1 of 2

৭৮. নতুন মানুষ

অধ্যায় ৭৮ – নতুন মানুষ

৭৮ থেকে ৪৪ সালের মাঝে এক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন স্পার্টাকাস। জুলিয়াস সিজার পম্পেই ও ক্রাসাসের সঙ্গে জোট গঠন করেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৭৮ সালে সুল্লা তার দেশের বাড়িতে মারা গেলেন। তিনি পাঁচটি বিয়ে করেছিলেন এবং তার ২৩ জন সন্তান ছিল। সবার ছোট সন্তানের নাম ছিল পসটুমাস কর্নেলিয়াস সুল্লা।

সুল্লা ও মারিয়াসের বৈরীতার রেশ তখনো রয়ে গেছিল।

সুল্লার ডানহাত পম্পেই আইবেরীয় উপদ্বীপে (স্পেনে) সেনাবাহিনী নিয়ে এসে মারিয়াসের এক মিত্রের বিরুদ্ধে লড়তে লাগলেন। অপর একটি বাহিনী পনটাসের রাজার বিরুদ্ধে অসমাপ্ত যুদ্ধ জয় করতে গেল। এই দুই যুদ্ধের পাশাপাশি ভূমধ্যসাগরে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে লড়তে অপর এক বাহিনী পাঠানো হয়েছিল। এই তিন যুদ্ধে রোমের সেনাবাহিনীর বড় একটি অংশ ইতালীয় উপদ্বীপ থেকে দূরে ছিল।

সশস্ত্র যোদ্ধাদের অনুপস্থিতিতে আবারও দাসরা বিদ্রোহ শুরু করার সাহস পায়। তবে এই দাসরা ছিলেন দক্ষ যোদ্ধা। তারা রোমের অভিজাতদের মনোরঞ্জনের জন্য লড়তেন—তারা ছিলেন ‘গ্ল্যাডিয়েটর’।

এতরুসকানদের আমল থেকে দর্শকদের মনোরঞ্জনের দাসরা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়েছেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সালের পর থেকে রোমের বিভিন্ন উৎসবে গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধ বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়।

রোমের একের পর এক যুদ্ধজয় দেশটিতে বিভিন্ন দেশ, জাতি ও বর্ণের দাস নিয়ে আসে। গল, আইবেরীয় উপদ্বীপ, থ্রেস, সিরিয়া ও গ্রিসের বন্দি যোদ্ধারা। একজন সফল গ্ল্যাডিয়েটর প্রায়ই বীরের মর্যাদা পেতেন। রোমান ধর্মতত্ত্ববিদ তারতুলিয়ান বলেন, ‘গ্ল্যাডিয়েটরা পুরুষদের মন আর নারীর যৌবন জিতে নিতেন’। তা সত্ত্বেও, রোমানরা তাদেরকে খুব নিচু দৃষ্টিতে দেখতেন।

গ্ল্যাডিয়েটরদের প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন সংগঠন বা ‘স্কুল’ চালু হয়েছিল রোমে। এর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত স্কুলটির অবস্থান ছিল কাপুয়াতে। কোনো এক বিচিত্র কারণে, এই স্কুলের গ্ল্যাডিয়েটরদের খুবই মানবেতর অবস্থায় রাখা হত। এর মালিক ছিলেন অত্যন্ত নির্দয়। খ্রিস্টপূর্ব ৭৩ সালে এই স্কুলের ৭৮ জন গ্ল্যাডিয়েটর তাদের কোয়ার্টার থেকে পালিয়ে গেলেন। তারা পার্শ্ববর্তী কসাইর দোকানে হামলা চালিয়ে ছুরি ও বল্লম জোগাড় করল। এরপর তারা দলবেঁধে শহরের দিকে রওনা হল।

কাপুয়া থেকে তাদেরকে আটক করতে সেনারা আসলে এই গ্ল্যাডিয়েটরা তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে উত্তম মধ্যম দিয়ে বিদায় করল।

‘গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধের’ শুরু এখান থেকেই, যা দুই বছর ধরে চলেছিল। গ্ল্যাডিয়েটররা স্পার্টাকাস নামে এক দাসকে তাদের নেতা হিসেবে নির্বাচিত করে। প্লুটার্ক বলেন, স্পার্টাকাস থ্রেসের ‘যাযাবর গোত্র’ থেকে উঠে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও সংস্কৃতিমনা ছিলেন—তার সঙ্গে কথা বললে তাকে গ্রিক বলে ভুল করত সবাই। এটা আদতে একধরনের প্রশংসাই ছিল।

তিনি অত্যন্ত সুকৌশলী একজন সেনাপতি হিসেবে আবির্ভূত হলেন। গ্ল্যাডিয়েটরদের শায়েস্তা করতে তিন হাজার রোমান সেনা পাঠানো হল। তারা তাদেরকে একটি পাহাড়ে কোণঠাসা করে ফেলল। সেখান থেকে পালানোর দুইটা পথ ছিল। একটি পথে রোমানরা প্রহরা দিচ্ছিল, আর অপরটি পাহাড়ের চূড়া বেয়ে নিচে নামার পথ। তবে দ্বিতীয় এই পথটি বন্য লতাগুল্ম দিয়ে ঢাকা ছিল। আটকে পড়া গ্ল্যাডিয়েটররা সেই বুনোলতা দিয়ে মই তৈরি করে পাহাড় বেয়ে দ্রুত নেমে এল। তারপর অপ্রস্তুত রোমান শিবিরে হামলা চালিয়ে তা দখল করে নিল

এরপর রোমের বেশ কয়েক দফা হামলা ব্যর্থ করলেন স্পার্টাকাস ও তার বাহিনী। একপর্যায়ে তার অধীনে ৭০ হাজার মানুষ যোগ দিল। যা শুরু হয়েছিল এক ‘সামান্য যন্ত্রণা’ হিসেবে, তা রোমের জন্য হয়ে দাঁড়াল ‘গলার কাঁটার’ মতো ভয়াবহ যুদ্ধে।

স্পার্টাকাসের রোম দখল করা বা সে-ধরনের কোনো উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন তারা আল্পস পাহাড় পেরিয়ে দাসের জীবন থেকে মুক্তি পাবেন এবং যে-যার বাড়িতে চলে যাবেন (থ্রেস, গল বা অন্য কোথাও)। কিন্তু বাকি গ্ল্যাডিয়েটররা তার কথা শুনতে আগ্রহী ছিলেন না। তারা চরম আত্মবিশ্বাসী ও সংখ্যায় বড় ছিল। তারা চাইছিল ইতালি ছারখার করে দিতে I

রোম বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব সহকারে নিয়েছিল। তারা তাদের দুই কনসালকে একসঙ্গে পাঠাল। কিন্তু তাদের হামলা ব্যর্থ হওয়ার পর সুল্লার সাবেক সহযোগী ক্রাসাসকে পাঠানো হল স্পার্টাকাসের বিরুদ্ধে লড়তে। তিনিও প্রথম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বারের হামলা বেশ ফলপ্রসূ হল। পিছু হটে উপকূলের দিকে যেতে বাধ্য হলেন স্পার্টাকাস। সেখানে তিনি এক জলদস্যুর সঙ্গে সমঝোতায় এলেন। অর্থের বিনিময়ে জলদস্যুদের জাহাজ তাকে ও তার বাহিনীকে সিসিলি পৌঁছে দেবে। কিন্তু সেই জলদস্যুরা কথা রাখেনি। স্পার্টাকাসের কাছ থেকে অর্থ বুঝে পেয়েও তাদেরকে না নিয়েই উপকূল ছেড়ে চলে যায় জলদস্যুরা। ইতালির একেবারে দক্ষিণে, রেজিয়ামের তীরে দাঁড়িয়ে নিজেকে অসহায় অবস্থায় আবিষ্কার করলেন স্পার্টাকাস।

ছোট উপদ্বীপে আটকা পড়লেন স্পার্টাকাস। ক্রাসাস এই উপদ্বীপের চারপাশে দেয়াল তুলে স্পার্টাকাসকে আরও ভালোভাবে আটক করার জন্য তার বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন। প্রাচীরের সামনে ১৫ ফুট দীর্ঘ নালাও খনন করা হল। তবে একটি তুষারঝড়ে এই নালা ধুলা, গাছের গুঁড়ি ও কাঠ দিয়ে ভরে গেল এবং স্পার্টাকাস সেখান থেকে তার বাহিনীর বড় একটি অংশকে নিয়ে বের হয়ে আসলেন।

এই পর্যায়ে রোমানরা অনুধাবন করল, ক্রাসাসের আরও সহায়তা প্রয়োজন। তারা পম্পেই’র বাহিনীকে সেখানে পাঠিয়ে দিল। তবে এতে ক্রাসাস খুশি হতে পারেননি। তিনি ভাবলেন, পম্পেই এসে তার গৌরব কেড়ে নেবে।

ক্রোসাস শেষ আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখন স্পার্টাকাসের বাহিনী অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে রোমানদের ওপর অপরিকল্পিত ও এলোমেলো এক হামলা চালিয়ে বসল। খুব সহজেই এই হামলা প্রতিরোধ করতে পারলেন ক্রাসাস। রোমানবাহিনীর পালটা হামলায় বেশিরভাগ গ্ল্যাডিয়েটর যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যায়। স্পার্টাসকেও একা রেখে তার সঙ্গীরা চলে যায়। নিরুপায় হয়ে সরাসরি ক্রাসাসের ওপর হামলা চালাতে যান তিনি, কিন্তু সঙ্গে আর কেউ না থাকাও সহজেই মারা পড়েন এই বীর গ্ল্যাডিয়েটর নেতা।

তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ঠিক সেসময় যুদ্ধক্ষেত্রে পম্পেই হাজির হন। তিনি পলায়নরত দাসদের ধাওয়া করেন এবং প্রায় ছয় হাজার দাসকে আটক করেন। তাদের সবাইকে কাপুয়া থেকে রোম পর্যন্ত বিস্তৃত সড়কের ওপর ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করেন তিনি। বেশিরভাগ মানুষ আপিয়ান সড়কের উপর অবস্থিত এই ‘উদাহরণ’কে পম্পেইর সাফল্য হিসেবে দেখল। পম্পেই নিজেই সিনেটের কাছে চিঠি পাঠিয়ে দাবি করলেন, ‘ক্রাসাস একটি যুদ্ধে জিতেছিল, কিন্তু আমি নিজে বিদ্রোহীদের সমূলে উৎপাটন করেছি।’

পরের বছরে (খ্রিস্টপূর্ব ৭০) ক্রাসাস ও পম্পেই, উভয়ই কনসাল পদে নিয়োগ পেলেন। প্লুটার্ক জানান, তাদের পুরো মেয়াদজুড়ে এই দুই ভদ্রলোক ঝগড়ায় মেতে রইলেন, এবং কোনো কাজই করতে পারলেন না। তবে মানুষের মাঝে শস্য বিতরণ করে জনপ্রিয়তা পান তারা। অনেকেই তাদেরকে ‘সাধারণ জনগণের নেতা’ হিসেবে দেখতেন। তবে এর মাঝে বন্ধ ছিল না ক্রাসাসের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ ও পম্পেইর অন্যের কাজকে নিজের বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা। অপরদিকে সিসেরো নামে এক তরুণ রাজনীতিক দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের চিহ্নিত করে তাদের বিচারের আওতায় আনার উদ্যোগ নিলেন। ভেরেস নামে এক ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হল।

ভূমধ্যসাগরে জলদস্যুতা বেড়ে গেলে ট্রিবিউনরা ঠিক করলেন পম্পেইকে সেখানে পাঠাবেন। তাকে এক বিশাল সামরিক বাহিনীর সাময়িক নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হল। তার সঙ্গে দেওয়া হল ভূমধ্যসাগরে রোমের সমগ্র নৌবহর এবং এক লাখেরও বেশি সেনা। সিনেট এক ব্যক্তির হাতে এত ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টিতে একমত না হলেও অ্যাসেম্বলিতে ভোটে পম্পেইর নিয়োগ পাস করল।

খুব অল্প সময়ের মাঝে সাফল্যের শিখরে উঠে গেলেন পম্পেই। জলদস্যুরা খুব দ্রুত পরাভূত হল। সুল্লার মৃত্যুর পর রোমে ফিরেছিলেন জুলিয়াস সিজার। তিনি পম্পেইর মেয়ে পম্পেইয়াকে বিয়ে করতে চাইলেন। পম্পেই এই বিয়েতে সায় দিলেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে পূর্বে পনটাসের বিরুদ্ধে লড়তে গেলেন।

৬৬ সালে পম্পেই এই যুদ্ধের অবসান ঘটান এবং ভূমধ্যসাগরের উপকূলে সিরিয়াসহ সেলেউসিদ সাম্রাজ্যের যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা দখল করে নেন। তিনি জেরুজালেমের মন্দিরে যান পরিদর্শন করতে। তবে পম্পেই উপাসকদের হাতেই শহরের নিয়ন্ত্রণভার দিয়ে আসেন।

নতুন ব্যবস্থা অনুযায়ী, জেরুজালেমকে রোমের প্রদেশ গ্যালেস্টানের অংশ করে নেওয়া হল। তাদের আর কোনো হাসমোনীয় রাজা থাকলেন না। পম্পেই তার জায়গায় জন হিরকানাস (দ্বিতীয় হিরকানাস নামে পরিচিত) নামে এক উপাসককে নিয়োগ দিলেন। তার উপাধি হল ‘হাই প্রিস্ট অব এতনার্চ’—এটি একইসঙ্গে ধর্মীয় ও অসাম্প্রদায়িক কার্যালয় ছিল। মন্দিরের উপাসকরা রোমের প্রতিনিধি হিসেবে প্যালেস্টাইন শাসন করবেন। তারা সিরিয়ায় নিযুক্ত রোমের গভর্নরের অধীনে থাকবেন।

৭৮.১ পম্পেই ও সিজারের যুদ্ধগুলো

এরপর পম্পেই গৌরবময় অভিযান শেষে রোমে ফিরে এলেন।

রোমে সিজার ও সিসেরো, উভয় রাজনীতির মাঠে ভালো করছিলেন। ৬৩ সালে কনসাল হলেন সিসেরো। জুলিয়াস সিজারও পরপর দুটি সরকারি উচ্চপদ ধারণ করলেন। ৬৫ সালে অর্থনৈতিক কর্মকর্তা (আইদিল) ও ৬৩ সালে রাষ্ট্রধর্মের সর্বোচ্চ উপাসক (পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমাস) হলেন সিজার।

তবে নির্বাচনি প্রচারণা চালাতে যেয়ে বড় আকারে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন সিজার। অপরিশোধিত বিলের কারণে গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় ছিলেন তিনি। তিনি রোম ছেড়ে পালাতে উদ্যত হলেন, কিন্তু তার আগে তার প্রয়োজন ছিল অর্থের। কোনোমতে সিজার আইবেরীয় উপদ্বীপে রোমের প্রদেশ হিসপানিয়ার গভর্নরের চাকরি জোটালেন। কিন্তু বন্দর ছেড়ে যাওয়ার আগে তাকে পাওনাদাররা ধরে ফেলল। তার মালপত্র ক্রোক করতে চাইলেন তারা।

ক্রাসাস একজন ভালো ব্যবসায়ী ছিলেন। তার রুপার খনি, অসংখ্য ফসলি জমি ও দাস ছিল। তিনি সিজারের ঋণের গ্যারান্টি দিলেন। পাওনাদাররা তাকে ছেড়ে দিলেন।

হিসপানিয়ায় সিজার দুই হাত ভরে উপার্জন করলেন। তিনি তার সব পাওনা পরিশোধ করে রোমে ফিরে আসলেন। সেখানে ফিরে পম্পেই ও ক্রাসাসের সঙ্গে আলোচনা বসলেন। সিজার প্রস্তাব দিলেন, তারা দুইজন যদি ৫৯ সালে পরবর্তী নির্বাচনে তাকে কনসাল পদে অর্থ ও জনসমর্থন দেন, তাহলে তারা যেসব আইন চাইবেন, তার সবই তিনি ক্ষমতায় যেয়ে পাস করাবেন।

পম্পেই রাজি হলেন। তিনি অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের জন্য কিছু বাড়তি সুবিধা চাচ্ছিলেন। তবে ক্রাসাসকে রাজি করানো এত সহজ ছিল না। তিনি তখনো গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধে পম্পেইর ‘গৌরব’ কেড়ে নেওয়ার বিষয়টি ভুলতে পারেননি। তবে তিনি সিজারের প্রস্তাবের লাভজনক দিকটি সহজেই বুঝতে পারলেন। সিজারের অর্থনৈতিক সংস্কার তার নিজের ব্যবসার উন্নয়ন ঘটাতে পারে। এই তিন ধূর্ত রাজনীতিবিদ এক ত্রিমুখী স্বার্থনির্ভর জোট গঠন করলেন।

এই উদ্যোগ সফল হল। সিজার কনসাল হিসেবে নির্বাচিত হলেন। নির্বাচিত হয়েই তিনি দরিদ্রদের জন্য জমির বণ্টনের ব্যবস্থা করলেন। এই উদ্যোগে তিনি তার সহকর্মী ও কনসাল বিবুলাস ও সার্বিকভাবে, সিনেটের বিরাগভাজন হলেন। তারা চাইত না একজন কনসাল ট্রিবিউনের মতো আচরণ করে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষায় কাজ করছেন।

তবে সাধারণ জনগণ বেশ খুশি হল। অ্যাসেম্বলিতে সিজারের উদ্যোগগুলো অনুমোদন পেল। পম্পেই ফোরামে সশস্ত্র রক্ষী পাঠালেন, যাতে সিনেটররা কোনো ধরনের বাধার সৃষ্টি করতে না পারেন।

বিবুলাস ফোরামে এসে প্রতিবাদ জানাতে আসলে তার মাথায় এক বালতি গরুর গোবর ঢেলে দেওয়া হল। প্লুটার্ক জানান, এই অপমানের পর তিনি নিজেকে গৃহবন্দি করে রাখেন এবং মেয়াদের বাকি সময়টা সেখানেই থাকেন।

কনসাল হিসেবে মেয়াদ শেষে পম্পেইর সহায়তায় গভর্নরের চাকরি পেলেন সিজার। আল্পস পর্বতের পূর্বের প্রদেশটির নাম ছিল ‘সিসালপিন গল’ ও পশ্চিমের অংশের নাম ছিল ‘ট্রানসালপিন গল’। পশ্চিম অংশের গভর্নর হলেন সিজার। এখানে তিনি দখলদার হিসেবে বিশেষ সুনাম অর্জন করেন। একপর্যায়ে তার ‘বীরত্ব’ পম্পেইকেও ছাড়িয়ে যায়। তিনি হেলভেতি ও তিগুরিনি নামে দুই কেল্টিক গোত্রকে পরাভূত করেন। এই গোত্রগুলো ট্রানসালপিন গল দখলের চেষ্টা চালাচ্ছিল। তারপর তিনি রাইন নদীরে তীরে ‘জার্মান’ নামে কয়েকটি গোত্রের জোটকে পরাজিত করেন। পম্পেইর কাছ থেকে শিক্ষা কাজে লাগিয়ে তার প্রতিটি বীরত্বগাথা ঢাকঢোল পিটিয়ে রোমে প্রচার করতেন সিজার।

এর মাঝে রোমের বিভিন্ন বিষয়ে নাক গলাচ্ছিলেন সিজার। তিনি ইতালির রুবিকন নদের কাছে একটি শিবির নির্মাণ করেন। লুকা শহরের এই শিবিরে বসে তিনি রাজনীতির খেলায় মেতে উঠলেন। অসংখ্য মানুষকে নানাবিধ কারণে ঘুস দিতে লাগলেন তিনি।

খ্রিস্টপূর্ব ৫৬ সালে ক্রাসাস আর পম্পেই এলেন সিজারের কাছে। তাদের ত্রিমুখী জোটের পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক হল। ৫৫ সালে আবারো ক্রাসাস ও পম্পেই কনসাল হওয়ার জন্য লড়বেন। তারা ক্ষমতায় গেলে সিজারকে আরও পাঁচ বছর গলে থাকার অনুমতি দেবেন, যাতে তিনি সেখানে তার ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে নিতে পারেন। কনসাল হিসেবে মেয়াদ শেষে ক্রাসাস নিজেকে পূর্বাঞ্চলে পার্থিয়ানদের বিরুদ্ধে অভিযানে সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দেবেন।

ততদিনে পার্থিয়ানরা সে-অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সামরিক ঝুঁকি। এতে ক্রাসাস কিছুটা বীরত্ব দেখানোর সুযোগ পাবেন। অপরদিকে পম্পেই আর যুদ্ধ করতে চাইলেন না। তিনি নিজেকে হিসপানিয়ার গভর্নর বানাবেন এবং সিজারের মতো অর্থ উপার্জন করবেন।

এই চুক্তির পর রোমে ফিরলেন ক্রাসাস ও পম্পেই। আবারও ঘুসের বিনিময়ে ভোট কিনে কনসাল হলেন এই দুই রোমান নেতা। প্রথম মেয়াদের ১৫ বছর পর দ্বিতীয়বারের মতো এই পদে বসলেন এই দুইজন। সিনেটে সিজারের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পাস হল।

সিজার তখন তুমুল জনপ্রিয় এবং এই জনপ্রিয়তা দিনে দিনে বাড়ছিল।

দুই কনসাল তাদের কাজ শুরু করার পর সিজার সম্পূর্ণ নতুন এক শত্রুর বিরুদ্ধে হামলা চালালেন। ৫৫ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের (ব্রিটেন) দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে এসে নামলেন।

ব্রিটেনের এই অংশের বাসিন্দারা ছিলেন খুব সম্ভবত এই দ্বীপের প্রাচীনতম মানবগোষ্ঠী। ইউরোপের মূল ভূখণ্ড থেকে আসা কেল্টরা এখানে বসতি গড়েছিলেন। ব্রিটেনে এসে তাদের যাযাবর জীবন যাপনের উপায় ছিল না। তারা ছোট ছোট গোত্রভিত্তিক রাজত্বে বিভক্ত হয়ে সেখানে বসবাস করছিলেন। তাদের বিষয়ে আমরা যা যা জানতে পারি, তার সবই সিজারের বর্ণনা থেকে। এ ছাড়া খানিকটা বিকৃত আকারে এই ইতিহাস জানা যায় মনমাউথের জেফরির ‘হিস্টোরিয়া রেগাম ব্রিটানিয়া’ থেকে।

এই ইতিহাসের শুরুতে প্রায় অসম্ভব এক গল্প শোনানো হয়। এইনাসের এক বংশধর অভিযানে বের হয়ে হঠাৎ করেই এই দ্বীপের খোঁজ পান। ব্রুটাস নামের এই বংশধর নিজের নামে এই দ্বীপের নাম রাখেন ব্রিটেন। এরপর প্রাচীন কিছু ব্রিটিশ রাজার কথা বলা হয়, যাদের মধ্যে কাসিভেলাউনাসের নাম উল্লেখযোগ্য। সিজারের বর্ণনায় তাকে একজন দুর্বত্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যিনি জোর করে ত্রিনোভান্তেস গোত্রের ক্ষমতা দখল করেছিলেন।

ত্রিনোভান্তেস গোত্রের রাজা লুড এই গোত্রকে দক্ষিণের অন্যতম শক্তিশালী রাজত্ব হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। তিনি মূলত টেমস নদীর তীরে প্রাচীর নির্মাণ ও এখানে বসতি স্থাপনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার প্রতি সম্মান জানিয়ে এই জায়গার নাম রাখা হয় লানড্রেস। লুডের মৃত্যুর পর তার ছেলের বদলে তারই ভাই সেই কাসিভেলাউনাস ক্ষমতা দখল করেন।

সিংহাসন না পেয়ে রাজপুত্র মানডুব্রাসিয়াস নদী পেরিয়ে গলে সিজারের সদর দপ্তরে এসে তার রাজত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য রোমের সাহায্য চান। যুগে যুগে রোমের সাহায্য চেয়ে পরবর্তী এই ভুলের মাশুল দেননি, এমন মানুষ কমই আছেন। তিনিও পরে তার এই উদ্যোগ নিয়ে অনুশোচনায় পড়েন।

প্রথম সফরে এসে সিজার তার শত্রুপক্ষকে যাচাই-বাছাই করেন। তিনি বলেন, ‘সকল ব্রিটন তাদের দেহ নীল রঙে রাঙিয়ে রাখে।’ খ্রিস্টপূর্ব ৫৪ সালে এ অঞ্চলের দখল নিতে সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরে আসেন জুলিয়াস সিজার।

সিজারের মোকাবিলা করতে কাসিভেলাউনাস তার রথবাহিনী নিয়ে এগিয়ে এলেন। প্রথমবারের মতো সিজার যুদ্ধে এ-ধরনের বাহন দেখল। রথের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রণকৌশল বদলাতে বাধ্য হল রোম। সিজার বলেন, ‘এ-ধরনের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমাদের যোদ্ধাদের আরও হালকা বর্ম পরতে হবে’। তিনি লক্ষ করলেন ব্রিটিশ রথযোদ্ধারা খুব দ্রুত রথ থেকে নেমে এসে যুদ্ধ করে আবারও দ্রুত রথে ফিরে যেতে পারে। সিজার সেনার বদলে ঘোড়সওয়ার বাহিনীকে সামনে পাঠাতে লাগলেন। শিগগির কাসিভেলাউনাস টেমসের তীরে ফিরে যেতে বাধ্য হল। এ অঞ্চলটি নদীর নিচে লম্বা লম্বা লুকানো বর্শা দিয়ে সুরক্ষিত রাখা হয়েছিল।

এই ফাঁদে পা দিলেন না সিজার; থামালেন নিজের বাহিনীকে। কিন্তু ততক্ষণে কাছাকাছি গোত্রগুলো একে একে রোমের কাছে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে দিয়েছে। একপর্যায়ে রোমান সেনারা কাসিভেলাউনাসের সদরদপ্তরও খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়। তারা তার সব গরু হত্যা করে, যার ফলে খাদ্যসংকটে পড়ে যান তিনি।

অবশেষে কাসিভেলাউনাসও দূত পাঠিয়ে সন্ধিপ্রস্তাব দেন সিজারকে। আসন্ন শীতের কথা ভেবে সন্ধিপ্রস্তাবে রাজি হয়ে যান সিজার। তবে তিনি শর্ত দেন, মানডুব্রাসিয়াসকে ত্রিনোভান্তেস গোত্রের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে হবে। তিনি রোমের প্রতিনিধি রাজা হিসেবে শাসনভার নেবেন। তিনি কাসিভেলাউনাসের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করলেন, তিনি মানডুব্রাসিয়াসকে কোনো ধরনের যন্ত্রণা দেবেন না। এরপর সিজার গলে ফিরে গেলেন।

সিজারের সুনাম তখন ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু তিনি এক নিদারুণ শোক সংবাদ পেলেন। পম্পেইর স্ত্রী, তার মেয়ে জুলিয়া সন্তানের জন্ম দিতে যেয়ে মারা গেছে।

অল্পদিনের মাঝে বিপর্যয়ের মুখে পড়লেন ক্রাসাস। গলে সিজারের বিজয়ের এক বছর পর, খ্রিস্টপূর্ব ৫৩ সালে পার্থিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউফ্রেতিস নদীর দিকে ক্রাসাস সেনাবাহিনী নিয়ে যাত্রা করলেন। এ অঞ্চল তখন ছিল পার্থিয়ানদের সীমান্ত। প্রায় ৭০ হাজার পদাতিক সেনা ও চার হাজার ঘোড়সওয়ার নিয়ে রোমান বাহিনী এগিয়ে গেল। কারহাই শহরে (প্রাচীন আমলের হারান) এই যুদ্ধ সংঘটিত হল। এই শহরেই জন্মেছিলেন নাবোনিদাস এবং এখানেই আব্রাহামের পিতা তেরাহ মারা যান।

কিন্তু রোমান বাহিনীকে খুব সহজেই কাবু করল পার্থিয়ানরা। দূর থেকে রোমানদের উদ্দেশে তির মারতে শুরু করল পার্থিয়ান যোদ্ধারা। সেসব তির খুব সহজেই রোমানদের বর্ম ভেদ করে তাদের মৃত্যুর কারণ হতে লাগল।

এই মর্মান্তিক যুদ্ধ ২-৩ দিনের বেশি স্থায়ী হয়নি। ক্রাসাস ও তার সন্তান পাবলিয়াস, উভয়ই মারা পড়লেন।

ক্রাসাসের মাথা কেটে পার্থিয়ার রাজা ওরোদেসের কাছে নিয়ে গেলেন পার্থিয়ান সেনাপতি সুরেনা। রোমান ইতিহাসবিদ ডিও ক্যাসিয়াসের মতে, এই ছিন্ন মস্তককে শিরোপা হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছিল।

রোম সাম্রাজ্যের পূর্ব ফ্রন্টিয়ার তাদের মানচিত্র থেকে মুছে গেল। সিরিয়ার রোমান গ্যারিসনগুলো কোনোমতে পার্থিয়ানদের হামলা থেকে বাঁচতে পারল, কারণ পার্থিয়ানরা তখনো এ-ধরনের হামলায় অভিজ্ঞ ছিল না।

এভাবেই ত্রিমুখী জোট বা ট্রায়ামভাইরেট খর্ব হয়ে দ্বিমুখী জোটে রূপান্তরিত হল।

পার্থিয়ানদের বিজয়ের পরের বছর সিজার রোমে ফেরার প্রস্তুতি নিলেন। মাত্রই গলদের এক গুরুতর বিদ্রোহ দমন করেছেন তিনি। তিনি তখন পম্পেইর চেয়েও বেশি সম্পদ ও সম্মানের মালিক।

তবে সিজারের ফিরে আসার খবরে সিনেট আশ্বস্ত হতে পারেনি। তার গৌরবগাথা, ধনসম্পদ ও সেনাবাহিনী সিনেট সদস্যদের শঙ্কিত করে তুলছিল। জুলিয়া ও ক্রাসাসের মৃত্যুর পর পম্পেইর সঙ্গে সিজারের সম্পর্কেও অবনতি আসে।

প্লুটার্ক জানান, সিজারকে ঈর্ষা ও ঘৃণা করতেন পম্পেই। এই অনুভূতিগুলো এ পর্যায়ে ভীতিতে রূপ নিল।

পম্পেই ও সিনেট সম্মিলিতভাবে উত্তরাঞ্চলে বার্তা পাঠালেন : পুরো সেনাবাহিনীসহ আত্মসমর্পণ না করলে সিজারকে রোমে ঢুকতে দেওয়া হবে না।

সিজার বেশকিছু বিকল্প প্রস্তাব রাখলেন, কিন্তু পম্পেই সিনেটকে প্রভাবিত করে সেগুলো একে একে নাকচ করালেন।

সিজার বুঝতে পারলেন, নিরস্ত্র অবস্থায় বা সুরক্ষিত না হয়ে রোমে গেলে আততায়ীর হাতে তার প্রাণ যাবে। পূর্বসূরি সুল্লার মতো, তিনিও গল থেকে তার সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ শক্তিমত্তাসহ ইতালির উত্তরাঞ্চলের দিকে রওনা হলেন।

প্লুটার্ক জানান, সিজার জানতেন যে তার এই পদক্ষেপে একটি রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ শুরু হবে। রবিকন নদীর তীরে এসে তিনি কিছুদিন অপেক্ষা করলেন, পুরো বিষয়টি নিয়ে ভাবলেন। কিন্তু শিগগির তিনি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, ‘আলেয়া ইয়াকতা এস্ত!’, এর অর্থ, ‘ছক্কা মারা হোক’। এটা ছিল জুয়াড়িদের স্লোগান। পাশা খেলায় ছক্কা চালার আগে তারা এই হুংকার দিতেন। তিনি নদী পার হলেন এবং ‘যুদ্ধের দ্বার উন্মুক্ত হল’।

পুরো ইতালিজুড়ে আতঙ্ক দেখা দিল। নারী-পুরুষ দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পালাতে লাগল। অবধারিত সংঘাত থেকে সবাই সরে যাওয়ার চেষ্টা চালাল।

শহরে উড়ো খবর আসতে লাগল, রোমের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছেন সিজার। ভয় পেয়ে পম্পেই রোম ছেড়ে চলে গেলেন এবং তিনি সিনেটের সদস্যদেরও সঙ্গে নিতে চাইলেন। তিনি ভেবেছিলেন রোমের জনগণ সিজারের জন্য তোরণ খুলে দিতে পারে। দক্ষিণে ব্রুনডিসিয়ামে চলে গেলেন তিনি। পূর্ব উপকূলের এই অঞ্চলে তিনি একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করলেন। তারপর তার নিজের সেনাবাহিনীকে সমুদ্র পেরিয়ে গ্রিক শহর ডায়ারাচিয়ামে সংগঠিত করার নির্দেশ দিলেন।

সিজার এই পদক্ষেপকে দুর্বলতার চিহ্ন হিসেবে নিলেন। সিসেরোও ভেবেছিলেন এটা ভুল সিদ্ধান্ত। তবে এ সময়ের মাঝে পম্পেই বিশাল জাহাজের বহর ও সেনাবাহিনী প্রস্তুত করলেন। সিজার তাকে ধাওয়া না করে রোমের দিকে আগাতে লাগলেন। পম্পেইর সঙ্গে সিসেরোসহ আরও অসংখ্য রোমান যোগ দিল।

ইতালিতে সিজার নির্বিঘ্নে রোমে প্রবেশ করলেন। সিনেটের বড় একটি অংশ সেখানে ছিল এবং তারা সিজারের সঙ্গে শান্তিরক্ষায় আগ্রহী ছিল। মারিয়াস বা সুল্লার মতো রোমে রক্তের বন্যা বইয়ে দেননি সিজার। তিনি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিলেন এবং নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে বিরোধীদের বশ্যতা আদায় করলেন। রাজকোষ থেকে অর্থ নিয়ে পম্পেইর মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি নিতে গেলে একজন ট্রিবিউন সিজারকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তখন সিজার মন্তব্য করেন, ‘ওহে তরুণ! তুমি যদি আমাকে বাধা দিতে থাকো, তাহলে আমি তোমাকে হত্যা করব। এ কথা বলতে আমার খারাপ লাগছে, তা বাস্তবায়ন করতে আরও খারাপ লাগবে।’ প্লুটার্ক জানান, এই কথা শুনে ভয়ে সেই ট্রিবিউন ছুটে পালিয়ে যান। এরপর এই যুদ্ধের বাকি সময়টা আর তহবিল নিয়ে ভাবতে হয়নি সিজারকে।

খ্রিস্টপূর্ব ৪৮ সালে, প্রায় দুই বছরের নিরলস যুদ্ধের পর ফারসালাসের যুদ্ধক্ষেত্রে সিজার পম্পেইকে পরাজিত করতে সমর্থ হন। ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়তে যেয়ে সিজারের বাহিনী যে কৌশল শিখেছিল, সেটা এই যুদ্ধে তারা প্রয়োগ করেন। এই অভিনব কৌশলের কোনো জবাব ছিল না পম্পেইর কাছে। সিজারের জয় অবধারিত, বুঝতে পেরে পুরনো পোশাক পরে পালিয়ে যান পম্পেই।

বিজয়ের সংবাদে সিনেট সিজারকে ‘প্রথম ডিক্টেটর’-এর খেতাব দেয়। এরপর ১১ দিন পর তাকে কনসাল বানায়। সিজারের সহযোগী মার্ক অ্যান্টনি ফারসালাসের যুদ্ধে তার বাহিনীর এক অংশের নেতৃত্ব দেন। তিনি সিজারের ডেপুটি হিসেবে নগর প্রশাসনে যুক্ত হন। সিজার শুনতে পেলেন পম্পেই মিশরের দিকে রওনা হয়েছে। তিনি তাকে ধাওয়া করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

সিজারের এই সিদ্ধান্তের পেছনে ব্যক্তিগত আক্রোশ থাকলেও রাজনৈতিক দিক দিয়েও এটি যৌক্তিক পদক্ষেপ ছিল। মিশর ততদিন ক্ষয়িষ্ণু এক রাজত্ব হলেও ঐশ্বর্যবান ছিল এবং ভবিষ্যতে সিজারের জন্য বিপদের কারণ হতে পারত। মিশরের রাজা ছিলেন তরুণ ও দুর্বল ত্রয়োদশ টলেমি—মহান টলেমির বংশধর।

সেসময় ১৩ নং টলেমি তার বোন সপ্তম ক্লিওপেট্রার সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়লেন। যখন পম্পেইকে মিশরের তীরে দেখা গেল, তখন ক্লিওপেট্রা আলেকজান্দ্রিয়ায় ছিলেন আর তরুণ টলেমি তার সেনাবাহিনী নিয়ে পেলিসিয়ামে ছিলেন। বোনকে আক্রমণ করতে উদ্যত হচ্ছিলেন টলেমি।

তরুণ টলেমি তার বেশিরভাগ কাজের জন্য উপদেষ্টাদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এই উপদেষ্টাদের কথা শুনে তিনি পম্পেইকে হত্যা করলেন। জাহাজ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই ৬০ বছর বয়সি পম্পেই মারা পড়লেন। দিনটি ছিল ২৯ সেপ্টেম্বর। একদিন আগেই তিনি তার জন্মদিন পালন করেছিলেন।

সিজার মিশরে এসে পৌঁছানোর পর মিশরের কর্মকর্তারা একটি ঝুড়িতে ভরে পম্পেইর মাথা তার সামনে হাজির করল। এতে প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়লেন সিজার। তিনি তার সাবেক মিত্রকে অপমান করতে চেয়েছিলেন, হত্যা নয়। তবে এই ঘটনায় তিনি মিশরের দখল ছিনিয়ে নেওয়ার একটি চমৎকার অজুহাত পেলেন।

তিনি ক্লিওপেট্রা ও টলেমিকে বললেন আলেকজান্দ্রিয়ায় আসতে। তাদের দুইজন থেকে একজনকে তিনি মিশরের শাসক হিসেবে (তার তত্ত্বাবধানে) নিয়োগ দেবেন।

কিন্তু যৌক্তিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে লোভ-লালসার বশবর্তী হলেন। ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার ভাইকে বিদায় করার আদেশ দিলেন। ত্রয়োদশ টলেমি রোমান সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিহত হলেন। ক্লিওপেট্রার অভিষেক হল এবং তিনি তার ছোটভাইকে বিয়ে করলেন। টলেমিরা যুগ যুগ ধরে এই মিশরীয় ঐতিহ্য বজায় রেখেছে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও, সিজার ও ক্লিওপেট্রার মধ্যে চলতে লাগল এক বিবাহ- বহির্ভূত সম্পর্ক, যা তাকে অলস করে দিয়েছিল—অন্তত, রাজনীতির দিক দিয়ে। বেশ কয়েক মাস তিনি আলেকজান্দ্রিয়ায় পড়ে রইলেন। অবশেষে সন্তানসম্ভবা ক্লিওপেট্রাকে ছেড়ে তিনি রোমান সাম্রাজ্যে সামরিক সফরে বের হলেন। পূর্ব সীমান্ত থেকে শুরু করে একেবারে আফ্রিকার সীমান্ত পর্যন্ত গেলেন তিনি। মাঝে আইবেরীয় উপদ্বীপও দেখে গেলেন। পরিশেষে রোমে ফিরে এলেন।

এর মাঝে চারবার কনসাল পদে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন সিজার। ৪৬ সালে রোমে তাকে বড় আকারে সংবর্ধনা দেওয়া হল। পুরো শহরে তার মূর্তি বসানো হল প্রাচীন রাজাদের পাশে। তিনি একটি পিঙ্গল বর্ণের পোশাক পরলেন এবং তাকে ‘ইমপেরাটর’ খেতাব দেওয়া হল। বিজয় মিছিলের সামনে একটি স্লোগান যোগ করা হল, যাতে বলা হল, ‘ভিনি, ভিদি, ভিচি! (আমি এলাম, দেখলাম, জয়’ করলাম)। সব মিলিয়ে, প্রাচীন এতরুসকান রাজাদের মতো জুলিয়াস সিজারের ‘উপাসনাত করতে বাধ্য হল রোমানরা।

এই বিজয়মিছিলের পর সিজার ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, আইন পাস করা ও সিনেট, ট্রিবিউন, অ্যাসেম্বলি ও কাউন্সিলের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন। সেনাবাহিনী তার প্রতি অনুগত ছিল। তিনি সেনাবাহিনীর সমর্থনে রোমে একনায়ক-ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা চালু করলেন। দেশের জনগণ তাকে তখনও রক্ষাকর্তা হিসেবেই দেখত। তিনি এমনকি, ক্যালেন্ডারও বদলে দিলেন। এখন আমরা লিপইয়ারের যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করি, সেটাও তিনিই চালু করলেন।

সিজারের আজ্ঞাবহ সিনেটের সদস্যরা সেনাবাহিনীর ভয়ে সিজারকে তুষ্ট করতে তার সব দাবি মেনে নিলেন। ৪৪ সালে সিনেট তাকে আজীবনের জন্য ‘ডিক্টেটর’ খেতাব দিল। তবে ডিক্টেটর আর রাজা এক নয়। তার শৈশবের কোনো একপর্যায়ে সিজার নিজেকে রাজা হিসেবে দেখার স্বপ্ন লালন করেছিলেন—এটুকু পরিষ্কার ছিল।

তবে তখনো তিনি রাজা হয়ে উঠতে পারেননি।

৪৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, মার্ক অ্যান্টনি সিজারের মাথায় মুকুট পরানোর পায়তারা করলেন। এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে তার মাথায় সেই চিরপরিচিত ফুল/লতা দিয়ে তৈরি মালা আকারের ডায়াডেম পরাতে গেলেন তিনি। তিনি সিজারকে সেটা দেওয়ার পর উপস্থিত জনতার মধ্যে খুব একটা উৎসাহ দেখা গেল না। মৃদু করতালি পড়ল। পরিস্থিতি বুঝে সিজার তা প্রত্যাখ্যান করলেন বেশ কয়েকবার। এবার আরও জোরে হাততালি পড়ল। স্পষ্টতই, রোমবাসীরা জানান দিলেন যে তারা চান না সিজার রাজা হয়ে উঠুক। রাজা শব্দটির সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের পার্থিয়ানদের যোগসূত্র অনেক বেশি বলিষ্ঠ ছিল। সিজারের কোনো বৈধ সন্তান ছিলেন না। ক্লিওপেট্রার গর্ভে জন্ম নিয়েছিল টলেমি ১৫ সিজারিয়ন, কিন্তু তিনি তার বোনের মেয়ের ছেলে অক্টাভিয়ানকে (১৮) তার উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচন করেন।

তবে কিছুদিনের মধ্যে সিনেট একমত হল, সিজার চাইলে মুকুট পরতে পারবেন। তবে শুধু যখন তিনি পার্থিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ লড়বেন, তখন। পুরাণের কাহিনি অনুযায়ী, শুধু একজন ‘রাজার’ পক্ষেই সম্ভব পার্থিয়াকে পরাজিত করা।

তবে সিজারের এসব উদ্যোগ নিয়ে ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিলেন সিনেটররা। তাদের মধ্যে অন্যতম সিজারের নিজের চাচাতো ভাই মার্কাস ব্রুটাস (সিজার তার উইলে ব্রুটাসকেও কিছু সম্পদ দিয়েছিলেন)। ব্রুটাস অন্যদের সঙ্গে নিয়ে সিজারকে হত্যার ষড়যন্ত্র করলেন। ঠিক হল, খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৫ মার্চ এই ঘটনা ঘটবে। সিজারের ডান হাত মার্ক অ্যান্টনি এই ষড়যন্ত্রে অংশ নেবে না, সেটা বুঝেই তাকে তার ঘরে আটকে রাখার পরিকল্পনা করা হল।

সিজারের উত্তরাধিকারী অক্টাস্টিয়ানের জীবনী লিখেছেন গ্রিক-লেখক নিকোলাউস অব দামাসকাস। তিনি তার লেখায় সিজারের হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বর্ণনা দেন।

সেই ঘটনাবহুল দিনে সিজার যখন সিনেটে প্রবেশ করলেন, তখন সদস্যরা দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানালেন। যারা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, তারা সবাই তার কাছেই ছিলেন। সবার আগে তার ওপর আঘাত হানলেন তুলিয়াস সিমবার। তুলিয়াসের ভাইকে নির্বাসনে পাঠান সিজার। তিনি হঠাৎ সিজারের সামনে এসে এমন একটা ভাব করলেন যেন তিনি তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে কিছু বলতে চান। কিন্তু তা না করে তিনি সিজারের টোগা (ঢিলেঢালা রোমান পোশাক) ধরে টান দিলেন। যার ফলে সিজার চাইলেও উঠে দাঁড়িয়ে তার হাতগুলো ব্যবহার করতে পারছিলেন না।

সিজার খুবই রেগে গেলেন, কিন্তু এবার বাকিরা তাদের ছোরা নিয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সারভিলিয়াস কাসকা তার বাম কাঁধে, কলারবোনের একটু উপরে আঘাত হানার চেষ্টা করলেও লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেন। সিজার নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন। কাসকা অতি উৎসাহে গ্রিক ভাষায় তার ভাইকে ডাকলেন। তার ভাই তরবারি দিয়ে সিজারের দেহের একপাশে আঘাত করলেন। এক মুহূর্ত পর ক্যাসিয়াস (লনজিনাস) তার মুখে আঘাত করলেন। ডেসিমাস ব্রুটাস তার উরুতে আঘাত করলেন।

ক্যাসিয়াস লনজিনাস আবারও তাকে মারতে যেয়ে বরং মার্কাস ব্রুটাসের হাতে মেরে বসলেন। মিনুসিউয়াস সিজারকে মারতে যেয়ে রুবরিয়াসের ঊরুতে আঘাত করলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, কে আগে সিজারকে মারবে, সেটা নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করেছে।

পম্পেইর মূর্তির সামনে সিজার পড়ে গেলেন। শরীরের বিভিন্ন অংশে ৩৫টি আঘাত পেয়ে অবশেষে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন জুলিয়াস সিজার।

প্লুটার্ক জানান, তিনি সাহায্য চেয়ে চিৎকার করতে করতে মারা যান। গ্রিকরা বলেন, তিনি গ্রিক ভাষায় ব্রুটাসের প্রতি আকুতি করে বলেন, ‘ব্রুটাস, তুমিও? (এত তু, ব্রুটাস?)’। সুটোনিয়াস বলেন, প্রথম আঘাত পেয়ে সিজার বিস্ময়ে বলে ওঠেন, “কিন্তু এখানে বলপ্রয়োগ করা হচ্ছে!”

১০০ বছর আগে গ্রাচ্চি ভাইদের হত্যার মাধ্যমে যে যুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তারই ধারায় সিজারকে হত্যা করা হয়। শক্তিশালী মানুষকে কোনো সংবিধান ধরে রাখতে পারেনি। এটা সিজারও প্রমাণ করে দেখান। এবং এবার তার নিজের অবলম্বন করা প্রক্রিয়ার শিকার হয়েই তাকে ইহধাম ত্যাগ করতে হল।

এই ঘটনায় এটাই প্রমাণ হল, রোম হচ্ছে এমন এক জায়গা যেখানে জনগণের হাতে ক্ষমতা রয়েছে। বেশ কয়েক দশক ধরে বিষয়টা এমন ছিল না, কিন্তু রোমানরা অন্য কোনোভাবে ভাবতে পারত না এবং এটাই তাদের আত্মপরিচয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *