৭-৮. পেয়ারা গাছের নিচে

সকালবেলা আমরা পেয়ারা গাছের নিচে আমি টিটন আর চঞ্চল একত্র হয়েছি। অনু এখনো আসেনি সে সবসময়ই দেরি করে আসে। মোটাসোটা মানুষেরা মনে হয় সবকিছুই আস্তে ধীরে করে। অনু পৌঁছলেই রওনা দিয়ে দেব, তার জন্যে অপেক্ষা করছি। এতো সকালে কোথায় যাই সেটা নিয়ে আমাদের বাসায় কেউ তেমন কিছু বলেনি। আগেও এরকম অনেকবার হয়েছে–বাসার সবাই মেনে নিয়েছে যে আমরা মাঝে মাঝে এরকম ছোটখাট পাগলামি করি। আমাদের বাসায় শুধু মিথিলা খুব ভোরে উঠে জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া, কই যাও?”

আমি আমার অভ্যাস মতো খেঁকিয়ে উঠলাম, “সেটা তোর জানার দরকার কী?”

ভেবেছিলাম আমার ধমক খেয়ে মিথিলা নাকি সুরে আম্মুকে নালিশ করে দেবে, আম্মু দেখো, ভাইয়া আঁমাকে বাঁকা দিচ্ছে কিন্তু কী কারণ কে জানে, সে নালিশ করল না। শুধু যে নালিশ করল না তা না–মনে হল একটু মিচকি হাসি দিল! কেন নালিশ না করে মিচকি হাসি দিল আমি এখন আর সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না।

অনু কেন এতো দেরি করে আসছে আমরা যখন সেটা নিয়ে তাকে বকাবকি করছি তখন দেখলাম সে হেলতে দুলতে আসছে। পিঠে বিশাল ব্যাকপেক। হাতে একটা খাঁচা সেখানে সাদা রঙের একটা কবুতর। আমরা গরম হয়ে বললাম, “এতো দেরি করে এসেছিস কেন?”

অনু আরো গরম হয়ে বলল, “সকালবেলা খাঁচার ভিতর একটা কবুতর হাতে নিয়ে রওনা হয়ে দেখ সকাল সকাল আসতে পারিস কি না। হেন-ত্যাননা একশটা প্রশ্ন।”

“তুই কী বলেছিস?”

“বলেছি আমরা কবুতরের পায়ে লাগিয়ে চিঠি পাঠানো যায় কি না সেটা পরীক্ষা করার জন্যে নিয়ে যাচ্ছি।”

চঞ্চল বলল, “ভেরি গুড। খুবই ভালো উত্তর দিয়েছিস।”

টিটন বলল, “অনুর মতো বানিয়ে বানিয়ে আর কেউ বলতে পারে না। মনে নাই, সেই দিন ব্যাঙের ছাতার গল্পটা বলেছিল?”

আমি বললাম, “বড় হয়ে লেখক হবে তো, সেই জন্যে এখন থেকেই গুলপট্টি মারা প্র্যাকটিস করছে।”

চঞ্চল বলল, “আয় রওনা দেই।”

“চল।” আমরা রওনা দিলাম।

আমরা ভয়ে ভয়ে ছিলাম যে, মিশকাত মঞ্জিলে গিয়ে যদি দেখি ফুটকি জিব মানিক আর তার ওস্তাদ মিঃ পাহাড় ঘোরাঘুরি করছে, তা হলে একটা মহা ঝামেলা হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের কপাল ভালো এতো সকালে সেখানে কেউ নাই, শুধু পাখিগুলো কিচিরমিচির করছে। আমরা তাড়াতাড়ি গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় আমাদের ঘরটাতে ঢুকে গেলাম। আমরা ব্যাকপেকগুলো পিঠ থেকে খুলে নিচে রেখে দিই, টিটন আগাছার মাঝে লুকিয়ে রাখা শাবলটা বের করে আনল।

আমি বললাম, “মনে আছে ঐ দিন একটা বেজি বের হয়েছিল? ভিতরে বেজি থাকে মনে হয়।”

চঞ্চল বলল, “হ্যাঁ।”

“আজকেও যদি ভেতরে থাকে?”

“যদি একটু শব্দ করি তা হলেই পালিয়ে যাবে।”

আমরা শাবল দিয়ে দেয়ালে এখানে সেখানে ঘা দিলাম তখন সত্যি সত্যি প্রথমে একটা বড় বেজি তারপর দুইটা ছোট বেজি গর্ত দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে গেল। অনু বলল, “বেজি পরিবার সুখী পরিবার।”

চঞ্চল বলল, “আহা বেচারা, আমরা তাদের বাড়িটা নষ্ট করে ফেলব। এখন আর সুখী পরিবার থাকবে না।”

আমি বললাম, “এখানে অনেক জায়গা আছে, বেজি পরিবার থাকার জন্যে অনেক জায়গা পেয়ে যাবে।”

টিটন জিজ্ঞেস করল, “আমরা কোথায় গর্তটা করব?”

চঞ্চল বলল, “যেখানে ছোট গর্তটা আছে সেখান দিয়েই শুরু করি।”

টিটন তখন শাবলটা দিয়ে সেখানে জোরে একটা ঘা দিল, সাথে সাথে একটা ইট খুলে এলো। তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা। দেখতে দেখতে একজন মানুষের ঢোকার মতো একটা গর্ত হয়ে গেল। চঞ্চল হাত তুলে বলল, “এখন থাম।”

অনু ইতস্তত করে বলল, “গর্তটা আরেকটু বড় কর।”

আমাদের মনে পড়ল অনু আমাদের তুলনায় বেশ নাদুস-নুদুস-আমরা ঢুকে যেতে পারলেও সে আটকে যাবে। টিটন তখন দুই পাশ থেকে আরো দুটি ইট খুলে ফেলল।

চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “কে আগে ঢুকবি?” টিটন বলল, “আমি। আমার কাছে তাবিজ আছে, আমার কোনো ভয় নাই।”

আমি অনু আর চঞ্চল একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম, টিটন যদি তার তাবিজের রহস্যটা জানত তা হলে সে কী করত কে জানে!

চঞ্চল বলল, “ঠিক আছে, তুই আগে ঢোক। তোর ব্যাগটা বাইরে থাকুক। টর্চ লাইটটা নিয়ে যা, ভেতরে গিয়ে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে চারদিক দেখে আমাদের জানা। যদি অস্বাভাবিক কিছু দেখিস তা হলে বের হয়ে আসবি।”

টিটন বলল, ঠিক আছে। তারপর তার হাতে বাঁধা তাবিজটা একবার চুমু দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী অবস্থা? ভিতরে কিছু আছে?”

টিটন বলল, “মাকড়শার জাল। আর বোঁটকা গন্ধ।”

“আর কিছু?”

“মাটিতে গাছ পাতা, মনে হয় এটা বেজির বাসা।”

“আর কিছু?”

“দুইটা বাদুর উড়ছে।”

চঞ্চল বলল, সাবধান, “বাদুর যেন না কামড়ায়। বাদুরের মাঝে র‍্যাবিজ ভাইরাস থাকে।”

“আমাকে কামড়াবে না। আমার তাবিজ আছে।”

“বাদুর তো জানে না, তোর তাবিজ আছে।”

আমি জিজ্ঞেস করলামম, ”ভিতরে আর কী আছে?”

“সামনে একটা ঘোরানো সিঁড়ি। নিচে নেমে গেছে।”

চঞ্চল বলল, “গুড। আগে তোর ব্যাগটা ভিতরে ঢুকিয়ে দিই। নে ধর।”

আমরা ঠেলে টিটনের ব্যাগটা ঢুকিয়ে দিলাম।

আমি বললাম, “এবারে আমি ঢুকি?”

“ঠিক আছে।”

আমি প্রথমে আমার ব্যাগটা ঠেলে ভিতরে ঢুকিয়ে নিজে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেলাম। টিটন ঠিকই বলেছে ভেতরে একটা বোটকা গন্ধ। কীসের গন্ধ কে জানে। আমি টর্চ লাইট জ্বালিয়ে একটু এগিয়ে সিঁড়িটার দিকে তাকালাম। একটা লোহার সিঁড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নিচে নেমে গেছে। নিচে অন্ধকার, কী আছে দেখা যায় না।

আমি আর টিটন যখন টর্চ লাইট জ্বালিয়ে নিচে নেমে যাওয়া সিঁড়িটার দিকে তাকালাম-একটা লোহার সিঁড়ি পেঁচিয়ে নিচে নেমে গেছে। নিচে অন্ধকার, কী আছে দেখা যায় না।

আমি আর টিটন যখন টর্চ লাইট জ্বালিয়ে নিচে নেমে যাওয়া সিঁড়িটা দেখছি তখন ছোট গর্তটা দিয়ে প্রথমে কবুতর আর দুটি ব্যাগ ঢুকিয়ে দিল তারপর অনু আর চঞ্চলও ঢুকে গেল। আমরা চারজন এখন গাদাগাদি করে ছোট একটা ঘরে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সবার হাতেই একটা করে টর্চ লাইট, ছোট ঘরটাকে সেটা বেশ ভালোভাবে আলোকিত করে রেখেছে। বাদুরগুলো আলোর কারণে খুবই ঝামেলায় পড়েছে মনে হয়, খানিকক্ষণ উড়ে শেষে গর্ত দিয়ে বের হয়ে গেল।

চঞ্চল এবার তার কাজ শুরু করে দেয়। প্রথমে চিকন নাইলনের একটা দড়ি দিয়ে কবুতরের খাঁচাটাকে বাঁধল। তারপর সেই খাঁচাটা আস্তে আস্তে নিচে নামিয়ে দিতে থাকে। মাঝামাঝি যাবার পর হঠাৎ সেটা ডানা ঝাঁপটে ওঠে, আমরা সবাই চমকে উঠলাম। টিটন জিজ্ঞেস করল, “মরে গেছে না কি?”

আমি বললাম, “না।”

চঞ্চল আবার কবুতরটা নিচে নামাতে থাকে। সেটা আবার এক-দুইবার ডানা ঝাঁপটে উঠল, একবার মনে হয় ভয় পেয়ে একটু ডেকেও উঠল। কবুতরটা যখন একেবারে নিচে নামানো হল আমরা দেখলাম সেটা খাঁচার ভেতরে হাঁটাহাঁটি করছে। তার মানে এখানে বিষাক্ত কোনো গ্যাস নেই।

চঞ্চল বলল, “এবারে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে খুব আস্তে আস্তে নামাতে থাকি। যদি মিথেন গ্যাস থাকে তা হলে আগুন ধরে যাবে। তা হলে আমরা নিচে নামব না।”

আমরা মাথা নাড়লাম, বললাম, “ঠিক আছে।”

আমরা একটা বড় মোমবাতি জ্বালিয়ে তার মাঝখানে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিচে নামাতে শুরু করলাম। আমরা ভয়ে ভয়ে ছিলাম, হঠাৎ যদি ভক করে আগুন ধরে একটা বিস্ফোরণ হয় তা হলে আমরা কী করব? ঐ ছোট গর্ত দিয়ে হাচড়-পাঁচড় করে বের হতে পারব?

কিন্তু কোনো বিস্ফোরণ হল না, মোমবাতিটা বেশ ভালোভাবেই জ্বলতে লাগল। চঞ্চল তখন সন্তুষ্টির ভান করে বলল, “ঠিক আছে। কোনো সমস্যা নাই।”

আমি বললাম, “চল নামি।”

“চল।”

“কে আগে?”

টিটন বলল, “আমি।” তাবিজের কারণে এখন তার অনেক সাহস, অনেক মজা।

আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। প্রথমে টিটন তারপর চঞ্চল তারপর অনু সবার শেষে আমি। লোহায় মরচে ধরা সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সেটা অল্প অল্প দুলতে থাকে, হঠাৎ করে সেটা ভেঙে পড়বে কী না সেটা নিয়ে আমার একটু দুশ্চিন্তা লাগতে থাকে। সাবধানে আস্তে আস্তে পা ফেলে আমরা যখন মাঝামাঝি এসেছি তখন আমার হঠাৎ মনে হল আমি যেন একটা শব্দ শুনতে পেলাম। মনের ভুল মনে করে আরো দুই পা নামার পর আমি আবার সেই শব্দটা শুনলাম, হাততালি দেবার মতো শব্দ। আমি চাপা গলায় বললাম, “চুপ! সবাই চুপ!”

আমার গলার স্বরে নিশ্চয়ই কিছু একটা ছিল–একসাথে সবাই চুপ করে গেল। চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “কী?”

আমি কাঁপা গলায় বললাম, “একটা শব্দ।” আমার কথা শেষ হবার সাথে সাথে সেই হাততালি দেওয়ার মতো শব্দটা আবার শোনা গেল। আমরা সবাই তখন একসাথে চমকে উঠি।

চঞ্চল বলল, “সবাই টর্চ লাইট নিভিয়ে ফেল।”

কেন টর্চ লাইট নিভাতে হবে আমরা ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিন্তু সবাই নিভিয়ে ফেললাম। সাথে সাথে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে পুরোটুকু ঢেকে গেল।

আবার হাততালির শব্দ শুনতে পেলাম তার সাথে মেয়ে কণ্ঠে একটু কান্নার শব্দ। টিটন কাঁপা গলায় বলল, “ইয়া মাবুদ।”

আমরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকি তখন আবার কান্নার শব্দটা শুনতে পেলাম। আমাদের বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। আমার মনে হতে লাগল এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে প্যাঁচানো একটা লোহার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা আমরা চারজন ছাড়া আশে পাশে আরো কেউ আছে। আমরা তার কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, তার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।

হঠাৎ করে কে যেন খিলখিল করে হেসে উঠল, আর আমরা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম। আমরা স্পষ্ট শুনতে পেলাম খিলখিল করে হাসতে হাসতে কিছু একটা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, হঠাৎ করে লোহার সিঁড়িটা ঝনঝন শব্দ করে কাঁপতে থাকে। আমি ভয়ে চিৎকার করে আমার টর্চ লাইটটা জ্বালালাম এবং সাথে সাথে ভয়ংকর আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর জমে গেল।

বীভৎস কুৎসিত একটা মুখ লোহার সিঁড়িটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় চোখ, লাল ঠোঁটের ফাঁকে কালো জিব, লম্বা লম্বা দাঁত, মাথায় শনের মতো চুল। ভয়ংকর জীবটি খিলখিল করে হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এগোতে থাকে। আমি আতঙ্কে চিৎকার করে অনুর গায়ের ওপর দিয়েই নিচে নামার চেষ্টা করতে থাকি। টিটন আর চঞ্চলও সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাবার চেষ্টা করে, ভয়াবহ আতঙ্কে একটা ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়।

ঠিক তখন উপর থেকে খিলখিল করে হেসে একজন পরিষ্কার গলায় বলল, “কী হল? তোরা এতো ভয় পাচ্ছিস কেন?”

আমরা উপরে তাকালাম। টুনি উপরে দাঁড়িয়ে আছে, একটু আগে যে ভয়ংকর বীভৎস মুখটি দেখেছিলাম সেটা আসলে একটা মুখোশ, টুনি সেই মুখোশটা খুলে হাতে ধরে রেখেছে। শুধু টুনি নয় আমরা দেখলাম টুনির পিছনে মিথিলাও আছে। পাজী মেয়েটা মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হাসছে।

টুনির ওপর প্রচণ্ড রাগে আমাদের ফেটে পড়ার কথা ছিল কিন্তু আমরা কেউই রেগে উঠলাম না। এই ভয়ংকর আতঙ্কটা আসলে সত্যি নয় সেই জন্যেই আমরা সবাই টুনিকে মনে মনে মাফ করে দিয়েছি। কিন্তু সেটা তো আর বাইরে প্রকাশ করতে পারি না, তাই খুব রেগে যাবার ভান করে আমি বললাম, “এটা কী রকম ঠাট্টা?”

টুনি বলল, “আই অ্যাম সরি। এই দেখ আমি কান ধরছি-” সত্যি সত্যি সে নিজের কান ধরল তারপর মিথিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুইও ধর।” তখন মিথিলাও কান ধরল, তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আর কখনো এরকম করব না! মোটেও বুঝতে পারিনি তোরা এত ভয় পাবি।”

টিটন বলল, “ভয় পাবার কী আছে? আমার কাছে তাবিজ আছে না? হঠাৎ দেখে শুধু একটু চমকে উঠেছিলাম।” পরিষ্কার মিথ্যা কথা, আমরা সবাই যা ভয় পেয়েছিলাম সেটা আর বলার মতো না। এখনো আমাদের সবার বুক ধুকধুক করছে।

টুনি বলল, “ভয় না পেলে ভালো। খুবই ভালো।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোরা এখানে এলি কেমন করে? কেমন করে বুঝতে পারলি আমরা এখানে?”

“আমরা হচ্ছি ব্ল্যাক ড্রাগন। আমরা সবকিছু পারি।”

“ফাজলেমি করবি না। সত্যি করে বল।”

টুনি খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, “খুবই সোজা! তোর ব্যাগে দেখ একটা মোবাইল টেলিফোন আছে। সকালবেলা যখন ঘর থেকে বের হচ্ছিলি তখন মোবাইলটা আমার টেলিফোনে ডায়াল করে কানেকশন নিয়ে তারপর রেখে দেওয়া হয়েছে। সেই কাজে সাহায্য করেছে কমরেড মিথিলা। তারপর আমরা ঘরে বসে তোদর সব কথা শুনেছি। পানির মতো সোজা।”

টুনির বুদ্ধি দেখে আমি বেকুব হয়ে গেলাম। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না। আমি বললাম, “তুই এসেছিস তো এসে গেছিস। সাথে ওই মিথিলাকে নিয়ে এসেছিস কেন? এখন এইখানে ভয় পাবে, কান্নাকাটি করবে।”

মিথিলা বলল, “কখনো ভয় পাব না। কান্নাকাটি করব না। তোমরা ভয় পেয়েছ?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ ভয় পেয়েছি। এরকম জায়গায় পড়লে যে কেউ ভয় পাবে।”

চঞ্চল বলল, “ব্যস! অনেক হয়েছে। চল আমরা নিচে নামতে শুরু করি।”

টুনি বলল, “ঠিক আছে। তোমাদের দলে আমরা দুজনও আছি। কালা গুইসাপের সাথে ব্ল্যাক ড্রাগন!”

আমরা এখন আর সেটা নিয়ে নতুন করে ঝগড়া শুরু করলাম না। টুনি বলল, “তোরা চিন্তা করিস না। আমরা আমাদের ব্যাগে করে অনেক ভালো ভালো খাবার এনেছি।”

অনু জিজ্ঞেস করল, “কী খাবার?”

“কোল্ড ড্রিংকস, স্যান্ড উইচ, চিপস, চকলেট, আপেল।”

অনু হাতে কিল দিয়ে বলল, “ভেরি গুড।”

আমাদের ভয় দেখানোর জন্যে টুনির উপর যেটুকু রাগ ছিল খাবারের কথা শুনে সেই রাগটুকুও উবে গেল।

আমরা আবার নিচে নামতে শুরু করি। টুনি বলল, “তোদের কবুতর দিয়ে বিষাক্ত গ্যাস আছে কী নেই সেটা দেখার বুদ্ধিটা একেবারে ফাটাফাটি।”

আমি বললাম, “আমাদের সব বুদ্ধিই ফাটাফাটি। সাথে থাক তা হলেই দেখবি।”

“আমরা তো সাথে থাকতেই চাই, তোরাই না হিংসুটের মতো আমাদের দলে নিতে চাস না।”

কথাটা সত্যি, তাই আমি আর কিছু বললাম না।

টিটন প্রথমে নিচে নামল, তারপর টর্চ লাইট দিয়ে চারদিক দেখে বলল, “খুবই আজব জায়গা।”

আমরাও যখন নিচে নেমে এসেছি তখন বুঝতে পারলাম আজব জায়গা বলতে সে কী বোঝাচ্ছে। আমাদের ধারণা ছিল আমরা বুঝি নিচে নেমে একটা হলঘরের মতো জায়গা পাব। কিন্তু আসলে নিচে কোনো ঘর নেই, নিচে একটা সুড়ঙ্গের মতো। সিঁড়ির নিচ থেকে সুড়ঙ্গটা শুরু হয়ে সেটা এদিক-সেদিক চলে গেছে। দেখে মনে হয় একটা গোলকধাঁধা।

চঞ্চল বলল, “আগেই কেউ রওনা দিস না। সত্যি যদি এটা গোলকধাঁধা হয় তা হলে একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসতে পারব না।”

টুনি বলল, “আমাদের কাছে দুইটা মোবাইল টেলিফোন আছে।”

চঞ্চল মাথা নেড়ে বলল, “মাটির তলায় নেটওয়ার্ক থাকার কথা না। তবু চেষ্টা করে দেখ।”

আমার ব্যাকপেকে লুকিয়ে রাখা মোবাইল ফোন আর টুনির মোবাইল ফোনটা বের করে পরীক্ষা করা হল, দেখা গেল চঞ্চলের অনুমান সত্যি। আসলেই নেটওয়ার্ক নেই।

টিটন জিজ্ঞেস করল, “তা হলে কী করব?”

“এই সিঁড়িটার সাথে দড়িটা বেঁধে দড়ি ধরে ধরে এগিয়ে যাই, তা হলে যদি হারিয়েও যাই, দড়ি ধরে ধরে আবার ফিরে আসতে পারব।”

টুনি বলল, “গুড আইডিয়া।”

আমি বললাম, “এইখানে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখে যাই তা হলে আলোটা দেখেও আসতে পারব।”

চঞ্চল বলল, “ঠিক বলেছিস।”

কাজেই লোহার সিঁড়িটাতে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখে আমরা দড়ি ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে যাই। সরু একটা সুড়ঙ্গ একজন মানুষ কষ্ট করে যেতে পারে। মাথা নিচু করে যেতে হয়, মাঝে মাঝে উপরে মাথা লেগে যায়। সুড়ঙ্গের দেয়ালটা ইট এবং পাথরের, কষ্ট করে এটা তৈরি করা হয়েছে। মাঝে মাঝে চুন দিয়ে আঁকি-ঝুঁকি করা, রহস্যময় একটা পরিবেশ।

সুড়ঙ্গের মাঝে ঠাণ্ডা। বিচিত্র শ্যাওলার মতো একটা গন্ধ। আমরা নিঃশব্দে একজনের পিছনে আরেকজন হেঁটে যেতে থাকি। সুড়ঙ্গটা আসলেই গোলকধাঁধা, সোজা যেতে যেতে হঠাৎ দেখা যায় ডান ও বাম দিকে দুটো সুড়ঙ্গ। ডান দিকে কিছু দূর গেলে আবার সেটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ দিয়ে কিছু দূর গেলে দেখা যায় সেটা আবার কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। তার কোনো একটা দিয়ে গেলে দেখা যায় আমরা হঠাৎ করে আগের জায়গায় ফিরে এসেছি। ভারী বিচিত্র একটা ব্যাপার। এটা কে তৈরি করেছিল, কেন তৈরি করেছিল কিংবা কীভাবে তৈরি করেছিল কে জানে!

সুড়ঙ্গ ধরে হেঁটে হেঁটে আমরা যখন ধরেই নিয়েছি এখানে এই সুড়ঙ্গ ছাড়া আর কিছু নেই তখন হঠাৎ করে আমরা একটা খাড়া দেয়ালের সামনে হাজির হলাম। সেখানে একটা কাঠের দরজা। সেই দরজায় বিশাল একটা তালা ঝুলছে।

আমরা সবাই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম, তালাটা দেখে একটু অবাক হয়ে সেটার দিকে তাকালাম। তালাটা ধরে একটু টানাটানি করে আমরা হাল ছেড়ে দিই। এতো বড় তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকার কোনো উপায় নেই। কাঠের দরজাটাও একেবারে পাথরের মতো শক্ত। কতোদিন থেকে এটা এখানে আছে কিন্তু কিছু হয়নি। মনে হয় আরো শক্ত হয়েছে।

চঞ্চল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “চাবি ছাড়া এই তালা খুলে ভিতরে ঢোকা যাবে না।”

মিথিলা তখন পিছন থেকে বলল, “এই যে চাবি।”

আমরা চমকে উঠে বললাম, “চাবি?”

“হ্যাঁ।” মিথিলা এগিয়ে এসে আমাদের দিকে দুইটা চাবি এগিয়ে দেয়, একটা একটু বড়, আরেকটা ছোট। আমি অবাক হয়ে বললাম, “চাবি কোথায় পেলি?”

“সুড়ঙ্গের মাঝখানে এক জায়গায় দেয়ালে ঝোলানো ছিল আমি খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছিলাম।”

টুনি মিথিলার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, “ভেরি গুড, কমরেড মিথিলা।”

আমরাও মাথা নাড়লাম, বললাম, “ফ্যান্টাস্টিক।” মিথিলা যে নাকি সুরে আম্মুকে নালিশ করা ছাড়াও অন্য কাজ করতে পারে এই প্রথম আমি তার একটা প্রমাণ পেলাম।

টিটন চাবি দুইটা নিয়ে তালার ভিতরে ঢোকায়। একটা বেশি ছোট অন্যটা ভিতরে ঠিকভাবে ঢুকে গেল। বহু বছর ব্যবহার না করার কারণে তালাটা প্রথমে খুলতে চাইল না। চঞ্চল তখন তার ব্যাকপেক খুলে সেখান থেকে একটা শিশি বের করে সেটা থেকে খানিকটা তেল তালাটার ভিতরে ঢেলে দেয় তারপর কয়েকবার তালাটা নাড়াচাড়া করে চাবিটা ভিতরে ঢুকিয়ে কয়েকবার চেষ্টা করতেই সেটা ঘটাং করে খুলে গেল। বিশাল তালাটা দরজার কড়া থেকে খুলে নিচে রেখে আমরা দরজাটা ধাক্কা দিলাম, তখন কাঁচ কাঁচ শব্দ করে দরজাটা খুলে যায়।

আমরা টর্চ লাইট দিয়ে ভিতরে উঁকি দিলাম। ভেতরে বেশ বড় একটা ঘর। এর ছাদটাও বেশ উঁচু। ঘরটার দেয়ালটা নকশি কাটা। আমরা সামনের দিকে তাকালাম এবং হঠাৎ করে মনে হল আমরা সবাই পাথরের মতো জমে গেছি।

ঘরের মাঝখানে একটা বড় সিন্দুক। সিন্দুকের উপরে একটা কঙ্কাল। কঙ্কালটা ছোট, দেখে বোঝা যায় কম বয়সী কোনো বাচ্চার। শরীরের কাপড়টা এতো দিনে ক্ষয়ে গেছে, তবু বোঝা যায় এক সময়ে বাচ্চাটাকে লাল কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখা ছিল। কঙ্কালটার ছোট ছোট হাতে সোনার চুড়ি। পায়ে সোনার নূপুর। মাথায় সোনার একটা টিকলি। নাকের নাকফুল আর কানের দুলগুলো খুলে পড়ে আছে।

দৃশ্যটি এতো ভয়ানক যে আমরা চিৎকার করতে পর্যন্ত ভুলে গেলাম। শুধু মিথিলা আতঙ্কে একটা চাপা শব্দ করে টুনিকে জড়িয়ে ধরল। টুনি মিথিলাকে ধরে ফিসফিস করে বলল, “ভয় নাই। কোনো ভয় নাই মিথিলা।”

অনু আস্তে আস্তে বলল, “যক্ষ–”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী বললি?”

“এই সিন্দুকে নিশ্চয়ই অনেক ধন-রত্ন আছে। এই ধন-রত্ন পাহারা দেবার জন্যে এই বাচ্চাটাকে খুন করে রেখে গেছে। সে যক্ষ হয়ে ধন-রত্ন পাহারা দিচ্ছে।”

মিথিলা ভয়ে ভয়ে বলল, “সত্যি?”

“রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে এরকম একটা গল্প আছে, সম্পত্তি-সমর্পণ। যক্ষ হয়ে ধন-রত্ন পাহারা দেয়।”

মিথিলা ভয়ে ভয়ে বলল, “এখন যদি কেউ এই ধন-রত্ন ধরে তা হলে কী হবে?”

“যক্ষ কাউকে ধরতে দিবে না। কেউ ধরলে যক্ষ তাকে মেরে ফেলবে।”

মিথিলা বলল, “চল, আমরা এখান থেকে চলে যাই।”

আমরা সিন্দুকটি ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলাম। মিথিলার মতো আমাদেরও মনে হচ্ছে এখান থেকে আমরা চলে যাই। সিন্দুকের উপর ছোট একটা বাচ্চার কঙ্কাল–এই দৃশ্যটি এতো ভয়ানক যে সেটার দিকে তাকানো যায় না। সবচেয়ে ভয়ানক তার হাতের ছোট ছোট সোনার চুড়ি। সেদিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় এই ছোট মেয়েটা বুঝি এক্ষুনি তার সোনার চুড়িগুলো নাড়িয়ে উঠে বসে আমাদের দিকে তাকাবে, বলবে, তোমরা এতোদিন পরে এসেছ? যখন এখানে আমাকে খুন করে সিন্দুকের উপর শুইয়ে রেখেছিল তখন কেউ আসতে পারলে না? আমাকে বাঁচাতে পারলে না?

চঞ্চল আস্তে আস্তে বলল, “আমাদের কাছে সিন্দুকটার চাবি আছে। ইচ্ছে করলে আমরা সিন্দুকটা খুলে দেখতে পারি ভিতরে কী আছে।”

মিথিলা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “না। দেখতে চাই না।”

আমরাও মাথা নাড়লাম, বললাম, “থাকুক। আমরা বাইরে গিয়ে বড় মানুষদের বলি, তারা এসে এটা খুলুক।”

চঞ্চল হাসার চেষ্টা করে বলল, “তোরা যক্ষের ভয় পাচ্ছিস?”

”না, ঠিক তা না। কিন্তু–” আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না।

টুনি বলল, “আসলে ছোট একটা বাচ্চার কঙ্কাল দেখে খুব খারাপ লাগছে। সিন্দুকটা খুলতে হলে কঙ্কালটাকে সরাতে হবে। আমাদের কারো সেটা করতে ইচ্ছে করবে না।”

অনু মাথা নাড়ল, বলল, “টুনি ঠিকই বলেছে।”

চঞ্চল বলল, “ঠিক আছে। তা হলে ক্যামেরাটা দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে আমরা যাই।”

চঞ্চল ক্যামেরা বের করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলল, তারপর সেটা ব্যাগের ভিতরে রেখে বলল, “চল যাই।”

আমি বললাম, “চল।”

ঠিক তখন কাঁচ কাঁচ করে দরজাটা খুলে গেল, ভারী গলায় একজন বলল, “আগেই চলে যেও না। দাঁড়াও।”

আমরা চমকে উঠে সামনের দিকে তাকালাম, দরজায় মানিক আর তার পাহাড়ের মতো ওস্তাদ দাঁড়িয়ে আছে। মানিকের হাতে একটা ছোট রিভলবার, সেটা আমাদের দিকে তাক করে রেখেছে। ওস্তাদের হাতে একটা শাবল, আমরা যেটা উপরে রেখে এসেছিলাম। ভারী শাবলটা সে এমনভাবে ধরেছে যেন এটা একটা পাঠকাঠি!

০৮.

পাহাড়ের মতো মানুষটা ভেতরে ঢুকে আমাদের সবাইকে একনজর দেখে বলল, “দেখছিস মাইনকা, চার গোলামের সাথে এখানে দুই বিবি যোগ হইছে।”

প্রথমে আমার মনে হল আমাদের গোলাম বলে গালি দিচ্ছে, একটু পরে বুঝতে পারলাম সে তাসের গোলাম আর বিবির কথা বলছে। আমরা কিছু বললাম না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। পাহাড়ের মতো মানুষটা ঘরের ভেতরে ঢুকে এদিক-সেদিক তাকাল। তারপর শাবলটা দিয়ে চঞ্চলের পেটে খোঁচা দিয়ে বলল, “কী, পেয়েছিস ব্যাঙের ছাতা? ব্যাঙের ছাতার জন্যে মাটির এতো নিচে আসতে হল?”

আমরা এবারেও কোনো কথা বললাম না। মানিক বলল, “আমি প্রথম যখন এই চার মক্কেলকে দেখেছি তখনি বুঝেছি কোনো গোলমাল আছে। মনে আছে ওস্তাদ, কী রকম চোখের পাতি না ফেলে মিথ্যা কথা বলে গেল? এরা যখন বড় হবে তখন কতো বড় ক্রিমিনাল হবে চিন্তা করতে পারেন?”

মোটা মানুষটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এই জন্যেই তো দেশের উন্নতি হয় না। ছোট পোলাপান ছোট পোলাপানের মতো থাকে না, বড় মানুষের কাজের মাঝে নাক গলায়।”

আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা কী চান?”

প্রথমে মানিক তারপর পাহাড়ের মতো মানুষটা হা হা করে হাসতে থাকে যেন আমি খুবই হাসির কথা বলেছি। এক সময় হাসি থামিয়ে মানিক বলল, “আমরা দুজন এখানে এসেছি আপনাদের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্যে! আপনারা এই রকম কামেল মানুষ আমরা যদি আপনাদের অটোগ্রাফ না নেই তা হলে কে নিবে?”

মোটা মানুষটা বলল, “আচ্ছা দেখি, তোরাই বলতে পারিস কী না! বল দেখি আমরা কী জন্যে এসেছি?”

আমি অনুমান করতে পারছিলাম কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না। বললাম, “জানি না।”

মানুষটা তার শাবলটা দিয়ে সিন্দুকটা দেখিয়ে বলল, “ঐ যে সিন্দুকটা দেখছিস না? তার ভিতর কী আছে বল দেখি?”

আমরা সেটাও অনুমান করতে পারছিলাম কিন্তু মুখে বললাম, “জানি না।”

“ঐ সিন্দুকের ভিতর আছে সাত রাজার ধন! মিশকাত খানের সাথে কাজ করতো ডাকাতের দল। তার ছিল কয়েকটা দোনলা বন্দুক। সে ডাকাতদের সেই দোনলা বন্দুক দিত ডাকাতি করার জন্যে। তারা ডাকাতি করে সোনাদানা আনতো, মিশকাত খান তার বখরা নিত। সব সে এই সিন্দুকে রেখে গেছে।”

চঞ্চল জিজ্ঞেস করল, “আপনি কেমন করে জানেন?”

“মিশকাত খানের ডান হাত ছিল গজু ডাকাত! আমি হচ্ছি গজু ডাকাতের ছেলের ঘরের নাতি। আমি যখন ছোট তখন আমার বাপ-চাচা আমার কাছে গল্প করেছে, বলেছে মিশকাত মঞ্জিলের নিচে আছে যক্ষের ধন। এই হচ্ছে সেই যক্ষের ধন। আমি ছয় বছর ধরে খুঁজেছি পাই নাই! তোরা সবাই একসাথে তিন দিনে খুঁজে পেয়ে গেলি। তোদের একটা পুরস্কার দেওয়া দরকার! বল দেখি তোদেরকে কী পুরস্কার দিব?”

চঞ্চল বলল, “জানি না।”

“তোদের সাথে একজনের পরিচয় করিয়ে দিব, তোদের বন্ধু। তারপর তোরা মিলেমিশে থাকবি।”

মানুষটা কী বলছে আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, চঞ্চল বলল, “বন্ধু? কোন বন্ধু?”

পাহাড়ের মতো মানুষটা তখন সিন্দুকের উপর শুয়ে থাকা বাচ্চাটার কঙ্কালটাকে দেখিয়ে বলল, “এই যে তোদর বন্ধু! আরেকজন বিবি! চার গোলাম দুই বিবি ছিলি, এখন হবি চার গোলাম তিন বিবি!” এই ঘরে সবাই মিলে থাকবি। গল্প-গুজব করবি। যখন রাত হবে তখন নাকি সুরে কেঁদে কেঁদে ঘুরে বেড়াবি।”

মানুষটার কথা শুনে আমার বুকটা কেঁপে উঠল, কী ভয়ানক কথা বলছে। আমাদের এখানে আটকে রাখবে! আমি মিথিলার দিকে তাকালাম, ভেবেছিলাম দেখব ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, কিন্তু ঠিক কী কারণ জানা নেই, তাকে দেখে মনে হল না সে খুব ভয় পেয়েছে। সে টুনির হাত ধরে রেখে শান্ত মুখে মানুষগুলোকে দেখছে।

মানিক আমাদের দিকে রিভলবারটা ধরে রাখল, আর তার পাহাড়ের মতো ওস্তাদ লোহার শাবলটা ঘাড়ে নিয়ে সিন্দুকটা ঘুরে একটা চক্কর দেয়। তারপর মুখ দিয়ে লোল টানার মতো শব্দ করে বলল, “আমার আর সহ্য হচ্ছে না। সিন্দুকটা খুলি। মাইনকা টর্চ লাইটটা এদিকে ধর।–”

চঞ্চল বলল, “আমাদের কাছে মোমবাতি আছে। লাগবে আপনাদের?”

“মোমবাতি?” পাহাড়ের মতো মানুষটার মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, “আগে বলবি তো? টর্চ লাইট ধরে কী কাজ করা যায়? বার কর মোমবাতি।”

চঞ্চল কেন গায়ে পড়ে মানুষগুলোকে সাহায্য করতে চাইছে অন্য কেউ সেটা বুঝতে পারল না, শুধু আমি বুঝতে পারলাম। সে তার ইনডাকশন কয়েলটা বের করতে চাইছে।

মানিক রিভলবারটা চঞ্চলের দিকে তাক করে রেখে বলল, “খবরদার কোনো রকম রং তামাশা করবি না। ভদ্রলোকের মতো মোমবাতিটা বের করবি।”

চঞ্চল তার ব্যাগ থেকে মোমবাতি বের করার ভান করে অনেক কিছু বের করল, তার ইনডাকশন কয়েলটাও। সেখান থেকে মোমবাতিগুলো আলাদা করে মানিকের হাতে দেয়, তারপর বের করা জিনিসগুলো আবার ব্যাগের ভেতর ঢোকাতে থাকে। আমি চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ করলাম সে অন্য জিনিসগুলো ব্যাগে ঢোকালেও ইনডাকশন কয়েলটা ঢোকালো না। আমি তখন চঞ্চলকে সাহায্য করার জন্যে মানিকের দৃষ্টি ফেরানোর চেষ্টা করলাম। তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনারা তো সিন্দুক খুলে সোনাদানা পাবেন। আমরা কি এখন যেতে পারি?”

মানিক অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী বললি?”

“বলছি যে আমরা কি এখন যেতে পারি?”

“কোথায় যাবি?”

“বাসায়।”

“বাসায়?” আমার কথা শুনে মানিক এতো অবাক হল যে বলার মতো নয়। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল, “তোর মাথায় কী গোবর না কী অন্য কিছু? তুই কেমন করে ভাবলি যে আমরা তোদের ছেড়ে দিব? তোদেরকে ছেড়ে দিলে তোরা যে বাইরে গিয়ে খবর দিবি আর পুলিশ, র‍্যাব, মিলিটারি এসে আমাদেরকে ধরবে সেটা তোর মোটা মাথায় ঢুকে না?”

অবশ্যই ঢুকে কিন্তু আমি যে তার দৃষ্টি আমার দিকে রাখার জন্যে কথাগুলো বলছি সেটা তো আর বলতে পারছি না। তাই আমি আলাপ চালিয়ে যাবার জন্যে বললাম, “ঠিক আছে তা হলে আমাদেরকে সোনাদানার একটু ভাগ দেন তা হলে আমরা কাউকে বলব না।”

“কী বললি?” মানিক আমার কথা শুনে এবারে শুধু অবাক নয় মনে হয় রেগেও গেল। বলল, “তোদের সোনাদানার ভাগ দিব?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “কেন দিবেন না? আমরাই তো এই জায়গাটা খুঁজে বের করেছি।”

মানিক তখন পাহাড়ের মতো মানুষটার কাছে নালিশ করল, বলল, “শুনছেন ওস্তাদ এই পোলা কী বলে? তারে না কি সোনাদানার ভাগ দিতে হবে।”

“এদের কথা শুনিস না মাইনকা। এরা মেলা তাঁদর। এদের কথা শুনলে কানের পোকা নড়ে যায়।”

এতক্ষণে চঞ্চল নিশ্চয়ই ইনডাকশন কয়েলটা তার হাতে লাগিয়ে ফেলেছে আমি তাই আর কথা বললাম না। পাহাড়ের মতো মানুষটা মোমবাতিগুলো ঘরের এদিক-সেদিক রেখে সেগুলো জ্বালিয়ে দেয়। সাথে সাথে ঘরের ভিতর একটা নরম আলো ছড়িয়ে পড়ে। টর্চ লাইটটা নিভিয়ে পাহাড়ের মতো মানুষটা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই সিন্দুকের চাবি কার কাছে?” টিটন তার হাতের চাবিটা

এগিয়ে ধরে, মোটা মানুষটা এসে ছোঁ মেরে চাবিটা নিয়ে নেয়।

পাহাড়ের মতো মানুষটা বলল, “এখন আমি এই সিন্দুকের তালা খুলব। তোরা কোনো গোলমাল করবি না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। চোরের গুষ্টি চোর।”

আমার কেমন জানি রাগ উঠে গেল, বললাম, “চুরি করতে এসেছেন আপনারা, আর আমাদেরকে বলছেন চোর?”

মানিক তখন হঠাৎ যেন খেপে গেল, চোখ পাকিয়ে বলল, “কী বললি? কী বললি তুই? আমরা চুরি করতে এসেছি? তোর এতো বড় সাহস, তুই আমাদের চোর ডাকিস?” মানিক রাগে দাঁত কিড়মিড় করে রিভলবারটা আমার মাথার দিকে তাক করে, আমি দেখতে পেলাম সে রিভলবারের ট্রিগারটা টেনে ধরেছে, যে কোনো মুহূর্তে একটা গুলি বের হয়ে আসবে।

তখন অত্যন্ত বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল, মিথিলা ছুটে এসে মানুষটার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে আনল আর ঠিক তখন রিভলবার থেকে একটা গুলি বের হয়ে আসে। ছোট ঘরটাতে প্রচণ্ড শব্দে সেটি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। মিথিলা মানুষটার হাত ধরে ঝুলে থাকে, কিছুতেই ছাড়ে না। মানিক ঝটকা মেরে মিথিলাকে সরানোর চেষ্টা করে, পারে না। তখন সে বাম হাত দিয়ে মিথিলার ঘাড়টা ধরে তাকে টেনে সরায়। তারপর মিথিলার বুকের কাছে ফ্রকটা ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “এই ছেমড়ি? তোর কী মাথা খারাপ হয়েছে? এক ঘুষিতে আমি যদি তোর সবগুলো দাঁত না ফালাই তা হলে আমার নাম মাইনকার বাচ্চা মাইনকা না।”

আমি তখন আমার জীবনের সবচেয়ে বিচিত্র দৃশ্যটি দেখতে পেলাম। টুনি দুই হাত উপরে তুলে হিংস্র গলায় বলল, “এই যে মাইনকার বাচ্চা মাইনকা সাহেব, বাচ্চা মেয়েটারে ছাড়েন। আর যদি সাহস থাকে তা হলে আমার কাছে আসেন।”

মানিক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, সে বিস্ফারিত চোখে টুনির দিকে তাকাল, বলল, “কী বললি?”

টুনি কিছু না বলে এক আঙুল দিয়ে মানিককে নিজের দিকে ডাকে। মানুষ পথে-ঘাটে কুকুর কিংবা বিড়ালের বাচ্চাকে যেভাবে ডাকে, অনেকটা সে রকম। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম টুনির সারা শরীর ইস্পাতের তারের মতো টান টান হয়ে গেছে, সে তার দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে নাচের ভঙ্গি করে দুলতে থাকে।

মানিক এবারে মিথিলাকে ছেড়ে দেয় তারপর রিভলবারটা টুনির দিকে তাক করে এগিয়ে আসে। হঠাৎ করে মনে হল ঘরের মাঝে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমরা দেখলাম টুনি ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়, তার পা শূন্যে উড়ে যায়, আমরা কিছু বোঝার আগে দেখলাম টুনি তার পা দিয়ে মানিকের মুখের মাঝে প্রচণ্ড জোরে লাথি মেরে বসেছে। একজন মানুষের পা যে এত উপরে উঠতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে আমরা বিশ্বাস করতাম না। মানিক একটা আর্ত চিৎকার করে ঘুরে পড়ে যায়। সে এখনো বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। আমরা মানিকের দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম তখন টুনি চিৎকার করে আমাদের থামাল, বলল, “তোরা সব যা।”

বিড়াল যেভাবে ইঁদুরের বাচ্চা ঘিরে ঘুরতে থাকে, টুনি এখন ঠিক সেভাবে মানিককে ঘিরে ঘুরতে থাকে। মানিক তার রিভলবারটা তুলে ধরে, আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি সে এখন গুলি করে বসবে কিন্তু তার আগেই টুনি বিদ্যুৎ চমকানোর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমরা দেখতে পেলাম তার একটা লাথিতে হাত থেকে রিভলবারটা উড়ে গিয়ে নিচে পড়েছে। টিটন তখন ছুটে গিয়ে রিভলবারটা নিজের হাতে তুলে নিল।

টুনি নাচের ভঙ্গিতে মানিককে ঘিরে ঘুরতে ঘুরতে বলল, “মানিকের বাচ্চা মানিক সাহেব, দুই হাত পিছনে নিয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ন তা না হলে আপনার দুটি দাঁত এক্ষুনি খুলে যাবে। আমি ফোর্থ ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট। আমাকে দেখে মনে না হতে পারে কিন্তু খালি হাতে আমি আপনার মতো দুই-চারজনকে খুন করে ফেলতে পারি।”

মানিক টুনির কথা বিশ্বাস না করে দুর্বলভাবে ওঠার চেষ্টা করল, আর সাথে সাথে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো টুনি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আমি দেখলাম সাথে সাথে মানিক হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল, আর ওঠার সাহস পেল না।

টিটন তখন রিভলবারটা তুলে পাহাড়ের মতো মানুষটার দিকে তাক করে ধরেছে, চিৎকার করে বলছে, “হ্যান্ডস আপ।”

পাহাড়ের মতো মানুষটার মুখ দেখে মনে হল সে এখনো পুরো ব্যাপারটা বিশ্বাস করছে না। সে অবাক হয়ে একবার টুনির দিকে আর একবার টিটনের দিকে তাকাল, তারপর বলল, “কী বললি? হ্যাঁন্ডস আপ? এই বান্দরের বাচ্চা তুই হ্যাঁন্ডস আপ মানে জানিস?”

টিটন কোনো কথা না বলে রিভলবারটা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। পাহাড়ের মতো মানুষটা তখন টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই নিজেকে কী ভাবিস? ফিল্ম স্টার? মাইনকা হচ্ছে মাজাভাঙা টিবি রোগী! তার সাথে মাইরপিট করে তোর সাহস বেড়েছে? আয় তা হলে আমার কাছে–তোর ফিলমি কায়দা আমার সাথে কর! তোর কলজে যদি আমি ছিঁড়ে না ফেলি তা হলে আমি বাপের ব্যাটা না।”

টিটন বলল, “হ্যান্ডস আপ। যদি আপনি হ্যাঁন্ডস আপ না করেন গুলি করে দিব।”

মানুষটা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “তুই গুলি কর! দেখি তোর গুলি আমার চামড়া ফুটা করতে পারে কি না। কর গুলি।”

টিটন গুলি করল না, শুধু চিৎকার করে বলল, “হ্যান্ডস আপ। না হলে গুলি করে দিব।”

মানুষটা হঠাৎ এগিয়ে এসে খপ করে টিটনের হাতটা ধরে রিভলবারটা কেড়ে নিয়ে বলল, “এই ছেমড়া, তোর রিভলবারকে আমি ভয় পাই?” মানুষটা রিভলবারটাকে তার কোমরে গুঁজে বলল, “আমার সাথে রংবাজি? আমি সবগুলোকে এখন খুন করে ফেলব। খালি হাতে আমি তোদের মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলব।”

পাহাড়ের মতো মানুষটা টিটনের চুল ধরে তাকে হ্যাঁচকা টানে নিজের কাছে টেনে আনে, মনে হয় সত্যিই বুঝি টিটনের মাথাটা ছিঁড়ে ফেলবে। ঠিক তখন চঞ্চল বলল, “ভালো হবে না কিন্তু, ছেড়ে দেন, ছেড়ে দেন ওকে।”

মানুষটা চঞ্চলের গলার স্বর শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কে কথা বলে?”

চঞ্চল বলল, “আমি।”

মানুষটা বলল, “আমি তাই ভেবেছিলাম। তুই না হলে এতো বেশি কথা আর কে বলবে? তোরে না আমি না করেছি বেশি কথা না বলার জন্যে। আমার কথা কানে যায় না?”

চঞ্চল ঠাণ্ডা গলায় বলল, “আপনি ওকে ছেড়ে দেন।”

পাহাড়ের মতো মানুষটা টিটনকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে ছেড়ে দিলাম। তোরে ধরলে তোর কোনো আপত্তি আছে?”

চঞ্চল বলল, “না, নাই।”

“ফড়িংয়ের বাচ্চা ফড়িং তোর সাহস তো কম না।” মানুষটা দাঁত কিড়মিড় করে চঞ্চলের দিকে এগিয়ে আসে। চঞ্চল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কাছে আসতেই সে খপ করে মানুষটাকে দুই হাতে তাকে ধরল সাথে সাথে আমরা দেখতে পেলাম মানুষটা বিকট আর্তনাদ করে ছিটকে পড়ল। তার দুই চোখে অবিশ্বাস, কী ঘটেছে সে কিছু বুঝতে পারছে না।

চঞ্চল দুই হাত সামনে বাড়িয়ে মানুষটার দিকে এগিয়ে যায় আর মানুষটা ভয়ে-আতঙ্কে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। চঞ্চল আবার দুই হাতে তাকে ধরে ফেলল, আর আমরা অবাক হয়ে দেখলাম এতো বড় মানুষটার সারা শরীর ঝাঁকুনি খেতে থাকে, মানুষটা থরথর করে কাঁপছে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তার চোখ উল্টে গেল, মুখ হাঁ হয়ে গেল, তখন চঞ্চল তাকে ছেড়ে দিল আর সে দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল, মনে হল বিশাল একটা কোলা ব্যাঙ বুঝি লাফ দিয়েছে।

চঞ্চল আবার এগিয়ে যায়, মানুষটার দুই চোখে তখন আতঙ্ক, সে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করল, সিন্দুকটাতে তার পা লেগে যায় আর সে প্রচণ্ড শব্দ করে মেঝেতে আছড়ে পড়ে। টুনি চিৎকার করে বলল, “ধর! ধর এটাকে।”

আমরা সবাই তখন মানুষটাকে চেপে ধরলাম, সে যদি শুধু একটা ঝটকা দেয় তা হলে আমরা উড়ে যাব কিন্তু মানুষটা আর সাহস করল না, চঞ্চল ঠিক তার পিঠের উপর বসে বলল, “যদি আপনি একটু নড়াচড়া করেন তা হলে ইলেকট্রিক শক দিয়ে আমি আপনার বারোটা বাজিয়ে দিব। দেড় ভোল্টের ব্যাটারির জায়গায় আমি নয় ভোল্টের ব্যাটারি লাগিয়েছি, আপনার হার্টটাকে আমি থামিয়ে দিতে পারব।”

মানুষটা নড়াচড়া করল না। টুনি প্রথমে তার কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবারটা বের করে নিল। আমি ছুটে গিয়ে ব্যাগ থেকে নাইলনের দড়ি বের করলাম তারপর দুই হাত পেছনে এনে শক্ত করে বাঁধলাম। টুনি দেখল ঠিক করে বাঁধা হয়েছে কি না, তারপর বাড়তি দড়ি দিয়ে আমরা পা দুটি বেঁধে ফেললাম।

চঞ্চল বলল, “আমি যে জিনিসটা দিয়েছি সেইটার নাম ইনডাকশন কয়েল। আমার নিজের হাতে তৈরি করা। এর মাঝে আছে প্রাইমারি কয়েল আর সেকেন্ডারি কয়েল। প্রাইমারি কয়েলের জন্যে ব্যবহার করেছি সতেরো গেজের তার। দুই লেয়ার। সেকেন্ডারি কয়েল চল্লিশ গেজ। বিশ লেয়ার। শক দেওয়ার জন্যে কানেকশন দিতে হয়। সেই জন্যে আছে ভাইব্রেটর। শব্দ শুনছেন?

ইলেকট্রিক শক খেয়ে এই মানুষটা যতটুকু কাবু হয়েছিল চঞ্চলের বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা শুনে তার থেকে বেশি কাবু হয়ে যন্ত্রণায় শব্দ করতে লাগল।

আমি বললাম, “ছেড়ে দে। অনেক হয়েছে।”

চঞ্চল বলল, “বিগ ব্যাং নিয়ে একটু বলি।”

“থাক। আর কষ্ট দিস না।”

চঞ্চল তখন পাহাড়ের মতো মানুষটাকে ছেড়ে দিল।

টুনি বলল, “এবারে চোখ দুটি বেঁধে ফেল।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”

“এই মানুষটাকে বিশ্বাস নাই, চোখ বাঁধা থাকলে নড়াচড়া করার সাহস পাবে না।”

আমরা তখন তার চোখও বেঁধে ফেললাম।

ঘরের আর এক কোনায় মানিক উপুড় হয়ে পড়েছিল, আর নাক থেকে রক্ত বের হচ্ছে, কেমন যেন ঘিনঘিনে চেহারা, দেখে ঘেন্না লাগে। টুনি বলল, “এটাকে নিয়ে কোনো ভয় নাই, কিন্তু এটাকেও বেঁধে ফেলি।”

আমি বললাম, “ঠিক আছে।” তারপর তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললাম। আমাদের কাজ আপাতত শেষ।

আমরা ঘরটার দিকে তাকালাম, “সিন্দুকের উপর বাচ্চা মেয়েটার কঙ্কাল নিঃশব্দে শুয়ে আছে। দেখে মনে হল মেয়েটি বুঝি পুরো দৃশ্যটি নিঃশব্দে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।

আমি বললাম, “আয় সবাই যাই।”

পাহাড়ের মতো মানুষটা বলল, “কোথায় যাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ তোমরা?”

আমি বললাম, “তোমার কী মনে হয়?”

“প্লীজ পুলিশকে খবর দিও না। প্লীজ! প্লীজ!”

“সেটা দেখা যাবে। আপাতত তোমরা শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নাও।”

সিন্দুকের উপর তালার চাবিটা রাখা ছিল আমরা সেটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দরজা বন্ধ করে বিশাল তালাটা ঘটাং করে লাগিয়ে দিলাম।

আমরা তখন প্রথমবার একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। আমি মিথিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, “মিথিলা থ্যাংকু। তুই যদি লাফ দিয়ে মানিকের হাতটা না ধরতি তা হলে মনে হয় আমাকে গুলি করে মেরেই ফেলত!”

মিথিলা বলল, “কতো বড় সাহস! টুনি আপু উচিত শিক্ষা দিয়েছে। তাই না টুনি আপু?”

আমরা সবাই মাথা নাড়লাম, আমি বললাম, “অসাধারণ ফাইট!”

চঞ্চল বলল, “তুই তো কখনো বলিসনি তুই ফোর্থ ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট! কী সাংঘাতিক!”

“তোরা কি আমাকে বলার চান্স দিয়েছিস? সবসময় আমাকে সরিয়ে রেখেছিস। তোদের ধারণা শুধু তোরাই সবকিছু পারিস আমরা কিছু পারি না।”

অনু বলল, “আর সরিয়ে রাখব না। এখন থেকে আমরা সবাই ব্ল্যাক ড্রাগন।”

আমরা মাথা নাড়ালাম, বললাম, “হ্যাঁ। ব্ল্যাক ড্রাগন।”

মিথিলা বলল, “কিংবা কালা গুইসাপ।”

আমরা সবাই হি হি করে হাসলাম, কালা গুইসাপ কথাটিকেও এখন খুব খারাপ শোনাচ্ছে না।

চঞ্চল বলল, “একদিনের জন্যে অনেক অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে। চল যাই।”

আমি বললাম, “চল।”

আমরা সেই সুড়ঙ্গ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়িটার দিকে এগোতে থাকি। হঠাৎ করে টুনি থেমে গিয়ে বলল, “ওটা কীসের শব্দ?”

আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম এবং শুনতে পেলাম সত্যিই দুম দুম করে একটা চাপা শব্দ হচ্ছে।

অনু বলল, “এখানে এতো ধুলা কেন?”

আমরা অবাক হয়ে দেখলাম সত্যিই সুড়ঙ্গের মাঝে ধুলা উড়ছে। হঠাৎ করে আমার একটা জিনিস মনে হল, সাথে সাথে ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠল, আমি বললাম, “সর্বনাশ!”

“কী হয়েছে?”

“মনে নাই তোদের বলেছিলাম মিশকাত মঞ্জিল ভেঙে ফেলবে?”

“হ্যাঁ।”

“মনে হয় ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করেছে।”

চঞ্চল বলল, “আমাদের তাড়াতাড়ি বের হতে হবে।”

“হ্যাঁ। খুব তাড়াতাড়ি।”

আমরা ছুটতে ছুটতে সিঁড়ির কাছে এসে হতবাক হয়ে যাই। পুরো সিঁড়িটা ভাঙা ইট-সিমেন্ট-সুড়কি দিয়ে বোঝাই। উপর থেকে দালানটা ভাঙতে শুরু করেছে আর আমাদের বের হওয়ার রাস্তাটা বুজে গেছে। এখান থেকে এখন বের হওয়ার কোনো উপায় নেই।

আমরা অনেক উপরে চাপা দুম দুম শব্দ শুনতে পেলাম। অনেক মানুষ মিলে পুরো বিল্ডিংটা ভেঙে ফেলছে আর আমরা তার ভিতরে আটকা পড়ে গেছি।

মিথিলা চিৎকার করে বলল, “বন্ধ কর! বন্ধ কর!” কেউ তার কথা শুনল না, কেউ কিছু বন্ধ করল না।

তারপর আমরা সবাই মিলে চিৎকার করলাম, আমাদের চিৎকার সুড়ঙ্গের মাঝে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল কিন্তু বাইরের কেউ শুনতে পেল না। তারা দুম দুম শব্দ করে ভাঙতেই থাকল।

আমি দেখলাম মিথিলার চোখে-মুখে ভয়াবহ আতঙ্ক। আমার নিজের জন্যে না–মিথিলার জন্যে হঠাৎ মায়া হতে থাকে।

টুনি ফিসফিস করে বলল, “আমরা খুব বড় বিপদে পড়ে গেছি।”

কেউ কোনো কথা বলল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *