অধ্যায় ৬১ – রাজত্ব ও সংস্কারকামীরা
খ্রিস্টপূর্ব ৫৬০ থেকে ৫০০ সালের মধ্যে ভারত বিভিন্ন রাজত্বে ভাগ হয়ে যায়। তৈরি হয় অসংখ্য মৈত্রী ও জোট। এসবের মাঝে বিশেষ সাফল্য পায় মগধ রাজত্ব।
মহাভারতের পৌরাণিক যুদ্ধের পর ভারতের সব যুদ্ধবাজ গোত্রগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও দরকষাকষি করে মোটামুটি স্থিতিশীল কিছু রাজত্ব গঠনের প্রচেষ্টা চালায়।
এ-ধরনের ১৬টি রাজত্বের বর্ণনা আছে বৌদ্ধদের কথ্য উপাখ্যানে, যা পরবর্তীতে লিপিবদ্ধ করা হয়। এসব রাজত্বের মধ্যে আছে ভারতযুদ্ধে অংশ নেওয়া প্রাচীন কিছু গোত্রের উত্তরসূরি রাজ্য কুরু, গান্ধারা ও পাঞ্চালা এবং দক্ষিণের রাজ্য আশুয়াকা, বিন্ধ্যা ও পার্বত্য অঞ্চল সাতপুরা। এছাড়াও শুষ্কভূমি ডেকান (দাক্ষিণাত্য) এবং গঙ্গানদীর তীরে অবস্থিত মগধ রাজ্যেরও উল্লেখ পাওয়া যায় সেখানে।
এই ১৬টি রাজত্বকে সমষ্টিগতভাবে মহাজনপদ বলে অভিহিত করা হয়। আর্য যোদ্ধারা নিজেদের ‘জন’ (গোত্রের সংস্কৃত শব্দ) হিসেবে অভিহিত করতেন। পরবর্তীতে এই যোদ্ধাদের মধ্যে যারা গঙ্গানদীর তীরে বসতি স্থাপন করে, তারা নিজেদেরকে জনপদ (ভূমিসমৃদ্ধ গোত্র) হিসেবে আখ্যায়িত করে। এই ১৬টি মহাজনপদের সদস্যরা অন্যান্য গোত্রদের পরাভূত করে তাদের জমির দখল নিয়েছিল। এসব রাজত্বে শাসকগোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন রাজা, তার আত্মীয়স্বজন ও যোদ্ধারা। এই গোত্রে যারা জন্ম নিতেন, তাদেরকে ক্ষত্রিয় বলা হত। তারাই ছিলেন সবচেয়ে ক্ষমতাবান ও অভিজাত।
ক্ষত্রিয়দের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকলেও পুরোহিতদের ছিল নিজস্ব, ভিন্নধর্মী ক্ষমতা। ভারতের দক্ষিণে যাত্রার শুরু থেকেই আর্যদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে পুজো-অর্চনা। ঋগ্বেদের প্রথমদিকের এক চরণে বলা হয়েছে : ‘যারা আত্মত্যাগে ব্যস্ত থাকে, তাদেরকে ইন্দ্র সাহায্য করেন।’
আর্যদের এসব চর্চা পরবর্তীতে হিন্দুধর্মের ভিত্তিমূল স্থাপন করে। এই পুরোহিতরা ভারতীয় সমাজের প্রথম, প্রকৃত কুলীনগোষ্ঠীতে পরিণত হন এবং তারা ১৬ রাজত্বের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেন। ক্ষমতাসীন ক্ষত্রিয়দের মতো পুরোহিতদেরও ছিল নিজস্ব গোত্র—তারা নিজেদেরকে ‘ব্রাহ্মণ’ হিসেবে পরিচয় দিতে লাগলেন।
প্রাচীন আমলে অন্যান্য অনেক গোত্রের মাঝেও এই তিন ধরনের বিভাজন ছিল-পুরোহিত, যোদ্ধা ও বাকি সবাই (এই বাকি সবাইদের সেখানে বৈশ্য বা সাধারণ মানুষ বলা হচ্ছিল)। তবে শুধু ভারতেই সম্ভবত ব্রাহ্মণরা তথা ধর্মগুরুরা বাকিদের ওপর ছড়ি ঘোরাতেন। বাকি সব প্রাচীন সমাজে রাজা ও যোদ্ধাই ছিলেন সর্বেসর্বা। বেশিরভাগ গোত্রে রাজা চাইলে ধর্মীয় আচার নিজেই সম্পাদন করতে পারতেন, এমনকি পূজারি বা পুরোহিতদের শাস্তিও দিতে পারতেন। কিন্তু ভারত ছিল ব্যতিক্রম।
১৬ রাজত্বের আমলে ব্রাহ্মণদের হাতে এমন ক্ষমতা ছিল যার কোনো ভাগীদার ছিল না। ক্ষত্রিয় না হয়েও একজন ব্যক্তি ব্রাহ্মণদের আশীর্বাদে রাজা হওয়ার সক্ষমতা ধারণ করতেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম না নিয়ে পুরোহিতের চাকরি পাওয়া কস্মিনকালেও সম্ভব ছিল না।
৬১.১ ভারতের রাজত্বগুলো
১৬ রাজত্বের দৌরাত্ম্যের আগে ধর্মীয় আচার হিসেবে পশু-বলিদান বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু ভারতের শহুরে জনগোষ্ঠী এ-ধরনের আচার থেকে বের হয়ে আসে। ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে তারা প্রাণীহত্যাবিহীন পূজার দিকে সরে আসে।
তবে এই ১৬ রাজত্বের আশেপাশে ছোট কিছু গোত্র অবশিষ্ট ছিল, যারা এই মহাজনপদগুলোতে ঢুকতে চায়নি। তারা সবাই মিলে একটি স্বাধীন জোট গঠন করে, যার নাম ছিল গণসংঘ।
ধারণা করা হয়, গণসংঘের সদস্য গোত্রগুলো আর্য-বংশোদ্ভূত ছিল না। তারা আর্যদের মতো কোনো ধরনের ধর্মীয় আচার পালন করতেন না। কিন্তু মহাজনপদের বাসিন্দাদের জন্য এ-ধরনের উপাসনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এই গণসংঘে দুই ধরনের মানুষ ছিলেন : শাসক বংশ, যাদের দখলে ছিল বেশিরভাগ ভূমি এবং ভৃত্যশ্রেণি, যারা সেসব জমিতে ফসল ফলাতেন। শাসক পরিবারের প্রধানরা সম্মিলিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতেন, যেমন যুদ্ধ ও বাণিজ্যসংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো। এসব বিষয়ে ভৃত্য বা শ্রমিকদের কোনো ভূমিকা ছিল না।
মহাজনপদেরও মতামতহীন ভৃত্যশ্রেণি ছিল। তারা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য ছিল না। নমশূদ্র বা শূদ্র নামে পরিচিত ছিল চতুর্থ এই গোত্রটি।
শূদ্ররা মূলত ছিল দাস ও ভৃত্যশ্রেণী। তারা অন্য শ্রেণিদের অধীনস্থ গোত্ৰ। তাদের কোনো মতামতকে আমলে নেওয়া হতো না এবং তাদের ছিল না কোনো ক্ষমতা। তারা কখনোই নিজেদেরকে এই দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারত না। তাদের প্রভু চাইলেই তাদেরকে হত্যা করতে পারতেন বা নির্বাসন দিতে পারতেন—এর জন্য আইনও পাস করা হয়। তাদেরকে ধর্মগ্রন্থ বেদ শুনতে দেওয়া হতো না। কেউ ভুলে শুনে ফেললে শাস্তি ছিল কানের ওপর ফুটন্ত সিসা ঢেলে দেওয়া। তারা মহাজনপদ সমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ধারণা করা হয়, পরাভূত কোনো জাতি থেকে তাদের উদ্ভব ঘটেছিল।
এ-ধরনের বিভাজনমূলক সমাজে প্রতিবাদী কণ্ঠের অনুপস্থিতি অস্বাভাবিক।
এ-বিষয়ে প্রথম আপত্তি আসে গণসংঘ থেকে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৯ সালের আশেপাশে ‘সংস্কারপন্থী’ নয়পুত্ত বর্ধমান গঙ্গার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে গণসংঘের অন্তর্ভুক্ত এক পরিবারে জন্ম নেন। তার গোত্র জনাত্রিকা ছিল ভ্রিজি জোটের অন্তর্গত। তিনি ছিলেন একজন রাজপুত্র। ধনী এই ব্যক্তি ছিলেন এক শাসকের ছেলে।
তিনি ৫৬৯ সালে ৩০ বছর বয়সে সংস্কার শুরু করেন। প্রথমেই তিনি জন্মসূত্রে পাওয়া সম্পদ ও সুযোগসুবিধা ত্যাগ করেন। পরনের একটিমাত্র কাপড় ছাড়া সব জাগতিক সম্পদ পরিত্যাগ করলেন তিনি। ১২ বছর নীরবে সাধনা করলেন তিনি। ১২ বছর শেষে তিনি জীবন সম্পর্কে একধরনের ধ্যানধারণা লাভ করলেন, যা এর আগে কোনো পুরোহিত পাননি। তার জগতে ব্রাহ্মণদের স্থান ছিল না। তিনি বললেন, পূজা-উপাসনার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পাওয়া বা তাকে তুষ্ট করা সম্ভব নয়। বরং একজন মানুষের উচিত সবধরনের লোভ- লালসাকে জীবন থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া, যা তাকে এই মর্ত্যের পৃথিবীর মায়াজালে জড়িয়ে রাখে।
৫৬৭ সাল নাগাদ তিনি নগ্নপদে সমগ্র ভারত ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তিনি তার পাঁচটি মূলনীতি প্রচার করতে লাগলেন : অহিংসা (ইচ্ছাকৃতভাবে হিংসা থেকে বিরত থাকা বা কাউকে আঘাত না-করা), সত্য (সত্যবাদিতা), অস্তেয় (চুরি না করা), ব্রহ্মচর্য (ইন্দ্রিয়-সংযম) ও অপরিগ্রহ (অনাসক্তি)। অর্থাৎ, সবধরনের জাগতিক উপকরণ থেকে নিজেকে মুক্তি দেওয়া।
নয়পুত্ত বর্ধমান অনেক অনুসারী খুঁজে পান। তিনি তাদের কাছে এক মহান শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে পরিচিতি পান। ভক্তরা তাকে নাম দেয় ‘মহাবীর। মহাবীর তার প্রচারিত পাঁচ নীতির চরম উদাহরণ দেখিয়ে পরনের সেই একটুকরো পোশাকটিও একসময় বর্জন করে সম্পূর্ণ নগ্নবেশে চলতে শুরু করেছিলেন।
মহাবীরের প্রচারিত নীতিগুলো হিন্দুধর্মেও বলা হয়েছে। তিনি নতুন কিছু উদ্ভাবন করেননি, বরং পুরনো ধ্যানধারণার সংস্কার করেছেন। তার প্রচারিত মতবাদ ‘জৈন’ ধর্ম হিসেবে পরিচিতি পায়।
কয়েক বছর পর মহাজনপদের বাইরে থেকে অপর এক সংস্কারপন্থীর আবির্ভাব হয়। তিনিও গণসংঘে জন্ম নেন, এবং তিনিও ৩০ বছর বয়সে তার জন্মসূত্রে পাওয়া সহায়সম্বল ত্যাগ করে স্বআরোপিত নির্বাসনে চলে যান।
তিনিও একই উপসংহারে পৌঁছান—মুক্তিলাভের একটিই রাস্তা, আর তা হল, সবধরনের লোভ-লালসা ত্যাগ করা।
এই মানুষটি আর কেউ নন, তিনি হলেন সিদ্ধার্থ গৌতম, যিনি আমাদের কাছে গৌতম বুদ্ধ নামে পরিচিত। তিনি তার স্ত্রী ও শিশুকন্যাকে ফেলে বাসা থেকে বের হয়ে যান।
বছরটি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৪।
একইভাবে, বুদ্ধের শিক্ষাও ছিল ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বিরোধী। তিনি বলেন, মানুষকে নিজের ক্ষমতায় বিশ্বাস রাখতে হবে। কোনো এক শক্তিশালী নেতা এসে সবার সব সমস্যার সমাধান করে দেবে, বিষয়টি এমন নয়।
শিগির বুদ্ধেরও অনেক অনুসারী জমায়েত হতে শুরু করে। বিভিন্ন গোত্র থেকে আসেন তারা।
একদিকে মহাবীর ও বুদ্ধ সব জাগতিক সম্বল পরিত্যাগের শিক্ষা দিচ্ছিলেন, আর অপরদিকে মহাজনপদের রাজারা যত বেশি সম্ভব ভূখণ্ড দখলের জন্য যুদ্ধে জড়িয়ে ছিলেন। গঙ্গার উত্তরে কাশী ও কোসাল এবং দক্ষিণের মগধ ছিলে একে অপরের জাতশত্রু। তারা গঙ্গা অববাহিকায় যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যোগ দেয় গণসংঘের ভ্রিজি—মহাবীরের গোত্ৰ।
কাশী ও কোসাল একে অপরের বিরুদ্ধে লড়লেও কেউই বেশিদিনের জন্য আধিপত্য বজায় রাখতে পারেনি। অপরদিকে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগল মগধ। ৫৪৪ সালে রাজা বিমবিসারা মগধের সিংহাসনে বসলেন। তিনিই ছিলেন ভারতের প্রথম সাম্রাজ্যবাদী শাসক। বুদ্ধ যখন বোধিপ্রাপ্ত হচ্ছিলেন, তখন বিমবিসারা বদ্বীপের রাজ্য আঙ্গার বিরুদ্ধে সেনা-সমাবেশ করছিলেন। এই রাজ্যটি বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে গঙ্গার সংযোগস্থলের নিয়ন্ত্রণ রেখেছিল। তাদের রাজত্বের গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল বন্দরনগরী কামপা। এই কামপার মাধ্যমেই এ-অঞ্চলের বেশিরভাগ জাহাজ দক্ষিণে বাণিজ্যের উদ্দেশে রওনা হত। বিমবিসারা এই রাজ্য ও শহরের বিরুদ্ধে লড়েন এবং সফল হন।
এটা বড় কোনো জয় ছিল না, কিন্তু ১৬ রাজ্যের মধ্যে প্রথম রাজ্য হিসেবে আঙ্গা পুরোপুরি অন্য একটি রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। এর মাঝেই ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে তার একটি বাস্তবচিত্র আমরা পেয়ে যাই। বিমবিসারার অন্যান্য সাফল্যের মধ্যে ছিল দুই বিয়ের মাধ্যমে কোসোল ও পশ্চিম সীমান্তে গণসংঘের সঙ্গে বন্ধুত্ব সৃষ্টি। তিনি তার রাজত্বের পুরোটা অংশজুড়ে সড়ক নির্মাণ করেন যাতে খুব সহজে সব জায়গায় গিয়ে গ্রামের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করা যায়।
এই সড়কের মাধ্যমে তিনি খুব সহজেই রাজ্যের সব অংশ থেকে কর আদায় করতে পারতেন। তিনি উত্তর থেকে আসা গৌতম বুদ্ধকে সাদরে গ্রহণ করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা খর্ব হয়, এমন যেকোনো মতবাদ রাজার ক্ষমতা বাড়াবে। তিনি বুদ্ধিমানের মতো মগধকে একটি ছোট সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলেন, যেখানে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সেনাবাহিনী গঠন একমাত্র কাজ ছিল না।