৮. এখন যে-ফোনটি বাজছে

এখন যে-ফোনটি বাজছে, সেটি অনন্যার, শব্দ শুনেই বুঝতে পারছি; কিন্তু আমি। ধরতে এতো দেরি করছি কেনো? আমি কি ফোন ধরবো না? অথচ আমি আজ অফিসে এসেছি শুধু অনন্যার ফোনেরই জন্যে। কিন্তু আমি ফোন ধরছি না কেনো? ফোন একবার থামলো, আবার বাজতে শুরু করলো; অনন্যা অনেকক্ষণ ফোন ধরে রাখতে পারে, আবার থামলো, বাজতে শুরু করলো আবার। আটটা চল্লিশ বেজে গেছে, তবু অনন্যার ফোন বাজছে, সে কি তার নটার ক্লাশ ধরবে না? আজ তার নটার ক্লাশ নেই? কেননা নেই? তার কি অসুখ করেছে? সে কি যাবে কোথাও? তার কতোটুকুই আমি। জানি, আসলে কিছুই জানি না, জানতেও চাই না। তার ছাত্রটি তাকে কতোগুলো গোলাপ দিয়েছে এ-পর্যন্ত গোলাপ দিতে গিয়ে ছেলেটা অনন্যার হাত ছোঁয় না? অনন্যার তখন কেমন লাগে? অনেকক্ষণ আঙুল লেগে থাকে? ঘাস কি সত্যিই সোনালি হয়ে উঠেছিলো? আমি কি হেলুসিনেশন দেখি? আমি এবার ফোন ধরি।

আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, অনন্যা বলে, আপনি ফোন ধরছেন না দেখে। আধঘণ্টা ধরে রিং করছি।

তুমি আজ কি কলেজে যাচ্ছো না? আমি বলি।

না, আজ আর যাবো না; বুক কষ্টে ভরে গেছে, অনন্যা বলে।

তোমার ছাত্রটি গোলাপ কাকে দেবে তাহলে? আমি বলি।

আপনি কি ওকে ঈর্ষা করেন? অনন্যা বলে।

একটু ভেবে দেখতে হবে, আমি সম্ভবত মিথ্যা বলি।

আপনার কি অসুখ করেছে? অনন্যা বলে।

না তো, আমি বলি।

কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি আপনার অসুখ করেছে, অনন্যা বলে।

তুমি কি আমাকে সারিয়ে তুলতে পারো? আমি বলি।

নিজেকেই আমি সারাতে পারি না, আপনাকে কীভাবে সারাবো? অনন্যা বলে।

কিন্তু আমার মনে হয় তোমার আঙুলে আরোগ্য আছে, আমি বলি।

অনন্যা হাসে, আমি তার হাসি দেখতে থাকি; সে বলে, তাহলে আপনি আপনার সিংহাসনে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করুন, আমি ম্যাসাজ করে দিই।

আমি অনন্যার স্পর্শ অনুভব করতে থাকি; দশটি স্বর্ণচাপা আমার চুলের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে, আমার চোখের পাতার ওপর দিঘির ওপর কালো ছায়ার মতো স্থির হয়ে আছে, স্বর্ণচাপা বয়ে চলছে আমার নাকের ওপর দিয়ে মুখের ওপর দিয়ে আমার গ্রীবার ওপর দিয়ে বুকের ওপর দিয়ে পিঠের ওপর দিয়ে আমার মাংসের ভেতর দিয়ে আমার রক্তের ভেতর দিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ছি স্বর্ণচাপা বয়ে চলেছে নদী বয়ে চলেছে ছায়া। স্থির হয়ে আছে আমি ঘুমিয়ে পড়ছি আমি স্বর্ণচাপা দেখছি ঘাস সোনালি হয়ে উঠছে পায়ে চুমো খাচ্ছি আমি অনুভব করছি আমার বুকের ওপর কে যেনো মাথা রাখছে অনন্যার শরীরের গন্ধ পাচ্ছি অনন্যার শাড়ির গন্ধ পাচ্ছি স্বর্ণচাপার গন্ধ পাচ্ছি।

একটু কি ভালো লাগছে। অনন্যা বলে।

খুব ভালো লাগছে, আমি বলি।

আমাকে কি আপনার দেখতে ইচ্ছে করছে না? অনন্যা বলে।

আমি তো তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, আমি বলি।

কিন্তু আমি তো আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না, অনন্যা বলে।

দুপুরে একসাথে খেলে কেমন হয়? আমি বলি।

বেশ হয়, অনন্যা বলে।

কোথায়? আমি বলি।

অনন্যা তার প্রিয় রেস্তোরাঁটির নাম বলে। চিংড়ি। অনন্যার একটি প্রিয় রেস্তোরাঁ আছে! অনন্যা টেলিফোন রাখতেই মাহমুদা রহমানের ফোন বেজে ওঠে, আমাকে এখনি তাঁর ওখানে যেতে হবে। আমার কোনো কাজ নেই, তবু বলি আমার অনেক কাজ; মাহমুদা রহমান তা শুনতে রাজি নন, আমাকে যেতেই হবে, এখন না গেলে হবে না। আমি গিয়ে দেখি মাহমুদা রহমান আর হাফিজুর রহমান দুজন দু-সোফায় বসে। আছেন। তারা কথা বলছেন না। আমাকে দেখে হাফিজুর রহমান মাথা আরো নামিয়ে নিলেন। কাউকে অপরাধীর মতো বসে থাকতে দেখলে আমার খারাপ লাগে, আমার খারাপ লাগলো। আমাদের সবারই তো অপরাধীর মতো বসে থাকার কথা, কিন্তু আমরা সবাই পুণ্যবানের মতো বসি, শুধু কেউ কেউ বসে অপরাধীর মতো।

আপনি আমাকে উদ্ধার করলেন না, মাহমুদা রহমান বলেন, কিন্তু আমি উদ্ধার করেছি নিজেকে, জানেন?

আমি বলি, না।

মাহমুদা রহমান বলেন, মেয়েটিকে খুন করি নি, বিয়ে দিয়েছি।

আমি বলি, কোথায়?

মাহমুদা রহমান বলেন, আমাদের ড্রাইভারের ভাগনের সাথে, দু-লাখ টাকা দিতে হয়েছে, বাচ্চাটা তারই হবে।

হাফিজুর রহমান বলেন, বাচ্চাটিকে আমি নিয়ে আসবো।

মাহমুদা রহমান বলেন, তা আনবে, পোলা হলে তো আনবেই, পোলার বাপ হবে আলহজ মোঃ হাফিজুর রহমান।

হাফিজুর রহমান বলেন, আজ আমি চলে যাচ্ছি, আগামী মাসে ডেলিভারির সময় আবার আসবো।

মাহমুদা রহমান বলেন, আজ চলে যাচ্ছে, কিন্তু বুকে একটা দাগ নিয়ে যেতে হবে তোমাকে। আমি একটু প্রতিশোধ নিতে চাই।

হাফিজুর রহমান বলেন, কী প্রতিশোধ?

মাহমুদা রহমান বলেন, আমি মাহবুব সাহেবের সাথে আজ রাতে ঘুমোবো এটুকু শুধু তোমাকে জানিয়ে রাখতে চাই। তুমি কিছু মনে কোরো না, মাহবুব সাহেবকে আমি পছন্দ করি, তাঁকে দেহটি দিতে চাই।

আমি কোনো কথা বলি না; ভালো মানুষের মতো বলতে পারি না, এ কী বলছেন, এ কী বলছেন, আমি চুপ করে থাকি, একটা সৎ মানুষের ভূমিকায় অভিনয় করতে আমার ভালো লাগছে না। হাফিজুর রহমানের মুখ কঠিন হয়ে ওঠার কথা, কিন্তু তিনি আরো ভেঙে পড়ছেন; তিনি বানিয়েই বলতে পারতেন, তাতো তোমরা ঘুমাই, কিন্তু তার মুখে কোনো কথা আসে না। তাতে মাহমুদা রহমান সুখ পাচ্ছেন না, তিনি সুখ পেতেন যদি হাফিজুর রহমান সাড়া দিতেন। সাড়া জাগানোর জন্যে মাহমুদা রহমান। তীব্র হয়ে উঠতে থাকেন।

আমি শুধু ঘুমোবা না, মাহমুদা রহমান বলেন, আমি মাহবুব ভাইয়ের দ্বারা প্রেগন্যান্ট হবো।

হাফিজুর রহমান একবার নড়েচড়ে বসেন, আমি পাথর হয়ে যাই।

মাহবুব ভাই রাজি না হলে, মাহমুদা রহমান বলেন, আমি আমার ড্রাইভারের সাথে ঘুমোবো, ড্রাইভারের দ্বার প্রেগন্যান্ট হবো।

হাফিজুর রহমান এবার নড়েচড়ে বসতেও পারেন না, একটু কাৎ হয়ে পড়েন সোফার ওপর।

মাহমুদা রহমান বলেন, ড্রাইভার রাজি না হলে ড্রাইভারের ভাগনের সাথে ঘুমোবো, আমি পেটে তার একটা পোলা নেবো।

আমি উঠে পড়ি, কোনো কথা বলি না। অনন্যার প্রিয় রেস্তোরাঁয় যেতে হবে আমাকে, সে বলছে সেটি খুব সুন্দর, ঢুকলেই মন ভরে যায়। মেয়েরা একটু পরেই আসে বলে জানি আমি, তাই একটু দেরি করেই ঢুকি, গিয়ে দেখি অনন্যা। আলোঅন্ধকারাচ্ছন্ন এক কোণে বসে আছে। সে বসে আছে দেখে আমি বিব্রত হই, আমারই আগে আসা উচিত ছিলো।

একা একা অপেক্ষা করতে আমার ভালো লাগে, অনন্যা বলে, তাই আমি একটু আগেই এসে বসে আছি।

দেরি করে আসতে আমার খারাপ লাগে, আমি বলি, আরেকটুকু আগে এলে তোমাকে আরেকটুকু বেশি দেখতে পেতাম।

তাহলে একটু দেরি করে বেরোবো আমরা, অনন্যা বলে।

কিন্তু আগের সময়টুকু কোথায় পাবো? আমি বলি।

আমি কোনো খাবারের নাম মনে রাখতে পারি না, কিন্তু অনন্যার দেখছি সব মুখস্থ, হয়তো নম্বরগুলোও মুখস্থ। সে একেকটির নাম, রেসিপি, আর স্বাদ বলতে থাকে, তার ঠোঁট থেকে নামগুলো খুব সুস্বাদু হয়ে বেরোচ্ছে। অনেক বছর পর খাবার আমার কাছে সুস্বাদু মনে হয়। আমি সুপ নেড়ে নেড়ে চিংড়ি খুঁজতে থাকি, অনন্যা চমৎকার মশলা। মিশিয়েছে সুপে, তার আঙুল থেকে সুস্বাদ গলে গলে নেমেছে সুপের পেয়ালায়। আমার মনে পড়ে প্রথম যেদিন চোচিংচোতে সুপ খেয়েছিলাম, সেদিন আমার খুব হাসি পেয়েছিলো।

আমি যদি সেদিন মরে যেতাম তাহলে আপনার সাথে দেখা হতো না, অনন্যা বলে।

আমি একটি সুন্দর লাশ দেখতে পেতাম, আমি বলি, খুব কষ্ট লাগতো; জানতে ইচ্ছে করতো জীবিত সে কেমন ছিলো।

আমাকে আপনার কেমন লাগে? অনন্যা বলে।

ভালো ও সুন্দর, আমি বলি।

সুন্দর দেখলে আপনার কেমন লাগে? অনন্যা বলে।

আমি কোনো উত্তর দিই না, দিতে পারি না, আমি যেনো বুঝে উঠতে পারছি না সুন্দর দেখলে আমার কেমন লাগে।

বলুন, আমার শুনতে ইচ্ছে করছে, অনন্যা বলে।

আমার সম্পূর্ণরূপে ভোগ করতে ইচ্ছে করে, আমি বলি, ছেলেবেলায় আমি চাঁদটাকে জড়িয়ে ধরে কামড়াতে চাইতাম।

আপনি তো ভয়ঙ্কর, অনন্যা বলে, সব কিছুকেই কামড়াতে চান?

চুলোর লাল টুকটুকে আগুনকেও আমার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করতো, আমি বলি, সম্পূর্ণরূপে ভোগ করতে ইচ্ছে করতো।

আমাকে ভোগ করতে আপনার ইচ্ছে করছে না? অনন্যা বলে।

আমি অনন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, ঘাস সোনালি হয়ে উঠছে দেখতে পাই।

না, আমি বলি।

কেনো? অনন্যা বলে।

তোমাকে আমার সুন্দরের থেকে বেশি মনে হয়, আমি বলি।

তাতে কী? অনন্যা বলে।

আমি তা বুঝতে পারছি না, আমি বলি, তবে আজো তোমাকে ভোগ করার কোনো ইচ্ছে আমার হয় নি। কোনো দিন হতে পারে।

আপনার চোখ দেখে আমি তা বুঝতে পারি, অনন্যা বলে, কিন্তু জানেন আমি যেখানেই যাই সবাই আমাকে ভোগ করতে চায়, হয়তো সব মেয়েদেরই চায়।

আমিও সাধারণত চাই, আমি বলি।

আমার ছাত্রটি আমাকে ভোগ করতে চায়, অনন্যা বলে, ওই গোলাপের অর্থ আমি বুঝি।

চুপ করে হাসে অনন্যা, এবং বলে, বুড়ো প্রিন্সিপালটি আমাকে ভোগ করতে চায়। ইলেক্ট্রিক বিল দিতে গেলে কেরানিটি এমনভাবে তাকায়! কোর্টে আমাদের একটি মামলা আছে, আমিই দেখাশোনা করি, আমাদের প্রত্যেকটি উকিল আমাকে ভোগ করতে চায়, আমি বুঝি, তাদের চার পাঁচটি করে বাচ্চা আছে।

খোঁড়া ভিখিরিকে পয়সা দেয়ার সময় খেয়াল কোরো, দেখবে সেও তোমাকে ভোগ করতে চাচ্ছে, আমি বলি, মনে মনে ভোগ করছে।

এমনকি আমার তিনটি সহকর্মিণীও চাচ্ছে, অনন্যা বলে, আমি ওদের সাথে ভোগে সঙ্গী হই।

তা চাইতে পারে, আমি বলি, সব সময় পুরুষ লাগে না।

ওরা হোস্টেলে থাকে, অনন্যা বলে, আমাকে জোর করে নিয়ে যায়, ভালো খাওয়ায়, আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওরা ঘুমোয়, আমাকে কিছু বলে না।

ওরা ভাবছে এক সময় তুমি নিজেই অংশ নেবে, আমি বলি।

আমি শিগগিরই বোধ হয় অনেক দূরে চলে যাবো, অনন্যা বলে, কষ্ট হয় আপনার সাথে দেখা হবে না।

কোথায় যাবে, কেননা দেখা হবে না? আমি বলি।

 আমি নিজেও জানি না, অনন্যা বলে, হয়তো কেউ জানবে না। তার আগে আমরা একদিন বেড়াতে যাবো।

তার আগে তুমি আমার সাথে বেড়াতে যাবে, আমি বলি, তাহলে আমি তোমার সাথে কোনো দিন বেড়াতে যাবো না। তখন তুমি আর অনেক দূরে যেতে পারবে না।

বেড়াতে না গেলেও হয়তো আমাকে চলে যেতে হবে, অনন্যা বলে, চলুন না। আজই বেড়াতে যাই।

না, না, না; আমি বেড়াতে যাবো না, আমি বলি।

অনন্যাকে আজ মধুরতম মনে হচ্ছে, আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো আমার বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করবে, হয়তো তাকে ভোগ করার বাসনা জেগে উঠবে, আমার রক্ত জ্বলে উঠবে। আমি উঠে পড়ার প্রস্তাব দিই, অনন্যা আরো কিছুক্ষণ থাকতে চায়, কিন্তু আমি উঠতে চাই।

আপনার কি কোনো জরুরি কাজ আছে? অনন্যা বলে।

না, কোনো কাজ নেই; বেরিয়ে কোথায় যাবো, তাও জানি না; কিন্তু আমি উঠতে চাই।

কেনো? অনন্যা বলে।

আর কিছুক্ষণ থাকলে আমার মনে ভোগ করার সাধ জাগবে, আমি বলি।

জাগুক না, অনন্যা বলে।

আমি অনন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি; কিন্তু এখনো আমার ভোগ করার সাধ জাগছে না, অনন্যার শরীর পরিমাপ করার আগ্রহ হচ্ছে না, মনে হচ্ছে আমার ভেতর। কোনো পুরুষ নেই, লিঙ্গ নেই। অদ্ভুত লাগে আমার।

আমাকে দেখে যাদের সাধ জেগেছে, অনন্যা বলে, তাদের জন্যে আমার কোনো সাধ জাগে নি; আমার ইচ্ছে হচ্ছে যার জন্যে আমার সাধ জেগেছে আমার জন্যে তার একটু সাধ জাগুক।

হয়তো কোনো দিন জাগবে, আমি বলি।

তখন হয়তো আমি থাকবো না, অনন্যা বলে।

অনন্যা ওঠে, আমি তাকে একটি রিকশয় উঠিয়ে দিই। অনেকক্ষণ রিকশটির দিকে তাকিয়ে থাকি। একটু আগে আমার মনে হচ্ছিলো কোথায় যাবো আমি জানি না, কিন্তু এখন আমার তা মনে হয় না। আমার বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে। খুব দুঃখ পেলে আমি খুব সুস্থ হয়ে উঠি। ছেলেবেলা জেগে ওঠে আমার মধ্যে, যখন আমি চরম কষ্টে পড়ি তখনি এটা হয়, দুঃখ পেলে আমি কেমন করে যেনো নিজেকে গুটিয়ে আনি নিজের মধ্যে। এখন যদি আমি রাস্তায় বসে ভিক্ষে চাইতে শুরু করতাম, সেটা অস্বাভাবিক। হতো না, আমার ভেতরটা তেমনি করছে; যদি আমি ট্রাকটির নিচে ঝাঁপিয়ে পড়তাম, সেটা অস্বাভাবিক হতো না, আমার ভেতরটা তেমনি করছে; কিন্তু আমি বাসার দিকে হাঁটতে থাকি। একটি রিকশ নিই, কাজের মেয়েটি আমাকে দেখে অবাক হয়। মেয়েটির মুখ দেখে ওকে নিঃসঙ্গ লাগে, ও আমার থেকেও নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে। একটু হুইস্কি খাবো? না। একটা এক্সএক্সএক্স ছবি দেখবোর না। আমার সহকারিণীটিকে ফোন করবো? না। আমি আমার বইগুলো আবার খুঁজতে শুরু করি, অনেক দিন বই পড়ি নি, একটি পাগলা কবির কবিতার বই আমার হাতে পড়ে, এককালে ওর কবিতা ভালো। লাগতো, ওর পাগলামো আমি পছন্দ করতাম; আমি পড়তে শুরু করি, পাগলামো। আমার আবার ভালো লাগতে শুরু করে। আমি ওর কবিতা পড়তে থাকি, উঁচুকণ্ঠে ..পড়তে থাকি, আমার মুখস্থ হয়ে যেতে থাকে, বাইরে সন্ধ্যা হয়ে যেতে থাকে। বারবার ফোন বাজতে থাকে, আমি ধরি না, আমার কোনো বাইরের জগৎ নেই। কিন্তু ফোনের শব্দে আমার চারপাশ ভেঙে পড়তে থাকে; আমি ফোন ধরি।

মাহবুব সাহেব, মাহমুদা রহমান বলেন, আপনাকে পাবো ভাবি নি, কিন্তু একটি খবর দেয়ার জন্যে আপনাকে চারদিকে ফোন করছি।

কী খবর বলুন?

এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে হাফিজের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, মাহমুদা রহমান বলেন, হাফিজ মারা গেছে।

আমি খুব দুঃখিত, আমি বলি, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

কিন্তু আমার কোনো কষ্ট লাগছে না, মাহমুদা রহমান বলেন।

হাফিজুর রহমানের লাশ দেখতে কি যেতে হবে আমাকে? মাহমুদা রহমান আমাকে যেতে বলেন নি, আর হাফিজুর রহমান বলে কেউ ছিলেন, তাঁর সাথে আমার পরিচয়। ছিলো, আমার মনে পড়ে না; তার চেহারা কেমন ছিলো? আমার মনে পড়ে না। অর্চিকে মনে পড়ে আমার, অর্চির মুখটি মনে পড়ে না। অর্চি কি পৌঁছে ফোন করেছে? অর্চি কি পৌচেছে? অর্চির প্লেন কি এখনো উড়ছে, চিরকাল উড়তে থাকবে? অর্চির এখন ফিরে আসতে ইচ্ছে করছে? অর্চি কে? আমার মেয়ে? অর্চির অনেক ছবি আছে অ্যালবামে, এখনি আমি বের করে দেখতে পারি, দেখতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু দেখতে গেলে ছবিগুলো যদি কাঁদে, ছবিগুলোর চোখে যদি জল দেখা দেয়? অনন্যা কি বাসায় ফিরেছে, না কি। সে অনেক দূরে যাবে বলেছে, অনেক দূরে যাত্রা করেছে? কতো দূর যাবে? আমি কি অনন্যাকে একবার ফোন করবো? আমি ফোন করলে সে ভয় পাবে, মনে হবে আমার কিছু হয়েছে।

ফিরোজা ফোন করেছে, তার বেশি কথা নেই, একটি মাত্র তার কথা।

আমি তোমার থেকে পৃথক থাকতে চাই, ফিরোজা বলে।

ঠিক আছে, আমি বলি।

ফিরোজার কথা আমার মনেই পড়ে নি কয়েক দিন, তার ফোন পেয়ে মনে হলো সে আমার স্ত্রী ছিলো, এখনো আছে; তবে এখন দূরে থাকতে চায়, কিছু দিন পর হয়তো। বিচ্ছেদ চাইবে। একলা থাকতে আমার খারাপ লাগছে না, ব্রিজ ভেঙে পড়লে ব্রিজের খারাপ লাগে না, খারাপ লাগে অন্যদের, আমার খারাপ লাগছে না। আমার ব্যক্তিগত সহকারিণীটিকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে, বিষণ্ণতায় সে সুন্দর হয়ে উঠছে। কার জন্যে, কী জন্যে?

তোমাকে এতো বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেনো? আমি বলি।

সে চমকে ওঠে, আমার থেকে সে এমন প্রশ্ন আশা করে নি; কিন্তু আমার প্রশ্ন শুনে সে খুশি হয়ে উঠছে।

কই, না স্যার, এমনি, সে বলে।

বিষণ্ণ হওয়ার কথা আমার, আমি বলি।

কেনো স্যার? সে বলে।

আমার মেয়ে চলে গেছে, বউ পৃথক থাকতে চাচ্ছে, আমি বলি।

মেয়েটি আবার বিষণ্ণ হয়ে পড়ে।

আমাদের লিমিটেড এখন গোটা দশেক ব্রিজের কাজ করছে, তার মধ্যে একটি বড়ো ব্রিজ রয়েছে, কিন্তু এখন আমি ভাবছি সুড়ঙ্গপথের কথা। ব্রিজ দেখে দেখে আমার ক্লান্তি এসে গেছে। যে-শহরটিতে আমি থাকি, সেটি জঙ্গলে পরিণত হয়ে গেছে, ওর দম আটকে আসছে, ওর রাস্তাগুলো নিশ্বাস ফেলতে পারছে না। আমি সুড়ঙ্গপথের কথা। ভাবছি, একটি পরিকল্পনা এসেছে আমার মাথায়। শহরের কেন্দ্র থেকে উত্তর দক্ষিণ পুব পশ্চিমে সুড়ঙ্গ খোঁড়া যেতে পারে, তার পরিকল্পনা করছি আমি মনে মনে, কিছুটা। কাগজে কম্পিউটারে; আমার মনে হচ্ছে এটা করার এখন সবচেয়ে ভালো সময়। আমার। আমার শরীরকাঠামো ততোদিন টিকবে না, আমি একটিও সুড়ঙ্গপথ দেখে যাবো না, কিন্তু তার পরিকল্পনা করার এটাই ভালো সময়। আমাদের কয়েকজনের। সাথে আমি আলাপ করেছি, তারা হেসেছেন, একজন আমাকে স্বপ্নদ্রষ্টা উপাধি দিয়েছেন, কিন্তু আমার ভালো লাগছে। বাস্তবের থেকে স্বপ্নকেই বেশি ভালো লাগছে আমার।

অনেক দিন পর নুর মোহাম্মদ আর বেগম নুর মোহাম্মদকে দেখে ভালো লাগলো আমার আগের মতোই বারান্দায় তারা একজন দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন, চোখ আরেকটুকু ঘোলা হয়েছে মনে হয় নুর মোহাম্মদ সাহেবের; আরেকজন চায়ের। পেয়ালা নিয়ে পুব দিকে তাকিয়ে আছেন, চা খাচ্ছেন না। আমার কি বেশ ভালো। লাগলো? কী সুখ এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বসে থেকে? তাঁরা কী করে পারছেন? তাঁদের ক্লান্তি লাগছে না? ক্লান্তিকে তাঁরা এতো মহৎ করে তুলছেন কীভাবে? একদিন আমি। তাদের সাথে গিয়ে বসবো? আলাপ করবো? তারা কি আলাপ করবেন আমার সাথে? তার কি বুঝতে পারছেন তাঁরা ক্লান্ত? একটি বেজি দৌড়ে ওপাশের জঙ্গলে ঢুকলো, বেজিটাকে আমার ঈর্ষা করতে ইচ্ছে করছে; নুর মোহাম্মদদের ঈর্ষা করছি না। অনেক দিন ধরে আমি কাম বোধ করছি না, আমার একটু বোধ করতে ইচ্ছে করছে; আজ অফিসে গিয়ে দেখবো সহকারিণীটিকে দেখে আমার কামবোধ হয় কি না।

আপনার সাথে বেড়াতে যেতে চাই, অনন্যা ফোনে বলছে, আপনি কেনো রাজি হচ্ছেন না?

তাহলেই তো তুমি অনেক দূরে চলে যাবে, আমি বলি।

চলে যে যাবোই তা তো আমি নিশ্চিতভাবে জানি না, অনন্যা বলে, যেতেও পারি, তার আগে চলুন না গাছ দেখে আসি নদী দেখে আসি।

আমি নদী আর গাছ অনেক দেখেছি, আমি বলি।

একলা নদী দেখা একলা গাছ দেখার থেকে দুজনে গাছ আর নদী দেখা ভিন্ন, অনন্যা বলে।

আমার থেকে সবাই আজকাল দূরে চলে যেতে চায়, আমি বলি।

আজ আমার আব্বার মৃত্যুর দিন, অনন্যা বলে, তাই আজ বেড়াতে যেতে খুব ইচ্ছে করছে।

তোমার আব্বা নেই? আমি বলি, তুমি তো কখনো বলে নি।

অনন্যা কাঁদতে থাকে, আমি তার কান্না দেখতে পাই।

চলুন না একটু বেড়িয়ে আসি, অনন্যা বলে।

না, আমি বলি।

আমার সহকারিণীটিকে দেখে আমি কামবোধ করছি, সে এখন অনেক বেশি স্বাভাবিক হয়ে উঠছে আমার সামনে, মাঝেমাঝে দু-একটি কথা বলছে, ঝিলিকের মতো লাগছে আমার।

স্যার, আজকে কি আমাকে বিষণ্ণ লাগছে? সে বলছে।

না, খুব ঝলমলে দেখাচ্ছে, আমি বলি।

আমাকে তো আপনি পছন্দ করেন না, স্যার, সে বলে।

কে বললো তোমাকে? আমি বলি।

আমার মনে হয়, সে বলে, আমার একটি খবর আপনাকে দিতে ইচ্ছে করছে, স্যার।

বলো, আমি বলি।

আমার বিয়েটা কয়েক দিন আগে ভেঙে গেছে, সে বলে, এখন ভালো আছি, স্যার।

আমার সাথে তুমি আজ বেড়াতে যাবে? আমি বলি।

যাবো, সে বলে।

আমি ফোন করে পাঁচতারা হোটেলের দশতলায় একটি কক্ষ বুক করি, দেবীর সাথে গিয়েছিলাম যে-কক্ষটিতে।

আমি আজ তোমাকে ছুঁতে চাই, আমি বলি।

আমিও চাই, সে বলে।

আমরা দশতলার কক্ষটিতে প্রবেশ করি, মেয়েটি উড়ছে বলে মনে হচ্ছে; গাড়িতে প্রজাপতির মতো করছিলো, বারবার জানালার কাঁচে লেগে ফিরে ফিরে আসছিলো। ভেতরে, বদ্ধতা বোধ হয় তার সহ্য হচ্ছিলো না। আমি ঘরে ঢুকে তার দিকে তাকাই, আমাকে সে জাগিয়ে তুলছে মনে হচ্ছে। আমি এতো দিন খেয়াল করি নি সে একটি চমকার শরীর, হাঁটার সময় অনেকটা নাচার মতো ভঙ্গি করে। এক সময় হয়তো। নাচতো, এখনো নাচে? তাকে আমি কী করে জড়িয়ে ধরবো? আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না। আমি একটি সোফায় বসে পড়ি, সে মেঝেতে বসে।

তুমি মেঝেতে বসলে কেনো? আমি বলি।

আপনিও বসুন স্যার, সে বলে, আপনার ভালো লাগবে।

আমি মেঝেতে বসি, তার থেকে অনেকটা দূরে।

তুমি আবার আমাকে বিয়ে করতে পাগল হয়ে উঠবে না তো? আমি বলি।

না, সে বলে।

আমাকে সে আর স্যার বলছে না, আমি স্বস্তি পাচ্ছি।

তোমার কি মনে হবে না যে আমি তোমাকে শোষণ করেছি? আমি বলি।

না, আমি তো অনেক দিন ধরে মনে মনে চাচ্ছি, সে বলে।

শরীর অনেক দিন পর আমাকে মুগ্ধ করে, আমি একটি নতুন শরীর লাভ করতে থাকি; আমার খোলশ খসে পড়তে থাকে, নতুন হয়ে উঠতে থাকি আমি। এ-নতুনকেই আমি চেয়েছিলাম। তার শরীরের স্বভাব আমাকে বিস্মিত করে; তার ডান হাতের একটি আঙুল আমি খেলাচ্ছলে ছুঁই, তারপর দুটি-তিনটি আঙুল ছুঁই, দুবার আস্তে ঠোঁটে ঘষি, আর অমনি সে মাথাটি কাঁধের ওপর বাঁকা করে রেখে ঘুমিয়ে পড়ে; আমি তার মুখে আঙুলের টোকা দিয়ে চিবুক নেড়ে ঠোঁট টেনেও তার ঘুম ভাঙাতে পারি না। তাকে। ঘুরিয়ে আমি যেভাবেই রাখি ঘুমের মধ্যে সে সেভাবেই থাকে। সে এমন সম্মোহিত হলো কীভাবে? আমি তার একটি হাত ওপরের দিকে তুলে ধরি, হাতটি সেভাবেই থাকে; মুখটি আমি একটু ঘুরিয়ে দিই, সেভাবেই থাকে। এমন সম্মোহিত শরীর আমি কখনো দেখি নি। মেয়েরা নিষ্ক্রিয় আমি জানি, নারীবাদী দুটি নারীও আমি দেখেছি, তারাও স্বল্প সক্রিয়তার পর সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে; কিন্তু এ সম্পূর্ণ সমর্মাহিত। আমি এক এক করে তাকে বস্ত্র থেকে মুক্ত করে আনি, বিস্ময়কর সব দেহখণ্ড বেরিয়ে পড়তে থাকে। তার স্তন দুটি পর্যন্ত সম্মোহিত হয়ে আছে। আমি দুটিকে একে অন্যের সাথে মিলিয়ে দিই, তারা দুটি যমজ বোনের মতো মিলে থাকে; আমি দুটিকে দূরতম দূরত্বে সরিয়ে দিই, তারা দূরবর্তী দ্বীপের মতো ভাসতে থাকে। আমি যদি শিশু হতাম। বিস্ময়কর এ-বস্তু দুটি নিয়ে বছরের পর বছর খেলতাম। আমি তাকে জাগানোর চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত ও উদ্দীপ্ত হয়ে পড়ি, সে কিছুতেই জাগে না; আমার মনে হতে থাকে পরম পুলকের আগে সে জাগবে না। তার একটি দীর্ঘ অঙ্কুর রয়েছে, আমার কড়ে আঙুলের সমান, গোলাপি আভা আছে তাতে, আর সেটিও সম্মোহিত। তার শরীরের যে-অংশ আমি গলাতে চাই, সেটুকুই গলতে থাকে; দীর্ঘ দীর্ঘ দীর্ঘ সময় কেটে যেতে থাকে, তিন ঘণ্টার মতো হবে, সে তখন সম্পূর্ণ গলে যায়, এবং এক সময় সে চিৎকার করে ওঠে।

আমি কোথায়? সে চিৎকার করে ওঠে।

আমার সামনে, আমি বলি।

নিজেকে সে সম্পূর্ণ নগ্ন দেখে একটু লজ্জা পায়, কিন্তু নিজেকে ঢাকার কোনো চেষ্টা করে না; আমার দিকে তাকিয়ে হাসে।

আমি মরে গিয়েছিলাম, সে বলে।

তিন ঘণ্টার ছোটো মৃত্যু, আমি বলি।

তিন ঘণ্টা?, সে ঝলমল করে ওঠে, আর বলে, এমন মৃত্যুই আমি চেয়েছি, কিন্তু ওই লোকটি তা বোঝে নি, তাই ভেঙে গেলো।

অনন্যা দু দিন ধরে ফোন করছে না, আমি উদ্বিগ্ন বোধ করছি; প্রতিটি কোষে আমি সময় বোধ করছি। আমার শরীরের ভেতর সময়ের কাটা ঘুরছে না স্থির হয়ে আছে? সময় আশ্চর্য ভারী জিনিশ। সবচেয়ে ভারী কী, কৃষ্ণ গহ্বর? একটি কৃষ্ণ গহ্বর আমার ওপর এসে পড়েছে। অনন্যা কি তাহলে খুব দূরে চলে গেছে? কেননা সে খুব দূরে যেতে চায়? আমি কিছুই তার কাছে জানতে চাই নি, সে বলতো না হয়তো। তার জন্যে আমি রক্তে এমন টান বোধ করি কেনো? আমার সহকারিণীটি একবার বলেছে, স্যার, আপনাকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। আমি কিছু বলি নি। আমি একবার বেরিয়ে পড়ি, একটা রিকশ নিই, রিকশ নিলে এখন আর কেউ কিছু মনে করে না, আমার ভালো লাগে, অনন্যাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াই। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হই, আমার বয়স হয়েছে, একটি চায়ের দোকানে ঢুকে চা খাই, আবার পথে দাঁড়াই। আমার ভালো। লাগে। তারপর অফিসে ফিরি।

বিকেলে ফিরোজা ফোন করে, তুমি কেমন আছো?

আমি বলি, ভালো।

ফিরোজা বলে, আমি ফিরে আসতে চাই।

আমি বলি, এভাবেই তো ভালো আছি।

ফিরোজার কান্নার শব্দ শুনতে পাই, আমি টেলিফোন রেখে দিই।

ফিরোজ কেনো ফিরে আসতে চায়? নৃতাত্ত্বিকটির সাথে কি তার মিল হচ্ছে না, না কি নৃতাত্ত্বিকটি এখন তরুণীতর নৃতত্ত্ব চর্চায় মন দিয়েছে? ফিরোজার জন্যে একটু সহানুভূতি হয়, কিন্তু আমি কোনো অভাব যন্ত্রণা বোধ করি না। অনন্যার জন্যে আমার কষ্ট হচ্ছে, অর্চির জন্যে কষ্ট হচ্ছে,-অর্চির প্লেন কি নেমেছে, ফিরোজার জন্যে হচ্ছে না, যদিও আমি চাচ্ছি তার জন্যেও আমার রক্তে কিছুটা কষ্ট দেখা দিক। আমি কি তাকে ফিরিয়ে নিতে পারি না? কেনো পারি না? নৃতাত্ত্বিকটির সাথে সে ঘুমিয়েছে বলে? তাতে কী হয়েছে? অন্যের সাথে ঘুমোলে মানুষ নষ্ট হয়ে যায়? যারা অন্যের সাথে ঘুমোয় না, তারা কি খাঁটি থাকে? আমি কি নষ্ট হয়ে গেছি, অন্যের সাথে আমি অনেক ঘুমিয়েছি। বলে? সন্ধ্যার দিকে দেখি ফিরোজা ফিরে এসেছে; একা আসে নি, সাথে তার আম্মা আর বোনও এসেছে। তাহলে সে ধরেই নিয়েছে সে অধিকার হারিয়ে ফেলেছে, একা। এলে অধিকার ফিরে পাবে না; কেউ তাকে অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। আমি বাইরে যাবো বলে ভেবেছিলাম, তারা আসায় আমি যেতে পারি না। ফিরোজা কাঁদছে দেখে। আমার খারাপ লাগে, কিন্তু তাকে কষ্ট বলা যায় না। তার বোন হাল্কা ভঙ্গিতে কথা বলছে যেনো কিছুই হয় নি।

ফিরোজাকে নিয়ে এলাম, তার বোন বলেন, ও খুব কষ্টে আছে।

আমি বলি, সে তত পৃথক থাকতে চায়।

তার বোন বলেন, ওটা ওর বিভ্রম, তুমি কিছু মনে কোরো না।

আমি বলি, আমাদের আর একসাথে থাকা সম্ভব নয়।

তার আম্মা বলেন, তোমার হাতে ধরছি, বাবা।

ফিরোজা বলে, তুমি কি আমাকে ঘেন্না করো।

আমি বলি, না।

ফিরোজা বলে, আমি তোমার কাছে ফিরে আসতে চাই।

আমি বলি, না।

আমরা চারজন বসে আছি, কথা বলছি না; ফিরোজার বোন কথা বলছিলেন, এখন তিনিও কথা বলছেন না; তবে তারা আরো দেখবেন, হয়তো সারারাত দেখবেন, তারপরও দেখার জন্যে আরো দিনরাত পড়ে থাকবে। আমি না-টিকে ফিরিয়ে নিতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না; ফিরোজার সাথে আমার বাঁশের সাঁকো ভেঙে গেছে, ওটি আবার আমি তৈরি করতে চাই না। আমি আর কোনো সাঁকোই তৈরি করতে চাই না, প্রথাগত সাঁকো তো নয়ই। স্বামী-স্ত্রী শব্দগুলো ঘিনঘিনে মনে হচ্ছে আমার কাছে, নিজেকে আমি আর স্বামী ভাবতে পারছি না কারো, কাউকে আমার স্ত্রী ভাবতে পারছি না। কাবিনের নোংরা কাগজে অনেক আগে আমি একবার সই করেছিলাম, তার কবল থেকে আমি বেরিয়ে পড়তে চাই। এমন সময়, সন্ধ্যে সাড়ে আটটা হবে, ফোন বেজে ওঠে।

এটা মাহবুব সাহেবের বাসা, মাহবুব সাহেবের বাসা? অন্য প্রান্ত থেকে এক মহিলা। আর্ত চিৎকার করছেন, কোথাও হয়তো আকাশ ভেঙে পড়েছে।

বলছি, আমি বলি, আমি মাহবুব বলছি।

আমি ডাক্তার তাহমিনা, তিনি আরো আর্ত চিৎকার করেন, আমি এলিফ্যান্ট রোডের মুক্তি ক্লিনিক থেকে বলছি।

বলুন, আমি বলি।

আপনি অনন্যা নামের কাউকে চেনেন? তিনি বলেন, আমি খুব বিপদে আছি।

কেনো? আমি বলি।

সে বিকেলে আমার ক্লিনিকে এমআর করানোর জন্যে এসেছিলো, তিনি বলেন, তার দেরি হয়ে গিয়েছিলো, তার আর জ্ঞান ফিরে আসে নি।

আমার টেলিফোন নম্বর কোথায় পেলেন? আমি বলি।

তার ব্যাগে একটি ফিজিক্সের বইয়ের ভেতর নাম আর নম্বর পেয়েছি, মহিলা কেঁদে ফেলেন, আমি তিন হাজার এম আর করেছি, আগে এমন আর হয় নি।

এ-নামের কাউকে আমি চিনি না, আমি বলি, এ-নামের কাউকে আমি চিনি না।

আমি টেলিফোন রেখে দিই। অনন্যা নামের কাউকে আমি চিনি না।

আমি স্তব্ধ হয়ে চেয়ারে বসি, অনন্যা নামের কাউকে আমি চিনি না। আমার ঘেন্না লাগতে থাকে, ওরা তিনজনই আমার সাথে কথা বলতে চায়, কী যেনো বলে, আমি শুনতে পাই না। আমার ঘেন্না লাগতে থাকে। আমি কোনো কথা বলি না, ওরা তিনজন আমাকে কী বলছে আমি শুনতে পাই না। ওরা আর কথা বলছে না মনে হয়, হয়তো ভয় পেয়ে গেছে। আমি অনন্যা নামের কাউকে চিনি না। দশটা বাজলো মনে হয়, ঘড়িটা থামছে না, সারা পৃথিবীতে ঘড়িটা দশটা বাজার সংবাদ পৌঁছে দেবে মনে হচ্ছে। আমি একটি পায়ের পাতা দেখতে পাই, পায়ের পাতার নিচে ঘাস সোনালি হয়ে উঠছে। আমার বুক খুব ভারী হয়ে উঠছে। আমি অনন্যা নামের কাউকে চিনি না। এগারোটা বাজলো, ওরা তিনজন আমার সামনে বসে আছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ কী যেনো বলতে চাচ্ছে, আমি শুনতে পাচ্ছি না। বারোটা বাজলো, ঘড়িটা সারা সৌরজগতে বারোটা বাজার শব্দ পৌঁছে দেয়ার পণ করেছে। একটা বাজে; কার জন্যে বাজে?–আমি আর বসে থাকতে পারছি না, আমি উঠে দাঁড়াই, দরোজা খুলে বাইরে বেরোই। আমি রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকি, এলিফ্যান্ট রোড আমি চিনি, এলিফ্যান্ট রোডের দিকে হাঁটতে থাকি। এখন কটা বাজে আমি জানি না। আমি চৌরাস্তায় এসে দাঁড়াই। মহিলা কোন ক্লিনিকের নাম যেনো বলেছিলো? মডার্ন, নবজীবন, আরোগ্য, আবেহায়াত? আমি কোনো নাম মনে করতে পারছি না। কতো নম্বর এলিফ্যান্ট রোডঃ ১০, না ১০০, না ১০০০? আমি মনে করতে পারছি না। আমি প্রতিটি দালানের দরোজায় দরোজায় যেতে থাকি, প্রত্যেকটি দরোজা বন্ধ; আমি নাম পড়তে চাই, কোনো নাম পড়তে পারি না। আমি দরোজা থেকে দরোজায় দৌড়ে যেতে থাকি, চিৎকার করতে থাকি নাম ধরে, কোনো দরোজা খোলে না। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না, চারদিকে প্রচণ্ড অন্ধকার নামছে। আমার সামনে একটি দালান ভেঙে পড়ছে আমি দেখতে পাচ্ছি, আমি দৌড়ে অন্য দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি, একটির পর একটি দালান ভেঙে পড়ছে; ওপাশের দালানগুলো ভেঙে পড়ছে, এপাশের দালানগুলো ভেঙে পড়ছে, সামনের দালানগুলো ভেঙে পড়ছে, পেছনের দালানগুলো ভেঙে পড়ছে, মহাজগত জুড়ে ভেঙে পড়ার শব্দ। হচ্ছে; আমি ভাঙা দালানের ভেতর দিয়ে ছুটছি, দালানের পর দালান ভেঙে পড়ছে, শহর ভেঙে পড়ছে, আমি অন্ধকারে ভেঙে পড়া দালানের পর দালানের ভেতর দিয়ে ছুটছি, কী যেনো খুঁজছি, আমার চারদিকে দালান ভেঙে পড়ছে, শহর ভেঙে পড়ছে, সব কিছু ভেঙে পড়ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *