1 of 2

৭০. আলেকজান্ডার ও উত্তরাধিকারীদের যুদ্ধ

অধ্যায় ৭০ – আলেকজান্ডার ও উত্তরাধিকারীদের যুদ্ধ

৩৩৬ থেকে ২৭২ সালের মাঝে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলকে এক সুবিশাল সাম্রাজ্যের অংশ করে নেন। পরবর্তীতে তার সেনাপতিরা সেই সাম্রাজ্যকে ভেঙে চুরমার করেন।

মেসিডোনিয়ার রাজা ফিলিপের মৃত্যুর পর তার ছেলে আলেকজান্ডার করিন্থীয় লিগের প্রধান ও মেসিডোনিয়ার রাজা হিসেবে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। তবে ফিলিপের প্রয়াণে বেশ কয়েকটি গ্রিক শহর লিগ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়, যাদের মধ্যে অ্যাথেন্স ও থেবেস অন্যতম। অ্যাথেন্স এমনকি উৎসব করে প্রয়াত পাউসানিয়াসকে স্বর্ণের মুকুট পরিয়ে দেয়, যা একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।

আলেকজান্ডার তার মেসিডোনীয় বাহিনীকে সাথে নিয়ে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে হামলা চালালেন। একের পর এক গ্রিক শহর পুনর্দখল করতে লাগলেন তিনি। যখন থেবেসের তোরণে হাজির হলেন আলেকজান্ডার, তিনি শহরের বাসিন্দাদের একটি প্রস্তাব দিলেন। ‘বিদ্রোহের জন্য দায়ী দুই ব্যক্তিকে আমার হাতে তুলে দাও, কারও কোনো ক্ষতি করা হবে না’, বললেন তিনি। কিন্তু থেবেস তার কথায় পাত্তা দিল না, এবং পরিণাম ভোগ করল। প্লুটার্ক বলেন, ‘ঝড়ের বেগে শহরের সব প্রতিরক্ষার পতন হল। লুটপাট, ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে গ্রিসের বাকি শহরগুলোর জন্য এক উদাহরণ তৈরি করলেন আলেকজান্ডার। তার আশা—বাকিরা সতর্ক হবে, তার বশ্যতা মেনে নেবে।’ থেবেসের ৩০ হাজার মানুষকে প্রকাশ্যে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হল। অন্তত ছয় হাজার মানুষ প্রাণ হারালেন।

অ্যাথেন্সকেও একই ধরনের প্রস্তাব দিলেন তিনি, যা তারা খুব দ্রুত মেনে নিল। প্লুটার্ক আরও জানান, ‘অপরিসীম নিষ্ঠুরতা দেখানোর পর আলেকজান্ডারের মনে খানিকটা দয়া হল। তিনি অ্যাথেন্সের অতীতের সব অপরাধ মাফ করে দিলেন। কোনো অ্যাথেনীয়কে কোনোভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হল না।’ অ্যাথেনীয়রাও আলেকজান্ডারের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে তড়িঘড়ি করে তার বিরোধী ও যারা করিন্থীয় লিগে যোগে দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন, তাদের সবাইকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিল।

দুই মাসের মাঝে করিন্থীয় লিগের বাকি দেশগুলো আলেকজান্ডারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করল। আলেকজান্ডার তার বাহিনী নিয়ে ইস্থমাস অব করিন্থে উপস্থিত হলেন। সেখানে করিন্থীয় লিগের এক সভার আয়োজন করলেন তিনি। সেখানে সবাই ভোটগ্রহণের মাধ্যমে মিলে তাকে তার পিতার স্থলাভিষিক্ত করল করিন্থী লিগের নেতা হিসেবে।

এভাবেই, পেশিশক্তিতে বলীয়ান তথাকথিত গণতন্ত্র ছিল আলেকজান্ডারের সবধরনের কার্যক্রমের অংশ। তিনি তার জীবদ্দশায় যা অর্জন করেছিলেন, তার বেশিরভাগই অস্ত্রের মাধ্যমে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি চাইতেন মানুষ যেন স্বেচ্ছায় তার শাসন মেনে নেয়। বিশেষ করে যেসব অঞ্চল তিনি দখল করে নিয়েছিলেন তাদের মাঝে। সশস্ত্র সংগ্রামে ক্ষমতা দখলের বিপরীতে সেই নতুন ধ্যানধারণা—মানুষকে বাধ্য না করেও তাদের আনুগত্য আদায় করা সম্ভব—এই আনুগত্যের ধারণা তার মাঝে অস্বস্তির কারণ হিসেবে থেকে যায়।

আলেকজান্ডার গ্রিসের রাজা হলেন। এর আগে স্পার্টা বা অ্যাথেন্সের কোনো বীর যা করে দেখাতে পারেনি, সেটাই করলেন তৃতীয় আলেকজান্ডার বা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বা শুধুই আলেকজান্ডার। তার সঙ্গে ছিল মেসিডোনিয়ার অভিজ্ঞ ও চৌকশ যোদ্ধা। সঙ্গে যোগ হল ৪০ হাজার গ্রিক যোদ্ধা। তিনি তখন পারস্য দখল করতে পুরোপুরি প্রস্তুত।

ততদিনে পারস্যের সেই খোজা রাজা বাগোয়াসের করুণ পরিণতি হয়েছে। রাজপুত্র আরসেসের মৃত্যুর পর বাগোয়াস তার পরবর্তী পুতুল-রাজা হিসেবে তৃতীয় আরতাজারক্সিসের দূরসম্পর্কের আত্মীয় কোদোমানোসকে জোগাড় করেন। তিনি ছিলেন লম্বায় সাড়ে ছয় ফুট, কিন্তু তার মেজাজ ছিল ঠাণ্ডা প্রকৃতির।

বাগোয়াস ভেবেছিলেন খুব সহজেই কদোমানোসকে হাতের পুতুল বানিয়ে রাখবেন। কিন্তু তিনি কদোমানোসকে বেশি হালকা করে নিয়েছিলেন। কদোমানোস নিজের নাম বদলে তৃতীয় দারিয়াস রাখলেন। অভিষেকের পর একদিন তিনি বাগোয়াসকে তার রাজদরবারে ডেকে পাঠালেন। তাকে এক পাত্র মদিরা পান করার আহ্বান জানালেন। অবস্থা বেগতিক দেখে বাগোয়াস বললেন, ‘আমি অসুস্থ, মদ খেতে চাই না।’ তখন কদোমানোস স্মিত হেসে বললেন, অবস্থায় এই সুরা ওষুধের কাজ করবে।’ নিরুপায় হয়ে মদ খেলেন বাগোয়াস। এক ঘণ্টার পর তার মৃত্যু হল। পারস্যের সর্বময় কর্তৃত্ব পেলেন তৃতীয় দারিয়াস। ৩৩৪ সালে ৩২ হাজার যোদ্ধা নিয়ে আলেকজান্ডার পারস্যে এসে হাজির হলেন। এই বাহিনীতে ১৪ হাজার সদস্য ছিলেন মেসিডোনীয়। বাকিরা অধিকৃত গ্রিসের বিভিন্ন শহরের যোদ্ধা। পারস্যবাসী তাদেরকে বাধা দেওয়ার আগেই দ্রুতগতিতে আলেকজান্ডার হেলেসপন্ট পার হলেন।

হেলেসপন্টে মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ হারিয়ে বিকল্প কৌশলে গেল পারস্য। মাত্রই বাগোয়াসকে বিদায় করে আরও কিছুদিন রাজধানীতে নজর রাখতে চাইলেন তৃতীয় দারিয়াস। যুদ্ধক্ষেত্রে মেমনন নামে এক সেনাপতি এক কৌশল বাতলানেন। তিনি বললেন, আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে স্থলযুদ্ধে যাওয়ার দরকারই নেই। তার মতে, পারস্যের সেনাবাহিনীর উচিত হবে সবধরনের খাদ্য-পানীয়, রসদ ও অন্যান্য উপকরণ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে আলেকজান্ডারের জন্য ঝামেলার সৃষ্টি করে রাজধানীর দিকে চলে আসা। অতঃপর এই পথে আলেকজান্ডারকে এগিয়ে আসার (এবং পথিমধ্যে খাবার-পানির অভাবে ধুঁকতে থাকা) লোভ দেখানো, এবং একইসঙ্গে মেসিডোনিয়ার মূল ভূখণ্ডে জাহাজ পাঠানো।

এটা খুবই ভালো পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু তার কথা কেউ শোনেনি। পারস্যবাহিনী প্রাচীন ট্রয় শহরের ধ্বংসস্তূপের কাছে, গ্রানিকাস নদীর তীরে এসে আলেকজান্ডারের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত হল।

আলেকজান্ডারের নিজ সেনাপতি পারমেনিওর মানা না শুনে তিনি তার বাহিনী নিয়ে নদী পার হয়ে পারস্যের বাহিনীর দিকে ধেয়ে গেলেন। পানি থেকে বের হয়ে আসার মেসিডোনীয় সেনাদের প্রথম দলটি কিছু বোঝার আগেই কচুকাটা হল। কিন্তু আলেকজান্ডারের আক্রমণের দমকে পারস্যবাহিনী পিছে হটতে বাধ্য হল। গ্রিক সামরিক ইতিহাসবিদ আরিয়ান জানান, এক্ষেত্রে আলেকজান্ডারের বাহিনীর অভিজ্ঞতা ও ‘পারস্যের হালকা বল্লমের বিপরীতে গ্রিসের কাষ্ঠ-নির্মিত মজবুত বল্লম’ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে আলেকজান্ডারের উপস্থিতি বিশেষভাবে মেসিডোনীয়দের অনুপ্ৰাণিত করেছিল—এতে কোনো সন্দেহ নেই। দারিয়াসকে কোথাও দেখা না-গেলেও তিনি একেবারে প্রথম হামলা থেকে শুরু করে যুদ্ধ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীর মাঝে দৃশ্যমান ছিলেন। তার বর্ম ভেদ করে একটি বল্লম ঢুকে পড়লেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। কুঠারের আঘাতে তার শিরস্ত্রাণও ভেঙে যায়। তার এক সেনাপতি ক্লেইটাস দ্য ব্ল্যাক শেষমুহূর্তে এই সেনার হাত কেটে ফেলতে সক্ষম হন—সে তখন দ্বিতীয়বার আঘাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

প্রাচীন নথি মতে, এই যুদ্ধে আলেকজান্ডার ২০০ সেনা হারান, আর অপরদিকে দারিয়াস হারান ৪ হাজার—যার মাঝে ছিল দারিয়াসের ছেলে, জামাতা ও শ্যালক। বাকি সেনারা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে গেলে আলেকজান্ডার আইওনিয়ান শহরগুলোকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন, যার অর্থ ছিল সেগুলো এখন তার অধীনে। তিনি সারদিসের উদ্দেশে যাত্রা করেন। আরিয়ান জানান, শহর থেকে ৮-৯ মাইল দূরে থাকা অবস্থায় গভর্নর সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এভাবে এশিয়া মাইনরকেও পরাভূত করেন তিনি।

৭০.১ আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্য

দারিয়াসের উদ্বেগ ততদিনে অনেক বেড়েছে। তিনি তার স্ত্রী, সন্তান ও সভাসদদের বেশিরভাগকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাবিলনে চলে গেলেন। সেখান থেকে তিনি এই আগ্রাসনের মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রাচীন এই শহরে বসে তিনি অতিকায় সেনাবাহিনী গঠন করলেন। পারস্য, মেদেস ও সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ থেকে উপঢৌকন হিসেবে পাঠানো দাসদের মধ্য থেকে প্রায় আড়াই লাখ সেনা জোগাড় হল। এই তথ্য জানিয়েছেন রুফাস।

এই সমীহ-জাগানো সেনাদল নিয়ে তিনি ব্যাবিলন থেকে পুরনো অ্যাসিরীয় ভূখণ্ডের দিকে রওনা হলেন। উদ্দেশ্য, সেখানে ছড়িয়ে পড়ে মেসিডোনিয়ার বাহিনীকে পরাভূত করবেন।

তারসাসে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়েন আলেকজান্ডার। প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছিলেন তিনি। সুস্থ না হয়ে আর সামনে আগাতে চাননি তিনি। কিন্তু শত্রুকে খুঁজে না পেয়ে অসহিষ্ণু হয়ে পড়েন তৃতীয় দারিয়াস। মেসিডোনিয়া থেকে তার বাহিনীতে যোগ দেওয়া এক ব্যক্তির উপদেশকে আমলে না নিয়ে তিনি এশিয়া মাইনরের দিকে রওনা হলেন। সিরিয়ার ইসাস নদীর তীরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হল দুই পক্ষ। কিন্তু পারস্যের বিশাল বাহিনী সেখানে কোনো সুবিধা পেল না—ক্ষুদ্র এই যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সব সেনার জায়গাই হল না!

আবারও মেসিডোনিয়ার বাহিনী পারস্যকে ছারখার করে তুলতে সক্ষম হল।

বাগোয়াসের পূর্ব-অনুমান কিছুটা হলেও সত্য হল। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে লেজ তুলে পালালেন দারিয়াস। এমনকি, তিনি তার স্ত্রী-পুত্র কন্যাদেরও কিছু বলে যাননি। আলেকজান্ডার যখন সেখানে বিজয়ীর বেশে উপস্থিত হলেন, তিনি দেখলেন তার বাহিনী ইতোমধ্যে দারিয়াসের পরিবারকে আটক করে রেখেছে। পরিবারের সদস্যরা বারবার জানতে চাইলেন, কোন্ বাহিনীর সঙ্গে দারিয়াস ছিল? কীভাবে তার মৃত্যু হল? তার পরিবারের সদস্যরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে দারিয়াস জীবিত থাকা অবস্থায় মেসিডোনিয়া জয়লাভ করতে পারে। আরও অবিশ্বাস্য ছিল, যুদ্ধের মাঝে তার পলায়নের বিষয়টি। তারা এই খবরে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন।

হামলায় অংশ নেয়নি, এরকম বন্দিদের ক্ষেত্রে আলেকজান্ডার সবসময়ই সদাশয় ছিলেন। তিনি দারিয়াসের পরিবারকে প্রাণে মারলেন না।

অপরদিকে, কিছুদূর এগিয়ে নিরাপদ অবস্থানে যেয়ে আলেকজান্ডারকে চিঠি পাঠালেন দারিয়াস। তার মিত্র হওয়ার প্রস্তাব দিলেন এবং জিম্মি হিসেবে তার স্ত্রী ও শিশুদের রেখে দেওয়ার কথা উল্লেখ করলেন।

ফিরতি চিঠিতে আলেকজান্ডার জানালেন, দারিয়াস সশরীরে আলোচনার জন্য না আসলে তিনি তার সঙ্গে কোনো চুক্তি করবেন না। এ ছাড়া, তাকে ‘এশিয়া মহাদেশের প্রভু হিসেবে অভিহিত করতে হবে। ভবিষ্যতে ‘আপনি যদি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, আমাকে সমগ্র এশিয়ার রাজা হিসেবে অভিহিত করবেন। আমাকে আপনার সমকক্ষ ভাববেন না।’

এই কথার মাধ্যমে এই দুই পক্ষের চুক্তির সম্ভাবনা পুরোপুরি তিরোহিত হল। দারিয়াস ইউফ্রেতিসের পূর্বে অবস্থান করলেন। আলেকজান্ডার দারিয়াসের পরিবারের সদস্যদের জন্য স্বচ্ছন্দে জীবনযাপনের ব্যবস্থা করলেন এবং সিরিয়ার মধ্যদিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার অব্যাহত রাখলেন। ৩৩২ সালে তিনি টায়ার শহরে পৌঁছালেন। সাত মাস পর তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল। এত সময় লেগে যাওয়ায় রাগান্বিত ছিলেন আলেকজান্ডার। তার সেই রাগের কারণে বাহিনীর সদস্যরা শহরের ভেতর ৩০ হাজার মানুষকে মেরে ফেললেও তিনি তাদের বাধা দেননি।

এরপর তিনি মিশরে যেয়ে তৃতীয় দারিয়াসের বদলে নিজে ফারাও হিসেবে ঘোষণা দিলেন। পারস্যের অধিকর্তা হওয়ার সময় দারিয়াস এই খেতাব অর্জন করেছিলেন। ৩৩১ সালে দারিয়াসের মোকাবিলা করতে গেলেন। কিন্তু আবারও যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করলেন ভীরু দারিয়াস। তিনি আবারও দরকষাকষি করতে গেলেন আলেকজান্ডারের সঙ্গে। এবার প্রস্তাব দিলেন তার পরিবারের মুক্তির বিনিময়ে ইউফ্রেতিসের পশ্চিমের সব ভূখণ্ড তুলে দেবেন। সঙ্গে পারস্যের এক রাজকন্যাকেও আলেকজান্ডারের স্ত্রী হিসেবে দিতে চাইলেন দারিয়াস। শর্ত একটাই, আলেকজান্ডারকে পারস্যের বন্ধু হতে হবে। আলেকজান্ডারের সেনাপতি পারমেনিও ভাবলেন এটি খুবই চমৎকার চুক্তি। এতে সবাই যার যার দেশে অক্ষত ফিরে যেতে পারবে। ‘আপনার জায়গায় আমি হলে এই শর্ত মেনে নিতাম’, বললেন তিনি। আর আলেকজান্ডার ভ্রকুটি করে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি যদি তোমার মতো হতাম, তাহলে আমিও এই প্রস্তাবে রাজি হতাম।’

অবধারিতভাবে, দুই বাহিনী আবারও মুখোমুখি হল। এবারের যুদ্ধক্ষেত্র গাউগেমেলা-তাইগ্রিসের উত্তর অংশে। এবারও পারস্য পরাজিত হল, এবং আবারও পালিয়ে গেলেন দারিয়াস। আলেকজান্ডারের বাহিনী বিজয়ীর বেশে সুসা ও পারসিপোলিসে এসে পৌঁছাল। সেখানে তিনি অসংখ্য গ্রিক যুদ্ধবন্দি আবিষ্কার করলেন। অনেকে কয়েক দশক ধরে দাসত্ব বরণ করছে। তাদের হাত-পা বিকলাঙ্গ করে রাখা হয়েছে। এসব দেখে ক্রোধে ফেটে পড়লেন। তিনি শহরে অবাধে লুটপাট চালানোর আদেশ দিলেন। সঙ্গে শত্রুদের বিনাশ, ঘরবাড়িতে আগুন ও সবলদের বন্দি করার নির্দেশও যোগ হল। তবে কোনো নারীকে যাতে ধর্ষণ করা না হয়, সেটা তিনি নিশ্চিত করলেন। পুরো শহর ধূলিসাৎ হল এবং দারিয়াসের প্রাসাদ জ্বালিয়ে দেওয়া হল।

দারিয়াস একবাতানার দিকে পালিয়ে গেলেন। আলেকজান্ডার নিজে ছোট একটি বাহিনী নিয়ে তাকে ধাওয়া করলেন। কিন্তু শত্রুর হাতে ধরা পড়ার আগেই নিজ বাহিনীর লোকরা তার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করল। তার ঘোড়সওয়ার বাহিনীর অধিনায়ক ও একজন সাতরাপ তাকে ছুরিকাঘাত করলেন এবং তাকে জুলাই মাসের উষ্ণ আবহাওয়ায় মৃত্যুর জন্য একটি ওয়াগনের সঙ্গে বেঁধে রেখে চলে গেলেন।

এবার বাস্তবিকই এক মহান রাজায় রূপান্তরিত হলেন আলেকজান্ডার। তার বাহিনীর সদস্যরা ভাবলেন, এবার বুঝি ছুটি মিলবে। কিন্তু আলেকজান্ডার চেয়েছিলেন সমগ্র পৃথিবী দখল করতে, এবং তখনো দখল হয়নি উত্তর-পূর্বের সাতরাপিগুলো—যার মধ্যে ব্যাট্রিয়া ও সোগডায়ানা অন্যতম। তিনি আরও দূর থেক দূরান্তে সাম্রাজ্য বিস্তারে মন দিলেন। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশকে মধ্য এশিয়া থেকে আলাদা করে রাখা পার্বত্য অঞ্চলে এসে তিনি ও তার বাহিনী বেশ ভোগান্তি পোহালেন। এই তিন বছরে প্রথমবারের মতো আলেকজান্ডারের প্রতি তার বাহিনীর আনুগত্যে ফাটল ধরল। পারমেনিওর ছেলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগ এল। আলেকজান্ডার তাকে নির্যাতন করে হত্যা করলেন। তারপর তার বাবাকেও মৃত্যুদণ্ড দিলেন। বিষয়টা নির্দয় হলেও মেসিডোনিয়ায় খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।

তারপর তিনি প্রথমবারের মতো বিয়ে করলেন। সোগডায়ানার রাজকন্যা, অনিন্দ্যসুন্দরী রক্সানকে। তার মতো পর্যায়ের মানুষের জন্য এটা ছিল অনেক দেরিতে বিয়ে। তবে তিনি বিয়ে না করলেও যৌনসম্পর্ক স্থাপনে পিছিয়ে ছিলেন না, এবং কথিত আছে, এক্ষেত্রে তিনি নারী-পুরুষ বাছবিচার করতেন না। কিন্তু রক্সানকে বিয়ে করে তিনি মেসিডোনিয়ার অভিজাত সমাজের বিরাগভাজন হলেন—তারা সোগডায়ানাকে দাস ও বর্বরদের গোত্র হিসেবে বিবেচনা করতেন। এর সঙ্গে যোগ হল আলেকজান্ডারের পারস্যের পোশাক ও সংস্কৃতির দিকে ক্রমবর্ধমান ঝোঁক। সবার ধারণা হল, নতুন নতুন ভূখণ্ড দখলে আলেকজান্ডার ক্রমশ মেসিডোনিয়ার সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছিলেন।

আলেকজান্ডার লাফ দিয়ে উঠে অস্ত্র খুঁজতে লাগলেন। ক্লেইটাসের বন্ধুরা তার মতো অতটা মাতাল ছিল না। তারা তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিলেন। কিন্তু পেছনের দরজা দিয়ে আবারও ফিরে এসে আলেকজান্ডারের প্রতি টিটকারি মারতে লাগলেন ক্লেইটাস। এবার আলেকজান্ডার এক দেহরক্ষীর কাছ থেকে বল্লম নিয়ে তার নিজ দেশের বাসিন্দা ক্লেইটাসকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলেন।

মদের নেশা কাটার পর তিনি অনুতপ্ত হলেও, সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টা কমালেন না। তবে তার সঙ্গে সেনারা আর আগের মতো খুশিমনে তার সঙ্গে যাচ্ছিলেন। যেকোনো মূল্যে ভারতবর্ষ জয়ে আগ্রহী ছিলেন আলেকজান্ডার।

অপরদিকে, সিন্ধু নদের অপর পারে, এককালের প্রতাপশালী মগধ রাজ্যের রাজা অগাথশত্রুর বংশধররা ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি। ৪২৪ সালে রাজবংশেরই এক অবৈধ সন্তান মহাপদ্ম নন্দ মগধ রাজ্যের ক্ষমতা দখল করেছিলেন এবং তিনিও সাম্রাজ্য বিস্তারের অভিযান পরিচালনা করেন।

৮৮ বছর বয়সেও তিনি সরাসরি যুদ্ধে লড়েছেন। তিনিই ছিলেন সে আমলে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ আধিপত্যবাদী রাজা। যখন আলেকজান্ডার খাইবার পাস পার হয়ে ভারতে এসে পৌঁছালেন, তখন ক্ষমতায় ছিলেন এই মহাপদ্ম নন্দের বংশধর ধন নন্দ।

আলেকজান্ডারের সামনে সবচেয়ে প্রথম ভারতের তক্ষশীলা বা টাক্সিলা রাজ্য পড়ল। সেই রাজ্যের রাজা তার রাজত্বের নামে নিজের নাম রাখেন টাক্সিলেস।

আলেকজান্ডার যখন সিন্ধু নদ পার হলেন (খুব সম্ভবত তিনিও পন্টুন সেতু ব্যবহার করেছিলেন), তখন রাজা টাক্সিলেস অনেক উপহার ও উপঢৌকন হিসেবে সেনা-সদস্যদের নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তিনি আশা করেছিলেন, পার্শ্ববর্তী রাজ্য হিদাসপেস (ঝিলম)-এর বিরুদ্ধে সুবিধা পেতে তিনি আলেকজান্ডারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবেন। ঝিলম নদীর তীরে অবস্থিত সেই রাজ্যের রাজা ছিলেন সাত ফুট লম্বা রাজা পোরাস (পুরু)।

আলেকজান্ডার এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন। ভারত ও মেসিডোনিয়ার যৌথবাহিনী ঝিলম নদীর উদ্দেশে যাত্রা করল। সেখানে তারা পুরু ও তার বাহিনীর মুখোমুখি হল। আরিয়ান জানান, পুরুর সঙ্গে “অসংখ্য হাতি” ছিল। অপরদিকে, মেসিডোনিয়ার রাজা তার বিশ্বস্ত চার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। এই দেহরক্ষীদের নাম ছিল : টলেমি, পারদিক্কাস, লাইসিমাকাস ও সেলুকাস। তিনি নদীর উপর দিয়ে তার বাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন—কেউ সাঁতরাল, কেউ ভেসে ভেসে এগোলো আর কেউ কেউ ডিঙি নৌকায় করে। তারা সবাই মিলে হাতিবাহিনী ও পুরুর ওপর হামলা চালাল।

আলেকজান্ডারের ঘোড়সওয়ার বাহিনী শুরুতে একটু ঝামেলায় পড়লেও ধীরে ধীরে তারা আগাতে থাকে। একপর্যায়ে আতঙ্কিত হাতিগুলো পুরুর বাহিনীকে পদদলিত করতে শুরু করলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। একপর্যায়ে পোরাস বা পুরু আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। তার বীরত্ব ও সাহসিকতায় মুগ্ধ আলেকজান্ডার তার প্রাণভিক্ষা দিলেন।

কিন্তু এই যুদ্ধে আলেকজান্ডারের বাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। তারা জানতে পারলেন, আলেকজান্ডার তাদেরকে নিয়ে গঙ্গানদী পার হতে চান, যেটি কিনা সিন্ধুর চেয়েও অনেক বিস্তৃত ও যার দুইপাশে আরও সহিংস সেনা ও হস্তিবাহিনী রয়েছে। স্বভাবতই তারা এতে খুশি হতে পারলেন না। বেঁকে বসল আলেকজান্ডারের বাহিনী।

তবে এবার আলেকজান্ডারের রাগ বা তার ব্যক্তিত্ব কোনোটাই কাজ করল না। অবশেষে, প্লুটার্কের বর্ণনা মতে, ‘তিনি ২ দিন তাঁবুতে শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলেন। এরপর রাগ কমে এলে বুঝতে পারলেন, এই যুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব নয়।’ তৃতীয় দিনে তিনি বাড়ি ফিরে যেতে রাজি হলেন।

কিন্তু খাইবার পাস ধরে ফিরে না যেয়ে তিনি তার সেনাদের সিন্ধুনদের তীর দিয়ে, সমুদ্রের দক্ষিণদিক দিয়ে হাটিয়ে নিয়ে গেলেন পশ্চিমে। এতে অনেক সময় লেগে গেল। সাত মাস ধরে আলেকজান্ডার ও তার বাহিনী আগাতে লাগল। এর মাঝে অসংখ্য হামলার মুখে পড়তে হল তাদেরকে। এর মাঝে মাল্লিয়ানদের শহরে আলেকজান্ডারের বুকে একটি তির এসে আঘাত হানল। কয়েক ঘণ্টার জন্য অজ্ঞান ছিলেন আলেকজান্ডার। অনেকেই ভেবেছিল তিনি মারাই গেছেন।

এরপর আবার যখন যাত্রা শুরু করলেন আলেকজান্ডার, তখন কোনোমতে ঘোড়ার পিঠে বসতে সক্ষম হন তিনি। এই আঘাত থেকে তিনি আর কখনোই পুরোপুরি সেরে উঠতে পারেননি।

উপকূলে আসার পর তারা একটি লবণাক্ত মরুভূমির মধ্যদিয়ে যান। প্লুটার্ক বলেন, ‘সেখানে কেউ কখনো চাষাবাদ করেনি। সেখানকার বাসিন্দাদের তেমন কিছুই ছিল না। তাদের ছিল কিছু ভেড়া। তাদের গা থেকে খারাপ গন্ধ বের হচ্ছিল এবং তারা সমুদ্রের মাছ খেয়ে জীবনধারণ করত।’ এই বৈরী অঞ্চলে সূর্যের তাপ অত্যন্ত প্রখর ছিল। সব পানি ছিল লবণাক্ত ও পানের অনুপযোগী। আলেকজান্ডারের সেনারা অনাহার, তৃষ্ণা ও রোগে ভুগে মারা পড়তে লাগলেন। এক লাখ ২০ হাজার পদাতিক ও ১৫ হাজার ঘোড়সওয়ার সেনার মধ্যে মাত্র ৩০ হাজার কোনোমতে দেশে ফিরতে সক্ষম হয়। এটা ছিল এক অসামান্য অভিযানের মর্মান্তিক পরিণতি।

সুসায় ফিরে ভারত-জয়ের স্বপ্নে জলাঞ্জলি দিলেন আলেকজান্ডার। সাম্রাজ্যবাদীর বদলে শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন তিনি। আবারও বিয়ে করলেন। এবারের পাত্রী ছিল তৃতীয় দারিয়াসের মেয়ে রাজকন্যা স্তাতেরিয়া। এক উদ্ভট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি মেসিডোনিয়ার অভিজাত পুরুষদের সঙ্গে পারস্যের অভিজাত নারীদের গণবিবাহের আয়োজন করলেন। এরপর তিনি তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, অনুগত সেনাপতি ও খুব সম্ভবত তার ছেলেবেলার প্রেমিক হেপহেসটিওনের সঙ্গে দারিয়াসের অপর কন্যা ড্রাইপেতিসের বিয়ে দিলেন।

তবে আলেকজান্ডারের গণবিয়ের এই প্রয়াস কাজে আসেনি। পারস্যবাসীদের কাছে মেসিডোনীয়রা ছিল অসভ্য, কুজাত—খানিকটা ভারতের নমশূদ্রের মতো। আর মেসিডোনীয়রা পার্সিদের দেখতেন অহংকারী হিসেবে। গণবিবাহের বেশিরভাগ দম্পতি শিগগির আলাদা হয়ে গেলেন। এ ছাড়া পার্সি তরুণদের মেসিডোনীয় সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার অপর একটি প্রচেষ্টাও মুখ থুবড়ে পড়ে।

এরপর তার দুই রাজত্বের বাসিন্দাদের মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টির অভিপ্রায়ে উভয় জাতির উদ্দেশে তিনি পৃথক পৃথক ভাষণ দিলেন। তার এই আবেগী ভাষণে কিছুটা হলেও কাজ হয়। যখন আলেকজান্ডার নিশ্চিত হলেন, এই দুই জাতি আরও কিছুদিন এক হয়ে থাকতে পারবে, তখন তিনি সুসা থেকে একবাতানার উদ্দেশে রওনা হলেন। সেখানে তিনি গ্রিক কায়দায় একটি বড় আকারের উৎসবের আয়োজন করলেন। তার ধারণা ছিল, এই ভোজের মাধ্যমে তিনি তার রাজত্বে বিদ্যমান ফাটলগুলো মেরামত করতে পারবেন।

কিন্তু উৎসবের মাঝামাঝি সময়ে তার বন্ধু হেপহেসটিওন অসুস্থ হয়ে পড়েন। খুব সম্ভবত তার টাইফয়েড হয়েছিল। যখন তিনি প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তখন ডাক্তারের উপদেশ উপেক্ষা করে মুরগি ও মদে সহযোগে পেটপুরে খেলেন তিনি। এটাই ছিল তার শেষ খাবার। কয়েক ঘণ্টার মাঝেই তার পেটে ছিদ্র হয়ে মারা যান তিনি।

প্রিয়তম বন্ধুর মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি আলেকজান্ডার। তিনি একবাতানা ছেড়ে ব্যাবিলনে ফিরে যান। সেখানে তিনি গভীর শোকে নিমজ্জিত হন।

প্লুটার্ক জানান, তিনি জ্বরে ভুগতে শুরু করেন। মাসের ১৮ তারিখে তিনি অসুস্থ হন এবং ১০ দিন পর মারা যান। বছরটি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সাল। তার বয়স ছিল মাত্র ৩৩।

শয়নকক্ষে আলেকজান্ডারের মরদেহ বেশ কয়েকদিন সংরক্ষণ করে রাখা হল। সেসময় তার সেনাপতিরা তর্কে মেতে উঠলেন—কার হাতে যাবে এই বিশাল সাম্রাজ্যের ভার? তিনি কোনো উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেননি। তবে মারা যাওয়ার অল্পদিন আগে আলেকজান্ডার জানতে পেরেছিলেন যে তার স্ত্রী রক্সান অন্তঃসত্ত্বা। তাই আর আলাদা করে উত্তরাধিকারী ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি তিনি।

যুদ্ধের দামামার মাঝে আলেকজান্ডারের সুবিশাল রাজত্ব গড়ে ওঠে। এতে ছিল না কোনো ধরনের প্রশাসন, আমলাতন্ত্র, কর ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, জাতীয় পরিচয় বা রাজধানী শহর। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে সাম্রাজ্য বিস্তারের মাঝে সেই যুদ্ধক্ষেত্রেই এক শিবিরে মারা যান আলেকজান্ডার। এ-ধরনের দ্রুতগতিতে সৃষ্ট প্রাচীন আমলের অন্যান্য রাজত্বের মতোই, আলেকজান্ডারের রাজত্বও ভেঙে পড়তে শুরু করল।

এই ভেঙে পড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় রক্সানের হাত ধরে। তিনি তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি নিরাপত্তার অভাবে ভুগতে লাগলেন। খবর পেলেন, আলেকজান্ডারের পার্সি স্ত্রী স্তাতেরিয়াও সন্তানসম্ভবা। তিনি নিজে ছিলেন নিচু জাত থেকে আসা নারী, আর স্তাতেরিয়া ছিল এক মহান রাজার মেয়ে। স্বভাবতই, বিষয়টি ভালো লাগেনি তার।

রোক্সান কৌশলে স্তাতেরিয়া ও তার বোন, প্রয়াত হেপহেসটিওনের বিধবা স্ত্রী ড্রাইপেতাসকে বিষ খাইয়ে হত্যা করলেন।

সে মুহূর্তে আলেকজান্ডারের একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকারী হিসেবে টিকে রইল রোক্সানের পেটে থাকা অনাগত সন্তান। কিন্তু ‘অনাগত’ সন্তান দেশের শাসক হতে পারে না। আলেকজান্ডারের সেনাপতিরা চাইলেন তারই কোনো এক রক্তসম্পর্কের আত্মীয় সিংহাসনে বসুক। প্রয়োজনে রিজেন্ট হিসেবে হলেও। তাই তারা আলেকজান্ডারের সৎভাইয়ের খোঁজ করতে লাগলেন। প্রয়াত ফিলিপের অবৈধ সন্তান, যার নাম ছিল ফিলিপ আরহিডিয়াস—তার বয়স ততদিনে ৩০ এর কোঠায়। বোকাসোকা ধরনের এই মানুষটিকে খুব সহজেই প্রভাবিত করা যেত। তিনিও ব্যাবিলনেই অবস্থান করছিলেন। আলেকজান্ডারের এক সেনাপতি এই ফিলিপের মাথায় মুকুট পরিয়ে তাকে সবার সামনে নিয়ে এলেন।

তবে এতে ঝামেলা মিটেনি। যারা গত এক দশক আলেকজান্ডারের ছত্রছায়ায় ছিলেন, তারাই তার ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। এদের মধ্যে ছিলেন টলেমি নামের এক মেসিডোনীয়। গুজব মতে, তিনিও ফিলিপের অবৈধ সন্তান ছিলেন। এ ছাড়া, অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন আলেকজান্ডারের বিশ্বস্ত সেনাপতি অ্যান্টিগোনাস, ভারত অভিযানের সঙ্গী লাইসিমাকাস ও পেরদিক্কাস।

এককভাবে কারো কর্তৃত্ব মেনে নিতে না পেরে মেসিডোনীয়রা একধরনের বোঝাপড়ায় উপনীত হয়। ফিলিপ নামসর্বস্ব রাজা হিসেবে শাসন চালিয়ে যাবেন আর যখন রক্সানের শিশু বড় হবে (অবশ্যই যদি সে ছেলে হয়), তাহলে ফিলিপ ও সেই শিশু যৌথভাবে দেশ শাসন করবে। তবে উভয়ের জন্যই এক রাজপ্রতিনিধি বা রিজেন্ট প্রয়োজন হবে। এই দায়িত্ব দেওয়া হল পেরদিক্কাসকে।

সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল হিসেবে ব্যাবিলনকে নির্বাচন করা হল। এখান থেকেই তার কার্যক্রম চালাবেন পেরদিক্কাস। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা পার্সি ব্যবস্থা অনুযায়ী সাতরাপের দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন। টলেমি মিশরের দায়িত্ব পেলেন। অ্যান্টিগোনাসের হাতে গেল এশিয়া মাইনরের বেশিরভাগ অংশ (লাইসিয়া, প্যামফিলিয়া ও বৃহত্তর ফ্রিজিয়া), লাইসিমাকাস পেলেন থ্রেসের দায়িত্ব। আলেকজান্ডারের অপর এক বিশ্বস্ত কর্মকর্তা অ্যান্টিপেটার রাজার অবর্তমানে মেসিডোনিয়া ও গ্রিস শাসনের দায়িত্ব পেলেন। অ্যান্টিপেটারের সন্তান কারিয়া পেলেন দক্ষিণ এশিয়া মাইনর উপকূলের দায়িত্ব। আরও পাঁচ কর্মকর্তা সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশের দায়িত্ব পেলেন।

এভাবে আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যকে ভেঙে সাতরাপিতে বিভক্ত করার মাঝেই প্রোথিত হল ভাঙনের সুর।

প্রায় তাৎক্ষণিকভাবেই ‘ওয়ারস অব দ্য দায়াদোচি’ বা ‘উত্তরাধিকারের যুদ্ধ শুরু হল।

৭০.২ ব্যাবিলনের বিভাজন

ঠিক নাটকের মতো, একেক দৃশ্যে আলেকজান্ডারের রাজ্যের একেক অংশে গোলযোগ লাগতে থাকে।

প্রথম দৃশ্য

রক্সানের একটি ছেলে হল। এতে পেরদিক্কাসের ক্ষমতা আরও সুসংহত হল। মেসিডোনিয়ার চতুর্থ আলেকজান্ডার নামকরণ করা হল তার। কিন্তু মিশরের টলেমির চিন্তা ভিন্ন ছিল। ভাড়াটে সেনাদের সহায়তায় তিনি প্রয়াত আলেকজান্ডারের মরদেহ ছিনিয়ে নিলেন এবং মিশরে কবর দিলেন—ভাবখানা এমন, আলেকজান্ডার যেন তারই পূর্বসূরি।

পেরদিক্কাস তার সেনাবাহিনী নিয়ে টলেমির বিরুদ্ধে লড়তে গেলেন। কিন্তু একপেশে এই লড়াইয়ে লজ্জাজনক পরাজয়ের মুখে পড়লেন তিনি। পেরদিক্কাসের বাকি অফিসাররা একজোট হয়ে তাকে হত্যা করলেন। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিলেন সেলুকাস, যিনি আলেকজান্ডারের সঙ্গে মিশরে ছিলেন।

দৃশ্যপট থেকে এক সেনাপতি উধাও হলেন। টলেমি ফিলিপ ও শিশু চতুর্থ আলেকজান্ডার উভয়কে ব্যাবিলন থেকে সরিয়ে মেসিডোনিয়ায় অ্যান্টিপাটেরের কাছে পাঠালেন। তিনি সেলুকাসকে পুরস্কার হিসেবে ব্যাবিলনের সাতরাপের দায়িত্ব দিলেন।

দ্বিতীয় দৃশ্য

৩১৯ সালে অ্যান্টিপাটের মারা গেলেন। তিনি তার ছেলে কাসানডারের (কারিয়ার সাতরাপ) কাছে মেসিডোনিয়ার দায়িত্ব দেননি।

কাসানডারকে তার পিতার ভূখণ্ড দখলে সহায়তা করতে টলেমি ও অ্যান্টিগোনাস সম্মত হলেন।

কিন্তু তখনও বহায়ল তবিয়তে বেঁচে ছিলেন আলেকজান্ডারের মা, সেই সাহসী নারী অলিম্পিয়াস। তিনি তার নাতি চতুর্থ আলেকজান্ডার ও ছেলের বউ রক্সানকে মেসিডোনিয়ার রাজধানী পেল্লায় নিয়ে এলেন। সেখানে সেনাবাহিনী সংগঠিত করে মেসিডোনিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে উদ্যত হলেন তিনি।

তবে তিন প্রতাপশালী সাতরাপের বিরুদ্ধে অলিম্পিয়াসের প্রতিরোধ বেশিদিন টেকেনি। তবে পরাজয় বরণের আগে তিনি ফিলিপকে হত্যা করেন। বস্তুত, এই হত্যাকাণ্ডের শাস্তি হিসেবেই পাথর ছুড়ে মেরে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় তিন সাতরাপ। ৩১৬ সালে পেল্লায় এসে উপস্থিত হলেন কাসানডার। অলিম্পিয়াসের ব্যবস্থা করার পর তিনি ৯ বছর বয়সি চতুর্থ আলেকজান্ডার ও তার মা রক্সানকে নিজেদের বাসায় অন্তরিন করে রাখলেন। স্ট্রাইমন নদীর কাছে অবস্থিত অ্যামফিপোলিস নামের এক প্রাসাদে, তাদের নিজেদের ‘নিরাপত্তার’ খাতিরে আটকে রইলেন তারা।

ততদিন আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্য পাঁচ ভাগে ভাগ হয়েছে। মেসিডোনিয়ায় কাসানডার, থ্রেসে লাইসিমাকাস, এশিয়া মাইনরে অ্যান্টিগোনাস, ব্যাবিলন ও পারস্যে সেলুকাস এবং মিশরে টলেমি।

তৃতীয় দৃশ্য

মেসিডোনিয়ায় অ্যামফিপোলিসের প্রাসাদে ৩১০ সালে নৈশভোজের সময় মদ খেলেন রক্স্যান ও চতুর্থ আলেকজান্ডার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুইজনই মারা গেলেন। আলেকজান্ডারের সর্বশেষ বংশধর এভাবেই ১২ বছর বয়সে প্রাণ হারালেন।

কিন্তু এই সংবাদ কেউ জানতে পারল না। নিঃসন্দেহে এর পেছনে কাসানডারের হাত ছিল, যিনি মেসিডোনিয়ার রাজার ভূমিকায় ছিলেন। পরবর্তী পাঁচ বছর এ বিষয়টি নিয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করল না। কাসানডার সহ বাকি সব সাতরাপ এমন ভাব দেখাল যেন তারা সবাই রাজার অধীনেই কাজ করে যাচ্ছেন।

পাঁচ সাতরাপের কেউই নিজেকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করতে চাননি, কারণ এরকম কিছু করলেই বাকি চারজন জোট বেঁধে তার বিরুদ্ধে লড়বে।

চতুর্থ দৃশ্য

এই ভারসাম্য পরিস্থিতি থেকে সবার আগে বের হলেন অ্যান্টিগোনাস। তার ছেলে ডিমোট্র… ..টি যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর তিনি এই উদ্যোগ নিলেন। ৩০৭ সালে অ্যাথেন্সে হামলা চালান তিনি।

অ্যান্টিপাটেরের মতো কাসানডারও মেসিডোনিয়ার পাশাপাশি গ্রিসেরও শাসক ছিলেন। ডিমেট্রিয়াস অ্যাথেন্সে এসে কাসানডারের লোকজনকে পিটিয়ে বিদায় করলেন। তারপর তিনি সালামিসে টলেমির নৌবহরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হলেন।

কাসানডার ও টলেমিকে পরাজিত করার সুবাদে এরপর অ্যান্টিগোনাস নিজেকে ‘রাজা’ হিসেবে অভিহিত করতে লাগলেন। লাইসিমাকাস (থ্রেস) ও সেলুকাস (ব্যবিলন) এই ‘একচোখা দানবকে’ (যুদ্ধক্ষেত্রে এক চোখ হারিয়েছিলেন অ্যান্টিগোনাস) খেপাতে চাইলেন না। তার বিরুদ্ধাচরণ না করে এই দুজনও নিজেকে রাজা বলে সম্বোধন করতে লাগলেন। টলেমি ও কাসানডারও তাই করলেন। ততদিনে কেউ মুখে উচ্চারণ না করলেও চতুর্থ আলেকজান্ডারের মৃত্যুর বিষয়টি সবাই বুঝে নিয়েছিল।

পঞ্চম দৃশ্য

৩০১ সালে ইপসাসের যুদ্ধে কাসানডার, লাইসিমাকাস ও অ্যান্টিগোনাস অংশ নেন। বিশাল এক বাহিনী নিয়ে সেলুকাস এসে লাইসিমাকাস ও কাসানডারের পক্ষে যোগ দিলে যুদ্ধে ফল আসে।

৮০ বছর বয়সি অ্যান্টিগোনাস প্রাণপণ যুদ্ধ করেন। যুদ্ধক্ষেত্রেই তিনি মারা যান। তার ছেলে গ্রিসে পালিয়ে যেয়ে নিজেকে রাজা হিসেবে ঘোষণা দেন। তার পিতার সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে ছিল এশিয়া মাইনর, কিন্তু তিনি সে-অঞ্চলের দখল ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন পরিত্যাগ করেন। লাইসিমাকাস এশিয়া মাইনরের পশ্চিম অংশ অধিগ্রহণ করে থ্রেসের অংশ করে নেন। বাকিটুকু যায় সেলুকাসের কাছে। এই যুদ্ধে কাসানডারের অর্জন অতি সামান্য। তখনো পাঁচ রাজা টিকে রইলেন (অ্যান্টিগোনাসের বদলে ডিমেট্রিয়াস), কিন্তু সীমান্তে অনেক পরিবর্তন এল।

ষষ্ঠ দৃশ্য

অন্যান্য রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় সেলুকাস ভারতীয় রাজা চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গেও দরকষাকষি অব্যাহত রেখেছিলেন।

৩২৫ থেকে ৩২১ সালের মাঝে এই রাজা ক্ষমতায় আসেন। মৌর্য নামে তার ছোট রাজত্বের রাজা ছিলেন তিনি। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি মগধ রাজ্যের শেষ নন্দ রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। মগধ রাজ্য দখলের পর তার ছোট রাজত্ব সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

তার সাফল্যের অন্যতম নিয়ামক ছিলেন তার সবচেয়ে কাছের মানুষ কৌটিল্য। রাজসভার এই সভাসদ প্রাচীন রাজনৈতিক নীতিমালা ‘অর্থশাস্ত্র’ রচণার জন্য বিখ্যাত। কৌটিল্য বলেন, শাসকের মূলত দুইটি কাজ। প্রথমত, শাসককে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর জন্য শ্রেণিবিভাজন ব্যবস্থা বা বর্ণপ্রথা মেনে চলতে হবে।

‘নিজের কর্তব্য পালন স্বর্গ ও অনন্ত আনন্দের দিকে ধাবিত করে। যখন এটি লঙ্ঘিত হবে, তখন জাতপাত এবং কর্তব্যের বিভ্রান্তির কারণে পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে। অতএব রাজা প্রজাদিগকে তাদের কর্তব্য থেকে বিচ্যুত থেকে দিবেন না; কেননা যে ব্যক্তি নিজের কর্তব্য পালন করবে, আর্যদের রীতিনীতি মেনে চলবে এবং ধর্মীয় জীবনের বর্ণ ও বিভাজনের নিয়ম মেনে চলবে, সে নিশ্চয়ই ইহকাল ও পরকালে সুখী হবে।’

‘এবং প্রতিটি প্রতিবেশী তার বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনা করছে, এমন সন্দেহ পোষণ করে এবং যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে বাইরের শৃঙ্খলা রক্ষা করতে করাও তার দায়িত্ব।’

তবে এক্ষেত্রে চন্দ্রগুপ্তের প্রতিবেশীরা কী চাইতেন তা জানা না-গেলেও তিনি নিজে নিঃসন্দেহে সাম্রাজ্য বিস্তারে আগ্রহী ছিলেন। তিনি গঙ্গা পেরিয়ে নিজের প্রভাবকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই উদ্দেশ্য হাসিল করতে তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান সেলুকাস, যিনি আলেকজান্ডারের অধিকৃত ভারতীয় ভূখণ্ডের অধিকর্তা ছিলেন।

সেলুকাসকে একটি প্রস্তাব দিলেন চন্দ্রগুপ্ত। তিনি তাকে যুদ্ধের জন্য হাতি সরবরাহ করবেন। বিনিময়ে, সেলুকাসকে তার ভারতীয় ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ চন্দ্রগুপ্তের হাতে তুলে দিতে হবে। বুদ্ধিমান সেলুকাস বুঝতে পেরেছিলেন, একই সঙ্গে তিনি তার রাজত্বের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্ত রক্ষা করতে পারবেন না। ২৯৯ সালে তাদের মধ্যে এই চুক্তি সম্পন্ন হয়।

সপ্তম দৃশ্য

একই বছর ডিমেট্রিয়াস মেসিডোনিয়া দখল করেন। এর আগের বছর কাসানডার মারা গেলে তার ছেলেরা নিজেদের মাঝে লড়াই শুরু করে। এক ছেলে ডিমেট্রিয়াসের কাছে সাহায্য চান। তবে এতে হিতে বিপরীত হয়। গ্রিক রাজা কাসানডারের দুই উত্তরাধিকারীকে পরাজিত করে মেসিডোনিয়াকে গ্রিসের অংশ করে নেন।

ততদিনে রাজার সংখ্যা পাঁচ থেকে চারে নেমে আসে অন্তরীণ টলেমি, সেলুকাস, লাইসিমাকাস ও ডিমেট্রিয়াস।

এ সময় দৃশ্যপটে হাজির হন পিরহাস। তিনি ছিলেন এপিরাসের রাজার নাতি ও অলিম্পিয়ার (আলেকজান্ডারের স্ত্রী) ভাইয়ের ছেলে। তিনি ছিলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের চাচাতো ভাই। বুদ্ধিমানের মতো তিনি টলেমির সৎমেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পর তিনি তার শ্বশুরের কাছে সহায়তা চাইলেন। উদ্দেশ্য, পিতৃপুরুষের ভূখণ্ড এপিরাসের দখল ফিরে পাওয়া। এপিরাস তখন গ্রিসের অংশ। তিনি তার বাহিনী নিয়ে ডিমেট্রিয়াসকে আক্রমণ করলেন। মিশরীয় বাহিনীর সহায়তায় পিরহাস এপিরাসের দখল ফিরে পান। ২৮৬ সাল নাগাদ তিনি মেসিডোনিয়ার বাকি অঞ্চলও দখল করে নেন।

ডিমেট্রিয়াস পালিয়ে এশিয়া মাইনরে চলে যান। ততদিনে তিনি মদে আসক্ত হয়ে পড়েছেন। অহংকারী ডিমেট্রিয়াস পূর্বে সেলুকাসের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। সেলুকাস মাছি-মারার মতো তার বাহিনীকে পরাভূত করেন এবং তাকে গৃহে অন্তরিন করে রাখেন। সেখানেই মদ খেয়ে খেয়ে তার মৃত্যু হয়।

মেসিডোনিয়ায় দুই বছর রাজত্ব করেন পিরহাস। এরপর থ্রেস থেকে এসে লাইসিমাকাস তাকে পরাজিত করেন। পিরহাস এপিরাসে পালিয়ে যান। প্রয়াত আলেকজান্ডারের চাচাতো ভাইয়ের প্রতি সম্মান জানিয়ে লাইসিমাকাস এপিরাস দখলের চেষ্টা চালাননি।

চার রাজা থেকে কমে তিন রাজা অবশিষ্ট থাকে—টলেমি, সেলুকাস ও লাইসিমাকাস।

সাতরাপগুলো তিন রাজত্বে বিভক্ত হল—টলেমিক, সেলুসিড ও থ্রেশিয়ান- মেসিডোনিয়ান ভূখণ্ড।

সেসময় ইতালিতেও একধরনের উত্তরাধিকারীর যুদ্ধ চলছিল।

রোম তখন দক্ষিণের গ্রিক উপনিবেশ তারেনতামের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাচ্ছে। তারেনতাম গ্রিসের সব অংশে সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠান। পিরহাস এতে সাড়া দেন। এপিরাসে চুপচাপ বসে থেকে তার কিছু করার ছিল না। তিনি ভাবলেন এই যুদ্ধের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা বাড়াবেন বা গৌরব অর্জন করবেন।

এপিরাস ছেড়ে তারেনতামের উদ্দেশে জাহাজে করে রওনা হলে পিরহাস। তার সঙ্গে ছিল কার্থেজ থেকে আনা হাতি ও মূলত স্যামনাইট ভাড়াটে সেনা। যখন রোমানরা হামলা চালাল, তখন এপিরাসের সুরক্ষা দিলেন পিরহাস। রোমানরা সম্ভবত এর আগে কোনোদিন হাতি দেখেনি। রোমান বাহিনীকে ধাওয়া দিয়ে রোমের ৪০ মাইলের মধ্যে নিয়ে যান পিরহাস।

২৭৯ সালে তিনি আরেক যুদ্ধে অংশ নেন। এবারের যুদ্ধক্ষেত্র ছিল আসকুলাম। এই যুদ্ধে জিতলেও তিনি অসংখ্য সেনা হারান। যখন পিরহাসকে অপর এক সেনা অভিনন্দন জানান, তখন তিনি জবাব দেন, ‘এরকম আরেকটি বিজয় আমাকে শেষ করে দেবে।’ প্লুটার্ক বলেন, ‘ততদিনে সঙ্গে নিয়ে আসা বাহিনীর বেশিরভাগ অংশ হারিয়েছেন তিনি। তার নিজের বন্ধু, প্রধান সেনাপতিসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ যুদ্ধে নিহত হন এবং নতুন করে কাউকে দলে টানার সুযোগ ছিল না।’

অপরদিকে, ফোয়ারার অব্যাহত পানির ধারার মতো নতুন নতুন সেনা রোম থেকে বের হয়ে আসতে লাগল।

২৭৫ সালে পিরহাস রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পিঠটান দিলেন। তারেনতাম ছেড়ে ফিরে গেলেন গ্রিসে।

৩ বছর পর রোমানরা অবশেষে তারেনতাম দখল করতে সক্ষম হয়। একই বছর পিরহাস স্পার্টার গৃহযুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধক্ষেত্রে এক বাড়ির ছাদ থেকে তার মাথায় পাথর ছুড়ে মারেন এক বৃদ্ধা। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারান পিরহাস এবং তার প্রতিপক্ষ তাকে সহজেই হত্যা করেন। তার মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *