এখনও দিনের আলো চারপাশে। মহাদেব সেনের নাতনির বিয়েতে বাড়িটাকে চমৎকার সাজিয়েছে ডেকোরেটাররা। নহবত তৈরি হয়েছে। সন্ধে নামলেই সেখানে সানাই বাজবে, আলোয় ঝলমল করবে বিয়েবাড়ি।
মহাদেব সেন তার ঘরে শেষ মুহূর্তের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। তখনও অতিথিদের আসার সময় হয়নি। দুজন কাজের লোক বাড়ির সামনে টুকটাক কাজ করছিল। তারা দেখতে পেল একটি যুবক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছে। যুবকের ভঙ্গিতে একটু সংকোচ থাকায় লোকদুটোর একজন জিজ্ঞাসা করল, কী চাই?
সত্যচরণ দু-পা এগোল, কথা বলতে চাই।
বলুন কী বলবেন? দ্বিতীয় লোকটি জানতে চাইল।
সেকথা আপনাদের বলা যাবে না। সত্যচরণ কোনওমতে বলতে পারল।
• • কী কথা যা আমাদের বলা যাবে না? আপনি কে ভাই? প্রথমজন বলল।
দ্বিতীয়জন জিজ্ঞাসা করল, কাকে বললেন চান?
ইয়ে, মানে, প্রতিমাকে।
প্রতিমাকে? কে আপনি? ওদের আত্মীয়?
না না।
আপনার মতলব কী বলুন তো? আজ-ওর বিয়ে আর আপনি হুট করে কোথা থেকে এসে কথা বলতে চাইছেন?
এইসময় টাকমাথা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এক-প্রৌঢ় এগিয়ে এলেন, কী ব্যাপার সনাতন?
প্রথম লোকটি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে প্রৌঢ়ের কানে কানে ব্যাপারটা বলতেই ভদ্রলোক বললেন, সর্বনাশ। এই যে, এদিকে এসো!
সত্যচরণ এগিয়ে গেল। প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি প্রতিমাকে চেনো?
মাথা নেড়ে সত্যচরণ জানাল হ্যাঁ।
কী কথা বলতে চাইছ তাকে?
একান্তই ব্যক্তিগত।
শোন। মেয়েটার আজ বিয়ে। একটু পরেই বর এবং বরযাত্রী এসে যাবে? তারা যদি শোনে বাইরের একজন ব্যক্তিগত কথা বলতে পাত্রীর দেখা চাইছে তাহলে আমাদের কী ভাববে বল তো? তুমি নিশ্চয়ই প্রতিমার ক্ষতি করতে চাও না?
না।
বাঃ। তাহলে চুপচাপ চলে যাও।
আমি কথা বললে ওর কোনও ক্ষতি হবে না। সত্যচরণ জানাল।
কিন্তু তোমাকে ওর কাছে যেতে দেওয়া হবে না।
এরকম বলবেন না। আমি অনেক ঝুঁকি নিয়ে এসেছি। ওর সঙ্গে কথা না বললে ও খুব বিপদে পড়বে। আমাকে বাধা দেবেন না। কাঁদো কাদো হল সত্যচরণ।
ভদ্রলোক বুঝলেন মামলা বেশ জটিল। একে এখনই মেরে ধরে বের করে দেওয়া যায়। কিন্তু তাতে পাড়ার লোক কৌতূহলী হয়ে উঠবে। গুজব ছড়াবে। প্রৌঢ় বললেন, আমি মেয়ের কাকা। তুমি এখানে অপেক্ষা করো আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত।
প্রৌঢ় ভেতরে গেলেন। ভেতরের উঠোনে তখন ছাঁদনাতলায় আলপনা দেওয়া হচ্ছে। চারপাশে মেয়েদের ভিড়। প্রতিমার মা এবং দিদিমাকে ডেকে নিয়ে একটা ঘরে ঢুকে প্রৌঢ় জানালেন সমস্যার কথা।
দিদিমা বললেন, সর্বনাশ। ছেলেটা কে?
নাম বলছে না। জেদ ধরে আছে প্রতিমার সঙ্গে কথা বলবে বলে। প্রৌঢ় বললেন, তোমরা কেউ জানতে না বউদি?
প্রতিমার মা মাথা নাড়লেন, না।
তোমার মেয়ে নিশ্চয়ই এই ছেলেটার সঙ্গে ভাব করেছিল। বিয়ের খবর পেয়ে ছুটে এসেছে ছোকরা। প্রৌঢ় বললেন।
আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে ঠাকুরপো। কী হবে এখন?
মেরেধরে বের করে দিতে পারি-। প্রৌঢ় বললেন।
না না। মা, আপনি বাবাকে বলুন। প্রতিমার মা বললেন।
উনি কী করবেন। যেরকম নার্ভাস মানুষ। ডাকো প্রতিমাকে। আচ্ছা, আমিই ডেকে আনছি। বৃদ্ধা বেরিয়ে গেলেন।
প্রতিমার মা বললেন, ছেলেপক্ষ যদি জানতে পারে–!
বিয়ে ভেঙে দিয়ে চলে যাবে। একটু আগে তোমার শ্বশুরমশাই ওদের ফোন করেছিলেন। ওরা এখনও বের হয়নি। কী জানি, এই ছোকরা তাদের খবর দিল কিনা! দিয়েছে বলে হয়তো ভাবছে আসবে কিনা?
প্রতিমার মা মাথা নাড়লেন, ও যে এরকম কিছু করেছিল তা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না।
আজকালকার মেয়ে, ওদের মুখ দেখে বোঝা যায় না পেটে কী আছে? প্রৌঢ় মাতব্বরের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।
দিদিমা প্রতিমাকে নিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রতিমার মা, তোর পেটে পেটে এত? এইভাবে আমাদের সর্বনাশ করলি?
কী বাজে বকছু?
বাজে বকছি? মারার জন্যে হাত তুললেন প্রতিমার মা।
প্রৌঢ় বললেন, থাক থাক। বউদি এত মাথা গরম কোরো না। শোনো, সত্যি কথা বলে, তুমি কি কোনও ছেলের সঙ্গে ভাব করেছ?
আমার কি মাথা খারাপ?
তার মানে?
এখানকার সবকটা ছেলে মাকাল ফল। তাহলে যে এসেছে সে আসবে কেন?
কে এসেছে?
একটি ছেলে। রোগা, লম্বা, ভালো দেখতে।
দূর। সে কী বলেছে? খেঁকিয়ে উঠল প্রতিমা।
তোমাকে ব্যক্তিগত কথা বলতে চায়। প্রৌঢ় বললেন।
তার মানে এই বিয়ে ভাঙতে চায়। দিদিমা বললেন।
চলো তো দেখি, কে এসেছে।
খবরদার! একদম বাইরে যাবি না। প্রতিমার মা মেয়ের হাত ধরল।
আশ্চর্য। যাকে চিনি না জানি না সে ব্যক্তিগত কথা বলতে আসবে। কেন?
প্রৌঢ় বললেন, কিন্তু সে বলছে, তোকে চেনে। হয় সে মিথ্যে বলছে নয় তুই বলছিস। বাইরে গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
কী কেলেঙ্কারি হবে? কীরকম মিইয়ে গেল প্রতিমা।
যদি তোকে বিয়ে করতে নিষেধ করে, যদি কান্নাকাটি করে তাহলে লোকজন হাসাহাসি করবে। তোর দাদুর কথা ভাব। বিয়ে ভেঙে গেলে ওঁর হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। প্রৌঢ় মাথা নাড়লেন, একটা ছেলে তো কোনও কারণ ছাড়াই এত সাহস দেখাতে পারে না।
দিদিমা বললেন, ছেলের বাপের কথা ভাব। তোকে কী পছন্দ করেছেন। তোর মুখে গালাগালি শুনতে চেয়েছিলেন বলে আমরা অবাক হয়েছিলাম। পরে বুঝতে পেরেছি মানুষটা আমুদে। তা গালাগাল শোনা এক কথা কিন্তু যাকে ছেলের বউ করে নিয়ে যাবেন তার চরিত্রে যদি কলঙ্ক থাকে তাহলে কিছুতেই মেনে নেবেন না।
তোমরা কী যা তা বলছ! আমি কী করেছি যে কলঙ্ক থাকবে? প্রায় চিৎকার করে উঠল প্রতিমা।
তুমি কিছুই করোনি। এখন দয়া করে নিজের ঘরে যাও। সেখানে কেউ যেন বুঝতে না পারে এসব ঘটনা ঘটেছে। এটুকু করো তাহলেই হবে। প্রতিমার মা বললেন।
বোঝা গেল অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রতিমা ফিরে গেল তার ঘরে যেখানে বান্ধবীরা তাকে সাজাচ্ছিল। দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন, কী হবে?
একটাই রাস্তা আছে। প্রৌঢ় চোখ বন্ধ করলেন।
কী? প্রতিমার মা শুকনো গলায় জিজ্ঞাসা করলেন। ..
আমি ওকে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি খানিকটা দড়ি আর প্লাস্টার নিয়ে ওখানে চলে এসো তাড়াতাড়ি। প্রৌঢ় প্রতিমার মাকে কথাগুলো বলে দ্রুত পা বাড়ালেন।
*
সত্যচরণ ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল। প্রৌঢ়কে আসতে দেখে বলল, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি, সে কোথায়?
ওপরে। আমার সঙ্গে এসো। কেউ কোনও কথা জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেবে না।
কেন?
আঃ। তোমার কি বাস্তববুদ্ধি নেই? বিয়ের কনে কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত কথা বলছে জানলে চারধারে হই-চই পড়ে যাবে, এটা বোঝ না? এসো। প্রৌঢ় এগোলেন। পেছনে সত্যচরণ। দোতলায় উঠে একটু দাঁড়ালেন। ইশারায় বললেন সত্যচরণকে থামতে। তারপর উঁকি মেরে দরজা থেকে ঘরের ভেতরটা দেখলেন। মহাদেব সেন পেছন ফিরে ফোন করছেন। সত্যচরণকে নিয়ে দ্রুত দরজা পেরিয়ে ছাদের সিঁড়ি ধরলেন প্রৌঢ়।
ছাদটি বেশ বড়। ওপরে উঠে দেখলেন প্রতিমার মা ততক্ষণে সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন। চিলেকোঠার ঘরের দরজা খুলে আলো জ্বেলে একটা চেয়ার টেনে প্রৌঢ় বললেন, বোস।
সে কোথায়? সত্যচরণ সরল গলায় জিজ্ঞাসা করল।
বউদি–! প্রৌঢ় ডাকলেন।
প্রতিমার মা ঘরে ঢুকলেন। তার মুখে ক্রোধ এবং বিরক্তি স্পষ্ট।
ওর মা এসেছেন, এবার ও আসবে। তুমি আগে বোসো। প্রৌঢ় বলতেই সত্যচরণ বসল। সঙ্গে সঙ্গে ওর হাতদুটো পেছনে নিয়ে এসে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললেন প্রৌঢ়।
একি! এ কী করছেন? সত্যচরণ উঠে দাঁড়াতে গেল।
চোপ! একটাও কথা নয়। বলতে বলতে প্লাস্টার অনেকখানি খুলে সত্যচরণের মুখে মাথায় জড়িয়ে দিলেন এমনভাবে যাতে কোনমতে সে একটিও শব্দ যেন না করতে পারে। তারপর বাকি দড়ি দিয়ে পা বাঁধলেন, শরীর জড়িয়ে দিলেন চেয়ারের সঙ্গে।
সত্যচরণ তখন প্রবল চেষ্টা করছে দড়ি খোলার। কিন্তু চাপা গোঁ গোঁ শব্দ ছাড়া কিছুই বেরুচ্ছে না।
তার কান ধরলেন প্রৌঢ়। মন দিয়ে শোন। এখানে চুপচাপ বসে থাকো। বিয়েটা চুকে যাক, নিমন্ত্রিতরা বাড়ি ফিরে যাক, তারপর এসে তোমাকে নামিয়ে গেটের বাইরে ছেড়ে দেব। তোমার বাপের ভাগ্য ভাল তাই গায়ে হাত তুললাম না। চল বউদি। ঘরের বাইরে এসে শেকল তুলে দিলেন প্রৌঢ়।
প্রতিমার মা বললেন, বেশি বয়স নয়। দেখে মনে হল বেশ নিরীহ।
আগে কখনও দেখেছ?
না।
ওকে সামলানোর উপায় আর কিছু ছিল না। চল নিচে চল, বরযাত্রীরা এসে পড়ল বলে। ওরা নিচে নেমে এলেন। আসার সময় দেখলেন মহাদেব সেন তার ঘরে নেই এবং তখনই সানাই বেজে উঠল। আলো জ্বলল। বিয়েবাড়ি জমজমাট।
মহাদেব সেন ঘড়ি দেখছিলেন। পুরুতমশাই এসে বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো। সাতটা পনেরো হয়ে গেল। লগ্নের তো দেরি নেই। ওরা এলে আশীর্বাদ হবে তারপরে বিয়ে। এত দেরি করছে কেন?
সেইসময় প্রৌঢ় এসে দাঁড়ালেন। দুজন অতিথিকে আপ্যায়ন করে এসে প্রৌঢ়কে বললেন মহাদেব সেন, ডুডুয়াতে ফোন করছি, ফোন এনগেজড। ওদের তো অনেক আগেই চলে আসার কথা। তুমি একটু থানায় ফোন করো তো?
থানা? প্রৌঢ় অবাক হলেন।
একমাত্র দুর্ঘটনা না ঘটলে ওদের এখনও না আসার কোনও কারণ নেই। মহাদেব সেন বললেন, বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার। বলেছিলাম রওনা হওয়ার সময় একটু ফোন করবেন। তাও করেনি।
সর্বনাশ। প্রৌঢ় বলে ফেললেন, শয়তানটা তাহলে প্রথমে ওখানেই গেছে।
মানে? কি বলছ তুমি? মহাদেব সেন হতভম্ব।
না না। আমি দেখছি, ফোন করছি। প্রৌঢ় ছুটলেন থানায় ফোন করতে।
*
ঘটকমশাই-এর কথা শুনে যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সতীশ রায়। তার শরীর কুঁকড়ে গেল।
সেটা লক্ষ করে নাগেশ্বর উৎসাহ পেল, আপনি মহান মানুষ। আজ আর একটু মহান হোন। মেয়েটাকে রক্ষে করুন। লগ্নভ্রষ্টা হলে আর বিয়ে হবে না এ জীবনে। মেয়েটা তো কোনও অন্যায় করেনি!
গোরক্ষ বলল, বয়সের কথা একদম চিন্তা করবেন না বড়বাবু। পুরুষমানুষ যদ্দিন সক্ষম তদ্দিন যুবক। এই সংসার খা খা করছে। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন। তাই এমন সুযোগ করে দিয়েছেন।
পাশে রাখা ফোনের রিসিভারটাকে নিচে নামিয়ে রেখে সতীশ রায় গম্ভীর গলায় বললেন, তোমরা এখন এখান থেকে যাও।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। এতবড় সিদ্ধান্ত নিতে হলে একটু ভাবতেই হবে। চল সবাই। বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করি।
হরিপদ দরজায় দাঁড়িয়ে শুনছিল। ওরা বেরিয়ে আসছে দেখে সে দৌড়াল ভেতরে। যে সমস্ত মহিলারা অনুষ্ঠান উপলক্ষে এ-বাড়িতে এসেছিলেন তাঁদের বেশিরভাগই চুপচাপ ফিরে গেছেন। মতির মা মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। তার পাশে এলোকেশী। হরিপদ ঢুকে বলল, বিয়ে হচ্ছে।
হচ্ছে? এলোকেশী লাফিয়ে উঠল,খোকা ফিরেছে?
না। সে তো এখন শিলিগুড়িতে।
তাহলে? হকচকিয়ে যায় সবাই।
মেয়ে যাতে লগ্নভ্রষ্টা না হয় তাই সবার অনুরোধ বড়বাবু রাজি হয়েছেন। হরিপদ ঘোষণা করা মাত্র কয়েকটি গলা থেকে আওয়াজ বেরিয়ে এল, অ্যাঁ?
এলোকেশী বলল, হায় ভগবান। বড়বাবুর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?
কী করবেন উনি? সবাই মিলে ধরল। হরিপদ বলল।
সবাই যদি বলে আত্মহত্যা করুন উনি করবেন? ছি ছি ছি। মেয়ের বয়সী বলে একটুও ভাবলেন না? এলোকেশী মাথা নাড়তে লাগল।
একজন প্রৌঢ়া বললেন, এই জন্যে বলে চিতায় উঠলেও পুরুষজাতটাকে বিশাস কোরো না, ছাই না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই। ছেলের বউ হতে যাচ্ছিল যে, তাকে নিজের বিছানায় বউ করে তুলতে ব্যাটাছেলেরাই পারে।
এলোকেশী বলল, হরিপদদা, আমি চললাম।
সেকি? কোথায়? হরিপদ অবাক।
এরপর এ বাড়িতে থাকব না। থাকতে পারব না।
চুপচাপ চলে যেও না, বড়বাবুকে বলে যাও। হরিপদ উপদেশ দিল।
তাই যাব। বলে, দুমদাম পা ফেলে এলোকেশী সতীশ রায়ের ঘরের সামনে চলে এল। দূরে দাঁড়িয়ে নাগেশ্বররা গুলতানি মারছে। তাদের উপেক্ষা করে ঘরে ঢুকল এলোকেশী।
বড়বাবু!
সতীশ রায় চোখ তুললেন।
আমি চলে যাচ্ছি।
কোথায়?
শ্বশুরবাড়ি।
সেকি? কেন?
আর আমার এখানে থাকা সম্ভব নয়।
দ্যাখো এলোকেশী, আমি এখন ভয়ঙ্কর সমস্যায় আছি। এইসময় এখানে এসে এসব কথা বলতে লজ্জা করল না তোমার? কড়া গলায় বললেন সতীশ। রায়।
না। করল না। শ্বশুরবাড়িতে গেলে আমি ভাসুর দেওরের শিকার হব। সেটা ঢের ভালো। আপনার পদস্খলন তো দেখতে হবে না। এলোকেশী বলল।
কী যা তা বলছ? চমকে উঠলেন সতীশ রায়।
ছোটমুখে বড় কথা না বলে পারছি না।
খুব বাড়াবাড়ি করছ তুমি। যাও, দূর হয়ে যাও।
নিশ্চয়ই যাব। আপনার নতুন সংসারে রাঁধুনি হয়ে থাকব না। এলোকেশী বেরিয়ে যাচ্ছিল। সতীশ রায় বললেন, দাঁড়াও। নতুন সংসার মানে?
এলোকেশী দাঁড়াল, ছেলের বদলে নিজে বিয়ে করতে যাচ্ছেন সংসার পাতবেন বলে, সেটা তো নিজেরই সংসার।
উঃ। কে বলল একথা? আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এই হারামজাদা দুটোকে তাড়াতে হবে। হরিপদ, হরিপদ।
দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল হরিপদ, আজ্ঞে।
গাড়ি রেডি করতে বল, আর ঘটকবাবুকে ডাক।
এলোকেশী হতবাক। কী শুনছে সে? তাহলে কি হরিপদ মিথ্যে বলেছিল? লজ্জায় কুঁকড়ে গেল সে।
ঘটকমশাই দৌড়ে এলেন। সতীশ রায় বললেন, চলুন।
তাহলে সবাইকে তৈরি হতে বলি। ঘটকমশাই উৎফুল্ল।
না। কেউ যাবে না। শুধু তুমি আমার সঙ্গে যাবে। এসো। সতীশ রায় বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। নাগেশ্বর পেছনে দৌড়াল, আমরাও যাব না?
না।
ড্রাইভারের পাশে ঘটকমশাই পেছনে সতীশ রায়। গাড়ি চালু হলে সতীশ রায় বললেন, অন্যদিন নিষেধ করি, আজ বলছি একটু জোরে চালাও।
ড্রাইভার মাথা নাড়ল।
গাড়ি ছুটছে। একটু উসখুস করে ঘটকমশাই বললেন, ওদের কাউকে আনলেন না। সাক্ষী হিসেবে ওরা থাকলে ভাল হত।
আমি কেন যাচ্ছি ঘটকবাবু?
প্রথমে ভেবেছিলাম যা, তা এখন ভারতে অসুবিধে হচ্ছে।
আমি যাচ্ছি ক্ষমা চাইতে। আমার ছেলে যে অন্যায় করেছে তার সব দায়। আমার। এজন্যে যে শাস্তি ওঁরা দেবেন তা মাথা পেতে নেব। মেয়ে যদি আজ লগ্নভ্রষ্টা হয় তাহলে ওই কুলাঙ্গারকে ত্যাজ্যপুত্র করে এই মেয়েকে আইন মাফিক দত্তক নিয়ে আমার সমস্ত সম্পত্তি ওর নামে লিখে দেব। সতীশ রায় জোরে জোরে বলছিলেন।
ঘটকমশাই কথা বললেন না। এরপর কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
*
দূর থেকে গাড়ি দেখে কেউ চিৎকার করে উঠল, এসেছে, এসেছে।
সঙ্গে সঙ্গে শাঁখ বাজতে লাগল। উলুধ্বনি শুরু হয়ে গেল।
গাড়িতে বসে ওই শব্দ শুনে আরও কুঁকড়ে গেলেন সতীশ রায়। গেটের সামনে গাড়ি থামতেই ঘটকমশাই আগে নামলেন, দেখলেন কয়েকজন এয়ো বরণডালা নিয়ে এগিয়ে আসছেন বরকে বরণ করতে।
দাঁড়ান দাঁড়ান। এই গাড়িতে বর আসেনি। ঘটকমশাই চিৎকার করতে সবাই থেমে গেল। সতীশ রায় নামলেন।
মহাদেব সেন এগিয়ে এলেন, আসুন আসুন। আপনাদের দেরি দেখে চিন্তায় প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। বরের গাড়ি কি পেছনে?
আপনার সঙ্গে কথা আছে, একটু–! সতীশ রায় থেমে গেলেন।
নিশ্চয়ই। সতীশ রায়কে নিয়ে প্যান্ডেলের অন্যপ্রান্তের নির্জনে চলে গেলেন মহাদেব সেন। প্রতিমার কাকা বিড়বিড় করলেন, এবার নিশ্চয়ই ছেলেটার কথা বলবে।
মহাদেব সেন বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো?
আমার ছেলেকে বিকেল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সতীশ রায় খুব নিচু গলায় বললেন, আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।
কানে ঢুকলেও অর্থবহ হচ্ছিল না কথাগুলো, কী বলছেন?
আমরা সর্বত্র খুঁজেছি। এ আমার অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার। সে যে বিয়ে করতে রাজি নয় তা কখনও আমাকে জানায়নি।
মহাদেববাবুর মুখের অবস্থা দেখে প্রৌঢ় এসে দাঁড়িয়েছিলেন পাশে।
মহাদেববাবু বললেন, ও কালীপদ, আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। বর নাকি বিয়ে করবে না বলে উধাও হয়ে গেছে।
সেকি! আপনি কে? কালীপদবাবু প্রশ্ন করলেন।
আমারই ছেলে।
লজ্জা করছে না আপনার। ছেলে বিয়ে করবে না তা আগে জানতেন না?
মাথা নেড়ে না বললেন সতীশ রায়।
কখনও জিজ্ঞাসা করেছেন?
আমাকে অমান্য করে না। তাই–।
এখন কী করবেন বলুন? আমাদের মানসম্মান, এত খরচ সব আপনার ছেলের জন্যে জলে যাবে? মেয়েটার বিয়ে যদি আজ না হয় পরে কোনও পাত্র তাকে বিয়ে করতে চাইবে? আপনাকে এর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কালীপদ চেঁচালেন।
ভিড় জমে গেল। কেউ বলল, নিশ্চয়ই অন্য মেয়ের সঙ্গে ভাব ছিল, তাই বিয়ে না করে কেটে পড়েছে। কেউ বলল, জোর করে বিয়ে দিতে চাইলে এইরকম হয়।
খবরটা ভেতর-বাড়িতে পৌঁছাতে দেরি হল না। প্রতিমার মা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। সানাই বন্ধ হল, নিভে গেল বাড়তি আলোগুলো।
মহাদেব সেনকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। ইতিমধ্যে যাঁরা খেতে বসে গিয়েছিলেন তারা দ্রুত হাত চালালেন, কেউ কেউ উঠে গেলেন।
সতীশ রায় নিজেকে খুনের আসামি মনে করছিলেন। তিনি হাতজোড় করে কালীপদবাবুকে বললেন, আপনারা ক্ষতিপূরণ হিসেবে যা চান তা আমি দিতে প্রস্তুত।
এখন বলছেন। পরে হাওয়া হয়ে যাবেন। কালীপদবাবু বললেন।
বেশ। আমি এখনই লিখে দিচ্ছি। আমার যা আছে তার একমাত্র উত্তরাধিকারিণী হবে প্রতিমা। ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করে ওকে আমি আইনসম্মতভাবে দত্তক নিতে তৈরি আছি। সতীশ রায় বললেন।
চমৎকার। আমাদের মেয়ে কি জলে পড়ে আছে যে আপনি তাকে দত্তক নেবেন? কালীপদবাবু ঘুরে দাঁড়ালেন, আপনারা তো সবাই শুনলেন। এখন কী করা যায়?
ঘটকমশাই এতক্ষণে কথা বললেন, উনি এত কষ্ট পেয়েছেন যে এখানে ছুটে না এসে পারেননি। ইচ্ছে করলে তো না-ও আসতে পারতেন।
আঃ। এখন ওর কথা হচ্ছে না। এই মালবাজারে কোনও ভালো ছেলের সন্ধান জানেন যে আমার ভাইঝিকে আজ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে!
কালীপদবাবুর কথা শুনে সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। একজন, বলল, এভাবে রেডিমেড জামাই পাওয়া কী যায়?
একটি বালক এসে কালীপদবাবুকে বলল, আপনাকে ভেতরে ডাকছে।
ভেতরে এলেন কালিপদবাবু। দেখলেন কনের সাজগোজ খুলে ফেলেছে প্রতিমা। তার চোখ জ্বলছে। মহাদেব সেনের স্ত্রী বললেন, এখন কী হবে বাবা?
ওই লগ্নভ্রষ্ট হওয়ার ব্যাপারটাকে যদি আমল না দেন তাহলে বলব দুশ্চিন্তার কিছু নেই। যা খরচ হয়েছে তা ওই সতীশ রায়ের কাছ থেকে আদায় করে নেব।
কিন্তু তারপর। তারপর মেয়ের বিয়ে হবে? প্রতিমার মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন।
বিয়ে করতেই হবে তার কি মনে আছে? কাকাবাবু তো বিয়ে করেননি। বেশ জোরে জোরে বলল প্রতিমা।
চুপ কর। যখনই ওই ছোকরা এসেছে তখনই আমার ডানচোখ কেঁপে উঠেছিল। মন বলছিল খারাপ কিছু না হয়। প্রতিমার মা বললেন।
আশ্চর্য! যাকে চিনি না জানি না সে যদি এসে কথা বলতে চায় তো আমি কী করব? তোমরা আমাকে মিছিমিছি দোষ দিচ্ছ। প্রতিমা বলল।
কালীপদবাবুর মাথায় তখনই ভাবনাটা চলকে উঠল, হয়াঁরে, ওর নাম কি?
কী মুশকিল! আমি কী করে জানব?
তুই জানিস না?
না। কী বলেছে সে?
তোর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। ব্যক্তিগত কথা।
মহাদেব সেনের স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলেটা কী করে? কী নাম?
কিছুই বলেনি।
তুমি সেসব জিজ্ঞাসা করবে তো?
একটা উটকো ছেলে যাকে প্রতিমা চেনে না তাকে জিজ্ঞাসা করে কী করব? ভেবেছিলাম বিয়ে চুকে গেলে বিদায় করে দেব। কালীপদবাবু বললেন।
দ্যাখো না কথা বলে। যদি ভালো ছেলে হয়। মহাদেববাবুর স্ত্রী বললেন।
ভালো কিনা জানি না, তবে সরল। বলছেন যখন–। পা বাড়ালেন তিনি।
প্রতিমা ফুঁসে উঠল, অসম্ভব। যার তার সঙ্গে তোমরা আমার বিয়ে দিতে পার না। আমি কি এতই ফ্যালনা?
ততক্ষণে সিঁড়িতে পা রেখেছেন কালীপদবাবু। পেছনে প্রতিমার মা।
দরজা খুলতেই দেখা গেল মাথা নিচু করে বসে আছে সত্যচরণ। কেউ ঘরে ঢুকেছে বুঝতে পেরে তাকাল সে। কালীপদবাবু ওর মুখ থেকে টেপ খুলে নিলেন। ঠোঁট চাটল সত্যচরণ।
তোমার বাড়ি কোথায়? কালীপদবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
কেন?
যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দাও।
দেব না। আপনি আমার ওপর অত্যাচার করেছেন।
বেশ করেছি। কি করো তুমি?
কিছু করি না। বেকার।
বাঃ। বাবার নাম কি?
বলব না।
বউদির দিকে তাকিয়ে কালীপদবাবু বললেন, দেখেছ কীরকম তাঁদোড়।
প্রতিমার মা এগিয়ে এলেন, আমি প্রতিমার মা। ওকে কী কথা বলতে তুমি এসেছিলে তা আমাকে স্বচ্ছন্দে বলতে পারো।
সত্যচরণের হাত পা তখনও বাঁধা। সে একটা গভীর শ্বাস ফেলে বলল, থাক।
না। তুমি বলো। আমি তোমার মায়ের মতো।
সত্যচরণ তাকাল। একবার ঠোঁট কামড়াল। তারপর মুখ নিচু করে বলল, আমি ক্ষমা চাইতে এসেছিলাম।
ক্ষমা চাইতে? তুমি কী অন্যায় করেছিলে? প্রতিমার মা অবাক।
না। অন্যায় নয়। ও যখন ওর দাদুর সঙ্গে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল তখনই আমার ওকে বলা উচিত ছিল। থেমে গেল সত্যচরণ।
তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিল? তোমাদের বাড়ি কি ডুডুয়ায়? উত্তেজিত হলেন প্রতিমার মা।
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল সত্যচরণ।
তোমার বাবার নাম কি সতীশ রায়? গলার কাছে হৃৎপিণ্ড যেন চলে এসেছে প্রতিমার মায়ের দেওরের দিকে তাকালেন তিনি।
হ্যাঁ।
কালীপদবাবু বললেন, সর্বনাশ। তুমিই সত্যচরণ?
হুঁ।
দ্রুত বাঁধন খুলে দিলেন কালীপদবাবু, একথা আগে বলবে তো?
আপনি জিজ্ঞাসা করেননি।
ওঠো ওঠো। হাত ধরে সত্যচরণকে তুলে কালীপদ বউদিকে বললেন, তুমি ওকে দোতলার ঘরে নিয়ে গিয়ে রেডি করে দাও? আমি ছুটছি।
কালীপদবাবু ছুটলেন। সত্যচরণ বলল, কিন্তু–।
কোনও কিন্তু নয় বাবা। আমার মেয়ে লগ্নভ্রষ্টা হতে চলেছে। তুমি তার সম্মান রক্ষা করো। তোমার যা বলার আছে বিয়ের পর বোলো৷ প্রতিমার মা হাত ধরে সত্যচরণকে ঘরের বাইরে নিয়ে এলেন।
কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না আমার পক্ষে বিয়ে করা অত্যন্ত অন্যায় কাজ হবে। আমার মনের কৌমার্য নেই। মাথা নাড়ল সত্যচরণ।
মনের কৌমার্য? সেটা আবার কী? হকচকিয়ে গেলেন প্রতিমার মা।
একজনকে দেখে আমার মনে অনুরাগ এসেছে।
অ্যাঁ। কারও সঙ্গে তুমি প্রেম করছ?
না না। সে করেনি। তার বিয়ে হয়েছিল, বিধবাও হয়ে গেছে বেচারা। কিন্তু আমি মনে মনে তাকে মন দিয়ে ফেলেছি। এই অবস্থায় কি অন্য কোনও মেয়েকে বিয়ে করা উচিত? আপনি বলুন। এই কথাটাই প্রতিমাকে বলতে এসেছিলাম।
বাড়িতে না জানিয়ে এসেছ?
হ্যাঁ। জানালে আসতে দিত না।
তোমাদের ডুডুয়ার মেয়ে?
হ্যাঁ।
কতটা এগিয়েছিলে তোমরা?
না না। ও আমাকে চিনত না, কথাই হয়নি কখনও।
বুক থেকে পাথর নেমে গেল প্রতিমার মায়ের। ঠিক সেইসময় সানাই বেজে উঠল নতুন করে। আলো জ্বলল। প্রতিমার মা বললেন, মাকে বললে সব ঠিক হয়ে যায়। এখন একথা কাউকে বলতে হবে না। দয়া করে আমাকে বাঁচাও।
ছি ছি, এ কী বলছেন আপনি! আমি কী করে আপনাকে বাঁচাব!
আমি যা বলছি তাই শুনবে, তাহলেই হবে। প্রতিমার মা সত্যচরণকে হাত ধরে নিয়ে চললেন।
*
আবার সানাই বাজছে, আলো জ্বলল, সতীশ রায় অবাক হলেন। ঘটকমশাই কাছে এসে বললেন, যাক বাঁচা গেল। শেয ভালো যার সব ভালো।
কীরকম? সতীশ রায় বিধ্বস্ত কিন্তু না জিজ্ঞাসা করে পারলেন না।
এরা পাত্র পেয়ে গেছেন। এই বিপদে কোনও যুবক মেয়েকে লগ্নভ্রষ্টা না করতে এগিয়ে এসেছেন। খুব বড় মন না হলে এমন কেউ করে না। ঘটকমশাই। বললেন।
কিন্তু লগ্ন তো চলে গেছে?
না। পুরুতমশাই বলছেন রাত নটা থেকে সওয়া নটায় বিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
উঃ। ভগবান। তুমি বাঁচালে। চোখ বন্ধ করলেন সতীশ রায়, নইলে সারাজীবন আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারতাম না।
মহাদেব সেন শুয়ে ছিলেন। সানাই বাজছে শুনে উঠে বসতে না বসতেই কালীপদবাবু চলে এলেন, চলুন। সব ঠিক হয়ে গেছে।
মহাদেববাবুর স্ত্রীও হাসিমুখে ঢুকলেন, রাখে হরি মারে কে! নাও, ওঠো, বাকি কাজগুলো শক্ত হয়ে শেষ করো।
কিন্তু পাত্র পেলে কোথায়?
পাত্র এ-বাড়িতেই ছিল। মহাদেব সেনের স্ত্রী হাসলেন আবার।
কী বলছ? এ-বাড়িতেই ছিল মানে? মহাদেব সেন বিরক্ত হলেন, কোন্ বংশের ছেলে, চালচুলো আছে কিনা খোঁজ না নিয়েই সানাই বাজিয়ে দিলে তোমরা?
কালীপদবাবু মহাদেব সেনের পাশে বসে বিকেলের ঘটনাটা জানালেন নিচু গলায়। সব শুনে মহাদেব সেন হতভম্ব, ছি ছি। এ কি করেছ তোমরা?
কোনও অন্যায় করিনি। কেউ যদি নিজের পরিচয় না দেয় তাহলে কী করে ভাবব বিয়ের পাত্র একা বিয়ে বাড়িতে চলে এসেছে দুঘন্টা আগে? এরকম কেউ কোথাও শুনেছে? আমরা ভেবেছি ছোকরা প্রতিমার বিয়ে ভেঙে দিতে চায়। ওকে তো চিনি না। কালীপদ নিজেদের পক্ষে সওয়াল করলেন।
ইস্। আমি যদি তখন দেখতাম। তোমরা আমাকে কিছু না জানিয়ে খুব অন্যায় করেছ। প্রতিমা দ্যাখেনি ওকে? মহাদেব সেন খুব বিব্রত।
না। সে বাইরে আসেনি। মহাদেব সেনের স্ত্রী বললেন।
এখন সতীশবাবুকে কী বলব? ওঁকে ওভাবে অপমান করা হল। ছি।
আপনি কিছু ভাববেন না, আমি সব ম্যানেজ করে নেব। আপনি এখানেই বিশ্রাম নিন, আশীর্বাদ করার সময় খবর পাঠাব। কালীপদবাবু বললেন।
তা হয় না। আমিও নিচে নামছি দেখি! কিন্তু তোমরা নিশ্চিত তো ছেলেটি সত্যচরণ? কালীপদবাবুর মুখের দিকে তাকালেন মহাদেব সেন।
সেন্ট পার্সেন্ট। কালীপদবাবু বেরিয়ে গেলেন।
আবার বিয়েবাড়ি জমে উঠেছে। যারা খাওয়া ছেড়ে উঠে এসেছিল তারা তুন করে খেতে বসেছে। একটি তরুণ ট্রে-তে করে শরবত এনে সতীশ রায়ের সামনে ধরল। সতীশ রায় মাথা নেড়ে না বললেন, ঘটকমশাই তুলে নিলেন গ্লাস। এইসময় মহাদেব সেন সামনে এলেন, একি! সরবত খেলেন না?
নাঃ। সতীশ রায় বললেন,শুনলাম একটি সুপাত্র পাওয়া গেছে!
হ্যাঁ। বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। মহাদেব সেন সতীশ রায়ের হাত ধরলেন, তখন উত্তেজনাবশত অনেক কুকথা বলা হয়েছে, আপনি মার্জনা
ছি ছি! একি বলছেন। আপনি আমার পিতৃতুল্য। যে অন্যায় আমার দিক থেকে হয়েছে তাতে। যাক্। একটাই সান্ত্বনা যে প্রতিমা মা পাত্রস্থ হতে চলেছেন।
এইসময় কালীপদবাবু এসে বললেন, আসুন, মেয়েকে আশীর্বাদ করবেন।
মহাদেব সেন সতীশ রায়কে বললেন, চলুন।
না না। সেই যোগ্যতা আমি হারিয়েছি। আমাকে বলবেন না।
একটু আগেই আপনি প্রতিমাকে মা বললেন। সে আপনার কাছে যেমন ছিল তেমন আছে। তার নতুন জীবনের শুরুতে আপনি আশীর্বাদ জানাবেন না? চলুন।
মহাদেব সেনের কথায় আবেগে আক্রান্ত হলেন সতীশ রায়।
কয়েক পা হেঁটে খেয়াল হল। বরযাত্রী এবং বরকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ে বাড়িতে আসবেন বলে তৈরি হওয়ার সময় আলমারি থেকে হারটা বের করে পকেটে রেখেছিলেন। এতক্ষণের ডামাডোলে সেকথা ভুলেই গিয়েছিলেন। এখন মনে হল, ভাগ্যিস ভুলে গিয়েছিলেন, নইলে মনে থাকলে বিয়ে হচ্ছে না বলে বাড়িতেই হার রেখে আসতেন!
প্রতিমা বসে আছে মুখ নিচু করে কনের সাজে সেজে। তাকে ঘিরে অল্পবয়সি মেয়েরা, মহিলারা। কালীপদবাবু বললেন, রায়মশাই, আপনি প্রথমে আশীর্বাদ করুন।
আমি কেন? পাত্রের বাবা কোথায়?
বুঝতেই পারছেন, হঠাৎ বিয়ে হচ্ছে। ওঁরা দূরে থাকেন।
ও।
পুরোহিত প্রথমে আশীর্বাদ করলেন। তারপর সতীশ রায় ধানদুর্বো দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। প্রতিমা মুখ তুলে তাকাতেই সতীশ রায়ের বুক মুচড়ে উঠল। কোথায় যাওয়ার কথা অথচ এই মেয়ে কোথায় যাচ্ছে! শঙ্খ বাজাল মেয়েরা। একটু ইতস্তত করে পকেট থেকে হারের বাক্সটা বের করে এগিয়ে ধরলেন সতীশ রায়, মা, তোমার জন্যে এটাকে রেখেছিলাম। এই নাও।
বাক্সটা নিয়ে কেঁদে ফেলল প্রতিমা। কোনমতে নিজেকে সামলে সরে এলেন সতীশ রায়। ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে বাইরের চাতালে পেতে রাখা চেয়ারে বসলেন। ঘটকমশাই এগিয়ে এলেন, বড়বাবু!
অ্যাঁ? হ্যাঁ। চল। রুমালে চোখ মুছলেন সতীশ রায়।
যখন সমস্যার একরকম সমাধান হয়েই গেছে তখন–।
না। কোনও সমাধান হয়নি। উঠে দাঁড়ালেন সতীশ রায়। অনিচ্ছুক ঘটকমশাইকে নিয়ে তিনি যখন বাড়ির গেটে পৌঁছে গেছেন তখন শঙ্খধ্বনি ভেসে এল।
এইসময় কালীপদবাবু পেছন থেকে ডাকলেন, রায়মশাই, শুনুন।
সতীশ রায় দাঁড়াতেই তিনি কাছে এসে বললেন, একি! আপনি চলে যাচ্ছেন? মেয়েটার বিয়ে দেখবেন না?
আমাকে অনুরোধ করবেন না। মাথা নাড়লেন সতীশ রায়।
কিন্তু আপনি চলে গেলে প্রতিমা খুব দুঃখ পাবে। ওদিকে ছেলের আশীর্বাদ চলছে। ওকে আশীর্বাদ করবেন না?
একজনকে তো করেছি। তাহলেই হবে। সতীশ রায় বললেন, ঘটকবাবু, ড্রাইভারকে বল গাড়ি আনতে।
ঘটকমশাই বাইরে বেরিয়ে কোথাও ড্রাইভারকে খুঁজে পেলেন না। ফিরে এসে সেকথা জানাতেই একজন বলল, ও তো এই ব্যাচে খেতে বসেছে।
সেকি! খেতে বসে গেল? সতীশ রায় রেগে গেলেন।
আহা! ও তো বুঝতে পারেনি চলে যাবেন। দয়া করে ওর খাওয়া শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করুন। কালীপদবাবুর কথায় মাঝখানেই ভেতরের ছাঁদনাতলায় হই-হই শুরু হল। বোঝা গেল বরকে ছাঁদনাতলায় আনা হয়েছে। পুরুতমশাই কাজ শুরু করেছেন। কালীপদবাবু বললেন, আমার উপোস করা নিষেধ। ডাক্তারের বারণ। তাই সম্প্রদান করতে পারছি না। সম্প্রদান করছে মেয়ের মা।
মা! তাই নাকি? অবাক হলেন সতীশ রায়। এই অঞ্চলে মেয়েরা সম্প্রদান করেছেন এমন ঘটনা শুনিনি। কিন্তু এটাই ঠিক। মেয়েকে সম্প্রদানের অধিকার মায়ের চেয়ে আর কার বেশি হবে!
তাহলে?
আমাকে আর বিব্রত করবেন না। হাতজোড় করলেন সতীশ রায়।
কালীপদবাবু ফিরে গেলেন। মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর ড্রাইভারের খাওয়া শেষ হল। বড়বাবুকে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে জিভ কেটে দৌড়াল গাড়ি নিয়ে আসতে। এইসময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন মেয়ের মা এবং দিদিমা।
মেয়ের মা সতীশ রায়ের সামনে এসে হাত জোড় করলেন, আপনি দয়া করে ভেতরে আসুন। আমি প্রতিমার মা, সরমা।
স-র-মা! অবাক হয়ে তাকালেন সতীশ রায়।
ডুডুয়াতে যখন মায়ের সঙ্গে পোস্টমাস্টার দাদার বাড়িতে গিয়ে কদিন ছিলাম তখন–। সরমা কথা শেষ করতে পারলেন না।
মনে পড়েছে। খুব বিরক্ত করতাম বলে আপনার মা আপনাকে নিয়ে সাততাড়াতাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। তখন অল্প বয়স ছিল। চপল ছিলাম।
স্বাভাবিক। কিন্তু আজ পরিণত বয়সে আপনি যদি চলে যান তাহলে খুব দুঃখ পাব। ঘটনাচক্রে এমন একটা পরিস্থিতি হয়েছে যা আপনাকে কেউ বলতে সাহস পাচ্ছে না। আমার অনুরোধ, দয়া করে ভেতরে চলুন। সরমা বললেন।
অগত্যা রাজি হলেন সতীশ রায়। সরমা দ্রুত চলে গেলেন, তাকে সম্প্রদান করতে হবে। কালীপদবাবু বললেন, আসুন। মেয়েকে আনা হচ্ছে।
শেষবার প্রতিবাদ করেছিল প্রতিমা দাদুর কাছে। কিন্তু তিনি নির্বিকার। শেষতক সে রাজি হল একটি শর্তে, বর অপছন্দ হলে সে ফিরে আসবেই।
পিঁড়িতে বসিয়ে তাকে নিয়ে আসা হল। ঘেরাটোপের মধ্যে বর দাঁড়িয়ে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। প্রতিমা পানপাতা দিয়ে ঢেকে রাখতে বাধ্য হয়েছে মুখ। সতীশ রায় এসে বসলেন দর্শকের চেয়ারে।
শুভদৃষ্টি হোক, তাকাও দুজন দুজনের দিকে। চেঁচালে দু-একজন।
পানের পাতা মুখ থেকে সরিয়ে সামনে তাকিয়েই প্রতিমা পৃথিবী ভুলে চিৎকার করে উঠল, একি! আপনি?
সত্যচরণ কুঁকড়ে উঠল, আমি!
আপনি কোত্থেকে উদয় হলেন? গলা আরও ওপরে উঠল প্রতিমার।
মালা বদল হোক, মালা বদল হোক। দাবি উঠল।
সতীশ রায় কালীপদবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে দেখুন তো? শুভদৃষ্টির সময় কোনও কনে এভাবে চিৎকার করে না।
কালীপদবাবু নিঃশব্দে সরে গেলেন।
বরকে যখন ছাদনাতলার পিঁড়িতে নিয়ে আসা হল তখন সতীশ রায়ের চোখ বিস্ফারিত। এ কাকে দেখছেন তিনি। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন, একি! তুমি? তুমি এখানে কী ভাবে এলে?
ঘোমটা সরিয়ে প্রতিমাও মাথা নাড়ল, আমিও তো অবাক।
সতীশ রায় কালীপদবাবুকে দেখতে না পেয়ে মহাদেব সেনকে বললেন, এই রসিকতার অর্থ কি? আমার অজান্তে ছেলেকে এখানে নিয়ে এসে আপনারা এতবড় নাটক করলেন কেন? আমি এখনই এখান থেকে চলে যাচ্ছি।
দাঁড়ান। মহাদেব সেনের স্ত্রী এগিয়ে এলেন, উত্তেজিত না হয়ে আপনাকে সমস্ত ঘটনা শুনতে হবে। আসুন এদিকে।
কয়েক মিনিট ধরে ঘটনাটা শুনলেন সতীশ রায়। শুনতে শুনতে তার মনে হচ্ছিল জুতো মেরে ছেলের মুখ ভেঙে দিতে।
ঘটকমশাই পাশে এসে দাঁড়ালেন, বড়বাবু?
সতীশ রায় জ্বলন্ত দৃষ্টি ফেললেন ওঁর মুখে। একটু কুঁকড়ে গেলেও ঘটকমশাই বললেন, ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন। বিয়ে যখন শুরু হয়ে গেছে তখন আপনি যদি বকাবকি করেন তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
হিতে বিপরীত হবে মানে? বিয়ের পিঁড়ি ছেড়ে উঠে যাবে? দেখি কত হিম্মত! ওর গতজন্মে কিছু ভাল কাজ করেছিল বলে এত কিছুর পরেও বউমা ওকে বিয়ে করছে। অন্য মেয়ে হলে–! গজরালেন সতীশ রায়।
তাহলে ডুডুয়াতে খবর দিই! ঘটকমশাই অনুমতি চাইলেন।
কী খবর? বুঝতে পারলেন না সতীশ রায় অন্যমনস্ক থাকায়।
বরযাত্রীরা চলে আসুক। এমন কিছু রাত হয়নি। দশটার মধ্যেই এসে যাবে।
কেন? তুমি আছ, আমি আছি।
আপনি বরকর্তা আর আমি ঘটক। ঠিক অর্থে আমরা তো বরযাত্রী নই।
দ্যাখো। এখন কাউকে পাবে বলে মনে হয় না।
*