অধ্যায় ৮১ – উত্তরাধিকারের সমস্যা
১৪ থেকে ৬৯ সালের মাঝে রোম সাম্রাজ্যে উন্মাদনা বাড়তে লাগল। শহরগুলোতে আগুন লাগল এবং খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন নেমে এল।
অগাস্টাসের মৃত্যুর পর ৫৪ বছর বয়স তাইবেরিয়াসের হাতে এল সর্বময় ক্ষমতা।
তার পূর্বসূরির মতো সিনেটের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারেননি তাইবেরিয়াস। এমনকি, তার নিজের ‘অগাস্টাস’ বা ইমপেরাটর খেতাবের দায়িত্বগুলোও সুচারুভাবে পালন করেননি তিনি।
অগাস্টাসের মৃত্যুর আগেই তিনি তার উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করেছিলেন—তার ভাইপো জার্মানিকাস। রাইনের সেনাদলের (রোমানরা এই প্রদেশের নাম দিয়েছিল জার্মানি এবং সেখানে বসবাসকারী কেল্ট গোত্রদের জার্মান বলে অভিহিত করা হত)।
এবার তিনি জার্মানিকাসকে রোমে ফিরিয়ে এনে কনসাল বানালেন। এরপর তাকে সিরিয়া প্রদেশের গভর্নর করে পাঠালেন I
কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর অল্প সময় পর মারা যান জার্মানিকাস। রেখে যান তার স্ত্রী ও শিশুসন্তান ক্যালিগুলাকে। তাইবেরিয়াস তার নিজের সন্তান দ্রাসাসের বদলে ভাইপোকে বেছে নিয়েছিলেন।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দ্রাসাস কনসাল ও সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হলেন। কিন্তু ২৩ সালে তিনিও মারা যান। তিন বছর পর রোম ছেড়ে গেলেন হতাশ তাইবেরিয়াস। প্রথমে কামপানিয়া, তারপর ক্যাপ্রিতে গেলেন তিনি। সেখানে বসেই রোমের প্রশাসনিক কাজ চালাতে লাগলেন তিনি।
সিনেট এরকম সম্রাট চায়নি। তারা চাইতেন রোমে একজন বলিষ্ঠ শাসক থাকবে, যার ভয়ে সম্ভাব্য গোলযোগ সৃষ্টিকারীরা ভয়ে থাকবে। কিন্তু তাইবেরিয়াস এসবে মনোযোগী ছিলেন না। রোমের শাসক হিসেবে অগাথ সম্পদের মালিক হয়ে তিনি মেতে রইলেন ভোগ-বিলাস ও বিকৃত যৌনাচারে।
সিনেট দেশশাসনের কাজ চালিয়ে গেলেও গৃহযুদ্ধের দামামা বেজে উঠছিল।
প্রিনসেপ, বা রোমের শাসকের ব্যক্তিগত রক্ষিবাহিনী বা প্রিটোরিয়ান গার্ডের কমান্ডার লুসিয়াস এলিয়াস সেজানাস ক্ষমতা দখলের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাইবেরিয়াসের মৃত্যুর পরপরই তিনি এই কাজ করবেন বলে মনস্থ করেন।
৩১ সালে তাইবেরিয়াস দুইটি উদ্বেগজনক তথ্য জানলেন। সেজানাসের সঙ্গে তার মৃত সন্তান দ্রুসাসের স্ত্রীর অবৈধ সম্পর্ক ছিল এবং তারা দুইজন মিলেই দ্রুসাসকে বিষপ্রয়োগের ষড়যন্ত্র করেছিল। তাইবেরিয়াস সেজানাসকে গ্রেপ্তার ও বিচারের আদেশ দিলেন। সেজানাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হল। এরপর একইভাবে অসংখ্য মানুষকে নানা দোষে শাস্তি দিতে লাগলেন তাইবেরিয়াস।
তাইবেরিয়াস যখন রোমানদের বিরুদ্ধে নির্দয় আচরণ চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন গ্যালিলি শহরে এক ভ্রাম্যমাণ ধর্মপ্রচারকের আবির্ভাব হল, যিনি নিজেকে জিসাস (যিশু) নামে অভিহিত করতেন। তার বক্তব্যে জেরুজালেমের একটি বড় ও শক্তিশালী উপাসক দল বেশ বিরক্ত হল। শীর্ষ উপাসক ও এথনার্চের পদ প্রত্যাহারের পর তাদের কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না। এ কারণে ধর্মীয় বিষয়ে কোনো ধরনের সমস্যা তারা মেনে নিতে চাইতেন না।
যিশুর মুখ বন্ধ করার জন্য তাদের রোমের সাহায্যের দরকার ছিল। রোমের প্রতিনিধি রাজা হেরোদ অ্যান্টিপাসের সামনে তাকে কোনো ধরনের রাজনৈতিক অপরাধে অপরাধী দেখানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন ইহুদি উপাসকরা। তারা যিশুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন, তিনি নিজেকে ‘ইহুদিদের রাজা’ বলে অভিহিত করেছেন।
কিন্তু রোমে তাইবেরিয়াসের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত হেরোদ কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। এমন কোনো উদ্যোগ তিনি নিলেন না, যা দেখে মনে হতে পারে তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করছেন। তিনি যিশুকে সরাসরি রোমান প্রোকিউরেটরের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
এই প্রোকিউরেটরের নাম ছিল পন্টিয়াস পিলেট। তিনি নিজেও তাইবেরিয়াসের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন।
তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন প্যালেস্টাইনে কোনো ধরনের বিপ্লব ঘটলে তা ভালো কিছু হবে না, এটুকু বুঝেছিলেন।
তিনি যিশুকে মৃত্যুদণ্ড দিতে রাজি হলেন। যখন পিলেট যিশুকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি নিজেকে ইহুদিদের রাজা হিসেবে দাবি করছেন কি না, তখন জিসাস কোনো হ্যাঁ-না উত্তর দিলেন না। ফলে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করার শাস্তি দেওয়া হল। এটা ছিল বিপ্লবীদের জন্য রোমানদের প্রচলিত শাস্তির বিধান।
স্পার্টাকাসের অনুসারীরাও এই শাস্তি পেয়েছিলেন।
৩৬ সালে আবারও একদল বিপ্লবী ধার্মিকদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন পিলেট। কিন্তু এ ঘটনায় প্যালেস্টানে রোম-বিরোধী মতাদর্শ জনপ্রিয়তা পায়। পিলাটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সিরিয়ার গভর্নর তাকে চাকরিচ্যুত করে রোমে ফেরত পাঠালেন।
৩৭ সালে তাইবেরিয়াসের মৃত্যু হয়। তাকে কেউ ঘুমের মধ্যে গলাটিপে হত্যা করেছিল।
এই খবরে রোমবাসী আনন্দে সড়কে নেমে আসে। ‘তাইবেরিয়াসকে তিবারে ফেলে দাও’ বলে রব ওঠে চারপাশে।
ততদিন যোগ্যতার ভিত্তিতে শাসক নিয়োগের ধারা থেকে পুরোপুরি পরিবারভিত্তিক উত্তরাধিকারে ফিরে গেছে রোম। তাইবেরিয়াসের পর শাসক হলেন মৃত জার্মানিকাসের সন্তান তরুণ ক্যালিগুলা। শাসক হওয়ার আগে তার পূর্বসূরিদের মতো তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সরকারি পদে ছিলেন না ক্যালিগুলা।
শাসক হিসেবে বেশ কুখ্যাতি অর্জন করেন ক্যালিগুলা। তবে তার শাসনামল নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে দ্বিমত রয়েছে। কেউ তাকে উন্মাদ রাজা বলেন, কেউ তাকে পুরনো প্রথার অনুসারী বলেন।
অপরদিকে, রোমের পূর্বসীমান্তে তৃতীয় আরতাবানাসের নেতৃত্বে পার্থিয়া বেশ উন্নতি করছিল।
সাবেক সেলেউসিদ সাম্রাজ্যের ভূমি আর্মেনিয়া ছিল পার্থিয়া ও রোমের মাঝে ‘নিরপেক্ষ’ অঞ্চল। অগাস্টাসের আমল থেকে আর্মেনিয়া ‘রোম দ্বারা সুরক্ষিত’ ভূখণ্ড হিসেবে পরিচিত ছিল। এই অঞ্চলকে রোমের প্রভাবমুক্ত করে তার সন্তান আরসাচেসকে আর্মেনিয়ার ক্ষমতায় বসাতে চাইলেন আরতাবানাস।
৩০ সালের আশেপাশে আর্মেনিয়ায় ব্যর্থ হামলা চালালেন তিনি। এই যুদ্ধে স্কাইথীয় ভাড়াটে সেনাদের নিয়ে এগিয়ে গেলেন আরসাচেস, এবং পৈতৃক প্রাণটি হারালেন। কিন্তু আরতাবানাস হাল ছাড়েননি।
রোমের কমান্ডার তাদের সীমান্তের এত কাছে যুদ্ধবিগ্রহ চাননি। তাই শান্তি- আলোচনার আহ্বান জানালেন তিনি।
আদতে তৃতীয় আরতাবানাসও চাইছিলেন না রোমের সঙ্গে বিবাদে জড়াতে। কারণ পার্থিয়ার পূর্বসীমান্তে নতুন এক শত্রুর আবির্ভাব ঘটেছে—কুশান রাজত্ব। রোমের সঙ্গে তড়িঘড়ি করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি।
ইয়েঝি যাযাবরদের থেকে কুশানদের আগমন।
খ্রিস্টাব্দ ৩০ সাল নাগাদ কুশান রাজত্বের রাজা হলেন কুজুলা কাদফিসেস নামে এক উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি। তার বিষয়ে খুব বেশিকিছু জানা যায় না। কিন্তু তিনি ৫০ বছর রাজত্ব করেন। এবং এ সময়, তিনি পার্থিয়ার ওপর বেশ চাপ সৃষ্টি করেন।
কুজুলা কাদফিসেসের অধীনে কুশানদের প্রবৃদ্ধি হতে লাগল। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধিতে হঠাৎ করেই এল বাধা। গন্ডোফারনেস নামে এক যোদ্ধা পাঞ্জাব দখল করে কাবুল পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তার করলেন।
তার বিষয়ে আমরা মূলত জানতে পারি প্রায় এক শতাব্দী পরে লেখা বই ‘দ্য অ্যাক্টস অব টমাস’ থেকে। এখানে টমাস দিদিমাস নামে যিশুর এক শিষ্যের যাত্রার কথা জানা যায়।
জেরুজালেমে টমাস গন্ডোফারনেসের সঙ্গে দেখা করেন। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর যিশু আবারও মৃতের দেশ থেকে ফিরে এসেছিলেন তার অনুসারীদের মাঝে এবং তাদেরকে নির্দেশ দেন সারাবিশ্বে তার ধর্মশিক্ষা ছড়িয়ে দিতে। টমাসের ভাগে পড়ে ভারতে যেয়ে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের দায়িত্ব। তিনি এই দায়িত্ব খুব একটা খুশি হতে পারছিলেন না। তবে তিনি স্বপ্নে দেখলেন যিশু তাকে বলছেন, ‘ভয় পেয়ো না টমাস। ভারতে যাও এবং (ধর্ম) প্রচার করো। আমার আশীর্বাদ আছে তোমার সঙ্গে।’ কিছুদিনের মাঝেই এক ভারতীয় বণিকের সঙ্গে দেখা হয় তার। আব্বানেস নামের এই বণিককে পাঠিয়েছিলেন রাজা গন্ডোফারনেস।
টমাসের সঙ্গে গন্ডোফারনেসের দেখা হল। পরিশেষে গন্ডোফারনেস নিজেও খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং নিজেকে ব্যাপ্টাইজ করেন।
গন্ডোফারনেস আদতে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন কি না, সেটা নিয়ে বিতর্ক ছিল। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত যে ‘সে আমল থেকে বিশ্বের নানা প্রান্তে খ্রিস্টধর্ম জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল।
৪০ খ্রিস্টাব্দে ক্যালিগুলা নিজেকে দেবতার আসনে বসালেন। তিনি রোমজুড়ে নিজের মূর্তি নির্মাণ করালেন। জোসেফাস বলেন, ‘তিনি সবাইকে নির্দেশ দিলেন তার উপাসনা করতে এবং তাকে দেবতা হিসেবে বিবেচনা করতে।’ ক্যালিগুলার এই নির্দেশ সমগ্র রোম ভূখণ্ডের জন্য প্রযোজ্য ছিল, কিন্তু জেরুজালেমের ইহুদিরা বেঁকে বসলেন। তাদের ধর্মমতে কোনো মূর্তি বা ছবির উপাসনা করা নিষিদ্ধ, তাই তারা রোমান কমান্ডারকে অনুরোধ করলেন তাদেরকে যেন এ-ধরনের কোনোকিছুতে বাধ্য করা না হয়।
পেট্রোনিয়াস নামের এই কমান্ডার একজন ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি রোমে চিঠি পাঠিয়ে জানতে চাইলেন, ক্যালিগুলার মূর্তিপূজা করা কি আবশ্যক কি না।
কিন্তু রাজধানী থেকে ফিরতি চিঠিতে তিনি অপ্রত্যাশিত সংবাদ পেলেন—ক্যালিগুলা আর নেই! প্রিটোরিয়ান গার্ডরা অবশেষে তাকে হত্যা করেছেন। তিনি তিন বছর ১০ মাস প্রিনসেপস ছিলেন।
ক্যালিগুলার মৃত্যুসংবাদ আসার ২৭ দিন পর ‘মৃত ক্যালিগুলার’ কাছ থেক আরেকটি চিঠি এল। তিনি পেট্রোনিয়াসকে হুমকি দিয়েছেন—মূর্তিপূজা শুরু না হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। এই উন্মাদ-রাজার মৃত্যুসংবাদবাহী জাহাজটি বেশি দ্রুত ছিল বলে তার মৃত্যুর সুসংবাদ(!) আগে এসেছিল
এ পর্যায়ে এসে সিনেট ঠিক করল, সেইসকল ক্ষমতা ও দায়িত্বের সমন্বিত কার্যালয় ‘প্রিনসেপস’ বিলুপ্ত করা হবে এবং পুরনো প্রজাতান্ত্রিক কর্মকর্তাদের মাঝে দায়িত্বগুলো আবারও বণ্টন করা হবে। এই উদ্যোগে দুইপক্ষ থেকে বাধা আসে। ক্যালিগুলার চাচা ক্লডিয়াস (মৃত জারমানিকাসের ভাই) প্রিনসেপ হতে চেয়েছিলেন। প্রিটোরিয়ান গার্ডদের ঘুস দিয়ে তিনি তার পক্ষে নিয়ে আসেন। এই অভিজাত সেনারা রোমের রাজনীতিতে ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসলে এই বাহিনীও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে ছিল।
অল্পদিনের মাঝেই ক্লডিয়াস প্রিনসেপস, পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমাস ও ইমপেরাটরের ক্ষমতা কুক্ষিগত করলেন। তিনি রক্ষীদের ঘুস দিলেন, ক্যালিগুলার হত্যাকারীদের ফাঁসি দিলেন এবং পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করলেন।
তিনি নিজের অবস্থান সুসংহত করতে দেশজুড়ে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দিলেন। ক্যালিগুলা যেসব জমি ও সম্পদ জোর করে দখল করেছিলেন, সব ফিরিয়ে দিলেন। ক্যালিগুলা যাদেরকে রাজদ্রোহের সন্দেহে কারাবন্দি করেছিলেন, তাদের সবাইকে মুক্তি দিলেন তিনি।
তবে এই পরিস্থিতি বেশিদিন চলেনি। ৪১ ও ৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি নির্বিচারে রোমান সিনেটর ও অভিজাত পরিবারের সদস্যদের হত্যা করতে লাগলেন। কারও কাছ থেকে কোনো হুমকির আভাস পেলেই এই কাজ করতেন তিনি। এতে তার স্ত্রী মেসালিনা ইন্ধন জোগাতেন।
ক্লডিয়াসের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল ব্রিটেনের রাজা কারাটাকাসের মোকাবিলা করা।
৪৩ সাল নাগাদ কারাটাকাস দক্ষিণে যথেষ্ট পরিমাণ ভূখণ্ডের দখল নিয়েছিলেন, যা রোমের জন্য হুমকি ছিল। ক্লডিয়াস তার চার লেজিওন সেনা সেখানে পাঠালেন।
তারা কেন্টে এসে হাজির হলে কারাটাকাসের বাহিনী বিস্ময়ে হতবাক হল—এর আগে এত বড় বাহিনী দেখেনি তারা। খুব সহজেই সেখানে একটি ঘাঁটি তৈরি করে টেমস নদীর দখল নিল ক্লডিয়াসের বাহিনী। ক্লডিয়াস নিজেই তখন হাজির হলেন। ১৬ দিন ধরে তিনি হামলায় নেতৃত্ব দিলেন। দ্বিতীয় লেজিওন পশ্চিমে ক্লডিয়াসের আস্থাভাজন কমান্ডার ভেসপাসিয়ানের নেতৃত্বে এগিয়ে গেল। ব্রিটেনে রোমান কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ছিল ক্লডিয়াসের আমলের সবচেয়ে বড় অর্জন।
অল্পদিনের মাঝে ক্লডিয়াসকে ব্রিটেন ছেড়ে দেশে ফিরে আসতে হল। তার স্ত্রী মেসালিনা অপর এক ব্যক্তিকে বিয়ে করে ফেললেন। চটে গিয়ে দুইজনকে হত্যা করল ক্লডিয়াস। এরপর তিনি ক্যালিগুলার ছোটবোন ও তার নিজের ভাগ্নী আগ্রিপ্পিনাকে বিয়ে করলেন। এর জন্য সিনেটের বিশেষ অনুমতি নিলেন তিনি। আগের ঘরের একটি ছেলে ছিল তার। লুসিয়াস ডমিশিয়াস নামের এই সন্তানকে দত্তক নিলেন ক্লডিয়াস আর তার নাম দিলেন নিরো।
৫১ সালে নিরোকে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করলেন তিনি।
৫৪ সালে এক ডাক্তারের সহযোগিতায় ক্লডিয়াসকে হত্যা করলেন তার স্ত্রী। মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রিনসেপস হলেন নিরো।
ক্লডিয়াসের মতো তিনিও প্রিটোরিয়ান গার্ডদের ঘুস খাইয়ে নিজের পক্ষে রাখলেন। তিনি সিনেটকে আশ্বাস দিলেন, তাদের কিছু ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন—যেমনটা চেয়েছিলেন অগাস্টাস। তার শিক্ষক সেনেকা এই বক্তব্য লিখে দিয়েছিলেন।
ক্ষমতায় টিকে থাকতে ক্লডিয়াসের দেখিয়ে যাওয়া পথেই থাকলেন নিরো। ক্লডিয়াসের ছেলে ব্রিটানিকাস (মেসালিনার সন্তান) চার মাস পর রহস্যজনকভাবে মারা গেলেন। নিরো তার মায়ের রক্ষীবাহিনী ভেঙে দিলেন এবং তাকে রাজকীয় আবাস থেকে নির্বাসন দিলেন।
প্রথম পাঁচ বছর সেনেকার নির্দেশনায় ভালোভাবেই রোম শাসন করলেন নিরো। কিন্তু তার বয়স ২০ হওয়ার পর থেকে তার মাঝে পাগলামির লক্ষণ দেখা দেয়।
৫৮ সালে তিনি তার বন্ধু অথোর স্ত্রী পপিয়ার প্রেমে পড়েন। তিনি অথোকে দূরের এক প্রদেশে পাঠিয়ে পপিয়াকে তার প্রাসাদে থাকার আহ্বান জানান। নিরো ইতোমধ্যে বিবাহিত ছিলেন, কিন্তু স্ত্রীর প্রতিবাদের মাঝেও তিনি এই কাজ করলেন।
একের পর এক পাগলামি করতে লাগলেন নিরো। ৫৯ সালে তিনি তার মাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে এই প্রচেষ্টা তাৎক্ষণিকভাবে সফল হয়নি। তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে হত্যা করানোর ব্যবস্থা করেন। তারপর তার মাথা এনে পপিয়াকে উপহার দেন। এরপর তিনি অথোর সঙ্গে পপিয়ার বিবাহবিচ্ছেদ করান এবং তাকে বিয়ে করেন।
ইতোমধ্যে রোমান সেনারা ব্রিটেনে তাদের ইচ্ছেমতো কাজ চালিয়ে গেলেন। কারাটাকাসের পুরনো রাজধানী কামুলোডানামের ওপর তারা নতুন এক শহর নির্মাণ করলেন।
ব্রিটেনে একাধিক বিদ্রোহ ও যুদ্ধবিগ্রহের পর রোমান কমান্ডার পলিনাস সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
তবে নিরোকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো কেউ ছিল না। তিনি একের পর এক নারীর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করেন, মদ খেয়ে মাতাল হন এবং তার বিলাসবহুল জীবনযাত্রার খরচ বহন করার জন্য প্রতিটি প্রদেশে করের বোঝা বাড়াতে থাকেন। তিনিও ক্যালিগুলার মতো রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মানুষকে যথেচ্ছ শাস্তি দিতে শুরু করেন।
৬৪ সালে রোমে এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। শহরের দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে দ্রুত এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বাতাসের প্রবল বেগে খুব দ্রুত এই আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শহরটিতে অসংখ্য শুষ্ক কাঠের তৈরি বাড়ি ছিল, যার ফলে আগুনের লেলিহান শিখা নজিরবিহীন উচ্চতায় পৌঁছে যায়। ডিও ক্যাসিয়াস বলেন, ‘গলদের সেই আগ্রাসনের পর রোমে এরকম অগ্নিকাণ্ড কেউ দেখেনি’।
‘সমগ্র প্যালাটাইন হিল, তাউরাস থিয়েটার ও বাকি শহরের প্রায় দুই- তৃতীয়াংশ আগুনে পুড়ে যায়। অগণিত মানুষের প্রাণ যায়’, যোগ করেন তিনি।
সেসময় শহরে ছিলেন না নিরো। কিন্তু তিনি এতটাই নির্দয় ছিলেন যে রোমে অনেকেই ভাবল তিনিই এই আগুনের জন্য দায়ী। গুজব ছড়িয়ে পড়ল, নতুন প্রাসাদ নির্মাণের জায়গা খুঁজে পেতে নিরো আগুন ধরিয়েছেন। কেউ বললেন, নিছক আমোদের জন্য তিনি এই কাজ করেছেন।
কথিত আছে, নিরো শহরে ফিরে রোমজুড়ে আগুনের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি, তিনি ছাদে উঠে বাঁশি বাজান আর গান গাইতে থাকেন।
আগুন, পাগলামি ও রাজদ্রোহের বিচারের মতো বিষয়গুলো একদল সিনেটরকে প্রলুব্ধ করল নিরোকে হত্যা করার পরিকল্পনা আঁটতে। ৬৫ সালের এপ্রিলে এই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে খোঁজ পেয়ে যান নিরো। জড়িত সিনেটরদের হত্যা করে আরও বেশি উন্মাদনায় মেতে উঠে নিরো।
এরকম সময়ে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নির্যাতন শুরু হয়। নিরোর জন্য তারা ছিলেন উৎকৃষ্ট বলির পাঁঠা। মনেপ্রাণে ঘৃণাও করতেন খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের।
নিরো যখন কোনোভাবেই রোমে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছিলেন না, তখন তিনি খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের দিকে অভিযোগের তির ছুড়লেন। বিভিন্ন অভিনব কায়দায় খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের নির্যাতন ও হত্যা করতে লাগলেন।
৬৬ সালে নিরো এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি আর্মেনিয়ার দখল ছেড়ে দিলেন। পার্থিয়ার তৎকালীন রাজা প্রথম ভলোগাসেস রোমের আধিপত্য মানতে রাজি হলেন না।
নিরো পার্থিয়ার সঙ্গে সন্ধি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ভলোগাসেসের ভাই তিরিদাতেসকে আর্মেনিয়ার রাজা হিসেবে মেনে নিলেন।
নিরো আর্মেনিয়া ছেড়ে দেওয়ার দুই বছর পর প্রিটোরিয়ান গার্ডের ক্যাপ্টেন জানালেন তিনি হিসপানিয়ার গভর্নরকে সমর্থন জানাবেন। তিনি ছিলেন অভিজ্ঞ যোদ্ধা ও সাবেক কনসাল গালবা। রোমান সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণভার নিয়ে ইমপেরিয়ামের দখল নেবেন তিনি, এটাই ছিল প্রত্যাশা। হিসপানিয়ার পুরো বাহিনীর পাশপাশি পার্শ্ববর্তী প্রদেশের সেনারাও গালবার প্রতি আনুগত্য দেখালেন। পাশের এই প্রদেশের গভর্নর ছিলে ওথো, যার স্ত্রীকে নিরো জোর করে বিয়ে করেছিলেন এবং পরবর্তীতে হত্যাও করিয়েছিলেন।
নিরো বুঝতে পারলেন, সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া তিনি তার সিংহাসন হারাবেন। তিনি পালিয়ে অসতিয়া বন্দরে চলে গেলেন। সেখানে জাহাজে উঠতে চাইলেও কোনো ক্যাপ্টেন তাকে তাদের জাহাজে আরোহণ করতে দিলেন না। বন্দর ছেড়ে শহরের বাইরে চলে গেলেও শিগগির প্রিটোরিয়ান গার্ডদের হাতে ধরা পড়লেন তিনি। এ পরিস্থিতিতে সম্মানজনক কাজ ছিল আত্মহত্যা। তারই এক সহযোগী তার হাত ধরে তার দেহে ছোরা ঢুকিয়ে দিলেন।
ততদিনে রোমের শাসনভার বা ক্ষমতার পটপরিবর্তনের নেপথ্যের নায়ক হয়ে উঠেছে প্রিটোরিয়ান গার্ডরা। ৭০ বছর বয়সি গালবার এ-বিষয়ে কোনো পূর্বঅভিজ্ঞতা না-থাকলেও তিনিই নিরোর স্থলাভিষিক্ত হলেন।
তবে অন্য প্রিনসেপের মতো সেনাবাহিনীকে ঘুস দিতে রাজি হলেন না গালবা। অবধারিতভাবে, প্রিটোরিয়ান গার্ডরা তাকে কৌশলে হত্যা করে ওথোকে সামনে ঠেলে দিলেন।
সিনেট অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওথোকে ইমপেরাটর ও প্রিনসেপস হিসেবে মেনে নিল। অপরদিকে রাইন নদীতে মোতায়েন করা সেনাবাহিনী জানাল, তারা জার্মানিতে অবস্থানরত বাহিনীর কমান্ডার ভিতেলিয়াসকে ইমপেরাটর হিসেবে দেখতে চায়।
ভিতেলিয়াস ইতালির দিকে রওনা হলেন। তার সেনারা পো নদী পার হতে একটি সেট নির্মাণ করলেন। ক্রেমোনার যুদ্ধে ওথোর অপেক্ষাকৃত ছোট বাহিনীর সঙ্গে ভিতেলাসের বাহিনীর যুদ্ধ হল।
ওথো সহজেই পরাজিত হলেন। রাতের আঁধারে আত্মহত্যা করলেন এবং ভিতেলাস ইমপেরাটর হলেন।
রোমে এসে ভিতেলিয়াস প্রিটোরিয়ান গার্ড ভেঙে দিলেন। এরপর নিজের অনুগত সেনাদের মাঝ থেকে নতুন করে এই বাহিনী গঠন করলেন।
বাকি সেনাদের এই ব্যবস্থা পছন্দ হল না। তারা ভেসিপাসিয়ান নামে অপর এক রোমান জেনারেলকে তাদের নেতা বানালেন।
ভেসপাসিয়ান রোমের ধারেকাছেও ছিলেন না। তিনি প্যালেস্টাইনে ইহুদি বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ছিলেন। ৬৬ সালে জিলট নামে একদল বিদ্রোহী জেরুজালেমের রোমান সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। ভেসপাসিয়ান নিজে এই বিদ্রোহ দমন করেন। এতে সাহায্য করে তার সন্তান ও কমান্ডার টাইটাস।
রোমে ভিতেলিয়াস ভোগ-বিলাসে মেতে ছিলেন। একপর্যায়ে ভেসপাসিয়ানের বাহিনী রোমে এসে উপস্থিত হল। আবারও ক্রেমোনায় যুদ্ধ হল। এবার জয়ী হল ভেসপাসিয়ানের প্রতি অনুগত সেনাদল।
৬৯ সালের ডিসেম্বরে ভিতেলিয়াসের বাড়িতে ঢুকে পড়ল সেনারা। তারা তাকে হত্যা করে তিবার নদীতে তার মরদেহ নিক্ষেপ করল।
ভেসিপাসিয়ান তার জায়গা নিতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু জেরুজালেমের ঝামেলা পুরোপুরি না-মিটিয়ে রোমে যেতে চাননি তিনি। সিনেট তার অনুপস্থিতিতেই তাকে প্রিনসেপস বানাল — যেমন বানিয়েছিল অগাস্টাস, তাইবেরিয়াস ও ক্লডিয়াসকে।
এই ডিক্রিতে ক্যালিগুলা, নিরো, গালবা, ওথো বা ভিতেলিয়াসের নাম উল্লেখ করা হয়নি। ইতিহাসের পাতা থেকে তাদের নাম পুরোপুরি মুছে দেওয়া হল। ইতালীয় ভাষায় ‘ড্যামনাশিও মেমোরিয়া।