৫. মানসিকতার শেকড়

এখন আমার মানসিকতার শেকড়ে শেকড়ে নতুন রসের রসায়নের লীলাখেলা চলছে। তার কার্যকারণসূত্রের সমস্ত রহস্যটা আমার কাছেও সুস্পষ্ট নয়। তবু বলি, বোনটি গান-বাজনায় বেশ সুন্দর উন্নতি করছে। এটা যে কেমন করে সম্ভব হলো তা আমি নিজেও বলতে পারব না। আমাদের পরিবারে কোনোকালে গান-বাজনার চর্চা ছিল না। হয়তো এমন হবে আমার বাবার রক্তের যে বাসনা, যে কামনা পাথরের ভেতর কীটের মতো বন্দী হয়ে ছিল, তাই-ই আমার বোনের কণ্ঠস্বরে রঙিন কুয়াশার মতো মুক্তিলাভ করছে। আমি যে কত খুশী হয়েছিলাম।

যাক আসল কথায় আসি। এই সময় থেকেই স্ত্রীকে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিতে দেখতে আরম্ভ করলাম। একটা ছোট্ট ঘটনাই তার কারণ। তাই সেটা বিবৃত করি। একদিন সন্ধ্যেবেলা আমি অফিস থেকে ফিরেছি। কি কারণে মনে পড়ছে না, সেদিন ফিরতে একটু দেরী করে ফেলেছিলাম। আমি তো বোবা স্ত্রীর স্বামী। তাই অফিস থেকে ফিরে অযথা কাউকে ডাকাডাকি করে বিড়ম্বনা বাড়াইনে। সেদিনও চুপি চুপি গেট খুলে ঘরে ঢুকি। আমার বোন তার থাকার ঘরটিতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানের প্র্যাকটিস করছে। গলার স্বর উঁচু পর্দা থেকে নিচু পর্দায় নামছে। নিচু থেকে উঁচুতে চড়ছে। স্বরতরঙ্গের এই লাস্যময় উত্তরণ অবতরণ ধারায় প্রাণের যে মাধুরী রক্ত সন্ধ্যেয় ব্যক্ত হচ্ছে তা ঘরের বাতাস পর্যন্ত মধুময় করে তুলেছে। আমার বোন নিজের মনে গান-বাজনা করছে। আর আমার বোবা স্ত্রী বদ্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। তার গলা দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ নামছে। বাতির আলোতে একফালি কপাল দেখতে পাচ্ছি। দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো সুন্দর। চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় জল গড়িয়ে পড়ছে। সারা শরীর থর-থর করে কাঁপছে। কোনো অসুখ-বিসুখ নয়ত! হাতে পায়ে বিশ্রী রকম খিল ধরার অবস্থা। সচরাচর সে তো এমন করে না। কাউকে ডেকে রহস্যটা উদ্ঘাটন করার সংকল্প নেই। বেশ খানিকক্ষণ লাগল বুঝতে।

আমার বোন গান গাইছে আর বোবা স্ত্রী সকলের অলক্ষ্যে প্রাণপণ প্রচেষ্টায় বোনের সুরেলা কণ্ঠের সঙ্গে নিজের নির্বাক কণ্ঠটি মেলাবার চেষ্টা করছে। চমৎকার অনুসরণ প্রক্রিয়া। কিন্তু পারছে না। সে তো বোবা। তার বাক-যন্ত্রটি কাজ করছে না। কিন্তু শরীরের অণুপরমাণু এই অক্ষমতা মেনে নিতে রাজী নয়। তাতে করে হিষ্টিরিয়া রোগীর মতো খিল ধরছে। সমস্ত শরীর থেকে যে প্রচণ্ড প্রয়াস স্কুরিত হচ্ছে তারই তোড়ে গলা দিয়ে গোল গোল নুড়ি পাথরের খণ্ড-খণ্ড শব্দাংশ ঝরে পড়ছে। সেটা ভাষা নয়। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার পূর্বে যে ধরনের আওয়াজ দেয় তেমনি ধরনের একটা কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় ।

সেদিন থেকে স্ত্রীর প্রতি আমার মনোভাবটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। বুঝতে বাকি থাকল না, তার মনের ভেতর কথা বলার আকাঙ্ক্ষা কি রকম জলপ্রপাতের ধারার মতো ফুলে ফুলে উঠছে। তার কণ্ঠও সুন্দর ধ্বনির প্রসূতি হতে তীক্ষ্মভাবে আগ্রহী। একজন মানুষ কথা বলতে পারে না, এটা কত দুঃখের!

যেটা আমাকে সবচে বেশি নাড়া দিয়েছে আমার স্ত্রী বাকশক্তিহীন দশাটিকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়নি। তার শরীরের প্রতিটি কণা, প্রতিটি অণু-পরমাণু এই বোবাত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বিক্ষোভে ফেটে পড়তে চায়। আমি নিজের চোখে তো দেখলাম। তারও মনের গভীরে ফুলের স্তবকের মতো কথা স্তরে স্তরে সাজানো রয়েছে। তার মনের ভেতর সুখ-দুঃখের আকারে যা ঘটছে এবং বাইরের পৃথিবীতে সুন্দর কুৎসিত যা বিরাজমান রয়েছে, প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তিত হচ্ছে- সব কিছুরই একটি নাম আছে। এই নামটিকেই সে প্রকাশ করতে চায়। কিন্তু পারে না। বাক যন্ত্রটি খারাপ এবং অকেজো বলে।

এই কদিন আগে আমিও তো মনের খনিজ তিমিরে মধুর গুঞ্জরণশীল পাখনাযুক্ত শব্দ ভাণ্ডার পরম দুঃখে আবিষ্কার করেছি। শুধু মেয়েমানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য কেমন উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমার বৌটির অবস্থা তার চাইতে ঢের ঢের করুণ। তার আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি গভীর। দাবী অনেক বেশি বাস্তব এবং জোরালো। স্ত্রীর প্রতি দরদ এবং মমতায় সমস্ত অন্তর মথিত হয়ে উঠল। সে রাতে তাকে অত্যন্ত কোমলভাবে আদর করলাম। স্বামী হিসেবে জীবনে যে-সব করিনি সব করলাম। হঠাৎ আদরের ঘটা দেখে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল । স্ত্রী জীবনে কোনোদিন আদর মমতার মুখ দেখেনি। খুবই ছোট্ট বয়সে মাকে হারিয়েছে। সত্মার সংসারে মানুষ। আমি তো একজন নিষ্ক্রিয় পুরুষ। হাতের কাছে যা পাওয়া যায়, তার বাইরে কিছু আছে বা থাকতে পারে একথা মনে একবারও উদয় হয়নি। আসলে আমার শ্বশুর সাহেব মোক্তারী বুদ্ধি দিয়ে যা সম্ভাবিত করেছিলেন তাই নিয়েই আমি সন্তুষ্ট ছিলাম।

গুণী বাজিয়ের হাতে পড়লে বেহালার তারের তড়িত যেমন অপরূপ শিখায় জ্বলে ওঠে তেমনি তার সমগ্র সত্তা আমার প্রতি স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। চোখে ঘুম নামছিল। আধোঘুমের মধ্যে অনুভব করলাম আমার বৌটি কাঁদছে… আহা কাঁদুক।

মাঝরাতে উঠে বাথরুমে যাবার জন্য বাতি জ্বাললে দেখি সে একাকী জানলার পাশে হাতের ওপর মুখ রেখে বসে রয়েছে। খুব দূরে শিরিশ পাতার জালের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে একখণ্ড কৃষ্ণ পক্ষের স্নান চাঁদ উঠে আসছে। তার মুখমণ্ডলে দেবীর মতো বিকশিত মহিমা। হাত ধরলে পায়ে পায়ে বিছানায় চলে এল। সারারাত একতাল কাঁদার মতো আমার শরীরের সঙ্গে লেগে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *