৭১.
ঢাকায় ফিরে এসে পূর্ব পাকিস্তান শান্তি কমিটির সভায় যোগদান করলাম। আতাউর রহমান খান সাহেব সভাপতি। ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই’—এই আমাদের স্লোগান। সেপ্টেম্বর মাসের ১৫-১৬ তারিখে খবর এল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলির প্রতিনিধিরা শান্তি সম্মেলনে যোগদান করবে। আমাদেরও যেতে হবে পিকিং-এ, দাওয়াত এসেছে। সমস্ত পাকিস্তান থেকে ত্রিশজন আমন্ত্রিত। পূর্ব বাংলার ভাগে পড়েছে মাত্র পাঁচজন। আতাউর রহমান খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, উর্দু লেখক ইবনে হাসান ও আমি। সময় নাই, টাকা পয়সা কোথায়? পাসপোর্ট কখন করব? টিকিট অবশ্য পাওয়া যাবে যাওয়া-আসার জন্য শান্তি সম্মেলনের পক্ষ থেকে।
আমরা পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত করলাম, পাওয়ার আশা আমাদের খুবই কম। কারণ, সরকার ও তার দলীয় সভ্যরা তো ক্ষেপে অস্থির। কমিউনিস্ট না হলে কমিউনিস্ট চীনে যেতে চায়? শান্তি সম্মেলন তো না, কমিউনিস্ট পার্টির সভা, এমনি নানা কথা শুরু করে দিল। মিয়া ইফতিখারউদ্দিন সাহেব চেষ্টা করছেন করাচিতে, আমাদের পাসপোর্টের জন্য। পাসপোর্ট অফিসার ভদ্রলোক বললেন, “আমি লিখে পড়ে সব ঠিক করে রেখেছি, হুকুম আসলেই দুই মিনিটের মধ্যে পেয়ে যাবেন। তিনি নিজেও করাচিতে খবর দিলেন। আমরা পূর্ব বাংলা সরকারের হোম ডিপার্টমেন্টে খবর নিতে লাগলাম। আতাউর রহমান সাহেবও জয়েন্ট সেক্রেটারি ও সেক্রেটারির সাথে দেখা করলেন। কেউই কিছু বলতে পারে। আমরা চেষ্টায় রইলাম, বিওএসি অফিসে খোজ নিলাম। তারা আমাদের জানালেন, আপনাদের টিকিট এসে গেছে। তবে পাসপোর্ট না আনলে টিকিট ইস্যু করতে পারব না, সিটও রিজার্ভ করা যাবে না। সপ্তাহে একদিন বিওএসি’র প্লেন ঢাকায় আসে। শুনলাম, ২৩ কি ২৪ তারিখ ঢাকা-রেজুন হয়ে হংকং যাবে।
জানলাম পিকিংয়ে ভীষণ শীত, গরম কাপড় লাগবে। কিন্তু গরম কাপড় আমার ছিল না। তবে হংকং থেকেও কিনে নেওয়া যাবে। খুব নাকি সস্তা। ২২-২৩ তারিখে আমরা আশা ছেড়ে দিলাম। বোধহয় ২৪ তারিখ একটা প্লেন ঢাকায় আসবে। সরকার থেকে খবর এসেছে আমাদের পাসপোর্ট দেওয়া হবে। আমরা বুঝলাম এটা দেয়া না, শুধু মুখ রক্ষা করা। পাসপোর্ট পেলাম একটায়। কখন বাড়িতে যাব, কাপড় আনব আর কখনই বা প্লেনে উঠব। আতাউর রহমান সাহেব টেলিফোন করলেন বিওএসি অফিসে, প্লেনের খবর কি? তারা বলল, প্লেনের কোন খবর নাই। তবে কয়েক ঘন্টা লেট আছে। মনে আশা এল, তবে বোধহয় যেতে পারব। আমরা দেরি করতে লাগলাম, আতাউর রহমান সাহেবের বাড়িতে। এক ঘণ্টার মধ্যে খবর দেবে বলেছে, ঠিক কত ঘন্টা লেট আছে। মানিক ভাই বলতে শুরু করেছেন, তার যাওয়া হবে না, কারণ ইত্তেফাক কে দেখবে? টাকা কোথায়? ইত্তেফাঁকে লিখবে কে? কিছু সময় পরে খবর পেলাম চব্বিশ ঘন্টা প্লেন লেট। আগামী দিন বারটায় প্লেন আসবে, একটায় ছাড়বে। আমরা একটু আশ্বস্ত হলাম। কিছু সময় পাওয়া গেল। আওয়ামী লীগের কাজ চালাবার জন্য কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। বাসায় এলাম, মোল্লা জালাল ও হামিদ চৌধুরী আমার সকল কিছু ঠিক করে দিল। আওয়ামী লীগ অফিস হয়ে মানিক ভাইয়ের কাছে ইত্তেফাক অফিসে চললাম। মানিক ভাইকে অনেক করে বললাম, একটু একটু করে রাজি হলেন, তবে ঠিক করে বলতে পারছেন না। আমাদের কথা ছিল, সকাল দশটায় আমরা আতাউর রহমান সাহেবের বাড়ি থেকে একসাথে এয়ারপোর্ট রওয়ানা করব। খন্দকার ইলিয়াস আমার ব্যক্তিগত বন্ধু, যুগের দাৰী সাপ্তাহিক কাগজের সম্পাদক। দুজনেই এক বয়সী, একসাথে থাকব ঠিক করলাম। মানিক ভাইকে নিয়ে বিপদ! কি যে করে বলা যায় না।
সকালে প্রস্তুত হয়ে আমি মানিক ভাইয়ের বাড়িতে চললাম। তখন ঢাকায় রিকশাই একমাত্র সম্বল। সকাল আটটায় যেয়ে দেখি তিনি আরামে শুয়ে আছেন। অনেক ডাকাডাকি করে তুললাম। আমাকে বলেন, “কি করে যাব, যাওয়া হবে না, আপনারাই বেড়িয়ে আসেন। আমি রাগ করে উঠলাম। ভাবীকে বললাম, “আপনি কেন যেতে বলেন না, দশ-পনের দিনে কি অসুবিধা হবে? মানিক ভাই লেখক, তিনি গেলে নতুন চীনের কথা লিখতে পারবেন, দেশের লোক জানতে পারবে। কাপড় কোথায়? সুটকেস ঠিক করেন। আপনি প্রস্তুত হয়ে নেন। আপনি না গেলে আমাদের যাওয়া হবে না।” মানিক ভাই জানে যে, আমি নাছোড়বান্দা। তাই তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নিলেন। আমরা আতাউর রহমান সাহেবের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। প্লেন সময় মতই আসছে। আজ আমাদের এগারটার মধ্যে পৌঁছাতে হবে। অনেক ফরমালিটিজ আছে। টিকিট অনেক পূর্বেই নিয়েছি। আমাদের সিটও রিজার্ভ আছে। আমরা পৌঁছার কিছু সময় পরেই বিওএসি’র প্লেন এসে নামল। কিছু কিছু বন্ধুবান্ধব আমাদের বিদায় দিতে এসেছে। শান্তি কমিটির সেক্রেটারি আলী আকসাদ কয়েকটা ফুলের মালাও নিয়ে এসেছে। আমাদের মালপত্র, পাসপোর্ট যথারীতি পরীক্ষা করা হল। এই প্লেনেই মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরী ও আরও দুই তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা চীন চলেছেন। শুনলাম, পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা করাচি থেকে হংকং রওয়ানা হয়ে গিয়েছেন, সেখানেই আমাদের সাথে দেখা হবে এবং একসাথে চীনে যাব। প্লেন প্রথমে রেঙ্গুন পৌঁছাবে। রাতে রেঙ্গুনে আমাদের থাকতে হবে। আমরা অনেক সময় পাব। বিকাল ও রাতটা রেঙ্গুনে থাকতে হবে। আতাউর রহমান সাহেব বললেন, “রেঙ্গুনে ব্যারিস্টার শওকত আলীর বড় ভাই থাকেন, তাঁর বিরাট ব্যবসা আছে। ঠিকানাও আমার জানা আছে।”
আমরা রেঙ্গুন পৌঁছার পরেই বিওএসির বিশ্রামাগারে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল। ব্রহ্মদেশ ও বাংলাদেশ একই রকমে ফুলে ফলে ভরা। ব্রহ্মদেশে তখন ভীষণ গোলমাল, স্বাধীনতা পেলেও চারিদিকে অরাজকতা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জাপান ও চীনের কাছ থেকে জনসাধারণ অনেক অস্ত্র পেয়েছিল। নিজেদের ইচ্ছামত এখন তা ব্যবহার করতে শুরু করেছে। কমিউনিস্ট ও কারেন বা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। গৃহযুদ্ধে দেশটা শেষ হতে চলেছে। আইনশৃঙ্খলা বলে কোন জিনিস নাই। যে কোন সময় এমনকি দিনেরবেলায়ও রেঙ্গুন শহরে রাহাজানি ও ডাকাতি হয়। সন্ধ্যার পরে সাধারণত মানুষ ভয়েতে ঘর থেকে বের হয় না। যাদের অবস্থা ভাল অথবা বড় ব্যবসায়ী তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। যে কোন মুহূর্তে তাদের ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে যেতে পারে। আর যে টাকা দুবৃত্তরা দাবি করবে, তা না দিলে হত্যা করে ফেলবে। প্রায়ই এই সকল ঘটনা ঘটছে। আমাদের হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে। কোথাও বের হলে বলে যেতে বলেছে। হোটেলকে রক্ষা করার জন্য রীতিমত সশস্ত্র সিপাহি রাখা হয়েছে। আমরা বিদেশী মানুষ, আমাদের আছেই বা কি?
হোটেলে পৌঁছেই আতাউর রহমান সাহেব রয়্যাল স্টেশনারির মালিক আমজাদ আলীকে টেলিফোন করলেন। তখন তিনি বাইরে ছিলেন, কিন্তু কিছু সময় পরে ফিরে এসে খবর পেয়ে হোটেলে উপস্থিত হলেন। আমাদের পেয়ে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত। বিদেশে আপনজন বা দেশের লোক পেলে কেই বা খুশি না হয়। তাঁর নিজের গাড়ি আছে, আমাদের নিয়ে তিনি বেড়াতে বের হলেন। প্রথমেই তার দোকানে নিয়ে গেলেন। রেঙ্গুনের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দোকান ছিল রয়্যাল স্টেশনারি। মনে হল যেন, সবকিছু ঝিমিয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে। তিনি আমাদের রেঙ্গুনের অবস্থা বললেন। তবে যা কিছু হোক, রেঙ্গুন তিনি ছাড়বেন না। রেঙ্গুন শহর ও তার আশেপাশের কুড়ি মাইলই মাত্র বার্মা সরকারের হাতে আছে। সরকার কিছুতেই বিদ্রোহীদের দমাতে পারছে না। যাহোক, ভদ্রলোক তার বাড়িতেও আমাদের নিয়ে গেলেন এবং স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রমহিলা অমায়িক ও ভদ্র। রাতে আমাদের তার ওখানেই খেতে হবে। কোনো আপত্তি শুনলেন না।
আমাদের নিয়ে আমজাদ সাহেব বের হয়ে পড়লেন রেঙ্গুন শহর দেখাতে। বড় বড় কয়েকটা প্যাগোডা (বৌদ্ধ মন্দির) দেখলাম। একটার ভিতরেও আমরা যেয়ে দেখলাম। সকলের চেয়ে বড় প্যাগোডা কয়েক মাইল দূরে। ফিরে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে তাই যাওয়া চলবে না, পথে বিপদ হতে পারে। আতাউর রহমান সাহেবের আর এক পরিচিত লোক আছেন, তিনিও পূর্ব বাংলার লোক। একবার মন্ত্রীও হয়েছিলেন। তাঁর বাড়িতে আমরা উপস্থিত হলাম। তিনি বাড়ি ছিলেন না, অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরে উপর থেকে এক ব্ৰহ্ম মহিলা মুখ বের করে বললেন, বাড়িতে কেউ নাই। দরজা খুলতে পারবেন না। কারণ, আমাদের চিনেন না। কাগজ চাইলাম। তিনি বললেন, “দরজা খুলব না, কাগজ বাইরেই আছে, লিখে জানালা দিয়ে ফেলে যান।” এই ব্যবহার কেন? আমজাদ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, “এইভাবে গাড়িতে করে ব্যান্ডিটরা আসে। বাড়ির মালিকের নাম ধরে ডাক দিলে আগে লোকেরা সাধারণত দরজা খুলে দিত। ব্যান্ডিটরা দরজা খুললেই হাত-মুখ বেঁধে বন্দুক ও পিস্তল দেখিয়ে সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়। এ রকম ঘটনা প্রায়ই রেঙ্গুন শহরে ঘটছে, তাই কেউই এখন আর দরজা খোলে না—জানাশোনা লোক না দেখলে।
রেঙ্গুন শহরের একদিন শ্রী ছিল। এখনও কিছুটা আছে, তবে লাবণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। আমজাদ সাহেব কয়েক ঘণ্টা আমাদের নিয়ে অনেক জায়গা দেখালেন। পরে আমাদের বার্মা ক্লাবে নিয়ে গেলেন। স্বাধীন হওয়ার পূর্বে এই ক্লাবে ইউরোপিয়ান ছাড়া কেউ সদস্য হতে পারত না। এমনকি ভিতরে যাওয়ার হুকুম ছিল না। লেকের পাড়ে এই ক্লাবটা অতি চমৎকার। আমজাদ সাহেবকে সকলেই চিনে এবং শ্রদ্ধা করে। দিনভর বেড়িয়ে রাতে আমাদের পৌঁছে দিলেন হোটেলে এবং বিশেষ করে অনুরোধ করলেন ফেরার পথে দুই একদিন থেকে বেড়িয়ে যেতে। আমি ও ইলিয়াস এক রুমে ছিলাম। রেঙ্গুন শান্তি কমিটির কয়েকজন সদস্য আমাদের সাথে দেখা করতে আসলেন। অনেকক্ষণ আলোচনা হল। তাদের নেতা আমাদের জানালেন, পূর্বেই শান্তি কমিটির কয়েকজন সদস্য চীন চলে গিয়েছেন। আরও সদস্য যাবেন, তবে পাসপোর্ট এখনও পান নাই। কিছু সদস্য পালিয়ে চলে গিয়েছেন, একথাও জানালেন।
খুব ভোরে আমাদের রওয়ানা করতে হল। আমরা ব্যাংকক পৌঁছালাম। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক, বেশ বড় এয়ারপোর্ট তাদের। এখানে আমরা চা-নাশতা খেলাম। এক ঘণ্টা পরে হংকং রওয়ানা করলাম। সোজা হংকং, আর কোথাও প্লেন থামবে না। আমার প্লেনে ঘুমাতে কোনো কষ্ট হয় না। থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ চীন সাগর পাড়ি দিয়ে বেলা একটায় হংকংয়ের কাইতেক বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছালাম। সিনহুয়া সংবাদ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা আমাদের অভ্যর্থনা করল। ইংরেজিতে ‘নিউ চায়না নিউজ এজেন্সি’ বলা হয় সংবাদ প্রতিষ্ঠানটাকে। কৌলুন হোটেলে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দশ-বারজন প্রতিনিধি আগেই পৌঁছে গেছেন। ঐদিন সন্ধ্যায় ও পরের দিন ভোরের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতিনিধি সকলেই পৌঁছাবে। পরের দিন ভোরে আমাদের সভা হল, সভায় পীর মানকী শরীফকে নেতা করা হল।
রাতে ও দিনে হংকং ঘুরে দেখলাম। হংকংয়ের নাম ইংরেজরা রেখেছে ভিক্টোরিয়া। নদীর এক পাড়ে হংকং, অন্য পাড়ে কৌলুন। আমরা সকলেই কিছু কিছু গরম কাপড় কিনে নিলাম। আমাদের টাকা বেশি নাই, কিন্তু জিনিসপত্র খুব সস্তা। তবে সাবধান হয়ে কিনতে হবে। এক টাকা দামের জিনিস পঁচিশ টাকা চাইবে, আপনাকে এক টাকাই বলতে হবে, লজ্জা করলে ঠকবেন। জানাশোনা পুরানা লোকের সাহায্য ছাড়া মালপত্র কেনা উচিত না। হংকংয়ের আরেকটা নাম হওয়া উচিত ছিল ঠগিজ শহর। রাস্তায় হাঁটবেন পকেটে হাত দিয়ে, নাহলে পকেট খালি। এত সুন্দর শহর তার ভিতরের রূপটা চিন্তা করলে শিউরে উঠতে হয়। এখন ইংরেজের কলোনি। অনেক চীনা অর্থশালী লোক পালিয়ে হংকং এসেছে। বাস্তুহারা লোকেরা পেটের দায়েও অনেক অসৎ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এক পাকিস্তানী বন্ধুর সাথে আলাপ হয়েছিল। সিন্ধুতে তার বাড়ি ছিল, এখন হংকংয়ে আছে। তার সাথে বসে বসে অনেক গল্প শুনলাম। পরে অনেকবার হংকংয়ে যেতে হয়েছে এবং কয়েকদিন থাকতেও হয়েছে। হংকং এত পাপ সহ্য করে কেমন করে, শুধু তাই ভাবি।
৭২.
বোধহয় হংকং থেকে ২৭ তারিখে রেলগাড়িতে ক্যান্টন পৌঁছালাম। সেনচুন স্টেশন কমিউনিস্ট চীনের প্রথম স্টেশন। ব্রিটিশ এরিয়ার পরে আর ব্রিটিশ রেল যায় না। আমরা হেঁটে হেঁটে পুল পার হয়ে স্টেশনে পৌঁছালাম। শান্তি কমিটির স্বেচ্ছাসেবক ও স্বেচ্ছাসেবিকারা আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাল। কোন চিন্তা নাই। মালপত্র সব কিছুর ভার তারা গ্রহণ করেছেন। আমাদের জন্য ট্রেনে খাবার ও থাকার সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে। দুই তিনজনের জন্য একজন করে ইন্টারপ্রেটার রয়েছে। এদের সকলেই প্রায় স্কুল, কলেজের ছেলেমেয়ে। আমি ট্রেনের ভিতর ঘুরতে শুরু করলাম। ট্রেনে এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত যাওয়া যায়। নতুন চীনের লোকের চেহারা দেখতে চাই। আফিং’ খাওয়া জাত যেন হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। আফিং এখন আর কেউ খায় না, আর ঝিমিয়েও পড়ে না। মনে হল, এ এক নতুন দেশ, নতুন মানুষ। এদের মনে আশা এসেছে, হতাশা আর নাই। তারা আজ স্বাধীন হয়েছে, দেশের সকল কিছুই আজ জনগণের। ভাবলাম, তিন বছরের মধ্যে এত বড় আলোড়ন সৃষ্টি এরা কি করে করল! ক্যান্টন পৌঁছালাম সন্ধ্যার পরে। শত শত ছেলেমেয়ে ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির। শান্তি কমিটির কর্মকর্তারা আমাদের রেলস্টেশনে অভ্যর্থনা করলেন। পার্ল নদীর পাড়ে এক বিরাট হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাতেই আবার ডিনার, শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে। চীনের লোকেরা বাঙালিদের মত বক্তৃতা করতে আর বক্তৃতা শুনতে ভালবাসে।
খাবার শুরু হবার পূর্বে বক্তৃতা হল। আমাদের পক্ষ থেকে পীর সাহেব বক্তৃতা করলেন। হাততালি কথায় কথায়, আমাদেরও তালি দিতে হল। ভোরেই রওয়ানা করতে হবে পিকিং। আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে পৌঁছাতে। তাই কনফারেন্স বন্ধ রাখা হয়েছে। কারণ, অনেক দেশের প্রতিনিধিরাই সময় মত পৌঁছাতে পারে নাই। ক্যান্টন থেকে প্লেনে যেতে হবে দেড় হাজার মাইল। সকালে নাশতা খেয়ে আমরা রওয়ানা করলাম। দিনেরবেলা প্লেনে দেড় হাজার মাইল চীনের ভূখণ্ডের উপর দিয়ে যাবার সময় সেদেশের সৌন্দর্য দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম।
ক্যান্টন প্রদেশ বাংলাদেশের মতই সুজলা সুফলা। শত শত বছর বিদেশীরা এই দেশকে শোষণ করেও এর সম্পদের শেষ করতে পারে নাই। নয়া চীন মন প্রাণ দিয়ে নতুন করে গড়তে শুরু করেছে। বিকেলবেলা আমরা পৌঁছালাম পিকিং এয়ারপোর্টে। পিকিং শান্তি কমিটির সদস্যরা, ভারতবর্ষেরও কয়েকজন প্রতিনিধি এবং ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা উপস্থিত হয়েছে। আমাদের পরিচয় পর্ব শেষ করে পিকিং হোটেলে নিয়ে আসা হল। এই সেই পিকিং, চীনের রাজধানী। পূর্বে অনেক জাতি পিকিং দখল করেছে। ইংরেজ বা জাপান অনেক কিছু ধ্বংসও করেছে। অনেক লুটপাট করেছে, দখল করার সময়। এখন সমস্ত শহর যেন নতুন রূপ ধরেছে। পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়ে প্রাণভরে হাসছে।
আমাদের পিকিং হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেছে। এই হোটেলটাই সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর। আতাউর রহমান সাহেব, মানিক ভাই ও আমি এক রুমে। বড় ক্লান্ত আমরা। রাতে আর কোথাও বের হব না। আমাদের দলের নেতা পীর সাহেব বলে দিয়েছেন, কোনো মুসলমান হোটেলে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। রাতে বাসে চড়ে সেখানে যেতে হবে খাবার জন্য। ভীষণ শীত বাইরে, যেতে ইচ্ছা আমাদের ছিল না, তবুও উপায় নাই। প্রায় দুই মাইল দূরে এই হোটেলটা। আমরা পৌঁছার সাথে সাথে খাবার আয়োজন করে ফেলেছে। মনে হল হোটেলের মালিক খুব খুশি হয়েছেন। চীনা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা তারা জানে না। ইন্টারপ্রেটার সাথেই আছে। খেতে শুরু করলাম, কিন্তু খাবার উপায় নাই। ভীষণ ঝাল। দু’এক টুকরা রুটি মুখে দিয়ে বিদায় হলাম। যা কিছু খেয়েছিলাম তার ধাক্কা চলল, পেটের ব্যথা শুরু হল। রুমে আঙ্গুর ও অন্যান্য ফলফলারি ছিল, তাই খেয়ে আর চা খেয়ে রাত কাটালাম। মানিক ভাই বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, তিনি আর যাবেন না ঐ হোটেলে খেতে। পিকিং হোটেলেই সব কিছু পাওয়া যায়। যা খেতে চাইবেন, তাই দিবে। মানিক ভাই আর কয়েকজন পরের দিন দুপুরে পিকিং হোটেলে খেয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি ও আতাউর রহমান সাহেব দুপুরেও বাধ্য হয়ে খেলাম ঐ হোটেলে। রাতে দেখা গেল পাঁচ ছয়জন আছেন পীর সাহেবের সাথে। পরের দিন পীর সাহেব ও তাঁর সেক্রেটারি হানিফ খান (এখন কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি) ছাড়া আর কেউ মুসলমান হোটেলে খেতে গেলেন না। পিকিং হোটেলে ভাত, তরকারি, চিংড়ি মাছ, মুরগি, গরুর মাংস, ডিম সবকিছুই পাওয়া যায়। কয়েক মিনিট দেরি করলে এবং বলে দিলে ঐসব খাবার পাক করে এনে হাজির করে। আমাদের এখন আর কোনো অসুবিধা হয় না। কয়েকদিন পূর্বে কলকাতা থেকে বিখ্যাত লেখক বাবু মনোজ বসু এবং বিখ্যাত গায়ক ক্ষিতীশ বোস এসেছেন। তাঁরা বাঙালি খানার বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন। তাঁদের সাথে আমাদের আলাপ হওয়ার পরে আরও সুবিধা হয়ে গেল।
আমাদের হাতে দুই-তিন দিন সময় আছে। ১লা অক্টোবর নয়া চীনের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৪৯ সালের ১লা অক্টোবর এরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। চীন থেকে পালিয়ে চিয়াং কাইশেকের দল ফরমোজায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল।
শান্তি সম্মেলন শুরু হবে ২রা অক্টোবর থেকে। ভাবলাম, সম্মেলন শুরু হবার আগে দেখে নিই ভাল কত্রে পিকিং শহরকে। পিকিং শহরের ভিতরেই আর একটা শহর, নাম ইংরেজিতে ‘ফরবিডেন সিটি’। সম্রাটরা পূর্বে অমাত্যবর্গ নিয়ে এখানে থাকতেন। সাধারণ লোকের এর মধ্যে যাওয়ার হুকুম ছিল না। এই নিষিদ্ধ শহরে না আছে এমন কিছুই নাই। পার্ক, লেক, প্রাসাদ সকল কিছুই আছে এর মধ্যে। ভারতে লালকেল্লা, ফতেহপুর সিক্রি এবং আগ্রাকেল্লাও আমি দেখেছি। ফরবিডেন সিটিকে এদের চেয়েও বড় মনে হল। এখন সকলের জন্য এর দরজা খোলা, শ্রমিকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, পার্ক, লেক সবকিছুই আজ জনসাধারণের সম্পত্তি। হাজার হাজার লোক আসছে, যাচ্ছে। দেখলাম ও ভাবলাম, রাজ-রাজড়ার কাণ্ড সব দেশেই একই রকম ছিল। জনগণের টাকা তাদের আরাম আয়েশের জন্য ব্যয় করতেন, কোনো বাধা ছিল না।
পরের দিন গ্রীষ্ম প্রাসাদ দেখতে গেলাম, যাকে ইংরেজিতে বলা হয়, সামার প্যালেস’। নানা রকমের জীব জানোয়ারের মূর্তি, বিরাট বৌদ্ধ মন্দির, ভিতরে বিরাট লেক, লেকের মধ্যে একটা দ্বীপ। এটাকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রমোদ নগরী বলা চলে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল রেজা পিকিং হোটেলে আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন। তিনি বললেন, আমাদের কোন অসুবিধা হলে বা কোনো কিছুর দরকার হলে তাকে যেন খবর দেই। তিনি আমাদের খাবার দাওয়াতও করেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে গল্প শুনলাম অনেক। কালোবাজার বন্ধ, জনগণ কাজ পাচ্ছে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ হয়ে গেছে। কঠোর হাতে নতুন সরকার এইসব দমন করেছে। যে কোন জিনিস কিনতে যান, এক দাম। আমি একাকী বাজারে সামান্য জিনিসপত্র কিনেছি। দাম লেখা আছে। কোনো দরকষাকষি নাই। রিকশায় চড়েছি। কথা বুঝতে পারি না। চীনা টাকা যাকে ইয়েন বলে, হাতে করে বলেছি, “ভাড়া নিয়ে যাও কত নেবা।” তবে যা ভাড়া, তাই নিয়েছে, একটুও বেশি নেয় নাই।
এবারের ১লা অক্টোবর তৃতীয় স্বাধীনতা দিবস। শান্তি সম্মেলনের ডেলিগেটদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের ঠিক পিছনে উঁচুতে মাও সে তুং, চু তে, মাদাম সান ইয়েৎ সেন (সুং চিং লিং), চৌ এন লাই, লিও শাও চী আরও অনেকে অভিবাদন গ্রহণ করবেন। জনগণ শোভাযাত্রা করে আসতে লাগল। মনে হল, মানুষের সমুদ্র। পদাতিক, নৌ, বিমান বাহিনী তাদের কুচকাওয়াজ ও মহড়া দেখাল। তারপরই শুরু হল, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, ইয়াং পাইওনিয়ারের মিছিল, শুধু লাল পতাকাসহ। একটা জিনিস আমার চোখে পড়ল। এতবড় শোভাযাত্রা কিন্তু শৃঙ্খলা ঠিকই রেখেছে। পঁচ-সাত লক্ষ লোক হবে মনে হল। পরের দিন খবরের কাগজে দেখলাম, পাঁচ লাখ। বিপ্লবী সরকার সমস্ত জাতটার মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে নতুন চিন্তাধারা দিয়ে।
আমি জানতাম না মাহাবুব এখানে আছে। মাহাবুব তৃতীয় সেক্রেটারি পাকিস্তান রাষ্ট্রদূতের অফিসে। আমার সাথে কিছুদিন ল’ পড়েছে। তার আব্বাকেও আমি জানতাম; জনাব আবুল কাশেম, সাবজজ ছিলেন। চট্টগ্রামে বাড়ি। বড় স্বাধীনচেতা লোক ছিলেন। সত্য কথা বলতে কখনও ভয় পেতেন না। মাহাবুবও দেখলাম তার স্ত্রীকে নিয়ে চলেছে স্বাধীনতা দিবসে যোগদান করতে। আমি মাহাবুবকে দূর থেকে দেখে ডাক দিলাম। হঠাৎ পিকিংয়ে নাম ধরে কে ডাকছে, একটু আশ্চর্যই হল বলে মনে হল। আমাকে দেখে খুবই খুশি হল। কাগজে দেখেছে আমি এসেছি। বিকালে হোটেলে এল, তার স্ত্রীও এলেন। আমাকে নিয়ে নিজেই শহরের অনেকগুলি জায়গা দেখাল। রাতে খাবার দাওয়াত ছিল বলে বেশি সময় থাকতে পারলাম না। পরদিন আবার দেখা হবে। যে কয়দিন পিকিংয়ে ছিলাম, রাতে আমি ওদের সাথেই খেতাম। বাংলাদেশের খাবার না খেলে আমার তৃপ্তি কোনোদিনই হয় নাই। মাহাবুবের বেগম আমাকে একটা ক্যামেরা উপহার দিলেন। টাকার প্রয়োজন ছিল, তাই মাহাবুব কিছু টাকাও আমাকে দিল। বলল, হংকং থেকে কিছু জিনিস কিনে নিও, খুব সস্তা। আমার স্ত্রীর কথাও বলল, “কিছু দিতে পারলাম না তাকে। এই টাকা থেকে ভাবীর জন্য উপহার নিও।” বেগম মাহাবুব আমাকে একটা ঘটনা বললেন। একদিন তিনি স্কুল থেকে আসছিলেন রিকশায়, কলম পড়ে গিয়েছিল রিকশার মধ্যে। বাড়ি এসে খোজাখুঁজি করে দেখলেন, কলম পাওয়া গেল না। তখন ভাবলেন, রিকশায় পড়ে গিয়াছে, আর পাওয়া যাবে না। পরের দিন রিকশাওয়ালা নিজে এসে কলম ফেরত দিয়ে গিয়েছিল। এ রকম অনেক ঘটনাই আজকাল হচ্ছে। অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে চীনের জনসাধারণের মধ্যে। বেগম মাহাবুব ও মাহাবুবের আদর আপ্যায়নের কথা কোনোদিন ভুলতে পারি নাই। চীনের পাকিস্তান দূতাবাসে মাহাবুবই একমাত্র বাঙালি কর্মচারী।
৭৩.
শান্তি সম্মেলন শুরু হল। তিনশত আটাত্তর জন সদস্য সাঁইত্রিশটা দেশ থেকে যোগদান করেছে। সাঁইত্রিশটা দেশের পতাকা উড়ছে। শান্তির কপোত একে সমস্ত হলটা সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। প্রত্যেক টেবিলে হেডফোন আছে। আমরা পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা একপাশে বসেছি। বিভিন্ন দেশের নেতারা বক্তৃতা করতে শুরু করলেন। প্রত্যেক দেশের একজন বা দুইজন সভাপতিত্ব করতেন। বক্তৃতা চলছে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও অনেকেই বক্তৃতা করলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তৃতা করলাম। আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান সাহেব ইংরেজি করে দিলেন। ইংরেজি থেকে চীনা, রুশ ও স্পেনিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পরে মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে নাই। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ আমরা বাংলা। ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি।”
বক্তৃতার পর, খন্দকার ইলিয়াস তো আমার গলাই ছাড়ে না। যদিও আমরা পরামর্শ করেই বক্তৃতা ঠিক করেছি। ক্ষিতীশ বাবু পিরোজপুরের লোক ছিলেন, বাংলা গানে মাতিয়ে তুলেছেন। সকলকে বললেন, বাংলা ভাষাই আমাদের গর্ব। (বক্তৃতার কপি আমার কাছে আছে পরে তুলে দেব),২৪ কতগুলি কমিশনে সমস্ত কনফারেন্স ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন রুমে বসা হল। আমিও একটা কমিশনে সদস্য ছিলাম। আলোচনায় যোগদানও করেছিলাম। কমিশনগুলির মতামত জানিয়ে দেওয়া হল, ড্রাফট কমিটির কাছে। প্রস্তাবগুলি ড্রাফট করে আবার সাধারণ অধিবেশনে পেশ করা হল এবং সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হল।
মানিক ভাই কমিশনে বসতেন না বললেই চলে। তিনি বলতেন, প্রস্তাব ঠিক হয়েই আছে। কনফারেন্সের শেষ হওয়ার পর, এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। বিরাট জনসভায় প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধিদলের নেতারা বক্তৃতা করলেন এবং সকলের এক কথা, “শান্তি চাই, যুদ্ধ চাই না”। বিভিন্ন ধর্মের লোকেরাও যোগদান করেছিল আলাদা আলাদাভাবে শোভাযাত্রা করে। চীনে কনফুসিয়ান ধর্মের লোকেরা সংখ্যায় বেশি। তারপর বৌদ্ধ, মুসলমানের সংখ্যাও কম না, কিছু খ্রিষ্টানও আছে। একটা মসজিদে গিয়েছিলাম, তারা বললেন, ধর্ম কর্মে বাধা দেয় না এবং সাহায্যও করে না। আমার মনে হল, জনসভায় তাহেরা মাজহারের বক্তৃতা খুবই ভাল হয়েছিল। তিনি একমাত্র মহিলা পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বক্তৃতা করেছিলেন। তাঁর বক্তৃতার পরে পাকিস্তানের ইজ্জত অনেকটা বেড়েছিল।
ভারতবর্ষের প্রতিনিধিদের ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সাথে কাশ্মীর নিয়ে অনেক আলোচনা হওয়ার পরে একটা যুক্ত বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল। তাতে ভারতের প্রতিনিধিরা স্বীকার করেছিলেন, গণভোটের মাধ্যমে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। এতে কাশ্মীর সমস্যা সমস্ত প্রতিনিধিদের সামনে আমরা তুলে ধরতে পেরেছিলাম।
আমরা ভারতের প্রতিনিধিদের খাবার দাওয়াত করেছিলাম। আমাদেরও তারা দাওয়াত করেছিল। আমাদের দেশের মুসলিম লীগ সরকারের যারা এই কনফারেন্সে যোগদান করেছিল তারা মোটেই খুশি হয় নাই। কিন্তু এই সমস্ত কনফারেন্সে যোগদান করলে দেশের মঙ্গল ছাড়া অমঙ্গল হয় না। পাকিস্তান নতুন দেশ, অনেকের এদেশ সম্পর্কে ভাল ধারণা নাই। যখন পাকিস্তানের পতাকা অন্যান্য পতাকার পাশে স্থান পায়, প্রতিনিধিরা বক্তৃতার মধ্যে পাকিস্তানের নাম বার বার বলে তখন অনেকের পাকিস্তান সম্বন্ধে আগ্রহ হয় এবং জানতে চায়।
রাশিয়ার প্রতিনিধিদেরও আমরা খাবার দাওয়াত করেছিলাম। এখানে রুশ লেখক অ্যাসিমভের সাথে আলাপ হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এই সম্মেলনেই আমি মোলাকাত করি তুরস্কের বিখ্যাত কবি নাজিম হিকমতের সাথে। বহুদিন দেশের জেলে ছিলেন। এখন তিনি দেশত্যাগ করে রাশিয়ায় আছেন। তার একমাত্র দোষ তিনি কমিউনিস্ট। দেশে তাঁর স্থান নাই, যদিও বিশ্ববিখ্যাত কবি তিনি। ভারতের ড. সাইফুদ্দিন কিচলু, ডাক্তার ফরিদী ও আরও অনেক বিখ্যাত নেতাদের সাথেও আলাপ হয়েছিল। আমি আর ইলিয়াস সুযোগ বুঝে একবার মাদাম সান ইয়েৎ সেনের সাথে দেখা করি এবং কিছু সময় আলাপও করি।
একটা জিনিস আমি অনুভব করেছিলাম, চীনের সরকার ও জনগণ ভারতবর্ষ বলতে পাগল। পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্ব এতে তারা আগ্রহশীল, তবে ভারতবর্ষ তাদের বন্ধু, তাদের সবকিছুই ভাল। আমরাও আমাদের আলোচনার মাধ্যমে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি, পাকিস্তানের জনগণ চীনের সাথে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহশীল। পিকিংয়ের মেয়র চেং পেংয়ের সাথেও ব্যক্তিগতভাবে আলাপ হয়েছিল আমার কিছু সময়ের জন্য।
আমরা পে ইয়ং পার্ক ও স্বর্ণ মন্দির (টেম্পেল অব হেভেন) দেখতে যাই। চীন দেশের লোকেরা এই মন্দিরে পূজা দেয় যাতে ফসল ভাল হয়। এখন আর জনগণ বিশ্বাস করে না, পূজা দিয়ে ভাল ফসল উৎপাদন সম্ভব। কমিউনিস্ট সরকার জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে চাষিদের মধ্যে জমি বিলি বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। ফলে ভূমিহীন কৃষক জমির মালিক হয়েছে। চেষ্টা করে ফসল উৎপাদন করছে, সরকার সাহায্য করছে। ফসল উৎপাদন করে এখন আর অকর্মণ্য জমিদারদের ভাগ দিতে হয় না। কৃষকরা জীবনপণ করে পরিশ্রম করছে। এক কথায় তারা বলে, আজ চীন দেশ কৃষক মজুরদের দেশ, শোষক শ্রেণী শেষ হয়ে গেছে।
৭৪.
এগার দিন সম্মেলন হওয়ার পরে দেশে ফিরবার সময় হয়েছে। শান্তি কমিটি আমাদের জানালেন ইচ্ছা করলে আমরা চীন দেশের যেখানে যেতে চাই বা দেখতে চাই তারা দেখাতে রাজি আছেন। খরচপাতি শান্তি কমিটি বহন করবে। আতাউর রহমান খান সাহেব ও মানিক ভাই দেশে ফিরবার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন। তারা বিদায় নিলেন। ইলিয়াস ও আমি আরও কয়েকটা জায়গা দেখে ফিরব ঠিক করলাম। কয়েকজন একসাথে গেলে ভাল হয়। পীর মানকী শরীফ ও পাকিস্তানের কয়েকজন নেতার সাথে আমরা দুইজনে যোগ দিলাম। ভাবলাম, আমাদের দেশের সরকারের যে মনোেভাব তাতে ভবিষ্যতে আর চীন দেখার সুযোেগ পাব কি না জানি না। তবে বেশি দেরি করারও উপায় নাই। বেশি দিন দেরি হলে সরকার সোজা এয়ারপোর্ট থেকে সরকারি অতিথিশালায় নিয়ে যেতে পারেন। যাহোক, ইউসুফ হাসান অন্য একটা দলে যোগদান করেন। আমরা অন্যদলে ট্রেনে যাব ঠিক হল। পিকিং থেকে বিদায় নিয়ে প্রথমে তিয়েন শিং বন্দরে এলাম। পীর সাহেবকে নিয়ে এক বিপদই হল, তিনি ধর্ম মন্দির, প্যাগোডা আর মসজিদ, এইসব দেখতেই বেশি আগ্রহশীল। আমরা শিল্প কারখানা, কৃষকদের অবস্থা, সাংস্কৃতিক মিলনের জায়গা ও মিউজিয়াম দেখার জন্য ব্যস্ত। তিনি আমাদের দলের নেতা, আমাদের তার প্রোগ্রামই মানতে হয়। তবুও ফাঁকে ফাঁকে আমরা দুইজন এদিক ওদিক বেড়াতে বের হতাম। আমাদের কথাও এরা বোঝে না, এদের কথাও আমরা বুঝি না। একমাত্র উপায় হল ইন্টারপ্রেটার।
তিয়েন শিং সামুদ্রিক বন্দর। এখানে আমরা অনেক রাশিয়ান দেখতে পাই। আমি ও ইলিয়াস বিকালে পার্কে বেড়াতে যেয়ে এক রাশিয়ান ফ্যামিলির সাথে আলাপ করতে চেষ্টা করি। কিন্তু ইন্টারপ্রেটার না থাকার জন্য তা সম্ভব হল না। মনের ইচ্ছা মনে রেখে আমাদের বিদায় নিতে হল, ইশারায় শুভেচ্ছা জানিয়ে। ইচ্ছা থাকলেও উপায় নাই। আমরাও তাদের ভাষা জানি না, তারাও আমাদের ভাষা জানে না। রাতে আমাদের জন্য যে খাবার বন্দোবস্ত করেছিল সেখানে একজন ইমাম সাহেব ও কয়েকজন মুসলমানকে দাওয়াত করা হয়েছিল। মুসলমানরা ও ইমাম সাহেব জানালেন তারা সুখে আছেন। ধর্মে-কর্মে কোনো বাধা কমিউনিস্ট সরকার দেয় না। তবে ধর্ম প্রচার করা চলে না।
দুই দিন তিয়েন শিং থেকে আমরা নানকিং রওয়ানা করলাম। গাড়ির প্রাচুর্য বেশি নাই। সাইকেল, সাইকেল রিকশা আর দুই চারখানা বাস। মোটরগাড়ি খুব কম। কারণ, নতুন সরকার গাড়ি কেনার দিকে নজর না দিয়ে জাতি গঠন কাজে আত্মনিয়োগ করেছে।
আমার নিজের একটা অসুবিধা হয়েছিল। আমার অভ্যাস, নিজে দাড়ি কাটি। নাপিত ভাইদের বোধহয় দাড়ি কাটতে কোনোদিন পয়সা দেই নাই। রেড আমার কাছে যা ছিল শেষ হয়ে গেছে। ব্লেড কিনতে গেলে শুনলাম, রেড পাওয়া যায় না। বিদেশ থেকে ব্লেড আনার অনুমতি নাই। পিকিংয়েও চেষ্টা করেছিলাম পাই নাই। ভাবলাম, তিয়েন শিং-এ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। এত বড় শিল্প এলাকা ও সামুদ্রিক বন্দর! এক দোকানে বহু পুরানা কয়েকখানা ব্লেড পেলাম, কি তাতে আর দাড়ি কাটা যাবে না। আর এগুলো কেউ কিনেও না। চীন দেশে যে জিনিস তৈরি হয় না, তা লোকে ব্যবহার করবে না। পুরানা আমলের ক্ষুর দিয়ে দাড়ি কাটা হয়। আমার আর উপায় রইল না, শেষ পর্যন্ত হোটেলের সেলুনেই দাড়ি কাটতে হল। এরা শিল্প কারখানা বানানোর জন্যই শুধু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে। আমাদের দেশে সেই সময়ে কোরিয়ার যুদ্ধের ফলস্বরূপ যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছিল তার অধিকাংশ ব্যয় হল জাপানি পুতুল, আর শৌখিন দ্রব্য কিনতে। দৃষ্টিভঙ্গির কত তফাৎ আমাদের সরকার আর চীন সরকারের মধ্যে! এদেশে একটা বিদেশী সিগারেট পাওয়া যায় না। সিগারেট তারা তৈরি করছে নিকৃষ্ট ধরনের, তাই বড় ছোট সকলে খায়। আমরাও বাধ্য হলাম চীনা সিগারেট খেতে। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হয়েছিল কড়া বলে, আস্তে আস্তে রপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
নানকিং অনেক পুরানা শহর। অনেক দিন চীনের রাজধানী ছিল। এখানে সান ইয়েৎ সেনের সমাধি। আমরা প্রথমেই সেখানে যাই শ্রদ্ধা জানাতে। পীর সাহেব ফুল দিলেন, আমরা নীরবে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম এই বিপ্লবী নেতাকে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও চীনের মাঞ্চু রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন এবং বিপুল ত্যাগ স্বীকার করেছেন। রাজতন্ত্রকে খতম করে দুনিয়ায় চীন দেশের মর্যাদা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিও বুঝতে পেরেছিল চীন জাতিকে বেশি দিন দাবিয়ে রাখা যাবে না, আর শোষণও করা চলবে না।
নানকিং থেকে আমরা সাংহাই পৌঁছালাম। এটা দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর ও ব্যবসা কেন্দ্র। বিদেশী শক্তিগুলি বার বার একে দখল করেছে। নতুন চীন সৃষ্টির পূর্বে এই সাংহাই ছিল বিদেশী শক্তির বিলাসীদের আরাম, আয়েশ ও ফুর্তি করার শহর। হংকংয়ের মতই এর অবস্থা ছিল। নতুন চীন সরকার কঠোর হস্তে এসব দমন করেছে। সাংহাইতে অনেক শিল্প কারখানা আছে। সরকার কতগুলি শিল্প বাজেয়াপ্ত করেছে। যারা চিয়াং কাইশেকের ভক্ত ছিল, অনেকে পালিয়ে গেছে। আর কতগুলি শিল্প আছে যেগুলি বাজেয়াপ্ত করে নাই, তবে শ্রমিক ও মালিক যুক্তভাবে পরিচালনা করে। আমাদেরকে দুনিয়ার অন্যতম বিখ্যাত টেক্সটাইল মিল দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এটা তখন জাতীয়করণ করা হয়েছে। শ্রমিকদের থাকার জন্য অনেক নতুন নতুন দালান করা হয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল করা হয়েছে, চিকিৎসার জন্য আলাদা হাসপাতাল করা হয়েছে। বিরাট এলাকা নিয়ে কলোনি গড়ে তুলেছে। আমি কিছু সময় পীর সাহেবের সাথে সাথে দেখতে লাগলাম। পরে ইলিয়াসকে বললাম, “এগুলো তো আমাদের দেখাবে, আমি শ্রমিকদের বাড়িতে যাব এবং দেখব তারা কি অবস্থায় থাকে। আমাদের হয়ত শুধু ভাল জিনিসই এরা দেখাবে, খারাপ জিনিস দেখাবে না। ইলিয়াস বলল, “তাহলে তো ওদের বলতে হয়।” বললাম, “আগেই কথা বল না, হঠাৎ বলব এবং সাথে সাথে এক শ্রমিকের বাড়ির ভিতরে যাব।”।
পীর সাহেব তার পছন্দের অন্য কিছু দেখতে গেলেন। আমরা ইন্টারপ্রেটারকে বললাম, “এই কলোনির যে কোনও একটা বাড়ির ভিতরটা দেখতে চাই। এদের ঘরের ভিতরের অবস্থা আমরা দেখব।” আমাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে চলে গেল ইন্টারপ্রেটার এবং পাঁচ মিনিটের ভিতরেই এক ফ্ল্যাটে আমাদের নিয়ে চলল। আমরা ভিতরে যেয়ে দেখলাম, এক মহিলা আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমাদের অভ্যর্থনা করলেন, ভিতরে নিয়ে বসতে দিলেন। দুই তিনটা চেয়ার, একটা খাট, ভাল বিছানাএই মহিলাও শ্রমিক। মাত্র এক মাস পূর্বে বিবাহ হয়েছে, স্বামী মিলে কাজ করতে গেছে। বাড়িতে একলাই আছে, স্বামী ফিরে আসলে তিনিও কাজ করতে যাবেন। তিনি বললেন, “খুবই দুঃখিত, আমার স্বামী বাড়িতে নাই, খবর না দিয়ে এলেন, আপনাদের আপ্যায়ন করতে পারলাম না, একটু চা খান।” তাড়াতাড়ি চা বানিয়ে আনলেন। চীনের চা দুধ চিনি ছাড়াই আমরা খেলাম। ইন্টারপ্রেটার আমাদের বললেন, “ভেতরে চলুন, দুইখানা কামরাই দেখে যান।” আমরা দুইটা কামরাই দেখলাম। এতে একটা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি ভালভাবে বাস করতে পারে। আসবাপত্রও যা আছে তাতে মধ্যবিত্ত ঘরের আসবাবপত্র বলতে পারা যায়। একটা পাকের ঘর ও একটা গোসলখানা ও পায়খানা। আবার ফিরে এসে বসলাম। ইলিয়াসকে বললাম, “এদের বাড়ি দেখতে এসে বিপদে পড়লাম। সামান্য কয়েকদিন পূর্বে ভদ্রমহিলার বিবাহ হয়েছে, আমাদের সাথে কিছুই নাই যে উপহার দেই। এরা মনে করবে কি? আমাদের দেশের বদনাম হবে।” ইলিয়াস বলল, “কি করা যায়, আমি ভাবছি।” হঠাৎ আমার হাতের দিকে নজর পড়ল, হাতে আংটি আছে একটা। আংটি খুলে ইন্টারপ্রেটাকে বললাম, “আমরা এই সামান্য উপহার ভদ্রমহিলাকে দিতে চাই। কারণ, আমার দেশের নিয়ম কোনো নতুন বিবাহ বাড়িতে গেলে বর ও কনেকে কিছু উপহার দিতে হয়।” ভদ্রমহিলা কিছুতেই নিতে রাজি নয়, আমরা বললাম, “না নিলে আমরা দুঃখিত হব। বিদেশীকে দুঃখ দিতে নাই। চীনের লোক তো অতিথিপরায়ণ শুনেছি, আর দেখছিও।” আংটি দিয়ে বিদায় নিলাম। পীর সাহেবের কাছে হাজির হলাম এবং গল্পটি বললাম। পীর সাহেব খুব খুশি হলেন আংটি দেওয়ার জন্য।
পরের দিন সকালবেলা শ্রমিক মহিলা আর তার স্বামী কিংকং হোটেলে আমার সাথে দেখা করতে আসেন। হাতে ছোট্ট একটা উপহার। চীনের লিবারেশন পেন। আমি কিছুতেই নিতে চাইলাম না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিতে হল। এটা নাকি অদের দেশের নিয়ম। সাংহাইয়ের
শান্তি কমিটির সদস্যরা তখন উপস্থিত ছিল।
দুই-তিন দিন সমানে চলল ঘোরাফেরা। যদিও সাংহাইয়ের সে শ্ৰী নাই, বিদেশীরা চলে যাওয়ার পরে। তবুও যেটুকু আছে তার মধ্যে কৃত্রিমতা নাই। ঘষামাজা করে রঙ লাগালে যে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয় তাতে সত্যিকারের সৌন্দর্য নষ্ট হয়। নিজস্বতা চাপা পড়ে। এখন সাংহাইয়ের যা কিছু সবই চীনের নিজস্ব। এতে চীনের জনগণের পূর্ণ অধিকার। সমুদ্রগামী জাহাজও কয়েকখানা দেখলাম।
নতুন নতুন স্কুল, কলেজ গড়ে উঠেছে চারিদিকে। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ভার সরকার নিয়েছে। চীনের নিজস্ব পদ্ধতিতে লেখাপড়া শুরু করা হয়েছে।
সাংহাই থেকে আমরা হ্যাংচাতে আসলাম। হ্যাংচো পশ্চিহ্রদের পাড়ে। একে চীনের কাশ্মীর বলা হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ফুলে ফুলে ভরা এই দেশটা। লেকের চারপাশে শহর। আমাদের নতুন হোটেলে রাখা হয়েছে, লেকের পাড়ে। ছোট ছোট নৌকায় চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে চীন দেশের লোকেরা। তারা এখানে আসে বিশ্রাম করতে। লেকেরফাঁকে ফাঁকে মাঝে মধ্যে দ্বীপ আছে। হ্যাংচো ও ক্যান্টন দেখলে মনে হবে যেন পূর্ব বাংলা। সবুজের মেলা চারিদিকে। পীর সাহেব একদিন শুধু প্যাগোডা দেখলেন, পরের দিনও যাবেন অতি পুরাতন প্যাগোডাগুলি দেখতে। আমি ও ইলিয়াস কেটে পড়লাম। নৌকায় চড়ে লেকের চারিদিকে ঘুরে দেখতে লাগলাম। দ্বীপগুলির ভিতরে সুন্দরভাবে বিশ্রাম করার ব্যবস্থা রয়েছে। মেয়েরা এখানে নৌকা চালায়। নৌকা ছাড়া বর্ষাকালে এখানে চলাফেরার উপায় নাই। বড়, ছোট সকল অবস্থার লোকেরই নিজস্ব নৌকা আছে। আমি নৌকা বাইতে জানি, পানির দেশের মানুষ। আমি লেকে নৌকা বাইতে শুরু করলাম।
এক দ্বীপে আমরা নামলাম, সেখানে চায়ের দোকান আছে। আমরা চা খেয়ে লেকে ভ্রমণ শেষ করলাম। হ্যাংচো থেকে ক্যান্টন ফিরে এলাম। ক্যান্টন থেকে হংকং হয়ে দেশে ফিরব। এবার ক্যান্টনকে ভালভাবে দেখার সুযোগ পেলাম। চীন দেশের লোকের মধ্যে দেখলাম নতুন চেতনা। চোখে মুখে নতুন ভাব ও নতুন আশায় ভরা। তারা আজ গর্বিত যে তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক। এই ক্যান্টনেই ১৯১১ সালে সান ইয়েৎ সেনের দল আক্রমণ করে। ক্যান্টন প্রদেশের লোক খুবই স্বাধীনতাপ্রিয়। আমরা চীন দেশের জনগণকে ও মাও সে তুং-এর সরকারকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ইতিহাস বিখ্যাত চীন দেশ থেকে বিদায় নিলাম। আবার হংকং ইংরেজে-কলোনি, কৃত্রিম সৌন্দর্য ও কৃত্রিম মানুষ, চোরাকারবারিদের আড্ডা। দুই-তিন দিন এখানে থেকে তারপর দেশের দিকে হাওয়াই জাহাজে চড়ে রওয়ানা করলাম। ঢাকায় পৌঁছালাম নতুন প্রেরণা ও নতুন উৎসাহ নিয়ে। বিদেশে না গেলে নিজের দেশকে ভালভাবে চেনা কষ্টকর।
আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করেছে। আর চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য হল, তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ এবং এদেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন। ফলে দেশের জনগণের মধ্যে ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। একটা মাত্র পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল সাদা চামড়ার জায়গায় কালা চামড়ার আমদানি হয়েছে।
চীনের জনগণ সরকারের কাজে সাহায্য করছে এটা বুঝতে কষ্ট হল না। জনমত দেখলাম চীন সরকারের সাথে। চীন সরকার নিজেকে কমিউনিস্ট সরকার’ বলে ঘোষণা করে নাই, তারা তাদের সরকারকে নতুন গণতন্ত্রের কোয়ালিশন সরকার বলে থাকে। কমিউনিস্ট ছাড়াও অন্য মতাবলম্বী লোকও সরকারের মধ্যে আছে। যদিও আমার মনে হল কমিউনিস্টরা নিয়ন্ত্রণ করছে সকল কিছুই। আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্ব লুট করেছে—তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। বিশ্বশান্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করা তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
৭৫.
আমি ঢাকায় এসে পার্টির কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। মওলানা ভাসানী ও আমার সহকর্মীদের অনেকে আজও জেল থেকে মুক্তি পান নাই। বন্দি মুক্তি আন্দোলন জোরদার করা কর্তব্য হয়ে পড়েছে। পল্টন ময়দানে সভা দিলাম। আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে এক বিরাট সভা হল। আমি সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলাম। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরে এই আমার প্রথম সভা, যদিও আমাদের মুক্তির পরে ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে ছাত্রলীগ এক সভা করেছিল সদ্য কারামুক্ত কর্মীদের এখানে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভাও কয়েকটা হয়েছিল বিভিন্ন বাড়িতে।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানকে গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে খবর দিলাম, পূর্ব বাংলায় আসবার জন্য। তিনি আমাকে পূর্বেই কথা দিয়েছিলেন এক মাস সমস্ত প্রদেশ ঘুরবেন এবং জনসভায় বক্তৃতা করবেন। আমি প্রোগ্রাম করে তাঁকে জানালাম। সমস্ত জেলা হেডকোয়ার্টারে একটা করে সভা হবে এবং বড় বড় কতগুলি মহকুমায়ও সভার বন্দোবস্ত করা হল। তিনি ঢাকায় আসলেন, ঢাকায় জনসভায় বক্তৃতা করলেন। পাকিস্তান হওয়ার পরে বিরোধী দলের এত বড় সভা আর হয় নাই। তিনি পরিষ্কার ভাষায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা, বন্দি মুক্তি, স্বায়ত্তশাসনের সমর্থনে বক্তৃতা করলেন। সিলেট থেকে শুরু করে দিনাজপুর এবং বগুড়া থেকে বরিশাল প্রত্যেকটা জেলায়ই আওয়ামী লীগ কর্মীরা সভার আয়োজন করেছিল। একমাত্র রাজশাহীতে জনসভা হয় নাই, তবে নাটোরে হয়েছিল। রাজশাহীতে তখনও জেলা কমিটি করতে আমি পারি নাই। রাজশাহীর অনেক নেতা নাটোরে শহীদ সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং তাঁকে রাজশাহী নিয়ে গেলেন, সেখানে বসে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়া হল। এই সময় প্রায় প্রত্যেকটা মহকুমায় ও জেলায় আওয়ামী লীগ সংগঠন গড়ে উঠেছে। শহীদ সাহেবের সভার পরে সমস্ত দেশে এক গণজাগরণ পড়ে গেল। জনসাধারণ মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগ দলে যোগদান করতে শুরু করেছিল। শহীদ সাহেবের নেতৃত্বের প্রতি জনগণের ও শিক্ষিত সমাজের আস্থা ছিল। জনগণ বিশ্বাস করত শহীদ সাহেব একমাত্র নেতা যিনি দেশের বিকল্প নেতৃত্ব দিতে পারবেন এবং তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করতে পারলে দেশের ও জনগণের উন্নতি হবে। দেশের মধ্যে দুর্নীতি, অত্যাচার ও জুলুম চলছে। কোনো সুষ্ঠু উন্নতিমূলক কাজে সরকার হাত না দিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি শুরু করেছে। আমলাতন্ত্র ও ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি শুরু করেছে। খাজা সাহেবের দুর্বল শাসনব্যবস্থার জন্য তাদের মধ্যে উচ্চাকাক্ষা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, গোলাম মোহাম্মদ, নবাব শুরমানির মত পুরানা সরকারি কর্মচারীরা রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছে। পাঞ্জাবি আমলাতন্ত্রকে খুশি করার জন্য চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে অর্থমন্ত্রী করে খাজা সাহেব নিজেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। জনগণের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে এবং তারা শহীদ সাহেবের নেতৃত্বের উপর আস্থা প্রকাশ করতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতন্ত্র সফল হতে পারে না। এই সময় মুসলিম লীগ দলের মোকাবেলায় একমাত্র আওয়ামী লীগই বিরোধী দল হিসাবে গড়ে উঠতে লাগল। পশ্চিম পাকিস্তানেও একদল নিঃস্বার্থ নেতা ও কর্মী আওয়ামী লীগ গঠন করতে এগিয়ে এলেন পীর মানকী শরীফের নেতৃত্বে।
শহীদ সাহেব পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলায় ঘুরে ঘুরে প্রতিষ্ঠান গড়তে সাহায্য করতে লাগলেন। প্রত্যেকটা জনসভার পরেই আমি জেলা ও মহকুমার নেতাদের ও কর্মীদের নিয়ে আলোচনা সভা করে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গঠনে সাহায্য করতে লাগলাম। শহীদ সাহেবের পুরানা ভক্তরা প্রায়ই আওয়ামী লীগে যোগদান করতে লাগল; বিশেষ করে যুবক শ্রেণীর কর্মীরা এগিয়ে এল মুসলিম লীগ সরকারের অত্যাচারের মোকাবেলা করার জন্য। শত শত কর্মী জেলের মধ্যে দিনযাপন করছে নিরাপত্তা আইনে। প্রথমে জেলায় জেলায় চেষ্টা করেছে আমাদের সভায় গোলমাল সৃষ্টি করার জন্য, পরে আর পারে নাই। জনমত আওয়ামী লীগ ও শহীদ সাহেবের পক্ষে ছিল। এই সময় শহীদ সাহেব মওলানা ভাসানী ও অন্য রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির জন্য প্রবল জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মওলানা ভাসানীও এই সময় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন সারা পূর্ব পাকিস্তানে।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠন হলেও আজ পর্যন্ত কোন কাউন্সিল সভা হতে পারেও নাই, কারণ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সকলকেই প্রায় কারাগারে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে। আমি সমস্ত জেলা ও মহকুমা আওয়ামী লীগকে নির্দেশ দিলাম তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন শেষ করতে হবে। তারপর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সংগঠনের কর্মকর্তা নির্বাচন করবে এবং গঠনতন্ত্র ও ম্যানিফেস্টো গ্রহণ করবে। আমি দিনরাত সমানভাবে পরিশ্রম শুরু করলাম। শহীদ সাহেব যে সমস্ত মহকুমায় যেতে পারেন নাই আমি সেই সকল মহকুমায় সভা করে পার্টি গড়তে সাহায্য করলাম। জনগণ ও কর্মীদের থেকে সাড়া যে পেলাম তা প্রথমে কল্পনা করতে পারি নাই। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়বার কাজে সাহায্য করছিল এই জন্য যে, শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া সরকারের জুলুমকে মোকাবেলা করা কষ্টকর। আওয়ামী লীগ গড়ে উঠবার পূর্ব পর্যন্ত একমাত্র ছাত্রলীগই সরকারের অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত এবং জনগণ ও ছাত্রদের দাবি দাওয়া তুলে ধরত। ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে তাদের নেতা ও কর্মীদের অনেক অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছে। মুসলিম লীগ সরকার ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠানকে খতম করার জন্য চেষ্টার ক্রটি করে নাই। গণতান্ত্রিক যুবলীগও অলি আহাদের নেতৃত্বে জনমত সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিল।
৭৬.
১৯৫৩ সালের প্রথম দিক থেকে রাজনৈতিক ও ছাত্রকর্মীরা মুক্তি পেতে শুরু করল। শামসুল হক সাহেবও মুক্তি পেলেন, তখন তিনি অসুস্থ। তার যে কিছুটা মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়েছে কারাগারের বন্দি থেকে, তা বুঝতে কারও বাকি রইল না। তিনি কোনো গোলমাল করতেন না, তবে কিছু সময় কথা বললেই বোঝা যেত যে, এক কথা বলতে অন্য কথা বলতে শুরু করেন। আমরা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। একজন নিঃস্বার্থ দেশকর্মী, ত্যাগী নেতা আজ দেশের কাজ করতে যেয়ে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে থেকে পাগল হয়ে বের হলেন। এ দুঃখের কথা কোথায় বলা যাবে? পাকিস্তান আন্দোলনে তার অবদান যারা এখন ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। বাংলাদেশে যে কয়েকজন কর্মী সর্বস্ব দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলন করেছে তাদের মধ্যে শামসুল হক সাহেবকে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মী বললে বোধহয় অন্যায় হবে না। ১৯৪৩ সাল থেকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানকে জমিদার, নবাবদের দালানের কোঠা থেকে বের করে জনগণের পর্ণকুটিরে যারা নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শামসুল হক সাহেব ছিলেন অন্যতম। একেই বলে কপাল, কারণ সেই পাকিস্তানের জেলেই শামসুল হক সাহেবকে পাগল হতে হল।
আমি অনেকের সাথে পরামর্শ করে তার চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। উল্টা আমার উপর ক্ষেপে গেলেন। আমি তখন তাকে প্রতিষ্ঠানের জেনারেল সেক্রেটারির ভার নিতে অনুরোধ করলাম। কার্যকরী কমিটির সভা ডেকে তাকে অনুরোধ করলাম, কারণ এতদিন আমি এ্যাকটিং জেনারেল সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করছিলাম। ভাবলাম, কাজের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লে তিনি ভাল হয়ে যেতে পারেন। তিনি সভায় উপস্থিত হলেন এবং বললেন, “আমি প্রতিষ্ঠানের জেনারেল সেক্রেটারির ভার নিতে পারব না, মুজিব কাজ চালিয়ে যাক।” আজেবাজে কথাও বললেন, যাতে সকলেই বুঝতে পারলেন যে, তাঁর মাথায় কিছুটা গোলমাল হয়েছে। আমি কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম। ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় হক সাহেবকে সভাপতিত্ব করার জন্য জোর করেই উপস্থিত করলাম। তিনি এমন এক বক্তৃতা করলেন যাতে সকলেই দুঃখ পেলাম। কারণ তিনি নিজকে সমস্ত দুনিয়ার খলিফা বলে ঘোষণা করলেন। আমরা হতাশ হয়ে পড়লাম, কি করে তার চিকিৎসা করানো যাবে? আরও অসুবিধায় পড়লাম, হক সাহেবের স্ত্রী প্রফেসর আফিয়া খাতুন বিদেশে লেখাপড়া করতে যাওয়ায়। তিনি থাকলে হয়ত কিছুটা ব্যবস্থা করা যেত।
ইয়ার মোহাম্মদ খান আমাকে সাহায্য করতে লাগলেন। তাঁর সমর্থন ও সাহায্য না পেলে খুবই অসুবিধা ভোগ করতে হত। মানিক ভাই ইত্তেফাক কাগজকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। সাপ্তাহিক কাগজ হলেও শহরে ও গ্রামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান অবজারভার কাগজও আমাদের সংবাদ কিছু কিছু দিত। মুসলিম লীগ ও মুসলিম লীগ সরকার জনপ্রিয়তা দ্রুত হারিয়ে ফেলেছিল। আমি বুঝতে পারলাম, এখন শুধু সুষ্ঠু নেতৃত্ব ও সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। এই সুযোেগ আমি ও আমার সহযোগীরা পুরাপুরি গ্রহণ করলাম এবং দেশের প্রায় শতকরা সত্তরটা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হলাম। যুবক কর্মীরা আমার দিকে ঝুঁকে পড়ল। কারণ আমিও তখন যুবক ছিলাম। ভাসানী সাহেব ও আওয়ামী লীগ কর্মীরা অনেকেই মুক্তি পেলেন। আমি মওলানা ভাসানী ও আতাউর রহমান খানের সাথে কাউন্সিল সভা সম্পর্কে পরামর্শ করলাম। কাউন্সিল সভা তাড়াতাড়ি করা প্রয়োজন একথা তারাও স্বীকার করলেন। প্রথম কাউন্সিল সভা ডাকা হল ঢাকায়। হল পাওয়া খুবই কষ্টকর। ইয়ার মোহাম্মদ খানের সাহায্যে মুকুল সিনেমা হল পেতে কষ্ট হল না। কাউন্সিল সদস্যদের থাকার জন্য কোন জায়গা না পেয়ে বড় বড় নৌকা ভাড়া করলাম সদরঘাটে। ঠিক হল সোহরাওয়ার্দী সাহেব কাউন্সিলে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন।
কাউন্সিল সভার দিন যতই ঘনিয়ে আসছিল আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রবীণ নেতা এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন, যাতে আমাকে জেনারেল সেক্রেটারি না করা হয়। আমি এ সম্বন্ধে খোঁজখবর রাখতাম না, কারণ প্রতিষ্ঠানের কাজ, টাকা জোগাড়, কাউন্সিলারদের থাকার বন্দোবস্তসহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হত। আবদুস সালাম খান, ময়মনসিংহের হাশিমউদ্দিন আহমদ, রংপুরের খয়রাত হোসেন, নারায়ণগঞ্জের আলমাস আলী ও আবদুল আউয়াল এবং আরও কয়েকজন এই ষড়যন্ত্রের নায়ক ছিলেন। প্রতিষ্ঠানের জন্য টাকা পয়সা এরা দিতেন না, বা জোগাড় করতেন না। প্রতিষ্ঠানের কাজও ভালভাবে করতেন না। তবে আমি যাতে জেনারেল সেক্রেটারি না হতে পারি তার জন্য অর্থ ব্যয় করতেন। সালাম সাহেবের অসন্তুষ্ট হবার প্রধান কারণ ছিল আমি নাকি তাকে ইমপর্টেন্স না দিয়ে আতাউর রহমান খান সাহেবকে দেই। আমি এ সমস্ত পছন্দ করতাম না, তাই আতাউর রহমান সাহেবকে কাউন্সিল সভার প্রায় পনের দিন পূর্বে একাকী বললাম, “আপনি জেনারেল সেক্রেটারি হতে রাজি হন; আমার পদের দরকার নাই। কাজ তো আমি করছি এবং করব, আপনার কোনো অসুবিধা হবে না।” আতাউর রহমান সাহেব বললেন, “আমি এত সময় কোথায় পাব? সকল কিছু ছেড়ে দিয়ে কাজ করার উপায় আমার নাই। এখন যে জেনারেল সেক্রেটারি হবে তার সর্বক্ষণের জন্য পার্টির কাজ করতে হবে। আপনি ছাড়া কেউ এ কাজ পারবে না, আপনাকেই হতে হবে। আমি বললাম, “কয়েকজন নেতা তলে তলে ষড়যন্ত্র করছে। তারা বলে বেড়ান একজন বয়েসী লোকের জেনারেল সেক্রেটারি হওয়া দরকার। দুঃখের বিষয় এই ভদ্রলোকদের এতটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ নাই যে, আমি জেল থেকে বের হয়ে রাতদিন পরিশ্রম করে প্রতিষ্ঠানের একটা রূপ দিয়েছি।” আতাউর রহমান সাহেব বললেন, “ছেড়ে দেন ওদের কথা, কাজ করবে না শুধু বড় বড় কথা বলতে পারে সভায় এসে।” আমি বললাম, “চিন্তা করে দেখেন; একবার যদি আমি ঘোষণা করে দেই যে, আমি প্রাথী তখন কিন্তু আর কারও কথা শুনব না।” তিনি বললেন, “আপনাকেই হতে হবে।” আতাউর রহমান সাহেব জানতেন, তার জন্যই সালাম সাহেব আমার উপর ক্ষেপে গেছেন। মওলানা সাহেব আমাকে জেনারেল সেক্রেটারি করার পক্ষপাতী। তাকেও আমি বলেছিলাম, আমি ছাড়া অন্য কাউকে ঠিক করতে, তিনি রাজি হলেন না এবং বললেন, “তোমাকেই হতে হবে।” শহীদ সাহেব করাচিতে আছেন, তিনি এ সমস্ত বিষয় কিছুই জানতেন না।
১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে জনাব আবুল হাশিম পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। তার অনেক সহকর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়। এই সময় জেলে তিনি অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের সাথে প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে আলোচনা করতে সুযোগ পান।
আমার বিরোধী গ্রুপ অনেক চেষ্টা করেও কোনো প্রার্থী দাঁড় করাতে পারছিলেন না। কেউই সাহস পাচ্ছিল না, আমার সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করতে। কারণ তারা জানেন, কাউন্সিলাররা আমাকেই ভোট দিবে। ভদ্রলোকেরা তাই নতুন পন্থা অবলম্বন করলেন। তারা আবুল হাশিম সাহেবের কাছে ধরনা দিলেন এবং তাঁকে আওয়ামী লীগে যোগদান করতে ও সাধারণ সম্পাদক হতে অনুরোধ করলেন। হাশিম সাহেব রাজি হলেন এবং বললেন, তার কোনো আপত্তি নাই, তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হতে হবে। তিনি মওলানা ভাসানী সাহেবকে খাবার দাওয়াত করলেন। তাকে যে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা এ ব্যাপারে অনুরোধ করেছেন তাও বললেন এবং মওলানা সাহেবের মতামত জানতে চাইলেন। মওলানা সাহেব তাকে বললেন, “সাধারণ সম্পাদক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করা যাবে কি না সন্দেহ, কারণ মুজিবের আপনার সম্বন্ধে খুব খারাপ ধারণা। তবে যদি সভাপতি হতে চান, আমি ছেড়ে দিতে রাজি আছি।” মওলানা সাহেব একথা আমাকে বলেছিলেন।
কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশন হওয়ার পরে মওলানা ভাসানী ঘোষণা করলেন, আমাদের চারজনের নামসর্বজনাব আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, আবুল মনসুর আহমদ ও আমি। এই চারজন আলাদা বসে সর্বসম্মতিক্রমে একটা লিস্ট করে আনবে কর্মকর্তাদের নামের। কাউন্সিল সভার একদিন পূর্বে আমার বিরোধী গ্রুপ আতাউর রহমান সাহেবকে অনুরোধ করলেন সাধারণ সম্পাদক হতে। আতাউর রহমান সাহেব একটু নিমরাজি হয়ে পড়লেন এবং আমার সাথে পরামর্শ করবেন বলে দিলেন। আতাউর রহমান সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, তাঁদের অনুরোধের কথা। আমি তাঁকে বলে দিলাম এখন আর সময় নাই, পূর্বে হলে রাজি হতাম। তাদের কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বলেন। আতাউর রহমান সাহেব তাদের জানিয়ে দিলেন। তাঁরা মওলানা সাহেবের কাছে অনুরোধ করলে, তিনি চারজনের উপর কমিটির নাম প্রস্তাব করার ভার দেয়ার কথা বললেন। তবে তা সর্বসম্মতিক্রমে হতে হবে। আলোচনা সভা বেশি সময় চলল না, কারণ অন্য কোনো নাম তারা প্রস্তাব করতে পারলেন না। আমি কাউন্সিল সভায় উপস্থিত হয়ে ভাসানী সাহেবকে জানিয়ে দিলাম, নির্বাচন হবে। একমত হতে পারা গেল না। আতাউর রহমান সাহেব আমাকে সমর্থন করলেন। আমরা ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র নিয়ে সমস্ত রাত আলোচনা করলাম সাবজেক্ট কমিটিতে। কাউন্সিল সভায় ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র গ্রহণ করা হল এবং নির্বাচনও সর্বসম্মতিক্রমে হয়ে গেল। মওলানা ভাসানী সভাপতি, আতাউর রহমান সাহেব সহ-সভাপতি, আমি সাধারণ সম্পাদক (ম্যানিফেস্টো আমার কাছে এখন নাই, পরে তুলে দিব)।২৫ এখন আওয়ামী লীগ একটা সত্যিকারের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে জনগণের সামনে দাঁড়াল। ম্যানিফেস্টো বা ঘোষণাপত্র না থাকলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।
এর পূর্বে আমরা লাহোরে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কনফারেন্সে যোগদান করি। সেখানে জমিদারি প্রথা বিলোপ এবং অন্যান্য প্রোগ্রাম নিয়ে নবাব মামদোতের সাথে একমত হতে না পারায় নবাব সাহেব আওয়ামী লীগ ত্যাগ করলেন।
পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরাট প্রভেদ রয়েছে। সেখানে রাজনীতি করে সময় নষ্ট করার জন্য জমিদার, জায়গিরদার ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা। আর পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতি করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। পশ্চিম পাকিস্তানে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত থাকার জন্য জনগণ রাজনীতি সম্বন্ধে বা দেশ সম্বন্ধে কোনো চিন্তাও করে না। জমিদার বা জায়গিরদার অথবা তাদের পীর সাহেবরা যা বলেন, সাধারণ মানুষ তাই বিশ্বাস করে। বহুকাল থেকে বাংলাদেশে কৃষক আন্দোলন হওয়াতে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের চেয়ে অনেকটা বেশি। এছাড়াও স্বাধীনতা আন্দোলনেও বাঙালিরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে দীর্ঘকাল যাবৎ গ্রাম পঞ্চায়েত প্রথা, তারপর ইউনিয়ন বোর্ড, লোকাল বোর্ড ও ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড থাকাতে জনগণের মধ্যেও রাজনৈতিক শিক্ষা অনেক পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। শিক্ষিতের সংখ্যা বেশি না থাকলেও বাঙালিরা অজ্ঞ বা অসচেতন ছিল না। ভালমন্দ বিচার করার ক্ষমতা তাদের ছিল এবং এর প্রমাণও করেছিল ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান দাবির উপরে সাধারণ নির্বাচনের সময়।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজ সমর্থন দিল। মুসলিম লীগের ভিতর তখন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চরম আকার ধারণ করেছিল। ব্রিটিশ আমলের আমলাদের রাজনীতিতে স্থান দিয়ে তারা ষড়যন্ত্রের জালে আটকে পড়েছিল। তাই প্রতিষ্ঠানের ভিতর আত্মকলহ দেখা দিল প্রবলভাবে। ছোট ছোট উপদলে ভাগ হয়ে পড়েছিল দলটি। নীতির কোন বালাই ছিল না, একমাত্র আদর্শ ছিল ক্ষমতা আঁকড়িয়ে থাকা। জেলায় ও মহকুমার পুরানা নেতাদের কোনো সংগ্রামী ঐতিহ্য যেমন ছিল না, তেমনি দুনিয়া যে এগিয়ে চলেছে সেদিকে খেয়াল ছিল না কারও। শুধু ক্ষমতায় থাকা যায় কি করে সেই একই চিন্তা।
৭৭.
এদিকে পূর্ব বাংলার সম্পদকে কেড়ে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে কত তাড়াতাড়ি গড়া যায়, একদল পশ্চিমা.তথাকথিত কেন্দ্রীয় নেতা ও বড় বড় সরকারি কর্মচারী গোপনে সে কাজ করে চলেছিল। তাদের একটা ধারণা ছিল, পূর্ব বাংলা শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে থাকবে না। তাই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তুলতে হবে।
আওয়ামী লীগ যখন হিসাব-নিকাশ বের করে প্রমাণ করল যে, পূর্ব বাংলাকে কি করে শোষণ করা হচ্ছে তখন তারা মরিয়া হয়ে উঠল এবং আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের উপর চরম অত্যাচার করতে আরম্ভ করল। এদিকে জনগণ মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান ও সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠছিল। পূর্ব বাংলায় তখন মুসলিম লীগের নাভিশ্বাস শুরু হয়েছে।
খাজা সাহেবের আমলে পালাবে এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। তাতে হাজার হাজার লোক মারা যায়। লাহোরে মার্শাল ল জারি করা হয়। আহমদিয়া বা কাদিয়ানি বিরোধী আন্দোলন থেকে এই দাঙ্গা শুরু হয়। কয়েকজন বিখ্যাত আলেম এতে উসকানি দিয়েছিলেন। কাদিয়ানিরা মুসলমান না’—এটাই হল এই সকল আলেমদের প্রচার। আমার এ সম্বন্ধে বিশেষ কোনো ধারণা নাই। তবে একমত না হওয়ার জন্য যে অন্যকে হত্যা করা হবে, এটা যে ইসলাম পছন্দ করে না এবং একে অন্যায় মনে করা হয়এটুকু ধারণা আমার আছে। কাদিয়ানিরা তো আল্লাহ ও রসুলকে মানে। তাই তাদের তো কথাই নাই, এমনকি বিধর্মীর উপরও অন্যায়ভাবে অত্যাচার করা ইসলামে কড়াভাবে নিষেধ করা আছে। লাহোরে ও অন্যান্য জায়গায় জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে স্বামী, স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে একসাথে ফেলে দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। যারা এই সমস্ত জঘন্য দাঙ্গার উসকানি দিয়েছিল তারা আজও পাকিস্তানের রাজনীতিতে সশরীরে অধিষ্ঠিত আছে।
পাকিস্তান হবে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী বা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান নাগরিক অধিকার থাকবে। দুঃখের বিষয়, পাকিস্তান আন্দোলনের যারা বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, এখন পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র করার ধুয়া তুলে রাজনীতিকে তারাই বিষাক্ত করে তুলেছে। মুসলিম লীগ নেতারাও কোনো রকম অর্থনৈতিক ও সমাজনৈতিক প্রোগ্রাম না দিয়ে একসঙ্গে যে শ্লোগান দিয়ে ব্যস্ত রইল, তা হল ইসলাম’। পাকিস্তানের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ যে আশা ও ভরসা নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন, তথা পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে কোন নজর দেওয়াই তারা দরকার মনে করল না। জমিদার ও জায়গিরদাররা যাতে শোষণ করতে পারে সে ব্যাপারেই সাহায্য দিতে লাগল। কারণ, এই শোষক লোকেরাই এখন মুসলিম লীগের নেতা এবং এরাই সরকার চালায়।
অন্যদিকে পূর্ব বাংলার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে প্ল্যান প্রোগ্রাম করেই পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে সাহায্য করতে লাগল। ফলে একদল শিল্পপতি গড়ে তুলতে শুরু করল, যারা লাগাম ছাড়া অবস্থায় যত ইচ্ছা মুনাফা আদায় করতে লাগল জনসাধারণের কাছ থেকে এবং রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেল। করাচি বসে ইমপোর্ট ও এক্সপোর্ট ব্যবসার নাম করে লাইসেন্স বিক্রি করে বিপুল অর্থ উপার্জন করে আস্তে আস্তে অনেকে শিল্পপতি হয়ে পড়ছেন। এটাও মুসলিম লীগ সরকারের কীর্তি এবং খাজা সাহেবের দুর্বল নেতৃত্বও এর জন্য কিছুটা দায়ী। কারণ তিনি কোনোদিন বোধহয় সরকারি কর্মচারীদের অযৌক্তিক প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করতে পারেন নাই। এদিকে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর মত ঘুঘু সরকারি কর্মচারীকে অর্থমন্ত্রী করে তিনি তাঁর উপর নির্ভর করতে শুরু করেছিলেন শুনেছি; ঠিক কি না বলতে পারি না, তবে কিছুটা সত্য হলেও হতে পারে। মরহুম ফজলুর রহমান সাহেবও তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। তিনি চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। খাজা সাহেবের মন্ত্রীদের মধ্যে দুইটা দল হয়েছিল। ফজলুর রহমান সাহেব একটা দলের নেতৃত্ব করতেন, যাকে বাঙালি দল’ বলা হত। আরেকটা দল চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে ছিল যাকে পাঞ্জাবি দল’ বলা হত। বাঙালি তথাকথিত নেতারা কেন্দ্রীয় রাজধানী, মিলিটারি হেডকোয়ার্টারগুলি, সমস্ত বড় বড় সরকারি পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য পাঞ্জাবি ভাইদের হাতে দিয়েও গোলাম মোহাম্মদ ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে খুশি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। গণপরিষদে বাঙালিরা ছয়টা সিট পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের দিয়েও সংখ্যাগুরু ছিলেন। তারা ইচ্ছা করলে পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে পারতেন। তাঁরা তা না করে তাঁদের গদি রক্ষা করার জন্য এক এক করে সকল কিছু তাদের পায়ে সমর্পণ করেও গদি রাখতে পারলেন না। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বুঝতে পেরেছেন, এদের কাছ থেকে যতটুকু নেওয়ার নেওয়া হয়েছে। এখন নতুন লোকদের নেওয়া প্রয়োজন, পুরানরা আর দিতে চাইবে না। কারণ, এরা এদের চিনতে পেরেছে বোধহয়। পূর্ব বাংলার নেতাদের দিয়ে এমন সকল কাজ করিয়েছে যে, এদের আর পূর্ব বাংলার জনগণ বিশ্বাস করবে না। ধাক্কা দিলেই এরা পড়ে যাবে। যেমন খাজা সাহেবকে দিয়ে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করিয়ে তার উপর বাঙালিদের যতটুকু আস্থা ছিল তাও খতম করতে সক্ষম হয়েছিল। এবার তাই নতুন চাল চালতে শুরু করল। ঘাগু ব্রিটিশ আমলের সরকারি আমলাদের কূটবুদ্ধির কাছে এরা টিকবে কেমন করে? জনগণের আস্থা হারিয়ে এরা সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল আমলাতন্ত্রের উপরে, যারা সকলেই প্রায় পশ্চিম পাকিস্তান তথা পাত্তাবের অধিবাসী।
১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে গভর্নর জেনারেল জনাব গোলাম মোহাম্মদ ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের সভাপতি, গণপরিষদ ও পার্লামেন্টের সংখ্যাগুরু দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনকে বরখাস্ত করে আমেরিকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আলী বগুড়াকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করলেন, যদিও মোহাম্মদ আলী গণপরিষদের সদস্য ছিলেন না। এমনকি মুসলিম লীগেরও সভ্য ছিলেন না। ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি পাকিস্তানের বাইরেই ছিলেন, দেশের মানুষের কোন খবরই রাখতেন না।
আমার মনে আছে, এই দিন আওয়ামী লীগ ঢাকার পল্টন ময়দানে এক সভা করছিল। সোহরাওয়ার্দী সাহেব বক্তৃতা করছিলেন। বহু জনসমাগম হয়েছিল। শহীদ সাহেব যখন বক্তৃতা করছিলেন, তখন কে একজন এসে খবর দিল, এই মাত্র রেডিওর খবরে বলেছে নাজিমুদ্দীন সাহেবকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। শহীদ সাহেব জনসাধারণকে বললেন, “আজ পাকিস্তানের একটা বিরাট খবর আছে। সভা শেষে যখন শহীদ সাহেবকে নিয়ে ফিরছিলাম, তিনি বললেন, “নাজিমুদ্দীন সাহেবকে বরখাস্ত করেছে, তবে এতে খুশি হবার কিছুই নাই।” আমি শহীদ সাহেবকে বললাম, “এটা খাজা সাহেব আর তাঁর দলবলের প্রাপ্য।” শহীদ সাহেব বললেন, “যা, শাসনতন্ত্র না দিয়ে এবং সাধারণ নির্বাচন না করে এরা পাকিস্তানকে ষড়ন্ত্রের রাজনীতিতে জড়িয়ে ফেলেছে। আরও অনেক বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছিলাম। যাহোক, অগণতান্ত্রিকভাবে খাজা সাহেবকে ডিসমিস করার প্রতিবাদ মুসলিম লীগ নেতারা করলেন না। এক এক করে তাদের নেতাকে ছেড়ে দিয়ে ক্ষমতার লোভে মোহাম্মদ আলী সাহেবকে নেতা মেনে নিলেন। এমন কি মুসলিম লীগের সভাপতির পদও খাজা সাহেবকে ত্যাগ করতে হল। মুসলিম লীগ নেতারা মোহাম্মদ আলী বগুড়াকে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি করে নিলেন, একজনও প্রতিবাদ করলেন না। আমার মনে আছে, এমন অগণতান্ত্রিকভাবে নাজিমুদ্দীন সাহেবকে বরখাস্ত করার প্রতিবাদ একমাত্র পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগই করেছিল।
পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমিন খাজা সাহেবের বিশ্বস্ত ভক্ত ছিলেন। তিনি ও অন্যান্য প্রদেশের মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রীরাও মোহম্মদ আলী সাহেবকে আনুগত্য জানালেন এবং একমাত্র নেতা হিসাবে গ্রহণ করে নিলেন। এই ঘটনার পরে আর কোনো শিক্ষিত মানুষ বা বুদ্ধিজীবীদের মুসলিম লীগের উপর আস্থা থাকার কারণ ছিল না। এটা যে একটা সুবিধাবাদী ও সুযোগ সন্ধানীদের দল তাই প্রমাণ হয়ে গেল। গোলাম মোহাম্মদ বড়লাট হয়ে এ সাহস কোথা থেকে পেয়েছিলেন? বড় বড় সরকারি কর্মচারী এবং এক অদৃশ্য শক্তি তাকে অভয় দিয়েছিল এবং দরকার হলে তার পেছনে দাঁড়াবে সে প্রতিশ্রুতিও তিনি পেয়েছিলেন। মুসলিম লীগ নেতা ও কর্মীদের চরিত্র সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল। খাজা সাহেবের সমর্থকরা একে একে মোহম্মদ আলী সাহেবের মন্ত্রিত্বে যোগদান করলেন। খাজা। সাহেব নিজেও এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস পেলেন না। ১৯৪৬ সালে যেমন চুপটি করে ঘরে বসে পড়েছিলেন, এবারও তিনি বিশ্রাম গ্রহণ করলেন—যদি কোনোদিন সুযোগ আসে তখন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবেন, এই ভরসায়।
মোহাম্মদ আলীর (বগুড়া) মধ্যে কোনো রাজনৈতিক চেতনা ছিল না। তার মধ্যে কোনো গভীরতাও ছিল না। শুধু আমেরিকা থেকে তিনি আমেরিকানদের মত কিছু হাবভাব ও হাঁটাচলা আর কাপড় পরা শিখে এসেছিলেন। গোলাম মোহাম্মদ যা বলেন, তাতেই তিনি রাজি। আর আমেরিকানরা যে বুদ্ধি দেয় সেইটাই তিনি গ্রহণ করে চলতে লাগলেন। আমেরিকান শাসকগোষ্ঠীরা যেমন সকল কিছুর মধ্যে কমিউনিস্ট দেখতেন, তিনিও তাই দেখতে শুরু করলেন। প্রথমে তিনি শহীদ সাহেবকে তাঁর রাজনৈতিক পিতা’ বলে সম্বােধন করলেন, পরে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করলেন।
৭৮.
মওলানা ভাসানী, আমি ও আমার সহকর্মীরা সময় নষ্ট না করে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। পূর্ব বাংলার জেলায়, মহকুমায়, থানায় ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে এক নিঃস্বার্থ কর্মীবাহিনী সৃষ্টি করতে সক্ষম হলাম। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্ররা মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মন প্রাণ দিয়ে রুখে দাঁড়াল। দেশের মধ্যে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছিল। শাসনযন্ত্র শিথিল হয়ে গিয়েছিল। সরকারি কর্মচারীরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারত। খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করে। বেকার সমস্যা ভীষণভাবে দেখা দিয়েছে। শাসকদের কোন প্ল্যান প্রোগাম নাই। কোনোমতে চললেই তারা খুশি। পূর্ব বাংলার মন্ত্রীরা কোথাও সভা করতে গেলে জনগণ তাদের বক্তৃতা শুনতেও চাইত না। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির কথা কেউই ভুলে নাই। আমরা তাড়াতাড়ি শাসনতন্ত্র করতে জনমত সৃষ্টি করতে লাগলাম। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা না মেনে নিলে আমরা কোনো শাসনতন্ত্র মানব না। এসময় ফজলুর রহমান সাহেব আরবি হরফে বাংলা লেখা পদ্ধতি চালু করতে চেষ্টা করছিলেন। আমরা এর বিরুদ্ধেও জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কোনো কোনো মুসলিম লীগ নেতা এককেন্দ্রিক সরকার গঠনের জন্য তলে তলে প্রপাগান্ডা করছিলেন। আওয়ামী লীগ ফেডারেল শাসনতন্ত্র ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির ভিত্তিতে প্রচার শুরু করে জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল।
বিনা বিচারে কাউকে বন্দি করে রাখা অন্যায়। ফলে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিল। প্রগতিশীল যুবক কর্মীরাও আওয়ামী লীগে যোগদান করতে আরম্ভ করছিল। ১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচন হবে। ঘোষণা করা হল। আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ রইল না। গণতান্ত্রিক দল’ নামে একটা রাজনৈতিক দল করা হয়েছিল, তা কাগজপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। জনাব এ, কে, ফজলুল হক সাহেব তখন পর্যন্ত এডভোকেট জেনারেল ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের। পাকিস্তান হওয়ার পরে আর তিনি কোনো রাজনীতি করেন নাই। ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি এডভোকেট জেনারেলের পদ থেকে পদত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। মুসলিম লীগের মধ্যে তখন কোন্দল শুরু হয়েছিল ভীষণভাবে। মোহন মিয়া সাহেব নূরুল আমিন সাহেবের বিরুদ্ধে গ্রুপ সৃষ্টি করেন এবং হক সাহেবকে মুসলিম লীগের সভাপতি করতে চেষ্টা করে পরাজিত হন। কার্জন হলে দুই গ্রুপের মধ্যে বেদম মারপিটও হয়। নূরুল আমিন সাহেবের দলই জয়লাভ করে, ফলে মোহন মিয়া ও তাঁর দলবল লীগ থেকে বিতাড়িত হলেন।
এরপর আমি হক সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে আওয়ামী লীগে যোগদান করতে অনুরোধ করলাম। চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের এক জনসভায় তিনি যোগদানও করলেন। সেখানে ঘোষণা করলেন, “যাঁরা চুরি করবেন তারা মুসলিম লীগে থাকুন, আর যারা ভাল কাজ করতে চান তারা আওয়ামী লীগে যোগদান করুন। আমাকে ধরে জনসভায় বললেন, “মুজিব যা বলে তা আপনারা শুনুন। আমি বেশি বক্তৃতা করতে পারব না, বুড়া মানুষ।” এ বক্তৃতা খবরের কাগজেও উঠেছিল।
এই সময় আওয়ামী লীগের মধ্যে সেই পুরাতন গ্রুপ যুক্তফ্রন্ট করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আবদুস সালাম খান, ময়মনসিংহের হাশিমউদ্দিন ও আরও কয়েকজন এজন্য প্রচার শুরু করলেন। এদিকে তথাকথিত প্রগতিশীল এক গ্রুপও বিরোধী দলের ঐক্য হওয়া উচিত বলে চিল্কার আরম্ভ করলেন। অতি প্রতিক্রিয়াশীল ও অতি প্রগতিবাদীরা এই জায়গায় একমত হয়ে গেল। কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল তখন ছিল না–একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া—যার নাম জনসাধারণ জানে। ভাসানী সাহেব ও আমি পরামর্শ করলাম, কি করা যায়। তিনি আমাকে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিলেন, যদি হক সাহেব আওয়ামী লীগে আসেন তবে তাঁকে গ্রহণ করা হবে এবং উপযুক্ত স্থান দেওয়া যেতে পারে। আর যদি অন্য দল করেন তবে কিছুতেই তার সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট করা চলবে না। যে লোকগুলি মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত হয়েছে তারা এখন হক সাহেবের কাঁধে ভর করতে চেষ্টা করছে। তাদের সাথে আমরা কিছুতেই মিলতে পারি না। মুসলিম লীগের সমস্ত কুকার্যের সাথে এরা ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জড়িত ছিল। এরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতাও করেছে। মওলানা সাহেব আমাদের অনেকের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আমাকে বলে দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সদস্যদের মধ্যে যেন যুক্তফ্রন্ট সমর্থকরা মাথা তুলতে না পারে।
ওয়ার্কিং কমিটির সভায় এ সম্বন্ধে অনেক আলোচনা হল। বেশি সংখ্যক সদস্যই যুক্তফ্রন্টের বিরোধী। কারণ, যাদের সাথে নীতির মিল নাই, তাদের সাথে মিলে সাময়িকভাবে কোনো ফল পাওয়া যেতে পারে, তবে ভবিষ্যতে ঐক্য থাকতে পারে না। তাতে দেশের উপকার হওয়ার চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়ে থাকে। আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা এই একতা চাচ্ছিল, তাদের উদ্দেশ্য মুসলিম লীগকে পরাজিত করা এবং ক্ষমতায় যে কোনোভাবে অধিষ্ঠিত হওয়া। ক্ষমতায় না গেলে চলে কেমন করে, আর কতকাল বিরোধী দল করবে।
অতি প্রগতিবাদীদের কথা আলাদা। তারা মুখে চায় ঐক্য। কিন্তু দেশের জাতীয় নেতাদের জনগণের সামনে হেয়প্রতিপন্ন করতে এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি যাতে জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলে, চেষ্টা করে সেজন্য। তাহলেই ভবিষ্যতে জনগণকে বলতে পারে যে, এ নেতাদের ও তাদের দলগুলি দ্বারা কোনো কাজ হবে না। এরা ঘোলা পানিতে মাছ ধরবার চেষ্টা করতে চায়।
মুসলিম লীগ জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এই দলটার কোনো নীতির বালাই নাই। ক্ষমতায় বসে করে নাই এমন কোন জঘন্য কাজ নাই। পরিষ্কারভাবে জনগণ ও পূর্ব বাংলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এই দল হতে যে লোকগুলি বিতাড়িত হয়েছিল তারা এই জঘন্য দলের সভ্যদের মধ্যেও টিকতে পারে নাই। এরা কতটুকু গণবিরোধী হতে পারে ভাবতেও কষ্ট হয়। এরা নীতির জন্য বা আদর্শের জন্য মুসলিম লীগ ত্যাগ করে নাই, ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে। এই বিতাড়িত মুসলিম লীগ সভ্যরা পাকিস্তান হওয়ার পরে একদিনের জন্যও সরকারের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করে নাই। এমনকি সরকার থেকে সুযোগ-সুবিধাও গ্রহণ করেছে। তারা চেষ্টা করতে লাগল যাতে হক সাহেবের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের সাথে দরকষাকষি করতে পারে।
হক সাহেব আওয়ামী লীগে যোগদান করবেন ঠিক করে ফেলেছিলেন। এমনকি অনেকের কাছে বলেওছিলেন। এই লোকগুলি হক সাহেবের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে তাঁকে বোঝাতে লাগল, আলাদা দল করে যুক্তফ্রন্ট করলে সুবিধা হবে। আওয়ামী লীগ তাঁকে উপযুক্ত স্থান দিবে না। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাকে প্রধানমন্ত্রী নাও করতে পারেন, এমনই নানা কথা। তাদের নিজের দল হলে আওয়ামী লীগ বাধা দিলেও মুসলিম লীগের সাথে মিলতে পারবে নির্বাচনের পরে। মুসলিম লীগও কিছু আসন নির্বাচনে দখল করতে পারবে। প্রথমে আওয়ামী লীগের সাথে মিলে নির্বাচন করে নেওয়া যাক, তারপর দেখা যাবে। পথ খোলা থাকলে যে কোনো পন্থা অবলম্বন করা যাবে। যদিও হক সাহেবকে আমরা জানিয়ে দিয়েছিলাম, তিনি পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক আইন পরিষদে আওয়ামী লীগের নেতা হবেন, শহীদ সাহেব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনসভার নেতা থাকবেন।
এই সময় ভাসানী সাহেব আমাকে চিঠি দিলেন আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সভা ডাকতে ময়মনসিংহে। আমার সাথে তিনি এই সম্বন্ধে আগে কোনো পরামর্শ করেন নাই। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি হাশিমউদ্দিন যুক্তফ্রন্ট চায়। আমি তাকে পছন্দ করতাম না, তা তিনি জানতেন। গোপনে গোপনে সালাম সাহেবের সাথে মিশে তিনি কিছু ষড়যন্ত্রও করতেন। আমার সমর্থক ময়মনসিংহ জেলার বিশিষ্ট কর্মী রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া ও হাতেম আলী তালুকদার ও আরও অনেকে তখনও কারাগারে বন্দি।
মওলানা ভাসানীর খেলা বোঝা কষ্টকর। ময়মনসিংহ কনফারেন্সে বেশ একটা বোঝাপড়া হবে বলে আমি ধারণা করলাম। তবু আমি কনফারেন্স ডেকে বলে দিলাম, সভাপতি হিসাবে মওলানা ভাসানী আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন সভা ডাকতে। শহীদ সাহেবকে দাওয়াত করা। হল এবং তাঁকে সভায় উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করা হল। শহীদ সাহেব আমাকে জানিয়ে দিলেন সভার দুই দিন পূর্বে তিনি ঢাকায় পৌঁছাবেন। সমস্ত জেলায় জেলায় আমি চিঠি পাঠিয়ে দিলাম। হাশিমউদ্দিন সাহেবকে নির্দেশ দিলাম, সমস্ত কাউন্সিলারদের থাকার বন্দোবস্ত করতে এবং হোটেল ঠিক করতে যেখানে সদস্যরা নিজেদের টাকা দিয়েই খাবে। যদিও জেলা কমিটির উচিত ছিল বাইরের জেলার সদস্যদের খাবার ব্যবস্থা করা।
আবুল মনসুর আহমদ সাহেব জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি সকল কিছুই ছেড়ে দিয়েছেন হাশিমউদ্দিন সাহেবের কাছে। আমি যে সেখানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অফিস করব সে বন্দোবস্ত করা হয় নাই। সমস্ত জেলায় খবর দেওয়া হয়েছে যেন সকলে উপস্থিত থাকে। আমার জানা আছে যেখানে সভা হোক না কেন শতকরা দশ ভাগ ভোটও আমার মতের বিরুদ্ধে যাবে না। অনেক জেলার কর্মীদের জন্য থাকবার বন্দোবস্ত করা হয় নাই। এই অবস্থায় আবদুর রহমান সিদ্দিকী নামে একজন কর্মীর সাহায্য পেয়েছিলাম। ছোট ছোট হোটেল ভাড়া করে বিভিন্ন জেলার সভ্যদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
সভার তিন-চার দিন পূর্বে মওলানা সাহেব খবর দিলেন, তিনি সভায় উপস্থিত হতে পারবেন না। কিন্তু কেন সে কারণ কিছুই জানান নাই। আমি জানতাম, কোনো রকম বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তিনি সরে থাকতে চেষ্টা করতেন। আমি ও খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস বাধ্য হয়ে রওয়ানা করলাম তাকে ধরে আনতে বগুড়া জেলার পাঁচবিবি গ্রাম হতে। সময়ও খুব অল্প, অনেক কাজ পড়ে আছে। বিভিন্ন জেলার কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। পার্টির যুক্তফ্রন্ট সমর্থকরা লোক পাঠিয়েছে বিভিন্ন জেলায়। খোন্দকার মোশতাক আহমদও যুক্তফ্রন্ট সমর্থক। ইলিয়াস ও আমি বাহাদুরাবাদ ঘাট পার হয়ে ফুলছড়ি ঘাটে ট্রেনে উঠেছি, এমন সময় বগুড়া থেকে একটা ট্রেন আসল। আমি দেখলাম, মওলানা সাহেবের মত একজন লোক দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় বসে আছেন। ইলিয়াসকে বললাম, “দেখ তো কে?” ইলিয়াস উঁকি দিয়ে বলল, “ঐ তো মওলানা সাহেব।” আমাদের ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে। তাড়াতাড়ি মালপত্র নিয়ে নেমে পড়লাম এবং মওলানা সাহেবের কাছে পৌঁছালাম। তিনি বেশি কোনো কথা না বলে হাঁটতে লাগলেন, আমরাও তার সাথে হাঁটতে লাগলাম এবং হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলাম, “ব্যাপার কি? আপনি সভা ডাকতে বললেন, এখন আবার উপস্থিত হবেন না কেন?” তিনি বললেন, “তোমরা জান না, ঐকফ্রন্ট করবার জন্য তোমাদের নেতারা পাগল হয়ে গেছে। আমি কিছুতেই ঐ সমস্ত নীতিছাড়া নেতাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে চাই না। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে যুক্তফ্রন্ট করার সংখ্যা বেশি। তোটে পারা যাবে না। আমি আর রাজনীতি করব না। আমার তো কিছুই নাই। আমি তো নির্বাচনে দাঁড়াব না। কারও ক্যানভাস করতেও পারব না, তাই আর রাজনীতি করার ইচ্ছা নাই। কাউন্সিল সভায় যোগদানও করতে পারব না।” আমি রাগ করে তাঁকে বললাম, “আপনি তো আমাদের সাথে পরামর্শ না করে ময়মনসিংহে কাউন্সিল সভা ডাকতে বলেছেন, কাউন্সিল সভা তো আরও কিছুদিন পরে ঢাকায় ডাকার কথা ছিল। তবে কাউন্সিলের মতামত আপনি জানেন না। আপনিও ইচ্ছা করলে ঐক্যফ্রন্ট করার পক্ষে প্রস্তাব পাস করাতে পারবেন কি না সন্দেহ! আওয়ামী লীগের সভ্যরা বিতাড়িত মুসলিম লীগ নেতাদের কাছে বহু অত্যাচার সহ্য করেছে এবং তারা জানে এরা বিরোধী দল করতে আসে নাই। আওয়ামী লীগের কাঁধে পাড়া দিয়ে ইলেকশন পাস করতে চায়, তারপর তাদের পথ বেছে নেবে। আপনি যদি উপস্থিত না হন তবে আমি টেলিগ্রাম করে সভা বন্ধ করে দিয়ে এই পথেই বাড়ি চলে যাব।”
মওলানার সঙ্গে আলাপ করতে করতে চরের ভিতর দিয়ে সর্দারের চর’ নামে একটা গ্রামে পৌঁছালাম এবং তাঁর এক মুরিদ মুসা মিয়ার বাড়িতে পৌঁছালাম। মুসা মিয়া খুবই গরিব মানুষ, মাত্র ছোট্ট ছোট্ট দুইখানা কুঁড়েঘর তার সম্বল। একটা গাছতলায় আমাদের সুটকেস ও বিছানা নিয়ে একটা মাদুরের উপর বসে পড়লাম। ভদ্রলোক আমাদের নিয়ে মহাবিপদে পড়লেন। কি যে করবেন বুঝে পান না। গরিব হতে পারেন, কিন্তু এত বড় প্রাণ আমার জীবনে খুবই কম দেখেছি। ট্রেন নাই ঢাকায় ফিরে যাবার। ভাসানী সাহেবও কিছু বলছেন না। রাতে সেখানে থাকতে হবে। মুসা মিয়ার বোধহয় যা কিছু ছিল তা ব্যয় করে আমাদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করলেন। দেড় মাইল দূরে ফুলছড়ি ঘাটে লোক পাঠিয়ে আমাদের জন্য চায়ের বন্দোবস্তও করলেন। রাতে তার এক পাশের বাড়িতে সেও মওলানা সাহেবের ভক্ত, সেখানে কাটালাম। তার বাড়িতে একটা ছোট আলাদা ঘর ছিল। মওলানা সাহেবের সাথে নরম গরম আলাপ হওয়ার পরে তিনি সভায় আসবেন বলে দিলেন। ইলিয়াসও মওলানা সাহেবের সাথে অনেক আলোচনা করল। পরের দিন সকালে আমরা দুইজন রওয়ানা করে ফিরে আসলাম। মোহাম্মদউল্লাহ সাহেব, কোরবান আলী, হামিদ চৌধুরী, মোল্লা জালালউদ্দিন পূর্বেই পৌঁছে গিয়েছে। শহীদ সাহেবকে অভ্যর্থনা করবার জন্য ঢাকায় আসতে হল। তাঁকে নিয়ে ময়মনসিংহে পৌঁছালাম। আওয়ামী লীগ অফিস করবার জন্য কোন স্থান না পেয়ে হামিদ, জালাল ও মোহাম্মদউল্লাহ আজিজুর রহমান সাহেবের বাসায় একটা কামরা নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছিল। আমার একলার জন্য থাকার বন্দোবস্ত করেছিল হাশিমউদ্দিনের বাড়িতে। আমি কেমন করে অন্যান্য কর্মকর্তাদের রেখে শিমউদ্দিন সাহেবের বাড়িতে থাকি? পূর্বে যখন গিয়েছি, আমি হাশিমউদ্দিন সাহেবের বাড়িতেই থাকতাম। খালেক নেওয়াজ, শামসুল হক, রশিদ ময়মনসিংহের বিশিষ্ট কর্মী, তারা হাশিমউদ্দিনকে পছন্দ না করলেও আমাকে ভালবাসত। তাদের সাহায্যও পেলাম কাউন্সিলারদের থাকার বন্দোবস্ত করতে। অলকা সিনেমা হলে সম্মেলন হবে। রাতে আমি খবর পেলাম, হাশিমউদ্দিন বাইরের লোক হলের মধ্যে পূর্বেই নিয়ে রাখবে অথবা আওয়ামী লীগ কাউন্সিলার নামেও কিছু বাইরের লোক নিবে যাতে তারা সংখ্যাগুরু হতে পারে।
আমি ভোর পাঁচটায় আবুল মনসুর আহমদ সাহেবকে এ বিষয়ে জানালাম এবং বললাম, “তাকে নিষেধ করবেন এ সমস্ত করতে। কারণ গোলমাল হলে লোকে মন্দ বলবে।” আবুল মনসুর সাহেব বললেন, “আমি তো কিছুই জানি না, তবে দেখব।” আমি সকালবেলায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলাম, এক একজন সেক্রেটারি এক একটা দরজায় থাকবে এবং তাদের প্রত্যেকের সাথে আটজন করে কম থাকবে। আমার দস্তখত করা কার্ড ছাড়া কাউকে ভিতরে যেতে দেওয়া হবে না। বিভিন্ন জেলা থেকে ভাল ভাল যুবক কর্মীদের গেটে থাকতে নির্দেশ দিলাম। ফল ভালই হল; বাইরের লোক কেউই ভেতরে যেতে পারল না। কেউ কেউ কয়েকবার চেষ্টা করেছে, লাভ হয় নাই। কর্মীদের মনোভাব দেখে আর অগ্রসর হতে সাহস পায় নাই। আমি সেক্রেটারির রিপোর্ট পেশ করলাম। শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব বক্তৃতা করলেন। আমার যতদূর মনে হয় বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ পেয়ে মিয়া ইফতিখারউদ্দিন সভায় যোগদান করেছিলেন; শেষে তিনি বক্তৃতাও করলেন। বৈদেশিক নীতি ও যুক্তফ্রন্ট’ এই দুইটা বিষয় নিয়ে খুবই আলোচনা হল। সাবজেক্ট কমিটিও বসেছিল, কিন্তু কোনো মীমাংসা হল না। আমি কাউন্সিল সভায় বৈদেশিক নীতির উপর প্রস্তাব আনলাম। আওয়ামী লীগের বৈদেশিক নীতি হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। আবদুস সালাম খান এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বক্তৃতা করলেন এবং অতি প্রগতিবাদী বলে আমাকে আক্রমণ করলেন। আমি তাঁকে অতি প্রতিক্রিয়াশীল বলে। যখোপযুক্ত জবাব দিলাম। প্রস্তাব পাস হয়ে গেল, অবস্থা দেখে তিনি আর ভোটাভুটি চাইলেন না।
এর পরই শুরু হল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলির ঐক্যফ্রন্ট করা হবে কি হবে না সেই বিতর্ক! ঐক্যফ্রন্ট সমর্থকরা প্রস্তাব আনলেন, আমি বিরোধিতা করে বক্তৃতা করে জিজ্ঞাসা করলাম, “আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য বিরোধী কোনো দল আছে কি না? যাদের নীতি ও আদর্শ নাই তাদের সাথে ঐক্যফ্রন্ট করার অর্থ হল কতকগুলি মরা লোককে বাঁচিয়ে তোলা। এরা অনেকেই দেশের ক্ষতি করেছে। রাজনীতি এরা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য করে, দেশের কথা ঘুমের ঘোরেও চিন্তা করে না। আমার বক্তৃতায় একটু ভাবপ্রবণতা ছিল। কারণ এদের মধ্যে অনেকে ১৯৪৮, ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনকে দমাবার জন্য সকল রকম চেষ্টা করেছে। লীগ সরকার আমাদের দিনের পর দিন কারাগারে বিনা বিচারে বন্দি করে রেখেছিল। ভাসানী সাহেবও ঐক্যফ্রন্টের খুব বিরোধী, শহীদ সাহেবও বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না। ঐক্যবাদীরা একটু ঘাবড়িয়ে গেল। তবে আতাউর রহমান সাহেব ও আমি একমত, যুক্তফ্রন্ট চাই না’-এ প্রস্তাব হওয়া উচিত না। জনগণ মনে করবে আওয়ামী লীগই একতা চায় না। আমি আমার বন্ধুদের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কি কারও কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েছেন যে, গায়ে পড়ে প্রস্তাব করতে চান? যুক্তফ্রন্টের প্রস্তাব আসলে ভোটে পরাজিত হয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত অবস্থা বিবেচনা করে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবকে ভার দেওয়া হল, তারা যা ভাল বিবেচনা করেন তাই করবেন। তবে দুইজনের একমত হতে হবে এবং ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের সাথে আলোচনা করবেন, যখন এ সম্বন্ধে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। আমার বন্ধুরা জানতেন, শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব দুইজনই ঐ সমস্ত লোকদের অনেককে পছন্দ করেন না। শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব পরিষ্কার ভাষায় বলে দিলেন, যদি ফজলুল হক সাহেব আওয়ামী লীগে আসেন তাঁকে তারা মাথা পেতে গ্রহণ করবেন এবং পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী বানাবার চেষ্টা করবেন। পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের নেতাও তিনি হবেন। শহীদ সাহেব আমাকে বলেছিলেন, “বৃদ্ধ নেতা, বহু কাজ করেছেন জীবনে, শেষ বয়সে তাঁকে একবার সুযোগ দেওয়া উচিত দেশ সেবা করতে।”।
মওলানা ভাসানী আমাকে বলে দিলেন, তিনি যুক্তফ্রন্ট করবেন না। হামিদুল হক চৌধুরী ও মোহন মিয়ার সাথে একসাথে রাজনীতি করার কোনো কথাই ওঠে না। নূরুল আমিন সাহেব যে দোষে দোষী এরাও সেই দোষেই দোষী। আমাকে নির্বাচন অফিস করা এবং কাকে নমিনেশন দেওয়া হবে সে সকল বিষয়ে সবকিছু ঠিক করার জন্য নির্দেশ দিলেন। আমি মওলানা সাহেবকে বললাম, “আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করবে, ভয়ের কোনো কারণ নাই। আর যদি সংখ্যাগুরু না হতে পারি আইনসভায় আওয়ামী লীগই বিরোধী দল হয়ে কাজ করবে। রাজনীতি স্বচ্ছ থাকবে, জগাখিচুড়ি হবে না। আদর্শহীন লোক নিয়ে ক্ষমতায় গেলেও দেশের কাজ হবে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার হতে পারে।” মওলানা সাহেব একমত হলেন, আমাকে বিভিন্ন জেলায় সভার ব্যবস্থা করতে বললেন। তিনি ও আমি প্রত্যেক জেলায় ও মহকুমায় ঘুরব, কোথায় কাকে নমিনেশন দেওয়া হবে ঠিক করব। শহীদ সাহেবও কয়েকদিনের মধ্যে করাচি থেকে ফিরে আসবেন এবং সমস্ত নির্বাচনের ভার নিবেন। আওয়ামী লীগের একটা জিনিসেরই অভাব ছিল, সেটা হল অর্থবল। তবে নিঃস্বার্থ এক বিরাট কর্মীবাহিনী ছিল, যাদের মূল্য টাকায় দেওয়া যায় না। টাকা বেশি দরকার হবে না, প্রার্থীরা যে যা পারে তাই খরচ করবে। জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষে।
সালাম সাহেব কিন্তু হাল ছাড়েন নাই। তিনি তখন কিছুটা কনসান্সকিপার হয়ে পড়েছিলেন হক সাহেবের। হক সাহেব রাতারাতি নিজের দল সৃষ্টি করলেন। তার নাম দিলেন, কৃষক শ্রমিক দল। দেশে কোথাও কোনো সংগঠন নাই, কয়েকজন লীগ থেকে বিতাড়িত নেতা হামিদুল হক চৌধুরী সাহেব ও মোহন মিয়ার নেতৃত্বে আর কিছু পুরানা হক সাহেবের ভক্ত এসে জুটল। এরা রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে সংসার ধর্ম পালন করছিলেন। কারণ, এরা প্রায়ই পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। জনাব আবুল হাশিম সাহেবও হক সাহেবকে পরামর্শ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগে যোগদান না করে নিজের দল সৃষ্টি করতে। সালাম সাহেবও হক সাহেবকে আওয়ামী লীগে যোগদান করার জন্য বেশি জোর দেন নাই। কারণ, আওয়ামী লীগে সালাম সাহেবের অবস্থা ভাল ছিল না। সালাম সাহেব আমাকে একদিন বললেন, “আর কত কাল বিরোধী দল করা যায়, ক্ষমতায় না গেলে জনসাধারণের আস্থা থাকবে না। যেভাবে হয় ক্ষমতায় যেতে হবে। যুক্তফ্রন্ট করলে নিশ্চয়ই ক্ষমতায় যেতে পারব।” এই কথার উত্তরে আমি তাকে বলেছিলাম, “ক্ষমতায় যাওয়া যেতে পারে, তবে জনসাধারণের জন্য কিছু করা সম্ভব হবে না, আর এ ক্ষমতা বেশি দিন থাকবেও না। যেখানে আদর্শের মিল নাই সেখানে ঐক্যও বেশি দিন থাকে না।” তিনি একমত হতে পারেন নাই। তাকে নিয়ে বিপদ, কারণ ক্ষমতায় তার যেতেই হবে, যেভাবে হোক তাঁর ধারণা, আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে তিনি নেতা হতে পারবেন না, তার চেয়ে হক সাহেবের সঙ্গে থাকলে তার নেতৃত্ব মানতে আপত্তি হবে না। হক সাহেবকে আওয়ামী লীগে আনতে কেউ তো আপত্তি করে নাই। তবে যেসব লোক তার সঙ্গে জুটেছে তারা হক সাহেবের সর্বনাশ করবে এবং সাথে সাথে দেশের এবং আওয়ামী লীগেরও সর্বনাশ করবে এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ আমার ছিল না। তাই আমি বিরোধিতা করতে লাগলাম। যুক্তফ্রন্ট করবার পক্ষে জনমত সৃষ্টি কিছুটা হয়েছিল সত্য, কিন্তু সেটা ভাবাবেগের উপর। জনসাধারণ মুসলিম লীগের হাত থেকে বাঁচবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মুসলিম লীগ ও আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের নাম জনসাধারণ জানত না।
শহীদ সাহেবও সভা করতে আরম্ভ করলেন। তিনি জানতেন, যুক্তফ্রন্ট হলে কি হবে! অতটা ব্যস্ত তিনি ছিলেন না। একদিন শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব আলাপ করছিলেন, আমিও তাদের সাথে ছিলাম। এ সম্বন্ধে আলোচনা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমি বলেছিলাম, “ইলেকশন এলায়েন্স করলে করা যেতে পারে। যেখানে হক সাহেবের দলের ভাল লোক থাকবে, সেখানে আওয়ামী লীগ নমিনেশন দিবে না। আর যেখানে আওয়ামী লীগের ভাল নমিনি থাকবে সেখানে তারা নমিনেশন দিবেন না। যার যার পার্টির প্রোগ্রাম নিয়ে ইলেকশন করবে।” ভাসানী সাহেব তাতেও রাজি নন। তিনি বললেন, “আওয়ামী লীগ এককভাবে ইলেকশন লড়বে।“ আমাকে কাজ চালিয়ে যেতে বললেন। ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাস হবে, শহীদ সাহেব ভাসানী সাহেব ও আমাকে বললেন, করাচি যেতে হবে কয়েকদিনের জন্য কিছু টাকার জোগাড় করতে হবে। এবার ফিরে এসে আর পশ্চিম পাকিস্তানে যাবেন না ইলেকশন শেষ না করে—তাও বললেন।
মওলানা সাহেব ও আমি জেলায় জেলায় সভা করতে বের হয়ে গেলাম। শহীদ সাহেব যেদিন ঢাকা আসবেন তার দু’একদিন পূর্বে আমরা ঢাকায় পৌঁছাব। এবার আমরা উত্তরবঙ্গ সফরে রওয়ানা করলাম। উত্তরবঙ্গ সফর শেষ করে কুষ্টিয়া জেলায় তিনটা সভা করে। ঢাকায় পৌঁছাব। খুবই ভাল সাড়া পেলাম। কোথায় কাকে নমিনেশন দেওয়া হবে সে বিষয়ে সুপারিশ করার জন্য জেলা কর্মকর্তাদের জানিয়ে দিলাম। তারা নাম ঠিক করে আমাকে জানাবে। যাদের জেলা কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সুপারিশ করবে তাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। যেখানে একমত হতে পারবে না, সেখানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনীত করবে। তবে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব একমত হয়ে যাকে ইচ্ছা তাকে নমিনেশন দিতে পারবেন। যেদিন ভাসানী সাহেব ও আমি কুষ্টিয়া পৌঁছালাম সেইদিনই টেলিগ্রাম পেলাম, আতাউর রহমান সাহেব ও মানিক মিয়া আমাদের দুইজনকে ঢাকায় যেতে অনুরোধ করেছেন। আমি রাতে আতাউর রহমান খান সাহেবের কাছে টেলিফোন করলাম কুষ্টিয়া থেকে। তিনি জানালেন, সভা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে আসতে। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম যে, আগামীকাল সভা, এখন বন্ধ করলে কর্মীরা মার খাবে। পার্টির অবস্থাও খারাপ হয়ে যাবে। খান সাহেব পীড়াপীড়ি করলেন। তখন আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, মওলানা সাহেবকে পাঠিয়ে দিতেছি আজ, আমি সভাগুলিতে বক্তৃতা করে তিন দিন পরেই পৌঁছাব। তিনি রাজি হলেন। আতাউর রহমান সাহেবও আমাদের সাথে প্রথমে একমত ছিলেন যে, যুক্তফ্রন্ট করা উচিত হবে না। দুঃখের বিষয়, তাঁর নিজের কোনো মতামত বেশি সময় ঠিক থাকে না। যে যা বলে, তাতেই তিনি হ্যাঁ, হ্যা করেন। এক কথায়, “তার হাত ধরলে, তিনি না বলতে পারেন না। মওলানা সাহেব ঢাকায় রওয়ানা করে গেলেন। আমি মিটিংগুলি শেষ করে রওয়ানা হব। এমন সময় খবর পেলাম, হক সাহেব ও মওলানা ভাসানী দস্তখত করে যুক্তফ্রন্ট করে ফেলেছেন।
আমি বুঝতে পারলাম না, ভাসানী সাহেব কি করে দস্তখত করলেন! শহীদ সাহেবের অনুপস্থিতিতে কি প্রোগ্রাম হবে? সংগঠনের কি হবে? নমিনেশন কোন পদ্ধতিতে দেওয়া হবে? কেনই বা মওলানা সাহেব এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন? কিছুই বুঝতে পারলাম না। ঢাকায় ফিরে এসে ইয়ার মোহাম্মদ খানের বাড়িতে মওলানা সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলাম। নিচের কামরায় আওয়ামী লীগের অফিস। অফিসে যেয়ে যখন বসেছি, তখন কর্মীরা আমায় খবর দিল, কিভাবে কি হয়েছে। আবুল মনসুর আহমদ সাহেব বিচক্ষণ লোক সন্দেহ নাই। তিনি ব্যাপারটি বুঝতে পারলেন এবং তাড়াতাড়ি কফিলুদ্দিন চৌধুরীর সাহায্যে একুশ দফা প্রোগ্রামে দস্তখত করিয়ে নিলেন হক সাহেবকে দিয়ে। তাতে আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসন, বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা, রাজবন্দিদের মুক্তি এবং আরও কতকগুলি মূল দাবি মেনে নেওয়া হল। আমরা যারা এদেশের রাজনীতির সাথে জড়িত আছি তারা জানি, এই দস্তখতের কোনো অর্থ নাই অনেকের কাছে।
আমি মওলানা সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, “দেখ মুজিব, আমি যুক্তফ্রন্টে দস্তখত করতে আপত্তি করেছিলাম তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত; আতাউর রহমান ও মানিককে আমি বললাম যে, মুজিব সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগের, তার সাথে পরামর্শ না করে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আতাউর রহমান ও মানিক বলল যে, তারা দুইজনে তোমার দায়িত্ব নিল। আমরা যা করব, মুজিব তা মেনে নেবে। তাই হক সাহেব যখন আমার কাছে এসে আমাকে অনুরোধ করলেন, তখন আমি দস্তখত করতে বাধ্য হলাম। আমি তাকে বললাম, “আমার কথা ছেড়ে দেন, শহীদ সাহেবের জন্য দুই দিন দেরি করলে কি অন্যায় হত? তিনি তো দুই তিন দিনের মধ্যে ঢাকায় আসবেন। পূর্বে আমাকে এক কথা বলেছেন, আজ করলেন তার উল্টা। আমাকে এগিয়ে দিয়ে নিজে দস্তখত করে বসলেন! কোন পন্থায় নমিনেশন হবে? কিভাবে কাজ চলবে? দায়িত্ব কে নিবে এই নির্বাচনের, কিছুই ঠিক না করে ঘোষণা করে দিলেন আমি আর হক সাহেব যুক্তফ্রন্ট করলাম!’ যা করেছেন ভালই করেছেন, আমি আর কি করব! আর যখন আতাউর রহমান সাহেব ও মানিক ভাই আমার ভার নিয়েছেন দাবি করে, তখন তাদের কথা আমি ফেলি বা কেমন করে! এতে দেশের যদি মঙ্গল হয় ভাল। আর যদি ক্ষতি হয় আপনারাই দায়ী হবেন, আমি তো পার্টির সেক্রেটারি ছাড়া আর কিছুই না। আপনারা নেতা, যখন যুক্তফ্রন্ট করেছেন—এখন যাতে তা ভালভাবে চলে তার বন্দোবস্ত করুন।” মওলানা সাহেব বললেন, “আমি বলে দিয়েছি, শহীদ সাহেব এসে সকল কিছু ঠিক করবেন। নমিনেশন বা নিয়মকানুন যা করতে হয় তিনিই করবেন।”
আমার মতের বিরুদ্ধে হলেও যখন নেতারা ভাল বুঝে এটা করেছেন তাতে দেশের ভালই হতে পারে। আমি চেষ্টা করতে লাগলাম যাতে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে যুক্তফ্রন্ট চলে। দুই দিন না যেতেই প্রথম খেলা শুরু হল। নামও শুনি নাই এমন দলের আবির্ভাব হল। হক সাহেব খবর দিলেন, নেজামে ইসলাম পার্টি’ নামে একটা পার্টির সাথে পূর্বেই তিনি দস্তখত করেছেন। তাদেরও যুক্তফ্রন্টে নিতে হবে। আমি মওলানা সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, “আমি তো কিছুই জানি না।” আমি বললাম, “ঐ পার্টি কোথায়, এর প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি কারা? সংগঠন কোথায় যে এদের নিতে হবে? এদের নিলে ‘গণতান্ত্রিক দল’ বলে যে একটা দল কাগজের মারফতে দু’একবার দেখেছি তাদেরও নিতে হবে। এদের মধ্যে তবু দুই চারজন প্রগতিশীল কর্মীও আছে। কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যে অনেকে গণতান্ত্রিক দলকে নেওয়া হয়, তা চায় না।”
শহীদ সাহেব এসে অফিস ঠিক করলেন। তাঁকে যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান করতে কেউই আপত্তি করল না। আওয়ামী লীগ থেকে আতাউর রহমান খান ও কৃষক শ্রমিক পার্টি হতে কফিলুদ্দিন চৌধুরী জয়েন্ট সেক্রেটারি এবং কামরুদ্দিন আহমদকে অফিস সেক্রেটারি করা হল। একটা স্টিয়ারিং কমিটিও করা হল। তিন পার্টির সমসংখ্যক সদস্য নিয়ে বোর্ড করা হল, যারা নমিনেশন দিবেন। শহীদ সাহেবকে চেয়ারম্যান করা হল, আর ঠিক হল সর্বসম্মতিক্রমে নমিনেশন দিতে হবে। কোন রকম ভোটাভুটি হবে না। শহীদ সাহেব কার্যাবলি ঠিক করে ফেললেন রাতদিন পরিশ্রম করে। তিনি অফিসের ভিতরেই একটা কামরায় থাকার বন্দোবস্ত করলেন। রাতদিন সেখানেই থেকে সকল কিছু ঠিকঠাক করে কাজ শুরু করলেন। নমিনেশনের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হল। ফর্ম ছাপিয়ে দেওয়া হল, তাতে প্রার্থী কোন পার্টির সদস্য তাও লেখা থাকবে এবং পার্টিকে কপি দিতে হবে। শহীদ সাহেব টাকা পয়সার অভাব অনুভব করতে লাগলেন।
যারা নমিনেশন পাওয়ার জন্য দরখাস্ত করবেন তাদের একটা ফি জমা দিতে হবে। নমিনেশন না দিলেও ঐ টাকা ফেরত দেওয়া হবে না। যত লোক নমিনেশনের জন্য দরখাস্ত করেছিল তাতে প্রায় এক লক্ষ টাকার মত জমা পড়েছিল। শহীদ সাহেব নিজে কয়েকটা মাইক্রোফোন জোগাড় করে এনেছিলেন। আমাদের যানবাহন বলতে কিছুই ছিল না। শহীদ সাহেব একটা পুরানা জিপ কিনেছিলেন।
আওয়ামী লীগের প্রার্থীর অভাব ছিল না। প্রত্যেকটা নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছিল, যারা ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত নিজ নিজ এলাকায় কাজ করেছে। হক সাহেবের কৃষক শ্রমিক দলের প্রার্থীর অভাব থাকায় বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা থেকে যারাই ইলেকশন করতে আশা করে তারাই কৃষক শ্রমিক দলে নাম লিখিয়ে দরখাস্ত করেছিল। কোনোদিন রাজনীতি করে নাই, অথবা রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছিল অথবা মুসলিম লীগের সভ্য আছে তারা নমিনেশন পাবে না। কিন্তু এমন প্রমাণও আছে প্রথমে মুসলিম লীগে দরখাস্ত করেছে, নমিনেশন না পেয়ে কৃষক শ্রমিক দলে নাম লিখিয়ে নমিনেশন পেয়েছে।
অনেক প্রার্থী—যারা জেল খেটেছে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, তাদের নমিনেশন দেওয়া যায় নাই; যেমন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সম্পাদক এম. এ. আজিজকে নমিনেশন দেওয়া যায় নাই। তার পরিবর্তে একজন ব্যবসায়ীকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছিল। খোন্দকার মোশতাক আহমদের মত জেলখাটা কর্মীকেও নমিনেশন দেওয়া হয় নাই। নোয়াখালীর আবদুল জব্বার খদ্দর প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগ করেছেন, তাঁকেও বাদ দিতে হয়েছিল। নেজামে ইসলাম দল কয়েকজন মওলানা সাহেবের নাম নিয়ে এসেছে, তারা দরখাস্তও করে নাই। তাদের সব কয়জনকে নমিনেশন দিতে হবে। এই দল একুশ দফায় দস্তখতও করে নাই। তবে এই দলের প্রতিনিধি একটা লিষ্ট দাখিল করলেন, যাদের নমিনেশন দেওয়া যাবে না। কারণ তারা সকলেই নাকি কমিউনিস্ট। এরা কিছু আওয়ামী লীগের জেলখাটা সদস্য আর কিছু কিছু গণতান্ত্রিক দলের সদস্য। এর প্রতিবাদে আমি বললাম, “আমারও একটা লিস্ট আছে, তাদের নমিনেশন দেওয়া হবে না, কারণ এরা পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছে।”
এদের দাবি এমন পর্যায়ে চলে গেল যে নিঃস্বার্থ কর্মী ও নেতাদের নমিনেশন না দিয়ে যারা মাত্র চার-পাঁচ মাস পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম লীগ করেছে অথবা জীবনে রাজনীতি করে নাই, তাদেরই নমিনেশন দিতে হবে। মাঝে মাঝে হক সাহেবের কাছ থেকে ছোট্ট ছোট্ট চিঠিও এসে হাজির হয়। তার চিঠিকে সম্মান না করে পারা যায় না। আবার কৃষক শ্রমিক পার্টি ও নেজামে ইসলামের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যরা সভা ছেড়ে উঠে চলে যায়, হক সাহেবের সাথে পরামর্শ করার কথা বলে। এইভাবে চলতে লাগল। মওলানা ভাসানী সাহেবকে অনেক কষ্ট করে ঢাকায় আনলাম। তিনি এসেই আবার বাইরে চলে যেতে চাইলেন। আমরা তাঁকে সব কথা বললাম। তিনি উত্তর দিলেন, “ঐ সমস্ত লোকের সাথে কি করে কাজ করা যায়, আমি এর ধার ধারি না। তোমাদের যুক্তফ্রন্ট মানি না। আমি চললাম। আমার সাথে খুবই কথা কাটাকাটি হল। তাকে বললাম, “নমিনেশন নিয়ে আলোচনার সময় অন্য দলের লোকেরা আলোচনা করতে চলে যায় হক সাহেবের কাছে, আর আমরা কোথায় যাই? শহীদ সাহেব তো চেয়ারম্যান, তিনি তো পক্ষ অবলম্বন করতে পারেন না। আপনি ঢাকায় থাকেন, আগামীকাল শহীদ সাহেবের সাথে আপনার আলোচনা হওয়া দরকার।” তিনি চুপ করে রইলেন। আমাকে তাড়াতাড়ি সভায় যেতে হবে। আতাউর রহমান সাহেবও চুপ করে থাকেন। আমাকেই সকল সময় তর্ক বিতর্ক করতে হয়। প্রত্যেকটা প্রার্থীর খবরাখবর নিতে হয়। কফিলুদ্দিন চৌধুরী সাহেব কৃষক শ্রমিক পার্টির সদস্য হলেও তার দলের নেতাদের ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের ভাল প্রার্থী হলে তাকে সমর্থন করতেন। তাই তার উপরে ক্ষেপে গিয়েছে তার দলের লোকেরা। আতাউর রহমান সাহেবও ক্ষেপে যেয়ে অনেক সময় বলতেন, “এদের সাথে কথা বলতে আমার ঘৃণা করে।”
মওলানা সাহেব আবার ঢাকা ত্যাগ করলেন কাউকেও কিছু না বলে। আমি খবর পেয়ে রেলস্টেশনে তাহার সাথে দেখা করতে পেরেছিলাম। ঢাকায় থাকার জন্য অনেক অনুরোধ করলাম, তিনি শুনলেন না। এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায় যায়, শুধু শহীদ সাহেবের ধৈর্য, সহনশীলতা ও বিচক্ষণতা যুক্তফ্রন্টকে রক্ষা করতে পেরেছিল।
৭৯.
তিন চারটা জেলায় তখনও নমিনেশন দেওয়া হয় নাই। আমাকে ঢাকা ত্যাগ করতে হল, কারণ আমার নমিনেশনের কাগজ দাখিল করতে হবে গোপালগঞ্জ ইলেকশন অফিসে। মাত্র একদিন সময় থাকতে রওয়ানা করলাম। আমি না থাকার জন্য এই সমস্ত জেলায় আমার অনেক ত্যাগী সহকর্মীকে নমিনেশন দেওয়া হয় নাই। এমনকি শহীদ সাহেবের অনুরোধও তাঁর রাখেন নাই। মওলানা ভাসানীর দরকারের সময় এই আত্মগোপনের মনোভাব কোনোদিন পরিবর্তন হয় নাই। ভবিষ্যতে অনেক ঘটনায় তার প্রমাণ হয়েছে।
আমি গোপালগঞ্জ যেয়ে দেখি, মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব ময়দানে সদলবলে নেমে পড়েছেন। তিনি নিজের জীবনেই বহু অর্থের মালিক হয়েছেন। লঞ্চ, স্পিডবোট, সাইকেল, মাইক্রোফোন কোনো কিছুরই তার অভাব নাই। আমার একটা মাইক্রোফোন ছাড়া আর কিছুই নাই। গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া এই দুই থানা নিয়ে আমাদের নির্বাচনী এলাকা। রাস্তাঘাট নাই। যাতায়াতের খুবই অসুবিধা। আমার নির্বাচন চালাবার জন্য মাত্র দুইখানা সাইকেল ছিল। কর্মীরা যার যার নিজের সাইকেল ব্যবহার করত। আমার টাকা পয়সারও অভাব ছিল। বেশি টাকা খরচ করার সামর্থ্য আমার ছিল না। আমার ফ্যামিলির কয়েকখানা ভাল দেশী নৌকা ছিল তাই ব্যবহার করতে হল। ছাত্র ও যুবক কর্মীরা নিজেদের টাকা খরচ করে আমার জন্য কাজ করতে শুরু করল। কয়েকটা সভায় বক্তৃতা করার পরে বুঝতে পারলাম, ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করবেন। টাকায় কুলাবে না, জনমত আমার পক্ষে। আমি যে গ্রামেই যেতাম, জনসাধারণ শুধু আমাকে ভোট দেওয়ার ওয়াদা করতেন না, আমাকে বসিয়ে পানদানের পান এবং কিছু টাকা আমার সামনে নজরানা হিসাবে হাজির করত এবং না নিলে রাগ করত। তারা বলত, এ টাকা নির্বাচনের খরচ বাবদ দিচ্ছে।
আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, “বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।” আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই! অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একই পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, “খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই। আমার চোখে পানি এল। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, “তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না।” টাকা সে নিল না, আমার মাথায় মুখে হাত দিয়ে বলল, “গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা।” নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেইদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোকা আমি দিতে পারব না। এ রকম আরও অনেক ঘটনা ঘটেছিল। আমি পায়ে হেঁটেই এক ইউনিয়ন থেকে অন্য ইউনিয়নে যেতাম। আমাকে রাস্তায় রাস্তায়, গ্রামে গ্রামে দেরি করতে হত। গ্রামের মেয়েরা আমাকে দেখতে চায়। আমি ইলেকশনে নামার পূর্বেই জানতাম না, এ দেশের লোক আমাকে কত ভালবাসে। আমার মনের একটা বিরাট পরিবর্তন এই সময় হয়েছিল।
জামান সাহেব ও মুসলিম লীগ যখন দেখতে পারলেন তাদের অবস্থা ভাল না, তখন এক দাবার খুঁটি চাললেন। অনেক বড় বড় আলেম, পীর ও মওলানা সাহেবদের হাজির করলেন। গোপালগঞ্জে আমার নিজের ইউনিয়নে পূর্ব বাংলার এক বিখ্যাত আলেম মওলানা শামসুল হক সাহেব জন্মগ্রহণ করেছেন। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। তিনি ধর্ম সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। আমার ধারণা ছিল, মওলানা সাহেব আমার বিরুদ্ধাচরণ করবেন না। কিন্তু এর মধ্যে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করলেন এবং আমার বিরুদ্ধে ইলেকশনে লেগে পড়লেন। ঐ অঞ্চলের মুসলমান জনসাধারণ তাকে খুবই ভক্তি করত। মওলানা সাহেব ইউনিয়নের পর ইউনিয়নে স্পিডবোট নিয়ে ঘুরতে শুরু করলেন এবং এক ধর্ম সভা ডেকে ফতোয়া দিলেন আমার বিরুদ্ধে যে, আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে।’ সাথে শর্ষিনার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব, রহমতপুরের শাহ সাহেব সকলেই আমার বিরুদ্ধে নেমে পড়লেন এবং যত রকম ফতোয়া দেওয়া যায় তাহা দিতে কৃপণতা করলেন না। দুই চারজন ছাড়া প্রায় সকল মওলানা, মৌলভী সাহেবরা এবং তাদের তালবেলেমরা নেমে পড়ল। একদিকে টাকা, অন্যদিকে পীর সাহেবরা, পীর সাহেবদের সমর্থকরা টাকার লোভে রাতের আরাম ও দিনের বিশ্রাম ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমাকে পরাজিত করার জন্য। কিছু সংখ্যক সরকারি কর্মচারীও এতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করল। ঢাকা থেকে পুলিশের প্রধানও গোপালগঞ্জে হাজির হয়ে পরিষ্কারভাবে তার কর্মচারীদের হুকুম দিলেন মুসলিম লীগকে সমর্থন করতে। ফরিদপুর জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট জনাব আলতাফ গওহর সরকারের পক্ষে কাজ করতে রাজি না হওয়ায় সরকার তাকে বদলি করে আরেকজন কর্মচারী আনলেন। তিনি আমার এলাকায় যেয়ে নিজেই বক্তৃতা করতে শুরু করলেন এবং ইলেকশনের তিন দিন পূর্বে সেন্টারগুলি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলেন, যেখানে জামান সাহেবের সুবিধা হতে পারে। আমার পক্ষে জনসাধারণ, ছাত্র ও যুবকরা কাজ করতে শুরু করল নিঃস্বার্থভাবে। নির্বাচনের চার দিন পূর্বে শহীদ সাহেব সরকারি দলের ঐসব অপকীর্তির খবর পেয়ে হাজির হয়ে দুটা সভা করলেন। আর নির্বাচনের একদিন পূর্বে মওলানা সাহেব হাজির হয়ে একটা সভা করলেন। নির্বাচনের কয়েকদিন পূর্বে খন্দকার শামসুল হক মোক্তার সাহেব, রহমত জান, শহীদুল ইসলাম ও ইমদাদকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে ফরিদপুর জেলে আটক করা হল। একটা ইউনিয়নের প্রায় চল্লিশজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। নির্বাচনের মাত্র তিন দিন পূর্বে আরও প্রায় পঞ্চাশজনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট দেওয়া হয়। শামসুল হক মোক্তার সাহেবকে জনসাধারণ ভালবাসত। তার কর্মীরা খুব নামকরা ছিল। আরও অনেককে গ্রেফতার করার ষড়যন্ত্র আমার কানে আসলে তাদের আমি শহরে আসতে নিষেধ করে দিলাম। আমার নির্বাচনী এলাকা ছাড়া আশেপাশের দুই এলাকাতে আমাকে যেতে হয়েছিল-যেমন যশোরের আবদুল হাকিম সাহেবের নির্বাচনী এলাকায়, ইনি পরে স্পিকার হন; এবং আবদুল খালেকের এলাকায়, ইনি পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন।
নির্বাচনে দেখা গেল ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব প্রায় দশ হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছেন। জনসাধারণ আমাকে শুধু ভোটই দেয় নাই, প্রায় পাঁচ হাজার টাকা নজরানা হিসাবে দিয়েছিল নির্বাচনে খরচ চালানোর জন্য। আমার ধারণা হয়েছিল, মানুষকে ভালবাসলে মানুষও ভালবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে। মওলানা শামসুল হক সাহেব পরে তার ভুল বুঝতে পেরে সক্রিয় রাজনীতি হতে সরে পড়েছিলেন। এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। নির্বাচনের কিছুদিন পূর্বে শহীদ সাহেব বিবৃতির মারফতে বলেছিলেন, মুসলিম লীগ নয়টির বেশি সিট পেলে আমি আশ্চর্য হব। তিনশতের মধ্যে মুসলিম লীগ নয়টা আসনই পেয়েছিল।২৬
দুনিয়ার ইতিহাসে একটা ক্ষমতাসীন দলের এভাবে পরাজয়ের খবর কোনোদিন শোনা যায় নাই। বাঙালিরা রাজনীতির জ্ঞান রাখে এবং রাজনৈতিক চেতনাশীল। এবারও তারা তার প্রমাণ দিল। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুর উপর সাধারণ নির্বাচনেও তারা তা প্রমাণ করেছিল। এবারের নির্বাচনে মুসলিম লীগের অনেক বড় বড় এবং হোমরাচোমরা নেতারা, এদের মধ্যে অনেকেই আবার কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য ছিলেন, যারা শুধু পরাজিত হন। নাই, তাদের জামানতের টাকাও বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। এমনকি পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমিনও পরাজিত হন। এতে শাসকগোষ্ঠী, শোষকগোষ্ঠী এবং আমলারা অনেকেই ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তবু আশা ছাড়েন নাই। তারা চক্রান্তমূলক নতুন কর্মপন্থা গ্রহণ করতে চেষ্টা করতে লাগলেন—বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা-যারা পূর্ব বাংলায় কারখানা ও ব্যবসা পেতে বসেছেন এবং যথেষ্ট টাকাও মুসলিম লীগকে প্রকাশ্যভাবে দিয়ে সাহায্য করেছেন তারা ভয়ানক অসুবিধায় পড়ে গেলেন। তাঁরা জানেন, তাঁদের পিছনে দাঁড়াবার জন্য এখনও কেন্দ্রীয় সরকার মুসলিম লীগের হাতে আছে। যারা পরাজিত হলেন তারা গণতান্ত্রিক পন্থায় বিশ্বাস কোনোদিন করতেন না, তাই জনগণের এই রায় মেনে নিলেন না। ষড়যন্ত্রের রাজনীতি আরম্ভ করলেন। পূর্ব বাংলা ছেড়ে সকলেই প্রায় করাচিতে আশ্রয় নিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা, শিল্পপতিরা ও আমলারা এদের বিপর্যয়ে খুবই ব্যথা পেলেন, কারণ এ রকম সুবোধ বালক’ তারা কি আর ভবিষ্যতে পাবেন; যাঁরা পূর্ব বাংলার সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে দিয়ে দেবেন, একটু প্রতিবাদও করবেন না! শুধু একটা জিনিস তাঁরা পেলেই সম্রষ্ট থাকেন, মন্ত্রিত্ব’ এবং ক্ষমতার একটু ভাগ। কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল জানেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসনের জন্য জনমত সৃষ্টি করেছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে—চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মিলিটারিতে বাঙালিদের স্থান দেওয়া হচ্ছে না—এ সম্বন্ধে আওয়ামী লীগ সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে কতগুলি প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলি করেছে সমস্ত দেশে। সমস্ত পূর্ব বাংলায় গানের মারফতে গ্রাম্য লোক কবিরা প্রচারে নেমেছেন।
এই নির্বাচনে একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেছে যে, জনগণকে ইসলাম ও মুসলমানের নামে’ স্লোগান দিয়ে ধোঁকা দেওয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দিবে না এ ধারণা অনেকেরই হয়েছিল। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি। মুসলিম লীগ নেতারা এসব বিষয়ে কোনো সুষ্ট প্রোগ্রাম জনগণের সামনে পেশ না করে বলে চলেছে পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে, মুসলিম লীগ পাকিস্তান কায়েম করেছে, তাই মুসলিম লীগ পাকিস্তানের মাতা, পাকিস্তান অর্থ মুসলিম লীগ ইত্যাদি। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য নেতারা রাষ্ট্রদ্রোহী, হিন্দুদের দালাল, পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা এক করতে চায়’—এ রকম নানা রকমের শ্লোগান দিতে আরম্ভ করেছিল। জনগণ শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে জানত যে তিনি পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হককে জানত, তিনি এদেশের মানুষকে ভালবাসতেন এবং মওলানা ভাসানীও পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছেন। আর আমরা যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেছি তাও জনগণের জানা ছিল, তাই ধোকায় কাজ হল না।
একুশ দফা দাবি জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য পেশ করা হয়েছে। তা জনগণ বুঝতে পেরেছে। কারণ, আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সাল থেকে বাংলাদেশে এর অনেকগুলো দাবি প্রচার করেছে। ইলেকশনের কিছুদিন পূর্বে এক সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হয়েছিল। চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলী কাগজের কারখানায় বাঙালিরা প্রায় সকলেই শ্রমিক, আর অবাঙালিরা বড় বড় কর্মচারী। তাদের ব্যবহারও ভাল ছিল না। মুসলিম লীগ নেতারা প্রচার করেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে অবাঙালিদের পূর্ব বাংলায় থাকতে দেবে না।
আওয়ামী লীগ ও তার কর্মীরা যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক নেতা ও কর্মী আছে যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে; এবং তারা জানে সমাজতন্ত্রের পথই একমাত্র জনগণের মুক্তির পথ। ধনতন্ত্রবাদের মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করা চলে। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা কোনোদিন কোনো রকমের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের কাছে মুসলমান, হিন্দু, বাঙালি, অবাঙালি সকলেই সমান। শোষক শ্ৰেণীকে তারা পছন্দ করে না। পশ্চিম পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এ রকম অপপ্রচার করা হয়েছে।
৮০.
নির্বাচনের ফলাফল বের হওয়ার পরে আমি ঢাকা আসলাম। আমাকে রেলস্টেশনে বিরাটভাবে অভ্যর্থনা করা হয়েছিল। শোভাযাত্রা করে আমাকে আওয়ামী লীগ অফিসে নিয়ে আসা হল। শহীদ সাহেব আমার জন্য চিন্তায় ছিলেন। যদিও আমার গ্রামের বাড়িতে বসে আমাকে বলে এসেছিলেন, “তোমার চিন্তার কোনো কারণ নাই, আমি যা দেখলাম তাতে তোমার জয় সুনিশ্চিত।”
তাড়াতাড়ি যুক্তফ্রন্টের এমএলএদের সভা ডাকা হল, ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে। আওয়ামী লীগ দলীয় এমএলএদের সভা ডাকা হল আওয়ামী লীগ অফিসে ঐ একই দিন সকালবেলা। নির্বাচনে জয় লাভ করার সাথে সাথে আমাদের কানে আসতে লাগল জনাব মোহাম্মদ আলী বগুড়া হক সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করছেন, পুরানা মুসলিম লীগারদের মারফতে—যারা কিছুদিন পূর্বে হক সাহেবের দলে যোগদান করে এমএলএ হয়েছেন কৃষক শ্রমিক দলের নামে। আদতে তারা মনে প্রাণে মুসলিম লীগ। সকালবেলা আওয়ামী লীগ সদস্যদের সভা আর বিকালে বার লাইব্রেরি হলে সমস্ত দল মিলে যুক্তফ্রন্ট এমএলএদের সভা। আওয়ামী লীগের সভায় শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব উপস্থিত ছিলেন। সভায় রংপুরের আওয়ামী লীগ নেতা খয়রাত হোসেন সাহেব প্রস্তাবের মারফতে বললেন, “জনাব এ, কে, ফজলুল হক সাহেবকে নেতা নির্বাচন করার পূর্বে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব তার সাথে পরামর্শ করে মন্ত্রীদের লিস্ট ফয়সালা করা উচিত। একবার তাকে যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি দলের নেতা করলে তার দলবলের মধ্যে এমন সমস্ত পাকা খেলোয়াড় আছে, যারা চক্রান্তের খেলা শুরু করতে পারে। আর একজন ডেপুটি লিডার আমাদের দল থেকে করা উচিত, কারণ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল যুক্তফ্রন্টের মধ্যে।” শহীদ সাহেব বললেন, “তিনি নিশ্চয়ই আমাদের দুইজনের সাথে পরামর্শ করবেন, মন্ত্রীদের নাম ঠিক করার পূর্বে। বৃদ্ধ মানুষ এখন তাঁকে আর বিরক্ত করা উচিত হবে না।” ভাসানী সাহেবও শহীদ সাহেবকে সমর্থন করলেন। আমি জনাব খয়রাত হোসেনের সাথে একমত ছিলাম। কিন্তু এই নিয়ে আর জোর করলাম না। আমি যখন আমার বাড়ি টুঙ্গিপাড়া থেকে নির্বাচনের পরে ফিরে আসি, শহীদ সাহেব আমাকে একাকী ডেকে বললেন, “তুমি মন্ত্রিত্ব নেবা কি না?” আমি বললাম, “আমি মন্ত্রিত্ব চাই না। পার্টির অনেক কাজ আছে, বহু প্রার্থী আছে দেখে শুনে তাদের করে দেন। শহীদ সাহেব আর কিছুই আমাকে বলেন নাই।।
ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে যুক্তফ্রন্ট এমএলএদের সভা হল। শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব তাতে উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় এ, কে, ফজলুল হক সাহেবকে সর্বসম্মতিক্রমে নেতা করা হল। আর দ্বিতীয় প্রস্তাবে মুসলিম লীগ দলীয় কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য, যারা পুরানা প্রাদেশিক আইনসভার মারফতে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন তাদের পদত্যাগ দাবি করা হল। হক সাহেব নেতা নির্বাচিত হওয়ার কিছু সময় পরেই পূর্ব বাংলার গভর্নর তাঁকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে আহ্বান করলেন। তিনি রাজি হয়ে এসে, শীঘ্রই মন্ত্রিসভার নাম পেশ করবেন বলে বাড়িতে ফিরে গেলেন। সেইদিন সন্ধ্যার পরে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব তার সঙ্গে আলোচনা করতে গেলেন। আমিও সাথে ছিলাম। তিন নেতা আলোচনায় বসলেন, এক আলাদা ঘরে। বাইরে থেকে কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতাদের হাবভাব দেখে আমার খুব খারাপ লাগল। চারিদিকে একটা ষড়যন্ত্র চলছে বলে মনে হল। কিছু সময় পরে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব বের হয়ে আসলেন এবং সোজা ইয়ার মোহাম্মদ খানের বাড়িতে পৌঁছালেন। আতাউর রহমান সাহেবও উপস্থিত হলেন। তাঁরা আমাদের জানালেন, হক সাহেব এখন মাত্র চার পাঁচজন মন্ত্রী নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন; কিছুদিন পরে আরও কিছু সংখ্যক মন্ত্রী নিবেন। এখন আবু হোসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া), আশরাফউদ্দিন চৌধুরী, আতাউর রহমান খান ও আবদুস সালাম খানকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করতে চান। আমাদের নেতারা তাকে অনুরোধ করে বলেছিলেন, পুরা টিম নিয়ে কাজ শুরু করা উচিত। জনগণের আশা আকাক্ষা হল, যুক্তফ্রন্ট তাড়াতাড়ি দেশের জন্য কাজ শুরু করবেন। তারা আরও আপত্তি করলেন, এখন নান্না মিয়াকে না নিয়ে পরে নিলেই ভাল হয়। আর যদি পুরা টিম নিয়ে মন্ত্রিত্ব গঠন করেন তবে তাকে এখনই নিতে আপত্তি নাই। তারা বিশেষ করে জোর দিলেন পুরা টিম নিতে। হক সাহেব রাজি না হওয়াতে তাঁরা তাঁকে বলে এসেছেন, আওয়ামী লীগের কেউই এভাবে মন্ত্রিত্বে যেতে পারে না। আপনি আপনার দল নিয়ে মন্ত্রিত্ব গঠন করেন। আওয়ামী লীগ আপনার মন্ত্রিসভাকে সমর্থন দিবে এবং যখন পুরা মন্ত্রিত্ব গঠন করবেন তখন আওয়ামী লীগ তাতে যোগদান করবে। আওয়ামী লীগের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টির এক ষড়যন্ত্র হচ্ছে এটা বুঝতে আর নেতাদের বাকি রইল না।
হক সাহেব শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবকে বলেছেন, “আমি শেখ মুজিবকে আমার মন্ত্রিত্বে নিব না।” তার উত্তরে শহীদ সাহেব বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগের কাকে নেওয়া হবে না হবে সেটা তো আমি ও ভাসানী সাহেব ঠিক করব; আপনি যখন বলছেন নান্না মিয়াকে ছাড়া আপনার চলে না, তখন আমরাও তো বলতে পারি শেখ মুজিবকে ছাড়া আমাদের চলে না। সে আমাদের দলের সেক্রেটারি। মুজিব তো মন্ত্রিত্বের প্রার্থী না। এ সকল কথা বললে পার্টি থেকে বলতে পারে।”
আমি শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবকে বললাম, আমাকে নিয়ে গোলমাল করার প্রয়োজন নাই। আমি মন্ত্রী হতে চাই না। আমাকে বাদ দিলে যদি পুরা মন্ত্রিত্ব গঠন করতে রাজি হয়, আপনারা তাই করেন। আমরা বসে আলাপ করছি, প্রায় এক ঘণ্টা পরে হক সাহেব খবর পাঠিয়েছেন, তিনি ছয়জনকে নিয়ে মন্ত্রিত্ব গঠন করতে চান এবং মুজিবকেও নিতে রাজি আছেন। ভাসানী সাহেব বলে দিলেন, “আওয়ামী লীগ যখন যোগদান করবে, আওয়ামী লীগের সব কয়জনই একসাথে যোগদান করবেন। এভাবে ভাঙা ভাঙাভাবে যোগদান করবে না।” পরদিন হক সাহেব শপথ গ্রহণ করলেন। আবু হোসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া (কেএসপি) এবং আশরাফউদ্দিন চৌধুরী (নেজামে ইসলাম) শপথ গ্রহণ করলেন। লাভবনের সামনে এক বিক্ষোভ মিছিল হল, স্বজনপ্রীতি চলবে না’, ‘কোটারি চলবে না’, এমনি নানা রকমের স্লোগান। যদি একসাথে পুরা মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করত তা হলে লক্ষ লক্ষ লোক অভিনন্দন জানাত। মনে হল, একদিনের মধ্যে গণজাগরণ নষ্ট হয়ে গেছে। জনসাধারণ ঝিমিয়ে পড়েছে। হক সাহেবের দলবল বলতে শুরু করল, “এ সমস্ত শেখ মুজিবের কাজ।” সত্য কথা বলতে কি, আমি কিছুই জানতাম না। সব খবরের কাগজ পড়ে দেখেছি জনগণ ক্ষেপে যাচ্ছিল এবং যারা সংবর্ধনা দিতে গিয়েছিল তারাই উল্টা স্লোগান দিয়েছিল নান্না মিয়াকে মন্ত্রী করার জন্য। কারণ, তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন না। তার একমাত্র পরিচয় লোকে জানত, হক সাহেবের ভাগিনেয়। লোক হিসাবে সৈয়দ আজিজুল হক অমায়িক ও ভদ্র। আমার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্বন্ধ খুবই মধুর ছিল। কলকাতা থেকে তাকে আমি জানতাম। কোনোদিন তাকে আমি রাগ হতে দেখি নাই। যাহোক, হক সাহেব এই সমস্ত কাজ নিজে কিছুই করেন নাই। বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। অন্যের কথা শুনতেন, বিশেষ করে লীগ থেকে বিতাড়িত দলের, যার নেতত্ব করতেন ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) সাহেব। তিনি নিজে মন্ত্রী হতে চান। তিনি জীবনভর মন্ত্রিত্ব ভাঙছেন আর গড়েছেন। তার একটা বিশেষ অসুবিধা হল তিনি লেখাপড়া ভাল জানতেন না, তাই কেউই তার নাম বলেন না। কর্মী হিসাবে তার মত কর্মী এ দেশে খুব কম জন্মগ্রহণ করেছেন। রাতদিন সমানভাবে পরিশ্রম করতে পারতেন। তাঁকে অনেকে Evil Genius বলে থাকেন। যদি ভাল কাজে তার বুদ্ধি ও কর্মশক্তি ব্যবহার করতেন তাহলে সত্যিকারের দেশের কাজ করতে পারতেন।