1 of 2

৭৭. উন্নয়নের সমস্যাগুলো

অধ্যায় ৭৭ – উন্নয়নের সমস্যাগুলো

১১৮ থেকে ৭৩ সালের মাঝে রোমের সব মিত্ররা নাগরিকত্বের দাবি জানান। হান রাজবংশ সাম্রাজ্যবিস্তারে অনেক অর্থ খরচ করে। সুল্লা ও মারিয়াস রোমের অভ্যন্তরে ক্ষমতার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়।

গ্রাচ্চি ভাইদের বিপর্যয়ের পর এটুকু পরিষ্কার হল যে, আইন করে দারিদ্র্য ও ভূমিহীনতার মতো সমস্যাগুলোর সমাধান করা যাবে না। ট্রিবিউন, কনসাল ও বিচারক, বিভিন্ন যাচাই-বাছাই ও অন্যান্য নীতিমালাসমৃদ্ধ হয়েও রোমান সংবিধান দেশটিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট ছিল না। ধনীদের ইচ্ছাশক্তি ও জনপ্রিয়দের কারিশমায় পাল্লা যেকোনো সময় বিপরীতদিকে হেলে পড়তে পারে। প্রায় প্রত্যেক রোমান বক্তা “কার্থেজ ধ্বংসের আগের” স্বর্ণযুগের স্মৃতিচারণা করতে লাগলেন। সেসময় পরিস্থিতি আরও ভালো ছিল। রোমান ইতিহাসবিদ সালুস্ট বছরকয়েক পরে লেখেন, ‘কার্থেজ ধ্বংসের আগে পর্যন্ত জনগণ ও সিনেট সরকারি দায়িত্বগুলো শান্তিপূর্ণভাবে ভাগ করে নিত এবং যে যার মতো ধৈর্যধারণ করত। শত্রুরা ক্ষমতা বা গৌরবের জন্য প্রতিযোগিতা করত এবং শত্রুরা রোমকে সমীহ করে চলত। যার মাধ্যমে পুরো রাজ্যের মনোবল চাঙা থাকত।’

তবে অনেকের মতেই, এই তথাকথিত ‘স্বর্ণযুগ’ শুধু রোমানদের কল্পনায় ছিল। তা সত্ত্বেও, সেসময় রোম সমাজকে লোভ, দুর্নীতি, গর্ব, অশ্লীল আচরণ ও উন্নয়ন থেকে আসা অন্যান্য অশুভ বিষয়গুলো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিল। এসবের ফলে আসে নতুন এক যুদ্ধ, যার নাম জাগারথাইন যুদ্ধ।

উত্তর-আফ্রিকায় নুমিদিয়ার রাজা মাসিনিসা তার সন্তান মিকিসপার কাছে মসনদ ছেড়ে দিলেন। মিকিসপার ছিল দুই পুত্রসন্তান ও এক ভাইপো, যার নাম জুগুরথা। এই জুগুরথা সিংহাসনের উত্তরাধিকারীদের তালিকায় ছিলেন না। তাই মিকিসপা তার জন্য সামরিক কেরিয়ার নির্ধারণ করে তাকে নুমিদিয়ার সেনাবাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে স্কিপিও এমেলিয়াসের সঙ্গে লড়তে পাঠালেন। সেখানে যেয়ে যুদ্ধ না করে জুগুরথা রোমান কর্মকর্তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলেন। তারা তাকে আশ্বাস দিল, রোম সরকারকে ঘুস দিলে তারা তাকে তার চাচার সিংহাসনে বসাবে। সালুস্ট বলেন, ‘রোমে অর্থ খরচ করলে যেকোনো কিছুই কেনা যায়।’

১১৮ সালে মিকিসপার মৃত্যুর পর জুগুরথা জোর করে সিংহাসন দখল করলেন। তার আততায়ীরা এক চাচাতো ভাইকে হত্যা করল আর আধেরবাল নামে অপর ভাই দেশ ছেড়ে পালাল। যথারীতি ক্ষমতায় বসে তিনি রোমের দূতদের মাধ্যমে ঘুস হিসেবে সিনেটরদের কাছে স্বর্ণ ও রুপা পাঠালেন। এতে বেশ ভালো কাজ হল।

আধেরবাল রোমে উপস্থিত হয়ে সাহায্য চাইলেন। কিন্তু দেখলেন ইতোমধ্যে রোম জুগুরথার অর্থে ‘কেনা হয়ে গেছে’। তা সত্ত্বেও, সিনেট রায় দিল, দুই চাচাতো ভাই মিলেমিশে রাজ্য শাসন করবে।

আধেরবাল নুমিদিয়ায় ফেরার পর জুগুরথা তার বিরুদ্ধে লড়াই করলেন। তাকে তার নিজের রাজধানীতে আটক করলেন। এরপর নির্যাতন করে তাকে হত্যা করলেন।

সিনেটের পক্ষে এই অবিচার সহ্য করা সম্ভব ছিল না। ১১১ সালে জুগুরথাকে শায়েস্তা করার জন্য একজন কনসাল পাঠানো হল নুমিদিয়ায়।

তবে এই কনসালও অন্যান্য রোমান কর্মকর্তাদের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন—খুব সহজেই তাকে ঘুস খাইয়ে ফেরত পাঠালেন জুগুরথা।

একের পর এক ঘুসের অভিযোগে রোমের সাধারণ জনগণ ফুঁসে উঠতে লাগল। অবশেষে ১০৯ সালে এক রোমান কর্মকর্তা সৎভাবে জুগুরথার বিষয়টি দেখভাল করতে গেলেন।

তার নাম ছিল গাইয়াস মারিয়াস। তিনি ছিলেন একজন ‘নতুন মানুষ’। তিনি এমন এক পরিবার থেকে এসেছিলেন, যাদের আগের কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা বা অর্থসম্পদের ইতিহাস নেই। রোমানরা তাকে বিপুল পরিমাণ সমর্থন দিল। দুই বছর তিনি উত্তর-আফ্রিকায় যুদ্ধ করলেন। ১০৭ সালে তিনি কনসাল নির্বাচিত হলেন।

নির্বাচনের পর আরও ৩ বছর এই যুদ্ধ চলল। তিনি তার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা লুসিয়াস কর্নেলিয়াস সুল্লার সহায়তায় জুগুরথাকে ফাঁদে ফেলে আটক করতে সমর্থ হলেন।

জুগুরথাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে রোমে নিয়ে আসা হল। এটা শুধু রোমের জয়ের প্রতীক ছিল না, বরং ছিল অভিজাতদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রোমের সাধারণ মানুষের সততার জয়। মারিয়াসকে রোমের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আখ্যায়িত করা হল। তারপর তিনি পরপর পাঁচ দফায় কনসাল নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তবে এটা ছিল রোমের সংবিধানের লঙ্ঘন। সংবিধান মতে, একই ব্যক্তির বারবার কনসাল হওয়ার বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু মারিয়াস জনগণের চোখের মণিতে পরিণত হন। এর আগেও সংবিধানকে পাত্তা না দিয়ে ধনীরা অনেক কিছু করেছে (গ্রাচ্চি ভাইদের কথা মনে করুন)। তাহলে মারিয়াস কেন এই সুবিধা পাবেন না।

মারিয়াস স্বয়ং হাজারো ইতালীয় মিত্রদের রোমের নাগরিকত্ব দেন। যুদ্ধে তার প্রতি সমর্থন জানানোর পুরস্কার হিসেবে তিনি এই উপহার দেন তাদেরকে। তিনি ব্যাখা দেন, ‘আমি দুঃখিত। কিন্তু যুদ্ধের শব্দ আমাকে আইনের শব্দ শুনতে বাধা দিয়েছে।’

কনসাল হিসেবে ষষ্ঠ মেয়াদ শেষে মারিয়াস বুঝতে পারলেন, সপ্তমবারের মতো জয়লাভ করা সম্ভব হবে না। তাই তিনি নিজেই অবসরে চলে গেলেন। জুগুরথাকে পরাজিত করার পর রোম আর কোনো যুদ্ধে অংশ নেয়নি। তবে যুদ্ধ খুব বেশিদূরে ছিল না।

উপদ্বীপে অবস্থিত ইতালীয় শহরগুলোতে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে লাগল। দীর্ঘদিন ধরে তারা রোমের নাগরিকদের মতো ভোটাধিকারসহ পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হতে চাচ্ছিল। কিন্তু সিনেট এ-বিষয়টি নিয়ে গড়িমসি করছিল। রোমে সাধারণ মানুষের মাঝে শোষিত হওয়ার যে অনুভূতি ছিল, তা ইতালির সাধারণ মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে। লাতিনরা এবং অন্যান্য মিত্ররা রোমের কার্যক্রমে অংশ নিতে চাচ্ছিল। তারা শুধু রোমের নাগরিক নয়, বরং রোলের ক্ষমতায় অংশীদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাইছিল। এই তথ্য জানিয়েছেন ইতিহাসবিদ জাস্টিন।

কিন্তু সিনেট এতে রাজি হল না। ফলে রোম-বিরোধী অনুভূতি আরও চাঙ্গা হল। শুরুতে রোমান আচার ও লাতিন ভাষাকে পরিত্যাগ করতে শুরু করল মানুষ। তারা ইতালির প্রাচীন ভাষায় কথা বলা শুরু করল। ইতিহাসিবিদ ই.টি. স্যালমন জানান, এই আমলের ইতালীয় শিলালিপিতে অসংখ্য প্রাচীন শব্দের ছড়াছড়ি দেখা যায়। এরপর ইতালির বেশ কয়েকটি শহর ‘ইটালিয়া’ নামে একটি জোটের অন্তর্ভুক্ত হল। খ্রিস্টপূর্ব ৯১ সালে ইতালীয়রা আসকুলাম শহরে এক রোমান কর্মকর্তাকে হত্যার পর যুদ্ধ শুরু হল।

এই অদ্ভুত যুদ্ধের নাম দেওয়া হল ‘সোশ্যাল ওয়ার’। এটা গৃহযুদ্ধ হলেও কিছু ভিন্নধর্মী ছিল। এতে রোমের মূল বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে লড়লেন পরবর্তীতে রোমের বাসিন্দায় পরিণত হওয়া বিদেশিরা। রোম ধীরে ধীরে ইতালীয় শহরগুলোকে পরাজিত করে আবারও নিজেদের কুক্ষিগত করতে লাগল। ৯০ সালে জুলি সিজারেস গোত্রের এক অভিযাত, কিন্তু দরিদ্র কনসাল এমন এক কৌশল অবলম্বন করলেন, যা প্রায় এক শতাব্দী আগে গাও জু সফলভাবে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। যারা এই বিদ্রোহে যোগ দিতে অস্বীকার করল, তাদেরকে তিনি নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রলোভন দিলেন। বাকি বিদ্রোহী শহরগুলোকে দমন করতে রোমান সেনাবাহিনী প্ৰস্তুত হল।

উত্তরের শহরগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানে নেতৃত্ব দিতে প্রায় ৭০ বছর বয়সি মারিয়াস অবসর ভেঙে ফিরে এলেন। তিনি মনেপ্রাণে উচ্চাভিলাষী হলেও তার ভগ্নশরীর এতে সায় দেয়নি। তিনি ধীরে চলাফেরা করতেন, সিদ্ধান্ত নিতেন অনিশ্চয়তার সঙ্গে এবং পরিশেষে, অসুস্থ শরীরের কারণে আর আগাতেই পারলেন না তিনি। দ্বিতীয়বারের মতো অবসর নিলেন মারিয়াস।

মারিয়াসের সাবেক সহযোগী, সেই লুসিয়াস কর্নেলিয়াস সুল্লা এই সোশ্যাল যুদ্ধে বেশ ভালো করলেন। তার বয়স মারিয়াসের চেয়ে ২০ বছর কম ছিল এবং তিনি দক্ষিণের অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন। একের পর এক বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে তিনি রোমবাসীদের কাছে ‘মহান নেতার’ তকমা পেলেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৮৮ সাল নাগাদ সোশ্যাল যুদ্ধ শেষ হল এবং রোম আবারও এই উপদ্বীপের অধিকর্তা হল। ইতালীয় শহরগুলো পূর্ণ রোমান নাগরিকত্বের অধিকার পেল।

সুল্লা কনসাল পদে নির্বাচন করে খুব সহজেই জিতে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন তাকেই বছরের সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া হবে। উত্তর-পশ্চিমের রাজত্ব পনটাসের রাজা ইউপাটর ডাওনিসিউস এশিয়া মাইনরের আরও ভূখণ্ড ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছিলেন।

৭৭.২ পনটাস

এই অভিযানে সুল্লা ছাড়া অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা কারও মাথায় একবারের জন্যেও আসেনি। বস্তুত তিনি ৩৫ হাজার সেনা নিয়ে পনটাসের কাছাকাছি এক জায়গায় প্রস্তুতিও নিতে শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এতে বাদ সাধলেন মারিয়াস।

কমবয়সি, সাবেক সহযোগীর একের পর এক সাফল্যে পরশ্রীকাতরতায় ভুগছিলেন মারিয়াস। তিনি সিনেটের কাছে দাবি করলেন তাকে এই অভিযানের দায়িত্ব দিতে। ততদিনে তিনি বর্ষীয়ান, নিয়মিত অসুখে ভোগেন এবং স্থুল হয়ে পড়েছেন।

অনেক রোমান তার এই প্রস্তাবকে হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলেও মারিয়াস ছিলেন একজন পাকা রাজনীতিবিদ। তিনি এক ট্রিবিউনকে ঘুস দিলেন। সালপিকাস নামের এই ট্রিবিউন ‘অ্যান্টি-সিনেট’ নামে একটি সেনাদল গঠন করে মোটামুটি অস্ত্রের মুখেই সিনেটকে রাজি করালেন মারিয়াসকে এই দায়িত্ব দিতে। একইসঙ্গে তিনি সুল্লার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মারিয়াসের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য দুইজন ট্রিবিউনকে পাঠালেন।

কিন্তু ট্রিবিউনদের দেখামাত্র তাদেরকে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলল সুল্লার বাহিনীর সদস্যরা।

প্লুটার্ক বলেন, ‘বহু বছর ধরে রোমের চকচকে পৃষ্ঠের নিচে একধরনের অসুস্থতা ছড়িয়ে পড়ছিল। এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে এই রোগ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।’

পূর্ণমাত্রার গৃহযুদ্ধ শুরু হল রোমে। রোমে মারিয়াস, সালপিকাস ও তার সশস্ত্র যোদ্ধারা সুল্লা ও তার বন্ধুদের হত্যা করতে উদ্যত হল। সিনেটররা তাদের প্রাণের ভয়ে সুল্লাকে আরেকটি বার্তা পাঠিয়ে তার সেনাবাহিনীসহ আত্মসমর্পণ করার অনুরোধ জানানলেন। পরিবর্তে সুল্লা তার বাহিনীকে জমায়েত করে রোমের উদ্দেশে পদযাত্রা শুরু করলেন।

এটা ছিল রোমের সংবিধানের আরও একটি বড় আকারের লঙ্ঘন। রোমের ভেতর প্রাচীরে ঘেরা পনেরিয়াম নামের অভ্যন্তরীণ অবস্থানটি ছিল সবধরনের ঝগড়া-বিবাদ ও গোলযোগ মুক্ত। এটা ছিল শুধুই সিনেটের এলাকা। কিন্তু সুল্লার চিন্তাধারা হল, মারিয়াস ইতোমধ্যে সালপিকাসের সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়োগ দিয়ে এই নিয়ম ভঙ্গ করেছেন।

সুল্লার কয়েকজন কর্মকর্তা পনেরিয়ামে হামলা চালাতে অস্বীকার করল। তিনি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বাকিদের নিয়ে এগিয়ে গেলেন। সিনেট তাকে অনুরোধ করল প্রাচীরের বাইরে অপেক্ষা করতে, যাতে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতির সমাধান করা যায়। কিন্তু ততক্ষণে রাগে অন্ধ হয়ে গেছেন সুল্লা। তিনি হাতে মশাল নিয়ে তোরণ দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। শত্রুদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার নির্দেশ দিলেন তিনি। প্লুটার্ক বলেন, ‘দিক্‌বিদিকজ্ঞান হারিয়ে সর্বত্র অগ্নিসংযোগ করতে লাগল সুল্লা ও তার বাহিনী। নির্দোষ ও দোষী, উভয়ই আগুনে পুড়তে লাগল।’

মারিয়াস উত্তর-আফ্রিকায় পালালেন। সালপিকাসকে আটক করা হল। এরপর সুল্লা ও তার বাহিনীর নেতৃত্বে সিনেটের অধিবেশনে সালপিকাসকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হল। মারিয়াসকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল তার অনুপস্থিতিতে।

সুল্লা একদিকে একনায়কের মতো আচরণ করছিলেন, আবার অপরদিকে তিনি সিনেটের মাধ্যমে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন।

তবে একনায়কের আসন থেকে এক পা পিছিয়ে কনসাল নির্বাচনের আয়োজন করলেন সুল্লা। এতে জয়ী হলেন কুচিয়াস সিনা। তিনি সুল্লার বন্ধু না হলেও সহকর্মীর প্রতি বিশ্বস্ততা দেখানোর এবং সিনেটের আদেশ মেনে চলার অঙ্গীকার করলেন।

সিনার কাছে শহরের দায়িত্ব দিয়ে সুল্লা এশিয়া মাইনরের দিকে রওনা হলেন। তারপর পূর্বে পনটাসের দিকে যুদ্ধযাত্রা করলেন।

পৃথিবীর অপরপ্রান্তের মহান সাম্রাজ্যটিও দুর্ভোগ পোহাচ্ছিল। রোমের সোশ্যাল ওয়ারের মতো চীনের শাসক সম্রাট উদি তার ৫০ বছরের শাসনামলের শেষে এসে শিশুংনুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ করে এনেছিলেন। শিয়ংনু তখনো হান ভূখণ্ড, পশ্চিমের জমি-জমা ও সিল্ক রোড দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল

১০১ সাল নাগাদ হানদের সেনাপতি লি কুয়াঙ্গকে চীনের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া হল। তার লক্ষ্য ছিল উত্তর-পশ্চিমের ফেরগানা বা তাই’ইউয়ান দখল। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে লি কুয়াং হান-সম্রাটদের পক্ষে যুদ্ধ করছিলেন। তার প্রথম সামরিক অভিযান ছিল সম্রাট ওয়েন্দির আমলে, সেই শিয়ংনুদের বিরুদ্ধেই।

লি কুয়াং বেশ কৌশলী ছিলেন। একবার তিনি বেশ কয়েক হাজার শিয়ংনু সেনাকে ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

৭৭.৩ সিল্ক রোড

রোমান সেনাপতিদের মধ্যে তখনো কৌশলগত চিন্তার বিষয়টি অতটা প্রচলিত ছিল না। তারা মূলত বড় আকারের সেনাবাহিনী এনে শত্রুকে বিনষ্ট করার কৌশল অবলম্বন করতেন। লি কুয়াং ফেরগানার চার বছরের যুদ্ধে এই কৌশল ভালোভাবেই কাজে লাগান।

শিয়ংনু ফেরগানায় হামলা বরদাশত করতে পারেনি। তারা অপরদিক থেকে হান সেনাবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লি কুয়াং-এর প্রথম হামলা সফল হয়নি। যতক্ষণে লি কুয়াং ইউ-চেং শহরে এসে পৌঁছালেন, তার সঙ্গে কয়েক হাজারের বেশি সেনা ছিল না।

এই সামান্য সেনা নিয়েই হামলা চালালেন তিনি, যা চরমভাবে ব্যর্থ হল। মূল সেনাবাহিনীর এক-পঞ্চমাংশ নিয়ে তাকে দেশে ফিরে আসতে হল।

এই কাহিনি শুনে প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়লেন সম্রাট উদি। তিনি ফেরগানা থেকে হান অঞ্চলে আসার সড়কের মাথায় কিছু সেনা মোতায়েন করলেন। তার নির্দেশ, জেড তোরণ দিয়ে কেউ দেশে ফিরতে চাইলে তাদেরকে সেখানে কচুকাটা করা হবে। লি কুয়াং এই সংবাদে থেমে যেতে বাধ্য হলেন। সামান্য সেনা নিয়ে যুদ্ধেও যেতে পারছেন না, আবার দেশেও ফিরতে পারছেন না।

প্রায় পুরো একটা গ্রীষ্মকাল তিনি কাটিয়ে দিলেন অনিশ্চয়তার মধ্যে।

উদি ভেবেছিলেন, তার সাম্রাজ্যের সম্মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তিনি রাজকোষ খালি করে ভাড়াটে সেনা জোগাড় করলেন। পাশাপাশি, কারাগারে বন্দি সব কয়েদিকে মুক্তি দিয়ে সেনাবাহিনীতে যুক্ত করলেন এবং উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া সব সেনাদেরকেও জমায়েত করলেন। এই সম্মিলিত বাহিনীকে তিনি লি কুয়াং-এর কাছে পাঠালেন।

তবে এবার আর আগেরবারের ভুলগুলো করেননি লি কুয়াং। ইয়-চেং-এর পর ফেরগানার শাসকের রাজধানী এর-শিহ শহরের পতন হল।

চার বছরের অভিযান শেষে ফেরগানার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেল হান সাম্রাজ্য।

৮৭ সালে উদি মারা গেলেন। একই বছর সুল্লা এশিয়া মাইনরের দিকে যাত্রা করলেন। সিল্ক রোড তখনো খোলা ছিল, কিন্তু হানদের রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে পড়েছিল এবং সেনাবাহিনী ছিল ক্লান্ত। পরবর্তী দুই হান সম্রাট ঝাওদি ও জুয়ানদি এই সাম্রাজ্যকে খুব বেশিদূর আগাতে পারেননি।

ইতালীয় উপদ্বীপ থেকে সুল্লা সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিনাকে তার সহকর্মীরা শহর থেকে বের করে দিয়ে তোরণে তালা লাগিয়ে দিল। প্রাচীরের বাইরে দাঁড়িয়ে সিনা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি ভেতরে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশে সেনা সংগ্রহ করতে লাগলেন। খবর পেয়ে মারিয়াস উত্তর-আফ্রিকা থেকে সেখানে এসে সিনার সঙ্গে দেখা করলেন।

রোমের কনসালদের অজনপ্রিয়তা ও ঘুসের সম্মিলিতি প্রভাবে কিছুদিনের মাঝেই সিনা ও মারিয়াসকে রোমে ফেরার আমন্ত্রণ জানানো হল।

মারিয়াস তার ব্যক্তিগত ধনসম্পদ ব্যবহার করে উত্তর-আফ্রিকা থেকে ভাড়াটে সেনার একটি বড় দলকে নিয়োগ দিলেন। তিনি ও সিনা একটি বড় আকারের বাহিনী নিয়ে রোমে ফিরে এলেন এবং সহজেই তোরণ দিয়ে ঢুকে পড়লেন।

রোমের ভেতরে ঢুকে মারিয়াসের মাথা খারাপ হয়ে গেল। অন্তত, ইতিহাসবিদরা সেরকমই বলেছেন। তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীরা বিনাবাক্যব্যয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে লাগলেন। কেউ মারিয়াসকে অভিবাদন জানালে তিনি যদি কোনো উত্তর না দিতেন, তাহলে তৎক্ষণাৎ তাকে হত্যা করা হত। এভাবেই চলছিল এই উন্মাদনা।

একপর্যায়ে সিনাও শঙ্কেত হয়ে পড়লেন।

অপরদিকে সুল্লা তখন এশিয়া মাইনরের দখল ফিরিয়ে নিচ্ছেন। রোমের এসব ঘটনার কথা তার কানে এসে পৌঁছালে তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরতি যাত্ৰা শুরু করলেন।

সুল্লা আসছে! এই হুংকারে রোমবাসী যেন নতুন করে জীবন ফিরে পেল। এতে আরও বড় আকারে প্রভাবিত হলেন মারিয়াস। তিনি অনিয়ন্ত্রিতভাবে মদ্যপান করতে লাগলেন। অল্প সময়ের মাঝে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন মারিয়াস। অবশেষে, খ্রিস্টপূর্ব ৮৬ সালের ১৭ জানুয়ারি নিজ বাড়িতে পাগলের প্রলাপ বকতে বকতে প্রাণ হারালেন তিনি।

সুল্লা তখনও অনেক দূরে। সুতরাং আদতে মারিয়াসের এত উৎকণ্ঠিত হওয়ার কিছু ছিল না। ইতালি এসে পৌঁছালেন তিনি ৮৩ সালে। ইতোমধ্যে, সিনার ‘অরাজক’ শাসন থেকে বাঁচতে অনেকেই পালিয়ে সুল্লার কাছে এসে পৌঁছেছেন। সুল্লার মোকাবিলা করতে সিনা তার বাহিনীকে সুসংহত করে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু পথিমধ্যে তারা বিদ্রোহ করল—মারা পড়লেন সিনা।

মারিয়াস ও সিনার চেয়ে সুল্লার জনপ্রিয়তা বেশি ছিল, নিঃসন্দেহে। তা সত্ত্বেও রোমে এসে তাকে সংঘাতের মোকাবিলা করতে হল। মারিয়াসের ছেলে তার বাবার সমর্থকদের নিয়ে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। কিন্তু সুল্লার সঙ্গে ছিল পম্পেই ও ক্রাসাস নামে দুই তরুণ সেনাপতি। এই ত্রিমুখী নেতৃত্ব বেশ কার্যকর হয়ে ওঠে।

সুল্লা রোমে প্রবেশ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছয় হাজার কয়েদিকে তার সামনে ঠেলে দেওয়া হল-তারা সবাই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন। তিনি নির্দ্বিধায় এই ছয় হাজার কয়েদিকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। যখন তিনি সিনেটে বক্তব্য রাখছিলেন, তখন বাইরে এই কয়েদিদের হত্যা করা হচ্ছিল।

প্লুটার্ক বলেন, ‘সুল্লা একটুও বিব্রত না হয়ে তার বক্তব্য চালিয়ে যান এবং শ্রোতাদের জানান, এসব হট্টগোলে কান না দিতে। কিছু অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।’

এসব ঘটনায় রোমের সবচেয়ে বড় নির্বোধ ব্যক্তিটিও বুঝে গেলেন, তারা এক একনায়কের বদলে আরেক একনায়ক ডেকে এনেছেন।

টাইবেরিয়াস গ্রাচ্চাসের মৃত্যুর পর থেকে প্রজাতন্ত্রে যে গোলযোগ শুরু হয়েছিল, তার আকার আরও বড় হয়েছিল। একনায়কদের বিরুদ্ধে লড়তে সক্ষম ছিলেন শুধু একনায়করাই। মারিয়াস ও সিনার বন্ধু-বান্ধব, সহযোগীরা হয় মারা পড়লেন, নইলে পালিয়ে বাঁচলেন।

সিনার তরুণ জামাতার নাম ছিল জুলিয়াস সিজার। তিনি পালিয়ে যেতে পারা ‘সৌভাগ্যবানদের’ অন্যতম ছিলেন। শুধু রাজনৈতিক কারণে নয়, সম্পদ দখল বা অন্যান্য ব্যক্তিগত কারণেও অনেকে মারা পড়লেন।

সুল্লার দুই সহযোগীও কোনো অংশে কম নির্দয় ছিলেন না।

পম্পেইর দায়িত্ব ছিল ইতালীয় উপদ্বীপ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মারিয়াসের মিত্রদের খুঁজে বের করা। তিনি বিদ্রোহীদের সিসিলি ও উত্তর-আফ্রিকায় খুঁজে বের করেন এবং তাদেরকে হত্যা করেন। রোমে ফিরে তিনি তার জন্য বিজয় সংবর্ধনা আয়োজনের দাবি জানান।

ইতোমধ্যে ক্রাসাস ব্যস্ত ছিলেন বাড়িতে বাড়িতে আগুন ধরানোর কাজে। যে বাড়িগুলো তিনি ও সুল্লা দখল করতে চাইতেন, সেগুলোতে যেয়ে আগুন ধরিয়ে দিতেন। বাড়িতে আগুন ধরার সঙ্গে সঙ্গে এক ‘জমির দালাল’ (সুল্লার নিয়োগ দেওয়া) এসে হাজির হতেন। তিনি বাড়ির মালিকের কাছ থেকে সস্তায় সেটি কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিতেন। বাড়ির মালিক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতির পরিমাণকে ন্যূনতম রাখতে রাজি হতেন। ইতোমধ্যে সুল্লারই বেতনভুক্ত দমকল বাহিনীর সদস্যরা এসে আগুন নিভিয়ে ফেলতেন।

রোম থেকে যা যা পাওয়া সম্ভব, তার সবকিছুই অর্জন করে সুল্লা অবসরে গেলেন। ৮০ বছর বয়সে নিজ দেশে ফিরে গেলেন তিনি। সেখানে এক নারীকে বিয়ে করলেন এবং এক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালেন তিনি—একই সময়ে। তবে সব মিলিয়ে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে তিনি সম্ভবত লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন।

গুরুতর অসুস্থ হয়েও তিনি সুস্থ থাকার অভিনয় করে তার জীবনের শেষ বছরগুলো কাটাচ্ছিলেন। প্রজাতন্ত্রের অবস্থাও তার মতোই ছিল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *