অধ্যায় ৮২ – রোমান সাম্রাজ্যের কিনারায়
৭০ থেকে ১৩২ খ্রিস্টাব্দের মাঝে নানা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে রোম। কিন্তু এ সময়টিতে কয়েকজন সুশাসকের আগমন ঘটে।
৭০ সাল নাগাদ জেরুজালেমের বিদ্রোহের আগুন নেভাতে সক্ষম হলেন ভেসপাসিয়ান। সেপ্টেম্বরে রোমের উদ্দেশে রওনা হলেন। প্রায় নয় মাস তিনি রোমে অনুপস্থিত থেকেও প্রিনসেপস-এর ক্ষমতা উপভোগ করেছেন।
ভেসপাসিয়ান নিজেও একজন অভিজ্ঞ যোদ্ধা ছিলেন। তিনি দেশশাসনে সেনাবাহিনীর গুরুত্বকে ছোট করে দেখেননি। শুরুতেই সব কমান্ডার পালটে দিলেন তিনি, যাতে পুরনো আনুগত্যের ধারা ভেঙে পড়ে।
১০ বছর মোটামুটি নির্বিঘ্নে শাসন করেন তিনি। ৭৩ সালে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। মাসাদায় নিজেদের দুর্গে অন্তরিন ইহুদি বিপ্লবীরা সপরিবারে আত্মহত্যা করেন। তারা তাদের সন্তানদের হত্যা করে নিজেদের প্রাণত্যাগ করেন। এভাবেই ইহুদিদের শেষ শক্তিশালী অবস্থানের পতন ঘটে। জুদিয়া ও প্রাচীন ইসরায়েলের প্যালেসটাইন সিরিয়া প্রদেশের অংশে পরিণত হয়।
ভেসপাসিয়ান কর কমিয়ে ও অহেতুক কাউকে বিচারের সম্মুখীন না করে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। রোমে শান্তি বিরাজ করছিল বলা যায়।
৭৯ খ্রিস্টাব্দে ৭০ বছর বয়সি ভেসপাসিয়ান সর্দি-জ্বরে ভুগে মারা যান। কিছুটা উদ্বেগের সঙ্গে সিনেট তার সন্তান টাইটাসকে তার পদে নিয়োগ দিল। যোদ্ধা হিসেবে নির্দয় হলেও বাবার পদ পেয়ে বাবারই দেখানো শান্তিপূর্ণ শাসন প্রক্রিয়া অটুট রাখেন টাইটাস।
তবে বেশিদিনের জন্য রোমে শান্তি বিরাজ করতে পারে না। পরপর তিনটি বিপর্যয় টাইটাসকে ব্যতিবস্ত করে তোলে।
তার শাসনামলের মাত্র দুই মাস যেতে-না-যেতেই ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত হয়। ইতালির উপকূলের কাছে অবস্থিত এই পর্বত নেপলস সাগর থেকে বেশিদূরে ছিল না। এই পর্বতের নিচে ছিল পম্পেই শহরের অবস্থান। সেখানে মানুষ ভূমিকম্পের সঙ্গে পরিচিত ছিল, কিন্তু অগ্ন্যুৎপাতের বিষয়ে কোনো সতর্কবাণী পাননি তারা।
ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাত ও পম্পেই নগরীর মর্মান্তিক পরিণতি নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে। অসংখ্য মানুষ প্রায় ২৫ ফুট উঁচু ছাইয়ের নিচে জ্যান্ত চাপা পড়েন। অন্যেরা উষ্ণতায় দম বন্ধ হয়ে ও গ্যাসে জ্ঞান হারিয়ে মারা যান। প্রায় দুই হাজার মানুষ এক রাতের মাঝেই মারা পড়েন।
তাৎক্ষণিকভাবে টাইটাস রোম থেকে ত্রাণ পাঠালেন। পরিস্থিতি কিছুটা নিরাপদ হওয়ামাত্র তিনি পম্পেই সফরে গেলেন। দ্বিতীয়বার যখন তিনি পম্পেই সফরে গেলেন, তখন রোমে ছোট একটি আগুনের ঘটনা থেকে শহরের বড় একটি অংশ ভস্মীভূত হল। এই আগুনের রেশ না-মিটতেই শহরের অসংখ্য শরণার্থীর মাঝে দেখা দিল মহামারি। গণহারে মারা পড়তে লাগলেন তারা।
৮১ সালে বিপর্যয় মোকাবিলা করতে করতে ক্লান্ত টাইটাস নিজেও জ্বরে আক্রান্ত হলেন। ৪২ বছর বয়সে মারা গেলেন তিনি। তিনি ৩টি ভয়াবহ বছরে প্রিনসেপস ছিলেন।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে টাইটাসের ভাই ডমিশিয়ানকে ইমপেরাটর হিসেবে নিয়োগ দিল প্রিটোরিয়ান গার্ড। সিনেটও অবধারিতভাবে তাকে প্রিনসেপস পদ দিল।
ডমিশিয়ান দয়া-দাক্ষিণ্য দেখানোর বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন না। ক্ষমতায় আরোহণের অল্প সময় পর তিনি ‘ডমিনাস এত ডিউস’ খেতাব নেন, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘প্রভু ও ঈশ্বর’। তিনি এরপর থেকে সব আনুষ্ঠানিক চিঠিতে ‘লর্ড অ্যান্ড গড’ লেখার নির্দেশ দেন এবং এভাবেই রোমের এই রীতি চালু হয়।
তিনি ক্যালিগুলার মতো উন্মাদ ছিলেন না। তিনি নিজেকে ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা করে কোনো আইন ভঙ্গ করেননি। সিনেটও এতে আপত্তি জানায়নি, প্রিটোরিয়ান গার্ডরাও তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন না।
তবে ডমিশিয়ানের এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রভিত্তিক সরকারের যতটুকু মুখোশ ছিল, সেটাও উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। সবচেয়ে খারাপ যে প্রিনসেপ ছিলেন, তিনিও সিনেটের অনুমোদন নিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে দাবি করেনি। ডমিশিয়ানই রোমের প্রথম শাসক নন, যিনি রাজার মতো ক্ষমতা ধারণ করতেন। কিন্তু তিনিই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তা মুখে উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে সম্রাটে পরিণত হন।
তবে এ-ধরনের সীমাহীন ক্ষমতা কখনো মঙ্গলজনক হয় না। ধীরে ধীরে অন্যদের মতো ডমিশিয়ানও স্বৈরশাসকে পরিণত হলেন।
তবে ডমিশিয়ান তার সেনা-কর্মকর্তাদের বেতন বাড়িয়ে তাদের আনুগত্য ধরে রেখেছিলেন। তবে ৯৬ খ্রিস্টাব্দে তার স্ত্রী, এক সহযোগী, এক ভাইপো ও প্রিটোরিয়ান গার্ডরা সম্মিলিতভাবে ডমিশিয়ানকে তার শয়নকক্ষে হত্যা করেন।
সিনেট তাৎক্ষণিকভাবে ৬১ বছর বয়সি কনসাল নার্ভাকে নতুন সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দিল
এতে রোমের জনগণ খুশি হলেও প্রিটোরিয়ান গার্ডরা খুশি হতে পারেননি। তারা নার্ভাকে তার নিজের প্রাসাদে আটক করলেন এবং ডমিশিয়ানের যে সহযোগী তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তার লিঙ্গ কেটে মুখে ভরে দিলেন এবং তার গলা কেটে ফেললেন। নার্ভা জানালেন, তার উত্তরসূরি হবেন সেনাবাহিনীর জনপ্রিয় সদস্য ট্রাজান। তিনি তখন রাইন নদীর তীরে মোতায়েন ছিলেন।
কয়েকমাস পরে নার্ভা জ্বরে ভুগে মারা যান।
নার্ভার মৃত্যুর ১৮ মাস পর রোমে এলেন ট্রাজান।
এ সময়টা রোমে শান্তি বিরাজ করেছে। ট্রাজান ছিলেন জনপ্রিয় শাসক। তিনি সড়ক, বন্দর মেরামত করেন, গ্রন্থাগার নির্মাণ করেন, খাল খনন করেন, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন করেন এবং ‘রক্তপাত না করার’ অঙ্গীকার করেন, যা মানুষকে সুখী করেছিল।
১০৬ সালে তিনি সিনাই ও দাবিউবের উত্তরের ভূখণ্ডগুলো রোম সাম্রাজ্যে যুক্ত করেন। তিনি নিজেই এসব সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনেন।
দানিয়বে তার বিজয়গাথার কাহিনিগুলো কমিক বইয়ের মতো করে রোমের একটি কলামে খোদাই করা হয়েছিল। ‘ট্রাজান’স কলাম’ নামের এই স্তম্ভটি আজও রোমে গেলে খুঁজে পাওয়া যায়।
ট্রাজানের আমলে সিনেট ও সম্রাটের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া দেখা যায়, যা এর আগে কয়েক দশকে বিরল ছিল।
ট্রাজানের শাসনামলের শেষ কয়েক বছরে রোম সাম্রাজ্যে এক নজিরবিহীন সমস্যা দেখা দেয়—খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। কনসাল প্লিনি এশিয়া মাইনরের প্রাদেশিক গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি এ বিষয়টি নিয়ে এতটাই বিচলিত হয়ে পড়েন যে তিনি ট্রাজানকে চিঠি দিয়ে জানতে চান করণীয়।
এই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা এমন এক রাজত্বের কথা বলত, যেখানে কোনো ইহজাগতিক শাসক নেই। তাদের এই মনোভাব ইহুদিদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল, যারা সম্রাটের উপাসনা করতে অস্বীকার করেছিল।
খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা প্রকৃতপক্ষে এমন এক রাজত্বের কথা ভাবতেন, যেখানে খোদাই হবেন শাসক। তাদের এই চিন্তা ইহুদিদের থেকে ভিন্ন ছিল।
আব্রাহামের আমল থেকে ইহুদিদের ঈশ্বরের উপাসনার সঙ্গে একটি সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ড জড়িয়ে ছিল। ঈশ্বর তাদেরকে ইসরায়েল নামের সেই ‘ভূখণ্ডের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যার অর্থ, তাদের ধর্মবিশ্বাসের একটি রাজনৈতিক দিগন্ত ছিল। ইহুদিরা রোমান সম্রাটদের উপাসনা করতে রাজি হননি, কারণ তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন রোমের ইসরায়েল শাসনের কোনো অধিকার নেই, বিশেষত জেরুজালেমের। জেরুজালেমের মালিক ঈশ্বর।
অপরদিকে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের কখনোই আলাদা করে নিজস্ব কোনো ভূখণ্ড বা দেশ ছিল না। তারা যে রাজত্বের কথা বলতেন, তা আধ্যাত্মিক, অন্য জগতের অংশ।
রোমের সম্রাট ও গভর্নরা এই ধাঁধার সমাধান করতে পারেনি।
ট্রাজান খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের না-ঘাঁটানোর নীতিতে থাকতে চাইলেন। তিনি প্লাইনিকে বললেন, প্রকাশ্যে খ্রিস্টধর্মের চর্চাকে নিরুৎসাহিত করতে, কিন্তু ধরে ধরে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের হত্যার মতো কিছু যেন না করা হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা শান্তিপূর্ণ আচরণ করছেন, তাদের সঙ্গেই একই ধরনের আচরণ করা হোক।
১১৩ সালে ট্রাজান আবারও আর্মেনিয়া দখল করে নেন।
এরপর তিনি নিজেই সেনাবাহিনী নিয়ে মেসোপটেমিয়ায় প্রবেশ করলেন, ব্যাবিলন অধিগ্রহণ করলেন এবং পার্থিয়ার রাজধানী সেসিফন দখল করলেন।
১১৭ সাল পর্যন্ত মেসোপটেমিয়ায় থেকে গেলেন ট্রাজান। তিনি পার্থিয়ানদের গেরিলা হামলা ঠেকাতে ব্যস্ত থাকলেন। এর মাঝে ১১৫ সালে পার্থিয়ার এই গোলযোগের সুযোগে ইহুদিরা আবারও সংগঠিত হতে লাগল। তারা তাদের প্রতিশ্রুত ভূখণ্ড ফিরে পেতে চাইলেন। তবে ট্রাজানের এক নির্দেশে এই বিদ্রোহ চাপা পড়ে যায়—তিনি গোলযোগপূর্ণ অঞ্চলে ইহুদি নন এমন সবাইকে নির্বিচারে ইহুদিদের হত্যা করার অনুমতি দিলেন। ফলে সাময়িকভাবে হলেও এই বিদ্রোহের দমন হল।
ট্রাজান পার্থিয়া ছেড়ে দেশে ফিরতে লাগলেন। কিন্তু এশিয়া মাইনরের সিসিলিয়ায় এসে তিনি স্ট্রোক করে মারা গেলেন। দিনটি ছিল ৯ আগস্ট, ১১৭। তার বয়স হয়েছিল ৬৪।
ট্রাজানের কোনো সুস্পষ্ট উত্তরাধিকারী ছিল না। তার শিষ্য হাড্রিয়ান ছিলেন সিরিয়ার গভর্নর। তিনি দাবি করলেন, ট্রাজান তাকে সম্রাট বানাতে চেয়েছিলেন। রোমে এসে প্রিটোরিয়ান গার্ডদের মোটা অঙ্কের ঘুস দিয়ে নিজের ক্ষমতা সুসংহত করলেন হাড্রিয়ান।
২১ বছর রোম শাসন করেন হাড্রিয়ান। তিনি জেরুজালেমের ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন রাজধানী নির্মাণের চেষ্টা করেন।
এই উদ্যোগে আবারও ইহুদি বিদ্রোহ বেগ পেল। এবার সায়মন বার কোচবা নামে এক ব্যক্তি বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিলেন।
হাড্রিয়ান তার সবচেয়ে অভিজ্ঞ সেনাপতিদের পাঠালেন এই বিদ্ৰোহ দমন করতে। তারা সমগ্র দেশজুড়ে ইহুদিদের গেরিলা ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাল। এতে ‘প্ৰতিশ্ৰুত ভূখণ্ড’ লণ্ডভণ্ড হল। ইতিহাসবিদ ইউসেবিয়াস বলেন, ‘তাদের ৫০টি গুরুত্বপূর্ণ টহল চৌকি ও ৯৮৫টি বিখ্যাত গ্রাম মাটির সঙ্গে মিশে যায়।
সম্মুখযুদ্ধে মারা যান পাঁচ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। মহামারি, খরা, আগুন ও দুর্ভিক্ষে আরও অগণিত মানুষ মারা যান।
এটা হাড্রিয়ানের সবচেয়ে বড় বিজয় হলেও তিনি এই লড়াই লড়েন আত্মরক্ষার্থে। তিনি পার্থিয়ানদের বিরক্ত করেননি বা অন্য কোথাও রোম সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টাও করেননি। তার এই আত্মরক্ষামূলক মনোভাবের প্রকাশ পায় এক সিদ্ধান্তে। তিনি ঠিক করলেন, ব্রিটেনে স্কটল্যান্ডের চারপাশে প্রাচীর নির্মাণ করবেন।
হাড্রিয়ানের প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১২২ সালে। ১০ বছরে এটার নির্মাণকাজ প্রায় শেষ হয়।
এই প্রাচীর ছিল ‘রোমান’ পরিচয়ের এক প্রতীকী প্রকাশ। প্রাচীরের ওপারের সবাই ‘বিদেশি’, আর ভেতরের সবাই ‘রোমান’। এর মাঝে আর কিছু নেই। বিদেশি প্রদেশের চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে এসেছিল রোম।