1 of 2

৬০. রোম প্রজাতন্ত্র

অধ্যায় ৬০ – রোম প্রজাতন্ত্র

খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ থেকে ৫০১ সালের মধ্যে দৃশ্যপটে কেল্ট ও কার্থেজিয়ানদের আবির্ভাব হলো, আর রোম তাদের রাজাদের পরিত্যাগ করল।

সদ্যবিজয়ী সাইরাস এশিয়া মাইনরে লিদিয়া অভিযান শেষ করার ভার দিলেন হারপাগাসকে। তিনি লিদীয় মিত্রদের দখলে থাকা উপকূলীয় আইওনিয়ান শহরগুলো দখল করতে গেলেন।

হেরোডোটাস আমাদের জানান, হারপাগাসের এই অভিযানে একধরনের তাসের ঘর ভেঙে পড়ার মতো ঘটনা ঘটে। সাইরাস উপকূলের একদম মাঝে অবস্থিত ফোশিয়ায় অভিযান শুরু করেন। এ শহরের মানুষগুলো ‘গ্রিকদের মধ্যে সর্বপ্রথম গভীর সমুদ্রে অভিযান চালিয়েছিলেন।’

তারা তখন পাথরের দেয়াল তোলার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। হামলার শিকার হয়ে শহরবাসী হারপাগাসকে জানালেন, তারা আত্মসমর্পণ করতে রাজি হতে পারে, যদি তিনি এক দিনের জন্য আক্রমণ থামিয়ে তাদেরকে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার সুযোগ দেন। তিনি তাই করলেন। আর এই সুযোগে ফিশিয়ানরা তাদের ‘পেন্টেকন্টার’ (একধরনের বড় জাহাজ)-এ করে নারী, শিশু, সব ব্যক্তিগত সম্পদসহ পালিয়ে গেলেন। ফলে, পারশিয়ানরা ফিশিয়ার নিয়ন্ত্রণ পেলেও সেখানে ছিল না কোনো পুরুষ।

,

ইতোমধ্যে সিরনাস, দ্বীপে (কর্সিকার গ্রিক নাম) ফিশিয়ানরা একটি বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন, যার নাম ছিল আলালিয়া। ফিশিয়ানদের অর্ধেক নাগরিক নিজ ভূমির জন্য মর্মবেদনায় ভুগতে লাগলেন। তারা সেই ফেলে আসা শহরের দিকে রওনা হলেন। বাকিরা আলালিয়ার পথে যাত্রা করলেন।

কর্সিকায় থিতু হয়ে ফিনিশীয়রা একটি বাণিজ্যভিত্তিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলার দিকে মনোযোগী হলেন। বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য পেনটেকনটারগুলো খুবই উপযোগী ছিল। এই জাহাজগুলো বৈঠা বাওয়ার জন্য ৫০ জন মাঝি, ডেকের ক্রু ও ক্যাপ্টেনসহ আরও অনেক মানুষকে জায়গা দিতে সক্ষম ছিল। তারা সবাই প্রয়োজনে যুদ্ধে যোগ দিতে পারতেন। ফলে সাধারণ বাণিজ্যিক জাহাজের চেয়ে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে পেন্টেকন্টার বেশি উপযোগিতা দেখায়। সাধারণ জাহাজগুলোতে খুব বেশি হলে ৫/৬ জন মানুষ থাকতে পারে। ফিশিয়ানরা চেয়েছিল ভূমধ্যসাগরের পশ্চিমদিকের সব বাণিজ্যিক পথগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে। এই পথগুলোর দিকে তখনও গ্রিকরা সেভাবে নজর দেয়নি।

পশ্চিমের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষার জন্য তারা উপকূলে একটি উপনিবেশ স্থাপন করে। এ অঞ্চলটি বর্তমানে ‘দক্ষিণ ফ্রান্স’ নামে পরিচিত।

এই নতুন কলোনির নাম দেওয়া হয় মাসালিয়া। এই উপনিবেশটির মাধ্যমে গ্রিক বণিকরা বেশ কয়েকটি ছোট ছোট গোত্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলে, যে গোত্রগুলো তখনো খুব বেশি পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি। তারা ছিল মূলত বর্বর গোত্র, যারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করেই বেশ সময় অতিবাহিত করত। এই বর্বর যোদ্ধারা উপকূল থেকে বহু দূরের ভূখণ্ড থেকে এসেছিল। সঙ্গে এনেছিল স্বর্ণ ও লবণ, অ্যাম্বার (একধরনের তৈলস্ফটিক) ও পশমের কাপড় আর সবচেয়ে দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান পণ্য, টিন।

এসময় ফিশিয়ানরা কেল্টদের মুখোমুখি হল।

‘কেল্ট’ হচ্ছে আরও একটি অ্যানাক্রোনিসটিক নাম। অর্থাৎ, এই জাতি পৃথিবী আসার আরও অনেক পরে তাদেরকে এই নাম দেওয়া হয়। কেন্দ্ৰীয় ইউরোপের পশ্চিম অংশে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৫০০ সালের মধ্যে যাযাবরের মতো ঘুরতে থাকা কিছু গোত্রকে এই নাম দেওয়া হয়। গ্রিক ও রোমান, উভয় জাতিই পরবর্তীতে তাদেরকে ‘কেল্ট’ বা ‘গল’ নাম দেয়। তবে ওই ১০০ বছর তাদের কোনো ‘জাতিগত’ পরিচয় ছিল না। তারা একই উৎস থেকে আসা ছড়ানো-ছিটানো গোত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

তারা ইন্দো-ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত হিসেবে বিবেচিত। অর্থাৎ, বহুবছর আগে তারা কাসপিয়ান ও কৃষ্ণসাগরের মাঝামাঝি জায়গা থেকে এসেছিলেন। এ অঞ্চলটির দখলে ছিল হিতিত, মাইসেনীয় ও আর্য জাতি। এই চার জাতির ভাষায় অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যা থেকে ধারণা করা যায়, তারা সবাই একই জায়গা থেকে যাত্রা শুরু করে চারটি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। হিতিতরা পশ্চিমে এশিয়া মাইনরের দিকে এগিয়ে যায়। মাইসেনীয়রা শুরুতে পশ্চিমে গেলেও পরবর্তীতে উত্তরে গ্রিক উপদ্বীপে বসতি গড়ে। ‘কেল্ট’রা উত্তরে আল্পস পর্বতের কাছে এবং পরিশেষে, আরিয়ান বা আর্যরা প্রথমে পূর্বে এবং পরবর্তীতে দক্ষিণে ভারতে বসতি গড়ে।

এই ইন্দো-ইউরোপীয় যাযাবর জাতি, যারা পরবর্তীতে কেল্ট নাম পায়, তারা লিখতে জানতেন না। তাই আমরা, ইতিহাসবিদরা শুধু তাদের রেখে যাওয়া কবর ও অন্যান্য পণ্য থেকে এই জাতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা চালাতে পারি। যতদিনে মাসালিয়া শহরটি নির্মাণ করা হয়েছিল (খ্রিস্টপূর্ব ৬৩০ সাল), ততদিনে আধুনিক অস্ট্রিয়া থেকে দক্ষিণের লোয়েরে নদী পর্যন্ত মৃত মানুষকে কবর দেওয়ার বিশেষ এক পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা এটাকে হলস্টাট সভ্যতা বলে থাকি। এই নামকরণের পেছনে কারণ হল এই জাতির রেখে যাওয়া সবচেয়ে সুপরিচিত দুই অবস্থান—একটি কবরস্থান ও দানিউব নদীর দক্ষিণে একটি লবণের খনি।

হলস্টাট গোত্রের সদস্যরা তাদের কবরে স্বর্ণের গয়না, তলোয়ার ও বর্শা রেখে দিতেন। এ ছাড়া খাবার, পানি ও পাত্রও রেখে দেওয়া হত, যাতে মৃতরা এগুলো ব্যবহার করতে পারে। কোনো গোত্রপ্রধান বা নেতা মারা গেলে, তাদের কবরের চারপাশে অন্যান্য যোদ্ধাদের কবর খোঁড়া হত, যাদের হাতে থাকত দীর্ঘ লোহার তৈরি তলোয়ার। এটাই ছিল তাদের সবচেয়ে দামি উপকরণ। হলস্টাট গোত্রের বণিকরা তাদের ওয়াগন চালিয়ে মাসালিয়াতে নিয়ে আসতেন। এতে অ্যামবার, লবণ ও টিন থাকত। আধুনিক যুগের কর্নওয়ালের খনির মতো দূরবর্তী জায়গা থেকে এই ওয়াগনগুলো আসত। এগুলো সবই ছিল মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য উপকরণ। এসব পণ্যের বাণিজ্যের মাধ্যমে মাসালিয়া খুব দ্রুত প্রবৃদ্ধিশীল শহরে পরিণত হয়।

মাসালিয়ার ভিত্তি ফিশিয়ান বাণিজ্য খুবই লাভজনক হয়ে ওঠে। এ বিষয়টি খুব দ্রুত এতরুসকানদের গাত্রদাহের কারণে পরিণত হয়। এতরুরিয়া প্রোপার খুব ব্যস্ত ছিল—তারা উত্তর দিকে দূরদূরান্তে শহর প্রতিষ্ঠা করছিল। এতরুসকানরা যে অঞ্চলকে নিজেদের আওতাধীন, অদখলকৃত ভূখণ্ড ভাবছিল, সেগুলোর দিকে আগ্রাসী গ্রিকরা নজর দেয়। আধুনিক ফ্রান্সের দক্ষিণ উপকূলজুড়ে একের পর এক গ্রিক উপনিবেশ মাথাচাড়া দিতে শুরু করে। মোনাকো, নিস ও সেইন্ট টোপাজ—তিন অঞ্চলেই আদি জনবসতি গড়ে উঠেছিল গ্রিক বাণিজ্যিক কেন্দ্রের মাধ্যমে।

এ-ধরনের চাপের মুখে এতরুরিয়ার স্বাধীন শহরগুলো নিজেদের মধ্যে জোট সৃষ্টি করে। কারণ খুব সহজ—গ্রিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। এক শতাব্দী আগে, একইভাবে ইতালির পাঁচ এতরুসকান শহর একত্রিত হয়ে রোমের বিরুদ্ধে লড়েছিল। এবার ১২টি এতরুসকান শহর গ্রিক অ্যাম্ফিকটিওনস-এর আদলে জোটবদ্ধ হয়। তাদের লক্ষ্য এক হলেও নিজ নিজ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অটুট ছিল। এই এতরুসকান লিগ খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালের দিকে গঠিত হয়। এতে ভেই, তারকুইনি ও ভলসিনি অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এত বড় জোট তৈরি করেও এই এতরুসকান লিগের পক্ষে ফিশিয়ান হামলাকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয়ী হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা ছিল না। ফিশিয়ানরা চাইলেই গ্রিক মিত্রদের হাজারো জাহাজকে যেকোনো চলমান যুদ্ধে ডেকে নিয়ে আসতে পারত। হেরোডোটাস জানান, এই নিরুপায় পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে এতরুসকানরা কার্থেজিয়ানদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হল।

আমরা খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছি। সেসময়ই কার্থেজের বয়স ছিল ৩০০ বছরেরও বেশি। আফ্রিকার উত্তর উপকূলে, ভূমধ্যসাগরের তলদেশে ছিল এর অবস্থান। ফিনিশীয় ফেডারেশন তখন ঢিমেতালে চলছিল। এই জোটের সবচেয়ে পুরনো দুই শহর, টির ও সিডন ততদিনে সাইরাসের দখলে ছিল। কিন্তু এই দুই শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত কার্থেজের ছিল নিজস্ব রাজত্ব। ৫৫০ সালে কার্থেজের রাজা ছিলেন মাগো। ইতিহাসে প্রথম কার্থেজীয় রাজা হিসেবে তার নামটাই আমরা জানতে পারি।

এই ‘মাগো’ (জননী বা মায়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই) রাজার আমলে কার্থেজ ভূমধ্যসাগরে তাদের নিজস্ব বাণিজ্যিক উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। গ্রিকরা তাদের চারপাশে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকলেও এতে কার্থেজিয়ানদের তেমন আপত্তি ছিল না, যেমনটা ছিল এক্রসকানদের। তারা আলালিয়ায় ফিশিয়ানদের বিরুদ্ধে হামলায় যোগ দিতেও বেশ উৎসাহী ছিল। অ্যারিস্টটলের ‘পলিটিকস’ বইতে এই জোটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ‘একদা একবার এতরুসকান ও কার্থেজিয়ানরা ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরে সমন্বিত সম্প্রদায় গঠন করেছিল।’

আলালিয়া বা কর্সিকায় গ্রিকরা এই হামলার বিষয়ে ইঙ্গিত পেয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। হেরোডোটাস জানান, ‘ফিশিয়ানরা ৬০টি জাহাজ প্রস্তুত রাখল। তারা সারডিনিয়ান সাগরে শত্রুর মোকাবিলা করতে গেল।’ এই যুদ্ধের ৪০টি ফিশিয়ান জাহাজ ধ্বংস হল আর বাকি ২০টি এত খারাপভাবে ক্ষতির শিকার হল যে সেগুলো আর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার উপযোগী ছিল না। কিন্তু এগুলো সমুদ্রযাত্রার মতো অবস্থায় ছিল। ফলে ফিশিয়ানরা পাল তুলে কর্সিকায় ফিরে এল। আবারও তারা তাদের নারী ও শিশুদের জাহাজে উঠিয়ে ইতালির একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত গ্রিক শহর রেজিয়ামে পালিয়ে গেল।

তৎকালীন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নৌযুদ্ধের তালিকায় আলালিয়ার যুদ্ধ দ্বিতীয় স্থান দখল করেছিল। তৃতীয় রামেসেস-এর নৌযুদ্ধ ছিল প্রথম অবস্থানে। এই যুদ্ধের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এতরুসকানরা ঐ অঞ্চলের সবচেয়ে ক্ষমতাধর জাতিতে পরিণত হয়। তারা কর্সিকা দখল করে নেয়। ফিশিয়ানরা তাদের পেন্টেকন্টারে করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল—তারা কোনো গুরুতর হুমকি হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়। এতরুসকানরা নিজেরাই অসংখ্য উপনিবেশ গড়ে তোলে। স্পেনের উপকূল পর্যন্ত তাদের এই কার্যক্রম বিস্তৃত হয়। তিবার উপদ্বীপের উত্তরের অংশে তারাই ছিল সবচেয়ে ক্ষমতাবান।

মাসালিয়ার সঙ্গে আলালিয়ার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল, কিন্তু এতরুসকানরা এটি ধ্বংস করেনি। মূল শহর ধ্বংস করার পর ছোটখাটো শহরগুলো নিয়ে তারা খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছিল না। মাসালিয়া খুব সম্ভবত অল্প কিছুদিন অস্তিত্ব-সংকটে ভুগেছিল। কিন্তু ধ্বংস তো দূরে থাক, এই শহর আজও বহাল তবিয়তে টিকে আছে। মাসালিয়া থেকে নামটা বদলে শুধু মার্সেই হয়েছে।

উল্লেখিত যুদ্ধের ফলে কার্থেজও নিজেদেরকে বিস্তৃত করার সুযোগ পায়। এতরুসকানদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী তারা সারডিনিয়ার শাসনভার নেওয়ার দাবি জানায়। পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গ্রিকদের উৎপাত না-থাকায় তারা সেদিক দিয়েও স্পেনের উপকূল পর্যন্ত তাদের দখল বাড়াতে সক্ষম হয়েছিল।

গ্রিকরা পিছু হটেছিল। কার্থেজিয়ান ও এতরুসকানরা ভূমধ্যসাগরে দাপট দেখাচ্ছিল। অপরদিকে, রোমও বসে ছিল না—তাদের আকার ও ক্ষমতা, দুটোই বাড়ছিল। রোম যত বেশি ভূখণ্ড দখল করছিল, ততই বাড়ছিল এই সভ্যতার অভ্যন্তরীণ কোন্দল। রোমের রাজার জন্য দেশ শাসন করা খুবই ঝামেলার ছিল। রোম সাম্রাজ্যের এক অংশের মানুষ অপর অংশের মানুষকে এতটাই ঘৃণা করত যে তারা একে অপরের মধ্যে বিয়েও করতে রাজি হত না।

এক্রসকান শাসনামলে রোমের রাজা ও প্রজারা নিজেদের মধ্যে একধরনের বন্দোবস্ত করে নেয়, যা ছিল কিছুটা সাইরাসের ধরন, কিছুটা সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন রাজতন্ত্র বা অ্যাথেন্সের মতো, জনগণের ক্ষমতায় দেশশাসনের সমন্বয়। তিন ধরনের শাসনব্যবস্থার কোনোটিই পুরোপুরি প্রযোজ্য ছিল না। এই খিচুড়ি- শাসনব্যবস্থার তেমন কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা পাওয়া যায় না। রোমের ইতিহাসবিদরা সে-আমলের শাসনব্যবস্থা নিয়ে বেশি কিছু না লিখে বরং আরও অনেক পরের শাসনব্যবস্থাকে ঐ আমলের শাসনব্যবস্থা হিসেবে নথিবদ্ধ করেন। তবে এটুকু নিশ্চিত, রাজার শাসন চালু থাকলে রোমে সবসময়ই দেশের জনসাধারণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হত।

রোমের ইতিহাসবিদ ভারো উল্লেখ করেন, আদি যুগে রোমের মানুষকে তিন ধরনের ‘গোত্রে’ ভাগ করা হত। খুব সম্ভবত তারা ছিলেন : স্যাবাইন, ল্যাশিয়াল ও এক্রসকান। লাইভি নামের অপর এক ইতিহাসবিদ দাবি করেন, সারভিয়াস তুলিয়াস রোমের মানুষকে ছয়টি শ্রেণিতে ভাগ করেন। এক্ষেত্রে তাদের পূর্বপুরুষ নয়, বরং ধনসম্পদের পরিমাণকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। সবচেয়ে ধনী রোমানদের কাছে প্রত্যাশা ছিল তারা ব্রোঞ্জের তৈরি শিরস্ত্রাণ, ঢাল, বর্ম, তলোয়ার ও বর্শা দিয়ে শহরের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত হবে। সবচেয়ে দরিদ্রদের বলা হত শুধু গুলতি ও পাথর নিয়ে আসতে। রোমের রাজার অধীনস্থ প্রজা হলেও, প্রতিটি নাগরিককেই তাদের নিজ শহরের সুরক্ষা নিশ্চিতের দায়িত্ব দেওয়া হত। এমনকি, তারা কে কোথায় হামলা চালাবেন, সেটাও নিজেরাই ঠিক করে নিতে পারতেন। রোমান নাগরিকদের হাতে এহেন ক্ষমতা থাকায় স্বভাবতই তারা খুব বেশিদিন রাজার শাসন মানতে পারেননি।

সারভিয়াস তুলিয়াসের ৪৪ বছরের শাসনামলের শেষের দিকে রাজতন্ত্র ধসে পড়ে।

এক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তি হচ্ছে সারভিয়াস তুলিয়াসের ভাইপো তারকুইন দ্য ইয়ংগার। সে শুধু উচ্চাভিলাষীই নয়, তার মধ্যে অশুভ বুদ্ধির কোনো অভাব ছিল না। সে তার ছোটভাইয়ের স্ত্রী তুলিয়ার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল।

লাইভির পর্যবেক্ষণ : ‘অশুভ শক্তিগুলোর মাঝে একধরনের চৌম্বক আকর্ষণ কাজ করে। এরা একে অপরকে আকর্ষণ করে।’ তারকুইন দ্য ইয়ংগার (তরুণতর তারকুইন) নিজেই বিবাহিত ছিলেন। কিন্তু এ বিষয়টিকে ঝামেলা হিসেবে বিবেচনা করে তিনি ও তার প্রেমিকা তুলিয়া তাদের নিজ নিজ সঙ্গী-সঙ্গিনীকে হত্যা করে একে অপরকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন।

লাইভি বলতে থাকেন, ‘সেদিন থেকে শুরু করে, বর্ষীয়ান ব্যক্তি সারভিয়াসের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যায়।’ শেক্সপিয়ারের চরিত্র লেডি ম্যাকবেথের মতো, তুলিয়াও ছিলেন উচ্চাভিলাষী—তিনি ভেবেছিলেন তার নতুন স্বামী রাজা হবেন। খুব শিগগির সারভিয়াসের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। তুলিয়া তাকে বললেন, ‘আমি এমন এক স্বামী চাই না, যে শুধু আমার স্বামী হয়েই খুশি—আমি এমন একজনকে চাই যার রাজা হওয়ার সক্ষমতা রয়েছে’।

তুলিয়ার কথায় প্রণোদিত হয়ে তারকুইন একপর্যায়ে হুড়োহুড়ি করে দরবারকক্ষে ঢুকে পড়লেন। সেসময় সারভিয়াস তুলিয়ায়স সেখানে ছিলেন না। তারকুইন তার সিংহাসনে বসে পড়লেন এবং নিজেকে রাজা হিসেবে ঘোষণা দিলেন। সারভিয়াস এই কাহিনি শুনে দ্রুত দরবারকক্ষে দৌড়ে গেলেন। কিন্তু তারকুইন বর্ষীয়ান রাজাকে নিজ হাতে বাইরের সড়কে ছুড়ে ফেললেন। সেখানে ব তার ভাড়াটে খুনেরা এই বৃদ্ধ রাজাকে হত্যা করল। লাইভি মন্তব্য করেন, ‘সারভিয়াসের মৃত্যুর সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে রাজার শাসন শেষ হল। এরপর আর কোনো রোমান রাজা কখনোই আর মানবিকতা ও ন্যায়বিচারের সঙ্গে রাজত্ব করতে পারেনি।’

তারকুইন রাজাকে উৎখাত করার পর তার নতুন নামকরণ হল : তারকুইনিয়াস সুপারবাস বা ‘তারকুইন দ্য প্রাউড’ (গর্বিত তারকুইন)। তিনি একটি দেহরক্ষী বাহিনী গঠন করে রোমের নাগরিকদের বশীভূত করার চেষ্টা চালান। তিনি সারভিয়াস তুলিয়াসের প্রতি অনুগত সব ব্যক্তিকে ফাঁসি দেন। তিনি নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধের অভিযোগ এনে তাদের অর্থ আত্মসাৎ করেন। লাইভি বলেন, ‘তিনি জোর করে ক্ষমতা দখল করেন, যার প্রতি তার কোনো বৈধ দাবি ছিল না।’

জনগণ তাকে নির্বাচিত করেনি। সিনেট তার সিংহাসনে আরোহণের অনুমোদন দেয়নি। যেহেতু তিনি তার প্রজাদের ভালোবাসা পাননি, তাই তিনি ভীতি সঞ্চার করে রাজত্ব করার চেষ্টা চালান। তিনি যাদেরকে সন্দেহ বা অপছন্দ করতেন, তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড, নির্বাসন অথবা সম্পতি ক্রোকের ‘উপহার’ দিতেন। দেশশাসন সংক্রান্ত সব ধরনের বিষয়ে সিনেটের সঙ্গে আলোচনার প্রচলিত প্রথাটি তিনি ভেঙে দেন। তিনি যার সঙ্গে ইচ্ছে, তার সঙ্গেই মৈত্রী তৈরি করতেন এবং এ বিষয়ে সিনেট বা হাউজ অব কমন্স-এর সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনার কথা চিন্তাতেও আনতেন না।

এর সবই ছিল গুরুতর অপরাধ। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ের অনিয়ম ঘটল যখন তার ছেলে, অর্থাৎ রোমের সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী, লুকরেশিয়া নামে এক অভিযাত নারীকে ধর্ষণ করেন। লুকরেশিয়া ছিলেন তার এক বন্ধুর স্ত্রী। লজ্জা ও অপমানে লুকরেশিয়া আত্মহত্যা করেন। তার মরদেহ পাবলিক স্কোয়ারে পড়ে ছিল, আর তার স্বামী তার স্ত্রীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে দেশের জনগণের কাছে সাহায্য চাইতে থাকেন চিৎকার করে। ধর্ষণের প্রতিবাদ দ্রুতই রাজপরিবারের সব সদস্যের স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে রূপ নেয়।

তারকুইন দ্য প্রাউড সেসময় রোমের বাইরে ছিলেন। তিনি প্রতিবেশী শহর আরদিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। যখন এই বিক্ষোভের সংবাদ তার কানে গেল, তিনি দ্রুত রোমের উদ্দেশে রওনা হলেন। কিন্তু ততক্ষণে বিদ্রোহের আগুন পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। লাইভির বর্ণনায়, ‘তারকুইন দেখলেন, শহরের তোরণ তার জন্য বন্ধ করে রাখা আছে এবং তাকে নির্বাসনে পাঠানোর নির্দেশ জারি হয়েছে।’ সেনবাহিনী ‘উৎসাহ নিয়ে’ এই বিদ্রোহে যোগ দেয়। ফলে তারকুইন বাধ্য হয়ে তার ছেলেকে নিয়ে উত্তরে ইক্ররিয়ায় পালিয়ে যান।

লুকরেশিয়ার শোকসন্তপ্ত স্বামী ও তার এক বিশ্বাসভাজন বন্ধুকে শহরের নতুন নেতা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। সেনা-সদস্যদের ভোটে তারা নির্বাচিত হন। এক্ষেত্রে শুধু সারভিয়াস তুলিয়াসের প্রতি অনুগতরাই ভোট দেওয়ার অনুমতি পান।

এই দুই ব্যক্তিকে রাজার মতো ক্ষমতা দেওয়া হয়। তারা যুদ্ধে যাওয়া বা অন্যান্য সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। তবে এক্ষেত্রে একটি পার্থক্য ছিল। তাদের এই ক্ষমতা শুধু এক বছরের জন্য এবং তারা একে অপরের সিদ্ধান্তে ভেটো দিতে পারতেন। তাদেরকে ‘কনসাল’-এর মর্যাদা দেওয়া হয়, যা ছিল রোমান সরকার ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পদ। এভাবেই রাজতন্ত্র থেকে মুক্তি পায় রোম এবং ‘রোমান প্রজাতন্ত্রের’ ধারণার জন্ম হয়।

ইতিহাসের এই পর্যায়ের জন্য আমাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র নিঃসন্দেহে লাইভি। তার মতে, তারকুইন দ্য প্রাউডকে শহর থেকে বের করে দেওয়ার পর রোমের ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায়।

প্রায় ১০০ বছর আগে, তারকুইন দ্য এলডার রোমের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সেসময় থেকেই এতরুসকানরা রোম শাসন করে আসছে। তবে ৫৩৫ সালে আলালিয়ার নৌযুদ্ধে জয়লাভের পর থেকে এতরুসকানদের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখা দুষ্কর হয়ে পড়ে।

তারকুইন দ্য প্রাউডকে বহিষ্কারের পর থেকেই এতরুসকান গোত্রের ক্ষমতার ক্ষয় হতে থাকে। তারকুইন এক শহর থেকে অপর শহরে যেয়ে রোমান-বিরোধী জোট সৃষ্টির প্রচেষ্টা করেন। ‘আমার আর তোমার শরীরে একই রক্ত বইছে—এই যুক্তি দেখিয়ে তাদের দলে টানার চেষ্টা করেন তিনি। ভেই আর তারকুইনি তার আহ্বানে সাড়া দেয়। তারকুইনের নেতৃত্বে মোটামুটি সমীহ-জাগানিয়া এক বাহিনী রোমের দিকে যাত্রা করে। তাদের উদ্দেশ্য, এতরুরিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে আবারও এতরুসকান ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা করা।

রোমান বাহিনীর বিরুদ্ধে তুমুল যুদ্ধ করেও এই জোট পরাজিত হল। এরপর এতরুসকানরা আবারও রোমে হামলা চালানোর পাঁয়তারা করতে লাগল। কিন্তু এবার এই বাহিনীর নেতৃত্বে এলেন লার্স পোরসেনা—এতরুসকান নগরী ক্লুসিয়ামের রাজা।

এবারে হামলার খবর পেয়ে রোমবাসীরা আতঙ্কিত হলেন। তারা কোনোমতে ভেই আর তারকুইনকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু লার্স পোরসেনার ছিল বীর হিসেবে সুখ্যাতি। ভয়ে রোম নগরীর উপকণ্ঠে যেসব কৃষক বসবাস করতেন, তারা তাদের ক্ষেত-খামার ফেলে শহরের প্রাচীরের ভেতরে আশ্রয় নিলেন।

রোম নগরীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছিল বেশ অদ্ভুত। এর তিনদিকে প্রাচীর থাকলেও পূর্বপ্রান্তে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বলতে শুধু তিবার নদীখানাই উপস্থিত ছিল। সবার ধারণা ছিল, এই নদী পেরিয়ে আসা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু নদী পেরিয়ে সরাসরি শহরে ঢোকার একটি রাস্তা ছিল। শহরের বাইরে, পূর্বাঞ্চলের ‘জানিকুলাম’ নামের ভূখণ্ড থেকে একটি কাঠের তৈরি সেতুর মাধ্যমে শহরের একেবারে কেন্দ্রে চলে আসা যেত।

বুদ্ধিমান লার্স পোরসেনা প্রাচীরে হামলা না চালিয়ে জানিকুলাম দখল করে নিলেন। তার অধীনস্থ এতরুসকান সেনাবাহিনী পিঁপড়ার মতো পিলপিল করে এসে খুব সহজেই সেখানে অবস্থান নিলেন। সেখানে অল্প কিছু রোমান সেনা টহল দিচ্ছিলেন—তারা লার্সের সেনাবাহিনী দেখেই অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালালেন। তারা সেই কাঠের সেতু দিয়ে শহরের নিরাপদ জায়গায় সরে গেলেন।

তবে হোরাশিয়াস নামক এক সেনা অটল রইলেন। তিনি সেতুর পশ্চিমপ্রান্তে অস্ত্র হাতে অবস্থান নিলেন। লাইভির ভাষায়, তিনি ‘পলাতকদের মাঝে এক ব্যতিক্রমী চরিত্র’, যিনি ‘তরবারি আর ঢাল নিয়ে হামলা ঠেকাতে প্রস্তুত’ হলেন।

রোমান কিংবদন্তি আমাদের জানায়, এই হোরাশিয়াস একাই এতরুসকানদের দীর্ঘ সময় ধরে ব্যস্ত রাখতে সক্ষম হন। একপর্যায়ে রোমান সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিস্ফোরক উপকরণ নিয়ে এসে সেতুটি উড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।

তাকে তার সহযোদ্ধারা চিৎকার করে সেতু দিয়ে ফিরে আসার অনুরোধ জানাচ্ছিল, কিন্তু হোরাশিয়াস তাতে কর্ণপাত করেননি। তিনি সেতু ধ্বংস হওয়ার আগপর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান।

সেতু ধসে পড়ায় এতরুসকানরা আর আগাতে পারলেন না। রোমানরা সাময়িক বিজয়ে উল্লসিত হলেন। বীরযোদ্ধা হোরাশিয়াস তার ভারী বর্ম ও অস্ত্রসহ পানিতে পড়ে গেলেন। তিনি সাঁতরে নদী পার হয়ে গেলেন। লাইভি জানান, ‘এ ছিল এক মহান কীর্তি। কিংবদন্তিতূল্যও বলা যায়। খুব সম্ভবত বছরের পর বছর তার নামটি মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হবে।’

জেরুজালেমের প্রাচীর ছেড়ে সেন্নাশেরিবের সরে যাওয়ার মতোই হোরাশিয়াসের সেতু প্রতিরক্ষা দেওয়ার কাহিনিটি মূলত অমরত্ব পেয়েছে এক কাব্যের কারণে। টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকআউলের ‘লে’জ অব এইনশেন্ট রোম কবিতায় হোরাশিয়াসকে ব্রিটিশদের জন্য অনুকরণীয় সাহসিকতার উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

সেতু প্রতিরক্ষা দেওয়ার উপাখ্যানটি সাহসিকতায় পরিপূর্ণ হলেও এতে থামেনি এতরুসকান-হামলা। পোর্সেনা পুরো জানিকুলামজুড়ে তার সেনাদলকে বিস্তৃত করলেন। তিনি পুরো নদীতে ব্যারিকেড তৈরি করলেন যাতে রোমে জাহাজে করে বাইরে থেকে কোনো খাবার ঢুকতে না পারে। এরপর তিনি বড় ও ভারী অস্ত্র দিয়ে রোমের প্রাচীর ভাঙার উদ্যোগ নিলেন। দীর্ঘসময় ধরে এই যুদ্ধ চলতে থাকলেও কোনো পক্ষই নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করতে পারেনি। অবশেষে পোর্সেনা রোমের সঙ্গে সন্ধি চুক্তিতে সম্মত হলে। দুই শহরের মাঝে সাক্ষরিত হল এক ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি। তবে চুক্তি স্বাক্ষর হলেও ভেতরে ভেতরে তাদের মাঝে বৈরীতা একবিন্দুও কমল না।

এই চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়, এতরুসকান ও রোমানদের একই পর্যায়ের ক্ষমতা রয়েছে। এতরুসকানদের জন্য এটা একধরনের পরাজয় ছিল, কারণ তারা দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলকে পরাভূত করে রেখেছিল। অপরদিকে, একই বছরে রোম, কার্থেজকে মিত্র হিসেবে পায়। তারা তিবার নদীর দক্ষিণ উপকূলকে এতরুসকান নয়, বরং রোম সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

‘রাইজ অব রোমান এমপায়ার’ নামের বইতে পলিবিয়াস এ চুক্তির বিস্তারিত উল্লেখ করেন। উভয় পক্ষের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু শর্ত এখানে উল্লেখ করা হয়।

চুক্তির খুঁটিনাটি থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার—রোমানরা তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সম্প্রসারণ নিয়ে চিন্তিত ছিল আর কার্থেজিয়ানরা মূলত একটি বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য সৃষ্টিতে মনোযোগ দিয়েছিল।

অপরদিকে, দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে যায় এতরুসকানরা। পো নদীর কাছে অবস্থিত ভুখণ্ডটিও তারা হারাতে বসেছিল। আল্পস পর্বতের ওপর থেকে ইতালির উত্তরাঞ্চল দিয়ে একদল কেল্টিক যোদ্ধা তাদের দিকে এগিয়ে আসছিল।

লাইভির মতে, জনসংখ্যা বিস্ফোরণই কেল্টদের এহেন অবস্থান পরিবর্তনের কারণ। গল রাজ্যে মানুষ এত বেড়ে গিয়েছিল যে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ কারণে গলের কেল্টদের রাজা তার দুই ভাইপোকে দুইদল অনুসারীসহ দুইদিকে পাঠিয়ে দেন। নতুন ভূখণ্ড খুঁজে পাওয়ার উদ্দেশে। একজন জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলে যায় আর অপরজন বিশাল বাহিনী নিয়ে আল্পস-এর দিকে এগিয়ে যায়। তারা পর্বত পেরিয়ে টাইসিনাস নদীর কাছে এতরুসকানদের পরাজিত করে। সেখানেই গোড়াপত্তন হয় আজকের মিলান শহরের। সে আমলে শহরটির নাম ছিল মেডিওলানিয়াম।

এখানেই তাদের এই আগ্রাসন থামেনি। লাইভি এ-ধরনের অন্তত চারটি গল আগ্রাসনের বর্ণনা দেন। প্রতিটি হামলায় আল্পস-এর দক্ষিণের শহরগুলোতে বসবাসরত এতরুসকানদের বিতাড়ন করা হয়। পো নদীর উপত্যকায় তারা নিজেরা নতুন করে শহর নির্মাণ করে। এরপর গল থেকে আগত কেল্টদের চতুর্থ বাহিনীটি এসে দেখে ইতোমধ্যে আল্পস থেকে পো পর্যন্ত বিস্তৃত ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়ে গেছে। তাই তারা ডিঙিনৌকা করে নদী পার হয়ে যেয়ে আপেনাইন রিজের মাঝের অংশে এতরুসকানদের নির্বাসন দিল।

এতরুসকানদের জন্য কেল্টরা ছিল এক মূর্তিমান আতঙ্ক। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে আসা যোদ্ধাদের দেখলেই তাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যেত। ‘কেল্ট’ শব্দের উৎস ইন্দো-ইউরোপীয়, যার অর্থ হল ‘আঘাত করা’। রোমান ও গ্রিকরা এই নাম দিয়েছিল তাদেরকে। তাদের কবরে যেসব অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে আছে সাত ফুট লম্বা বল্লম, ধারালো লোহার তরবারি, রথ, শিরস্ত্রাণ ও ঢাল। পলিবিয়াস মন্তব্য করেন, তারা নলখাগড়া ও পাতার তৈরি বিছানায় ঘুমাত। তারা মাংস খেত এবং যুদ্ধ ও কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কিছু করত না। তারা যুদ্ধবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিল।

এই আগ্রাসনগুলো শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫০৫ সালের দিকে। সেসময় থেকে কেল্টিক ঐতিহ্যে আসে আমূল পরিবর্তন। পুরনো হলস্ট্যাট মহল্লাগুলোর রীতিনীতি বদলে নতুন সংস্কৃতির আবির্ভাব ঘটে।

নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকেই দক্ষিণে, ইতালির দিকে আগ্রাসনে মনোযোগ দেয় কেল্টরা।

পরবর্তীতে রোমান ইতিহাসবিদ জাস্টিন আমাদের জানান, গলরা নিজেদের মধ্যে মারামারি ও হানাহানি করতে করতে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে পড়েছিল। নতুন- পুরনো ঐতিহ্যের সংঘাতের নিরসন করতেই তারা ইতালিতে হাজির হয়। এখানে এসে যথারীতি এতরুসকানদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে তারা একে একে মিলান, দি কোমো, ব্রেসিয়া, ভেরোনা, বেরগামো, ত্রেন্তো ও ভিচেঞ্জা শহর নির্মাণ করে।

কিছু কেল্ট নাগরিক হয়তোবা ইউরোপের পশ্চিম উপকূলে, এমনকি সাগর পেরিয়ে ব্রিটেনেও পৌঁছে গেছিল। সেসময় ব্রিটেন-দ্বীপে যারা বসবাস করছিল, তাদের বিষয়ে আমাদের তেমন কিছুই জানা নেই। শুধু আমরা জানি তারা আকাশের পুজো করত এবং এজন্য তারা সারিসারি পাথর সাজিয়ে কিছু স্তম্ভ নির্মাণ করেছিল।

এসব স্থাপনার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাতটি হল আমাদের সবার পরিচিত ‘স্টোনহেঞ্জ’। এর নির্মাণ শুরু হয়েছিল খুব সম্ভবত ৩১০০ সালের দিকে এবং তা পরবর্তী ২০০ বছর ধরে চলে। কিন্তু এই আকাশের পূজারিরাও কেল্টদের হাত থেকে নিস্তার পায়নি। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সাল নাগাদ ব্রিটেনের কবরস্থানগুলোতে প্রথমবারের মতো রথ দেখা দিতে শুরু করে, যা দক্ষিণ জার্মানির লা তেনে কবরস্থানের সঙ্গে মিলে যায়।

উত্তরের এসব আগ্রাসনের জবাবে রোমান রিপাবলিকের সরকারব্যবস্থায় আসে পরিবর্তন। ভালো মানুষ লাইভি আমাদের জানান, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উদ্বেগ ও আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। ফলে, প্রথমবারের মতো, একজন একনায়ক শাসক নিযুক্ত করার প্রস্তাব আসে।’ বছরটি ছিল ৫০১—এই প্রজাতন্ত্রের গোড়াপত্তনের মাত্র আট বছর পর।

এই প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি হিসেবে জরুরি সামরিক অবস্থাকে তুলে ধরা হয়। কাছাকাছি শহরগুলোর সঙ্গে সংঘাত, স্যাবাইনদের বৈরী মনোভাব, অন্যান্য লাতিন শহর থেকে হামলার সম্ভাবনা,

হামলার সম্ভাবনা, ‘সাধারণ জনগণের’ বিদ্রোহ করার আশঙ্কা—এসবের পাশাপাশি, নিঃসন্দেহে উত্তর থেকে দক্ষিণে ধেয়ে আসা সম্ভাব্য আগ্রাসন সমগ্র উপদ্বীপটিকে উদ্বেগে আচ্ছন্ন করে তোলে।

তবে সে আমলের একনায়করা এখনকার মতো অসীম ক্ষমতা ভোগ করতেন না। রোমান একনায়কদের ক্ষমতা প্রতি মেয়াদে মাত্র ছয়মাস স্থায়ী হত এবং শাসক কনসালরা তাদের নিয়োগ দিতেন। প্রায়ই কনসালদের থেকেই এই একনায়ক নির্বাচন করা হত। এই একনায়কের ভূমিকা ছিল বহিঃশত্রুর কাছ থেকে আসা নজিরবিহীন হুমকির মোকাবিলা করে রোমকে সুরক্ষিত রাখা। তবে শহরের ভেতরেও তিনি অনেক অস্বাভাবিক ক্ষমতা উপভোগ করতেন। রোমের প্রাচীরের বাইরে কনসালরা যেকোনো রোমান নাগরিককে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারতেন। কিন্তু শহরের ভেতরে কাউকে শাস্তি দিতে হলে সেটার কর্তৃত্ব থাকত ভোটারদের হাতে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন সেই একনায়ক—তিনি যেকোনো জায়গায় রোমানদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারতেন।

রোমের প্রথম একনায়কের মূল দায়িত্ব ছিল আগ্রাসী গল, লাতিন ও এতরুসকানদের মোকাবিলা করা। কিন্তু পাশাপাশি, রোমের অবাধ্য জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে আনাও ছিল তার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। লাইভি বিষয়টি পরিষ্কার করেন, ‘রোমে প্রথমবারের মতো একনায়কের নিয়োগ দেওয়া হল। সবাই সড়কে দাঁড়িয়ে, যুদ্ধ-কুঠার উঁচিয়ে তাকে বরণ করে নিল।’ এই পেশিশক্তির প্রদর্শনীতে সাধারণ জনগণের মনে ভীতির সঞ্চার করে। এই একনায়কের কাছ থেকে কেউ ভালোবাসা বা দয়া প্রত্যাশা করছিল না। বরং চুপচাপ তার বশ্যতা মেনে নেওয়া বা এই ‘অন্তর্নিহিত আনুগত্য’ দেখানো ছিল জরুরি।

এই অন্তর্নিহিত আনুগত্যকে রোমের প্রথম সুরক্ষাব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই প্রথম প্রজাতন্ত্রের নাগরিক অধিকারগুলোকে স্থগিত রেখে বশ্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল—তবে এটাই শেষ নয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *