মৌলবাদের সমাধান সন্ধানে
প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভাল, মৌলবাদী সমস্যার সমাধানে কোন চটজলদি ফর্মুলা বা প্রেসক্রিপশান হাতের কাছে মজুত নেই। আর এ ব্যাপারে নিজের বোধ এত কম ও অক্ষমতা এত বেশি যে, এ ধরনের কথা বলাও অনেকের কাছে একটি হাস্যকর ঔদ্ধত্য বলে মনে হতেই পারে। এ ব্যাপারে উপযুক্ত পণ্ডিত ও সচেতন ব্যক্তিরাও চিন্তাভাবনা করছেন। তাঁদের চিন্তার সামান্য শরিক হতে চাওয়াটা অন্যায় নয় বলেই, এমন ঔদ্ধত্য প্রকাশ করার সাহস হয়।
মৌলবাদী সমস্যার সমাধানের কথা ভাবতে গিয়ে প্রথমে একটি কথা মনে আসে যে, আদৌ এর সমাধানের প্রয়োজন আছে কিনা এবং যে ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে তার সৃষ্টি হয়েছে তাকে পরিবর্তন করাও সম্ভব কিনা। মৌলবাদের উচ্ছেদ ঘটানোটা যে অতি জরুরী তা হয়তো যে কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, মানবতাবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিই নিদ্বিধায় স্বীকার করবেন। তবু প্রশ্ন জাগে, পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন ধর্মের মৌলবাদীরা ও সামগ্রিক ভাবে মৌলবাদী মানসিকতা যে জনসমর্থন বিগত দু’এক দশকের মধ্যে অর্জন করেছে, সেটি এটি অন্তত প্রমাণ করে যে, জনগণের একটি অংশ মৌলবাদ চান, হয়তো বা অসচেতনভাবে কিংবা ধর্মীয় অভ্যাসে। তাই তাঁদের এই আকাঙ্ক্ষাকে মর্যাদা না দেওয়া অনুচিত কিনা। একইভাবে সাম্রাজ্যবাদের জনবিরোধী ও মানবতাবিরোদী ভূমিকার কথা যাঁরা উপলব্ধি করেন, তাদেরও এই প্রশ্ন করা যায় যে, সত্যিই এইভাবে সাম্রাজ্যবাদকে চিহ্নিত করা উচিত হচ্ছে কিনা,–নাকি এটি একটি বিশেষ উৎপাদন ব্যবস্থার বিকশিত এক রূপ, যার সাহায্যে উৎপাদন বাড়ছে, বহু ভোগ্যপণ্যের সৃষ্টি হচ্ছে, বহু মানুষ এর ফলে সুখস্বচ্ছন্দ্যের মুখ দেখছেন (সাময়িকভাবে হলেও) এবং বহু মানুষ মানসিকঅর্থনৈতিক-সামাজিক ভাবে এই ব্যবস্থার শরিক হয়েছেন,-ধর্মবিশ্বাস তথা ধর্মের বিভিন্ন স্তরের শরিক হওয়ার মত।
মৌলবাদী মানসিকতায় অভ্যস্ত বা সাম্রাজ্যবাদের প্রসাদপুষ্ট মানুষদের কাছ থেকে এমন ধরনের কূট বিতর্ক উঠলেও উঠতে পারে, কিন্তু তা উভয়ের সভ্যতাবিরোধী ভূমিকাকে আলোকোজ্জ্বল আদৌ করে না। এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এক সময়ে ইটালিতে ফ্যাসিবাদের অনুগামীও কম ছিল না। এই শতাব্দীর চতুর্থ দশকে যখন জার্মানীতে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সমগ্র জার্মান জাতিই তার সমর্থক ছিল, এবং এখনো তার অবশেষ আছে, নিও-নাৎসি গোষ্ঠী আছে, আছে একই ধরনের সন্ত্রাসবাদী কর্তৃত্ববাদ ও হিংস্র৷ জাতীয়তাবোধ। তবু দক্ষিণপাহী-বামপন্থী নির্বিশেষে পৃথিবীর কোন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই তার উৎসাহদাতার ভূমিকা পালন করতে ইচ্ছুক নন। কারণ ফ্যাসিবাদকে ‘ফ্যাইন্যান্স পুঁজির সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল একনায়কত্ব’ হিসেবে অনুভব করা যাক বা না যাক, এটি অন্তত বোঝা গেছে কি বীভৎস নারকীয়তার সঙ্গে সে তার কাজ হাসিল করতে চায়, কিভাবে বাজারের স্বার্থে যুদ্ধ বাধায়, কিভাবে লক্ষ লক্ষ নির্দোষ আবালবৃদ্ধবনিতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই মানবতাবিরোধী মানসিকতার অবসানে তাই দলমত নির্বিশেষে বহু মানুষ এক সময় সংগ্ৰাম করেছেন। ১৯৪৫– এ, এখন থেকে ৫০ বছর আগে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছিল। কিন্তু ঐ ফ্যাসিবাদ ভিন্ন রূপে এখনো আছে, রেখে গেছে তার সঙ্গীসাথী ও সন্তানসন্ততিদের। এদেরই অন্যতম ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ।
পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা মানুষের সমস্যা সমাধানের কোন পথ যে আদৌ নয়, তা বোঝা যায় তাদের নিজেদেরই ক্রমবর্ধমান সংকটের বিপুলতা থেকে। এই ব্যবস্থা নৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটে ক্রমশ নিমজমান। নৈতিকসামাজিক ক্ষেত্রে সংকট ও অবক্ষয় কি ভয়াবহতা অর্জন করেছে তা উন্নত ইংরেজ জাতির’ সাম্প্রতিক অবস্থা থেকে আচি করা যেতে পারে; শুধু বিগত ২৫ বছরে (১৯৭০-৯৫) ইংল্যান্ডের এই অবস্থা কেমন দাঁড়িয়েছে তার একটি আংশিক চিত্র শ্ৰী নীরদচন্দ্ৰ চৌধুরীর বর্ণনা থেকে পাওয়া যেতে পারে।–
‘১. নরনারী সম্পর্কিত আচরণ। বর্তমানে ইংরেজের মধ্যে লাম্পট্যের যে বিস্তার, বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতা দেখা যাইতেছে তাহা দ্বিতীয় চার্লস-এর যুগে বা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষেও দেখা যায় নাই।
এ-যুগের ইংরেজ লম্পটেরা শিশু, বালিকা ও বৃদ্ধাকেও বলাৎকার করিয়া হত্যা করিতেছে। এমন কি বারো তেরো বৎসরের বালকও এইরূপ বলাৎকার করিতেছে। অপর পক্ষে অল্পবয়স্কপ বালিকারাও এরূপ কামপরবশ হইয়াছে যে, তাহাদিগকে গৰ্ভ নিবারণের ঔষধ দিবার ব্যবস্থা হইয়াছে।
২। নরহত্যা। শুধু কামের বশেই নয়, অর্থের জন্যও নরহত্যার বিস্তার হইতেছে। বারো-তেরো বৎসরের বালকেরাও সামান্য অর্থের জন্য পেনসনভোগিনী বৃদ্ধাকে হত্যা করিতেছে। আমি ১৯৭৫ সাল পর্যন্তও অক্সফোর্ডের চারিদিকে অতি নির্জন স্থানে প্রাতঃভ্রমণ করিতে যাইতাম, এখন আর ভরসা পাইনা।
৩। গুন্ডাবাজির যে প্রসার হইয়াছে, উহা ভীতিজনক, একটু রাগ হইলেই একজন বা একদল অন্য ব্যক্তির বা অন্য দলের উপর ছোরা চালাইতেছে।
৪। অর্থালিন্সা সর্বব্যাপী এবং সকল বয়সের ইংরেজের মধ্যে দেখা দিয়াছে, কিন্তু সেই অৰ্থলিন্সাও, লাম্পট্যের মতই, ইতর, সামান্য অর্থের জন্য। সকল ইংরেজের মনে এক চিন্তা-কি করিয়া টাকা হইবে-ইংরেজি ভাষায় উহার পরিচয় দিতে হইলে বলিতে হয়–Everybody wants his penny-worth for his penny or his penny for his pennyworth. ইহার বেশি উচ্চ ধারণা অর্থোপার্জন সম্বন্ধেও নাই।’ (দেশ; ১২.৮.৯৫)
যাঁরা একটু খোঁজ খবর রাখেন তাঁরা জানেন আমেরিকা ও তার মানুষও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। ‘ইউ এস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট নামে মার্কিন সাময়িকী ১৯৮০-তে এ ব্যাপারে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল তার থেকে জানা যায়, ওখানে ‘গড়ে প্রতি দু সেকেন্ডে একটি সিঁদেল চুরি, প্রতি ২৮ সেকেন্ডে একটি গাড়ি চুরি, প্রতি ৪৮ সেকেন্ডে একটি মারাত্মক শারীরিক আক্রমণ ও আঘাত, প্রতি ৫৮ সেকেন্ডে একটি সশস্ত্ৰ ডাকাতি, প্রতি ৬ মিনিটে একটি ধর্ষণ এবং প্রতি ২৩ মিনিটে একটি খুনের ঘটনা ঘটে।’ এবং সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান এর চেয়ে আশাব্যঞ্জক তো নয়ই, বরং আরো ভয়াবহ।
নৈতিক ও সামাজিক এই সংকট যে ধর্মহীনতার জন্য সৃষ্টি হয়েছে তা আদৌ নয়। ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রভাব ও ধর্মবিশ্বাস যথেষ্টই আছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিপুলভাবে এগিয়ে থাকলেও এই এগিয়ে থাকার ব্যাপারটি নিছকই যান্ত্রিক ও শ্রেণী:স্বার্থে প্রযুক্ত। প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্কতার পরিবেশ এমন পুঁজিবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে এখনো তৈরি হয় নি। এরই একটি প্রতিফলন ঘটে এমন দেশের নাগরিকদের মধ্যে ঈশ্বরবিশ্বাস ও ধর্মমোহ থেকে মুক্তির মানসিকতা অতি নূ্যনতমমাত্রায় বিকশিত হওয়ার মধ্যে। যেমন ১৯৮০ সালের হিসাব অনুযায়ী উত্তর কোরিয়ার শতকরা ৬৭.৯ জন, আলবেনিয়ার ৫৫.৪ জন, চীনের ৭১.২ জন বা মঙ্গোলিয়ার ৬৫.৪ জন (১৯৯০) ব্যক্তি যখন ঈশ্বরবিশ্বাসমুক্ত (atheist) ও ধর্ম-পরিচয়হীন (nonreligious) হিসাবে নিজেদের ঘোষণা করেছেন, সেখানে আমেরিকায় এমন মানুষের সংখ্যা মাত্র শতকরা ৬.৮ ও ইংল্যান্ডে ৮.৮ ভাগ। (বিগত বছরগুলিতে এই পরিসংখ্যান বিরাটভাবে কিছু পরিবর্তিত হয় নি।) স্পষ্টতঃই আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের ৯০ ভাগেরও বেশি মানুষ ধর্ম ও ঈশ্বরকে যতটুকুই হোক না কেন এবং যেভাবেই হোক না কেন আঁকড়ে আছেন। আমেরিকায় ফান্ডামেন্টালিজমসহ চার্চের প্রভাব কম নয়। ইংল্যান্ডে তো রাজতন্ত্রের পাশাপাশি চার্চ অব ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের মহিমা ও প্রাধান্য বিপুল। এই অবস্থায় ইংল্যান্ডে বা আমেরিকায় এই চূড়ান্ত নৈতিক অবক্ষয়, এই হিংস্রতা, লাম্পট্য ও অর্থগৃধুতা, চরম ভোগবাদী মানসিকতার পেছনে বস্তুবাদী দর্শনের বা বামপন্থী আন্দোলনের ভূমিকা শূন্য। বরং এটি বলা অসঙ্গত নয় যে, এর পেছনে ভূমিকা পালন করেছে। ধর্ম এবং শোষণভিত্তিক পুঁজিবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার ককটেল। খৃস্ট ধর্মের ব্যবহার ঐ সব দেশে সম্পূর্ণত আদর্শ মৌলবাদী চরিত্র হয়তো অর্জন করে নি। কিন্তু মানসিকতা বা ভিত্তি আছেই, এবং ঐসব দেশে হিংস্র ধর্মীয় মৌলবাদের অনুপস্থিতির একটি বড় কারণ হিংস্র ভিন্ন বা বিরোধী ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির সংখ্যার নূ্যনতম পরিমাণ। (আমেরিকায় শতকরা মাত্র ৬.৭ জন ও ইংল্যান্ডে শতকরা ৪.৩ জন ব্যক্তি অন্যান্য নানা ধর্মাবলম্বী।)
এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, আমেরিকা-ইংল্যান্ডের মত দেশগুলির ধর্ম ও পুঁজিবাদী সংস্কৃতির ককটেল ভারতের মত দেশেও চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এবং সম্প্রতি তা বিপুল উদ্যোগে বাড়ানো হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘সর্বধর্মে সমভাব’ করে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দেওয়া হয়েছে, ধর্মীয় মৌলবাদের সৃষ্টির পথ পরিষ্কার করা হয়েছে। বামপন্থী-দক্ষিণপন্থী নির্বিশেষে প্রায় সব রাজনৈতিক সুবিধাবাদী দলগুলি ভোটের লক্ষ্যে ধর্মীয় কুসংস্কার এবং ধর্মকে ব্যবহার করছে ও প্রশ্ৰয় দিচ্ছে। অন্যদিকে-ভোগবাদ, পণ্যবাদ বা কনজিউমারজম, আত্মকেন্দ্রিকতা, যে কোনভাবে অর্থোপার্জনের মানসিকতা ইত্যাদি এবং এসবকে জনপ্রিয় করার জন্য যৌনতা ও হিংস্রতার সংস্কৃতি–কে দূরদর্শন ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে ঢালাও ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। সবাইকে নিয়ে বাঁচা নয়, শুধু নিজেকে প্রতিষ্ঠা করাই এখনকার যুব সমাজের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে।
(সামাজিকভাবে এর প্রতিফলনও ঘটছে। এর একটি সামান্য পরিচয় এ ধরনের হিসাব থেকে পাওয়া যাবে যে, ভারতে এখন প্ৰতি ৪৭ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিতা হন, প্ৰতি ৪৪ মিনিটে একজন নারী অপহৃত হন এবং প্রতিদিন পণজনিত কারণে বধূহত্যা ঘটে ১৭টি। —-গণশক্তি, ৬৯.৯৫)
আমেরিকা-ইংল্যান্ডে ধর্মের অবস্থান থেকে এটি বোঝা যায় যে, ধর্ম এই নৈতিক সংকট আটকানোর ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা তো নেয়ই না, বরং তাকে বাড়িয়ে তোলায় সাহায্য করে। কোন কোন সরল বিশ্বাসী ধামিক ব্যক্তি এমন মনে করতে পারেন যে, ধর্মের মূল শিক্ষা ঐ সব দেশের মানুষ ভুলে গেছে, আগে এই শিক্ষা ছিল বলে এমন নৈতিক-সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি হয় নি। এটি একটি ভ্রান্ত ও আত্মপ্রবঞ্চনাকারী ধারণা। অতীতেও, ধর্মীয় শিক্ষার চেয়ে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও ঐ অনুযায়ী সামাজিক পরিকাঠামোই। এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে ব্যবস্থায় বর্তমানের পুঁজিবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদী পরিকাঠামো টিকিয়ে রাখার উপযোগী মুনাফা বাড়ানো, পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবর্তে অবাধ প্রতিযোগিতা (অর্থাৎ অন্যকে ল্যাং মেরে বা ধাক্কা মেরেও নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া), চূড়ান্ত পণ্য নির্ভরতা, ক্রমবর্ধমান ভোগবাদ (না হলে পণ্য বিক্রি হবে না) ইত্যাদি থাকার প্রয়োজন ছিল না বা থাকবে না সেই ব্যবস্থাগুলিতে এমন অর্ধগৃধুতা, হিংস্ৰতা ও তাদের হাত ধরাধরি করে আসা যৌনবিকৃতি সৃষ্টির পরিবেশও শক্তিশালী ছিল না বা থাকবে না। বরং দেখা গেছে তথাকথিক ধৰ্মশাস্ত্রগুলিতে আদিম যৌনতাকে সুড়সুড়ি দেওয়ার উপকরণ বহুতু পরিমাণেই মজুত আছে। ‘লীলা’ বলে যতই চালানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, শ্ৰীকৃষ্ণের উলঙ্গ গোপিনীদের তারিয়ে তারিয়ে দেখার, বা ছদ্মবেশে ঝোপে ঝাড়ে কুয়াশার মধ্যে যেখানেই হোক সুন্দরী মহিলাদের উপর হামলে পড়ার দৈব অনুগ্রহের’ মত অজস্র লাম্পট্যের ঘটনা এই সব তথাকথিত ধর্মগ্রন্থে অসংখ্য রয়েছে। আছে শ্ৰীীরামচন্দ্রের সুগ্ৰীব বধ বা ইন্দ্ৰজিতকে খুন করার মত নৃশংস হিংস্রতার অজস্র উদাহরণও। ব্যাপারগুলি তখনকার পরিবেশে স্বাভাবিক হয়তো ছিল। কিন্তু ধর্মের নামে এখনো তা প্রচার করা ও মহীয়ান করার অর্থ ঐ বিকৃতিকে, ক্যান্সার বৃদ্ধিকারী উত্তেজনার (carcinogenic) ভূমিকা নিয়ে বাড়িয়ে তোলা। সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতিও তাই চায়। তারা চায় ধর্মের অবৈজ্ঞানিক মানসিকতার সঙ্গে যৌনতায় আচ্ছন্ন এক ব্যক্তিত্বহীন ক্ৰেতাজনগণ, যারা যা প্রচার করা হবে। বিনাযুক্তি প্রয়োগে (যেন ঈশ্বরভক্তির মত), নিজেকে তৃপ্ত করতে (যেন এক যৌন আনন্দ লাভের মত) তাই-ই কিনবে।
মৌলবাদী ধর্মের এই নোংরা ব্যবহারের এক কেন্দ্রীভূত রূপ,—তার এই কেন্দ্রীভবন মূলত ধর্মকে নিয়ে, সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রীভবন যেমন ঘটে একচেটিয়া পুঁজির মধ্যে। সাম্রাজ্যবাদ সামান্য সংখ্যক কিছু মানুষের একটি ছোট্ট গোষ্ঠীর স্বাের্থরক্ষণ করতে, বিপুল সংখ্যক পৃথিবীবাসীকে তাদের অর্থনৈতিকভাবে ক্রীতদাস, সাংস্কৃতিকভাবে পঙ্গু এক সত্তায় পরিণত করতে চায়। ধর্মীয় মৌলবাদও তেমনি মানুষকে এক ভাববাদী অবৈজ্ঞানিক চেতনার ক্রীতদাসে পরিণত করতে ও স্বাধীন বিকাশে অক্ষম, জড়বদ্ধ প্রাচীন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে আচ্ছন্ন করে পঙ্গু করে তুলতে চায়। উভয়ের নেতৃত্ব দেয় স্বল্প কিছু মানুষের একটি আপাত শক্তিশালী শ্রেণী, যারা বিপুল শক্তিধর ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে সাময়িকভাবে শাসন করে বা করতে চায়। তাই উভয়েই সমানভাবে ঘূণ্য, পরিত্যাজ্য ও মানবতার শত্রু।
এরা মানুষের স্বাভাবিক মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাই ভালবাসা ও পরস্পরকে সাহায্য করা। এর পেছনে তার হরমোন ও জীন-গত (genetic) গঠন যেমন কাজ করে, তেমনি কাজ করে তার বহু শত বছরের অভিজ্ঞতা, যে অভিজ্ঞতায় সে জেনেছে পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা সম্ভব নয়। ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ—একই বৃন্তের এই তিন বিষফুল মানুষের এই পারস্পরিক মমত্ববোধ, সহযোগিতা ও সহমর্মিতাকে ধ্বংস করতে চায়। তা না করলে তাদের অস্তিত্বই সম্ভব নয়।
জার্মানির সেই ফ্যাসিবাদ শুধু বাঁচার কথা বলেছিল জার্মান জাতিকে,-ইহুদি ও অন্যান্য তথাকথিত অনার্যদের শত্রু বলে বিপুল সংখ্যক জার্মান নাগরিককে বিশ্বাস করিয়েছিল। এটি বৃহদংশ জার্মানদের কাছে জনপ্রিয়ও হয়েছিল; তেমনি তা বৃহত্তর মানবিক ঐক্য, সৌহার্দ ও সম্প্রীতিকে ধ্বংস করে অন্যের প্রতি ঘৃণা ও নির্মম হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশও ঘটিয়েছিল। এটিকে শুধু পাশবিক বল্লে, পশুদেরও অপমান করা হয়, কারণ এটি জানা আছে যে আত্মরক্ষা, প্রাণধারণের জন্য খাদ্যে টান পড়া, যৌন অতৃপ্তি ইত্যাদির চরম প্রয়োজন ছাড়া সাধারণতঃ পশুরাও পরস্পরের প্রতিহিংস্র হয়ে ওঠে না। এখন সাম্রাজ্যবাদ প্রায়শঃ আরো ঠাণ্ডা মাথায় এ কাজ করে। হিটলারি-উগ্রতার ও চটজলদি সব কিছু পাওয়ার ততটা প্রয়োজন তার সবসময় হয় না, যতটা প্রয়োজন হয় ধীরগতিতে বিপুল সংখ্যক মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং অর্থনীতি ও সমাজকে নিজের কন্তুজায় আনতে। এর ফলেই সে অন্যদের শুধু নিজের প্রতিযোগী হিসেবে ভাবতে শেখায়, সহযোগী বা সাখী হিসেবে নয়। কিভাবে প্রতিযোগিতায় ব্যবসা ও পুঁজি বাড়বে, নিজের ভাল চাকরি ও পদ অর্জন করা সম্ভব হবে, অর্থদায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হওয়া যাবে-এই ই তার শিক্ষণীয়। যতদিন এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হবে, এমনকি তার শ্ৰীবৃদ্ধিও ঘটানো হবে, ততদিন মানুষে মানুষে সত্যিকারের সম্প্রীতি ও সহযোগিতার বাতাবরণ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আর এই প্রতিযোগিতার ব্যাপকতর প্রয়োগ ঘটে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দাঙ্গা সৃষ্টির মধ্যে, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে মদত দেওয়ার মধ্যে—যে সবগুলিতে মাঝখান থেকে মারা পড়ে নিরীহ শতশত মানুষ, নিরপরাধ অসহায় মানুষই। যেন এক অদৃশ্য সুতোর টানে তারা মৃত্যুমুখে এগিয়ে যায়।
ধর্মীয় মৌলবাদ (এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদও) ধর্মকে কেন্দ্র করে এই মানবিক অনৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে ও প্ৰেমগ্ৰীতিহীন ফ্যাসিস্ট ধর্মীয় সত্তা গড়ে তুলতে চায়। একদা যেসব প্রতিবেশীরা ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে দীর্ঘকাল পরস্পরের সহযোগী সুহৃদ হয়ে বেঁচেছিল, তারা এক সময় এই ধৰ্মীয় অপশক্তির হাতে ধরা সুতোর টানে ছুরি হাতে পরস্পরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানুষ থেকে অমানুষ হয় ওঠে। নবজাত শিশুদের শরীরে শারীরিক চিহ্ন হিসেবে কোন ধর্ম নেই, জাত নেই, শ্রেণী নেই। সমাজই তাকে এক সময় এমনভাবে শিক্ষিত করে ও এমন পরিচয়ে পরিচিত করায়। এই কৃত্রিম পরিচয় ও বিভাজন ধর্মের একটি কাজ। ধর্মীয় মৌলবাদ এই বিভাজনকে বাহ্যিক নয়। অভ্যন্তরীণ, পরিবর্তনীয় নয় অপরিবর্তনীয় ও অলঙঘ্য হিসেবে সুতীব্রভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ করতে গিয়ে সে ভিন্ন ধর্মের প্রতিবেশী মানুষদের প্রতিযোগী হিসেবে ও সমস্যার কারণ হিসেবে, এমনকি দেশেরও শত্ৰু হিসেবে চিহ্নিত করে। (ভাষাগত, জাতিগত, অঞ্চলগত ইত্যাদি ধরনের সাম্প্রদায়িকতাবাদীরাও তাই-ই করে।) সংখ্যায় যারা যেখানে বেশি সেখানে তারা ছড়ি চালায়। তার প্রতিক্রিয়ায় সংখ্যালঘুরাও ছড়ি ধরে। বিভাজন, অপ্রেম, অবিশ্বাস বেড়েই চলে। মৌলবাদকে ও সাম্প্রদায়িকতাকে টিকিয়ে রাখা ও বাড়তে দেওয়ার অর্থ মানুষের স্বভাববিরোধী এই সব দিকগুলিকে দ্রুত বাড়িয়ে তোলা, যার পরিণতি দাঙ্গা, যুদ্ধ ও ধ্বংসই হতে বাধ্য। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিশেষ ধর্মের মানুয নিজেদের কিছুদিনের জন্য শক্তিশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ও কর্তৃত্বলাভ করতে পারে, কিন্তু দীর্ঘকাল নয়। ভিন্ন গোষ্ঠীর যাদের সে শত্রু পরিণত করেছে, হত্যা করেছে, নিপীড়ন চালিয়েছে তারা প্ৰতিশোধ নোবেই। অবিশ্বাস ও শক্রিতার পথ ধরে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে আসবে এই পারস্পরিক হনন, যদি না মানুষের শুভবুদ্ধি এই চক্রকে মধ্যপথে ছিন্ন করে। এবং তা করেও।
রাজনৈতিক মৌলবাদও দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার নামে ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশ, স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব ও বিশেষ ভাললাগা-মন্দলাগার বোধ আর আবেগগুলিকে অস্বীকার করে। এবং পদদলিত করে,—এক রাজনৈতিক কর্তৃত্বের (তা ব্যক্তির বা গ্রন্থের) অধীনে। ‘রোবট’-এ পরিণত করে তার অনুগতদের। অন্যদিকে এই মানসিকতা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের জনসাধারণকে শত্রু (শ্রেণীশত্রু?) হিসেবে, প্রতিযোগী হিসেবে ও সহযোগিতা পাওয়ার অযোগ্য বলে প্রতিষ্ঠা করে। একদা যে জনগণ বন্ধুর মত দীর্ঘকাল পাশাপাশি বসবাস করেছে, এখন রাজনৈতিক সচেতনতার নামে পাটিপরিচয় পরস্পরের মধ্যে বিভেদ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করছে। এমনকি আমাদের মত দেশের গ্রামেগঞ্জেও, আগের মত ‘কৌন জাত বা’-র পরিবর্তে ‘কৌন পাটি বা’—এ প্রশ্নই সামনে আসে। ব্যাপারটি ধর্মীয় বা জাতপাতের বিভাজনের চেয়ে সামান্য কিছুটা সুস্থতর মনে হলেও, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনৈক্য সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট। এর ফলে রাজনৈতিক হানাহানিই বাড়ে। সবাই জনগণের মঙ্গলের কথা বলে, কিন্তু সবাই জনগণকেই বলি দিতে থাকে। মতাদর্শের অনুদার, যান্ত্রিক ও অমানবিক প্রয়োগ এই মৌলবাদীদের,—তারা ধর্ম ও ধর্মীয় মৌলবাদ, এমন কি পুঁজিবাদসাম্রাজ্যবাদের বিরোধী ভূমিকা নিলেও, মূলবিচারে মানুষের শত্রুতে পরিণত করে। তাই সবধরনের মৌলবাদই যে পরিত্যাজ্য এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক মৌলবাদী মানসিকতার সমাধান হয়তো ভবিষ্যতে কোনদিন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অবলুপ্তির মধ্য দিয়ে হতে পারে, যখন বৃহত্তর সমবায় ভিত্তিক ও নূ্যনতম কিছু ক্ষেত্রে ঐক্যভিত্তিক মতাদর্শ ও কর্মসূচীকে সামনে রেখে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতিকে স্বচ্ছল ও সুস্থ করে তুলবে। কিন্তু এটি অর্জনের পূর্বশর্ত সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও ধর্মীয় বিভাজনকে ধ্বংস করা এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদকে অবলুপ্ত করা। কারণ এই শোষণ ও এই বিভাজন এমন ঐক্যের ভিত্তিমূলের শত্ৰু, শেকড়েই তাকে বিনষ্ট করে দিতে সচেষ্ট। আর এই সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদের উচ্ছেদে পরস্পর সংযুক্ত দুটি মোটা দাগের দায়িত্বের কথা বলা যায়—তা হল সচেতনতা ও সংগ্রাম।
ধর্মীয় মৌলবাদ প্রসঙ্গে এই সচেতনতার লক্ষ্য,-ধর্ম ও ধর্মীয় মৌলবাদ সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত সত্যগুলিকে জানা, তার উদ্ভব ও সৃষ্টির ইতিহাস ও কারণগুলিকে উপলব্ধি করা। সংগ্রামের লক্ষ্য,-যে ব্যবস্থার উপরিকাঠামো হিসেবে ধর্ম ও ধর্মীয় মৌলবাদের টিকে থাকা ও সৃষ্টি হওয়া, সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন। এবং প্রয়োজনে ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রামও।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপুল সংখ্যক মানুষকে সচেতন করে তোলা একটি বড় প্রয়োজন। এর ফলে ধর্ম, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের শিকার তারা হবেন কি হবেন না, এই সিদ্ধান্ত র্তারা নিজেরাই নেওয়ার উপযুক্ত হয়ে উঠবেন। আর ফলতঃ পারস্পরিক হানাহানি বন্ধ করে প্রকৃতির বিরুদ্ধে ও অর্থনৈতিক সংগ্রামে যুক্ত হওয়াকে তাঁরা সুস্থতর ব্যাপার বলে অনুভব করতে সক্ষম হবেন।
ধর্মীয় মৌলবাদ সৃষ্টির পেছনে এই সংগ্রামের শূন্যতা একটি বড় ভূমিকা পালন করে। তাই তৃণমূল স্তর অব্দি বিস্তৃত বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে অবিজ্ঞান ও গণবিরোধী শত্রুর বিরুেদ্ধে সংগ্রাম যত বিস্তৃত হবে, ধর্মীয় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা ততই হ্রাস পাবে বা প্ৰতিহত হবে। এক্ষেত্রে সঠিক বামপন্থী আন্দোলনই তার গণমুখী, ভাববাদবিরোধী মতাদর্শ নিয়ে এবং অর্থনৈতিক ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের পাশাপাশি একটি বিরাট ভূমিকা নিতে সক্ষম। এটি ঠিক যে, এই সঠিক’ কথাটি একটি বিরাট গোঁজামিলের ব্যাপার। চূড়ান্ত অর্থে সঠিক কোন কিছু সম্ভব নয়। তবু ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতাগুলিকে আন্তরিকভাবে ও খোলামনে নূ্যনতম করার মধ্য দিয়ে এই সঠিকতার কাছাকাছি পৌঁছনোর চেষ্টা করাটা অসম্ভব নয়।
ধর্মের প্রভাব মুক্ত এবং বিজ্ঞানমনস্ক মানসিকতার নেতৃত্বে, অজস্র সংগঠন গড়ে তোলা দরকার। দেশের প্রতিটি গ্রামে ও শহরের প্রতিটি পাড়ায় এ ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংস্থা বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। আন্তরিক ইচ্ছা থাকলে সরকারী উদ্যোগেই প্রতিটি গ্রামে ও পাড়ায় সামান্য কিছু সাম্মানিক দিয়ে দু’তিন জন স্থানীয় সচেতন তরুণ-তরুণীকে এ ব্যাপারে নিয়োগ করা যায় এবং পশ্চিমবঙ্গ এ ক্ষেত্রে একটি মডেল রাজ্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। সাক্ষরতা কর্মসূচীর অঙ্গ হিসেবে এ রাজ্যে দু’একটি জেলায় এমন উদ্যোগ গড়েও উঠছে। (যেমন বর্ধমান জেলায় ১৯৯৫-এর অক্টোবরের সূর্যগ্রহণকে কেন্দ্র করে।) তবে এটি সভয়ে লক্ষ্য করার ব্যাপার যে, এই সুস্থ উদ্যোগ যেন সংকীর্ণ দলবাজির শিকার না হয় এবং দলীয় রাজনীতিকে বা তার মাহাত্ম্যকে প্রতিষ্ঠা করার আত্মহননকারী উদ্যোগে না পর্যবসিত হয়। এছাড়া এই পশ্চিমবঙ্গের (অন্যান্য কিছু রাজ্যেও)। সরকারী প্রভাবমুক্ত বহু বিজ্ঞানসংস্থা গড়ে উঠেছে। এদেরও গোঁড়ামিমুক্ত সামগ্রিক ঐক্যবদ্ধতা ধৰ্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা রুখতে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে সক্ষম এবং প্রকৃতপক্ষে সরকারীভাবে একাজ কতটা আন্তরিকভাবে হবে, এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহও আছে। এখনকার পরিস্থিতিতে সরকারী বন্ধন মুক্ত মানুষের গণ উদ্যোগ এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা নিতে সক্ষম।
ধর্মীয় মৌলবাদ যেভাবে মাথা চাড়া দিচ্ছে, তাতে এ ধরনের গণবিজ্ঞান আন্দোলন অতি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী। এক্ষেত্রে মৌলবাদবিরোধী প্রত্যেকের মধ্যে ও প্রতিটি সংস্থার মধ্যে ঐক্যও গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে বুর্জেয়া নাস্তিকতা ও যান্ত্রিক যুক্তিবাদের সঙ্গে বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়াটাও দরকার। কি হিন্দু, কি ইসলাম, কি খৃস্ট–সব ধরনের ধর্মীয় মৌলবাদীরা ক্ষমতা পেলে পরিপূর্ণ ফ্যাসিবাদী ক্রিয়াকাণ্ড শুরু করার জন্য প্রস্তুত। শিবসেনা-আর এস এস-এর মত হিন্দু মৌলবাদী নয়াফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী বা ইরান থেকে পাকিস্তান নানা দেশের অজস্র মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনগুলি প্রকাশ্যে এমন কথাবার্তাও বলে এবং ফ্যাসিবাদের ইঙ্গিত দেয়। (নেহাত বি জে পি-র মত কিছু কিছু ‘রাজনৈতিক দল’ আইন বাঁচাতে ও ভোটে দাঁড়ানোর জন্য প্রকাশ্যে এখনকার মত একটু রেখে ঢেকে কথা বলে।) সেক্ষেত্রে এরা ক্ষমতা পেলে,-হিটলারের ইহুদি নিধনের মত, ভিন্ন ধর্মের এবং কম্যুনিষ্ট বা মুক্তমনানাস্তিক-ধর্মপরিচয়মুক্ত বলে মনে করা ব্যক্তিদের লাখে লাখে হত্যা করতে পিছপা হবে না।(১) (৯০ কোটি ভারতবাসীর ৮-১০ কোটিকে মেরে ফেল্পে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকেই যাবে।) হয় পরিপূর্ণ আনুগত্য, কিংবা নিশ্চিহ্নকরণ—এই এদের নীতি। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি আটকাতে ধর্মীয় মৌলবাদীদের সামান্য সংস্রবকেই প্রধান গুরুত্ব দিয়ে প্রতিহত করার কাজে সামান্যতম গাফিলতির কোন ক্ষমা নেই। মৌলবাদী প্রভাব ও প্রচার টিকিয়ে রাখার অর্থ অন্যান্য ক্ষতির পাশাপাশি এই লক্ষ্যে তাদের পৌঁছনোর পথকে খুলে রাখা।
সমাজের শ্রেণীবিভাজন ও শ্রেণীবৈষম্যকে স্বীকার করুন, বা না করুন, অন্তত ধর্মীয় প্রভাব তথা ধর্মীয় মৌলবাদের প্রভাবকে আটকানোর প্রশ্নে, তাই ধর্মনিরপেক্ষ বুর্জেয়া, বুর্জেয়া নাস্তিক ও যুক্তিবাদীদের সঙ্গে বামপহী-দক্ষিণপন্থী নির্বিশেষে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীরও যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলা এবং ঐক্যবদ্ধ ব্যাপক কর্মসূচী নেওয়া উচিত। এঁরা পরস্পরের মধ্যে রাজনৈতিক সংগ্ৰাম চালাতেই পারেন, কিন্তু মৌলবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে নিজেদের অনৈক্য মৌলবাদের আগমনকেই উৎসাহিত করবে।
নিজেদের ও প্রতিবেশীদের,-বিশেষত দরিদ্র, প্রথাগত শিক্ষাবর্জিত ও সামাজিকভাবে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে, সচেতনতা বৃদ্ধির ঐক্যবদ্ধ ও গণমুখী ব্যাপক বিজ্ঞান আন্দোলন, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা বিরোধী কাজকর্ম এবং সরাসরি মৌলবাদবিরোধিতা তীব্রতম করার সময় এসেছে। নিছক বিজ্ঞান আন্দোলনের জন্য বিজ্ঞান আন্দোলনও এ ক্ষেত্রে কিছু ভূমিকা রাখবেই। কিন্তু সচেতন ব্যক্তিদের উচিত এই বিজ্ঞান আন্দোলনকে সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলন, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এবং ছাত্র-যুব-নারী সংগঠনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এবং উচিত ক্রমশ এই বিজ্ঞান আন্দোলনকে শ্রেণী সচেতনতা ও সমাজঅর্থনীতি সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির দিকে নিয়ে যাওয়া। যান্ত্রিক যুক্তিবাদী ক্রিয়াকাণ্ড বা শ্রেণীবোধহীন বুর্জেয়া নাস্তিকতা আমাদের মত বিপুল সংখ্যক দরিদ্র ও নিরক্ষর জনসাধারণের দেশে একটি স্তর আদি মূল্যবান হলেও, ক্রমশঃ যদি না তার এই উত্তরণ ঘটানো যায়। তবে তা একসময় কানাগলির সম্মুখীন হতে ও ব্যর্থ হতে বাধ্য। এই উত্তরণের অভাবে এই ধরনের যান্ত্রিক বিজ্ঞান আন্দোলন এক সময় মৌলবাদের মত সামাজিক অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হতে থাকে এবং দোদুল্যমান শিক্ষিত মানুষ (এমনকি তথাকথিত বিজ্ঞানীদের’ও) সৃষ্টি করে, যারা সুযোগ পেলেই অবিজ্ঞান, ধর্মীয় কুসংস্কার এমনকি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের শিকার হয়ে যায়। এই উত্তরণের অভাবেই যান্ত্রিক যুক্তিবাদী আন্দোলনের মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক নেতৃত্বের সৃষ্টি হয়, যে নিজেকে নির্ভুল সবোত্তম বলে ভাবে, ভিন্ন গোষ্ঠীর লোকেদের শত্রু বলে ধরে নেয় এবং মানুষের অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অনাবিল ধর্মবিশ্বাসকে অপমান ও ব্যঙ্গ করে। বিজ্ঞান আন্দোলনের মূল লক্ষ্য বিজ্ঞানমনস্কতা অর্জন করা, যার সাহায্যে ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি সম্পর্কে তথা মানুষের বিভিন্ন শ্রেণীবিভাজন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ক্রমশ উচ্চ পরিমাণে লাভ করা সম্ভব। এর ফলেই একজন বিনয়ী, পরমতসহিষ্ণু, মানবিকও হয়ে ওঠে। কারণ প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিই ক্ৰমশঃ উপলব্ধি করতে পারেন জ্ঞান কত বিপুল। আর ব্যক্তিগতভাবে তার কত ক্ষুদ্র অংশ জানা সম্ভব এবং জ্ঞানের চরম সত্যতা, কত অসম্ভব, তাই নিজের জানার মধ্যে কত বিতর্কের অবকাশ আছে। (পাশাপাশি নতুন জ্ঞানের আলোয় তা পরিবর্তিত না হলে, তার থেকে তাঁরা সরেও আসেন না, আবার নতুনকে বিনা দ্বিধায় গ্রহণও করেন।)
তাই বিজ্ঞান আন্দোলন নিছক ধর্মবিরোধী আন্দোলন নয়। কিন্তু বিজ্ঞান তথা বস্তুবাদী দর্শন ধর্মবিরোধী অবশ্যই। বিজ্ঞানের সঙ্গে ভাববাদ, ঈশ্বরবিশ্বাস ও এই বিশ্বাসকেন্দ্ৰিক ধর্মের মিলনের নানা গন্তীর বাগাড়ম্বর ও সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা, আসলে বিজ্ঞান আন্দোলনকে বিপথগামী করার এবং ভাববাদ ও ধর্মকে নতুন কৌশলে প্রতিষ্ঠা করার কৌশল মাত্র।
বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বরা (আসলে এরা সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী ব্যক্তিদেরই জ্ঞাতি ভাই) এবং তাদের অনুগত তথাকথিত শিক্ষিত ও এমনকি বিজ্ঞানের ডিগ্রিধারী ব্যক্তিরা নানা গুরুগম্ভীর লেখাপত্ৰ-আলোচনা-সেমিনারে এমনভাবে বিজ্ঞান ও ধর্মের মিলনের(২) কথা প্রচার করলেও, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক বা অজ্ঞতাপ্রসূত কথাবার্তা আদতে শাসকশ্রেণীর স্বার্থবাহী এবং ধৰ্মজীবী পরজীবীদের আত্মরক্ষার উপায় মাত্র।
আসলে ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করার পথটি সঠিকভাবে আয়ত্ত করা দরকার। যে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অঙ্গ হিসেবে ধর্মের টিকে থাকা, সেই সমাজের পরিবর্তন ছাড়া ধর্মের অবস্থানেরও গুণগত কোন পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়। ধর্ম সম্পর্কে বিজ্ঞান সম্মত তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করার প্রক্রিয়াটি এই শ্রেণীবিভক্ত সমাজ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটিকে ছাড়া আরেকটি পরিপূর্ণতা পেতে পারে না। একইভাবে ধর্মের বিরদ্ধে সংগ্রামের বিষয়টি এই সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য যে সংগ্রাম, বা অন্তত শোষণ, আধিপত্য ও বৈষম্য দূর করার জন্য মানুষের যে লাগাতার দৈনন্দিন সংগ্রাম, তার সঙ্গে সম্পূক্তভাবে না। মিশলে সফল হতে পারে না। তা না করে, বিশেষত ধর্ম সম্পর্কে সচেতনতা না। বাড়িয়ে, বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলে মানুষের মধ্যে ধর্মকে আরো বেশি আঁকড়ে রাখার প্রবণতা সৃষ্টি হবে এবং ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ সৃষ্টি হওয়ার বা শক্তিশালী হয়ে ওঠার ব্যাপারটিই জোরদার হবে। ধর্ম তখন শহিদ হয়ে সহানুভূতি অর্জন করবে। ধর্ম যে নিপীড়িত মানুষকেই শহিদ করছে, এ বোধ জাগার আগেই ধর্মকে ও ধর্মবিশ্বাসীদের আঘাত করে গেলে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিগুলি মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ আরো বেশী করে পাবে।
তাই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা বা মৌলবাদকে রুখতে গিয়ে, তখনো অসচেতন জনসাধারণের উপর শ্রেণীসচেতন বৈজ্ঞানিক হলেও ধর্মপরিচয়মুক্তি বা ধর্মবিরোধিতাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা জনসাধারণকে এদেরই শক্ৰ করে তুলবে, আসলে যারা তার বন্ধুই হতে চাইছিল এবং মৌলবাদ ইত্যাদিকে তার বন্ধু করে তুলবে, আসলে যারা তার শত্রুই। ধর্ম ও তার এই ধরনের বিভিন্ন রূপ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করাটাই বড় দরকার, যে সচেতনতা অবশ্যই তার নিজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান বা সমস্যাবলী সম্পর্কে সচেতনতারই অংশ হিসেবেই হবে। এবং এই সচেতনতাই তাকে লড়াইয়ের সঠিক পথ খোঁজার উপযুক্ত করে তুলবে। এই লড়াই ধর্মের যে সব সামাজিক ভিত্তি, সেই অজ্ঞতা, অসহায়তা, বঞ্চনা, শোষণ, বৈষম্য ও দারিদ্র্য ইত্যাদি দূর করার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মেরও বিলুপ্তি ঘটাবে, কারণ তখন ঐভাবে ধর্মকে আঁকড়ে রাখার প্রয়োজন মানুষের আর থাকবে না। স্বাভাবিকভাবে তখন ধর্মকে কেন্দ্র করে অন্ধবিশ্বাস, সাম্প্রদায়িকতা বা মৌলবাদও শেকড়েই শুকিয়ে যাবে।
ব্যাপারটি এইভাবে বলে যাওয়া যেমন সহজ, বাস্তবে তার প্রয়োগ তেমনি অনেক জটিল, কঠিন ও দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়ার অংশ। নিয়তিবাদী বা স্বতস্ফুর্ততানির্ভর মানসিকতা থেকে যদি এমন ভাবা হয় যে ইতিহাসের নিয়মে ব্যাপারগুলি রয়ে সয়ে ঠিক ঘটে যাবে, তবে তা হবে আত্মঘাতী ও সুবিধাবাদী, পলায়নী একটি মনোবৃত্তির পরিচয়। একাজে অবশ্যই সচেতন বহুজনকে নেতৃত্বদায়ী ভূমিকা নিতে এগিয়ে আসতে হয়, যে নেতৃত্ব কখনোই কর্তৃত্ববাদী, একনায়কতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক হবে না।
মৌলবাদ একটি অসুস্থতা। ধর্ম তার বিপন্ন আস্তিত্বের সময় যেমন জঙ্গী মৌলবাদের মাধ্যমে তার ভিত্তিমূলকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তেমনি যারা এর নেতৃত্ব দেয় সেই গোষ্ঠী তার হতাশা ও সংকটের সময়, ক্ষমতা অর্জন করতে ধর্ম ও মৌলবাদকে কাজে লাগায়। শোষিত মানুষের যে অংশ তাদের সঙ্গী হয়। তারাও নিজেদের ক্রমবর্ধমান নানা সামাজিক সংকট, বিপন্নতাবোধ ও হতাশার ফলে প্ৰত্যারিত হয়।
মৌলবাদী অসুস্থতার সমাধানের ক্ষেত্রে দুটি প্রধান দিক রয়েছে, (১) এর তাৎক্ষণিক চিকিৎসা, (২) এর স্থায়ী প্রতিরোধ। এই তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে চরম ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও কারো কারোর মাথায় আসে। যেমন আলজিয়ার্সে মুসলিম মৌলবাদীদের মৃত্যুদণ্ড। —
‘১৩ মৌলবাদীর মৃত্যুদণ্ড–তিউনিস, ৩০ মে-আলজিয়ার্সের এক বিশেষ আদালত ১৩ জন মৌলবাদী মুসলমানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। ’৯২ সালে ঐ বিশেষ আদালত গঠন করা হয়। ইসলামি মৌলবাদের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইয়ের অঙ্গ হিসেবেই এই আদালত বসানো হয়। এ পর্যন্ত ৪৮০ জন মৌলবাদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে এই আদালত। এ ছাড়াও ৫ জন জঙ্গিকে যাবজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে বিশেষ আদালত।–রয়টার’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১.৫.৯৪)।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স এবং আফ্রিকার এই দেশে জনসংখ্যার শতকরা ৯৯.১ জনই মুসলমান (সুন্নি) ও দেশটির রাষ্ট্ৰীয় ধর্ম ইসলাম। ইসলাম ধর্মাবলম্বীর এত সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশে মুসলিম মৌলবাদীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনা এটি প্রমাণ করে যে, ইচ্ছা থাকলে মৌলবাদীদের শায়েস্তা করার কঠোরতম পন্থা অবলম্বন করা যায়ই। বাংলাদেশের যে মৌলবাদীরা তসলিমাকে হত্যার ফতোয়া দেয় কিংবা দরিদ্র অন্তঃসত্ত্বা এক রমনীকে নৈতিকতার দোহাই তুলে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ঢ়িল ছুড়ে মারার নির্দেশ দেয়, তাদের এই মৃত্যুদণ্ড দেওয়াটা মৌলবাদবিরোধিতার ঐকান্তিক ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশই হতে পারত। পাকিস্থান বা ইরানের মৌলবাদীদের কিংবা ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের (আসলে যারা মৌলবাদী-ই) ঐ ধরনের অপরাধে কিংবা একটি জাতীয় ঐতিহাসিক সৌধ বিধ্বংস করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিলেও ঐ ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারত। আরব থেকে চীন নানা দেশেই ড্রাগপাচারকারীদের যেমন এইভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মৌলবাদীদের ধর্মীয় ধান্দা এই ড্রাগব্যবসায়ীদের চেয়ে কোন অংশে কম বিপজ্জনক ও কম অপরাধমূলক নয়। বরং হয়তো বেশিই, কারণ ধর্মীয় মৌলবাদের মত ড্রাগ অন্তত বিপুল সংখ্যক ভিন্নধর্মের মানুষকে ঘূণা করতে ও নিশ্চিহ্ন করতে প্ররোচিত করে না। কাউকে হত্যা বা আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করা যদি অপরাধ হয়, তাহলে এইসব ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবাদী ও মৌলবাদীরাও একই অপরাধে অপরাধী। তবে ড্রাগের বিরুদ্ধে লড়াই করা তুলনায় অনেক সহজ, কারণ ড্রাগ চোখে দেখা যায়। কিন্তু ধর্মাশ্রয়ী মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই অনেক কঠিন, কারণ তার এই ধর্মীয় আশ্রয় চোখে দেখা যায় না বা ‘মিফার ডগ’ দিয়ে চিহ্নিত করা যায় না। তা এক কায়াহীন মানসিক দিক, যা সরল ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে নানা স্তরে, নানা মাত্রায় মিশে থাকে।
তবে সাধারণভাবে আধুনিক বিশ্বে এই মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি একটি অমানবিক ও মনুষ্যত্ববিরোধী দিক। যত অপরাধে অপরাধীই হোক না কেন, ঐ অপরাধীরই মত একটি প্রাণকে নিশ্চিহ্ন করার অপরাধ করাকে সুস্থভাবে মেনে নেওয়া মুস্কিল। বিশেষত, কে প্রকৃত মৌলবাদী, সে কি অপরাধ করেছে, তাকে অপরাধী সাজানোর ক্ষেত্রে কোন রাজনৈতিক বা ভিন্নতর ষড়যন্ত্র আছে কিনা, মৌলবাদের সৃষ্টির পেছনে অমৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের ভূমিকাও শাস্তিযোগ্য কিনা, তার মৌলবাদী আচরণ সংশোধনের অতীত কিনা— ইত্যাদি নানা ব্যাপার এর সঙ্গে জড়িত এবং এ ব্যাপারটি বিতর্কিতও বটে। এ ব্যাপারে চরমভাবে সঠিক সিদ্ধান্তে আসাও দুরূহ।
তবু মৌলবাদীদের কঠোর আইনী শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত,-যাবজীবন কারাদণ্ড বা শ্রমশিবিরে পাঠানোর মত, যেমন দেওয়া হয়। হত্যাপরাধীদের। সতীদাহ, নদীতে শিশুনিক্ষেপ বা বহুবিবাহ প্রথার মত বর্বর ও তথাকথিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে আইন ও শাস্তি তাই বড় ভূমিকা পালন করেছে। একইভাবে ভিন্ন ধরমের মানুষের প্রতি বিষেদাগার করা, তাদের নিগৃহীত করতে অন্যদের প্ররোচিত করা, মানবিক মূল্যবোধগুলিকে অস্বীকার করা, ইত্যাদির মত যে সব আচরণ মৌলবাদীদের বৈশিষ্ট্য সেইগুলি প্রমাণিত হলেও আরো কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং আন্তরিকভাবে তা প্রয়োগ করাও উচিত,–বর্তমানে যেমন ভারতবর্ষে ধর্ম ও জাতপাতকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক প্রচার কোন আইনী রাজনৈতিক দলের পক্ষে নিষিদ্ধ। (এ কারণে বিজেপি বা মুসলিম লীগ বহুৎ উসখুসি করলেও একটু সমঝে চলে, তবে তাদের হয়ে এ কাজ করে দেয় অন্য সমমনোভাবাপন্ন গোষ্ঠীগুলি।)
রাষ্ট্ৰীয় আইনী ব্যবস্থার পাশাপাশি মৌলবাদের চিকিৎসায় জনসাধারণের ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টা আরো বেশি মূল্যবান। নিজেদের মানসিকতায় ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদকে সচেতনভাবে পরিহার করার পাশাপাশি বিজ্ঞানমনস্কতা ও গণমুখী যুক্তিবাদ অনুসরণ করার অনুশীলন অতি গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভব ক্ষেত্রে যার মধ্যে এমন ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখা যাবে, সক্রিয়ভাবে তার বিরোধিতাও করা উচিত। নিজের নিশ্চেষ্টতা প্রশ্রয়ের নামান্তর মাত্র। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার চেয়ে যৌথ সাংগঠনিক উদ্যোগই অধিকতত কার্যকরী। এলাকায় এলাকায় বিজ্ঞান ক্লাব থেকে শুরু করে ‘মৌলবাদ (বা সাম্প্রদায়িকতা) প্রতিরোধী সংস্থা’ জাতীয় অজস্র সংগঠন, প্রতিটি সচেতন ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিদের গড়ে তোলা ও জনসাধারণের তৃণমূলস্তর আদি বিস্তৃত করা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে তারা তা করেছেনও। কিন্তু প্রয়োজন আরো অনেক, অনেক বেশী।
এই ধরনের সংগঠন রাজনৈতিকও হতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষ দক্ষিণপাহী এবং বামপন্থী আন্দোলনের ব্যাপকতা মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতায় বিষাক্ত পরিবেশকে কলুষমুক্ত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রাবল্যের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের প্রসার এই ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি মূল্যবান অংশ। (এ প্রসঙ্গে এটিও গুরুত্বপূর্ণ যে, বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপুল প্রসারের সময়, কি অর্থনীতি, কি সংস্কৃতি ও সমাজনীতি কোনটিই বিশেষ দেশে গণ্ডিবদ্ধ থাকতে পারে না। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও লেনদেন ছাড়া কোন দেশে শুধুমাত্র সংকীর্ণ জাতীয়তা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও বিশুদ্ধ নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি সম্ভব নয়।)
এবং মূল্যবান উপযুক্ত অর্থনৈতিক কর্মসূচীও। মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলি যে অর্থনৈতিক সংকটের সুযোগে তাদের গণভিত্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করে, জনগণের ঐ সংকট ও দুরবস্থাকে দূর করার ক্ষেত্রে আন্তরিক ও বিকল্প উদ্যোগও জরুরী। এমন কি তা সংস্কারমূলক হলেও। তবে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থবিমুক্ত, বৈষম্যহীন ও গণমুখী অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্য এবং তাকে রূপায়িত করার জন্য আন্তরিকতটুকু অন্তত থাকা চাই। প্রকৃতপক্ষে মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলি অর্থনৈতিক সুখ-স্বপ্ন সহ যে সব মিথ্যা। আশা ভরসার কথা জনসাধারণের সামনে হাজির করে, তাদের প্রতিটিরই বাস্তব ও উপযুক্ত বিজ্ঞানসম্মত বিকল্প রাখা দরকার। এ ক্ষেত্রে মার্কসীয় দার্শনিক ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামো একটি বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম, যদিও এর অর্থ এ নয় যে মার্কসবাদই শেষ কথা ও অদূরভবিষ্যতে আরো বিকশিত কোন প্রক্রিয়া মানুষ আয়ত্ত করবে না।
ধর্মীয় মৌলবাদ তথা ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে যক্ষ্মারোগের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অন্ধকারাচ্ছন্ন আলো-বাতাসহীন স্যাৎসেতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, উপযুক্ত পুষ্টি ও বিশ্রামের অভাব তথা প্রতিরোধ ক্ষমতার হ্রাস, তীব্র জীবাণু সংক্রমণ ইত্যাদি যক্ষ্মরোগ সৃষ্টির পথ সুগম করে। একইভাবে বিজ্ঞানমনস্কতার আলোর অভাব, অসচেতনতার অন্ধকার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসহায়তার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ধর্মাশ্রয়ী ঐসব অসুস্থতাকে ডেকে আনে। ধর্মজীবী ধান্দাবাজেরা যক্ষ্মার জীবানুর মত মানুষের মনের এই অন্ধকারকে আশ্রয় করে তার জাল বিস্তার করে। অচিকিৎসিত যক্ষ্মারোগ তিলে তিলে শরীরকে ধ্বংস করে, উন্দরী থেকে মস্তিষ্কবিকৃতি জাতীয় নানা জটিলতার সৃষ্টি করে এবং এক সময় হঠাৎ করে মৃত্যুর দরজা খুলে যায়। অপ্রতিহত মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাও মানুষ ও তার সমাজকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করতে থাকে, এক বিকৃত পিছিয়ে পড়া আদিমতার অন্ধকারের দিকে মানুষকে ঠেলে দেয়, ভ্রাতৃহত্যা থেকে উন্নয়নের স্থবিরত্ব জাতীয় নানা ধরনের জটিলতার সৃষ্টি করে এবং এক সময় ফ্যাসিস্টদের মত তার বিধ্বংসী প্ৰাবল্য নিয়ে জাতির উপর ঝাপিয়ে পড়ে। অচিকিৎসিত যক্ষ্মা শুধু ব্যক্তির মধ্যে সীমিত থাকে না, তা প্রবল সংক্রামকও বটে, নিকট মানুষদের মধ্যেও তার সংক্রমণ ঘটে, বিশেষত যাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। অপ্রতিহত ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িকতামৌলবাদও শুধু কিছু ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠীতে সীমিত থাকে না, তা পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ায় অন্যদেরও উত্তেজিত করে তোলে এবং ভিন্ন ধর্মের অসচেতন ও মানসিক প্রতিরোধহীন ব্যক্তিদেরও স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে একই পন্থা অবলম্বন করে মোকাবিলার জন্য প্ররোচিত করে। যক্ষ্মার চিকিৎসায় জীবাণুকে মারার ওষুধের পাশাপাশি তার প্রতিরোধ অতি গুরুত্বপূর্ণ-উপযুক্ত পুষ্টি-বিশ্রাম-আলো-বাতাস ইত্যাদি রোগ নিরাময় ও প্রতিরোধের জন্য ওষুধের সঙ্গে অবশ্যই সুনিশ্চিত করা দরকার। মৌলবাদ জাতীয় অপশক্তির ক্ষেত্রেও তার চিকিৎসা ও প্রতিরোধের দিকগুলি একই সঙ্গে প্রযুক্ত হওয়া দরকার।
ধর্মীয় মৌলবাদ তথা ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার প্রতিরোধের ক্ষেত্রে গণমুখী যুক্তিবাদী চিন্তার প্রসার এবং বিজ্ঞানমনস্কতার আলোকোজ্জল পরিবেশ সৃষ্টি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। অহংকার, অবিনয়, স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার মত বদ্ধ পরিবেশ থেকে গণতান্ত্রিক বাতাবরণে মুক্তি এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শ্রেণীসচেতন অর্থনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জন করা এক বৈষম্যহীন ও পারস্পরিক সহযোগিতা নির্ভর সমাজব্যবস্থায় মৌলবাদের মত অপশক্তিগুলি তার টিকে থাকার বা সৃষ্টি হওয়ার জমিই হারায়।
ধর্মীয় মৌলবাদ প্রতিরোধে ধর্মপ্রসঙ্গে বৈজ্ঞানিক সত্য প্রচারও এ ব্যাপারে। সচেতনতাবৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কিভাবে একসময় নিয়ানডার্থল আমলের মানুষ তার উন্নততর চিন্তা, অনুসন্ধিৎসা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার সাহায্যে একটি অতিপ্রাকৃতিক শক্তি ও মৃত্যুপরবর্তী প্রাণের কল্পনার জন্ম দিয়েছে, কিভাবে হাজার হাজার বছর ধরে এই কল্পনা ঈশ্বর আত্মা ও নানা ধর্মের সৃষ্টি করেছে, শ্রেণীবিভাজিত সমাজে কিভাবে শাসক ও শোষিত উভয়েই এই ধর্মকে ব্যবহার করেছে এবং কোন সামাজিক ও প্রাকৃতিক প্রতিকুল বৈরীশক্তির অস্তিত্বের কারণে এখনো বহু মানুষ এই ধর্মকে অনুসরণ করছে—এসবের অসূয়ামুক্ত ঔদ্ধত্যহীন বিনম্র বৈজ্ঞানিক আলোচনা ও প্রচার ব্যাপকভাবে করা দরকার। বিশেষত শ্রেণীবিভক্ত সমাজের এই গণবিরোধী সামাজিক শত্রুগুলিকে দূর করার উদ্যোগ ব্যাপকতর করার সঙ্গে মৌলবাদবিরোধিতার ও মৌলবাদপ্রতিরোধের প্রশ্নটি সম্পৃক্তভাবে যুক্ত।
এ কথাগুলি পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করেই এবং ধর্মের বিরুদ্ধে এ ধরনের পরোক্ষ লড়াই-এর পাশাপাশি প্রয়োজনে ধর্মের বিরুদ্ধে প্ৰত্যক্ষ সংগ্রাম চালানোরও সময় এসেছে,-বিশেষত ধর্মীয় মৌলবাদীদের সাম্প্রতিক ক্রমবর্ধমান দাপটের পরিবেশে। এর অর্থ কখনোই সরলধর্মবিশ্বাসী মানুষের অসহায় ধর্মবিশ্বাসকে অপমান ও ব্যঙ্গ করা নয়। কিন্তু অবশ্যই তার অর্থ বেদ-বাইবেল-কোরান-হাদিসমনুসংহিতাদির মত ধর্মগ্রন্থের বর্তমান অপ্রাসঙ্গিকতা, শ্রেণীভিত্তি, ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক দিকগুলিকে উন্মোচিত করা। পাশাপাশি তাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও প্রাচীন উপযোগিতাকে মর্যাদা দেওয়াও দরকার, দরকার তাদের উপর গোঁড়ামিমুক্ত গবেষণারও। ধর্মের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের অর্থ খীশু-মহম্মদ বা যাজ্ঞবল্ক্যাদির প্রতি একপেশে, সবজান্তা ও উদ্ধত মানসিকতা থেকে অপমান ও ব্যঙ্গের বাণ নিক্ষেপ করা নয়। কিন্তু অবশ্যই তাদের মূল্যবান ঐতিহাসিক ভূমিকাকে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েই, এখনকার দিনেও তাদের হুবহু অনুসরণ করা ও অন্ধভাবে ভক্তিপ্রদর্শন করার মানসিকতাকে প্রতিহত করা। ধর্মের বিরুদ্ধে প্ৰত্যক্ষ সংগ্রামের অর্থ ধর্মীয় বাতাবরণে বিশ্বমানবিক সৌভ্রাতৃত্বের মত যে সব মানবিক মূল্যবোধের কথা যতটুকু বলা হয়েছে সেগুলিকে অস্বীকার করা নয়। কিন্তু অবশ্যই তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে এবং গ্রহণ-বর্জনের গোঁড়ামিমুক্ত মানসিকতা থেকে, ধর্মের তথা ঈশ্বর-নির্ভরতার নাম না করেই মনুষ্যত্ব ও মানবিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা করা। (যেমন ‘বিশ্বমানবিক সৌভ্রাতৃত্ব’ বা ‘চুরি করা মহাপাপ’ জাতীয় কথাগুলি শুনতে ভাল লাগলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলি শাসকগোষ্ঠীর স্বাৰ্থবাহী। নিকট অতীতের বা বর্তমানের শ্রেণীবিভাজিত সমাজে পৃথিবীর সবাইকে ভাই বা বন্ধু ভাবার অর্থ শোষিত জনগণের কাছে শাসকশ্রেণীকেও সুহৃদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা অর্থাৎ অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধেও শাসিতদের সংগ্রামকে দুর্বল করে দেওয়া। চুরি করা মহাপাপ’-এর প্রচারও আসলে ব্যক্তিগত সম্পত্তি সৃষ্টির পর, বৈষম্যভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায়, অর্থবানদের সম্পদরক্ষার একটি কৌশলমাত্র, যে সম্পদ তারা অর্জন করেছে নিজেদেরই নিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কাঠামোর সুযোগ নিয়ে। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বমানবিক সৌভ্রাতৃত্বের’ মত কথাগুলি প্রকৃত মর্যাদা পাবে শ্রেণীহীন বৈষম্যমুক্ত সমাজে। এই সমাজে ‘চুরি করা মহাপাপ’-এর মত নীতিবাক্য প্রচারেরও কোন প্রয়োজন থাকবে না—এখনো যেমন আদিবাসী গোষ্ঠীর বহু মানুষ চুরির ব্যাপারটিই জানে না এবং এমন নীতিবাক্য তাদের কাছে হাস্যকর। চুরির বা পারস্পরিক বৈরিতার সৃষ্টিই হয়েছে শ্রেণীবিভাজনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তা যখন বিধ্বংসী ও শাসকশ্রেণীর পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়, তখন তারা নিজস্বার্থে নানা ধৰ্মকথার মাধ্যমে এমন নীতিবাক্যের সৃষ্টি ও প্রচার করে। যতদিন এই বিভাজন থাকবে, ততদিন এই ধরনের নীতিবাক্যের উপযোগিতাও থাকবে, কিন্তু তার পেছনের সত্যগুলিকে জেনে একটি বিজ্ঞানসম্মত মানবিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়াই মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। ধর্ম তথা ধর্মীয় নানা নীতিবাক্য-অনুশাসন-নির্দেশাদির প্রসঙ্গেও একথাগুলি প্রযোজ্য।)
প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় মৌলবাদী আটকাতে গিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে শুধু ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করা বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর একটি পদ্ধতি,–যা এক সময় ব্যর্থ হবে বাধ্য। কারণ প্রথমত, মানুষের সমস্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থাগুলিকে টিকিয়ে রেখে এবং ধর্ম সম্পর্কে একটি স্তর আদি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী অর্জন করার আগে, ধর্মকে শহিদ করলে ধর্ম তথা প্রাচীন ঐতিহ্য সম্পর্কে আগ্রহ নতুন করে জেগে ওঠার সম্ভাবনাই বেশি। এবং এরই প্রতিক্রিয়ায় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির এবং ধর্মান্ধতার পালে হাওয়াই লাগবে। ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই তার সামাজিক ভিত্তিগুলির বিরুদ্ধে লড়াইয়েরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। বস্তুবাদী দর্শনকে সামনে রেখে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রেণীসচেতন সংগ্রামই ধর্মকে উচ্ছেদ করার সর্বোৎকৃষ্ট ও সবচেয়ে কার্যকরী পথ। বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মকে দূর করা সম্ভব নয় অর্থাৎ সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক কোন ক্ষেত্রে সংগ্রাম পরিচালিত হওয়ার আগে বা না করে, শুধু ধর্মীয় মৌলবাদকে চূড়ান্তভাবে উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। এ কারণেই শ্রেণীসচেতনতাহীন বুর্জোয়া নাস্তিকতা কিংবা যান্ত্রিক যুক্তিবাদ কখনো ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ব্যাপক মানুষকে ঈশ্বরবিশ্বাস থেকে প্রকৃত মুক্তি বা যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানসিকতা অর্জন করাতে পারে না। তাই চারপাশে এমন উদাহরণ কম নেই যে, সমাজে এ ধরনের নাস্তিক মানুষ যথেষ্ট আছেন, পাশাপাশি মৌলবাদও আছে শুধু নয়, নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যান্য দেশের কথা ছেড়ে শুধু পশ্চিমবঙ্গের কথাই বলা যায়, যেখানে দীর্ঘদিনের বামপন্থী ও উদারপন্থী আন্দোলনের ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও কিংবা বুদ্ধিজীবীদের একাংশ যথেষ্ট উদার, ধর্মমোহমুক্ত বা নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ভারতীয় জনতাপাটি বা অখিল ভারতীয় বিদ্যাহী পরিষদের মত হিন্দুত্ববাদী ও ভিত্তিমূলে মৌলবাদী শক্তিগুলি তৃণমূলস্তর অব্দি তাদের প্রভাব, যতটুকুই হোক না কেন, বিস্তৃত করতে পেরেছে। একইভাবে এমন যুক্তিবাদী’রাও আছে যাদের মধ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মপ্রচার ও নিজেকে সর্বোত্তম যুক্তিবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগই বেশি; কুসংস্কারের শিকার সাধারণ মানুষদের তো বটেই, বিজ্ঞানমনস্কতার স্বপক্ষে আন্দোলনে রত অন্য ব্যক্তিদের হেয় করার প্রবণতাও রয়েছে। এবং যারা যান্ত্রিকভাবে কিছু ম্যাজিকপত্ৰ দেখিয়ে অলৌকিকতার বুজরুকি তুলে ধরাকেই প্রধানতম কাজ বলে মনে করেন। এই ধরনের ‘নাস্তিক’ বা যুক্তিবাদী’-দের কোন ইতিবাচক ভূমিকা নেই তা নয়, কিন্তু শেষ বিচারে ইতিবাচক কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ যথেষ্টই রয়েছে।
মার্কসীয় দর্শনকে সামনে রেখে (তা সে যত আলগাভাবেই ঝুলিয়ে রাখা হোক না কেন), ‘বামপন্থী’দের একটি বড় অংশ অন্যদিকে ধর্ম সম্পর্কে যে হাস্যকর অবস্থান গ্রহণ করেন তাতে পরোক্ষে ধর্মজীবীদের হাতই শক্ত হয়। মার্কসবাদ, বস্তুবাদী দর্শন ইত্যাদির কথা বলেও যখন দেখা যায়। এইসব বামপন্থীরা পাড়ার দুর্গাপূজা-কালীপূজার পৃষ্ঠপোষকতা করেন (যুক্তি?—জনসংযোগ), ঠনঠনিয়া বা দক্ষিণেশ্বরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কপালে মাথা ঠোকেন (যুক্তি?-অভ্যাস), জ্যোতিষ আর কুষ্ঠিবিচার কিংবা শ্ৰাদ্ধ ও ধর্মীয় আচার মেনে বিয়ে করেন (যুক্তি?—জ্যোতিষে কিছু বিজ্ঞান আছে এবং শ্ৰাদ্ধ ইত্যাদি দেশীয় ঐতিহ্য) ইত্যাদি,-তখন অন্য মানুষদের কাছে ধর্মের (এবং ধর্মীয় মৌলবাদীদেরও) গ্রহণযোগ্যতাই বাড়ে। সাম্প্রতিক ভারতে বন্যার মত ছড়িয়ে পড়া ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী দাপটের পেছনে স্থানীয় বামপন্থী আন্দোলনের (নিকট অতীতেও যার বৈজ্ঞানিক অবস্থান ছিল এবং এখনো সংখ্যালঘু কিছুজনের মধ্যে আছেই)। চরম বিচ্যুতি ও শূন্যতা বেশ কিছুটা ভূমিকা পালন করেছেই।
জনগণের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তভাবে মিশিয়ে বিজ্ঞানমনস্কতার স্বপক্ষে ও ধর্মপ্রসঙ্গে আন্দোলনও অবশ্যই করা দরকার। একটিকে ছাড়া আরেকটি সফল হতে পারে না। মাওসেতুং যেমন বলেছিলেন, ‘আমি যখন গ্রামাঞ্চলে ছিলাম তখন কৃষকদের মধ্যে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আমিও প্রচার চালিয়েছিলাম।’ এবং যেভাবে করেছেন তার একটি সামান্য পরিচয় কৃষকদের সামনে রাখা তাঁর বক্তব্য থেকে বোঝা যেতে পারে। —’ঐসব দেব ও দেবীরা বাস্তবিকই করুণার উদ্রেক করে। আপনারা শত শত বছর ধরে তাদের পুজো করে এসেছেন, অথচ তারা আপনাদের উপকারার্থে স্থানীয় উৎপীড়ক বা অসৎ ভদ্রলোকদের একজনকেও উচ্ছেদ করেনি। এখন আপনারা আপনাদের খাজনা কমাতে চান। আমি জিগ্যেস করতে চাই-কিভাবে আপনারা সেটা করবেন? আপনারা কি দেবদেবীর উপর বিশ্বাস করবেন, না কৃষক সমিতির উপর বিশ্বাস করবেন?’ (হুনানে কৃষক আন্দোলনের তদন্ত রিপোর্ট, মার্চ, ১৯২৭; নবজাতক প্রকাশন প্রকাশিত ‘মাওসেতুং-এর নির্বাচিত রচনাবলী’ থেকে)
আর এর ফলে গ্রামের ‘অশিক্ষিত কৃষকরাও কিভাবে ‘ধর্মীয় কর্তৃত্বের জোয়াল ছুড়ে ফেলতে পারেন, তার একটি পরিচয়ও তাঁর বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়।–‘ভূস্বামীদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের উচ্ছেদ ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই গোষ্ঠীগত কর্তৃত্ব, ধর্মীয় ও স্বামীর কর্তৃত্ব(৩) সবইটিলায়মান হয়ে পড়ে।. সর্বত্র যেখানেই কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সেখানেই ধর্মীয় কর্তৃত্ব টলে উঠেছে। অনেক জায়গায় কৃষক সমিতি দেবদেবীর মন্দিরকে তাদের অফিসের কাজের জন্য দখল করে নিয়েছে। সর্বত্র তারা কৃষকদের স্কুল খুলবার কাজে বা সমিতির খরচ নির্বাহের জন্য মন্দিরের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে বলে। এটাকে তারা বলে ‘কুসংস্কার থেকে সাধারণের আয়’। লিলিং জেলায় কুসংস্কারমূলক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা এবং মূর্তি ধ্বংস করার ধূম লেগেছে। এই জেলার উত্তরাঞ্চলীয় মহকুমাগুলোতে কৃষকরা মহামারীর দেবতাকে শাস্ত করার জন্য প্রজুলিত ধূপ-মোমবাতি নিয়ে শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। লুখীে-এর ফুপোলিংস্থিত তাও-মন্দিরে অনেক মূর্তি ছিল, কিন্তু কুওমিনতাংএর আঞ্চলিক সদর দপ্তরের জন্য যখন আরো ঘরের দরকার পড়ল, তখন ছোটবড় সব মূর্তিগুলোকে একসাথে কোণে গাদা করে রাখা হল। কৃষকরা এতে কোন আপত্তি তোলেনি। তারপর থেকে কোন পরিবারে কারো মৃত্যু হলে দেবদেবীর প্রতি উৎসর্গ, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন এবং পবিত্র বাতি প্ৰদান করার ঘটনা খুবই কম ঘটেছে। …উত্তরের তৃতীয় মহকুমায় লোংফেং নানের কৃষকেরা এবং প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকেরা কাঠের মূর্তিগুলোকে কেটে সেই কাঠ দিয়ে মাংস রাঁধে। দক্ষিণের অঞ্চলে অবস্থিত তোংফু মন্দিরের তিরিশটিরও বেশি মূর্তিকে ছাত্র ও কৃষকরা মিলে পুড়িয়ে ফেলে।…’ ইত্যাদি। (ঐ) ধর্মীয় কর্তৃত্বের জোয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা এমন মানুষদের কোন গোলাম আজম-বোল থ্যাকারে-খোমেইনিঋতম্ভরাদের দল তাদের শিবগরে পরিণত করবে?
এটি স্মর্তব্য যে মাওসেতুং এ রিপোর্ট দেন। চীনের মুক্তিরও ২২ বছর আগে, ১৯২৭-এর মার্চ মাসে। তারপর সারা চীন জুড়ে এমন কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয় তথা গণজাগরণ ঘটে কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বে। আমেরিকায় ফান্ডামেন্টালিস্টরা, ভারতে হিন্দুত্ববাদী ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা, কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম মৌলবাদীরা তাদের দাপট চালানোর সময় চীনের ঐ বিশাল ভূখণ্ডে এর ফলে এদের ছায়াও দেখা যায়নি।
সময় আরো এগিয়ে গেছে। শ্রেণীবৈষম্য ও সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন আরো বীভৎস ও সূক্ষ্মতর আকার ধারণ করেছে। এসবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে উঠেছে ধৰ্মজীবীদের মৌলবাদী তাণ্ডব। কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩), ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস (১৮২০-১৯৮৫), এমনকি ভলাদিমির ইলিয়াভিচ লেনিন (১৮৭০-১৯২৪)-এর সময়েও ধর্মীয় মৌলবাদের সাম্প্রতিক ভয়াবহ রূপ সম্যক পরিস্ফুট হয়নি। এ অবস্থায় মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-এর ধর্মের বিরুদ্ধে প্ৰত্যক্ষ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিক শিক্ষাকে নতুন করে ভাবা যায়। লেনিন লিখেছিলেন,–
‘মার্কসবাদ সবসময়ই সকল আধুনিক ধর্ম ও গীর্জা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে, এবং প্রতিটি ধর্মীয় সংগঠনকে বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়ার হাতিয়ার, যা শোষণের ব্যবস্থা রক্ষায় এবং শ্রমজীবী শ্রেণীকে হতবুদ্ধি করার কাজে ব্যবহৃত হয়, হিসেবে গণ্য করেছে।
‘একই সাথে এঙ্গেলস সেসব লোকেরও নিন্দা করেছেন, যারা সোস্যালডেমোক্রাটদের চেয়েও বেশি বামপন্থা’ বা ‘বেশি বিপ্লবী’ হতে চায়, যারা ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার লক্ষ্যে শ্রমিকের রাজনৈতিক দলের কর্মসূচীতে নাস্তিক্যবাদের সুস্পষ্ট ঘোষণা অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। লন্ডন প্রবাসী ব্লাংকুইপাষ্ট্ৰী কমিউনিষ্টদের বিখ্যাত ঘোষণাপত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ১৮৭৪ সালে এঙ্গেলস ধর্মের ব্যাপারে তাদের উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণাকে নিবুদ্ধিতা হিসেবে অভিহিত করেন এবং বলেন যে, এ ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহ নতুন করে জাগিয়ে তোলার এবং এটিকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার সর্বোত্তম পন্থা। এঙ্গেলস ব্লাংকুইদের দোষারোপ করে বলেন, তারা বুঝতে পারে না যে, একমাত্র শ্রমজীবী জনগণের শ্রেণীসংগ্রামই প্রলেতারিয়েতের ব্যাপক অংশকে সচেতন বিপ্লবী সামাজিক অনুশীলনের মধ্যে টেনে এনে নিপীড়িত জনগণকে ধর্মের জোয়াল থেকে প্রকৃতপক্ষে মুক্ত করতে পারে; আর এর বিপরীতে, ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে শ্রমিকদের রাজনৈতিক দলের একটি রাজনৈতিক কাজ হিসেবে ঘোষণা করা নেহাত-ই নৈরাজ্যবাদী বুলি কপচানো … এঙ্গেলস জোর দিয়ে বলেছেন যে, ধর্মের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক যুদ্ধ ঘোষণার জুয়াখেলায় জড়িয়ে না ফেলে প্রলেতারিয়েতকে সংগঠিত করা ও শিক্ষাদান করার কাজটি ধৈৰ্য্যের সাথে সম্পাদন করার সামর্থ্য শ্রমিকদের রাজনৈতিক দলের থাকা উচিত।
‘আমরা ধর্মের বিরুদ্ধে লড়ব-এটা সকল বস্তুবাদের এবং সবশেষে মার্কসবাদের গোঁড়ার কথা। তবে মার্কসবাদ এমন কোন বস্তুবাদ নয়, যা গোঁড়াতেই থেমে গেছে। মার্কসবাদ আরো এগিয়ে যায়। মার্কসবাদ বলে ৪ ধর্মের বিরুদ্ধে কিভাবে লড়তে হয়, তা আমাদের জানতে হবে এবং এ জন্যে আমরা জনগণের মধ্যে বস্তুবাদী পন্থায় বিশ্বাস ও ধর্মের উৎস ব্যাখ্যা করব। ধর্মকে মোকাবিলা করার ব্যাপারটি বিমূর্ত তত্ত্ব প্রচারের মধ্যে সীমিত রাখা যায় না এবং এ কাজটিকে এ ধরনের প্রচারে সীমাবদ্ধ করা যাবে না। এটিকে শ্রেণী আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট অনুশীলনের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে হবে, যার লক্ষ্য ধর্মের সামাজিক মূলগুলোকে নির্মূল করা।’ (লেনিন, সংগৃহীত রচনাবলী, খণ্ড ১৬, ইংরেজি সংস্করণ, প্রোগ্রেস পাবলিশার্স, মস্কো, ১৯৭৩, পৃঃ ৪০৩, ৪০৪ ও ৪০৫, গুরুত্ব আরোপ লেনিনের। এখানে অনীক, মে, ১৯৯৫-এ প্রকাশিত সাদেক রশিদ-এর ‘প্ৰসঙ্গ ৪ তসলিমা নাসরিন’ থেকে সংগৃহীত, অনুবাদ তীরই।)
ধর্মের বিরুদ্ধে (এবং এইভাবে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে) কিভাবে লড়তে হবে অবশ্যই তা আমাদের জানা দরকার। এক্ষেত্রে কোন সন্দেহ নেই যে, এই লড়াই করতে হবে জনসাধারণের মধ্যে থেকে, তাদের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক সংগ্রামের সাথী হয়ে। চীনের পূর্বোক্ত অভিজ্ঞতা যেমন এটিও জানায় যে, আসলে ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী শোষিত মানুষই, যাঁরাই মূলত ধর্ম ও ধর্মীয় মৌলবাদের দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এবং তাঁরা তা করবেন তাদের সামগ্রিক আন্দোলনের অংশ হিসেবেই। সচেতন ব্যক্তিদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের সংগঠিত করে সঠিক দিশার সঙ্গে পরিচিত করা এবং তাঁদেরই হাতে নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়া। বর্তমান বিশ্বে এই ‘শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী’ মানুষের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছে উচ্চ মাইনের তথাকথিত শ্রমিক থেকে নানা স্তরের বুদ্ধিজীবীরাও। এদের মধ্যে সচেতনতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার আন্দোলন যেমন গড়ে ওঠে, তেমনি, ধর্মসহ প্রতিষ্ঠানিক বিভিন্ন কায়েমী স্বার্থের সঙ্গে তাদের কারো কারোর স্বাৰ্থও গাঁটছড়া বাধা। তবু এই স্তরের ব্যক্তিদের একটি বড় অংশই ধর্মের বিরুদ্ধে তথা ধর্মীয় মৌলবাদের মত নানা অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইতে সামিল হবেন। এবং ধর্মীয় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধিতার বিরুদ্ধে লড়াইতে সাধারণ ধর্মবিশ্বাসীরাও অংশগ্রহণ করতে সক্ষম। ধর্মবিশ্বাসী মাত্রেই মৌলবাদী নন এবং তাঁদের অনেকেই মৌলবাদকে ঘূণাও করেন (যদিও ধর্ম তাদের অনেকের নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের মত)। মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে এই ধরনের বিভিন্ন স্তরের মানুষই শরিক।
এঙ্গেলস যখন ধর্মের ব্যাপারে ‘উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণাকে নিবুদ্ধিতা হিসেবে অভিহিত করেন।’ তখন সাম্প্রতিক কালের হিন্দু-মুসলিম-খৃস্ট মৌলবাদীরা দূরের কথা, আমেরিকায় ফান্ডামেন্টালিস্টরাই সুসংগঠিত হয়ে ওঠেনি। একইভাবে মার্কসএঙ্গেলস-এর সময়ে ফ্যাসিবাদেরও উদ্ভব ঘটেনি, দেশে দেশে নয়া ফ্যাসিস্ট ধর্মীয় মৌলবাদের ক্রমবর্ধমান তাণ্ডবও দেখা যায়নি। তাই ধর্ম প্রসঙ্গে লড়াইয়ের জায়গাটা এখন শুধু ধর্মে আবদ্ধ নেই, তা একটি বিশেষ মাত্রা পেয়ে আরো হিংস্র, উগ্র, গোঁড়া ও অন্ধ মৌলবাদীদের ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে নিজেদের নিছক ধর্মীয় কর্তৃত্বের জোয়াল থেমে মুক্ত করার দীর্ঘস্থায়ী ধৈর্যসাপেক্ষ প্রক্রিয়া নয়, মৌলবাদের বিরুদ্ধে দ্রুতগতির লড়াইও চালানো দরকার। কোন এক দূর বা অদূর ভবিষ্যতে ‘ধর্মের সামাজিক মূলগুলোকে নির্মূল করার’ মধ্য দিয়ে ধর্মের স্বাভাবিক বিলুপ্তি ঘটবে,-স্পষ্টতঃ তখন ধর্মীয় মৌলবাদের অস্তিত্বেরও কোন প্রশ্ন আসে না। কিন্তু এখনকার জঙ্গী মৌলবাদীদের রুখতে, বিশেষত ‘শ্রেণীসংগ্রামের’ বর্তমান বিভ্রান্তিকর পরিবেশে, মৌলবাদ প্রসঙ্গে বিশেষ কর্মসূচী নেওয়া দরকার। শ্রেণীসংগ্রাম তীব্রতর করা, সমমনস্ক ব্যক্তিদের সংগঠিত করা, শোষিত জনগণকে সংঘবদ্ধ করে। শিক্ষাদান করার কাজ আরো বিকশিত হওয়া যেমন উচিত, তেমনি প্ৰত্যক্ষভাবে শুধু ধর্মের প্রসঙ্গে প্রচার অ্যাগের চেয়ে, (অন্তত মার্কস-এঙ্গেলস-এর আমলের চেয়ে) অনেক বেশি গুরুত্ব পাওয়া দরকার।
‘শ্রমিকদের রাজনৈতিক দলের কর্মসূচীতে নাস্তিক্যবাদের সুস্পষ্ট ঘোষণা অন্তর্ভুক্ত’ করার মত পরিস্থিতি এখনো হয়তো আসেনি, কিন্তু ধর্ম প্রসঙ্গে বিজ্ঞানমনস্কতার ও মৌলবাদ-বিরোধিতার সুস্পষ্ট ঘোষণা অন্তর্ভুক্ত করার সময় এসেছে এবং গণবিজ্ঞান আন্দোলনের পাশাপাশি শ্রেণী সচেতন ও বস্তুবাদী দর্শনে শিক্ষিত নাস্তিক্যবাদী সংস্থার প্রয়োজনও এখন অনেক বেশি বলেই প্রতীয়মান হয়। এটি ঠিক যে, এখন থেকে ৭০ বছরেরও বেশি সময় আগে চীনের হুনানে সঠিক পথে সঠিক নেতৃত্বে পরিচালিত অল্প কয়েক বছরের কৃষক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে কৃষকরা যেমন ধর্মীয় কর্তৃত্বের জোয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে প্রস্তুত হয়েছিলেন, বর্তমান বাংলায়, ভারতে বা অন্যান্য কিছু দেশে দীর্ঘ কয়েক দশকের ‘বামপন্থী কৃষক আন্দোলনের’ পরে অন্তত ধর্মীয় ক্ষেত্রে ঐ প্রস্তুতির অনেকটাই এখনো বাকি। কবে এই আন্দোলন ‘বামপন্থী’ হবে ও রাজনৈতিক মৌলবাদী মানসিকতামুক্ত হবে কে জানে! তবু অন্তত ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধিতার প্রশ্নে এই ধরনের সমস্ত বামপন্থী সংগঠনের মধ্যকার ঐক্য এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিক্যবাদী সংস্থা বা গণবিজ্ঞান সংগঠনগুলির সঙ্গে সহযোগিতামূলক কর্মসূচী যে নেওয়া হবে —এ আশা ব্যক্তি করা যায়।
এঙ্গেলস ভয় করেছিলেন, ধর্মের বিরুদ্ধে উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণা ধর্মের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলবে এবং ধর্মকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবে। এখনকার পরিস্থিতিতে এটিও কতটা সত্য তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এর বড় কারণ ধর্মের বিরুদ্ধে উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণা এখন কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে ততটা আসছে না, যতটা আসছে মূলত মানুষের দ্রুত বিকশিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের তথা প্রকৃতি সম্পর্কে সত্য উপলব্ধির থেকে। বিবর্তনবাদ ছিল এ ধরনের প্রথম বড় যুদ্ধ ঘোষণা। তারপর জৈব অণুর কৃত্রিম সৃষ্টি থেকে কোয়ান্টামতত্ত্ব বা আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সহ ব্ৰহ্মাণ্ড সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান জ্ঞানের এই পরিবেশে ঈশ্বর ও ঈশ্বর বিশ্বাসকেন্দ্ৰিক ধর্মের অবস্থানটিই ক্ৰমশঃ হাস্যকর হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে ঐ অনুযায়ী ঐতিহ্যমণ্ডিত মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গীও পরিবর্তিত হচ্ছে। কেঁপে উঠছে ধর্মের ভিত্তি। এর প্রতিক্রিয়ায়ও ধর্মান্ধতা বা মৌলবাদের সৃষ্টি হয় ও হচ্ছে, কিন্তু তা আটকাতে এই উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণা তথা জ্ঞানচর্চা বন্ধ হবে না, হওয়া উচিতও নয়। অর্থনৈতিক-ও শ্রেণী-সংগ্রামের পাশাপাশি এই বৈজ্ঞানিক সত্যোপলব্ধিও ধর্ম তথা ধর্মীয় মৌলবাদের মৃত্যুঘণ্টা বাজাবে।
এখন থেকে ১০০ বছর আগে, এঙ্গেলসদের সময় ধর্মের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াইয়ের ডাক ধৰ্মকে শহিদ করে তার প্রতি মানুষের সহানুভূতি বাড়াত। কিন্তু এখন হুবহু এ পরিস্থিতি নেই, যদিও এ ধরনের সহানুভূতি পাওয়ার পরিবেশ স্থানবিশেষে একেবারে নেই তা-ও নয়। তবে এখন পৃথিবীর ১১৫ কোটিরও বেশি মানুষ ধর্ম ও ঈশ্বরের মোহ থেকে মুক্ত, কয়েক দশক আগেও যা ভাবাই যেত না। এঁদের মধ্যে উদার বুর্জেয়া, অজ্ঞাবাদী (agnostic) ও বিজ্ঞানীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ যেমন আছেন, তেমনি আছেন মার্কস-এঙ্গেলসদেরই শিক্ষায় উদ্ধৃদ্ধ মানুষও। এছাড়া আরো বহুসংখ্যক মানুষই রয়েছেন যাঁরা অতি আলগা ভাবেই (কখনো বা নিছকই সুবিধাজনক হিসেবে) ধর্মও ঈশ্বরকে আঁকড়ে আছেন এবং এঁদের বৃহদংশ দোদুল্যমান অবস্থায় থাকেন। প্রকৃতপক্ষে নাস্তিক ও ধর্মপরিচয়মুক্ত হিসেবে নিজেদের সরকারীভাবে ঘোষণা না করা বাকী প্রায় শতকরা ৭৯-৮০ ভাগ পৃথিবীবাসীরও ৯০ ভাগই প্রকৃত বা আদৌ ধর্মাচরণ করেন না বলেই জানা গেছে। এঁদের কাছে ধর্মপরিচয় ও ঈশ্বর একটা কায়াহীন ঐতিহ্যগত অভ্যাস মাত্র। এছাড়া কয়েক শতাব্দী পূর্বে তো বটেই, বিগত শতাব্দীতেই ধর্ম যেমন রাষ্ট্ৰীয় ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা পালন করত, এখন ঐ পরিস্থিতিও নেই।
সব মিলিয়ে, ১৮৭৪ সালে এঙ্গেলস ধর্মের বিরুদ্ধে উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণাকে ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহ নতুন করে আগ্রহ জাগিয়ে তোলার এবং এটিকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষণ করার সর্বোত্তম উপায় হিসেবে যে অভিহিত করেছিলেন, এই ১২০ বছর পরে ঐ পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে কিনা, তা ভেবে দেখার সময় বামপন্থীদেরও এসেছে, বিশেষত মৌলবাদীদের সাম্প্রতিক দাপটের পরিস্থিতিতে এবং আন্তর্জাতিক ভাবে বামপন্থী আন্দোলনের বিভ্রান্তির সময়ে। শ্রেণী সংগ্রাম ও শোষিত মানুষের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী প্রচারের গুরুত্বকে সামান্যতম খাটো না করেও এটি বোধহয় বলা যায় যে, ধর্মের বিরুদ্ধে উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণার পরিস্থিতি ও সময় এগিয়ে এসেছে। বাস্তবিক দেখা যাচ্ছে, ধর্মের বিরুদ্ধে এ ধরনের লড়াইয়ের ডাক দেওয়ার ফলে মৌলবাদীরা যেমন ক্ষিপ্ত হচ্ছে, তেমনি পৃথিবীর বহু মানুষ এই লড়াইকে সমর্থন করতেও এগিয়ে আসছেন। এরা নানা ধরনের উদ্দেশ্য থেকে তা করতে পারেন, কিন্তু মৌলবাদ প্রতিরোধে এদের এই ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের লড়াইয়ের প্রতিক্রিয়ায় মৌলবাদীরা যে হিংস্ৰ মনোভাব প্রকাশ করে, তাতে তাদের স্বরূপ আরো নগ্নভাবে মানুষের সামনে পরিস্ফুটও হয়। (সম্প্রতি তসলিমা নাসরিন বা সলমন রুশদির মত ব্যক্তিদের সমর্থনে নানা স্তরের মানুষ যেভাবে সমবেত হয়েছেন, তাতে এটি স্পষ্ট যে, ধর্মের বিরুদ্ধে তীব্র ও প্রত্যক্ষ লড়াই ধর্মকে ‘মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার সর্বোত্তম পন্থা’ আর নয়। পুঁজিবাদী সংস্কৃতির ধারক ও বাহকেরা নিজ স্বার্থে ও আপন অস্তিত্বের স্বার্থে এঁদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে এগিয়ে আসছে, এটি হয়তো আংশিক সত্য এবং এ ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশও আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক দুনিয়ায় মৌলবাদ প্রতিরোধে যে মৌলবাদ-বিরোধী ব্যাপক যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলা দরকার তাতে এ ধরনের ব্যক্তি ও তাদের সমর্থকদের ভূমিকা অবশ্যই মূল্যবান ও অবিচ্ছেদ্য)।
মৌলবাদের স্থায়ী প্রতিরোধে শ্রেণীসংগ্রাম ও দীর্ঘস্থায়ী প্রচার অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। তা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের অংশও বটে। কিন্তু মৌলবাদ যখন দরজায় কড়া নাড়ছে, তখন কবে জনগণ সংগঠিত হয়ে একটি সঠিক, বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলন বা শ্রেণীসংগ্রাম শুরু করবেন, ঐ অপেক্ষায় দরজা বন্ধ করে বসে না থেকে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের উদ্যোগও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত ধর্ম যখন বিশেষ শ্রেণীর একটি শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়ে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দিচ্ছে, তখন ধর্মের এই ব্যবহারের বিরুদ্ধে এবং মৌলবাদসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্ৰত্যক্ষ সংগ্রাম করার অর্থ ‘শ্রেণীসংগ্ৰাম’-ই করা,–তা আংশিক হলেও এবং তাকে এইভাবে চিহ্নিত না করা হলেও। মৌলবাদের তাংক্ষণিক চিকিৎসার জন্য এই লড়াইয়েরই অংশ ধর্মের বিরুদ্ধে উচ্চনাদের যুদ্ধ ঘোষণাও।
মৌলবাদ বিরোধী জনগণের ব্যাপক যুক্তফ্রন্ট এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দেবেন। এই যুক্তফ্রন্টে বামপন্থী বিপ্লবী থেকে সরল ধর্মবিশ্বাসী ব্যক্তিরা যেমন, তেমনি মৌলবাদবিরোধী বুর্জেয়া ব্যক্তিত্ব থেকে বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী মানুষরাও যুক্ত হবেন। ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে বা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে যেমন ব্যাপক যুক্তফ্রন্টের প্রয়োজন, তেমনি ফ্রন্টের প্রয়োজন ধর্মীয় মৌলবাদ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও। ধর্মীয় মৌলবাদ সম্পূর্ণত (অন্তত বাহ্যিকভাবে) ধর্মকেন্দ্ৰিক ধর্মের রীতিনীতি, অনুশাসন, আচার অনুষ্ঠানকে সামনে রেখেই তার জন্ম ও বেঁচে থাকা।
হতে পারে না। এর ফলে ধর্ম সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হবে কিনা তা অন্য প্রশ্ন, কারণ এটি জড়িত প্ৰাকৃতিক ও বিশেষত সামাজিক জনবিরোধী প্রতিকুল শক্তিগুলির সম্পূর্ণ উচ্ছেদের সঙ্গে। কিন্তু মৌলবাদকে আটকাতে,-’এখনকার জাতীয় ও আন্তজার্তিক পরিস্থিতিতে, ‘শ্রেণী:আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট অনুশীলনের’ লক্ষ্য সামনে রেখেও তার জন্য শুধু অপেক্ষা করে গেলে, বড় বেশি দেরি হয়ে যাবে না তো?
***
হ্যাঁ, দেরি হয়েই যাচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে ভারতীয় ভূখণ্ডে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি ও মৌলবাদীদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব যেমন এর অন্যতম দিক, তেমনি আফগানিস্থানে তালিবানদের উদ্বেগজনক উত্থান তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য নির্দেশক।
ভারতের হিন্দু মৌলবাদীদের জোট নানা কৌশলে জনসাধারণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ও ভিত্তি বিস্তুত করে চলেছে। এরা তাদের মূল লক্ষ্য অর্থাৎ রাষ্ট্ৰক্ষমতা দখলের ও হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাকে অপরিবর্তিত রেখে, এই লক্ষ্য অর্জনের কৌশলগুলি সুবিধাজনকভাবে পাল্টায়। কখনো তারা অযোধ্যায় রামমন্দির গড়া ও বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার আহ্বান জানায়, কখনো বা প্রতিশ্রুতি দেয় দুনীতিমুক্ত প্রশাসন ও উন্নত স্বনির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার। দোহাই দেয় নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, তথাকথিত জাতীয়তা ইত্যাদি নানাবিধ মনোমুগ্ধকর ও বিভ্রাস্তিকর বিষয়ের।
হিন্দু মৌলবাদীদের অন্যতম মুখপত্ৰ স্বামী মুক্তানন্দ স্পষ্টই বলেছিলেন, ‘হিন্দুর নামে যে রাজনীতি করে তাকেই আমরা শ্রেষ্ঠ বলে মানি। কারণ হিন্দুরা সাম্প্রদায়িক নয়।’ এবং ১৯৯২-এর ৬ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, ‘ওগুলির ধ্বংস কেবলমাত্র হিন্দুমন্দির ধ্বংসের প্রতিশোধেই ঘটে। হিন্দুরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে কখনোই মসজিদ ধ্বংস করে না। কিছু বালক যেমন ফুর্তি করার জন্য মসজিদ ভাঙ্গে’ (মেইনষ্ট্ৰীম, ৩০.১০.৯৩)।
হিন্দু মৌলবাদীদের প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তার ১৯৯৬-এর নির্বাচনী ইস্তেহারে দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করে ‘হিন্দুত্বই সেই একমাত্র সংযোগসূত্র যা আমাদের জাতির ঐক্য এবং সংহতি রক্ষা করতে পারে।’–হ্যাঁ, এদের কাছে ভারতীয় হিসেবে পরিচয় নয়, হিন্দু হিসেবে পরিচয়ই একমাত্র গ্রহণীয়। তাই ১৯৮০ সালে প্রথম বিশ্বহিন্দু পরিষদের প্রকাশ্য ঘোষণা—All nonHindus are aliens (সমস্ত অহিন্দুই বিদেশী)
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আমেরিকা বা প্রথম বিশ্বের দেশগুলির প্রতি এদের দুর্বলতা, তথা সাম্রাজ্যবাদী ও কম্যুনিজম-বিরোধী শক্তিগুলির সঙ্গে এদের সহমর্মিতার আঁচও নানা ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহারে যেমন বলা হয়েছে ‘চীন যে পাকিস্থানকে অস্ত্র ও নানাবিধ সাহায্য করছে সে সম্পর্কে উদাসীন হলে চলবে না।’ অথচ একই ধরনের কাজ আমেরিকা ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও বহুজাতিক সংস্থারা করলেও সে সম্পর্কে তা নীরব।
শিক্ষা, নারী, অর্থনীতি, বৈদেশিক নীতি-ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রে হিন্দুত্বকেন্দ্ৰিক ভয়াবহ মৌলবাদী ভাবনাকে নানা কৌশলে ভারতীয় জনমাসনে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে। এরইসঙ্গে নানা ধরনের রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, ধান্দাবাজি ও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে ভারত একটি হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যাবে,-যখন ‘ভারত’ বা ‘ইন্ডিয়া’ নামটি মুছে দিয়ে রাষ্ট্রের নাম হবে হিন্দুস্থান, যে রাষ্ট্রে ধর্মপরিচয়ই হবে নাগরিকদের প্রধানতম পরিচয়, তথাকথিত হিন্দুনেতারা ও তাদের মধ্যেও মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই থাকবে শাসন ক্ষমতায়, এই শাসকগোষ্ঠীরও নৈতিক নেতৃত্ব দেবে পরিশ্রমজীবী সাধুসন্তের দল, হিন্দু ছাড়া ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা হবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, সম্প্রদায়গত দাঙ্গা ও অসহিষ্ণুতা হবে তীব্র, নারীরা হবে গৃহকোণে আবদ্ধ ও শুধুমাত্র সস্তানের জন্মদাত্রী, সমস্ত ধরনের মুক্ত উদার ও বৈজ্ঞানিক চিন্তা হবে কঠোরভাবে অবদমিত, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ হবে আরো তীব্র ও সূক্ষ্ম, শিক্ষাদীক্ষা হবে মধ্যযুগীয় ইত্যাদি। হিটলারের ইহুদি নিধনের মত মুসলিম-খৃষ্টানদের গণহত্যাও ভিন্ন পদ্ধতিতে সংঘটিত হতে পারে,-যদি না তারা নিঃশর্তে হিন্দুত্বকে বরণ করে।
এই হিন্দু-মৌলবাদী ফ্যাসিবাদী অপশক্তিকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে মানবপ্রেমিক-দেশপ্রেমিক ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁদের এই ঐক্য এখনো আশানুরূপ পর্যায়ে পৌঁছয় নি। মৌলবাদের উত্থান প্রতিরোধে বামপন্থী সহ প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলির আন্তরিকতার অভাবও অনুভব করা যায়-যার প্রতিফলন ঘটছে বিভিন্ন রাজ্যে, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও, পঞ্চায়েত-পুরসভাসহ নানা ক্ষেত্রের নির্বাচনে কিছু কিছু আসনে হিন্দুত্ববাদীদের বিজয়ী হওয়ার মধ্যে। এরই মধ্যে আবার কোন কোন ‘লড়াকু’। নেতা বা নেত্রী তার প্রধান শত্রু হিসেবে ‘বামপন্থীদের’ চিহ্নিত করছেন এবং হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলির সম্পর্কে একেবারেই নীরব। ব্যাপারটি উভয়ের গোপন আঁতাত ও সহমর্মিতার ইঙ্গিত দিতে যথেষ্ট এবং অদূর ভবিষ্যতে তা তাঁদের ক্ষমতায়ও বসাতে পারে–যদি না শুভবুদ্ধির উদয় হয় ও সুদৃঢ় প্রতিরোধ আসে।
তাই দেরি হয়েই যাচ্ছে।
অন্যদিকে পৃথিবীর নানা কোণে খৃষ্টীয় মৌলবাদীরাও বসে নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে বড় বেশি বিলম্বিত হচ্ছে ইসলামী মৌলব্লাদীদের প্রতিহত করার কাজটিও। ইরানের মত কিছু ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে হলেও অবস্থার কিছু পরিবর্তন তবু একটু আশা জাগায়। ইরানে সম্প্রতি (অগাস্ট, ১৯৯৭) নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মহম্মদ খাটামি শপথ নিয়েছেন। ইনি ধর্মপ্ৰাণ হলেও আগের কট্টরপন্থীদের তুলনায় উদার। শপথ নেওয়ার অব্যবহিত পরে একজন নারীকে ভাইসপ্রেসিডেনটের পদ দিয়েছেন—১৯৭৯-এর ‘ইসলামী বিপ্লবের’ পর এই প্রথম। ইরানের কঠোর ইসলামী বিধিকে সরলীকরণ করা ও দুর্বল অর্থনীতিকে চাঙ্গা কবার জন্যও খাটামির প্রতিশ্রুতি আশাব্যঞ্জক। তবু কট্টরপন্থী ইসলামী মৌলবাদীরা তাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালু রেখেছে এবং শেষ অব্দি তিনি কতটা সফল হবেন তা এখনি বলা মুস্কিল।
কিন্তু এরই পাশাপাশি আফগানিস্থানে তালিবানদের উত্থান উদ্বেগজনক৷ ১৯৯৬-এর ২৭শে সেপ্টেম্বর তালিবানরা আফগানিস্থানে প্রেসিডেন্ট রব্বানিকে ক্ষমতাচুত করে কাবুল দখল করে। ক্রমশ বহির্বিশ্বের মানুষ জানতে পারে মৌলবাদীরা ক্ষমতায় এলে কিভাবে মানুষের অগ্রগতির ইতিহাসকে পেছনে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। মধ্যযুগীয় শরীয়তি ইসলামী আইন, মেয়েদের উপর নানা ধরনের ফতোয় ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তালিবানরা তাদের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের প্রকাশ ঘটায়।
আরবীতে ‘তালিব’ কথার অর্থ ছাত্র; বহুবচনে তালিবা (Taliban)। শুরুতে ছাত্রদের হাতেই গঠিত হয়েছিল এই বিপ্লবী ইসলামী বাহিনী। তালিবান সরকারের একটি ইতিবাচক দিক হল, কঠোর আইন প্রয়োগে দুনীতিগ্রস্ত আমলা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের শায়েস্তা করা। কিন্তু ব্যাপারটি. এই নয় যে, এই ধরনের কঠোর শরীয়তি আইন না থাকলে এদের শাস্তি দেওয়া যেত না। অন্নসলে পূর্বতন সরকারেরও দুনীতি দমনের আইন ছিল। কিন্তু তার উপযুক্ত প্রয়োগ ঘটত না এবং ছিল ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত। সাম্প্রতিক ভারতে যেমন লালু-জয়ললিতা-রাও-ভগত প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা ও তাদের পরবর্তী স্তরের বহু নেতা ও আমলারা জনসাধারণের অর্থ আত্মসাৎ, স্বজনপোষণ, খুন, প্রতারণা, সীমাহীন বিলাসব্যসন ইত্যাদি নানা অপরাধে অভিযুক্ত হলেও, তাদের বিচার কবে শেষ হবে এবং অপরাধী হলে, কবে তারা শাস্তি পাবে—এ ব্যাপারটিই এখনো বিশ বঁও জলে। আফগানিস্তানেও বিগত কয়েক বছরে দুনীতির ছবিটা ছিল একইরকম। তালিবানরা এ ছবিকে নিঃসন্দেহে কিছুটা পাল্টেছে। ব্যাপারটি কঠোর শরীয়তি আইনের প্রয়োজনীয়তার চেয়ে আইনের যথার্থ ও দ্রুত প্রয়োগের গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা করে এবং বিচার ব্যবস্থার হাস্যকর দীর্ঘসূত্রিতা ও সীমাবদ্ধতারই পরিচয় বহন করে।
সাম্প্রতিক ভারতেও এতদিনকার ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের এই দুনীতিকে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা তথা হিন্দু মৌলবাদীরা নিজেদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছে, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে দুনীতিমুক্ত প্রশাসনের। ভারতীয় নাগরিকদের একাংশের মধ্যে তাদের প্রভাব বৃদ্ধির পেছনে এটিও অন্যতম ভূমিকা পালন করছে। একই ব্যাপার ঘটেছে আফগানিস্তানে তালিবানদের ক্ষেত্ৰেও। জনসাধারণের বড় একটি অংশ তালিবানদের সমর্থন করছে তাদের কঠোর ইসলামী ফৌজদারি আইন প্রয়োগ করে দুনীতিপরায়ণ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য—যা বিগত প্ৰায় এক দশকে ওখানে প্রায় হয়ই নি। মৌলবাদীরা কিভাবে নানা কৌশলে জনভিত্তি অর্জনের প্রচেষ্টা চালায় তা এ থেকে বোঝা যায়। ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতায় আসায় আগে এভাবেই সাধারণ মানুষকে মনোমুগ্ধকর নানা কথাবার্তা দিয়ে মোহগ্ৰস্ত করে,-জার্মানিতে হিটলার যেমন বলেছিল বিশুদ্ধ আৰ্য রক্তের জার্মানজাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার কথা, ভারতে তেমনি বলা হচ্ছে হিন্দুত্ব ও পবিত্র হিন্দু ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার কথা। সঙ্গে উন্নত ও স্বনির্ভর অর্থনীতি থেকে দুনীতিমুক্ত প্রশাসনের আপাত জনস্বার্থবাহী গাজর খাওয়ানোও হয়। এবং এইভাবেই আড়াল করা হয় তাদের ধর্মীয় মৌলবাদী তথা প্ৰগতিবিরোধী, বিজ্ঞান-বিরোধী সাম্প্রদায়িকতাবাদী চরিত্র, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে।
অন্যদিকে আমেরিকা তথা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তালিবানদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কমিউনিজম তথা সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র ইত্যাদির সামান্য পুনরাবির্ভাবকে প্ৰতিহত করতে তারা তালিবানদের ব্যবহার করতে শুরু করেছে। মৌলবাদ ও ফ্যাসিজমের বিরোধিতা, জনগণ ইত্যাদি তাদের কাছে গৌণ।
কিন্তু তালিবানরা কিছু কিছু এলাকায় ক্ষমতায় আসতে না আসতেই তাদের আসল স্বরূপ প্রকাশ করেছে। শুধুমাত্র সমাজের অবিচ্ছেদ্য অর্ধাংশ যে নারী, তাদের উপর নানা কঠোর তালিবানী ফরমান থেকে এর আঁচ পাওয়া যায়।
তালিবানরা মেয়েদের চাকরি করা ও স্কুল-কলেজে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছে। মেয়েদের ঘরের মধ্যেই থাকতে হবে, প্রয়োজনে বাজার হাট করতে গেলেও, বোরখা পরে পা-ঢেকে বেরুতে হবে। ইত্যাদি।
একইভাবে পুরুষদের জন্যও আছে কঠোর শরীয়তি আইন; আছে। পশ্চিমী পোষাক পরা, গান, টিভি, ভিডিও ইত্যাদির উপর নিষেধাজ্ঞা, মদ্যপান, ড্রাগ সেবন কিংবা অবৈধ যৌন সম্পর্কের শাস্তি হিসেবে পাথর দিয়ে মেরে ফেলার মধ্যযুগীয় বিধান ইত্যাদি। আসলে হিন্দু-মুসলিম-খৃষ্টান নির্বিশেষে মৌলবাদীদের চিন্তা-চেতনা মানসিকতা সবই মধ্যযুগীয় বা আরো আদিম,-সংকীর্ণতা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, অন্য গোষ্ঠীর প্রতি বৈরিতা, হিংস্রতা ইত্যাদি। মানুষের এইসব পশ্চাদপদ ভাবনাকে ভাঙ্গিয়েই তাদের ক্ষমতা লাভের চেষ্টা।
ধর্মীয় মৌলবাদ সব মিলিয়ে এখনো মানুষের বড় একটি শত্রু। এর সঙ্গে রাজনৈতিক মৌলবাদী মানসিকতা ভিন্নতর বিপদের সৃষ্টি করছে এবং সার্বিক অবস্থাকে জটিলতর করে তুলছে। এ অবস্থায় মানুষের কল্পিত ঈশ্বরের এবং ঐ কল্পনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নানা প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের মূলোচ্ছেদ করার কাজ অতি সক্রিয়ভাবেই পালন করা প্রয়োজন। বড় বেশি প্রয়োজন ‘ধৰ্ম’ থেকে ‘রাজনীতি’ সব ধরনের গোঁড়া মৌলবাদী অন্ধ বিশ্বাসের মূলোচ্ছেদ করে বিজ্ঞানমনস্কতা অর্জন করার ও মনুষ্যত্বের মুক্তচিন্তাকে সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করার।
———————–
(১) ক্ষমতা পাবার আগেই নিজ সংগঠন বহির্ভূত হিন্দুদের দিয়েও, এ কাজ করা যায়। কিনা তার যাচাই করার রিহার্সেল যথাসম্ভব হয়ে গেল। ২১শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ তারিখে গণেশকে দুধ খাওয়ানোর গণ উন্মাদনা সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে।
(২) শুধু বিজ্ঞান ও ধর্মের মিলনের প্রেসক্রিপশান নয়, পরিবর্তিত সময়ে, আধুনিক মনের গ্রহণযোগ্য করে এই ধরনের লোকেরা হাস্যকরভাবে ধর্মের নতুন নতুন সংজ্ঞাও হাজির করে। যেমন ধর্ম বলতে ঐ পূজা-প্রার্থনা, মন্দির-মসজিদ-গির্জা ইত্যাদি নয়, ধর্ম আসলে মানবিক ঐক্য বা সত্যই আসলে ঈশ্বর ইত্যাদি। তাহলে ঐ ধর্ম, ঈশ্বর এসব কথাকে আঁকড়ে রাখাই বা কেন? এসব গালগল্পও আসলে সূক্ষ্মভাবে ধর্ম ও ঈশ্বরকে টিকিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টা মাত্র। শুধু তাকে একটু মানবিক পালিশ দেওয়া মাত্র।
(৩) মাওসেতুং চীনা পুরুষদের উপর তিন ধরনের আধিপত্যের কথা বলেছিলেন,–(১)রাষ্ট্রব্যবস্থা (রাজনৈতিক কর্তৃত্ব), (২) কুলব্যবস্থা (গোষ্ঠীগত কর্তৃত্ব) ও (৩) অতিপ্রাকৃত ব্যবস্থা (ধৰ্মীয় কর্তৃত্ব) নারীরা এই তিনটির সঙ্গে আরো একটি আধিপত্যের দ্বারা শাসিত–সেটি হল পুরুষদের দ্বারা শাসন (স্বামীর কর্তৃত্ব)।