৭-৮. সন্ধ্যা হইবার পূর্বে

সন্ধ্যা হইবার কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই ধৃতিকান্ত মাহমুরগঞ্জের বাটীর সম্মুখ হইতে একটি রিকশা লইয়া রথযাত্রা চৌমহনীর দিকে চলিয়া গেলেন।

যাইবার পূর্বে রেশমিকে কহিয়া গেলেন যে, তুমি কোথাও যেয়ো না। তোমার জন্যে কচুরিগলি থেকে রাবড়ি আর গোধূলিয়ার মোড় থেকে পান নিয়ে আসছি।

দাসী রেশমির চুল বাঁধিয়া দিতেছিল। বাহিরের বারান্দায় মোড়ার উপর বসিয়া রেশমি পথের দিকে চাহিয়াছিল।

বারান্দা পথ হইতে কিঞ্চিৎ দূরে। সম্মুখে একফালি বাগান। নুরুন্নেসা শখ করিয়া নানারূপ গাছগাছালি লাগাইয়া ছিলেন। কোনো গুণগ্রাহী লখনউয়ের নার্সারি হইতে গোলাপ আনিয়া দিয়াছিলেন। কেহ-বা আলমোড়া হইতে ম্যাগনোলিয়া গ্ল্যাণ্ডিফ্লোরার চারা। অত্যুৎসাহী কেহ বা উটকামন্ড বা কালিম্পং হইতে রডোডেনড্রন ও অন্যান্য দুষ্প্রাপ্য অর্কিডও আনিয়া উপহার দিয়াছিলেন।

বলা বাহুল্য, বারাণসীর আবহাওয়ায় উটকামন্ড বা কালিম্পং-এর অর্কিড ফুল দেয় নাই– শুকাইয়া মরিয়া গিয়াছিল। দাতার প্রেমের ফুলও তাহার সহিত শুকাইয়া ঝরিয়াছিল কি না তাহা নুরুন্নেসাই কহিতে পারিতেন।

যাহাই হউক, প্রত্যহ প্রত্যুষে উঠিয়া রেশমি নিজহস্তে এইসকল গাছগাছালিতে বারি সিঞ্চন করে, ময়নাকে সস্নেহে দানা খাওয়ায়, বিড়ালটিকে দুগ্ধ সেবন করায়। মালতীলতা বা মাধবীলতা গতরাত্রের ঝোড়ো হাওয়ায় হেলিয়া পড়িয়া থাকিলে, তাহাদের সুবিন্যস্ত করিয়া রাখে।

এই সকল-ই প্রত্যুষে।

বৈকালে এ সমস্ত ভার দাসী ও মুরতেজার। যেদিন রেওয়াজ করে না (আজকাল সে রেওয়াজ বা তালিম খুব কম-ই করে বা নেয়) রেশমি বারান্দায় বসিয়া উহাদের কাজের তদারকি করে। দাসী কাজ সারিয়া আসিয়া হাত ধুইয়া লইয়া নানারূপ পুষ্পের আরক ও বহুপ্রকার হাকিমি দাওয়াই দ্বারা সুরক্ষিত কিন্তু অতিসুগন্ধি তৈল লইয়া মেঝেতে বসিয়া রেশমির কেশচর্চা করে। দিনের এই সময়টুকুতে রেশমি সম্পূর্ণ নিরালা হইয়া যায়। মনে-মনে পথের দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে কত কী-ই সে ভাবে।

চক্ষু পথের উপরেই নিবদ্ধ থাকে কিন্তু কে যায়, না-যায় তাহা, তাহার চক্ষে পড়ে না। তাহার মনের চক্ষু ততক্ষণে স্মৃতির অলিন্দে-অলিন্দে ঘুরিয়া বেড়ায়।

বাটীর সম্মুখের চবুতরায় প্রথমপ্রত্যুষে এবং সন্ধ্যার প্রাক্কালে কবুতরেরা ভিড় করিয়া আসে। দাসী তাহাদের জন্য যে-গে, বাজরা বা ধান্য দিয়া আসে তাহারা তাহা খুঁটিয়া খায়। প্রত্যেকটি কবুতরকে রেশমি বিশেষরূপে জানে। কোনোদিন উহাদের মধ্যে একজনও অনুপস্থিত থাকিলে দাসী বা মুরতেজা মারফত হাসান সাহেবের বাগানবাটীতে তাহার অসুখ করিয়াছে কি না, সে খবর লইয়া আসিতে পাঠায়। কবুতরগুলি বড়োই প্রিয় রেশমির।

অদ্য ধৃতিকান্ত এক্ষণে বাহির হইলেন বলিয়াই বারান্দার রেলিংয়ের ফোকর দিয়া ধৃতিকান্তর সাইকেলরিকশা আসীন মূর্তিটি যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায়, ততক্ষণ রেশমি সেই দিকে চাহিয়া রহিল।

পথের বাঁকে সাইকেলরিকশাটি মিলাইয়া যাইবার পর, রেশমি বারান্দার অভ্যন্তরে চক্ষু ফিরাইয়া লইল।

একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিল। অপস্রিয়মাণ ধৃতিকান্তর সাইকেলরিকশায় বসিবার অসহায় ভঙ্গিটি তাহার বক্ষে বড়োই বাজিল! কী ধৃতিকান্ত, কী হইয়াছেন! সত্য সত্যই তাহার বর্তমানে বিবশ মার্জারটির প্রতি রেশমির যেরূপ স্নেহ ও মমতা, ধৃতিকান্তের প্রতিও ঠিক সেইরূপ এক মমতা বোধ করে সে ইদানীং। এরূপ অবস্থায় সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় ধৃতিকান্তকে বাঁচিয়া থাকিতে দেখিয়া রেশমির মনে একইসঙ্গে উম্মা, অভিমান, সমবেদনা এবং ক্রোধ আসিয়া দাপাদাপি করে। ধৃতিকান্তই একমাত্র পুরুষ যাঁহার কাছে রেশমি তওয়ায়েফকেও আজীবন হার স্বীকার করিতে হইল। কখনো এমনকী আজিকার ধৃতিকান্তর অসহায়তার মধ্যেও সে, তাঁহাকে পরাজিত করিতে পারিল না। তাঁহার সর্বস্বহৃত অবস্থাতেও তাঁহাকে ‘তাহার’ করিয়া পাইল না। কিংবা অন্তর্যামীই জানেন; হয়তো ধৃতিকান্তর সর্বস্ব এখনও খোয়া যায় নাই। হয়তো এখনও বাকি আছে কিছু।

এই পরাজয়ে রেশমির গ্লানি বোধ করার-ই কথা ছিল। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে গ্লানি বোধ না করিয়া রেশমি এক অতীন্দ্রিয় আনন্দ অনুভব করে সর্বক্ষণ তাহার বক্ষমধ্যে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আনন্দর স্বরূপ রেশমি তওয়ায়েফের ন্যায় আর কে জানিবে? সে আনন্দ তো সুন্দরী মানবী শরীর লইয়া যাহারাই জন্মায় তাহারাই জানে। কিন্তু ‘অতিন্দ্রীয় প্রেমের মধ্যে যে, দেবদুর্লভ আনন্দ তাহার স্বাদ সকলের ভাগ্যে জোটে না। এ বাবদে রেশমি নিজেকে পরমভাগ্যবতী বলিয়া মনে করে। ধৃতিকান্ত ইন্দ্রিয়সুখ বলিতে যাহা জাগতিক অর্থে বুঝায়, তাহা দেন নাই তাহাকে ইহা সত্য, কিন্তু যাহা দিয়াছেন, তাহা নিক্তির একপার্শ্বে রাখিয়া, জীবনের সমস্ত অন্যান্য ইন্দ্রিয়সুখকে অন্যপার্শ্বে রাখিয়া সে দেখিয়াছে যে, প্রথম দিকের ওজন চিরদিন-ই বেশি।

পাঠক! পূর্বেই বলিয়াছি যে, রেশমি ধৃতিকান্তের নিকট হইতে যে, সহজপ্রাপ্তি চাহে নাই এমন নহে। কিন্তু যে-কারণেই হউক, সেই দানের প্রতি ঘৃতিকান্তর বিমুখতা এবং ধৃতিকান্তর সমস্ত সত্তা আর একজন নারী (যাহাকে রেশমি কখনো দেখে নাই) আচ্ছন্ন করিয়া ছিল বলিয়াই হয়তো এই অপ্রাপ্তির প্রাপ্তির, পরমপ্রকৃতি রেশমি যেমন বুঝিল, তেমন করিয়া আর কোনো তওয়ায়েফ কখনো বুঝিবে না।

ধৃতিকান্ত রথযাত্রা চৌমহনী ছাড়াইয়া গোধূলিয়ার বাঁকে পৌঁছিয়া তাঁহার পরিচিত দোকানির দোকান হইতে দুই খিলি পান লইলেন।

এই দোকানি তাঁহাকে যৌবনে দেখিয়াছে, তাঁহার অতীত সম্বন্ধে সে, বিশেষরূপে জ্ঞাত আছে। এই ব্যক্তি ছাদ-খোলা বিদেশি গাড়িতে করিয়া কুর্তা ও গিলা করা পাঞ্জাবি পরিধান করিয়া তাহার দোকানের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইতেন, উর্দিপরা চালক ও খিদমদগার গাড়ি হইতে আসিয়া রৌপ্যনির্মিত করঙ্কমধ্যে তাম্বুল ভরিয়া লইয়া যাইত, সেই করঙ্কর নীচতলায় বরফ রহিত। সেই বরফের উপর গোলাপ জল ছিটাইয়া দেওয়া হইত। তাম্বুল থাকিত উপরের তলায়।

ধৃতিকান্ত, সেই ঐশ্বর্য ও মহিমার দিনে যেরূপ আন্তরিক ও উদার ব্যবহার করিতেন, এই দোকানির সহিত আজিও সেইরূপ-ই করেন। কিয়ৎদিন পূর্বে সেই দোকানির পুত্র অত্যন্ত অসুস্থ হওয়ায় ধৃতিকান্ত মধ্যাঙ্গুরীয়র হীরকখচিত শেষ অঙ্গুরীয়টি পানওয়ালাকে দিয়া কহিয়াছিলেন যে, এইরূপ শত-শত অঙ্গুরীয়র বিনিময়েও, তোমার পুত্রের জীবনের মূল্য দেওয়া যায় না, তাই এই একটি অপ্রয়োজনীয় অঙ্গুরীয়র বিনিময়ে যদি তাহাকে সুস্থ করিয়া তুলিতে পারো, তাহা হইলে এই হীরকখন্ড যথার্থ সার্থক হইবে।

পুত্র সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়া উঠিয়াছে। সেই সন্ধ্যায় সে দোকানে উপস্থিতও ছিল। দোকানি ও স্বীয়পুত্র ধৃতিকান্তকে দেখিয়া যারপরনাই আনন্দিত হইল। দোকানি রেশমির নিমিত্ত সযত্নে তাম্বুল সাজিতে লাগিল। কহিল, পুত্র মারফত সে তৎক্ষণাৎ মাহমুরগঞ্জে পান পাঠাইয়া দিতেছে।

এ-জীবনে ধৃতিকান্ত বহুব্যক্তির জন্য, বহুসংসারের জন্য তাঁহার যৎসামান্য সামর্থ্যনুসারে অনেক কিছুই করিয়াছেন–যখন তাঁহার সে সামর্থ্য ছিল। কিন্তু শিক্ষিত ও সচ্ছল ব্যক্তিদের মধ্যে যে-অসীম অকৃতজ্ঞতা ও স্বার্থপরতা তিনি দেখিয়াছেন, তাহাতে চিত্ত বড়োই ব্যথিত হইয়াছে। কিন্তু অশিক্ষিত দরিদ্র ব্যক্তিমাত্রই তাঁহাকে চমৎকৃত করিয়াছে। তাহারা কিছু ভোলে না; কদাপি না। সেই শিক্ষিত সচ্ছলদের মধ্যে, কেহ-কেহ কোনো দুর্দিনে-প্রাপ্ত সাহায্যে তৎকালীন আর্থিক মূল্য বহুবৎসর পর ধৃতিকান্তকে ছুঁড়িয়া দিয়া গর্বভরে কহিয়াছেন, সব-ই শোধ করিলাম। যেন ধৃতিকান্ত রৌপ্যমুদ্রাই দিয়াছিলেন, তৎসঙ্গে কাহাকেও অন্যকিছুই দেন নাই। যেন রৌপ্যমুদ্রা শোধ করিলেই তামাম-শোধ হইয়া যায় এই সংসারে। কেহ-বা কিছুমাত্র শোধ না করিয়া অথবা শোধ করিবার চেষ্টামাত্র না করিয়া ধৃতিকান্তের দুর্নাম করিয়া বেড়াইয়াছেন, কহিয়াছেন; উহার আছে, তাই দেয়, ইহাতে বাহাদুরির কী? যাহার আছে সে না দিবে কেন?

সকলেই এবং প্রত্যেকে ধৃতিকান্তর অর্থ ও প্রতিপত্তিকে ভালোবাসিয়াছেন, ধৃতিকান্তকে তাঁহার নিজের জন্য, তাঁহার অন্তরের উষ্ণতার জন্য, অন্যকে সুখী দেখিয়া, আনন্দিত দেখিয়া তিনি যে, স্বার্থহীন আন্তরিক আনন্দ পাইতেন; সেই আনন্দের স্বরূপকে কেহই কখনোই কণামাত্রও দাম দেন নাই। মনুষ্যচরিত্রের এই নগ্নভাবে প্রকট ও হৃদয়বিদারক রূপটি তাঁহাকে বড়োই ব্যথিত করিয়াছে। অনেক দেখিয়া শুনিয়া, ভাবিয়া, বহুদিন যাবৎ কাহারও নিকট হইতে তাঁহার আর কোনোই প্রত্যাশা নাই। তিনি দূর হইতে অন্যকে ভালোবাসিয়া, অন্যের শুভকামনা করিয়াই বহুদিন যাবৎ খুশি আছেন।

সে কারণেই, এই দরিদ্র পানওয়ালা ও তাহার পুত্রের এবংবিধ আচরণ তাঁহাকে মুগ্ধ করিল। তিনি পুনর্বার বুঝিলেন যে, কে কতখানি দিতে পারেন জাগতিকার্থে, তাহার উপর কিছুই নির্ভর করে না, কে কেমনভাবে তাহা দেন, কেমনভাবে তাহা প্রত্যর্পণ করেন, তাহার উপর-ই সমস্ত কিছু নির্ভরশীল।

ধৃতিকান্ত যখন রিকশা ঘুরাইয়া লইয়া অন্যত্র চলিলেন, তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে।

রঘুনন্দনের বাটী অতিক্রম করিয়া আসিয়া তিনি রিকশা ছাড়িয়া দিলেন।

তাহার পর পদব্রজে রঘুনন্দনের বাটী ছাড়াইয়া আরও কিছুদূর আগাইয়া গেলেন।

পূর্ব নির্দেশানুসারে একটি নীলরঙা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি অন্ধকার পথের অপেক্ষাকৃত নির্জন স্থানে পথিপার্শ্বস্থ একটি ঘোড়া-নিমের অন্ধকারতর ছায়ায় দাঁড়াইয়াছিল।

ছত্রপাল গাড়ির নম্বরপ্লেট বদলাইয়া লইয়াছে। গাড়ির গায়ে স্থানে-স্থানে জমি ঘষিয়া রং চটাইয়া ফিকা-বাদামি-রঙা প্রাইমার লাগানো হইয়াছে। ছত্রপাল কহিয়াছে যে, কার্য সমাধা হইলেই, গাড়ি পুনর্বার রং করাইয়া লইবে।

ধৃতিকান্ত ধীরে পায়ে হাঁটিয়া গাড়িটিকে একবার অতিক্রম করিয়া গেলেন। তাহার পর ফিরিয়া আসিয়া চালককে ফিসফিস করিয়া কী কহিলেন।

চালক সম্মুখের বাম দিকের দরজা খুলিয়া দিল।

ধৃতিকান্ত ভিতরে উঠিয়া কিছুক্ষণ দম লইয়া কহিলেন, ছোটন কেমন আছে?

চালক হাসিয়া উত্তর দিলেন, ভালো আছে।

ধৃতিকান্ত আবারও কহিলেন, আজকাল কি শিকার-টিকার খেলে?

চালক হাসিল। কহিল, নাঃ। এখন কাজকর্মে, সংসারের চাপে আর সময় হয় না। বয়সে তো হয়েছে।

ধৃতিকান্ত ভাবিলেন, তাহা ঠিক। বয়স তো হইয়াছেই! ছোটন তাঁহার সমবয়সিই হইবে। তাহার পর শুধাইলেন, তোমার নাম কী?

–আমার নাম লোটন!

–তুমি কী কাজ করো?

–আমার মোটর মেরামতের গ্যারাজ আছে।

লোটন একবার ঘড়ি দেখিল।

কহিল, সময় হয়েছে তো?

ধৃতিকান্ত কহিলেন, হয়েছে। তবে তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। রঘুনন্দন বেরোক– বেরিয়ে ও এদিকেই আসবে। প্রায় আধ ঘণ্টা এই নির্জন জায়গায় পায়চারি করবে। তখন যা করার আমিই করব। তুমি ছোটনের ভাই, ছেলেমানুষ; তোমাকে কোনো হুজ্জোতি পোয়াতে হবে না।

‘ছেলেমানুষ’ আখ্যা দেওয়াতে, লোটন কিছুটা ক্ষুব্ধ হইল।

মুখে কিছুই কহিল না।

ছোটন ধৃতিকান্ত ও ছত্রপালের বহুপুরাতন শিকার-সঙ্গী।

ছোটনকে একবার মির্জাপুর জেলার এক বনমধ্যে আক্রমণোদ্যত ভল্লুকের হাত হইতে ধৃতিকান্ত রক্ষা করিয়াছিলেন। ছোটন বলিয়াছিল ‘ইয়াদ রহে গা। তুমহারা কোই কামমে আনেসে ইয়াদ করনা ইয়ার।

ছোটনের ন্যায় এত সত্বর কেহই জানোয়ারের চামড়া ছাড়াইতে পারি না। যেকোনো জানোয়ার-ই হউক না কেন, বাঘ হইতে শম্বর চামড়া ছাড়ানো তাহার পক্ষে কোনোই দুরূহ কর্ম ছিল না।

ধৃতিকান্তর মনে পড়িল যে, ছোটন কহিত, আমি যেমন জানোয়ারের ছাল ছাড়াতে পারি, তেমন মানুষেরও পারি; মনে রেখো ইয়ার। কখনো জরুরত হলে বলবে। জিন্দেগি ভর ইন্তেজার করব।

জরুরত বহুবৎসর পর হইয়াছে, তাই ছত্রপাল মারফত ধৃতিকান্ত ছোটনকে সংবাদ দিয়াছিলেন।

বর্তমানে বয়স্ক ছোটন নিজ অপেক্ষাও জবরদস্ত ও জোয়ান অনুগত সহোদরকে পাঠাইয়াছে, যাহাতে ছাল ছাড়ানোর কোনো ত্রুটি না হয়।

ধৃতিকান্ত লোটনের প্রতি হাত বাড়াইয়া দিলেন।

লোটন এদিক-ওদিক চাহিয়া পাঞ্জাবির পকেট হইতে একটি পিস্তল বাহির করিল।

–গুলি ভরা আছে?

ধৃতিকান্ত শুধাইলেন।

–আছে। সাতটি ম্যাগাজিনে, একটি চেম্বারে।

বহু বহুদিন পর শীতল কালো পিস্তলটির বাঁট হাতে করিয়া ধৃতিকান্ত বড়োই খুশি হইলেন।

হাতে জোর নাই, হাত একটু-একটু কাঁপে ইদানীং। তবুও হাতে পিস্তল থাকিলে, রঘুনন্দনকে মারিতে যতটুকু জোরের প্রয়োজন হইবে; ততটুকু জোর এখনও ধৃতিকান্তের অবশিষ্ট আছে।

সময় বহিয়া যাইতেছে।

লোটন আরও একবার ঘড়ি দেখিল।

কহিল, খবর পায়নি তো আগে?

ধৃতিকান্ত কহিলেন, সেকথা তো তুমি জানবে। ইন্তেজাম তো সব তোমার।

লোটন পুনরায় ক্ষুব্ধ হইল।

কহিল, আমার ইন্তেজামে কোনো গড়বড়ি নেই। আপনাকে দেখে ফেলেনি তো?

ধৃতিকান্ত কহিলেন, আমাকে পথের মধ্যে রিকশায় দেখলেও চিনতে পারার কথা নয়। কিন্তু দেখেতোনি।

আরও প্রায় দশ মিনিট কাটিয়া গেল।

ধৃতিকান্ত পশ্চাতে দেখিবার আরশিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন।

হঠাৎ লোটন কহিল, ছত্রপাল ভাইয়া কিন্তু বার বার বলে দিয়েছে, যে প্রাণে মারা চলবে না।

ধৃতিকান্তর চোয়াল শক্ত হইয়া উঠিল।

কহিলেন, জানি। জানে মারলে তোমাদের উপরও হামলা হতে পারে।

তাহার পর কহিলেন, আজকাল সকলেই ভীতু হয়ে গেছে। অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন। ‘জান’-এ না মারলে হামলা তো আরও বেশি হবে। আমার উপর হবে; রেশমির উপর হবে।

লোটন কহিল, আমরা বানারসে থাকতে ওই হারামজাদা যাতে মাহমুরগঞ্জের বাড়িতে আর কখনোও পা না দেয়, তা আমাদের জিম্মাদারি। আপনাকে জবান দিলাম। ভয় রেশমি বহিনের জন্য নয়; ভয় আপনাকেই নিয়ে। আপনার শিগগির কলকাতা চলে যাওয়া উচিত। আজ এ ব্যাপারটা ভালোমতো মিটে গেলে, কালকের গাড়িতেই আপনার চলে যাওয়া উচিত।

ধৃতিকান্ত কোনোই উত্তর করিলেন না।

ভাবিতে লাগিলেন, কলিকাতায় যাইয়া তিনি কী করিবেন। প্রথমত, সে-স্থলে তাঁহার থাকিবার ন্যায় কেহই নাই, দ্বিতীয়ত, রঘুনন্দনের চেলারা ভাবিবে যে, তিনি ভীরু। তাঁহার শরীর অশক্ত, দুর্বল হইয়াছে বলিয়া তাঁহার মনও দুর্বল হইয়াছে, একথা ভাবিয়া থাকিলে বলিতে হইবে যে, ধৃতিকান্তকে এখনও তাহারা সম্যক চিনে নাই।

হঠাৎ ধৃতিকান্ত সোজা হইয়া বসিলেন।

আরশিতে রঘুনন্দনকে আসিতে দেখা গেল।

প্রকান্ড মেদবহুল গোলাকৃতি অবয়ব। আজ পরনে মিলের মিহি ধুতি এবং বেনারসি সিল্কের পাঞ্জাবি।

চকিতে মস্তক ঘুরাইয়া ধৃতিকান্ত চতুষ্পর্শে দেখিয়া লইলেন। আশ্বস্ত হইলেন, রঘুনন্দনের সহিত চেলা-চামচা আর কেহ নাই দেখিয়া।

থপথপ করিয়া একটি অতিকায় কোলাব্যাঙের ন্যায় রঘুনন্দন আগাইয়া আসিতেছিল।

দেখিতে দেখিতে রঘুনন্দন গাড়ির নিকটবর্তী হইল।

ধৃতিকান্ত দেখিলেন, সম্মুখ হইতে জনাকয় লোক একইসঙ্গে আসিতেছে। তাহাদের প্রায় প্রত্যেকের হস্তেই প্রকান্ড-প্রকান্ড বংশদন্ড।

এতক্ষণে রঘুনন্দন একেবারে গাড়ির পার্শ্বে চলিয়া আসিয়াছে। কিন্তু ওই লোকগুলিকে দেখিয়া ধৃতিকান্ত চিন্তিত হইলেন। পরমুহূর্তেই লক্ষ করিলেন যে, রঘুনন্দন নিজেও ওই লোকগুলিকে আসিতে দেখিয়া ধৃতিকান্ত হইতেও বেশি চিন্তিত।

লোকগুলি তাহাদের প্রতি দৃকপাত না করিয়া আপনাদিগের মধ্যে গল্প করিতে-করিতে গাড়িকে অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেল।

কিন্তু ততক্ষণে রঘুনন্দন অনেকখানি আগাইয়া গিয়াছে।

ধৃতিকান্ত জানিতেন যে, রঘুনন্দনের পাঞ্জাবির নীচে ছয় ঘরা রিভলবার লুক্কায়িত নিশ্চয়ই আছে। তাই সম্মুখ হইতে তিনি উহার সহিত মোকাবিলা করিতে চাহিলেন না।

লোটন কহিল, গাড়িটা একটু এগিয়ে নিয়ে যাই ওর পিছুপিছু।

ধৃতিকান্ত কহিলেন, না না। এখানেই ভালো আছে। গাছটার জন্য এখানে অন্ধকার। ও আবার ফিরে আসবে। তখন আমি যা করার করব।

লোটন তাঁহার দিকে চাহিয়া কহিল, যা-করার মানে কিন্তু প্রাণে মারা নয়।

ধৃতিকান্ত পুনর্বার কহিল, সেকথা তো আগেই বলেছ। বারবার এককথা কেন?

শীর্ণ ও অশক্ত ধৃতিকান্তর কঠিন স্বরমধ্যে যে-ব্যক্তিত্ব ঝরিয়া পড়িল, লোটন তাহাতে যারপরনাই আশ্চর্যান্বিত হইল।

রঘুনন্দনকে ফিরিয়া আসিতে দেখা গেল। থপথপ করিয়া সে আসিতেছিল।

রঘুনন্দনকে দেখিবামাত্র ধৃতিকান্ত নিঃশব্দে বাম দিকের দ্বার খুলিয়া নামিয়া গাড়ির পশ্চাতে চলিয়া গেলেন এবং পশ্চাতেই লুকাইয়া রহিলেন।

রঘুনন্দন গাড়ির নিকটবর্তী হইয়াই অকস্মাৎ গাড়ির পার্শ্বে দাঁড়াইয়া লোটনকে উদ্দেশ করিয়া সন্দিগ্ধ স্বরে কহিল, কিসকা গাড়ি হ্যায় ই?

লোটন তাচ্ছিল্যভরে দুই হস্ত মস্তকোপরি তুলিয়া একটি আড়মোড়া ভাঙিল।

তাহার পর কহিল, আপ কেয়া পুলিশ-সার্জেন্ট হ্যায়?

রঘুনন্দন কহিল, এ্যাইসেহি পুছ রহা হ্যায় ম্যায়। জবাব দেনেমে আপকো তকলিফ ক্যা হ্যায়?

লোটন মুহূর্তমধ্যে দরজা খুলিয়া নামিয়া পড়িল কহিল, আরে মোটু, ইয়ে তেরা বাপকা গাড়ি হ্যায়!

অস্বাভাবিকতার গন্ধ পাইয়াই সঙ্গে সঙ্গে রঘুনন্দন নিজেকে গুটাইয়া লইল। তাহার চাতুর্য। তাহাকে ‘মূর্খ’ হইতে কহিল।

সে এতবড় অপমানটা হজম করিয়াই দ্রুতপদে তাহার বাটী অভিমুখে রওয়ানা হইল।

রঘুনন্দন সবেমাত্র গাড়িটি অতিক্রম করিয়াছে, অমনি ধৃতিকান্ত পিস্তল বাহির করিয়াই তাহার পৃষ্ঠদেশে ঠেকাইয়া তাহাকে হস্তদ্বয় উপরে তুলিতে কহিলেন।

ব্যাপার বুঝিবার পূর্বেই লোটন আসিয়া রঘুনন্দনের ট্যাঁক হইতে রিভলবারটি ছিনাইয়া লইল।

ধৃতিকান্ত রঘুনন্দনকে ঘাড়ে লইয়া আসিয়া গাড়ির পশ্চাতের দ্বার খুলিয়া দিয়া একধাক্কায় তাহাকে পিছনের সিটে ঢুকাইয়া দিলেন।

লোটন অবাক হইয়া লক্ষ করিল যে, রঘুনন্দনের অতিবড়ো দেহটি ধৃতিকান্তর হস্তের এক ধাক্কায় হুড়মুড় করিয়া পশ্চাতের সিটের উপর হুমড়ি খাইয়া পড়িল।

ধৃতিকান্ত নিজেও অবাক কম হন নাই। কিন্তু রঘুনন্দনকে ঢুকাইয়া তিনি নিজেও প্রায় হুমড়ি খাইয়া পড়িবার ন্যায় পশ্চাতের সিটে রঘুনন্দনের পার্শ্বে গিয়া বসিয়া পড়িলেন।

লোটনকে কহিলেন, মাহমুরগঞ্জ।

রঘুনন্দন কহিল, ব্যাপারটা কী?

বাম হস্তে পিস্তল ধরিয়া, দক্ষিণ হস্ত দ্বারা রঘুনন্দনের মাংসল গালে ঠাস’ শব্দে এক চপেটাঘাত কষাইয়া দিয়া ধৃতিকান্ত কহিলেন, মুখ নীচু করে পাদানিতে মুখ ঢুকিয়ে বসে। পড়ো। কথা বলেছ কী তোমার জান নিয়ে নেব।

লোটন পুনর্বার কহিয়া উঠিল, জানে মেরো না, জানে মেরো না।

ধৃতিকান্ত লোটনকে ধমকাইয়া কহিলেন, চুপ করো তুমি।

লোটন বিস্ময়ান্বিত হইয়া একবার ঘাড় ফিরাইয়া ধৃতিকান্তকে দেখিয়া লইয়া তাহার মুখের আশ্চর্য দৃঢ় ভাব ও জ্বলন্ত চক্ষু লক্ষ করিয়া আর কিছু কহিল না।

মাহমুরগঞ্জের বাটীর গেটের ভিতর গাড়ি ঢুকিবার পর গাড়ি গ্যারাজের নিকটে আসিলে, ধৃতিকান্ত অন্যপার্শ্বের দ্বার খুলিয়া রঘুনন্দনকে নামিতে কহিলেন ও তাহার ঘাড়ে পিস্তলের নল ঠেকাইয়া, মুরতেজা দ্বার খুলিবামাত্র, তাহাকে দ্বিতলে লইয়া চলিলেন।

লোটনকে কহিলেন, তুমি গাড়িতেই থাকো।

দাসী রঘুনন্দনকে দেখিবামাত্র চিৎকার করিয়া উঠিল।

ধৃতিকান্ত তাহাকে চুপ করিতে কহিলেন।

রেশমি অন্ধকার বারান্দায় বসিয়া ছিল। ধৃতিকান্ত ডাকিলেন রেশমি। এই তোমার রাবড়ি এনেছি।

রেশমি বারান্দা হইতেই কহিল, গেলে রিকশায়। কিন্তু গেটে কার গাড়ি ঢুকতে দেখলাম? কার গাড়ি?

ধৃতিকান্ত রঘুনন্দনকে রেশমির ঘরে লইয়া গিয়া মাটিতে হাঁটু গাড়িয়া বসিতে কহিলেন।

রেশমি উত্তর না পাইয়া বারান্দা হইতে ভিতরে আসিয়াই দাসীর উত্তেজিত চোখ-মুখ লক্ষ করিয়া নিজকক্ষে প্রবেশ করিল।

ঘরে প্রবেশ করিয়া আতঙ্কিত স্বরে কহিল, এ কী? এ কে?

তাহার পর ধৃতিকান্তর হস্তে পিস্তল দেখিয়া ভীতস্বরে কহিল, একে ধরে এনেছ কেন?

ধৃতিকান্ত হাসিলেন।

কহিলেন, একে বলেছিলাম যে, আর একবার তোমার কাছে আসতে হবে। তাই-ই নিয়ে এলাম।

স্থূলকায় রঘুনন্দনের মাটিতে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া থাকিতে কষ্ট হইতেছিল। তাহার চোখে মুখে জানোয়ারসুলভ এক অভিব্যক্তি ফুটিয়া উঠিয়াছিল।

ধৃতিকান্ত কহিলেন, মাপ চাও রঘুনন্দনবাবু।

রেশমির পায়ে হাত দিয়ে মাপ চাও।

রঘুনন্দন কহিল, কভভি নেহি।

নেহি? ধৃতিকান্ত শুধাইলেন।

-নেহি!

আতঙ্কিত রেশমির সম্মুখে মুহূর্তমধ্যে ধৃতিকান্তর জুতাসুদ্ধ দক্ষিণ পদ সজোরে রঘুনন্দনের মুখে আঘাত করিল।

রঘুনন্দন মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া গেল।

কিন্তু ভূলুণ্ঠিত অবস্থা হইতে উত্থিত হইয়া কহিল, হাতে পিস্তল নিয়ে বাহাদুরি করছ, নইলে শুকনো ইঁদুর তোমাকে আমি দেখে নিতাম।

ধৃতিকান্তর মুখে এক শীতল, হিমেল হাসি ফুটিয়া উঠিল।

তিনি কহিলেন, সেদিন তোমার হাতেও রিভলবার ছিল এবং সঙ্গে তোমার শাগরেদরা ছিল। আজ আমার দিন–বলিয়াই পুনরায় সজোরে তাহার মুখে পদাঘাত করিলেন।

রঘুনন্দন পুনর্বার পড়িয়া গেল।

থাক থাক, অনেক হয়েছে,–বলিয়াই রেশমি ধৃতিকান্তকে থামাইতে গেল।

ধৃতিকান্ত কহিলেন, রেশমি, পুরুষের ব্যাপারে মেয়ে হয়ে মাথা ঘামাতে এসো না। চুপ করে খাটে বোসো, পা ঝুলিয়ে। ও আজ মাপ না চাইলে, ওকে সত্যিই জানে খতম করে দেব। ও আমাকে চেনে না। ও ভেবেছে, আমি একেবারে শেষ হয়ে গেছি। শেষ হয়ে যাবার আগে ওকে শেষ করে যাব।

রঘুনন্দন একবার ঝাঁপাইয়া পড়িয়া বৃতিকান্তর হস্ত হইতে পিস্তলটি ছিনাইয়া লইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু ধৃতিকান্ত ক্ষিপ্র চিতাবাঘের ন্যায় লাফাইয়া সরিয়া গিয়া পিস্তলের নল দিয়া রঘুনন্দনের মস্তকে সজোরে আঘাত করিলেন।

রঘুনন্দন যন্ত্রণায় চিৎকার করিয়া উঠিল।

তাহার কপাল গড়াইয়া রক্ত পড়িতে লাগিল। বেনারসি সিল্কের পাঞ্জাবি রক্তে ভাসিয়া যাইতে লাগিল।

রঘুনন্দন প্রথমে ভাবিয়াছিল, ধৃতিকান্ত সত্য সত্যই তাহাকে জানে মারিবার ন্যায় দুঃসাহসী হইবেন না, কিন্তু নিজরক্ত দেখিয়া তাহার মনোবল কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হইল।

ধৃতিকান্ত কহিলেন, তাড়াতাড়ি রেশমির পায়ে ধরে মাপ চাও। তোমাকে ছুটি দিয়ে দেব।

রঘুনন্দন ইতস্তত করিতেছে দেখিয়া, ধৃতিকান্ত কহিলেন মাপ চাইবে না তুমি? তাহলে চলো, তোমাকে এখুনি শেষ করে তোমার মরা হাত জোড়া করে, বেঁধে আমি মাপ চাওয়াব। কামিনা, তোমার মতো অনেক জানোয়ারের রক্তে আমার হাত ভরে গেছে। তোমাকে মারতে আমার হাত একটুও কাঁপবে না।

রঘুনন্দনের আর্তনাদ শুনিয়া ইতিমধ্যে লোটন আসিয়া কমধ্যে দাঁড়াইল।

রেশমি ভয় পাইয়া কহিল, এ কে?

ধৃতিকান্ত সংক্ষেপে কহিলেন, এ আমার লোক।

লোটন পুনরায় কহিল, জানে কিন্তু মারবেন না।

ধৃতিকান্ত রাগতস্বরে কহিলেন, তুমি বড় বাড়াবাড়ি করছ ছোকরা। বেশি কথা বললে তোমাকেও শেষ করে দেব। যেকোনো লড়াইতে নেতা একজন-ই থাকে–তুমি চুপ করো, আমি যা বলছি–তাই করো।

লোটনের মুখমন্ডলে অপমানের ছাপ লাগিল।

ধৃতিকান্ত পুনরায় রঘুনন্দনের মুখে পদাঘাত করিলেন। ধৃতিকান্তর জুতায় রক্ত লাগিয়া গেল।

লোটন কহিল, এখনও পায়ে ধরো, নইলে তোমাকে কিন্তু আমিও বাঁচাতে পারলাম না।

লোটনের কথাতে রঘুনন্দন সত্য সত্যই ভয় পাইল।

রেশমি খাটের বাজু ধরিয়া বসিয়া ভাবিতেছিল, যে-ব্যক্তিকে, সে ও মুরতেজা দুইজনে মিলিয়াও চুনারের দুর্গে উঠাইতে কষ্ট পাইতে দেখিয়াছিল, সে ব্যক্তির জীর্ণ অসুস্থ শরীরে এত । বল কোথা হইতে আসিল।

রঘুনন্দন উঠিয়া দাঁড়াইয়া রেশমির নিকট আগাইয়া আসিতে লাগিল।

ধৃতিকান্ত কহিলেন, না। হেঁটে নয়, হামাগুড়ি দিয়ে এসো।

কহিয়াই পুনরায় তাহাকে আরও এক চপেটাঘাত করিলেন। চপেটাঘাতে এমন জোর শব্দ হইল যে, দাসী ও মুরতেজা বারান্দা হইতে কমধ্যে ছুটিয়া আসিল।

রঘুনন্দন এক্ষণে হামাগুড়ি দিয়া ধীরে-ধীরে রেশমির দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। মেঝেতে রক্ত পড়িয়া তাহা ভাসিয়া যাইতে লাগিল। কপালবাহিত রক্তস্রোতে রঘুনন্দনের দুই চক্ষু বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। সে কোনো রক্তাক্ত বদবু জানোয়ারের ন্যায় আসিয়া রেশমির দোদুল্যমান দুই পদতল দুই হস্তে ধরিল।

ধৃতিকান্ত কহিলেন, বলো-যে, আমাক মাপ করো রেশমি। বলো-যে, এ বাড়ি জীবনে আর কখনো ঢুকবে না। বলো, জোরে জোরে বলো।

রঘুনন্দন বাঁধা-বুলির ন্যায় ধৃতিকান্তর শিখাইয়া দেওয়া কথা কয়টি কহিল।

মাপ চাওয়া হইতেই বৃতিকান্ত কহিলেন, এবার চলল।

রেশমি আলমারি খুলিয়া সেদিনের দশ টাকার নোটের বাণ্ডিলটি ধৃতিকান্তের হস্তে তুলিয়া দিল।

ধৃতিকান্ত তাহা ভূতলে নিক্ষেপ করিয়া জুতা দিয়া মাড়াইয়া মেঝেতে ঘষিয়া রঘুনন্দনের রক্তে মাখামাখি করিয়া ফেলিলেন।

তাহার পর রঘুনন্দনকে কহিলেন, উঠিয়ে নে কুত্তা, গোবর কি কিম্মত।

রঘুনন্দন ইতস্তত করিতেছে দেখিয়া ধৃতিকান্ত তাহার দিকে পিস্তল উঁচাইলেন।

রঘুনন্দন যখন রক্তমাখা টাকার বাণ্ডিলটি উঠাইতেছিল, ঠিক সেই সময় লোটন এক লম্ফে আসিয়া ধৃতিকান্তর হস্তধৃত পিস্তলটি ছিনাইয়া লইয়া কহিল, যা করণীয় ছিল; করা হয়েছে। বেইজ্জতির বদলা নিয়েছেন। এখন একে আমার হাতে ছেড়ে দিন।

রেশমি ভয়ে আর্তনাদ করিয়া উঠিল।

ধৃতিকান্ত আশ্চর্যান্বিত চক্ষে লোটনের পানে তাকাইলেন।

ঠিক সেইমুহূর্তে রঘুনন্দন ধৃতিকান্তর প্রতি ধাইয়া আসিল।

লোটন মুহূর্তমধ্যে তাহার পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইবার জন্য ছুটিয়া গেল কিন্তু তাহার পূর্বেই ধৃতিকান্ত নিজেই রঘুনন্দনের দিকে আগাইয়া আসিয়া অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতার সহিত রঘুনন্দনের তলপেটে সজোরে একটি পদাঘাত করিলেন।

রেশমি বিস্ময়ে হতবাক হইয়া আবারও ভাবিতে লাগিল যে, এত জোর, এত শক্তি এই মুমূর্ষ লোকটির মধ্যে আসিল কীরূপে? কোথা হইতে আসিল?

ধৃতিকান্ত লোটনকে নাম ধরিয়া না ডাকিয়া কহিলেন, এবারে চলো। আমার কাজ শেষ!

রঘুনন্দন কহিল, আমার সঙ্গে শত্রুতা করলে বাঙ্গালিয়াবাবু এর দাম দিতে কিন্তু তুমি দেউলে হয়ে যাবে।

ধৃতিকান্ত হাসিলেন। কহিলেন, জানি। কিন্তু তাতে তোমার আজকের এই কুকুরের মতো অপমান মুছে যাবে না। তুমি যদি মানুষ হও রঘুনন্দন, যদি সত্যিকারের জানোয়ার না হও, তাহলে আমাদের এই পুরুষদের কাজিয়াতে রেশমিকে আর জড়িয়ে না কখনো। ও আওরত। বদলা নিতে হয় যদি, নিতে পারো; তাহলে আমার উপরেই নিয়ো। রেশমিকে ওর ইজ্জত নিয়ে বাঁচতে দিয়ো।

রঘুনন্দন কোনো কথা কহিল না।

লোটন কহিল, কী হল? এর উত্তর পাওয়া আমার দরকার। এই উত্তরের ওপর তোমার জীবন নির্ভর করছে রঘুনন্দন। যদি এই কথা এক্ষুনি না মানো, মরদের বাচ্চার মতো যদি জবান না দাও এই ব্যাপারে, তাহলে পিস্তল আমি ওঁকে আবার ফিরিয়ে দেব। তারপর তোমাকে নিয়ে যাব ডিজেল লোকোমোটিভ ওয়ার্কাস-এর ময়দানে। ভেবে বলল।

রঘুনন্দন রেশমির প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। সে চাহনিতে কোনো বিদ্বেষ ছিল না, কিন্তু বেদনা ছিল বলিয়াই বোধ হইল ধৃতিকান্তর।

পাঠক! কে বলিতে পারে? রঘুনন্দন হয়তো রেশমিকে সত্যসত্যই ভালোবাসিত। এ সংসারে সকলের ভালোবাসার প্রকাশ তো একরূপ নয়! সকলেই কিছু রুচিসম্মত ও ভদ্র শিষ্টভাবে ভালোবাসিতে জানে না। হয়তো রঘুনন্দনের ভালোবাসার প্রকাশটাই জঘন্য। হয়তো রেশমিকে তীব্রভাবে ভালোবাসিয়াও তাহার শরীর অথবা মন কিছুই না পাইয়া রেশমির উপর তাহার স্থূল বুদ্ধি অনুসারে সে প্রতিশোধ লইয়াছিল। সে জানোয়ার হইতে পারে, কিন্তু জানোয়ারেরাও তো ভালোবাসে–তাহারাও তো ভালোবাসা চায়।

রঘুনন্দন রেশমির প্রতি পুনরায় চক্ষু তুলিয়া চাহিল। আধা জমাট বাঁধা রক্তে চক্ষু তাহার বুজিয়া গিয়াছে।

রঘুনন্দন স্থির, নিষ্কম্প কণ্ঠে কহিল, তোমার কোনো ক্ষতি আমার দ্বারা হবে না রেশমি। তোমাকে আমি ভালোবাসি।

লোটন পশ্চাৎ হইতে তাহার উপর ঝাঁপাইয়া পড়িয়া কহিল, ভালোবাসি! ভালোবাসার আর জায়গা পেলে না?

রঘুনন্দন জবাব দিল না।

ধৃতিকান্তর হঠাৎ মনে হইল যে, রঘুনন্দনের চক্ষু বাহিয়া শুধু রক্তই নহে, কিঞ্চিৎ অশ্রুও যেন গড়াইয়া পড়িল।

আশ্চর্য! কতরকম মনুষ্যই-না সংসারে দেখা যায়।

স্কুল কদাকার শরীর, কদর্য রুচিসম্পন্ন রক্তাক্ত রঘুনন্দন সিঁড়ি বাহিয়া টলিতে টলিতে অবতরণ করিতে করিতে ভাবিতে লাগিল যে, রেশমিকে সে যথার্থই ভালোবাসিয়াছিল কিন্তু তাহার প্রতি ঘৃণা ব্যতীত রেশমির আর কিছুই দেয় ছিল না। কিন্তু অপর পক্ষের সাড়া না মিলিলেও তাহার নিকট হইতে কিছুমাত্র উৎসাহ না পাইয়াও তো কেহ কাহাকে এক তরফের ভালোবাসা বাসিতেও পারে। রঘুনন্দন রক্তাপ্লুত অবস্থায় তাহার সমস্ত বুদ্ধি জড়ো করিয়াও বুঝিতে পারিল না যে, কাহাকে ভালোবাসিবার শাস্তি এইরূপ হয় কেন? তাহার সেই মুহূর্তের জানোয়ারসুলভ স্থূল অন্তরের বেদনা তাহার সমস্ত শারীরিক বেদনাকে ছাপাইয়া ফেলিল।

রঘুনন্দনকে তাহার বাটীর নিকটস্থ সেই ঘোর-নিমের ছায়ায় নামাইয়া দিয়া ধৃতিকান্ত কহিলেন, এক্ষুনি ডাক্তার ডেকে চিকিৎসা করাও। নইলে মাথার ক্ষত বিপদ ডেকে আনতে পারে।

অপস্রিয়মাণ গাড়িটির পশ্চাতের লাল আলো মিলাইয়া যাইতে দেখিতে দেখিতে রঘুনন্দন ভাবিল, রেশমির এই বাঙ্গালিয়া রিস্তাদার বড়োই রহস্যময় ব্যক্তি। ক্ষতর সৃষ্টি করিতেও তাহার দ্বিধা হইল না, আবার ক্ষতর চিকিৎসার জন্য চিন্তান্বিত হইতেও বিলম্ব হইল না।

.

০৮.

অদ্য দেওয়ালি।

বারাণসীর প্রতি গৃহে-গৃহে আজ আলোকসজ্জা। কক্ষে কক্ষে তিনপাত্তি খেলিবার ধুম পড়িয়া গিয়াছে। আকাশে নানারূপ আতশবাজির কারসাজি। চতুর্দিকে দুমদাম শব্দে কর্ণে তালা ধরাইয়া পটকা ফাটিতেছে। ধৃতিকান্ত গোধূলিয়ার বাঁকের দিকে চলিয়াছেন একটি সাইকেলরিকশা চড়িয়া, উদ্দেশ্য তাম্বুল সেবন করা এবং কচুরিগলি হইতে অদ্য সত্যসত্যই রেশমির নিমিত্ত রাবড়ি লইয়া যাওয়া।

রঘুনন্দনকে নামাইয়া দিয়া সেইদিন যখন ধৃতিকান্ত মাহমুরগঞ্জে ফিরিয়া ছিলেন তখন রেশমি কাঁদিয়া কাটিয়া তাঁহাকে অনেক অনুযোগ করিয়াছিল। কহিয়াছিল, তোমার কী দরকার ছিল গুণ্ডা বদমায়েশদের সঙ্গে মারামারি করার। আমার ইজ্জত-এর কথা আমি বুঝতাম। ঘরের বউয়ের ইজ্জত আর তওয়ায়েফের ইজ্জত তো একরকম হয় না। আমার জন্য তুমি নিজে এতবড়ো ঝুঁকি নিতে গেলে কেন?

ধৃতিকান্ত হাসিয়া কহিয়াছিলেন, একমাত্র তোমার জন্যই তো ঝুঁকি নেওয়া যায়। একমাত্র তুমিই তো আমার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে রইলে। তোমার বুকে যতটুকু ভালোবাসা ছিল, সব তো একমাত্র আমাকেই নিংড়ে দিলে। অন্য কেউই তো আমার হাতে তাদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য তাদের মান-অপমান তোমার মতো এমন নিঃশেষে তুলে দেয়নি। আমি চাইলেও দেয়নি। আমার ওপর তুমি ছাড়া আর কারুর-ই ভরসা ছিল না এককণা। তোমার জন্য ঝুঁকি নেব না তো কার জন্য নেব বলো?

রেশমি খুব-ই উত্তেজিত ও চিন্তিত হইয়াছিল।

শুধাইয়াছিল, তোমাকে রঘুনন্দন যদি কিছু করে?

করলে করবে। ধৃতিকান্ত সহজভাবে কহিয়াছিলেন।

তাহার পর কহিয়াছিলেন, তুমি ছাড়া এই মুহূর্তে আমার হারাবার মতো আর কিছুই তো অবশিষ্ট নেই। না হয় তোমার কারণেই তোমাকে হারাব। এতে দুঃখের কী আছে? তা ছাড়া যেভাবে বেঁচে আছি তার চেয়ে রঘুনন্দন যদি তাড়াতাড়ি বৈতরণী পার করাবার বন্দোবস্ত করে তাহলে তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমার জন্য ভেবো না। আমার জন্য এমন করে ভেবে এই প্রয়োজনহীন জীবনটার প্রতি মিথ্যে মমত্ববোধ বাড়িয়ে দিয়ো না। তাহলে মরবার সময়ে বড়োকষ্ট পাব।

রেশমি ধমকাইয়া কহিয়াছিল, তুমি কি চুপ করবে?

গোধূলিয়ার বাঁকের আলো ও পুলিশচৌকি দেখা যাইতেছে। আর একটু আগাইলেই ধৃতিকান্তর সেই পরিচিত পানের দোকানির দেওয়াল-বিস্তৃত আরশি চক্ষে চমকাইবে।

ক্যাঁচোর-কোঁচোর শব্দে রিকশা চলিতেছে–লোকজন, নানারূপ যানবাহনের ভিড় ঠেলিয়া।

এমন সময়ে অকস্মাৎ রিকশাটিকে প্রায় ধাক্কা মারিয়া একটি জিপগাড়ি রিকশাটিকে অতিক্রম করিয়া গিয়া রিকশার সম্মুখে ব্রেক কষিয়া দাঁড়াইল।

ধৃতিকান্ত দেখিলেন যে, মস্তকে পট্টি লাগানো রঘুনন্দন ও চারিপাঁচজন লোক তাঁহার রিকশা ঘিরিয়া ফেলিয়াছে।

রঘুনন্দন জিপ হইতে অবতরণ করিয়া হাতজোড় করিয়া ধৃতিকান্তকে কহিল, দিওয়ালি মুবারক।

পথবাহিত জনস্রোত ও অন্যান্য যানবাহনের মধ্যে এই প্রীতি বিনিময়ের ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিক বলিয়াই প্রতিপন্ন হইল। কাহারও কোনোই সন্দেহের উদ্রেক হইল না।

ধৃতিকান্ত কিছু বুঝিবার পূর্বেই তাঁহাকে জিপগাড়ির পশ্চাতে গিয়া উঠিতে হইল। উহাদের মধ্যেই কেহ রিকশাওয়ালাকে পাওনা মিটাইয়া দিল, যাহাতে তাহার চিত্তেও কোনোরূপ সন্দেহের উদ্রেক না হয়।

পথে বিশেষ কথাবার্তা হইল না। ধৃতিকান্তকে দুইপার্শ্ব হইতে দুইজন বলিষ্ঠ গুণ্ডা প্রকৃতির লোক চাপিয়া বসিয়াছিল। ধৃতিকান্ত পলাইবার বা বাধা দিবার চেষ্টমাত্র না করিয়া যাহা প্রত্যাশা করিয়াছিলেন, সেই পূর্বনির্ধারিত অন্তিম সময়ের অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। বাঁচিবার এবং আরও দীর্ঘকাল বাঁচিয়া থাকিবার কোনোরূপ স্পৃহা তাঁহার ছিল না। বরঞ্চ মনের অভ্যন্তরে রঘুনন্দনের প্রতি এক দুর্বোধ্য কৃতজ্ঞতাবোধ করিতেছিলেন তিনি।

জিপ গোধূলির মোড় পার হইয়া দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে চলিল। ঘাটে দেওয়ালির রাত্রে বেশ ভিড়। অনেকে জলে প্রদীপ ভাসাইতেছেন, মৃত আত্মীয় পরিজন ও জীবিতদের মঙ্গলকামনায়। ঘাটে যাঁহারা ছিলেন, তাঁহারা সকলেই নিজ-নিজ কর্মে ব্যস্ত! জলপুলিশ নৌকায় টহল দিতেছে। কিন্তু কাহারও কোনো সন্দেহ হইল না। ধৃতিকান্তও কাহারও মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কিছুমাত্র চেষ্টা করিলেন না।

বোধ হয় পূর্ব হইতেই নৌকা ঠিক করা ছিল। নৌকার মাঝিরা ইহাদের দেখিয়াই নৌকা ত্যাগ করিয়া তীরে উঠিয়া আসিল। রঘুনন্দনের দলের দুইজনে দাঁড় লইয়া বসিল, একজন হালে।

রঘুনন্দন আর ধৃতিকান্ত সামনাসামনি বসিলেন।

নৌকা ছাড়িয়া দিল।

উত্তরবাহিনী গঙ্গার জল ছলাৎছলাৎ শব্দে নৌকার গায়ে আসিয়া লাগিতেছিল। শীতের দক্ষিণাভিমুখী হাওয়ায় জলের উপর প্রচন্ড শীত লাগিতেছিল। ধৃতিকান্ত তাঁহার চাদর মুড়িয়া সেই হিমেল হাওয়া হইতে বাঁচিবার জন্য গা-ঢাকিয়া বসিলেন। যতক্ষণ বাঁচেন, ভালো করিয়াই বাঁচা উচিত।

ভালো করিয়া বাঁচা হইল না বলিয়াই তো মরিতে তাঁহার বিন্দুমাত্র খেদ নাই।

রঘুনন্দন কহিলেন, কিছু বলবে বাঙ্গালিয়াবাবু?

ধৃতিকান্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে কহিলেন, কী বলব? কিছুই বলার নেই।

–প্রাণভিক্ষা করবে না?

রঘুনন্দন ঠাট্টার স্বরে শুধাইল।

–…নাঃ।

ধৃতিকান্ত পুনরায় সহজকণ্ঠে কহিলেন।

জন্ম হইতে এতাবৎকাল কাহারও নিকট হইতে কিছুমাত্র ভিক্ষা করেন নাই, তাই এই শেষসময়ে রঘুনন্দনের নিকট হইতে কিছু ভিক্ষা মাগিতে তাঁহার সম্ভ্রমে বাধিল। ভিক্ষা জীবনে তিনি মাত্র একজনের নিকট হইতেই চাহিয়াছিলেন, ভিক্ষা চাহিয়া, তাহা না পাওয়ার গ্লানি যে, কী তাহা তিনি ভালোরূপেই জানেন। সেই গ্লানির কথা মনে পড়ায় নিজের প্রাণভিক্ষা করিতেও তাঁহার প্রবৃত্তি হইল না।

তীর হইতে পটকার শব্দ জলের উপর দিয়া ভাসিয়া আসিতেছিল। অদ্য চতুর্দিকেই দুমদাম আওয়াজ। তন্মধ্যে রঘুনন্দনের রিভলবারের শব্দ কাহারও বিস্ময় বা দৃষ্টি আকর্ষণ করিবে না। এই দেওয়ালির দিনে হয়তো সে-কারণেই পূর্ব হইতে সমস্ত কিছু পরিকল্পনা করিয়া রঘুনন্দন বদলা লইতে আসিয়াছে।

নদীর অপর পারের বিস্তীর্ণ তীরকে অন্ধকার রাত্রিতে অন্ধকারতর যমসদৃশ যবনিকার ন্যায় দেখাইতেছিল।

নৌকা মাঝ-নদীতে আসিয়া উপস্থিত হইল।

রঘুনন্দন কহিল, তোমাকে আমার একটা কথা বলার ছিল।

কী? সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন করিলেন ধৃতিকান্ত। বিরক্ত ও নিস্পৃহ কণ্ঠে।

-তোমাকে কেন মারছি জান?

–জানি।

-কেন?

–তোমার সেদিনকার অপমানের শোধ তোলার জন্য।

রঘুনন্দন হাসিয়া উঠিল।

তাহার মেদবহুল শরীরে সেই হাসি তরঙ্গ তুলিল।

রঘুনন্দন কহিল, না সেজন্য নয়।

তাহার পর একটু থামিয়া কহিল, আমি যাকে আজ কুড়ি বছর ধরে ভালোবেসে আসছি, যাকে পাবার জন্য করিনি এমন কিছু নেই; সেই রেশমি তোমাকে সব দিয়ে বসে আছে। বদলাটা সেদিনের মারধরের নয়। বদলাটা এইজন্য। তোমার মধ্যে কী-এমন আছে, যা আমার নেই, তা তোমাকে মেরে ফেলে কেটে কুটে আমার দেখতে বড়ো ইচ্ছা হয়। লাশ কাটা ঘরে ফেলে তোমাকে চিরে-চিরে দেখতে ইচ্ছা করে।

ধৃতিকান্ত কিঞ্চিৎ ভাবিয়া কহিলেন, যোগ্যতা’র বিচার করে কেউ কাউকে কি কখনো ভালোবাসে রঘুনন্দন? ভালোবেসে ফেলে কেউ কাউকে। ভালো লেগে যায় এই-ই!

কিঞ্চিৎ থামিয়া কহিলেন, এই ভালোবাসা ব্যাপারটা যুক্তি, তর্ক, মারামারির নয়। এ বরাতের ব্যাপার। আমারও হাত নেই; তোমারও না।

বলিয়াই ভাবিলেন, এইসব ইহাকে বলিয়া লাভ কী? এই রঘুনন্দন এসবের মূল্য বা অর্থ কী বুঝিবে?

কিন্তু ধৃতিকান্ত যাহা বলিলেন, তাহা রঘুনন্দনকে ভাবিত করিয়া তুলিল বলিয়া ধৃতিকান্তর ধারণা হইল। এমন কথা এ-জীবনে এমন করিয়া কেহই বোধ করি আর তাহাকে বলে নাই।

রঘুনন্দনের অনুচরেরা কহিল, ওস্তাদ আর দেরি নয়। মাঝনদীতে নৌকো দেখলেই জল পুলিশের নৌকো এসে পড়তে পারে।

রঘুনন্দন ঘোর কাটাইয়া উঠিয়া কহিল, ঠিক, আর দেরি নয়।

তাহার পর কহিল, তোমার রেশমির মুখ শেষবারের মতো মনে করো বাঙ্গালিয়াবাবু। সেই মুখের জলছবি তোমার সঙ্গে সেঁটে স্বর্গে যাবে।

একটি মুখ মনে সত্যই করিলেন ধৃতিকান্ত, কিন্তু সে মুখ রেশমির নহে। উজ্জ্বল চক্ষুবিশিষ্ট অতিসাধারণ এক বাঙালিনির কালো নরম মুখটি, এই সমস্ত কালো পটভূমির কালিমা মুছিয়া দিয়া সন্ধ্যাতারার প্রসন্নস্নিগ্ধ দ্যুতিতে ধৃতিকান্তর সমস্ত চিত্তাকাশ জুড়িয়া জ্বলজ্বল করিতে লাগিল। তাঁহার নাসারন্ধ্রে কোথা হইতে রাশ-রাশ বকুলফুলের গন্ধ ভাসিয়া আসিল।

ঠিক এমত সময় ঝমঝম শব্দে ‘দিল্লি-কালকা’ মেলটি মোগলসরাইয়ের ব্রিজের উপর দিয়া কলিকাতা অভিমুখে আলো জ্বালাইয়া বাঁশি বাজাইয়া ছুটিয়া চলিতেছিল।

গুমম-ম-ম করিয়া রিভলবারের গুলি ছুটিবার শব্দ হইল।

ধৃতিকান্তর চক্ষে শেষবারের ন্যায় কলিকাতাগামী সেই আলোকিত ট্রেনটির সমস্ত কামরার আলো কয়টি একইসঙ্গে জ্বলিয়া উঠিয়াই পরমুহূর্তে নিভিয়া গেল।

রঘুনন্দনের যে-অনুচর হাল ধরিয়া বসিয়াছিল, সে কহিল, ওস্তাদ শত্রুর শেষ রাখতে নেই। আরও একটা লাগাও। যদি কোনোক্রমে বেঁচে যায়।

রঘুনন্দন জানিত, অর্ধহস্ত দূর হইতে রিভলবারের গুলি কাহারও বক্ষে লাগিলে, সে কখনোই বাঁচে না, তবুও রঘুনন্দন অর্ধশায়ীন গুলিবিদ্ধ ধৃতিকান্তর কপাল লক্ষ্য করিয়া আরও একটি গুলি করিল।

ধৃতিকান্তর কপালে কে যেন টিপ পরাইয়া দিল।

গলগল করিয়া ললাট ও নাসিকা বাহিয়া উষ্ণ রক্ত বাহির হইয়া আসিতে লাগিল।

গুলির শব্দ, রেলগাড়ির শব্দে একাকার হইয়া অন্ধকারে জলের উপর দিয়া কোন দূর দূরান্তরে কাঁপিতে-কাঁপিতে ভাসিয়া যাইতে লাগিল।

রঘুনন্দনের অনুচরেরা ধৃতিকান্তর পদযুগল ধরিয়া তাঁহাকে সজোরে এবং দূরে নিক্ষেপ করিল, যাহাতে নৌকামধ্যে রক্তবিশেষ না পড়িতে পায়। তাহার পর যেটুকু রক্ত পাটাতনে পড়িয়াছিল তাহারা তাহা আঁজলা ভরিয়া জল লইয়া নিশ্চিহ্ন করিয়া ধুইয়া ফেলিল।

রঘুনন্দন ধৃতিকান্তর ধুলা-মলিন ও ক্ষয়প্রাপ্ত চটি-জোড়াও জলে নিক্ষেপ করিল।

সঙ্গে সঙ্গে রূপ-রস-গন্ধ স্পর্শ-শব্দভরা পৃথিবী হইতে ‘ধৃতিকান্ত’ নামক এক ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের মনুষ্যটিরও আর কোনো চিহ্নমাত্রই অবশিষ্ট রইল না। এমনকী তাঁহার কোনো চিতাভস্ম অথবা কবরও এই ধরিত্রীর মৃত্তিকাতে রহিল না যে, ভুলক্রমে কেহ তাহাকে স্মরণ করিতে চাহিলেও স্মরণ করিতে পারিবে। কৃষ্ণবর্ণ অমাবস্যার রাত্রি সাক্ষী রহিল, নক্ষত্র-খচিত আকাশ সাক্ষী রহিল; উত্তরবাহিনী গঙ্গাই শুধুমাত্র ধৃতিকান্তর নিশ্চিহ্ন হইবার সাক্ষী রহিল।

শীতল জলরাশি মুহূর্তমধ্যে ধৃতিকান্তর রক্তাক্ত শবকে গ্রাস করিয়া লইল। এই জলেই একদিন এই শব ফুলিয়া, পচিয়া, গলিয়া এই জলমধ্যেই বিলীন হইয়া যাইবে, যদি না, মৎস্য ও কুম্ভীরে তাঁহার শরীরকে টুকরা-টুকরা ছিন্ন-ভিন্ন করিয়া খাইয়া ফেলে।

পূর্বে আলো ফুটিয়াছে। শিউপ্রসাদজির নিকট যে-যুবকটি নাড়া বাঁধিয়াছিল, সে তম্বুরা সহযোগে ভৈরবীতে আলাপ করিতেছে। ভৈরবীর কোমল রেখাব ও কোমল গান্ধারের স্বর কী এক বিষণ্ণ সুরে প্রভাতের মাহমুরগঞ্জের আকাশ-বাতাস ভরিয়া তুলিয়াছে।

দেওয়ালির রাত্রি শেষ হইয়াছে। প্রভাতে হিমে পোড়া বারুদ আতশবাজি এবং তিনপাত্তির হার জিতের মালা কেহ বা কিছু জিতিয়াছে; কেহ বা হারিয়াছে।

কিন্তু রেশমির ন্যায় এরূপ সর্বস্বান্ত বোধ করি গতরাত্রে আর কেহই হয় নাই।

সমস্ত রাত্রি রেশমি ঘুমাইতে পারে নাই। পরিচিত, অর্ধপরিচিত সমস্ত লোকের নিকট বারংবার মুরতেজাকে পাঠাইয়াছে। তথাপি ধৃতিকান্তর সংবাদ মিলে নাই।

অদ্য রেশমির সময় হয় নাই চবুতরার কবুতরদিগের জন্য ধান্য ছিটাইবার। ভুলিয়াও গিয়াছিল সে। কিন্তু দাসী ভোলে নাই। সে ধামা লইয়া গিয়া ধান্য ছিটাইয়া দিল বাঁধানো চত্বরের-চবুতরায়।

একে-একে সব কয়টি কবুতর ডানা মেলিয়া উড়িয়া আসিল। তাহার পর ‘বকম-বকম’ রবে গ্রীবা ফুলাইয়া, চক্ষু ঘুরাইয়া ধান্য খুঁটিয়া খাইতে লাগিল।

নিদ্রাহীন ক্রন্দনকাতর চক্ষে কবুতরগুলির পানে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে অকস্মাৎ তীক্ষ্ণফলার ন্যায় সুতীব্র কোনো বেদনা রেশমিকে আমূল বিদ্ধ করিল। সে নিশ্চিত বুঝিতে পারিল যে, তাহার বড়ো সোহাগের কবুতরটি আর কোনো দিনও রেশমির খুশি-ভরা প্রেমকাতর চক্ষের সম্মুখে ঘুরিয়া-ফিরিয়া কোনো কিছুই খুঁটিয়া খাইবে না। রেশমির অন্তরমধ্যস্থ নির্জন চবুতরায় বিচরণকারী সেই কবুতরটি অমাবস্যার নিকষ-কালো অন্ধকারে কোথায় না-জানি চিরতরে নিরুদ্দেশ হইয়া গিয়াছে।

এ-সংসারে আপনার বলিতে ধৃতিকান্তর কেহই ছিলেন না। যাঁহারা ছিলেন, তাঁহারা কেহই তাঁহাকে আপনজন বলিয়া স্বীকার করেন নাই। সে ত্রুটি ধৃতিকান্তর অথবা তাঁহাদের; তাহা বিচার করিয়া লাভও আজ আর কিছুই নাই।

পাঠক! যদি কখনো বারাণসীতে যাওয়া হইয়া উঠে, এবং যদি অবকাশ ঘটে, তাহা হইলে দশাশ্বমেধ ঘাটে একটি প্রদীপ জ্বালাইয়া ধৃতিকান্তর উদ্দেশ্যে গঙ্গাবক্ষে ভাসাইয়া দিবেন। সেই দুঃখী কাঙাল মানুষটির আত্মা যেখানেই থাকুক না কেন, ইহা জ্ঞাত হইয়া সেই আত্মা নিশ্চয়ই শান্তি লাভ করিবে যে, আপনজনে তাহাকে পর করিলেও যাঁহারা তাহার আপনজন নহেন, তাহাদিগের মধ্যে কেহ তাঁহাকে ‘আপন’ জ্ঞান করিয়াছিলেন।

ইহা জানিয়াও সেই আত্মা তৃপ্ত হইবে যে, তাহার অতৃপ্ত ইহজীবনে, যাহাকে তিনি ভালোবাসিয়াছিলেন, তাহার ভালোবাসা তিনি পান নাই সত্য, কিন্তু যাহাদের তিনি ভালোবাসিবার বা জানিবার সুযোগমাত্রও পান নাই, তাহাদিগের অনেকের ভালোবাসার ও সমবেদনার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তিতে তাহার পরজীবন এই পরমপূর্ণতায় অভিষিক্ত হইয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *