1 of 2

৭৯. সাম্রাজ্য

অধ্যায় ৭৯ – সাম্রাজ্য

খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ থেকে ১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অক্টাভিয়ান (সিজারের উত্তরাধিকারী) প্রথম নাগরিক হলেন, পার্থিয়ানরা রোমের জীবনধারা মেনে চলতে অস্বীকার করল আর পুরো সাম্রাজ্যের মানুষ নিজেদের বুঝ দিতে লাগল যে, রোম তখনও একটি প্রজাতন্ত্র।

সিনেটে তখনো জুলিয়াস সিজারের মরদেহ পড়ে আছে। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন মার্ক অ্যান্টনি। সময়মতো এসে পৌঁছাতে পারেননি তিনি। তবে সিজারের মরদেহ যাতে নদীতে নিক্ষেপ করা না হয়, সে ব্যবস্থা করলেন তিনি।

পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে অ্যান্টনি তার এক বন্ধুর বাসায় লুকিয়ে থাকলেন। দাসের ছদ্মবেশ ধারণ করে শহর থেকে পালালেন। অপরদিকে, ব্রুটাস ও কাসিয়াস সিজারের মৃত্যুকে একটি মর্মান্তিক, কিন্তু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে প্রচার করতে লাগলেন।

সিনেটের পরবর্তী সভায় বড় আকারে সিজারের শেষকৃত্য আয়োজনের প্রস্তাব উঠল। তাকে এমনকি, স্বর্গীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সম্মান দেওয়ার কথাও বলা হল। এসব উদ্যোগে রোম শান্ত রইল আর মার্ক অ্যান্টনি ফিরে আসার সাহস পেলেন। সিজারের কোনো মিত্রের কোনো ধরনের ক্ষতি করার কোনো চেষ্টা ছিল না কোথাও।

তবে সিজারের উইল প্রকাশ পাওয়ার পর পরবর্তী কয়েক দিনে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে। জানা গেল, সিজার তার বিশাল সম্পদ রোমের সব নাগরিকদের মাঝে ভাগ করে দিয়ে গেছেন। তার মরদেহ রোমের সড়ক দিয়ে বহন করে নিয়ে যাওয়া হল—এতে সায় দিয়েছিলেন ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস। সম্মানজনক শেষকৃত্যের একটি অংশ ছিল এই কাজ। কিন্তু যখন রোমবাসীরা সিজারের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ দেখলেন, তখন তারা ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। একটি বিক্ষোভ দানা বাঁধতে লাগল, আর এই আগুনে ঘি ঢাললেন মার্ক অ্যান্টনি।

মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে ছিল একটি সেনাদল ও তার এক মিত্র মার্কাস অ্যামেলিয়াস লেপিদাস। লেপিদাস সিজার গল ও স্পেনের কাছাকাছি অঞ্চলের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। লেপিদাস তার নতুন দায়িত্বগ্রহণ করার সুযোগ পাননি।

মার্ক অ্যান্টনি সিজারের শেষকৃত্যে একটি নাটকীয় ভাষণ দিলেন। তিনি সিজারের রক্তমাখা টোগা বের করে সবাইকে দেখালেন।

এই দৃশ্য দেখে ক্রুদ্ধ জনতা হাতে মশাল নিয়ে রাস্তা নেমে এল। তারা ব্রুটাস আর কাসিয়াসকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলার হুমকি দিতে লাগল।

তবে রায়টের শুরুতেই তারা অ্যান্টিয়ামে পালিয়ে গেছেন। লেপিদাসের সহায়তায় মার্ক অ্যান্টনি সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিলেন। তিনি লেপিদাসকে পনটিফেক্স ম্যাক্সিমাস খেতাব দিলেন—রোমের প্রধান উপাসক।

তবে শাসক হিসেবে মার্ক অ্যান্টনি জনপ্রিয় ছিলেন না। তার গ্রহণযোগ্যতা ও ছিল তলানিতে।

নির্বাসিত ব্রুটাস রোমে ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। অ্যান্টনির বদলে তাকে ক্ষমতা বসাতে সহযোগীর ভূমিকা পালন করছিলেন সিসেরো।

তবে এসময় দৃশ্যপটে সিজারের উত্তরাধিকারী ও পালক পুত্র অক্টাভিয়ানের আগমন হল। তিনি ইতালি থেকে বেশ দূরে সামরিক দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু চাচার মৃত্যুসংবাদ শুনে বাড়ির পথে রওনা হলেন তিনি।

সিসেরো অক্টাভিয়ানের সঙ্গে হাত মেলালেন। ফলে ব্রুটাস ক্ষমতার লালসা ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে অ্যাথেন্সে এক বন্ধুর বাড়িতে চলে গেলেন।

সিজারের বন্ধু অ্যান্টনি সরাসরি তার ভাইপোর বিরোধিতা করতে পারলেন না। তবে অক্টাভিয়ানের আগমনকে তার কর্তৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখলেন তিনি। তিনি এই যুবককে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা চালালেন। ট্রিবিউন পদে নির্বাচন করা থেকে তাকে বিরত রাখারও চেষ্টা চালালেন ‘চাচার বন্ধু’ অ্যান্টনি।

মার্ক অ্যান্টনির সব শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে লাগলেন বুদ্ধিমান অক্টাভিয়ান। একপর্যায়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ল, মার্ক অ্যান্টনিকে হত্যার জন্য অক্টাভিয়ান আততায়ী পাঠাবেন। এতে দুইজনের সম্পর্কে বৈরীতা দেখা দিল।

খ্রিস্টপূর্ব ৪৩ সালে মোদেনার যুদ্ধে মুখোমুখি হলেন অক্টাভিয়ান ও অ্যান্টনি এতে অক্টাভিয়ান জয়লাভ করলেও দুইজন কনসাল ও অসংখ্য সেনা হারালেন তিনি।

অ্যান্টনি আল্পস যেয়ে সেখানে আবারো একটি সেনাবাহিনী গঠনে মন দিলেন। এ পর্যায়ে অক্টাভিয়ান তার চিন্তাধারা বদলালেন। তিনি বুঝলেন, যতদিন সিনেট ও সিসেরো প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থার ফিরে আসার স্বপ্ন ধারণ করছে, ততদিন তারা তার পক্ষে আসবেন না। যদিও সিনেট তাকে সমর্থন দিয়েছিল, তা ছিল শুধু মার্ক অ্যান্টনিকে রোম থেকে তাড়ানোর জন্য। কিন্তু অক্টাভিয়ান প্রজাতন্ত্র চাননি, তিনিও তার চাচার মতো রাজসুলভ ক্ষমতা চেয়েছিলেন এবং এ-কাজে সিসেরো তাকে সহায়তা করবেন না।

সিজারের পথ অনুসরণ করে তিনি মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করলেন।

নভেম্বরে বোলোনার এক গোপন অবস্থানে দুইজন দেখা করে তিনদিন ধরে অংশীদারত্ব নিয়ে আলোচনা করলেন। তারা দুইজন ও সঙ্গে মার্ক অ্যান্টনির মিত্র লেপিদাস মিলে আরেকটি ত্রিমুখী জোট বা ট্রায়ামভিরেট গঠন করলেন।

তাদের মাঝে আনুষ্ঠানিক ও লিখিত চুক্তি হল।

তারা প্রত্যেকে মিলে ৩০০ জনের একটি তালিকা বানালেন। এতে ছিলেন সিসেরো (অ্যান্টনির তালিকায়), অ্যান্টনির এক চাচা (অক্টাভিয়ানের তালিকায়) ও লেপিডাসের ভাই (লেপিডাস নিজেই তাকে হত্যা করতে চাইতেন)।

তিন নেতা বড় এক সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে রোমে ফিরে এসে এই ৩০০ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে রোম দখল করে নিলেন। চুক্তি অনুযায়ী, তিনজন পুরো সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ভাগ করে নিলেন

অক্টাভিয়ান পেলেন পশ্চিম, অ্যান্টনি পূর্ব, আর লেপিদাস তার নিজের দখলে থাকা গল ও স্পেন হারিয়ে পেলেন সুদূর আফ্রিকা।

লেপিদাসকে সাময়িকভাবে রোমের শাসনভার দিয়ে বাকি দুইজন ক্যাসিয়াস ও ব্রুটাসকে হত্যা করতে গ্রিসের দিকে রওনা হলেন।

মেসিডোনিয়ায় ক্যাসিয়াস ও ব্রুটাস তাদের মুখোমুখি হলেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে অসুস্থ হয়ে বাড়ির পথে ফিরতে লাগলেন অক্টাভিয়ান। অ্যান্টনির বাহিনীর কাছে পরাজিত হলেন ক্যাসিয়াস। তারপর শত্রুর হাতে ধরা না দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। এরপর ব্রুটাসকেও ধ্বংস করলেন তিনি। অপরদিকে রোমান প্রদেশ সিরিয়ায় পার্থিয়ানরা হামলা চালাবে—এমন সংবাদ পেয়ে সেদিকে রওনা হলেন অ্যান্টনি।

রাজা দ্বিতীয় ওরোদেসের নির্দেশে বড় এক বাহিনী যাচ্ছিল সিরিয়া দখল করতে। সিরিয়ায় রোমের নিয়োগ দেওয়া গভর্নর অ্যান্টিপ্যাটার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার ছেলে হেরোদ তখন এই দায়িত্ব নিয়েছেন মাত্ৰ।

৪১ সালে সিরিয়া এলেন অ্যান্টনি। কিন্তু সম্ভাব্য পার্থিয়ান হামলার কথা ভুলে গেলেন তিনি। তিনি সেখানে ক্লিওপেট্রার সঙ্গে দেখা করলেন।

ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সিরিয়াকে সুরক্ষা দেওয়ার বদলে আলেকজান্দ্রিয়ায় রওনা হলেন অ্যান্টনি।

কয়েক মাস পরে, ৪০ সালে পার্থিয়ান হামলায় সিরিয়া কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারল না। হেরদ রোমে পালিয়ে গেলেন। তাকে না পেয়ে পার্থিয়ানরা সর্বোচ্চ উপাসক জুদিয়ার এথনার্ক হিরকানাসের দুই কান কেটে দিল। অঙ্গহানি হওয়ার ফলে তৎকালীন ইহুদি রীতি মতে তিনি সর্বোচ্চ উপাসকের পদ হারালেন।

এই সাফল্যের পর ওরোদেসকে হত্যা করেন তার ছেলে চতুর্থ ফ্রাতেস। তাকেও তার ভাই ও বড়ছেলে মিলে হত্যা করল। ক্লিওপেট্রার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে অ্যান্টনি রোমে ফিরে এলেন। তিনি অক্টাভিয়ানের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। ততদিন সুস্থ হয়েছেন অক্টাভিয়ান। পূর্বাঞ্চলে ফিরতে লাগলেন অ্যান্টনি।

৩৭ সালে পার্থিয়ানদের সিরিয়া থেকে ভাগিয়ে দিয়ে হেরদকে আবারও রোমের প্রতিনিধি-রাজা হিসেবে বসালেন তিনি। তিনি ছিলেন ইহুদিদের অসাম্প্রদায়িক রাজা—যার কাছে একইসঙ্গে উপাসনা ও শাসনের দায়িত্বভার ন্যস্ত হল।

অপরদিকে, পশ্চিমে লেপিদাসকে নিশ্চিহ্ন করলেন অক্টাভিয়ান। বাকি দুই নেতার ব্যক্তিত্বের কাছে ম্লান হতে হতে বিরক্ত হয়ে পড়ছিলেন লেপিদাস।

লেপিদাসের বাহিনী খুব সহজেই পক্ষ বদলে অক্টাভিয়ানের কাছে চলে এলেন। আপাতত রোমের সর্বময় ক্ষমতা অক্টাভিয়ান ও অ্যান্টনির কাছে রইল।

তবে অ্যান্টনি তখন আর অত শক্তিশালী অবস্থায় ছিলেন না। পার্থিয়ার বিরুদ্ধে অভিযানে তিনি প্রচুর সমস্যায় পড়েন। মেদিয়া দখলের চেষ্টা চালিয়ে তিনি ২৪ হাজার পদাতিক সেনা ও চার হাজার ঘোড়সওয়ার হারান।

৩৪ সাল নাগাদ অ্যান্টনি হাল ছেড়ে দিলেন। তিনি ক্লিওপেট্রার কাছে ফিরে গেলেন। তার এই দেশত্যাগের ঘটনায় অক্টাভিয়ান সুযোগ পেলেন। তিনি অ্যান্টনিকে রোমের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করলেন এবং নিজেকে অ্যান্টনির আওতাধীন অঞ্চলের শাসক হিসেবে ঘোষণা দিলেন।

খুব সহজেই সিনেটকে নিজের পক্ষে নিয়ে এলেন অক্টাভিয়ান। ৩২ সালে তিনি অ্যান্টনির উইলের তথ্য সিনেটের কাছে ফাঁস করলেন। জানা গেল, অ্যান্টনি তার সম্পদের বেশিরভাগ অংশ তার মিশরীয় সন্তানদের জন্য ছেড়ে যাবেন এবং তিনি তাকে মিশরেই সমাহিত করার অনুরোধ করেছেন। উইলের তথ্য ফাঁস করা অবৈধ হলেও এসব তথ্য জেনে সেটা নিয়ে আর সিনেট মাথা ঘামাল না। তারাও অক্টাভিয়ানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে অ্যান্টনিকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করল।

ক্লিওপেট্রার গর্ভে অ্যান্টনির যমজ সন্তান ছিল—একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। অক্টাভিয়ান মন্তব্য করলেন, অ্যান্টনিকে ক্লিওপেট্রা ‘জাদু করেছে’।

অ্যান্টনি এই খবর শুনে ইফেসাসে ৫০০ যুদ্ধজাহাজ, এক লাখ পদাতিক সেনা ও জুদিয়ার রাজা হেরদ সহ আরও কয়েকজন মিত্রসহ একটি সমীহ জাগানিয়া সেনাবাহিনী গঠন ক্রুলেন।

অক্টাভিয়ানের নৌবাহিনীর সঙ্গে অ্যান্টনির বাহিনীর মোলাকাত হল গ্রিসের উত্তর উপকূলের কাছে অবস্থিত অ্যাক্টিয়ামে। সেখানে অক্টাভিয়ান অ্যান্টনির ৩০০ জাহাজ ধ্বংস করার পর তিনি ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে মিশরে ফিরে গেলেন।

অ্যান্টনির বেশিরভাগ সেনা অক্টাভিয়ানের দলে যোগ দিল।

অক্টাভিয়ান শীতকালে অ্যান্টনিকে শায়েস্তা করতে মিশরের উদ্দেশে রওনা হলেন।

অক্টাভিয়ানের আসার খবর পেয়ে পেটের মধ্যে তলোয়ার ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করলেন অ্যান্টনি। তবে সঙ্গে সঙ্গে মারা যাননি তিনি, দীর্ঘসময় ধরে রক্তক্ষরণের পর মারা যান তিনি। ক্লিওপেট্রাও আত্মহত্যা করেন। তবে তার মরদেহের পাশে

কোনো ছোরা পাওয়া যায়নি বা তার শরীরে কোনো ক্ষতও ছিল না। পরে তার দাস-দাসীরা ধারণা করেন, খুব সম্ভবত তিনি স্বেচ্ছায় বিষাক্ত সাপের কামড় খেয়েছিলেন। বিষক্রিয়ায় মারা যান তিনি। আজীবন অক্টাভিয়ানের দাসত্ব বরণের চেয়ে এ-ধরনের মৃত্যু বেছে নেন তিনি।

খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সালে ক্লিওপেট্রা ও সিজারের সন্তানকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন অক্টাভিয়ান। সে মুহূর্তে তিনিই ছিলেন রোমের একক অধিপতি।

খ্রিস্টপূর্ব ২৯ সালে অক্টাভিয়ান বিজয়মিছিলের আয়োজন করলেন। ততদিনে রোমের মানুষ যুদ্ধ-বিগ্রহে ত্যক্তবিরক্ত। অ্যাক্টিয়ামে অক্টাভিয়ানের বিজয় ছিল এক নতুন শুরু। পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদরা বলেন, এই ঘটনার জেরে রোমান প্রজাতন্ত্রের মৃত্যু ঘটে এবং রোমান সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়। তবে অক্টাভিয়ান সেসময় দাবি করেন, রিপাবলিকের (প্রজাতন্ত্র) নবজাগরণ ঘটেছে।

রোমের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পটভূমিকায় সিনেট ও অক্টাভিয়ান সমঝোতায় পৌঁছালেন। অক্টাভিয়ান চাইতেন ক্ষমতা, আর সিনেটের কাজ ছিল প্রজাতন্ত্রের ধারণাকে টিকিয়ে রাখা। কিন্তু সিনেট এটুকু বুঝেছিল যে, অক্টাভিয়ানকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো ক্ষমতা তাদের নেই। আবার অক্টাভিয়ানও বুঝতেন যে, সিনেটকে বিলুপ্ত করে দিয়ে সাধারণ মানুষকে চটিয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

অক্টাভিয়ান নিজেই পরিস্থিতির একটি বর্ণনা দেন : ‘আমি গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানোর পর সবার সম্মতিতে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হই। আমার সেই ক্ষমতা থেকে আমি রাষ্ট্রকে রোমান সিনেট ও জনগণের নিয়ন্ত্রণভার ছেড়ে দিই।’

এভাবে অক্টাভিয়ান প্রমাণ করলেন যে তিনি রিপাবলিকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। রিপাবলিকও তাকে উদার হাতে নানা সুযোগ-সুবিধা দিল।

কনসাল, ইমপেরাটরের পাশাপাশি আরেকটি উপাধি পেলেন তিনি- অগাস্টাস।

পরবর্তীতে এই অগাস্টাস নামেই তিনি বেশি পরিচিত হন। অগাসটাসের কাছে সম্রাটের খেতাব না-থাকলেও ক্ষমতা ছিল পুরোপুরি।

২৩ সালে কনসাল পদে পুনর্নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হলেন না অগাস্টাস। একই বছরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন অগাস্টাস।

খ্রিস্টপূর্ব ২০ সালে পার্থিয়ান রাজা চতুর্থ ফ্রাতেসের সঙ্গে সন্ধি করলেন অগাস্টাস। এই চুক্তির আওতায় ফ্রাতেস রোমের যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দিলেন। তবে রোমের কাছ থেকে কী পেয়েছিলেন, তার বর্ণনা পাওয়া যায় না। শুধু জানা যায়, অগাস্টাস তাকে একজন দাসী দিয়েছিলেন, যিনি খুব শিগগির তার প্রেমিকার ভূমিকা নেন।

খ্রিস্টপূর্ব ১১ সাল নাগাদ অগাস্টাস সিনেটের বেশকিছু নিয়ম বদলে নিজের ক্ষমতা বাড়ালেন। আগের নিয়ম ছিল ৬০০ সদস্যের মধ্যে অন্তত ৪০০ জনের কোরাম পূর্ণ না হলে কোনো কার্যক্রম চলবে না। তিনি এ নিয়ম রদ করলেন।

একইসঙ্গে অগাস্টাস একজন উত্তরাধিকারী খুঁজে রাজবংশ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছিলেন—একটি খুবই অপ্রজাতান্ত্রিক ধারণা।

সিনেট তার উত্তরাধিকারীর মতামতে পুরোপুরি বিপক্ষে ছিল না। অগাস্টাসের মৃত্যুর পরপরই দেশে গোলযোগ নেমে আসুক, তা তারা চাইতেন না। কিন্তু একজন উত্তরাধিকারী, রোমের পরবর্তী ইমপেরাটর নির্বাচনের কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছিল না। এ ছাড়া, অগাস্টাসের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। তিনি তার জামাতাকে উত্তরাধিকারী বানাতে চেয়েছিলেন। ২৪ সালে তিনি তার ১৪ বছর বয়সি মেয়ে জুলিয়াকে তার ১৭ বছর বয়সি চাচাতো ভাই মারসেলাসের কাছে বিয়ে দিলেন। কিন্তু এক বছরের মাথায় মার্সেলাস মারা গেলেন। এরপর তার বাহিনীর এক কর্মকর্তা এগরিপ্পার সঙ্গে বিয়ে দিলেন মেয়ের। কিন্তু ১২ সালে এগরিপ্পাও মারা গেলেন।

দুর্ভাগা মেয়েকে শান্তি না দিয়ে আবারও তাকে বিয়ে দিলে তার স্ত্রীর আগের ঘরের সন্তান তাইবেরিয়াসের কাছে।

খ্রিস্টপূর্ব ৪ সালে সিরিয়ার প্রতিনিধি রাজা হেরোদ মারা গেলেন। তিনি তিন ছেলে ও এক সুবিশাল মন্দির রেখে গেলেন।

অগাস্টাস হেরোদের কোনো এক সন্তানকে নতুন প্রতিনিধি-রাজা না-বানিয়ে প্যালেস্টাইনের তিন অংশে তিন ছেলেকে ক্ষমতা দিলেন।

অপরদিকে পার্থিয়ান রাজা চতুর্থ ফ্রাতেসের সেই রোমান দাসীর ঘরে জন্ম নেওয়া সন্তানের বয়স ২০-এর কোঠায় পৌঁছালে তিনি রোমান কায়দায় তার বাবাকে হত্যা করলেন। পঞ্চম ফ্রাতেসের আমলের মুদ্রায় তাকে আর তার মাকে একসঙ্গে দেখা যায়, তবে সহ-শাসক বা সন্তান-মায়ের ভূমিকায় নয়, বরং খানিকটা প্রভু-রক্ষিতার ভূমিকায়। সে আমলে এ-ধরনের অনাচার খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না। শাসক হিসেবে এই দুইজন একেবারে জনপ্রিয় ছিল না। চার বছরের মাথায় পার্থিয়ানরা তাদেরকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়।

এরপর রোমের শিক্ষায় শিক্ষিত অপর এক সন্তান ক্ষমতা গ্রহণ করে নাম নেন প্রথম ভনোনেস।

মাত্র চার বছরের মাথায় রোমের আশীর্বাদপুষ্ট প্রথম ভনোনেসকে হত্যা করে শাসনভার গ্রহণ করেন পার্থিয়ান দেশপ্রেমিক আরতাবানাস। রোমের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছিল পার্থিয়া, কিন্তু তারা রোমের সবধরনের প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল।

৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অগাস্টাস উত্তরাধিকারী খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টা বাদ দিয়েছেন।

জুলিয়ার নাতিরা বড় হয়ে রাজা হবে, এরকম ধারণা বা ইচ্ছে মনে পোষণ করলেও এ পরিকল্পনা কাজ করেনি। দুই নাতি অকালে মারা যায়, অপর একজন উন্মাদ হয়ে পড়েন। সেই তাইবেরিয়াসই টিকে থাকল। তিনি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিবারের সদস্য করে নিলেন।

১৩ খ্রিস্টাব্দে টাইবেরিয়াসকে রোমের সেনাবাহিনীর দায়িত্ব দেওয়া হল। ১৪ সালের আগস্ট মাসে তাইবেরিয়াসের সঙ্গে যাত্রা করার সময় ৭৪ বছর বয়সি অগাস্টাস ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলেন। শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন তিনি।

জীবনের শেষ মুহূর্তে তিনি স্বীকার করেন, প্রজাতন্ত্রের রক্ষাকর্তা হিসেবে তার ভূমিকা অভিনয় ছাড়া কিছুই ছিল না এবং সম্রাটের খেতাব না-নেওয়ার পেছনে এই অভিনয় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সবকিছুই তিনি করে গেছেন ‘দর্শকদের’ জন্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *