[৬]
টাঙ্গায় উঠে ফেলুদা গাড়োয়ানকে বলল, ‘হজরতগঞ্জ।’
আমি বললাম, ‘সেটা আবার কোন জায়গা?’
‘এখানকার চৌরঙ্গি। শুধু নবাবি আমলের জিনিস ছাড়াও তো শহরে দেখবার জিনিস আছে। আজ একটু দোকান-টোকান ঘুরে দেখব।’
গতকাল রেসিডেন্সি থেকে আমরা বনবিহারীবাবুর বাড়িতে কফি খেতে গিয়েছিলাম। সেই সুযোগে ওঁর চিড়িয়াখানাটাও আরেকবার দেখে নিয়েছিলাম। সেই হাইনা, সেই র্যাট্ল্ স্নেক, সেই মাকড়সা, সেই বনবেড়াল, সেই কাঁকড়া বিছে।
বৈঠকখানায় বসে কফি খেতে খেতে ফেলুদা একটা দরজার দিকে দেখিয়ে বলল, ‘ও দরজাটায় সেদিনও তালা দেখলাম, আজও তালা।’
বনবিহারীবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ—ওটা একটা এক্স্ট্রা ঘর। এসে অবধি তালা লাগিয়ে রেখেছি। খোলা রাখলেই ঝাড়পোঁছের হ্যাঙ্গামা এসে যায়, বুঝলে না!’
ফেলুদা বলল, ‘তা হলে তালাটা নিশ্চয়ই বদল করা হয়েছে, কারণ এটায় তো মরচে ধরেনি।’
বনবিহারীবাবু ফেলুদার দিকে একটু হাসি-হাসি অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ—এর আগেরটায় এত বেশি মরচে ধরেছিল যে ওটা বদলাতে বাধ্য হলাম।’
বাবা বললেন, ‘আমরা ভাবছিলাম হরিদ্বার লছমনঝুলাটা এই ফাঁকে সেরে আসব।’
বনবিহারীবাবু পাইপ ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে কড়া গন্ধওয়ালা ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘কবে যাবেন? পরশু যদি যান তো আমিও আসতে পারি আপনাদের সঙ্গে। আমার এমনিতেই সেই বারো ফুট অজগর সাপটা দেখার জন্য একবার যাওয়া দরকার। আর ফেলুবাবুও যেভাবে গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছেন, কয়েকদিনের জন্য শহর ছেড়ে কোথাও যেতে পারলে বোধহয় সকলেরই মঙ্গল।’
ধীরুকাকা বললেন, ‘আমার তো শহর ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই। তোমরা কজন ঘুরে এসো না। ফেলু তপেশ দুজনেরই লছমনঝুলা না-দেখে ফিরে যাওয়া উচিত হবে না।’
বনবিহারীবাবু বললেন, ‘আমার সঙ্গে গেলে আপনাদের একটা সুবিধে হবে—আমার চেনা ধরমশালা আছে, এমন কী হরিদ্বার থেকে লছমনঝুলা যাবার গাড়ির ব্যবস্থাও আমি চেনাশুনার মধ্যে থেকে করে দিতে পারব। এখন আপনার ব্যাপারটা ডিসাইড করুন।’
ঠিক হল পরশু শুক্রবারই আমরা রওনা দেব। দুদিন আগে যদি বনবিহারী বাবু বলতে আমাদের সঙ্গে যাবেন, তা হলে আমার খুব ভালই লাগত। কিন্তু আজ বিকেলে রেসিডেন্সির ঘটনার পর থেকে আমার লোকটা সম্বন্ধে মনে একটা কীরকম খটকা লেগে গেছে। তবুও যখন দেখলাম ফেলুদার খুব একটা আপত্তি নেই, তখন আমিও মনটাকে যাবার জন্য তৈরি করে নিলাম।
আজ সকালে উঠে ফেলুদা বলল, ‘দাড়ি কামাবার ব্লেড ফুরিয়ে গেছে—ওখানে গিয়ে মুশকিলে পড়ে যাব। চল ব্লেড কিনে আনিগে।’
তাই দুজনে টাঙ্গা করে বেরিয়েছি। হজরতগঞ্জে নাকি সব কিছুই পাওয়া যায়।
কাল থেকেই দেখছি ফেলুদা আংটি নিয়ে আর কিছুই বলছে না। আজ সকালে ও যখন স্নান করতে গিয়েছিল, তখন আমি আরেকবার ওর নোটবইটা খুলে, দেখেছিলাম, কিন্তু পড়তে পারিনি। অক্ষরগুলোর এক একটা ইংরিজি মনে হয়, কিন্তু বেশির ভাগই অচেনা।
গাড়িতে যেতে যেতে আর কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম।
ও প্রথমে লুকিয়ে ওর খাতা দেখার জন্য দারুণ রেগে গেল। বলল, ‘এটা তুই একটা জঘন্য কাজ করেছিস। তোকে প্রায় ক্রিমিন্যাল বলা যেতে পারে।’
তারপর একটু নরম হয়ে বলল, ‘তোর পক্ষে ওটা পড়ার চেষ্টা করা বৃথা, কারণ ও অক্ষর তোর জানা নেই।’
‘কী অক্ষর ওটা?’
‘গ্রিক।’
‘ভাষাটাও গ্রিক?’
‘না।’
‘তবে?’
‘ইংরিজি।’
‘তা তুমি গ্রিক অক্ষর শিখলে কী করে?’
‘সে অনেকদিনের শেখা। ফার্স্ট-ইয়ারে থাকতে। আল্ফা বিটা গামা ডেল্টা পাই মিউ এপসাইলন—এ সব তো অঙ্কতেই শিখেছি, আর বাকিগুলো শিখে নিয়েছিলাম এন্সাইক্লোপিডিয়া ব্রিট্র্যানিকা থেকে। ইংরিজি ভাষাটা গ্রিক অক্ষরে লিখলে বেশ একটা সাংকেতিক ভাষা হয়ে যায়। এমনি লোকের কারুর সাধ্য নেই যে পড়ে।’
‘লখ্নৌ বানান কী হবে গ্রিকে?’
‘ল্যামডা উপসাইলন কাপা নিউ ওমিক্রন উপসাইলন! C আর Wটা গ্রিকে নেই, তাই বানানটা হচ্ছে L-U K-N O U।’
‘আর ক্যালকাটা বানান?’
‘কাপা আল্ফা ল্যাম্ডা কাপা উপসাইলন টাউ টাউ আল্ফা।’
‘বাস্রে বাস্! তিনটে বানান করতেই পিরিয়ড কাবার!’
চৌরঙ্গি বললে অবিশ্যি বাড়িয়ে বলা হবে—কিন্তু হজরতগঞ্জের দোকান-টোকানগুলো বেশ ভালই দেখতে।
টাঙ্গার ভাড়া ঢুকিয়ে দিয়ে ফেলুদা আর আমি হাঁটতে আরম্ভ করলাম।
‘ওই তো মনিহারি দোকান ফেলুদা—ওখানে নিশ্চয়ই ব্লেড পাওয়া যাবে।’
‘দাঁড়া, আগে একটা অন্য কাজ সেরে নিই।’
আরও কিছুদূর গিয়ে ফেলুদা হঠাৎ একটা দোকান দেখে সেটার দিকে এগিয়ে গেল। দোকানের সামনে লাল সাইনবোর্ডে সোনালি উঁচু উঁচু অক্ষরে লেখা আছে—
MALKANI & CO
ANTIQUE & CURIO DEALERS
কাচের মধ্যে দিয়ে দোকানের ভিতরটা দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম সেটা সব পুরনো আমলের জিনিসের দোকান। ঢুকে দেখি হরেক রকমের পুরনো জিনিসে দোকানটা গিজগিজ করছে—গয়নাগাটি কার্পেট ঘড়ি চেয়ার টেবিল ঝাড়লণ্ঠন বাঁধানো ছবি আর আরও কত কী।
পাকাচুলওয়ালা সোনার চশমা পরা একজন বুড়ো ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন।
ফেলুদা বলল, ‘বাদশাদের আমলের গয়নাগাটি কিছু আছে আপনাদের এখানে?’
‘গয়না তো নেই। তবে মুগল আমলের ঢাল তলোয়ার জাজিম বর্ম, এই সব কিছু আছে। দেখাব?’
ফেলুদা একটা কাচের আতরদান হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলল, ‘পিয়ারিলালের কাছে কিছু মুগল আমলের গয়না দেখেছিলাম। তিনি তো আপনার খুব বড় খদ্দের ছিলেন, তাই না?’
ভদ্রলোক যেন অবাক হলেন।
‘বড় খদ্দের? কোন পিয়ারিলাল?’
‘কেন—পিয়ারিলাল শেঠ, যিনি কিছুদিন আগে মারা গেলেন।’
মালকানি মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমার কাছ থেকে কখনই কিছু কেনেননি তিনি, আর আমার চেয়ে বড় দোকান এখানে আর নেই।’
‘আই সি। তা হলে বোধহয় যখন কলকাতায় ছিলেন তখন কিনেছিলেন।’
‘তাই হবে।’
‘এখানে বড় খদ্দের বলতে কাকে বলেন আপনি?’
মালকানির মুখ দেখে বুঝলাম বড় খদ্দের তার খুব বেশি নেই। বললেন, ‘বিদেশি টুরিস্ট এসে মাঝে মাঝে ভাল জিনিস ভাল দামে কিনে নিয়ে যায়। এখানের খদ্দের বলতে মিস্টার মেহতা আছেন, মাঝে মাঝে এটা সেটা নেন, আর মিস্টার পেস্টনজি আমার অনেক দিনের খদ্দের—সেদিন তিন হাজার টাকায় একটা কার্পেট কিনে নিয়ে গেছেন—খাস ইরানের জিনিস।’
ফেলুদা হঠাৎ একটা হাতির দাঁতের তৈরি নৌকোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ওটা বাংলা দেশের জিনিস না?’
‘হ্যাঁ, মুরশিদাবাদ।’
‘দেখেছিস তোপ্সে—বজরাটা কেমন বানিয়েছে।’
সত্যি, এত সুন্দর হাতির দাঁতের কাজ করা নৌকো আমি কখনও দেখিনি। বজরার ছাতে সামিয়ানার তলায় নবাব বসে গড়গড়া টানছে, তার দুপাশে পাত্রমিত্র সভাসদ সব বসে আছে, আর সামনে নাচগান হচ্ছে। ষোলোজন দাঁড়ি দাঁড় বাইছে, আর একটা লোক হাল ধরে বসে আছে। তা ছাড়া সেপাই বরকন্দাজ সব কিছুই আছে, আর সব কিছুই এত নিখুঁতভাবে করা হয়েছে যে দেখলে তাক লেগে যায়।
ফেলুদা বলল, ‘এটা কোত্থেকে পেলেন?’
‘ওটা বেচলেন মিস্টার সরকার।’
‘কোন মিস্টার সরকার?’
‘মিস্টার বি. সরকার—যিনি বাদশানগরে থাকেন। উনি মাঝে মাঝে এটা সেটা কিনে নিয়ে যান। ভাল জিনিস আছে ওঁর কাছে।’
‘আই সি। ঠিক আছে। থ্যাংক ইউ। আপনার দোকান ভারী ভাল লাগল। গুড ডে।’
‘গুড ডে, স্যার।’
বাইরে এসে ফেলুদা বলল, ‘বনবিহারী সরকারের তা হলে এ সব দোকানে যাতায়াত আছে। অবিশ্যি সে সন্দেহটা আমার আগেই হয়েছিল।’
‘কিন্তু উনি যে বলেছিলেন এ সব ব্যাপারে ওঁর কোনও ইন্টারেস্ট নেই।’
‘ইন্টারেস্ট না থাকলে পাথর দেখেই কেউ বলতে পারে সেটা আসল কি নকল?’
মালকানি ব্রাদার্সের সামনে দেখি এম্পায়ার বুক স্টল বলে একটা বইয়ের দোকান। ফেলুদা বলল ওর হরিদ্বার লছমনঝুলা সম্বন্ধে একটা বই কেনা দরকার, তাই আমরা দোকানটায় ঢুকলাম, আর ঢুকেই দেখি পিয়ারিলালের ছেলে মহাবীর।
ফেলুদা ফিস্ফিস্ করে বলল, ‘ক্রিকেটের বই কিনছে। ভেরি গুড।’
মহাবীর আমাদের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে বই কিনছিল তাই আমাদের দেখতে পায়নি।
ফেলুদা দোকানদারের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘নেভিল কার্ডাসের কোনও বই আছে আপনাদের?’
বলতেই মহাবীর ফেলুদার দিকে ফিরে তাকাল। আমি জানতাম নেভিল কার্ডাস ক্রিকেট সম্বন্ধে খুব ভাল ভাল বই লিখেছে।
দোকানদার বলল, ‘কোন বইটা খুঁজছেন বলুন তো?’
‘Centuries বইটা আছে?’
‘আজ্ঞে না—তবে অন্য বই দেখাতে পারি।’
মহাবীর মুখে হাসি নিয়ে ফেলুদার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনার বুঝি ক্রিকেটে ইন্টারেস্ট?’
‘হ্যাঁ। আপনারও দেখছি…’
মহাবীর তার হাতের বইটা ফেলুদাকে দেখিয়ে বলল, ‘এটা আমার অর্ডার দেওয়া ছিল। ব্র্যাডম্যানের আত্মজীবনী।’
‘ওহো—ওটা পড়েছি। দারুণ বই।’
‘আপনার কী মনে হয়—রণজি বড় ছিলেন, না ব্র্যাডম্যান?’
দুজনে ক্রিকেটের গল্পে দারুণ মেতে গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলার পর মহাবীর বলল, ‘কাছেই কোয়ালিটি আছে, আসুন না একটু বসে চা খাই।’
ফেলুদা আপত্তি করল না। আমরা তিনজনে গিয়ে কোয়ালিটিতে ঢুকলাম। ওরা দুজনে চা আর আমি কোকা-কোলা অর্ডার দিলাম। মহাবীর বলল, ‘আপনি নিজে ক্রিকেট খেলেন?’
ফেলুদা বলল, ‘খেলতাম। স্লো স্পিন বল দিতাম। লখ্নৌয়ে ক্রিকেট খেলে গেছি।..আর আপনি!’
‘আমি ডুন স্কুলে ফার্স্ট ইলেভেনে খেলেছি। বাবাও স্কুলে থাকতে ভাল খেলতেন।’
পিয়ারিলালের কথা বলেই মহাবীর কেমন জানি গম্ভীর হয়ে গেল।
ফেলুদা চা ঢালতে ঢালতে বলল, ‘আপনি আংটির ঘটনাটা জানেন নিশ্চয়ই।’
‘হ্যাঁ। ডক্টর শ্রীবাস্তবের বাড়ি গিয়েছিলাম। উনি বললেন।’
‘আপনার বাবার যে আংটি ছিল, আর উনি যে সেটা শ্রীবাস্তবকে দিয়েছিলেন সেটা আপনি জানতেন তো?’
‘বাবা আমাকে অনেকদিন আগেই বলেছিলেন যে আমাকে ভাল করে দেবার জন্য শ্রীবাস্তবকে উনি একটা কিছু দিতে চান। সেটা যে কী, সেটা অবিশ্যি আমি বাবা মারা যাবার পর শ্রীবাস্তবের কাছেই জেনেছি।’
তারপর হঠাৎ ফেলুদার দিকে তাকিয়ে মহাবীর বলল, ‘কিন্তু আপনি এ ব্যাপারে এত ইন্টারেস্ট নিয়েছেন কেন?’
ফেলুদা একটু হেসে বলল, ‘ওটা আমার একটা শখের ব্যাপার।’
মহাবীর চায়ে চুমুক দিয়ে একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল।
ফেলুদা বলল, ‘আপনার বাড়িতে আর কে থাকেন?’
‘আমার এক বুড়ি পিসিমা আছেন, আর চাকর-বাকর।’
‘চাকর-বাকর কি পুরনো?’
‘সবাই আমার জন্মের আগে থেকে আছে। অর্থাৎ কলকাতায় থাকার সময় থেকে প্রীতম সিং বেয়ারা আছে আজ পঁয়ত্রিশ বছর।’
‘আংটিটার মতো আর কোনও জিনিস আপনার বাবার কাছে ছিল?’
‘বাবার এ-শখটার কথা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এটা অনেক দিন আগের ব্যাপার। তখন আমি খুবই ছোট। এবার এসে এই সেদিন বাবার একটা সিন্দুক খুলেছিলাম, তাতে বাদশাহী আমলের আরও কিছু জিনিস পেয়েছি। তবে আংটিটার মতো অত দামি বোধহয় আর কোনওটা নয়।’
আমি ‘স্ট্র’ দিয়ে আমার ঠাণ্ডা কোকা-কোলায় চুমুক দিলাম। মহাবীর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে গলাটা একটু নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘প্রীতম সিং একটা অদ্ভুত কথা বলেছে আমাকে।’
ফেলুদা চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগল। রেস্টুরেন্টের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ফেলুদার দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে মহাবীর বলল, ‘বাবার যেদিন দ্বিতীয় বার হার্ট অ্যাটাক হল, সেদিন সকালে অ্যাটাকটা হবার কিছু আগেই প্রীতম সিং বাবার ঘর থেকে বাবারই গলায় একটা আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিল।’
‘বটে?’
‘কিন্তু প্রীতম সিং তখন খুব বিচলিত হয়নি, কারণ বাবার মাঝে মাঝে কোমরে একটা ব্যথা হত, তখন চেয়ার বা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াবার সময় উনি একটা আর্তনাদ করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কারুর সাহায্য নিতেন না। প্রীতম সিং প্রথমে ভেবেছিল ব্যথার জন্যই উনি চিৎকার করছেন, কিন্তু এখন বলে যে ওর হয়তো ভুল হতে পারে, কারণ চিৎকারটা ছিল বেশ জোরে।’
‘আচ্ছা, সেদিন আপনার বাবার সঙ্গে কেউ দেখা করতে গিয়েছিলেন কি না সে খবর আপনি জানেন? প্রীতম সিং-এর কিছু মনে আছে কি?’
‘সে কথা আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু ও ডেফিনিটলি কিছু বলতে পারছে না। সকালের দিকটায় মাঝে মাঝে বাবার কাছে লোকজন আসত—কিন্তু বিশেষ করে সেদিন ওঁর কাছে কেউ এসেছিল কি না সে কথা প্রীতম বলতে পারছে না। প্রীতম যখন বাবার ঘরে গিয়েছিল, তখন ওঁর অবস্থা খুবই খারাপ, আর তখন ঘরে অন্য কোনও লোক ছিল না। তারপর প্রীতমই ফোন করে শ্রীবাস্তবকে আনায়। বাবার হার্টের চিকিৎসা যিনি করতেন—ডক্টর গ্ৰেহ্যাম—তিনি সেদিন এলাহাবাদে ছিলেন একটা কন্ফারেন্সে।’
‘আর স্পাই ব্যাপারটা সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা?’
‘স্পাই?’—মহাবীর যেন আকাশ থেকে পড়ল।
‘ও, তা হলে আপনি এটা জানেন না। আপনার বাবা শ্রীবাস্তবকে ‘স্পাই’ সম্বন্ধে কী যেন বলতে গিয়ে কথাটা শেষ করতে পারেননি।’
মহাবীর মাথা নেড়ে বলল, এটা আমার কাছে একেবারে নতুন জিনিস। এ সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না, আর বাবার সঙ্গে গুপ্তচরের কী সম্পর্ক থেকে থাকতে পারে তা আমি কল্পনাই করতে পারছি না।’
আমি কোকো-কোলাটাকে শেষ করে সবে স্ট্র-টাকে দুমড়ে দিয়েছি, এমন সময় দেখলাম একজন ষণ্ডা মার্কা লোক আমাদের কাছেই একটা টেবিলে বসে চা খেতে খেতে আমাদেরই দিকে দেখছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ভদ্রলোক টেবিল ছেড়ে উঠে এগিয়ে এলেন, আর ফেলুদার দিকে ঘাড়টা কাত করে বললেন, ‘নমস্কার। চিনতে পারছেন?’
‘হ্যাঁ—কেন পারব না।’
আমি প্রথমে চিনতে পারিনি, এখন হঠাৎ ধাঁ করে মনে পড়ে গেল—ইনিই বনবিহারীবাবুর বাড়িতে থাকেন আর ওঁর চিড়িয়াখানা দেখাশোনা করেন। ভদ্রলোকের থুতনিতে একটা তুলোর উপর দুটো স্টিকিং প্লাস্টার ক্রসের মতো করে লাগানো রয়েছে। বোধহয় দাড়ি কামাতে গিয়ে কেটে গেছে।
ফেলুদা বলল, ‘বসুন। ইনি হচ্ছেন মহাবীর শেঠ—আর ইনি গণেশ গুহ।’
এবার লক্ষ করলাম যে ভদ্রলোকের ঘাড়েও একটা আঁচড়ের দাগ রয়েছে—যদিও এ দাগটা পুরনো।
ফেলুদা বলল, ‘আপনার থুতনিতে কী হল?’
গণেশবাবু তার নিজের টেবিল থেকে চায়ের পেয়ালাটা তুলে এনে আমাদের টেবিলে রেখে বলল, ‘আর বলবেন না—সমস্ত শরীরটাই যে অ্যাদ্দিন ছিঁড়ে ফুঁড়ে শেষ হয়ে যায়নি সেই ভাগ্যি। আমার চাকরিটা কী সে তো জানেনই।’
‘জানি। তবে আমার ধারণা ছিল চাকরিটা খুশি হয়েই করেন আপনি।’
‘পাগল! সব পেটের দায়ে। এক কালে বিজু সার্কাসের বাঘের ইন-চার্জ ছিলুম—তা সে বাঘ তো আফিম খেয়ে গুম হয়ে পড়ে থাকত। বনবিহারীবাবুর এই সব জানোয়ারের কাছে তো সে দুগ্ধপোষ্য শিশু। সেদিন বেড়ালের আঁচড়, আর কাল এই থুতনিতে হাইনার চাপড়। আর পারলুম না। সকালে গিয়ে বলে এসেছি—আমার মাইনে চুকিয়ে দিন। আমি ফিরে যাচ্ছি সার্কাস পার্টিতে। তা ভদ্রলোক রাজি হয়ে গেলেন।’
ফেলুদা যেন খবরটা শুনে অবাক হয়ে গেল। বলল, ‘সেকী, আপনি বনবিহারীবাবুর চাকরি ছেড়ে দিলেন? কাল বিকেলেও তো আমরা ওঁর ওখানে ঘুরে এলাম।’
‘জানি। শুধু আপনারা কেন, অনেকেই যাবেন। কিন্তু আমি আর ও তল্লাটেই নয়। এই এখন স্টেশনে যাব, গিয়ে হাওড়ার টিকিট কাটব। ব্যস্— ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গিয়ে নিশ্চিন্ত। আর—’ ভদ্রলোক নিচু হয়ে ফেলুদার কানের কাছে মুখ নিয়ে এলেন, ‘—একটা কথা বলে যাই—উনি লোকটি খুব সুবিধের নন।’
‘বনবিহারীবাবু?’
‘আগে ঠিকই ছিলেন, ইদানীং হাতে একটি জিনিস পেয়ে মাথাটি গেছে বিগড়ে।’
‘কী জিনিস?’
‘সে আর না হয় নাই বললাম’—বলে গণেশ গুহ তার চায়ের পয়সা টেবিলের উপর ফেলে দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে হাওয়া হয়ে গেল।
ফেলুদা এবার মহাবীরের দিকে ফিরে বললেন, ‘আপনি দেখেছেন বনবিহারীবাবুর চিড়িয়াখানা?’
‘ইচ্ছে ছিল যাওয়ার—কিন্তু হয়নি। বাবার আপত্তি ছিল। ওই ধরনের জানোয়ার-টানোয়ার উনি একদম পছন্দ করতেন না। একটা আরশোলা দেখলেই বাবার প্রায় হার্ট্ প্যালপিটেশন হয়ে যেত। তবে এবার ভাবছি একদিন গিয়ে দেখে আসব।’
মহাবীর তুড়ি মেরে বেয়ারাকে ডাকল। ফেলুদা অবিশ্যি চায়ের দামটা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু মহাবীর দিতে দিল না। আমি মনে মনে ভাবলাম যে ফিল্মের অ্যাক্টরের অনেক টাকা, কাজেই মহাবীর দিলে কোনও ক্ষতি নেই।
বিলটা দেবার পর মহাবীর তার সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিল। দেখলাম প্যাকেটটা চারমিনারের।
‘আপনি কদিন আছেন?’ মহাবীর জিজ্ঞেস করল।
‘পরশু দিন-দুয়েকের জন্য হরিদ্বার যাচ্ছি, তারপর ফিরে এসে বাকি এ মাসটা আছি।’
‘আপনারা সবাই যাচ্ছেন হরিদ্বার?’
‘ধীরেনবাবুর কাজ আছে তাই উনি যাবেন না। আমরা তিনজন যাচ্ছি, আর বোধ হয় বনবিহারীবাবু। উনি লছমনঝুলায় একটা অজগরের সন্ধানে যাচ্ছেন।’
রেস্টুরেন্টের বাইরে এসে পড়লাম। মহাবীর বলল, ‘আমার কিন্তু গাড়ি আছে—আমি লিফ্ট দিতে পারি।’
ফেলুদা ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘না, থাক। মোটর তো কলকাতায় হামেশাই চড়ি। এখানে টাঙ্গাটা বেড়ে লাগছে।’
এবার মহাবীর ফেলুদার কাছে এসে ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ করে সত্যিই ভাল লাগল। একটা কথা আপনাকে বলছি—যদি জানতে পারি যে বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবে হয়নি, তার জন্য অন্য কেউ দায়ী, তা হলে সেই অপরাধী খুনিকে খুঁজে বার করে তার প্রতিশোধ আমি নেবই। আমার বয়স বেশি না হতে পারে, কিন্তু আমি চার বছর মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে ছিলাম। রিভলভারের লাইসেন্স আছে, আমার মতো অব্যর্থ টিপ খুব বেশি লোকের নেই।…গুড বাই।’
মহাবীর রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে একটা কালো স্ট্যান্ডার্ড গাড়িতে উঠে হুশ্ করে বেরিয়ে চলে গেল।
ফেলুদা খালি বলল, ‘সাবাস্।’
আমি মনে মনে বললাম, ফেলুদা যে বলেছিল প্যাঁচের মধ্যে প্যাঁচ সেটা খুব ভুল নয়।
টাঙ্গার খোঁজে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। এটাও বুঝতে পারছিলাম যে ব্লেড জিনিসটার খুব বেশি দরকার বোধহয় ফেলুদার নেই।