জয়ন্তীতে পৌঁছে তটিনী অভিভূত হয়ে গেছিল একেবারে। তবে ভয়ও যে, পায়নি তাও নয়। সন্ধেবেলা গা ধোওয়ার সময়ে হঠাৎ জানলার কাছে একটা বড়ো অথচ দৈর্ঘ্যে কম সরীসৃপের ছায়া দেখে ভয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল। ঘরে ঢুকে জামাকাপড় পরে বাইরে বেরিয়েই আকাতরুকে বলেছিল, ভীষণ-ই ভয় পেয়ে গেছিলাম। বাথরুমে, খাবার ঘর দিয়ে দিয়ে দেখুন, কী-একটা জিনিস বাথরুমের জানলার কাঁচের বাইরে সেঁটে আছে। ভয়ে হার্টফেল-ই করে গেছিলাম বলতে গেলে।
আকাতরু দেখে এসে হাসল, বলল, জিনিসটা কী তা আপনি চিনেন তবে এতবড়ো হয়তো আগে দেখেন নাই কুখনও।
কী?
তটিনী বলল।
তক্ষক।
তক্ষক? সে তো অনেক-ই দেখেছি পেপে গাছে, অন্যান্য গাছে। “ঠিক! ঠিক! ঠিক’! করে
ওগুলো ছোটো প্রজাতির। তারপরেই বলল, একটু চুপ কইর্যা থাহেন। শুনতে পাইবেন আনে ওদের ডাক। নদীর ওপরে থিক্যা ডাকলে এপার থিক্যা শুনতে পাইবেন। ডাকবআনে ‘টাকটু-উ-উ! টাকটু-উ-উ কইর্যা। ডাকোনের আগে আবার একটু গলা খাঁকড়াইয়া লয়। বড়ো বড়ো উচ্চাঙ্গ সংগীতের পন্ডিতেরা বোধ হয় মইর্যা তক্ষক হন।
ওদের ইংরেজি নাম কী?
GECKO। অন্য নাম Tucktoo৷ ওই ‘টাকটু-উ-উ’ বলে ডাকে বলেই।
হাসল তটিনী।
আকাতরু যেন, অবশ হয়ে গেছে। চান-করে-ওঠা তটিনীর গায়ের সাবান আর পারফুমের গন্ধ, বনের গন্ধ, নদীর গন্ধ, ওই চাঁদনি রাতের গন্ধ সব মিলেমিশে আকাতরুর জীবনের সব স্বপ্ন যেন, সত্যি হয়ে মর্তে নেমে এসেছে। আর ওপারের পাহাড় থেকে গেকো ডাকছে। ‘টাকটু-উ-উ’ আর এপার থেকে দোসর সাড়া দিচ্ছে ‘টাকটুউ’। পাহাড়ের কণ্ঠার কাছে দাবানল জ্বলছে। আগুনটা সোনালি চিতার মতন একবার এদিক আর একবার ওদিক করে নীচে নামার চেষ্টা করছে যেন। আগুনের মালা গড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। গাঁথছে কেউ। এখনও অসম্পূর্ণ আছে। মালা গাঁথা শেষ হয়নি। তটিনী অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছে সেদিকে।
আকাতরুর কথা শেষ হতে না হতেই জয়ন্তীর বন-বাংলোর ছাদের নীচে ফলস-শিলিং এর মধ্যে থেকেই একটা ডেকে উঠল ‘টাকটু-উ-উ’ বলে আর অন্য একটা সাড়া দিল নদীর ওপার থেকে। নদীটা বাংলোর সামনে অনেক-ই চওড়া–চাঁদের আলোয় শঙ্খের মতন রঙে আর ওপারের কালো রোমশ কাছিম-পেঠা আকাশ-ছোঁওয়া পাহাড়ের পটভূমিতে আরও যেন, সুন্দর দেখাচ্ছে। বাংলোর সামনে ঠিক নদীর উপরেই একটা বসার জায়গা। বাঁধানো। হাতার মধ্যে কয়েকটি শাল গাছ।
শাল ইখানের স্বাভাবিক গাছ নয়। বনবিভাগ-ই লাগাইছেন।
আকাতরু বলল।
ওরা দু-জনেই ছিল একা। মৃদুল অবনীকে নিয়ে গাড়ি নিয়ে রেঞ্জার বিমান বিশ্বাসের বাড়িতে গেছে আলাপ করতে। আসলে বোধ হয় ভুটানি হুইস্কি কী করে পাওয়া যায়, তার-ই
তত্ত্বতালাশ করতে।
আকাতরু বলল, বিশ্বাস সাহেবের মিসেস খুব-ই সুন্দরী।
তাই? আপনার সঙ্গে আলাপ আছে?
আমি একটা ফালতু লোক। আমার সঙ্গে আলাপ কার-ই বা আছে। আপনেই দয়া কইর্যা আমারে এত ইজ্জত দিয়া কথা কন। নইলে আমার কী আছে? না বিদ্যা, না বুদ্ধি, না টাকা, না রূপ। আমি ত একটা মানার চায়্যাও অধম।
‘মাকনা’ কী?
ওঃ তাও জানেন না? মাকনা হইল গিয়া পুরুষ হাতি কিন্তু যাঁর দাঁতি নাই। তার আর দাম কী?
তবে দাম কোন হাতির?
দাঁতালের আর গণেশের। গণেশের আবার পূজাও করে অনেকে।
গণেশটা কী বস্তু?
ওঃ। যে-পুরুষ হাতির একদাঁত তারে কয় ‘গণেশ’।
তাই?
হঃ।
আপনি কত্ত জানেন। সত্যি!
হঃ। আপনার পায়ের নখেরও যগ্যি যদি হইতে পারতাম।
কী যে বলেন! আপনি মানুষটা খুব ভালো। আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। আকাবাবু।
আকাতরুর হৃৎপিন্ডটা বন্ধ হয়ে গেল যেন। ওর বুকের মধ্যে আকাশ-বাতাস-নদী-পাহাড় চাঁদনি রাত সব যেন, একসঙ্গে গান গেয়ে উঠল। জন্মের পর থেকে সে, এতখুশি কোনোদিন হয়নি। ওর ইচ্ছে করল তটিনীর পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে, ওর পায়ের পাতাতে চুমু খায় নীচু হয়ে।
কিন্তু কিছুই করতে পারল না।
শুধু মুখে বলল, আপনে কী যে কন! আপনারে আমার হৃদয়টা একখান লাল বারোমাইস্যা জবার মতন নিজে হাতে ছিইড়্যা দিতে পারি। কিন্তু আপনের তাতে কী প্রয়োজন?
তটিনী চুপ করে আকাতরুর মুখের দিকে চেয়ে রইল।
পুরুষ মানুষ সে অনেক-ই দেখেছে। অনেক পুরুষের সঙ্গে সে শুয়েছে। পুরুষ জাতটা সম্বন্ধে একমাত্র প্রাণধন খাঁ ছাড়া, তার মনে শ্রদ্ধার কোনো আসন নেই। কিন্তু আকাতরুর মতন নিষ্পাপ, শিশুর মতন সরল, পবিত্র পুরুষ সে, আগে দেখেনি কখনো। বড়োই আবিষ্ট হয়ে গেছে তটিনী। ওর মনে হচ্ছে নিজেই নষ্ট করে দেওয়া ওর কোনো জ্বণ যেন, জীবন্ত হয়ে ওর প্রেমিক হয়ে আকাতরুর মাধ্যমে ওর কাছে এসেছে। জ্বণও প্রাণ। জ্বণহত্যাও পাপ। মেরি স্টোপস ক্লিনিকের অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান লেডি ডাক্তার তাকে বলেছিল। কে জানে! হয়তো তাই!
আকাতরু বলল, আমি ম্যামসাহেবের দেখিও নাই কুনোদিন। তবে শুনছি যে, সুন্দরী। সুন্দরী বইল্যাই ত কারোর-ই দেখান না ওয়াইফরে বিশ্বাস সাহেব। না দেখানোই ভালো।
কেন?
তটিনী বলল।
মৃদুলবাবুর মতন মানুষদের ত এক্কেরেই বাইরে বাইরেই রাখন উচিত। অবনী যে, কোন আক্কেলে তারে লইয়া গেল সিখানে কে জানে! মৃদুলবাবু হাইলি এডুকিটেড হইতে পারেন, পার্টও দারুণ করেন কিনু মানুষ ইক্কেরে থার্ড ক্লাস। আপনের সাথে এমন কইর্যা কথা কইতাছিল না, আমার মনে হইতাছিল, দিই গলা টিইপ্যা ইক্কেরে শেষ কইর্যা।
তটিনী আতঙ্কিত গলায় বলল, না, না। অমন করতে যাবেন না। ওঁরা মানীগুণী লোক। এস.ডি.ও., এস.ডি.পি., এস.পি., ডি.এম সকলেই ওঁদের একনামে চেনে। আপনিই সারাজীবন জেল খেটে মরবেন। আপনার কী ধারণা যে, হাজার হাজার মানুষ আমাদের দেশের শয়ে শয়ে জেলে পচে মরছে, ঘানি ঘুরোচ্ছে, যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে গেছে তারা সকলেই দোষী। বদমাইশ, চোর, ডাকাত, খুনে, রেপিস্টদের মধ্যে অধিকাংশই বাইরে আছে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ পড়েননি আপনি? “আইন সে তো তামাশামাত্র। বড়োলোকেরাই পয়সা খরচ করিয়া সে তামাশা দেখিতে পারে।” ডেপুটি বঙ্কিম এ-কথা বলেছিলেন, পরাধীন ভারতবর্ষ সম্বন্ধে। আজ বঙ্কিম এই পূর্ণ-স্বাধীন ভারতবর্ষে বেঁচে থাকলে কী বলতেন, তা কে জানে? জানেন আকাতরু। বড়োলজ্জা হয় ভাবলে। না, না আপনি ওরকম কিছু করার কথা ভাববেন না। কখনো না।
তটিনী ভাবছিল, এ জীবনে অনেক-ই ছদ্ম-ভালোবাসা পেয়েছে অসংখ্য পুরুষের। কিন্তু আকাতরুর মতন কোনো এক-শো ভাগ সৎ, এক-শো ভাগ পবিত্র, এক-শো ভাগ নারীসঙ্গর অভিজ্ঞতাহীন পুরুষ তাকে এমন শুদ্ধ, সুন্দর ভালোবাসা বাসেনি। তার ওপরে জয়ন্তীর এই পরিবেশ। মাথার উপরে একজোড়া কাঠগোলাপের গাছ। বিস্তৃত চওড়া নদীরেখা। চাঁদের আলোতে মোহময়, রহস্যাবৃত। দূরের বাঁকে হারিয়ে গেছে নদী, বিপরীতের কাছিম-পেঠা আকাশ-ছোঁওয়া পাহাড়। তার কণ্ঠার কাছে দাবানলের আলোয় মালা। লাল। রাতের বাঘের চোখের মতন লাল। ও ভাবল যে, এমন পরিবেশে, এমন শুদ্ধ পবিত্র একজন মানুষের অস্ফুট প্রার্থনা, অশুচি বহুভোগ্যা তটিনী মঞ্জুর করে নিজেই ধন্য হবে।
পরক্ষণেই হাসি পেল তটিনীর।
ভাবল, এই মহিরুহর মতন পুরুষটা এতটাই ছেলেমানুষ যে, সে যদি, তাকে এই মুহূর্তে বলে যে, তোমাকে আমার অদেয় কিছুই নেই, তবে এই নিষ্পাপ অনভিজ্ঞ শিশুটি হয়তো তার পায়ের একপাটি চটি, তটিনীর সাদা-রঙা স্পিঞ্জ কুকুর জিম-এরই মতন, তুলে নিয়ে দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে। তার চাহিদা যে কী, একজন পূর্ণযুবতী নারী তাকে যে, কী দিতে পারে, সে-সম্বন্ধেও তার হয়তো কোনোই স্পষ্ট ধারণা নেই। এই দেবশিশুর ভালোবাসা যে, কোথায় রাখবে, কী করে তার দাম দেবে, ভেবেই পেল না তটিনী।
পরমুহূর্তেই ভাবল, একমাত্র আকাতরুর মতন অকলুষিত, নিষ্পাপ, গ্রাম্য প্রবল পুরুষ আর তার জার্মান স্পিৎজ জিম-এর মতন মদ্দা কুকুর-ই একজন নারীকে প্রকৃত নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিতে পারে। নইলে, তটিনীর দেখা পুরুষ প্রজাতির অধিকাংশই শুয়োর। শুয়োর যে, তা তো সমারসেট মম বহুদিন আগেই তাঁর ‘RAIN’ গল্পেই বলে গেছেন। All men are pigs.
আকাতরু বলল, আমি আজ আত্মহত্যা করুম।
আত্মহত্যা?
চমকে উঠে আতঙ্কিত গলাতে বলল তটিনী।
তারপর বলল, কেন?
সে আপনে বোঝবেন না।
আমার কোনো অপরাধ হয়েছে কি?
হ্যাঁ। হইছেই ত!
কী?
আপনে আমারে মানুষের মর্যাদা দিছেন।
এটা কি অপরাধ?
হ! হ! হ! আপনের আগে আমারে সবাই Exploit-ই করছে। আমারে কেউই মানুষ। বইল্যা ভাবে নাই।
কেন? আপনার বন্ধু অবনী? তিনি তো আপনাকে ভালোবাসেন খুব।
আমি মাইয়াদের কথা কইতাছি।
ও। তটিনী বলল।
তারপর স্তম্ভিত, দুঃখিত হয়ে তটিনী বলল, আপনি আমার পাশে এসে বসুন তো একটু।
আকাতরু পাশে না বসে তটিনীর পায়ের কাছে বসল।
তটিনী আকাতরুর মাথার কেয়াবনের মতন ঠাসবুনোন এবং ফিঙের মতন কালো চুলগুলো নিজের ডান হাতে নেড়ে চেড়ে এলোমেলো করে দিয়ে ওর মাথার তালুতে একটা চুমু খেল। যে-ঠোঁট দিয়ে সে অনেক অসৎ, দুষ্ট, অপবিত্র পুরুষের সর্বাঙ্গে চুমু খেয়েছে, সেই ঠোঁট দিয়ে।
তটিনীর মনে হল, আকাতরুর মাথাটাকেই অপবিত্র করে দিল যেন সে।
আকাতরু আনন্দে শিউরে উঠল। আর তটিনী লজ্জায়।
এমন সময়ে জয়ন্তীর বন-বাংলোর হাতাতে একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি এসে ঢুকল। একজন নেমে গেটটা খুলল। গাড়িটা হেডলাইট জ্বেলে গেটের ও-পাশে দাঁড়িয়ে রইল। আলোর বন্যাতে জঙ্গল পাহাড় আর নদীর অনুষঙ্গের জ্যোৎস্না রাতের মোহময়তা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তার ওপরে গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ। গাড়িটার সাইলেন্সার পাইপটা ফুটো হয়ে গেছে। তাতে ইঞ্জিনের আওয়াজের সঙ্গে ‘গাঁক গাঁক’ আওয়াজ যোগ হয়েছে। হেডলাইট জ্বালা থাকায় ওদের দুজনের চোখ বেঁধে গেছিল। দেখতে পাচ্ছিল না কিছুই। গাড়িটা ভেতরে ঢুকে ওদের কাছে চলে এল। যে-লোকটি গাড়ি থেকে নেমে গেট খুলেছিল সে রোগামতো। চেহারাটা বড়োলোকের মোসাহেবের মতন। গাড়ি থেকে চারজন লোক নামল। সেই প্রথম লোকটিকে নিয়ে। ড্রাইভার গাড়িতেই বসে রইল।
কে যেন বলল, এই তো পাখি এখানে।
আকাতরু চিনতে পারল একজনকে। চানু রায়। আলিপুরদুয়ারেরর কুখ্যাত বড়োলোক। নামি মাতাল। নানারকম ব্যবসা তার। লোকে বলে জঙ্গলের চোরাই কাঠেরও ব্যবসা আছে। শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ির কাঠ-চেরাই কল-এ সরাসরি ট্রাক-ট্রাক কাঠ চালান যায়। বনবিভাগের কোনো কোনো আমলার সঙ্গেও তার আঁতাত আছে বলে মনে হয়, নইলে। অতকাঠ বের করে কী করে? মানুষটাকে দু-চোখে দেখতে পারে না আকাতরু। তবে বড়োলোক এবং ক্ষমতাবান বলে এড়িয়ে চলে।
চানু রায় এগিয়ে এসে বলল, অবনী নেই?
আকাতরু বলল, না। রেঞ্জার সাহেবের কাছে বাংলোয় গেছেন গিয়া।
তাই?
তারপর-ই বলল, নমস্কার তটিনী দেবী। আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল।
আমার সঙ্গে?
তটিনী উঠে দাঁড়িয়ে বলল।
তারপর বলল, আপনাকে তো আমি চিনি না।
কে আর কাকে চেনে বলুন? চিনতে আর কতক্ষণ লাগে? যদি চেনার ইচ্ছা থাকে। চা বাগানে আজ আমরা একটু আমোদ-আহ্লাদের ব্যবস্থা করেছি। আপনাকে তাই নিতে এলাম। যদি গান করেন একটু। রাতে গেস্ট-হাউসেই থাকার বন্দোবস্তও করা হয়েছে। আপনার কোনো অসুবিধে হবে না। আর সম্মানী দেব আমরা দশ হাজার। কাল সকাল আটটার মধ্যে এখানে ফেরত দিয়ে যাব আবার।
দশ হাজার?
টাকার অঙ্কটা শুনে আকার মাথা ঘুরে গেল।
তটিনী বলল, আপনার বোধ হয় মাথা খারাপ হয়েছে। চিনি না শুনি না, আপনি কীভাবে এমন প্রস্তাব করেন? তা ছাড়া আমি এদিকে বেড়াতে এসেছি। মৃদুলবাবুও এসেছেন।
কে মৃদুলবাবু?
হলুদ গোলাপ-এর নায়ক, মৃদুল দাস।
অ। তাতে কী? ওঁর তো আপত্তি নেই কোনো।
উনিও যাবেন। মানে যাবেন বলে বলেছেন আপনাকে?
না, না উনি গিয়ে কী করবেন। ওঁর সঙ্গে আমার আলিপুরদুয়ারেই কথা হয়েছে। বলেছিলেন দশ হাজার অফার করলেই আপনি রাজি হয়ে যাবেন।
তটিনী প্রচন্ড রেগে গেল।
বলল, আমি তো মৃদুলবাবুর স্ত্রীও নই, বোনও নই। আমার ওপরে তাঁর কোন অধিকার যে, উনি আমার সম্বন্ধে বে-এক্তিয়ারে এমন কথা বলেন?
তা তো আমি জানি না তটিনী দেবী।
অবনীবাবুও কি আপনাকে কিছু বলেছিলেন এ-ব্যাপারে?
তটিনী বলল।
না। অবনী তো লোকাল ছেলে। সে কী করে আপনার সম্পর্কে আমার সঙ্গে কথা বলবে।
তারপর আকাতরুর দিকে ফিরে, চানু রায় বলল, আপনিও তো লোকাল। কলেজ পাড়াতে বাড়ি নয় আপনার?
হ।
আকা বলল।
আপনি এখানে কী করছেন?
আমি ওঁর বডিগার্ড।
চানু রায় হো হো করে হেসে উঠল।
বলল, বডিগার্ড। ব্ল্যাক-ক্যাট কমাণ্ডো। বাবাঃ। তটিনী দেবী যে, সঙ্গে বডিগার্ড নিয়ে ঘোরেন তা তো জানা ছিল না। সঙ্গে কি সেলফ-লোডিং রাইফেল টাইফেল আছে নাকি? এ. কে. ফর্টি সেভেন? চাইনিজ?
আকা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে বলল, না। সেসব তত থাকে স্মাগলারদের ই।যারা কাঠ বা সোনার বিস্কিট-এর স্মাগলিং করে নানা ব্যবসার ছুতার আড়ালে। আমার হাত দুইখান-ই যথেষ্ট।
চানু রায় খোঁচাটা নীরবে হজম করল।
তারপর বলল, বাবাঃ আপনি অনেক-ই খবর রাখেন দেখছি।
আপনার সম্বন্ধে রাখি না তবে স্মাগলারদের মোডাস-অপারেণ্ডির খবর কিছু কিছু রাখি। ডি.আই.জি, সাহেবের লগেও আলাপ আছে। একসঙ্গে ফুটবল খ্যালতাম আমরা।
চানু রায়ের মুখটা কালো হয়ে গেল। বলল, চক্রবর্তী সাহেব?
হ।
খুব অনেস্ট অফিসার।
হ। একশৃঙ্গ গন্ডার আর অনেস্ট পুলিশ অফিসার ত কেরমেই একেবারে দুস্পাপ্য হইয়া উঠতাছে।
তাহলে আপনি যাবেন না আমাদের সঙ্গে তটিনী দেবী? আমি ফালতু লোক নই। আমার নাম চানু রায়। বাঘে-গোরুতে একঘাটে জল খায় এখানে আমার নামে। আপনার বডিগার্ডকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। অবনী এবং এই ভদ্রলোকও মানে, আপনার বডিগার্ডও আমাকে চেনেন। আপনার নামটা যেন, কী?
আকাতরু রায়।
তাই বলুন। তা নইলে দুধে লালির সঙ্গে এতভাব।
মুখ সামলাইয়া কথা কইয়েন য্যান চানু বাবু। আপনের নামে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল ক্যান খায় তা আমি জানি। কিন্তু ইখানে গোরুর কারবার নাই। খালিই বাঘ।
তাই?
হ। তাই।
তাহলে আপনি যাবেন-ই না তটিনী দেবী?
কী করে বলেন আপনি যাওয়ার কথা ভেবে পাই না আমি।
এমন সময়ে ওদের মারুতি ভ্যানটা ফিরে এল। মৃদুল আর অবনী নামল।
এই যে অবনী!
অবনী চানু রায়কে দেখে অবাক হয়ে গেল।
বলল, আপনি চানুবাবু? এখানে।
অবাক হলেন নাকি? যেখানে মধু সেখানেই মৌমাছি। আমি যে, কখন কোথায় থাকি, বিশেষ করে উইক-এণ্ডে তা কি আমি নিজেই জানি?
মৃদুল তাড়াতাড়ি পকেট থেকে সিগারেট-এর প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাল। দেখে মনে হল সে যেন, বেশ নার্ভাস।
চানু রায় বলল, এই যে হিরো। কেসটা কী হল? আমি এদিকে বাগানে সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছি। ইয়ার দোস্তরা সব বসে আছে। আর এ কী শুনি মন্থরার মুখে? পিপিং থেকে আমার এক শাগরেদ আপনার জন্যে ভুটান মিস্ট হুইস্কিও জোগাড় করেছে।
পিপিং? সে তো চায়নাতে।
মৃদুল, বলার মতন কিছু খুঁজে পেয়ে, স্বস্তি পেয়ে যেন বলল।
দুর মশাই। পিপিং কী চায়নার কেনা নাকি? ভুটানেও ‘পিপিং’ আছে। ভুটানঘাট থেকে। এগিয়ে গেলেই পিপিং। ভুটানের গিরিখাদ থেকে বেরিয়ে ওয়াঙ্গু নদী যেখানে এসে রায়ডাক হয়ে সমতলে ছড়িয়ে গেছে।
তাই?
মৃদুল বলল।
সে কথার উত্তর না দিয়ে চানু রায় বলল, এখন কী হবে মৃদুলবাবু?
কীসের কী?
আপনার হিরোইন যদি আমাদের সঙ্গে না যায় তবে তো আপনাকেই আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। ফাসখাওয়া অথবা জয়ন্তী নদীর শুকনো বুকের উপরে কাল সকালে যদি আপনার উলঙ্গ ডেডবডি পাওয়া যায় তবে আমাকে দোষ দেবেন কি?
মৃদুল বলল, কী হল কী? আপনি এসব কী বলছেন?
কী বলছি তা বুঝতে পারছেন না?
অবনী তাড়াতাড়ি মাঝে পড়ে বলল, চানুদা আপনি একটু ওদিকে চলুন তো! ব্যাপারটা কী বুঝি।
ব্যাপার বোঝার জন্য ওদিকে যাওয়ার দরকার কী অবনী? তোমাদের হিরো আমার কাছ থেকে পরশু শোয়ের শেষে পাঁচশো টাকার নতুন নোট নিয়েছেন দশখানি। দালালি। তোমাদের হিরোইনকে একরাতের জন্যে ঠিক করে দেবেন বলে। রেট নাকি দশ। বলেই পাঞ্জাবির ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা খাম বের করল। বলল, এতে কুড়িখানি বড়োপাত্তি আছে। একেবারে টাঁকশালের গন্ধমাখা। এমন নেশাধরানো গন্ধ কোনো মেয়েছেলের শরীরেও নেই।
সাবধান। আপনেরে আমি সাবধান কইর্যা দিতাছি।
বলেই আকা চানু রায়ের দিকে এগিয়ে গেল।
সেই মোসাহেব গাড়ির দিকে ফিরে গিয়ে হাতে করে কী একটা নিয়ে ফিরে এল। তটিনীর মনে হল, রিভলভার টিভলবার হবে হয়তো।
তটিনী আকার হাত ধরল পেছন থেকে এসে।
চানু রায় বলল, এই পালাটার নাম কী অবনী?
কোন পালা?
এই এখন আকাতরু রায় আর তটিনী দেবী যে-পালাটি চালু করলেন।
মোসাহেব প্যাকেটটা মৃদুলের হাতে দিয়ে বলল, ভুটান মিস্ট-এর বোতলটা। যেমন কথা ছিল।
চানু রায় বলল, কথা আর কিছু নেই। ফেরত নিয়ে যা, গদাই বোতলটা। শালা বেইমানকে আর হুইস্কি খাওয়াতে হবে না।
গোলমাল শুনে ভেতর থেকে বাংলোর চৌকিদার অজয় ছেত্রী বাবুর্চিখানা থেকে দৌড়ে এল ফিনফিনে জাল লাগানো স্প্রিং-এর দরজা ঠেলে। বলল, কী হইছে স্যার? রেঞ্জার সাহেবরে কি খবর দিমু?
বলেই বলল, নমস্কার চানুবাবু।
চানুবাবু একটি লাল পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে অজয়কে দিয়ে বললেন ভালো খবর তো সব অজয়।
হ্যাঁ স্যার।
নোটটা নিয়ে সেলাম করে অবস্থাটা যে, মনোরম নয় তা আন্দাজ করেই অজয় ভেতরে চলে গেল। যাওয়ার আগে একবার দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আপনেরা কেউ কি জল খাইবেন স্যার?
না অজয়। জল খাব না। তবে একগ্লাস আমাকে দিতে পারো। মাথায় দেব। মাথা গরম হয়ে গেছে।
এরপর-ই চানু রায় সেই, গদাই নামক মোসাহেবকে বলল, গদাই, মালটা ফেরত নিয়ে নে হিরোর কাছ থেকে। হিরো। কালচার্ড মানুষ। কথায় কথায় ইংরেজি ফোঁটায়। কবিতার আবৃত্তিকার। রোজ খবরের কাগজে নাম বেরোয়, প্রশংসা বেরোয় এইসব মানুষদের। ছবি বেরোয়। ছিঃ। কাগজ রাখাই বন্ধ করে দেব। শুধু যাত্রার বিজ্ঞাপন আর এইসব হিরোদের হিরোসিমা।‘
ওই প্রচন্ড অস্বস্তিকর অবস্থাতেও হাসি পেল অবনীর চানু রায়ের সেন্স অফ হিউমার লক্ষ করে।
গদাই বলল, মৃদুলকে, টাকাটা ছাড়ন হিরো। যাত্রা করে তো অনেক-ই টাকা পান তার ওপরেও মেয়ের দালালি করে রোজগার কি, না করলেই নয়? তাও যদি মাল কন্ট্রোলে থাকত।
মৃদুলের মুখ ছাই-এর মতন সাদা হয়ে গেছিল।
বলল, নিয়ে আসছি। স্যুটকেস-এ আছে।
যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে একবার আকাতরুর দিকে তাকাল ও। দেখল আকাতরু সত্যিই বাঘের মতন লাল চোখ করে তাকিয়ে আছে মৃদুলের দিকে। অবনী, তটিনী, এমনকী চানু রায়ও বুঝতে পারল যে, চানু রায় অ্যাণ্ড কোং চলে গেলেই আকাতরু মৃদুলকে আজ মেরেই ফেলবে।
মৃদুল বলল, চানুবাবু, আপনারা যেখানে যাচ্ছেন আজ রাতটা আমাকেও সেখানে নিয়ে যাবেন? তারপর আপনাদের সঙ্গেই ফিরে যাব আলিপুরদুয়ারে।
তারপর?
চানু রায় বলল। তারপর কী করবেন?
কলকাতায় যাব।
অবনী বলল, এখান থেকে জলপাইগুড়ি যাওয়ার কথা যে, আপনাদের। তাঁরা তো নিতে আসবেন পরশু। আপনাদের পুরো ইউনিটও কাল রাতেই বাস ভরতি করে ফিরে আসবেন। কুচবিহার থেকে যে।
আমি যাব না জলপাইগুড়ি।
মেরে তক্তা করে দেবে। হাবু ঘোষকে তো চেনেন না।
সে ভেবে দেখব। আজকে নিয়ে যাবেন আমাকে?
ভিখিরির মতন ভিক্ষা চাইল মৃদুল চানু রায়ের কাছে।
চানু রায় বলল, চলুন। হিরো বলে ব্যাপার। গেলেই দেখবেন চানু রায় এক তটিনীর ভরসাতে বাঁচে না। ডিমা, নোনাই, কালজানি, জয়ন্তী, রায়ডাক নদীর দেশে অভাব নেই কোনো। কলকাতার হিরোইন না হলেও চলে যাবে। আমাদের মোদেশিয়া, নেপালি, ডুবকা, টোটো, রাভা, মেচিয়া, বাঙালিদের মধ্যে কি সুন্দরী নেই নাকি? তারা নাচ-গান জানে না?
থার্ড ক্লাস যত্ত।
বলেই, দু-হাত জড়ো করে তটিনীর কাছে ক্ষমা চাইল চানু রায়। বলল, তটিনী দেবী, বুঝতেই পারছেন, দোষটা আমার নয়। আমি যে, খারাপ তা সকলেই যেমন জানে, তেমন আমি নিজেও জানি। সপ্তাহে ছ-দিন হাজার ঝামেলাতে কাটে। বউ, পূজা-আচ্চা আর তার হা-ভাতে বাপের বাড়ির কল্যাণেই লেগে থাকে।
আর সে গুষ্টি তো নয়, রাবণের গুষ্টি। আমার নিজের প্রয়োজনে আমি বরবাদ হইনি। হয়েছি ওই হারামজাদা গুষ্টির জন্যে। আমার ওপরে বিয়ের পরদিন থেকে তারা বডি ফেলে দিয়েছে। শ্বশুরবাড়ি মানুষের কত আদর-যত্ন-সম্মানের-ভালোবাসার বাড়ি। আমার আজ ঘেন্না ছাড়া তাদের প্রতি কিছুমাত্রও নেই! এইটুকুই আমার আনন্দ ম্যাডাম।
এক একজন মানুষ, এক একরকম করে খুশি হয়। তার খুশি অন্যকে দুখি না করলেই হল। আমি খারাপ হতে পারি কিন্তু আমি ভন্ড নই আপনার হিরোর মতন। এইসব মানুষকেই সমাজ ‘শিক্ষিত’ বলে মানে। দূরদর্শনে এদের মুখ-ই দেখতে হয় আমাদের প্রতিসপ্তাহে একবার করে। এরাই নানা পুরস্কার পায়, পুরস্কার পাইয়ে দেয় অন্যকে। এই বঙ্গভূমের এই কালচার্ড খচ্চরদের মতন এমন হাড় হারামজাদা খচ্চর আর বোধ হয় হয় না।
এমন সময় মৃদুল বেরিয়ে এল হাতে ব্যাগ নিয়ে। তটিনীর মুখের দিকে তাকাল না। তাকাতে পারল না। আকাতরুর মুখের দিকেও নয়। অবনীর দিকে একটি চোরা চাউনি দিয়ে বলল, চললাম।
চানু রায় তটিনীকে আবারও নমস্কার করে বলল, ক্ষমা কি পেলাম?
তটিনী বলল, সত্যি তো। দোষ তো আপনার নয়।
চানু রায় আকাতরুকে বলল, আচ্ছা ব্ল্যাক ক্যাট। চললাম। ভায়া-মেজাজটা বড়োগরম। আসলে মানুষটা তুমি বড়োসোজা। যে-জগৎটাকে মৃদুল সেন আর চানু রায়েরা কন্ট্রোল করছে সেই জগতে সটান সোজা আকাতরু গাছ হয়ে যদি কেউ বাঁচতে চায় তবে তার মরার দিন-ই এগিয়ে আসবে। দেখেশুনে পথ চলল ভাই। আগে তো নিজের প্রাণটা। নেহরুদের তিন জেনারেশান দেশটার যে-অবস্থা করে রেখে গেছে এখানে মানুষের মতন বাঁচার চেষ্টা করার মতন মূর্খামি আর নেই। হয় কুকুর-বিড়ালের মতন বাঁচো নয় সাপের মতন বাঁচো। Like snakes in the grass। এই বক্সাতে বিস্ট সাহেব বাঘ বাঁচাবার, বাঘ বাড়াবার চেষ্টা করলে হবে কী, বাঘ-ফাঘ-এর দিন শেষ হয়ে গেছে এই দেশে। খল, ধূর্ত শেয়াল হও, সুখে থাকবে। বেঁচে থাকবে।
গাড়ির দরজা খুলে উঠতে উঠতে বলল, আকাতরু ভাই তোমাকে এই আমার ফ্রেণ্ডলি অ্যাডভাইস। আমাদের বাড়িও আগে আলিপুরদুয়ারের কলেজ পাড়াতেই ছিল। তুমি আমার পুরোনো পাড়ার লোক বলেই এতকথা বললাম, চলি। গুড নাইট।
.
০৬.
গাড়িটা হেডলাইট জ্বেলে চলে যেতেই আবার চাঁদের আলো স্পষ্ট হল। নদীর সাদা বালি আর পাথরের বুকের ওপরে, কী-একটা পাখি ভূতুড়ে ডাক ডেকে ফিরছে চমকে চমকে। সেই ডাক তটিনীর বুকের ভেতরটা পর্যন্ত চমকে দিচ্ছে। পাখিটা বলছে, ডিড ঊ্য ডু ইট? ডিড ট্য ডু ইট? ডিড উ্য ডু ইট?’
পাহাড়ের ওপরে দাবানল আরও ছড়িয়ে গেছে। আলোর মালা ফুটে উঠেছে। কার গলাতে উঠবে সে মালা কে জানে!
উঠবে হয়তো কোনো অনাঘ্রাত সতী কুমারীর গলাতে। উলু দেওয়া হবে, শাঁখ বাজবে, আতর-জল ছড়াবে আর লাল গোলাপ দেবে ছোটোমেয়েরা। কবিতা ছাপা হবে দিদার, দাদুর। ঠাকুরদা, ঠাম্মার। বর আসবে টোপর মাথায় দিয়ে ফুল সাজানো গাড়িতে।
নদীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তটিনীর দুটি চোখ জলে ভরে এল।
অবনী বলল, আমি চান করে শুয়ে পড়ছি রে আকা। আমার একদম খিদে নেই। তুই কিন্তু তটিনী দেবীকে দেখাশোনা করিস। উনি আমাদের অতিথি। আলিপুরদুয়ারের সকলেরই অতিথি। অনেক অপমান অসম্মান করেছি ওঁকে আমরা। তোর ওপরে ভার দিলাম যদি ক্ষততে সামান্য প্রলেপও দিতে পারিস।
আকাতরু অথবা তটিনী কেউই অবনীর কথার কোনো উত্তর দিল না। কিছু কিছু কথা থাকে, সেসব কথার উত্তর হয় না। কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে, যখন কোনো কথা না বললেই সব বলা হয়।
নদীর ওপারের পাহাড় থেকে গেকো ডাকল ‘টাকটু-উ-উ’। এপার থেকে তার দোসর সাড়া দিল টাকটু-উ-উ। তক্ষক যে তক্ষক, তারও প্রেমিক আছে। স্বার্থহীন, সৎ, ভালো প্রেমিক। অবশ্য তক্ষকের প্রেমিকাও ভালো। সে নিশ্চয়ই সতী।
আকাতরু বলল, ফিরা যাই আমি আলিপুরদুয়ারে। ওই মৃদুল দাসের মুখের জিয়োগ্রাফি আমি যদি না পালটাইয়া দিই ত আমার বাবা-মায়ের বড়ো-মায়ের দেওয়া নামডাই আমি বদলাইয়া ফেলাইম। দেইখেন আনে!
তটিনীর দু-চোখের জল গড়িয়েই যেতে লাগল দু-গাল বেয়ে। গাল থেকে বুক বেয়ে এসে ব্লাউজ ভিজিয়ে দিল।
তটিনী বলল, দোষ তো ওদের কারোর-ই নয়।
ক্যান? নয় ক্যান?
আমিই যে, খারাপ, খারাপ, খারাপ।
আমারে ভগবান যদি, স্বয়ং আইস্যা এইকথা কয় তবুও আমি বিশ্বাস করুম না। আপনে খারাপ হইতেই পারেন না। পিথিবীর যা-কিছু ভালো সেইসব ভালোর প্রতিনিধি আপনে।
হাতের ইশারায় ডাকল তটিনী আকাতরুকে কাছে। তারপর তার সামনে সিমেন্ট-বাঁধানো বসার জায়গাতে বসতে বলল।
আকাতরু তার সামনে গিয়ে বসল। তটিনী তার নিজের হাত দু-টি দিয়ে সারল্য, ভালোত্ব আর পবিত্রতার প্রতিমূর্তি আকাতরুর দু-টি গাল স্পর্শ করল, বড়ো আদরে, বড়ো যতনে।
আকাতরু কাছে আসাতে বুঝতে পারল যে, তটিনী কাঁদছে অনেকক্ষণ হল।
আকাতরু বলল, ম্যাডাম, আপনের দুই পায়ে পড়ি। আমার সামনে আপনে কাইন্দেন না, কোনোদিনও কাইন্দেন না। আমার পরান ভাইঙ্গা যায়। প্লিজ! প্লিজ! ম্যাডাম। বিশ্বাস করেন। আপনে আমারে বিশ্বাস…
দুধলি রাত আর তারাভরা আকাশ আর দাবানলের মালা আর রাতের নদীর বুকে চমকে চমকে ডেকে বেড়ানো ‘ডিড-ইউ-ডু-ইট’ পাখিটাই শুধু জানল আকাতরুর বুকের মধ্যে কী হচ্ছে।
এবং হয়তো তটিনীও জানল।