অধ্যায় ৬৪ – দ্য পার্শিয়ান ওয়ারস : পারস্যের যুদ্ধ
খ্রিস্টপূর্ব ৫২৭ থেকে ৪৭৯ সালের মাঝে দারিয়াস অ্যাথেন্সকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে গ্রিসের সব শহর সমন্বিতভাবে তার পুত্র জারক্সিসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
পারস্য সাম্রাজ্যের বিস্তার চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেও উত্তর-পশ্চিম অংশে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। সেখানে স্কাইথিয়ানরা বসবাস করত।
স্কাইথিয়া নামে সুনির্দিষ্ট কোনো অঞ্চল ছিল না। স্কাইথিয়ানদের অসংখ্য গোত্র ও অল্প কয়েকজন রাজা ছিল। তারা প্রায় ২০০ বছর ধরে যাযাবর জীবন যাপন করেছে। ৫১৬ সালে মূলত পশ্চিমের দানিউব ও পূর্বের ডন নদীর মাঝামাঝি অংশে তাদের বসবাস ছিল।
অ্যাসিরীয় নথি অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ সালে তাদেরকে যাযাবর হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং প্রায় ২০০ বছর পর, ৫১৬ সালে এসেও তাদের এই অবস্থানের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
৫১৬ সালে পারস্যের রাজা দারিউস স্কাইথিয়ানদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালানোর পরিকল্পনা শুরু করেন।
৬৪.১ স্কাইথিয়ানদের ‘দেশের বাড়ি’
দারিউস নিজেই রাজকীয় সড়ক ধরে সারদিসে এসে পৌঁছালেন। সেখান থেকে তার রাজত্বের একপ্রান্তে এসে পৌঁছালেন। স্কাইথিয়ানদের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে তিনি এশিয়া মাইনরের উপকূল ধরে হেলেসপন্ট দিয়ে বসফরাস প্রণালিতে তার নৌবাহিনীকে নিয়ে আসলেন। এরপর কৃষ্ণসাগর হয়ে দানিউব নদী পেরিয়ে অবশেষে নৌবাহিনী স্কাইথিয়ান রাজ্যের দক্ষিণপ্রান্তে এসে উপস্থিত হল।
অপরদিকে তার স্থলবাহিনী ইউরোপ পেরিয়ে আগাতে লাগল। দারিউস তার এক গ্রিক প্রকৌশলীকে বসফরাস প্রণালির উপর সেট নির্মাণের দায়িত্ব দিলেন। ম্যান্ড্রোক্লেস নামের এই আইওনিয়ান দায়িত্ব পেলেন।
বসফরাস প্রণালির সবধরনের মাপজোখের পর ম্যান্দ্রোক্লেস বিশ্বের প্রথম পন্টুন ব্রিজটি সেখানে নির্মাণ করলেন।
গ্রিক কবি অ্যাসচিলাসের বর্ণনায়, এই সেতুটি পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পরেও সেনাবাহিনীর সেতু নির্মাণের মডেল হিসেবে টিকে ছিল।
এই সেতুর উপর দিয়ে পারস্যের হাজারো সেনা ও ঘোড়সওয়ার যোদ্ধা পেরিয়ে গেলেন। এরপর তারা নৌবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হলেন এবং স্কাইথিয়ান ভূখণ্ডে প্রবেশ করার জন্য আরেকটি পন্টুন সেতু নির্মাণ করা হল। কাছাকাছি অবস্থিত শহর থ্রেস এসব কর্মকাণ্ড দেখেও তাদেরকে বাধা দেওয়ার কোনো চেষ্টা চালায়নি। থ্রেসের বেশিরভাগ মানুষ স্কাইথিয়ানদের ভয় পেতেন। তারা পারস্যের বাহিনীকে তাদের রক্ষাকর্তা হিসেবে বিবেচনা করলেন।
মজার বিষয় হল, স্কাইথিয়ানরা সংঘবদ্ধ হয়ে এই বিরাট বাহিনীর মোকাবিলা করার কোনো চেষ্টাই চালাল না। তারা বারবার পিছু হটে পালাতে লাগল। আর যাওয়ার সময় সব ঝর্না আর কূপ ধ্বংস করে এবং গাছপালা ও ঘাসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যেতে লাগল। ফলে, তাদের পেছনে আসা পারস্যের বাহিনী জঞ্জাল ও আবর্জনা ছাড়া কিছুই পেল না। স্বভাবতই, খাবার ও সুপেয় পানি খুঁজে পেতে তাদেরকে অনেক সমস্যায় পড়তে হল। ঘোড়া ও মানুষ, উভয়ই ক্ষুধার্ত হতে লাগল। একটিবারের জন্যেও তারা তাদের যুদ্ধের দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারল। ফলে সবাই হতাশ হয়ে পড়ল। হেরোডোটাস বলেন, ‘এর যেন কোনো অন্ত নেই। দারিউস নানা সমস্যায় পড়তে লাগলেন।’
পরিশেষে পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিলেন মহান রাজা দারিউস। পুরো পারস্যবাহিনী আবারও পদযাত্রা করে সেই দক্ষিণে ফিরে এল। আবার সেই পন্টুন সেতু পেরিয়ে দানিউবে এসে উপস্থিত হল তারা। স্কাইথিয়ানদের পরাজিত করা তো দূরে থাক, তাদের টিকিটারও দেখা পাননি দারউস। পারস্যের ইতিহাসবিদ ও লেখকরা এই সমস্যার সমাধান করলেন এভাবে—ইতিহাসের পাতা থেকে দানিউবের দক্ষিণের সব ভূখণ্ড ও এর অধিবাসীরা উধাও হয়ে গেল। যাদেরকে হারানো যায় না, তারা গুরুত্বপূর্ণও নন—এই নীতিতে আগালেন তারা।
তবে একেবারে খালিহাতে ফিরতে চাননি দারিউস। তিনি সারদিসে ফিরে যাওয়ার সময় তার সেনাবাহিনীকে সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেনাপতি মেগাবাজুসের দায়িত্বে ছেড়ে গেলেন এবং থ্রেস জয়ের নির্দেশ দিলেন।
মেগাবাজুস একজন দক্ষ যোদ্ধা ছিলেন এবং পারস্যবাহিনীতে দক্ষ সেনার অভাব ছিল না। থ্রেসের একের পর এক শহরের পতন হতে লাগল। থ্রেসের রক্ষক না হয়ে ভক্ষক হলেন দারিউস।
মেগাবাজুস থ্রেসকে পারস্যের সর্বশেষ সাতরাপিতে রূপান্তরিত করলেন আর নাম দিলেন স্কুদরা। এরপর তিনি দক্ষিণে যেয়ে মেসিডোনিয়ার দিকে নজর দিলেন।
থ্রেস ও গ্রিকের মূল ভূখণ্ডের মাঝে অবস্থিত মেসিডোনিয়া উল্লিখিত দুই জাতি থেকে বেশ খানিকটা ভিন্ন ছিল।
মেসিডোনিয়া অবিভক্ত ছিল না। একজন রাজা সমগ্র ভূখণ্ডের শাসক ছিলেন। মেসিডোনিয়ার অধিবাসীরা গ্রিসের আরগিয়াদ নামে এক যোদ্ধাগোষ্ঠীর বংশধর ছিলেন। কবি হেসিওদ মেসিডোনিয়ার বাসিন্দাদের গ্রিক বীরদের চাচাতো- মামাতো ভাই ও দেবতা জিউসের বংশধর হিসেবে চিত্রায়িত করেন।
আরগিয়াদ গোত্রের লোকজন উত্তরে এসে থারমাইক উপসাগরের আশেপাশের ভূখণ্ডগুলো দখল করে এবং সেখান থেকে কিছুটা উত্তরে রাজধানী শহর এইগের গোড়াপত্তন করে, যেটি ছিল প্রাচীন এদেসা দুর্গের কাছে অবস্থিত। এরপর তারা একটি সেনাবাহিনী গঠন করে এবং কর আদায় করতে শুরু করে। মেসিডোনিয়া ছিল ইউরোপের প্রথম সুসংহত রাষ্ট্র।
যখন মেগাবাজুস তার বাহিনী নিয়ে মেসিডোনিয়ায় হাজির হলেন, তখন সেখানে রাজত্ব করছেন রাজা এমিনতাস। তিনি ছিলেন নবম আরগিয়াদ রাজা। শুরুতে পারস্যবাহিনী পেইওনিয়ানদের শহরগুলো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল। মেসিডোনিয়ার ভূখণ্ডের খুব কাছাকাছি অবস্থিত এই শহরগুলোর পরিণতি দেখে অ্যামিনতাস অনুধাবন করলেন, পারস্যের বিরুদ্ধাচরণ করে লাভ হবে না।
মেগাবাজুসের ছেলের নেতৃত্বে সাতজনের একটি প্রতিনিধিদল মেসিডোনিয়ার সীমান্ত পেরিয়ে আসলে রাজা আমিনতাস তাদেরকে এইজিয়াতে অবস্থিত রাজপ্রাসাদে সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন।
হেরোডোটাস বলেন, “তারা রাজা দারিউসের জন্য ভূমি ও পানির দাবি জানাল”, যা ছিল পারস্যের তৎকালীন প্রথা, যার মাধ্যমে একটি অধিকৃত দেশের ভূখণ্ড ও জলসীমার ওপর আধিপত্য বিস্তার করা হয়। আমিনতাস এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। তিনি এমনকি তিনি মেগাবাজুসের ছেলের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দেওয়ারও প্রস্তাব জানালেন। মেসিডোনিয়ার জন্য এই মৈত্রী খুবই ফলপ্রসূ হয়। এরপর ইলিরিয়ান বা অবশিষ্ট পেইওনিয়ানরা তাদেরকে আর কখনো বিরক্ত করতে আসেনি।
এসব ঘটনায় দক্ষিণের গ্রিকরা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। মেসিডোনিয়া তখন পারস্যের মিত্র। ফলে পারস্যের উচ্চাভিলাষ ও গ্রিক উপদ্বীপের মাঝে আর তেমন কোনো বাধাই রইল না।
সেসময় গ্রিসের সবচেয়ে বড় দুই শহর, অ্যাথেন্স ও স্পার্টা, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল।
সোলোনের সংস্কারেও অ্যাথেন্সে শান্তি আসেনি।
অ্যাথেন্সবাসীদের মধ্যে তিনটি গোত্র ছিল। উপকূলের বাসিন্দারা (মেন অব দ্য কোস্ট) সোলোনের সংস্কার বজায় রাখতে চেয়েছিল। অ্যাথেন্সের মূল, সমতলভূমির বাসিন্দা ‘মেন অব দ্য প্লেইন’, সবচেয়ে ধনী অ্যাথেন্সবাসীদের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল এবং পাহাড়িরা (মেন অব দ্য হিলস) গণতন্ত্র চেয়েছিল।
পেইসিট্রাটাস ছিল গণতন্ত্রকামী পাহাড়িদের নেতা। অ্যারিস্টটলের ভাষায়, তিনি ছিলেন ‘উগ্র গণতন্ত্রপন্থী।
৬৪.২ পারস্যের যুদ্ধের সময় গ্রিসের পরিস্থিতি
নির্বাসিত পাহাড়ি নেতা পেইসিট্রাটাস নতুন করে ক্ষমতা দখলের চিন্তা শুরু করলেন। পেশিশক্তিতে পেরে না উঠে তিনি কৌশলের আশ্রয় নিলেন। তিনি গোপনে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর নেতা মেগাক্লেসের সঙ্গে আঁতাত করলেন। সমতলভূমির বাসিন্দাদের ‘খেদাও’ করার বিনিময়ে পেইসিট্রাটাস, মেগাক্লেসের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হলেন।
তবে পেইসিট্রাটাস ক্ষমতা ফিরে পেলেও তা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি। ‘বিছানায় স্ত্রীর সঙ্গে সঠিকভাবে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতেন না তিনি। অন্তত হেরোডোটাস তাই লিখে গেছেন। এ বিষয়ে মেয়ে তার মায়ের কাছে অভিযোগ করে, এবং সেই অভিযোগ পিতা মেগাক্লেসের কানে পৌঁছায়। পেইসিট্রাটাসের সঙ্গে মৈত্রী নিয়ে তিনি এমনিতেও খুব একটা খুশি ছিলেন না। মেয়ের এই মন্দ(!)ভাগ্যে রেগে গেলেন তিনি। আবারও সমতলভূমির বাসিন্দাদের সঙ্গে জোট বেঁধে পেইসিট্রাটাসকে উৎখাত করার পরিকল্পনা করলেন তিনি।
বিদ্রোহ, সশস্ত্র সংগ্রাম ও রাজনৈতিক কৌশল—সবই ব্যর্থ হল। এবার পেইসিট্রাটাস মনোযোগ দিলেন অর্থ-বিত্তের ব্যবহারে। প্রয়োজনে নিজের আসন ‘কিনে নেবেন’, এমন সংকল্প করলেন তিনি। ১০ বছর রুপার খনিতে কাজ করলেন তিনি। এরপর অর্জিত অর্থ দিয়ে ৫৪৬ সালে ভাড়াটে সেনা জোগাড় করে আবারও অ্যাথেন্সে হাজির হলেন তিনি। পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে তিনি অ্যাথেন্সের নাগরিকদের সব অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। তারপর থেকে তিনি গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েম করলেন।
তিনি ভাবলেন, অ্যাথেন্সবাসীদের ভালোর জন্যই তিনি তাদের ওপর এ- ধরনের শাসন কায়েম করেছেন।
৫২৮ সালে তার মৃত্যুর পর বড়ছেলে হিপ্পিয়াস (মেগাক্লেসের মেয়ের সন্তান নয়, আগের ঘরের সন্তান) উত্তরাধিকারসূত্রে রাজা হলেন। অ্যারিস্টটলের মতে, এই পরিবারে সংকট ঘনিয়ে আসল যখন হিপ্পিয়াসের ছোটভাই হিপ্পারকাস এক সুদর্শন যুবকের প্রেমে পড়লেন। তবে হারমোদিয়াস নামের সেই বালক একেবারেই হিপ্পারকাসের বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না।
আহত হিপ্পারকাস জনসম্মুখে মন্তব্য করলেন, হারমোদিয়াস ‘এক বেজন্মা। প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়লেন হারমোদিয়াস। তিনি এক বন্ধুর সহায়তায় হিপ্পারকাসকে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হত্যা করলেন। ভেবেছিলেন, উৎসবের হৈহুল্লোড়ে কেউ বিষয়টি টের পাবে না। কিন্তু বাস্তবে, রাজরক্ষীরা হারমোদিয়াসকে হত্যা ও তার সহযোগীকে গ্রেপ্তার করলেন।
ভাইয়ের মৃত্যুতে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন হিপ্পিয়াস। তিনি সেই তরুণ সহযোগীকে দীর্ঘদিন ধরে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা দিয়ে নির্যাতন করলেন। একপর্যায়ে, সেই তরুণ ‘স্বীকার’ করলেন, অ্যাথেন্সের অনেকেই হিপ্পিয়াস ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
হিপ্পিয়াস খুবই তিক্ত একজন মানুষে পরিণত হলেন। তিনি সেই তরুণ সহযোগী যাদের নাম নিয়েছিল, তাদের সবাইকে একে একে হত্যা করতে লাগলেন। অ্যাথেন্সবাসীদের এই দুর্দিন থেকে মুক্তি দিলেন স্পার্টার বৃদ্ধ রাজা ক্লিওমেনেস। ডেলফি নগরে এই রাজার প্রধান পূজারিনী তাকে বারবার জানাতে লাগলেন, তার স্বর্গীয় কর্তব্য হচ্ছে অ্যাথেন্সকে স্বৈরাচারমুক্ত করা। ৫০৮ সালে তিনি স্পার্টান বাহিনীর প্রধান হিসেবে অ্যাথেন্সের দিকে রওনা হলেন।
তবে ক্লিওমেনেস অ্যাথেন্সবাসীকে মুক্ত করতে নয়, বরং পারস্যের হুমকিতে বিপর্যস্ত হয়ে এই উদ্যোগ নেন। স্পার্টা আর পারস্যের মাঝে সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র বাধা ছিল এই অ্যাথেন্স। অ্যাথেন্স পারস্যের দখলে চলে গেলে স্পার্টার লেজ তুলে পালানো ছাড়া কিছু করার থাকবে না—এমনটাই ভাবলেন স্পার্টার রাজা।
স্পার্টান বাহিনী হিপ্পিয়াসকে উৎখাত করলেও অ্যাথেন্সের দখল নেয়নি। তারা অ্যাথেন্সবাসীকে ‘গণতান্ত্রিক’ নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ করে দেয়। তা সত্ত্বেও, তারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বিজেতা হিসেবে দেখার জন্য সবধরনের বন্দোবস্ত করে রাখে।
তবে অ্যাথেন্সবাসীর কাছে স্পার্টার এই চক্রান্ত লুকনো থাকেনি।
রাজসভার এক অজ্ঞাতনামা সদস্য মত দেন, স্পার্টার ঔদ্ধত্যকে নিয়ন্ত্রণে আনা তখনই সম্ভব হবে, যখন অ্যাথেন্সের থাকবে বড় ও শক্তিশালী কোনো মিত্ৰ। এরকম মিত্র কে হতে পারে? সবাই একবাক্যে স্বীকার করল, পারস্যই হতে পারে সেই মিত্র। এ বিষয়ে আলোচনা করতে সারদিসের পথে রওনা হলেন এক প্রতিনিধি। সেখানকার গভর্নর ও দারিয়াসের সৎভাই আরতাফ্রেনেসের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন সেই প্ৰতিনিধি।
দারিয়াসের পক্ষে তার ভাই এই আলোচনায় অংশ নিলেন। তিনি অ্যাথেন্সকে না-চেনার ভান করলেন এবং শর্ত দিলেন, তাদেরকে মাটি ও পানি পাঠালেই কেবল মৈত্রী কিংবা সহায়তা আসতে পারে।
এতে একমত হয়ে প্রতিনিধিরা প্রাণ নিয়ে অ্যাথেন্সে ফিরে এলেন।
পারস্য বা অন্য কারো কাছে ভূখণ্ডের দখল বা অর্থ দেওয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিল না স্বাধীনতাকামী অ্যাথেন্সবাসীর। তারা ঠিক করল, নিজেরাই স্পার্টার মোকাবিলা করবে। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অ্যাথেন্স থেকে স্পার্টার সব সেনাদের বিদায় করলেন।
স্পার্টানরা দৃশ্যপট থেকে বিদায় হুয়ার পর অ্যাথেন্সবাসী বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে তাদের শাসনব্যবস্থার সংস্কার করল। সমগ্র জনগোষ্ঠীকে ১০ গোত্রে ভাগ করা হল। অভিজাত পরিবারের আধিপত্য থেকে মুক্তি পেতে পুরো দেশকে ৩০টি ভৌগোলিক অঞ্চলে ভাগ করা হল, যেগুলোর নাম ‘দেমে’। প্রতিটি দেমের বাসিন্দাদের বলা হল নামের শেষে নিজ বংশের বদলে দেমের নাম যোগ করে নিতে। এই চিন্তাটি আগ্রহোদ্দীপক হলেও তা ধোপে টেকেনি—খুব শিগগির সবাই তাদের বংশপ্রদত্ত নামে ফিরে যান।
অ্যাথেন্স থেকে সাবেক স্বৈরশাসক হিপ্পিয়াসের সব বন্ধু ও আত্মীয়-পরিজনকে বিতাড়ন করা হল—জানিয়েছেন অ্যারিস্টটল।
অপরদিকে অপর এক গ্রিক শহর পারস্যের বন্ধুত্ব পেতে চাইল। পারস্য শাসিত এশিয়া মাইনরের একপ্রান্তে অবস্থিত আইওনিয়ান শহর মিলেতাসের নেতা ছিলেন অ্যারিস্তাগোরাস। তিনিও বেশ কয়েক বছর ধরে কঠোর হাতে নিজ দেশ শাসন করে এসেছেন। তিনি সারদিসের গভর্নরের কাছে যেয়ে প্রস্তাব দিলেন, পারস্য যদি তাকে সেনা ও জাহাজ দেয়, তাহলে তিনি সাইক্লেডস নামের গ্রিক দীপপুঞ্জ দখল করবেন পারস্যের নামে।
আরতাফ্রানেস এতে সম্মতি দিলেন। অ্যারিস্তাগোরাস খুশিতে ডগমগ হয়ে তার নিজের ও পারস্যের বাহিনী নিয়ে প্রথম লক্ষ্যবস্তু, নাক্সোসের উদ্দেশে রওনা হলেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তার এই অভিযান সফল হয়নি। নাক্সোসের বাসিন্দারা সম্মুখযুদ্ধে না-যেয়ে শহরের প্রাচীরের ভেতর সব উপকরণ ও রসদ জমিয়ে রেখে প্রতিরক্ষা ৗশল হাতে নেয়। চার মাস চেষ্টা করেও প্রাচীর ভেদ করতে ব্যর্থ হলেন অ্য।।রস্তাগোরাস। ফুরিয়ে এল তার হাতে থাকা পারস্যের অর্থ। আরতাফ্রানেসও এই প্রকল্পে আর অর্থ খরচ করতে রাজি হলেন না। ভগ্ন হৃদয়ে, কালিঝুলিমাখা মুখ নিয়ে মিলেতাস শহরে ফিরে এলেন অ্যারিস্তাগোরাস।
এবার তিনি পারস্যপন্থী থেকে পারস্যবিরোধী হবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি চেয়েছিলেন এশিয়া মাইনরের গ্রিক শহরগুলোর নেতৃত্ব দিইয়ে পারস্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবেন। তার মনে স্বপ্ন ছিল, এই অভিযান সফল হলে সব গ্রিক শহর তার পদতলে আসবে।
তিনি একটু খোঁজখবর করে জানতে পারলেন, খুব সম্ভবত অন্যান্য আইওনিয়ান একনায়করা তার সঙ্গে যোগ দেবেন। তবে নাক্সোসের পরাজয় তাকে বড় শিক্ষা দিয়েছিল। পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার আগে আরও সমর্থন প্রয়োজন—এটা তিনি অনুধাবন করলেন।
প্রথমেই তার মাথায় এল স্পার্টার কথা। গ্রিকের নগরভিত্তিক রাজ্যগুলোর একটি জোট ছিল, যার নাম পেলোপোনেশিয়ান লিগ। স্পার্টার নেতৃত্বাধীন এই জোটের লক্ষ্য ছিল সম্মিলিতভাবে বহিঃশত্রুর মোকাবিলা। স্পার্টা যদি পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যায়, তাহলে এই লিগের অন্যান্য শহরেরও সেই যুদ্ধে যাওয়ার কথা—অন্তত কাগজে-কলমে। অ্যারিস্তাগোরাস স্পার্টায় এসে ক্লিওমেনেসের সঙ্গে দেখা করলেন। তাকে পারস্যে হামলা চালানোর প্রস্তাব দেওয়ার পর তিনি প্ৰথমে ভাবলেন অ্যারিস্তাগোরাস ঠাট্টা করছেন। পরে যখন দেখলেন তিনি আসলেই এ কাজ করতে চান, তখন তিনি তাকে হাসতে হাসতে স্পার্টার সীমান্ত থেকে বের করে দিলেন।
স্পার্টার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অ্যাথেন্সে ফিরে এলেন অ্যারিস্তাগোরাস। সেখানে তার কথা শোনার মতো কিছু মানুষ খুঁজে পেলেন তিনি।
অ্যাথেন্সের ক্ষমতাচ্যুত একনায়ক হিপ্পিয়াস আবারও ফিরে আসার হুমকি দিচ্ছিলেন।
তিনি গ্রিস থেকে পালিয়ে হেলেসপন্ট পেরিয়ে পারস্যবাসীদের কাছে যেয়ে সাহায্য চাইলেন। তার পরিকল্পনা শুনে আরতাফ্রেনেসের ধারণা হল, হিপ্পিয়াসই হতে পারেন গ্রিসে প্রবেশের উপযুক্ত মাধ্যম। তিনি অ্যাথেন্সবাসীদের কাছে বার্তা পাঠালেন, “হিপ্পিয়াসকে ফিরিয়ে নাও আর নয়তো পারস্যের বিরাগভাজন হও”। ঠিক সে-মুহূর্তে অ্যারিস্তাগোরাস পারস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্রস্তাব নিয়ে সেখানে এসেছিলেন।
পারস্যের এই হুমকিকে পাত্তা দেয়নি অ্যাথেন্স। তারা অ্যারিস্তাগোরাসের বিদ্রোহে সহায়তা করতে ২০টি জাহাজ পাঠাল। অপরদিকে ইরিত্রিয়া থেকে এল আরও ২৫টি জাহাজ। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালে যুদ্ধ শুরু হল।
পারস্যের ইতিহাসে এই যুদ্ধের তেমন কোনো উল্লেখ নেই। অপরদিকে, গ্রিক ইতিহাস পড়লে মনে হবে এ ২০ বছর গ্রিসের মানুষ এই যুদ্ধে অংশ নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করেনি।
একাধিক গ্রিক ইতিহাসবিদের মতে, এই ‘পার্শিয়ান ওয়ার’ মানবসভ্যতার উৎকর্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে পারস্যের দৃষ্টিতে এগুলো খণ্ডযুদ্ধ ছাড়া কিছুই না।
এই বিদ্রোহে যোগ দেওয়া আইওনিয়ান শহরগুলো দারিউসের নৌবাহিনীর ৩০০ জাহাজ নিয়ে এগিয়ে আসে। জাহাজগুলোতে গ্রিক কর্মীরা নিযুক্ত ছিলেন। দারিউস তাৎক্ষণিকভাবে আইওনিয়ানদের দমন করতে তার সুপ্রশিক্ষিত বাহিনীকে পাঠিয়ে দেন।
পারস্য ও আইওনিয়ান বাহিনী এপহেসুসে যুদ্ধ শুরু করল। খুব শিগগির আইওনিয়ানরা ধ্বংস হল। অ্যাথেন্সবাসীরা টের পেল, এই যুদ্ধে শুভ ফল আসার সম্ভাবনা কম। তাই তারা লেজ তুলে বাড়ি ফিরে গেল। কিন্তু আইওনিয়ানদের হাতে আর কোনো বিকল্প না-থাকায় তারা যুদ্ধ চালিয়ে গেল।
আইওনিয়ান নৌবাহিনী হেলেসপন্টের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যেয়ে বাইজ্যানটিয়াম শহরে মোতায়েন পারস্যের সেনাবাহিনীকে শহর থেকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হল। এরপর জাহাজগুলো উপকূল ঘেঁষে ফিরে যাওয়ার পথে আরও মিত্র সংগ্রহ করতে লাগল। সব মিলিয়ে, বিদ্রোহ ততদিনে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ফলে পারস্য এই যুদ্ধে বছরের পর বছর ব্যতিব্যস্ত রইল।
অবশেষে খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৪ সালে ৬০০ জাহাজ নিয়ে পারস্যের যোদ্ধারা আইওনিয়ানদের পরাজিত করতে সক্ষম হল। মিলেতাসের কাছে, খোলা সাগরে এই নৌযুদ্ধ হল। আইওনিয়ানদের অসংখ্য জাহাজ ধ্বংস হল। গ্রিকরা পরাজয়ের সম্মুখীন হল। আইওনিয়ান নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল সিসিলিতে পালিয়ে যেয়ে জলদস্যুতে পরিণত হলেন।
অ্যারিস্তাগোরাস নিজেই এশিয়া মাইনরে পালিয়ে গেলেন। সেখান থেকে থ্রেসের এক শহর দখল করার সময় তিনি নিহত হন।
বিজয়ী পার্শিয়ান জাহাজগুলো মিলেতাসের উপকূলে এসে ভিড়ল। এটাই ছিল অ্যারিস্তাগোরাসের শহর। তারা এই শহরকেও পরাভূত করল। হেরোডোটাস জানান, “শহরের বেশিরভাগ বাসিন্দাকে হত্যা করা হয়। যারা বেঁচে ছিলেন, তাদেরকে, বিশেষত নারী ও শিশুদের ধরে সুসায় নিয়ে দাসত্ব করতে বাধ্য করা হল।”
দারিয়াস তাদেরকে তাইগ্রিসের মুখে ঘাসাচ্ছাদিত অঞ্চলে পুনর্বাসিত করলেন। এখানে এককালে চালদিয়ানরা বসবাস করত। দূর থেকে অ্যাথেন্সবাসী এসব ঘটনাক্রমে দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হল। মিলেতাস একসময় অ্যাথেন্সেরই অংশ ছিল-এই অঞ্চলের ভয়াবহ ও করুণ পরিণতি অ্যাথেন্সকেও প্রভাবিত করে।
তবে এখানেই গল্প শেষ হয়নি। দারিউস ভুলে যাননি যে, শুরুতে এই বিদ্রোহের আগুনে তেল ঢেলেছিল অ্যাথেন্স ও ইরিত্রিয়া। ৪৯২ সালে তিনি তার সেনাপতি ও জামাতা মারদোনিয়াসের নেতৃত্বে একটি স্থল ও নৌবাহিনী পাঠালেন এই শত্রুদের শায়েস্তা করতে।
তবে গ্রিসের বিরুদ্ধে পারস্যের এই প্রথম, বৃহত্তর অভিযান শুরুর আগেই শেষ হয়ে যায়। গন্তব্যে পৌঁছানোর অল্প সময় আগে মাউন্ট আথোসের কাছে পারস্যের প্রায় সব জাহাজ এক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ধ্বংস হয়। নৌবাহিনীর সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা না-থাকায় স্থলবাহিনীও পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
পুনর্গঠিত হতে পার্শিয়ানদের পুরো দুই বছর লেগে যায়। ৪৯০ সালে নতুন বাহিনী আবারও প্রস্তুত হল। আবারও যুদ্ধে গেলেন মারদোনিয়াস।
৬০০ জাহাজ নিয়ে পার্শিয়ানরা রওনা হল। এই নৌবহর এতটাই বিশাল ছিল যে এবার তারা আর স্থলবাহিনী পাঠানোর প্রয়োজনবোধ করল না। একটি জাহাজে ছিলেন হিপ্পিয়াস। তাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, অ্যাথেন্স পরাজিত হলে তিনি সেখানে একনায়ক হিসেবে শাসন করবেন।
কয়েকদিনের মাঝেই নাক্সোস, ইরিত্রিয়ার পতন হল। পরবর্তী লক্ষ্য ছিল অ্যাথেন্স ও আত্তিকার রানী।
পরিত্রাণের কোনো উপায় না-দেখে মরিয়া প্রচেষ্টা হিসেবে অ্যাথেন্সবাসী স্পার্টার কাছে সাহায্য ভিক্ষা চেয়ে দূত পাঠাল।
কথিত আছে, এই দূত ছিলেন একজন প্রশিক্ষিত রানার বা ‘ফেইদিপ্পিদেস’, তিনি দুই অঞ্চলের মাঝের ১৪০ মেইল দূরত্ব ২৪ ঘণ্টার মাঝেই পেরিয়ে যান। হেরোডোটাস হয়তো একটু বাড়িয়েই বলেছিলেন, তবে সময়টা ২৪ ঘণ্টা না হলেও দূরত্বে কোনো ভুল ছিল না। কিন্তু স্পার্টা এই আহ্বানে সাড়া দেয়নি।
স্পার্টানরা ধার্মিক জাতি ছিল। খুব সম্ভবত তারা পারস্যের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যেতে চায়নি।
পারস্যের বাহিনী মূলত অ্যাথেন্সকে শাস্তি দিতে এসেছিল। যেসব গ্রিক নগর আইওনিয়ান বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল, সেগুলোই মূলত পারস্যের রুদ্ররোষে পড়ে। স্পার্টা কখনোই এই বিদ্রোহে যোগ দেয়নি।
অ্যাথেন্সবাসী কোনো বিকল্প না-পেয়ে পারস্যের বিরুদ্ধে লড়তে প্রস্তুত হয়। তাদের কোনো বাইরের সাহায্য বা মিত্র ছিল না।
তিনি অ্যাথেন্সের যোদ্ধা হপলাইটদের কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী উপায়ে সাজালেন। কেন্দ্রে অল্প সেনা রেখে দুইপাশে (উইং) বেশি সেনা মোতায়েন করলেন তিনি। হপলাইটদের নামকরণ হয় তাদের ঢালের নামে—হপলন। এই ঢালের একপাশে ধরার জন্য গ্রিপ ছিল; কেন্দ্রের পরিবর্তে। হপলনের উপযোগিতা ছিল, এতে ডানহাতে বল্লম ধরা সুবিধাজনক হয় আর বামহাতে ঢাল ব্যবহার করা যায়। ফলে যোদ্ধার ডানপাশে কিছুটা অনাবৃত অংশ থাকলেও বাঁয়ে খুবই মজবুত প্রতিরক্ষা থাকে। অপর এক হপলাইট কাছে থাকলে এই দুর্বলতা দূর হয়। এ- ধরনের বর্ম ও ঢালের জন্য সেরা কৌশল ছিল একত্রিত ও সমন্বিত ফর্মেশন, যাকে ইংরেজিতে ফ্যালাংক্স বলা হয়। একা একজন হপলাইট খুবই দুর্বল ও ভঙ্গুর। কিন্তু ফ্যালাংক্স ফর্মেশনে থাকা একদল হপলাইটকে পরাজিত করা খুবই কষ্টকর ছিল।
দীর্ঘদিনের সুশৃঙ্খল প্রশিক্ষণ ও মরিয়া পরিস্থিতি অ্যাথেন্সের জন্য ইতিবাচক প্রভাব এনে দেয়। হেরোডোটাস বলেন, ‘পারস্যের যোদ্ধাদের দেখেই অ্যাথেন্স বাহিনী তাদের দিকে বিদ্যুদ্বেগে ছুটে যায়।’ এই পরিস্থিতি দেখে ইরানিরা (তৎকালীন পার্শিয়ান) ভাবেন, অ্যাথেন্সের যোদ্ধারা পাগল হয়ে গেছে। কার্যত, অ্যাথেন্সের সেই মধ্যের সেনারা খুব দ্রুতই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। কিন্তু দুই উইংয়ের সেনারা পার্শিয়ানদের তাদের মাঝে নিয়ে আসেন এবং ফ্যালাংক্স ফর্মেশনের মৃত্যুফাঁদ থেকে বাঁচতে তারা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হন। তারা তাদের জাহাজের দিকে ফিরে যাওয়ার সময় অনেকেই সেই ঘাস ও নলখাগড়া আচ্ছাদিত ভূমিতে পড়ে যান। অনেকে তাদের ভারী বর্মের ওজন বহন করতে সমস্যায় পড়েন।
অনেক পার্শিয়ান তাদের জাহাজে ফিরে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু অ্যাথেনিয়ানরা সাতটি জাহাজ দখল করে ও অসংখ্য হামলাকারীকে হত্যা করে। হেরোডোটাসের মতে, ৬ হাজার ৪০০ পার্শিয়ানের বিপরীতে মাত্র ১৯২ জন অ্যাথেনিয়ান মারা পড়েন।
হতাহতের সংখ্যা নিঃসন্দেহে অতিরঞ্জিত। তবে ‘ম্যারাথনের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত এই যুদ্ধটি ছিল অ্যাথেন্সের জন্য বড় এক বিজয়। তারা ‘রাক্ষস’কে পরাভূত করতে পেরেছিল।
হিন্দি সিনেমার পুলিশের মতো স্পার্টানরা পরিশেষে সাহায্য করতে এসেছিল, কিন্তু লাশ গণনা ছাড়া আর কিছুতে তাদের সাহায্যের প্রয়োজন পড়েনি।
ম্যারাথনের যুদ্ধে যারা লড়েছিলেন, পরবর্তীতে তাদেরকে সম্মানিত করতে ‘ম্যারাথনোমাচোই’ নামকরণ করা হয়। একইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যারা লড়েছিলেন, তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র সম্মান দেয়। বিজয়ী সেনাপতি মিলতিয়াদেসের পরিণতি অবশ্য বেশ করুণ। পরবর্তীতে পারস্যের প্রতি বিশ্বস্ত পারোস দ্বীপ দখল করতে না-পারার দায়ে তাকে সেনাপতির পদ থেকে বের করে দেওয়া হয়। তাকে বিচারের আওতায় আনা হয়। বিচারাধীন অবস্থায় সেই ব্যর্থ অভিযান থেকে পাওয়া ক্ষত পচে গ্যাংগ্রিন হয়ে তিনি মারা যান।
অপরদিকে দারিউস গ্রিসের সঙ্গে নতুন করে যুদ্ধ করার নানা পথ বিবেচনা করে দেখছিলেন। ম্যারাথন যুদ্ধের চার বছর পর, ৪৮৬ সালে গ্রিসে কর বাড়ানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন। প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্রোহ করে মিশর। কিন্তু মিশরকে শায়েস্তা করার সুযোগ পাননি দারিউস। একই বছরে তিনি অসুস্থ হন এবং শীতের আগেই তার মৃত্যু হয়।
বড় ছেলে জারক্সিস তার স্থলাভিষিক্ত হলেন।
জারক্সিস নিবিড়ভাবে তার বাবার শাসনামলকে অনুসরণ করছিলেন। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পরপরই কিছু বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে—এটা নতুন কিছু নয়। ব্যাবিলনের বিদ্রোহ দমনে তিনি শহরটিকে দুটি ছোট আকারের সাতরাপিতে বিভক্ত করলেন। ফলে খুব সহজেই কিছু গোত্র একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিদ্রোহের আগুন স্তিমিত হতে লাগল। পেশিশক্তি দিয়েই তিনি মিশরকে দমন করলেন। ফলে মিশর ও পারস্য, উভয় জায়গাতেই “দুই দেশের প্রভু” নাম পেলেন তিনি, যার প্রমাণ রয়েছে অসংখ্য শিলালিপিতে।
এরপর তিনি গ্রিসের দিকে নজর দিলেন। ৪৮৪ সাল নাগাদ তার সাম্রাজ্যের সব বন্দরে জাহাজ নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হল। গ্রিক ভাড়াটে সেনারা ২২০টি জাহাজে নিয়োগ পেলেন। ২০০ জাহাজ এল মিশর থেকে। মিশরীয়রা জারক্সিসকে আরেকটি পন্টুন সেতু নির্মাণে সহায়তা করল। এটা দারিয়াসের সেতুর চেয়ে খানিকটা দক্ষিণে অবস্থিত ছিল।
অ্যাথেন্সে নির্মিত হচ্ছিল ট্রাইরেম জাহাজের বহর। এই লম্বা, কিন্তু চিকন আকৃতি জাহাজগুলো বাইতে ১৭০ জন মাঝির প্রয়োজন পড়ত। এই দ্রুতগতির জাহাজগুলো ছিল ১২০ ফুট লম্বা ও মাত্র ১৫ ফুট চওড়া। অ্যাথেন্স ও ৩০টি শহর নতুন এক জোট গঠন করল—হেলেনিক লিগ। এর একমাত্র লক্ষ্য ছিল গ্রিসকে পারস্যের আগ্রাসন থেকে সুরক্ষিত রাখা। এই পারস্য-বিরোধী জোটে সবচেয়ে অভিজ্ঞ বাহিনী ছিল স্পার্টার, যারা এর আগে অনিচ্ছা দেখালেও অবশেষে পারস্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে রাজি হয়েছিল।
একই বছরের হেমন্তঋতুতে জারক্সিস নিজেই তার সেনাদের পদযাত্রার মাধ্যমে সারদিসে নিয়ে আসলেন। সেখানে শীতকাল পর্যন্ত তারা বিশ্রাম নিয়ে দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি দূর করলেন এবং শক্তি ফিরে পেলেন। ৪৮০ সালের বসন্তকালে তিনি তাদেরকে সেই পন্টুন সেতু পেরিয়ে হেলেসপন্টে নিয়ে আসলেন।
গ্রিকরা উত্তরাঞ্চলের প্রতিরোধে খুব একটা ভরসা রাখেনি। তারা তাদের মূল বাহিনীকে মালিয়ান উপসাগরের ঠিক নিচের অংশে মোতায়েন করে। থারমোপিলিতে এই সেনাসমাবেশ ঘটেছিল। এটাই ছিল উপদ্বীপের দক্ষিণে পৌঁছানোর জন্য জারস্কিসের কাছে থাকা একমাত্র পথ। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে একটি লুকনো সড়কপথও ছিল, তবে জারক্সিস সেটা আবিষ্কার করে ফেলবেন, এমনটা ভাবেনি কেউই। ইউবিয়ার উত্তরে নৌবাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হয়।
গ্রিসের বেশিরভাগ মানুষ বড়ধরনের বিপর্যয়ের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অ্যাথেন্সবাসী ও সেখানে বসবাসরত বিদেশিরা তাদের নারী ও শিশুদের ট্রোইজেনের নিরাপদ অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয় এবং বৃদ্ধ ব্যক্তি ও স্থানান্তরযোগ্য সম্পদগুলোকে সালামিসে পাঠায়।
অশরীরীর মতো নেমে আসল জারক্সিস ও তার বাহিনী। থ্রেস আত্মসমর্পণ করল। তারপর মেসিডোনিয়ার শহরগুলোরও পতন হতে লাগল। জারক্সিস গ্রিসের মূল ভূখণ্ড দিয়ে পদযাত্রা করছিল। যদি তিনি পর্বত পেরিয়ে যেতে পারেন, তাহলে দক্ষিণের শহরগুলো বিপদে পড়ে যেত। আত্তিকার এক সেনাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সেই গোপন পর্বতপথের ওপর নজর রাখতে। তবে থার্মোপিলির গুরুত্বপূর্ণ পথের সুরক্ষা দেওয়া দায়িত্ব পান স্পার্টার সাত হাজার যোদ্ধা। ক্লেওমেনেসের উত্তরাধিকারী স্পার্টান রাজা লিওনাইডাস ছিলেন তাদের অধিনায়ক।
সব ঠিকভাবে চললে এই অপ্রশস্ত ভূমিতেই পারস্য ও গ্রিসের লড়াই হত। কিন্তু গ্রিকদের এক বিশ্বাসঘাতক জারক্সিসকে সেই লুকানো পার্বত্যপথের মানচিত্র এঁকে দিয়ে আসে। জারক্সিস তার বাহিনীর ১০ হাজার সেনার মধ্যে সবচেয়ে সুপ্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ একটি দলকে এক সেনাপতির নেতৃত্বে এই পার্বত্যপথে পাঠান। হেরোডোটাস এই পেশাদার ও দক্ষ বাহিনী ‘দ্য ইমমর্টালস (অমর যোদ্ধা)’ নামে পেছনদিক দিয়ে, পার্বত্যপথ ধরে এই অমর যোদ্ধারা স্পার্টানদের পেছনে এসে পৌঁছাল।
লিওনাইডাস টের পেলেন, তার বাহিনী দুইদিক দিয়ে ‘স্যান্ডউইচ’ হতে যাচ্ছে এবং পরাজয় অবধারিত। এ অবস্থায় তিনি তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ৩০০ সেনা ছাড়া বাকি সবাইকে দক্ষিণদিক দিয়ে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এই ৩০০ সেনা ও থেবেস ও থেসপিয়া থেকে আসা অল্পকিছু সেনা (যারা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেছিল) নিয়ে এক অবিশ্বাস্য প্রতিরোধ গড়ে তোলেন লিওনাইডাস। এই সত্য ঘটনার এক কল্পরূপ দেখা যায় হলিউডের সিনেমা ‘থ্রি হানড্রেড’-এ। তবে যুদ্ধ জয় নয়, জারক্সিসের বিজয়রথকে কিছুটা বিলম্বিত করতে জানপ্রাণ দিয়ে লড়ে যায় স্পার্টার বীর সেনারা।
লিওনাইডাস ভাবলেন, আত্তিকা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, কিন্তু স্পার্টার বাকি সেনারা ফিরে যেতে পারলে পেলোপোনিস, ট্রইজেন ও সালামিসকে রক্ষা করতে পারবে, যেখানে গ্রিসের বাকি মানুষ, নারী ও শিশুরা রয়েছে।
নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত স্পার্টানরা যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। যুদ্ধে ইমমর্টালরাও নিশ্চিহ্ন হলেন। জারক্সিসের দুই আপন ভাই মারা গেলেন। পরবর্তীতে এই ঘটনা মানব-ইতিহাসের সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের অন্যতম হিসেবে আখ্যায়িত হয়। জারক্সিস ঘটনাপ্রবাহে একটুও খুশি হতে পারেননি। তিনি লিওনাইডাসের মরদেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করলেন।
প্লুটার্ক আমাদেরকে জানান, বিব্রত ও বিপর্যস্ত গ্রিকরা পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে বিতর্কে মেতে ওঠেন। সম্মিলিত গ্রিক সেনাদলে অ্যাথেন্সের সদস্যরা আত্তিকা রক্ষার জন্য আর্জি জানায়, কারণ অ্যাথেন্সকে রক্ষার সেটাই শেষ উপায় ছিল। কিন্তু অন্যেরা পারস্যের সুবিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে লড়ার সাহস পেল না।
পরিশেষ পুরো বাহিনী পেলোপোনিসে ফিরে এল। সেখানে সালামিস দ্বীপের চারপাশে সব জাহাজকে প্রতিরক্ষার জন্য মোতায়েন করা হল এবং ‘ইসথমাস অব করিন্থ’ নামের নিচু ও অপ্রশস্ত সেতুর চারপাশে স্থলবাহিনীকে মোতায়েন করা হল। পেলোপোনিস থেকে আত্তিকার মাঝে এই সেতুর মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছিল।
জারক্সিস তার বাহিনী নিয়ে বিনাবাধায় অ্যাথেন্স জয় করলেন। অ্যাথেন্সবাসী পেলোপোনিসে বসে দেখতে পেল, তাদের অ্যাক্রোপোলিস জ্বলছে। হতাশ ও রাগান্বিত অ্যাথেন্সবাসীর ধারণা হল, তাদের সঙ্গে মিত্ররা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
পারস্যের এক বার্তাবাহক রাজধানী সুসায় ফিরে জারক্সিসের মাকে খবর দিলেন—তার সন্তান পেলোপোনিসে গ্রিকদের ওপর হামলা চালাতে উদ্যত হয়েছে।
এসময় গ্রিক নেতা থেমিসতোক্লিস জারক্সিসের কাছে বার্তা পাঠিয়ে পক্ষ পরিবর্তনের প্রস্তাব দিলেন। তিনি জানালেন, এ মুহূর্তেই গ্রিকদের ওপর হামলা চালালে জারক্সিসের জয় নিশ্চিত। তারা ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ও মনোবলহীন। জারক্সিস ভেবেছিলেন পেলোপোনিসের চারদিক নৌবাহিনী দিয়ে ঘিরে ধরা—সেক্ষেত্রে বাইরে থেকে কোনো পণ্য বা সাহায্য সহায়তা সেখানে আসতে পারত না, আর খুব শিগগির তারা আত্মসমর্পণ করত। কিন্তু থেমিসতোক্লিসের বার্তা পেয়ে জারক্সিস সরাসরি সেই অপ্রশস্ত পথে জাহাজ পাঠালেন, যেখানে অ্যাথেন্সের ট্রাইরেম জাহাজগুলো প্রহরা দিচ্ছিল।
ঠিক এটাই চাচ্ছিলেন থেমিসতোক্লেস। সালামিসের অপ্রশস্ত পানিতে ট্রাইরেমগুলো পারস্যের অধিকতর শক্তিশালী জাহাজের চেয়ে বেশি উপযোগী ছিল।
অবিশ্বাস্য হলেও, এই যুদ্ধে পরাজিত হল জারক্সিসের নৌবাহিনী।
জারক্সিস একটি উঁচু জায়গায়, স্বর্ণের তৈরি টুলে বসে যুদ্ধ ‘উপভোগ’ করছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের এই হাল দেখে তিনি খুবই রাগান্বিত হলেন। এই যুদ্ধে তার সব ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়নি—চাইলেই তিনি আবারও শক্তি সঞ্চয় করে গ্রিকদের পরাজিত করতে পারতেন। কিন্তু তার প্রচণ্ড ক্রোধই তার পতনের কারণ হলেন। তিনি তার নৌবাহিনীর অধিনায়কদের কাপুরুষতার অভিযোগে ফাঁসির আদেশ দিলেন। কিন্তু নাবিকরা সবাই ছিলেন ফিনিশীয়—তারা এই নির্দেশ না- মেনে জারক্সিসের বিরুদ্ধে চলে গেলেন।
অপরদিকে ব্যাবিলনেও বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠতে লাগল। আর চতুর থেমিসতোক্লিস যথারীতি তার কূটকৌশলের প্রয়োগ করতে লাগলেন। তিনি পারস্যের এক যুদ্ধবন্দিকে মুক্তি দিলেন। কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার আগে তাকে দিলেন মিথ্যে তথ্য। সেই বন্দি জারক্সিসের কাছে এসে বললেন, গ্রিক নৌবহর হেলেসপন্টে যেয়ে পন্টুন সেতু ধ্বংস করবে, যাতে তিনি ও তার বাহিনী দেশে ফিরতে না পারেন। এই খবরে জারক্সিস দ্রুত বাড়ি ফিরতে মনস্থ করলেন।
তিনি ঘোষণা দিলেন, যে থেমিসতোক্লিসকে বন্দি করতে পারবে, তাকে পুরস্কৃত করা হবে। এরপর তিনি ভাব দেখালেন যে, এ অঞ্চল রক্ষার জন্য একটি বাহিনী রেখে যাচ্ছেন—আদতে তিনি তার বাহিনীর বেশিরভাগ সেনা নিয়ে মেসিডোনিয়া হয়ে থ্রেসের উদ্দেশে রওনা হলেন, আর সেখানে রেখে গেলেন জামাতা মারদোনিয়াসের নেতৃত্বে একটি প্রতীকী বাহিনী। বস্তুত, তিনি মারদোনিয়াসকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে গেলেন। লেজ তুলে পালানোর অপমান থেকে বাঁচতেই তিনি এই কাজ করলেন।
অ্যাথেন্সের বাহিনী ইসথমাস অব করিন্থ পেরিয়ে প্লাশিয়ায় মারদোনিয়াসের ক্ষুদ্র বাহিনীর মুখোমুখি হল।
লিওনাইডাসের ভাইপো পাউসানিয়াস উত্তরাধিকারসূত্রে সেনাপতির দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তিনি একইসঙ্গে লিওনাইডাসের তরুণ পুত্রের (তিনি স্পার্টার নতুন রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন) প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি এই হামলায় নেতৃত্ব দেন। গ্রিকরা জয়ী হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন মারদোনিয়াস হেরোডোটাস বলেন, ‘যুদ্ধের একদিন পর তার মরদেহ হারিয়ে যায়। কেউ জানে না তাকে কোথায় সমাহিত করা হয়েছিল।’
অপরদিকে জাহাজে করে পলায়নরত পার্শিয়ানদের ধাওয়া করে অ্যাথেন্সের নৌবহর। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা নৌযুদ্ধ না করে মাইকালে নামের এক জায়গায় জাহাজ থেকে নেমে স্থলযুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। পারস্যবাহিনী ভেবেছিল তাদের সাথে থাকা আইওনিয়ানরা তাদেরকে বাড়তি সুবিধা দেবে। কিন্তু খুব শিগগির আইওনিয়ানরা পরাজিত হয়। অ্যাথেন্স ও স্পার্টার সমন্বিত বাহিনী পারস্যবাসীদের সারদিস পর্যন্ত ধাওয়া করে। এসময় অসংখ্য পার্শিয়ান সেনা নিহত হন। অল্প কয়েকজন সারদিস পর্যন্ত জীবিত পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
প্লাশিয়া ও মাইকালের যুদ্ধে জয়ের মধ্যদিয়ে অবসান ঘটে গ্রিসের বিরুদ্ধে পারস্যের আগ্রাসন, যা ‘পার্শিয়ান ওয়ারস’ নামে পরিচিত। এই পরাজয়ে পারস্যের তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও, তারা পরবর্তীতে আর নৌবহর গঠনের চেষ্টা চালায়নি। অপরদিকে, স্পার্টা থেকে শুরু করে আইওনিয়ান উপকূল পর্যন্ত, সবগুলো গ্রিক শহর স্বেচ্ছায় জোটবদ্ধ হয়। এটাই ছিল সমগ্র গ্রিক জগতের প্রথম সমন্বিত উদ্যোগ। সেবারই প্রথমবারের মতো সমগ্র গ্রিক জগৎ কোনো রাজনৈতিক কারণে নয়, বরং একই ধরনের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাষার মাধ্যমে একত্রিত হয়েছিল।