৬. অসুখে ভুগে উঠল সীতা

০৬.

অনেক অসুখে ভুগে উঠল সীতা। টাইফয়েড হয়েছিল, তার সঙ্গে স্নায়বিক রোগ, জ্বর সেরে যাওয়ার পরও বিছানা ছেড়ে উঠতে পারত না।

আজকাল বারান্দা পর্যন্ত যেতে পারে সে। গায়ে একটা পশমি চাদর জড়িয়ে রেলিং ধরে বসে থাকে চেয়ারে। কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে দুর্বলতায়। হাতে পায়ে শীত। সারা গায়ে খড়ি উঠছে। শরীরের সমস্ত রক্ত কে যেন সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে নিয়ে গেছে। এত সাদা দেখায় তাকে। কাগজের মত পাতলা হয়ে গেছে সে। যেন ওজন নেই।

বিয়েটা পিছিয়ে গেছে। আদ্রায় জয়েন করেছে মানস। কোয়ার্টার পেয়েছে। মাঝে মাঝে আসে। পাতিয়ালার কোচিং-এ সে যাচ্ছে না। যেতে ভয় পায়।

বলে–আমি চোখের আড়াল হলেই না জানি তুমি কী ঘটিয়ে বসবে।

-কী ঘটাব!

কী জানি! ভয় করে। তোমাকে অসুখের সময়ে দেখে মনে হত পুটুস করে মরে যাবে বুঝি! সাদা। হাতে নীল শিরা দেখা যাচ্ছে, চোখে কালি, খাস ফেলছ না-ফেলার মতো। কী যে আপসেট করে দাও।

এক এক সময়ে আদ্রার কথা ভাবতে ভালই লাগে সীতার। সেখানে বোধহয় নির্জনতা আছে। বনভূমি, একটা কলস্বরা নদী। কলকাতার মতো সেটা দোকানের শহর নয়। না হোক। তবু সেখানে ভুতুড়ে টেলিফোন যাবে না!

আবার মনে হয়, কলকাতা ছেড়ে যাবে? সারা দুপুর ঘুরে ঘুরে জিনিস কেনা, সে যে কী ভাল! কাজের জিনিস, অকাজের জিনিস, ঠকে আসবে, তারপর দাঁতে ঠোঁট কামড়াবে, আবার পরদিন বেরোবে ঠকতে, কণ্টকিত শরীরে মাঝে মাঝে শুনবে সেই গোস্ট কল। গোস্ট? হবেও বা।

সেরে উঠছে সীতা, আজকাল এ সব রোগ সহজেই সারে।

.

একটা ম্যাক্সি কিনেছিল সীতা শখ করে, বহুদিন আগে। সুটকেশ ঘাটতে গিয়ে টেনে বের করল। ফুল ভয়েলের ওপর পিঙ্ক লাল আর কালো চমৎকার নকশা, হাতে সূক্ষ্ম লেসের ফ্রিল। ম্যাক্সি পরার কথা তার নয়। পরবার জন্য বা ব্যবহার করার জন্য নয়, শখ করে কত অকাজের জিনিসই সে যে কেনে?

ম্যাক্সিটা বুকে করে সে আয়নার সামনে এল। খুব রোগা হয়ে গেছে সে। সাদা। কিন্তু তার মুখে অসুখের ফলে কোনও বুড়োটে ছাপ পড়েনি। বরং যেন বা বয়স কমে গেছে তার। বালিকার মতো দেখাচ্ছে।

দরজা বন্ধ করে আসে সীতা। শাড়ি ছেড়ে ম্যাক্সিটা পরে নেয়। পায়ের পাতা পর্যন্ত ঝুল। শরীরটা একটু আঁট বুঝি। ঘুরেফিরে আয়নায় দেখে সে নিজেকে। ওমা, সে তো আর যুবতী নেই। একদম না। ঠিক কিশোরী সীতা। পাতলা, ফরসা, ছোট্টটি। বুকটা দেখে হেসে ফেলে সে। স্তনভার নেই। বোঝাই যায় না বুকে কিছু আছে। শুধু দুধারে কুঁচির ওপর একটু একটু ঢেউ। ঠিক প্রথম যেমন হয়। আস্তে আস্তে পা ফেলে আয়না থেকে দূরে গেল সীতা। দেখল। কাছে এল। দেখল। কোনও ভুল নেই। সেইরকম অবিকল, যেমন সে ছিল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুলে ভাবতে বসল সীতা। পশ্চাৎগামী রেলগাড়ির মতো সে ফিরে যাচ্ছিল সেই বয়সে নানা বয়সের স্মৃতি চলন্ত রেলগাড়ি থেকে আলোর চৌখুপি ফেলে যাচ্ছে।

.

একদিন দুপুরে টেলিফোন এল।

মিসেস লাহিড়ি আছেন?

লাহিড়ি। না তো! লাহিড়ি কেউ নেই। রং নাম্বার।

সীতা ফোন নামিয়ে রাখতে যাচ্ছিল।

ওপাশে কণ্ঠস্বরটা আঁতকে উঠে বলেনা, না, রং নাম্বার নয়! আপনি কে বলুন!

–আমি! অবাক হয়ে সীতা বলে–আমি সীতা ব্যানার্জি।

–ব্যানার্জি? কণ্ঠস্বরটা যেন বিষম খায়, বলে–মৌ, তুমি এখনও ব্যানার্জি?

 –ওঃ। বলে ভয় পেয়ে চুপ করে যায় সীতা।

কী?

ভুল হয়েছিল।

অধৈর্যের গলায় মানস বলে–মৌ, ডিসগাস্টিং।

ভুল তো মানুষ করেই। আমি ভাবলাম বোধহয় এজেন্সির ব্যাপারে কেউ কিছু জানতে চাইছে। এজেন্সিটা তো ওই নামেই।

–ঠিক আছে। ক্ষমা করলাম।

–কখন এসেছ কলকাতায়?

সকালে। কিন্তু এবার দেখা হচ্ছে না, এক্ষুনি বার্নপুরে যাচ্ছি। ফোন করছি হাওড়া থেকে। অল ইন্ডিয়া মিট, ভীষণ ব্যস্ত। কেমন আছ?

–ভাল।

–আমাকে ছেড়েও ভাল?

না, না, তা বলিনি। এমনি ভালই।

–ভাল থাকো, ছেড়ে দিচ্ছি।

 ম্যাক্সিটা মাঝে মাঝে বের করে পরে সীতা। বালিকা সেজে বসে থাকে। দুটো বিনুনি ঝুলিয়ে দেয়। আয়নায় তাকিয়ে হাসে। একটা পশ্চাৎগামী রেলগাড়ি তাকে তখন তুলে নিয়ে যায়, আলোর চৌখুপিগুলি নানা রং ফেলে যেতে থাকে।

সীতা আস্তে আস্তে আবার রাস্তায় বেরোয়, একা একা চলে যায় গড়িয়াহাটা, এসপ্ল্যানেড, নিউমার্কেট, হাতিবাগান। ঘুরে ঘুরে কেনে কাজের জিনিস, অকাজের জিনিস। ভাল লাগে। বড় ভাল লাগে। মাঝে মাঝে একটা চমকা ভয় বুক খামচে ধরে। চলে যেতে হবে কলকাতা ছেড়ে? সে কলকাতার বাইরে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না যেন। কলকাতার বাইরে গিয়ে তার কখনও ভাল লাগেনি। একবার লেগেছিল। শিমুলতলায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *