ষষ্ঠ অধ্যায় – শিলচরে সত্যাগ্রহী হত্যা:পশ্চিমবঙ্গে প্রতিক্রিয়া, ১৯৬১
আমরা জানি, বাংলা ভাষার দাবিতে ১৯৬১ সালের ১৯ মে সত্যাগ্রহের প্রথম দিনেই আসাম সরকারের সশস্ত্র বাহিনী নিরুপদ্রব নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের ওপর বেপরোয়া গুলি চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হতাহত করে। হতাহতদের মধ্যে একজন নারীসহ ৯ জন প্রথম দিনেই নিহত হন। গুলিবিদ্ধদের মধ্যে দু-জন পরদিন মৃত্যুবরণ করেন। শিলচর, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দির হাসপাতালগুলো আহতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। কেবল শিলচর সদর হাসপাতালেই গুলিবিদ্ধ ৭৭ জনের চিকিৎসা সেবা নেওয়ার সংবাদ জানা গেছে। এদের মধ্যে আমরা ৫২ জন গুলিবিদ্ধ আহত সত্যাগ্রহীর নাম ঠিকানা বর্তমান গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করতে পেরেছি অর্ধ শতাব্দীরও পর, এ আমাদের লজ্জা। এই নৃশংস নারকীয় হত্যাকান্ড সংবাদ আসামসহ সমগ্র ভারতবর্ষ তো বটেই, আন্তর্জাতিক মহলকেও নাড়া দেয়। কারণ এ মৃত্যু মাতৃভাষার দাবিতে, মাতৃভাষার মান বাঁচাতে গিয়ে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে উপমহাদেশ তো বটেই সমগ্র বিশ্বে কোনো সত্যাগ্রহী নারীর মাতৃভাষার জন্য প্রাণদানের ঘটনা আর ঘটেছে কি না আমরা জানি না।
শিলচরের নৃশংস হত্যাকান্ডে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ প্রচন্ড ক্ষোভে, দুঃখে, যন্ত্রণায় দিশেহারা হয়ে পড়েন। কারণটা সঙ্গত, সত্য। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাঙালি, পড়শি প্রদেশও বটে। আসামের ঘটনাস্থলসহ কাছাড় জেলা বাঙালি অধ্যুষিত আসামের যদিও সেখানে সর্বত্রই উল্লেখ্যযোগ্য বাঙালির বাস রয়েছে এবং তাঁরা নানা উপলক্ষ্যে ঘর বেঁধেছেন। আর সিলেট জেলা তো আসাম প্রদেশ গঠিত হওয়ার সময় থেকে অর্থাৎ ১৮৭৪ থেকে ১৯৪৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত আসামভুক্ত ছিল। ফলে, সম্প্রদায়গত দিক থেকেও আসামের বাঙালিদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে একটা যোগসূত্র গড়ে ওঠে। চাকরিসূত্রেও অনেকে আসামে ঘর বেঁধেছিলেন। ব্যাবসা, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি সূত্রেও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আসামের মানুষের সখ্যতা রয়েছে। ফলে এই প্রতিক্রিয়া ছিল স্বাভাবিক।
শনিবার অর্থাৎ ২০ মে ১৯৬১, ‘কলকাতার ইডেন উদ্যানে রবীন্দ্র শতাব্দী জয়ন্তী সমিতির মেলা ও লোকরঞ্জন মন্ডপে অনুষ্ঠানকালে এবং ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে জনসংঘ আয়োজিত এক সভায় ঐ নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে বাংলার বলিষ্ঠ নিন্দা অভিব্যক্তি লাভ করে। …
ইতিমধ্যে শনিবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে প্রচারিত বিভিন্ন বিবৃতিতে আসামে প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরুর উপস্থিতি সত্ত্বেও এরূপ নৃশংস ‘শিশুঘাতী নারীঘাতী’ ‘হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রবল ধিক্কার ধ্বনিত হয় এবং এ ব্যাপারে অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের এবং বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান হয়।’
সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লকের চেয়ারম্যান শ্রী হেমন্তকুমার বসু, এম.এল.এ এক বিবৃতিতে বলেন, শান্তিপূর্ণ জনতার উপর আসাম সরকারের এই আক্রমণের নিন্দা করিবার মতো ভাষা আমার নাই। আরও আশ্চর্যের বিষয় প্রধানমন্ত্রী নেহরুর আসাম উপস্থিতিতেই এই কান্ড ঘটিয়াছে এবং তিনি ইহার প্রতিবাদে একটি কথাও বলেন নাই।
কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যপরিষদ অবিলম্বে ঐ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান। কমিউনিস্ট এম.পি. শ্রী হীরেন মুখার্জী প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরুর কাছে গৌহাটিতে প্রেরিত এক তারবার্তায় ‘নাগরিক অধিকারের ওপর ঐ ঘৃণ্য আক্রমণের উল্লেখ করেন এবং আসাম সরকারের দুষ্কর্মের একটা সীমা থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেন।’
পশ্চিমবঙ্গ প্রজা-সমাজতন্ত্রী দলের চেয়ারম্যান শ্রীমতী লীলা রায় প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরুকে আসাম সরকারের ওপর তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে এবং বাঙ্গালিদের বৈধ দাবি স্বীকার করে নিতে আবেদন জানান।
পশ্চিমবঙ্গ জনসংঘের সভাপতি শ্রী দেবপ্রসাদ ঘোষ বলেন, ‘আসামে ক্ষমতাধিষ্ঠিত দল বাঙ্গালিদের শিক্ষা দিতে চাচ্ছেন। তারা এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করতে চান— যা জালিয়ানওয়ালাবাগ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সার্পেভিল হত্যাকান্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়’।
আর.এস.পি-র সাধারণ সম্পাদক শ্রী ত্রিদিব চৌধুরী এম.পি. বলেন, ‘মনে হয় আসাম সরকার এবং আসামের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষাগোষ্ঠী রক্তপাত ও হিংসার সাহায্যেই অসমিয়া জঙ্গি ভাষাগত জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করতে বদ্ধপরিকর’।
আর.সি.পি.আই-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সেক্রেটারি শ্রী সুধীন্দ্রনাথ কুমার গুলি চালনার জন্য দায়ী অফিসারদের অবিলম্বে সাময়িক কর্মচ্যুতি এবং নিরপেক্ষ উচ্চ পর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।
পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভার সম্পাদক শ্রী হরেকৃষ্ণ কোঙার ঐ হত্যাকান্ডের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান। বিপ্লবী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্রী পরিমল মজুমদার বলেন, ‘রবীন্দ্র দরদী প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরু এ সময় আসামে উপস্থিত। দক্ষিণ-আফ্রিকায় নির্যাতিতদের জন্য শ্রী নেহরু সেদিন কী অশ্রুই না বিসর্জন করেছিলেন। কিন্তু আজ তিনি নীরব।’ কাছাড়ের বিশিষ্ট নেতা ও ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান শ্রী সতীন্দ্রমোহন দেব বর্তমানে অসুস্থ হয়ে কলকাতায় অবস্থান করছেন। ২০ মে শনিবার তিনি এক বিবৃতিতে শিলচরে গুলীবর্ষণের বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী করেন এবং আসাম সরকারের অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদে কাছাড়ের সকল এম.এল.এ এবং এম.পি.-দের অবিলম্বে পদত্যাগের জন্য আবেদন জানান। শ্রীদেব বলেন, তিনি অসুস্থতা সত্ত্বেও দু-একদিনের মধ্যে শিলচর যাচ্ছেন।’
‘শনিবার সন্ধ্যায় কলকাতা ইডেন গার্ডেনে রবীন্দ্র শতাব্দী জয়ন্তী সমিতির মেলা ও লোকরঞ্জন বিভাগের মন্ডপে ঐ দিনের নির্দিষ্ট কর্মসূচি আরম্ভ হওয়ার পূর্বে শিলচরে সত্যাগ্রহী নিরস্ত্র জনতার ওপর অসমিয়া পুলিশের নির্বিচারে গুলীবর্ষণের তীব্র নিন্দা করা হয়। এবং বাঙ্গলাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষারূপে স্বীকৃতি দেবার দাবি জানানো হয়। বাঙ্গলার গণমানস আসাম সরকারের এই হিংস্র আচরণে তীব্র বেদনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। সেই বিক্ষোভ ও বেদনার প্রকাশ পেল রবীন্দ্র শতাব্দী জয়ন্তী সমিতির মেলা ও লোকরঞ্জন বিভাগের মন্ডপে। জনতার অন্তরের ক্ষোভ প্রতিধ্বনিত হল তাদের কন্ঠে। লোক সংস্কৃতি মন্ডপে যে সমাবেশ হয়, তাতে সভাপতিত্ব করেন শ্রী মানিকলাল দাস। শ্রী তারাপদ চক্রবর্তী এক প্রস্তাবে অবিলম্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবীও জানান। ড. যোগেশচন্দ্র মুখার্জী প্রস্তাবটি সমর্থন করেন।
শনিবারের এই সভায় নিখিল ভারত জনসংঘের সাধারণ সম্পাদক পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে আসাম সরকারের নতুন করে বাঙ্গালি নিধনযজ্ঞ শুরু করার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন যে, কোনো গণতান্ত্রিক দেশে যে এরূপ দমননীতি চালানো যেতে পারে, তা তাঁর ধারণা ছিল না। প্রারম্ভে ভারতীয় জনসংঘের সভাপতি অধ্যক্ষ দেবপ্রসাদ ঘোষ বলেন যে, ভাষা আন্দোলনে আত্মাহুতি দিয়ে কাছাড়ের বাঙ্গালিরা রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত স্মৃতি তর্পণ করলেন। সভায় আসাম মন্ত্রিসভার পদত্যাগের দাবি জানিয়ে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়।’১
২১ মে রবিবার ‘কলকাতায় দুটি বিশাল জনসভায় শিলচরের হত্যাযজ্ঞে কেন্দ্রীয় সরকারের নিষ্ক্রিয়তার তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। সভা থেকে আগামী ২৪ মে বুধবার সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে সর্বাত্মক হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রজা সমাজতন্ত্রী ছাড়া অপরাপর বামপন্থী দল ময়দানে এবং প্রজা সমাজতন্ত্রী দল সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। দুটি জনসভায়ই সমবেত জনতার প্রবল ধিক্কার ধ্বনির মধ্যে আসাম সরকারের বাঙ্গালিদ্বেষী ‘নরঘাতন’ নিষ্ঠুর দমননীতি এবং কেন্দ্রীয় সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরুর প্রতিকারে অসমর্থ নিষ্ক্রিয় এবং প্রকৃতপক্ষে আসাম সরকারের ‘পক্ষপাতমূলক’ নীতির তীব্র নিন্দা করে বিভিন্ন বক্তা বক্তৃতা দেন। কোনো কোনো বক্তা এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, শুধু প্রতিবাদ সভা, প্রস্তাব পাস, হরতাল পালন প্রভৃতি কর্মসূচি অনুসরণ করলেই বাঙ্গালির কর্তব্য শেষ হয়ে যাবে না। বাঙ্গালি যুবকদের দলে দলে কাছাড়ে গিয়ে প্রয়োজন হলে পুলিশের বুলেট মাথায় পেতে নিতে হবে, কাছাড়ের জেলগুলি ভরে ফেলতে হবে।’
‘ময়দানের জনসভায় সভাপতিত্ব করেন শ্রী বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়। আর. এস. পি., কম্যুনিস্ট পার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক, মার্কসিস্ট ফরওয়ার্ড ব্লক, এস.ইউ.সি, বলশেভিক পার্টি, আর. সি. পি. আই. ডব্লিউ. পি. আই এবং সাধারণতন্ত্রী দলের উদ্যোগে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সূচনায় পুলিশের বর্বর গুলীবর্ষণে নিহত ১১ জনের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য দুই মিনিটকাল নীরবতা পালন করা হয়।
সভায় গৃহীত প্রস্তাবে আশু বিচার বিভাগীয় তদন্ত, দোষী কর্মচারীদের যথোপযুক্ত শাস্তি এবং নিহতদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেবার দাবি জানানো হয়। বলা হয়, যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সন্দেহ জাগে যে, বোধ হয় এই সমগ্র ঘটনার পেছনে একটা পরিকল্পনা ছিল, এবং এটাও স্পষ্ট যে, যা কিছু ঘটছিল— সে সম্বন্ধে ভারত সরকার ওয়াকিবহাল ছিলেন। এমন একটি সঙ্কট রোধ করবার জন্য ভারত সরকারের যথাসময়েই ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত ছিল। কিন্তু তাঁরা তা করেননি।
শ্রী ত্রিদিব চৌধুরী, এম.পি. ওই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, কাছাড়বাসীরা প্রথমে সংবিধানসম্মত পথে সকল প্রকার আবেদন নিবেদনের পথ অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু ঐসব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় আন্দোলন করা ছাড়া তাঁদের সম্মুখে অন্য কোনো পথ ছিল না। আশ্চর্যের বিষয়, প্রধানমন্ত্রীর আসামে উপস্থিতিতেই এরূপ নৃশংস হত্যাকান্ড অনুষ্ঠিত হয়। তিনি নিহতদের জন্য কোনো সমবেদনা জানালেন না। বরং আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে ভর্ৎসনাই বর্ষণ করেছেন। মাতৃভাষার দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙ্গালিকে আরও স্বার্থত্যাগ, আরও দুঃখবরণ, আরও সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
শ্রী হীরেন মুখার্জী, এম.পি. বলেন, সত্যাগ্রহ আন্দোলন দমনে আসাম সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তা কি শ্রী নেহরু জানতেন না? তারা বাংলা ও বাঙ্গালিকে এত ভয় করেন কেন যে বাঙ্গালিকে শিক্ষা দেবার জন্য এই জালিয়ানওয়ালাবাগী হত্যাকান্ড? তাঁরা জেনে রাখুন যে দমননীতির দ্বারা বাঙ্গালির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কন্ঠ রুদ্ধ করা যাবে না।
শ্রীহেমন্তকুমার বসু, এম.এল.এ, বলেন, ভারত সরকার নিজেদের গদি ঠিক রাখার জন্য আসাম সরকারের প্রাদেশিকতার দাবীকে স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁরা বাঙ্গালিদের ন্যায্য দাবি মেনে নিতে প্রস্তুত নন। এর ভেতর রাজনীতিও আছে। প্রগতিশীল বাঙ্গালিকে তারা ভয় করেন।
শ্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, এম.এল.এ, বলেন, ‘আসামে বিগত বাঙ্গালি পীড়ন আন্দোলনকালে আসামের ‘বৈষ্ণব সরকার’ গুলি ছুঁড়তে পারেননি। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতাকে ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ’ বলে অভিহিত করেন এবং বলেন যে, শ্রীনেহরুর কাছে আবেদন করে কোনো লাভ হবে না, বাংলার জাগ্রত জনমতের কাছে আবেদন জানাতে হবে।… কাছাড়ে যে অত্যাচার অনুষ্ঠিত হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং কংগ্রেস তার সক্রিয় প্রতিবাদ করতে চান কিনা তা তিনি জানতে চান। অন্যথায় তিনি তাঁদের চলে যেতে অনুরোধ করবেন। …
ড. ত্রিগুণা সেন বলেন, ‘বাঙ্গালি কি চিরকাল প্রতিবাদ সভা, হরতাল পালনের মধ্য দিয়েই তাঁদের কর্তব্য শেষ করবে? বাঙ্গালি হিসেবে তাঁরা শ্রীনেহরুর কাছে থেকে কোনো আশা রাখেন না। তিনি বলেন, কাছাড়ের বাঙ্গালিদের ভোটে শ্রীচালিহা আজ আসামের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি প্রস্তাব করেন, শ্রীচালিহা বদরপুর বা কাছাড়ের যে কোনো স্থান থেকে ভাষার প্রশ্নে পদত্যাগ করে পুননির্বাচনের সম্মুখীন হোন। তাঁরা কোনো দলের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিনিধিকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করাবেন না, একটি ভারবাহী জীবের নাম করে বলেন, ওটাকে দাঁড় করালেও তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, এই নির্বাচনে শ্রীচালিহা হেরে যাবেন। তিনি বাঙ্গালি যুবকদের দলে দলে কারফিউর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পুলিশের গুলী বুক পেতে নিতে এবং কারাবরণ করবার জন্য আবেদন জানান।’
সভাপতি শ্রী মুখার্জী বাংলার সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশে কাছাড়ে বর্বর পীড়নের প্রতিবাদে এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চরমতম লাঞ্ছনার দিনে সরকার প্রদত্ত খেতাব বর্জন করবার জন্য আবেদন জানান। …তিনি সকল রাজনৈতিক দলকে একত্র হয়ে কাছাড়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য দশ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রেরণের জন্যও অনুরোধ করেন।
শ্রী নীহার মুখার্জী এবং শ্রী বিমলানন্দ মুখার্জীও বক্তৃতা করেন।
‘রবিবার প্রজা-সোশ্যালিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ শাখার উদ্যোগে আসামের সাম্প্রতিক ঘটনার প্রতিবাদ জ্ঞাপনের জন্য অনুষ্ঠিত এক জনসভায় আসাম সরকারের ‘হিংস্র ও বর্বর দমননীতি’ সম্পর্কে বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং অবিলম্বে আসাম মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবী করে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঐ সভায় বাংলাকে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষারূপে স্বীকৃতি দেবার দাবীও উত্থাপিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ শাখার চেয়ারম্যান শ্রীমতী লীলা রায় ঐ সভার কার্য পরিচালনা করেন।
এই জনসভাতেই আসামের শিলচরে ‘বর্বর হত্যাকান্ডের’ প্রতিবাদে আগামী বুধবার, ২৪ মে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে সর্বাত্মক হরতাল পালনের মধ্য দিয়ে গভীর শোক প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
সভায় শ্রীমতী লীলা রায় এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, শিলচরের এই ঘটনাকে নৃশংসতার দিক দিয়ে জালিয়ানওয়ালাবাগের সঙ্গে তুলনা করা চলে। আসাম সরকার বাংলাভাষীদের ন্যায্য দাবি সন্ত্রাসবাদের দ্বারা দমন করার জন্য পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিলেন বলেই মনে হয়। শ্রীমতী রায় আরও বলেন, ‘বিশ্বজনীন প্রেমে মশগুল’ শ্রী নেহরু বাইরের শান্তি রক্ষার জন্য সর্বদাই ব্যস্ত। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরেই এই ধরনের অত্যাচার সম্পর্কে তিনি নীরব এটা আশ্চর্যের কথা। ঐ ‘নৃশংস হত্যাকান্ড’ সম্পর্কে সারা রাজ্যব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তিনি দেশবাসীর কাছে আবেদন জানান। শিলচরের বিশিষ্ট জননেতা শ্রী সতীন্দ্রমোহন দেব সভায় বলেন, বাংলা ভাষার জন্য আসামে এই আন্দোলন সকলের আন্দোলন এবং এই আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। শ্রীদেব আরও বলেন যে, বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষারূপে স্বীকৃতিদানের জন্য আইনগতভাবে অথবা সংবিধানের পথে যা কিছু করণীয় তা করেও কোনো লাভ হয়নি। তাই এই সক্রিয় ভাষা আন্দোলন শুরু করতে হয়েছে। শ্রী সমর গুহ বলেন, আসামের বাংলা ভাষা-আন্দোলনের সত্যাগ্রহীরা এটাই প্রমাণ করেছে যে, নিষ্প্রাণ প্রাণ বলিদান হয়; কিন্তু মাতৃভাষা মরে না।
শ্রী হরিপদ মিত্র বলেন, সমস্ত বাংলাভাষীকে দমন করার জন্য চালিহা সরকারের চন্ডনীতি এই ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। শ্রী বিদ্যুৎ বসু, শ্রী ধীরেন ভৌমিক, শ্রী দিলীপ চক্রবর্তী প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
এ দিন পশ্চিমবঙ্গ সুভাষ সেবাদল-এর পক্ষ থেকে সম্পাদক শ্রী নির্মল রায় এক বিবৃতিতে বলেন যে:
সাম্প্রতিক ঘটনায় আসামে অহিংস ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর কংগ্রেসি সরকারের ‘চরম চন্ডনীতি’ নগ্নরূপে প্রতিফলিত হয়েছে। ঐ ঘটনা সম্পর্কে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতিতে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের অবিলম্বে শাস্তি বিধানের দাবি উত্থাপন করা হয়েছে।’২
২৪ মে বুধবার শান্তিপূর্ণভাবে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে হরতাল পালনের জন্য বামপন্থী নেতৃবৃন্দ জনগণের প্রতি আবেদন জানালেন। সর্বশ্রী জ্যোতি বসু (কমিউনিস্ট পার্টি), হেমন্তকুমার বসু (ফ ব), মাখন পাল (আর এস পি), তারা দত্ত (ফ ব মা), নীহার মুখার্জি (এস ইউ সি), বরদা মুকুটমণি (বি পি), হেমেন্দ্র মুখার্জি (ডবলিউ সি আই) এবং বিমলানন্দ মুখার্জি (আর সি পি আই) নিম্নলিখিত বিবৃতি দিয়েছেন,
‘শিলচরে শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রীদের ওপর পুলিশের বর্বর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের তীব্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রকাশ করবার জন্য আমরা ২৪ মে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গব্যাপী হরতাল পালন করবার জন্য ইতিপূর্বেই আহ্বান জানিয়েছি। বাংলা ভাষার ন্যায্য অধিকার অর্জনের জন্য কাছাড়ে যে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে, তার প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করার জন্যও এই দিন প্রতিপালিত হবে।
হরতাল বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে। অত্যাবশ্যক প্রতিষ্ঠান, যথা— অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল, ডাক্তারখানা, ফায়ার ব্রিগেড, ওয়াটার সাপ্লাই, ইলেকট্রিক, দুগ্ধ সরবরাহ, গ্যাস এবং প্রেস এই হরতালের আওতায় পড়বে না।
হরতাল শেষ হবার পর ঐদিন সন্ধ্যা ছ’টায় মনুমেন্টের পাদদেশে একটি কেন্দ্রীয় সভা হবে। প্রত্যেকটি জেলা শহরে এবং অন্য যেখানে যেখানে সম্ভব এ রকম সভা করতে হবে। সভাগুলিতে গৃহীত প্রস্তাবের অনুলিপি প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠাতে হবে।
পশ্চিমবাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহ্য অনুযায়ী মর্যাদার সঙ্গে এবং শান্তিপূর্ণভাবে দিনটি প্রতিপালনের জন্য এই রাজ্যের জনগণের প্রতিটি অংশের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।
পশ্চিমবঙ্গ প্রজা-সোশ্যালিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান শ্রীযুক্তা লীলা রায় আগামী ২৪ মে বুধবার শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণের কাছে আবেদন জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা কাছাড়ের ভাইবোনদের এই আশ্বাস দিতে পারি যে, পশ্চিমবাংলার আপামর জনসাধারণ কাছাড়বাসীর আসামে বাংলা ভাষার সম্মানজনক যোগ্য স্থান প্রতিষ্ঠার ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের পশ্চাতে রয়েছে।’
এদিকে ছাত্রসংস্থা বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন, ডি এসও এবং পি এস ইউ-এর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়:
মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে শিলচরের জনসাধারণ পুলিশের নির্মম অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছে। পুলিশের গুলিচালনার সংবাদে পশ্চিমবাংলার ছাত্রসমাজ অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ। কাছাড়ের জনসাধারণের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নেবার জন্য আমরা আসাম রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট দাবি জানাচ্ছি।
অল ইণ্ডিয়া স্টুডেন্টস ব্লকের পক্ষ থেকে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ভাষা-সত্যাগ্রহীদের শত প্ররোচনা সত্ত্বেও এই শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি।’
২৪ মে সারা বাংলায় হরতাল পালন করে আসাম সরকারকে ধিক্কার দেবার জন্য বিপ্লবী ছাত্র সংস্থা এবং নিখিল বঙ্গ ছাত্র ব্লকও আবেদন জানান।’৩
‘…কলকাতা হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন গত সোমবার অর্থাৎ ২২ মে এক সভায় কাছাড়ে শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণে গভীর দুঃখ ও ঘৃণা প্রকাশ করে এক প্রস্তাব গ্রহণ করেন।’ প্রস্তাবে বলা হয়, ‘সভা এই ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের নিষ্ক্রিয়তার তীব্র নিন্দা করছে এবং সংবিধান অনুসারে ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অধিকার অস্বীকারে আসাম সরকারের কুচক্রান্তকে সমর্থন করাই তাঁদের এই নীরবতার অর্থ বলে মনে করেন। এই সভা আরও মনে করেন যে, আসামের কংগ্রেস সরকার আসামের সংখ্যালঘুদের জীবন ও স্বার্থ রক্ষায় অক্ষম এবং এই হেতু তাঁদের পদত্যাগ করা কর্তব্য।’৪
‘কলকাতা বারের সদস্যগণ সোমবার এক সভায় ‘নিরস্ত্র অসহায় নরনারী ও শিশুকে হত্যার জন্য বন্দুক ধারণের’ তীব্র নিন্দা করে এক প্রস্তাব গ্রহণ করেন। সভা নিহত সত্যাগ্রহীদের শোকার্ত পরিবারবর্গের উদ্দেশ্যে সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন।
কলকাতা সিটি কোর্টস বার অ্যাসোসিয়েশনের এক বিশেষ সভায় গৃহীত প্রস্তাবে শিলচরের বাঙালি সত্যাগ্রহী নিধনের তীব্র নিন্দা করেন। অবিলম্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরুর কাছে এক তারবার্তাও প্রেরিত হয়।
ওয়ার্কমেনস কমপেনসেশন কোর্ট বার লাইব্রেরির সদস্যগণ নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশের গুলি চালনার প্রতিবাদ করে ভারত সরকারকে বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান।
আলিপুর জেলা বার অ্যাসোসিয়েশন বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার মতো শৌর্য প্রদর্শন করায় কাছাড়বাসীগণকে অভিনন্দিত করে এক প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
অবিলম্বে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ, বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং অপরাধীদের শাস্তি দাবি করে শ্রীহট্ট সম্মিলনীর কার্য-নির্বাহক সমিতি শিলচরে গুলিবর্ষণের পরদিন অর্থাৎ ২০ মে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এক তারবার্তা প্রেরণ করেন।
সুপ্রিমকোর্ট বিচারপতি দিয়ে শিলচর হত্যার তদন্তের জন্য কাছাড় বণিক সমিতি ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নিকট তারবার্তা প্রেরণ করেন।
আর জি কর মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ, ফেডারেশন অব মার্কেন্টাইল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নও শিলচরে সত্যাগ্রহী হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।
পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র পরিষদ সভাপতি শ্রী শ্যামল ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রদেশ কার্যকরী সমিতির ২১ মে-র সভায় নিম্নলিখিত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়:
শিলচরে বাংলা ভাষাভাষী সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে এগারজন নরনারীর মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র পরিষদ অত্যন্ত মর্মাহত। পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র পরিষদ এই গুলীবর্ষণের তীব্র প্রতিবাদ করছে এবং আসামের বাংলা ভাষাভাষী জনসাধারণের প্রতি ও নিহত ব্যক্তিগণের পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছে। আমরা আশা করি, আসামের সকল শ্রেণীর মানুষের মনের শুভ ইচ্ছা ফিরে আসবে এবং শান্তিপূর্ণ পথে আসামের ভাষাসমস্যাজনিত অশান্তি দূর হবে। এ ব্যাপারে অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরুর হস্তক্ষেপ এবং উপযুক্ত বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য ছাত্র পরিষদ আবেদন জানাচ্ছে।৫
ভারত সভা হলেও জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘ভারত সভা হলের সভায় সভাপতিত্ব করেন শ্রী বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়। শ্রী নলিনাক্ষ সান্যাল, শ্রী সুধীরকুমার ঘোষ, শ্রী জ্ঞানাজন পাল এবং শ্রী জে. সি. মৈত্র সভায় বক্তৃতা কালে শিলচরের লোমহর্ষক ঘটনায় দেশের গণচিত্ত কীরূপ বিক্ষুব্ধ হয়েছ তা বিবৃত করেন এবং বাংলাভাষীদের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের অবজ্ঞা ও অবহেলার জন্য বেদনা প্রকাশ করেন। সংবিধান যেখানে অবহেলিত, সেখানে নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকা কাপুরুষতা।
সভাপতি শ্রী বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় বলেন, বাংলা ভাষাভাষীদের ওপর গত বৎসর যে লাঞ্ছনা ও অত্যাচার হয়, যখন বাঙ্গালিদের ঘরবাড়ি লুন্ঠিত হয়, নারীর মর্যাদাহানি হয়, তখন চালিহার পুলিস নিষ্ক্রিয় ছিল। আর কাছাড়ে নিরস্ত্র ও শান্ত সত্যাগ্রহীদের ওপর গুলী ও লাঠি চালিয়ে সেই পুলিশ নৃশংসতার পরিচয় দিল। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার তার তর্জনী তুলে এই জঘন্য ঘটনার প্রতিবাদ করল না। বাঙ্গলার রাজনৈতিক দলগুলিকে ভেদাভেদ ভুলে এ সময় সংঘবদ্ধ হবার জন্য তিনি আবেদন জানান।’৬
ভারতীয় জনসংঘ, স্বতন্ত্র পার্টি, হিন্দু মহাসভা প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বতন্ত্র পার্টির পশ্চিমবঙ্গ শাখার চেয়ারম্যান শ্রী নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সভাপতি শ্রী নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ভাষণে বলেন:
‘মাতৃভাষা বাংলার জন্য কাছাড়বাসীদের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে—তা প্রত্যেক বাঙ্গালির সমর্থন করা উচিত। এই ‘‘আধুনিক জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের’’ জন্য যারা দায়ী তাদের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। ন্যায়বিচার যদি না পাওয়া যায় তাহলে আসামের সঙ্গে কাছাড়ের সকল সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত। শ্রী চট্টোপাধ্যায় এ লজ্জাজনক ঘটনার পিছনে শ্রী চালিহার ‘চালবাজি’ রয়েছে বলে মনে করেন। আসামের ঘটনা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রধামন্ত্রী শ্রী নেহরুর ভূমিকার তিনি কঠোর সমালোচনা করেন।
সভায় গৃহীত প্রস্তাবে দুর্গাপুর অধিবেশন বর্জন ছাড়াও অবিলম্বে আসামের চালিহা মন্ত্রিসভাকে বাতিল করার, বাংলাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা দানের এবং ভাষা আন্দোলনে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুক্তিদানের অনুরোধ জানানো হয়।’৭
এদিকে বেলঘরিয়া পোস্ট অফিস মাঠে ২১ মে ‘জাগো বাঙালি’ আন্দোলনের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সভায়: ‘মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত কাছাড়ের বাঙ্গালিদের ওপর বর্বর আসাম সরকারের হিংস্র পুলিশি আক্রমণ ও ১১ জন সত্যাগ্রহীকে হত্যার প্রতিবাদে এবং বীর শহীদদের অমর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
সভায় বক্তাগণ আসামের বাংলাভাষীদের মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার সংগ্রামকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করেন এবং যে সকল বীর মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে সমগ্র বাঙ্গালি জাতির মুখকে উজ্জ্বল করেছেন— তাঁদের সেই অসমাপ্ত সংগ্রামকে সফলতার দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালি তরুণকে আসামের পথে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানান।’৮
বুধবার ২৪ মে পশ্চিমবঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সংবাদপত্রে বলা হল:
‘কাছাড়ে বঙ্গভাষা আন্দোলন দমনে আসাম সরকার নিষ্ঠুর হত্যালীলায় মত্ত হয়ে উঠলে তার প্রতি যে বিক্ষোভ পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জনসাধারণের মনে পুঞ্জীভূত হয়েছিল, এ দিন শান্ত সংহত স্বতঃস্ফূর্ত হরতালের রূপে তা আত্মপ্রকাশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ অত্যাচারীর প্রতি ক্ষোভে উদ্বেল হয়ে উঠেছে, বিকারগ্রস্ত অত্যাচারকে নিয়ত ধিক্কার দিয়েছে, তবু সে অসংযত আচরণ করে নাই, মর্যাদা হারায় নাই। ছোটখাটো দু-একটা ঘটনা বাদে কোনখানে শান্তি ও শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটেছে— এমন সংবাদ পাওয়া যায়নি।
এ দিন সকাল থেকে অপরাহ্ন পর্যন্ত কলকাতা ও শহতলির বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৭০ মাইল পরিভ্রমণ করেছি। যেখানেই গেছি, মনে হয়েছে কোনো এক চরম আঘাতে প্রাণচঞ্চল এই জগৎ বুঝি অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে। দোকান-পাট অফিস কারখানা বন্ধ, সর্বত্র নির্জনতা। কলকাতার পথে যানবাহন চলে নাই। অন্যান্য দিনের মতো ট্রামের ঘর্ঘর শোনা যায়নি। বাস, লরি, ট্যাক্সি, প্রাইভেট কারের ভয়ে কোনো পথিককে আজ সশঙ্কিত চিত্তে পথ চলতে দেখা যায়নি। কারণ সেগুলি ঐ সময়ে পথে বাহির হয় নাই। এমনকি ছ্যাকড়া গাড়ি, সাইকেল রিক্সা আড্ডায় আড্ডায় নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কর্মব্যস্ত ডালহৌসি স্কোয়ার জনশূন্য। এসপ্ল্যানেড ফাঁকা। কয়েকজন শান্ত্রী ছাড়া রাইটার্স বিল্ডিং-এ লোকজন আসে নাই। মার্চেন্ট অফিস, ব্যাঙ্ক প্রভৃতি খাঁ খাঁ করছে। শুধুমাত্র অত্যাবশক সংস্থাসমূহ— সংবাদপত্র, ডাক্তারখানা, হাসপাতাল, দুধ, জল, বিজলি ও গ্যাস সরবরাহ, ফায়ার ব্রিগেড ইত্যাদি চালু ছিল। বাঙ্গালি ঐক্য সংসদ প্রাঙ্গণে (শ্রীগোপাল মল্লিক লেন) আসামের বর্বরতার প্রতিবাদে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভা শেষে একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করা হয়।
সকাল ছ’টার আগে হাওড়া এবং শিয়ালদহ স্টেশনের নিরাপদ আশ্রয়ে যে ক’টি ট্রেন এসে পৌঁছুতে পেরেছে এবং যে ক’টি ট্রেন ছেড়েছে, সেগুলি ছাড়া আর কোনো ট্রেন যাতায়াত করেনি। যে ক’টি আপ ট্রেন ছেড়েছিল সেগুলিও গন্তব্যে পৌঁছুতে পারেনি। আপ ও ডাউন ট্রেনগুলি বিভিন্ন স্টেশনে পথের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছে। হরতাল শেষ হলে তবেই ট্রেনগুলি নড়বে। পূর্ব রেলওয়ের ৩২৮ ডাউন দিনাপুর প্যাসেঞ্জার ভদ্রেশ্বরে, ২০নং ডাউন মিথিলা এক্সপ্রেস চুঁচুড়ায়, ১নং ডাউন দুন এক্সপ্রেস ব্যাণ্ডেলে এবং দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ৪নং ডাউন মাদ্রাজ মেল ও ১নং ডাউন বোম্বে মেল খড়গপুরে আটক পড়েছিল। ১১০ ডাউন কোলফিল্ড এক্সপ্রেস, ২নং ডাউন দিল্লি মেল ও ৬নং ডাউন অমৃতসর মেল বর্ধমানে রাখা হয়। ১৬ নং ডাউন বারাণসী এক্সপ্রেস আসানসোল থেকে ছাড়ার ব্যবস্থা করা হয়। দু’একটি বাদে সকল লোকাল ট্রেনের চলাচলই ৪টা পর্যন্ত বন্ধ ছিল। এ দিন হাওড়ায় ৭৫ খানা এবং শিয়ালদহে ১৮০ খানা ট্রেন বাতিল করা হয়।’৯
‘অন্যান্য দিন অফিসের সময় যে শিয়ালদহ, হাওড়া, শ্রীরামপুর, দমদম স্টেশন প্রভৃতি লোকের ভিড়ে নি:শ্বাস ফেলবার ফুরসত পায় না, এ দিন সেসব স্থান জনশূন্য। কোথাও আটক যাত্রীরা অধীরভাবে হরতাল শেষ হবার অপেক্ষা করছে, কোথাও অলস মালবাহকের দল খালি প্লাটফর্মে তাস খেলছে কোনোখানে বা রেল-কর্মীরা পরম নিশ্চিন্তে বেঞ্চির ওপর শরীর এলিয়ে দিয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন।
দমদম বিমানঘাঁটিতে দূরের বিমানযাত্রীদের গাড়ি করে ভোর চারটায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁরা বিমানযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে যাত্রা করেছেন। যাঁরা বোম্বাই, দিল্লি, মাদ্রাজ, ঢাকা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থান থেকে এসে এ দিন দমদমে অবতরণ করেছেন— তারা ৪টা পর্যন্ত বিমানঘাঁটিতে আটক ছিলেন। …
সাঁতরাগাছি স্টেশনে পিকেটিং হয় বলে জানা গেছে। বালি ব্রিজের ওপর দিয়ে সাড়ে ১১টার সময় আমরা যখন যাই, তখন টোল আদায়কারী জানায় যে, আমাদের গাড়িটিই এ দিন ঐ ব্রিজের ওপর দিয়ে প্রথম যাচ্ছে। অবশ্য তৎপূর্বে একটি অ্যাম্বুলেন্স ঐ পথে গেছে।
কোন্নগর, ভদ্রেশ্বর, দেবীপুর, চন্দননগর, মগরা, ডানকুনি, বরাহনগর, হুগলিঘাট, বালিগঞ্জ, বারাসাত এবং জিয়াগঞ্জে জনসাধারণ ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখবার উদ্দেশ্যে শান্তিপূর্ণভাবে রেললাইনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বলে সংবাদ পাওয়া যায়। … রেল কতৃপক্ষ পথে আটক যাত্রীদের খাবার ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করেন বলে জানা যায়।
এ দিন বাগডোগরা অভিমুখে দুটি এবং আসাম অঞ্চলে তিনটি বিমান যাবার কথা ছিল। কিন্তু বিমান-কর্মীর অভাবে বাগডোগরা ও আসাম অভিমুখে মাত্র দুটি বিমান চলে। একই কারণে এ দিন কলকাতা থেকে রেঙ্গুনে কোনো বিমান চলাচল করেনি।
এ দিন বরাহনগরে সর্বত্রই শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালিত হয়। দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, কারখানা সমস্তই বন্ধ থাকে।’১০
শিলচরে পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি শহর এমনকী গ্রামেও স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল প্রতিপালিত হয়। ২৪ মে হিলিতেও (পশ্চিম দিনাজপুর) ভোর পাঁচটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। এ দিন কমিউনিস্ট পার্টির এক জনসভাও অনুষ্ঠিত হয়। শ্রী কিরণ দে, শ্রী মনোজ গোস্বামী প্রমুখ আসাম সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। জনগণ শিলচরে শহিদদের উদ্দেশে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন।
নৈহাটিতেও পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। এ দিন প্রত্যুষে আপ ও ডাউন দুটি ট্রেন ছাড়া অন্য কোনো ট্রেনই ছাড়েনি। বিদ্যালয়, বাজার ও অফিসে কেউ উপস্থিত হয়নি।
আসানসোলেও এ দিন হরতাল পালন করা হয়। সমস্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। আদালতে ও অফিসসমূহে উপস্থিতির সংখ্যা ছিল নগণ্য।
কালনা, মাজদিয়া (২৪ পরগনা), দিঘা, বাঁকুড়া, বর্ধমান, হাওড়া, দমদম এবং রাণাঘাট সর্বত্রই পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। হরতাল ছিল শান্তিপূর্ণ।
২৪ মে ‘দুর্গাপুরে (এখানেই এ আই সি সি-র অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে) স্বাভবিক জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে। ৪টা পর্যন্ত সকল দোকান ও বাজার বন্ধ থাকে। সকাল থেকে রেলওয়ে ও অন্যান্য পরিবহণ ব্যবস্থাও বন্ধ থাকে। সংবাদ প্রতিষ্ঠান, অ্যাম্বুলেন্স ও ডাক্তারের গাড়ি মাত্র চলতে দেওয়া হয়। হরতাল সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্ত ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। কেবল ভৃwগী (নাচন রোড) ও গ্রাণ্ডট্রাঙ্ক রোডের জংশনে দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার সম্মুখে একদল মোটর ট্রাক ড্রাইভার ও তাদের সহকারীদের সঙ্গে হরতাল সমর্থকদের এক সংঘর্ষ হয়। ইট খন্ড ও সোডার বোতল ব্যবহৃত হয়। প্রকাশ, মোটর ট্রাক ড্রাইভাররাই উত্তেজনা সৃষ্টি করে। তারা ১১ বৎসরের এক বালক ও অন্যান্য কয়েকজনকে মারধোর করে। বালকটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থা খুব ভালো নয়। দুর্গাপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অবস্থা মোটেই স্বাভাবিক নয়। সর্বত্র নেহরু-বিরোধী মনোভাব বর্তমান। প্রায় দেড় লক্ষ শ্রমিক এই হরতালে যোগ দেয়।’১১
একাদশ শহিদের পূতাস্থি নিয়ে ২৪মে বুধবার কলকাতার রাজপথে ঐতিহাসিক মৌন শোক মিছিল বের হল শান্তিতে, নীরবতায় এক অপার্থিব আবহাওয়ার মধ্যদিয়ে। সেদিনের সংবাদপত্র জানাল সেইসব দুর্লভ মুহূর্তগুলির কথা, অজানা বিস্মৃতিপ্রায় দিনের কথা। স্টাফ রিপোর্টার জানালেন: ‘মরণ’ সাগর পারে যাঁরা অমর— শিলচরের ভাষা আন্দোলনে নিহত সেই একাদশ শহীদের পবিত্র চিতাভস্ম নিয়ে বুধবার কলকাতায় এক বিরাট শোক মিছিল বের হয়। চার ঘণ্টা ধরে মৌন মিছিলটি নগরীর রাস্তা প্রদক্ষিণান্তে রাত দশটায় তা কেওড়াতলা শ্মশানঘাটে পৌঁছে। চিতাভস্ম আদি গঙ্গার ঘাটে বিসর্জিত হয়।
প্রায় এক মাইল দীর্ঘ, হাজার হাজার নরনারীর এই শোক-মিছিলটি ছিল মৌন ও গম্ভীর। দেশবন্ধু পার্ক থেকে বের হয়ে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট, নির্মলচন্দ্র স্ট্রিট, চৌরঙ্গী, আশুতোষ মুখার্জি রোড, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রোড ও রাসবিহারী এভিনিউ হয়ে মিছিলটির কেওড়াতলা ঘাটে পৌঁছতে চার ঘণ্টা সময় লাগে।
এ দিনকার শোক-মিছিলটি শিলচরের নারীঘাতী শিশুঘাতী বীভৎসার ওপরে হাজার হাজার বাঙ্গালির প্রবল ধিক্কারের প্রতীক। সন্ধ্যা ৬টার সময় ভস্মাধারটি একটি মোটরের ছাদে পুষ্পস্তবকে সুসজ্জিত করে শোভাযাত্রা শুরু করা হয়। যাত্রার পুরোভাগে ছিলেন সর্বশ্রী সমর গুহ, বিদ্যুৎ বসু, হেমন্ত বসু, অমর বসু, মাখন পাল, ত্রিদিব চৌধুরী, মোহিত মৈত্র, যতীন চক্রবর্তী, হেমন্ত ঘোষাল, আবদুল হানিফ, সুবোধ ব্যানার্জী ও দিলীপ চক্রবর্তী।’
‘তাঁদের পরে কয়েক ফুট স্থান স্বেচ্ছাসেবকরা কর্ডন করে রাখেন। এই স্থানটিতে একাদশ শহীদের প্রতীকস্বরূপ এগারটি মাটির প্রদীপ হাতে এগারজন স্বেচ্ছাসেবক ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকেন।
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসবার পূর্বেই দেশবন্ধু পার্ক থেকে যাত্রা শুরু। তখন ক্লান্ত সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। পার্কের একপ্রান্তে বিশ্রামাগারের প্রাঙ্গণে শহীদদের পূতাস্থি একটি আধারে রক্ষিত ছিল। সে ভস্মাধার ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। দীপশিখায় ধূপের গন্ধে আর দর্শনার্থী হাজার হাজার মানুষের শ্রদ্ধায় সে স্থানটি যেন মন্দিরের পবিত্রতা লাভ করেছে।
ভস্মাধার নিয়ে সুসজ্জিত গাড়িখানি অগ্রসর হতে থাকে। পশ্চাতে হাজার হাজার অনুগামী। তাঁদের অনেকের বুকে কালো ব্যাজ, মিছিলের সম্মুখেও কালো পতাকা।
শ্যামবাজারের মোড় থেকে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে পড়বার পর থেকেই মিছিলে জনতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। পথের মোড়ে মোড়ে অপেক্ষমান জনতার অনেকে নিজেদের মিছিলের সঙ্গে শামিল করে ফেলেন। শ্যামবাজার থেকে রাসবিহারী এভিনিউ— দীর্ঘ দশ মাইল ধরে ‘রাজপথ পরে লোক নাহি ধরে, বাতায়ন যায় খুলি।’
বিশেষ করে প্রতিটি রাস্তার মোড়ে আবালবৃদ্ধবণিতা দলে দলে জমায়েত হয়ে অমর শহীদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। যে আলোকে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে শিলচরের সেই এগারটি অমর প্রাণ ‘মোদের গরব মোদের আশা’ বাংলা ভাষাকে আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, সেই প্রাণ প্রদীপের উত্তাপ আপন অন্তরে গ্রহণ করার জন্য এ দিন কলকাতার সমস্ত মানুষ বুঝি উদগ্রীব হয়েছিল।
মিছিলটি এরপর ভবানীপুর অঞ্চলে পৌঁছুলে দক্ষিণ কলকাতার অধিবাসীরা কাতারে কাতারে পথের দু’ধারে জমায়েত হয়ে শহীদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ দিন জনতার মাঝে অনেক মায়ের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল— আসামের সন্তানহারা মায়েদের শোকে কলকাতার মায়েরাও আজ চোখের জল না ফেলে পারেননি।
কাছাড়ের মুসলমান সরকারী কর্মচারিদের ঈদ উৎসবের জন্য মে মাসের বেতন দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পিকেটিং-এর দরুণ সরকারী অফিস সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় তা দেওয়া সম্ভব হয়নি। মাতৃভাষার কারণে মুসলমান সরকারী কর্মচারীরা ঐ অসুবিধা বিনা প্রতিবাদে স্বীকার করে নিয়েছেন।’
শিলচরের সরকারী অফিসসমূহ আজও পূর্ণোদ্যমে পিকেটিং চলে। ফলে সরকারী অফিসগুলি বন্ধ ছিল। …
রাত ‘প্রায় পৌনে দশটার সময় চিতাভস্মবাহিত মোটর ভ্যানটি কেওড়াতলা শ্মশানঘাটের কাছে পৌঁছুলে হাজার হাজার নরনারী আকুল আগ্রহে শহিদের চিতাভস্মবাহিত ভ্যানটি দর্শন করে এবং নীরবে নতশিরে শহীদদের উদ্দেশে অন্তরের অর্ঘ্য নিবেদন করে।
হাজরা রোডের মোড়ে এত বিপুল জনসমাবেশ হয় যে, যানবাহন তো দূরের কথা, লোক চলাচল করা পর্যন্ত দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। এখানে সন্ধ্যা সাতটা থেকে লোক অপেক্ষা করতে থাকে। রাস্তার দু’পাশের গৃহের অলিন্দে, ছাদে, ফুটপাতে কাতারে কাতারে লোক ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। শহীদদের চিতাভস্মবাহিত শোকযাত্রাটি ঐ স্থান দিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় স্থানটি যেন এক জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। অসংখ্য ফুলের মালা ভস্মাধারের ওপর পড়তে থাকে। বাড়ির ওপর থেকে পুরাঙ্গণাগণ পুষ্পবর্ষণ করতে থাকেন। অথচ এতটুকু কথা নেই। মৌন শোকযাত্রা ধীর পদক্ষেপে চলতে থাকবার সময় রাস্তার দু’পার্শ্ববর্তী অপেক্ষমান বিপুল জনতার কন্ঠও বুঝি স্তব্ধ হয়ে যায়। এতক্ষণ তারা যেন একটু অধীর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু শোকযাত্রাটি দেখামাত্র তাদের অন্তরের অব্যক্ত বেদনা মূর্ত হয়ে ওঠে। তারা মিছিলে নেমে গেলেন। এভাবে হাজরা পার্ক থেকে শ্মশানঘাট পর্যন্ত মানুষের ঘন মিছিল চলে। রাসবিহারী এভিনিউ ও রসা রোডের মোড়ে তেমনি ভিড়। এত ভিড় গত কয়েক বৎসরের মধ্যে দেখা যায়নি। ৮০ বছরের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে ৪/৫ বছরের শিশুটি পর্যন্ত দাঁড়িয়েছিল শ্মশানঘাটের নিকটবর্তী রাস্তার দু’ধারে।
রাত তখন পৌনে দশটা বেজেছে। লোকের সংখ্যা এতটুকু কমেনি। বরং বেড়ে চলেছে। ঠিক দশটার সময় মোটর ভ্যানের ওপর রক্ষিত ভস্মাধারটি নামিয়ে আনা হয়। অতঃপর ধীর পদক্ষেপে সেটি কেওড়াতলা শ্মশানঘাটের ভেতর দিয়ে আদি গঙ্গার তীরে নিয়ে যাওয়া হয়। গঙ্গার পরপারে তখন হাজার হাজার লোক বসে আছেন। শোকযাত্রায় যোগদানকারীরাও স্বল্পপরিসর ঘাটে নামবার স্থান না পেয়ে শেষে গঙ্গার বিপরীত দিকে চলে যেতে থাকেন।
হাজার হাজার লোকের মৌন বেদনার মধ্যে শ্রী সুখময় সিংহ কতৃক চিতাভস্ম গঙ্গাবক্ষে বিসর্জিত হয়। এ সময় চতুর্দিক থেকে পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকে। এতক্ষণ জনতা ছিল শান্ত ও নীরব। কিন্তু শহীদের চিতাভস্ম গঙ্গায় মিশে যাওয়ার পর আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনিতে। এই ধ্বনির যেন বিরাম নেই।
এই ধ্বনি দিতে দিতে কাছাড়ের বাঙ্গালিরা এখনও বুঝি সত্যাগ্রহ করে লাঞ্ছনা বরণ করছে— এই ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি দিতে দিতে শতশত বঙ্গ ও ভারত সন্তান মৃত্যুবরণ করেছে, ফাঁসিকাঠে ঝুলেছে অথবা অত্যাচার নিয়েছে বুক পেতে।
গঙ্গায় তখন ভাঁটার টান চলছে। দেখা গেল, শহীদদের উদ্দেশে প্রদত্ত ফুলের মালাগুলি ভেসে যাচ্ছে। এই ফুলের মালা হয়তো শেষ পর্যন্ত সাগরে বয়ে অদৃশ্য হবে। আর শহীদদের স্মৃতি? লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালির চিত্তে সেই স্মৃতি অক্ষয় ও অম্লান হয়ে থাকবে। বাঙ্গালি বলবে, ‘বাঙলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় তোমরা আত্মহুতি দিয়াছ, তোমরা অমর।’১২
এ দিন পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্র আনন্দবাজার পত্রিকা ও দেশ এবং হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড কাছাড়ে নিগৃহীতদের সাহায্যে এক মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পত্রিকাত্রয়ের পক্ষ থেকে শ্রী অশোককুমার সরকার, সম্পাদক, আনন্দবাজার পত্রিকা ও দেশ এবং শ্রী সুধাংশুকুমার বসু, সম্পাদক, হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড জনগণের উদ্দেশ্যে এক প্রচারপত্রে জানালেন:
আনন্দবাজার পত্রিকা
কাছাড় নিগৃহীত সাহায্য ভান্ডার
মানুষের ন্যুনতম মৌল অধিকার মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা প্রয়াসে কাছাড়ের যে সকল বীর সন্তান পুলিসের গুলীতে প্রাণ হারাইয়াছেন, যাঁহারা নির্মম অত্যাচারে আহত হইয়াছেন, তাঁহাদের ও তাঁহাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গকে সাহায্যদান ব্যবস্থার আয়োজনের জন্য আমাদের পাঠকবর্গের নিকট হইতে আমরা প্রতিদিনই বহু আবেদন পাইতেছি। কাছাড় শহীদের আত্মোৎসর্গ জনচিত্তে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করিয়াছে, সহস্র সহস্র বাঙ্গালী আজ কাছাড়ের নিগৃহীত ভ্রাতাভগ্নিগণকে উদার হস্তে সাহায্য করিতে চাহিতেছেন। এই সময়োচিত সুমহৎ সঙ্কল্পকে বাস্তবে রূপ দিবার জন্য আনন্দবাজার, হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড এবং দেশ পত্রিকার পক্ষ থেকে ‘কাছাড় নিগৃহীত সাহায্য ভান্ডার’ নামে একটি তহবিল খোলা হইল। আনন্দবাজার পত্রিকা প্রাইভেট লিমিটেডের পক্ষ হইতে এই ভান্ডারে ১,০০১ (এক হাজার এক টাকা) দান করা হইয়াছে। ‘কাছাড় নিগৃহীত সাহায্য ভান্ডারে’ দান হিসেবে টাকাকড়ি নিম্নলিখিত ঠিকানায় সাদরে গৃহীত হইবে: শ্রী যোগেন্দ্রমোহন সেন, কোষাধ্যক্ষ, কাছাড় নিগৃহীত সাহায্য ভান্ডার, আনন্দবাজার পত্রিকা ভবন, ৬নং সূতারকিন স্ট্রীট, কলিকাতা—১।
নিবেদক—
শ্রী অশোককুমার সরকার,
সম্পাদক, আনন্দবাজার পত্রিকা ও দেশ;
শ্রী সুধাংশুকুমার বসু,
সম্পাদক, হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড১৩
এখানে বলা প্রয়োজন যে, এই সাহায্য ভান্ডারে যাঁরা সাহায্য দিয়েছেন— তাঁদের নাম, স্থান ও অর্থের পরিমাণ উল্লেখ করে ধারাবাহিকভাবে আনন্দবাজার পত্রিকা-য় মুদ্রিত হয়েছে। এই তহবিল থেকেই কাছাড় নিগৃহীতদের সাহায্য প্রদান করা হয়েছে। অক্টোবর ১৯৬১-তে তহবিলের অবশিষ্ট অর্থ ‘শিলচর মাতৃভাষা শহীদস্মৃতি ও সাহায্য সমিতি’র হাতে অর্পণ করা হয়। স্থানীয় পত্রিকায় বলা হল: ‘২৮ অক্টোবর শিলচর মিউনিসিপাল হলে কংগ্রেস সভাপতি শ্রী নন্দকিশোর সিংহ (পদত্যাগী বিধানসভা সদস্য) মহাশয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক মনোরম অনুষ্ঠানে আনন্দবাজার হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড-এর প্রতিনিধি শ্রী বিনোদবিহারী বসু উক্ত পত্রিকাদ্বয়ের পক্ষে সংগৃহীত কাছাড় নিগৃহীত সাহায্য ভান্ডারের অবশিষ্ট মোট ৩১,১০৪.৪৯ একত্রিশ হাজার এক’শ চার টাকা উনপঞ্চাশ নয়া পয়সার একখানা ব্যাঙ্ক ড্রাফট শিলচরের ‘মাতৃভাষা শহীদ স্মৃতি ও সাহায্য সমিতির’ হাতে প্রদান করেন। সমিতির পক্ষে সভাপতি শ্রী মহীতোষ পুরকায়স্থ সেটি গ্রহণ করেন। কাছাড় বার লাইব্রেরির পক্ষে শ্রী উপেন্দ্রশঙ্কর দত্ত, অ্যাডভোকেট এই মহৎ উদ্যোগের জন্য আনন্দবাজার কতৃপক্ষকে কাছাড়বাসীদের পক্ষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। শ্রী রামপ্রসাদ চৌবে, এম.এল.এ., শ্রী সুখময় সিংহ (মিউনিসিপাল কমিশনার) প্রমুখ আনন্দবাজার পত্রিকা-র সাহায্য ও সহানুভূতির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
আনন্দবাজার ও হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড-এর পক্ষে শ্রীবসু সাহায্য ভান্ডারের হিসাব প্রদান করে বলেন যে, আনন্দবাজার প্রভৃতি কর্তব্য হিসেবেই এই কাজ করেছেন। এর দ্বারা দুর্গতদের সামান্যতম সাহায্য হলেও তাঁরা সার্থক মনে করবেন।’১৪
এদিকে ‘শিলচরে পুলিশের গুলিতে নিহত এগারোজন শহিদ স্মরণে বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ২৫ মে কলকাতা কর্পোরেশনের সভা মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতুবী হয়ে যায়। এই সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এক প্রস্তাবে আসাম সরকার যাতে ভাষা আন্দোলন দমনের নিষ্ঠুর নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হন, সেজন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ দিতে অনুরোধ করা হয়।
এ দিন ঐ প্রস্তাব গ্রহণ এবং তৎসম্পর্কে মেয়র শ্রী রাজেন্দ্রনাথ মজুমদারের সংক্ষিপ্ত বিবৃতি ছাড়া সভায় অন্য কোনো কাজ হয়নি। শোকে, দুঃখে এবং ক্ষোভে মূহ্যমান সদস্যগণ নীরবে দুই মিনিট দাঁড়িয়ে শিলচরের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন।
মেয়র শ্রী মজুমদার উত্থাপিত ঐ প্রস্তাবে নিম্নলিখিত দাবিগুলিও করা হয়। ১. শিলচরে ১৯ মে’র ঘটনা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি দিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের আশু ব্যবস্থা এবং দুষ্কৃতিকারীদের শাস্তি বিধান; ২. অবিলম্বে আসামের ভাষা সমস্যার সন্তোষজনক সমাধানের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার কতৃক যথোপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন।
মেয়র শ্রী রাজেন্দ্রনাথ বলেন, ‘পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, বাংলা যাদের মাতৃভাষা, তারা এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকলেই আসামে পুলিসের অযৌক্তিক ও অত্যন্ত বর্বর পীড়নের তীব্র নিন্দা করবেন। শিলচরে নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতকেই বিক্ষুব্ধ করেছে।’১৫
পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাট বার অ্যাসোসিয়েশন, জিয়াগঞ্জ, কাঁথি, সোনামুখী, মেমামি, মালদহ, চুঁচুড়া, কীর্ণাহার (বীরভূম), হাবড়া, সিউড়ি, সাঁইথিয়া, বোলপুর, বসিরহাট এবং রঘুনাথগঞ্জে (মুর্শিদাবাদ), শিলচরে সত্যাগ্রহী হত্যার প্রতিবাদে হরতাল পালন, প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আজাদ হিন্দ বাগেও জনসভা অনুষ্ঠিত হল। শিলচরে ভাষা-আন্দোলনের সত্যাগ্রহীদের হত্যার প্রতিবাদে এ দিন সন্ধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ সংযুক্ত পরিষদ ও বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের উদ্যোগে আজাদ হিন্দ বাগে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত প্রস্তাবে আসামের কাছাড় ও গোয়ালপাড়া জেলা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি করা হয়।
শ্রী সাতকড়িপতি রায় সভায় সভাপতিত্ব করেন। সর্বশ্রী সত্যেন বসু, রমেন দে, কেশব চক্রবর্তী, রবীন্দ্রলাল চট্টোপাধ্যায় এবং সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় সভাতে বক্তব্য রাখেন।১৬
চুঁচুড়ায় ফরওয়ার্ড ব্লক সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলন সভাপতি শ্রী বিভূতি ঘোষ সূচনায় শিলচরে নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহীদের ওপর আসাম সরকারের পুলিশের বর্বর আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন এবং ভাষা আন্দোলনের বীর শহিদদের উদ্দেশে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি বলেন, ‘শহিদদের নামে শপথ করছি, আসামের বাংলাভাষীদের দাবি আদায়ের জন্য সর্বপ্রকারে সাহায্য করব। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ শেষপর্যন্ত কাছাড়বাসীর পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করবে।’
‘সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে শ্রী হেমন্তকুমার বসু, এম.এল.এ., কাছাড়ের পুলিশি হত্যাকান্ড ও অত্যাচারের তীব্র নিন্দা করে বলেন যে, ‘বাঙ্গলা ভাষার আন্দোলনে আমরা সকলে এক— আমরা মনে করি এ অত্যাচার শুধু কাছাড়ের বঙ্গভাষাভাষীদের ওপর করা হয়নি, আমাদের ওপরও করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার দলগত স্বার্থে দিনের পর দিন আসাম সরকারের যে সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা ও বর্বরতা প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন তার ফলে জাতীয় ঐক্য ব্যাহত হবার এক বিরাট আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কাছাড়ের শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে সম্মেলনে অনুষ্ঠিতব্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়। অপর প্রস্তাবে শিলচরে পুলিশী বর্বরতার প্রতিবাদ ও এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপের দাবী জানানো হয়।’১৭
২৫ মে কলকাতায় ২০টি মহিলা সংগঠন নিয়ে গঠিত মহিলা সমন্বয় পরিষদ আয়োজিত এক সভায় ‘শিলচরে নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানানো হয়। সভাপতিত্ব করেন এম.পি.শ্রীমতী রেণু চক্রবর্তী। সভায় বলা হয়, বিশ্বব্যাপী যখন রবীন্দ্রনাথের জন্ম-শতবার্ষিকীতে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে— তখন ভারতেরই একটি অংশে তাঁর ভাষা বাংলাকে ‘পদদলিত’ করার ঘটনা অত্যন্ত পরিতাপজনক। নারী সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল— নিখিল বঙ্গ মহিলা ইউনিয়ন, ওয়াই. ডব্লু. সি. এ., কেরালা মহিলা সমাজ, মহারাষ্ট্র ভগিনী সমাজ এবং নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলনের বঙ্গীয় শাখা।’১৮
পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া বার অ্যাসোসিয়েশন, বারাসত, ইটিণ্ডা, গাইঘাটা, বিষ্ণুপুর, শ্রীরামপুর, খড়দহ, নাকাশীপাড়া, চাপড়া, খড়গপুর, ঘাটাল প্রভৃতি স্থানেও শিলচরে সত্যাগ্রহী হত্যার প্রতিবাদে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় এবং পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণও ‘রাঁচিতে ২৪মে আবদুল বারি পার্কে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় ‘ভাষা উন্মত্ত অসমিয়াদের নিন্দা’ করেন। তিনি বলেন, গত বৎসর জুলাই মাসে ভাষা উন্মত্ত অসমিয়ারা তাদের প্রতিবেশী বাঙ্গালিদের হত্যা করে, গৃহে অগ্নিসংযোগ করে, নারীদের ওপর দুর্ব্যবহার করে তাদের বিতাড়িত করা হয়। জীবন ও সম্মানের নিরাপত্তার জন্য আসামের প্রায় ৫০ হাজার বাঙ্গালি পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়।
আগরতলাতেও ২৬ মে আয়োজিত এক সভায় শিলচরে গুলীবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে চালিহা মন্ত্রিসভার অপসারণ দাবি করা হয়। আগরতলার প্রজা সমাজতন্ত্রী দল ও তপশিলভুক্ত জাতি সমিতি এই সভার আয়োজন করে।
বিহারের ভূতপূর্ব রাজস্বমন্ত্রী শ্রী কৃষ্ণবল্লভ সহায় ২৫ মে রাঁচির এক জনসভায় ‘শিলচরে নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশের গুলীবর্ষণের নিন্দা করেন। তিনি বলেন, নিজেদের ভাষার স্বীকৃতির জন্য শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করার অধিকার জনসাধারণের আছে।’১৯
শিলচর হত্যাকান্ডের বিচার চাইলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৭ মে শনিবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন:
আসামে শিলচরে বাংলা ভাষা সত্যাগ্রহে যে এগারটি বহুমূল্য প্রাণ আসাম সরকারের রোষবহ্নিতে বলি প্রদত্ত হইল এবং শতাধিক ব্যক্তি রক্ত ঢালিয়া আহত হইলেন ইহার পরে আমি কি করিতেছি এবং ইহাতে কি আমার কোনো কর্তব্য নাই— এই প্রশ্ন করিয়া অন্তত পঁচিশ ত্রিশখানি পত্র আমি পাইয়াছি। এবং নি:সংশয়ে বলিতে পারি বন্ধুবান্ধব ও হিতাকাঙ্খীরাও অনেকে মনে মনে এই প্রশ্ন করিতেছেন।
ইহাদের সকলকেই উত্তরে কবিগুরুর কথা ও কাহিনীর ‘বিচারক’—‘পুণ্যনগরে রঘুনাথ রাও পেশোয়া নৃপতি বংশ’ কবিতাটি স্মরণ করাইয়া দিয়া বলিতেছি— আমি ন্যায়াধীশ রামশাস্ত্রী নই, তাঁহার সমপর্যায়ে নিজেকে ফেলিতেছি না, তবে একজন সাধারণ ব্যক্তির মতো পথিপার্শ্বে দাঁড়াইয়া ভারত সরকারকে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে বলিতেছি— এই হত্যাকান্ডের বিচার চাহিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়াছি। আপনাদের বিজয়রথ বিচার শেষ পর্যন্ত রোধ করুন।
আজ সংবাদপত্রে হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ডে দেখিতেছি প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শ্রী নেহরু বলিয়াছেন—
It is not proper to kill men, women and child because they agitated for the recognition of Bengali as a state language in Assam.
বাংলা ভাষা সম্পর্কে তিনি যাহা বলিয়াছেন তাহার উল্লেখ করিব না। কারণ বাংলা ভাষার গুণের ও অবদানের দাবি মুখে স্বীকৃতির অপেক্ষা রাখে না। এবং এখানে সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রশ্নই সর্বাপেক্ষা বড়। যাই হোক, প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তির পর অপরাধের প্রশ্ন সম্পর্কে আমরা নি:সন্দেহ।
আমি শিলচরে গুলি চালনার পরই প্রধানমন্ত্রীকে তার করিয়াছি, পত্র লিখিয়াছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তার করিয়াছি। কংগ্রেস সভাপতি শ্রী রেড্ডীর নির্দেশে ব্যথিত ও বিস্মিত হইয়া পত্র লিখিয়াছি। প্রশ্ন করিয়াছি। এগুলির নকল শিলচর সংগ্রাম পরিষদের নিকট পাঠাইয়াছি। যেসব পত্র পরে প্রয়োজন হইলে যথাসময়ে প্রকাশ করিব। আমি উত্তরের অপেক্ষা করিতেছি। বিচার যদি না হয়, যদি উপেক্ষা ভরে তাঁহারা ধ্বজা পতাকা উড়াইয়া অগ্রসর হন, তবে কবিতাটির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া সকল সংস্রব ত্যাগ করিয়া ফিরিয়া আসিব আমার গৃহে, আমার স্বস্থানে, বলিয়া আসিব এ খেলাঘরের খেলায় আর নিজেকে অবরুদ্ধ রাখিব না।২০
আসামে নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদে ‘২৭ মে দুর্গাপুরে বামপন্থী দল সমূহের বিরাট বিক্ষোভ মিছিল ও সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাম নেতৃবৃন্দের সাক্ষাতের প্রস্তাবও প্রস্তাখ্যাত হয়। সংবাদে বলা হয়, ‘বাঙলা ভাষার মর্যাদা চাই’ ‘শিলচরের গুলিবর্ষণের বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই’, ‘অপরাধীদের শাস্তি চাই’ প্রভৃতি ধ্বনিতে মুখরিত সাত সহস্রাধিক নারী-পুরুষের এক সুসংগঠিত ও শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা আজ অপরাহ্নে দুর্গাপুরে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি অধিবেশন মন্ডপের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে, অধিবেশন স্থলের দু’শ গজ দূরে বিরাট পুলিসবাহিনী তার গতিরোধ করে।
বিক্ষোভ শোভাযাত্রার পর নাচন রোডে এক বিরাট জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে লোকসভার কমিউনিস্ট সদস্য অধ্যাপক হীরেন মুখার্জী যখন বক্তৃতা করছিলেন, তখন হঠাৎ দুটি লরি থেকে কংগ্রেসিরা নেমে পিছন থেকে সভার ওপর হামলা চালায়।
কমিউনিস্ট পার্টিসহ ৮টি বামপন্থী দলের আহ্বানে অনুষ্ঠিত এই বিক্ষোভ মিছিলের পুরভাগে লোকসভা সদস্য, বিধানসভা সদস্য ও নেতৃবর্গ ছিলেন।২১ বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন— শ্রী হেমন্তকুমার বসু, ড. রণেন সেন, শ্রী বিনয় চৌধুরী, শ্রী যতীন চক্রবর্তী, শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, অধ্যাপক হীরেন মুখার্জি, শ্রী তারা দত্ত, শ্রী বরদা মুকুটমণি, শ্রী প্রমথনাথ ধীবর, শ্রী অরবিন্দ ঘোষাল, শ্রী সুধীর মুখুটি, শ্রী অনিল চ্যাটার্জি, শ্রী বিমলানন্দ মুখার্জি, শ্রী নীহার মুখার্জি প্রমুখ।
‘বিক্ষোভ মিছিলে প্রজা-সমাজতন্ত্রী দলও শামিল হয়। এ সব বাম দল ছাড়াও ‘জনসংঘ’, ‘হিন্দু মহাসভা’ এবং ‘জাগো বাঙালি’ মিছিলে যোগদান করে। নেতৃবর্গের মধ্যে শ্রী হরিপদ ভারতী, শ্রী অনুতোষ মুখার্জি (স্বর্গত ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির পুত্র) এবং শ্রী সুধাংশু গাঙ্গুলি মিছিলে যোগ দেন। দুর্গাপুরে কালো পতাকা হাতে অসংখ্য সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জও করে। মিছিলে যোগদানকারী অধিকাংশ মানুষের হাতেই ছিলো কালো পতাকা।’২২
২৮ মে দুর্গাপুরে শিলচরে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশন ১০ মিনিটের জন্য মুলতুবি রাখা হয়। সংবাদে বলা হয়: ‘কংগ্রেস হাইকমাণ্ড বোধ হয় এখন এই সত্যটি উপলব্ধি করেছেন যে, কাছাড়ে বঙ্গ ভাষার আন্দোলনে যে ১১ জন শহীদ হয়েছেন— তাঁদের জীবন অমূল্য। কংগ্রেস সভাপতি শ্রী রেড্ডী সকালে এ-আই-সি-সি’র উদ্বোধনী ভাষণে তাই বারবার বলেন, …ঐ ১১টি অমূল্য জীবনহানিতে আমরা সকলেই, সারা ভারতের সকলেই গভীর দুঃখিত।
‘অতঃপর শ্রী রেড্ডীর প্রস্তাবক্রমে এ-আই-সি-সি’তে উপস্থিত সকলে এক মিনিটকাল দাঁড়িয়ে নীরব নতমস্তকে উক্ত ১১জন শহিদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন।
কিন্তু এর অব্যবহিত পরেই এমন একটা ব্যাপার হয় যাতে বুঝা যায় কংগ্রেস হাইকমাণ্ড এখনও কাছাড়ে বঙ্গ ভাষার আন্দোলনকারীদের নির্যাতন কংগ্রেস মহলে কত তীব্র বিক্ষোভের সৃষ্টি করেছে তা সম্যক উপলব্ধি করতে পারেননি। শোক প্রকাশের এক মিনিট শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিমবঙ্গের শ্রী কৃষ্ণকুমার চ্যাটার্জী এবং আসামের শ্রী বৈদ্যনাথ মুখার্জী উঠে দাঁড়িয়ে উক্ত শহীদগণের স্মৃতিতে দশ মিনিটকাল এ.আই.সি.সি-র অধিবেশন মুলতুবি রাখবার দাবী উত্থাপন করেন। তাঁরা বলেন,
এ সম্পর্কে তাঁরা কংগ্রেসকে পূর্বেই অনুরোধ করেছিলেন। তা কেন করা হচ্ছে না। শ্রী রেড্ডী এরপর অধিবেশন ঐ শহিদদের স্মৃতিতে দশ মিনিটকাল মূলতুবি রাখেন।’২৩
পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি ৩০ মে দুর্গাপুরে এক সভায় বলে: ‘কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি’কে কাছাড়ের ঘটনাবলী সম্পর্কে তদন্তের জন্য উচ্চ ক্ষমতাবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন এবং নিহত ব্যক্তিদের পরিবারবর্গের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও সাহায্য দেবার ব্যবস্থা করার নিমিত্ত অনুরোধ করা হয়।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শ্রী যাদবেন্দ্রনাথ পাঁজা ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, ভাষা সমস্যা নিয়ে কাছাড় এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অন্যান্য স্থানে উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং শান্ত সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশের গুলীবর্ষণ ও লাঠি চালনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। শোচনীয় অবস্থার মধ্যে অতগুলি লোকের প্রাণহানি হওয়ায় কমিটি গভীর দুঃখ প্রকাশ করছেন।’২৪
শিলচরে হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানালেন পশ্চিমবাংলার কয়েকজন বিশিষ্ট সমাজসেবী, সাহিত্যিকা এবং অধ্যাপিকা। তাঁরা এক বিবৃতিতে জানালেন, শিলচরে শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে; এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সংখ্যালঘুদের যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত দাবির মীমাংসাও করতে হবে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয় যে, ‘গত বছর আসামের বঙ্গভাষাভাষীরা অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেছেন। নির্বিচারে প্রাণহানি ও সম্পত্তি নাশ করা হয়েছে। কাছাড়বাসীদের ন্যায্য দাবী উত্থাপনের অধিকারকে দমিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা সংবিধানবিরোধী। …বিগত কয়েক মাস ধরে আসামের সংখ্যালঘুগণ ভারত সরকারের কাছে তাঁদের দাবী মেনে নেওয়ার আবেদন জানিয়ে আসছেন। সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরই তাঁরা শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহের পথ গ্রহণ করেছেন। আসাম সরকার পুলিশ ও বন্দুকের মুখে এই আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে চান। কিন্তু কাছাড়ের প্রত্যেক নরনারী এই আন্দোলনের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে আন্দোলনকে জোরদার করে তুলেছেন। মৃত্যু, নির্যাতন তাঁদের দমাতে পারেনি।
সমগ্র বিশ্ব যখন কবিগুরুকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছেন, সারা ভারত যখন রবীন্দ্রনাথকে গানে গানে ফুলে ফুলে অর্ঘ্য নিবেদন করছেন— তখন কবিগুরুর ভাষায় যাঁরা কথা বলেন, বাংলা চর্চা করতে চান, চান লালন করতে— তাঁদেরই ওপর চলে গুলী, কবির স্মৃতিকেই তো তারা কলঙ্কিত করলেন। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন— শ্রীমতী সীতা দেবী, মীরা দত্তগুপ্তা, মীরা দেবী, আশাপূণা দেবী, প্রভাবতী দেবী, সরস্বতী, সুরুচি সেনগুপ্তা, মঞ্জুশ্রী দেবী, অরুণা মুন্সী, শান্তা দেবী (নাগ), পুষ্পময়ী বসু, মলিনা দেবী ও শান্তা দেব।২৫
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় ৩০ মে মঙ্গলবার কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিং-এ সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, ‘আসাম সরকার ইচ্ছা করলে আজই হোক বা কালই হোক, যে কোনো দিন শুধু একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আসামে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারেন।’
আইনটির সংবিধান বিরুদ্ধ কয়েকটি গুরুতর ত্রুটিবিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও ডা. রায় মনে করেন, ঐ আইনের বলেই বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে অনায়াসে স্বীকৃতি দেওয়া যায়।…
তিনি আসাম আইনের একটি কপি আনিয়ে সাংবাদিকদের কাছে তার ব্যাখ্যা করে জানান, সংবিধানের ৩৪৫ ও ৩৪৭ নং ধারা বলে রাষ্ট্রপতিও ইচ্ছা করলে আসামের বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারেন।’
ডা. রায় সাংবাদিকদের জানান, ‘আসামের সরকারি আইনের ২ নং ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, আইনটির ওপর গভর্নরের সম্মতি সরকারী গেজেটে প্রকাশিত হবার ৫ বছরের মধ্যে রাজ্য সরকার সরকারি গেজেটে একটি নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার দ্বারা সমগ্র রাজ্যে বা বিভিন্ন কাজে রাজ্যের বিশেষ বিশেষ অংশে আইনটি বলবৎ করতে পারবেন। আইনটির ওপর গভর্নরের সম্মতি গত ১৯ ডিসেম্বর ১৯৬০ সালের সরকারী গেজেটে প্রকাশিত হয়েছে।
আইনের ৫নং ধারায় বলা হয়েছে যে, বাংলা ভাষাকে কাছাড় জেলার শাসনকার্য পরিচালনায় এবং অন্যান্য সরকারী কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে, যদি ঐ জেলার মহকুমা পরিষদসমূহ এবং পৌরপ্রতিষ্ঠানসমূহ অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে তা অনুমোদন লাভ করে।
ডা. রায় এই ধারাটিকে সংবিধান বিরোধী মনে করেন, কেননা এই ধারার বলে মহকুমা পরিষদ ও পৌর প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রপতির সমান ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে; এরূপ ক্ষমতা দেবার কোনো অধিকার থাকতে পারে না। কোন এলাকায় কোন ভাষা সরকারী হবে কি না হবে, তা মহকুমা পরিষদ বা পৌর প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করতে পারেন না। সংবিধানের ৩৪৫ নং ধারায় সমগ্র রাজ্যে একাধিক ভাষাকে সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার অধিকার দেওয়া হয়েছে এবং সংবিধানের ৩৪৭নং ধারায় এরূপ বলা হয়েছে যে, কোনো রাজ্যের বা সেই রাজ্যের কোনো অংশের পর্যাপ্তসংখ্যক জনসাধারণ যদি কোনো একটি ভাষাকে সরকারী ভাষা করবার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে দাবী করেন এবং রাষ্ট্রপতি যদি সেই দাবীর যৌক্তিকতায় সন্তুষ্ট হন, তাহলে তিনি ইচ্ছা করলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যকে সেই ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার নির্দেশ দিতে পারেন।’২৬
কিন্তু তারপরও বাংলাভাষাকে রাজ্যভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়নি। সামনে ভোট রাজনীতি, তারপর তো ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুজু রয়েছেই। স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই তো একাধিকবার বলেছেন ওরা রাজ্য ভাষা হিসেবে বাংলাকে মেনে নেবে না। আসাম সরকার মানে বি পি চালিহাও চান একমাত্র অসমিয়া আর কিছু নয়। দেশের সংবিধান, আইন ওসব কিছু নয়— ‘মাসল,’ ‘মানি’ আর অকৌশলই শেষ মন্ত্র? ‘আসাম’ নামক রাজ্যে এটাই শেষ কথা।
৪ জুন রবিবার ‘কলকাতার মহাবোধি সোসাইটি হলে পশ্চিমবঙ্গ যুব সম্মেলনে বিভিন্ন বক্তা এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, কাছাড়ে ভাষা আন্দোলনজনিত যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা আসাম বা বাংলায় সীমাবদ্ধ নয়, পরন্তু তা সর্বভারতীয় সমস্যা। সর্বভারতীয় ভিত্তিতেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
সম্মেলনের উদ্যোক্তাগণ জানান যে, তাঁরা এই আন্দোলনের তাৎপর্য সারা ভারতের যুব সমাজের কাছে উপস্থাপিত করতে চেষ্টা করছেন। এটা যে বাঙ্গালির প্রাদেশিকতা মনোভাবজাত কোনো আন্দোলন নয়, সংবিধান স্বীকৃত স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সর্বভারতীয় ভিত্তিতে তা প্রচারের প্রয়োজনীয়তা আছে।
প্রধান অতিথি ড. ত্রিগুণা যেন সারা ভারতের যুব সমাজকে এক হবার জন্য আবেদন জানান এবং বলেন যে, দলের তকমাই একমাত্রই যেন তাঁদের কাছে প্রধান না হয়ে ওঠে। তিনি আরও বলেন, কাছাড়ের ভাষা আন্দোলনকে হেয় করে দেখাবার জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সংবাদপত্র মারফত চেষ্টা চলছে। বাংলার যুব সমাজকে এই ভুল ধারণা দূর করবার জন্য অগ্রণী হতে হবে।
কাজী আবদুল ওদুদ বলেন, অসমিয়াদের মধ্যে সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবোধই বর্তমান অশান্তির মূল কারণ। সর্বভারতীয় স্তর থেকে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। শ্রী অপূর্ব চন্দ সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবসমূহ সমর্থন করেন সর্বশ্রী কাঞ্চন বসুঠাকুর, চন্দন দত্তমজুমদার, শক্তি মুখার্জী, প্রশান্ত বসু, অমলেন্দু রায় প্রমুখ।’২৭
বৃহস্পতিবার ৭ জুন কলেজ স্কোয়ারে স্টুডেন্ট হলে ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনের পশ্চিমবঙ্গ কমিটি শিলচরে সত্যাগ্রহী হত্যার প্রতিবাদে এক সভার আয়োজন করে। সভায় শ্রীমতী রেণু চক্রবর্তী এম পি বলেন— কাছাড় জেলায় আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার সক্রিয় যোগদানের ফলে ভাষা-আন্দোলন ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নিয়েছে। বিপুলসংখ্যক মহিলা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। আসলে কাছাড়ে এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যে এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য করছেন না।
সভার সভানেত্রী শ্রীযুক্তা সীতাদেবী বলেন, বিদেশিদের আমল থেকেই বাঙালিদের ওপর নির্যাতন চলে আসছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে যে, বাঙালিরা সর্বাপেক্ষা বেশি দুঃখবরণ করেছেন, সেই বাঙালি আজও নির্যাতিত। সীতাদেবী বলেন, আসামের বঙ্গ ভাষাভাষীদের আন্দোলনের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গবাসীদের আন্দোলন যুক্ত হওয়া উচিত। সভায় পুলিশি বর্বরতার নিন্দা এবং বাংলা ভাষাকে ন্যায়সঙ্গত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা হোক।২৮
পশ্চিমবঙ্গ স্বতন্ত্র পার্টি সভাপতি শ্রী এন সি চ্যাটার্জি ১০ জুন শনিবার কলকাতায় এক জনসভায় জানালেন, ‘শাস্ত্রী-সূত্র পন্থ ফর্মুলা অপেক্ষাও ক্ষতিকর।’ শ্রী চ্যাটার্জি শিলচরে গুলিচালনা সম্পর্কে তদন্তের জন্য গঠিত বেসরকারি কমিশনের সভাপতিরূপে তদন্ত কাজ শেষ করে সম্প্রতি কলকাতায় ফিরেছেন। শ্রী চ্যাটার্জী বলেন, সবচাইতে মর্মান্তিক নারী ও শিশুদের ওপর অত্যাচার। পুলিশি অত্যাচারের শিকার কয়েকজন নারীর সাক্ষ্য গ্রহণকালে তাঁদের মুখ থেকে পুলিশের বর্বর আক্রমণের কাহিনি শুনে তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। শিলচরে গুলিচালনার ঘটনার দিন শান্তিপূর্ণ নারী সত্যাগ্রহীদের ওপর যে জঘন্য অত্যাচার হয়— তার তুলনা পাওয়া যায় না। শিশু ও নারী নির্বিশেষে সকলের ওপর গুলি ও লাঠি চালনা ছাড়া নারীর শ্লীলতাহানি করতেও তারা ছাড়েনি। মহিলাদের শাড়ি খুলে দেওয়া হয়েছে ব্লাউজ ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে। ‘‘হত্যার জন্য গুলি চালনার নির্দেশও যে ছিল এ সম্পর্কে তাঁরা নি:সন্দেহ হয়েছেন বলেও শ্রীচ্যাটার্জি জানান। তিনি বলেন, প্রায় সবক্ষেত্রেই কোমরের ওপর গুলি লেগেছে। বিনা প্ররোচনায় শান্ত সত্যাগ্রহীদের ওপর লাঠি ও গুলি চালনা করা হয়েছে— এ বিষয়েও তাঁরা নি:সন্দেহ হয়েছেন।’’
শনিবার সন্ধ্যায় ভারতসভা ভবনে অনুষ্ঠিত এ সভায় শ্রী দেবপ্রসাদ ঘোষের পক্ষ থেকে এক প্রস্তাবে কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ এবং অন্যান্য সংস্থা কতৃক ‘শাস্ত্রী ফর্মুলা’ পরিত্যক্ত হওয়ায় পরিষদ ও ঐসব সংস্থাকে অভিনন্দন জানান হয়। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী আসামের বঙ্গভাষাভাষী অধিবাসীদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরিত এক স্মারকলিপিতে যে দাবি করা হয়েছে তদনুসারে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় আদেশ জারি করবার জন্যও ঐ প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতির কাছে দাবি জানান হয়।’২৯
পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী নেতৃবৃন্দ হাইলাকান্দির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এই ঘটনার দায় আসাম সরকার এড়াতে পারেন না। সর্বশ্রী সমর মুখার্জি এম.এল.এ (সিপিআই), অশোক ঘোষ (ফ.ব), মাখন পাল (আর এস পি), তারা দত্ত (ফ ব মা), নীহার মুখার্জি (এস ইউ সি), সন্তোষ মুখার্জি (বিপি), হেমেন্দ্র মুখার্জি (ডব্লু পি আই) এবং বিমলানন্দ মুখোপাধ্যায় (আর সি পি আই) এক যৌথ বিবৃতিতে জানান,
আমরা গত সোমবার হাইলাকান্দি শহরে দাঙ্গাহাঙ্গামা, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের সংবাদে অত্যন্ত উদ্বেগ বোধ করিতেছি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে মনে হয় যে, যারা শহরের লোকদের উপর আক্রমণ চালাইয়াছিল সেই জনতা বাহির হইতে আসিয়াছিল। এই ঘটনা যে কাছাড়ের জনসাধারণের মিলিত ভাষা আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য উক্ত মহল কতৃক পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের পরিণতি তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। ইহা পরিষ্কার যে, আসাম সরকার পূর্বাহ্নেই এই প্রস্তুতিপর্বের সংবাদ অবগত ছিলেন। কিন্তু এই দাঙ্গাকে বন্ধ করার কোনো ব্যবস্থা তাহারা করে নাই। সুতরাং এই ঘটনার দায়িত্ব আসাম সরকার কোনো রকমেই এড়াইয়া যাইতে পারে না। যখন ভাষা আন্দোলন স্থগিত রাখা হইয়াছে এবং আন্দোলনের নেতারা পারস্পরিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার সূত্র বাহির করিবার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সহিত আলোচনা করিতে স্বীকৃত হইয়াছেন তখন আন্দোলন সমর্থনকারীদের উপর এই আক্রমণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিভেদকারীরা জানিত যে, কাছাড়ের এই আন্দোলন কাছাড়ের হিন্দু, মুসলমান ও সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়গুলি সকলের মিলিত আন্দোলন। আন্দোলনের তীব্রতা ও উহার সফলতার সম্ভাবনায় ভীত হইয়া স্বার্থান্বেষী প্রতিক্রিয়াশীল মহল সাম্প্রদায়িকতা ও প্রাদেশিকতার বিদ্বেষ সৃষ্টি করিয়া আন্দোলনকে বানচাল করার জঘন্য অপচেষ্টা করিয়াছে।৩০
শ্রী এন সি চ্যাটার্জি আসামে রাষ্ট্রপতির শাসন দাবি করলেন। তিনি এ কথাও জানালেন যে, হাইলাকান্দির ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। পশ্চিমবঙ্গ স্বতন্ত্র পার্টির সভাপতি শ্রী এন সি চ্যাটার্জি এ বিষয়ে এক বিবৃতি দেন:
জনগণের যথার্থ দাবীকে বানচাল করিবার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক তান্ডবকে দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহার করিবার সাম্রাজ্যবাদী অপকৌশলের পুনরাবৃত্তি দেখা গেল হাইলাকান্দির দুঃখজনক ঘটনায়। কাছাড়ের ভাষা আন্দোলনকে ধ্বংস করিবার জন্য চক্রান্তই হাইলাকান্দির ঘটনার দ্বারা উদঘাটিত হইল। ১৯ মে শিলচরে শহীদদের আত্মদানের ঠিক এক মাস পর ১৯ জুন হাইলাকান্দি আক্রমণ একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ইহা কাছাড়ের গণআন্দোলনের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করিবার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী হইয়াছে।
অভিযানের স্লোগান ধ্বনি, কোনো কোনো নেতার কৌশলপূর্ণ আবির্ভাব-অন্তর্ধান, কাছাড়ে ও আসামে পাকিস্তানীদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ (তাহাও সাময়িক ভিসায় নয়, ভারতীয় পাসপোর্ট লইয়া), বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে দরাজ হাতে অর্থবণ্টন, ভারতবিরোধী লোকজনের অনুপ্রবেশ বন্ধ করিবার জন্য সীমান্তে বেড়া দিবার প্রয়োজনীয়তা আবিষ্কারে বহু বিলম্ব— এই সবই পূর্বব্যবস্থিত পরিকল্পনার অন্তর্গত খন্ড খন্ড ব্যাপার। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ১৯৬০ সালের জুলাই মাসে আসামের শাসন শৃঙ্খলা রক্ষার যন্ত্র নিষ্ক্রিয় ছিল। কিন্তু ১৯৬১-র মে মাসে শিলচরে উহাকে বড়ই তৎপর এবং আক্রমণশীল ভূমিকায় দেখা যায়। আবার, সীমান্ত এলাকায় প্রহরা ব্যবস্থা রহিল শিথিল ও নিষ্ক্রিয়। বহিরাগতের অনুপ্রবেশ এবং সহস্র সহস্র মানুষের সুসংগঠিত অভিযান সম্ভব করিবার জন্যই এই ব্যবস্থা।
পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম জনগণ নিজ মাতৃভাষার প্রতি অবিচলিত আনুগত্যে লড়াই করিয়াছেন; বাংলা ভাষা পাকিস্তানে তাই সসম্মানে অধিষ্ঠিত হইতে পারিয়াছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই পূর্ব পাকিস্তান হইতে একদল লোক কাছাড় ও আসামে ঢুকিয়া অন্যের প্ররোচনায় বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে উন্মত্ত জেহাদে মত্ত হইয়াছে।
কাছাড়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আমার টেলিফোনে আলাপ হইয়াছে। হাইলাকান্দিতে ব্যাপক অগ্নি -সংযোগের সংবাদ পাওয়া গিয়াছে।
সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি জনাব আবদুর রহমান চৌধুরী হাইলাকান্দি শহরের একজন বিশিষ্ট নাগরিক। তাঁহাকে হেয় প্রতিপন্ন করিবার জন্যই কি হাইলাকান্দিকে সাম্প্রদায়িক সমরক্ষেত্ররূপে ব্যবহার করা হইয়াছে? লক্ষ করিবার বিষয় যে, জনাব আবদুর রহমানের বাড়িও আক্রান্ত এবং বিধ্বস্ত হইয়াছে। গত ২ জুন এই ভদ্রলোকের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপের সুযোগ আমার হইয়াছিল। বেসরকারি তদন্ত কমিশনের সম্মুখে তিনি সাক্ষ্যও দিয়াছিলেন। জনাব আবদুর রহমান চৌধুরী ও তাঁহার সহকর্মিগণ ভাষা আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে রাখিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছেন।
আসাম সরকার যদি ১৯৬০ সালে গোরেশ্বর, গৌহাটি, নওগাঁ ও অন্যান্য অঞ্চলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার কর্তব্য পালন করিতেন তবে দুষ্কৃতকারীরা এইভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিদ্বেষবহ্নি ছড়াইতে সাহস করিত না, হাইলাকান্দিতেও শোচনীয় কান্ড ঘটিত না। সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম বিশিষ্ট নেতা শ্রী রথীন্দ্রনাথ সেন ১৭জুন কারামুক্ত হইয়া কলিকাতায় পৌঁছিয়াছেন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর সঙ্গেও আমার আলাপ হইয়াছে। শুধু কাছাড় ও আসামের স্বার্থ ও নিরাপত্তার প্রশ্নেই নহে, পরন্তু ভারতের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরেই অবিলম্বে আসাম রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তনের দাবি করিতে বাধ্য হইতেছি। এ ছাড়া উপায় নাই। কাশ্মীর যে শিক্ষা দিয়াছে তাহা ভুলিলে চলিবে না। প্রধানমন্ত্রী অগৌণে কাছাড় পরিদর্শন করুন। কাছাড়ের জনগণের দাবির যৌক্তিকতা তিনি উপলব্ধি করিবেন। যে মন্ত্রিসভায় কয়েকজন সদস্যকে হীন চক্রান্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন সন্দেহ করা হয়, সেই মন্ত্রিসভাকে ভাঙ্গিয়া দেওয়া হোক।৩১
২২ জুন বৃহস্পতিবার কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক বৈঠকে বলা হয়: ‘ভারতীয় জনসংঘের উত্তরাঞ্চলিক সম্পাদক অধ্যাপক বলরাজ মাধক, এম পি কাছাড়ের বর্তমান ঘটনাবলিতে বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, আসামে ব্যাপকভাবে পাকিস্তানিদের অনপ্রবেশ এবং হাইলাকান্দি ও কাছাড়ের অন্যান্য স্থানে মুসলমান জনতা কতৃক হিন্দুদের ওপর আক্রমণ ভারতের অখন্ডতা ও নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক।
আসামের বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাপক মাধক আসামের বর্তমান মন্ত্রিসভা বাতিল করে অবিলম্বে সেখানে যাতে রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয় সেজন্য দাবি জানান। বেআইনিভাবে যেসব পাকিস্তানি আসামে প্রবেশ করেছে— তাদের সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে জনসংঘ নেতা অভিযোগ করেন যে, ৬ লক্ষ পাকিস্তানি বেআইনিভাবে আসামে প্রবেশ করেছে। আসামের রাজ্যপালকে ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে ঐসব পাকিস্তানিকে বিতাড়নের উপযোগী ক্ষমতা দেবার দাবিও তিনি জানান।
অধ্যাপক মাধক আসামের কৃষিমন্ত্রী শ্রী মইনুল হক চৌধুরী এবং আই জি পি শ্রী হায়দার হোসেনের কার্যকলাপ ও গতিবিধি সম্পর্কে পূর্ণ তদন্ত ব্যবস্থার জন্যও দাবি জানান।
ভাষার সমস্যা সমাধানের আবেদন জানিয়ে জনসংঘ নেতা প্রস্তাব করেন যে, বিশিষ্ট আইনবিদ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মধ্য থেকে তিনজন সদস্য নিয়ে একটি সালিশকারী পর্ষদ গঠন করে আসাম ও পাঞ্জাবের ভাষা সমস্যার সমাধানের সুপারিশসহ একটি রিপোর্ট প্রণয়নের ভার ঐ পর্ষদের ওপর ন্যস্ত করা হোক।’৩২
শ্রী এন সি চ্যাটার্জি তাঁর বিবৃতিতে হাইলাকান্দি বিষয়ে যেসব মন্তব্য প্রকাশ করেছেন— সে সম্পর্কে দ্বিমতের কোনো অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। তিনি যা বলেছেন স্পষ্ট করেই বলেছেন কোনো রাখঢাক বা দুকুল রক্ষা করতে বা হেঁয়ালির আশ্রয় নেননি। সত্যনিষ্ঠ এই মানুষটি মানুষের জন্যই কাজ করেছেন।
অধ্যাপক মাধকও কাছাড় তথা আসাম সম্পর্কে যা বলেছেন সততার সঙ্গেই বলেছেন, মানুষের পাশেই দাঁড়িয়েছেন। তিনি আসাম সরকারের একজন সর্বোচ্চ পর্যায়ের পুলিশ কর্তা এবং একজন মন্ত্রীর নাম উচ্চারণ করতেও কুন্ঠাবোধ করেননি।
৫ জুলাই স্বতন্ত্র পার্টি প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এন জি রঙ্গ নিদুব্রোলুতে (অন্ধ্র) এক বিবৃতিতে জানান: ‘আসাম মন্ত্রিসভা আসামে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করতে অক্ষম হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরু আসাম মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে কেন্দ্র থেকে কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করতে অস্বীকৃত হওয়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
অধ্যাপক রঙ্গ প্রধানমন্ত্রী ও ভারত সরকারের বিরুদ্ধে এই মর্মে অভিযোগ করেন যে, তাঁরা আসামে বাঙালিদের জীবন, সম্পত্তি, ভাষা ও সাংস্কৃতিক জীবন রক্ষা করার ব্যাপারে শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা আসামে বর্তমান কংগ্রেস মন্ত্রিসভাকে ক্ষমতায় আসীন রেখেছেন।
অধ্যাপক রঙ্গ সাংবাদিকদের বলেন, আসামের সকল দলের নেতৃবৃন্দ যতদিন না বাঙালি, খন্ডজাতি নির্বিশেষে সকল অনসমিয়া জনগণের স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন, ততদিন আসামে রাষ্ট্রপতির শাসন বলবৎ করার জন্য শ্রী এন সি চ্যাটার্জি যে দাবি জানিয়েছেন, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সকল দেশপ্রেমিকের তা সমর্থন করা উচিত।’৩৩
অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের অনুষ্ঠানে ‘অবিলম্বে আসামে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবি জানানো হল। পরিষদের উদ্যোগে ‘জাতীয় সংহতি সপ্তাহ’ উদযাপনের শেষ দিনে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলের এক জনসভায় কাছাড়ের ঘটনাবলির দরুন অবিলম্বে আসামে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি এবং আসাম সরকারের অপসারণের দাবি জানিয়ে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। এদিন ছিল শনিবার, ৮ জুলাই ১৯৬১।
প্রস্তাবে বলা হয় যে, হাইলাকান্দিতে প্রকাশ্য দিবালোকে ভারতীয় নাগরিকগণের ওপর বিশেষত বাঙালি হিন্দুদের ওপর যে নারকীয় অত্যাচার অনুষ্ঠিত হয়েছে তা ভারতীয় ঐক্য, সংহতি এবং সার্বভৌমত্বের ওপর প্রচন্ড আঘাত।
প্রধান অতিথি কাছাড় সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা শ্রী রথীন্দ্রনাথ সেন দিল্লিতে পরিষদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরু ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী শাস্ত্রীর আলোচনার মর্ম বিবৃত করেন। তিনি বলেন, আসামে বাংলা ভাষা স্বীকৃতির ব্যাপারে তাঁদের দাবি দিল্লিতে পূরণ হয় নাই, মূল দাবিও তাঁরা ছাড়েন নাই। কেন্দ্রীয় সরকারকে সময় দেবার জন্য শ্রী শাস্ত্রী তাঁদের যে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তদনুযায়ীই তাঁরা আন্দোলন স্থগিত রেখে কতৃপক্ষকে সময় দিয়েছেন। তিন মাস পর যদি সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীর অগ্রগমনের পথ রুদ্ধ হয়, তবে কাছাড়ে আগামী আন্দোলন ব্যাপক রূপ পরিগ্রহ করবে। তখন এটা শুধু কাছাড়েই সীমাবদ্ধ থাকবে না। শ্রীসেন বলেন, কাছাড়ের ভাষা আন্দোলনে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। হাইলাকান্দির সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলীর উল্লেখ করে তিনি আসামের মন্ত্রী জনাব মইনুল হক চৌধুরীর রাজনৈতিক কার্যকলাপ, আসামে পাকিস্তানি মুসলমানদের অবাধ অনুপ্রবেশের বিপদ এবং এ ব্যাপারে আসাম সরকারের নিষ্ক্রিয়তা এবং প্রধানমন্ত্রীর পক্ষপুটে জনাব মইনুল হককে প্রশ্রয়দান প্রভৃতির উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় সরকার ও আসাম সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন।
শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সভায় সভাপতিত্ব করেন। শ্রী সীতানাথ গোস্বামী এবং শ্রী তুষারকান্তি মজুমদারও সভায় বক্তব্য রাখেন। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় যে, ভাষা আন্দোলনের অন্তরালে পাকিস্তানি মুসলমানদের এই বর্বর অত্যাচার, লুন্ঠন ও অগ্নিদাহ ভারতের অন্তরাত্মাকে বিচলিত করেছে। আসাম সরকারের সহায়তা ভিন্ন এই ব্যাপক পাশবিক পর্ব অনুষ্ঠিত হতে পারে না বলে সভা মনে করে।’৩৪
আসামের শিলচরে ১৯ মে-র নরহত্যা, নর-মৃগয়া সমগ্র ভারতবাসীকে চমকে দেয়। একজন নন, দু’জন নন, ওরা এগারোজন। এ সব সত্যাগ্রহীদের মধ্যে ছিলেন নারী, শিশু। না, তাঁরা কোনো অস্ত্র হাতে তুলে নেননি। বিদ্রোহও করেননি, বিপ্লবও নয়। গণতান্ত্রিক ভারতে গণতান্ত্রিক পথেই নিরুপদ্রবে নিজ মাতৃভাষার দাবিতে শান্তিপূর্ণ অবস্থান করছিলেন। বিনা উস্কানিতে, কোনো হুঁসিয়ারি না দিয়ে বেপরোয়া গুলি চালিয়ে ওরা মানুষ খুন করল, আহত হল প্রায় শতাধিক। পাখির মতো সব পড়ে রইল ঘটনাস্থলেই। না, সরকারের কেউ আসলেন না। গুলির মধ্যেই আসলেন স্বেচ্ছাসেবী আর সাধারণ মানুষ। তাঁরাই হতাহতদের তুলে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে।
এই মৃত্যু, পুলিশি অত্যাচার, হাইলাকান্দিতে হামলা, গৃহদাহ, নারী নির্যাতন— সে এক দুর্বিষহ ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল সমগ্র কাছাড় জেলাতেই। আর এই দুঃসহ যন্ত্রণায় পাশে দাঁড়ালেন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ, রাজনীতিবিদ, শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক, নারী সমাজ, অভিনেতা-অভিনেত্রী। ভাষার প্রশ্নে, মানুষ হত্যার প্রশ্নে, বাঙালি জাতির প্রশ্নে আর কেউ আলাদা নন। ডান-বাম, হিন্দু-মুসলমান, নারী-শিশু, ধনী-দরিদ্র— সব এক। প্রতিবাদ জানিয়েছেন সকলে, নিজের মতো করেই। ২৪ মে ছিল সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে হরতাল।’ এমন হরতাল পশ্চিমবঙ্গের মানুষ খুবই কম দেখেছেন। এক ঐতিহাসিক দিন।
পরিশেষে কাছাড়ের শহিদ স্মরণে বনফুল-এর ‘প্রণাম লহ’ কবিতাটি বর্তমান প্রজন্মের উদ্দেশে উদ্ধৃত করব:
মাতৃভাষার মান বাঁচাতে তোমরা যারা প্রাণ দিয়েছ বীরতোমরা যারা বুঝিয়ে দিলে প্রাণের চেয়ে মানটা বহু বড়প্রণাম লহ প্রণাম লহ, শোকাচ্ছন্ন এ বঙ্গ-কবির,ওরে অসাড় বঙ্গবাসী, ওদের লাগি অর্ঘ্য কর জড়ো।
ঘরের চালে জ্বলছে আগুন, অপমানে যাচ্ছে মরে সতীগুন্ডা তাদের নিচ্ছে টেনে দিনের আলোয় চুলের ঝুঁটি ধরে’,
এই বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে’ প্রাণ দিয়েছ তোমরা মহারথীআমরা যখন সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছি দূরেতে চূপ করে’।
স্বাধীনতার নামে যখন সারা দেশে চলছে জুয়াচুরিলিঙ্গুইজম-নিন্দা করে লীডারিজম জাগছে দিকে দিকেতোমরা তখন জীবন দিয়ে ভেঙে দিলে সকল জারিজুরিরঙে-রঙে এঁকে দিলে স্বাধীনতার মর্ম কথাটিকে।
প্রমাণ করে’ দিয়ে গেলে মৃতের দেশে তোমরা ছিলে জিতাপ্রমাণ করে’ দিয়ে গেলে তোমাদেরই সত্যি ছিল প্রাণপ্রাণের আগুন দিয়ে বন্ধু জ্বেলে দিলে অত্যাচারীর চিতাপ্রমাণ করে’ দিয়ে গেলে বাংলা মায়ের তোমরা সুসন্তান।
রত্না-গর্ভা মা তোমাদের, ধন্যা তাঁরা, বহু পুণ্যবতীতোমরা তাঁদের অঙ্ক-শোভা বঙ্গ-মণি নি:শঙ্ক বীরঅন্ধকারের দেশে আজি ফুটিয়ে দিলে কী অপূর্ব জ্যোতিবেসুরোদের হট্টগোলে গেয়ে গেলে কী সুর গম্ভীর।৩৫
তথ্য নির্দেশ
১. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২১ মে, ১৯৬১
২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২২ মে, ১৯৬১
৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৩ মে, ১৯৬১
৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৪ মে, ১৯৬১
৫. প্রাগুক্ত
৬. প্রাগুক্ত
৭. প্রাগুক্ত
৮. প্রাগুক্ত
৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৫ মে, ১৯৬১
১০. প্রাগুক্ত
১১. প্রাগুক্ত
১২. প্রাগুক্ত
১৩. প্রাগুক্ত
১৪. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ৩ নভেম্বর, ১৯৬১
১৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৬ মে, ১৯৬১
১৬. প্রাগুক্ত
১৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৭ মে, ১৯৬১
১৮. প্রাগুক্ত
১৯. প্রাগুক্ত
২০. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৮মে, ১৯৬১
২১. স্বাধীনতা, কলকাতা, ২৮ মে, ১৯৬১
২২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৮ মে, ১৯৬১
২৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৯ মে, ১৯৬১
২৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৩১ মে, ১৯৬১
২৫. দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ৩১ মে, ১৯৬১
২৬. প্রাগুক্ত
২৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৫ জুন, ১৯৬১
২৮. দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ৯ জুন, ১৯৬১
২৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১১ জুন, ১৯৬১
৩০. স্বাধীনতা, কলকাতা, ২১ জুন, ১৯৬১ এবং আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২২জুন, ১৯৬১
৩১. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা ২৩ জুন, ১৯৬১
৩২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৩ জুন, ১৯৬১
৩৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৬ জুলাই, ১৯৬১
৩৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১০ জুলাই, ১৯৬১
৩৫. যুগান্তর, কলকাতা, ৩০ মে, ১৯৬১