৩ জুন আলোচনা করা হল। কমিটির দুই সদস্য, রজার ড্রেক ও রিচার্ড বেচার, মত দিলেন যে ক্লাইভ যা আশঙ্কা করছেন তার খুব একটা ভিত্তি নেই। কমিটি সিদ্ধান্ত নিল: ‘নবাবের সঙ্গে নতুন কোনও চুক্তির কথা ভাবা উচিত হবে না। আমাদের শক্তি যদি থাকে এবং সুযোগ যদি আসে, তা হলে এখনই আমাদের নবাবের বিরুদ্ধে অভিযান করা যুক্তিযুক্ত হবে।’ কমিটি এটাও স্থির করল যে আর বেশি দেরি করলে ইংরেজদের শক্তি দিন দিন কমে যাবে, অন্যদিকে নবাবের শক্তি বৃদ্ধি হবে, কারণ নবাব তখন চারদিক থেকে তাঁর অনুগত সৈন্যদের জড়ো করে ফেলতে পারবেন। তাই কমিটি ক্লাইভকে নির্দেশ দিল, যদি ক্লাইভ মনে করেন যে যুদ্ধে ইংরেজদের সাফল্যের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে তা হলে তাড়াতাড়ি নবাবের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করতে। অবশ্য কমিটির কোনও সংশয়ই ছিল না যে, নবাবকে যদি তাড়াতাড়ি আক্রমণ করা যায় তা হলে সাফল্য আসবেই।২০
কমিটির এই চাতুর্যপূর্ণ চিঠি ক্লাইভের কাছে পৌঁছয় ২৭ জুন। ততদিনে যুদ্ধ শেষ, ক্লাইভ বিজয়ী বীর। তিনি ওই চিঠির উত্তর দিলেন রীতিমতো ব্যঙ্গ করে— ‘আপনাদের চিঠির বক্তব্য এমন অসঙ্গতিপূর্ণ ও পরস্পরবিরোধী যে আমার মনে হয় এটা লেখার আসল উদ্দেশ্য, যদি আমার অভিযান ব্যর্থ হয়, তা হলে তার জন্য আপনারা আমার ওপর সম্পূর্ণ দোষ চাপিয়ে নিজেরা বেঁচে যাবেন।’২১ এর মধ্যে ক্লাইভ খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ২১ জুন যুদ্ধবিষয়ক কাউন্সিলের একটি মিটিং ডাকলেন। সিলেক্ট কমিটিকে লেখা একটি চিঠিতে ক্লাইভ এই মিটিং ডাকার কারণ হিসেবে লিখেছেন যে, কোনও দেশীয় শক্তির সাহায্য ছাড়াই নবাবকে আক্রমণ করা ঠিক হবে কি না বা মীরজাফরের কাছ থেকে সাহায্যের সঠিক প্রতিশ্রুতি না পাওয়া পর্যন্ত এগুনো উচিত হবে কি না এ-সব বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্ত নেবার জন্য।২২ আয়ার কুট (Eyre Coote) কাউন্সিলের আলোচ্য বিষয় জানাচ্ছেন:২৩
কর্নেল [ক্লাইভ] কাউন্সিলকে জানান যে নবাবের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হলে তাতে মীরজাফর নিরপেক্ষ থাকবেন, তার বেশি কিছু করবেন বলে তাঁর মনে হয় না। এদিকে মঁসিয়ে ল’ কিছু ফরাসি সৈন্য নিয়ে নবাবের সঙ্গে যোগ দিতে আসছেন, তাঁর পৌঁছুতে দিন তিনেক লাগবে। ক্লাইভ এই সভা ডেকেছেন, এ-অবস্থায় নবাবের ওপর তক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত, না আমরা যেখানে আছি সেখানে আরও সুসংহত হয়ে বর্ষা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করে তারপর মারাঠাদের নবাবের বিরুদ্ধে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো উচিত, তা জানতে।
এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে পলাশির যুদ্ধের মাত্র দু’দিন আগেও ক্লাইভ সিরাজদ্দৌল্লাকে গদিচ্যুত করার জন্য মারাঠাদের সঙ্গে হাত মেলাবার কথা চিন্তা করছিলেন। এতে এটাই পরিষ্কার বোঝা যায় যে সিরাজকে হঠিয়ে অন্য কাউকে নবাব করার যে-চক্রান্ত সেটা পুরোপুরি ইংরেজদেরই ‘প্রকল্প’ (‘project’)। এ-প্রকল্পের রূপায়ণের জন্য তারা যে-কোনও শক্তি বা গোষ্ঠীর সাহায্য নিতে প্রস্তুত—মুর্শিদাবাদ দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর ওপরই শুধুমাত্র তারা নির্ভর করে ছিল না।
যুদ্ধবিষয়ক কাউন্সিলে ক্লাইভ নবাবকে এক্ষুনি আক্রমণ করার বিরুদ্ধে ভোট দিলেন। কাউন্সিলের অন্য বারোজন সদস্যও এর বিরুদ্ধে ভোট দিল। পক্ষে ভোট মাত্র সাত। কিন্তু এই মিটিং-এর এক ঘণ্টা পরেই ক্লাইভ আয়ার কুটকে জানালেন যে পরের দিনই নবাবের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করা হবে,২৪ যদিও তখনও পর্যন্ত মীরজাফরের কাছ থেকে ইতিবাচক কোনও সংকেত বা নির্দেশ এসে পৌঁছয়নি। এতেই স্পষ্ট যে, বিপ্লব সংগঠিত করতে ইংরেজরা শুধু অস্থিরই নয়, খুব উদগ্রীবও হয়ে পড়েছিল। ২২ জুন ভোরবেলা ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী পলাশি অভিমুখে অভিযান শুরু করল। কিন্তু সেদিনই সম্ভবত যাত্রা শুরু করার আগে ক্লাইভ আবার মীরজাফরকে তাঁর সঙ্গে এসে যোগ দিতে ব্যাকুল হয়ে চিঠি লিখলেন:২৫
যদিও আপনি নিজে কিছুই করছেন না, আপনার জন্য সর্বস্ব বিপন্ন করতে আমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ। আজ সন্ধের মধ্যেই আমি নদীর ওপারে পৌঁছে যাব। আপনি যদি পলাশিতে আমার সঙ্গে যোগ দেন তা হলে আমি মাঝপথ পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে আপনার সঙ্গে মিলিত হতে পারি….আমি আপনাকে শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই এর ওপর আপনার সম্মান ও নিরাপত্তা কতখানি নির্ভর করছে। আপনাকে আমি সম্পূর্ণভাবে আশ্বস্ত করছি যে এটা করলে আপনি তিন প্রদেশেরই (বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা] সুবাদার (নবাব) হবেন। কিন্তু আপনি যদি আমাদের সাহায্যার্থে এটুকুও না করেন তা হলে ভগবান আপনার সহায় হন। আমাদের কিন্তু পরে বিন্দুমাত্র দোষ দিতে পারবেন না।
মীরজাফর যাতে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেন তার জন্য একদিকে কী ধরনের প্রলোভন ও অন্যদিকে যে প্রচ্ছন্ন ভীতিপ্রদর্শন করা হয়েছিল, তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন ওপরের চিঠিটি। শেষ পর্যন্ত ২২ জুন দুপুরের দিকে ক্লাইভের কাছে মীরজাফরের চিঠি এসে পৌঁছুল এবং বিকেলেই ক্লাইভ পলাশি অভিমুখে অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত মীরজাফরকে জানিয়ে দিলেন।২৬
এদিকে নবাবের শিবিরে তখন সম্পূর্ণ বিভ্রান্তি চলছিল। আমরা আগেই দেখেছি ইংরেজ ও ফরাসিরা উভয়েই তাদের সাধ্যমতো দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উৎকোচ দিয়ে নিজেদের দলভুক্ত করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু জাঁ ল’-র অর্থবল তেমন ছিল না, ফলে তিনি শুধু এমন সব ব্যক্তিদের হাত করতে পেরেছিলেন যাদের সম্বন্ধে ইংরেজদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। এরা ফরাসিদের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করেছিল। অন্যদিকে ইংরেজরা প্রচুর টাকাপয়সার জোরে ও উমিচাঁদের সহায়তায় মুর্শিদাবাদ দরবারে ফরাসিদের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। চন্দননগরের পতনের পর সিরাজদ্দৌল্লা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েন। বস্তুতপক্ষে এর ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসি-নবাব জোটবন্ধনের সম্ভাবনা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং তাতে ইংরেজদের পক্ষে নবাবের বিরুদ্ধে জোরালো ব্যবস্থা নেওয়া অনেক সহজ হয়ে পড়ে। চন্দননগর বিজয়ের জন্য বিহ্বল সিরাজ ইংরেজদের ‘উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন’ জানালেন২৭ ঠিকই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কাশিমবাজারে জাঁ ল’-কে উৎসাহিত করতে বা ব্যুসিকে (তখন দাক্ষিণাত্য থেকে কটকের দিকে আসছেন বলে গুজব) চিঠি লিখতে বিরত থাকলেন না। তা ছাড়াও তিনি সৈন্যবাহিনীর একজন সর্দারকে (জমাদার) একশো জন গোলন্দাজ সমেত কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠি পাহারা দেবার জন্য পাঠিয়ে ছিলেন। ফরাসি কুঠির ওপরে নবাবের একটি পতাকাও টাঙিয়ে দেওয়া হল। সিরাজ ল’-কে খবর পাঠালেন, ভয়ের কিছু নেই, তিনি তাঁর সব সৈন্যবাহিনী নিয়ে ফরাসিদের রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত।২৮ ব্যুসিকেও নাকি নবাব লেখেন:২৯
ইংরেজদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা আপনাকে কী আর বলব! তারা কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই মঁসিয়ে রেনন্টের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছে এবং যুদ্ধে ফরাসিদের পরাস্ত করে তাদের (চন্দননগর) কুঠি দখল করে নিয়েছে। এখন তারা আপনাদের কাশিমবাজার কুঠির প্রধান মঁসিয়ে ল’-র সঙ্গে ঝগড়া বাধাবার চেষ্টা করছে কিন্তু আমি তাতে বাধা দেব এবং তাদের বদ মতলব ভেস্তে দেব। আপনি যখন বালেশ্বরে পৌঁছুবেন তখন আমার আন্তরিকতার নিদর্শনস্বরূপ আমি মঁসিয়ে ল’-কে আপনার সাহায্যার্থে পাঠাব। এখন আমার কর্মচারীদের নির্দেশ পাঠাচ্ছি আপনাকে সবরকম সাহায্য দেবার জন্য।
এ-সব চিঠিপত্রের যাথার্থ্য সম্বন্ধে এখন প্রশ্ন উঠেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু ল’ নিজে তাঁর ও সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ব্যুসির চিঠিপত্রের আদানপ্রদানের কথা উল্লেখ করেছেন।৩০ আসলে সত্যিকারের ব্যাপার বোধহয়, সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের দাপট দেখে কিছুটা ভয় পেয়েছিলেন। আবার দরবারে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাই তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু দুর্বলচিত্ত স্বভাব ও মানসিক স্থৈর্যের অভাবের জন্য দোনামনা করে শেষপর্যন্ত তা করে উঠতে পারেননি।
ইতিমধ্যে চন্দননগরের পতন ও সিরাজদ্দৌল্লার নিঃসঙ্গতার সুযোগে ইংরেজরা আরও সাহসী হয়ে উঠল এবং স্বমূর্তি ধারণ করল। ক্লাইভ এখন ওয়াটসকে এরপর কীভাবে চলতে হবে তার নির্দেশ দিলেন।৩১
এতদিন আমাদের নীতি ছিল নরমে গরমে যখন যে রকম দরকার সেভাবে নবাবকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাংলা থেকে ফরাসিদের তাড়ানোর ব্যবস্থা করা। এখন আমাদের তাঁকে বোঝাতে হবে আমরা যা করেছি তা আমাদের দু’ পক্ষের জন্যই সবচেয়ে উত্তম ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে যে যুক্তি সবচেয়ে কার্যকর হবে তা হল—করমণ্ডল উপকূলে আমাদের ও ফরাসিদের কার্যকলাপের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে নবাবকে বোঝাতে হবে ফরাসিরা কীভাবে নিজাম বাহাদুর সালাবৎ জঙ্গের হাত থেকে তাঁর রাজ্য কেড়ে নিয়ে তাঁকে পুরোপুরি ক্রীড়নক বানিয়েছে…. তা ছাড়া নবাবকে আশ্বস্ত করতে হবে যে আমরা সর্বদা তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে তাঁকে সাহায্য করব। বিনিময়ে আমরা শুধু চাইব যে, আমাদের সঙ্গে নবাবের যে চুক্তি তা তিনি মেনে চলবেন এবং আমাদের স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে দেবেন। এটাও তাঁকে বোঝাতে হবে যে, ফরমানে আমাদের যে সুযোগসুবিধে দেওয়া হয়েছে তার বেশি কিছু আমরা চাই না। এখন থেকে আমরা শুধু বণিক হিসেবেই কাজকর্ম করব। কিন্তু তাঁর শত্রুদের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্য আমরা উপযুক্ত সংখ্যক সৈন্য এখানে রাখব। তাঁকে নিশ্চিত করতে হবে যে আমার সৈন্যবাহিনীর বহর দেখে ফরাসিরা আর কোনও ঝামেলা পাকাবার সাহস পাবে না। তবে তারা নবাবের কোনও একটি প্রদেশ দখল না করা পর্যন্ত অস্ত্রসংবরণ নাও করতে পারে। আমাদের দিক থেকে একমাত্র চাহিদা নবাবের সঙ্গে চুক্তি যাতে পুরোপুরি মেনে চলা হয়। এখন যে শুভ সূচনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ হওয়া একান্ত প্রয়োজন আর সেজন্য নবাব যেন যেখানে ফরাসিরা আছে তাদের সে-সব জায়গা এবং সব সম্পত্তি আমাদের হাতে সমর্পণ করেন।
ক্লাইভের ওপরের নির্দেশ থেকে এটা স্পষ্ট যে ইংরেজদের পক্ষে শুধু চন্দননগরের পতন যথেষ্ট নয়। সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে চুক্তির বাইরে গিয়ে তারা চাইছিল যে, নবাবকে তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহায্য করার অজুহাতে বাংলায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ফৌজ রাখতে এবং ফরাসিদের যাবতীয় কুঠি ও সম্পত্তি হস্তগত করতে। খুব সম্ভবত, চন্দননগরের পতনের পরও ফরাসি-বাঙালি আঁতাতের সম্ভাবনায় তারা আশঙ্কিত ছিল এবং ভাবছিল মঁসিয়ে ল’ যতদিন কাশিমবাজারে থাকবেন ততদিন মুর্শিদাবাদ দরবারে ফরাসি প্রভাব বজায় থাকবে। তাই মাদ্রাজ থেকে তাঁকে ফিরে যাবার জন্য জরুরি বার্তা পাঠানো সত্ত্বেও ক্লাইভ বাংলা থেকে ফরাসিদের সমূলে উৎপাটন করার জন্য বাংলায় থেকে যাওয়াই স্থির করলেন। মাদ্রাজের গভর্নর পিগটকে তিনি ২৯ মার্চ লিখলেন: ‘এখানে আগস্ট মাস পর্যন্ত থেকে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। আমার মনে হয় তাতে করে আমরা এখানে কোম্পানির পক্ষে অত্যন্ত সুবিধেজনক শর্তে সবকিছুর মীমাংসা করতে পারব এবং ফরাসিদের সব কুঠিগুলি আমাদের হাতে সমর্পণ করার জন্য নবাবকে রাজি করাতে পারব। ফলে এখান থেকে ফরাসিদের সম্পূর্ণভাবে বহিষ্কার করা সম্ভব হবে।’৩২ ওই একই দিনে ক্লাইভ সিরাজদ্দৌল্লাকে জানান যে, ইউরোপে ইংরেজ ও ফরাসিরা পরস্পরের সঙ্গে যতদিন যুদ্ধে রত থাকবে বাংলায়ও ততদিন তারা যুদ্ধরত বলে গণ্য হবে। সুতরাং যতদিন না পর্যন্ত নবাব ফরাসিদের সব সম্পত্তি ও কুঠি ইংরেজদের হাতে তুলে দিচ্ছেন ততদিন তাঁর পক্ষে শান্তির কোনও আশা নেই। ক্লাইভ তাঁকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, এ-সব ইংরেজদের দিয়ে দিলে এদেশে তাদের আর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না এবং কেউ যদি দেশের শান্তি বিঘ্ন করার চেষ্টা করে তাদের শায়েস্তা করতে ইংরেজরা নবাবকে সাহায্য করবে।৩৩
সিরাজদ্দৌল্লা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে রেষারেষি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা জিইয়ে রাখতে পারলেই তাঁর পক্ষে সবচেয়ে সুবিধেজনক হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ঘটনাক্রম তাঁর হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি ক্লাইভের প্রস্তাব মেনে নিতে কতগুলি অসুবিধের কথা জানিয়ে আপত্তি করেছিলেন—যেমন ফরাসিরা মুঘল বাদশাহের অনুমতি নিয়েই এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করছিল, তাদের তাড়িয়ে দিলে বাদশাহের রাজস্বের ক্ষতি হবে। তাই তিনি ক্লাইভকে বললেন, ফরাসিরা তাদের সব কুঠিই ইংরেজদের হাতে তুলে দেবে এই মর্মে রেনল্টের কাছ থেকে একটি চিঠি জোগাড় করতে এবং ফরাসিরা চলে গেলে রাজস্বের যে ক্ষতি হবে ইংরেজরা তা পূরণ করে দেবে এই প্রতিশ্রুতি দিতে।৩৪ ক্লাইভ কিন্তু সিরাজের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেন এই বলে যে তিনি ফ্রেব্রুয়ারি চুক্তির শর্তাবলী মানেননি, যেটা আমরা আগেই দেখেছি, একেবারেই ভিত্তিহীন। এ-প্রসঙ্গে জাঁ ল’ মন্তব্য করেছেন যে ইংরেজরা হাজার রকমের নতুন নতুন দাবিদাওয়া নিয়ে সিরাজকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল।৩৫ ক্লাইভ আসলে এ-সব দাবিদাওয়ার অজুহাত তুলে নবাবের ওপরে চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাত এড়াতে সিরাজদ্দৌল্লা শেষপর্যন্ত তাদের অন্যতম দাবি মেনে নিলেন। তিনি ৭ এপ্রিল জাঁ ল’-কে মর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দিলেন। তারপরের ঘটনাবলীর বিবরণ ল’ নিজেই দিয়েছেন—যা থেকে পরিষ্কার, এ সময় নানারকমের বিপাকের সম্মুখীন হয়ে তরুণ নবাব একেবারে দিশেহারা ও অসহায় বোধ করতে থাকেন এবং নিজের কর্তব্য স্থির করতে দোদুল্যমান হয়ে পড়েন।৩৬
জাঁ ল’ জানাচ্ছেন যে ফরাসিদের বিতাড়ন করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নবাবের ছিল না। বরং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজদের দাবিয়ে রাখার জন্য ফরাসিদের উপস্থিতি তার একান্ত প্রয়োজন ছিল। যা হোক, ১০ এপ্রিল নবাব ল’-কে দরবারে ডেকে পাঠান। ল’-র ধারণা, সম্ভবত নবাব তাঁকে বন্দি করে ইংরেজদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই সময় ফরাসি সৈন্যের একটি দল সময়মতো ওখানে উপস্থিত হওয়ায় নবাব তাঁর মত বদলে ফেলেন। নবাবের সঙ্গে ল’-র যখন দেখা হল তখন নবাব তাঁকে পরামর্শ দিলেন, হয় ওয়াটসের প্রস্তাব অনুযায়ী কাশিমবাজারের কুঠি ইংরেজদের হাতে সমর্পণ করে কলকাতা চলে যেতে নয়তো তাড়াতাড়ি নবাবের রাজ্য ছেড়ে দিতে। ল’ জানাচ্ছেন সিরাজদৌল্লা তাঁকে বললেন: ৩৭
আপনাদের [ফরাসিদের] জন্যই ইংরেজদের কাছে আমাকে অপদস্থ হতে হচ্ছে। আপনাদের জন্য সমগ্র দেশে আমি অশান্তি ডেকে আনতে পারি না। আপনার মনে রাখা উচিত যখনই আপনাদের সাহায্য আমার প্রয়োজন হয়েছে তখন তা করতে আপনারা অস্বীকার করেছেন। এখন আমার কাছ থেকে আপনারা কিছুই প্রত্যাশা করতে পারেন না।
ল’ অবশ্য স্বীকার করেছেন যে নবাবের সঙ্গে তাঁরা যে আচরণ করেছেন তারপর নবাবের কাছে জবাব দেওয়ার মুখ তাঁর ছিল না। তিনি এটাও জানিয়েছেন যে, নবাব যখন তাঁকে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যেতে বলেন তখন নবাব মখ নিচ করে ছিলেন—যেন নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই নবাব এই নির্দেশ দিলেন। তিনি যখন নবাবকে বললেন যে পাটনার দিকে যাওয়াই তাঁর ইচ্ছে তখন নবাব এবং খোজা ওয়াজিদ ছাড়া দরবারের বাকি সবাই প্রায় সমস্বরে চিৎকার করে উঠল—ওদিকে নয়, ল’-কে মেদিনীপুর বা কটকের দিকেই যেতে হবে। নবাব মুখ নিচু করেই রইলেন—কিছু উচ্চবাচ্য করলেন না। ল’ যখন জিজ্ঞেস করলেন, নবাব কি চান যে তাঁকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়া হোক, তখন নবাব উত্তর দিলেন, ‘না না, আপনার যেদিকে ইচ্ছে যান, আল্লা আপনার সহায় হন।’৩৮ সিয়র-এর লেখক গোলাম হোসেন জানাচ্ছেন যে সিরাজদ্দৌল্লা ল’-কে বলেছিলেন, প্রয়োজন হলেই তাঁকে তিনি ডেকে পাঠাবেন। উত্তরে ল’ বলেছিলেন—‘আমাকে আবার ডেকে পাঠাবেন? জাঁহাপনা, আপনি আশ্বস্ত থাকুন, এই আমাদের শেষ দেখা। মনে রাখবেন আমাদের আর কোনওদিন দেখা হবে না। আমাদের দেখা হওয়া প্রায় অসম্ভব।’৩৯ তবে ল’ বা ওয়াটস কেউ এ ধরনের কোনও কথোপকথনের কথা বলেননি, যদিও ওয়াটস সর্বদাই প্রায় দরবারে উপস্থিত থাকতেন। ল’ শেষপর্যন্ত ১৬ এপ্রিল মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে পাটনা অভিমুখে রওনা হলেন। মাঝখানে ভাগলপুর অতিক্রম করার সময় তিনি নবাবের একটি পরোয়ানা পেলেন যে তাঁর যাত্রা স্থগিত করে নবাবের নির্দেশের জন্য ওখানে অপেক্ষা করতে। ল’পরের দিনই সে-নির্দেশ পেলেন—তক্ষুনি মুর্শিদাবাদ ফিরে আসতে এবং ইংরেজদের আক্রমণ করতে। কিন্তু তাঁর মনে সন্দেহ জাগল—হয়তো এ-নির্দেশ নবাবের নয়, এর মধ্যে ‘বিশ্বাসঘাতকে’র দল জড়িয়ে আছে। তাই সত্য যাচাই করার জন্য এবং মুর্শিদাবাদের হালচাল জানতে তিনি সাঁ ফ্রে-কে (M. de St. Fray) সেখানে পাঠালেন আর সিরাজদ্দৌল্লাকে লিখলেন যে তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে তিনি প্রস্তুত, তবে সৈন্যদের বেতন দিতে তাঁর অর্থের প্রয়োজন।
সিরাজদ্দৌল্লার কাছ থেকে ল’ দ্বিতীয় পরোয়ানা পেলেন ৬ মে। এতে নবাব তাঁকে মুর্শিদাবাদ আসতে বারণ করে দিলেন। নির্দেশ দিলেন রাজমহলে গিয়ে অপেক্ষা করতে। এদিকে ফরাসি সূত্র থেকে কোনও খবর না পাওয়ায় ল’-র মন থেকে সন্দেহ দূর হল না। তাই তিনি পাটনার পথে মুঙ্গের যাওয়া সাব্যস্ত করলেন। তিনি মুঙ্গের পৌছুলেন ৭ মে। এখানেই তিনি মুর্শিদাবাদে কী ঘটছে তার বিস্তারিত খবর পেলেন। তিনি অবশ্য পরে বুঝতে পেরেছিলেন যে ইংরেজদের ব্যবহারে উত্ত্যক্ত হয়ে সিরাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং স্থির করেছিলেন যে তাদের আর বরদাস্ত করা হবে না এবং ফরাসিদের ডেকে পাঠাতে হবে। এদিকে বিপ্লবের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা যেহেতু তখনও কিছু হয়নি, তাই ইংরেজ ও শেঠরা স্থির করল যে আপাতত নবাবকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে।৪০ ওদিকে জঁ ল’ ৩ জুন পাটনা পৌঁছুলেন, সেখানে বিহারের নায়েব সুবা রাজা রামনারায়ণ তাঁকে আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যথনা করলেন। তিনি বেশ কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবলেন, তেমন নতুন বা আশঙ্কাজনক কিছু ঘটলে সিরাজদ্দৌল্লা নিশ্চয়ই তাঁকে বিশদ জানাবেন। তিনি পরে লিখেছেন, এদিকে ইংরেজরা নবাবকে সম্পূর্ণভাবে প্রতারিত করে তাঁর মধ্যে একটা মিথ্যা নিরাপত্তার ভাব সৃষ্টি করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেল। ইংরেজদের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তখনও পর্যন্ত সিরাজের স্পষ্ট কোনও ধারণা ছিল না। কিন্তু ল’ জানাচ্ছেন—‘এই পুরো সময়টাতেই ইংরেজদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল কীভাবে নবাবের সর্বনাশ করা যাবে এবং তাদের [বিপ্লবের] ‘বিরাট প্রকল্প’ সফলভাবে রূপায়িত হবে।’৪১ সিরাজদ্দৌল্লা ১০ জুন একটি চিঠিতে, যেটা ল’ পেলেন ১৯ জুন, ল’-কে নির্দেশ দিলেন তিনি যেন পাটনাতেই অবস্থান করেন এবং তাঁর সম্বন্ধে কোনওরকম চিন্তা না করেন।৪২ ২০ জুন ল’ পাটনাতে গুজব শুনলেন যে ইংরেজরা মুর্শিদাবাদ অভিমুখে অভিযান করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তিনি ২২ জুনের চিঠিতে সিরাজদ্দৌল্লাকে অনুনয় করে লিখলেন, তাঁর আসা অবধি অপেক্ষা করতে, কারণ তাঁর ভয় হচ্ছিল যে নবাব তাঁর নিজের পক্ষে অসুবিধেজনক একটা সময়ে তাঁর ইংরেজ শত্রুদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে উদ্যোগ নেবেন।৪৩ কার্যত তাই হল—২৩ জুনের মধ্যে সব শেষ। সিরাজদ্দৌল্লাকে সাহায্য করার জন্য ল’ আর মুর্শিদাবাদ পৌঁছে উঠতে পারলেন না।
সিরাজদ্দৌল্লার দৃঢ় সংকল্পের অভাব ও দোদুল্যমান মনোভাবের একটা অন্যতম কারণ ছিল, খুব সম্ভবত, আহমদ শা আবদালির নেতৃত্বে আফগান আক্রমণের আশু সম্ভাবনা। ১৭৫৭ সালের প্রথম দিক থেকেই এ আক্রমণের আশঙ্কা তাঁর কাছে এক বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর মনে হয় তিনি ঠিক করে হোক বা ভুল করে তোক ভেবেছিলেন, ইংরেজদের চাইতে তখন আফগানরাই বড় বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই তিনি ইংরেজদের আপাতত খুশি রাখতে একের পর এক সুযোগ সুবিধে দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ পর্যন্ত ইংরেজদের প্রতি তাঁর আচরণ থেকে স্পষ্ট যে তাদের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাত এড়িয়ে চলাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। আবদালি দিল্লি ও তাঁর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল লুঠতরাজ করে ৩ এপ্রিল দিল্লি থেকে বিদায় নিলেও আফগানদের বাংলা আক্রমণের আশঙ্কা আগের মতোই প্রবলই ছিল, কিছুমাত্র কমেনি। নবাবের সবচেয়ে দক্ষ সৈন্যবাহিনী রাজা রামনারায়ণের নেতৃত্বে আফগান আক্রমণ প্রতিহত করতে বিহার সীমান্তে পাঠানো হয়েছিল। এতে বাংলায় সিরাজের সৈন্যবাহিনী অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। নবাবি ফৌজের যে-অংশ মুর্শিদাবাদে ছিল তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে অনেকেই নির্ভরযোগ্য ছিল না।৪৪ সৌভাগ্যক্রমে এপ্রিলের শেষদিকে আফগান বাহিনী ভারতবর্ষ থেকে নিজেদের দেশে ফিরে যেতে শুরু করল। তখন সিরাজদ্দৌল্লা ক্লাইভকে লিখলেন যে, আফগান আক্রমণের আশঙ্কা যেহেতু বিলীন হয়ে গেছে সেজন্য ইংরেজদের সাহায্য তাঁর আর প্রয়োজন হবে না। তা ছাড়া আবদালির আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়ায় তিনি এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন এবং বেশ কিছুটা সাহস পেয়ে তিনি ক্লাইভকে জানালেন তিনি যেন মুর্শিদাবাদ অভিমুখে তাঁর যাত্রা বন্ধ রাখেন কারণ এটা আলিনগরের সন্ধির পরিপন্থী এবং এতে ওই চুক্তিভঙ্গই করা হবে।৪৫ একই সঙ্গে তিনি মীরজাফরকে পনেরো হাজার সৈন্য নিয়ে পলাশিতে রায় দুর্লভরামের সঙ্গে যোগ দিতে নির্দেশ দিলেন—দুর্লভরাম একমাস ধরে ওখানেই অবস্থান করছিলেন। মনে হয়, আফগান আক্রমণের বিপদ কেটে যাওয়ায় তরুণ নবাব তখন অনেকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য মনস্থির করে ফেলেছিলেন। ওয়াটস ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ক্লাইভকে ২৮ এপ্রিল লিখলেন: ‘নবাব [এখন] তুঙ্গে আছেন….আমি আপনাকে অনুরোধ করছি আপনার ফৌজকে এখন কলকাতা ফেরত পাঠান, শুধুমাত্র চন্দননগরে অল্পসংখ্যক সৈন্য রাখুন। এমন ভাব দেখান যে মাথা থেকে যুদ্ধের চিন্তা তাড়িয়ে দিয়েছেন, আপনার লোকজনদের এদিক ওদিক পাঠাবেন না—একেবারে চুপচাপ থাকুক।’৪৬
আসলে ইংরেজরা বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটানোর জন্য অত্যুৎসাহে তাদের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে লাগল। সিলেক্ট কমিটির আলোচনায় বলা হল, ‘যেহেতু [দেশের] সবাই একটা রাজনৈতিক পরিবর্তন চাইছে, সেজন্য আমরা সাহায্য করি বা না করি, বিপ্লবের একটা প্রচেষ্টা হবেই এবং খুব সম্ভবত তা সফলও হবে। ’পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের ভূমিকার সমর্থনে কমিটি বলছে—‘এমন একটি ঘটনার অলস ও নির্বিকার দর্শক হয়ে থাকাটা রাজনীতিতে গুরুতর ভ্রান্তি হিসেবেই গণ্য হবে। অন্যদিকে যাকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনা হচ্ছে তার মিত্র হিসেবে তার সাহায্যে এগিয়ে গেলে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এবং আমাদের দেশবাসীর প্রভূত লাভেরই সম্ভাবনা।’৪৭ তাই ইংরেজরা এখন সিরাজের প্রতি নরম মনোভাব দেখাতে শুরু করল এবং তাঁকে বেশ মিষ্ট ভাষায় চিঠি দিতে লাগল। পলাশির ষড়যন্ত্র তখনও পূর্ণরূপ না নেওয়ায় ক্লাইভও কিছুটা নরমভাব দেখাতে লাগলেন এবং কিছুটা পিছু হঠতে চাইলেন। তিনি সিরাজকে লিখলেন যে তাঁর অধিকাংশ ফৌজকে কলকাতায় ফেরত যেতে আদেশ দেওয়া হয়েছে এবং সব কামানগুলিও ওখানে পাঠানো হবে। তিনি কায়দা করে এটাও নবাবকে জানিয়ে দিলেন যে বিনিময়ে নবাবও পলাশি থেকে তাঁর সৈন্যবাহিনী সরিয়ে নেবেন, এটা তিনি চান।৪৮ কিন্তু ততদিনে মিষ্টি কথায় ভোলার পর্যায় সিরাজ পেরিয়ে গেছেন—তাঁর সৈন্যবাহিনীকে পলাশি থেকে সরিয়ে নেবার কোনও চেষ্টাই তিনি করলেন না। এ সময়ই তিনি জাঁ ল’-কে মুর্শিদাবাদে ডেকে পাঠালেন। ল’ যদি ঠিক সময় পৌঁছুতে পারতেন তা হলে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজরা আদৌ জয়ী হতে পারত কি না তাতে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।
ইংরেজদের ভাগ্যক্রমে সিরাজদ্দৌল্লাকে প্রতারিত করার আরেকটি সুযোগ তাদের হাতে এসে যায়। এটা দিয়ে তারা নবাবকে তাদের আন্তরিকতার প্রমাণস্বরূপ নিদর্শন হিসেবে দেখিয়ে তাঁকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস পেল। তারা ৯ বা ১০ মে নাগাদ মারাঠা পেশোয়া বালাজি রাও-এর কাছ থেকে মারাঠাদের সঙ্গে তাদের আঁতাতের প্রস্তাব নিয়ে একটি চিঠি পেল। বালাজি রাও প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, এক লক্ষ কুড়ি, হাজার মারাঠি অশ্বারোহী সৈন্য নবাবের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেবে এবং কলকাতায় ইংরেজদের যা ক্ষতি হয়েছে তার দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ তাদের দেওয়া হবে। ক্লাইভ প্রথমে ভাবলেন চিঠিটা জাল এবং এটা লিখে নবাব ইংরেজদের আসল উদ্দেশ্য যাচাই করতে চাইছেন। স্ক্র্যাফ্টন অবশ্য বলেছেন যে ক্লাইভ পত্রবাহকের সঙ্গে গোপনে একটা বৈঠক করেছিলেন।৪৯ শেষপর্যন্ত ক্লাইভ এই চিঠিকে দুটো কাজে লাগাতে চাইলেন—প্রথম, ওয়াটসকে বললেন, মীরজাফরকে ব্যাপারটা সম্বন্ধে জানাতে। তা হলে হয়তো মারাঠা আক্রমণের ভয়ে মীরজাফরও বিপ্লব ত্বরান্বিত করতে বাধ্য হবেন। অন্যদিকে স্ক্র্যাফ্টনের মারফত চিঠিটা সিরাজদৌল্লাকে পাঠিয়ে দেওয়া যাতে নবাব ইংরেজদের আন্তরিকতা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হন।৫০ মারাঠাদের চিঠিটি নিয়ে সিলেক্ট কমিটি যে সিদ্ধান্ত করল তা থেকে ইংরেজদের দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং এটাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যে-কোনও উপায়ে সিরাজকে হঠাতে তারা বদ্ধপরিকর ছিল। কমিটির সিদ্ধান্ত: ৫১
কমিটির সদস্যরা সবাই একমত যে মারাঠা শাসন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য এবং সম্ভব হলে আমরা তা কখনও হতে দেব না। সেজন্যই আমরা মীরজাফরকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনা সমর্থন করি, যদি তা কার্যে পরিণত করা যায়। কিন্তু এমনও হতে পারে যে আমাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে এবং নবাবের সঙ্গে আবার আমরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যেতে পারি। সেক্ষেত্রে মারাঠাদের সাহায্য দেশের [বাংলার] বিভিন্ন অঞ্চলে যে অরাজকতার সৃষ্টি করতে পারবে তা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত সুবিধেজনক হবে। তাই ঠিক করা হল যে বাজিরাও’র সঙ্গে বন্ধুতাপূর্ণ যোগাযোগ রেখে চলাই শ্রেয়। সুতরাং তাঁর প্রস্তাব পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান বা তা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ কোনওটাই করা হবে না।
লিউক স্ক্র্যাফ্টন বাজিরাও-এর চিঠি নিয়ে সিরাজদৌল্লার কাছে গেলেন। চিঠিটি সম্বন্ধে নবাবের প্রথমে সন্দেহ হয় কিন্তু স্ক্র্যাফ্টন বেশ চাতুর্যের সঙ্গে তাঁর সন্দেহ ভঞ্জন করতে সক্ষম হন। ফলে ইংরেজদের চালাকি বেশ সফল হল৷ সিরাজদৌল্লা ক্লাইভের ‘প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ফেটে পড়লেন,’ এবং এমনকী ঘোষণা করলেন যে তিনি পলাশি থেকে তাঁর সেনাপতিদের—রায়দুর্লভ, মীরজাফর ও মীর মর্দান— ফিরে আসার নির্দেশ দেবেন। নবাব অবশ্য প্রথমে বলেছিলেন যে শুধু মীরজাফরকে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। তাতে কিন্তু চক্রান্তকারীরা খুব বিপদে পড়ে যেত। তাই ওয়াটস ভাবছিলেন মীরজাফর যাতে পলাশি থেকে এক পা না নড়েন সে-সম্বন্ধে তাঁকে সাবধান করে দেওয়ার কথা। ইংরেজদের ভাগ্যক্রমে সিরাজদৌল্লা অচিরেই তাঁর মত পরিবর্তন করেন এবং তিন সেনাপতিকেই মুর্শিদাবাদে ফিরে আসতে নির্দেশ দেন।৫২ মীরজাফর ৩০ মে মুর্শিদাবাদে ফিরে এলেন।
ততদিনে ষড়যন্ত্রের কথা লোকে বলাবলি করতে শুরু করে দিয়েছে। সিরাজদৌল্লাও হয়তো কিছুটা আভাস পেয়েছিলেন। তাই তিনি মীরজাফরকে সরিয়ে খাজা আব্দুল হাদি খানকে বক্সির পদে নিযুক্ত করেন। মুজাফ্ফরনামা-র লেখক করম আলি মন্তব্য করেছেন যে ষড়যন্ত্রের কথা সিরাজকে জানানো সত্ত্বেও তিনি তা অগ্রাহ্য করে ‘ইন্দ্রিয় সুখের ভোগে’ লিপ্ত থাকলেন। তাঁর বিশ্বাসভাজন ও বিশেষ অনুগত ব্যক্তিরা, বিশেষ করে মীর মর্দান ও আব্দুল হাদি খান, তাঁর এহেন নিষ্ক্রিয়তায় অত্যন্ত ব্যথিত হলেন।৫৩ এটা কিন্তু সঠিক বলে মনে হয় না। খুব সম্ভবত ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে এবং ইংরেজদের সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় সিরাজদৌল্লা বিচলিত ও দিশেহারা হয়ে পড়েন। তাই হয়তো নবাব, যারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বলে সন্দেহ করছিলেন, তাদেরও সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে ভয় পাচ্ছিলেন। হয়তো তাঁর তখনও আশা ছিল যে ইংরেজরা আক্রমণ করলে সঙঘবদ্ধভাবে তার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। সে-কারণে তিনি তাড়াতাড়ি মীরজাফর ও খাদিম হোসেন খানকে তাঁদের পুরনো পদে পুনর্বহাল করে তাঁদের সঙ্গে নতুন করে বোঝাপড়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা শপথ নিলেন যে নবাবের প্রতি তাঁরা বিশ্বস্ত থাকবেন।৫৪
মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গী অন্য চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে কোনও চরম ব্যবস্থা না নিয়ে সিরাজদৌল্লা যে সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বস্তুতপক্ষে সিরাজের প্রতি অনুগত সেনাপতিরা মীরজাফরদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেবার জন্য তাঁকে বারংবার অনুরোধ করেছিল। খাজা আব্দুল হাদি খান ও মীর মর্দান নাকি তাঁকে এই বলে সাবধান করেছিলেন যে, ‘ইংরেজদের কার্যকলাপ সহ্যের সব সীমা অতিক্রম করে গেছে। তারা এদেশ জয় করতে বদ্ধপরিকর….মীর মহম্মদ জাফর খান বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে এই নবাবের বংশকে ধ্বংস করতে প্রস্তুত। সুতরাং প্রথমেই তাঁকে খতম করা উচিত। তা হলে পরে ইংরেজদের সঙ্গে মোকাবিলা করা সহজসাধ্য হবে।’৫৫
খুবই সৎপরামর্শ সন্দেহ নেই। কিন্তু করম আলির ভাষ্য অনুযায়ী কয়েকজন ‘বিশ্বাসঘাতক’ মিলে সিরাজকে পরামর্শ দিল যে একটি বিশাল সৈন্যবাহিনী সমাবেশ করে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইয়ে জেতা প্রায় অসম্ভব—তাই তিনি মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গীদের শাস্তি দেবার চিন্তা মাথা থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে মিটমাট করে ফেলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মীর মর্দান আবার তাঁকে সাবধান করে দিলেন এই বলে যে: ৫৬
বিপজ্জনক শত্রু সম্বন্ধে খুবই সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এসময় ওই সব সরদারদের [সেনাপতিদের অর্থাৎ মীরজাফর ইত্যাদি] কাছ থেকে কোনও রকম সাহায্য প্রত্যাশা করা আমাদের পক্ষে অনুচিত। আমাদের প্রধান কর্তব্য হবে এদের শায়েস্তা করা। তা হলে সেই শুনেই ইংরেজরা পিছু হঠে যাবে। আমাদের তাঁবুতে ওই দু’জনের [মীরজাফর ও খাদিম হুসেন খান] উপস্থিতি আমাদের অনুগত সেনাপতিদের অস্বস্তি ও আশঙ্কার কারণ হবে। ওঁরা দু’জন বিশ্বাসঘাতকতা করবেনই।
সিরাজদৌল্লা কিন্তু এ-সবে কর্ণপাতই করলেন না। এমনকী স্ক্র্যাফ্টনও জোর দিয়ে বলছেন যে মীরজাফরের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে সিরাজদৌল্লা চরম ভুল করেছিলেন। শুধু তাই নয়। তিনি মন্তব্য করেছেন যে সিরাজ তাঁর নিজের দুর্বলতা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন কিন্তু তার ঊর্ধ্বে উঠে এবং সবরকম ভয় কাটিয়ে মীরজাফরকে শায়েস্তা করতে সাহস করেননি। তার পরিবর্তে বদান্যতা ও ক্ষমা প্রদর্শনের সূক্ষ্ম আড়ালে তাঁকে ভোলাবার চেষ্টা করলেন এবং শপথ বাক্যের মাধ্যমে তা সুদৃঢ় করার প্রয়াস পেলেন।৫৭ জাঁ ল’-ও বলছেন যে চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা না নিয়ে নবাব বিরাট ভুল করেছিলেন। তাঁর মতে মীরজাফর প্রতারণা করেছেন সিরাজদৌল্লা তাও বুঝতে পারেননি। তাঁর সঙ্গে একটা মিটমাট করে ফেললেন। মীরজাফর কোরাণ নিয়ে শপথ করলেন, তিনি নবাবের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন, আর সিরাজ তাতেই সন্তুষ্ট থাকলেন।৫৮ ল’-র সঙ্গত প্রশ্ন, সিরাজদৌল্লা যখন মীরজাফর, জগৎশেঠ এবং অন্যান্যদের তাঁর প্রতি বিরুদ্ধতার কথা জানতেন তখন এঁদের পরিকল্পনার কথা কেন আগে থেকে আঁচ করতে পারেননি? উত্তরটা অবশ্য তিনি নিজেই দিয়েছেন:৫৯
নবাবের এই অদ্ভুত আচরণের একমাত্র ব্যাখ্যা বোধহয় মোহনলালের অসুস্থতার ফলে তিনি একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। কাকে বিশ্বাস করবেন তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তিনি তাঁর শত্রুদের বিশ্বাস করছেন এমন ভাব দেখাতে চাইলেন যদি এভাবে তাদের ছলনা করা যায়। এভাবে আপাতত তাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে পরে সুযোগমতো তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া যাবে, সম্ভবত এটাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
বস্তুতপক্ষে মোহনলালের অসুস্থতাই সিরাজের পক্ষে মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যার ফলে ভাগ্যচক্রের কাঁটা নবাবের বিরুদ্ধে এবং ইংরেজ সমেত ষড়যন্ত্রকারীদের সপক্ষে ঘুরে যায়।মোহনলালের শত্রুরা তাঁকে বিষপ্রয়োগ করেছিল বলে সন্দেহ করা হয়।ইউসুফ আলি বলেছেন মোহনলাল ছিলেন সিরাজদৌল্লার সবচেয়ে বড় ভরসা এবং ডানহাত।৬০ জাঁ ল’ অবশ্য তাঁকে ‘সবচেয়ে বড় বজ্জাত’ বলে অভিহিত করেছেন, যদিও তার কারণ হয়তো তাঁর হতাশা যে মোহনলাল নবাবকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য করতে এবং মুর্শিদাবাদ থেকে তাঁর বিতাড়ন বন্ধ করতে রাজি করাননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে স্বীকার করতে হয়েছে যে সিরাজদৌল্লা ওই সময় যে বিপদে পড়েছিলেন তার মোকাবিলা করার জন্য তাঁর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল মোহনলালকে। ল’ লিখছেন:৬১
মোহনলাল ছিলেন শেঠদের জাতশত্রু এবং তাঁদের সঙ্গে লড়াই করার পক্ষে সবচেয়ে সক্ষম ব্যক্তি। আমার ধারণা মোহনলাল সুস্থ থাকলে এই সওকাররা [জগৎশেঠরা] তাঁদের [বিপ্লবের] প্রকল্পে অত সহজে সফল হতে পারতেন না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, কিছুদিন ধরে এবং এই সংকটের মুহূর্তে মোহনলাল সাংঘাতিক অসুস্থ…. খুব সম্ভবত তাঁকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে। এই দুর্ঘটনায় সিরাজদৌল্লা তাঁর একমাত্র ভরসা থেকে বঞ্চিত হলেন।
ততদিনে ষড়যন্ত্র পাকা হতে চলেছে এবং ওয়াটস মুর্শিদাবাদ থেকে পালাবার ফন্দি করছিলেন। ১২ জুন যখন ওয়াটস মুর্শিদাবাদ থেকে পালান, তখনই নবাব প্রমাদ গুনলেন এবং ইংরেজদের আসল মতলব সম্বন্ধে নিশ্চিত হন। ১৩ জুন ক্লাইভ নবাবকে তাঁর শেষ সতর্কবাণী জানিয়ে দিলেন। তার জবাবে সিরাজদৌল্লা লিখলেন:৬২
ওয়াটসের পলায়ন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রতারণামূলক আচরণ। [আলিনগরের] সন্ধি বানচাল করার জন্যই এটা করা হয়েছে। আপনার অনুমতি ও নির্দেশ ছাড়া ওয়াটস নিশ্চয় এরকম করতেন না। এরকম কিছু যে ঘটতে পারে তা আন্দাজ করেই আমি পলাশি থেকে আমার সৈন্যবাহিনী সরিয়ে আনিনি। কারণ আমি সন্দেহ করেছিলাম আপনারা এরকম কোনও ফন্দি করছেন। আল্লাকে ধন্যবাদ যে আমার দিক থেকে চুক্তিভঙ্গ করা হয়নি।
সিরাজদৌল্লা এখন পাগলের মতো জাঁ ল’-কে চিঠি লিখলেন, তাঁকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহায্য করার জন্য মুর্শিদাবাদ ফিরে আসতে। এ সময় প্রচণ্ড গুজব যে ব্যুসি (Bussy) বাংলার দিকে আসছেন। ইংরেজদের তখনও ভয় ছিল যে ফরাসিরা নবাবকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে পারে।আর নবাবের কাছে তা ছিল একমাত্র আশাভরসা। নবাবের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন অমাত্য আবার তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করল মীরজাফরকে বন্দি করে রাখতে, কিন্তু সম্ভবত এই সংকটময় মুহূর্তে তাঁর সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিভাজন এড়াবার জন্য সিরাজ আবারও মীরজাফরকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করলেন। মীরজাফর তাঁর আস্থাভাজন ওমর বেগকে ১৯ জুন লেখা একটি চিঠিতে নবাব তাঁকে কীভাবে তোয়াজ করছেন তা সবিস্তারে জানালেন: ৬৩
ওয়াটসের [পালানোর] খবর সোমবার সকালে জানাজানি হয়ে যায়। এতে নবাব বেশ বিচলিত হয়ে পড়েন। আমাকে খুশি করা একান্ত প্রয়োজন মনে করে তিনি নিজেই আমার কাছে আসেন।বৃহস্পতিবার বিকেলে হুগলি থেকে চিঠি এসেছে যে তারা [ইংরেজরা] তাদের অভিযান [পলাশি অভিমুখে] শুরু করেছে। নবাব চাইলেন আমি যেন তাঁর সঙ্গে থাকি। তিনটে শর্তে আমি রাজি হলাম।প্রথম, আমি তাঁর সৈন্যবাহিনীতে কাজ করব না; দ্বিতীয়, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব না আর শেষ শর্ত, আমি তাঁর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেব না। আমি তাঁকে খবর পাঠালাম তিনি যদি এ-সব শর্তে রাজি থাকেন তা হলে তাঁর সঙ্গে যেতে আমি প্রস্তুত। যেহেতু আমাকে তাঁর প্রয়োজন ছিল, তিনি রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু আমি সব সেনাপতি ও গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধানের কাছ থেকে লিখিয়ে নিলাম যে ইংরেজদের পরাজিত করার পর আমি এবং আমার পরিবারের সকলে যেখানে যেতে চাই তারা আমাদের সেখানে যেতে দেবে।
সিরাজদৌল্লার পক্ষে অপমানজনক শর্ত সন্দেহ নেই কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ শক্তি প্রদর্শনের আশায় তিনি সব মেনে নিলেন। কিন্তু সব বিফলে গেল কারণ ক’দিনের মধ্যেই মীরজাফর নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। পলাশির রঙ্গমঞ্চ অবশেষে তৈরি হয়ে গেল। ষড়যন্ত্র এখন পাকা। ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টন ষড়যন্ত্র সফল করতে আপ্রাণ করেছেন। মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়ে গেছে, শীলমোহর দিয়ে তা ইংরেজদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ষড়যন্ত্রের পুরো খসড়া তৈরি এবং সব আয়োজন সমাপ্ত।পলাশির যুদ্ধ অবধারিত হয়ে গেল—পলাশি অভিমুখে যাত্রার আর কোনও পিছুটান রইল না।
নবাবও তাঁর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হবার জন্য যাত্রা শুরু করলেন। তাঁর সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন অনুমান আছে—স্ক্র্যাফ্টনের মতে তার সংখ্যা ৭০,০০০, ক্লাইভ ও আয়ার কুটের অনুমান ৬০,০০০ আর ওয়াটসের মতে ৩৫-৪০,০০০৷ তবে কাশিমবাজারের ডাচ কর্মচারী ভেরনেটের (Vernet) অনুমান যে, নবাবের বাহিনীতে প্রকৃত যোদ্ধার (vanguard) সংখ্যা ছিল ১৫,০০০ এবং এটাই অনেকটা সঠিক অনুমান বলে মনে হয়।৬৪ নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীতে সাঁ ফ্রে-র নেতৃত্বে ৪০-৫০ জনের মতো ফরাসিও ছিল। কামানের সংখ্যা ৪০টির মতো। ইংরেজদের ফৌজে ছিল এক হাজার ইউরোপীয়, দু’হাজার সেপাই, ৫০জন নৌসেনা আর ৮টি কামান।৬৫ যুদ্ধক্ষেত্রে মীরজাফর, রায় দুর্লভরাম ও ইয়ার লতিফ খানের নেতৃত্বে নবাবের সৈন্যবাহিনীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ একেবারে পুতুলের মতো নিষ্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।নবাবের সৈন্যবাহিনীর অগ্রবর্তী অংশের নেতৃত্বে ছিলেন তাঁর অনুগত সেনাপতিরা—মোহনলাল, মীর মর্দান, খাজা আব্দুল হাদি এবং নবসিং হাজারী প্রভৃতি। সিয়র-এর লেখক গোলাম হোসেন লিখেছেন, মীরজাফর তাঁর অধীনস্থ সৈন্যবাহিনী নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন, একেবারে যেন দর্শক হয়ে, নিতান্ত মজা দেখতেই যেন যুদ্ধে আসা।৬৬ আর রিয়াজ-এর লেখক বলছেন মীরজাফর তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে নবাবের মূল বাহিনীর বাঁদিকে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন—নবাব তাঁকে বার বার তাঁর দিকে আসার জন্য অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও একবিন্দু নড়লেন না।৬৭
তা সত্ত্বেও পলাশির তথাকথিত যুদ্ধে হার-জিৎ আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে যায়নি, প্রথমে যথেষ্ট অনিশচয়তাই ছিল.২৩ জুন সকালে যখন নবাবের সৈন্যবাহিনী তাঁবু থেকে বেরিয়ে সারিবদ্ধভাবে মাঠে দাঁড়াল তা দেখে স্ক্র্যাফ্টন লিখেছেন:৬৮
…when the Soubah’s army appeared marching from their fortified camp…and what with the number of elephants all covered with scarlet cloth and embroidery; then horses with their drawn swords glistering in the sun; their heavy cannon drawn by vast trains of oxen; and their standard flying, they made a most pompous and formidable appearance. And their disposition as well as the regular manner in which they formed, seemed to speak greater skill in war than we expected from them.
পলাশিতে নবাবের শিকারগৃহের ছাদ থেকে ক্লাইভ দৃশ্যটা দেখলেন।সকাল আটটায় (ক্লাইভের ভাষ্যে ছ’টায়) যুদ্ধ শুরু হল। কিছুক্ষণ পর ইংরেজদের দিকে নবাবের বাহিনীর এগিয়ে আসা দেখতে দেখতে ক্লাইভের ব্যাপারটা খুব আশাপ্রদ মনে হল না। তিনি ভাবলেন দিনের বেলা কোনও রকমে যুদ্ধ করে রাত্রে কলকাতা ফিরে যাবেন। এমন ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও সিরাজদৌল্লার দিক থেকে এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি, তাঁর সঙ্গে এখনও বেশ কয়েকজন দক্ষ এবং অনুগত সেনাপতি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। মীর মর্দান, মোহনলাল, খাজা আব্দুল হাদি খান, নবসিং হাজারী প্রভৃতির নেতৃত্বে নবাবি সৈন্য ইংরেজদের সঙ্গে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে চলেছিল। সাঁ ফ্রে-র অধীনে গোলন্দাজ বাহিনীও ইংরেজদের ওপর ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করে চলেছিল। ক্লাইভ নিজে স্বীকার করেছেন: ‘[আম্রকুঞ্জে] আমাদের সুবিধেজনক অবস্থান আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে,’ ‘তাদের [নবাবের গোলন্দাজদের] কামান স্তব্ধ করে দেওয়া আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।’ তাই ইংরেজরা চুপ করে তাদের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে রাত্রে শত্রুদের তাঁবু আক্রমণ করার অপেক্ষায় ছিল।৬৯
নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণে আধ ঘণ্টার মধ্যে ইংরেজ ফৌজের ১০ জন ইউরোপীয় ও ২০ জন সেপাই মারা গেল বা আহত হল। ইংরেজদের অপেক্ষাকৃত ছোট ফৌজের পক্ষে এ-ক্ষতি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই ক্লাইভ তাঁর সৈন্যদের আম্রকুঞ্জে আশ্রয় নিতে আদেশ দেন। নবাবের সৈন্যদের দিক থেকে এরকম প্রতিরোধ ক্লাইভ চিন্তাই করতে পারেননি। তিনি নাকি ষড়যন্ত্রকারীদের একজন প্রতিনিধিকে বলেছিলেন যে তাঁকে ধারণা দেওয়া হয়েছিল ‘নবাবের সৈন্যরা এবং তাদের সেনাপতিরা নবাবের ওপর সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ,’ তাই তারা বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ করবে না। কিন্তু এখন তিনি তো দেখছেন ‘সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র’।৭০ জন ডড (John Wood) নামে পলাশিতে যুদ্ধ করেছেন এমন এক ইংরেজ সৈনিক লিখেছেন যে সেদিন সারা সকাল ইংরেজদের অবস্থা ছিল হতাশাজনক এবং রাত না হওয়া পর্যন্ত কিছু করার কথা তারা চিন্তাই করছিল না।৭১ ইংরেজদের অবস্থা যে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও খারাপ হয়ে পড়ে তা ওয়াটসের লেখা থেকেও স্পষ্ট: ‘নবাব বা তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে কেউ যদি ইংরেজদের অবস্থাটা ভাল করে অনুধাবন করতে পারত তা হলে তারা নিশ্চিতভাবে ইংরেজদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং ইংরেজ ফৌজকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করতে পারত। তা হলে ক্লাইভকে [কলকাতা পালাবার জন্য] রাত্রের অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করতে হত। ক্লাইভ আসলে তাই ভেবে রেখেছিলেন।’৭২
চার ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলার ও গোলা বিনিময়ের পরেও কিন্তু কোনও ফলাফল দেখা গেল না।তবে ইংরেজদের অবস্থা তখন মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। ফারসি ঐতিহাসিকদের ভাষ্য অনুযায়ী (এঁরা কিন্তু সিরাজের প্রতি মোটেই সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না), তখন বেলা প্রায় তিনটে, নবাবের জয় প্রায় সুনিশ্চিত হয়ে এসেছে।৭৩ তাঁর সৈন্যবাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখতে থাকলেও ৭৪ বাকি সৈন্যরা তাঁর অনুগত সেনাপতি মীর মর্দান, মোহনলাল ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে বীরত্ব ও অসম সাহসের সঙ্গে পলাশির আম্রকুঞ্জে অবস্থানকারী ইংরেজফৌজের দিক এগোতে লাগল। ঠিক এই সময় হঠাৎ দুর্ভাগ্যবশত মীর মর্দান একটি গোলার আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে পড়েন এবং তাঁকে নবাবের তাঁবুতে নিয়ে আসার পর তাঁর মৃত্যু হয়। এতেই যুদ্ধের মোড় একেবারে ঘুরে যায়। স্ক্র্যাফ্টন লিখেছেন: ‘আমাদের জয়ের একটি বিরাট কারণ যে আমাদের সৌভাগ্যক্রমে মীর মর্দান নিহত হন।’৭৫ মীর মর্দানের এই আকস্মিক মৃত্যুতে সিরাজদৌল্লা দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মীরজাফরকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর রাজকীয় মুকুট মীরজাফরের পায়ে রেখে তাঁর কাছে নিজের প্রাণ ও সম্মান বাঁচাবার জন্য ব্যাকুল আকুতি জানান। মীরজাফর নবাবকে পরামর্শ দিলেন ওইদিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে এবং পরের দিন সকালে তা শুরু করতে। খবরটা তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভকে জানিয়ে দিলেন। সিরাজদৌল্লা দিশেহারা হয়ে রায়দুর্লভকে ডেকে পাঠালেন—তিনিও একই পরামর্শ দিলেন।সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে তরুণ নবাব মোহনলাল এবং অন্যান্য অনুগত সেনাপতিদের—যেমন, খাজা আব্দুল হাদি খান, নবসিং হাজারী, মীর মহম্মদ কাজিম, রাজা মাণিকচাঁদ প্রভৃতি—যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। মীর মর্দানের মৃত্যুর পর মোহনলালই মূল বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ওই সেনাপতিদের সকলেই কিন্তু প্রথমে সিরাজের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলেন, কারণ ওই সময় পিছু হঠে আসা অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে এই যুক্তিতে। কিন্তু নবাবের বারংবার ব্যাকুল অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে তাঁরা শেষপর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন।৭৬ প্রায় সম-সাময়িক ঐতিহাসিক ইউসুফ আলি খান পলাশিতে কী ঘটেছিল তার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন:৭৭
সিরাজদৌল্লা মোহনলাল, খাজা আব্দুল হাদি খান, মীর মহম্মদ কাজিম এবং রাজা মাণিকচাঁদ—যাঁরা নিজের নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন—তাঁদের সবাইকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে নির্দেশ পাঠালেন। কিন্তু তাঁরা সবাই এরকম সময় পিছু হঠাটা যে অত্যন্ত বিপজ্জনক তা যতই বোঝাতে চেষ্টা করুন না কেন, সিরাজ তাঁদের কথায় কর্ণপাতও করলেন না। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা নবাবের সামনে হাজির হলেন।ওই সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁদের ওভাবে চলে আসার নির্দেশ দেওয়ার জন্য মীর মহম্মদ কাজিম বেশ রূঢ় ভাষায় নবাবকে র্ভৎসনা করতেও দ্বিধা করেননি।
সিরাজদৌল্লার সৈন্যরা পেছন ফিরতেই ইংরেজরা তাদের ওপর নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তারপরই নবাবের সৈন্যবাহিনী ছত্রখান হয়ে যায়। বিকেল পাঁচটার মধ্যেই পলাশির যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। পলাশি যুদ্ধের ইংরেজ সৈনিক জন উড যথার্থই মন্তব্য করেছেন: ‘Such was this great and decisive battle by which a kingdom was conquered without there ever having been a general assault.’৭৮ ক্লাইভ সন্ধে ছ’টায় মীরজাফরের অভিনন্দনসূচক বার্তা পেলেন: ‘I congratulate you on executing your design.’৭৯ লক্ষণীয় যে মীরজাফর তখনও কিন্তু বলছেন ‘আপনার [অর্থাৎ ইংরেজদের] পরিকল্পনা।’ ক্লাইভ দাউদপুর থেকে পরের দিনই (২৪ জুন) স্ক্র্যাফ্টন মারফত মীরজাফরকে চিঠি পাঠালেন: ‘I congratulate on the victory which is yours, not mine. I should be glad if you would join me with the utmost expedition. We propose marching tomorrow to complete the conquest…I hope to have the honour of proclaiming you Nabob’.৮০ মুর্শিদাবাদে ক্লাইভই মীরজাফরকে মসনদে বসিয়ে তাঁর মাথায় মুকুট পরিয়ে দিলেন।
.
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. ক্লাইভকে ওয়াটসের চিঠি, ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 397.
২. Select Committee Proceedings, 11 June 1757, Orme Mss., India V, ff. 123-23; O. V. 170, ff.256-57. জোরটা আমার দেওয়া।
৩. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৬ জুন ১৭৫৭, Hill II, p. 400; 7 June 1757, Hil, II, p. 400:
৪. Watts’, Memoirs, P. 107; Hill, II, p. 400; ক্লাইভকে ওয়াটস, ১১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp. 401, 403.
৫. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 403; Watts’, Memoirs, p. 98.
৬. Scrafton, Reflections, pp. 88-89; ক্লাইভকে ওয়াটস ৮, ৯, ও ১১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, PP. 401, 403.
৭. Srcafton, Reflections, pp. 91-92; Watts’, Memoirs, p. 98.
৮. Law’s Memoir, Hill, III, p. 212.
৯. Watts’, Memoirs, pp. 104-105.
১০. শেখ আমিরুল্লাকে ক্লাইভের চিঠি, ১১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 404.
১১. ক্লাইভকে শেখ আমিরুল্লা, ১২ জুন ১৭৫৭, Hill, II, 405.
১২. আলিনগরের সন্ধিতে এমন কোনও শর্ত ছিল না। ইংরেজদের প্রতি তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব ব্যক্ত করার জন্য সিরাজ ব্যক্তিগত চিঠিতে (যেমন ওয়াটসনকে ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 220; ক্লাইভকে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 222) ওটা লেখেন। ওয়াটস পরিষ্কার জানিয়েছেন নবাব ফরাসিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকলেও তাতে তিনি চুক্তির শর্ত, কোনও ক্রমেই ভঙ্গ করেননি (ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 362-63)। ইংরেজরাও নবাবের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু তারা তা আদৌ মেনে চলেননি (নবাবকে ওয়াটসন, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 221)।
১৩. নবাবকে ক্লাইভের চিঠি, ১৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp. 405-07. জোরটা আমার দেওয়া।
১৪. নবাব ওয়াটসনকে, ১৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p.410; ক্লাইভকে নবাব, ১৫ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 411.
১৫. Watts’ Memoirs, p. 108; Scrafton, Reflections, p. 92.
১৬. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভের চিঠি, ১৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp.417-18.
১৭. ঐ, পৃ. ৪১৮।
১৮. মীরজাফরকে ক্লাইভ, ১৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 419. জোরটা আমি দিয়েছি।
১৯. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 414.
২০. Select Committee Proceedings, 27 June 1757, Hill, II, p. 431.
২১. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২৭ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 431.
২২. ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটিকে, ২১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 419.
২৩. আয়ার কুটের জার্নাল, Ome Mss., India VII, f. 1665; Hill, III, p.54.
২৪. ঐ।
২৫. মীরজাফরকে ক্লাইভ, ২২ জুন ১৭৫৭ (১ নং), Hill, II, pp. 420-21; ক্লাইভকে মীরজাফর, ক্লাইভ পেলেন ২২ জুন বিকেল তিনটে, Hill, II, p. 420; মীরজাফরকে ক্লাইভ, ২২ জুন ১৭৫৭ (২ নং), সন্ধেয় ছ’টায় পাঠাননা, Hill II, p. 421. জোরটা আমার দেওয়া।
২৬. মীরজাফরকে ক্লাইভ, ২২ জুন ১৭৫৭, Hill, I, p. 421.
২৭. ক্লাইভকে সিরাজদৌল্লা, ২৯ মার্চ ১৭৫৭, Hill, II, p. 295; Scrafton, Reflections, p. 79.
২৮. Law’s Memoir, Hill, III, p.199.
২৯. ব্যুসিকে সিরাজদৌল্লা, মার্চ ১৭৫৭, Hill, II, p. 314.
৩০. অক্ষয়কুমার মৈত্র, সিরাজদৌল্লা, পৃ. ২৮৭; Law’s Memoir, Hill, II, p. 196.
৩১. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ২৪ মার্চ ১৭৫৭, One Mss., India XI, ff. 2752-54. জোর আমার দেওয়া।
৩২. গভর্নর পিগটকে ক্লাইভ, ২৯ মার্চ ১৭৫৭, Hill, II, p. 303.
৩৩. সিরাজদৌল্লাকে ক্লাইভ, ২৯ মার্চ ১৭৫৭, Hill, II, p. 304,
৩৪. ক্লাইভকে সিরাজদৌল্লা, ৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 316.
৩৫. Law’s Memoir, Hill, III, p. 208.
৩৬. ঐ, পৃ. ২০২-১০।
৩৭. ঐ, পৃ. ২০৫।
৩৮. ঐ, পৃ. ২০৬।
৩৯. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৭।
৪০. Law’s Memoir, Hill, III, p. 208.
৪১. ঐ, পৃ. ২০৯-১০; জোর আমার দেওয়া।
৪২. জাঁ ল’-র সন্দেহ যে ইংরেজরা নবাবের ওয়াকিয়ানবিশকে ঘুষ দিয়ে এই জাল চিঠি লিখিয়েছিল। Law’s Memoir, Hill, III, p. 210, fn.l.
৪৩. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 210, 212.
৪৪. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 116-17.
৪৫. ক্লাইভকে সিরাজদৌল্লা, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 361.
৪৬. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 367.
৪৭. Select Committee Proceedings, 1 May 1757, Hill, II, p. 371.
৪৮. সিরাজদৌল্লাকে ক্লাইভ, ২ মে ১৭৫৭, Hill, II, P. 372; 4 May 1757, Hill, II, pp. 376-77.
৪৯. Scrafton, Reflections, pp. 84-85.
৫০. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১১ মে ১৭৫৭, Hill, II, pp. 378-79; ১২ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 379; সিরাজকে ক্লাইভ, ১৪ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 380; ২০ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 390; ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১৯ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 389; ওয়াটস ভেবেছিলেন যে চিঠিটা নবাবের একটা চালাকি, ক্লাইভকে ওয়াটস, ১৭ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 386.
৫১. Select Committee Proceedings, Orme Mss., India V, f. 1223; O. V. 170, f. 238. জোর আমার দেওয়া।
৫২. Scrafton, Reflections, pp. 85-86; সিরাজদৌল্লাকে ক্লাইভ, ২৫ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 394; ক্লাইভকে সিরাজদৌল্লা, ২৭ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 394.
৫৩. করম আলি, মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৯৮.
৫৪. রিয়াজ, পৃ. ৩৭৪; তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঞ্জী, পৃ.১৩২; মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৪-৭৫; ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৬ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 400; ক্লাইভকে ওয়াটস, ৮ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 401; ৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 403; ১১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 403; Scrafton, Reflections, p p. 89,91-92.
৫৫. মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৪.
৫৬. ঐ, পৃ. ৭৪-৭৫.
৫৭. Scrafton, Reflections, pp. 91-92.
৫৮. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 211-12.
৫৯. ঐ, পৃ. ১৯৪।
৬০. তারিখ-ই বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১৩২।
৬১. Law’s Memoir, Hill, III p. 190. করম আলি এবং ইউসুফ আলি দু’জনই জানিয়েছেন যে, মোহনলাল মারাত্মক এক দুরারোগ্য রোগে সাংঘাতিক অসুস্থ, মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭০; তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১২৯।
৬২. ক্লাইভকে সিরাজদৌল্লা, ১৫ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 411.
৬৩. ওমর বেগকে মীরজাফরের চিঠি, ১৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 416; মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৫।
৬৪. হুগলিতে ডাচ ডাইরেক্টর ও কাউন্সিলকে লেখা ভেরনেটের চিঠি, ২৪ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 426; Scrafton, Reflections, p. 92; সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২৪ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 427, 436. ক্লাইভ ফোর্ট সেন্ট জর্জের সিলেক্ট কমিটিকে, ২ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p, 440; সিক্রেট কমিটিকে ক্লাইভ, ২৬ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 457; তাঁর পিতাকে ক্লাইভ, ১৯ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, III, p. 360; আয়ার কুটের জার্নাল, Hill, III, p. 56; Watts’ Memoirs, p. 109, ইউসুফ আলি (পৃ. ১৩২) বলছেন পদাতিক ও অশ্বারোহী মিলে নবাবের সৈন্যসংখ্যা ছিল ১০,০০০।
৬৫. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩০; ফোর্ট সেন্ট জর্জের সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 440; ক্লাইভ তাঁর পিতাকে, ১৯ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, III, p. 360; Scrafton, Reflections, p. 92; Watts’ Memoirs, p. 109.
৬৬. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩১।
৬৭. রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫; মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৫।
৬৮. Scrafton, Reflections, pp. 93-94.
৬৯. ফোর্ট সেন্ট জর্জের সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 440; লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে ক্লাইভ, ২৬ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 457; Watts’ Memoirs, p. 110.
৭০. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩১; Mark Bence-Jones, Clive, p. 140; Michael Edwardes, Battle of Plassey, pp. 144-45.
৭১. Holden Furber and Kristof Glarnann, ‘Plassey’, p. 178.
৭২. Watts’, Memoirs, p. 110.
৭৩. রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫।
৭৪. সিয়র, পৃ. ২৩১; রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫।
৭৫. Scrafton, Reflections, p. 110.
৭৬. তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১৩৩; সিয়র, পৃ. ২৩২-৩৪; রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫; মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৫-৭৬।
৭৭. তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১৩৩।
৭৮. Holden Furber and Kristof Glamann, ‘Plassey’, p. 181.
৭৯. ক্লাইভকে মীরজাফরের চিঠি, ২৩ জুন ১৭৫৭, (ক্লাইভ পেলেন সন্ধে ছ’টায়), Orme Mss., India, XI, f. 2814.
৮০. দাউদপুর থেকে স্ক্র্যাফ্টনের মারফত মীরজাফরকে ক্লাইভের চিঠি, ২৪ জুন ১৭৫৭, Orme Mss., India, XI, f. 2815.