অধ্যায় ৭১ – মৌর্য সভ্যতার পরিণতি
২৯৭ থেকে ২৩১ সালের মাঝে সাম্রাজ্য বিস্তারের চেয়ে ধর্মের দিকে বেশি মনোযোগ দেন মৌর্য শাসক, যার ফলে সাম্রাজ্যে ফাটল দেখা দেয়।
২৯৭ সালে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সিংহাসন ছেড়ে দেন। তার ছেলে বিন্দুসারা নতুন রাজা হন। জৈনধর্ম অনুসরণ করছিলেন চন্দ্রগুপ্ত। তিনি একদল সন্ন্যাসীর সঙ্গে যোগ দিয়ে অনাহারে মৃত্যুবরণ করেন, যা ছিল সবধরনের জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বিচ্যুতির চূড়ান্ত উদাহরণ।
বিন্দুসারার ২৫ বছরের রাজত্বের বিষয়ে খুব বেশিকিছু জানা যায় না। গ্রিকরা তাকে আমিত্রোচ্যাতেস বলে অভিহিত করতেন, যার অর্থ ‘শত্রু বিনাশকারী’।
মৌর্য সাম্রাজ্য উত্তরাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত ছিল। দক্ষিণে অন্যান্য রাজত্ব ছিল। দক্ষিণ-পূর্বে কালিঙ্গা, দক্ষিণ উপদ্বীপের কেন্দ্রে অন্ধ্র, পশ্চিমে চেরা এবং আরও একটু দক্ষিণে পাণ্ডিয়াদের ভূখণ্ড।
৫০০ সালের আগে পর্যন্ত এসব অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না।
৭১.১ মৌর্য ভারত
কালিঙ্গা দক্ষিণে মৌর্যদের প্রভাব বিস্তারে বাধা দেয়। ২৭২ সালে বিন্দুসারা যখন মারা যান, তখনও স্বাধীন ছিল কালিঙ্গা।
বিন্দুসারার ছেলে অশোকের ওপর কালিঙ্গা দখলের দায়িত্ব বর্তায়
অশোকের বিষয়ে আমরা যা যা জানতে পারি, তার বেশিরভাগই জানা গেছে শিলালিপি থেকে। তার নির্দেশে এই শিলালিপিগুলো প্রথমে পাথরের উপর এবং পরবর্তীতে বেলেপাথরের তৈরি পিলারে এই লিপিগুলো খোদাই করা হয়। এগুলোতে অশোকের বাল্যজীবন সম্পর্কে জানা যায়। তরুণ বয়সে তার পিতা তাকে তক্ষশিলায় পাঠিয়েছিলেন। বিদ্রোহ দমনের জন্য সেখানে যান তিনি। এরপর মৌর্য সাম্রাজ্যের পাঁচ জনপদের একটির প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন তিনি। উজ্জয়িনী নামের এই জেলার প্রশাসনের দায়িত্ব নেন তিনি।
সেখানে দেবী নামে এক সুন্দরী নারীর প্রেমে পড়েন অশোক। তিনি ছিলেন এক বণিকের মেয়ে। দেবীর ঘরে দুই সন্তান আসে অশোকের, কিন্তু তাকে বিয়ে করেননি তিনি। পরবর্তীতে তার এক সন্তান বুদ্ধ সন্ন্যাসী হন। এ থেকে ধারণা করা হয় দেবী নিজেও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন। তবে তিনি অশোককে গৌতম বুদ্ধের অহিংসার বাণীতে অনুপ্রাণিত করতে পারেননি।
বিন্দুসারার মৃত্যুর পর অশোক সিংহাসনের দখল পেতে ভাইদের সঙ্গে লড়াই করেন। চার বছরের মাথায় তার ভাইদের পরাজিত করেন তিনি।
আরও ৮ বছর নির্বিঘ্নে দেশ শাসন করেন অশোক। ২৬০ সালে তিনি কালিঙ্গার বিরুদ্ধে অভিযান চালান। এক শিলালিপি থেকে জানা যায়, ‘তিনি দেড় লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেন এবং এক লাখেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেন।
এই ভয়াবহ সহিংসতা পরবর্তীতে অশোকের মনে অনুশোচনা এনে দেয়। তার মাঝে আসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। শিলালিপিতে তার এই অনুধাবনের চিত্র উঠে এসেছে : ‘আমার মনে অনুশোচনা এল। এই হত্যাকাণ্ড, মৃত্যু ও মানুষকে বাস্তুচ্যুত করার বিষয়টি অত্যন্ত মর্মান্তিক—এর ভারে আমি ভারাক্রান্ত।’
এরপর থেকে তার রাজত্বের বাকি দিনগুলোকে ‘অরাজনৈতিক’ বললে ভুল হবে না। তিনি প্রশাসনিক কাজে সময় না দিয়ে ধর্ম-কর্মে মন দেন। তিনি ‘ধাম্মা, ধর্ম, সঠিক পথ, আলোকিত পথ, দায়িত্ব—এ-ধরনের একটি ধ্যানধারণার চর্চা করেন তিনি
অপর এক শিলালিপিতে অশোক বলে যান, ‘আমার সকল সন্তান ও নাতিদের বলছি—সাম্রাজ্য বাড়ানোর চিন্তা মনে স্থান দেবে না। ধর্মপালনে যে আনন্দ, সেটাই যথেষ্ট। এটা এমন এক কাজ, যা ইহজগৎ ও পরজগৎ, উভয় ক্ষেত্রেই মূল্যবান।’
এটা ছিল এমন একধরনের রাজকীয় নির্দেশ, যার সঙ্গে পশ্চিমের সভ্যতাগুলো একেবারেই অপরিচিত। রাজার ছেলে রাজা হবে, বাবার কীর্তিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে, নতুন নতুন সাম্রাজ্য দখল করবে—এটাই ছিল স্বাভাবিক চিন্তাধারা। কিন্তু এক্ষেত্রে ভারতীয়দের বলা হচ্ছে রাজার প্রথাগত কাজ ফেলে ধর্মে মন দিতে।
কালিঙ্গার যুদ্ধের পর অশোকের সবচেয়ে বড় সাফল্যগুলো ছিল ধর্ম-সংক্রান্ত; রাজনীতির সঙ্গে সেগুলোর কোনো যোগসূত্র রইল না। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিল ২৪৫ সালে তৃতীয় বৌদ্ধ কাউন্সিলের আয়োজন। পাটালিপুত্র শহরের এই সম্মেলন থেকে পালিধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থের উদ্ভব হয়। কাউন্সিল শেষে অশোকের ছেলে মাহিন্দাকে ধর্মপ্রচারের জন্য ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের বিশাল দ্বীপ সেইলনে (শ্রীলংকা) পাঠানো হল।
আলেকজান্ডারের মতো অশোকও তার সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষকে একই ছাতার নিচে আনার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছিলেন। আলেকজান্ডারের মতো অদ্ভুত কিছু না করে বরং অশোক একটি একক ধর্ম প্রবর্তন করার চেষ্টা করেন। তিনি চেয়েছিলেন সব ভারতীয়কে ‘আমার সন্তান’ বলে অভিহিত করতে। কালিঙ্গার এক শিলালিপি থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
কিন্তু এই প্রয়াসও ব্যর্থ হয়। ২৩১ সালে অশোকের মৃত্যুর পর মৌর্য সাম্রাজ্যও ভেঙে পড়ে। পরবর্তী এক দশককে অন্ধকারাচ্ছন্ন বললে কম বলা যায়।
অশোকের ছেলে ও নাতিরা রাজত্বের ওপর দখল হারায় এবং এটি আবারও খণ্ডবিখণ্ড হয়ে পড়ে।