৫. পারিজাত

৫। পারিজাত

স্কুলের ঘন্টা শুনলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আমি ছেলেবেলায় একটা অবৈতনিক উদ্বাস্তু বিদ্যালয়ে পড়েছিলাম। সেই স্কুলটার অবস্থা ছিল আমাদেরই মতো, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। পেতলের ঘন্টা কেনার পয়সা ছিল না বলে রেল ইয়ার্ড থেকে কুড়িয়ে আনা একটা লোহার টুকরো আওয়াজ তোলা হত। সে আওয়াজের কোনও জোর ছিল না। স্কুলে বেশিদিন পড়া হয়নি আমার। পরিবেশের অমোঘ নির্দেশে আমরা ক্রমে ক্রমে রাস্তার ছেলে হয়ে যাচ্ছিলাম। পরবর্তীকালে আমার জীবনের গতিকে আমি পরিবর্তিত করি বটে, কিন্তু স্কুলের জন্য আজও আমার বুকে কিছু দীর্ঘশ্বাস সঞ্চিত আছে।

আজ ছুটির দিন বলে শিবপ্রসাদ স্কুলে কোনও ঘণ্টার শব্দ নেই। অবশ্য এই সাতসকালে ঘণ্টা বাজেও না। খুব সম্প্রতি আমি ছুটির দিনে স্কুলটায় আসি এবং কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াই বা বসে থাকি।

না, আমি কবি, ভাবুক বা আবেগপ্রবণ লোক নই। আমি যা করি তার পিছনে সর্বদাই অত্যন্ত বাস্তব এবং প্রত্যক্ষ কারণ থাকে। ছুটির দিনে শিবপ্রসাদ স্কুলে আমার এই আগমনকে লোকে কী চোখে দেখবে জানি না। কিন্তু কারণটা আমার ব্যক্তিগত।

তটস্থ দারোয়ান ও দফতরিকে হাতের ইশারায় আমার অনুগমন করা থেকে নিবৃত্ত করে আমি প্রকাও স্কুলটা লম্বা ও প্রায় অন্ত বারান্দা করে বহু দূর পর্যন্ত হাঁটতে থাকি। ক্লাসঘরগুলোর দরজা বন্ধু। ভূতের বাড়ির মতো নিস্তব্ধ পরিবেশ। স্কুলের মাঝখানে মস্ত মাঠ, মাঠের ধারে ধারে বাঁশের বেড়া দেওয়া চমৎকার বাগান। কমলা সেনের রুচি আছে। স্কুলে ঢুকলেই বোঝা যায়, ভারী ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন এর পরিবেশ। দেওয়ালে কোনও লেখা নেই, বারান্দা বা বারান্দার নীচের ঘাসে কোনও নোংরা নেই। থামের ধারে ধারে ময়লা ফেলার বাক্স সাজানো রয়েছে।

কিন্তু এসব দেখতে আমি আসিনি। ক্লাস ফাইভের সামনের বারান্দার সিঁড়িতে বসে আমি বিশাল স্কুল বাড়িটার দিকে চেয়ে থাকি। মাঠের তিন দিক ঘেরা ইংরেজি ইউ অক্ষরের মতো মস্ত দোতলা বাড়ি। আমি এই স্কুলের সেক্রেটারি বটে, কিন্তু স্কুলটার সঙ্গে আমার কোনও ভাবগত যোগাযোগ নেই। আমি এই জায়গার লোক নই, এই স্কুলে কখনও পড়িনি। তাই এই স্কুলকে নিয়ে মামার কোনও সুখস্মৃতি নেই। সম্ভবত এই স্কুল বা পৃথিবীর অন্য কোনও স্কুলের প্রতি আমার তেমন কোনও দুর্বলতা বা ভালবাসাও নেই।

আমার না থাক, অসীমার আছে। আর সেই ভালবাসা কতটা গভীর এবং কতটা একনিষ্ঠ তা আমার জানা দরকার।

অসীমার আচরণের মধ্যে সম্প্রতি আমি কিছু অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করছি। যে কোনও স্বাভাবিক মানুষের কাছেই পদোন্নতি একটি অত্যন্ত আকাঙিক্ষত বস্তু। বিশেষ করে স্কুলের হেডমিস্ট্রেস হওয়াটা তত যে কোনও শিক্ষয়িত্রীর কাছেই শিকে ছেঁড়ার মতো ঘটনা। এই অত্যন্ত ভাল জাতের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হওয়ার স্বপ্ন অনেকেই দেখার কথা। কিন্তু অসীমার মধ্যে সেই দুর্লভ ইচ্ছাপূরণজনিত কোনও আনন্দের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে না।

কমলা সেনকে অসীমা বোধহয় একসময় খুবই শ্রদ্ধা করত এবং ভালও বসত। কিন্তু সম্প্রতি কমলা সেনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না। না যাওয়ারই কথা। কমলা সেন আমাকে পছন্দ করেন না, আমার ভাবী স্ত্রীকেও তার পছন্দ হওয়ার কথা নয়। তবু এই কমলা সেনের পদত্যাগের কথায় অসীমা যেন তেমন স্বস্তি পাচ্ছে না। তার বদ্ধমূল ধারণা, কমলা চলে গেলে স্কুলের অবনতি ঘটবে। এমনকী সে ধরেই নিয়েছে, তার পক্ষে স্কুলের প্রশাসন ঠিক মতো চালানো সম্ভব নয়।

আমার সমস্যা অসীমাকে নিয়ে। আমি তাকে আর একটু জানতে চাই। আমার ভিতরে যে ক্যালকুলেটর যন্ত্রটি সব সময়েই নির্ভুল নির্দেশ দেয় সে যেন বলছে, অসীমার ভাবগতিক ভাল নয়। তার ভিতরে একটা বিদ্রোহের অঙ্কুর দেখা যাচ্ছে। যদিও আমার ধারণা সেই অঙ্কুরটি সম্পর্কে অসীমা নিজেও সচেতন নয়।

বস্তুত এই স্কুলে এসে এর পরিবেশটিকে আমি হৃদয়ঙ্গম করারই চেষ্টা করি। বুঝতে চেষ্টা করি, অসীমার প্রকৃত মনোভাবটি কী।

চিন্তাটা অবশ্য ঘরে বসেও করা যায়। কিন্তু স্কুলে এলে এমনটা এই পরিবেশে আরও সুনিশ্চিয়তার সঙ্গে তার ক্যালকুলেশন চালাতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

ক্লাস ফাইভের সামনে সিঁড়িতে বসে আমি অসীমার শুষ্ক ও রুক্ষ মুখখানা স্পষ্টই মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম, অসীমা ক্লাসের শেষে বারান্দায় বেরিয়ে এল। আনমনে বাগানের একটা দোলনচাঁপা গাছের দিকে চেয়ে দেখল একটু। সাদা সুন্দর নিষ্পপ ফুল। তারপর একটু শিউরে উঠল সে। কুসুমে যে কীটও আছে। শিবপ্রসাদ স্কুলের হিসাবনিকাশ অন্তত সেইরকমই একটা আভাস দিচ্ছে। এই শুচিশুভ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটছে নেপথ্যের লোভী হস্তাবলেপ। তার হয়তো সন্দেহ, সে হেডমিস্ট্রেস হওয়ার পর তার ভাবী স্বামী তাকে সামনে শিখণ্ডীর মতো রেখে তলায় তলায় স্কুলের ভিত ক্ষয় করে ফেলবে। কিন্তু তা হতে দেয় কী করে সে? এই স্কুলকে যে সে প্রাণাধিক ভালবাসে। প্রারম্ভিক প্রার্থনাসংগীত থেকে শেষ পিরিয়ডের ড্রিল পর্যন্ত তার কাছে যেন এক বিশুদ্ধ সংগীতেরই বিস্তার ও পরিণতি।

শিবপ্রসাদ স্কুলের প্রতিটি ইট কমলা সেনের মতোই তার কাছেও বুকের পাঁজর।

চোখ বুজে অসীমার মানসিকতার মধ্যে আমি এমন ডুবে ছিলাম যে আকস্মিক একটা আর্ত চিৎকারে প্রায় লাফিয়ে উঠতে হল।

পরমুহূর্তেই অবশ্য ভুল ভাঙল। চিৎকার নয়, গান। মনে ছিল না যে, রবিবার সকালে এই স্কুলে একটা গানবাজনার স্কুলের ক্লাস হয়।

আমি উঠে পড়লাম, উঠতে উঠতেই সিদ্ধান্ত নিলাম, অসীমার ওপর নজর রাখতে হবে। খুবই সতর্ক নজর রাখতে হবে। তার মানসিকতা এখন স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই।

বেরিয়ে আসবার মুখে ফটকের কাছে একজন তানপুরাধারী লোক আমার পথ আটকাল।

দাদা! আমি হাল ছাড়িনি।

 প্রথমটায় চিনতে পারিনি। মস্ত বাবরি চুল, গালে মাইকেলের মতো জুলপি, পরনে চুপ্ত পায়জামা আর গায়ে দারুণ চিকনের কাজ করা পাঞ্জাবি। একটু ঠাহর করে দেখে তবে গন্ধর্বকে চিনতে হল।

আপনা থেকেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল। বললাম, না গন্ধর্ব, হাল ছাড়াটা ঠিকও হবে না। লেগে থাকো। গান কেমন হচ্ছে?

দারুণ! আজকাল-কথা পর্যন্ত গান হয়ে বেরোতে চায়।

বাঃ! আর নাচ?

 দুর্দান্ত। আজকাল আমার হাঁটাচলায় পর্যন্ত নাচের ছন্দ।

তোমার হবে গন্ধর্ব।

আপনার আশীর্বাদ।-বলে গন্ধব আমার পায়ের ধুলো নিয়ে বলে, রুমার সঙ্গে আসানসোলের একটা ফাংশনে দেখা হয়েছিল।

তাই নাকি? কেমন বুঝলে?

 পাত্তা দিচ্ছে না।

একদম না?

না, তবে আড়ে আড়ে দেখছে বলে মনে হল।

 তুমিও লক্ষ রেখো, রুমা পাকাল মাছের মতো পিছল মেয়ে।

লক্ষ রাখার সময় কোথায়? খুব ভোরে গলা সাধি। সকালে যোগব্যায়ামের ক্লাসে যাই। দুপুরে কলেজ। বিকেলে জিমনাসিয়াম। সন্ধেবেলায় নাচের প্র্যাকটিস। ঠাসা প্রোগ্রাম।

আমি সভয়ে বলি, তুমি কি রুমাকে ভুলে যাচ্ছ গন্ধর্ব?

গন্ধর্ব একটু লজ্জা পেয়ে জিব কেটে বলে, তা নয়। তবে আগের মতো সব সময়ে রুমাকে নিয়ে ভাবার মতো সময় হয় না।

কিন্তু মনে পড়ে তো?

একটু-আধটু কি আর পড়ে না।

 আমি অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলি, বিরহের ভাবটা কেটে যাচ্ছে না তো গন্ধর্ব?

গন্ধর্ব আমতা আমতা করে বলে, তা কাটছেনা। তবে আগের মতো তীব্রতা নেই।

সর্বনাশ! গন্ধর্বের কথা শুনে ও হাবভাব দেখে প্রায় মাথায় হাত দেওয়ার অবস্থা হয় আমার। কুমার বিরহ যদি ও হজম করে বসে থাকে তা হলে হয় রুমাকে অন্যপাত্র দেখতে হবে, নয়তো পাকাপাকিভাবেই আমার কাঁধে ভর করতে হবে। কোনওটাই অভিপ্রেত নয়। আমি ভীষণ উদ্বেগে ওর হাত দুটো ধরে ফেলার চেষ্টা করি। তবে ওর এক হাতে তানপুরা থাকার জন্য মোটে একটা হাতই নাগালে আসে আমার, অতি করুশ স্বরে আমি প্রশ্ন করি, গন্ধর্ব, রুমার জন্য তোমার বিরহের তীব্রতা কেন কমে যাচ্ছে? রুমাকে কি সুন্দর বলে মনে হয় না তোমার? বিবাহিত জীবনের স্মৃতিও কি তোমাকে হন্ট করে না?

গন্ধর্ব খুবই লজ্জা পেয়ে বলে, না না, ওসব ঠিকই আছে। তবে বিরহটা একটু ভোতা হয়ে গেছে বটে। আমার মনে হয় দাদা, দুনিয়ার অধিকাংশ বিরহের গল্পই বোগাস। ঠিক মতো ব্যায়াম করলে, গানটান গাইলে বা নাচলে এবং আসন করলে বেশিরভাগ বিরহই কেটে যেতে থাকে।

আমি তার সবল পেশিবহুল হাতখানা জড়িয়ে ধরে রেখেই মিনতির স্বরে বলি, তা হলে তুমি ব্যায়াম বা আসন কমিয়ে দাও গন্ধর্ব, অত নাচগানেরই বা দরকার কী পুরুষমানুষের?

গন্ধর্ব ম্লান একটু হেসে বলে, তা আর হয় না দাদা। ব্যায়াম আমার চোখের সামনে থেকে একটা কূপমণ্ডুকতার পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। নাচ আর গানখুলে দিয়েছে অন্য এক জগতের দরজা, জীবনটা কী যে ভাল লাগে আজকাল। পৃথিবীকে কত সুন্দর লাগে।

রুমাকে ছাড়াও?- করুণতর স্বরে আমি জিজ্ঞেস করি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গন্ধর্ব বলে, রুমাকে ছাড়াও।

 কিন্তু এ তো ভাল কথা নয় গন্ধর্ব!

 কিন্তু এ পথ আপনিই দেখিয়েছিলেন দাদা। আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ব্যায়াম, নাচ বা গানে বিরহের ব্যথা সত্যিই কমে যায় বলে যদি জানতাম তা হলে কি আর সেই পথ দেখাতাম গন্ধর্বকে? মনে হচ্ছে, আমার অভ্যন্তরে স্থাপিত ক্যালকুলেটর মেশিনটা এই প্রথম একটা ঠিকে ভুল করে ফেলেছে।

আশপাশ দিয়ে গান ও নাচের ক্লাসের মেয়েরা যাচ্ছে। বেশ সুন্দরী সব মেয়ে। যেতে যেতে গন্ধর্বের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছে। হাসছেও কেউ কেউ চেনার হাসি। আমি তাদের চোখে গর্কে প্রতি একধরনের সপ্রশংস গুণমুগ্ধতার ভাব লক্ষ করে শিউরে উঠি। ব্যায়াম করে গন্ধর্বর চেহারা খুলেছে। গানও বোধহয় সে খুবই ভাল গাইছে আজকাল। নাচও হয়তো মন্দ নাচছে না। মেয়েরা যদি গন্ধর্বকে পাত্তা দিতে থাকে তবে বোকা এবং আহাম্মক রুমাটা তো একেবারেই বেপাত্তা হয়ে যাবে।

কথা বলতে বলতেই একটি সুন্দরী মেয়ে এসে গন্ধর্বকে প্রায় হাত ধরে টেনে নিয়ে ভিতরে চলে গেল।

খুবই বেকুবের মতো আমি বাসায় ফিরে আসি এবং ভাবতে থাকি।

.

আকাশ ঘনঘোর মেঘে আচ্ছন্নই ছিল। হঠাৎ বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল। অঝোর বৃষ্টি। আমার চিন্তা রুমা থেকে দাঁড় বদল করে বৃষ্টির ঘরে গিয়ে বসল। বৃষ্টির লক্ষণ ভাল নয়। বন্যা হবেই। হবে কেন, বন্যা শুরুও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। গাঁ গঞ্জে কিছু কিছু নিচু জায়গা ডুবে যাওয়ায় ছোটখাটো ইভ্যাকুয়েশনও শুরু হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই স্কুল কলেজ বন্যার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। বন্যার্তরা এসে ভিড় করবে সেখানে। একারি রিলিফ পৌঁছোতে দেরি হবে আর তা করতে জনগণের নেতারা ছিঁড়ে খাবে প্রশাসনকে। তখন অবশ্যম্ভাবী ডাক পড়বে আমার। আমি সেজন্য প্রস্তুত আছি। আমার কাছে গম, চাল, চিনি, জামাকাপড় সবই মজুত আছে রিলিফের জন্য। তবু একটু খিচ থেকেই যাচ্ছে। রিলিফ নিয়ে গোলমাল বেঁধেছিল গেলবারের আগেরবার। সরকারি গুদাম লুট হয়েছিল অধরের নেতৃত্বে। আমার ক্যালকুলেটর বলছে, নেতৃত্ব অধর এবারও দেবে। তবে এবার আর সরকারি গুদাম নয়। তার লক্ষ্য হবে আমার নিজস্ব গুদাম।

প্রতিপক্ষ হিসেবে অধর চমৎকার। শক্তিমান, আত্মবিশ্বাসী, বুদ্ধিমান। বলতে কী, এই অঞ্চলে আমার নিরঙ্কুশ প্রাধান্য তার জন্যই খানিকটা আটকে আছে। আমাদের মধ্যে একটা শেষ লড়াই হওয়া দরকার। সেটা আসন্ন বলেই আমার অনুমান। এক আকাশে যেমন দুই সূর্যের স্থান নেই তেমনিই এই জায়গার পক্ষে দু-দুজন ধুরন্ধর একটা বিশাল বাহুল্য মাত্র। হয় তাকে উচ্ছেদ হতে হবে, নয়তো আমাকে।

অনেকেরই ধারণা অধরের প্রেস্টিজে হাত দেওয়া আর জাতসাপের লেজ দিয়ে কান চুলকোনো একই ব্যাপার। আমি অবশ্য এরকম কোনও বিশ্বাসে বিশ্বাসী নই। দারিদ্র্যসীমার ওই রেলবাঁধটা ডিঙোতে গিয়ে আমাকে বহু উঁচু ও নিচুতে ঠোক্কর খেতে হয়েছে এবং বিবিধ জাতসাপের লেজ দিয়ে বে-খেয়ালে বহুবারই আমি কান চুলকে ফেলেছি। সেই জাতসাপগুলো এখনও বেঁচে আছে কি না আমি তা সঠিক জানি না। কিন্তু আমি বেঁচে আছি। আসল কথা হল, সাপ যেন মানুষের শত্ৰু, তেমনি মানুষও সাপের শত্রু। অন্যের দাঁত নখ দেখে অধিকাংশ মানুষই ভয়ে পিটিয়ে থাকে। কিন্তু তারা ভুলে যায় যে, ভগবান তাদেরও যথেষ্ট দাঁত নখ দিয়েছেন।

সন্ধেবেলায় আমি একথাটাই গুণেনবাবুকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। গুগেনবাবু খুব মনোযোগী শ্রোতা নন। সাধারণত পণ্ডিত ও বক্তারা অন্যের কথা শুনতে ভালও বাসেন না। কিন্তু আজ গুণেনবাবুকে খুবই অন্যমনস্ক ও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। উনি আমার সব কথাতেই ই দিয়ে যাচ্ছিলেন। অনেকক্ষণ শোনার পর বললেন, দাঁত নখের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। আবহমানকাল ধরেই মানুষ ও অন্যান্য পশু দাঁত নখ ইত্যাদি ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বলে একটা কথা আছে পারিজাত।

আমি মাথা নেড়ে বলি, হ্যাঁ, ওরকম একটা কথা প্রায়ই আমার কানে আসে।

 গুণেনবাবু একটু চিন্তিত মুখে বলেন, কানে তো আসে, কিন্তু কথাটার মানে জানো?

খুব ভাল জানি না।

সোজা কথা হল, দাঁত নখ যদি কোনওদিন ঈশ্বরের কৃপায় লোপাট হয়ে যায় তবে অন্য কথা। কিন্তু যতদিন মানুষের দাঁত নখ থাকবে ততদিন তারা সেটা ব্যবহার করতেও ছাড়বে না। আমাদের শুধু দেখতে হবে, মানুষ যেন অপ্রয়োজনে বা সামান্য কারণেই তা ব্যবহার না করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হল একটা আপসরফা মাত্র। দুর্বল ও সবলের মধ্যে একটা নড়বড়ে সাঁকো বাঁধার চেষ্টা। তবু সেই চেষ্টাটাই হচ্ছে মনুষ্যত্ব।

আমি একটা হাই গোপন করার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললাম, তা হবে।

গুণেনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, অধরের সঙ্গে তোমার যদি একটা শো-ডাউন হয়ই তবে সেটা হবে দুটো বিগ পাওয়ারের লড়াই আমাদের তাতে কোনও প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই। কিন্তু মনে রেখো, দুটো বড় শক্তির লড়াই যখন লাগে তখন কিছু উলুখাগড়ারও প্রাণ যায়। আমার ভয় সেখানেই।

আমি ভ্রু কুঁচকে নিজের নখ দেখতে লাগলাম।

উনি বললেন, অধর লোকটা খুব খারাপ নয় পারিজাত। ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি তো। একটু মাথাগরম গা-জোয়ারি ভাব আছে বটে, কিন্তু মানুষের দায়ে দফায় ও সবার আগে গিয়ে বুক দিয়ে পড়ে। এই তো সেদিনও মেথরপট্টির একটা মড়া পোড়ানোর টাকা দিল, নিজে কাঁধে করে মড়া বইল পর্যন্ত। একসময়ে ওর নামই হয়ে গিয়েছিল এ শহরের রবিন হুড।

আমি বিনীতভাবেই বললাম, আমি জানি।

 গুণেনবাবু একটু চাপা স্বরে বললেন, আমি বলছিলাম কি ওর সঙ্গে একটা মিটমাট করে নাও।

শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তো?

 ধরো তাই।

তা হলে এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ব্যাপারটা আপনি অধরবাবুকেও একটু বুঝিয়ে বলুন না।

গুণেনবাবু অসহায়ের মতো মুখ করে বললেন, মুশকিল হল, তুমি আমার হবু ভগ্নীপতি। তাই অধর ধরেই নিয়েছে যে, আমি তোমার পক্ষে। কাজেই সে আমার কথা কানে তুলছে না। কমলার ব্যাপারটাতেও সে খুব পারটারবড়।

তা হলে আর কী করা যায় বলুন!

কমলা আর অধরের ব্যাপারটাকে আমি সাপোর্ট করছি না পারিজাত। আমি মানি, কোনও স্কুলের হেডমিসট্রেসের ব্যক্তিগত জীবনে কোনও কলঙ্ক থাকা উচিত নয়। তবু এতকাল এটা নিয়ে উচ্চবাচ্য যখন করেনি তখন তুমিই বা হঠাৎ ময়লার গামলায় খোঁচা দিতে গেলে কেন?

আপনারা এতকাল ধরে একটা দুর্নীতি ও ব্যভিচারকে সমর্থন করে আসছেন কেন সেটা আমি আজও বুঝতে পারি না। হয়তো অধবকে আপনারা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভয় পান এবং কমলা সেনের যোগ্যতা সম্পর্কে আপনাদের ধারণাও অনেকটাই অতিরঞ্জিত।

গুণেনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলেন। আজ উনি তর্ক করার মুডে নেই। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কথাটা হয়তো তুমি ঠিকই বলেছ। তবু বলি, তুমি যদি কিছু মনে না করো তবে আমি তোমার সঙ্গে অধরের একটা মিটমাট ঘটানোর শেষ চেষ্টা করে দেখতে পারি।

আপনি অত ভয় পাচ্ছেন কেন?

গুণেনবাবু মরা মাছের চোখের মতো এক ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে আমাকে দেখতে দেখতে বললেন, অধরের হাতে অনেক লোক আছে।

আমি মৃদু হেসে বললাম, আমি জানি অধরবাবুর হাতে অনেক লোক এবং তাও আছে। তদুপরি তিনি হলেন লোকাল লোক, যাকে বলে ভূমিপুত্র। তিনি এখানকার রবিনহুডও বটে। শহরের বেশিরভাগ লোকেরই সমর্থন অধরের দিকে। এ সবই আমি জানি। আমি তার সঙ্গে লাগতেও চাই না। কিন্তু একটা অন্যায়ের প্রতিকার হওয়া উচিত বলে মনে করি।

গুণেনবাবু চুপ করে গেলেন। অবশ্য এর চুল আর অন্য একটা কাল লি। ঘরের বাইরে ভেজা ছাতাটা বারান্দায় রেখে জহরুবাবু গায়ের অলআড়ছেন। মুখে বিগলিত হাসি।

এই একজন লোক যিনি এখনও কিভাবে আমার দলে। অন্য কতদিন ইন আমার দলে থাকবেন তা বলা শক্ত। প্রতিমার চাকরিটানাহলে হয়তো চট করে দলবদলে ফেললো এই যুগে দল বদলের একটা বীজাণু এসে গেছে।

জহরবাবু ঘরে ঢুকতেই গুণেবাবুচলি হেপারিজাত বলে উঠেপড়লেন। আমিরুকরলাম, গুণেনবাবু যাওয়ার সময় ভুল করে নিজের ছাতটার বদলে অহরবাবুর মুতাটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি কিছুই বললাম না। এইছতা দলের সঙ্গে সঙ্গে যদি দুজনের মানসিকতারও একটু বদল হয়? হতেও তো পারে! দুনিয়ায় কি অঘটন আজও ঘটে না।

জহরবাবু বসে রুমাল দিয়ে ভাল করে মাথা মুছেবললেন, ওঃ! প্রতিমা তো সেই থেকে কেবই আপনার কথা বলছে। যেমন সুন্দর চেহারাখানা, তেমনি অমায়িক ব্যবহার, প্রসায় একেবারে পঞ্চমুখ।

কথাটায় সত্যতা কত পারসেন্ট তা হিবে করতে তেও আমি বেশ খুশিই বোধ করলাম। সুন্দরী যুবতী মেয়েদের আমি তেমন করে আকর্ষণ করার চেষ্টা কখনও করিনি বটে, কিন্তু কেউ আকৃষ্ট হয়ে থাকলে ভালই লাগে।

বললাম, তাই নাকি?

আর বলবেন না। দিনরাত শুধু আপনার কথা। আজ দুপুরে ওর মাকেও বললি, পারিজাতবাবু দরিদ্র অবস্থা থেকে যেভাবে ওপরে উঠে এসেছে তা নিয়ে একটা উপন্যাস লেখা যায়। আপনার জীবনী লেখার জন্য তো ও একেবারে মুখিয়ে আছে।

জহরবাবু সেই জীবনীপ্রসঙ্গেই আটকে আছে। র মনটা হল খারাপ আমোফান রেকর্ডের মতো। যেখানে পিন আটকায় ঘুরেফিরে সেই জায়গাটাই বাজতে থাকে।

তবু এইসব কথাতেও আমি কেন যেন খুশি হৰি। স্তাবকতা যে মানুষের কত বড় শত্রু। বেশ খোশ গলায় বললাম, তাই নাকি?

জহরবাবু হঠাৎ টেবিলে ভর দিয়ে একটু ঝুঁকে চাপা গলায় বললেন, ওই ছোকরাটাকে আপনি জোটালেন কোথা থেকে বলুন তো!

আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন ছোকরা?

ওই যে অভিজিৎ গাঙ্গুলি না কী যেন নাম।

 আমিও চাপা গলায় বললাম, কেন বলুন তো।

আরে দূর! দূর! ও মাস্টারি করবে কী মশাই? ও তো ডেনজারাস নকশাল।

 তাই নাকি?

 আরে হ্যাঁ, বলছি কী তা হলে? মউডুবির বঙ্কিম গাঙ্গুলির নাতি। বংশটাই গোঁয়ার গোবিন্দ টাইপের। এ ছোকরা তো শুনি খুনটুনও করেছে।

কোথা থেকে শুনলেন?

খবর নিয়েছি আর কি! ও ছোকড়া স্কুলে ঢুকলে স্কুল লাটে তুলে দেবে।

আমি গম্ভীর হয়ে বলি, তা হতে পারে। তবে ছেলেটা লেখাপড়ায় ভাল। হায়ার সেকেন্ডারিতে তিন বিষয়ে লেটার পেয়েছিল।

নির্বিকার মুখে মিথ্যে কথাটা বলে আমি জহরবাবুর রিঅ্যাকশন লক্ষ করতে লাগলাম। জহরবাবু অসহায়ভাবে নিজের ঠোঁট দুটো গিলে ফেলার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, তিনটে লেটার!

তিনটে বলেই তো জানি।

টুকেছে তা হলে। বোমা বন্দুক বানিয়ে আর মানুষ খুন করে পড়াশুনোর সময়টা পেল কখন বলুন।

এই একটা ব্যাপার সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা খুব গভীর। তাই আমি খুব গম্ভীর হয়ে জহরবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কখনও পরীক্ষায় টুকেছে?

আমি!-জহরবাবু থতমত খেয়ে বললে,কী যে বলেন!

আমি মাথা নেড়ে বললাম, তা হলে আপনার একটা জিনিস জানা নেই। টুকে পাশ করা যায় বটে, কিন্তু কিছুতেই লেটার পাওয়া যায় না। কারণ চোথা দেখে দেখে খাতায় তুলতে ডবল সময় লাগে। তার ওপর গার্ডের দিকেও নজর রাখতে হয়। যদি টোকার অভিজ্ঞতা থাকত তা হলে বুনে, তিন ঘটায় মেরেকেটে ত্রিনিক্সের ব্যবস্থা করা যায় বটে, কিন্তু কিছুতেই লেটার পাওয়া যায় না। তা যদি যেত তা হলে আমিও হায়ার সেকেন্ডারিতে সব কটা বিষয়ে লেটার পেতাম।

জহরবাবু আমার স্বীকারোক্তিতে ভারী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আবার নিজের ঠোঁট দুটো গিলে ফেলার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, তাই বুঝি।

আমি গলায় যতদূর সম্ভব বিষাদ মাখিয়ে বললাম, হ্যাঁ জহরবাবু, আমিও টুকেই পাশ করেছি। সবকটা বিষয়ে।

জহরবাবু সজোরে গলা খাঁকারি দিয়ে চট করে লাইন পালটে বললেন, আপনার কথা আলাদা। একদিকে তীব্র দারিদ্র্য, অন্যদিকে সাতিক জীবন সংগ্রাম। মরণপণ লড়াই। হয়তো ঘরে বাতি জ্বালাবার মতো কেরোসিন নেই বই নেই, খাতা নেই, পেনসিল নেই। অথচ পাশ করতেই হবে। ওরকম কনডিশনে মশাই, আমার তো মনে হয় না টোকা অপরাধ।

আমি মোলায়েম গলায় বললাম, কথাটা প্রতিমাকে বলনে।

 কোন কথাটা?

আমি যে পরীক্ষায় টুকে পাশ করেছি সেই কথাটা। ও তো আমার জীবনী লিখবে, ওর এসব জানা দরকার।

খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জহরবাবু বললেন–বলব। কিন্তু দেখবেন, ও আপনাকে ভুল বুঝবে না। আপনার ওপর ওর এ এতই বেশি যে, আপনার প্রতিটি কাজের মধ্যেই ও একটা মহত্ত্ব দেখতে পায়। কিন্তু ওই অভিজিৎ ছোঁড়া সম্পর্কে আমার একটু খিচ থেকেই গেল। অতগুলো লেটার ও বাগালে কী করে? ওর হয়ে অন্য কেউ পরীক্ষা দেয়নি তো?

তা কী করে বলব? দিতেও পারে।

লেটার প্রতিমাও গোটাকয় পেত, বুঝলেন পারিজাতবাবু! কিন্তু আচমকা টাইফয়েড হয়ে সব ওলটপালট হয়ে গেল। টাইফয়েড বড় সাংঘাতিক জিনিস। পরীক্ষার আগে মাস দুয়েক তো প্রতিমা বই খুলতেই পারত না। অক্ষরের দিকে তাকালেই মাথা ঝিমঝিম করত।

বটে! তারপর?

সে আর বলেন কেন? আমি গরিব মানুষ, কষ্টেসৃষ্টে একজন ভাল মাস্টার রাখলাম। মাস্টার পড়ত, প্রতিমা শুনত। কিন্তু ব্রেনটা ভাল বলে শুনেই মনে রাখতে পারত।

ওভাবেই পরীক্ষা দিল?

পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না সেবার মেয়েটার। বলেও ছিল, এক বছর ড্রপ দিয়ে পরের বছর পরীক্ষা দিলে গোটা তিন-চার লেটার পাবেই। তা আমি রাজি হলাম না। আবার বছরটাকের ধাক্কা।

আমি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, গরিবদের বড় কষ্ট।

বড় কষ্ট। প্রতিধ্বনি করে জহরবাবু বলেন, একবছর নষ্ট করা কি আমাদের পোয়? তবে মাস্টারটি পেয়েছিলাম চমৎকার। চালাকচতুর ছোকরা। সে ভরসা দিল, সব ম্যানেজ করে দেবে।

দিয়েছিল?

লজ্জা-লজ্জা মুখ করে জহরবাবু বললেন, তা দিয়েছিল বটে।

 কীভাবে?

 জহরবাবু ভারী লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বলেন, ওই আর কি!

আমি বুঝলাম এবং আর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

জহরবাবু করুণ স্বরে বললেন, কথাটা আপনি ঠিকই বলেছেন। চোথা দেখে লিখলে পাশ করা যায় ঠিকই, কিন্তু লেটার পাওয়া যায় না। আপনি অতিশয় বিজ্ঞ মানুষ।

অভিজ্ঞও। আমি বললাম।

 প্রতিমার সঙ্গে অনেক ব্যাপারেই আপনার আশ্চর্য মিল।

 তাই নাকি?

 প্রতিমাও বলছিল। আপনার ডান গালে একটা তিল আছে। ওরও তাই।

আমি ডান গালে হাত বুলিয়ে বললাম, আছে নাকি? লক্ষ করিনি তো!

 জহরবাবু একটু হেসে বললেন, নিজেকে আর আপনি কতটুকু লক্ষ করেন? আপনার হচ্ছে হাতির মতো দশা। হাতি যদি বুঝতে পারত যে সে কত বড় তা হলে তুলকালাম বাঁধিয়ে দিত। কিন্তু নিজেকে তো সে দেখে না। তাই বলছিলাম, আপনার দেখাশোনারও একজন লোক দরকার।

জহরবাবুর ইঙ্গিতটা আমি ঠিক ধরতে পারলাম না। কিন্তু মনে হল, উনি কিছু বলতে চাইছেন। গভীর ও গোপনীয় কিছু।

আমি নিীতভাবে বললাম, হ্যাঁ, তা তো বটেই।

উনি গলা খাকারি দিয়ে বললেন, বিপত্নীকদের ভারী অসুবিধে।

আমি বললাম, হ্যাঁ, তা তো ঠিকই।

গুণেনবাবুর বোন অবশ্য ভাল মেয়ে। তবে বড্ড রুগ্ন।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

জহরবাবু উঠে পড়লেন। বললেন, প্রতিমা নিজেই আপনার কাছে আসবে। আপনার জীবনের কথা জানতে খুবই আগ্রহ ওর। বলছিল, পারিজাতবাবুর কাছে গিয়ে বসে থাকলেও জ্ঞানলাভ হয়।

আমি বিনীতভাবে চুপ করে রইলাম। অঝোর বৃষ্টির মধ্যেই অন্যমনস্ক এবং উত্তেজিত জহরবাবু ভুল ছাতা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি তাকে নিষেধ করলাম না।

ঘরে বসে আমি বাইরের বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে অনেক কিছু ভাবলাম। আমার মন পাখির মতো এক ডাল থেকে আর এক ডালে লাফিয়ে যায়, কিছুক্ষণ বসে, আবার ওড়ে। গুণেনবাবু, অধর, প্রতিমা… বৃষ্টি…

রাতে খাওয়ার টেবিলে রুমার সঙ্গে দেখা। খুবই সন্তর্পণে দূরত্ব বজায় রেখে আমি বসলাম এবং অন্যদিকে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করতে লাগলাম।

আমাদের দারিদ্র্যের দিনে বাস্তবিকই আমরা প্রকৃত অর্থে ছোটলোক হয়ে গিয়েছিলাম। খুব অল্প বয়সেইআমরা সবরকম খারাপ কথা ও গালাগাল শিখি এবং তা প্রয়োগ করতে শুরু করি। একথাও ঠিক যে, আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং শুরুই হত শুয়োরের বাচ্চা দিয়ে। কালক্রমে অবশ্য আমি সেইসব শব্দকে সংযত ও সংহতভাবে প্রয়োগ করতে শিখেছি। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে প্রয়োগ করি না। অনভ্যাসে বহু তীক্ষ্ণ গালাগাল ভুলেও গেছি। কিন্তু রুমা কেন যেন ভোলেনি। যথেষ্ট সংস্কৃতির চর্চা করা সত্ত্বেও ওর মধ্যে সেই নর্দমার বস্তিযুগের ঘরানা এখনও বেঁচে আছে। রেগে গেলেই মা সেই নর্দমার মুখটি খুলে দেয়। তখন আর ভদ্রতার লেশমাত্র থাকে না। সেই ভয়ে আমি কোনও সময়েই ওকে চটাই না। কিন্তু মনে হচ্ছিল, ওকে এবার একটু সাবধান করে দেওয়াও দরকার। গর্ব যদি সত্যিই ওর হাহাড়া হয়ে যায় তা হলে আমার বিপদ।

আমি অন্যদিকে চেয়ে থেকেও ওর মুড বুঝবার চেষ্টা করলাম। মনে হল, মুড খুবই ভাল। এত বৃষ্টিতে তা-ই হওয়ার কথা।

সাবধানে বললাম, গন্ধর্বর সঙ্গে আজ দেখা হয়েছিল।

মা একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল। পাতাটা ঝটাং শব্দে উলটে দিয়ে বলল, দেখা হতেই পারে।

 আমি একটু ফাঁক দিয়ে বললাম, ওর অনেক ফ্যান হয়েছে দেখলাম।

 রুমা ঝটাং করে আর একটা পাতা উলটে দিল। বলল, তাই নাকি? কীসের ফ্যান, নাচ না গান না ব্যায়াম?

 তা কে জানে! মনে হল তিন রকমেরই।

ঠোঁট উলটে রুমা বলল, দু চোখে দেখতে পারি না। মাগো! গায়ে গিল গিল করছে গোল গোল মাংসপিণ্ড! তার ওপর আবার পুরুষ হয়ে কোমর বেঁকিয়ে নাচ, গলা কাঁপিয়ে গান! ওয়াক!

আমি ভারী অপ্রতিভ বোধ করতে লাগলাম। গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, তোর পছন্দ না হতে পারে। কিন্তু বেশ সুন্দরী সব মেয়ে জুটে গেছে ওর চারধারে।

রুমা সশব্দে ম্যাগাজিনটা টেবিলে ফেলে দিয়ে, চেয়ারটা এক ধাক্কায় ছিটকে ঘর থেকে পটাং পটাং চিটর শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল।

রেগে গেছে। হয়তো রাতে খাবেও না।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *