৭. পরিশিষ্ট – এই বৃত্তান্তরচনার যুক্তি ও বৃত্তান্তসমাপ্তির কারণ

পরিশিষ্ট

২১৯.

এই বৃত্তান্তরচনার যুক্তি ও বৃত্তান্তসমাপ্তির কারণ

তিস্তাপারের বৃত্তান্ত শেষ হয়ে গেছে।

পাহাড় থেকে সমতলে নামার পর তিস্তার দৈর্ঘ্য ত মাত্র কয়েক মাইল। তাও আবার ভারতীয় ইউনিয়ন আর বাংলাদেশের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। কিন্তু সেই কয়েক মাইলের মধ্যেই জোতপর্ব, বনপর্ব, চরপর্ব, ফরেস্টের বৃক্ষপর্ব, মিটিং-মিছিলপর্ব, তিস্তা ব্যারেজ পর্ব এই সব নানা ভাগ আছে। এগুলো আসলে নানা চিহ্নও ত বটে। এই সব চিহ্ন রেখে-রেখেই একটা নদী উপন্যাসের ভেতর দিয়ে দিয়ে বয়ে যায়। এই সব চিহ্ন দেখে-দেখেই আমরা উপন্যাসের ভেতরে প্রবহমাণ একটা নদীকে চিনে নেই।

সেই আদি পর্বের লোকরা অনেকেই অন্ত্যপর্বে তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল। আদিপর্বে তিস্তার জলপ্রান্তর আপলচাঁদ ফরেস্টের ভেতর যে-গাজোলডোবা গ্রামে প্রথম এবৃত্তান্তে দেখা গিয়েছিল, ঘটনাক্রমে সেই গাজোলডোবাতে সেই আপলাদের ভেতরই তিস্তার ভেতর মৈনাকের মাথা, মানুষের তৈরি মৈনাকের মাথা, জেগে উঠেছে–তিস্তা ব্যারেজ। এতে সত্যি সত্যি যেন একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। একটি বৃত্তান্তের সমাপ্তি ঘটল।

বাস্তবে কিন্তু তেমনটি হয়নি। এ বৃত্তান্ত লিখবার সময় জুড়ে তিস্তা ব্যারেজের কাজ চলেছে। এখনো সেকাজ শেষ হয়নি। এবৃত্তান্তে যখন প্রথম গাজোলেডোবা গ্রামে তিস্তার পাড়ে সার্ভের কথা লেখা হয়েছিল, তখন জানাও ছিল না–ঐ গাজোলডোবাতেই তিস্তা ব্যারেজের প্রধান ঘাটি হবে। এ বৃত্তান্তে তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধনের কথা যখন লেখা হয়েছিল–তখন উদ্বোধন হবে এমন কথা ওঠেই নি। কিন্তু কিছু দিন পরে এই বৃত্তান্তের বর্ণনানুযায়ীই একটি উদ্বোধন-অনুষ্ঠান ঘটেছিল। এবৃত্তান্তে কেননা ব্যক্তি বা ঘটনাকে বা ইতিহাসকে নথিভুক্ত করা হয়নি। বরং বারবার এই বৃত্তান্ত থেকে বেরিয়ে গিয়ে কোনো ঘটনা বাইরে কোথাও ঘটে গেছে, হয়ত ইতিহাসও হয়ে গেছে। উপন্যাসের মতই এই সব ব্যারেজও ত একটা সৃষ্টিকর্ম। তাই সৃষ্টির যুক্তিতে এ দুই ঘটনা, এই ব্যারেজ আর এই বৃত্তান্ত, একই জায়গায় ফিরে-ফিরে আসছে। আসছেই যখন, তখন সেইখানে ফিরে আসার আগে এ-বৃত্তান্ত শেষ করা যেত না।

এ বৃত্তান্ত শেষ হওয়ার পর এর আর নতুন কোনো পর্বান্তরও সম্ভব নয়। ব্যারেজ উদ্বোধনের সঙ্গে-সঙ্গে এবৃত্তান্তের তিস্তা ইতিহাস হয়ে গেল। এখন আর তিস্তা সেই পুরনো তিস্তা থাকল না। এখন প্রকৃতির সেই নদীর পুনর্জন্ম ঘটবে মানুষের হাতে। হিমালয়ের তুষারগলা জল আর মৌসুমি মেঘের বৃষ্টিধারায় তিস্তার জল যতই বেড়ে উঠুক, তা বয়ে যাবে মানুষের নির্দেশিত খাতে, নির্দেশিত গতিতে। তখন চর জেগে উঠবে মানুষের ইচ্ছায়। সে-চরকে সবুজ করে দিয়ে নদী তার পাশ দিয়ে অনুগত বয়ে যাবে–মানুষের তৈরি নিসর্গে। তিস্তা নিয়ে কোনো উপকথা পুরুষানুক্রমে বয়ে আসবে না। তিস্তা ব্যারেজের পর তিস্তার প্রাকৃতিক জীবন শেষ, এখন সে এক মানবিক নদী। তিস্তা তার মানবিক ইতিহাসের পর্বে ঢুকবে। তিস্তাবুড়ি, কুমারী হয়ে উঠবে।

এই তিস্তাপারের বৃত্তান্ত সেই প্রাকৃতিক তিস্তার সঙ্গে মানুষজনের সহবাসের রীতিনীতির বৃত্তান্ত। গয়ানাথের সঙ্গে তিস্তার সহবাসের এক রকম রীতিনীতি, নিতাইদের সঙ্গে আর-এক রকম আর সীমান্তবাহিনীর সঙ্গে আরো এক রকম। বাঘারুর রীতিনীতি বলে কিছু নেই। তিস্তা তার নদীস্বভাবে প্রাকৃতিক, সে জল ছাড়া কিছু নয়। বাঘারু তার মানবস্বভাবে প্রাকৃতিক–সে কেবল মানুষ, একজন মানুষ ছাড়া কিছু নয়।

এই বৃত্তান্ত লেখা এখানেই শেষ হল। তিস্তা ব্যারেজ আরো কয়েক বছর পর শেষ হবে। তখন সেই নতুন, মানুষের তৈরি নদীর সঙ্গে মানুষজনের সহবাসের রীতিনীতি একেবারে আমূল বদলে যাবে। কত দ্রুত আর কতটাই আমূল যে তা বদলায়–তা বদলানোর আগে আমরা ধারণাও করতে পারি না, বদলানোর পরও মাপতে পারি না।

ব্যারেজে জল আটকে ফেলায় কত নতুন জমি চাষে আসবে। ব্যারেজ থেকে জল ছাড়ায় কত নতুন জমি চাষে আসবে। দুই নম্বর কচুয়ার সঙ্গে মণ্ডলঘাটের আর কোনো তফাত থাকবে না–সেটা মণ্ডলঘাটের ভেতরই চলে আসবে।

নিতাইদের চরটা বোধহয় থাকবে না–ব্যারেজের অত কাছে অত বড় চর রাখা যাবে না। কিন্তু তার বদলে তিস্তার বায়ে বা ডাইনে তিস্তাকে সরিয়ে এনে নতুন জমি বের করে নিতাইদের নতুন গা বসানো হবে হয়ত। দহগ্রামের ছিটমহলগুলো নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সীমান্তটা শুধু স্থলভাগ দিয়েই চিহ্নিত করা হবে হয়ত!

তিস্তা ব্যারেজের ফলে তিস্তার সঙ্গে গয়ানাথের সহবাসের রীতিনীতি সবচেয়ে বেশি বদলে যাবে। সে পুরনো মামলাগুলির কিছু জিতবে, কিছু হারবে। নতুন মামলাও কিছু করতে পারে। কিন্তু সে-ই সবচেয়ে তাড়াতাড়ি অভ্রান্ত বুঝে যাবেব্যারেজের অর্থ কী? ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে ভাগের মামলায় সে জিতলেও পাবে এক চিলতে জমি আর কয়েকটা শালগাছ। আর তিস্তা ব্যারেজের ফলে সে পাবে এক জমিতে তিন ফসল। ব্যারেজের নিশ্চিত জল, ব্যারেজের ফলে বন্যার অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি, কেমিক্যাল সার আর ট্র্যাক্টার-সেই তিনটি ফসল খোলানে তুলে দিল বলে। গয়ানাথ পাওয়ার টিলার কিনে ভাড়া খাটাবে। গয়ানাথের গাই-বলদ কমে আসবে, জমিও হয়ত একটু কমে আসবে, বাঘারুও কমে আসবে কিন্তু ফলন বাড়বে, বিক্রি বাড়বে, লাভ বাড়বে।

আর, এই ব্যারেজের ফলেই গয়ানাথের কত কাছাকাছি চলে আসবে রাধাবল্লভদের কৃষক সমিতি। গয়ানাথদের সঙ্গে রাধাবল্লভদের ঝগড়া-মারামারি ছিল খাশজমির দখল নিয়ে। পুরনো তিস্তায়, এই বৃত্তান্তের তিস্তায়, ছিল সম্পত্তির জোতদারি। নতুন তিস্তায়, এই বৃত্তান্তের পরের তিস্তায়, শুরু হবে ফলনের জোতদারি। সম্পত্তির জোতদারিতে রাধাবল্লভদের সঙ্গে গয়ানাথদের সংঘাত ছিল। ফলনের জোতদারিতে রাধাবল্লভরা আর গয়ানাথরা ত সহকর্মী। গয়ানাথের পাওয়ারটিলার ছাড়া রাধাবল্লভদের চলবে না। আবার গয়ানাথের নিজের জমিতেও তিন-চারটি ফসল ফলবে, কৃষক সমিতির ভেস্টজমিতেও তিন-চারটি ফসল ফলবে। গয়ানাথ আর কৃষক সমিতি একসঙ্গে তখন ন্যাশন্যাল হাইওয়ের ওপর বসে–রাস্তা রোকো আর জেল ভরো আন্দোলন করবে। আন্দোলনের যে-সব কায়দা রাধাবল্লভদের কৃষক সমিতির জানা আছে, সেই সব কায়দা দিয়ে সরকারের কাছ থেকে কৃষিপণ্যের ন্যায্য দর আদায় করার জন্যে গয়ানাথ আর কৃষক সমিতি মিলে আন্দোলন করবে-যেমন করছে উত্তরপ্রদেশে, যেমন করছে মহারাষ্ট্রের খেতকারীরা।

ব্যারেজের ফলে তিস্তাপারের ফরেস্ট বদলে যাবে, আপলচাঁদ বদলে যাবে। এসব ফরেস্ট ত মানুষের পরিকল্পনার ফলে তৈরি হয়নি। প্রচুর প্রচুর বৃষ্টিপাতে আর তিস্তার পলিতে এই তরাই-ডুয়ার্স সেই কবে থেকে ত এমন ঘন বন হয়ে আছে। যত ঘন হয়েছে, তত লম্বা-লম্বা গাছ হয়েছে। এক-একটা শাল, সেগুন, অর্জুন, খয়ের, লাম্পাতি গাছ দশকের পর দশক ধরে বেড়ে উঠেছে। আর সেই ভাবে বড় হতে-হতে স্থায়ী হতে-হতে এই পর্ণমোচী অরণ্য হয়ে উঠেছে প্রাকৃতিক। তা থেকে গাছ কেটে বিক্রি করা হয়েছে। দেশ-দেশান্তরে এখানকার শালগাছের সুখ্যাতি রটেছে। কিছু নতুন গাছ লাগানোও হয়েছে নিশ্চয়ই! কিন্তু আমাদের স্বাধীনতাই ত হয়েছে মাত্র চল্লিশ বছর। শালগাছের একটা বন তৈরি করতে চল্লিশ বছর আর কতটুকু সময়।

ব্যারেজ জল দেবে, ব্যারেজ বন্যা ঠেকাবে–তা হলে এই সব হাজার বছরের পরমায়ুওয়ালা গাছ নিয়ে কী হবে? এ-সব গাছ উৎপাটিত হয়ে যাবে–তার জায়গায় নতুন গাছ বোনা হবে। সে-সব গাছ অত্যন্ত তাড়াতাড়ি বাড়ে, তাড়াতাড়ি পাকে, তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়। ইউক্যালিপটাস হয়ত এসব বৃষ্টি-বাদলের জায়গায় তত ভাল হবে না। কিন্তু অন্য কোনো গাছ আবিষ্কার হবে-নরম গাছ। সে-গাছ থেকে ত স্থানীয় কোনো শিল্পও তৈরি হতে পারে।

বন বদলালে জীবজন্তু বদলে যাবে। হরিণ যদি তার খাবারযোগ্য ঘাস না পায়, তার নাকে যদি অভ্যস্ত গন্ধ না আসে, সে যদি এবনভূমিতে নিজেকে মিশিয়ে দেবার কোনো আবরণ না পায়, তা হলে, সে এখানে থাকবে কী করে। গণ্ডারের যদি ছায়া না জোটে, ভেজা পচা পাতা না জোটে, গড়াবার মত কাদা না জোটে তা হলে সে তার উদাসীন পা ফেলে-ফেলে কোনো এক দিকে হেঁটে চলে যাবে। হাতিরা দল বেঁধে চলাফেরা করে। শিশু বয়সে দলের সঙ্গে সঙ্গে থেকে শেখে পাহাড়ের কোন পথ দিয়ে নামতে হয়, কোন নদীর পাড় ধরে-ধরে এগতে হয়, কোথায় নদী পেরতে হয়, কোন জায়গায় পাওয়া যাবে স্বাদ চালতার বন, কোথায় আছে বড়বড় কলাগাছ। তারপর নিজে জোয়ান হয়ে তার দলকে সেই পুরুষানুক্রমিক পথেই নিয়ে আসে। কিন্তু এই বনই যদি না থাকে–হ্যাঁতির পাল কী করে নিজে পথ নির্ণয় করবে। তা ছাড়াও সেই নতুন বনের নতুন গাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে, দ্রুত বিক্রি হয়। হাতির পালকে ত আর সেবনে ঢুকতে দেয়া যায় না। একটা শালগাছের ডাল ভাঙলে আর-একটা ডাল গজাবে। কিন্তু এ-সব গাছের ডাল ভাঙলে ত আর্থিক ক্ষতি! নগদ ক্ষতি! সেই নতুন বনে হাতির পাল পথ বদলাবে।

তিস্তাপারের এই সব বনে বানর খুব বেশি। এত ঘন বনে, এত উঁচু-উঁচু গাছে আর এত জমাট জঙ্গলে (আন্ডারগ্রোথ) বানরদের সব দিক থেকেই সুবিধে। তারা একটা এলাকায় গাছ থেকে গাছে চলে যেতে পারে অনায়াসে। গাছেরও খেতে পারে, তলারও কুড়োতে পারে। পাখি আর জন্তু-জানোয়ারদের সঙ্গে তাদের নানা রকম খেলাও চলে। কিন্তু সেই নতুন ফরেস্টে বন ত এত ঘন হবে না–ফরেস্টেরই প্রয়োজনে। সেবনে এই জঙ্গলও হয়ত থাকবে না–ফরেস্টেরই প্রয়োজনে। সেই নতুন বনে যে-গাছগুলো দ্রুত বেড়ে উঠবে আর দ্রুত বিক্রি হবে সেগুলোর ডালপালা এতই দামি যে বানরদের সেখানে ছেড়ে দেয়া যায় না!

এই সব ফরেস্টে অজস্র পাখি আছে। নতুন পাখি আসে কি না কে জানে কিন্তু পুরনো পাখিদেরই এক বিশাল পৃথিবী তৈরি হয়ে আছে বড় বড় গাছের সুযোগে। আর ঘন জঙ্গলের সুযোগে আছে নানা ধরনের সাপ, প্রধানত পাইথন। এদের এই বন ছাড়তে হবে।

কিন্তু তিস্তাপরের বৃত্তান্ত যে-এমন আমূল বদলে যাবে–তাতে বাঘারু, মাদারির মা ও মাদারির কী হবে?

তারা কি গয়ানাথ রাধাবল্লভ-নিতাইদের মত নতুন তিস্তার সঙ্গে, নতুন ফরেস্টের সঙ্গে, নতুন চাষবাসের সঙ্গে মিলেমিশে যাবে? নাকি, তারা ঐ গণ্ডার, হরিণ, হাতির পাল, বানরের দল, পাখি, সাপদের মত এই বন বদলাবে, এই নদীকে ছেড়ে অন্য কোনো অপরিবর্তিত নদী-তীর খুঁজবে?

নৃতত্ত্বে অবিশ্যি এর একটা জবাব আছে। বানর থেকে মানুষ হয়ে ওঠার পাঁচ লক্ষ বছর ধরে যে-সব মানবগোষ্ঠী নিজেদের নিয়ত বদলাতে বদলাতে এসেছে, তাদের মধ্যে অনেকগুলি গোষ্ঠী সেই আদি মানবসমাজ থেকে আধুনিক মানবসমাজের রূপান্তরের মাত্র হাজার পাঁচেক বছর আর তাল রাখতে পারেনি। তারা সেই পাঁচ হাজার বছরের ভেতরে কেননা একটা স্তরে ঠেকে গেছে। যেমন, আন্দামান-নিকোবরের জারোয়া, উঙ্গি, সেনটিনেল বা কেরালার গুহামানবরা। তেমনি নদী-অরণ্য এই সব প্রাকৃতিক বিষয় বদলে দিয়ে যে-নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে, তার সঙ্গে বাঘারু, মাদারির মা ও মাদারি তাল রাখতে পারেনি, তারা ঐ আদি একটা স্তরে আটকে গেছে। এদের জন্যে অর্থনীতিতে একটা নতুন নামও তৈরি করা যায়, উৎপাদন ব্যবস্থার আদিবাসী-উপজাতি। কিন্তু এরকম নৃতাত্ত্বিক তত্ত্ব বা তুলনা দিয়ে বাঘারুসমস্যা সামলানো যাবে না। অবিশ্যি সমস্যা বলে মেনে নিলে তবে ত সমাধানের কথা আসে। এ বৃত্তান্তের যে-কোনো পাঠকই অনুমান করতে পারবেন যে এখন নদী যতই বদলাক, ফরেস্ট যতই বদলাকবাঘারু, মাদারির মা ও মাদারি বদলাবে না। বদলের আগেই আমরা জানি কী বদলাবে আর কী বদলাবে না। কিন্তু নৃতত্ত্বে কি এমন কোনো পদ্ধতি আছে যাতে এরকম আগে থেকে বলা যায় কোন্-কোন্ গোষ্ঠী তাল মেলাতে পারবে না, ও আটকে যাবে? মাদারির মা আর বাঘারু ত পুরনো উৎপাদন ব্যবস্থারও কেউ ছিল না। তাদের তাই আটকে থাকারও কোনা জায়গা নেই। আর, পুরনো উৎপাদন ব্যবস্থায় তারা কোথাও ছিল না বলেই নতুন ব্যবস্থাতেও তারা কোথাও থাকবে না। মাদারির মা যেখানে আছে, সেখানেই থাকতে-থাকতে ঘাসপাতার সঙ্গে মিশে যাবে। কিন্তু বাঘারু ও মাদারির কী হবে? এরা দুজনই শেষ পর্যন্ত এই বৃত্তান্তে অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে।

সেদিন বাঘারু স্বাধীন পা ফেলে উদ্বোধন মঞ্চের দিকে হেঁটে আসছিল। স্বাধীন–কারণ, গয়ানাথ তাকে বলেনি ঐ উৎসবে যেতে। স্বাধীন-কারণ, সে তার শরীরে এক দায় বোধ করেছিল এই নদীর ভেতর গজিয়ে ওঠা পাহাড়টার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী তা বোঝার। সে এক ঝুঁকিতে গয়ানাথের ঝাণ্ডা ফেলে দিয়ে নদীর ব্যারেজ ও ব্যারেজের প্যান্ডেলের দিকে এগয়। আপলচাঁদ ফরেস্ট ও তিস্তা নদীতে ত এমন কিছু ঘটতে পারে না যা বাঘারুর শরীরনিরপেক্ষ। পাখিদেরও এরকমই স্বভাব। কোনো এক মহীরুহের ডালে-ডালে, দেলে-খোদলে, কত বিচিত্র জায়গায় কত রকম ভাবে তারা বাসা বাধে, জন্ম-জন্মান্তর ধরে সে বাসায় থাকে। একটা পাখির জীবন একটা মহীরুহের তুলনায় ক-দিনের। সেই মহীরুহকে পাখিরা পুরুষানুক্রমিক চেনে। তারপর মহীরুহটি উৎপাটিত হলেও পাখিরা তাদের অভ্যেস ছাড়তে পারে না। তারা আকাশের সেই শূন্যতাটাকেই ডালপালা ভেবে নেয়, উড়ে-উড়ে এসে বসতে চায়। সেখানে যে সত্যি আর গাছটা নেই এটা বুঝতে সেই পাখিগুলোকে দু-এক বর্ষায় ভিজতেই হয়। শরীর দিয়ে তারা জেনে নেয়–পুরনো আশ্রয় আর নেই। তখন নতুন গাছ খোঁজে।

বাঘারু সেভাবেই এগচ্ছিল দক্ষিণ থেকে উত্তরে। যেন সে আছে আর ব্যারেজ আছে আর ব্যারেজের প্যান্ডেল আছে।

এখান থেকে মঞ্চে পৌঁছুবার কোনো রাস্তা ছিল না। ভি-আই-পিদের গাড়ি রাখার জায়গার পেছনে মিছিলগুলোকে বসাবার ব্যবস্থা একেবারে ফরেস্টের ভেতর। জঙ্গল বহুদূর পর্যন্ত পরিষ্কার করে দেয়া। হয়েছে। বাঘারু সোজা আসছিল। তার পা ফেলায় মুক্তির ছন্দও ছিল হয়তোর কাঁধে ঝাণ্ডা নেই, হাত-পা ঝাড়া। আপাদমস্তক খোলামেলা। অথচ অতটা নগ্নতাতেও দারিদ্র্য থেকে সে সম্পূর্ণ মুক্ত। বাঘারুকে এখন শালপ্রাংশু বলা চলে। সোজা হাঁটতে হাঁটতে এসে বাঘারু বাঁশের বেড়ায় ঠেকে যায়। ঠেকে গিয়ে বেড়াটা টপকাতে নেয়।

তখন এক পুলিশ এসে তাকে বোঝায় এ-বেড়াটা টপকাতে দেয়া যাবে না। পুলিশটি খুব ভদ্রতার সঙ্গে বাঘারুকে দেখিয়ে দেয় এবং এগিয়েও দেয়। বাঘারুকে এখন ডাইনে ঘুরে এই বাঁশের বেড়াটার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যেতে-যেতে আবার ফরেস্টের ভেতর ঢুকতে হবে। সেখান থেকেই বক্তৃতা শুনতে হবে। বেড়ার এক পাশে পুলিশ, এক পাশে বাঘারু–একই সঙ্গে পা ফেলে এগিয়ে যায়। তারপর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পুলিশ আঙুল তুললে দেখাই যায়–ফরেস্টের ভেতর মানুষের অগুনতি মাথা। বাকি। পথটুকু বাঘারু একাই যায়। এক জায়গায় বেড়াটা বা দিকে ঘুরেছে। সেখান থেকে লোকজন বসেছে।

বাঘারু প্রথম সারিতেই ঢুকতে যায়।

বাঘারু যেদিক থেকে জনসভায় ঢুকছিল সেদিক থেকে আর-কেউই ঢোকেনি। মঞ্চ থেকে কেউ যদি নেমে এই সভার লোকজনের কাছে আসে, তাকেও ত প্রথম সারিতেই আসতে হবে।

কিন্তু প্রথম সারি ত দূরের কথা ততক্ষণে ত সভার সেই জায়গা মিছিলে-মিছিলে ভরে গেছে। সব মিছিলই এই তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধনে সরকারকে জিন্দাবাদ দিতে এসেছে, কিন্তু, প্রত্যেকটা জায়গার মিছিলকে ত আলাদা-আলাদাই রাখতে হবে, থাকতে হবে। এক জায়গার মিছিলের সঙ্গে যদি আর-একটা জায়গার মিছিল মিশে যায় তা হলে ত সবাই হারিয়ে যাবে, একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা হবে। ফলে, এক-একটা জায়গার মিছিল এক-একটা জায়গায় গায়ে-গা লাগিয়ে, ঘঁটুতে হাঁটু লাগিয়ে বসে আছে প্রায় দেয়ালের মত। বাঘারু ঐ বেড়া ধরে এসে ঐ দেয়ালের ভেতর ঢুকতে যায়। তাকে তাই ঢুকতে হবে, কারণ, বাঁশের সেই বেড়া ওখানেই বায়ে বেঁকেছে আর বাঘারু ত বেড়া ধরেই এগচ্ছে। কিন্তু বাঘারু ঢুকবেই বা কী করে, ঢুকতে দেবেই বা কে? তাকে সেটা বুঝতে হয়, ধাক্কা খেতে-খেতে। নানা ভাষায় তাকে একটা কথাই শুনতে হয়, পেছনে যাও, পেছনে যাও, নিজের জায়গায় যাও, নিজের জায়গায় যাও। তাদের সবার বুকে ব্যাজ। তারা বাঘারুর ব্যাজহীন বুকের দিকে তাকায়। বাঘারুর বুকে ব্যাজ লাগানোর মত কাপড় নেই। কেউ রাগ করে তাকে বলে না। কেউ-কেউ ত সহানুভূতির সঙ্গেই তাকে রাস্তা দেখিয়ে দেয়। কিন্তু সবাইই এব্যাপারে প্রায় রাতে গায়ের পাহারাদারদের মত সতর্ক ও সাবধান যে, তাদের মিছিলের ভেতর যেন অন্য কেউ ঢুকে না পড়ে। এই কারণে বাঘারুকে ক্রমেই পেছিয়ে যেতে হয়, ক্রমেই সরে যেতে হয়, ক্রমেই দূরে যেতে হয়।

এই প্রসঙ্গটি এখানেই থাক। যদি এটা বৃত্তান্তের প্রধান অংশের অন্তর্গত হত তা হলে না হয়, বাঘারুর মিছিল প্রবেশের চেষ্টা বা মিছিলের বাঘারু-অবরোধ এই নামে একটি অধ্যায় লেখা যেত। কিন্তু এখন আমরা এরকম কোনো ঘটনার বর্ণনা দিতে পারি না। আমরা শুধু কয়েকটি খবর জানাতে পারি।

বাঘারুকে শেষ পর্যন্ত সেই ফরেস্টের ভেতর ঐ ফরেস্টেরই মত বিরাট জনসভার একেবারে শেষে পৌঁছুতে হয়। ততক্ষণে মাইকে নানা রকম চেঁচামেচি, বক্তৃতা, শুরু হয়ে গেছে। ততক্ষণে, ফরেস্টের ভেতর এই ফরেস্টেরই মত লক্ষ-লক্ষ মানুষ সেই মঞ্চের সঙ্গে গলা মিলিয়ে শ্লোগান দিতে শুরু করেছে। এই বক্তৃতা, এই শ্লোগান আর এই মিছিলের মধ্যে দিয়ে বাঘারু সেই মিছিলের শেষে এসে পৌঁছয়। সেখান থেকে একবার দেখবারও চেষ্টা করেনদীর ভেতর গজানো, সেই পাহাড়ের প্যান্ডেলটা দেখা যায় কি না। প্যান্ডেল ত দূরের কথা–মানুষের মাথারই শেষ দেখা যায় না। বাঘারু একটা গাছে হেলান দিয়ে মাটির ওপর বসে পড়ে। মিছিলের সেই শেষেও বাঘারুর আশেপাশে কিছু লোক ঘোরাফেরা করছিলই। মানে, অত শেষে গিয়েও বাঘারু মিছিলের মাঝখানেই থাকে, অথচ মিছিলগুলো সেখানে অতটা আত্মরক্ষাপ্রবণ নয়। বাঘারু সেখানে শুধু দাঁড়াবারই জায়গা পায় না, ইচ্ছেমত বসারও জায়গা পায়।

কিন্তু বাঘারু ত গয়ানাথের মিছিল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর এগিয়েছিল তিস্তা নদীর ব্যারেজ ও ফরেস্ট ও তার ভেতরকার মিলটা বুঝে নিতে। একবার বুঝে নিতে। একবার বুঝে নিলেই তার সারা জীবন চলে যায়। কিন্তু শরীর দিয়ে একবার অন্তত বুঝে নিতে হবে।

অথচ সেই মিছিল আর মিছিল আর মিছিল তাকে ঐ ব্যারেজ ও ব্যারেজের মঞ্চ থেকে এই এতদূরে সরিয়ে নিয়ে এসেছে যেখানে মাইকের আওয়াজ শুধু পৌঁছচ্ছে, সেখান থেকে নদীর বা ব্যারেজের বা মঞ্চের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মাইকের আওয়াজের ত আর কোনো অর্থ নেই বাঘারুর কাছে। সুতরাং বাঘারু যে-গাছতলায় বসে পড়েছিল, সেই গাছতলাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। গাছে হেলান দিয়ে বাঘারু বসেছিল। গাছে হেলান দিয়ে বাঘারু ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমিয়ে পড়লে মাথাটা আর সোজা থাকে না। বুকের ওপর হেলে পড়ে, না-হয় পাশে হেলে যায়। বাঘারুর মাথাটা ডান পাশে হেলে গেল। সে গাছতলায় গড়িয়ে পড়ে ঘুমোয়। শরীরটা তার গাছটাকে এমন ঘিরে থাকে যেন মনে হয় ফরেস্টের ঐ গাছটার গোড়াটা সে আঁকড়ে জড়িয়ে থাকতে চাইছে।

কিন্তু এ-প্রসঙ্গ এখানেই থাক। এটা যদি বৃত্তান্তের প্রধান অংশের অন্তর্গত হত তা হলে না-হয়, আপাদে বাঘারুর শেষবার ঘুমিয়ে পড়া বা বাঘারু ও তার শেষ বৃক্ষ এই শিরোনামে একটি অধ্যায় লেখা যেত।

কিংবা, বাঘারুর নিদ্রাভঙ্গ বা মিছিলের বাঘারুবর্জন নামে আরো একটি অধ্যায়। কারণ, বাঘারু যখন জাগে, তখন সন্ধ্যা উতরে গেছে, কোথাও কোনো মানুষ নেই, আপলচাঁদ আপলাদের মতই নির্জন, বাঘারুর চারপাশে জোনাকি জ্বলছে, একটা পাখি বাঘারুর মাথার ওপরে ডাল বদলায়–প্যাচা হতে পারে, ময়ূরও হতে পারে। বাঘারু দাঁড়ালে বহু দূরে কিছু আলোর সারি দেখতে পায়। বাঘারু সেই আলো দেখেই বুঝতে পারে ব্যারেজ, সেই নদীর ভেতর জেগে ওঠা পাহাড়, পাহাড়ের ওপর বানানো প্যান্ডেল। বাঘারু সোজা সেই আলোর দিকে হাঁটে।

এই হাঁটাটা বাঘারুকে বদলে দিল? পরে, সেরকমই মনে হতে পারে, কারণ সে আর ফিরে আসেও নি। কিন্তু এই ঘঁটাটা কি মিছিল-মিটিঙের শেষে ঘুমভাঙা থেকে শুরু হল? এই এখন? নাকি এটা শুরু হয়েছিল, সেই সকালের দিকেই, যখন গয়ানাথের ঝাণ্ডা কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফেলে দিয়ে সে গটগটিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিল ঐ ব্যারেজ আর মঞ্চের দিকে? যদি তখন বাঁশের বেড়ার ও পুলিশের বাধা না পেত, যদি তখন মিছিলের বাধা না পেত, তা হলে ফরেস্টের এই এত ভেতর পর্যন্ত ত সে পৌঁছুতই না! এখন সব, বাধা সরে গেছে, এখন রাত্রি, এখন রাত্রির পাখিরা ডাল বদলায়, এখন বাঘারুকে ঘিরে জোনাকি জ্বলে ও ঝিঁঝি ডাকে, এখন সেই ব্যারেজের আলোর সারি দেখা যায়, এখন বাঘারু সোজা আপলাদের ভেতর দিয়ে গয়ানাথের বাড়িতে চলে যেতে পারত, কিন্তু তা না গিয়ে বাঘারু সেই সকালের দিকের বাধ্যত ছেড়ে-দেয়া হাটা আবার শুরু করে। তখন পথ পায়নি বলে এতক্ষণ ঘুমল। এখন পথ পেয়েছে, এখন যাচ্ছে। বাঘারুকে এরকম ঘুরপথৈ ত অনেক সময়ই যেতে হয়েছে। নইলে, গয়ানাথ তিস্তার ভেতরে ডোবা জমি তাকে দিয়ে মাপাত কী করে, তিস্তায় ভাসিয়ে দেয়া ফরেস্টের গাছ ডাঙায় তুলে বেচত কী করে। বাঘারুর পথ ত এরকমই একটু অদ্ভুত–গ্রহণে বাথানের গাইকে প্রসব করানো, রমণ-ইচ্ছুক পাখির ডাক ডেকে ওঠা, জলের ওপর দিয়ে হাঁটা, শ্রীদেবীর সামনে নাচা। এখন বাঘারুকে জোনাকির  মধ্যে দিয়ে সেই ব্যারেজের দিকে হাঁটতে হয়।

কিন্তু এ-প্রসঙ্গ থাক। যদি একটা বৃত্তান্তের মূল অংশের অন্তর্গত হত তা হলে না-হয় জোনাকিসহ বাঘারুর হাঁটা, বা বাঘারুকে নিয়ে জোনাকিস্রোত এই শিরোনামে কোনো অধ্যায় লেখা যেত। বাঘারুকে জোনাকির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছিল। ফলে, দূর থেকে কেউ দেখলে, দেখত, ফরেস্টময় ঐ জোনাকির মধ্যে বাঘারুর শরীরের আকারের একটা অন্ধকার এগিয়ে আসছে। সে-অন্ধকারের গায়েও দুটো-একটা জোনাকি লাগছে বটে কিন্তু তাতে জোনাকির ভেতর অন্ধকার দিয়ে তৈরি বাঘারুকে চিনে নেয়া যায়–আকাশের অবান্তর অত তারা সত্ত্বেও ত নানা তারার অন্তর্বর্তী অন্ধকার দিয়ে তৈরি কালপুরুষ বা সপ্তর্ষি চিনে নিতে ভুল হয় না।

এবার বাঘারু বেড়া টপকায়। কয়েকটা ফ্লাডলাইট ঐ ব্যারেজের প্যান্ডেলের ওপর ফেলা। বেড়া টপকে সেই আলোর ভেতর দু-চার পা যেতেই দুটো-একটা জায়গা থেকে চিৎকার ওঠে, এই, এই, আরে থামো, এই কোথায় যাচ্ছ? এই। এই।

বাঘারু দাঁড়িয়ে পড়ে। এখন ত ফ্লাড-লাইটগুলি তার আপাদমস্তক নগ্ন শরীরের পেছনের ওপর। ঐ। ভাবে আলোর বৃত্তে দাঁড়িয়ে বাঘারু কিন্তু দেখে সামনে সেই মঞ্চ। এখন আর মঞ্চের ওপর ঝাণ্ডা নেই। 

দুজন পুলিশ বন্দুক ঘাড়ে করে ধীরেসুস্থে বাঘারুর দিকে আসে। তাদের শরীরের সম্মুখভাগে ঐ ফ্লাড-লাইটা পড়ে। তারা সামনে এসে বাঘারুকে একবার আপাদমস্তক দেখে ঘাড় হেলিয়ে তার দিকে। তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, বেশ শান্ত নিরুত্তেজ গলায় জিজ্ঞাসা করে, কোথায় যাচ্ছ?

বাঘারুও হাতটা বাড়িয়ে দেখায়, ঐঠে যাম, প্যান্ডেল!

একটি পুলিশ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বাঘারু প্যান্ডেল বলে কাকে। আর-একটি পুলিশ তখনই অর্ধেক ফিরে বাঘারুকে হাত নাড়িয়ে বলে দেয়, যাও, যাও, এখন ওখানে যাওয়া নিষেধ। মিছিল হারাইছ বুঝি-ই?

পুলিশ দুটো প্রায় সম্পূর্ণ পেছন ফিরলে বাঘারু একই জায়গায় দাঁড়িয়ে বলে, না। মোর কুনো মিছিল নাই। যেন সেই কথাটা শুনলে তাকে যেতে দিতে পারে। এবার একজন পুলিশ খুব জোরে বলে, মিছিল নাই ত বানাও গিয়া। যাও যাও, এখন এখানে ঢোকা নিষেধ।

বাঘারু আর-একবার সেই ফাঁকা কিন্তু রঙিন ঝাণ্ডাহীন আলোকিত মঞ্চটা দেখে, তারপর পেছন ফিরে হাঁটা শুরু করে। যেন এদিক দিয়ে যখন ঢোকা গেল না, তাকে আর-এক রকম চেষ্টা করতে হবে। সে আলোর বৃত্তটা যখন প্রায় পেরিয়ে এসেছে, বেড়াটা টপকাবে, তখন পেছন থেকে শোনা যায়, এই, এই, শোনো, এই, আরে এই বাউ, শুইন্যা যাও, এই। বেড়ার কাছ থেকে বাঘারু দেখে ঐ পুলিশদুটো কপালের ওপর হাত দিয়ে তাকে খুঁজছে। আলোর পেছনে তাকে দেখতে পাচ্ছে না।

বাঘারু কোনো জবাব না দিয়ে ঐ আলোর সীমায় ফিরে যায়, ঠিক সীমাটিতে, যাতে ওরা তাকে দেখতে পায়। ঢুকে, দাঁড়িয়ে থাকে।

পুলিশদুটোকে এবার অনেকটা হেঁটে তার সামনে আসতে হয়। এই জায়গাটা বালিভর্তি। মঞ্চে প্রবেশের রাস্তা আর সভার সীমার মাঝখানে নো-ম্যানস ল্যান্ড। তাই এখানে আর পাথর ফেলাও হয়নি, গাছও পোতা হয়নি। তিস্তার আদি বালি ফ্লাড লাইটে চকচক করছিল।

পুলিশদুটি সামনে এসে দাঁড়ায়। একজন বলে, শুনো। একটা ছোটো ছেলে হারাইয়্যা গিছে। এইখানে আছে। কী চায় বুঝি না। ঐডারে নিয়া যাও ত, ঠিক জায়গায় পৌঁছাইয়্যা দিও, আর কী দেইখব্যার চ্যাও ত এক পাক দেইখ্যা যাও। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে সেই মঞ্চের দিকে তাকিয়ে ডাকে, এই চ্যাংড়া, এদিকে আয়। আবার বাঘারুর দিকে তাকিয়ে বলে, এক পাক কিন্তু, তার বেশি না। তারপর আবার ঘাড় ঘুরিয়ে সেই ছেলেটির আসার সম্ভাব্য পথের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলে, তা, তুমিও কি হারাইছ নাকি? তোমার মিছিল গেল কই?

মোর কুনো মিছিল নাই। বাঘারু জবাব দেয়।

একলা আইছ? পুলিশটি আবার জিজ্ঞাসা করে, বাঘারু কোনো জবাব দেয় না। তখন বাঘারু দেখে, মঞ্চের তলা থেকেই যেন, বা, যেন ঐ ব্যারেজের ভেতর থেকেই একটা ছোট ছেলে বেরিয়ে ধীরে-ধীরে এদিকে এগিয়ে আসছে। এই দূরত্ব থেকে বাঘারু অনুমানও করতে পারে না ছেলেটা কত ছোট। কিন্তু ছেলেটি ধীরে ধীরে এই বেশি আলোতে স্পষ্ট হয়। ছেলেটি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। এত তীব্র আলোর দিকে আসতে ক্রমেই সে চোখ কোচকায়, তারপর বন্ধ করে ফেলে। পুলিশদুটো : বুঝতেই পারে না-ছেলেটি তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে আসছে কি না দেখবার জন্যে ঘাড়টা ঘোরাতেই দেখে ছেলেটি পাশে দাঁড়িয়ে। তখন তার মাথায় একটা হাত দিয়ে বলে, এই শোন, এইডা এই মিটিঙের লোক, এইডার সঙ্গে যা, তোকে পৌঁছাইয়া দিব নে। 

বাঘারু ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে মুই মিটিঙের মানষি না হই। পুলিশটা ঠাট্টা করে ওঠে, আ হা হা মণি আমার, আইল্যা ঐ মিটিঙের জায়গা থিক্যা আর এ্যাহ্ন কও, মিটিঙের, লোক না। তার পর ধমকের সুরে বলে, যাও, ছেলেডারে নিয়্যা ব্যারেজ-ম্যারেজ কী দেইখব্যা দেইখ্যা রওনা দ্যাও। জলদি। ছেলেটির মাথায় হাত দিয়ে পুলিশটি তাকে বাঘারুর দিকে ঠেলে কি ঠেলে না, মাদারি এসে বাঘারুর লম্বা হাতের আঙুলগুলি ধরে, তোমরালা এই ব্যারেজখান দেখিবেন? যেন সেই লোভেই সে বাঘারুর সঙ্গে যেতে রাজি হয়।

এই অংশ যদি মূল বৃত্তান্তের কোনো পর্বের অন্তর্ভুক্ত হত, তা হলে মাদারি-হস্তান্তর.রা বাঘারু-মাদারি সাক্ষাৎ এই শিরোনামে একটা অধ্যায় লেখা যেত। ফ্লাড লাইটের আলো এই ছোট, ঘেরা, বালুভূমিতে যেন ফেটে পড়ছে। সেই আলোর দিকে মুখ করে সঁহ্যাঁড়ালে চারপাশের অন্ধকারকে কঠিন মনে হয়। মঞ্চের ওপর আলো–নির্জন, রঙিন মঞ্চের ওপর। পুলিশদুটি ও মাদারির মাথা থেকে পা পর্যন্ত সম্মুখভাগে আলো। বাঘারুর মাথা থেকে পা পর্যন্ত পশ্চাদ্ভাগে আলো। বাঘারুর সেই শালপ্রাংশু নগ্নতা। মুহূর্তের মধ্যে মাদারি পুলিশের দিক থেকে বাঘারুর হাত ধরে বাঘারুর দিকে চলে আসে। তারও সম্মুখভাগ আবছা হয়ে যায়। মাদারি বাঘারুর হাত ধরে টেনে সেই মঞ্চের নীচ দিয়ে ব্যারেজের দিকে টেনে নিয়ে যায়।

যে-পথে সকালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রের রাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাজ্যের অন্যান্য মন্ত্রীরা, নিরাপত্তার কারণে ছড়ানো পাথরের ওপর দিয়ে, মঞ্চের নীচের পর্দা তুলে ব্যারেজে প্রবেশ করেছিলেন, বাঘারুর হাত ধরে মাদারি সেই নিশীথ নির্জনতায় সেই পথ দিয়েই ব্যারেজে ঢোকে আর সঙ্গে-সঙ্গে সেই ব্যারেজের আলোহীন উচ্চতা, নির্জনতা, বিস্তার তাদের যেন গ্রাস করে ফেলে। নিজের চেনাজানা পথের বাইরে এসে হাতির পাল বা একলা বাঘ যেমন থমকে যায়, বাঘারু আর মাদারি তেমনি থমকায়। মাদারি ততটা নয়, বাঘারু যতটা। মন্ত্রীরা যেখানে গ্রুপ ফটোর জন্যে দাঁড়িয়েছিলেন, বাঘারুকেও সেখানেই দাঁড়াতে হয়। মাদারি বাঘারুর কব্জি শক্ত করে ধরে। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মাদারির কব্জি বাঘারু শক্ত করে ধরে, যেন এখানে আচম্বিতে আত্মরক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।

মঞ্চের পেছনে একটি মাত্র অবান্তর আলো! কিন্তু একটা আবছায়া ছড়িয়ে আছে আকাশ-নদী জুড়ে যেমন থাকে। বাঘারু দেখেতিস্তা কোথাও দেখা যাচ্ছে না, তারা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে সোজা তাকালে ওপারের বোদাগঞ্জ ফরেস্টের গাছগুলোকে মনে হচ্ছে তাদের পায়ের অনেক নীচে। এই আবছায়ায় বোদাগঞ্জ ফরেস্টের গাছগুলোকে চেনা যায় না। মনে হয়, ওর কাছাকাছি গিয়ে এই আলো, অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গেছে। কিন্তু বাঘারু এ-আকাশের ছায়া-আবছায়া, আলো-অন্ধকার সবই দেখতে পায়! সে জানে, ওটাই বোদাগঞ্জ ফরেস্ট। তা হলে, তারা কত উঁচুতে উঠে এসেছে, যেখান থেকে ফরেস্টের গাছগুলোকে তাদের পায়ের তলায় দেখা যায়? কত উঁচুতে? তিস্তা কোথায়?

তিস্তাটাকে খুঁজে বের করতেই বাঘারুকে কয়েক পা হেঁটে এগতে হয়। খালি পায়ে পাথরের ওপর হাঁটতে তাদের অসুবিধে হয় না। বাঘারু লম্বা কিন্তু ধীর পা ফেলে–ডাইনোয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে। অথচ তার ডাইনে ও বায়ে ধু ধু আকাশ সেখানে কী এমন ঘটতে পারে যে বাঘারুকে আত্মরক্ষার ভঙ্গি নিতে হতে পারে ত্বরিত?

মাদারির কব্জি বাঘারুর হাতে ধরা। বাঘারু জোরে চেপে ধরে ছিল–যেন কোনো কারণে মাদারিকে তার হাত থেকে ছিটকে তেতে হতে পারে, যেন তেমন কোনে টান আচমকা আসতে পারে। বাঘারুর মুঠেযর ঐ চাপের ফলেই মাদারির ভেতরা টান আচমকা আসতে পারে। বাঘারুর মুঠোর ঐ চাপের ফলেই মাদারির ভেতরও হয়ত বাঘারুর আশঙ্কা সঞ্চারিত হয়ে যায়। সে বাঘারুর পায়ের সঙ্গে লেপ্টে যায়।

কয়েক পা গিয়েই বাঘারু দাঁড়ায়। তারপর ডান দিকে সরে যায় ধীরে-ধীরে। ধীরে-ধীরে, প্রায় ব্যারেজের কিনারায় এসে দাঁড়ায়।

এইঠে গেট বানাইছে, জল আটকি রাখিছে– বাঘারু বলে। আর, সেই নিজের কাছে বলা কথাগুলোও যেরকম উড়ে যায় তাতেই তারা বোঝে তাদের ডাইনে থেকে বায়ে, উত্তর থেকে দক্ষিণে বাতাস ছুটে যাচ্ছে। সেই বাতাসে ভর দিয়ে বাঘারু ঘাড় নুইয়ে দেখে, নীচে, কোন পাতালে জল চিকচিক করছে। বাঘারু আরো খানিকটা তাকিয়ে থেকে দেখে নিতে পারে–আরো অনেক দূর পর্যন্ত জলের অস্পষ্ট চিকচিক। এই একটা স্লুইস গেট দিয়ে জল বের করে উদ্বোধন ঘটানোর জন্যে তিস্তায় নানা স্রোতকে দূর-দূর থেকে ছোট-ছোট বাধ বেঁধে-বেঁধে এই গেটটার সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। বাঘারু সেই বাধগুলো দেখতে পায় না। সে দেখে, নীচে কিছুদূর পর্যন্ত জলের আবছা তরলতা। দেখে, সে বুঝে উঠতে পারে না তিস্তার স্রোত কোন দিক থেকে কোন দিকে বইছে। বুঝে উঠতে পারে না, তিস্তা কোন পথে কোথায় যাচ্ছে। বাঘারু ত তিস্তার ভেতর থেকে তিস্তা দেখে এসেছে–এখন সে কী করে, এত উঁচু থেকে তলায় তাকিয়ে তিস্তাকে চিনে নিতে পারবে।

বাঘারু কিনারা থেকে সরে আসে। হাতের মুঠিতে ধরা মাদারি এখন তার ডান পায়ের সঙ্গে সেঁটে। বাঘারু এবার উল্টো দিকের কিনারার দিকে চলে।

মাদারি জিজ্ঞাসা করে, ঐঠে জল বান্ধি রাখিছে?

বান্ধি রাখিছে।

 ক্যানং করি বান্ধে জল?

 না জানো-।

এখন বাতাস তাদের পেছনে। বাঘারু মাদারিকে বা হাতে নিয়ে নেয়–পেছনেই হাত বাড়িয়ে। মাদারি তার বা পায়ের সঙ্গে সেঁটে। এবার আর অতটা কিনারে যায় না বাঘারু, যেন বাতাস পেছন থেকে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে পারে। সে বা হাত আর বা পাটা শরীর থেকে সরিয়ে রাখে। মাদারিকে তলায় নদী দেখতে হয় সেই পায়ের বাধার ওপার থেকে। একটু ঝুঁকি দেবার জন্যে মাদারি বাঘারুর পেছনে হাত দেয় শরীরের ভর রাখতে। সেই ভরটা তাকে বদলাতেও হয়। বাঘারু টের পায়, মাদারি মাঝে-মাঝেই তার পেছনে সেই বাঘের থাবাটার ওপর হাত রাখছে। শেষে, সেখানেই রাখে বাঘারুর পিচ্ছিল শরীরে ঐ বাঘের থাবার অসমতলে যেন হাতের ভর রাখার সুবিধে।

স্লুইস গেট খুলে জল এই দিক দিয়ে বের করা হয়েছিল। বেশিক্ষণ নয়, জল ছিল না। সেই জল এখন এদিকের নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়েবৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর যেমন দেখায়। বাঘারু অত উঁচু থেকে অত কিছু দেখতে পায় না কিন্তু জল যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সেটা বুঝতে পারে।

এইঠে জল ছাড়িছে, এইঠে, বাঘারু নিজের কাছে বলে বুঝে নেয়। কিন্তু ব্যারেজের সেই তলদেশ থেকে চোখ তুলে তাকে তার আনুমানিক তিস্তার ওপর দিয়ে আবছায়ায় চোখ ছড়িয়ে দিতে হয় তিস্তাকে চিনে নিতে। বহুবহু ভাটিতে রাত্রির আকাশের তারাগুলোর ভেতর সে যেন দেখতে পায় তার শরীরের তিস্তাকে। কিন্তু নিশ্চিত হয় না। বা হাতটা আরো পেছিয়ে মাদারিকে আগে সরিয়ে বাঘারু সেই কিনারা থেকে সরে আসে।

মাদারি তার পায়ের সঙ্গে লেপ্টে থেকে জিজ্ঞাসা করে, জল ছাড়েন ক্যানং করি?

না জানো, না জানো-বাঘারু ব্যারেজের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়।

এখন বাঘারু ব্যারেজের ওপর দিয়ে সামনে তাকিয়ে। ব্যারেজ ধরে সে সামনে এগিয়ে যাবে–তার প্রস্তুতি নেয়, তারপর হাঁটা শুরু করে। মাদারি বা হাতেই ধরা, বাঘারুর বা পায়ের সঙ্গে লেপ্টে। আকাশের ভেতর দিয়ে যেন তারা হাটে-বাঘারু তলার তিস্তা আর ওপরের আকাশের দিকে যতবারই তাকায় ততবারই মনে হয় আকাশের ভেতর দিয়ে তারা হাঁটছে। আর, আকাশের সমস্ত বাতাস বাঘারু আর মাদারির শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। এ বাতাস অনেক ওপরের বাতাস। এর কোনো আওয়াজ নেই কিন্তু বাঘারু শরীর দিয়ে বোঝে সেই নিঃশব্দ বাতাসের জোর কতটা। ব্যারেজের ওপর তার পা দুটো গেঁথে দিতে চায় কিন্তু ব্যারেজের ওপর পা সেঁটে যায় না। বাঘারু তার হাঁটুটায় ভাজ ফেলে, যেন প্রস্তুত হয়ে নেয়, এই বাতাস তাকে উল্টে দিতে গেলেই সে মাদারিকে টেনে নিয়ে বসে পড়বে। গভীর বনের ভেতর যে-প্রস্তুতির ভঙ্গি বাঘারুর শরীরগত, এই ব্যারেজে সেই ভঙ্গিতেই বাঘারু প্রস্তুতি খোঁজে। কিন্তু বনের গভীরতাও তার পায়ের চেনা, ব্যারেজের এই উচ্চতার মুক্তি তার চেনা নয়।

বাঘারু জানে না, ব্যারেজটা কতখানি লম্বা। সে শুনেছে বটে ব্যারেজ শেষ হয়নি কিন্তু কোন পর্যন্ত হলে শেষ তা ত আর সে জানে না। এই বাতাসের ধাক্কা সামলাতে-সামলাতে এই আবছায়া ঠেলে এগতে-এগতে তার মনে হয় সে অনেকদূর এসে পড়েছে। সে আর এগবার সাহস পায় না। বাঘারু সামনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। দাঁড়ানোর পর তার দুই পা ফাঁক করে দেয়–আবার সেই প্রস্তুতিতে। বাঘারুকে মাথাটা একটু পেছনে হেলাতে হয় বাতাসের বেগ সামলাতে বা সামনের দূরত্বের আন্দাজ পেতে।

মাদারি তার শরীরের ভেতর থেকে চিৎকার করে, এইঠে শেষ? এই ব্যারেজখান?

না জানো।

মাদারি শুনতে পায় না। সে বাঘারুর বা পা থেকে মাথাটা বের করে এনে আবার চিৎকার করে, এইঠে শেষ? এই ব্যারেজখান?

এবার বাঘারু মাদারিকে পেছন থেকে সামনে টেনে আনে–মোক জোর করি ধরি থাক–ক্যানং বাতাস!

মাদারি ঘারুকে জড়িয়ে ধরে কিন্তু বেড় পায় না। না-পেয়ে ছোট-ছোট হাতদুটো বাঘারুর শরীরে আরো গেঁথে দেয়। তার পর বা হাতটা আলগা করে বাঘারুর পেছনে সেই বাঘের থাবার অসমতলটা খোঁজে, যেখানে হাতটা আটকানো যেতে পারে। মাদারি বাঘারুকে চিনে নিয়েছে তিস্তা বদলে দেয়া এই অজ্ঞাতপূর্ব ব্যারেজের ওপর এই নিশীথিনীতে একসঙ্গে থাকলে যে-দ্রুততায় চিনে নেয়া যায়, চিনে নিচ্ছে। বাঘারু মাদারিকে দুই হাতে তার শরীরে জড়িয়ে ধরে।

মাদারি ঘাড় হেলিয়ে বাঘারুকে জিজ্ঞাসা করে, এইঠে শেষ? এই ব্যারেজখান?

না জানো।

এইঠে তিস্তা? তিস্তা নদী?

কথাটার জবাব দেবার জন্যেই হোক অথবা নিজেই সে তিস্তাকে খুঁজছে বলেই হোক, বাঘারু ডাইনে বায়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে।

না জানো।

তোমরালা তিস্তা নদীখান্ না-চেনেন?

না চিনো।

এইঠে তিস্তা নদীখান তুলি দিছে?

 না জানো।

নতুন নদী বানাইছে? এইঠে?

না জানো।

 তোমরালা এইঠেকার মানষি না হন?

 বাঘারু জবাব দেয় না।

 জলুশত্ আসিছেন?

মোর কুনো মিছিল নাই। বাঘারু হাতদুটো মাদারির মাথার চুলের ওপর রাখে আর মাদারি এই মিছিলহীন ও নদীহীন সর্বহারা মানুষটিকে মমতায় আরো জড়িয়ে ধরে। তারপর আধা কৌতুকে জিজ্ঞাসা করে, তোমরালা কি মোর নাখান হারি (হারিয়ে) গিছেন?

বাঘারু খুক করে হেসে ফেলে।

পেছনে পুলিশের চিৎকার শোনা যায়, এই চইল্যা আইস, টাইম হইয়া গিছে, চইল্যা আইস।

 মাদারি আর বাঘারুর ঘুরে দেখে পুলিশ টর্চ ফেলে তাদের ফিরে যেতে বলছে। তারা ফিরে আসতে থাকে।

পুলিশটি তাদের ডেকে ও তাদের ফিরে আসতে দেখেই চলে গিয়েছিল। মঞ্চের তলার পর্দা ঠেলে বাঘারু আর মাদারি যখন সেই তীব্র আলোকিত, ছোট বালুভূমিতে ঢোকে তখন সেখানে আর-কেউ ছিল না। মাদারি বাঘারুকে ছেড়ে দেয়, বাঘারু মাদারির মুঠো আলগা করে দেয়। মাদারি এক পায়ে ভর দিয়ে নাচতে নাচতে সেই বালুভূমি পার হয়। পেছন ফিরে বাঘারুকে ডাকে, আইসেন। শাদা বালির ওপর তাদের ছায়াদুটো ক্রমেই লম্বা হতে থাকে, শেষে সেই শাদা মাঠের সবটুকু জুড়েই ওদের ছায়াদুটো। যেই তারা আলোর স্তম্ভটা পার হয় অত দীর্ঘ ছায়াদুটো নিমেষে মুছে যায়। ওখানে বাঁশের বেড়া আছে। বাঘারু ও মাদারি সেটা টপকে আপলাদের ভেতর ঢুকবে। তাপলাদে এখন জঙ্গলময় জোনাকি। মঞ্চের নীচ থেকে ঐ ফ্লাড-লাইটগুলো পেরিয়ে বাঘারু-মাদারিকে বা সে-সব কিছু দেখা যায় না।

.

আমরা বাঘারু-মাদারিকে আর অনুসরণ করব না।

বাঘারু তিস্তাপার ও আপলচাঁদ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মাদারিও তার সঙ্গে যাচ্ছে। যে কারণে তিস্তাপার ও ও আপলাদের শালবন উৎপাটিত হবে–সেই কারণেই বাঘারু উৎপাটিত হয়ে গেল। যে কারণে তিস্তাপার ও আপলাদের হরিণের দল, হাতির পাল, পাখির ঝাক, সাপখোপ চলে যাবে–সেই কারণেই। বাঘারু চলে যায়। তার ত শুধু একটা শরীর আছে। সেই শরীর এই নতুন তিস্তাপারে, নতুন ফরেস্টে বাঁচবে না। এই নদীবন্ধন, এই ব্যারেজ, দেশের অর্থনীতি বদলে দেবে, উৎপাদন বাড়াবে। বাঘারুর কোনো অর্থনীতি নেই। বাঘারুর কোনো উৎপাদনও নেই। বাঘারু এই ব্যারেজকে, এই অর্থনীতি ও এই উন্নয়নকে প্রত্যাখ্যান করল। বাঘারু কিছু-কিছু কথা বলতে পারে বটে কিন্তু প্রত্যাখ্যানের ভাষা তার। জানা নেই। তার একটা শরীর আছে। সেই শরীর দিয়ে সে প্রত্যাখ্যান করল।

সে এখন সারারাত ধরে এই ফরেস্ট পেরবে–যেখানে সে জন্মেছিল। দুটো-একটা রাস্তাও পেরবে। কাল সকালে আবার ফরেস্ট পেরবে। দুটো-একটা হাটগঞ্জও পেরবে। কখনো মাদারির ঘুম পাবে। বাঘারু মাদারিকে বুকে তুলে নেবে। কখনো মাদারি বাঘারুর আগে-আগে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে-দিয়ে রাস্তা বানাবে। মাদারিও ত আর-এক ফরেস্টের সন্তান। এরকম হাঁটতে-হাঁটতে যখন বাঘারুর মনে হবে নতুন একটা ফরেস্ট, নতুন একটা নদী খুঁজে পেল, তখন বাঘারু থামবে। সেই নতুন নদী, নতুন ফরেস্টটা বাঘারু এই শরীর দিয়েই চিনবে। বাঘারু জানে না-মাদারি কে, সে কোথায় থাকে, সে কেমন করে ফেরত যাবে। কিন্তু পাঠক ত জানেন–মাদারি কে, সে কোথায় থাকত। এখন, সারারাত, সারা দিন ফরেস্টের পর ফরেস্ট, নদীর পর নদী, হাটের পর হাট পেরতে-পেরতে তাদের কত কথা হবে, তারা দুজন-দুজনকে কত জানবে, তাদের কতবার ঘুম পাবে আর কতবার জাগরণ ঘটবে, তারা দুজন দুজনের পক্ষে কত অপরিহার্য হয়ে উঠবে। সে ত আর-এক স্বতন্ত্র বৃত্তান্ত।

এ বৃত্তান্ত এখানেই শেষ হোক।

এই প্রত্যাখ্যানের রাত ধরে বাঘারু মাদারিকে নিয়ে হাঁটুক, হাঁটুক, হাঁটুক…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *