৭. শিবের লাঠি

৬১. শিবের লাঠি

প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বিজয়। শুক্র যেখানে উদয় হয়েছে তারা ঠিক সে স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। পাহাড়টা এখানে এসে গিরিখাদের আকার নিয়েছে।

সার্চলাইটের আলোয় খাদের গায়ে স্পষ্ট দেখা গেল খোদাইকৃত। লম্বা ত্রিশূল।

শিবের লাঠি।

অথবা ইউমেনিসের কথা মত গ্রিক রীতি অনুযায়ী পোসেডিনের লাঠি। চোখের সামনে শিবের যষ্ঠি দেখে অবশ হয়ে গেছে নাকি গন্তব্যের কাছাকাছি এসে থ’ মেরে গেছে বোঝা যাচ্ছে না। তবে কিছুক্ষণের জন্য অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পুরো দল।

সবার আগে মন্ত্রমুগ্ধ অবস্থা কাটিয়ে উঠল ভ্যান ক্লক। “রাইট। তাহলে আমাদের শেষ স্টপেজ কোনটা? পাঁচ মাথাঅলা সাপ?” এমন ভাবে বিজয়ের দিকে তাকাল যেন বলতে চাইছে যে তোমাকে তো এই কারণেই এখানে এনেছি। এখন জানাও।

বিজয় স্মরণ করতে চাইল যে ইউমেনিস জার্নালে কী লিখে গেছেন। ত্রিশূল পার হবার পরে সাপ পেতে তো আলেকজান্ডারের তেমন কোনো কষ্ট হয়নি। তার মানে সেই পাথুরে কাঠামোটাও কাছেই কোথাও আছে।

ইউমেনিস যেন কী বলেছিলেন? “চলো, সবাই ছড়িয়ে পড়ে চারপাশের এক কিলোমিটার এলাকা খুঁজে দেখি।” নির্দেশ দিল বিজয়। যতদূর মনে পড়ে সর্পের পাথরটাকে খুঁজে পেতে বেশ খানিকটা সময় ব্যয় করতে হয়েছিল। তার মানে যে কোনো দিকেই হতে পারে।

তিন দলে ভাগ হয়ে খুঁজতে শুরু করল পুরো দল। সবাই জানে কী খুঁজছে। আর একবার সেটা পেয়ে গেলেই দেবতাদের রহস্য তাদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে।

.

অসম্পূর্ণ অংশ

একদৃষ্টে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বসে আছে কলিন। যদিও এতে তেমন অভ্যস্ত নয়। সচরাচর গবেষণার কাজগুলো বিজয় করে। কোম্পানির প্রতিষ্ঠা, তাদেরকে ধনী বানিয়ে দেয়া প্রজেক্ট থেকে শুরু করে এর আগে দুই বন্ধু একত্রে যা কিছু করেছে সবসময় গবেষণার দিক সামলেছে বিজয়। বিশ্লেষণ, যুক্তিবিন্যাস আর কার্যে পরিণত করা কলিনের কাজ হলেও দুজনের মধ্যে ভাবুক হল বিজয়। তাই একে অন্যের সাথে চমৎকার ভাবে খাপ খাইয়ে গেছে দুই বন্ধু।

অথচ এখন ফাপড়ে পড়ে বিজয়ের কাজ করতে গিয়ে মনে হচ্ছে ছেলেটা কিভাবে এত বিনা প্রচেষ্টায় গবেষণার হ্যাপা সামলায়।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথার চুলে বিলি কাটল কলিন আর ঠিক সে সময় রুমে ঢুকল এলিস। “কিছু পেলে?” এলিস আর ডা. শুক্লাকে বিজয়ের সাথে আলোচনার কথা খুলে বলল কলিন।

“বিজয় আমাকে ফোন করেনি দেখে ভাবছি হয়ত শুক্রের অবস্থান জেনে গেছে। কিন্তু শেষ পদ্য কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। যেখানে চোখ আর তিন ভাইয়ের কথা লেখা আছে। সম্ভাব্য সবকিছু দিয়ে গুগলে সার্চ করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।”

কলিনের কম্পিউটারের পর্দায় মানচিত্রের দিকে তাকাল এলিস।

“যদি আরাল সমুদ্র সম্পর্কে তোমার কথা সঠিক হয় তাহলে তিনজন ভ্রাতা’ও দক্ষিণেই কোথাও আছে। কারণ আমরা জানি যে আলেকজান্ডার আরাল সমুদ্রের ওপাড়ে আর কোথাও যান নি। আর দক্ষিণে তাকালে মাত্র দুটো দেশ আছে। উজবেকিস্তান আর কাজাকাস্তান।”

“রাইট।” নব প্রাণশক্তি ফিরে পেল কলিন, দেশগুলোর নামের কী ওয়ার্ডস দিয়ে তো কিছু খুঁজি নি।”

“দেখো চেষ্টা করে।” উৎসাহ দিল এলিস, “যদি কিছু পাওয়া যায়।”

“তিনজন ভ্রাতা উজবেকিস্তান” নাম টাইপ করল কলিন। সার্চ ইঞ্জিনের এনে দেয়া সূত্রগুলো খুঁজে দেখল। প্রথম ছয় পাতা আঁতিপাঁতি করে খুঁজে হতাশ হয়ে এলিসের দিকে তাকাল।

“গুগল আদৌ তিনভ্রাতা সম্পর্কে জানে কিনা সেটাই বা কিভাবে বুঝব? কিউবটা তো সেই হাজার হাজার বছর আগেকার তৈরি।”

“লিখো কাজাকাস্তান।” নম্রভাবে তাগাদা দিল এলিস। “চলো সবকিছুই দেখা যাক।”

মাথা নেড়ে তিন ভ্রাতা কাজাকাস্তান” লিখে ফেলল কলিন।

আবারো একই দশা। প্রথম পাতায় কিছু নেই। দ্বিতীয় পাতায় ক্লিক করল। কিছুই নেই। এবার তৃতীয় পাতা।

জমে গেল কলিন। ঘাড়ের কাছে এলিসের নিঃশ্বাসের স্পর্শ পেয়ে বুঝল মেয়েটাও কাছেই আছে।

পর্দায় ভেসে উঠল একগাদা ছবি; টাইটেল ক্যাপশনে লেখা : “কাজাকাস্তানের তিন ভ্রাতার ছবি।

.

৬২. আশার ফালি

প্যাটারসনের কথা মন দিয়ে শুনলেন ইমরান। হাসপাতালের রুমে যন্ত্রপাতি বসানোর পর এটা তাদের দ্বিতীয় আলোচনা। দুজনে মিলে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্ভাব্য সবকিছু নিয়েই আলোচনা করেছে। তাই ক’দিন আগেও প্যাটারসনের প্রতি ইমরানের যে প্রাথমিক বিরক্তাবস্থা ছিল তা কেটে গিয়ে লোকটার বুদ্ধিমত্তা আর কৌশলগত দক্ষতা দেখে প্রশংসা না করে পারল না। তারপরেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্যাটারসন খানিকটা প্রস্তর যুগের মানব হলেও ইমরান মুগ্ধ হল আজকের কৌশলগত সিদ্ধান্তসমূহ নিয়ে।

তবে প্যাটারসনের পরিকল্পনার সবটুকু যে মনঃপুত হল তা নয়। যেমন, রাধা সম্পর্কে আশা ছেড়ে দেওয়াটা। প্যাটারসন বারবার জোর দিয়েছে যেন এ ব্যাপারে ইমরানও আশা ছেড়ে দেয়। অথচ ইমরানের দাবি তারা অবশ্যই মেয়েটাকে খুঁজে বের করবে।

“যুদ্ধে তুমি আশা নিয়ে জিততে পারবে না। কাজ করতে হবে।” ফ্ল্যাট স্ক্রিন মনিটর জুড়ে গমগম করে উঠল বিশালদেহী আফ্রিকান-আমেরিকানের গলা। “রাধার ব্যাপারে যদি কোনো সম্ভাবনা জাগ্রত হয় তাহলে আমরা দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব। এতে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু আপাতত কিছু করার নেই। অন্যদিকে এই কেসের জন্য আরো অনেক কিছু করা বাকি। তাই চুপচাপ বসে আশা আর প্রার্থনা ছেড়ে কাজে লেগে পড়তে হবে। মেয়েটা যদি বেঁচে থাকে তত খুব ভালো। টাস্ক ফোর্সের একজন সদস্যকে হারাতে হল না। কিন্তু সেটা ধরে বসে থাকলে চলবে না।”

পরিকল্পনার অন্যান্য অংশ নিয়েও অস্বস্তিতে আছেন ইমরান। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে কোনো উপায় নেই। ঝুঁকিটা সত্যিই বড় বেশি হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু কিংবা কিছুই নয়।

“রাইট, তাহলে আজ রাতে ভালো করে ঘুমাও। আগামীকাল খুব দীর্ঘ একটা দিন যাবে। যেভাবেই কাটুক না কেন। আশা করছি শীর্ষে পৌঁছে যেতে পারব।” সাইন অফ করে কানেকশন কেটে দিলেন প্যাটারসন।

অস্পষ্ট হতে হতে কালো হয়ে যাওয়া পর্দার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইমরান। তারপরেই মনে হল ফোনের কথা। প্যাটারসনের সাথে কথা বলার সময় খেয়াল করেছিলেন যে একটা ই-মেইল-মেসেজ এসেছে। কে হতে পারে!

প্রেরকের নাম দেখে তো চোখ কপালে উঠে গেল; মেসেজটা এখনো খোলাও হয়নি।

কিছুতেই যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। রাধা! ও বেঁচে আছে! ইমরানকে মেসেজ পাঠিয়েছে। কোনো একভাবে ব্যবস্থা করে মেসেজ পাঠিয়েছে যেন তারা আশা না ছাড়ে।

বেড কাভার ছুঁড়ে ফেলে হাসপাতালের বিছানা থেকে নামতে গিয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলেও তোয়াক্কা করলেন না ইমরান। হাসপাতাল গাউন বদলে নিজের কাপড় গায়ে চাপিয়ে অফিসের নাম্বারে ডায়াল করলেন।

“অর্জুন, আমাকে এক্ষুনি নিয়ে যান। আপনাকে একটা ই-মেইল পাঠাচ্ছি। সাথে সাথে লোকেশন খুঁজে বের করার ব্যবস্থা করুন। এক্ষুনি।”

.

উৎস

এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। অথচ তাদেরকে সিক্রেটের কাছে পৌঁছে দেবে যে পাঁচ মাথাঅলা সাপ সেটার এখনো কোনো খোঁজ নেই। তবে পুরো দলটাই বেশ উজ্জীবিত হয়ে আছে। ভ্যান কুকও উদ্যম ফিরে পেয়েছে। সবাই জানে যে গন্তব্য একেবারে কাছেই কোথাও আছে।

হঠাৎ করেই কুপারের স্যাটেলাইট ফোনের রিং বেজে উঠল। একপাশে সরে গিয়ে নিচু স্বরে কার সাথে যেন কথা বলে আসল। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল বিজয়। কিন্তু মাত্র কয়েকটা শব্দ ছাড়া আর কিছুই বুঝল না। “যা দরকার করো…নিশ্চিত করতে হবে… আমি…তবে কুপার যে উদ্বিগ্ন তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। দ্রুত আর সংক্ষেপে আলোচনা সেরে ফোন আবার পকেটে রেখে দিল।

ওপাশের লোকটা কে না জানলেও ক্লান্তি বোধ করছে বিজয়। এত উচ্চতায় এই লাগাতার ভ্রমণ শরীরের উপর প্রভাব ফেলছে। ঠিক করল খানিক বসে বিশ্রাম নেবে। বেয়ারা সাপটাকে খোঁজার জন্য যদি আরো পনের মিনিট সময় বেশি লাগে তো লাগুক।

কিন্তু নিচু হয়ে যেই না বসতে যাবে কানে এলো ভ্যান ক্লকের উত্তেজিত চিৎকার, “এখানে এসো!”

বিশ্রামের চিন্তা ভুলে অন্যদের সাথে বিজয়ও দৌড় দিল ভ্যান ক্লকের কাছে। সার্চলাইটের আলোতে দেখা যাচ্ছে বিশাল বড় একটা পাথুরে শিলাস্তর, উচ্চতায় কমপক্ষে পনেরো ফুট। দেখে ঢেউ মনে হলেও খুব সহজেই পাঁচ মাথাঅলা সাপ হিসেবে ধরে নেয়া যায়। পাথরের এই কাঠামো যে কতটা প্রাচীন ভেবে অবাক হয়ে গেল বিজয়। হয়ত কোনো এক সময় সত্যিকারের সাপের মতই আকৃতি ছিল। পদ্যে যেমনটা লেখা আছে তবে হাজার হাজার বছরের ক্ষয়ও মৌলিক আকৃতিটার কোনো পরিবর্তন করতে পারেনি। এবার বুঝতে পারল তাহলে কিউবটার বয়স কত। ওরা যা ভেবেছিল তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি।

“গুহায় ঢোকার পথ খোজো।” ভ্যান কুক তাড়া দিতেই আবার ছড়িয়ে পড়ল পুরো দল।

খুব বেশি সময় লাগল না। সরু একটা ফাটল পাওয়া গেল যেখান দিয়ে একেকবারে একজন মাত্র মানুষ কোনোরকমে ভেতরে ঢুকতে পারবে।

“তুমি আগে যাও।” বিজয়ের দিকে তাকিয়ে দেতো হাসি দিল ভ্যান ক্লক, “তারপর আমাদেরকে জানাও যে ভেতরে যাওয়াটা নিরাপদ হবে কিনা।”

কুপারের বাহিনির একজনের সার্চলাইট টেনে নিয়ে মাথা নাড়ল বিজয়। তারপর ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

পাথরের মাঝখানে সরু একটা রাস্তা ধরে খানিক এগোতেই হঠাৎ করে আবার থেমে যেতে হল। কারণ পবর্তের অভ্যন্তরে কেটে তৈরি করা সিঁড়ি ধাপে ধাপে নিচের দিকে নেমে গেছে। নিচে আলো ফেলল বিজয়। বেশ ভালো একটা দূরত্বে বলতে গেলে পবর্তের একেবারে গভীরে নেমে গেছে সিঁড়ি।

“সবকিছু ঠিক আছে” চিৎকার করে জানিয়ে দিল বিজয়। এখানে সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে; অন্তত পাঁচশ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। আমি নামতে শুরু করলে কিন্তু আর আমার কথা শুনতে পাবে না।”

উত্তরের অপেক্ষা না করেই নামতে শুরু করল বিজয়। তলদেশে কী আছে দেখার জন্য তারও আগ্রহ কম নয়। যে সিক্রেট নিয়ে এত রহস্য এখন জানতে পারবে দেবতাদের সিক্রেটের প্রকৃত অর্থ; তাই নিজের চোখে দেখার জন্য তর সইছে না। মহাভারতে যেমনটা বর্ণনা করা হয়েছে সত্যিই কি তাই?

নিচে নামতে গিয়ে দেখা গেল বেড়ে গেছে চারপাশের আলো। অর্থাৎ অন্যেরাও পিছু নিয়েছে। কিন্তু একটুও না থেমে একেবারে তলদেশ অব্দি পৌঁছে গেল বিজয়।

চারপাশে সার্চলাইটের আলো ফেলে দেখল, বিশাল বড় একটা গুহাকক্ষ। বিস্ময়ে বন্ধ হয়ে গেছে মুখের ভাষা। মনে হচ্ছে যেন পুরো হিন্দুকুশ পবর্তমালার অভ্যন্তরভাগ নিয়ে তৈরি হয়েছে এ গুহাকক্ষ। একটা দেয়ালও নজরে পড়ছে না।

চোখে পড়ছে কেবল একটাই জিনিস। গুহার বেশিরভাগ জায়গা জুড়েই যা ছড়িয়ে আছে। পৌরাণিক কাহিনির উৎস। প্রকৃত রহস্য।

আর মহাভারতে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে চোখের সামনে ঠিক সেই দৃশ্য। চিরায়ত এক মহারহস্যের সৃষ্টির ভিত্তির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বিজয়।

.

৬৩. শুরু হল অনুসন্ধান

বিমানবন্দরের দিকে তীব্র গতিতে ধাবমান গাড়িতে বসে ক্ষতের সেলাইয়ের উপর হাত বোলালেন ইমরান। রাধার কাছ থেকে মেসেজটা পাওয়ার পর এরই মাঝে এক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। মেসেজের ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণীত হবার সাথে সাথে ইমরানের তড়িৎ অনুরোধের উত্তরে কমান্ডো টিমসহ তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ত্রিশ মিনিটের ভেতর তৈরি হয়ে যাবে একটা এয়ারক্রাফট। দশ মিনিট আগে স্থির হওয়া লোকেশনটা হল একটা মেডিকেল ফ্যাসিলিটি যা জয়পুর থেকে এক ঘণ্টার ড্রাইভ। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এই ফ্যাসিলিটি কিন্তু টাইটান ফার্মাসিউটিক্যালসের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য ভাড়া নেয়া হয়নি। অন্তত তাদের কন্ট্রাক্ট লিস্টে তো নেই।

যতক্ষণ পর্যন্ত রাধার নিশ্চিত কোনো খোঁজ না পেয়ে ব্যাপারটা কেবল আলোচনার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল ততক্ষণ হাসপাতালের বিছানায় যেন স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে শুয়েছিলেন ইমরান। কিন্তু এখন মেয়েটার অবস্থান জানতে পেরে আর বসে থাকার কোনো মানে হয়না। রেসকিউ টিমের অংশ তাকে হতেই হবে। আগেও এসব করেছেন এবং আবার করতেও কোনো দ্বিধা নেই। গত বছর থেকেই কেন যেন মেয়েটার সাথে এক আত্মিক বন্ধন অনুভব করছেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে উদ্ধার তৎপরতা দেখার জন্য কেউ যদি পরামর্শ দিত তাহলে বোধহয় ইমরান লোকটার থোতা মুখ ভোতা করে দিত।

যাই হোক আশার বাণী হচ্ছে এয়ারক্রাফট পাওয়াতে তারা এক ঘণ্টার আগেই জয়পুর পৌঁছে যাবে। এয়ারপোর্ট থেকে একটা হেলিকপ্টার নিয়ে যাবে তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।

এরই মাঝে টাইটান ফার্মার সিনিয়র পরিচালকেরা কে কোথায় আছে তাও চেক করে নিয়েছেন ইমরান। তাদের অনেকেই ভ্রমণরত হলেও একজন কেবল জয়পুরে আছে। তাও গিয়েছে চিকিৎসা সংক্রান্ত সম্মেলনে বক্তৃতা দেবার জন্য।

চিফ মেডিকেল অফিসার, ডা, বরুণ সাক্সেনা। নিশ্চয় ব্যাপারটা কাকতালীয় নয়।

পাথরের মূর্তির মত শক্ত চেহারা নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছেই দল নিয়ে অপেক্ষারত হেলিকপ্টারে উঠে গেলেন ইমরান।

তিনি রাধাকে অবশ্যই সুস্থ শরীরে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন।

.

যাবার সময় হয়েছে

সাক্সেনা আর ফ্রিম্যানের সামনে দিয়ে রুম থেকে বের করে অপেক্ষারত অ্যামবুলেন্সে ভোলা হল রাধার অচেতন দেহ। “মেয়েটা মারা গেছে। এতগুলো বুলেট হজম করে কারো বেঁচে থাকার কথা নয়। আর যদি তা নাও হয় রক্ত ক্ষরণই বাকি কাজ সেরে দিবে। ফ্যাসিলিটিতে নিয়ে এ শূন্যস্থান পূরণ করারও সময় নেই। আর যদি গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়; তাহলে তো বাঁচিয়ে তোলার আর কোনো সুযোগই থাকল না।”

কঠোর হয়ে গেল সাক্সেনার চেহারা, “বেয়াদব গার্ডগুলো! বদমায়েশগুলোর গুলি ছোঁড়াটা উচিত হয়নি। ও তো এখানে হোস্টেজ হিসেবে ছিল! তাই নির্দিষ্ট সময় না আসা পর্যন্ত গুলি করাটা ঠিক হয়নি।”

“হেই, ওরা তো শুধু ওদের দায়িত্ব পালন করেছে। অভিযোগ করলো ফ্রিম্যান। “গার্ডেরা তো জানত না যে ও আমাদের জিম্মি ছিল। সিসিটিভিতে মেয়েটার গতিবিধি দেখে সিকিউরিটি তদন্ত করে টয়লেটের মেঝেতে নিঃসাড় গার্ডকে খুঁজে পায়। আর তারপর তোমাকেও বন্দী অবস্থায় অ্যালার্ম বাজাতে দেখে। গার্ডেরা যখন ওকে গ্রাউন্ড ফ্লোরে খুঁজে পায় ভেবেছে কোনো রোগী বুঝি তোমাকে আটকে রেখে পালানোর পায়তারা কষছে। ফলে তারা তাদের। যা করার তাই করেছে। মনে নেই, কেউ বেঁচে থাকবে না মানে কেউ দেখবে না। তারা এটাই করেছে। গার্ডদেরকে এজন্য দোষারোপ করো না।”

“ওরা হচ্ছে সব বেকুবের দল।” বিড়বিড় করে উঠলেন সাক্সেনা, “পুরো বিষয়টাকে আরো জটিল করে তুলছে। কিন্তু আমি হতাশ নই। মেয়েটা মারা গেলেও বিজয় সিং তো আর জানতে পারছে না। এরই মাঝে কুপারকে জানিয়ে দিয়েছি। সে সব সামলে নেবে।”

কৌতূহলী হয়ে উঠল ফ্রিম্যান। “তাহলে তুমি কেন মেয়েটার শরীরে ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়ার ককটেইল ইনজেকশনের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দিয়েছ? বুলেট না মারলেও এতেই মারা যাবে মেয়েটা। আমরা তো ভালোভাবেই জানি। এই পরীক্ষার পর এখন পর্যন্ত একজনও বেঁচে ফেরেনি। আর তুমি তো ওকে আরো একস্ট্রা একটা ভোজ দিয়েছ।”

মাথা ঝাঁকালেন সাক্সেনা, “আমি তো ভেবেছিলাম যে এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য বড় একটা সুযোগ পাওয়া গেল। এর আগে ঢোজ দেয়ার জন্য মারাত্মক ক্ষত সমৃদ্ধ সুস্থ কোনো সাবজেক্ট পাওয়া যায়নি। দেখা যাক কী ঘটে। খুব বেশি খারাপ নিশ্চয় হবে না। কারণ মেয়েটা এমনিতেই মারা যাবে। কিন্তু চমৎকার কিছু হলেও হতে পারে” মনে নেই আলেকজান্ডারের মমিতে কী পেয়েছিলাম?”

সম্মত হল ফ্রিম্যান। “হুম, মনে আছে। আর ছয় মাস গেলেই আমার এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল জেনে যাবে।” তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে জানাল, “আশা করছি কেউ এতে আহত হবে না।”

চারপাশে তাকালেন সাক্সেনা, “চলো এখান থেকে চলে যাই। এক অর্থে ভালই হল যে আমি এখানে থাকাকালীন মেয়েটা ই-মেইল পাঠিয়েছে। অন্তত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে স্থান ত্যাগের সময়টাতে পাওয়া গেল। এরই মাঝে সার্ভারও মুছে ফেলা হয়েছে। তাই ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো চাইলেও কোনো তথ্য পাবে না। ফলে টাইটানের সাথে এই ফ্যাসিলিটিকে জড়াবার কোনো উপায়ও রইল না। তারপরেও আইবি’র জন্য ছোট্ট একটা জিনিস রেখে যাবো।”

মাথা নাড়লো ফ্রিম্যান। জানে সাক্সেনা কিসের কথা বলছে। “আহারে, সব নমুনাগুলোকে এখানে ছেড়ে যেতে হবে।”

“কোনো ব্যাপার না।” উত্তরে জানালেন সাক্সেনা, “আমাদের কাছে তো ওদের ইতিহাস আর রেজাল্ট আছে। ইতিমধ্যেই যে ফলাফল পেয়েছি তা ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন নমুনার উপর পরীক্ষা শুরু করতে কোনো সমস্যাই হবে ন। এছাড়া নমুনারই হয়ত আর কোনো প্রয়োজন নেই। কুপার যদি একবার উৎসের স্যাম্পল খুঁজে পায় তাহলেই কেল্লা ফতে।”

পরস্পরের দিকে তাকাতেই খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল দু’জনের চেহারা। যেভাবেই হোক না কেন মিশন সফল হবেই। এখন পথের কাঁটা বলতে আর কিছুই রইল না।

.

৬৪. দুধেল মহাসমুদ্র

একদৃষ্টে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে বিজয়। চারপাশে কেবল জল আর জল। বিশাল অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে যে একেবারে কাছের তীর ছাড়া আর কোন কিনার চোখে পড়ছে না। যতদূর দৃষ্টি যায় পুরো গুহাকক্ষে ছড়িয়ে আছে লেক।

কিন্তু এ আবিষ্কার তাকে স্তম্ভিত করেনি। ভ্যান ক্লকের কাছ থেকে আগেই ধারণা পাওয়ায় এরকম বৃহৎ জলাধারের আশাই করেছিল। অথচ এখন লেকের দৃশ্য দেখে দম বন্ধ হবার জোগাড়।

সার্চলাইটের আলোয় রূপালি সাদা দ্যুতি ছড়াচ্ছে পুরো লেক। এতক্ষণে পৌঁছে গেছে বাকি দল। সকলেরই অবস্থান বিজয়ের মতন। বিমূঢ় হয়ে দেখছে। সামনের শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য। সার্চলাইটের আলো পড়ে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। স্থির, নিশ্চল রূপালি-সাদা জল।

“এ কারণেই তারা এটাকে দুধেল মহাসমুদ্র বলত।” বিজয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে উঠল ভ্যান কুক।

কিন্তু বিশালাকার এ গুহাকক্ষে লুকিয়ে আছে আরো অনেক বিস্ময়। সিঁড়িপথের পাশের দেয়ালে সার্চলাইটের আলো ফেলতেই দেখা গেল সুবিন্যস্ত ধাতব পাইপ আর পাথরের নালা। লেকের দিক থেকে এসে বড়সড় একটা পাথরের গহ্বরে শেষ হয়েছে নালা। অন্যান্য পাইপ আর নালাগুলো এসে আরো অসংখ্য পাথরের জলাধারের সাথে যুক্ত হয়ে তৈরি করেছে বিশাল এক ধাতব যন্ত্র। যা তাদের মাথার উপরে উঁচু হয়ে আছে। পাইপ আর যন্ত্রটার নির্মাণে ব্যবহৃত ধাতু সম্পূর্ণ কালো। অথচ সার্চলাইটের আলো ধাতুর গায়ে এক ফোঁটাও মরিচা খুঁজে পেল না। বিজয়ের মনে পড়ল গত বছরের গোলাকার ধাতব ডিস্কটার কথা। পুরো যন্ত্রটা দেখে ঠিক যেন ইউএসে দেখা ছোট ছোট মদ চোলাইয়ের যন্ত্র বলে মনে হল।

হঠাই চিৎকার করে উঠল কুপারের বাহিনির একজন, “এখানে কিছু একটা নড়ছে!”

সাথে সাথে সবকটা সার্চলাইটের আলো ঘুরে গেল সেদিকে। সবাই স্থীর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। এক মুহূর্তের জন্য কিছুই ঘটল না।

আর তার পরপরই আলোর কিনারে কী যেন একটা দুলে উঠল। বড়সড়, গোলাকার দেহ। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সার্চলাইটের পুলে টলতে লাগল একটা বিশালাকার কচ্ছপ। এতবড় যে চওড়ায় অন্তত বিশ ফুট হবে। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না বিজয়। ধীরে ধীরে হেঁটে আলোর সীমারেখা পেরিয়ে ওপাশের অন্ধকারে হারিয়ে গেল জন্তুটা।

“ওকে, কাজে লেগে পড়ল সবাই।” আদেশ দিল ভ্যান কুক। পরবর্তী দশ মিনিটের মাঝেই স্যাম্পল সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করে ফেলা চাই। তারপর এখান থেকে বেরিয়ে যাবো।”

লেকের তীরে গিয়ে রূপালি উপরিভাগ পরীক্ষা করে দেখল বিজয়। বিশ্বাস করা শক্ত যে পৌরাণিক কাহিনিতে এ জলাধারের কথাই বলা হয়েছে। যদিও সে পানির রঙের সত্যিকার কারণটা জানে। দ্য গ্রেট আলেকজান্ডারের মমিতে অর্ডার যে ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পেয়েছে এটাই হল তার উৎস। দুই হাজার তিনশ বছর আগেকার সেই নিয়তিনির্দিষ্ট রাতে তিনি এই লেকের পানিই পান করেছিলেন।

কিন্তু তাহলে মারা গেলেন কেন? উনার ক্ষেত্রে কেন এটা কাজ করেনি?

“যাবার সময় হয়েছে।” বিজয়ের চিন্তায় বাধা দিল ভ্যান কুকের তীক্ষ্ণ গলা। “সবাই বের হয়ে যাও।” এরপর বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “জালালাবাদ ফেরার সময়ে আমাকে সবশেষ পদ্যটার অর্থ জানাবে।”

.

ধাঁধার মীমাংসা

বিজয়ের ফোনের অপেক্ষায় স্টাডিতে বসে আছে এলিস আর কলিন। বিজয় স্যাটেলাইট ফোনের নাম্বার শেয়ার করার অনুমতি না পাওয়ায় ওর সাথে যোগাযোগ করারও কোনো উপায় নেই। আপাতত ঘুমের বাহানায় রুমে গেছেন ভা, শুক্লা। কিন্তু এখনো রাধার কোনো খবর না পাওয়ায় উনি যে কতটা ঘুমাতে পারবেন তা কলিন ভালোভাবেই জানে।

হঠাৎই রাতের নীরবতাকে চিরে দিয়ে ফোন বেজে উঠল। হুড়াহুড়ি করে ফোন ধরতে ছুটল কলিন। স্পিকার অন করে দিল যেন এলিসও শুনতে পায়।

“হাই, বিজয়” বন্ধুকে সম্ভাষণ জানিয়ে বলল, “এলিসও এখানে আছে।”

“গাইজ, এতক্ষণে নিশ্চয় আমার জন্য কিছু পেয়েছ?”।

“হুম পেয়েছি।” কণ্ঠস্বরের গর্বিত ভাব লুকাতে পারল না কলিন। “তোমার প্রয়োজনমত সর্বশেষ অবস্থানটা হল উসিয়র্ত মালভূমি; যা কাজাকাস্তান আর উজবেকিস্তানকে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। পদ্যে তিন ভাতা নামে যে স্থানের উল্লেখ করা হয়েছে তা প্রাকৃতিকভাবেই গঠিত কাজাক অংশের মালভূমি। এটা কাজাকাস্তানের অত্যন্ত কঠিন একটা অঞ্চল। যাত্রাপথে জান বেরিয়ে যাবে। এলিস আর আমি ঝাড়া পয়তাল্লিশ মিনিট ধরে পুরো জিনিসটা নিয়ে গবেষণা করেছি।”

“অসাধারণ! আর তীরের মত মাথা? যা কিনা পথ দেখাবে?”

ইন্টারনেটের মাধ্যমে কী পেয়েছে তা খুলে বলল কলিন।

“বেশ যুক্তিযুক্ত। অদ্ভুত হলেও অসম্ভব নয়। বাজি ধরে বলতে পারি।”

“আমিও। তবে সত্যি কথা বলতে আমার কোনো ধারণাই নেই যে ওখানে কী খুঁজে পাবে। কারণ অনুসন্ধানের কেন্দ্রস্থল” মানে এখনো জানিনা।”

“আমি জানি। এটা হল একটা ভাইরাস। মালভূমিতেই আছে ভাইরাসের উৎস। কুনার ভ্যালিতে ব্যাকটেরিয়া পেয়েছি। এখান থেকেই তৈরি হচ্ছে অমৃত। তাই আর বাকি আছে প্রকৃত ভাইরাসের নমুনা। আর অমৃতের জন্য ভাইরাস প্রধান উপাদান হওয়াতে মালভূমিই হল অনুসন্ধানের কেন্দ্রস্থল।” কুনার উপত্যকায় কী পেয়েছে তা বর্ণনা করল বিজয়।

“তার মানে এখন কেবল ক্যালিসথিনস ব্যাকট্রিয়া থেকে কী পেয়েছিলেন তার মর্মোদ্বার করা বাকি আছে?” ভেবে বলল এলিস, “তুমি কি চাও আমরা এটা নিয়েও গবেষণা করি?”

খানিক বিরতি দিয়ে দলের সাথে আলোচনা করে এলো বিজয়। তারপর লাইনে ফিরে জানাল, “না, দরকার নেই।” এতক্ষণ ভ্যান ক্লকের সাথে কথা বলেছে। “ওরা এটা নিয়ে কাজ করছে। পদ্য সম্পর্কে আর কিভাবে উল্লেখিত জিনিসগুলো খুঁজতে হবে জেনে যাওয়ায় এদিকটা ওরাই সামলাবে। থ্যাংকস, গাইজ। তোমরা যে কত উপকার করলে।” বিদায় জানিয়ে ফোন কেটে দিল বিজয়।

মনমরা হয়ে এলিসের দিকে তাকাল কলিন, “ও একবারও রাধার কথা উচ্চারণ করেনি।”

ব্যাপারটা এলিসও খেয়াল করেছে, “তুমি ঠিকই বলেছ। মেয়েটার মুক্তি নিয়ে আলোচনা করার মত অবস্থানে পৌঁছেও ওকে খুশি মনে হল না।”

“এমন না যে ও চেষ্টা করলে সফল হবে না।” ব্যাখ্যা করল কলিন, “আমার তো মনে হয় ও রাধাকে ফিরে পাবার আশাই বাদ দিয়েছে।”

চুপচাপ বসে বিজয়ের মানসিক অবস্থার কথা ভাবতে লাগল দুজনে। নিজের বাগদত্তাকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে এমন একদল লোকের মাঝে ছেলেটা একা পড়ে গেছে। আর যদি সে মেয়েটাকে ফিরে পাবার আশা ত্যাগ করে তাহলে তো সত্যিই উদ্বেগের কথা।

.

৬৫. জয়পুর, রাজস্থান

জয়পুরে বিমানবাহিনির ঘাঁটি থেকে তলব করে আনা দুটো হেলিকপ্টারের একটা এম আই-টুয়েন্টি সিক্সের মধ্যে বসে আছেন ইমরান। এই হেলিকপ্টার পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন মিলিটারি বাহন হওয়ায় এই মিশনের জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত। রাধার অবস্থানে কমান্ডোদেরকে বহন করে নেয়ার জন্য কাজে লাগানো হচ্ছে এই দুই চপার।

এইমাত্র জয়পুরের শহরতলী ছাড়িয়ে পেছনে ফেলে এসেছে নগরের বাতি। সামনে এখন গাঢ় অন্ধকার। মাঝে মাঝে ছোট ছোট আলোর ফুটকি। নিয়মিত বিরতিতে লাল ওয়ার্নিং লাইটের জুলানেভা দেখে আঁধার সত্তেও স্পষ্ট বুঝতে পারছে অন্য হেলিকপ্টারের অস্তিত্ব।

শহর ত্যাগ করার প্রায় দশ মিনিট পরে ঠিক সামনেই বিশাল এক আলোর কুন্ডলি দেখা গেল। এটাই হল তাদের টার্গেট মেডিকেল ফ্যাসিলিটির কম্পাউন্ড।

রাধার লোকেশন নির্ণয় করার সাথে সাথে জয়পুর পুলিশকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যেন কম্পাউন্ডের চারপাশে রোড ব্লক বসানো হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেডিকেল সেন্টার ছেড়ে যাবার জন্য কারো তৎপরতার কথা রিপোর্ট করেনি পুলিশ।

দুশ্চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন ইমরান। এর মানে তো কেবল দুটো জিনিস হতে পারে। হয় বরুণ সাক্সেনা ফ্যাসিলিটতে নেই কিংবা রোড ব্লক বসানোর আগেই চলেই গেছে। যাই হোক না কেন টাইটানের সি এমওকে বুঝি ফাঁদে আটকানো গেল না।

টার্গেট লোকেশনে পৌঁছে অবতরণ শুরু করল দুই বিশালদেহী হেলিকপ্টার। ফ্যাসিলিটিতে যাবার জন্য বেশ চওড়া একটা ড্রাইভওয়ে আছে। এখানেই ল্যান্ড করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে ঢুকে গেল হ্যাঁচ। পিল পিল করে নেমে এলো কমান্ডোবাহিনি। কম্পাউন্ডের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে যার যার অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেল। তবে কমান্ডোদের মূল দল ইমরানের পিছু নিয়ে অত্যন্ত গোপনে এগোল দালানের দিকে। কমান্ডোবাহিনিকে বাধা দেবার জন্য কোনো সশস্ত্র দল আছে বলে মনে হচ্ছে না; কিন্তু তারপরও আগে ভাগে কিছুই বলা যায় না যে কী ঘটবে।

রিসেপশনের বাতি বন্ধ। নীরব দালানটা মনে হচ্ছে একেবারেই পরিত্যক্ত। সুইচ বোর্ড দেখা গেলেও কোনো জনপ্রাণী নেই। পুরো দালানের দুই তলা ছেয়ে ফেলল কমান্ডোবাহিনি। কিছুই পাওয়া গেল না। বোঝা গেল যে সকলে ইচ্ছেকৃতভাবেই স্থান ত্যাগ করে গেছে।

“সিসিটিভি আর্কাইভ চেক করো। মুছে না ফেললে হয়ত কিছু পেয়ে যাবে।” অর্জুনকে নির্দেশ দিলেন ইমরান। ডেপুটি বাকি দলকে নিয়ে আর্কাইভ চেক করতে গেলেও তিনি গ্রাউন্ড ফ্লোরেই রয়ে গেলেন। এলিভেটরের কাছে যেতেই মনে পড়ল দিল্লির মেডিকেল সেন্টারের বেসমেন্টের কথা।

লিফট চেক করে তিনটা বেজমেন্ট ফ্লোরের বাটন খুঁজে পেলেন ইমরান। কিন্তু অ্যাকসেস কার্ড ছাড়া লিফট সচল করার উপায় নেই। তবে এবার তিনি প্রস্তুত হয়ে এসেছেন। তার দলের ইলেকট্রনিকস এক্সপার্ট হাতে বহনযোগ্য এমন এক মাস্টার প্রোগ্রামার বানিয়ে দিয়েছে যার মধ্যে এলিভেটরের সিকিউরিটি সিস্টেম নষ্ট করে যেখানে খুশি যাওয়া যাবে।

গুনগুন করে উঠল ইয়ার ফোন। অর্জুন। “স্যার, আপনি একটু আসবেন?”

“এক্ষুনি আসছি।” কমান্ডো টিমের কাছে যাবার জন্য ঘুরলেন ইমরান। “অ্যাকসেস পেলেই সব ফ্লোর খুঁজে দেখ! শেষ করেই আমাকে রিপোর্ট করবে। আমি জানতে চাই নিচে কী আছে।”

খানিক বাদেই সিকিউরিটি সেন্টারে অর্জুনের পাশে এসে দাঁড়ালেন।

“স্যার, অদ্ভুত একটা জিনিস পেয়েছি।” ইমরানকে দেখানোর জন্য ভিডিও ক্লিপ প্লে করার আগে জানাল অর্জুন, “আর্কাইভস, একেবারে ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলা হয়েছে। একটা বাদে আর কোনো রেকর্ডিং নেই। এটাই মাথায় ঢুকছে না। সব মুছে ফেললেও একটা কেন রেখে গেছে?”

“চলো, দেখাও।” শক্ত হয়ে গেল ইমরানের চেহারা। কেন যেন মনের মাঝে অশনি সংকেত বেজে উঠেছে। মানে নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্যেই রেখে গেছে এই ক্লিপ। তাই সন্দিগ্ধ চোখে মনিটরের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

ভিডিও ক্লিপে দেখা গেল মেঝেতে ল্যাপটপের উপর ঝুঁকে বসে আছে। রাধা।

সাথে সাথে সচকিত হয়ে উঠলেন ইমরান। বুঝতে পারলেন কী ঘটছে। মনে হচ্ছে তাল হারিয়ে পড়ে যাবেন। কয়েক সেকেন্ড পরেই ল্যাপটপ রেখে উঠে দাঁড়াল রাধা। সাবধানে চার পাশে তাকিয়ে হাঁটা আরম্ভ করল। ঠিক সেই মুহূর্তেই পর্দার কিনারে আরেকটা দৃশ্য দেখাল অর্জুন। অডিও না থাকলেও তিনজন গার্ড যে তাদের অস্ত্র উঁচিয়ে রাধাকে গুলি করছে তা বুঝতে কোনো

অসুবিধাই হল না। আতঙ্কে জমে গেলেন ইমরান। রক্তের সমুদ্রে ডুবে গেল রাধা। মেয়েটার ক্ষতস্থানের রক্ত ছড়িয়ে পড়ল মেঝের সর্বত্র।

তারপর হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল ভিডিও ক্লিপ।

ইমরানের পায়ে যেন শেকড় গজিয়ে গেছে। একেবারে অথর্বের মত নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখের সামনে এইমাত্র রাধাকে মারা যেতে দেখেছেন।

.

৬৬. ষষ্ঠ দিন

সমুদ্র মন্থন

ভ্যান ক্লকের অতিশয় আরামদায়ক আর জাকজমকপূর্ণ গাম্ফস্ট্রিম জেটের পেটে বসে আছে বিজয়। গন্তব্য কাজাকাস্তানের আকর্তাও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর; যেখান থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে কলিনের বর্ণিত অবস্থানে পৌঁছে যাবে। তাদের আগমনের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করছে একদল সশস্ত্র প্রহরী। সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে অর্ডার যখন যেখানে খুশি তাদের লোকজন আর অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়ে দিতে পারে।

বাইরে এখনো রাত। ভ্যান ক্লকের চাপে তৎক্ষণাৎ রওনা দিতে হয়েছে। সূর্যোদয় হবার আগেই মালভূমিতে পৌঁছাতে চায়। কী খুঁজছে জানলেও দিনের কোন সময়টার ছায়া পড়ে উন্মোচিত হবে ভাইরাসের উৎস সেই গোপন প্রবেশপথ সে সম্পর্কে কারো কোনো ধারণা নেই। তাই সকালে অবতরণ করাটাই সবচেয়ে নিরাপদ হবে।

ইতোমধ্যেই আকর্তাও থেকে রওনা হয়ে গেছে একটা অ্যাডভ্যান্স টিম। সারা দিনের প্রায় অর্ধেক ব্যয় করে ফোর হুইল ড্রাইভে চড়ে বালি আর কাদাময় পথ পাড়ি দিয়ে ৪০০ কি. মি. দূরত্বে পৌঁছে অপেক্ষা করবে মূল দলের জন্য আর একই সাথে পুরো এলাকা টহল দিয়ে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বও তাদের হাতে।

হঠাৎ করেই বিজয়ের মাথায় একটা চিন্তা এলো। কুনার উপত্যকায় ভ্যান ক্লকের ধারণাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তারপরেও কেন যেন মহাভারতের পৌরাণিক কাহিনির সাথে মিল খুঁজে পাচ্ছে না।

ভ্যান কুকের সাথে ক্রসচেক করল নিজের ধারণা।

“অবশ্যই আমরা যা পেয়েছি তা মহাভারতেই লেখা আছে।” ঘোৎ ঘোৎ করে উঠল ভ্যান কুক, “তোমাকে কেবল পদ্যগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা করতে হবে।” উঠে কেবিনেটের কাছে গিয়ে মোটাসোটা একটা বই তুলে এনে টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বলল, “সংস্কৃত বোঝো?”

মাথা নেড়ে না বলল বিজয়।

“হুমম, বেশিরভাগ ভারতীয়েরই একই অবস্থা।” কণ্ঠের হতাশা লুকাতে পারলেন না ভ্যান কুক, “আমি এ ভাষা গড়গড় করে পড়তে পারি।” বললো, “চলো তোমাকে ব্যাখ্যা করে শোনাই।”

বইটা খুলে একের পর এক পাতা উল্টে বলল, “এটা আদি পর্বের ভলিউম মহাভারতের একেবারে প্রথম বই। এখানেই সমুদ্রমন্থনের গল্পটা আছে।”

প্রথমবারের মত বিজয় উপলব্ধি করল যে ইউরোপীয় ক্লকের সংস্কৃত উচ্চারণ একেবারে নিখুঁত। শুধু অন্যান্য পশ্চিমাদের মত খানিকটা টান আছে। হয়ত একেবারে ছোট বয়সে শিখেছে। তারপর বছরের পর বছর ধরে পরিচর্চা করে সংস্কৃত পড়া আর লেখায় এতটা দক্ষতা আয়ত্ত করেছে।

“আহ, এই তো পেয়ে গেছি।” নির্দিষ্ট পাতার উপর আঙুল রেখে বলল ভ্যান কুক। “আদি পর্বের কয়েকটা শ্লোক আমাদেরকে হাজার হাজার বছর আগেকার ঘটনা জানাবে। অবশ্য শ্লোকের সত্যিকার অর্থের উপর ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা আর সময়ের আবর্তে হারিয়ে গেছে ঘটনাগুলোর প্রকৃত আবহ। বস্তুত এই গল্পের ইংরেজি নামটার মাঝেই গড়ল আছে। সত্য বটে সমুদ্রমন্থন বলতে মহাসমুদ্রের ঘূর্ণিও বলা যায়। তবে মন্থনের আসল শিকড় হল গণিত। ইংরেজিতে যেটার অসংখ্য অর্থ আছে। এর মাঝে একটা হল সবেগে ঘোরা। অন্য অর্থগুলোর মাঝে আছে মেশানো, নাড়া অথবা আলোড়িত করা। তার মানে ঐতিহাসিক টাইটেলটাকে ব্যাখ্যা করলে “সমুদ্রকে নাড়িয়ে দেয়া।” কিংবা “মিশিয়ে দেয়া বোঝায়।” আর তুমি নিজের চোখেই যা দেখেছ তার জন্য এটাই বেশি উপযুক্ত নয় কি? এছাড়া লেকের পাশে যে যন্ত্র দেখলাম তাতে তো তাই ঘটছে। লেকের পানি পাথরের নালা বেয়ে জলাধারে গিয়ে জমা হয় আর তারপর সমস্ত উপাদান মিশে যায়। হতে পারে যন্ত্রটা পানি তোলার সময় লেকের পানি নড়ে উঠে আর তাই লোকে এটাকে সবেগে ঘোরা” হিসেবেই ব্যাখ্যা করে। দেখা যাক আরো কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় কিনা।

মাথার উপরের বাতি জ্বালিয়ে বইয়ের পাতায় পিটপিট করে তাকাল ভ্যান কুক। “এসো, এই শ্লোকটা শোন:

देवैरसुरसंधै श्च मथ्यतां कलशोदधिः
भविष्यत्यमृतं तत्र मध्यमाने महोदधौ

শ্লোকটার ঐতিহাসিক অর্থ হল: দেবতা আর দানবদের হাতে সবেগে ঘোরার পর সমুদ্রের জল অমতের পাত্রে পরিণত হবে। কিন্তু তুমি যদি সবেগে ঘোরা বলে নাড়া কিংবা মেশানো বলল তাহলে পুরো অর্থটাই বদলে যাবে। ব্যাখ্যা হিসেবে পাবে: দেবতারা আর দানবেরা সমুদ্রের জলকে নেড়ে কিংবা মিশিয়ে

অমৃতের পাত্রে পরিণত করবেন।”

পরের শ্লোকটাও পড়ে ফেলল কুক :

सौषधीः समावाप्य सर्वरनानि चैव हि।
मन्थध्वमुदधिं देवा वेत्स्यध्वममृतं ततः

এখানকার ঐতিহাসিক অর্থ হল: সব ধরনের ঔষধি গাছ আর রত্ন অর্জনের (পর) ও ঈশ্বর, সমুদ্রকে সবেগে ঘোরাও; তাহলেই তুমি অমত পাবে।” আবারো যদি নাড়া কিংবা মিশিয়ে দেয়া ব্যবহার করো তাহলে কিউবে বর্ণিত গাছ আর ফল খুঁজে পাবে।”

যা শুনছে তা কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না বিজয়। বেড়ে উঠার দিনগুলোতে এই পৌরাণিক কাহিনি একাধিকবার শুনলেও ভ্যান কুক তার নিজের শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন সব ব্যাখ্যা দিচ্ছে।

“এবারে, কুনার উপত্যকায় যা পেয়েছি তার সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত একটা শ্লোক শোন:

ततस्तेन सुराः सार्धं समुद्रमुपतस्थिरे।
तमूचुरमृतार्थाय निर्मथिष्यामहे जलम्

এই শ্লোকের ঐতিহাসিক অর্থ হল: “তারপর দেবতারা আর দানবেরা সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে বললেন, “অমৃতের জন্য আমরা সমুদ্রকে সবেগে ঘোরা।” এখানে মজার ব্যাপার হল, সমুদ্র বলতে “পানির সন্নিবেশকে বোঝায়। আমরা তো তাই পেয়েছি, নাকি? তাহলে এই শ্লোকের প্রকৃত অর্থ হল: “তারপর দেবতারা আর দানবেরা পানির সন্নিবেশের কাছে দাঁড়িয়ে বললেন অমৃতের জন্য আমরা পানিকে নাড়ব কিংবা মিশিয়ে দেব।”

তারপর কয়েকটা পাতা উল্টে আরেকটা পদ্যের দিকে ইশারা করল কুক:

“এখানেই আসছে বিজ্ঞান। তবে এই শ্লোকের সঠিক ব্যাখ্যা পাবার জন্য তোমার কিন্তু একটা খোলা মন থাকতে হবে।

तत्र नानाजलचरा विनिष्पिष्टा महाद्रिणा।
विलयं समुपाजग्मुः शतशो लवणाम्भसि

ঐতিহাসিকভাবে এর মানে হল: “তখন বিশালাকার পর্বতের চাপে চূর্ণ হয়ে বিভিন্ন ধরনের জলজ প্রাণী একসাথে ধ্বংস হয়ে যায় আর তারপর লবণাক্ত পানিতে আরো শতবার পুনর্জাত হয়ে উঠে।” জালাকারার অনুবাদে “সামুদ্রিক প্রাণী” বলাটা আসলে শুদ্ধ নয়। এই শব্দের মানে “পানির দ্বারা বেঁচে থাকা” আর তাহলে পানিতে বসবাসরত যে কোনো প্রাণিসত্তাকেই বোঝাচ্ছে। এর মাঝে আমরা যে লেক পেয়েছি সেখানে বসবাসরত ব্যাকটেরিয়াও আছে। খেয়াল করো বিনিসপিস্তা শব্দটার মানে “নিচে বোঝায়।” সবশেষে, আবারো লবণ পানির কথা উল্লেখ আছে। আম্বাসি মানে জল আর লাভানাম মানে হল লবণাক্ত। তার মানে আমরা যে লেক পেয়েছি তার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। তাহলে নতুন করে অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: “সামুদ্রিক প্রাণিসত্তা অথবা ব্যাকটেরিয়া লবণাক্ত পানিতে ধ্বংস হয়েও আরো শতবার পুনর্জাত হয়ে উঠে।” আরো ভালোভাবে বললে, “রেট্রোভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে সংক্রমণের পর তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্যকে বদলে দেয়, এক ধরনের পুনর্জীবন, তাই না? তুমি কী বলো?”

“মিঃ ভ্যান কুক” স্পিকারে ভেসে এলো পাইলটের গলা, “আমরা আকতাও এ অবতরণ করতে যাচ্ছি। ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই ল্যান্ড করব।”

বই বন্ধ করে অনুসন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে বিজয়ের দিকে তাকাল ভ্যান ক্লক, “আরো অনেক কিছু আছে। অনেক, অনেক কিছু। কিন্তু হাজার হাজার বছর আগেকার একটা বৈজ্ঞানিক ঘটনা মহাভারত কিভাবে বর্ণনা করেছে দেখেছ? আর এটা কোনো মহাসমুদ্র কিংবা সমুদ্র নয়, লবণাক্ত জলই হল এ ঘটনার ভিত্তি। নিজের চোখেই যা এইমাত্র দেখলে।”

মাথা নাড়ল বিজয়। মুখের ভাষা হারিয়ে যেন বোবা হয়ে গেছে। শ্লোকের পেছনে লুকিয়ে থাকা অর্থ অনুধাবনের চেষ্টা করছে যা ভাসা ভাসাভাবে বর্ণনা করেছে এক চমৎকার ঘটনার গল্প।

.

৬৭. ইঁদুর দৌড়

ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকালেন প্যাটারসন। মনে হচ্ছে সারারাত এভাবেই কেটে যাবে। জয়পুর থেকে এসে আবার হাসপাতালের রুমে ফিরে এসেছেন ইমরান। সেলাইয়ের ক্ষতে ব্যথা করছে আর সারারাত ভ্রমণের ক্লান্তিও আছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ আর সার্জারির ফলে দুর্বল হয়ে পড়ায় জয়পুরের ভ্রমণ কোনো সাহায্য করেনি।

রাধার সম্পর্কে প্যাটারসনকে সমস্ত কিছু জানিয়েছেন ইমরান। পুরো সময় জুড়ে উদাসীন মুখ নিয়ে বসেছিলেন বড়সড় প্যাটারসন। এটা একটা যুদ্ধ আর আগেও দলের সহকর্মী হারিয়েছেন। তাই শোক করার জন্য পরেও সময় পাওয়া যাবে। এখনো বহু কাজ বাকি।

কিন্তু কলিনের খবর শুনে তেমন খুশি হলেন না।

“কেন এত জায়গা থাকতে কাজাকাস্তানকেই বেছে নিল?”

ঘোৎ ঘোঁৎ করে উঠলেন প্যাটারসন। “মাত্র কয়দিন আগেই কিরগিজস্তান থেকে সামরিক ঘাঁটি তুলে আনা হয়েছে। মধ্য এশিয়ার আর কোথাও কোনো আমেরিকান ঘাঁটি নেই। আফগানিস্তানে যতক্ষণ ছিল চাইলে ওখানকার ড্রোন ঘাটি দিয়ে বিজয়কে সাহায্য করতে পারতাম কিংবা ঝামেলা ছাড়াই বের করে নিয়ে আসতে পারতাম। ওখানে এখনো আমাদের সেনাবাহিনি আছে। কিন্তু কাজাকস্তানে ব্যাপারটা কঠিন হয়ে যাবে। পুরো অঞ্চল এখন বেসামাল হয়ে আছে। আফগানিস্তানের যে কোনো ফ্লাইটকে উজবেক আর কাজাক আকাশসীমা পেরোতে হবে। আর আফগান ঘাঁটি থেকে হেলিকপ্টার ব্যবহার করারও উপায় নেই, ওদের এত রেঞ্জ নেই। এত স্বল্প নোটিসে মনে হয় না এসব দেশ তাদের আকাশসীমায় আমাদের ফাইটার জেটকে অনুমতি দেবে।”

“এর মানে এখন থেকে বিজয়ের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে?” সশব্দে চিৎকার করে উঠলেন ইমরান।

কাঁধ ঝাঁকালেন প্যাটারসন। “ওকে কাভার দেয়ার জন্য আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। কিন্তু দুশ্চিন্তা সেটা না। এটার জন্য ওয়াশিংটন থেকে যা যা করার আমি করব। কিন্তু ভয় হচ্ছে হাতে বোধহয় যথেষ্ট সময় নেই। যদি ওরা কাজাকের স্থানীয় সময় অনুযায়ী কাল ভোরের মধ্যেই পৌঁছে যায় তাহলে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় আছে। তাহলে এই কথাই রইল। আমি দেখছি কী করা যায়।”

“অল দ্য বেস্ট।” সাইন অফ করে মনিটরের সুইচ বন্ধ করে দিলেন ইমরান। বুকের ভেতরটা একেবারে শূন্য হয়ে গেছে। ইতোমধ্যেই রাধাকে হারিয়েছেন। আর প্যাটারসনও বিজয়কে সাহায্য করার ব্যাপারে তেমন কোনো আশা দিতে পারল না। খারাপ দিকগুলো ইমরান ভালোই জানেন। আর মন না চাইলেও মানতে বাধ্য হচ্ছেন যে আজ দ্বিতীয় আরেক বন্ধুকেও হারাবেন।

.

তিন ভ্রাতা

উসিয়ত মালভূমি পার হবার সময় হেলিকপ্টার দিয়ে বাইরে তাকাল বিজয়। অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে বালুয় মোড়ানো সমতল ভূমি। ভোরের আলোয় তেমন কোনো গাছপালা চোখে পড়ছে না আর যতদূর দৃষ্টি যায় পানিও নেই। একেবারেই হতশ্রী দশা।

মরুভূমির বালি ভেদ করে ঊর্ধ্বে উঠে গেছে দানবীয় সব পাহাড়ের সারি; চুনাপাথরের পাহাড়। মনে হচ্ছে যেন মাথার উপর দিয়ে যেই উড়ে যাক না কেন সেটাকে ধরার প্রয়াস করছে। খাজ কাটা, ভাঙ্গা চূড়াগুলো কমপক্ষে ৩০০ মিটার উঁচু। সগর্বে জাহির করছে ভিন্ন ভিন্ন রঙ, শ্বেতশুভ্র সাদা থেকে শুরু করে নীল আর গোলাপি। এত উপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবী নয় অন্য কোনো গ্রহ।

এখানেই কি তাহলে লুকিয়ে আছে ভাইরাসের উৎস? শীঘ্রিই জানা যাবে এর উত্তর।

আর ঠিক যেন বিজয়ের মনের কথা পড়তে পেরেই ঘুরে গেল পাইলট। স্পিকারে জানাল নিচের এই পাথুরে আকৃতিই তিন ভ্রাতা নামে সর্বাধিক পরিচিত।

“তীরের মুখ খোজো” নির্দেশ দিল ভ্যান কুক, “আমি চাই সবার চোখ যেন মাটিতে থাকে।”

বিস্মিত বিজয়ের চোখের সামনে নিচের সমতলভূমি এক বিশালাকার তীরের আকার নিল। মনে পড়ল মাইলের পর মাইল জুড়ে ভূমিতে খোদাইকৃত নাজকা আকৃতির কথা। তবে এখানে তীর ছাড়া আর কোনো কাঠামোর অস্তিত্ব নেই।

তীরগুলো একসাথে মিলে ইউ-শেপ তৈরি করায় অগ্রভাগ খুঁজে পেতে কোনো সমস্যাই হল না।

পদ্যের অর্থ বুঝতে পারল বিজয়। ভ্যান ক্লক কেন সূর্যোদয়ের আগেই পৌঁছাতে চেয়েছে তার কারণও টের পেল।

আবির্ভূত হয়েছে তিন ভ্রাতার আকৃতি। একই সাথে রাজকীয় আর ভয়ংকর। আশেপাশের পুরো অঞ্চলকে ডুবিয়ে দিয়ে খাড়াভাবে প্রকাণ্ড চুনাপাথরের বালিয়াড়ির মত গর্বিত ভঙ্গিতে ঊর্ধ্ব মুখে উঠে গেছে তীক্ষ্ণ পাথরের তিনটা কলাম। তবে পুরোটাই খালি কোনো গাছপালা নেই। সদ্যজাত সূর্যের আলোয় পূর্বদিকে আগুন ধরে গেছে।

জনমানবশূন্য মালভূমির সৌন্দর্যকেও হারিয়ে দিল প্রকৃতির এই অনিন্দ্য সুন্দর সৃষ্টি। চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়ল। প্রকৃতির কোনো উপাদান যদি মৃত্যুহীন জীবন দান করতে পারে তাহলে এটাই হচ্ছে সেই শ্রেষ্ঠ জায়গা।

“তিন ভ্রাতা” এরকম সৌন্দর্য দেখে ভ্যান কুক নিজেও ‘খ’ বনে গেছে। কিন্তু হুশ ফিরতেই পুরোপুরি সামরিক কায়দায় একের পর এক নির্দেশ দিয়ে গেল।

অন্যদিকে মাটিতে পিঁপড়া সদৃশ আকৃতি চারপাশে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে একটা এস ইউ ভি। অ্যাডভান্স টিম।

আর তারপরেই বিজয়ের চোখে পড়ল আরেক সেট তীরের মাথা। পথিমধ্যে ফেলে আসা বাকিগুলোর মতই মালভূমির পাথর। তবে এগুলো তিনজন ভ্রাতার দিকে নির্দেশ করছে; অথচ বাকিগুলোর মুখ ছিল উত্তরে।

পথ দেখিয়ে দিবে তীরের মাথা।

কিন্তু পদ্যে কোন তীরের মাথার উল্লেখ করা হয়েছে? প্রতিটিই পাথরের দিকেই পয়েন্ট করছে; কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন অংশ।

“এগুলোর কোনটা?”।

হেলিকপ্টারের রোটরের গর্জন ছাপিয়ে শোনা গেল কুপারের চিৎকার। “ছায়া এসে যেটাকে স্পর্শ করবে, সেটাই আমাদেরকে সিলের কাছে নিয়ে যাবে!” পাল্টা চিৎকার করে উত্তর দিল ভ্যান ক্লক, “দেখ, এরই মাঝে সরতে শুরু করেছে।”

কুকের কথাই ঠিক। কাঁপতে শুরু করেছে ভোরবেলার সূর্যের তৈরি ছায়া; আস্তে আস্তে পিছিয়ে পাথুরে বিন্যাসের দিকে সরে যাচ্ছে।

“এখানে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরা যাবে না!” গজগজ করে উঠল কুপার, আর যতটুকু ফুয়েল আছে তা দিয়ে কোনো মতে কেবল আকতাও ফেরা যাবে।”

“তীরের মাথায় নির্দেশ করছে!” জবাব দিল ভ্যান কুক, “আমরা এখন নিচে নামব।”

অবতরণ শুরু করেছে হেলিকপ্টার আর এদিকে মাটিতে বিভিন্ন তীরের মাথার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে অ্যাডভান্স টিম। বিজয় বুঝতে পারল কী ঘটছে। দিনের আলো ফুটতেই সাদা পতাকা পুঁতে দেয়ার কাজ শুরু করেছে। এই টিম। সঠিক তীরের উপর ছায়া পড়লেই সাদা পতাকার ছায়া দেখে বুঝে যাবে কোথায় যেতে হবে।

ধুলা আর বালির ঝড় তুলে ল্যান্ড করল হেলিকপ্টার। রোটরের শব্দে কানে তালা লেগে যাবার জোগাড়।

চারপাশের দৃশ্য সত্যি মনোমুগ্ধকর। বিশালাকার জনশূন্য সমভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিন ভাতা নামক পাথুরে বিন্যাস। সূর্য আকাশে চড়ার সাথে সাথে বহুদূরে বদলে যাচ্ছে পাহাড় চূড়ার রঙ।

“একটা ব্যাপার মাথায় ঢুকছে না।” বলে উঠল বিজয়। এই মুহূর্তে উভয় তীরের মাথায়ই ছায়া পড়েছে। যত সময় যাচ্ছে উভয় মাথাই সরে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট একটা দিকেই নির্দেশ করছে!”

“ধীরে বৎস ধীরে” ভ্যান ক্লক জানাল, “মনে রাখবে কিউবটা অর্ডারের তৈরি, আমরা যাই করি না কেন তার একটা উদ্দেশ্য অবশ্যই থাকবে। পদ্যে যদি লেখা থাকে যে এই নির্ণীত হবে সেই অবস্থান; তাহলে আমার বিশ্বাস তাই ঘটবে।”

অপেক্ষা করছে পুরো দল।

এখনো পিছু হটছে ছায়া। কোনটা হবে তাদের কাঙ্ক্ষিত পথপ্ৰদৰ্শক তীর?

.

৬৮. সাপের সিল

কাঁপতে কাঁপতে দুটো তীরের মাথা অতিক্রম করে একেবারে ডানদিকেরটার উপর গিয়ে স্থির হল ছায়া। একসাথে চিৎকার করে উঠল পুরো দল। তিন ভ্রাতার সবচেয়ে ছোটটির দিকেই নির্দেশ করছে ছায়া।

ভ্যান কুকের ধারণার সত্যতা উপলব্ধি করল বিজয়। এখন পর্যন্ত লোকটার উচ্চারিত বাণী সত্যিই অবিশ্বাস্য। কিন্তু পেছনে যাওয়ার সময় ছায়া নিজে একটা তীরের মাথা তৈরি করে পাথুরে বিন্যাস থেকেও দূরে কোথাও নির্দেশ করছে। পাথর আর সূর্যের এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে তীরের মাথার ন্যায় ছায়ার ফলা আর মালভূমির তীরের মাথা এবারে একসাথে মিলে গেল।

ভ্যান কুক বিজয়ীর ভঙ্গিতে তাকাতেই বিজয়ও সম্মত হয়ে মাথা নাড়ল। “চলো।” আগে আগে চলল ইউরোপীয় ভ্যান আর হেলিকপ্টার থেকে বিশাল ট্রাংক নামিয়ে পিছু নিল বাকি দল।

ছোট্ট চূড়াটার কাছে পৌঁছাতেই উত্তেজিত হয়ে উঠল বিজয়; না জানি সাপের সিলটা কেমন হবে?

চোখ ফিরিয়ে তীরের মাথার দিকে তাকাল কুপার। মাথার ভেতরে নিশ্চয় কোনো, হিসাব কষছে, “তীর তির্যকভাবে উপরের দিকে উঠে গেছে।” অবশেষে জানাল, “তার মানে ঢাল খনন করতে হবে। মনে হয় ওখানে।” পাথুরে বিন্যাসের খাড়া একটা অংশ নির্দেশ করে দেখাল কুপার।

নির্দেশ দিতেই সামনে এগিয়ে গেল পাঁচজন। একটা ট্রাংক খুলে ভেতর থেকে যন্ত্রপাতি বের করে নিজেদের মাঝে আলোচনা সেরে নিল। এরই ফাঁকে বারবার পাথর চূড়া দেখে নিল। পর্বতারোহী না হওয়ায় বিজয় তাদের আলোচনা না বুঝলেও এটুকু বুঝতে পারছে যে কোন যন্ত্রণাটা ব্যবহার করা হবে সেটা নিয়ে লোকগুলো ধন্ধে পড়ে গেছে।

তারপর একজন একটা সিলিন্ডারের আকৃতি সদৃশ যন্ত্র হাতে নিয়ে সবচেয়ে ছোট চূড়াটার মাথায় নিশানা করল। ছুটে গেল গ্র্যাপলিং হুক। পাথরের মাথায় আটকে যেতেই দেখা গেল পেছনে রেখে গেছে সঁড়ি। বিজয় বুঝতে পারল যে যন্ত্রটা বোধহয় কোনো এক ধরনের কমপ্রেসড এয়ার ক্যানন যা হুকটাকে আটকে ফেলেছে। দড়ি ধরে টান দিল পাঁচজনের একজন। কয়েক ইঞ্চি খুলে এসেই পুরোপুরি আটকে গেল। তার মানে পাথরের গায়ে কোনো গর্তে বিধে গেছে।

এরপর প্যাকেট থেকে আরেকটা যন্ত্র বের করে দড়ির সাথে জুড়ে দেয়া হল। কিন্তু হার্নেস বের করে যন্ত্রটার সাথে না লাগানো পর্যন্ত চিনতে পারল না বিজয়। আর তারপর একটা বোতামে চাপ দিতেই মোটরচালিত কপিকলে দ্রুত সঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল লোকটা।

“পাথরের উপর কোনো প্রবেশ মুখ কিংবা অর্ডারের চিহ্ন সম্বলিত কোনো সিল আছে কিনা খুঁজে দেখবে।” গলার কাছে ঝোলানো মাইক্রোফোনের মাধ্যমে লোকটাকে নির্দেশ দিল কুপার। বিজয় আর ভ্যান কুক ছাড়া দলের বাকি সকলের কাছেই যোগাযোগ করার জন্য মাইক্রোফোন আর ছোট্ট ইয়ারপিস আছে।

কপিকল লোকটাকে টেনে পুরোপুরি উপরে নিয়ে গেল। এরপর প্রায় সত্ত্বর ফিট। কাছে গিয়ে দড়িটাকে পাথরের সাথে বেঁধে নিল যেন বাতাসে দুলতে না হয়।

“ও সিল খুঁজে পেয়েছে।” ভ্যান কুককে জানাল কুপার, “পুরোপুরি অক্ষত আছে।”

মাথা নাড়ল ভ্যান কুক, “আমিও তাই ভেবেছিলাম। এখন বোঝা যাচ্ছে যে আলেকজান্ডার কেন মারা গেছে” বিজয় উৎসুক হয়ে তাকালেও নিজের সাংকেতিক বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিল না ভ্যান কুক।

বাকি ট্রাকগুলো ভোলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পুরো দল। একে একে বের হল পোর্টেবল জেনারেটর, পাওয়ার ড্রিল, গর্ত তৈরির ইলেকট্রিক মেশিন, জ্যাক হ্যাঁমার, হাতে ব্যবহৃত খন্তা, কোদাল, কুঁড়াল আর পাথর ভাঙ্গার জন্য বিশালাকার সব হাতুড়ি।

অন্যদিকে বাকি চারজনও একই ধরনের যন্ত্র ছুঁড়ে দড়ি বেয়ে উঠে গেল পাহাড় চূড়ার উপরে। প্রথম পর্বতারোহী এরই মাঝে পৌঁছে কোমরের সাথে সঁড়ি বেঁধে নিয়েছে। একটা ব্যাগে যন্ত্রপাতি ভরে নিয়ে গেছে সকল পবর্তারোহী। সাপের মত এঁকেবেঁকে নিচে নামা পাওয়ার টুলসের দড়ি মাটিতে জেনারেটরের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে।

“তোমাদেরকে সিলটা ভাঙ্গতে হবে।” মাইক্রোফোনে উপরের লোকদেরকে নির্দেশ দিল কুপার, “কোনো ধরনের সাবধানতার দরকার নেই। প্রবেশ মুখটা পরে আবার বন্ধ করে দেব।”

জেনারেটর চালু হতেই চারপাশের বিশাল পাথুরে মালভূমিতে প্রতিধ্বনিত হল সে শব্দ। ভয় পেয়ে গেল পাখি আর খরগোশের দল।

সিলটা ভাঙ্গার জন্য ড্রিল আর হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভাঙ্গার কাজ শুরু হয়ে গেছে। এত দূর থেকে সিলটা দেখতে পাচ্ছে না বিজয়। তবে বেশ বুঝতে পারছে যে নিশ্চয় অতি সপ্তপর্ণে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। কেউ কখনো জানতেই পারেনি যে পাথুরে বিন্যাসের মাঝে কোথাও একটা সিল লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

অবশেষে উপরের লোকগুলোর চিৎকারের সাথেই শোনা গেল ভেঙে পড়ার প্রচন্ড আওয়াজ আর ঢালু বেয়ে গড়াতে লাগল ভাঙ্গা অংশ। সিলটা ভেঙে গেছে।

খুলে গেল চারকোণা, কালো একটা প্রবেশ মুখ। যেরকম সাদা ঢালের উপরে ছিল তার তুলনায় পুরোপুরি অন্ধকার। দেখে তো তেমন বড় মনে হচ্ছে না। আর একেবারে প্রথম পবর্তারোহী নামতেই হিসাব করে দেখল দু’পাশে তিন ফুটের বেশি বড় হবে না। কেবল একজন ঢুকতে পারবে।

পাঁচটা কপিকলের মাধ্যমে পাওয়ার ইকুপমেন্টগুলো নামিয়ে আনা হল। বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রগুলো নামানোর আগেই একের পর এক পাঁচজনই ভেতরে ঢুকে গেল। এবার সাথে নিল হস্তচালিত যন্ত্র।

“আনুভূমিক এই টানেলটা পাথরের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে।” ভ্যান ক্ষুককে জানাল কুপার, “খুব সরু হওয়াতে উবু হয়ে চলতে হচ্ছে।” খানিক বাদেই বোধহয় থেমে গেল পাঁচজন। মনোযোগ দিয়ে ইয়ারপিসের কথা শুনল কুপার। তারপর ভ্যান ক্লককে জানাল, “ওরা একটা চেম্বারে পৌঁছে গেছে। সেখান থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নিচের দিকে পৌঁছে গেছে। এখন তাহলে আমাদেরও যাওয়া উচিত। কারণ একবার ওরা নিচে নামা শুরু করলেই যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে।”

“চলো, তাহলে।” পিছু নেয়ার জন্য সবাইকে ইশারা করে লম্বা লম্বা পা ফেলে পাদদেশে পৌঁছে গেল ভ্যান কুক। তারপর একটা কপিকলে হাত দিয়ে বলল, “দেখা যাক, এত আগে অর্ডার কী খুঁজে পেয়েছিল।”

.

প্রায় পৌঁছে গেছে

দুজন গার্ডের মাঝখানে স্যান্ডউইচ হয়ে কপিকলে চড়ে উপরে উঠে এলো বিজয়। ওকে অবশ্য তেমন কিছু করতে হয়নি। সব কাজ কপিকলই করেছে। তারপর সামনের প্রবেশ মুখে ঢুকে হারিয়ে গেল গার্ড। বিজয়ও পিছু নিল। হেলমেট ল্যাম্পের আলোয় গার্ডের আবছায়া দেহ দেখা যাচ্ছে।

পাথরের ভেতরে আনুভূমিকভাবে এগিয়ে গেছে টানেল। তবে ততটা সরু নয়। মাথা তেমন উঁচু করতে না পারলেও দু’পাশে জায়গা পাচ্ছে বিজয়। টানেলের মেঝে আর দেয়াল একেবারে মসৃণভাবে পালিশ করা হয়েছে। ফলে

মনে পড়ে গেল গত বছরের একটা টানেলের কথা। অন্য একটা সময়ে, ভিন্ন। একটা স্থান হলেও ঠিক এটার মতই ছিল সেই টানেল। ভাবতে অবাক লাগছে যে ওই টানেল আর এখন যেখানে হামাগুড়ি দিচ্ছে এই দুই টানেলের নির্মাতাদের মাঝে কোনো যোগাযোগ ছিল কিনা।

প্রায় ত্রিশফুট যাবার পর সামনে দেখা গেল একটা বড়সড় চেম্বার। উঠে দাঁড়িয়ে ভ্যান ক্লক আর বাকিদের সাথে যোগ দিল বিজয়। প্যাসেজ বেয়ে অন্যরাও চলে এলো।

“বাতি জ্বালাও।” ভ্যান ক্লক আদেশ দিতেই শক্তিশালী পোর্টেবল সার্চলাইচ জ্বলে উঠল। আলোকিত হয়ে উঠল নিচের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া এক ধাপ সিঁড়ি। এতটাই নিচে যে সার্চলাইটের আলোও সেই তলদেশ অব্দি পৌঁছাতে পারেনি।

কুপার সিগন্যাল দিতেই দ্রুত নিচে নেমে গেল চারজনের একটা অ্যাডভান্স টিম। নিজের ইয়ারপিসে তাদের গতিবিধি মনিটর করছে কুপার।

একের পর এক মিনিট কেটে যাচ্ছে। চুপচাপ, ধৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরো দল। আর তারপর বিজয়ের ধারণা মিনিট বিশেক পর, ভ্যান কুকের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল কুপার, “অল ক্লিয়ার।”

ভ্যান ক্লক সম্মতি দিতেই সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করল বাকি দল।

.

৬৯. অমৃত আর রত্ন

সিঁড়ির একেবারে শেষ ধাপে পা দিয়ে চারপাশে তাকাতেই বিস্মিত হয়ে গেল বিজয়। সার্চলাইটের আলোতে উদ্ভাসিত হল পাথর কেটে তৈরি একটা বড়সড় হলরুম। এটা কোনো গুহাকক্ষ নয়; প্রাকৃতিক কিংবা মানুষসৃষ্টও নয়। চেম্বারে স্পষ্ট সব জামিতিক রেখা দেখা যাচ্ছে। আয়তাকার চেম্বারের দেয়ালগুলোও একেবারে মসৃণ। অন্ধকারে হারিয়ে গেছে দেয়ালের দুপাশে সারিবদ্ধ অসংখ্য দরজা। দলটার ঠিক সামনেই দেয়ালের একেবারে শেষ মাথায় একটা আয়তাকার পাথর। দেখে মনে হচ্ছে দেয়াল থেকে বের হয়েছে।’

ভ্যান কুক আর কুপারের নির্দেশে পুরো দল ছোট ছোট ইউনিটে ভাগ হয়ে দরজাগুলোরও পাশে দেখার জন্য ছড়িয়ে পড়ল। ভ্যান কুকের পিছু নিয়ে এক রুম থেকে আরেক রুমে যাচ্ছে বিজয়; সর্বদাই ওর সাথে ঘুরছে দুজন গার্ড।

প্রথম রুমে দেখা গেল অসংখ্য মটকা। দেয়ালের পাশে সারিবদ্ধ তাকে দাঁড়িয়ে আছে এক ফুট উঁচু মটকাগুলো। কমপক্ষে শখানেক তো হবেই। আর সবকটিই ধাতব পাতটার মত কালো ধাতু নিয়ে তৈরি। বিজয়ের ধারণা গত বছর নিজেও এই ধাতুগুলোই দেখেছিল। পাথরের ভেতরকার টানেলের মত এই মটকাগুলোও দেখে মনে হচ্ছে এগুলো আর গত বছর বন্ধুরা মিলে যে সিক্রেট লোকেশন খুঁজে পেয়েছিল সেটার নির্মাতারাও একই দলের লোক।

কিন্তু তাদের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। ভ্যান কুক হয়ত জানে। দুটো স্থান নির্মাণের পেছনেই কি অর্ডারের হাত আছে নাকি?

সার্চলাইটের আলো পড়তেই দেয়ালের একেবারে উপরের অংশে দেখা গেল দেবনাগরী ভাষায় লেখা একটা মাত্র শব্দ।

“রাসাকুন্ডা” বিজয় খোদাইকৃত লেখাটা পড়লেও জানে না এর মানে কী।

ছেলেটার হতভম্ব ভাব দেখে মিটিমিটি হাসছে ভ্যান কুক। “এসব পাত্রে এক বিশেষ ধরনের তরল থাকে; মহাভারতে যাকে অমৃত নামে বর্ণনা করা হয়েছে।” সৌজন্য প্রকাশের মত করে ব্যাখ্যা করল কুক। “এই তরল যে পান করবে তার শক্তি মত্তা বহুগুণে বেড়ে যাবে। মহাভারতে, দুর্যোধনের হাতে বিষ খাওয়ার পর ভীম যখন নাগাস রাজ্যে ফিরে আসে তখন এই তরল খাইয়েই ওর শক্তি ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। মহাকাব্য অনুযায়ী একসাথে আট জগ অমৃত খেয়ে ফেলে ভীম; যার একেকটাই গায়ে হাজার হাতির জোর এনে দিতে পারে।”

“তোমার মানে কী এ জগগুলোর কথাই মহাভারতে লেখা হয়েছে?” নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না বিজয়। এরই মাঝে জেনে গেছে যে হাজার বছর আগেকার প্রকৃত ঘটনার উপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছে মহাভারত। নিজের চোখে প্রমাণও দেখেছে। কিন্তু প্রাচীন মহাকাব্যের কোনো বস্তু চাক্ষুষ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।

কাঁধ ঝাঁকাল ভ্যান ক্লক, “হয়ত একই জগ নয়। কিন্তু এখানে তো তাই লেখা আছে।” কুপারের দিকে তাকিয়ে বলল, “এত শত বছর পরে মটকাগুলো নিশ্চয় খালি। বাস্প হয়ে উড়ে গেছে অমৃত। তবে পানিতে রেট্রোভাইরাস অবশ্যই থাকবে। অমৃত পান করার পরেই শরীরের শক্তি বেড়ে যাবার এটাই হল একমাত্র ব্যাখ্যা। তাই ভাইরাস সমৃদ্ধ তলানি থাকলেও থাকতে পারে। যথেষ্ট পরিমাণ নমুনা সংগ্রহ করে নাও।”

মাথা নেড়ে সম্মতি দিল কুপার। সাথে সাথে ব্যাগও চলে এলো। বিজয় এতক্ষণ খেয়াল করেনি; কিন্তু সবার কোমরের কাছেই একটা করে ভেঙে বন্ধ করা যায় এমন নাইলনের ব্যাগ ঝুলছে। মটকাগুলো পরীক্ষা করে ব্যাগের মাঝে কিছু একটা ঢুকাতে লাগল সকলে।

লম্বা লম্বা পা ফেলে চেম্বারের বিপরীত দিকের রুমে ঢুকে গেল ভ্যান ক্লক। সার্চলাইটের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল দেয়ালের পাশের সারিবদ্ধ। রত্ন। মাথা নেড়ে ইউরোপীয় লোকটা বলল, “যেমনটা হওয়া উচিত সবকিছু ঠিক তাই।” নিজের চেয়েও বেশি বিজয়কে শোনাল, “এটাই হল শ্লোকের মানে।”

ভ্যান কুকের বিড়বিড়ানি বুঝতে পারল বিজয়। কাজাকাস্তান আসার পথে ফ্লাইটে বিজয়কে একটা শ্লোকের ব্যাখ্যা শুনিয়েছিল যাতে ঔষধি গাছ আর রত্নের কথা ছিল। ঔষধি গাছের কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে-ক্যালিসথিনসের উপর ব্যাকট্রিয়ার জঙ্গল থেকে এই গাছ সংগ্রহের ভার ছিল। কিন্তু সে সময় রত্নের ব্যাপারটা বিজয় বুঝতে পারেনি। এবার উপলব্ধি করছে যে রত্ন তত এখানেই আছে। ভাইরাসের ঠিক সাথে।

পাথরের সিলটা ভাঙ্গার সময় আলেকজান্ডারকে কী খুন করেছিল তা নিয়েও বিড়বিড় করেছিল ভ্যান কুক।

এখন সেই মন্তব্যের অর্থও ধরতে পেরেছে বিজয়। অমৃত পান করার পরেও কেন আলেকজান্ডার মৃত্যুবরণ করেছেন তাও স্পষ্ট হয়ে গেছে।

.

সর্বশেষ বাধা

“এটা একটা দরজা।” চেম্বারের ঠিক বিপরীত দিকের দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা পাথরের স্ল্যাবটাকে দ্রুত একবার পরীক্ষা করে এসে জানাল ভ্যান কুক। মেইন চেম্বারের পাশেই আবিষ্কৃত হল ছোট আরেকটা চেম্বার। কিন্তু প্রথম চেম্বারের মটকা আর দ্বিতীয় রুমের রত্ন ব্যতীত তেমন বিশেষ কিছু আর পাওয়া গেল না। কেবল একটা কক্ষের দেয়ালে কিছু লেখা। মনে হচ্ছে এই স্থানে আগে যিনিই এসে থাকুক না কেন বন্ধ করার পূর্বে সবকিছুই নিয়ে গেছেন; শুধু পড়ে আছে রত্নপাথর আর জলাধার। এগুলোকেও কেন নিয়ে যান নি তার কোনো সদুত্তর মাথায় না এলেও এখন এত চিন্তা করার সময় নেই। ভাইরাসের আরো বিশ্বাসযোগ্য নমুনা পাবার জন্য তাড়াহুড়া শুরু করেছে ভ্যান ক্লক আর জেদ করে বসে আছে যে তা পাথুরে দরজার পেছনেই পাওয়া যাবে।

কিন্তু দরজাটা খোলার কোনো উপায় নেই। “ভেঙে ফেল।” দেরি সহ্য করতে না পেরে আদেশ দিল ভ্যান ক্লক।

বিশালাকার পাথর ভাঙ্গার হাতুড়ি এনে কাজে লেগে গেল তিনজন লোক।

পাথরের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ যাই থাকুক না কেন, তা এত সহজে হাতে পাওয়া যাবে না। আধঘণ্টা অবিশ্রান্ত পরিশ্রমের পর পাথরের উপর ফাটল দেখা গেল। এর আগ পর্যন্ত পুরো চেম্বারে উড়াউড়ি করেছে ছোট ছোট পাথরের টুকরা। অন্যেরা তাই পাথুরে রকেটের আঘাত থেকে বাঁচার জন্য বাধ্য হয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার প্রথম তিনজন ঘরে এসে পরবর্তী তিনজনের জন্য জায়গা ছেড়ে দিল। যেন নব উদ্যমে দ্রুত সমাপ্ত হয় কাজ।

আরো আধঘণ্টা প্রাণান্তকর চেষ্টার পর অবশেষে খসে পড়ল পাথুরের দরজার একেবারে শেষ অংশ।

উন্মোচিত হল কৃষ্ণ কালো এক গম্বর।

এই খোলা মুখের পেছনে কী আছে কে জানে?

.

৭০. ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ

বর্তমান সময়ের আফগানিস্তান

মানব থেকে দেবতা

পূর্বদিকে অভিযানে বেরোবার আগে মায়ের দেয়া পার্চমেন্টের দিকে চোখ কুঁচকে তাকালেন আলেকজান্ডার। পাশেই মশাল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ইউমেনিস। তিনি এখন সেনাবাহিনি নিয়ে যেখানে যাবেন সেখানকারই এক দার্শনিক নাকি অলিম্পিয়াসকে এটা দিয়েছেন। কিন্তু পার্চমেন্টের উৎস নিয়ে তার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। পৌরাণিক সেই কাহিনিই-দেবতাদের রহস্য তাঁকে সেনাবাহিনি নিয়ে এশিয়া পার হয়ে ইন্দাসভূমিতে যেতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে তুলেছে।

চারপাশের গাঢ় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে চেষ্টা করলেন সে অঞ্চলের ভূ প্রকৃতিসহ পার্চমেন্টে উল্লেখিত পদ্যগুলোর অর্থ অনুধাবন করতে। ঠিক যেমনটা মা বলেছে।

“এটা এখানেই কোথাও হবে” বিড়বিড় করে নিজেকে আর ইউমেনিসকে শোনালেন আলেকজান্ডার, “আমরা তো এইমাত্রই পোসেডিনের যষ্ঠি পার হয়ে এসেছি।”

মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন ইউমেনিস, “আরেকটু আগে যাব? হয়ত সামনেই কোথাও আছে।”

রাজি হলেন আলেকজান্ডার। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে অনুসন্ধান করলেও অসমান পাথুরে ভূমি আর অন্ধকার এসে তাদের কাজকে আরো কঠিন করে তুলেছে। কিন্তু আঁধারেই কাজ সারতে চেয়েছিলেন আলেকজান্ডার। তাহলেই পোসেডিনের ত্রিশূল পাওয়া যেত।

চমৎকারভাবে বুদ্ধি খাঁটিয়ে সেনাবাহিনিকে এতদূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। তাই সফলতার পথে আর কোনো বাধা চান না। প্রথমে সৈন্যদেরকে জানিয়েছিলেন যে তারা গৌরব লাভের জন্যই যুদ্ধ করছে। মেসিডোনিয়ার মহিমা বৃদ্ধির জন্য। পারসীয়দের হাতে তাদের অবমাননার প্রতিশোধ নেবার জন্য। তারা পারসীয়দেরকে পরাজিত করলে আলেকজান্ডারই হবেন এর শাসক। ফলে সৈন্যরাও মেনে নিয়েছে এ যুক্তি। বিশেষ করে পিতা দ্বিতীয় ফিলিপের অধীনস্থ অভিজ্ঞ সৈন্যের দল। তারা আলেকজান্ডারের পরিকল্পনায় ফিলিপের উচ্চাশা আর রাজ্য জয়ের আকাঙ্ক্ষার প্রতিপালন দেখেছে। তাই আলেকজান্ডারকে পিতার যোগ্য পুত্র হিসেবে বরণ করে নিয়েছে।

এরই ধারাবাহিকতায় শেষ কয়েক বছরে দারিউসের পিছু ধাওয়া করে পারস্যের শাসকবর্গের সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারী অভিজাতদেরকে মেরে ফেলে আলেকজান্ডারকে শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর ঠিক তখন, বাল্কে পৌঁছে সৈন্যরা যখন দেশে ফিরতে উদগ্রীব তখনই বোমা ফাটালেন আলেকজান্ডার। তারা এবার এশিয়ার দিকে অগ্রসর হবে। পৃথিবীর শেষ মাথা অব্দি জয় করে ইন্দাস ভূমিতে মেসিডোনীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার গল্প শোনালেন সৈন্যদেরকে। সৈন্যরা নিজেদের বিজয় থেকে প্রেরণা নিয়ে আর রাজার অজেয়তা দেখে আলেকজান্ডারের চারপাশে এসে জড়ো হল।

এবার তিনি এখানে আসার সত্যিকার কারণের কাছে পৌঁছে গেছেন। দেবতাদের রহস্য। সেনাবাহিনিকে দু’ভাগ করে পার্চমেন্টের নির্দেশ অনুযায়ী এক অংশকে নিজে নেতৃত্ব দিয়ে কুনার উপত্যকায় নিয়ে এসেছেন। এর আগে সগডিয়ান পার্বত্যভূমিতে ব্যাকট্রিয়ার গোত্রদের সাথে লড়াই করার সময় পার্চমেন্টের নির্দেশানুযায়ী নিজের দায়িত্ব সম্পন্ন করে গেছেন ক্যালিসথিনস।

তাই পার্চমেন্ট অনুযায়ী সবকিছুই সাথে করে এনেছেন আলেকজান্ডার। এখন, তিনি এবং ইউমেনিস ক্যাম্প থেকে চুপিসারে বেরিয়ে সিক্রেট লোকেশনে যাবার সর্বশেষ চিহ্নটা খুঁজছেন।

খুব ধীরে অত্যন্ত সতর্কভাবে সামনে এগোলেন দু’জনে। রাতের নীরবতার মাঝে চারপাশে আর মাথার উপরকার সুউচ্চ পাথুরে কাঠামোগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কারো কবর। অনেক নিচে ঠিকমত দেখাও যাচ্ছে না, পর্বতের মাঝে লুকিয়ে আধারের চাদর গায়ে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী। এত রাজার যাওয়া আসা দেখেছে যে বর্তমানে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজেতার উপস্থিতিও যেন বিস্মৃত হয়ে গেছে।

উদ্বিগ্ন হয়ে চারপাশে তাকালেন ইউমেনিস। সাথে গার্ড আনার দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন আলেকজান্ডার; সৈন্য হিসেবে নিজের তরবারি আর দক্ষতার উপরেই ভরসা করেছেন। “পুরো পৃথিবী জয় করে নিয়েছে এমন একজন মানুষকে কে আক্রমণ করবে?” সৈন্য নিয়ে আসার জন্য ইউমেনিসের মন্ত্রণায় তাই কর্ণপাত করলেন না আলেকজান্ডার। কিন্তু ইউমেনিস এতটা আত্মবিশ্বাসী নন। এই অঞ্চলের পাহাড়ি উপজাতিদেরকে প্রশমিত করার জন্য নিজের মনোবাসনা গোপন করেন নি আলেকজান্ডার। তর্ক করে বলেছেন তারা সেনাবাহিনির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু ইউমেনিস ঠিকই জানেন যে এটার কারণ ছিল আজ রাতের মিশনকে ঢেকে রাখার জন্য। তবে তাদের আগমনের কথা শুনে পালিয়ে গেছে স্থানীয় গোত্রের লোকজন। পিছু হঠে আর্নসে তাদের শক্ত ঘাঁটিতে অবস্থান নিয়েছে। পূর্ব দিকে যাবার জন্য প্রবেশ মুখ থেকে ঠিক কয়েক মাইল দূরে। কিন্তু যদি এমন হয় যে দলছুট এক গোত্রের কেউ পাথর আর গাছের আশ্রয়ে লুকিয়ে সভ্য দুনিয়ার শাসককে গোপনে হত্যা করার সুযোগ খুঁজছে?

“এইতো!” জেনারেলের চিন্তায় বাধা দিল আলেকজান্ডারের তীক্ষ্ণ ফিসফিস।

গলা বাড়িয়ে তাকালেন ইউমেনিস। সামনে গজিয়ে উঠেছে আরেকটা অদ্ভুত পাথুরে বিন্যাস। তবে অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। মনে হচ্ছে দু’পাশেই থাকে থাকে ছড়িয়ে পড়েছে; মাথার উপরে বিশাল ঢেউয়ের মত ভেঙে পড়ে আকাশে উঠে গেছে।

বড়সড় একটা ঢেউ কিংবা পাঁচ মাথাঅলা একটা সাপ। পার্চমেন্টের পদ্যের সাথে হুবহু মিলে গেছে।

ত্রস্তপায়ে এগিয়ে গেলেন আলেকজান্ডার। রাজার সাথে তাল রাখতে গিয়ে পড়িমড়ি করে ছুটলেন ইউমেনিস।

সাপ আকতির পাথরটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন দুজনে। প্রথম দেখায় যতটা মনে হয়েছিল তার চেয়েও অনেক উঁচু। মাথার উপরে প্রায় পনেরো ফুট পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে।

মশাল আগে বাড়িয়ে পার্চমেন্টে উল্লেখিত পাথরের নিচেকার ভূগর্ভস্থ গুহাকক্ষে ঢোকার কোনো উপায় পাওয়া যায় কিনা তা খুঁজে দেখলেন ইউমেনিস।

কিন্তু আলেকজান্ডার পেয়ে গেলেন। পাথরের ভাজের পেছনে লুকিয়ে আছে সরু একটা ফাটল। যদি কেউ এর অস্তিত্বের কথা না জানে, তাহলে উজ্জ্বল দিনের আলোতেও খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।

“এখানে অপেক্ষা করো।” ইউমেনিসের হাত থেকে মশালটা নিয়ে আদেশ দিলেন আলেকজান্ডার। “আমি শীঘ্রই ফিরে আসব।”

বাধা দেবার চেষ্টা করেও সাথে সাথে থেমে গেলেন ইউমেনিস। “এটা একটা পবিত্র স্থান” জানালেন আলেকজান্ডার, “কেবল একজন দেবতার জন্য উপযুক্ত। আমি একাই যাবো।”

অন্ধকারে ইউমেনিসকে একা রেখে ফাটল গলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন তরুণ বিজেতা। কিন্তু জেনারেল নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত নন। দু’জনের একজনও জানেন না যে ফাঁকের ওপাশে কী আছে। এক আগন্তুকের কথার উপর ভরসা করেই এগোতে হবে। কিন্তু যদি এটা কোন কৌশল হয়, আলেকজান্ডারকে মেরে ফেলার জন্য সাজানো নাটক হয়?

একের পর এক মুহূর্ত কেটে যাচ্ছে। শক্ত, পাথুরে ভূমিতে বসে রাজার ফেরার অপেক্ষা করছেন ইউমেনিস।

অবশেষে, মনে হল যেন অনন্তকাল শেষে ফাটল দিয়ে বেরিয়ে এলেন। আলেকজান্ডার। দেহবর্ম পুরোটাই ভেজা হলেও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে চেহারা।

“হয়ে গেছে।” ইউমেনিসের হাতে মশাল ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, “এবার আমি আসলেই একজন দেবতা হলাম!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *