৯১. ডু নট রিপিট বার্মা
জেলের ভেতরে ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনা তখনও চারদিকে গোপন। জেলের আইজি পরদিন বঙ্গভবনে ফোন করে জেল হত্যার খবরটি জানালে খন্দকার মোশতাকের ঘনিষ্ঠ কয়জন বিরটি জানেন। নিরুত্তাপ থাকেন মোশতাক। বাকিরা নীরবতায় সমাধিস্থ করে রাখেন এ সংবাদ। জানেন না খালেদ মোশারফও। তিনি তখনও মেজরদের দেশত্যাগের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় করছেন। খালেদ বলেন, তিনি রক্ত পাত এড়াতে মেজরদের দেশ ত্যাগের অনুমতি দিতে প্রস্তুত।
নভেম্বর ৩ তারিখ সন্ধ্যায় অভুত্থানের সঙ্গে জড়িত ফারুক, রশীদসহ ১৭ জন সদস্য একে একে তেজগা বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ বাংলাদেশ বিমানের একটি প্লেন ওঠেন। সঙ্গে তাদের স্ত্রী, সন্তানেরা। তাদেরকে ভীত এবং বিমর্ষ দেখায়। তারা নিরাপত্তার স্বার্থে কাছে অস্ত্র রাখতে চান। সে অনুমতি দেওয়া হয় না তাদের। রাত প্রায় নয়টার দিকে বিদ্রোহী অফিসারদের নিয়ে আকাশে উড়ে বিমান। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে তেল রিফুয়েলিং করবার জন্য বিমানটি নামে আবার। তারপর রওনা দেয় ব্যাংককের দিকে। এদেশের ইতিহাসের বীভৎসতম নাটকের কুশীলবদের নিয়ে বিমান পেরিয়ে যায় বাংলাদেশের সীমান্ত।
পরদিন সকালে খালেদ মোশারফ প্রথমবারের মতো জানতে পারেন জেল হত্যার খবর। বিস্মিত হন তিনি। যে অশঙ্কায় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে তার কোনো যোগসূত্রই কোনো দিকে নেই। খালেদ মোশারফের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই ঘটেনি ঐ নেতাদের। তার লক্ষ্য তখন শুধু সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠিত করা।
মোশতাকের নির্দেশে ঘটে যাওয়া জেল হত্যার খবরে উত্তেজিত হয়ে উঠেন খালেদের সহযোগী ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত। তিনি আগেও একবার মোশতাকের ব্যাপারে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। শাফায়াত খালেদকে বলেন : স্যার মোশতাক ইজ দি মেইন কালপ্রিট। তাকে আর কিছুতেই প্রেসিডেন্ট পোস্টে রাখা চলবে না। উই মাস্ট রিমুভ হিম।
একমত হন খালেদ মোশারফ। আর কোনো টেলিফোন সংলাপ নয়। এম এ জি তোয়াব এবং এম আর খানকে নিয়ে এবার খালেদ সরাসরি চলে যান বঙ্গ ভবনে। সাথে করে নেন জিয়ার নিজের হাতে লেখা পদত্যাগপত্র।
বঙ্গভবনে পৌঁছে খালেদ ক্ষুব্ধ হয়ে মোশতাকের কাছে জেল হত্যার ব্যাখ্যা চান। মোশতাক দক্ষ অভিনেতার মতো ভাব করেন যেন তিনি কিছুই জানেন না। তিনি বোঝাতে চান পলাতক মেজররাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। খালেদ মোশারফ এবার মোশতাকের কাছে দাবি করেন, সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবার জন্য তাকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করতে। তিনি জিয়ার লেখা পদত্যাগপত্র তুলে দেন মোশতাকের হাতে। মোশতাক তখনও দক্ষ খেলোয়াড়ের মতো গুটি চেলে চলেছেন। তিনি বলেন, এ সিদ্ধাম নিতে হলে কেবিনেট মিটিং ডাকতে হবে। ডাকা হয় কেবিনেট মিটিং।
মন্ত্রিপরিষদের মিটিংয়ে জেল হত্যা নিয়ে আলাপ হলেও খালেদ মোশারফ তার সেনাপ্রধান হওয়ার ব্যাপারটি আলোচনায় তোলেন। নানা সাংবিধানিক জটিলতার প্রশ্ন তুলে আপত্তি করেন ওসমানী। এই নিয়ে বাক বিতণ্ডা চলতে থাকে মন্ত্রিপরিষদের সভায়। চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে অখানের সূচনা হলেও, তা শেষ পর্যন্ত এসে ঠেকে খালেদ মোশারফের সেনাপ্রধান হওয়ার এজেন্ডায়। এ বড় অদ্ভুত যে খালেদ মোশারফ যিনি অভ্যুত্থানের প্রধান হোতা, চাইলে সেনাপ্রধান কেন, প্রেসিডেন্টের পদটিও নিয়ে নিতে পারেন। অথচ যাদের বিরুদ্ধে তার অভ্যুত্থান তাদের দেশত্যাগের সুযোগ দিয়ে, সেই ঘাতকদের মনোনীত প্রেসিডেন্টের কাছে সেনা প্রধানের পদটির জন্য আবদার করে চলেছেন। এ যেন এক বিচিত্র, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বিবর্জিত, বিরল প্রজাতির অভ্যুত্থান।
খালেদ মোশারফ যখন বঙ্গভবনে চিফ অব আর্মি স্টাফ বিষয়ে দেন দরবার করছেন, তখন দেশের মানুষ ঘোর অন্ধকারে। কি ঘটছে দেশে, কে চালাচ্ছে দেশ কোনো কিছু বুঝবার উপায় নেই। একটি বদ্ধ ঘরে চলছে দেশের ভাগ্য নির্ধারণের নাটক। কোনো খবর আসছে না রেডিও টিভিতে। রহস্যকে আরও ঘনীভূত করে তখনও রেডিওতে অবিরাম গান গেয়ে চলেছেন রুনা লায়লা।
আর বঙ্গভবনের সভাকক্ষের বাইরের চত্বরে, করিডোরে, বারান্দায় অস্ত্রধারী নানা অফিসার, খোলা পিস্তল, স্টেনগান আর তাদের ভারী বুটের আওয়াজ।
বঙ্গভবনে যখন মিটিং চলছে তখন সীমাহীন অনিশ্চয়তা ঝুলে আছে ক্যান্টনমেন্টে। চারদিকে নানা গুজব। বন্দি হয়ে আছেন জিয়া। সিপাইদের মধ্যে দ্রুত বাড়ছে উৎকণ্ঠার পারদ। অফিসাররা ছোট ছোট গ্রুপে কানাঘুষা করছেন। খালেদ সেই সকালে ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে গেছেন বঙ্গভবনে কিন্তু তারপর থেকে তার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই অভুত্থানের দ্বিতীয় কমান্ডিং অফিসার শাফায়াত জামিলের সঙ্গে। উৎকণ্ঠায় খালেদ মোশারফের সংবাদের জন্য ক্যান্টনমেন্টে অপেক্ষা করছেন শাফায়াত। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে তারপরও কোনো খবর নেই খালেদের! এবার খালেদ মোশারফের উপরেই ক্ষেপে যান শাফায়াত। বস্তুত পাল্টা অভ্যুত্থানের ব্যাপারে তিনিই উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সবাইকে। শাফায়াত কয়েকজন সঙ্গীসহ রওনা দেন বঙ্গভবনে। এবার নিজেই তিনি ঘটনার উপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান? সেখানে অপেক্ষা করে আরেক নাটকীয়তা।
বঙ্গভবনে পৌঁছে শাফায়াত দেখেন মোশতাক, ওসমানি, খালেদ মোশারফ, এম এ জি তোয়াব এবং এম এইচ খান মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে আসছেন। করিডোর দিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। মোশতক উত্তেজিত হয়ে খালেদকে বলছেন : আই হ্যাভ সিন মেনি ব্রিগেডিয়ার্স অ্যান্ড জেনারেলস অব পাকিস্তান আর্মি। ডোন্ট ট্রাই টু টিচ মি।
করিডোরে শাফায়াতের সঙ্গে কিছু সৈনিকসহ দাঁড়িয়ে ছিলেন মেজর ইকবাল। মেজর ইকবাল হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে তার হাতের সাবমেশিনগানটি মোশতাকের দিকে কক করে বলেন : ইউ হ্যাভ সিন জেনারেলস অব পাকিস্তান, নাউ সি দি মেজরস অব সংলাদেশ।
ইকবালের সঙ্গের সিপাইরা তাদের অস্ত্র তাক করে ধরে মোশতাকের দিকে। মোশতাকের পাশে দাঁড়ানো ওসমানী শাফায়াতকে চিক্কার করে বলেন, শাফায়াত, সেভ দি সিচুয়েশন, ডেন্ট রিপিট বার্মা।
বার্মার জেনারেল নেউইনর নেতৃত্বে যখন অভূত্থান হয়েছিল তখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট প্যালেসে ঘটে গিয়েছিল রক্তপাত। বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে উপর্যুপরি নৃশংস রক্তকাণ্ড, যেকোনো মুহূর্তে নতুন আরও একটি রক্তপাতের সম্ভাবনা।
ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই স্তম্ভিত, হতবিহ্বল। মোশতাক আতঙ্কিত। এবার দৃশ্যপটে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হন শাফায়েত জামিল। তিনি গিয়ে দাঁড়ান মেজর ইকবাল আর মোশতাকের মাঝখানে। ইকবালকে সরে যেতে বলেন তিনি। শাফায়াত জামিলের হাতেও অস্ত্র। তিনি সবাইকে বলেন, কেবিনেট কক্ষে ঢুকে যেতে। চুপচাপ করিডোরে দাঁড়ানো সবাই গিয়ে ঢোকেন কেবিনেট কক্ষে। পেছনে পেছনে সশস্ত্র সৈন্য, অন্যান্য অফিসার। সভাকক্ষের ভেতরে যারা ছিলেন হঠাৎ এত অস্ত্রধারীদের দেখে ভড়কে যান সবাই। কেউ কেউ দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করে।
সভাকক্ষে ঢুকে যেন নাটকের মঞ্চে প্রবেশ করেছেন এমন ভঙ্গিমায় বাকি সবাইকে দর্শকের ভূমিকায় রেখে শাফায়াত বেশ একটি উত্তেজিত বক্তৃতা দেন। তিনি মোশতাক এবং তার সহযোগীদের জেল হত্যার জন্য দায়ী করেন। শাফায়াত খন্দকার মোশতাককে খুনি বলে সম্বোধন করেন এবং তাকে পদত্যাগ করতে বলেন। খালেদ মোশারফকে অবিলম্বে সেনাপ্রধান ঘোষণার দাবি করেন।
বেশ কিছু উত্তেজিত, বিশৃঙ্খল মুহূর্ত কাটার পর সশস্ত্র সৈন্যদের উপস্থিতিতে আবার শুরু হয় সভা। দীর্ঘ আলোচনা চলে। সভায় শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, শেখ মুজিব হত্যা এবং জেল হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হবে, খালেদ মোশারফকে চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হবে এবং বঙ্গ ভবন থেকে সৈনিকরা ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাবে।
সেই সভার সিদ্ধান্তের পরই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে সেনাবাহিনী প্রধান করা হয়। জেল হত্যার অভিযোগে চার মন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নুরুল ইসলাম মঞ্জুরকে গ্রেফতার করে পাঠানো হয় জেলে।
এম এ জী তোয়াব এবং এম এইচ খান অভিনন্দন জানান তাকে। খালেদ মোশারফের দুপাশে বসে ব্রিগেডিয়ারের র্যাঙ্ক খুলে তার দুই কাঁধে পরিয়ে দেন মেজর জেনারেলের র্যাঙ্ক।
দীর্ঘ মিটিং শেষে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মোশতাক ভোর রাতে বিশ্রাম নিতে যান বঙ্গভবনে তার শোবার ঘরে। ওসমানী বিদায় নেন তার কাছে। কোলাকুলি করে বলেন : উই প্লেইড এ ব্যাড গেম।
৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় খন্দকার মোশতাক পদত্যাগপত্র সই করেন। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে খন্দকার মোশতাক পুলিশ প্রহরায় রওনা দেন তার আগামসি লেনের তিনতলার বাড়িতে, যেখান থেকে ১৫ আগস্ট ভোরে ট্যাঙ্ক আর কামান প্রহরায় আটকা পড়ে তিনি বেরিয়েছিলেন দেশের ক্ষমতা গ্রহণের জন্য। কলঙ্ক আর ইতিহাসের অভিশাপ নিয়ে শেষ হয় খন্দকার মোশতাকের ৮১ দিনের রাজত্ব।
৯২. দুটি ছবি, একটি খবর
এসময় দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় দুটি ছবি ছাপা হয়।
একটিতে খালেদ মোশারফের দুপাশে বসে তোয়াব এবং এম এইচ খান তার দুই কাঁধে পরিয়ে দিচ্ছেন মেজর জেনারেলের র্যাঙ্ক। সুদর্শন খালেদ মোশারফ হাসিতে উদ্ভাসিত করে রেখেছেন তার মুখ।
অপর ছবিটি একটি মিছিলের। মিছিলে খালেদ মোশারফের ভাই রাশেদ মোশারফ। রাশেদ আওয়ামী লীগ করেন। তিনি আওয়ামী লীগের কর্মীদের নিয়ে একটি মিছিল বের করেছেন, মিছিলে জয় বাংলার ব্যানার। খালেদ মোশারফের ম’ও যোগ দিয়েছেন সে মিছিলে। শেখ মুজিব হত্যার পর সেই প্রথম আওয়ামী লীগের ব্যানারে কোনো মিছিল। সেই প্রথম আবার জয় বাংলা।
সেদিন সন্ধ্যায় ভারতের রেডিও এবং টিভি খালেদ মোশারফের ক্ষমতা দখলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে খবর প্রচার করে।
সেনা প্রধানের ব্যাংক কাঁধে মিষ্টি হাসি, জয় বাংলা শ্লোগানে মা এবং ভাইয়ের মিছিল আর ভারতীয় রেডিওর উচ্ছ্বাস, এই তিন মিলিয়ে এক অশনিসংকেত রচনা করে খালেদ মোশারফের জন্য! লোকের মনে প্রশ্ন জাগে :
খালেদ মোশারফ যা কিছু করছেন তাতে ক্ষমতার মসনদে বসবার জন্যই, নইলে সেনাপ্রধান হয়ে তার ঐ আকর্ণ বিস্তৃত হাসি কেন?
তার এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে আওয়ামী লীগ অবশ্যই জড়িত নইলে তিনি ক্ষমতায় বসবার সঙ্গে সঙ্গে জয় বাংলা স্লোগান নিয়ে কেন তার মা, ভাই রাস্তায়?
তার সঙ্গে অবশ্যই ভারতের যোগাযোগ আছে নইলে তারা এত উচ্ছ্বসিত কেন?
খালেদ মোশারফ আওয়ামী লীগ এবং ভারতের ইঙ্গিতে এই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন, বাস্তব ভিত্তি না থাকলেও এই গুজবটি জোরদার হয়ে ওঠে তখন। রেডিও টিভিতে নিজের অবস্থান, উদ্যোগ ব্যাখ্যা করে একবারও কোনো বক্তব্য রাখেন না খালেদ। এতে করে চারদিকে কেবলই ছড়াতে থাকে সন্দেহের ধুম্রজাল।
৯৩. এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি
খন্দকার মোশতাক আর খালেদ মোশারফ তখন নাগর দোলায়। একজন উঠছেন, একজন নামছেন। কিন্তু তারা কেউ জানেন না ঠিক সেই সময়টিতেই তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে, শহরের অন্য এক প্রান্তে।
আবু ইউসুফের এলিফ্যান্ট রোডের ৩৩৬ নম্বর বাসাটি তখন আবারও সরগরম। তার বাসাটি যে গলিতে সেটি নোয়াখালী সমিতির গলি নামে পরিচিত। সেই সমিতির পাশাপাশি ইউসুফের বাসা। তার উল্টোদিকেই থাকেন ওয়েভ পত্রিকার সম্পাদক কে বি এম মাহমুদ। জাসদের শুভাকাঙ্ক্ষী তিনি। তার প্রশস্ত ড্রইং রুমেও তখন ভিড়। জাসদের তরুণ কর্মীরা ছাড়াও ইউসুফ এবং মাহমুদের বাসা জুড়ে সেনাবাহিনী থেকে চলে আসা অসংখ্য হাবিলদার, সুবেদার, কর্পোরাল, সার্জেন্ট ওয়ারেন্ট। এরা সবাই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য। দফায় দফায় মিটিং হচ্ছে, জটলা করছেন তারা।
গত কয়দিনেই হঠাৎ করে বেড়ে গেছে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য সংখ্যা। নিয়মিত পুরনো সদস্য ছাড়াও এসময় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থায় যোগ দিয়েছে ফারুক, রশীদের অনুসারী সিপাইরাও। ফারুক রশীদ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াতে তাদের অধীনে ল্যাপার এবং ২ ফিল্ড আর্টিলারির সিপাইরা মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছেন। যাদের পেছনে দাঁড়িয়ে তারা বিদ্রোহ করেছেন তারা তাদের ফেলে রেখে চলে গেছেন দেশের বাইরে। সেনাবাহিনীতে তাদের কোনো আশ্রয় তখন আর নেই। তারা আতঙ্কিত হয়ে ভাবছেন এবার হয়তো খালেদ মোশারফ তাদের বিচার শুরু করবেন। চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন তারা। এই বেকায়দা অবস্থায় তারা এমন একটি পক্ষ চাচ্ছিলেন যারা হবে খালেদ মোশারফের বিপক্ষে। এমনকি খালেদ মোশারফের দলের ফাস্ট বেঙ্গল এবং ফোর্থ বেঙ্গলের অনেক সৈনাও শুধুমাত্র সিনিয়র অফিসারের আদেশ রক্ষা করতে গিয়ে তাদের সহকর্মী সিপাইয়ের দিকে বন্দুক তাক করতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক সাধারণ সৈন্য এও মনে করেন যে অন্যায়ভাবে সেনাপ্রধান জিয়াকে বন্দি করেছেন খালেদ মোশারফ। তারা খালেদ মোশারফের পতন চান। এদের সবার বিকল্প হয়ে দাঁড়ায় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। এরা সবাই আসেন তাহেরের কাছে উদ্ধারের আশায়।
তারা বিদ্রোহ করতে চান। কেউ খালেদ মোশারফকে উৎখাত করতে চান। কেউ চান খালেদ, জিয়াসহ সব অফিসারদের হত্যা করতে। তাহের তাদের লাগামহীন উত্তেজনার রাশ টেনে ধরেন। তাদের বোঝান হত্যা বিপ্লব নয়। তবে এও বলেন যে, সময় এসেছে একটা চুড়ান্ত পদক্ষেপ নেবার এবং অচিরেই তারা একটি পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু সতর্কতার সঙ্গে এগুতে হবে তাদের। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নয়, জাসদের সামগ্রিক অবস্থাটিও বিবেচনা করতে হবে। সে জন্যই প্রয়োজন জাসদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার।
৪ নভেম্বক থেকে আবু ইউসুফ এবং এ বি এম মাহমুদের বাসায় শুরু হয় জাসদের নেতৃবৃন্দের লাগাতার মিটিং। জাসদের প্রধান অনেক নেতা যেমন মেজর জলিল, রব, নুর আলম জিকু, শাজাহান সিরাজ, মো : শাহজাহান, রুহুল আমিন ভূঁইয়া, মীর্জা সুলতান রাজা, ছাত্রনেত্রী শিরিন আক্তার তখন জেলে। যারা বাইরে ছিলেন একে একে আসেন এলিফ্যান্ট রোডে। আসেন সিরাজুল আলম খান, ড. আখলাকুর রহমান, হাসানুল হক ইনু, আ ফ ম মাহবুবুল হক, খায়ের এজাজ মাসউদ, কাজী আরেফ প্রমুখেরা। অন্যান্য নেতা মাশাল মণি, শরীফ নুরুল আম্বিয়া তখন ঢাকার বাইরে। আর যথারীতি আছেন তাহেরের ভাই আবু ইউসুফ, আনোয়ার এরাও। সরাসরি মিটিংয়ে যোগ না দিলেও আশপাশে আছেন বেলাল, বাহার। যে কোনো প্রয়োজনে প্রস্তুত। আছেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতা হাবিলদার হাই, কর্পোরাল আলতাফ, নায়েব সুবেদার মাহবুব, জালাল, সিদ্দিক প্রমুখেরা। সেইসঙ্গে অগণিত সাধারণ সৈনিক, গণবাহিনীর তরুণ কর্মীরা ঘোরাঘুরি করছেন নোয়াখালী সমিতির গলিটিতে। দেশের অন্যতম প্রধান এই দল যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তুমুল দাবি নিয়ে তোলপাড় তুলেছে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে, তারা একবার দিকভ্রান্ত হয়েছেন শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের কারণে, বাধাগ্রস্ত হয়েছে তাদের যাত্রা। দ্বিতীয়বারের মতো রাজনীতির গতিপথ বদলে দেবার জন্য আবির্ভূত হয়েছেন খালেদ মোশারফ। এবার জাসদ তার সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে মোকাবেলা করতে চায় এ পরিস্থিতি। আর জাসদের প্রধান শক্তি তখন গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। দুটি অঙ্গসংঠনেরই কমান্ডার ইন চিফ তাহের। ফলে সবার মনোযোগ তখন তাহেরের দিকে।
তারা খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানটি নিয়ে কথা বলেন। একে দুর্বল রাজনৈতিক ভিত্তির বিশৃঙ্খল একটি অভ্যুত্থান হিসেবেই চিহ্নিত করেন তারা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার নামে খালেদ মোশারফ তার সেনাপ্রধান হওয়ার ইচ্ছাই চরিতার্থ করছেন শুধু। তাছাড়া বিনা বিচারে শেখ মুজিবের খুনিদের দেশত্যাগের সুযোগ দিয়ে বিরাট অন্যায় করেছেন তিনি। কেউ কেউ ভারতের সাথে তার যোগসাজশের ব্যাপারটিও খতিয়ে দেখতে চান। বিমান বাহিনীর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা জানান তাড়া খবর পেয়েছেন, ভারতীয় বিমান নাকি বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।
তাহের বলেন : আর্মিতে একটা টোটাল কেওয়াস তৈরি হয়েছে। দেশে সত্যিকার অর্থে এ মুহূর্তে কোনো সরকার নেই। স্টেট একটা ভীষণ ভালনারেবল জায়গায় আছে। আমি মনে করি পুরো ব্যাপারটার মধ্যে ইন্টারভেন করার এইটাই সঠিক সময়।
ড. আখলাক বলেন আপনি কিভাবে ইন্টারভেন করার চিন্তা করছেন।
তাহের : ক্যান্টনমেন্টে সিপাইরা মারাত্মকভাবে এজিটেটেড হয়ে আছে। তারা খুব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে যে, তাদের ইউজ করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই এই এক্সপ্লয়টেশন চলছে। তারা এর একটা শেষ দেখতে চায়। ক্যান্টনমেন্টে আমাদের একটা ভালো বেইজ আছে। জাসদের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনগুলো সাপোর্ট করলে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে লীড করে আমরা ক্যান্টনমেন্টের কন্ট্রোল নিতে পারি।
ড. আখলাক বলেন : কিন্তু শুধু ক্যান্টনমেন্টে কন্ট্রোল নিলেই তো হচ্ছে না। পার্টি হিসেবে এ মুহূর্তে জাসদের পক্ষে এরকম একটা পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দেবার মতো অবস্থা কি আছে? আমাদের মেইন লিডাররা সব বন্দি, জাসদের বিশ হাজার কর্মী জেলে। এ অবস্থা আমরা সামাল দিতে পারব? আমার তো মনে হয় আমাদের উচিত এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা।
তাহের : নিশ্চয়ই শুধু ক্যান্টনমেন্ট দখল করে হবে না। সেজনাই তো জাসদের অন্য ফোরামগুলোর সাপোর্ট চাচ্ছি। কিন্তু আমি মনে করি এ মুহূর্তে
জাসদ নিষ্ক্রিয় থাকলেও অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে আর্মিতে একটা বিদ্রোহ ঘটবেই। এই বিদ্রোহকে যদি আমরা এখন আমদের পক্ষে আনতে না পারি আমি নিশ্চিত যে এর ফল ভোগ করবে শত্রুপক্ষের কেউ। এ অবস্থায় আমাদের ক্ষমতা দখলের সুযোগ হাত ছাড়া করা হবে মারাত্মক ভুল। স্টেট এখন সবচেয়ে দুর্বল। এই দুর্বল অবস্থায় আঘাত না হলে আমাদের হয়তো পরে ক্ষমতা দখলের জন্য আরও শক্তিশালী বুর্জুয়া রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়তে হবে। আমি মনে করি আমাদের একটা একটিভ রোলে যাওয়া উচিত।
কোনো প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডে, জনসভায় না থাকলেও সিরাজুল আলম খান জাসদের নীতিনির্ধারণী সভাগুলোতে থাকেন। এই গুরুত্বপূর্ণ সভাতেও তিনি উপস্থিত। সিরাজুল আলম খান বলেন : আমার মনে হয় কর্নেল তাহের যা বলছেন সেটা আমাদের গুরুত্বের সাথে ভাবা দরকার। রাষ্ট্র এখন যেরকম নাজুক অবস্থায় আছে এমন অবস্থা আমরা হয়তো আর পাবো না। ১৫ আগস্টে একবার পরিস্থিতি আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে, এবারও সে সুযোগটা দেওয়া ভুল হবে। কিন্তু এটাও খুব সত্য যে, সিপাইদের সঙ্গে জনতার একটা যোগাযোগ ঘটাতে না পারলে আমরা যাই করি না কেন সেটা আরেকটা আর্মি ক্যুতে পরিণত হবে। আমাদের গণবাহিনীর অবস্থাটা কি?
কথা বলেন ইনু, খায়ের এজাজ, মাহবুদুল হক। তারা জানান আগে রক্ষীবাহিনী, পরে মোশতাকের দমন নীতির কারণে গণবাহিনীর সদস্যরা ঐ মুহূর্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। ইনু বলেন তবে সময় পেলে তাদের সক্রিয় করে তোলা যেতে পারে।
তাহের : আসলে আমি মনে করি, পুরোপুরি একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলবার মতো প্রস্তুতি সিপাইদের নাই। এতবড় ঘটনা এই মুহূর্তে শুধু তাদের উপর ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু সময় গড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু আমি দাদার সাথে একমত যে তাদেরকে অবশ্যই জনগণের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। আপনারা যদি প্রস্তুত থাকেন এবং সংগঠিত শ্রমিকদের বের করে নিয়ে আসতে পারেন আমি সিপাইদের নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট দখল করে নিতে পারব এবং সেখান থেকে অস্ত্র বের করে আনতে পারব বাইরে। আর বাইরে যদি পিপল রেডি থাকে তাহলে এটা একটা জয়েন্ট আপরাইজিং হাতে পারে। কিন্তু আমাদের ডিসিশন নিতে হবে তাড়াতাড়ি। ইতিহাসের মোড় যে কোনো দিকে ঘুরে যেতে পারে।
জাসদের নেতৃবৃন্দ খানিকটা দ্বিধান্বিত্ত থাকলেও তাহেরের আত্মপ্রত্যয় প্রভাবিত করে তাদের। তারা সমর্থন করেন তাহেরকে। ড. আখলাক অবশ্য তখনও নিষ্ক্রিয় থাকার পক্ষে। বাদানুবাদ চলে। সিরাজুল আলম খান শেষে বলেন: এই পরিস্থিতিতে নিষ্ক্রিয় থাকা জাসদের জন্য হবে বোকামী। যতটুক শক্তি আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়াই হবে সমীচীন। দেশে একটা স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এখন জরুরি এবং তা আনতে হবে আরেকটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেই।
দীর্ঘ আলোচনার পর অবশেষে একটি অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেবে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, এরপর জাসদ তার গণবাহিনী এবং অন্যান্য সংগঠনসহ ছাত্র, শ্রমিক জনতাকে এই বিপ্লবে শামিল করবে। এটি হবে সিপাই জনতার বিপ্লব। এই অপারেশনের নেতৃত্ব দেবেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সুপ্রিম কমান্ডার কর্নেল তাহের।
এলিফেন্ট রোডের বাসায় যখন মিটিং চলছে তখন বাইরে বিপুল সংখ্যক। সৈনিক সংস্থার সদস্য, অন্যান্য বাহিনী এবং রেজিমেন্টের সিপাইরাও আছেন। আনোয়ার এবং ইউসুফ ঘর বাহির করছেন। রাস্তায় টহল দিচ্ছে বেলাল, বাহারসহ মোশতাক, মাসুদ, বাচু, হারুন, বাবুল, সবুজ প্রমুখ গণবাহিনীর অন্য তরুণরা। ইউসুফের স্ত্রী এতগুলো উত্তেজিত মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা করছেন। ডাল চাল মিশিয়ে খিচুরি রান্না হচ্ছে। তার সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন প্রতিবেশী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদক কে বিএম মাহমুদের স্ত্রী, কন্যারা।
সিদ্ধান্ত হয় পরদিন অর্থাৎ ৫ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষ থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একটি লিফলেট বিলি করা হবে। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনীর অন্যান্য সিপাই এবং অফিসারদেরকে আসন্ন বিপ্লবী উদ্যোগের ব্যাপারে অবহিত করা হবে। দেখা হবে তাদের প্রক্রিক্রিয়া। সেই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৯ নভেম্বর সারাদেশে ডাকা হবে হরতাল। এই হরতালের মধ্য দিয়ে জাসদের অন্যানা গণ সংগঠনগুলোকে চাঙ্গা করে মাঠে নামানো হবে এবং আসন্ন বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করা হবে। তারপর পরিস্থিতি বুঝে ধার্য করা হবে বিপ্লবের নির্দিষ্ট দিন।
গোপনে বিপ্লবের সিদ্ধান্তু যখন চূড়ান্ত হয়ে গেছে খালেদ মোশারফ তখনও তার সেনাবাহিনী প্রধানের পদ নিয়ে দেন দরবার করছেন মোশতাকের সঙ্গে। জিয়া বন্দি হয়ে আছেন তার বাড়িতে। ক্যান্টনমেন্ট জুড়ে চাপা উত্তেজনা।
৯৪. একটি লিফলেট
পার্টির অনুমোদন পাওয়ার পর এবার ঘটনাকে এগিয়ে নেবার দায়িত্ব তাহেরের। সিপাইদের উত্তেজনাকে আপাতত সামাল দিতে এবং পরিস্থিতিকে আরও ভালোমতো বুঝতে পরিকল্পনা মতো লিফলেট বিলির প্রস্তুতি নিতে থাকেন তাহের। লিফলেটের ব্যাপারে তাহেরের বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। কিশোর বয়সে চট্টগ্রামের প্রবর্তক সংঘ স্কুলের ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী শিক্ষকের কাছে যখন শুনছিলেন অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের আগে তারা সারা শহর জুড়ে ছড়িয়েছেন ইস্তেহার, মানুষকে প্রস্তুত হতে বলেছেন অভ্যুত্থানের জন্য, সেই স্মৃতি যেন গেঁথে আছে তার মনে। তাহের নিজে যখন একটি অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন কৈশোরিক সেই নস্টালজিয়া যেন ভর করে তাকে। অভুত্থানটি তিনি শুরু করতে চান ঐ ইস্তেহার বিলি করার মধ্য দিয়েই।
তাহের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃস্থানীয় কয়েকজনকে ডেকে বলেন : আমরা একটা অভ্যুত্থানে যাব, তোমরাই সে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেবে, কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে যাব, স্টেপ বাই স্টেপ। একটা লিফলেট আমরা আগে ছড়াবো ক্যান্টনমেন্ট। লিফলেটটা আগে তোমরা লেখ, সেটা আমরা দেখে দেব। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তোমরা কি অর্জন করতে চাও সেটা লেখ।
তাহের, তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইনু এবং আনোয়ারকে নিয়ে বসেন। বলেন : মনে রেখ বিপ্লবটা কিন্তু সিপাইদের, আমরা শুধু ফেসিলিটেট করব। লিফলেটের ড্রাফট তারা করুক পরে আমরা দেখবো। লিফলেটটা ক্যান্টনমেন্ট ছড়িয়ে রিয়াকশনটা দেখতে চাই। সিপাই অফিসার সবাইকে প্রিপিয়ার করা দরকার। অফিসারদের ইনিশিয়ালি এর মধ্যে রাখতে চাই না। এরা পুরো ব্যাপারটাই বানচাল করে দিতে পারে। শুধু মেজর জিয়াউদ্দীন থাকবে আমাদের সাথে। তারপর অবস্থা বুঝে দেখব কি করা যায়।
লিফলেটের খসড়া তৈরি করেন ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের হাবিলদার বারী এবং নায়েক সুবেদার জালাল। পরে ইনু, আনোয়ারসহ আরও কয়জন মিলে চূড়ান্ত করেন ঐ লিফলেট। লিফলেটে তাড়া তাদের আক্রোশ আর ইচ্ছার কথা লেখেন–
‘সৈনিক ভাইয়েরা, আমরা আর ধনিক শ্রেণীর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হইতে চাই না। নিগৃহীত, অধিকারবঞ্চিত সিপাইরা আর কামানের খোরাক হইবে না। আসুন আমরা একটি অভ্যুত্থান ঘটাই। আমাদের এই অভ্যুত্থান শুধুমাত্র নেতৃত্বের পরিবর্তন করিবার জন্য হইবে না বরং এই অভ্যুত্থান হইবে সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার জন্য। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়া আমরা ঔপনিবেশিক আমলের রীতিনীতি বদলাইয়া ফেলিয়া সশস্ত্র বাহিনীকে জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী একটি বাহিনীতে পরিণত করিব। আমরা রাজবন্দিদের মুক্ত করিব, দুর্নীতিবাজদের অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করিব। মনে রাখিবেন এখন সিপাই আর জনতার ভাগ্য এক। তাই সিপাই জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করিতে হইবে। সিপাই সিপাই ভাই ভাই সুতরাং সিপাইদের ঐক্যবদ্ধভাবে অফিসারদের এই ক্ষমতার লড়াইকে রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে। যদি অফিসাররা নির্দেশ দেয় আরেক সৈনিক ভায়ের বিরুদ্ধে বন্দুক ধরিবার তাহা হইলে আপনারা বন্দুক ধরিবেন না। আসুন ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ করি’।
জাসদের রাজনৈতিক প্রকাশনা দেখতেন শামসুদ্দিন পেয়ারা, তাকে দায়িত্ব। দেওয়া হয় লিফলেটটি ছাপানোর? শামসুদ্দিন সেই রাতের বেলাতেই জিন্দাবাজারে তার পরিচিত এক প্রেসে গিয়ে হাজির হন। দাঁড়িয়ে থেকে জরুরি ভিত্তিতে ছাপান দশ হাজার লিফলেট। তাহের শামসুদ্দিনকে বলেন : লিফলেটগুলো ক্যান্টনমেন্ট ফার্স্ট গেটে দিয়ে আস।
শামসুদ্দিন বলেন; আমি তো কখনো ঐদিকে যাইনি, কাকে দেবো, চিনি না তো কাউকে।
তাহেরঃ ভয়ের কিছু নাই। ওখানে যারা ডিউটিতে থাকবে তারা আমাদের সৈনিক সংস্থার লোক। কারো সঙ্গে তোমার কোনো কথা বলতে হবে না। তোমার হাতে বান্ডিল দেখলেই ওরা বুঝবে। তুমি গার্ডরুমের সিঁড়িতে বান্ডিলটা রেখে দিলেই হবে। বাকিটা ওরাই করবে।
গোপন অভিযানের ভঙ্গিতে রাতের বেলা একটি বেবিট্যাক্সি নিয়ে শামসুদ্দিন চলে যান ক্যান্টনমেন্টের গেটে। একটি বাক্যও উচ্চারন না করে দশ হাজার লিফলেটের বান্ডিলটা তিনি রেখে আসেন সেখানে। সেরাতেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা সারা ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে দেয় সেই লিফলেট। ব্যারাকের মসজিদে, নামাজের স্থানে, টয়লেটে, মশারির উপর, মেঝে, খাবার মেসে ছড়িয়ে রাখা হয় লিফলেট, যাতে সকালে উঠেই তা সবার চোখে পড়ে।
যথারীতি ঘুম থেকে উঠতেই সবার চোখে পড়ে সেই লিফলেট। সিপাইদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া হয় ব্যাপক। ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতি তখন বিস্ফোরন্মুখ। সাধারণ সৈনিকরা তখন আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসছে। যারা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার তৎপরতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না তারা এই লিফলেট পড়ে মুহূর্তে জ্বলে উঠেন বিদ্যুতের মতো। একটি অভ্যুত্থানের আহ্বান, জনগণের স্বার্থ রক্ষাকারী একটি সেনাবাহিনীর স্বপ্ন, অফিসারদের রুখে দেবার অঙ্গীকার দাবানলের মতো আগুন ধরিয়ে দেয় যেন সিপাইদের মধ্যে। লিফলেটের প্রতিটি লাইন গিয়ে যেন বেঁধে তাদের বুকে। এ যেন তাদের সবারই মনের গোপন সত্য কথা। লিফলেট পড়ে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সৈনিকরা তো বটেই অন্য সৈনিকরাও যেন প্রম্নত হয়ে উঠেন এমন একটি অভ্যুত্থানের জন্য। তারা সবাই এসে দাঁড়ান সৈনিক সংস্থার পাশে। ক্যান্টনমেন্টে তৎক্ষণাৎ এক অভূতপূর্ব উত্তেজনাকর পরিস্থিতির জন্ম হয়। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাও প্রস্তুত ছিলেন না তার জন্য। সাধারণ সিপাইরা তীব্র দাবি তোলেন, অভ্যুত্থান যদি ঘটাতেই হয় তবে আর দেরি কেন,ঘটাতে হবে পরদিনই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাদের, তারা এগিয়ে যেতে চান অধ্যানের দিকে, এর যে কোনো পরিণতি মাথা পেতে নিতে তারা প্রস্তুত। লিফলেট অফিসারদের হাতেও পড়ে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তাদের মধ্যে। পরবর্তী নির্দেশনার জন্য বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতারা আসেন তাদের চিফ কমান্ডার তাহেরের কাছ।
৯৫. নাও অর নেভার
বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা যখন গোপনে তাদের অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে ফেলেছে খালেদ মোশারফ তখন ক্যান্টনমেন্টে তার অবস্থান দৃঢ় করবার কাজে ব্যস্ত। ইতোমধ্যে বগুড়া থেকে দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঢাকায় এনে শেরে বাংলানগরে রেখেছেন খালেদ মোশারফ। এই রেজিমেন্টের সৈন্যরাই তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ করেছে। খালেদ মোশারফের সমর্থনে রংপুর থেকে বাহাত্তর ব্রিগেডের কর্নেল কে এস হুদাও এর মধ্যে ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন। ক্যান্টনমেন্টে সৈনিক সংস্থার লিফলেট ছড়ানোর খবর খালেদ মোশারফের কাছেও পৌঁছে। সৈনিক সংস্থার কথা আবছা কিছুটা শুনলেও এদের কাজের বিস্তৃতি এবং ধরন সম্পর্কে বিশেষ ধারণা ছিল না তার। লিফলেটের কারণে সিপাইদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে সে খবর খালেদ মোশারফ পান। এই উত্তেজনা প্রশমনের ব্যবস্থা হিসেবে খালেদ মোশারফ বিভিন্ন রেজিমেন্টের সিপাইদের ঢাকা থেকে অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টে বদলি করতে শুরু করেন। এবী সৈনিক সংস্থার নেতাদের খুঁজে বন্দি করবার নির্দেশ দেন তিনি।
নানা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ঢাকায় সৈন্য সমাবেশ এবং ঢাকার সৈন্যদের বদলির ঘটনায় সিপাইদের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায় আরও। সৈনিক সংস্থার নেতাদের বন্দি করার পায়তারার খবরও তারা পান। সেদিন সন্ধ্যায় সেনাবাহিনীর সব নিয়মকানুন ভেঙ্গে সিপাইরা দলে দলে এসে ভীড় করেন এলিফেন্ট রোডে তাহেরের কাছে। অনেকেই ছদ্মবেশ নেওয়ার জন্য ইউনিফর্মের উপর একটি সুঙ্গি চাপিয়ে চলে আসেন। সিপাইরা তাহেরকে জানান, প্রতিটি মুহূর্ত এখন গুরুত্বপূর্ণ, আগামীকালের মধ্যে কিছু ঘটাতে না পারলে খালেদ মোশারফ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতাদের বন্দি করবেন, বাকিদের বদলি করে দেবেন ঢাকার বাইরে। তখন আর করার থাকবে না কিছুই। সিপাইরা বলেন অভ্যুত্থান ঘটাতে হলে, ঘটাতে হবে আজই।
এমন একটি পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না তাহের। তাহের আবারও সিপাইদের শান্ত হতে বলেন। বলেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে পার্টির সাথে কথা বলে নিতে হবে।
সেদিন বিকালে আবু ইউসুফের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় আবারও একে একে চলে আসেন জাসদের প্রধান নেতারা। আৰু ইউসুফের বাসা এবং তার পাশে সাপ্তাহিক ওয়েভ পত্রিকার মালিক কে বি এম মাহমুদের বাসা তখন জাসদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অস্থায়ী অফিস। দুই বাসায় জাসদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকজনের ছোটাছুটি।
ক্রাচে শব্দ তুলে তাহের এ ঘর ও ঘর পায়চারী করেন। গভীর চিন্তিত মুখ তার। অপ্রত্যাশিত এক পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত এক সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে। শান্ত কণ্ঠে পার্টি নেতাদের তাহের বলেন : আমি জানি যে আমরা এরকম একটা সিচুয়েশনের জন্য প্রস্তুত না, এত তাড়াতাড়ি সব ঘটবে আমারও তা ধারণায় ছিল না। তবে আমাদের আর ফিরে আসবার উপায় নেই। অভ্যুত্থান ঘটাতেই হবে এবং তা কালকেই। অভ্যুত্থান যারা করবে তারা প্রস্তুত। তাদের আর কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। ঘটনার গতিপথকে এখন আমাদের ফলো করতেই হবে। আমরা এমন একটা সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছি যে দিস হ্যাজ টু বি নাও অর নেভার। কাল মধ্য রাতের পরই অর্থাৎ সাতই নভেম্বর আমি অভ্যুত্থানটি ঘটাতে চাই।
আশ্চর্য কাকতালীয় ব্যাপারই বটে। লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার চূড়ান্ত বিপ্লবটি ঘটেছিল ৭ নভেম্বরই। লেনিনও এমন এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে পোঁছেছিলেন। বলেছিলেন, বিপ্লবের জন্য ৬ তারিখ বেশি আগে হয়ে যাবে, ৮ তারিখ হবে বেশি দেরি, বিপ্লব ঘটাতে হবে ৭ তারিখেই। লেনিন বলেছিলেন, অভ্যুত্থান কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের ওপর নির্ভর করে না। সমাজের এক ক্রান্তিলগ্নে যখন পরিবর্তনকামী মানুষ তাদের অগ্রণী বাহিনীর নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে তখনই অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি পেকে ওঠে। তার উত্তরসূরি স্তালিন বলেন, এমন সময়কে চূড়ান্ত আঘাত হানার মুহূর্ত, অভ্যুত্থান আরম্ভ করার মুহূর্ত হিসেবে স্থির করতে হবে যখন সংকট চরমে পৌঁছেছে, যখন স্পষ্টই বোঝা গেছে যে অগ্রগামী বাহিনী শেষ পর্যন্ত লড়তে প্রস্তুত, মজুত বাহিনী অগ্রগামীদের সমর্থন করতে প্রস্তুত, এবং শক্র শিবিরে চূড়ান্ত আতঙ্ক বিরাজ করছে।
অগ্রগামী বাহিনী বিপ্লরী সৈনিক সংস্থা তখন শেষ পর্যন্ত লড়তে প্রস্তুত, মজুত বাহিনী, জাসদের গণবাহিনী অগ্রগামীদের সমর্থন করতে প্রস্তুত, এবং শত্রু শিবিরে অর্থাৎ ক্যান্টনমেন্টের ক্ষমতাশালীদের মধ্যে তখন চূড়ান্ত আতঙ্ক বিরাজ করছে। সুতরাং ঢাকাতেও অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি পেকে উঠেছে বলা যেতে পারে।
তাহেরের প্রস্তাবে কেউ কেউ আবারও ঐ মুহূর্তে পার্টির সার্বিক প্রস্তুতির অভাবের কথা বলেন। তারা পূর্ব পরিকল্পিত ৯ তারিখের হরতালটি আগে পালন করে শক্তি সঞ্চয়ের কথা প্রস্তাব করেন। কিন্তু একটা স্রোতের তোড়ের মধ্যে তারা তখন সবাই।
তাহের বলেন : না, সে সুযোগ আর এখন নেই। একটা দিন দেরি করলেই পুরো পরিস্থিতি আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে। তবে পার্টি পুরোপুরি প্রস্তুত না বলে আমি মনে করি এই মুহূর্তেই জাসদ বা সৈনিক সংস্থার পুরোপুরি ক্ষমতা দখল করা ঠিক হবে না। একটা ইন্টেরিম পিরিয়ড় আমাদের দরকার, যে সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের শক্তি সঞ্চয় করে নিতে পারব। এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে যাতে আমরা ক্ষমতার কেন্দ্রে না থোকও পরিস্থিতিকে কন্ট্রোল করতে পারব। সেজন্য এই মধ্যবর্তী সময়ে সিপাই এবং জনগণ সমর্থন করবে এমন একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসিয়ে জাতীয় সংহতি রক্ষা করা দরকার, তাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের নিজেদের অবস্থা অনুকূলে এনে তারপর আমরা পাওয়ার নিতে পারি।
পার্টি সদসারা জানতে চান, তাহের কার কথা ভাবছেন।
তাহের বলেন; আমি জেনারেল জিয়ার কথা ভাবছি। আপনাদের আগেই জানিয়েছি যে উনি আমাকে ইতোমধ্যে তাকে রেসকিউ করার জন্য রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন। দুই তারিখ রাতে ফোন ছাড়া পরেও এক সুবেদারের মাধ্যমে আমাকে এস ও এস ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন। এ মুহূর্তে উনিই সবচেয়ে এক্সেপ্টেবল হবেন। নাশালিস্ট, সৎ অফিসার হিসেবে আর্মিতে তার একটা ইমেজ আছে। স্বাধীনতার ঘোষণার কারণে সাধারণ মানুষের কাছেও তার একটা পরিচিতি আছে। যুদ্ধের মাঠ থেকে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। আপনাদের আগেও জানিয়েছি যে তার সঙ্গে আমার টাইম টু টাইম যোগাযোগ হয়েছে, জাসদের একটিভিটিজের ব্যাপারে উনি বেশ ভালোমতোই জানেন এবং এ ব্যাপারে সবসময় একটা নীরব সমর্থন তার আছে। তাছাড়া আমরা পুরা অভ্যুত্থানটা ঘটাতে চাচ্ছি সিপাইদের নিয়ে, এটা স্পষ্ট যে আমাদের সঙ্গে তেমন কোন অফিসার নাই। এটা আমাদের একটা উইকনেস। মেজর জিয়াউদ্দিন ছিল, আনফরচুনেটলি এই মুহূর্তে সে ঢাকার বাইরে, গেছে খুলনা। আমাদের অফিসারদের সাপোর্ট দরকার। আর টপ অফিসার জিয়া যদি আমাদের সঙ্গে থাকেন, তাহলে তো পুরো পরিস্থিতিটা ট্যাকল দেওয়া আমাদের জন্য অনেক ইজি হবে।
কাজী আরেফ বলেনঃ কিন্তু জিয়া আমাদের পক্ষে থাকবেন সেটা আপনি কতটা নিশ্চিত?
তাহের : এ মুহূর্তে জিয়ার অবস্থাটা চিন্তা করে দেখেন। তার তো ভবিষ্যত বলতে কিছু নাই। তিনি ইতোমধ্যে আমি থেকে রিজাইন করেছেন। বসে আছেন বন্দি হয়ে। তাকে মেরে ফেলা হতে পারে যে কোনো সময় আমরা তাকে মুক্ত করতে পারলে তাকে একরকম মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করা হবে। একজন মৃত্যু পথযাত্রী আর কতটা সাহস দেখাতে পারবে বলেন? জিয়াকে তো আমি চিনি, হি উইল বি আল্ডার আওয়ার ফুট। তাকে ক্ষমতায় বসিয়ে প্রথমে আমাদের সব পার্টি লিডারদের কারামুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। পার্টি নেতারা যার যার এলাকায় গিয়ে প্রস্তুতি পর্ব সম্পন্ন করা এখন জরুরি। আমাদের অবস্থাটা খানিকটা অর্গানাইজড হলে সুবিধামতো তাকে সরিয়ে দেওয়া যাবে।
পার্টি তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খান অনুমোদন করেন এই পরিকল্পনা। অন্য নেতাদেরও বোঝান যে এ মুহূর্তে এর চেয়ে ভালো বিকল্প আর নাই।
তাহের বলেন, তবে দাদা মিলিটারি অপারেশনের দায়িত্ব পুরো আমার, কিন্তু সিভিল মোবিলাইজেশনের দায়িত্ব আপনাদের নিতে হবে।
পার্টি নেতারা বলেন তারা তা করবেন। তেজগাও, পোস্তগোলা শিল্প এলাকায় শ্রমিকদের মধ্যে জাসদের ভালো সংগঠন রয়েছে, আদমজী থেকেও শত শত শ্রমিককে জড়ো করা সম্ভব, বিশ্ববিদ্যালয়েও জাসদের শক্ত অবস্থান আছে, আছে ঢাকার গণবাহিনীর কয়েকশত সদস্য। ফলে এদের মাঠে নামাতে পারলে সহজেই নিশ্চিত হবে বিজয়। তারা তাহেরকে এগিয়ে যেতে বলেন।
এপর্যায়ে আলাপ ওঠে অভ্যুত্থান যদি সফল হয়, তবে বিজয়ী সিপাই জনতা কার নামে শ্লোগান দেবে। অনেকেই বলেন, অবশ্যই তাহেরের নামে। কিন্তু তাহের আপত্তি করেন। বলেন, ক্যান্টনমেন্টে আমার নামে স্লোগান হলে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। আমি আর্মি থেকে রিটায়ার্ড একজন মানুষ তাছাড়া সাধারণ মানুষও জাসদের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে জানে না। হঠাৎ করে আমার নাম চারদিকে উচ্চারিত হতে থাকলে আবার একটু ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাবে মানুষ। জাসদের কোনো পাবলিক ফিগারের নামেই স্লোগান হওয়া উচিত।
কিন্তু জনগণের কাছে পরিচিত জাসদ নেতা জলিল, রব, শাহাজাহান সিরাজ তখন কারাগারে। আর সিরাজুল আলম খান নেপথ্যের মানুষ, জাসদের আনুষ্ঠানিক কোনো নেতা তিনি নন, সাধারণ লোকে তারই জানে না। ড. আখলাকও কোনো পাবলিক ফিগার নন। তাহের বলেন সে ক্ষেত্রে জিয়ার নামে স্লোগান হালেই ভালো। উনি আর্মির লোক, তাকে আমরা মুক্ত করছি তাছাড়া সাধারণ মানুষের কাছেও তার একটা পরিচিতি আছে। অনেকেই তবুও বলেন অভ্যুত্থানের নেতা যেহেতু তাহের, তার নামেও শ্লোগান হওয়া উচিত। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় জিয়া এবং তাহেরের নামেই শ্লোগান হবে তবে বিভ্রান্তি এড়াতে প্রধানত জিয়াকেই তুলে ধরা হবে জনগণের কাছে।
ঘটনাচক্র আর কাকতালীয় সমাপতনে দ্বিতীয়বারের মতো জিয়াউর রহমানের পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। স্বাধীনতা ঘোষণার এক আকস্মিক ঘটনায় এক অপরিচিত মেজর দেশ দেশান্তরে হয়ে উঠেছিলেন পরিচিত নাম। দ্বিতীয়বার কৌশলগত কারণে তার নামটিকেই সিপাহী বিদ্রোহের অভ্যুত্থানের মূল দৃশাপটে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তে আবারও জিয়াউর রহমানের জীবনের মোড় ফিরবার প্রেক্ষাপট রচিত হয়।
এলিফ্যান্ট রোডের নোয়াখালী সমিতির গলিতে যখন তার জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত হচ্ছে জিয়া তখন সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করা এক সাধারণ নাগরিক যিনি পায়জামা পাঞ্জাবি পড়ে বন্দি হয়ে বসে আছেন তার বাড়িতে। ইতোমধ্যে তার জীবনরক্ষার বার্তা পাঠিয়ে তিনি ক্ষীণ আশা নিয়ে অপেক্ষা করছেন হয়তো তাহের তাকে উদ্ধার করবেন কখনো।
৯৬. খেলার মাঠে ইস্তেহার
নানা পথ ঘুরে দেশের এক চরম ক্রান্তিকালে দেশের ইতিহাসের ঘুড়ির নাটাই এসে পড়েছে তাহেরের হাতে। আশরাফুন্নেসার তিন নম্বর সন্তান নান্টু, পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো নান্টু, এক পা হারানো নান্টুর হাতে তখন বাংলাদেশের ভবিষ্যত।
খানিকটা বিল তাহের। এতবড় একটি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবার জন্য তিনি কি প্রস্তুত? আবার নিজেকেই প্রশ্ন করেন তিনি এমন একটি ঘটনার জন্যই কি নিজেকে প্রস্তুত করছেন না সারাটা জীবন? ঠাণ্ডা মাথায় পুরো অভ্যুত্থানের ছকটি তৈরি করতে বসেন তাহের। তার সঙ্গে ইনু, ভাই আনোয়ার, ইউসুফ। ভাই বাহার বেলালও আছে সহযোগী হিসেবে।
অভ্যুত্থানের দুটি পর্ব, একটি সামরিক, অন্যটি বেসামরিক। কথা হয়েছে তাহের তার নেতৃত্বে ক্যান্টনমেন্টে অভ্যুত্থানের সামরিক পর্বটি সফল করবার পর, জাসদের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বেসামরিক পর্বে শামিল করবেন শ্রমিক, ছাত্র সাধারণ জনগণকেতাহের অভুত্থানের প্রধান অংশ সামরিক পর্বটি সুচারু পরিকল্পনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
কিন্তু বেসামরিক পর্বটির প্রস্তুতিতে দেখা দেয় নানা অনিশ্চয়তা। জাসদের যে জননেতারা শ্রমিক কৃষক, ছাত্রদের জমায়েত করতে পারবেন তারা অধিকাংশই কারাগারে। যারা বাইরে আছেন তাড়া সাধারণ মানুষকে এই অভ্যুত্থানে যুক্ত করবার জন্য খানিকটা সময় চেয়েছিলেন। হরতাল, গণজমায়েতের মধ্য দিয়ে মানুষকে এই অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু সে সুযোগ তারা পাননি। ঘটনা, সময়ের দাবিতে তারা বাধ্য হচ্ছেন অভ্যুত্থানের পক্ষে যেতে। তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তাহেরই। যদিও তারা সমর্থন জানিয়েছেন এই অভ্যুত্থানকে, পারতপক্ষে খানিকটা আধো মন নিয়েই দাঁড়িয়েছেন তাহেরের পেছনে। তারা দেখতে চাচ্ছেন তাহের কতদূর যান, কতটা সফল হন, তারপর মাঠে নামবেন তারা।
রহস্যময় মানুষ দলের চিন্তাগুরু দাদা সিরাজুল আলম খান তাহেরকে মাঠে নামিয়ে দিয়ে চলে যান অজ্ঞাতস্থানে। যদিও সেখান থেকে তিনি যোগযোগ রাখেন তাহেরের সঙ্গে কিন্তু মূল দৃশ্যপট থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন তিনি। ড. আখলাক যিনি বরাবরই এই অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করে এসেছেন, তিনি আশ্রয় নেন এক পীরের দরগায়, যেখানে সংকটাপন্ন সময়ে প্রায়ই আশ্রয় নিয়ে থাকেন তিনি। সবাই অভ্যুত্থানের ঘোরে ব্যস্ত থাকলেও সিরাজুল আলম খান এবং ড. আখলাকের অবস্থানটিকে বিশেষভাবে নজরে রাখেন তাহেরের ভাই সাঈদ। সাঈদ ইতোমধ্যে জেল থেকে বেরিয়েছেন এবং নিজেকে খানিকটা দূরে রেখেছেন এ ঘটনার।
অভ্যুত্থানের প্রথম সারির প্রথম মানুষটি তখন তাহের। ইউসুফ একাকে জিজ্ঞাসা করে; তাহের, যদি জাসদের লিডাররা পিপল মোবিলাইজ করতে না পারে, তাহলে শুধু সিপাইরা কিন্তু এ ঘটনা সামলাতে পারবে না।
তাহের : আমি তা জানি ইউসুফ ভাই। কিন্তু সেটা তো তাদের দায়িত্ব। আমি যে দায়িত্বটা নিয়েছি সেটা থেকে তো আমার পেছানোর কোনো সুযোগ নাই।
সেদিন রাতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে চূড়ান্ত মিটিংয়ে বসেন তাহের। এবার মিটিং এলিফ্যান্ট রোডে নয় আবু ইউসুফের বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ার সিদ্দীকির গুলশানের বাসায়। গুলশানের সেই বাড়িতে তখন কয়েকশত সৈন্য। সভা পরিচালনা করেন তাহের। সভার শুরুতে সকালে ক্যান্টনমেন্টে বিলি করা লিফলেটটি আবার পড়া হয়। তাহের সিপাইদের জানান পার্টির অনুমোদনক্রমে ৬ তারিখ দিবাগত রাত অর্থাৎ ৭ নভেম্বরই অভ্যুত্থান ঘটানো হবে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে সৈনিকদের মধ্যে। তাহের সৈনিকদের বুঝিয়ে বলেন : তোমাদের মনে রাখতে হবে দেশের একটা সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে জনজীবনে শৃঙ্খলা আনবার জন্য সেনাবাহিনী এবং জনগণ দুই পক্ষ মিলে এই অভ্যুত্থান ঘটাতে যাচ্ছে। তবে এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকবে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। অন্য সৈনিকদের সাথে সন্মিলিতভাবে অভ্যুত্থান ঘটাতে হবে। এরপর আমরা একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করব। তাহের এক এক করে অভ্যুত্থানের নির্দিষ্ট কর্মসূচি বর্ণনা করেন সিপাইদের কাছেঃ
১. রাত বারোটায়
ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে বিপ্লবের সূচনা করা হবে।
২. জীবন বাঁচানোর অনিবার্য
প্রয়োজন ছাড়া কাউকে গুলি করা যাবে না।
৩. খালেদ মোশারফকে গ্রেপ্তার
করা হবে।
৪.
জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হবে এবং নিয়ে আসা হবে এলিফ্যান্ট
রোডের বাসায়।
৫. সৈনিকরা বিপ্লবের পক্ষে স্লোগান দিয়ে ট্রাকে ট্রাকে শহর প্রদক্ষিন করবে।
৬. প্রতিটি ট্রাকে অন্তত একজন সৈনিক সংস্থার লোক থাকবে।
৭. ৭ তারিখ সকালে সোহরাওয়ার্দী
উদ্যানে সৈনিকদের সমাবেশ হবে।
৮. বিপ্লবের পর বেতার টেলিভিশনে নেতাদের বক্তব্য প্রচার করা হবে।
৯. কোনো লুটপাটে অংশগ্রহণ
করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
১০.
বিপ্লবের পর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ইউনিট এবং নেতাদের নিয়ে বিপ্লবী পরিষদ
বা রেলেশন কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা হবে।
১১. সামরিক অফিসারদের বিপ্লব সমর্থন করার আহবান জানানো হবে। যারা করবে না তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
১২. কর্নেল তাহের বিপ্লবের সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
এরপর তাহের, ইমুকে সঙ্গে নিয়ে সৈনিক সংস্থার সদস্যদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্বগুলো ভাগ করে দেন। এখানেও কৈশোরে শোনা ব্রিটিশ অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অপারেশনের আদলে সৈনিক সংস্থার যারা অভ্যুত্থানে অংশ গ্রহণ করবেন তাদের ছয়টি দলে ভাগ করেন তাহের;
গ্রুপ এক-এই গ্রুপের নেতৃত্ব দেওয়া হয় নায়েব সুবেদার মাহবুবকে। এরাই সিগনাল দখল করে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করার মাধ্যমে বিদ্রোহ সূচনার প্রথম সংকেত দেবেন। এরপর সেন্ট্রাল অর্ডিনেন্স ডিপো (সিওডি) দখল করে অস্ত্রাগারের অস্ত্র নিজেদের হেফাজতে আনবেন। এদিকে বিদ্রোহ সূচনা সংকেত শোনার পর সমর্থন সূচক গুলিবর্ষণ করবেন ফার্স্ট ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ার, সেন্ডে ফিল্ড আর্টিলারি, ফার্স্ট ট্যাংকের সৈন্যরা।
গ্রুপ দুই : এই গ্রুপের নেতা হাবিলদার সুলতান। এদের দায়িত্ব বিদ্রোহ শুরু হবার পর সব অফিসারদের টু ফিল্ড আর্টিলারি অফিসে জড়ো করা। যাতে অফিসাররা নিজেরা মিলে আর কোনো ষড়যন্ত্র করতে না পারে।
গ্রুপ তিন : এ দলের নেতা নায়েব সুবেদার জালাল এবং জমির আলী। এদের দায়িত্ব হচ্ছে প্রথম দল ব্যর্থ হলে তারা এগিয়ে আসবেন সাপ্লাই ব্যাটালিয়ান নিয়ে।
গ্রুপ চার : এই দলের নেতা হাবিলদার সামাদ এবং হাবিলদার বারি। এদের দায়িত্ব হচ্ছে বিভিন্ন গ্রুপ গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা।
গ্রুপ পাঁচ : এই দলের নেতা হাবিলদার হাই। এদের দায়িত্ব জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে এলিফ্যান্ট রোডে নিয়ে আসা।
গ্রুপ ছয় : এই দলের নেতা নায়েক সিদ্দীক এবং সরোয়ার। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে খালেদ মোশারফকে গ্রপ্তার করা।
ভয় আর উত্তেজনার মিলিত অনুভূতি তখন সৈনিকদের। তারা জানেন তাদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড। কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে বলেন : জিয়াকে মুক্ত বা খালেদ মোশারফকে বন্দি করবার দরকার কি? দুজনকে মেরে ফেললেই তো হয়।
তাহের স্পষ্ট করে আবার বলেন : মনে রাখবে একটা গৃহযুদ্ধ ঠেকাবার জন্য আমরা এগিয়ে এসেছি, এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দেশকে আবার একটা যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেওয়া যাবে না। তোমাদের আবার বলছি কাউকে হত্যা করা যাবে না। খালেদ মোশারফকে বন্দি করা এবং জিয়াকে মুক্ত করে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারার মধ্যেই আমাদের এই পুরো অভ্যুত্থানের সাফল্য নির্ভর করছে। সুতরাং খুব সতর্কতার সাথে কাজ করতে হবে।
তাহের হাবিলদার হাইকে ইতোমধ্যে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে প্রস্তুত থাকবার কথা জানিয়ে দিতে বলেন। হাই শুরু থেকে জিয়াকে যারা বন্দি করে রেখেছেন এবং তার আশপাশের সৈনিকদের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। জিয়ার ব্যাটম্যান হাবিলদার সুলতান, ড্রাইভার কুদুস মোল্লা, জিয়ার গার্ড ইন চার্জ সুবেদার রইসউদ্দীন এরা সবাই ৭১ এ হাইয়ের সহযোদ্ধা। হাবিলদার হাই জিয়ার দেহরক্ষীদের গিয়ে বলেন, স্যারকে জানিয়ে রাখবেন, যে কোনো মুহূর্তে আমরা তাকে মুক্ত করতে আসতে পারি, তিনি যেন প্রস্তুত থাকেন।
ইনু বলেন : তাহের ভাই, একটা ব্যাপার আমাদের মনে রাখা দরকার, সৈনিকদের মধ্যে কিন্তু ফারুক, রশীদ, মোশতাকের পক্ষেরও অনেকে আছে।
তাহের বলেন : আমি জানি কিন্তু তারা খুবই ভালনারেবল এখন। আপাতত ওদের শক্তিটাও থাকুক আমাদের সাথে। সময় মতো ওদের কিক আউট করতে হবে। তাছাড়া এরা যোগ দিলে বরং একটা বড় প্রতিপক্ষ নিষ্ক্রিয় থাকবে।
সিদ্ধান্ত হয় অভ্যুত্থানের সময় তাহের ক্যান্টনমেন্টের বাইরে থাকবেন। ক্যান্টনমেন্টের ভেতর থেকে না, ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বাইরে থেকে। এজনা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বলয় থেকে বের করে আনা খুবই জরুরি। অভ্যুত্থানের মূল কর্মকাণ্ড হবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এবং প্রয়োজনে সাহায্য নেওয়া হবে অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে থাকা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের।
ঢাকা স্টেডিয়ামে তখন চলছে আগা খাণ গোল্ড কাপ। ছয় তারিখ বিকেলে জাসদ কর্মীরা দল বেধে যান থাইলান্ডের পেনাং এবং ব্রাদার্স ইউনিয়নের খেলা দেখতে। এক ফাঁকে আগের দিনে ক্যান্টনমেন্টে ছাড়া লিফলেটটি এবার জাসদ কর্মীরা ছাড়েন স্টেডিয়ামে। খেলার মাঠে হঠাৎ উড়তে দেখা যায় হাজার হাজার ইস্তেহার। উড়ে আসা লিফলেট হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দেখে ফুটবলপ্রেমী মানুষেরা। ঠিক বুঝে উঠতে পারে না লিফলেটের মর্মার্থ। অর্থ বুঝবার জন্য তাদের সবাইকে অপেক্ষা করতে হয় সেদিন মাঝরাত পর্যন্ত।
৯৭. ঘুম নেই
মিটিংয়ের মাঝখানে একফাঁকে বেরিয়ে এসে বেলালকে বারান্দায় পান তাহের। বলেন : তোমার ভাবীকে ফোন করে বলে দাও আজকে রাতে আমি নারায়ণগঞ্জ ফিরব না। ইউসুফ ভাইয়ের বাসাতেই থাকব। আমি পরে ফোন করব ওকে।
লুৎফা নারায়ণগঞ্জের জান মঞ্জিলে উদ্বিগ্নতায় দিন কাটাচ্ছেন কয়দিন। বুঝতে পারছেন একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। চিন্তিত, ব্যস্ত তাহের স্পষ্ট করে বলছে না কি ঘটছে। মাঝে শুধু একবার ফোন করে বলেছেন: আমাদের হয়তো একটা সিরিয়াস ডিসিশন নিতে হবে। আরেকটা কাউন্টার কু ঘটবে হয়তো। চিন্তা করো না। আমি সেফ থাকব।
রাতে ফোন বেজে ওঠে। লুৎফা ফোন ধরলে বেলাল বলেন, ভাবী সেজ ভাইজান আজকে আসবেন না। মেজ ভাইজানের ওখানে থাকবে।
লুৎফা : কি হচ্ছে বলো তো।
বেলাল : আমি সব জানি না ভাবী। মিটিং চলতেছে।
লুৎফাঃ আর কারা আছে?
বেলা : পাটি লিডাররা আছে আর সিপাইরা। সেজ ভাইজান আপনাকে পরে ফোন করবেন বলছে।
ফোন রেখে দেন লুৎফা। উৎকণ্ঠায় তার বুক কাঁপে। হয়তো একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে আজ। তাহের নিরাপদে থাকবে তো? ইতোমধ্যে মিশুরও জন্ম হয়েছে। তাহের যখন অভূত্থানের আয়োজন করছেন, লুৎফা তখন সামলাচ্ছেন তিন শিশু নীতু, যীশু, মিশুকে। সেদিন তিনজনকেই তাড়াতাড়ি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন লুৎফা। নিজে সামান্য একটু ভাত মুখে দিয়ে টেলিফোনের কাছে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসেন। তন্দ্রায় ঢুলতে ঢুলতে মাঝে মাঝে হঠাৎ চমকে উঠে ফোনের দিকে তাকান, ফোন বাজল কি?
৯৮. জিরো আওয়ার
আর দশটি রাতের মতোই আরও একটি রাত নামে ঢাকা শহরে। ঘড়ির কাঁটা মধ্য রাত পেরোয়, সেদিন ৭ই নভেম্বর। শহরের উপর দিয়ে বয়ে যায় নভেম্বরের ঠাণ্ডা হাওয়া। মানুষ লেপের নিচে গা ঢাকে। অবশ্য তারা জানে না, সেই ১৮৫৭ সালের পর প্রায় দেড়শত বছর পেরিয়ে আর কিছুক্ষণ পরেই শুরু হবে উপমহাদেশের দ্বিতীয় সিপাহী বিপ্লব।
এলিফ্যান্ট রোডের বারান্দায় আধো অন্ধকারে অধীর আগ্রহে বসে আছেন তাহের, ইনু, ইউসুফ আনোয়ার। নীরব শুনশান চারদিকে। অপেক্ষা করছেন প্রথম ফায়ার ওপেন হবার খবরের জন্য। ক্যান্টনমেন্ট থেকে এলিফ্যান্ট রোড বেশ খানিকটা দূরে, তবু তারা আশা করছেন ফায়ার শুরু হলে রাতের নীরবতায় হয়তো তা শোনা যাবে সে শব্দ। হঠাৎ একটা গুম গুম আওয়াজ। চমকে উঠেন তারা, তবে কি শুরু হলো অভ্যুত্থান? না, পরে দেখো গেল পাশের বাড়ির লোকেরা তাদের পানির পাম্প ছেড়েছে, তারই শব্দ। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসেন তারা। উদ্বিগ্নতায় কথা বলেন না কেউ। ইতোমধ্যে পরিকল্পনামাফিক প্রথম ফায়ারের সময় পার হয়ে গেছে। বাড়ির বাইরে মূল রাস্তায় পায়চারী করছে ঢাকা নগরীর গণবাহিনীর বিশেষ স্কোয়াড-বাহার, বেলাল, মুশতাক, বাবুল, সবুজ, বাচ্চু, মাসুদ, হারুন প্রমুখেরা।
প্রথম ফায়ারটি ওপেন করার কথা যে নায়েব সুবেদার মাহবুবের তিনি ঐ মুহূর্তে এক অপ্রত্যাশিত ঝামেলায় জড়িয়ে গেছেন। আর্মি হেডকোয়ার্টারের কাছে লাল মসজিদের পাশে জেসিওদের কোয়ার্টারে মাহবুবের বাসা। সারাদিন বাইরেই মিটিংয়ের পর মিটিং করে কাটিয়ছেন তিনি। অপারেশনে যাবার আগে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে রওনা দিলে বাসার কাছে তার পথ আগলে দাঁড়ান সুবেদার নুরুন্নবী। নুরুন্নবী মাহবুবের প্রতিবেশী। অবাক হন মাহবুব : কি ব্যাপার নুরুন্নবী ভাই?
নুরুন্নবী বলেনঃ মাহবুব ভাই, আপনাদের অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেছে। জেনারেল খালেদ অর্ডার দিয়েছেন আপনাকে এরেস্ট করার। আমি আপনাকে এরেস্ট করতে এসেছি।
মুহূর্তের জন্য খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়েন মাহবুব। কিন্তু তিনি জানেন যে তার ওপরই নির্ভর করছে পুরো বিদ্রোহ। সবাই অপেক্ষা করে থাকবেন তার ওপেনিং ফায়ারের জন্য। যে কোনো উপায়ে এ অবস্থাকে অতিক্রম করতে হবে তার। মাহবুব বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। বলেন : অনেক দেরি করে ফেলেছেন নুরুন্নবী ভাই। এখন আমাকে এরেস্ট করেও কোনো লাভ হবে না, সারা ক্যান্টনমেন্টে আমাদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোক এখন পজিশন নিয়ে আছে। একটু পরেই তারা দখল করে নেবে ক্যান্টনমেন্ট। আপনাদের আর কয়জন পারবেন না আমাদের সাথে? বিপ্লব হবেই। আর বিপ্লব সফল হলে আপনার পরিণতি কি হবে ভেবে দেখছেন? আপনি খালেদ মোশারফের সঙ্গে গেছেন, তার দলে থাকলে আপনি সুবেদার সুবেদারই থাকবেন। ৰিপ্লব করে আমরা সিপাই অফিসারের পার্থক্য তুলে দেবো। আপনি আমাদের সঙ্গে আসেন।
মাহবুবের আত্মবিশ্বাস দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন নুরুন্নবী। কিছু না বলে পথ ছেড়ে দেন মাহবুবের। মাহবুব দ্রুত বাসাঁয় গিয়ে দু মুঠো ভাত খেয়ে ইউনিফর্ম পরেন, ঘরে রাখা কুরআন ছুঁয়ে শপথ করেন, স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যান অন্ধকারে। রাত এগারোটায় একটি নির্দিষ্ট জায়গায় তার দেখা করার কথা ফার্স্ট ইঞ্জিনিয়ারের সৈনিক সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখেন কেউ নেইকে। ভড়কে যান মাহবুব। এসময় সৈনিক সংস্থার এক সদস্য তাকে জানান যে ফার্স্ট ইঞ্জিনিয়ারের সৈন্যদের খালেদের লোকেরা এসে বন্দি করে নিয়ে গেছে এবং তাদের তৃতীয় গ্রুপের নেতা নায়েব সুবেদার জালালকেও এরেস্ট করা হয়েছে। কি করবেন বুঝে উঠতে পারেন না মাহবুব। এসময় একজন হাবিলদার খোঁজ নিয়ে আসেন যে ফাস ইঞ্জিনিয়ারের অধিকাংশ সিপাই বন্দি হলেও ১৭ জন অস্ত্র নিয়ে পাশের জঙ্গলে পালিয়ে আছেন। মাহবুব সেই হাবিলদারসহ পালিয়ে থাকা সৈন্যদের নিয়েই বিদ্রোহ শুরু করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ঐ ছোট দল নিয়ে আচমকা সেন্ট্রাল অর্ডিনেন্স ডিপো (সি ওডি) আক্রমণ করেন। সিওডির নাইট কমান্ডার তখনও অভ্যুত্থান বিষয়ে কিছু জানেন না। ঘটনার আকস্মিকতায় নাইট কমান্ডার আত্মসমর্পণ করেন। তাছাড়া সিওডি পাহারারত ব্যাটালিয়নের অধিকাংশ সিপাইই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য। তারা আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে ছিলেন এই আক্রমণের জনা, ফলে মাহবুব সেখানে কোনো প্রতিরোধের মুখোমুখি হন না। অস্ত্রাগার খুলে দেন সিপাইরী। অস্ত্রাগার ভরা এল এমজি। বিদ্রোহী সৈন্যরা যার যার মতো হাতে তুলে নেন হাতিয়ার।
কথা ছিল অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে আর্মি হেডকোয়ার্টার দখল করার পর ফায়ার ওপেন করার কিন্তু ইতোমধ্যেই দেরি হয়ে যাওয়াতে মাহবুব সিওডিতেই ফায়ার ওপেন করেন। তখন ৭ নভেম্বর রাত ১২টা ৩০ মিনিট। প্রথম ফায়ারটি দেরি হওয়াতে শুরুতে সৈনিক সংস্থার বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সমন্বয়ে সমস্যা দেখা দেয়। সৈনিক সংস্থার লোকদের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি এবং ভীতির সঞ্চার হয়। কিন্তু মাহবুবের ফায়ার শুনবার সাথে সাথে, আগে থেকে প্রস্তুত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার শত শত সৈনিক ফায়ার করতে করতে এগিয়ে যেতে শুরু করে আর্মি হেডকোয়ার্টারের দিকে। সারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে হাজার হাজার বুলেট ছুটে যেতে থাকে আকাশে। চারদিকে ফায়ার ফায়ার চিৎকার। কিছুক্ষণ পর আর্টিলারির কামান ফায়ার ওপেন করে, বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাঙ্কগুলোও চালু হয়ে যায়। ঘুম থেকে জেগে ওঠে পুরো ক্যান্টনমেন্ট। চারদিকে শ্লোগান সিপাই সিপাই ভাই ভাই, সিপাই বিপ্লব লাল সালাম, কর্নেল তাহের লাল সালাম, জেনারেল জিয়া লাল সালাম
৯৯. সিপাই দিপাই ভাই ভাই
রাত একটার দিকে ক্যান্টনমেন্টের চারদিক থেকে সিপাইরা এসে আর্মি হেডকোয়ার্টার দখল করেন। কথামতো অপারেশনের দু নম্বর দল বিভিন্ন মেল, কোয়ার্টার থেকে অফিসারদের এনে জড়ো করেন টু ফিল্ড আর্টিলারিতে। অনেক অফিসাররাই সিপাইদের মেসের দিকে আসতে দেখে ভড়কে যান, এদিক ওদিক ছুটে পালান, বাকিরা রাতের পোশাকে, কেউ সেন্ডেল পায়ে, কেউ খালি পায়ে আতঙ্কিত মুখে অনুসরণ করেন সিপাইদের। বুঝে উঠতে পারেন না ঠিক কি হচ্ছে।
অফিসারদের টু ফিল্ড আর্টিলারির হল রুমে বসিয়ে রেখে, তাদের সামনেই সিপাইরা একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলি করে। এক সৈনিক জনৈক কর্নেলকে বলেন, স্যার আজ থেকে সিপাই আর অফিসারের মধ্যে আর কোনো ব্যাংকের পার্থক্য নাই। আমরা সব সমান।
কলে কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। এই আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত, অভূতপূর্ব ঘটনায় তারা হতবিহ্বল। যারা তাদের হুকুমের দাস, অতি অধস্তন এইসব কর্মচারী যাদের দিকে তারা ভালোমতো চোখ তুলে তাকানওনি, যারা তাদের জুতা পালিশ করে দেয় তারা কিনা তুখোর বাঘের মতো ঘিরে রেখেছে তাদের আর তারা পরাক্রমশালী অফিসাররা হরিনশাবকের মতো কাঁপছে।
সিপাইদের একটা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার খবর খালেদ মোশারফ পেলেও অভ্যুত্থানের ব্যাপকতা বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না। বিদ্রোহের আভাষ পেয়ে ইতোমধ্যেই ক্যান্টনমেন্টে তার নির্ধারিত মিটিং বাতিল করে দিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গভবন থেকে ফোন করে তিনি জানতে পারেন যে ক্যান্টনমেন্টের অধিকাংশ সৈনিক বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে, এমনকি তিনি যে ইউনিটে বসে তার অভূত্থান পরিচালনা করেছেন সেই চতুর্থ বেঙ্গলও।
খেলা ঘুরে যাচ্ছে আবার। ক্যালাইডোস্কোপের মতো মুহূর্তে মুহূর্তে যেন বদলে যাচ্ছে রাজনীতির নকশা। এবার কোনো মেজর, ব্রিগেডিয়ার, জেনারেল নন, এবার ঘটনার নায়ক সাধারণ সিপাই, হাবিলদার, সুবেদাররা। ঘটনা কোনোদিকে মোড় নিচ্ছে বুঝে উঠতে পারেন না খালেদ। তবে বিপদের আঁচ করে তিনি বঙ্গভবন ত্যাগ করেন। চলে যান রক্ষীবাহিনী প্রধান শুভাকাঙ্ক্ষী ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের বাসায়, সেখানে সামরিক পোশাক পাল্টে নেন তিনি এবং তারপর যান তার এক আত্মীয়ের বাসায়। সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে পরিস্থিতি বুঝবার চেষ্টা করেন তিনি। বিস্ময়ের সাথে জানতে পারেন যে ক্যান্টনমেন্ট পুরোপুরি সিপাইদের দখলে। হিসাব মেলে না খালেদের। তিনি টের পেয়ে যান যে এ বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। তিনি বরং চলে যান শেরে বাংলা নগরে অবস্থান করা দশম বেঙ্গলে। এটি তার বিশ্বস্ত ইউনিট, এখান থেকেই তিনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন। তার সঙ্গে কর্নেল হুদা আর হায়দার। তার অভ্যুত্থানের সেকেন্ড ইন কমান্ড শাফায়াত জামিল তখনও বঙ্গভবনে।
ওদিকে খালেদ মোশারফকে বন্দি করবার উদ্দেশে যাওয়া সৈনিক সংস্থার দলটি নির্ধারিত স্থানে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে রওনা দেন টু ফিল্ড আর্টিলারিতে। আকাশে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকেন তারা, স্লোগান দিতে থাকেন মুহুর্মুহ। নিজের বাড়ি থেকে এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে বিহ্বল হয়ে পড়েন ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার কর্নেল হামিদ। তিনি রাতের পোশাকেই আধো অন্ধকারে নেমে পড়েন সৈনিকদের বিজয় মিছিলে। কিছুক্ষণ পর শ্লোগান ওঠে সিপাই সিপাই ভাই ভাই অফিসারের রক্ত চাই। ভয় পেয়ে যান কর্নেল হামিদ। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যান।
১০০. রাতের ঘোষণা
ইউসুফের বাড়ির টেলিফোন বেজে ওঠে। তাহের, ইনু, ইউসুফ ধড়মড়িয়ে উঠেন। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য ফোন করে জানান সিপাইরা আর্মি হেডকোয়ার্টার দখল করেছে, অফিসারদের টু ফিল্ড আর্টিলারিতে আনা হয়েছে এবং একটি দল গেছে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করতে। তাহের তার ক্ৰাচটা হাতে নিয়ে এগিয়ে যান রেলিংয়ের দিকে, যেন চেষ্টা করেন সৈনিকদের ফায়ারে কোনো শব্দ শোনা যায় কিনা। উত্তেজিত তাহের। ইনু বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। অভ্যুত্থান শেষে সৈনিকদের আসার কথা এলিফ্যান্ট রোডে। ইনু এগিয়ে গিয়ে দেখবার চেষ্টা করেন তারা আসছে কিনা। কিছুক্ষণ পর আরেকটি ফোন আসে, সৈনিকরা জানান তারা রেডিও স্টেশন দখল করেছেন। একের পর এক অভ্যুত্থানের টার্গেট অর্জিত হচ্ছে বলে আনন্দিত হয়ে ওঠেন তাহের। অভ্যুত্থানের এরপরের গুরুত্বপূর্ণ মিশন জিয়ার মুক্তি। ইউসুফ সে খবরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেন টেলিফোনের পাশে। তাহের আনোয়ারকে বলেন, গণবাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দিতে যাতে তারা মাইকিং করে শহরের লোকদের বিপ্লবের খবর জানায় এবং আগামীকাল সকালের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং শহীদ মিনারের জনসভায় যোগ দেবার আহ্বান জানায়। তাহের আনোয়ারকে আরও বলেন এ বি এম মাহমুদের বাসার টেলিফোন থেকে সিরাজুল আলম খানকে খবর জানাতে। আনোয়ার ফোন করে গোপন আস্তানায় থাকা সিরাজুল আলম খানকে অভ্যুত্থানের সাফল্যের খবর জানান। সিরাজুল আলম বলেন, বিপ্লবের পক্ষে রেডিওতে একটি ঘোষণা দিয়ে দিতে। টেলিফোনেই তিনি রেডিওতে প্রচারের জন্য বক্তব্যটি বলেন এবং আনোয়ার তা টুকে নেন।
আনোয়ার, গণকণ্ঠের সাংবাদিক শামসুদ্দিন পেয়ারাকে সঙ্গে করে তার কমলা রঙ্গের মটোর সাইকেলটি নিয়ে রাতের অন্ধকারে রওনা দেন রেডিও স্টেশনের দিকে। যাবার আগে রাস্তায় টহল দেয়া গণবাহিনীর বিশেষ স্কোয়াডের নেতা ভাই বাহার আর বেলালকে বলেন বিপ্লবের পক্ষে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করতে। তাহেরের ড্রেজার সংস্থার জীপটি নিয়ে বেলাল, বাহার, মুশতাক, সবুজ এবং অন্যরা বেরিয়ে পড়েন মাইকের খোঁজে। মাঝরাতে মাইকের দোকানদারকে ঘুম থেকে তোলেন তারা।
আনোয়ার এবং শামসুদ্দিন শাহবাগে ডায়াবেটিক হাসপাতালের পাশে রেডিও স্টেশন গিয়ে দেখেন গেটের সামনে ট্যাঙ্ক, রাস্তা জুড়ে উল্লসিত সৈনিকরা। আকাশে অটোমেটিক ফায়ার করছেন কেউ কেউ। সৈন্যরা আনোয়ারকে চেনেন। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নিয়মিত রাজনৈতিক ক্লাস নিয়েছেন তিনি। ফলে আনোয়ারকে দেখে রেডিও স্টেশনের গেট খুলে দেন সিপাইরা। বিপ্লবের ঘোষণাটি তখন তাদের হতে, কিন্তু শামসুদ্দিন বা আনোয়ার কি করে রেডিওতে ঘোষণা দিতে হয় জানেন না। রেডিও স্টেশনে ঘুমাচ্ছিলেন এক বেতার কর্মচারী, তিনি জানান রেডিওর চিফ টেকনিশিয়ান থাকেন কাছেই। তাকে ডেকে আনলেই হবে। কয়েকজন সিপাইসহ সেই কর্মচারী গিয়ে বাসা থেকে ধরে আনেন সেই টেকনিশিয়ানকে। টেকনিশিয়ান এসে অন এয়ার চালু করেন। শামসুদ্দিনকে ঘোষণাটি পড়তে বলেন আরোয়ার। গভীর রাতে ইথারে ভেসে আসে শামসুদ্দিন পেয়ারার কণ্ঠ : বাংলাদেশের বীর বিপ্লবী জনগণ, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, ও গণবাহিনীর যৌথ নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর জোয়ানরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। আপনারা শান্ত থাকুন। গণবাহিনীর সদস্যরা স্ব স্ব এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করুন এবং আঞ্চলিক কমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখুন..।
তিন মাস কালের ব্যবধানে বাংলাদেশে তিন তিনটি বিপরীতমুখী অভ্যুত্থানের ডামাডোল।