৫. বাড়ির আবহাওয়া শান্ত

এখন বাড়ির আবহাওয়া মোটামুটি শান্ত। সৌরভের সঙ্গে মলির একটা আপাত সমঝোতা হয়েছে। অন্তত সামনাসামনি মলি সৌরভের সঙ্গে কথা বলছে। সৌরভও প্রয়োজনে চেঁচিয়ে মলি বলে ডাকছে। স্বভাবতই সরলা এতে খুশি। গৌরব দোতলায় ব্যালকনিতে বসে মাকে নিয়ে ভাবছিল। এই মা কত বদলে গেল। রুচি শিক্ষা এবং সহবৎ নিয়ে যে মা এককালে কোনো কিছুর সঙ্গে আপোষ করত না সেই মা একে একে সব মেনে নিচ্ছে। সৌরভ যে রাত আটটার পরে স্নান সেরে হুইস্কি নিয়ে বসে সেটাও তার অজানা নয়। কিন্তু হুইস্কি খেয়ে যদি কেউ মাতলামি না করে তাহলে তার যে আপত্তি নেই সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু যতই ভাবভালবাসা আপাতভাবে ছড়িয়ে থাক মলির সঙ্গে মায়ের যে মানসিক দূরত্ব কয়েক যোজনের তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দুটি নারী নেহাৎ নিজস্ব শান্তির জন্যে একটা অভিনয় জিইয়ে রেখেছে। জয়তী যদি এই সংসারে বউ হিসেবে আসে তাহলে তার সঙ্গেও কি মায়ের সম্পর্ক ওই রকম স্তরে পৌঁছবে? জয়তী আধুনিকা, কিন্তু তার উগ্রতা নেই। বরং আবেগের চেয়ে যুক্তিতে তার বেশি ভরসা। মলি আবার যুক্তির ধার ধারে না। তার মনে যখন যা আসে তাই ঘটাতে চায়। মলির সঙ্গে জয়তীর মিল হওয়া নিতান্তই অসম্ভব। মায়ের সঙ্গে মিলবে এমন ভরসা কোথায়?

মোটরবাইক নিল না গৌরব। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসে চড়বে বলে স্থির করল। বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়াতেই একটা ট্যাক্সি নজরে এল। সেটা বোধহয় সওয়ারী পেতে অপেক্ষা করছিল। ট্যাক্সি ড্রাইভার দরজা খুলে এগিয়ে এল, আরে দাদা, আপনি? এদিকে থাকেন নাকি?

গৌরব লোকটার দিকে তাকাল। অল্প অল্প দাড়ি, বেশি বয়স নয়। পাঞ্জাবি ড্রাইভারদের মতো নস্যি রঙের পাঞ্জাবি। চিনতে অসুবিধা হলো না তবু, আরে! এ বেশে এখানে?

আমাকে চিনতে পারছেন দাদা?

বিলক্ষণ!

আমি এখন ড্রাইভারি করছি। কন্ট্রাক্টে ট্যাক্সি চালাই। দিনে গোটা চল্লিশেক হয়। ফার্স্ট ক্লাস। নিজেই নিজের রাজা।

 মাস্তানি? মারপিট?

আর লজ্জা দেবেন না দাদা। ভেবে দেখলাম ওতে কোনো ফায়দা নেই। আপনি ভেবে দেখুন, এই কলকাতা শহরে আমার মতো পাড়ার মাস্তান অন্তত হাজার পাঁচেক আছে। এরা কেউ এইট নাইন পর্যন্ত পড়েছে কি না সন্দেহ। তিরিশ বত্রিশ বছর পর্যন্ত রংবাজি করে দিব্যি চালিয়ে যায়। কিন্তু তদ্দিনে অল্পবয়সী রংবাজ উঠে আসে। যা বাইশে মানায় তা চল্লিশে চলে না। এর মধ্যে মারপিট, পুলিশের ধোলাই এসব তো রয়েছে। তাই পঁয়ত্রিশের পর মাস্তানরা বেকার হয়ে যায়। আর পলিটিক্যাল দাদারা পাত্তা দেওয়া বন্ধ করলে কেস খতম। তখন না পায় চাকরি না করতে পারে ব্যবসা। কী ভাবে যে বেঁচে থাকে তা ওরাই জানে।

জমানো টাকা পয়সা থাকে না?

দূর, সব মেজাজ দেখাতে ফক্কা হয়ে যায় আসার পরেই। সেদিন খুকিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর মারপিট হতেই আমার মনে হলো অনেক হয়েছে এবার একটু অন্যরকম জীবন যাপন করা যাক। ড্রাইভিংটা জানতাম। বেরিয়ে পড়লাম ট্যাক্সি চালাতে, জয় বলল।

এখন কোথায় আছ?

এন্টালিতে। যার ট্যাক্সি তার একটা ছোট ঘর খালি ছিল। দুশোটাকা ভাড়া দিয়ে আছি। আপনি যাবেন কোথায়?

কোথাও না। মানে কোথাও যাব বলে ঠিক করি নি। এমনি।

তাহলে চলে আসুন দাদা, আমার পাশে বসবেন। ট্যাক্সিওয়ালাদের জীবনটা একটু দেখে নিন। জয় কথা শেষ করতে না করতেই এক ভদ্রলোক চিৎকার করলেন, ট্যাক্সি। জয় ইশারা করল গৌরবকে। মজা লাগছিল গৌরবের। ছোটকাকার বাড়িতে গিয়ে এই মাস্তানটার যা চেহারা দেখেছিল আজ তার একদম বিপরীত রূপ। ছেলেটা কথাগুলো ঠিকই বলেছে। তাদের সময় যেসব মাস্তান আতঙ্ক সৃষ্টি করে বিরাজ করত তারা এখন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে।

স্রেফ সময় কাটানোর জন্যেই জয়ের পাশে উঠে বসল। জয় বলল, মিটারটা ডাউন করে দেবেন দাদা?

হাত বাড়িয়ে সেটা করতে গৌরবের কিঞ্চিত অসুবিধে হলো। পেছনের আসনে বসে ভদ্রলোকে বললেন, তাড়াতাড়ি যাবেন। তারাতলার মোড়।

অর্থাৎ কলকাতার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। জয় বেশ ফুর্তির সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছিল। হঠাৎ ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, তুমি খুব অন্যায় করছ।

ভদ্রলোক ফুঁসে উঠলো, বেশ করেছি।

তুমি কি আমাকে তোমার দাসী মনে করো? তুমি যা বলবে তাই আমাকে শুনতে হবে? এভাবে আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়।

না হলে বাপের বাড়ি চলে যাও। আমার বাড়িতে যদ্দিন থাকবে তদ্দিন আমার কথা শুনতে হবে। পরিষ্কার কথা। ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক।

পুরোটা পথ দুজনে ঝগড়া করে গেলেন গলা তুলে। এটা একটা ট্যাক্সি এবং সামনের আসনে দুটো মানুষ বসে আছে একথা তারা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলেন না। গৌরব এর আগে যখনই ট্যাক্সিতে উঠেছে তখন যাত্রী হিসেবেই উঠেছে। আজ এই নতুন ভূমিকায় তার মনে হলো কলকাতার যাত্রীরা সত্যি কিম্ভূত।

ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে মনে হলো ড্রাইভার হিসেবে জয় নিতান্তই ব্যতিক্রম। কাউকে না বলছে না। খালি থাকলে যে ডাকছে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। গন্তব্য স্থান নিয়ে আপত্তি করছে না। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক খামোকা ঝগড়া করলেন। ট্যাক্সি খালি ছিল। হাত তুলে চিৎকার করে থামালেন। কাছে এসে চেঁচিয়ে বললেন, কানের মাথা খেয়েছ, এত চিৎকার করছি শুনতে পাচ্ছ না?

জয় বলেছিল, হাত নাড়লেই হতো, খামোকা চিৎকার করতে গেলেন কেন?

কি? খামোকা? ডাকলে তোমরা থামতে চাও না আবার কথা। শোনো তুমি যদি আমাকে রিফুজ কর তাহলে আমি থানায় যাবো।

আমি আপনাকে কিছুই বলি নি। জয় হাসল।

কোনো কথা না বলে পেছনের দরজা খুলে উঠে বসলেন বৃদ্ধ, এই আমি বসলাম। এবার দেখি তুমি কী করো।

আপনি যেখানে যেতে চাইবেন নিয়ে যাব।

ও তাই নাকি? হঠাৎ এত ভদ্র কথা। শ্যামবাজার।

জয় গৌরবের দিকে তাকাল। গৌরব হেসে ফেলল। বৃদ্ধ সম্ভবত সেটা দেখতে পেলেন, হাসি কেন? এত হাসি কীসের? বদ মতলব আছে নাকি?

জয় ইশারা করল গৌরবকে কথা না বলতে।

এরপরে সারাটা পথ বৃদ্ধ টিকটিক করে গেলেন। এত স্পিডে কেন, ওভারটেক করবে না, এই রাস্তায় জ্যাম হয় একটা বাচ্চা ছেলেও জানে তবু তুমি ঢুকলে, বাঙালির থেকে সর্দারজি ট্যাক্সি ড্রাইভার হাজার গুণ ভালো, এই জন্যেই বাঙালির কিছু হলো না– যেন নিজের মনেই কথা বলে গেলেন।

স্টার থিয়েটারের একটু আগে ট্যাক্সি থামালেন বৃদ্ধ। ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করলো, কত হয়েছে? ঠিক মতো হিসেব করবে।

জয় গম্ভীর মুখে রেট কার্ড বের করে ওঁকে দিলো। বেশকিছুক্ষণ ধরে সেটাকে পড়ে তিনি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নেমে পড়লেন। জয় বলল, এ ধরনের প্যাসেঞ্জার প্রচুর। কত যে গালাগাল রোজ শুনতে হয়। বলতে বলতে সে পেছনে তাকিয়েই চিৎকার করে উঠল, দাদু, দাদু! বৃদ্ধ ততক্ষণে উল্টো ফুটপাতে, চিৎকার শুনে ফিরে তাকালেন। পেছনের সিট থেকে একটা ছোট চামড়ার ব্যাগ তুলে জয় ওঁকে দেখাতে তিরের মতো ছুটে এলেন, ইস,সর্বনাশ হয়ে গিয়েছিল। একদম ভুলে গিয়েছিলাম, তুমি তো মন্দ ছেলে না। অবশ্য তেমন কিছু ছিল না, টাকা বিশেক। চলি।

বৃদ্ধের আচরণে গৌরব হতভম্ব হয়ে গেল। জয় বলল, এই হলো জীবন দাদা।

.

সারাদিন নানা অভিজ্ঞতা মনুষ্যচরিত্র সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হলো গৌরবের কাছে। সেই সঙ্গে জয়কেও। গৌরবের বারংবার মনে হচ্ছিল এই ছেলেটি নেহাৎই একটি অশিক্ষিত পাড়ার মাস্তান নয়। এর মধ্যে দু-দুবার প্রমাণ পেয়েছে সে। কিন্তু বলে ফেললেই জয় সেটাকে ঘোরাতে চেয়েছে। একবার দেওয়ালে সাঁটা জনৈকের মৃত্যু নামে একটা নাটকের পোস্টার দেখে গৌরব বলেছিল, বাঃ, একই নাটক কলকাতায় আর ন্যুয়র্কে অভিনয় হচ্ছে।

জয় ঘাড় নেড়ে বলেছিল, এটা এর আগেও এখানে রেগুলার শো হয়েছে। ডেথ অফ এ সেলসম্যান। প্রথমে খেয়াল করেনি গৌরব। পরে কানে লাগল। একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের পক্ষে মূল নাটকটির নাম জানা সহজ ব্যাপার নয়। জয় কিন্তু ওই প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ালই না। গৌরব দু-একবার বললেও শ্রোতার ভূমিকা নিয়ে নিল। গৌরবের তখন মনে হয়েছিল হয়তো খুকিদের কাছে প্রসঙ্গে ওই নামটা শুনে মনে করে রেখেছে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক বাদে মদ খাওয়া, মাতলামো নিয়ে কথা উঠতে জয় ফট করে বলে বসল, ইংরেজি ছবিতে অনেকেই মদের গ্লাস হাতে নিয়ে কথা বলে কিন্তু মাতালকে নিয়ে ছবিতে হাসাহাসি আজকাল হয় না।

 গৌরব জিজ্ঞাসা করল, তুমি খুব ইংরেজি ছবি দেখো মনে হচ্ছে?

না না। আজকাল সময় পাই না, আগে দেখতাম।

 তোমার অতীতটা বলতে অসুবিধা আছে?

কথা না বলে জয় গাড়ি চালাচ্ছিল। বড়বাজার থেকে বালিগঞ্জ। পেছনে এক বৃদ্ধ মাদ্রাজী দম্পতি। প্যাসেঞ্জার বুঝে যে নিজস্ব কথা বলা চলে এই ধারণাটা ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে গৌরবের। জয় জবাব না দেওয়ায় কৌতূহল বাড়ছিল গৌরবের। সে বলল, আমি তোমার সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড। কেন জানতে চাইলে বলব তোমাকে এই শ্রেণির লোক মনে হয় না।

কোন্ শ্রেণির?

 পাড়ায় যারা মারামারি করে অথবা ট্যাক্সি চালায়।

একটু ভুল হলো দাদা। পাড়ায় যারা মারপিট করে, মাস্তান নামে বিখ্যাত হয় তাদের কোনো শ্রেণি নেই তাই আত্মমর্যাদা বলে কোনো ব্যাপারও নেই। কিন্তু যারা ট্যাক্সি চালায়, নিজের পেটের রুটি পরিশ্রম দিয়ে রোজগার করে তারা ওদের সঙ্গে এক হতে পারে না। বেশ জোরালো গলায় বলল জয়।

সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে নিল গৌরব, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ।

জয় স্টিয়ারিং-এ টোকা মারল। ট্যাক্সি ডালহৌসি ছাড়িয়ে এখন রাজভবনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। সে বলল, দাদা শুনেছি আপনি আমেরিকায় অনেক কাল আছেন। সেখানে কি স্নেহমাখা প্রীতি ভালবাসা, মানে এইসব সম্পর্কগুলো উঠে গিয়েছে?

মোটেই না। মানুষের জীবন থেকে এগুলো কখনই উঠে যাওয়ার নয়।

ঠোঁট কামড়ালো জয়, আমার সব গোলমাল হয়ে যায়। শ্রেণির কথা আছে মনে করেন? নেই। আই হেট দেম। ওইসব মুখোশপরা মানুষগুলোকে আমি ঘেন্না করি।

গৌরব নিঃসন্দেহ হলো। আজ অবধি কোনো বাঙালি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে সে এই ভাষায় কথা বলতে শোনেনি। জয়ের নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে কোনো গোপন ক্ষত আছে। সে কিছু বলল না দেখে জয় গলা নামাল, আমার এভাবে কথা বলা হয়তো ঠিক হয় নি কিন্তু ওদের কথা ভাবলেই মাথা গরম হয়ে যায়। আমি ওদের দেখেছি, দেখতে বাধ্য হয়েছি কারণ ওরকম একটা পরিবারে দুর্ভাগ্যবশত আমার জন্ম হয়েছিল। যে ভদ্রলোককে বাবা বলতাম তিনি বিদেশি কোম্পানির বড় চাকুরে। যাঁর পেটে আমি জন্মেছিলাম অসম্ভব সুন্দরী আর সৌন্দর্য নিয়ে মশগুল থাকা ছাড়া আর কিছু জানেন না। দুজনের মধ্যে আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক অথচ কখনই ডিভোর্স করবেন না। ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলার দেখা হয় একমাত্র ব্রেকফার্স্ট টেবিলে। প্রতিটি সন্ধ্যায় ভদ্রমহিলা সেজেগুজে পার্টিতে চলে যান বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে। ফিরে আসেন মধ্যরাত শেষ হলে। ভদ্রলোক বাইরে মদ গিলে আউট হয়ে ঘরে নাক ডাকায়। এই অবস্থায় আমার বাল্যকাল কেটেছিল। আমার একটা বোন ছিল। খুব মিষ্টি। সে মানুষ হতো আয়ার কাছে। আমাকে খুব ভালবাসতো। কিন্তু জ্ঞান হবার পর থেকে আমি আর বাবা-মাকে সহ্য করতে পারতাম না।

জয় চুপ করল

তারপর?

সকালবেলায় দুজনে আমাকে খুব জ্ঞান দিতেন। ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে আর আমি মনে মনে ভাবতাম। স্কুল লিভিং পাস করার পর আর স্কুলে যেতাম না। তখন কিছু বন্ধু জুটে গিয়েছিল। তারা ট্যাবলেট খেত। আমিও খেয়েছি কয়েকবার। কিন্তু ব্যাপারটা কেন জানি না আমাকে টানত না। এর মধ্যে আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির একটা লোক ঝি-এর সঙ্গে অশ্লীল ব্যবহার করেছিল। মেয়েটাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল লোকটার বউ। সে বেচারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছিল। ঘটনাটা শুনতে পেলে আমরা তিনজন বন্ধু সেদিনই লোকটাকে রাস্তায় ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে বেধড়ক মারলাম। ওই লোকটাকে আমি কদিন মাকে নিয়ে পার্টিতে যেতে দেখেছি। সেই রাগটাও ভেতরে ছিল। মার খেয়ে হাত ভেঙে লোকটা নিশ্চয়ই বাবামায়ের কাছে নালিশ করেছিল। সেদিন ফেরামাত্র দুজন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। গায়েও হাত তুলেছিল। আঁতে ঘা লাগলে ওই এলিট সম্প্রদায়ের সঙ্গে বস্তির লোকের কোনো পার্থক্য নেই। বাবা আমায় বাড়ি থেকে দূর হয়ে যেতে বলল। মা বলল, আমার মুখ দেখা পাপ। আমি কথা না বাড়িয়ে জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কদিন এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম। তারাও অস্বস্তিতে পড়ল আমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসায়। মাসখানেক ছিলাম। তদ্দিনে একটু একটু করে আমি বেশ মাস্তান হয়ে গিয়েছি। শেষে একটা বস্তিতে গিয়ে ঘর ভাড়া করে বেশ ছিলাম। দলটল তৈরি হয়ে গেল সেই সঙ্গে অ্যান্টি পার্টি। আমার অসুবিধে হচ্ছিল একটাই আমি কোনো বড় মাস্তানের সেল্টার নিই নি বা পলিটিক্যাল নেতার চামচে হই নি। ওটা না হলে শুধু মাস্তানি করে টিকে থাকা মুশকিল।

তোমার মা-বাবার সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি?

না।

ওঁরা কোথায় থাকেন?

কি হবে জেনে? আমি ওই চ্যাপ্টারটা ভুলে যেতে চাই।

গৌরব ওর মুখের দিকে তাকাল। মনের ভেতরে একটা সন্দেহ ক্রমশ প্রবল হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত সে জিজ্ঞাসা না করে পারল না, তোমার বোন কি এখনও ছাত্রী?

হ্যাঁ। বাচ্চা মেয়ে। ওর জন্যই মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। খুব মিস করি ওকে। যাত্রী নামিয়ে ওরা এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে চা খেল। ভাঁড়ের চা বহুদিন বাদে খেতে মন্দ লাগল না। এবার সন্ধে হয়ে গিয়েছে। গৌরবের বাড়ি ফেরার কথা মনে হলো। জয়কে সেকথা বলতেই সে বলল, চলুন ফিরে যাই। আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আমি ট্যাক্সি গ্যারেজ করে দেবো আজ।

আমাকে নামাতে অতদূরে যেতে হবে না তোমাকে। আমি চলে যাব।

দূর! তা কি কখনও হয়?

জয় ছাড়ল না। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশ দিয়ে আসছিল ওরা। রাস্তায় আলো জ্বলছে। ফুটপাতে লোক চলাচল এমনিতেই কম থাকে এদিকে। হঠাৎ দেখা গেল একটি মেয়ে মরিয়া হয়ে দৌড়োচ্ছে। তার পেছন পেছন দুটো মানুষ। ব্যাপারটা দেখতে পেয়ে জয় দ্রুত মেয়েটির পাশে গাড়ি নিয়ে গিয়ে ব্রেক কষল। সে চিৎকার করল, কী হয়েছে? দৌড়চ্ছেন কেন?

মেয়েটি আতঙ্কিত মুখে এপাশে তাকাল তারপর পেছনে। যে লোক দুটো অনুসরণ করছিল তারা দাঁড়িয়ে পড়েছে। জয় আবার জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

মেয়েটি কথা বলতে পারছিল না ভালো করে। কাঁপতে কাঁপতে বলল, ওরা–ওরা।

ওরা আপনাকে বিরক্ত করছে?

মেয়েটি আবার পেছন দিকে তাকাল, ওরা খুব খারাপ লোক।

জয় ট্যাক্সি থেকে নেমে দাঁড়াতেই লোকদুটো পিছু হটল। তারপর ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। জয় বলল, আপনি চলে যান এবার, ওরা পালিয়েছে।

মেয়েটির চোখে মুখে তখনও ভয়, না ওরা লুকিয়ে আছে, আপনারা চলে লেগেই আবার আসবে। দোহাই, আমাকে এখান থেকে অন্য কোনো জায়গায় নিয়ে নামিয়ে দিন। দয়া করে বাঁচান আমাকে।

জয় গৌরবের দিকে তাকাল। গৌরব বলল, যা করার করো, এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা ভালো হচ্ছে না। জয় মেয়েটিকে ইঙ্গিত করল, পেছনে উঠুন।

মেয়েটি বিনা বাক্যব্যয়ে পেছনে উঠে বসল। ট্যাক্সিতে ফিরে এসে জয় বলল, দেখুন, আপনাকে আমরা চিনি না। কোনো নাটক করার চেষ্টা করবেন না। সে ইঞ্জিন চালু করে অ্যাকসিটারে চাপ দিলো।

এবার গৌরব জিজ্ঞাসা করল, আপনি এদিকে এসেছিলেন কেন? এই সময়ে?

 মেয়েটি জবাব দিলো না। মুখ নিচু করে রইল।

 গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কী করেন আপনি?

কিছু না। নিচু গলাতেই জবাবটা এল।

তাহলে এখানে কী করছিলেন?

একজন নিয়ে এসেছিল। বলেছিল চাকরি দেবে।

এখানে চাকরি?

আসার পর বুঝলাম কী চাকরি।

 তার সঙ্গে আলাপ হলো কোথায়?

ট্রেনে।

ট্রেনে? কোথায় থাকেন আপনি?

নিউ ব্যারাকপুর।

মেয়েটি বলামাত্র জয় হাসল গাড়ি চালাতে চালাতে, এসব গল্প এর আগে অনেকবার শোনা হয়ে গেছে। ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারে না এরা।

মেয়েটি ককিয়ে উঠল, বিশ্বাস করুন, আমি মিথ্যে বলছি না। আমি স্কুল ফাইন্যাল পাশ। পড়াশোনা করতে পারি নি টাকার অভাবে। বাবা নেই, দাদার রোজগার খুব কম। চাকরির খোঁজে কলকাতায় আসতাম। এই সময় লোকটার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। বিশ্বাস করুন আমার কথা।

 হঠাৎ জয় বলল, চলুন আমি নিউব্যারাকপুরে আপনার বাড়িতে যাব।

মেয়েটি বলল, চলুন। দেখবেন আমি সত্যি বলছি।

জয় শিয়ালদা স্টেশনে নিয়ে এল ট্যাক্সি। বলল, নেমে যান। মেয়েদি কেঁদে ফেলল, আপনারা ভগবান।

দূর। আমরা কিছু নই। আমি তো নই। যদি সত্যি কথা বলে থাকেন তাহলে আজ না হয় বাঁচলেন কিন্তু রোজ আমি থাকব না উদ্ধার করতে।

মেয়েটি চুপচাপ নেমে চলে গেল। জয় স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে ওর যাওয়া দেখল। তারপর বলল, মেয়েটা সত্যি বলেছে, না দাদা?

গৌরব কোনো কথা বলল না। তারও মন খারাপ লাগছিল। পৃথিবীর সব দেশেই অভাব এভাবে মেয়েদের সর্বনাশের পথে নিয়ে যায়। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, জয়? তোমার বোনের নাম কি টিনা? চমকে ফিরে তাকাল জয়। এত অবাক সম্ভবত কখনও হয়নি সে। কথা বলতে একটু সময় নিল, আপনি চিনলেন কী করে?

আমি চিনি। তোমার সঙ্গে যেভাবে আলাপ হয়েছিল সেইরকম এক ঘটনাচক্রে ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। আমি তোমাদের বাড়িতেও গিয়েছি। অবশ্য আমি আন্দাজে এত কথা বলছি, যদি আমার চেনা টিনা তোমার বোন হয়!

আপনার পরিচিত টিনা কোথায় থাকে?

গৌরব এলাকাটা বলল। স্টিয়ারিং-এ রেখে গম্ভীর মুখে জয় জিজ্ঞাসা করল। আপনার সঙ্গে আলাপ হলো কীভাবে?

আগে শুনতে চাই ওই টিনা তোমার বোন কিনা? 

জয় নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। গৌরব শুরু করল সেই রাত্রে একা টিনা যেভাবে পথে বেরিয়ে এসেছিল, সেখান থেকে। সমস্ত ঘটনা শোনার পর জয় বিস্ময়ে জমে গেল, টিনা এত বড় হয়ে গিয়েছে?

তুমি ওকে কতদিন দ্যাখোনি?

বছর চারেক।

 এই সময়ে চার বছর মেয়েদের পক্ষে বড় হবার জন্যে অনেক বেশি সময়।

আমি ভাবতেই পারছি না দাদা, সেই টিনা, ছোট্ট টিনা—

তুমিও তখন খুব বড় দাদা ছিলে না জয়!

কিন্তু আপনি নিশ্চিত টিনা ড্রাগের আড্ডায় যায়? আমি এটা মানতে পারছি না। এটা সত্যি হলে আমি কাউকে ছেড়ে দেবো না। কঠোর হলো ওর মুখ।

হ্যাঁ, ড্রাগের আড্ডায় সে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ড্রাগ সে নেয়নি তা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। আমার ধারণা সেই রাত্রের পরে ও আর নিজেকে নষ্ট করতে বাইরে বের হবে না। কিন্তু ধারণাটা যদি ভুল হয় তুমি কী করতে পার? দূর থেকে কোন্ মানুষকে তুমি কতটা বুঝবে?

মানে থতমত হয়ে গেল জয়।

কথাগুলো শুনে তোমার খুব খারাপ লেগেছে, বোনকে অত্যন্ত ভালবাসতে এবং সেই স্মৃতি এখনও তোমার মনে রয়ে গেছে। গৌরবকে কথা শেষ করতে দিলো না জয়। মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, স্মৃতি নয় দাদা আমি পৃথিবীর যে কোনো মানুষের চেয়ে ওকে বেশি ভালবাসি।

তোমার সেটা ধারণা।

কী বলতে চাইছেন আপনি? রুখে উঠল জয়।

গৌরব হাসল, ভালবাসা একটা বায়বীয় ব্যাপার নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের এই সম্পর্ক তৈরি হয় এবং বেঁচে থাকে পরস্পরের ব্যবহার, চালচলন, মানসিকতার ওপর। ধর, তুমি যাকে ভালবাসতে সে বরফ। বরফই তোমার খুব প্রিয়। এইবার তুমি পরিস্থিতির চাপে সেই বরফের কাছ থেকে দূরে চলে যেতে বাধ্য হলে। কিন্তু তোমার মনে সেই ভালবাসা অটুট হয়ে রইল। যখনই তার কথা ভাব তখনই শেষ দেখা স্মৃতিটি তোমাকে সাহায্য করে। এই অবধি বলে গৌরব জিজ্ঞাসা করল, আমার কথার মধ্যে কোনো অসঙ্গতি আছে মনে হয়?

জয় মাথা নাড়ল। তারপর?

এবার বেশ কিছুদিন পরে তুমি সেই বরফের কাছে এসে দেখলে তা জল হয়ে গিয়েছে। জল সম্পর্কে তোমার আগ্রহ নেই বরফ সম্পর্কে ছিল। তুমি সেই জলকে আগের মতো বরফ ভেবে ভালবাসতে গেলে পারবেও না উল্টে দুঃখ পাবে। জয়, পণ্ডিতরা বলে গিয়েছিলেন ভালোবাসার নিয়ত পরিচর্চা হওয়া উচিত। সেটা না হলে পরে সব হিসেব ওলোট পালোট হয়ে যায়। ব্যতিক্রম যে নেই তা বলব না কিন্তু ব্যতিক্রমই তো নিয়ম নয়।

কথাগুলো মন দিয়ে শুনে জয় ট্যাক্সি চালাতে লাগল। এখন অনেকেই হাত নেড়ে তাকে থামতে বলছে কিন্তু সে ভ্রূক্ষেপ করছে না। একেবারে গৌরবের পাড়ায় পৌঁছে বলল, যাকগে। ও তো এখন বড় হয়ে গিয়েছে, আমার কি! যাদের দায় তারা বুঝবে। আমি যখন ওই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি তখন আর ভাবতে যাব কেন?

গৌরব হাসল, কিন্তু তুমি ভাববে।

 জয় ঠোঁট কামড়াল।

গৌরব বলল, তোমাদের সঙ্গে সংঘাত হয়েছিল বাবা এবং মায়ের। তাদের জীবনযাত্রা তুমি পছন্দ করোনি। তোমার মনে হয়েছে পিতামাতা হিসাবে তারা ব্যর্থ। প্রতিবাদ জানাতে নিজের ভবিষ্যতের তোয়াক্কা না করে তুমি বেরিয়ে এসেছিলে। ভালো মন্দ প্রশ্ন আমি করছি না। কিন্তু টিনার সঙ্গে তো তোমার কোনো মতবিরোধ ঘটেনি। সে তোমাকে ভালবাসত তুমি এখনও তাকে ভালবাসো। দাদা হিসেবে সে কর্তব্য যদি না করো তাহলে বাবা মাকে সমালোচনা করার কোন অধিকার তোমার নেই। আচ্ছা, আসি।

ট্যাক্সির দরজা খুলে নেমে যাচ্ছিল গৌরব জয় বাধা দিলো, দাদা, এক মিনিট।

গৌরব থামল। জয় মুখ ঘুরিয়ে নিল, আপনার বাড়িটা ঠিক কোথায় দেখে গেলে কোনো অসুবিধে হবে?

গৌরব আবার দরজা বন্ধ করে বসে পড়ল, বিন্দুমাত্র নয়।

একদম বাড়ি তো আমি ঢুকব না। টিনার সঙ্গে দেখা করি কী করে?

গৌরব হাসল, ঠিক আছে আগামী পরশু তুমি আমার কাছে একটা খবর নিও। এ বাড়ির টেলিফোন নম্বরটা লিখে দিচ্ছি। ছোট্ট একটা কাগজে নম্বর লিখে এগিয়ে ধরতে জয় সেটা নিয়ে বলল, দেখা হবে দাদা। সে চলে গেল।

.

কলকাতা শহরে মানুষ আরামে বাস করতে পারে না। দুশো বছর এদেশে বাস করে ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজনে শহরটিতে যেসব আধুনিক সুবিধে তৈরি করে গিয়েছিল স্বাধীনতার পর চল্লিশ বছর ধরে তার অধিকাংশই আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। একমাত্র পাতাল রেল ছাড়া নতুন কিছু তৈরি করিনি। যে শহরে চল্লিশ হাজার মানুষের চলাফেরা ছিল সেখানে চল্লিশ লক্ষ মানুষ নিঃশ্বাস ফেলছে। যে রাস্তা একশটা গাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল সেখানে দশ হাজার গাড়ি ঠেলাঠেলি করে চলেছে। একমাত্র বক্তৃতা এবং মিছিল ছাড়া কলকাতার মানুষের জীবনযাত্রার কোনো উন্নতি হয় নি।

আমেরিকা থেকে কলকাতায় বাস করতে হলে তাকে অনেক কিছু ছেড়ে দিতে হবে। এই ছাড়ার হিসেব করতে গিয়ে গৌরব দেখল সবই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। অমন আরামদায়ক বাড়ি যা স্বচ্ছন্দেই ঠাণ্ডা গরম করা যায় অত্যন্ত অল্প পয়সায় তা কলকাতায় পাওয়া যাবে না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি যার দাম খুবই অল্প, যেটা চালানোর জন্যে মসৃণ রাস্তা দেশময় বানিয়ে রেখেছে আমেরিকান সরকার তা এখানে স্বপ্নেও কল্পনা করা যাবে না। বাজারে গিয়ে দুধ মাংস মাছ সবজি থেকে যা কিছু খাদ্যদ্রব্য নির্ভেজাল বলে কিনে আনা আর এ দেশে সম্ভব নয়। চাকরির ক্ষেত্রে চমৎকার কাজের আবহাওয়া এ দেশে কখনই তৈরি হল না। দেশ আমাকে যা দিচ্ছে তার বিনিময়ে আমার শ্রম এবং মেধা দেশকে দেওয়া প্রথম কর্তব্য–এই বোধ যাতে তৈরি না হয় সেই চেষ্টা করে গিয়েছে ভারতবর্ষের মানুষের সুখদুঃখের ইজারা নেওয়া, কয়েকটি রাজনৈতিক দল। অন্যের উল্লাস, অন্যের বেখেয়ালী আনন্দের চাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়া সত্ত্বেও এ দেশের মানুষ প্রতিবাদ করতে ভয় পায়। প্রতিবাদ করলেও প্রতিকার পায় না। ভারতবর্ষ একটি গণতান্ত্রিক দেশ কিন্তু সেই গণতন্ত্রে আদালতে নির্ভর করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অর্থবান মানুষের পক্ষে কথায় কথায় আদালতে যাওয়ার শ্রম পোষায় না। হার্টের রোগে শয্যাশায়ী মানুষের বাড়ির পাশে শীতলা পুজো উপলক্ষে সারারাত মাইক বাজানো মানে প্রথম ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা। এই ভদ্রলোক পুলিশের কাছে তেমন সহযোগিতা পাবেন এমন নিশ্চয়তা নেই। পুলিশের পক্ষেও প্রতিটি মানুষকে ধরে গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া অসম্ভব। আসলে একটা জাত শিথিল হতে হতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে এখানে বাস করতে হলে প্রতি মুহূর্তে ঠোক্কর খেতে হবে। কিন্তু আমেরিকায় সে যাতে অভ্যস্ত তাতে যা কিছু আরাম তা নিজের জন্যেই পেয়ে এসেছে। তার স্নেহের শ্রদ্ধার ভালবাসার মানুষেরা যদি এই পরিবেশে পড়ে থাকে তাহলে কি সে একা ব্যক্তিসুখ ভোগ করবে না স্বেচ্ছায় সবরকম কষ্ট মেনে নেবে? এই দোটানায় তখন দুলছে গৌরব। এইসময় চিঠিটা বাড়িতে এল। ডব্লু অ্যান্ড ডব্লু নামক মাল্টি ন্যাশানাল কোম্পানি তাকে ইন্টারভিউতে ডেকেছে।

ব্যাপারটার পেছনে সৌরভের উদ্যোগ রয়েছে।

আজ রবিবার। বাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছে কিন্তু ভোর হতেই ঘুম ভেঙে গেল গৌরবের। ঘুম চলে যাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে থাকা খুবই কষ্টকর। গৌরব উঠে পড়ল। তার ঘরে লাগোয়া বাথরুমের ওপাশে মায়ের ঘরের বাথরুম। দাঁতে ব্রাশ ঘষতে ঘষতে সে থমকে দাঁড়াল। মায়ের কাশির আওয়াজ ভেসে আসছে। অনেকটা সময় ধরে কষ্ট করে যে কাশি চেপে রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও বেরিয়ে আসছে তার আওয়াজ মোটেই ভালো নয়। গৌরব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কাশতে কাশতে মা বেদম হয়ে শেষতক আবার আঃ আঃ করতে লাগলেন।

চটপট মুখ ধুয়ে নিয়ে গৌরব নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে মায়ের ঘরের দরজায় শব্দ করল। এই ঘরে এখন মা আর বনি শোয়। টনির আলাদা ঘর। এমন কাশির শব্দে বনির ঘুম ভেঙে যাওয়া উচিত। তিনবার আধ মিনিটের ব্যবধানে শব্দ করার পর মায়ের গলার স্বর শোনা গেল, কে?

গৌরব জানান দিলো। তার পরেও কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর মা ধীরে ধীরে দরজা খুললেন। গৌরব দেখল মা পরিষ্কার, মুখে জলের ভেজা দাগও নেই। বরঞ্চ চোখে বিস্ময়, কিরে?

তুমি কাশছিলে?

কই! না তো।

কিন্তু আমি যে তোমার বাথরুম থেকে কাশির শব্দ ভেসে আসতে শুনলাম।

দূর! ভুল শুনেছিস।

গৌরব আচমকা শক্ত হয়ে গেল। সে ভুল শুনতে পারে না। মা ব্যাপারটা গোপন করতে চাইছেন। কিন্তু কেন? সে লক্ষ্য করল মায়ের মুখ সামান্য লাল। এই সময় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কি সারারাত জেগে বই পড়িস যে উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখছিস ভোরবেলায়?

গৌরব হাসবার চেষ্টা করল, সরি। তুমি রেস্ট নাও। এখনই উঠো না। সে চলে এল ব্যালকনিতে। ব্যাপারটা তার একদম ভালো লাগছিল না। বাংলাদেশের মায়েরা তাদের অসুখের কথা প্রথম দিকে বলতে চান না। হয়তো কাউকে বিরক্ত করার জন্যে সঙ্কোচ হয় তাঁদের। কিন্তু মা তাদের দলে পড়বেন কেন? তার সঙ্গে তো খুব সহজ সম্পর্ক। তারপরেই মনে হলো সে হয়তো একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। কত কি কারণে মানুষের কাশি হতে পারে। আর সবসময়ে যে কারণগুলো খুব ভয়ঙ্কর তা তো নয়।

এরকমটা ভাবতে মন কিছুটা হাল্কা হলো। সে বাগানের দিকে তাকাল, এখন ছায়া ছায়া চারধার। গাছপালাগুলো অত্যন্ত তাজা। সামান্য হাওয়ায় ওরা হাল্কা দুলছে। সে আকাশের দিকে তাকাতেই ধন্দে পড়ল। আকাশ বেশ মেঘলা। যাকে সে এতক্ষণ প্রথম ভোর বলে মনে করছিল সেই সময়টা নিশ্চয়ই পেরিয়ে গেছে। যেহেতু সূর্যদেবকে মেঘেরা অক্টোপাশের মতো ঢেকে রেখেছে তাই সেটার চেহারা ফোটেনি রোজের মতো। গৌরব ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো। সদর দরজা খুলে বারান্দা পেরিয়ে বাগানে এসে দাঁড়াল। সৌরভ মলি এখনও ওঠেনি। আজকের মেঘলা আকাশ নিশ্চয়ই ওদের সময় সম্পর্ক বিভ্রান্ত করছে। সৌরভ তো ছুটির দিনে সহজে বিছানা ছাড়তে চায় না। সে বাগানে হাঁটতে লাগল। প্রায় প্রতিটি গাছ মায়ের নিজের হাতে যত্নে লাগানো। স্নেহপ্রবণ মানুষের সঙ্গে মাটির সম্পর্ক খুব নিবিড়। এইখানে বোধহয় মাইনে করা লোকের ওপর নির্ভর করলে মনে তৃপ্তি আসে না।

মেঘলা বলেই সম্ভবত রাস্তা আজ নির্জন। অন্যদিন প্রাতঃভ্রমণকারীদের ক্রমাগত যাতায়াত করতে দেখা যায় রাস্তায়। গৌরব একটা গোলাপফুলের কুঁড়ির দিকে তাকাল। ঈষৎ মুখ খোলা, যেন চুপিসারে আকাশ বাতাস এবং মৌমাছির জন্যে নিজেকে বিকশিত করতে তৈরি হচ্ছে! হঠাৎ গৌরবের মনে হলো আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব চারপাশে ঘিরে থাকলেও মানুষ সবসময়ই একা। কলকাতা কিংবা নিউইয়র্ক অথবা লন্ডনের শহরতলিতে যদি সে একা বাস করে তাহলে কিছু কিছু মুহূর্তে সে একই রকম থাকে। তার নিজস্ব উপলব্ধির মুহূর্তে অন্য কেউ তাকে সঙ্গ দিতে পারে না। এই একাকীত্ব সাময়িকভাবে দূর হয় গ্রথিত সম্পর্কে মানুষের সংশ্রবে এলে। কিন্তু তার আগে পরে সে তার নিজের জন্যেই একা। নিউইয়র্কে বাস করেও মাঝে মাঝে তার মনে যেসব অনুভূতিরা স্বচ্ছন্দে চলে আসে কলকাতার এই ভিড়ে তাদের আসতে কোনো অসুবিধা হয় না যদি সে একা থাকে। হঠাৎই গৌরবের মনে হলো কেউ যেন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল। জয়তী–!

এত সকালে জয়তী তার কাছে এসেছে। বুকের ভেতর যেন, অজস্র ড্রাম বেজে উঠল তার। প্রায় দৌড়েই সে পৌঁছে গেল গেটের সামনে, তুমি?

অসুবিধে করলাম? জয়তী হাসার চেষ্টা করল।

কী জবাব দেবে বুঝতে পারল না গৌরব। জয়তী তার কাছে এলে সে অসুবিধে বোধ করতে কখনও পারে। হ্যাঁ, আমার পক্ষে সময়টা একটু–!

সে জবাব না দিয়ে গেট খুলতে লাগল, এত ভোরে তুমি এলে কী করে? বাস ট্রাম চলছে?

 ওগুলো রাত থাকতেই চলাচল শুরু করে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসে উঠে বসলাম। তারপরই বাড়ির দিকে তাকাল সে, মাসীমা ওঠেননি?

মা উঠেছেন তবে এখনও বাইরে আসেননি। আর সবাই তো ছুটির দিন বলে চুটিয়ে ঘুমিয়ে নিচ্ছে। খুব অবাক হয়ে যাবে সবাই তোমাকে দেখে।

ঠোঁট কামড়াল জয়তী, একটু ভাবল, তুমি এই অবস্থায় রাস্তায় বেরুতে পারবে?

 কেন? তুমি বসবে না? অবাক হলো গৌরব।

একটু হাঁটতে ইচ্ছে করছে।

একটা সময় ছিল রাস্তায় বেরুবার জন্যে গৌরব পোশাকের তোয়াক্কা করত না। কৈশোরে গেঞ্জি গায়ে বাইরের রাস্তায় খেলতে গিয়ে কতবার মায়ের বকুনি খেয়েছে। পরে পাজামা শার্ট পরে স্বচ্ছন্দে বন্ধুদের সঙ্গে পার্কে আড্ডা মেরেছে। বিদেশে থাকার ফলে ওর স্বভাবে বাড়ির বাইরে এবং বাড়ির ভেতরের পোশাক সম্পর্কে স্পষ্ট সীমারেখা তৈরি হয়েছে। যে পোশাকে বিছানায় শোওয়া যায় সেই পোশাকে কখনই রাস্তায় বেরুনো উচিত নয়। যে চটি পরে ঘরের ভেতর ঘোরা যায় তাকে রাস্তায় বের করা অনুচিত। কিন্তু এখন তার পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। দুটোর কোনোটাতেই সামান্য ইস্ত্রি নেই। ইস্ত্রি করা কাপড় পরে শুলে কিছুতেই ঘুম আসে না। গৌরব রাস্তার দিকে তাকাল। এখনও বেশ নির্জন। স্বভাববিরোধী কাজ করল সে, চলো, একটু হাঁটা যাক। গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে এল সে। শূন্য পিচের রাস্তায় গাছেরা এখনও গাঢ় ছায়া ফেলে রেখেছে।

হাঁটা শুরু করে জয়তী জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি রোজ এত সকালে ওঠো?

ওখানে উঠতে হতো। এখানে এসে লেটরাইজার হয়ে গিয়েছিলাম। আজ হঠাৎই। হাসল সে।

ওরা আরও কিছুটা চুপচাপ হাঁটল। ডান দিকে একটা পার্ক। সেখানে কিছু বৃদ্ধ এবং অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সচেতন যুবক রয়েছে। জয়তী জিজ্ঞাসা করল, এই সাতসকালে আমি কেন তোমাদের এখানে এলাম তা তো একবারও জিজ্ঞাসা করলে না!

এত তাড়া তো আমার নেই। তুমি এসেছ সেইটেই আসল কথা।

জয়তী মুখ ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। যেন নিশ্বাস বন্ধ করল। তারপর অন্য রকম গলায় গৌরবকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি আমায় এখনও কি ভালোবাসো?

জবাব না দিয়ে আলতো শব্দ করে হেসে ফেলল গৌরব। সঙ্গে সঙ্গে চাবুক খাওয়ার অভিব্যক্তিতে জয়তী মুখ ফেরাল, হাসছ তুমি?

না। একটা কথা হঠাৎই মনে পড়ে গেল। এই গতকালই আমি একটা ছেলেকে বলছিলাম ভালবাসা হলো একটা চারাগাছের মতো। সবসময়ে আদরযত্ন করতে হয়। তাকে বেড়া দিয়ে রাখতে হয়। গৌরব বলল, এত তাড়াতাড়ি প্রশ্নটাকে শুনতে হবে ভাবি নি।

আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।

দুটি মানুষ পরস্পরকে যে কারণে ভালবেসেছিল সেই কারণগুলো যদি পরবর্তীকালে দুজনের অসাক্ষাতের জন্যে আর তেমন সক্রিয় না থাকতে পারে। দুজনের মনের ওপর নানা স্তর পড়তে পারে নয় ওই দূরত্ব তৈরি হবার জন্যেই অজানা থেকে গেছে। এরকম ক্ষেত্রে সেই আগের ভালবাসা কতটা জোরালো থাকবে তাই ভাবনার বিষয়।

তার মানে তুমি আর আমাকে ভালবাসো না?

 ফিরে এসে আমার আচরণ দেখে তোমার কি তাই মনে হয়েছে?

এই বারো বছরে আমি তো অনেক পাল্টে যেতে পারি যা তুমি জানো না।

নিশ্চয়ই পারো। এবং সেটা আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

তাহলে?

সেটা আমাদের দুজনের ওপর নির্ভর করছে। বারো বছর বিদেশে থাকার সময়ে আমার জীবনে কোনো নারীকে আমি আমন্ত্রণ করিনি। কলকাতায় এসেও যখন পাগলের মতো তোমায় খুঁজে বেড়িয়েছি তখন নিশ্চয়ই পৃথিবীর যে কোনো কোণে তোমার জন্যে যেতে পারি।

কিন্তু তারপর?

তারপর মানে?

দেখা হলো, কথা হলো। আমার এই পরিবর্তিত জীবন তুমি দেখলে। দেখে একটা সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ তোমার আছে। তোমার গত বারো বছরের জীবন আমি জানি না। কিন্তু আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি।

এসব কথা উঠছে কেন?

কারণ তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না!

আমার দিকে তাকাও। এবার বলো, তুমি উত্তরটা জানো না? গৌরব দাঁড়িয়ে পড়ল।

আমি নিজের মুখে শুনতে চাই। জয়তী চোখে চোখ রাখল।

কী শুনলে তুমি খুশি হবে? গৌরব কোনো তল পাচ্ছিল না।

 যা সত্যি। তা এখনও সত্যি।

কীভাবে কথাটাকে বলবে ভাবতে গিয়ে ওঁদের দেখতে পেল গৌরব। সন্দীপ আসছে। সঙ্গে ওর স্ত্রী এবং এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। মানুষটির অনেক বয়স হয়েছে। লাঠিতে ভর করে হাঁটছেন। সম্ভবত সন্দীপের ঠাকুর্দা ইনি যাকে রিসিভ করতে ওরা সেদিন স্টেশনে গিয়েছিল। দূর থেকে হাত নাড়ল সন্দীপ। গৌরব বলল, আমার পুরনো দিনের এক বন্ধু। ইদানীং যোগাযোগ নেই।

জয়তী কিছু বলল না। যে ভাবে কথা এগোচ্ছিল তাতে ওই মুহূর্তে এই বাধা সে খুব একটা পছন্দ করছিল না। তবু মুখ সহজ করার চেষ্টা করল।

সন্দীপরা ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে। সন্দীপ বলল, তুই মর্নিং ওয়াক করিস, অথচ তোকে কোনোদিন এপথে দেখিনি তো!

সন্দীপের স্ত্রী হেসে উঠল। তুমি এমন করে বলছ যেন কত বছর ধরে মর্নিং ওয়াক করছ, দাদু না এলে তো সাতটার আগে বিছানা ছাড়ানো যেত না।

সন্দীপ লজ্জা পেল না। কাউকে তো একটা জায়গা থেকে শুরু করতেই হয়। ওহো, দাদুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, দাদু আমার বন্ধু গৌরব বসু, আমেরিকায় আছে অনেক দিন পর এদেশে বেড়াতে এসেছে।

গৌরব নমস্কার করল বৃদ্ধকে। তিনিও দুটো হাতযুক্ত করলেন। এবং এবার অস্বস্তি। ওদের নজর জয়তীর দিকে। স্বভাবতই জয়তীর পরিচয় জানতে ওরা উৎসুক। গৌরব বলল, তোদের সঙ্গে জয়তীর আলাপ করিয়ে দিই। জয়তী, এ হলো সন্দীপ। ছাত্র হিসেবে খুব মেধাবী ছিল। সন্দীপের স্ত্রী এবং ওদের দাদু। আর জয়তী আমার সঙ্গে পড়ত।

সন্দীপের স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, আপনি এপাড়ায় থাকেন?

জয়তী মাথা নাড়ল, নাঃ। গৌরবের সঙ্গে একটু দরকার ছিল। পরে এলে ওকে বাড়িতে পাওয়া যাবে না তাই সাতসকালকে বেছে নিতে হলো।

গৌরব জয়তীর গলায় উষ্ণ আভাষ পেল। সে হাসল। এসে অবধি সারাদিন এত চক্কর মারছি। তোদের বাড়িতে যে যাব তার সময় পাইনি।

সন্দীপ জয়তীকে বলল, আপনাকে আমি কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে দেখেছি। এতগুলো বছর হয়ে গেল, খুব একটা পাল্টে যান নি।

এই স্বাভাবিক কথায় জয়তী যেন স্বস্তি পেয়েই সামান্য হাসল।

 গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কেমন লাগছে দাদু, নাতির কাছে এসে।

ভালো খুব ভালো। এদিকটা তো বেশ ফাঁকা তাই আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। শহরের ভেতরে না যেতে হলে আমার কোনো অসুবিধে নেই।

সন্দীপ বলল, দাদুর একটা প্রব্লেম হয়েছে। ওঁর বাঁ হাতের আঙুলের ফাঁকে একটা ঘা কিছুতেই শুকোচ্ছে না। অনেক ওষুধ দেওয়া হলো!– ভাবছি একজন ভালো স্কিন স্পেশালিস্টকে দেখাবো। আজ চলি, আর তোদের আটকে রাখব না।

মাথা নাড়ানাড়ি করে ওদের দলটা চলে গেলে গৌরব কথা খুঁজল। হঠাৎ যেন কিছুক্ষণ হইচই হবার পর বড্ড বেশি থিতিয়ে গিয়েছে আবহাওয়া। ওরা চুপচাপ কিছুটা পথ হাঁটার পর একটা ভাঁড়ের চায়ের দোকান দেখতে পেল গৌরব। সে জিজ্ঞাসা করল, চা খাবে?

এখানে? জয়তী অবাক হলো। এটাকে দোকানও বলা যায় না। একটা কাপড় মাথার ওপর কোনোমতে টাঙিয়ে লোকটা কয়লার উনুনে হাঁড়ি চাপিয়ে বসেছে। দুটো দেহাতি চেহারার মানুষ তার সামনে উবু হয়ে বসে চা খাচ্ছে।

হ্যাঁ, খুব খারাপ করবে না মনে হয়। গৌরব লোকটাকে দুটো চা দিতে বলল ভাঁড় ধুয়ে। লোকটা তার সম্ভব মতো যত্ন নিয়ে ভাঁড়ে চা ঢেলে দিলো। চুমুক দিয়ে গৌরব বলল, আঃ। দারুণ।

চা একটু ঠাণ্ডা না করে খেতে পারে না জয়তী। সে ভাঁড়টাকে ধরেই বলল, আমেরিকায় নিশ্চয়ই ভাঁড়ের চা পাওয়া যায় না?

মাথা খুঁড়লেও নয়। তবে যদি কেউ অনুমতি যোগাড় করে ভাঁড়ের চা আর তেলেভাজার দোকান খুলতে পারে তাহলে পাঁচ বছরে মিলিওনিয়ার হয়ে যেতে পারবে। ওখানে এই পরিমাণ চা ম্যাকডোনাল্ডের মতো রাস্তার দোকানে প্রায় আটটাকা পড়ে ইন্ডিয়ান কারেন্সিতে কনভার্ট করলে। আমেরিকার পঞ্চাশ পয়সা।

তা তুমি কি এখানে এসে পুরনো অভ্যেসে এই ভাবে ঝালিয়ে নিচ্ছ না ইচ্ছে করেই দেখাতে চাইছ আমেরিকায় বারো বছর তোমার মাথা ঘুরিয়ে দেয় নি!

জয়তী, আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি।

চায়ের দাম মিটিয়ে ওরা এবার ফিরল। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, তুমি কাল রাত্রে ঘুমিয়েছিলে তো?

কেন?

মুখ এত শুকনো লাগছে কেন?

 তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি।

 প্রশ্ন? ও গৌরবের মনে পড়ল। তারপর বলল, তোমাকে না ভালবেসে বেঁচে থাকার কথা আমি ভাবতেই পারি না জয়তী।

কেন?

এটা আমার রক্তে মিশে গিয়েছে। এতেই আমার শান্তি। অদ্ভুত আলো খেলে গেল জয়তীর মুখমণ্ডলে এই মেঘের সকালে। কিন্তু সে কোনো কথা বলল না। গৌরবের পাশাপাশি চুপচাপ হাঁটতে লাগল। কখনও গৌরবের হাতে তার হাতে চলার ছন্দেই স্পর্শ নিচ্ছে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল গৌরব অগ্রণী হয়ে আঙুলগুলো আঙুলে জড়িয়ে নিক। কথা না বলে সে পারল না, আচ্ছা তুমি তো আমাকে একবারও জিজ্ঞাসা করলে না কেন আমি এই অদ্ভুত সময়ে এসেছি!

দুটো কারণ। প্রথম কথা আমার কাছে আসার জন্যে তোমার সময় বিচার করার কোনো দরকার নেই। তোমার এমন ইচ্ছে হওয়াটাই আমার আনন্দ। দ্বিতীয় কারণ তুমি আমাকে ভুল বুঝতে পারো। এই সময় কেন এলে জানতে চাইলে তোমার মনে হতে পারে আমি কৈফিয়ত চাইছি। মাথা নেড়ে নিজের কথা বোঝাল গৌরব।

বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছিল ওরা। জয়তী দাঁড়িয়ে পড়ল। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কী হলো?

জয়তী মুখ নামাল, আমি তোমাকে ছেড়ে আর থাকতে পারব না।

গৌরবের সমস্ত শরীরে রোমাঞ্চ ছড়াল। সে আবিষ্কার করল গলার স্বর আসছে না। সমস্ত শরীরে অদ্ভুত আনন্দ।

জয়তী নিজের মনেই বলে যাচ্ছিল, কাল সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি গৌরব! কেবলই মনে হচ্ছিল আমরা আমাদের বানানো কিছু ভাবনা আঁকড়ে থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র করে রাখি। আমরা সবসময় প্রতিরোধ করতে চাই, সমর্পণের আনন্দ পেতে জানি না। আমি তোমাকে ভালোবাসি এটা সত্যি। নইলে বারো বছর কলকাতা শহরে একা এমনভাবে সব কিছু উপেক্ষা করে থাকতে পারতাম না। কিন্তু ওই সত্যিটার ওপরে নানা ডালপালা চাপিয়ে নিজেকে ভোলবার চেষ্টা করে এসেছি এতদিন। কিন্তু কী পেয়েছি তাতে? কিছু না।

গৌরব বলল, তোমার কোনো দোষ নেই। এটা নাগরিক সভ্যতার ফল। সবসময় জটিল ভাবনা এসে সরল সত্যকে আড়াল করে রাখে। নিজের ইগো ক্রমশ এতবড় চেহারা নেয় যে নড়াচড়া করার কোনো উপায় থাকে না।

জয়তী বলল, তুমি, তুমি আমার সঙ্গে একমত?

হ্যাঁ, কিন্তু–?

আবার কিন্তু কেন? তোমার সমস্যা? আমায় নিয়ে?

না, না। আমার পক্ষে পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে আসা কতখানি সম্ভব হবে জানি না। আমি দেশে না ফিরলে তোমার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। তাছাড়া মা রয়েছে। সব মিলিয়ে!

আমি আর এসব নিয়ে ভাবতে পারছি না। জীবন যেমন চলার তেমন চলুক।

জয়তী কপাল থেকে চুল সরাল।

.

যা ছিল বারো বছরের বিতর্কিত বিষয়, কলকাতায় এসে এতদিনেও গৌরব যার কোনো সুরাহা করতে পারে নি সেই সমস্যা যে এই সাতসকালে কয়েক পা হাঁটাহাটি করেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবে তা গৌরবের ধারণার বাইরে ছিল। মানুষ যখন আন্তরিকভাবে কিছু চায়, যখন ভালবাসাই তার কাছে হৃদপিণ্ড হয়ে দাঁড়ায় তখন প্রিয়জনকে সে আর প্রতিপক্ষ বলে কল্পনা করে না। তার সব ত্রুটি বিচ্যুতি, আচরণের অন্ধকার অংশগুলো সে উপেক্ষা করে যায়। যা একসময়ে একান্তই অবাস্তব বলে মনে হতো তাই হয়ে যায় সরল সহজ। তখন আর কথা নয়, কথায় কথা তৈরি হয় এবং সেটা বাতাসের মতো অবয়বহীন হয়ে ভেসে চলে।

জয়তীকে নিয়ে বাড়ির গেটে পৌঁছতেই সরলার সামনে পড়েছিল গৌরব। ভদ্রমহিলা তখন বাগান পরিচর্যা করছিলেন। এত অবাক হয়ে তাকালেন তিনি যে গৌরবের লজ্জা করছিল। দ্রুত এগিয়ে এসে তিনি বলেছিলেন, ও মা, জয়তী আসবে তা তুই আমায় বলিসনি তো?

গৌরব মাথা নাড়ল, আমিই কি ছাই জানতাম!

সরলা বললেন, যা মোক্ষদাকে তিন কাপ চা করতে বল, আমরা এখানেই চা খাব।

একবারও এমন প্রশ্ন করলেন না যাতে জয়তী বিব্রত হতে পারত। অথচ এই সকালে আসার জন্যে জয়তী সেরকম প্রশ্নের সামনে পড়তে পারত।

দাঁত মেজে, পরিষ্কার হতে না হতেই মোক্ষদার চা হয়ে গেল। গৌরবের খেয়াল হলো, জয়তী যদি সাত তাড়াতাড়ি চলে আসে তাহলে ওরও তো পরিষ্কার হবার প্রয়োজন আছে। একথা মায়ের সামনে বলতে কোনো অসুবিধে নেই অথচ এখন তার একটু অস্বস্তি হচ্ছে কেন? সে বাইরে বেরিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়াল। বাগানে কেউ নেই। তারপরেই পেছনে মাকে দেখতে পেল।

সরলা বললেন, ঘুম থেকে উঠেই চটপট চলে এসেছে, মেয়েটা এখনই আসছে, মোক্ষদাকে বললাম ব্যালকনিতেই চা দিতে।

গৌরব চেয়ার টেনে বসে পড়তেই সরলা বসলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ওর সঙ্গে তোর সব কথা হয়ে গিয়েছে?

হ্যাঁ। গৌরব মাথা নাড়ল।

আমি তোকে একমাস সময় দিলাম। তার মধ্যে যা করার করবি।

কী করতে বলছ?

জানিস না আমি কী বলছি?

সেটা তো যে কোনো দিনই হতে পারে। একমাস অপেক্ষা করার কোনো কারণ আছে কি। নোটিস টোটিস দেওয়ার ব্যাপারটাও ম্যানেজ করা যায়।

তুই মন্ত্র পড়তে চাস না?

দ্যাখো মা, আমাদের যা বয়স তাতে মন্তর পড়ার মানসিকতা থাকতে পারে না। অবশ্য তুমি এবং জয়তী যদি চাও তাহলে আমাকে মেনে নিতেই হবে।

তুই আর একটি মানুষের কথা ভুলে যাচ্ছিস। জয়তীর মা।

ও হ্যাঁ। কিন্তু উনি বোধহয় আপত্তি করবেন না। ওঁর ছোট মেয়ের বিয়েতে মন্ত্র শাঁখ বাজা এসব হয়নি।

তোর যদি মন্ত্র পড়তে আপত্তি থাকে তাহলে এক কাজ কর। যে ভাবে হিন্দু পরিবারে বিয়ে হয়, তত্ত্ব যাওয়া আসা, গায়ে হলুদ আশীর্বাদ এসব হবে। তুই বন্ধুবান্ধব নিয়ে বিয়ে করতেও যাবি কিন্তু সেখানে ছাঁদনাতলায় বসে মন্ত্র না পড়ে দুজনে সই করবি। এতে হবে?

একশ বার। কিন্তু সেখানে আর একটু যোগ করা দরকার। আমি যতক্ষণ সেখানে না যাচ্ছি ততক্ষণ বিয়ে বাড়িটা মেয়েদের দখলে, মানে মেয়েপক্ষের। আমি পৌঁছে যাওয়ার পর দুপক্ষের।

বুঝলাম না।

তখন বরযাত্রী কন্যাত্রী একাকার হয়ে যাবে। বিয়ে এবং বউভাত একই সঙ্গে হবে। ক্যাটারার সব করবে। দুদুবার একই ঘটনা ঘটানোর কোনো প্রয়োজন নেই।

বেশ আমার আপত্তি নেই।

তাহলে তুমি এইভাবে কথা বলো। এই সময় মলি এসে দাঁড়াল, বাবাঃ, তোমরা সাত সকালে উঠে পড়েছ। তারপর গলা তুলে বলল, মোক্ষদা আমার জন্যে চা করো। এই গোরা, চা খাবে?

তুমি আগে নিজের চা বলে তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করছ?

আমি জানি মা যখন উঠেছেন তখন তোমার এক কাপ খাওয়া হয়ে গিয়েছে। মলি এসে তৃতীয় চেয়ারটিতে বসল। ফুল ছড়ানো সাদা শাড়ি পরেছে মলি। বয়সের ছাপ পড়লেও দেখতে আরাম লাগে। অন্তত মলির যখন মেজাজ ভালো থাকে তখন তাকে সবার পছন্দ হবেই। মলি চোখ ছোট করলো, কী দেখছ?

তোমাকে। গৌরব গম্ভীর হবার ভান করল, কী সুন্দর তুমি।

 মলি সরলার দিকে তাকাল, মা শুনছেন?

সরলা হাসলেন, কথাটা তো মিথ্যে নয়।

গৌরব বলল, এত সুন্দর কেন তুমি?

আমি জানি না, যাও। মুখ বাঁকাল মলি।

জানো, খোঁজখবর নাও। মুরুব্বিচালে বলল গৌরব।

 ওমা! কীসের খোঁজ নেব? অবাক মলি।

কেন তুমি এত সুন্দর!

সকালবেলায় কেন আমায় লেগপুল করছ বলো তো?

এই সময় জয়তী আর বনি বেরিয়ে এল মায়ের ঘর থেকে। তাকে দেখে চমকে গেল মলি, ওম্মা! তুমি কখন এলে? কাল রাত্রে? আমি জানি না তো! শেষ শব্দ তিনটি সরলার দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করল মলি।

সরলা বললেন, জয়তী একটু আগে এসেছে। এসো, এখানে এসে বসো জয়তী।

 জয়তী এগিয়ে এল। একটু হেসে মলিকে জিজ্ঞাসা করল, ভালো আছেন?

মলি মাথা নাড়ল। তার বিস্ময় যেন যাচ্ছিল না। সে গৌরবের দিকে তাকাল। গৌরব মিটি মিটি হাসছে। সেই হাসি দেখে সন্দেহ হলো মলির। চকিতে সরলার দিকে তাকাল সে, মা সত্যি? বেশ উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞাসা গলায় জিজ্ঞাসা করল মলি।

সরলা নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

সঙ্গে সঙ্গে স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠল মলি। প্রায় দৌড়েই চলে গেল নিজের শোয়ার ঘরের দিকে। চেয়ারে বসে জয়তী জিজ্ঞাসা করল, কী হলো?

সরলা বললেন, ওর অমন মাঝে মাঝে হয়। এই বনি দাঁত মাজা হয়েছে?

হ্যাঁ।

যা টনিকে তোল আগে। তারপর আসছি।

বনির যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তাকে যেতে হলো। এই সময় মোক্ষদা চায়ের ট্রে নিয়ে এল। সঙ্গে বিস্কুট। সরলা প্রথমে জয়তীকে দিলেন। চা নেওয়া হয়ে গেলে তিনি মোক্ষদাকে কিছু নির্দেশ দিলেন। ওদিকে মলির গলা পাওয়া যাচ্ছে। সে যেন জোর করেই সৌরভকে বিছানা থেকে তুলল।

জয়তী বলল, আমি বোধহয়ে সবার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।

ভালোই তো। একটু অন্যরকম হলো।

সেদিন সকাল জুড়ে বাড়িতে আড্ডা হইচই। যেন একটা উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। জয়তীরও খুব ভালো লাগছিল কারণ কেউ তার আর গৌরবের বিষয়ে কোনো কথা তুলছিল না। অথচ বোঝাই যাচ্ছিল সেটা প্রত্যেকেরই জানা।

ব্রেকফার্স্ট খাওয়ার পর জয়তী উঠল, আমি চলি।

মলি আপত্তি তুলল, এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে?

সরলা বাধা দিলেন, না, না। কত সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। ওর মা চিন্তা করছেন। গোরা, তুই ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আয়।

তৎক্ষণাৎ কথা বলল সৌরভ, না, গোরা না। আমি জয়তীর সঙ্গে যাব।

 মলি খেঁকিয়ে উঠল, তুমি যাবে মানে? তোমার কি মাথায় কিছু ঢোকে না?

খুব ঢোকে। আমি যাচ্ছি, জয়তী, এক মিনিট অপেক্ষা করো ভাই।

সৌরভ উঠে গেল। গৌরব কী করবে বুঝতে পারছিল না। সে ভেবেই রেখেছিল যে জয়তীর সঙ্গে বেরুবে। কিন্তু সৌরভের এই কথার পরে আপাতত কিছু করা সম্ভব নয়। সে জয়তীকে জিজ্ঞাসা করল, বিকেলে বাড়িতে থাক?

হ্যাঁ। জয়তী মাথা নাড়ল।

.

খানিকক্ষণ হাঁটার পর ট্যাক্সি নিল সৌরভ। গাড়িতে উঠে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, জয়তী, তুমি কি চাও গোরা আমেরিকায় সেটল করুক?

জয়তী জবাব দিলো না। সৌরভ কোনো অর্থ বুঝতে পারল না। সে বোঝাতে চেষ্টা করল, না, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। দ্যাখো, এদেশের ভালো ছেলেরা কিছু কমফর্টের আশায় বিদেশে চলে যায় তাহলে সর্বনাশ। কোনোদিন উন্নতির মুখ দেখব না আমরা। তাছাড়া ওখানে একা থেকে ও করবে কী? তোমারও সমস্ত আত্মীয়স্বজন এখানে, আমরাও থাকব, তোমার ভালো লাগবে আমেরিকায়?

আপনি ওর সঙ্গে কথা বলেছেন? নরম গলায় জিজ্ঞাসা করল জয়তী।

হ্যাঁ। ও ভেবে পাচ্ছে না। ওর মনে হচ্ছে এখানে চাকরির আবহাওয়া নেই। আমি জোর করে একটা অ্যাপ্লিকেশন করিয়েছি। সামনের সপ্তাহে ইন্টারভিউ। যদি ও ইন্টারভিউ দিতে যায় তাহলে চাকরি না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। মাইনে এখন প্রায় পাঁচ হাজার। কটা বাঙালি পায়। অবশ্য ও আমেরিকায় যে ডলার পায় তার সঙ্গে তুলনা করা ভুল হবে।

জয়তী নিজের অভিমত স্পষ্ট বলতে পারল না। আসলে সে নিজেই বুঝতে পারছিল না গৌরবের কী করা উচিত। দেশে ভালোভাবে কেউ যদি থাকতে পারে তাহলে তার বিদেশে যাওয়ার কি দরকার? মুস্কিল হলো, এই ভালোভাবে থাকার ব্যাপারটা খুব গোলমেলে। কে কীসে শান্তি পায় তা বোঝা সহজ নয়। অতএব এই কিছু চাপিয়ে দিলে ভবিষ্যতে যদি এর জন্যে কথা শুনতে হয় তবে তার থেকে খারাপ আর কিছু হবে না।

জয়তীদের বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিলো সৌরভ। তারপর বলল, তুমি নিশ্চয়ই আমাকে দেখে ভাবছ আমি এমন হুট করে চলে এলাম কেন?

না না, আপনি আসুন, আমি কিছু ভাবছি না। জয়তী এগিয়ে চললো।

দরজায় শব্দ করার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। জয়তীর মা দরজা খুলে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। জয়তী বলল, মা ইনি গৌরবের দাদা।

সৌরভ এগিয়ে এসে প্রণাম করতে চেষ্টা করতেই ভদ্রমহিলা দ্রুত সরে দাঁড়ালেন, আরে না, প্রণাম করতে হবে না। জয়তী, ওকে ভেতরে নিয়ে আয়।

বাইরের ঘরে সৌরভকে বসিয়ে, জয়তী ভেতরে চলে গেল। মা আগেই চলে গিয়েছিলেন, মেয়েকে বললেন, কোথায় গিয়েছিলি, আমি চিন্তায় মরছি।

গৌরবদের বাড়িতে। জয়তী মাথা নামাল।

 সেকী? কেন? মা বিস্মিত।

এমনি।

মা মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন, কিছু বোঝার চেষ্টা করলেন। জয়তী বলল, বাইরের ঘরে উনি বসে আছেন। যাও।

জয়তীর মা ধীরে ধীরে বাইরের ঘরে এলেন। এসে জিজ্ঞাসা করলেন, সব খবর ভালো?

সৌরভ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

 জয়তীর মা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি কিছু বলবে?

হ্যাঁ। আমরা আপনার মেয়েকে আমাদের বাড়িতে পাকাপাকিভাবে নিয়ে যেতে চাই।

এ তো ভালো কথা। এই খবরটা শোনার জন্য আমি অপেক্ষা করে আছি।

ব্যাপারটা হলো গোরা তেরো সপ্তাহের ছুটিতে কলকাতা এসেছে আমাদের ইচ্ছে ওর ছুটি ফুরোবার আগে বিয়েটা হয়ে যাক।

তোমরা যা চাও তাই হবে।

তাহলে একটা দিন ঠিক করা যাক। সৌরভ ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল, অন্তত দিন পনেরো সময় দরকার। আপনাদের আত্মীয়স্বজন, আমাদের সকলকে খবর দিতে হবে।

তোমরা কি আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে দিতে চাও।

আপনার যা ইচ্ছে। অবশ্য গোরা বলছে সে মন্ত্র পড়ে বিয়ে করবে না, তবে বর যেভাবে আসে সেইভাবেই আসবে। বিয়ের পিঁড়িতে বসে সই সাবুদ করবে। বিয়ে এবং বউভাত একসঙ্গে করতে হবে। কিন্তু এসব ওর ইচ্ছে, যদি আপনার ইচ্ছে আলাদা রকমের হয় তাহলে সেটাকে মেনে নিতে ওকে বাধ্য করব।

না না। বাধ্য করতে হবে না কাউকে। বিয়ে করবে ওরা, ওদের যেমন ইচ্ছে সেইরকম হবে। ভালোই তো, আত্মীয়স্বজনকে বাদ দিয়ে তো ওরা কিছু করতে চাইছে না। জয়তীর মা বললেন, ছোট মেয়েকে যা দেবার দিয়ে দিয়েছি। এখন যা আছে তা তো জয়তী পাবে। আমি চেষ্টা করব তাই দিয়ে বিয়েটা ভালোভাবে দিয়ে দিতে।

সৌরভ হাত তুলল, শুনুন। এই বিয়েতে কোনোরকম দেওয়া-থোওয়ার কথা তো উঠতেই পারে না। আমাদের পরিবারে এর চল নেই। আপনি এমন কিছু করবেন না যা আপনার সাধ্যের অতিরিক্ত। মা হিসেবে আপনার সম্মানে যাতে আঘাত না লাগে তাই শুভকাজের সব আয়োজন আপনাকেই করতে দিচ্ছি। কিন্তু ওই পর্যন্ত। বাকিটার দায়িত্ব আমাদের।

কথাটা বুঝতে পারলাম না।

আনুষ্ঠানিক কাজকর্ম যা মেয়েদের তরফ থেকে করতে হয় তার দায়িত্ব আপনি নেবেন। কিন্তু নিমন্ত্রিতদের খাওয়া-দাওয়া মানে ডিনারের আয়োজন আমরাই করব!

সেকি? আমার মেয়ের বিয়েতে যারা আসবে তাদের আমি খাওয়াবো না?

কথাটা ঠিক। কিন্তু আপনি আপনার আত্মীয় বন্ধুদের নেমতন্ন করবেন। সেই সঙ্গে বরযাত্রী হিসাবে যারা আসবে তাদেরও। কিন্তু তার সংখ্যা কত বড়জোর দশ পনের। কিন্তু বউভাতে তো আমাদের কয়েকশ মানুষ আসবেন। তাদের দায়িত্ব তো আপনার নয়। যখন বিয়ে আর বউভাতের রিসেপশন আমরা একসঙ্গে করছি তখন মনে করুন আমরা আপনার ছেলে, একসঙ্গে সব দায়িত্ব নিচ্ছি। সৌরভ আন্তরিক গলায় জানাল।

জয়তীর মার পছন্দ হচ্ছিল না কথাগুলো। কিন্তু তিনি প্রতিবাদও করতে পারলেন না। প্রতিবাদ করা মানে বলতে হয় অনুষ্ঠান দুটো আলাদা করে করতে।

.

চৌরঙ্গীর ওপরে কোম্পানির নিজস্ব চারতলা বাড়ি। গেটে দারোয়ান, পার্কিং প্লেস, বিশাল কাচের দরজা ঝকঝকে মেঝে এবং সুদৃশ্য রিসেপশনে সুন্দরী রিসেপশনিস্টদের অবস্থা বলে দিচ্ছে কোম্পানিদের অবস্থা খুব ভালো। আর যাই হোক চৌরঙ্গী এলাকায় নিজস্ব পার্কিং স্পেস রাখার ক্ষমতা কম অফিসেই আছে।

রিসেপশনিস্ট খুব স্মার্ট অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা। জিজ্ঞাসা করলেন, কী করতে পারি?

অনুগ্রহ করে বলে দিন মিস্টার এস কে গোয়েল, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের কাছে পৌঁছতে গেলে আমায় কী করতে হবে? গৌরব বারো বছরে অভ্যস্ত মার্কিনি উচ্চারণে প্রশ্নটা করল। তফাতটা কানে লাগল মহিলার। অপাঙ্গে একবার দেখে নিয়ে সতর্ক ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি আসবেন তা উনি জানে?

হ্যাঁ, কারণ উনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

 টেলিফোনের রিসিভারে হাত রেখে মহিলা জানতে চাইলেন, কী নাম বলব?

গৌরব বসু। আজ একটা ইন্টারভিউ নেবার কথা আছে।

মহিলা সেই কথা জানাতে ওপাশ থেকে অনুমতি মিলল। টেলিফোন নামিয়ে রেখে তিনি বললেন, সামনেই লিফ্ট। সেকেন্ড ফ্লোরে নেমে সোজা চলে যাবেন করিডোরের শেষ। ওখানেই ওয়েটিং রুম। বলে হাসলেন, উইশ ইউ এ গুড লাক!

ধন্যবাদ। গৌরব পা বাড়াল। লিফট নেমে আসছিল নিচে। পাশাপাশি দুটো। ভেতরে ঢোকার আগে পেছন ফিরে তাকাতেই গৌরব দেখল রিসেপশনিস্ট মহিলা ওই অতদূর থেকেও তার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছেন। সে মাথা নাড়তেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

অপেক্ষা করার ঘরে গিয়ে গৌরব দেখল আরও দুজন ভদ্রলোক সেখানে আগে থেকেই বসে আছেন। পুরো বাড়িটাই সেন্ট্রালি এয়ার কন্ডিশল্ড তবু একজন কপালের ঘাম মুছলেন। দুজনের পরনে স্যুট, টাই। গৌরব ইচ্ছে করেই স্যুট পরেনি। কলকাতার গরমে স্যুট পরার কোনো যুক্তি নেই। আর টাই-এর ব্যবহার তো আজকাল আমেরিকাতেও বন্ধ হতে চলেছে। নির্দিষ্ট সময়ের ঠিক পাঁচ মিনিট আগে সে পৌঁছে গিয়েছে। এই সময় দরজায় একজন বয়স্কা মহিলা এলেন। হাতে ডটপেন। সেটা নেড়েচেড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি এখান থেকে পাঠানো চিঠিগুলো এনেছেন?

টাইপরা একজন সটান উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

ঘরে ঢুকে চিঠিগুলো নিয়ে তিনি বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে গেলেন একটু অপেক্ষা করতে হবে। আধঘণ্টার মধ্যেই চেয়ারম্যান এবং মেম্বাররা আপনাদের সঙ্গে কথা বলবেন।

গৌরব একটা ম্যাগাজিন তুলে নিল। এই ধরনের কোম্পানিগুলোর বার্ষিক কার্যকলাপের রিপোর্ট পাতায় পাতায় ছড়ানো। একটা লেখার দিকে নজর পড়ল তার। লেখক কোম্পানির চেয়ারম্যান। কম্পুটার এবং উৎপাদন বিষয়ক প্রবন্ধ। পড়তে পড়তে বেশ মজা লাগছিল তার। একদম প্রাথমিক স্তরের কথাবার্তা হঠাৎ একজন চেয়ারম্যান বলবেন কেন? ভারতবর্ষে কম্পুটার প্রবর্তনে বেকার সমস্যা বাড়বে না বলেছেন ভদ্রলোক কিন্তু এর পেছনে তেমন জোরালো যুক্তি নেই। কম্পুটারের কাজ যদি কয়েক হাজার মানুষের সময় বাঁচিয়ে দিতে পারে, দীর্ঘসূত্রতাজনিত দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করতে পারে সেইটে করাই অন্যায়। কলকাতায় বসে কম্পুটার বলে দিতে পারে মাদ্রাজ থেকে বাঙ্গলোর যাওয়ার রিজার্ভেশন পাওয়া যাবে কিনা। জীবনযাপন স্বস্তির না হয়ে কিছু বেকারের চাকরির নামে অষ্টাদশ শতকে দেশটাকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার মতো মূর্খতা সহ্য করা যায় না।

গৌরব দেখল চারজন ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়েছেন দরজায়। তাদের খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। একজন ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কী জন্যে এখানে এসেছেন তা জানতে পারি?

টাই পরা একজন বলল, আমাদের ইন্টারভিউ দিতে ডাকা হয়েছে।

মাথা নাড়লেন, আপনারা এই মুহূর্তে অফিস ছেড়ে চলে যান।

 টাই পরা লোকটি খুব ঘাবড়ে গেল, কেন?

আমরা ইন্টারভিউ নিতে দেব না। আজ ইন্টারভিউ হবে না।

কিন্তু একটু আগে এক মহিলা বলে গেলেন।

 যে যাই বলুক, এখন আমরা যা বলছি তা করুন। সমস্ত অফিস খেপে উঠেছে। কর্মীরা যদি আপনাদের ওপর নির্যাতন করে তাহলে দায়ী হব না।

গৌরব এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবার উঠে দাঁড়াল, কিছু মনে করবেন না। আপনারা কারা?

ইউনিয়নের নেতা আমরা।

 আচ্ছা! ইন্টারভিউটা কেন হতে দেবেন না?

আমাদের সঙ্গে কোম্পানির কন্ট্রাক্ট হয়েছে কোনো ভ্যাকেন্সি হলে সেই পোস্টে এমপ্লয়িসদের মধ্যে স্যুটেবল থাকলে তাকে আগে প্রেফারেন্স দিতে হবে। আপনারা জানেন না এটা।

না জানতাম না। গৌরব বলল, কন্ট্রাক্ট হয়ে থাকলে সেটা ভাঙা ঠিক নয়। কিন্তু সব পোস্টের ক্ষেত্রে কি একই কন্ট্রাক্ট।

না। কিন্তু আমরা স্যুটেবল প্রার্থীর লিস্ট নিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু উনি সময় দিতে চাইলেন না। এর প্রতিবাদে আজ ইন্টারভিউ হতে দিতে পারি না আমরা। কর্মীদের জীবন নিয়ে কোম্পানিকে ছেলেখেলা করতে দেওয়া হবে না। আপনারা চলে যান।

জঙ্গী ভঙ্গিতে বললেন নেতা।

এই সময় তিনজন অফিসার গোছের লোক সেই ভদ্রমহিলাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। টাক মাথা একজন, যিনি বাঙালি নন, ইংরেজিতে নেতাকে জিজ্ঞস করলেন, আমরা আপনাদের দাবি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছি। চেয়ারম্যান খুবই ক্ষুব্ধ।

উনি ক্ষুব্ধ হলে আমাদের কিছু করার নেই। নেতার জবাব।

আপনারা ইন্টারভিউ করতে দেবেন না?

 না। ঘরের ছেলেদের বঞ্চিত করে বাইরে থেকে লোক নেওয়া চলবে না।

আপনারা ঠিক কী চান?

আমাদের কর্মী এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে যারা প্রার্থী তাদের ডাটা আপনাদের দিয়েছি

দিয়েছেন। কিন্তু ধরুন পোস্টটা একজন ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারের আর আপনাদের ক্যান্ডিডেট সংস্কৃতে অনার্স।

হতেই পারে না। নেতা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলেন, এই দেখুন, দুজন ক্যান্ডিডেট বি এস সি করে কম্পুটারে কোবাল কোর্স কমপ্লিট করেছে এদের ডাকুন ইন্টারভিউতে।

আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি। এব্যাপারে আপনাদের ধারণা খুবই কম। আপনাদের এই ক্যান্ডিডেট দুজন অত্যন্ত প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা নিয়েছেন। ধরুন ডিজিট শিখে প্লাস মাইনাস ডিভিশন পর্যন্ত শিখেছেন। কিন্তু আমাদের চাই অঙ্কের মাস্টার ডিগ্রি এবং সেই সঙ্গে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা।

অভিজ্ঞতা! কাজ করতে না দিলে অভিজ্ঞতা হবে কী করে?

ঠিকই। কিন্তু ধরুন আপনাকে এয়ারক্র্যাফট চালানোর ট্রেনিং দেওয়া হলো। মেশিনপত্র চিনলেন। নিজে ফ্লাইং শুরু করা আগে কি একটা প্যাসেঞ্জার প্লেনের পাইলট হিসাবে আপনি দায়িত্ব নিতে পারবেন নাকি সেটা আপনাকে দেওয়া উচিত।

ঠিক তাই। আনস্কিলড পোস্টে কোম্পানি আপনার সঙ্গে যে কন্ট্রাক্ট করেছে তা মেনে চলতে বাধ্য। যদি আপনাদের কাছে কোনো স্কিল্ড ক্যান্ডিডেট থাকত তাহলে আমরা তার সঙ্গে নিশ্চয়ই কথা বলতাম। কেউ কম্পাউন্ডারি পাস করলে তাকে আমরা এম. বি. বি. এস ডাক্তার হিসেবে চাকরি দিতে পারি না। প্লিজ, মাথা গরম না করে সহযোগিতা করুন।

নেতারা এ ওর মুখের দিকে তাকালেন। নিজেদের মধ্যে একটু আলোচনা করে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে, ইন্টারভিউ হোক, আমরা কিন্তু সমস্ত ঘটনার ওপর লক্ষ্য রাখছি।

ভিড় সরে গেলে গৌরব ঘড়ি দেখল। ইতিমধ্যে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। এই মানুষগুলো যদি শ্রমিকদের জন্যে দরদী হন তাহলে তাদের বাস্তব জ্ঞান বিসর্জন দিতে হবে? কোম্পানির যে কোনো কাজে প্রতি পায়ে এরা কি বাধা দেয়?

এইসময় একটি অল্পবয়সী স্মার্ট সুন্দরী মহিলা এসে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে এই অবাঞ্ছিত ঘটনার জন্যে ক্ষমা চাইলেন। চা খেতে কারো আপত্তি আছে কি না জানতে চাইলে টাইপরা দুজন হেসে বললেন, আপত্তি নেই। গৌরব বলল, না, আমার কোনো প্রয়োজন নেই। অনেক ধন্যবাদ। মহিলা চোখ ঘুরিয়ে গৌরবকে একবার দেখে গেলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে ওই দুজনের জন্যে চা এল। আরও কিছুক্ষণ সময়। তারপর সুন্দরী আবার এলেন। তিনি যার নাম ডাকলেন তিনি স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠতেই অনুরোধ এল, প্লিজ। চেয়ারম্যান কথা বলবেন। ভদ্রলোক মহিলাকে অনুসরণ করলেন। অর্থাৎ ইন্টারভিউ শুরু হলো। মিনিট আটেক বাদে তিনি রুমালে মুখ মুছতে মুছতে ঘরের সামনে দিয়ে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন তখন দ্বিতীয় টাই পরা লোকটা ডাকল, ও দাদা, প্লিজ। ভদ্রলোক তাকালেন। দ্বিতীয় জন জিজ্ঞাসা করল, কী কী প্রশ্ন করল?

ঢোকার আগে আমি তো জানতাম না, আপনি কেন জানবেন? বলে লোকটা জোরে পা ফেলে চলে গেল। সুন্দরী এসে মিষ্টি হেসে দ্বিতীয় জনকে ইশারা করতে তিনি টাই ঠিক করার জন্য চেষ্টা করে অনুসরণ করলেন। গৌরবের মনে পড়ল স্কুলে ছেলেরা একসময় একজন আর একজনকে জিজ্ঞাসা করত। বাঙালির মানসিকতায় স্কুলের ছাপ বড্ড জোরালো।

এবার সুন্দরী এসে দাঁড়ালেন, মিস্টার গৌরব বাসু?

হ্যাঁ। গৌরব উঠে এল। মহিলা তাকে নিয়ে করিডোর পেরিয়ে একটা বিশাল দরজায় মৃদু নক করলেন। করে ইশারা করলেন ভেতরে যেতে। গৌরব দরজায় হাত দিতে সেটা খুলে গেল। সে দেখল ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট পাতা বিশাল ঘর। লম্বা টেবিলে ওপাশে যে তিনজন বসে আছেন তাদের একজন স্থির চোখে তাকে দেখছেন। চেয়ারম্যান বসে আছে মাঝখানে। গৌরব নমস্কার করল। তারপর এগিয়ে গেল চেয়ারের দিকে, বসতে পারি? চেয়ারম্যান জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি তো ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন না মে আই কাম স্যার?

গৌরব উত্তর দিলো না। হেসে মাথা নাড়ল।

চেয়ারম্যান বললেন, বসুন মিস্টার বাসু। তারপর ফাইলটার কাগজ ওল্টাতে লাগলেন। চেয়ারে সোজা হয়ে বসে গৌরব বাকি দুজনকে দেখল। তাঁরা মুখের দিকে যেন এক্সরে চোখে তাকিয়ে আছেন।

চেয়ারম্যান মুখ তুললেন, এখানে দেখতে পাচ্ছি আপনি স্টেটসে বারো বছর আছেন। এবার কিজন্যে এসেছিলেন?

আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে।

অর্থাৎ আপনি এখনও ওখানে চাকরি করছেন?

হ্যাঁ স্যার।

মিস্টার বাসু, আপনি আমেরিকায় এখন যে মাইনে পান তা যে কোনো ভারতীয়র কাছে স্বপ্নের অতীত। এমন লোভনীয় চাকরি ছেড়ে আপনি এখানে কেন আসবেন ভাবতে পারছি না।

এটা আমার একদম ব্যক্তিগত ব্যাপার। গেীরব হাসল।

 দ্বিতীয়জন বললেন, আপনি মনে করছেন যে দেশকে সেবা করা উচিত মানে দেশের দামী ছেলেদের দেশ সেবার জন্যে ঘরে ফিরে আসা উচিত?

সত্যি কথা বলছি, আমার মনে এখনও কোনো ভাবনা আসেনি।

তাহলে?

বলতে পারেন যাঁদের সঙ্গে আমার মনের শিরা-উপশিরা জড়িয়ে আছে তাদের আর ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। এইসব মানুষ অথবা মানুষেরা কখনও এই দেশ ছেড়ে আমেরিকায় যাবেন না। গৌরব সত্যি কথাই বলল।

কিন্তু আপনার যে কোয়ালিফিকেশন সেইমত চাকরি পাওয়া স্টেটসেই সম্ভব, এদেশে সেটা কোনো কাজে লাগবে না।

হয়তো। তবে একজন ডক্টরেট ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রকে তার মতো পড়াতে পারেন। অবশ্য যদি পড়ানোর আবহাওয়াটা ঠিক থাকে।

গুড। কিন্তু আবহাওয়া এখানে অনুকূল নাও হতে পারে। এদেশে মানুষ এখনও আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে ভয় পায়।

স্যার উপকার পেলে ভয় থাকবে না। কিছু স্বার্থলোভী মানুষ তাদের ভয় পাওয়ায়।

চেয়ারম্যান হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, আপনি রাজনীতি করেন?

না স্যার। সময় বা ইচ্ছে কখনই হয়নি।

 এখানে যিনি আপনার রিপোর্ট নেবেন তিনি কিন্তু লেস কোয়ালিফায়েড।

যদি তার কমপ্লেক্স না থাকে তাহলে আমার কোনো অসুবিধা নেই।

 ওয়েল। এবার আপনি যেতে পারেন। উই উইল লেট ইউ নো। দিন তিনেকের মধ্যে জানতে পারবেন। চেয়ারম্যানের কথা শেষ হওয়ামাত্র গৌরব উঠে নমস্কার করল। তারপর স্বচ্ছন্দ পায়ে বেরিয়ে এলো ঘর ছেড়ে।

বাড়িতে ফিরে টিনাকে দেখতে পেল গৌরব। আজ আর জিনস কিংবা স্কার্ট নয়, সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে মেয়েটা। বাইরের ঘরে বসে মা আর মলির সঙ্গে গল্প করছিল। গৌরব ঢুকতেই বড় চোখ মেলে তাকাল, তাকিয়ে হাসল।

গৌরব বলে উঠল, আরে ব্বাস! হোয়াট এ সারপ্রাইজ! কখন এসেছ?

অনেকক্ষণ। দেখা না করে যাব না বলে বসে আছি।

মলি বলল, না গো! আমরাই ওকে জোর করে বসিয়ে রেখেছি।

 টিনা হাসল, কনগ্রাচুলেশন!

কী কারণে?

বাঃ। বিয়ের খবরটা এখানে না এলে পেতামই না!

 ও, এই ব্যাপার!

মলি বলল, এমন ভাব করছ যেন ব্যাপারটা কিছুই না।

গৌরব হাসল, তোমার খবর বলো টিনা!

ভালো আছি! টিনা মাথা নাড়ল, আমার কিছু কথা ছিল।

 বলে ফেলো। গৌরব উল্টোদিকের সোফায় বসে পড়ল।

সরলা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন, এবার উঠে দাঁড়ালেন, তুই কী রে? ও নিশ্চয়ই কথাগুলো শুধু তোকেই বলতে চায় আর তুই আমাদের সামনে শুনতে চাইছিস?

গৌরব বলল, তাই? খুব পার্সোনাল টিনা?

 না, মানে, আচ্ছা, মাসীমা আপনি বসুন।

 সরলা আপত্তি করলেন, না, না, তুমি কথা বলো। আমি দেখি ছেলেমেয়ে দুটো কোথায় গেল। সরলা আর দাঁড়ালেন না।

মলি বলল, তাহলে আমি আর বসে থেকে কী করব।

 টিনা মাথা নাড়ল, না না। আপনি থাকলে কোনো অসুবিধে হবে না।

গৌরব জানতে চাইল, কী ব্যাপার বলো তো?

টিনা মাথা নিচু করল। একটু ভাবল। তারপর বলল, আমাদের বাড়ির আবহাওয়া এখন পাল্টে গিয়েছে। মা সংসারে সময় দিচ্ছেন! বাবার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি অবশ্য চলছে কিন্তু আমাকে আর আগের মতো একা থাকতে হচ্ছে না।

খুব ভালো ব্যাপার।

হ্যাঁ। ইন ফ্যাক্ট মায়ের সঙ্গে আমার একটা ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মা দেখছি ইদানীং, তার পুরুষ বন্ধুদের এড়িয়ে চলছেন। কিন্তু আমার সঙ্গে মায়ের এই সম্পর্ক বাবা ভালো চোখে দেখছেন না। মনে হয় তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। বাবা আমাকে বোঝাতে চাইছেন, ঠিক সরাসরি নয়, ঘুরিয়ে, যে মায়ের জন্যে তাঁর জীবনে অশান্তি এসেছে।

গৌরব মলির দিকে তাকাল। চোখাচোখি হতে মলি মুখ ঘুরিয়ে নিল। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওকে কী বলছ?

আমি দুজনের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ব্যাপারটা মিটবে বলে মনে হয় না। বাবা আর মায়ের মধ্যে অন্তত আট বছরের ডিফারেন্স। বাবা ক্যারিয়ার নিয়ে থেকেছেন, শরীরের যত্ন নেননি। যতটা বয়স তার চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক দেখায়। মা ঠিক উল্টো। ফ্যাট যাতে না হয়, স্কিন ভালো থাকে এসব চেষ্টা করে গেছেন। ফলে বয়সের তুলনায় ওঁকে অনেক ইয়াং লাগে। মনে হয় এটাই বাবার কমপ্লেক্স তৈরি করেছে। টিনা বলল।

গৌরব বলল, তোমার অনুমান সত্যি নাও হতে পারে।

না। আমি ভুল বলছি না। যদি দুজনে একই বয়সের হতো তাহলে হয়তো এমন সমস্যা হতো না। এখন লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এদেশের মেয়েরা অনেক বেশি বয়স পর্যন্ত নিজেদের তাজা রাখতে পারে, ছেলেরা সেই চেষ্টা করেই না।

মলি মাথা নাড়ল, কথাটা সত্যি। আমার ঠাকুমা তিরিশ বছরে পড়তেই আর রঙিন শাড়ি পরতেন না, সেমিজ ব্যবহার করতেন। মা চল্লিশে পৌঁছে পাউডার লিপস্টিকের কথা ভাবতেই পারতে না। সব রঙিন শাড়ি আমাদের দিয়ে দিয়েছিলেন। এখন পঞ্চাশেও ওসব ভাবতে পারি না। ভালভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা মেয়েদের মনে এখন অনেক বেশি জোরদার হয়েছে।

গৌরব বলল, সেটা বাইরে বেরুতে হচ্ছে বলে। ছেলেদের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছে তাই মেয়েরা চেহারা সম্পর্কে এখন সচেতন হয়েছে। কিন্তু টিনা, তোমার সমস্যা আগের থেকে এখন অনেক কমেছে নিশ্চয়ই।

কমেছে। কিন্তু এখন আমরা দাদাকে ফিরে পেতে চাই।

কেন?

মনে হয় দাদা ফিরে এলে একটা ব্যালেন্স তৈরি হবে।

 কী ভাবে? সে তো তোমাদের ওপর বিরক্ত।

আমার ওপর নয়। মুশকিল হলো আমি জানি না দাদা কোথায় আছে!

এ ব্যাপারে আমি তোমাকে কি সাহায্য করতে পারি?

আমি জানি না। গৌরবদা, আমি বিয়ে করছি।

অ্যাঁ? মাই গড! এতক্ষণ বলোনি কথাটা? প্রশ্নটা করে গৌরব দেখল মলি হাসছে। সে বলছে, টিনা কিন্তু এসেই আমাদের বলেছে।

আচ্ছা! আর আমাকে এতক্ষণ অন্যকথা বলা হচ্ছিল। তা সেই ভাগ্যবান পুরুষটির পরিচয় দাও। তিনি কি করেন, কোথায় থাকেন?

ও আমার চেয়ে দুবছরের সিনিয়ার। কিন্তু আমার বন্ধু।

গুড। কিন্তু কী করে?

এখনও কিছু করে না। আসলে আমি যদি ওর পাশে না থাকি ও মরে যাবে।

মানে? গৌরব অবাক। মলিও।

সুদীপ ড্রাগ অ্যাডিক্টেড। হতাশা থেকে একটু একটু করে নেশা করে ফেলেছে। কে না জানে এই নেশা থেকে মুক্তির পথ খুব কম। দুদুবার ওকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে কিন্তু সেরে উঠেই আবার নেশার দিকে এগিয়ে গেছে। কোনো কিছু চিন্তা করতে পারে না, ব্রেন বেশি পরিশ্রম করলে কষ্ট পায়। অদ্ভুত ব্যাপার, আমাকে দেখলেই সুদীপ কেমন যেন হয়ে যেত। হাসতো, খুশি হতো। আমি যতক্ষণ কাছে থাকতাম ততক্ষণ ও চেষ্টা করত নেশা না করতে। ওরকম ব্রাইট স্বাস্থ্যবান ছেলের দুর্দশা দেখে আমার খুব কষ্ট হতো। আমি যে আড্ডায় সেদিন গিয়েছিলাম সেখানে সুদীপ ছিল। প্রথম প্রথম দু-এক ঘণ্টা, পরে সাত আট ঘণ্টা ওর সঙ্গে থাকতে লাগলাম। লক্ষ্য করলাম ও মনের জোর আনতে পেরেছে। আমি যতক্ষণ সঙ্গে থাকতাম ততক্ষণ ও নেশা করত না। কষ্ট হতো কিন্তু সেই কষ্টটাকে শেষ পর্যন্ত সুদীপ উপেক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। একটা ছেলের জীবন সম্পূর্ণভাবে আমার ওপর নির্ভর করছে।

টিনা থামতেই গৌরব বলল, তুমি খুব ভালো কাজ করেছ টিনা। ড্রাগের নেশা যাদের একবার ধরে নেয় তাদের মানসিক চিকিৎসা আগে দরকার। তুমি সেটা করেছ। কিন্তু একটা ভালো কাজ করার ইচ্ছে থেকে সমস্ত জীবন একসঙ্গে কাটানোর কথা ভাবা ঠিক হবে কিনা তুমি কি ভেবেছ? তুমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করো সুদীপকে কি করুণা করছ না? ও সুস্থ হলে তোমার জীবন যে অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে তা দেবার ক্ষমতা কি সুদীপের আছে?

তুমি একটা অদ্ভুত কথা বললে। আমি একটি শিক্ষিত মানুষ। যা পড়াশোনা করেছি তাতে নিজের খরচ চালানোর ক্ষমতা যদি না থাকে সেটা আমার সমস্যার। সুদীপ আর আমি মিলে রোজগার করলে নিশ্চয়ই না খেয়ে মরব না।

তোমার বাবা-মা এই বিয়ে মেনেছেন?

 মাকে রাজি করিয়েছি। কিন্তু বাবাকে নিয়ে সমস্যা হয়েছে।

কী বলছেন তিনি?

 তিনি সুদীপকে ভ্যাগাবন্ড, ওয়ার্থলেশ, লুম্পেন বলে গালাগাল দিচ্ছেন। আসলে মা যদি কথাগুলো বলত তাহলে বাবা আমাকে সমর্থন করতেন। আজ সকালে বাবা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন সুদীপকে বিয়ে করলে তিনি সব সম্পর্ক ত্যাগ করবেন।

মলি বলল এতক্ষণে, তুমি যদি নিজেতে স্থির থাকো তাহলে ওকথায় কান দিও না। বাবা মা প্রথমদিকে এমন জেদ দেখান পরে সময় গেলে মেনে নেন।

টিনা মাথা নাড়ল, আমি আমার জন্যে চিন্তা করছি না। এইভাবে আমি চলে গেলে মায়ের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক আরও খারাপ হবে।

এই দুজনের মধ্যে তুমি কাকে ভালোবাসো টিনা?

 আমি বাবাকে বেশি ভালবাসতাম।

এখন!

আমি জানি না।

আচ্ছা, বিয়ের ব্যাপারে একটু অপেক্ষা করা যায় না?

 আমি তো ব্যস্ত নই। কিন্তু সুদীপের মা আমার সাহায্য চাইছেন। তিনি মনে করছেন একমাত্র আমিই সুদীপকে বাঁচাতে পারি। উনি ব্যস্ত হয়েছেন। এটা অবশ্য খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এদিকটার একমাত্র উপায় দাদাকে নিয়ে আসা।

কিন্তু তোমার দাদা দীর্ঘকাল বাড়ির বাইরে আছে। হয়তো তার মনের চেহারা এবং জীবনের অভ্যাস এতদিনে পাল্টে গিয়েছে। ফিরে এলে সে তোমাদের সঙ্গে মানিয়ে নাও থাকতে পারে।

আমি বিশ্বাস করি না। দাদার মধ্যে অনেক নরম ব্যাপার ছিল।

ছিল তুমি বলছ? তার মানে তুমি জানো না এখনও সেটা আছে কিনা! সে ফিরে এলে তোমার বাবা তাকে নাও মেনে নিতে পারেন। সংঘাতটা তার সঙ্গে ছিল, তাই না? গৌরব উঠল, তোমার মা জানেন যে তুমি তাকে খুঁজতে চাইছ?

না। মা খুব অভিমানী।

এক্ষেত্রে অভিমানটা কীসের?

 দাদার চলে যাওয়া তিনি মানতে পারেননি। কিন্তু স্বীকার করে নিয়েছেন।

থানা পুলিশ করেছেন?

দাদা প্রাপ্তবয়স্ক ছিল।

তাতে কী? একটা লোক হারিয়ে গেলে তাকে কেউ খুঁজবে না। ঠিক আছে, টিনা, আমাকে তুমি দুটো দিন সময় দেবে?

মানে?

আমি আগে তোমার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

 বেশ।

 তারা তো আমার কথা জানেন।

হ্যাঁ। আমি সব বলেছি।

এবার আমরা চা খাব। এত চিন্তাভাবনা স্থগিত থাক।

কিন্তু আমাকে উঠতে হবে। সুদীপকে কথা দিয়ে এসেছি। টিনা উঠে দাঁড়াল, আমি জানি না কেন তোমার ওপর নির্ভর করে আছি।

টিনা চলে গেলে মলি জিজ্ঞাসা করে, তোমার ইন্টারভিউ কেমন হলো?

গৌরব সংক্ষেপে তার অভিজ্ঞতার কথা বলল। যাওয়ার আগে টিনা সরলার সঙ্গে দেখা করেছিল। তাই তিনি ঘরে ফিরে এসেছিলেন। গৌরবের কথা শুনে বললেন, ওরা তোকেই নেবে। আমার কথা মিলিয়ে দেখে নিস।

কিন্তু মা, ওরা যদি আমাকে চাকরি করতে ডাকে তাহলেও আমি করতে পারব কি না সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। গৌরব গম্ভীর গলায় বলল।

কেন? মলি জানতে চাইল।

ওভাবে যদি প্রতিপদে ইউনিয়নের চোখ রাঙানি শুনতে হয় তাহলে আর কাজটা হবে না। ঝগড়া চালিয়ে যেতে হবে। তাতে আমি অভ্যস্ত নই।

আগে থেকে কেন এসব ভাবছিস। হয়তো উল্টোটাও হতে পারে। সরলা বললেন, তোর দাদাকে ফোন করেছিস? ও এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব চিন্তা করছিল।

এমন কিছু খবর তো হয় নি। এসেই শুনবে। মা, তোমার শরীর কেমন আছে?

কেন বল তো? সরলা যেন অবাক হলেন।

 তুমি প্রায়ই ওই কাশিটা কাশছ।

কোথায়? কি যে বলিস! সরলা উঠলেন। যেন এড়িয়ে যেতেই বাগানে বেরিয়ে গেলেন।

মলি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার বলো তো? আমি তো কিছুই জানি না মায়ের কী হয়েছে?

জানি না, গতকাল এবং আজ সকালে বাথরুমে গিয়ে খুব কাশতে শুনলাম। জিজ্ঞাসা করলে কী বললেন শুনলে তো। বনিকে জিজ্ঞাসা করে দ্যাখতো, রাতে বিছানায় শোওয়ার পর কাশিটা হয়নি?

মলি নীরবে মাথা নাড়ল। তারপর আচমকা জিজ্ঞাসা করল, টিনার ব্যাপারটা কী করবে? ও তোমার ওপর খুব নির্ভর করে আছে!

কী করব বুঝতে পারছি না। বাবা-মায়ের মনের মিল না হলে সেটা সন্তানদের ওপর প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। আসলে আমরা প্রত্যেকে এতটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছি না যে অল্পেই অসহিষ্ণু হয়ে পড়ি!

তুমি কথাটা আমার দিকে তাকিয়ে বলছ?

অ্যাঁ? না তোমার কথা ভাবি নি বলার সময়। তবে দ্যাখো, তোমার সঙ্গে দাদার যে ঝামেলা চলছিল তা আর কিছুদিন লেগে থাকলে বনির অবস্থা যে টিনার মতো হতো না কে বলতে পারে।

ঠিক বলেছ। এ ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে। মলি মাথা নাড়ল, তবে আমার মনে হয় ওদের ব্যাপারে তুমি কথা না বললেই ভালো করবে।

গৌরব জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

মলি বলল, তুমি হাজার হলেও বাইরের লোক। তোমার কাছে ওঁরা কিছুতেই মনের কথা অকপটে বলতে পারেন না। সেটা না হলে অবস্থা কোনো পরিবর্তন হবে না।

গৌরব উঠল, আমি একটু ঘুরে আসি।

এই তো এলে, হঠাৎ?

একটা ব্যাপারে তুমি ঠিক বলেছ বউদি। ওদের সমস্যার সমাধান করতে হলে ঠিকঠিক ভেতরের লোক দরকার। আমি তার সন্ধানে যাচ্ছি! গৌরব হাসল।

তার মানে?

পরে বলব। বাইরে বেরিয়ে এসে গৌরব দেখল সরলা বাগান পরিষ্কার করছেন। শুকনো পাতা ডাল থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন তন্ময় হয়ে। এ যেন গাছটার সুস্থ সুন্দর রূপ দিতে তার একান্ত চেষ্টা। অথচ তাঁর কথা ভাববার মানুষ কে আছে। গৌরবের মনে হলো বৃদ্ধ হলে, বয়স বাড়লে, মানুষের মন বোধহয় একমাত্র প্রকৃতির কাছে গেলেই শান্তি পায়। গাছেরা সবাইকে নিয়েই থাকতে ভালবাসে।

জয়-এর ডেরা খুঁজে বের করতে কিছু অসুবিধা হলো না। কিন্তু সে তখনও ফেরে নি। পাশের দরজায় একটি অল্পবয়সী বউ দাঁড়িয়েছিল, নাম বলতে ঠোঁট ওল্টানো, কে জানে! ফেরার তো কোনো ঠিক নেই। গৌরব কী করবে বুঝতে পারছিল না। বউটি জিজ্ঞাসা করল,আপনি ওর কে হন?

দাদা। গৌরব জবাব দিল।

যাক। তবু একজন আত্মীয়কে দেখা গেল।

গৌরব বাইরে চলে এল। প্রায় ঘন্টাখানেক এলোমেলো ঘুরে সে যখন আবার ফিরে এল তখন রাত হয়েছে। দরজায় তালা নেই। শব্দ করতে জয় দরজা খুলে অবাক, আরে আপনি? আসুন, আসুন।

না, ভেতরে যাব না। তুমি বরং পোশাক পরে নাও। যেতে হবে।

কোথায়?

এসো, বলছি।

চটপট তৈরি হয়ে দরজায় তালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে জয় জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার?

তোমাকে আমার একটা অনুরোধ রাখতে হবে।

বলুন।

টিনার খুব বিপদ। ও একটি ছেলেকে বাঁচাবার জন্যে বিয়ে করতে চায়। আমি কথা বলেছি। ওর সিদ্ধান্ত থেকে ওকে সরানো যাবে না। তোমার বাবা ব্যাপারটা মানতে পারছেন না। মায়ের আপত্তি নেই। এই নিয়ে ওই বাড়িতে খুব ঝামেলা হচ্ছে।

তারপর? জয় খুব সহজভাবে জিজ্ঞাসা করল যেন এসবে তার কিছু এসে যাচ্ছে না।

টিনা এসেছিল আমার কাছে। ওর ধারণা একমাত্র তুমি এলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

ও জানল কী করে আপনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে?

আমি এখনও সেটা বলিনি। কিন্তু পাগলের মতো তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে টিনা। তুমি তো ওই বোনটাকেই সবচেয়ে ভালবাসতে, তাই না?

হুঁ। এবার যেন জয় চিন্তিত হলো।

তাহলে?

কিন্তু ওই ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা আমাকে মেনে নাও নিতে পারেন। সত্যি কথা বলতে কি বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের যে টান থাকে তা ওঁদের সম্পর্কে আমার একদম নেই। আমার সম্পর্কেও একই ধারণা!

সবই ঠিক বলছ তুমি। আবার বেঠিক হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

মানে?

মানুষের মনের নাগাল পাওয়া অত সহজে সম্ভব নয়। কোনো ফর্মুলায় মানুষের মন পড়ে না। গিয়ে হয়তো দেখবে ওঁরা তোমার জন্যে কাঙাল হয়ে বসে আছেন। অসম্ভব কিছু নয়। গৌরবের কথা শেষ হওয়া মাত্র হো হো করে হেসে উঠল জয়, এমন জোরে যে রাস্তার মানুষ তাকিয়ে দেখল। জয় বলল, দাদা, আপনি আমার মাতৃদেবীকে চেনেন না। তিনি আগে একজন মহিলা তারপর মা বোন অথবা স্ত্রী। কিন্তু এই বয়সে টিনা বিয়ে করতে চাইছে আর তিনি সমর্থন করছেন? অদ্ভুত লাগছে।

তোমার বাবা সমর্থন করলে তিনি বিরোধিতা করতেন। বাবা মানতে চাইছেন না বলেই– গৌরব কথা শেষ করল না।

ছেলেটির কী হয়েছে যে টিনাকে বাঁচাতে হবে?

ছেলেটিকে টিনা নিশ্চয়ই ভালবাসে। কিন্তু সে ড্রাগের নেশা করে। আর ওর বিশ্বাস একমাত্র টিনার ভালবাসাই ওকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে।

এরকম একটা ছেলেকে বিয়ে করে টিনা সারাজীবন কষ্ট পাবে।

তুমি জানো না। মানুষের পরিবর্তন হয় জয়।

 বেশ। আমাকে আপনি কি করতে বলেন?

তোমার অভিমান আছে। অপমান বোধও। কিন্তু যেহেতু তোমার বোন এখন সাহায্য চাইছে তাই বাড়িতে যাওয়া উচিত। সেখানে থাকবে কি না তা তোমার মনের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু টিনার পাশে গিয়ে তুমি দাঁড়াও।

জয় ঘুরে দাঁড়াল, ঠিক আছে। আপনার কথা রাখব। আমি আজই যাচ্ছি। এখনই। আপনি কি আমার সঙ্গে যাবেন?

না জয়। এটা তোমাদের একান্ত ঘরোয়া ব্যাপার। আমি গেলে কেউ সহজ হবে না। উইশ ইউ গুড লাক। গৌরব বাড়ির পথে রওনা হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *