৮. নতুনভাবে দেশগঠন
If I were to look over the whole world to find out the country most richly endowet with all the wealth, power and beauty that nature can bestow- is some parts a very paradise on earth–I should point to India.
–F. Max muller
২০০১ সালের ঝাড়খণ্ড সফরের উল্লেখ করে এ বইয়ের লেখা শুরু করেছিলাম। যে সফরটির কথা বইয়ের শুরুতে উল্লেখ করেছি সেটা ছিল চতুর্থবারের মত আমার ঝাড়খণ্ড সফর। ঝাড়খণ্ড রাজ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক উন্নয়ন বিপ্লব চলছে, প্রথম দুই সফরেই আমি তা টের পেয়েছিলাম। এ রাজ্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কাউন্সিল গঠনে আমি পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলাম।
চতুর্থবারের মত আমার ঝাড়খণ্ড সফরের উদ্দেশ্য ছিল এ রাজ্যের পল্লী ও বনজ সম্পদসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়নের বিষয়ে একটি প্রকল্প চালু করা। এ কারণে আমি ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী বাবুলাল মারান্ডি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী সমরেশ সিং এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সংগে বৈঠক করি। ঝাড়খন্ডের আগে আমার সফর ছিল রাচিতে। রাঁচিতে পৌঁছানো মাত্র ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমাকে ফুল দিয়ে অভিবাদন জানাল। আমার মত একজন সাধারণ তুচ্ছ বিজ্ঞানী এবং তার স্বপ্নের প্রতি তাদের এত আস্থা দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত হলাম।
এছাড়া ওই সফরের সময় আমি ঝাড়খন্ডের গভর্ণর প্রভাত কুমারের সংগে দেখা করলাম। তিনি আমাকে এ এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিশ্রমী মানুষদের ব্যাপারে নানা তথ্য দিলেন।
তারও আগে আমি রাচি থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরবর্তী একটি পাহাড়ি গ্রামে গিয়েছিলাম। শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিষয়ক একটি প্রকল্প পরিদর্শনের জন্য প্রফেসর বসু আমাকে সেখানে নিয়ে যান। যখন আমি সেই পাহাড়ি আবাল বৃদ্ধবণিতার সংগে মাটিতে বসে কথা বলছিলাম তখন আমার পরিষ্কার মনে হচ্ছিল সেখানে আমার উপস্থিতি ছিল একেবারে ভবিতব্য। উন্নয়নের উপযোগী এক একজন সাহসী সৈনিক আমার সামনে। ওখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়। সারা এলাকা জুড়ে আকাশ ছোঁয়া বৃক্ষরাজি আর ঊর্বর ফসলের মাঠ। সবচেয়ে বড় কথা হলো ওই মানুষগুলো সবাই কৃষির জন্য নিবেদিত প্রাণ পরিশ্রমী কৃষক।
তাদের চোখেমুখে যে অকৃত্রিম হাসির ঝিলিক আমি দেখেছিলাম তা সচরাচর আর চোখে পড়ে না। অন্তত এই শহুরে জীবনে তো নয়ই। তবে সেই হাসির আড়ালেও ঢের বোঝা যাচ্ছিল, বেঁচে থাকার তাগিদে সহ্যক্ষমতার চেয়ে বেশী তারা পরিশ্রম করছিল।
ওই সফরের সময়ই আমরা সেখানে উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আয়ুর্বেদীয় ওষুধ কারখানা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করলাম। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল হার্বাল ওষুধ ও প্রসাধনী পণ্য সেখানেই উৎপাদন করে সেখান থেকে সরাসরি বাজারজাতকরণের মাধ্যমে এলাকাবাসীর রোজগার ও জীবনযাত্রার মান বাড়ানো। আমাদের এ উদ্যোগ এলাকাবাসীর জন্য ছিল একটা নতুন পরীক্ষামূলক বিষয় এবং আমাদের জন্য ছিল নতুন পরীক্ষামূলক মিশন। কিন্তু এই মিশন পরিচালনা করতে গিয়ে দেখলাম ঝাড়খন্ডে ঔষধি দ্রব্য সামগ্রী, আয়ুর্বেদিক ওষুধ ও প্রসাধনীর সুবিশাল সম্ভাবনা।
রাঁচির বৈঠক শেষ করে ঝাড়খন্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হব হব করছি, এমন সময় দেখলাম আকাশে মেঘ। ফ্লাইট বাতিল করা হবে কি হবে না তা নিয়ে ইতিমধ্যে জল্পনাকল্পনা শুরু হয়ে গেছে। হলোও তাই। খবর এল খারাপ আবহাওয়ার কারণে রাচি থেকে ফ্লাইট চলাচল আপাতত বন্ধ। রাজ্য সরকার আমার যাবার জন্য একটা পবন হ্যাঁন্স হেলিকপ্টার ভাড়া করে আনল। এ আবহাওয়ায় চালানো যাবে কি না আমি পাইলটকে এ প্রশ্ন করতেই সে সহ সবাই উষ্ণ হাসিতে আমার সকল ভাগ্যবিড়ম্বনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলেন। পাইলট আমাকে খুব ভাল একটি ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিলেন। খুব ঝক্কিহীনভাবে আমিসহ আমার বেশকয়েকজন সাথী নিয়ে উড়ল কপ্টারটি।
আমাকে প্রায়ই হেলিকপ্টারে চড়তে হয়। কিন্তু এ ধরনের মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় কখনও আমাকে পড়তে হয়নি।
কপ্টারটির পাইলটকে খুব দক্ষ মনে হল। ছন্দময়ভাবে, ঝাঁকির হাত এড়িয়ে চালানোর জন্য বেশ কয়েকবার তাকে ধন্যবাদও দিলাম। অরণ্য, পাহাড় আর নদী ছুঁই ছুঁই করে আমরা যখন এগুচ্ছিলাম সে দৃশ্য আমার কাছে এক বিরল অভিজ্ঞতা। আমি বিভোর হয়ে এই নির্মল শ্যামল শোভা দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, সাময়িক লাভের আশায় যারা আমাদের এই বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করছে তাদের হাত থেকে এ সম্পদরাশি আমাদের বাঁচাতেই হবে। ভাবতে ভাবতে খেয়াল হল আমরা নিচের দিকে নামা শুরু করেছি।
হঠাৎ খেয়াল করলাম পাইলট দুজন আরপিএম পতনের বিষয় নিয়ে উত্তেজিত ভাবে কী যেন বলাবলি করছে। আমি সতর্ক হয়ে বসলাম। নিচে তাকিয়ে দেখি অসংখ্য গাড়ি। আর চারদিকে পিঁপড়েসারির মত মানুষ। ঠিক পরমুহূর্তেই ক্র্যাশ করলো কপ্টারটি। কপ্টারটি বিকটশব্দে মাটিতে আঘাত করলো। ভাঙাচোরা যন্ত্রাংশ আশপাশ দিয়ে উড়ে গেল। দেখলাম আমাদের দিকে ছুটে আসছে অগ্নি নির্বাপনী কয়েকটি গাড়ি।
আমি স্বাভাবিকভাবেই হেলিকপ্টার থেকে নেমে এলাম। একেবারে মরা মানুষের মত ধপাস করে মাটিতে পড়েছিল কপ্টারটি।
আমাদের ভাগ্য ভাল ল্যান্ড করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কপ্টারে যান্ত্রিক জটিলতা দেখা দিয়েছিল। ভূমি থেকে সামান্য ওপরে থাকতে ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ায় সেদিন আমরা বেঁচে গেছি।
পাইলট দুজন অসহায়ের মত আমার দিকে তাকালো। তারাও এ ঘটনায় বড় ধরনের মানসিক ধাক্কা খেয়েছে। আমি তাদের সংগে করমর্দন করে বললাম ফ্লাইং মেশিন চালাতে গেলে এরকম দুএকটা দুর্ঘটনা তো ফেস করতেই হবে।
সেদিন রাঁচিতে চিন্ময় বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সংগে আমার দেখা করার কথা ছিল। তাদের সংগে যোগ দিতে কপ্টার দুর্ঘটনার আঘাত ও ভয় ফেলে ছুটলাম চিন্ময় বিদ্যালয়ে। স্কুলের প্রিন্সিপাল কৃষ্ণস্বামী আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন এবং অডিটরিয়ামের মাঝখান দিয়ে বক্তব্য মঞ্চে যাবার সময় ছেলে মেয়েরা আমার মাথায় বৃষ্টির মত গোলাপের পাপড়ি ছড়াতে লাগলো। আমি আসার আগেই কপ্টার ক্র্যাশের খবর চলে এসেছিল। বাচ্চারা সব পিনপতন নিরবতায় আমার সামনে বসেছিল।
পরিস্থিতি সহজ করার উদ্দেশ্যে শিশু-কিশোরদের উদ্দেশ্যে বললাম, বন্ধুরা, রাচি থেকে এখানে আসবার সময় আমি তোমাদের প্রতি ঈশ্বরের দেওয়া উপহার দেখতে দেখতে তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম।
তোমাদের পায়ের নিচে এবং পায়ের ওপরে ঈশ্বর তোমাদের সীমাহীন সম্পদ দিয়েছেন। ঝাড়খন্ডের উর্বর মাঠ তোমাদের শস্যের সম্পদ দিতে পারে। যখন আমি তোমাদের পাহাড়, উপত্যকা, অরণ্য আর নদীর ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারে উড়ে উড়ে আসছিলাম তখনই ভাবছিলাম তোমাদের এ এলাকা হার্বাল সামগ্রী উৎপাদনের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক। তোমাদের এখানে দেখলাম পুরোমাত্রায় চলছে একটি সম্ভাবনাময় স্টীল প্ল্যান্ট। আমি আমার দিব্যদৃষ্টিতে এ এলাকাকে একটি উন্নত শিল্প এলাকা হিসেবে দেখতে পাচ্ছি। উন্নত ও সমৃদ্ধ রাজ্যের জন্য যা যা থাকা দরকার তার সবই এখানে আছে। এখানকার ভূমিগুলোকে শুধু সেই পর্যায়ে পরিবর্তন করা দরকার। আমি দেখতে পাচ্ছি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তোমাদের গ্রামগুলো শহরের যাবতীয় সুযোগসুবিধা অর্জন করতে পারবে। আজকের এই দুর্ঘটনা আমাকে বাকি জীবনের মিশন নির্ধারণে আরও বেশী প্রেরণা দিয়েছে। তোমাদের সামনে সমৃদ্ধির অপার সম্ভাবনা। উন্নত রাজ্য হিসেবে তোমাদের রাজ্যকে গড়ে তুলতে কীভাবে তোমরা সমন্বিত প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নামবে? এ সফলতার জন্য সবাইকে মিশন মুড নিয়ে কাজ করতে হবে।
একদিন এই শিশুগুলোই বড় হবে। বিভিন্ন পদে আসীন হবে। এরাই সুশীল সমাজের অংশ হয়ে উঠবে। দেশের প্রতি তাদের অবদান তখন উন্নত রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে। একদিন এদেরই প্রধান লক্ষ্য হবে ঝাড়খণ্ডকে মহান ও উন্নত রাজ্যে পরিণত করা।
শিশুদের হাতে তৈরী বিভিন্ন খেলনা, আঁকা ছবির প্রদর্শনী দেখে এবং তাদের পরিবেশিত ময়ূরনাচ সহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক পরিবেশনা দেখে আমার মনে হচ্ছিল সৃষ্টিশীলতা বিকাশ ও উন্নত শিক্ষার জন্য তাদের এ কার্যক্রম খুবই আশাবহ অবদান রাখবে। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম এমন একটি সম্ভাবনাময় রাজ্যের সংগে অবশ্যই আমি কাজ করে যাবো।
চিন্ময় বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে টাউন হলের একটি পূর্ব নির্ধারিত মিটিংয়ে যোগ দিতে গেলাম। অবশ্য বোকারো স্টিল প্লান্টের জেনারেল ম্যানেজারের পাঠানো একদল ডাক্তার আমাকে সেখানে না গিয়ে বারবার বিশ্রাম নেবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। আমি তাদের অনুরোধ উপেক্ষা করেই টাউন হলের মিটিংয়ে উপস্থিত হই। সেখানে আমার বক্তব্যের বিষয়বস্তু ছিল, ঝাড়খন্ডের সুপ্ত সামর্থ্য ও শিল্প কারখানা। পরবর্তী আলোচনা ও বাকবিনিময়ে আলোচ্য বিষয়ের গভীরতা তলিয়ে দেখা যাবে একথা বিবেচনা করেই আমি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলাম।
ইতিমধ্যেই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া যা করার করে ফেলেছে। আমাদের আগমন। উপলক্ষ্যে বাছা বাছা সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা আমাদের সংগে এসেছিলেন। ফলে হেলিকপ্টার ক্র্যাশের ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে সারা দেশে প্রচারিত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর পর আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠতে লাগল। আমি সুস্থ্য আছি কিনা তা জানার জন্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা ফোন করছিলেন। আমি মিটিংয়ের আলোচনায় ব্যাঘাত না ঘটিয়ে রাচি থেকে আমার সহগামী হওয়া বন্ধু ড. বিজয় রাঘবনকে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, কলগুলো রিসিভ করে তিনি যেন সবাইকে জানিয়ে দেন আমি সুস্থ্য আছি। একই সংগে রামেশ্বরমে বসবাসরত আমার ছিয়াশি বছর বয়স্ক বড়ভাইকে ফোন করে আমার সুস্থতার কথা জানাতে বললাম। দিল্লিতে অবস্থানরত আমার আরেকজন একান্ত সচিব শেরিডনকে ফোন করে জানাতে বললাম সে যেন বাইরের ফোনগুলো রিসিভ করে আমার সুস্থ্যতার খবর সবাইকে জানায়।
আমি মিটিংয়ে কথা বলছি, এ সময় বিজয় রাঘবন আমার সামনে একটা চিরকুট রাখলেন, তাতে লেখা, আপনার ভাই কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছেন না যে আপনি সুস্থ্য। তিনি আপনার সংগে কথা বলতে চাইছেন। বড় ভাইরা চিরকালই বড়ভাই থেকে গেলেন। আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে তার সংগে কথা বলতে হল আমাকে।
মত বিনিময় সভায় একজন প্রশ্নকারী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ড. কালাম, আপনি আমাদের বলবেন কেন বিশেষ পূর্বপরিকল্পিতভাবে আমাদের বন্দরগুলো থেকে কাঁচামাল রফতানি করা হচ্ছে?
এই ঝাড়খন্ডে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ থাকায় এবং তা বাইরের দেশে রফতানি করায় প্রশ্নটি প্রাসংগিক ও সময়োপযোগী হয়েছে। তার প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমি গোয়াতে বন্ধুদের সংগে আলোচনার একটি বিষয় খুলে বললাম। একবার গোয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখতে যাচ্ছিলাম, আমার সহগামী হয়েছিলেন ড. হোসে পল। তিনি গোঁয়ার মারগুয়াও বন্দরের চেয়ারম্যান।
আমরা আমাদের ভারতের লোহা রফতানির বিষয়ে কথা বলছিলাম। আমাদের কথাবার্তার মূল বিষয় ছিল ভারতের অপরিশোধিত লৌহ আকর জাপানে রফতানি নিয়ে। পল জানালেন, প্রতি বছর ৩ কোটি টন লৌহ আকর চারটি বন্দর থেকে জাপানে রফতানি করা হয়। এর মধ্যে ১ কোটি ৭০ লাখ টন রফতানি হয় এই মারগুয়াও বন্দর থেকে। বিদেশী ক্রেতা দেশগুলো এই কাঁচা লোহাকে অত্যন্ত নিম্নমানের বিবেচনা করায় প্রতিটন লোহা মাত্র কয়েক ডলারে বিক্রি করা হয়। অথচ ওই কাঁচা লোহা রফতানি না করে যদি তা দেশে কাজে লাগানো যায় তাহলে তাকে আরও বেশী স্থানীয় আয় বাড়বে। তবে এর জন্য সঠিক মূল্য সংস্কার করা দরকার।
এটুকু বলতেই বোকারোর মতবিনিময় সভার একজন দাঁড়িয়ে বললো, মূল্য সংস্কার বলতে আপনি কী বোঝাতে চান? একটা উদাহরণ দেবেন কি?
আমার একটা সুন্দর উদাহরণের কথা মনে পড়লো।
১৯৭০ সালের স্যাটেলাইট অভিযানের জন্য আমরা যখন কাজ করছিলাম, তখন বেরিলিয়াম ডায়াফ্রাজমস নামের একটি জিনিসের দরকার পড়লো। এটি এক ধরনের তাপনিয়ন্ত্রক সাদা ধাতুতে তৈরী হয়। রকেট অথবা ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপনের পর তার গতি এবং প্রকৃতি সম্বন্ধে তথ্য দানকারী জোরাস্কোপ ও সেন্সর মেশিনে এ বিশেষ ধাতু ব্যবহৃত হয়। যেহেতু আমাদের দেশে ওই ধাতু ছিল না সেজন্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তা কিনে আনবার জন্য একটি বিশেষ দল গঠন করা হল।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশানের নেতৃত্বে মাধব নায়ার, ড. এস. সি. গুপ্ত এবং আমি বেরিলিয়াম কেনার জন্য নিউইয়র্কের একটি কোম্পানীর কাছ থেকে ১শ বেরিলিয়াম ডায়াফ্রামের আমদানির চুক্তি করলাম।
তিন মাস পর ওই কোম্পানী থেকে একটি মেসেজ এল যাতে বলা হয়েছে, যেহেতু বেরিলিয়াম ধাতুটি উপমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইলে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, সেহেতু ভারতে তা রফতানির অনুমতি দিচ্ছে না মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সমস্যা সমাধানে আমরা তড়িঘড়ি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কোন একটা উপায় খুঁজে বের করতেই হবে।
অবশেষে প্রযুক্তির প্রত্যাখ্যানই আমাদের প্রযুক্তি সফলতার পথ দেখাল।
একটি খবর বেরুল ভারতে বিশ্বের সবচে বড় বেরিলিয়াম আরকের খনি রয়েছে। ভারত থেকে যে কাঁচা লোহার আরক জাপানে রফতানি হচ্ছে, তারা তা শোধন করে বেরিলিয়াম রড অথবা শীট তৈরী করছে। জাপান আবার সেই শীটগুলো বিক্রি করছে আমেরিকার কাছে। আমেরিকান কোম্পানী সেগুলো দিয়ে ডায়াফ্রাজম চোঙসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র বানাচ্ছে।
ঘটনা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। চিন্তা করতে লাগলাম, ভারতের খনির বেরিলিয়াম নিম্নমানের লৌহআকর হিসেবে যাচ্ছে জাপানে, জাপান সেটা প্রসেসিং করে পাঠাচ্ছে আমেরিকায় আর সেই ভারতের কাছে প্রক্রিয়াজতকৃত দ্রব্য বেচতে অস্বীকার করেছে আমেরিকা। আমাদের চিন্তার পশ্চাৎপদতা দেখে আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। এ বিষয় নিয়ে পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি শুরু হল এবং বেরিলিয়াম রফতানি বন্ধ করা হল।
এই একই ঘটনার প্রতিফলন ঘটেছে অন্যান্য ক্ষেত্রেও। প্রচুর সম্পদ থাকার পরও ভারত অর্থনৈতিক সফলতা পাচ্ছে না এই মূল্য সংস্কার করতে না পারার কারণে।
এটা শুধু খনিজ সম্পদের কারণে তাই নয় বরং কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রেও ঘটছে একই ঘটনা। একেকটি পণ্যকে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীতে রূপান্তরের সংগে সংগে তার দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এমনকি বেরিলিয়ামের মত তা ১শ গুণ বেশী দামেও বিক্রি হতে পারে। আমাদের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রের মূল্য সংস্কারের উপায় জানতে হবে, নয়তো আমাদেরই জিনিস ওরা পরিবর্তন করে অর্থাৎ মূল্য সংস্কার করে আমাদের কাছে কয়েকগুণ বেশী দামে বিক্রি করবে।
ওই একই মতবিনিময় সভায় আমাকে আরেকটি মজার প্রশ্ন করা হল, আপনি কি রাজনীতিতে স্বচ্ছতা তৈরী করা সম্ভব বলে মনে করেন? যদিও তাৎক্ষণিকভাবে আমি এ প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, তথাপি আমার মনে একটি জবাব ভেসে উঠলো। আমি বললাম, আমাদের দেশ রাজনীতি, শিল্প, বিজ্ঞান, সাহিত্য সর্বক্ষেত্রেই কৃতিত্ব দেখিয়েছে যে কারণে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছিলাম। মহাত্মা গান্ধী, সি.ভি. রমন, জে. আর. ডি. টাটা, ফিরোজ শাহ বি. গোদরেজ, লক্ষনরাও কিরলস্কর, রামকৃষ্ণ বাজাজ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডি. আর. এস. রাধাকৃষ্ণন, মদনমোহন মালবী এসব মহাত্মার তালিকা অনেক দীর্ঘ।
সে সময় এতগুলো প্রতিভা একত্রিত হওয়ায় ভারতভূমি জেগে উঠেছিল। সে সময় ভারত স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়েছিল বলেই রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য সবক্ষেত্রে একটি আবহ তৈরী সম্ভব হয়েছিল।
আমি বিশ্বাস করি, স্বাধীনতার লক্ষ নিয়ে মানুষ যেভাবে জেগেছিল ঠিক সেভাবে যদি আরেকটি দ্বিতীয় গণজাগরণ সৃষ্টি করা যায় তাহলে রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব।
পরের দিন আমি বোকাবরা স্টীল প্ল্যান্ট পরিদর্শনে গেলাম। এটি ভারতের সর্ববৃহৎ স্টীল প্ল্যান্ট। প্ল্যান্টের জেনারেল ম্যানেজার মিস্টার তিওয়ারি আমার সংগে ছিলেন। প্ল্যান্টের আয়তন দেখে যে কারও ভিরমি খাওয়ার কথা। প্ল্যান্টের ভেতরে গিয়ে দেখলাম বিশাল ড্রেনের মত জায়গা দিয়ে গলিত লোহার স্রোত আগুনের নদীর মত বয়ে যাচ্ছে। কয়েক শ মানুষ সেই প্রচন্ড গরমের মধ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের শরীর থেকে দর দর করে ঘাম ঝরছে।
মিস্টার তিওয়ারি জানালেন, এখানকার খনির লোহা শেষ হতে অনেক বছর লেগে যাবে। শুনে খুব ভাল লাগল। কিন্তু যখনই জানলাম এ প্ল্যান্টের ওপর ভিত্তি করে এখানে এখনও কোন কলকারখানা গড়ে ওঠেনি তখন কেমন খারাপ লাগল। আমি আমার সঙ্গীদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম এই লোহার ওপর ভিত্তি করে এখানে তো অনেক লৌহ ও লৌহজাতুদ্রব্যের কারখানা গড়ে ওঠার কথা ছিল, উঠছে না কেন? তারা জানালেন কেন্দ্রীয় সরকারের এখানে কারখানা গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাই স্থানীয়রা এগিয়ে আসছে না।
আমার মনে হল এটা কেন হবে? স্থানীয় কোম্পানীগুলো যদি প্ল্যান্টের আশে পাশে তাদের কারখানা গড়ে তুলতে পারে তাহলে তা সবার জন্যই মঙ্গলজনক হবার কথা।
দিল্লি ফিরে ভাবতে লাগলাম ঝাড়খন্ডকে কীভাবে সাহায্য করা যায়। আমার মনে হল একেকটা নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ঝাড়খন্ডে কয়েকটি মিশন চালু করতে হবে। এই মিশনগুলো সফল করার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার একজোট হয়ে কাজ করবে। এটা কি সম্ভব?
২০০১ সালের অক্টোবর মাসে দিল্লির গুরু গোবিন্দ সিং ইন্দ্রপ্রস্থ বিশ্ববিদ্যালয় সফরের সুযোগ হয় আমার। ছাত্রদের প্রতি দেওয়া আমার ভাষণের বিষয়বস্তু ছিল, দায়িত্বশীল তরুণ নাগরিক। এ বক্তব্যে আমি ভারতকে একটি নলেজ সোসাইটি বা সুশীল সমাজ হিসেবে গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলাম। আমার বক্তব্য শেষ হলে একটি ছাত্র জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি বলবেন কেন ভারতীয়রা, বিশেষ করে শিক্ষিত ভারতীয়রা ইউরোপ আমেরিকায় গেলে খুব ভাল কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে পারে? তারা কিন্তু সেসব দেশে গিয়ে ধনীও হচ্ছে।
আমি বললাম, সম্প্রতি আমি বিদ্যানন্দ রাজঘট্টের লেখা দি হর্স দ্যাট ফ্লিউ নামে একটি বই পড়েছি। যেসব ভারতীয় বিদেশে বিশেষ করে আমেরিকায় তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করেছে এ বইটি তাদের নিয়ে লেখা।
আমি খুব গভীরভাবে খেয়াল করে দেখেছি বইয়ে বিদেশে অবস্থানরত যেসব সফল ভারতীয়র কথা বলা হয়েছে তারা কেউ এককভাবে কাজ করে উন্নতি লাভ করতে পারেনি। তারা সবাই একটা ভিন্ন দেশে, ভিন্ন মানুষের মধ্যে কাজ করার ঝুঁকি নিতে পেরেছে শুধু যুথবদ্ধ সাহসের কারণে।
একবার আমি বি. চন্দ্রশেখরের সংগে দেখা করেছিলাম। তিনি মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির প্রতিষ্ঠাতা। এখানেই প্রথম ভারতের ইন্টারনেট টেকনোলজি সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। একদিন সকালে চন্দ্রশেখর তার সমগ্র প্রতিষ্ঠান ১ হাজার কোটি ডলারে বিক্রি করে দিলেন এবং অন্য প্রতিষ্ঠান শুরু করার উদ্যোগ নিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম নতুন প্রকল্প চালু করার জন্য কী করে তিনি এত বড় ঝুঁকি নিতে গেলেন?
চন্দ্রশেখর আমাকে জানালেন, তিনি ঝুঁকি নিতেই ভালবাসেন। তবে সে ঝুঁকিকে অবশ্যই পরিকল্পিত হতে হবে।
১৯৫৫ সালে মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে আমি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার বিষয় ছিল অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। আমাদের পরিচালক ছিলেন ড. শ্রীনিবাস। শ্রীনিবাস নিজেও বড় অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। আমরা তার তত্ত্বাবধানে থেকে একটি ছোট যুদ্ধ বিমানের ডিজাইন করছিলাম। এর মধ্যে বিবেকানন্দ, মহাবলেশ্বর ভাট এবং আমি এই তিনজনের দায়িত্ব ছিল একটি সিস্টেম ইনটিগ্রেশনের কাজ। তিন মাসের মধ্যে আমাদের ডিজাইন জমা দিতে হবে এবং সেটা এক্সটারনাল শিক্ষকরা পরীক্ষা করবেন।
ইঞ্জিন, কন্ট্রোল সিস্টেম এবং আরও কিছু সাব সিস্টেমের তথ্য বন্ধুরা দুই সপ্তাহ দেরীতে জমা দিল। ফলে ড্রইং জমা দিতে আমারও দেরী হয়ে গেল।
আগস্ট মাসের এক আদ্ৰ সন্ধ্যায় আমি ড্রইং বোর্ডে কাজ করছি। ড. শ্রীনিবাস তার টেনিস কোর্টে যাবার সময় উঁকি দিয়ে আমার কাজ দেখছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন আমার কাজ শেষ হতে এখনও অনেক বাকি। তিনি বললেন, কালাম, তিন দিনের মধ্যে ড্রইং শেষ না হলে তোমার স্কলারশীপ বন্ধ হয়ে যাবে।
তার এ কথায় আমি প্রচণ্ডভাবে নাড়া খেলাম। স্কলারশীপ আমার জীবনের প্রধান সাধনা। এমআইটিতে পড়ানোর সামর্থ্য আমার বাবার নেই। কাজটা তিনদিনের মধ্যে আমাকে শেষ করতেই হবে। এ চিন্তা মাথায় রেখে একটানা কাজ শুরু করলাম। শুধু খাওয়া ছাড়া ওই তিনদিন আমি রুমের বাইরে যাইনি এবং ঘুম এলে বেঞ্চিতে বসে ঘুমিয়ে নিয়েছি। এভাবে রাতদিন পরিশ্রমের পর অবশেষে আমি ড্রইং শেষ করলাম।
তিনদিন পরে ড. শ্রীনিবাস ড্রইংবোর্ড দেখতে এলেন। এক ঘন্টা ধরে পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর বললেন, খুব ভাল হয়েছে, যে কাজ করতে কয়েক সপ্তাহ লাগার কথা, তুমি তা কয়েক দিনে করলে। তার একথা আমার কাজের বিরাট স্বীকৃতি বলে আমি সেদিন বিবেচনা করেছি।
সেদিনই আমি বুঝেছি প্রচন্ড মানসিক শক্তি নিয়ে কাজ শুরু করলে হাজারও ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও সফলতা অনিবার্য। ভাল কিছু করতে হলে ঝুঁকি মোকাবেলা করতেই হবে। জন্মের প্রক্রিয়াটাই তো ঝুঁকির। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ দিয়ে একটা শিশু সংগ্রামের মুখোমুখি হয়ে জন্ম নেয়। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস চালু হলে, যখন সে কান্নার মাধ্যমে স্বীয় অস্তিত্ব ঘোষণা করে তখন সবাই স্বস্তি পায়। সকলের মুখ আনন্দে ঝলমল করে ওঠে। এজন্য সাফল্যের চিন্তা মাথায় নিয়ে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে কাজ করলেও সফলতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।