৫. ওদের পীড়াপীড়িতে শেষপর্যন্ত

ওদের পীড়াপীড়িতে শেষপর্যন্ত আমাকেই গল্পের বক্তার ভূমিকা নিতে হল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমি চরিত্রগুলোর কথা ভেবে নিলাম। সূরযলাল-হঠকারী বড়োললাকের ছেলে, ইয়ারবন্ধুদের পাল্লায় পড়ে টাকা ওড়াচ্ছে। সুখেন রায়—শান্তশিষ্ট বইপড়া যুবক, বাড়িতে পুত্রহীনা সুন্দরী স্ত্রী। করবী তার স্বামীকে ভালোবাসে—অথচ ছোট্ট সংসারের একঘেয়ে জীবনে মন টেকে না। হরিনাথ অন্যের পয়সায় মদ খায়—সুখেনকে অপছন্দ করার যথেষ্ট কারণ আছে তার। নিজের চরিত্রের বিপরীত ধরনের লোক দেখলেই অনেকের রাগ হয়। চৌকিদার রামদাস

আমি মুখ তুলে বললাম, কর্নেল সেন, আমার আরও দু-একটা ব্যাপার জেনে নেওয়ার আছে। চৌকিদার রামদাস কি বিবাহিত? আপনি পরে নিশ্চয়ই খবর পেয়েছিলেন।

হ্যাঁ, পেয়েছিলাম। চৌকিদারের বউ মারা গিয়েছিল অনেক দিন আগে। সে একা থাকত।

কিন্তু আপনি যখন তার ঘরের দরজা ঠেলেছিলেন, তখন দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।

তাই ছিল।

অর্থাৎ ঘরের মধ্যে কেউ লুকিয়েছিল। আপনি সেসময়ে ও ব্যাপারে মনোযোগ দেননি। আর একটা কথা। এই গল্পের মধ্যে ডাকবাংলোটার বেশ অনেকখানি ভূমিকা আছে। কেননা, সুখেন, করবী আর সূরযলাল এরা স্থানীয় লোক—ডাকবাংলো ব্যবহার করে বাইরে থেকে যারা আসে। তা ছাড়া সুখেন, করবী আর সূরযলাল এরা থাকে কাছাকাছি বাড়িতে। সুখেন যদি ট্যুরের নাম করে অন্য কোথাও গিয়ে থাকে, তাহলে তার বাড়িতে এসব ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক ছিল। তবু, ডাকবাংলোটার ভূমিকা আমি আন্দাজ করতে পারি। কারণ আমি ওই ধরনের বাংলোতে অনেকবার থেকেছি। রঞ্জনের অভিজ্ঞতা আছে। আচ্ছা, সুখেন রায় যে বাড়িটাতে থাকত সেই বাড়িটা, আপনি বলেছেন, খুব ভালো নয়। ঠিক কীরকম? বৃষ্টি হলে ছাদ থেকে জল পড়তে পারে?

কর্নেল সেন হেসে বললেন, তুমি ঠিক লাইনেই এগোচ্ছ। হ্যাঁ, সুখেনের বাড়িটা ওইরকমই।

কর্নেল সেনের কাছে প্রশ্ন করে আমি আরও কয়েকটা তথ্য জেনে নিলাম।

তারপর আর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে আমি পটভূমিটা মনে মনে ছকে নিলাম। আস্তে আস্তে চরিত্রগুলো আমার চোখের সামনে নড়াচড়া করতে লাগল। গল্প-উপন্যাস লেখার সময় আমি চরিত্রগুলোকে যেমন রক্ত-মাংসের চেহারায় কিছুক্ষণ দেখে নিই, তাদের সঙ্গে কথা বলি—এখানে সুখেন, করবী, সূরযলাল, রামদাস প্রভৃতির সঙ্গে আমার একে একে পরিচয় হল, আমি যেন, চেনাশোনা লোকদের মতনই ওদের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। মুখ তুলে এবার কর্নেল সেনের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, দেখুন, দেখুন, সেই সন্ধ্যেবেলার দৃশ্যটা আমি ফুটিয়ে তুলতে পারি। কিন্তু তাতে এই রহস্যকাহিনির কোনো সমাধান হবে কি না জানি না!

মাধবী বলল, ঠিক আছে আগে শুনেই দেখি-না।

আমি শুরু করলাম।

বিহারের ওইধরনের ছোটোখাটো শহরে শীতকালে যারা থেকেছে, তারাই বুঝতে পারবে কীরকম দুর্দান্ত শীত পড়ে, ড্রাই কোল্ড যাকে বলে। হাড় কনকনিয়ে দেয়। যে-সময় ঘটনাটা ঘটেছিল, সেটা যদিও নভেম্বর মাস, খুব বেশি শীত পড়ার কথা নয়, কিন্তু বৃষ্টি পড়লে ওসব জায়গায় নভেম্বরেও খুব শীত লাগতে পারে।

সেদিন সন্ধ্যে থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল। সেইসঙ্গে কনকনে হাওয়া। কর্নেল সেন, আপনিই বলেছেন যে, পরের দিন আপনি যখন ডাকবাংলোতে গিয়েছিলেন, তখনও টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। সুতরাং তার আগের দিনও বৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। মোটকথা, আমি ধরেই নিচ্ছি যে, বৃষ্টি পড়ছিল সেই সন্ধ্যেবেলা—তাতে আমার গল্পের সুবিধে হয়।

মাধবী বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ধরুন-না, কে আপত্তি করছে?

সুখেন তার বসবার ঘরের চৌকিতে শরীর এলিয়ে বই পড়ছে।

এইসব ছোটোখাটো জায়গায় সন্ধ্যের পরে আর কেউই থাকে না। বৃষ্টির জন্য সেদিন আর কেউ আড্ডা দিতেও আসবে না।

করবী এঘরে-ওঘরে একবার যাচ্ছে আর একবার আসছে। কখনো একটু বসছে সুখেনের পাশে আবার উঠে যাচ্ছে ভেতরে। তার কোনো কাজ নেই। সন্ধ্যেটা আর কাটতেই চায় না। দু-জন মানুষের রান্না, তাও কখন শেষ হয়ে গেছে। সুখেনের মতন তার বই পড়ার অত নেশা নেই।

করবী একবার বসবার ঘরে ঢুকে সুখেনকে বলল, এখন খেয়ে নেবে?

সুখেন বই থেকে মুখ তুলে বলল, এক্ষুনি? ক-টা বাজে?

টেবিলের ওপর রাখা হাতঘড়িটা দেখে বলল, মাত্র সাতটা। এরমধ্যেই খেয়ে নেব!

সুখেনের মুখটা শুকনো। সেদিন তাকে খানিকটা মনমরা দেখাচ্ছিল। এক হাতে বই, এক হাতে সিগারেট—মাঝে মাঝেই সে অন্যমনস্ক হয়ে তাকাচ্ছিল বাইরের দিকে। অফিস থেকে পাটনা যাওয়ার জন্য ছুটি নিয়েছে, অথচ পাটনায় যাওয়ারও ইচ্ছে নেই তার।

করবী বলল, হ্যাঁ তাড়াতাড়ি খেয়েই নাও। আমি আজ রাত্তিরে এখানে থাকব না।

সুখেন বলল, আজ আবার বেরোবে? আজ থাক-না—

করবী বলল, না, আজ আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি!

সুখেন বলল, আজ রাত্তিরে আর বেরিয়ে কাজ নেই। কালকে বরং তুমি আমার সঙ্গে চলো পাটনায়।

সে কালকের কথা কালকে। আজ রাত্তিরে আমার একটুও থাকতে ইচ্ছে করছে না এখানে। তোমাকে কত করে বলছি, আর একটা বাড়ি দেখো—

আজকের রাতটা অন্তত…

করবী বলল, না, চলো। বৃষ্টি পড়ছে, বেশিজোরে বৃষ্টি নামলে আবার আজ ছাদ থেকে জল পড়বে।

আজ আমার শরীরটা ভালো নেই, গা ম্যাজম্যাজ করছে—আবার গাড়ি চালাতে হবে—

কী হয়েছে কী! জ্বর হয়েছে নাকি?

করবী স্বামীর কপালে হাত রাখল। তারপর বলল, জ্বর তো নেই। চলো, ওখানে গিয়ে আরাম করে শোয়া যাবে। এই শীতের মধ্যে–

তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল! সামান্য দু-একটা টুকিটাকি জিনিস সঙ্গে নিল শুধু। বিছানাপত্তর ডাকবাংলোতেই সব আছে। মাঝে মাঝেই ওরা বাড়ি ছেড়ে ডাকবাংলোয় এসে থাকে। ওদের নিজের বাড়ির থেকে ডাকবাংলোয় থাকা অনেক বেশি আরামপ্রদ, বিশেষত শীতকালে।

নির্জন জায়গার ডাকবাংলোতে এসব ব্যাপার খুব স্বাভাবিক। বাইরের লোকজন সেখানে কম আসে, সেখানে স্থানীয় সরকারি অফিসের কোনো কর্মচারীই পাকাপাকি বাসিন্দা হয়ে যায়। একটা ঘর শুধু খালি থাকে। এইসব বাংলোতে আবার অনেক সময় অসামাজিক লোকদেরও আড্ডা হয়। চৌকিদারকে বকশিশ দিয়ে কিংবা ভয় দেখিয়ে তারা সন্ধ্যের পর এসে আড্ডা জমায়, মদ্যপান করে মেয়েদের নিয়ে অবৈধ কান্ডকারখানার পক্ষেও বেশ সুবিধাজনক জায়গা। আমাদের গল্পের এই বাংলোটা সেই ধরনের।

রঞ্জন ফস করে জিজ্ঞেস করল, তুই কী করে বুঝলি যে, সেই বাংলোটা এই ধরনের? তুই কি সেখানে গেছিস? বাংলোটা কোন জায়গায় তার নামই তো আমরা কেউ জানি না।

আমি বললাম, আমি সে বাংলোতে যাইনি বটে। কিন্তু সব কিছু শুনে মনে হচ্ছে বাংলোটা এই ধরনেরই। এ-রকম অনেক বাংলো আমি দেখেছি—সেখানে স্থানীয় কোনো সরকারি কর্মচারী নিজের কোয়ার্টার বানিয়ে নিয়েছে একেবারে।

কর্নেল সেন বললেন, সুনীলকে বাধা দিয়ো না। আমার মনে হচ্ছে, সুনীল ঠিক রাস্তাতেই এগোচ্ছে। এ-পর্যন্ত যা বলেছে, তা মিলে যাচ্ছে-তুমি বলে যাও–

করবী আর সুখেন যখন পৌঁছোললা, তখন সেই বাংলোয় আগে থেকেই আরও লোক এসে রয়েছে। সাধারণত, বাংলোতে যদি অন্য লোক এসে যায়, তাহলে আর করবীরা সেখানে সে-দিন থাকে না। ফিরে যায়। এতটা এসে আবার ফিরে যেতে হবে বলে সুখেন বিরক্ত হয়ে উঠছিল, এমন সময় দেখতে পেল, যারা এসেছে, তারা ওদের চেনা লোক। ওদের চেনা সূরযলাল আর হরিনাথ মদের বোতল নিয়ে আড্ডা জমিয়েছে। সূরযলালের বাড়িতে ওসব চলে না, তাই সে ডাকবাংলোতে আসে মাঝে মাঝে। চৌকিদার রামদাস তাদের খাবার-টাবার বানিয়ে দেয়-সূরযলাল কথায় কথায় বকশিশ দেয় পাঁচ টাকা দশ টাকা।

সুখেন আর করবীকে দেখে সূর্যলাল হই হই করে উঠল। এমনভাবে সে আপ্যায়ন করতে লাগল যেন বাংলোটা তার নিজের। হাত বাড়িয়ে বলল, আইয়ে, আইয়ে ভাবিজি, আইয়ে সুখেন দাদা-আজ কত সৌভাগ্য আমাদের যে, আপনারা এসেছেন–

সুখেন বলল, আমরা এসে ডিস্টার্ব করলাম না তো?

কী যে বলেন?

সুখেন নম্র ধরনের মানুষ। সে ইচ্ছে করলে চৌকিদারকে হুকুম দিয়ে বাংলোতে এই ধরনের লোকদের আসা বন্ধ করে দিতে পারে। তার বদলে সে নিজেই সংকুচিত হয়ে রইল।

একটা চেয়ারে আরাম করে বসে, আর একটা চেয়ারে পা তুলে দিয়েছে সূরযলাল। ছোটো টেবিলে দু-টি মদের বোতল ও কয়েকটি গেলাস। হরিনাথ ঠিক অনুগত ভৃত্যের মতন সূরযলালকে গেলাসে মদ ঢেলে দিচ্ছে, জল মেশাচ্ছে। হরিনাথ নিজেই খেয়ে ফেলেছে। অনেকটা। সে সুখেন আর করবীকে দেখে বলল, এই যে, দাদা আর বউদিও এসে গেছেন। তাহলে জমবে ভালো আজ!

করবী ওদের সঙ্গে একটাও কথা বলল না। চলে এল তাদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে। ভুরু কুঁচকে স্বামীকে বলল, ওরা আবার এখানে কেন? ওদের চলে যেতে বলো।

করবী বেশ গলা উঁচু করেই কথা বলছিল। সুখেন ফিসফিস করে বলল, এই আস্তে! যা :, তা কী বলা যায়! থাক-না!

করবী বিরক্ত হয়ে বলল, ধ্যাৎ! ভালো লাগে না। এখানে একটু নিরিবিলিতে ঘুমোতে এসেছি—তারমধ্যে আবার জ্বালাতন। ওরা সারারাত হইহল্লা করবে

না, না, সারারাত থাকবে না! খানিকটা বাদে চলে যাবে নিশ্চয়ই!

মোটেই যাবে না! দেখো তুমি।

এর আগেও দু-একবার সুখেন আর করবী ডাকবাংলোতে এসে সূরযলালদের দেখতে পেয়েছে। তবে, আগে যখন আলাপ পরিচয় ততটা বেশি ছিল না, তখন সুরযলাল সুখেনকে খানিকটা সমীহ করত। ওরা এলে ডাকবাংলো ছেড়ে চলে যেত তাড়াতাড়ি। মাস খানেক আগে এক রাত্তিরে ওরা রাত তিনটে পর্যন্ত ছিল—শেষপর্যন্ত সুখেনই ওদের জিপে পৌঁছে দিয়ে আসে।

করবী বলল, তুমি কিন্তু আজ ওদের পৌঁছে দিয়ে আসতে যাবে না কিছুতেই। একা একা থাকতে আমার ভয় করে। ওদের বলো তাড়াতাড়ি চলে যেতে—এখন বেশি রাত হয়নি, হেঁটেই চলে যেতে পারবে।

করবী বেশ রেগে গেছে। সুখেন তার পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করল। সুখেনের ভদ্রতাবোধ আছে। সে মুখ ফুটে ওদের চলে যেতে বলতে পারবে না।

দরজার বাইরে থেকে সূর্যলাল বলল, এই সুখেনদাদা, আসুন একটু গপসপ করি। এক্ষুনি কি নিদ যাবে নাকি?

সুখেন করবীকে বলল, একটু বাইরে গিয়ে ওদের সঙ্গে বসা যাক। মোটে তো সাড়ে আটটা বাজে!

করবী বলল, তুমি যাও। আমার ভালো লাগছে না।

সুখেন বাইরের বারান্দায় ওদের সঙ্গে এসে বসল। কয়েকখানা চেয়ার বাইরে বার করা হয়েছে। ইচ্ছে করেই আলো জ্বালেনি। বৃষ্টি পড়ছে অশ্রান্তভাবে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। চাদরমুড়ি দিয়ে চেয়ারে পা গুটিয়ে বসতে বেশ আরাম লাগে।

সূরযলাল মদের বোতল দেখিয়ে বলল, দাদা, একটু খাবেন নাকি?

সুখেন বলল, না ভাই, আমি ওসব খাই না। আমার ভালো লাগে না।

হরিনাথ এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। এবার হেসে উঠে বলল, না খেলে বুঝলেন কী করে যে ভালো লাগে না। আগে খেয়ে দেখুন, তবে তো বুঝবেন!

সুখেন বলল, না, তার দরকার নেই।

হরিনাথ নিজের গেলাসের সবটুকু মদ ঢক করে শেষ করে দিয়ে বলল, ওফ গলা জ্বলে গেল! মাইরি সুখেনদা, এ জিনিস খেলেও যেমন কষ্ট, না খেলেও সেরকম কষ্ট। তবে, বুঝবেন, খেয়ে কষ্ট পাওয়াটাই বেটার। আর সব কিছু ভুলিয়ে দেয়।

সুখেন জিজ্ঞেস করল, হরিনাথ, তুমি কোথা থেকে এসব খাওয়া শিখলে?

হরিনাথ হো-হো করে হেসে উঠে বলল, এসব কি কারুকে শেখাতে হয়? ভালোবাসা কি কারুকে শেখাতে হয়? মানুষ আপনি আপনি ভালোবাসে।

আমি তো আপনি আপনি শিখলাম না!

আপনি চেষ্টা করলেন না তা, শিখবেন কী! মেয়েমানুষ ছাড়া যেমন ভালোবাসা জমে না–

সূরযলাল ততক্ষণে আর একটা গেলাসে খানিকটা মদ ঢেলে জল মিশিয়ে বলল, নিন দাদা, একটু চেখে দেখুন! ভাবিজি রাগ করবেন বলে ভয় পাচ্ছেন? হা-হা–

না, না, তারজন্য নয়।

ভাবিজির কাছে পারমিশন সিক করে লিন।

ও কিছু বলবে না। এমনিই আমি খাব না—।

সুখেন আড়চোখে তার ঘরের জানলার দিকে তাকাল। জানলা দিয়ে আলো এসে পড়েছে। বাইরে। করবী শুয়ে পড়েনি, বোঝাই যায়। ঘরের মধ্যে তার চলাফেরার খুট-খাট শব্দ। সুখেন মনে মনে শঙ্কিত হল, করবী বোধ হয় রেগে যাচ্ছে। তারা এসেছিল এখানে নিরিবিলিতে শান্তিতে ঘুমোতে। তা ছাড়া সুখেনের নিজেরই আজ শরীরটা ভালো নয়—তারই ইচ্ছে করছিল শুয়ে পড়তে। কিন্তু এরা বাইরে বসে থাকলে কী আর হঠাৎ উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুমোনো যায়!

সামনে একটা প্লেটে শুকনো শুকনো করে ভাজা মুরগির মাংস জমা আছে। সূরযলাল নিজের বাড়িতে মাংস খেতে পারে না বলে ডাকবাংলোতে এসে খায়। প্লেটটা সুখেনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এক টুকরো মাংস মুখে দিন। তারপর গেলাসে একটু চুমুক দিন, দেখবেন কীরকম ভালো লাগে, গ্যারান্টি দিচ্ছি!

সুখেন হাত দিয়ে গেলাসটা সরিয়ে দিয়ে বলল, না ভাই, তোমরা খাও-না! তোমরা আনন্দ করছ, তাতে তো আমি বাধা দিচ্ছি না। আমাকে এরমধ্যে জড়াননা কেন? আমি গরিব লোক, আমার এসব বড়লোকি নেশা কী পোষায়?

সূরযলাল থতমত খেয়ে গেলাস সরিয়ে নিয়ে বলল, থাক! তবে থাক! আমি কী আপনাকে জুলুম করছি! আমি বলছিলাম কী, লাইফ তো খুব শর্ট, এর ভিতরে একটু ফুর্তি মজা যদি না করা যায়–

সুখেন গরিব বড়োলোকের কথাটা তোলায় হরিনাথের খোঁচা লেগেছে। সে সরু চোখে সুখেনের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কেন খাবেন না, তা আমি জানি। পেটে পেটে ইচ্ছে থাকলেও–

সূর্যলাল বলল, কেন? কেন?

হরিনাথ ব্যঙ্গ করে বলল, ও খাবে না। বউয়ের ভয় পাচ্ছে। আমাদের তো বউ নেই–

এই ধরনের খোঁচা মারলে মানুষের পৌরুষে লাগে। সুখেন দুর্বল ধরনের পুরুষ। তা ছাড়া হরিনাথ তার দুর্বল জায়গাতেই খোঁচা মেরেছে। সুখেন সত্যিই করবীকে বেশ ভয় পায়। আজ করবী রেগে আছে বলে সে এমনিতেই মনে মনে অস্থির। তবু বউয়ের নামে খোঁচা মারলে অনেক পুরুষই হঠাৎ সাহসী হয়ে যায়। গেলাসটা তুলে নিয়ে অবহেলার সঙ্গে বলল, খাওয়ার মধ্যে কী আছে? খেলেই হয়। কিন্তু আমার এসব ভালো লাগে না।

হরিনাথ বলল, একটু টেস্ট করেই দেখুন-না ভালো লাগে কি না!

সুখেন গেলাসটা তুলে একসঙ্গে সমস্ত মদ গলায় ঢেলে দিল। বিষম খেল সঙ্গে সঙ্গে।

সূরলাল ব্যস্ত হয়ে হা-হা করে উঠল। বলল, করলেন কী, করলেন কী! সবটা এক সঙ্গে —আপনি নতুন–

সুখেন দুর্বলতা ঢাকবার জন্য বলল, আমার কিছু হয়নি। এমনি বিষম খেয়েছি।

সূরযলাল বলল, এ জিনিস আস্তে আস্তে খেতে হয়। পানিকা মাফিক ঢকঢক করে আপনি মেরে দিলেন!

সুখেন বলল, খেলাম তো! কিছু তো হল না আমার! তোমরা এসব খেয়ে কী আনন্দ পাও?

সুখেনের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। সে নিজেও আগে কল্পনাই করতে পারেনি যে, সামান্য এক গেলাস পানীয়র এতখানি তেজ। রীতিমতো ভয় ধরে গেছে তার, কিন্তু কিছুতে সেটা ওদের সামনে প্রকাশ করবে না। বার বার সে ফাঁকা অহংকার দেখিয়ে বলতে লাগল, এসব খেলে তার কিছু হয় না। এসব জিনিসের জন্য টাকা নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। ইচ্ছে হলে সে এক বোতলও খেয়ে ফেলতে পারে। এসব খাওয়ার মধ্যে কোনো বীরত্ব নেই।

হরিনাথ বলল, এই তো দাদা, বেশ কলজের জোর আছে। তাহলে আগে খাব না, খাব না করছিলেন কেন?

সত্যি, আমি আগে কখনো খাইনি।

আর একটু খান।

না, আর দরকার নেই।

খান-না। এই সূরযলাল দাও, দাদাকে দাও–

সূর্যলাল আবার ঢেলে দিয়ে বলল, নিন, সঙ্গে একটু মাংস খেয়ে নিন। মাংস না খেলে লিভার ঠিক থাকে না।

হরিনাথ বলল, একটু একটু মাংস চাখবেন আর গেলাসে একটু একটু চুমুক দেবেন। ওরকম গোঁয়ারের মতন কেউ এক ঢোকে খায়! আস্তে আস্তে খেলে, জিনিসটার স্বাদ পাবেন। ঠিক।

আমি আর খাব না।

এই যে বললেন, ইচ্ছে করলে এক বোতল খেয়ে ফেলতে পারেন? আর এক পেগেই হয়ে গেল! আপনার কিছু নেশা হয়েছে বলুন?

কিছু হয়নি।

তাহলে আর ওটুকু খেয়ে কী লাভ হল? আর একটা খান–

এইভাবে সুখেন তিন-চার গেলাস খেয়ে ফেলল। এবং ক্রমাগত বলতে লাগল, আমার কিছু হয়নি। আমার কিছু হয়নি! হরিনাথ মিটিমিটি হাসছে। এই হরিনাথ ধরনের লোকরা অন্যদের নেশা ধরিয়ে দিয়ে বে-কায়দায় ফেলে খুব আনন্দ পায়। সে কথার মারপ্যাঁচে সুখেনকে ক্রমাগত খাইয়ে যেতে লাগল।

ঘণ্টাখানেক কেটে যাওয়ার পর করবী বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ক্রুদ্ধ গলায় স্বামীকে বলল, তোমরা এখানে বসে বসে গল্প করবে, আর আমি একা ঘরে শুয়ে থাকব? এবার চলে এসো–অনেক রাত হয়েছে।

সূরযলাল হাসতে হাসতে বলল, ভাবিজি, আপনার কি ঘরের মধ্যে ভয় করছে নাকি? আপনাদের বাংলাতে যাকে বলে ব্রহ্মদৈত্য—এখানে সেই একটা ব্রহ্মদৈত্য আছে কিন্তু।

করবী সূরযলালের কথা গ্রাহ্য না করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, একী, তুমি বসে বসে এইসব ছাইভস্ম খাচ্ছ!

সুখেন জড়িত গলায় বলল, একটুখানি শুধু টেস্ট করেছি। কিন্তু আমার কিছু হয়নি। কিছু যে খেয়েছি—তা টেরই পাচ্ছি না। কেন যে ওরা এইসব খেয়ে পয়সা নষ্ট করে।

বুঝেছি! আর খেতে হবে না, তুমি এবার ওঠো।

কেন, তুমি ভয় পাচ্ছ, আমি মাতাল হয়ে যাব? হাঃ-হাঃ-হাঃ? অত সহজ নয়! তুমি কিছু বুঝতে পারছ? আমি নর্মাল, কমপ্লিটলি নর্মাল!

ঠিক আছে, তোমার কিছু হয়নি। কিন্তু এখানে আর কত রাত পর্যন্ত বসে থাকবে?

কেন, তোমার ঘুম পাচ্ছে?

হ্যাঁ।

তাহলে তুমি একলা একলা ঘুমিয়ে পড়ো! আমি একটু বাদে যাচ্ছি।

একলা একলা ওই ঘরে থাকতে আমার বুঝি ভালো লাগে?

তাহলে তুমি এখানেই একটু বোসো!

না। তুমি ওঠো বলছি!

সূরযলাল বলল, ভাবিজি এত রাগারাগি করছেন কেন? বসুন-না। আপনিও একটু বসুন-না।

হরিনাথও বলল, বসুন বউদি, একটু বসুন। আমরা তো আর খানিকটা বাদে চলে যাব।

ওদের অনুরোধে করবী অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসল। সূরযলাল তার দিকে মুরগির প্লেটটা বাড়িয়ে দিল—করবী সেটা ছুঁয়েও দেখল না।

সূরালাল সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে। ওদের বংশে কেউ কখনো মদ তো দূরের কথা মাছ-মাংসও ছোঁয়নি। সূরযলাল এরমধ্যে ওর সব ক-টারই ভক্ত হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে হরিনাথ তার প্রধান শাগরেদ। সূরযলালের আত্মীয়স্বজনরা বলে যে, বাঙালিদের সঙ্গে মিলেমিশেই তার এই অধঃপতন।

হরিনাথ বলল, বউদি, আপনার স্বামীটি কিন্তু বেশ খেতে পারে। ঢকঢক করে মেরে দিল কীরকম! আপনিও একটু খাবেন নাকি!

করবী বলল, ছিঃ!

করবীর সেই ছিঃ বলার মধ্যে এমন একটা দর্প এবং অবহেলা ছিল যে, কেউ আর অনুরোধ করতে সাহস পেল না।

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। করবী আসার পর সব গল্প থেমে গেছে। সূরযলাল আর হরিনাথ খেয়ে যাচ্ছে, সুখেনের গেলাস খালি। হরিনাথ বলল, দাদা আর একটু নেবেন নাকি?

সুখেন করবীর দিকে চেয়ে বলল, থাক, আর না!

করবী সুখেনের দিকে প্রখর চোখে তাকিয়ে আছে। মুখে কিছু বলল না। সুখেন অপরাধীর মতন একটু হাসল।

সূরযলাল গেলাসে ঢেলে দিয়ে বলল, নিন, আর একটু নিন। ভাবিজি কিছু বলবেন না!

সুখেন গেলাসটা তুলে নিয়ে বলল, আর খেয়েই বা কী হবে? এত খেয়েও তো কিছু হচ্ছে না। তোমরা ভেবেছিলে আমি এক চুমুক দিয়েই বেহেড হয়ে যাব।

হরিনাথ হাসতে হাসতে বলল, সত্যি দাদার কলজের জোর আছে!

এই সময়ে দূরে কিছু লোকের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। ওরা সতর্ক হয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। ভালো করে তাকিয়ে দেখল, বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে চার-পাঁচজন হেঁটে আসছে। বাংলোর কম্পাউণ্ড দিয়ে।

সূরযলাল চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কে?

কোনো উত্তর নেই।

গেলাস নামিয়ে রেখে ওরা সবাই তাকিয়ে রইল লোকগুলোর দিকে। ওরা ক্রমশ এগিয়ে আসছে।

সূর্যলাল গলা চড়িয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, কৌন হ্যায়?

এবারও সাড়া না পেয়ে সূর্যলাল পকেট থেকে রিভলবার বার করল। রাত বিরেতে কোথাও বেরোলে এটা সঙ্গে নিয়ে ঘোরে। রিভলবারটা হাতে নিয়ে সূরযলাল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুম লোগ কৌন হ্যায়? খাড়া হো যাও! মত আও ইধার!

লোকগুলো থমকে দাঁড়িয়ে হিন্দিতে উত্তর দিল এবার। ওরা নিরীহ গ্রামের লোক। শর্টকাট করার জন্য বাংলোর কম্পাউণ্ড দিয়ে যায়। ওদের অন্যায় হয়ে গেছে, বাবুরা আছে জানলে আসত না!

লোকগুলো চলে যাওয়ার পর হরিনাথ হেসে বলল, তুমি একেবারে বন্দুক বার করে ফেললে ওদের দেখে?

সূরযলাল বলল, বিশ্বাস নেই! চোর-ডাকাতের তো কমতি নেই। সুখেন রিভলবারটা হাতে নিয়ে বলল, দেখি তো! গুলি ভরা আছে?

হ্যাঁ।

এটা তো অনেক পুরোনো কালের জিনিস দেখছি।

আমার পিতাজির ছিল।

তোমার টিপ কীরকম? কখনো ছুড়েছ এটা?

না দাদা, আভিতক কোনো মানুষের দিকে ছুড়তে হয়নি। শুধু ভয় দেখালেই হয়! পা

খি-টাখি শিকার করেছ তো? নাকি তাও করোনি?

সূর্যলাল বলল, দাদার তো বন্দুক-পিস্তল সম্বন্ধে বহুত জ্ঞান দেখছি। রিভলবার দিয়ে কি কেউ পাখি শিকার করে? বাড়িতে আমার আর একটা শটগান আছে। চলুন, আপনাকে একদিন শিকারে নিয়ে যাব। আপনি মারতে পারবেন তো?

সুখেন বললে, আমি কোনোদিন বন্দুক-পিস্তল হাতে ছুঁয়েই দেখিনি এর আগে। তোমারটাই প্রথম হাতে নিলাম।

করবী বলল, ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হবে না। রেখে দাও। হঠাৎ গুলিটুলি যদি বেরিয়ে যায়–

সূরযলাল বলল, না, হঠাৎ গুলি বেরিয়ে যাবে না। সেফটি ক্যাচ তোলা আছে। এই যে, দেখিয়ে দিচ্ছি।

রিভলবারটা হঠাৎ নামিয়ে রেখে সুখেন হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। একটা হেঁচকি তুলে বলল, একী, আমার মাথা ঘুরছে কেন?

সূরযলাল বলল, আপনার তাহলে বেশি হয়ে গেছে। আর খাবেন না।

সুখেন উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টলে পড়ে যাচ্ছিল, করবী তাড়াতাড়ি তাকে ধরল। সুখেনের চোখ দুটো সম্পূর্ণ লাল, দৃষ্টি উদ্ভান্তের মতন। আস্তে আস্তে বলল, করবী, আমার মাথা ঘুরছে, আমি দাঁড়াতে পারছি না।

করবী ধমক দিয়ে বলল, কেন ওসব খেতে যাও। এমনিতেই তোমার শরীর খারাপ—

ওরা যে বলল।

ওরা বললেই তুমি খাবে?

আমি এতক্ষণ খাচ্ছিলুম, কিন্তু টের পাইনি!

চলো, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়বে চলো।

আমার ভীষণ গরম লাগছে।

এত শীতের মধ্যে তোমার গরম লাগছে? জল দিয়ে মাথা ধুয়ে দেব?

সূরযলাল খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। সে উঠে এসে বলল, না, না, ভাবিজি, এখন পানি লাগালে অচানক ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আপনি ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিন। সুখেনদাদা, ভয় পাবেন না। হোড়া বাদ সব ঠিক হয়ে যাবে। এ-রকম সবারই এক-একদিন হয়।

সুখেন অবিশ্বাসের সুরে বলল, আমার এতক্ষণ কিছু হয়নি, হঠাৎ এ-রকম হল কেন? শেষ গেলাসটায় কিছু মিশিয়ে দিয়েছ নাকি?

সূরযলাল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী মিশিয়ে দেব?

হরিনাথ বলল, তখনই বুঝেছি। যেরকম ঢকঢক করে খাচ্ছিলেন—

সুখেন তবু বলল, কিন্তু এতক্ষণ আমার কিছু হয়নি! হঠাৎ এ-রকম হল কেন? নিশ্চয়ই এবার আলাদা কিছু ছিল।

সূরযলাল বলল, কারুর কারুর এ-রকম হঠাৎই হয়। করবী বলল, এতক্ষণ তোমার কিছু হয়নি মানে কী? তোমার কথা জড়িয়ে গিয়েছিল।

মোটেই না!

ঠিক আছে। তুমি এখন ঘরে চলো!

আমাকে ওরা কিছু মিশিয়ে দিয়েছে। ওদের কিছু হল না, শুধু আমারই একা এ-রকম হল কেন? আমার গা গুলোচ্ছে, অসম্ভব গুলোচ্ছে–

সূরযলাল কাচুমাচু হয়ে বলল, দাদা আমাদের নামে মিথ্যে দোষ দিচ্ছেন। আপনাকে বললাম, আস্তে আস্তে খেতে–

সুখেন হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল, আস্তে আস্তেই তো খেয়েছি! আগেরগুলোতে আমাকে শুধু জল দিয়েছ। আমি খেয়েই বুঝেছি, স্রেফ জল। কিন্তু শেষবারটায়, ওঃ, গলা জ্বলে যাচ্ছে— কী দিয়েছিলে বলো! বিষ খাইয়েছ আমাকে?

আপনি কী বলছেন? যান গিয়ে একটু শুয়ে পড়ুন, সব ঠিক হয়ে যাবে!

চোপ। আমি সব জানি!

করবী জোর করেই স্বামীকে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল। শুইয়ে দিল খাটে। ভিজে তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিল মুখ। খাটে শুয়ে শুয়েই মাটির দিকে মুখ নীচু করে বমি করল সুখেন। সেসব পরিষ্কার করল করবী!

তারপর বলল, আলো নিবিয়ে দিচ্ছি। তুমি এবার ঘুমিয়ে পড়ো।

সুখেন চিৎকার করে বললে, না ঘুমোব না! ওরা আমাকে কী খাইয়ে দিয়েছে? বলো! বলো!

করবী বলল, তুমি খেতে গেলে কেন? তুমি কী কচি খোকা? তোমাকে জোর করে খাওয়াতে পারত কেউ?

তা বলে যা-তা কিছু একটা খাইয়ে দেবে?

চুপ। আস্তে কথা বলো।

কেন, আমি আস্তে কথা বলব কেন? আমি কি কারুকে ভয় করি?

সে-কথা হচ্ছে না। এখন না ঘুমোলে তোমারই আরও শরীর খারাপ হবে।

আমার শরীর খারাপের জন্য তুমি তো ভারি কেয়ার করো! আমাকে ওরা বিষ খাইয়ে দিল, তুমি কিছু বলতে পারলে না?

আমি তোমাকে ওসব ছাইভস্ম খেতে বারন করিনি?

কোথায় বারন করলে? শেষ গেলাসটা খাবার আগে আমি তোমার চোখের দিকে তাকালাম। তখন তুমি আমাকে বারন করতে পারতে না?

করিনি?

না, করোনি! তুমি দেখছিলে, আমি খাই কি না! সেইজন্যই তো আমি খেলাম!

তুমি খুব বুঝেছ তা হলে!

সুখেনের কথাবার্তা অন্যরকম হয়ে গেছে। কোনোদিন সে করবীকে ধমকায় না, তার নামে স্পষ্ট ভাষায় অভিযোগ জানায় না। আজ সে বেপরোয়া। চোখ দুটো লাল। হেঁচকি ওঠা এখনও বন্ধ হয়নি।

করবীর হাতটা চেপে ধরে সুখেন আস্তে আস্তে দৃঢ় গলায় বলল, সত্যি করে বলো তো, সূরযলাল এখানে যে আজ থাকবে, তুমি আগে থেকেই জানতে না?

বাঃ আমি তা জানব কী করে?

নিশ্চয়ই জানতে! সেইজন্যই আজ এখানে আসার জন্য তোমার এত গরজ!

কী যা-তা বলছ। গরজের আবার কী আছে। বৃষ্টি পড়লেই তো এখানে আসি।

আজ আমার শরীর খারাপ, আসতে চাইনি—তাও তুমি জোর করে—

শরীর খারাপ নিয়েও তুমি ওইসব খেলে? তোমার একটু কান্ডজ্ঞান নেই।

আমি না খেতে চাইলেও ওরা আমাকে জোর করে খাওয়াত!

আজেবাজে কথা বোলো না। এখন ঘুমোও।

আমি আজেবাজে কথা বলছি? আমি সব বুঝি! সূরলাল যে এখানে আসবে, তা তুমি খুব ভালো করেই জানতে। তাই তুমি জোর করে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ। আমি জানি, আমার সঙ্গে থাকতে তোমার ভালো লাগে না। আমি জেগে থাকলে তোমাদের অসুবিধে হবে–তাই আমাকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে–

আমি তো এসেই ওদের দেখে বলেছিলাম, তুমি ওদের চলে যেতে বলে দাও! তখন বললে না কেন?

আমি বললেও ওরা শুনত না। তুমি ওদের আসতে বলেছ—আমার কথা ওরা শুনবে কেন? আমার কথা কেউ শোনে না! আমায় কেউ ভালোবাসে না!

আচ্ছা পাগলামি করছ তো আজ। আমি এই তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, আমি এসব কিছু জানতাম না—এবার তোমার বিশ্বাস হবে?

সুখেন হঠাৎ হু-হু করে কাঁদতে আরম্ভ করল। অবোধ শিশুর মতন বার বার বলতে লাগল, আমি জানি, তুমি আমাকে ভালোবাসো না! তুমি আমাকে ভালোবাসো না?

করবী ধৈর্য ধরে ভিজে তোয়ালে দিয়ে আবার মুখ মুছিয়ে দিল সুখেনের। তারপর তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে। অস্ফুট গলায় বলল, শোনো, তাকাও আমার চোখের দিকে। কিছু দেখতে পাচ্ছ না? বুঝতে পার না, আমি তোমায় সত্যিই ভালোবাসি?

সত্যি সত্যি বলছ?

তিন সত্যি করব?

আমার গা ছুঁয়ে বলো।

এই তো গা ছুঁয়ে বলছি।

না, পুরোটা বলো। আমার বুকে হাত ছুঁইয়ে রেখে বলল, আমি তোমায় ভালোবাসি। যদি মিথ্যেকথা বলো তা হলে আমি মরে যাব।

এই যে, বলছি, আমি তোমায় ভালোবাসি।

করবীর হাতখানা বুকে চেপে রেখে সুখেন আবার কাঁদতে লাগল।

গল্প থামিয়ে আমি একটুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর মাধবীর দিকে তাকিয়ে বললাম, মেয়েদের মন বোঝা খুব শক্ত। হয়তো করবী তার স্বামীর কাছে সত্যিকথাই বলেছিল। সে হয়তো সূরযলালের সঙ্গে আগে থেকে কোনো ষড়যন্ত্রই করেনি—সবটাই একটা গোযোগ। করবী তার স্বামীকে ভালোবাসে—এবং দুশ্চরিত্রা—একইসঙ্গে এ-রকম দু-টি ব্যাপার থাকা অস্বাভাবিক নয়।

মাধবী বলল, তার মানে? এ আবার কী অদ্ভুত কথা?

এ-রকম অদ্ভুত মানুষও আছে। করবী তার স্বামীকে ভালোবাসত—যেরকম অধিকাংশ মেয়েই ভালোবাসে। কিন্তু করবীর জীবনটা তার সংসারের ওই ছোট্ট গন্ডির মধ্যে আটকে রাখতেও পারেনি। সেইজন্যই সূরযলালের সঙ্গে। তা ছাড়া, একটি মেয়ে কী একসঙ্গে একাধিক পুরুষকে ভালোবাসতে পারে না? মেয়েদের ভালোবাসা কি এত কম যে, একজনকে দিলেই ফুরিয়ে যাবে?

ওকে ভালোবাসা বলে না। ওর অন্য নাম আছে।

কী নাম?

তা আপনি ভালোরকমই জানেন।

তা হলে ভালোবাসা কাকে বলে—তা নিয়ে আগে আলোচনা করা দরকার।

কর্নেল সেন বললেন, সেটা কিন্তু হবে অ্যাকাডেমির আলোচনা, সেটা এ-গল্পের সঙ্গে খাপ খাবে না।

রঞ্জন আমাকে বলল, ঠিক আছে, তোমাকে আর গল্পের মধ্যে টীকাটিপ্পনী দিতে হবে না। শুধু গল্পটাই বলে যাও।

আমি বললাম, সুখেনকে যে ওরা বিষ-টিস কিছু খাইয়েছে তা-ও মনে হয় না। প্রথম প্রথম মদ খেতে গিয়ে লোকে হঠাৎ এইরকমভাবে আউট হয়ে যায়। সুখেন করবীর সঙ্গে আরও অনেকক্ষণ তর্কবিতর্ক মান-অভিমান করল। তারপর বলল, আমি আজ সারারাত ঘুমোব না।

করবী বলল, বেশ তো ঘুমিয়ো না।

দরজা-টরজা সব বন্ধ করে দাও!

দিচ্ছি।

আলো জ্বেলে রাখো। তুমি এসে শোও আমার পাশে।

কিন্তু কোনো নেশাগ্রস্ত লোকের পক্ষে সারারাত জেগে থাকা সম্ভব নয়। বিশেষত বিছানায় শুয়ে শুয়ে। করবী সুখেনের কথামতন আলো নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল সুখেনের পাশে। সুখেন তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, আজ একটুও ঘুমোব না। সারারাত গল্প করব। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই সুখেন ঘুমিয়ে পড়ল।

নেশাগ্রস্ত ললাকেরা একবার ঘুমিয়ে পড়লে সাধারণত সারারাতের মধ্যে আর জাগে না। সুখেনও যদি না জাগত, তাহলে সব কিছুই অন্যরকম হত। পরদিন সকালে আবার সব কিছুই স্বাভাবিক। কিছুটা লজ্জা, কিছুটা সন্দেহ থেকে যেত মনের মধ্যে—কিন্তু মানুষের জীবনে তাতে বড়ো রকমের কোনো পরিবর্তন ঘটে না।

বাইরের বারান্দায় বসে হরিনাথ আর সূরযলাল আরও কিছুক্ষণ বসে খেল। ঘরের মধ্যে সুখেন আর করবীর সব কথাই তারা শুনতে পেয়েছে। সূরযলালের মুখখানা গম্ভীর। হরিনাথ কিন্তু বেশ খুশি খুশি। অন্য কেউ অসুবিধেয় পড়লে তার বেশ আনন্দ হয়।

সূরযলাল ব্যাজারভাবে বলল, কী ঝঞ্ঝাট রে বাবা! উনি খেলেন কেন? আমরা কী ওকে। জোর করে খাওয়াতে গেছি?

হরিনাথ বলল, এদিকে শালা কত বারফট্টাই! খেলেও আমার কিছু হয় না! এবার বোঝো, কিছু হয় কি না! আবার বলে কিনা আমরা বিষ মিশিয়ে দিয়েছি! যতসব নভিসের কান্ড!

এই হরিয়া, তুই শালা ওকে বেশি বেশি খাইয়েছিস?

মোটেই না! আমি নিজে কম খেয়ে অন্যকে বেশি দেব—আমি তেমন পাত্তর নই! শেষকালে নিজের মাল শর্ট পড়ে যাবে–

তাহলে হঠাৎ ওরকম আউট হয়ে গেল কেন?

কলজের জোর নেই, শুধু মুখে বড়ো বড়ো কথা!

আজ আর জমবে না। চল, ঘর যাই।

এত রাত্তিরে ঘর যাব? রামদাস খাবার দিল না এখনও। খাবার-টাবার খাই, তারপর আর একটু মাল খাব।

আমার আর ভালো লাগছে না।

একটু বাদে রামদাস এসে গরম গরম মাংস আর রুটি দিয়ে গেল। সূর্যলাল কিছুই খেল না প্রায়, হরিনাথ খেল চেটেপুটে। তারপর গেলাসে আবার মদ ঢেলে দুটো চুমুক দিয়ে বলল, আর পারছি না, পেট অ্যাইসা ভরে গেছে। চলো শুয়ে পড়া যাক।

সূরযলাল কোনো উত্তর দিল না।

হরিনাথ বলল, চলো ওস্তাদ, এবার শুয়ে পড়ি? তুমি না যাও, আমি যাচ্ছি। তোমার ইচ্ছে হলে এসো!

হরিনাথ চলে যাওয়ার পর সূরযলাল একটা সিগারেট ধরিয়ে বসে রইল একা। কোথাও কোনো শব্দ নেই। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত থমথমে। বৃষ্টি থেমে গেছে একটু আগে। মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মারল মলিন চাঁদ। তারপর একটি দু-টি তারা। হাওয়া দিচ্ছে বেশ জোরে। সূরযলাল গায়ের শালটা জড়িয়ে নিল ভালো করে।

বেশ খানিকক্ষণ বাদে খুব ক্ষীণভাবে খুট করে শব্দ হল দরজা খোলার। সূরলাল পেছনে ফিরে তাকাল না পর্যন্ত। আবার একটা সিগারেট ধরাল। দরজা খুলে বাইরে এল করবী। হালকা পায়ে এগিয়ে এসে বসে পড়ল সূরযলালের পাশে। কোনো কথা বলল না, সূরযলালের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে নিজের ঠোঁটে চুঁইয়ে টানল দু-একবার। তারপর সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিল বাইরে।

করবীর গায়ে গরম জামা নেই, শীতে সে কাঁপছে। সূরযলাল নিজের শালটা খুলে এগিয়ে দিল করবীর দিকে। করবী সেটা একসঙ্গে জড়িয়ে নিল দু-জনের গায়ে। দু-জনে হাত রাখল পরস্পরের কাঁধে।

করবী বলল, তুমি যদি ঘুমিয়ে পড়তে তাহলে জীবনে তোমার সঙ্গে আর কথা বলতাম না।

সূরযলাল বলল, আমি রাতভর এখানে জেগে থাকতে পারতাম।

ওকে অত মদ খাওয়ালে কেন?

আমি তো খাওয়াইনি। হরিনাথ খাইয়েছে। আমি একবার শুধু বলেছিলাম।

আর কোনোদিন খাওয়াবে না।

আচ্ছা।

তুমিও এত বেশি খাবে না। আজ খুব বেশি খেয়েছ।

এখনও পুরো হয়নি। তুমি এসেছ তো, তাই আর একটু খাব।

বৃষ্টি থেমে গেছে। মাঠের মধ্যে একটু হাঁটতে ইচ্ছে করছে।

চলো।

বারান্দা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল ওরা দু-জনে। দু-জনেরই গায়ে এক-ই চাদর জড়ানো-যমজ মূর্তির মতন ওরা ঘুরতে লাগল সামনের বাগানে। আকাশে অস্বচ্ছ আলো, হু-হু করছে শীতের হাওয়া—তারমধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছে এক স্বাস্থ্যবান যুবক ও এক স্বাস্থ্যবতী যুবতী। বাকি সবাই এখন ঘুমন্ত।

তবু, মাঝরাত্রে সুখেনের নিয়তি তাকে জাগিয়ে দিল। এমনিতেই তার গাঢ় ঘুম, আজ এত নেশা হওয়া সত্ত্বেও তার ঘুম ভাঙার তো কোনো প্রয়োজন ছিল না। পাশ ফিরতে গিয়ে দেখল বিছানায় অনেকখানি শূন্যতা। ঘর অন্ধকার, অথচ করবী বিছানায় নেই। ঘরের মধ্যে হ্যাজাকটা করবী ঘুমোতে যাওয়ার সময়ই নিভিয়ে দিয়েছিল-বারান্দার হ্যাজাকটাও এখন নেভাননা। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। সুখেন ধড়মড় করে উঠে বসল।

সুখেনের তখনও পুরো নেশা, মাথা টলমল করছে। তবু সে খাট থেকে নেমে নি:শব্দে চলে এল পাশের ঘরে। সে-ঘরও অন্ধকার। খাটের ওপর বিশ্রী ভঙ্গিতে ঘুমোচ্ছে হরিনাথ।

সুখেন বেরিয়ে এল বারান্দায়। বারান্দার এককোণে মেঝের ওপর দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে করবী, তার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে সূরলাল। সূরযলালের হাতে মদের গেলাস, সেটা উঁচু করে দিচ্ছে করবীর মুখের কাছে। করবী আলতো করে চুমুক দিয়ে খানিকটা খেল, তারপর মুখ নীচু করে চুমু দিল সূরযলালের ঠোঁটে।

ওরা এমনই নিশ্চিন্ত এবং ভাবে বিভোর ছিল যে, সুখেনের আসার ব্যাপারটা টেরই পায়নি। সুখেন প্রায় এক মিনিট থমকে থেকে ওদের দেখল। যেন সে, নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। কিংবা, করবী যেন তার স্ত্রী নয়, অন্য একটি মেয়ে ও পুরুষের ঘনিষ্ঠ দৃশ্য দেখে ফেলেছে সে। বৃষ্টি থেমে গেছে, অন্ধকার তেমন গাঢ় নয়—বারান্দার কোণে ওদের ওই অন্তরঙ্গ ভঙ্গি এক হিসেবে খুব সুন্দর।

একটি মেয়ে আর একটি ছেলে যদি ওরকম অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে থাকে—তাহলে দূর থেকে সেটা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে যেকোনো লোকেরই ভালো লাগবার কথা। একমাত্র নিজের স্ত্রীকে ওই অবস্থায় পরপুরুষের সঙ্গে বসে থাকতে দেখলে স্বামীর ভালো লাগে না। সুখেন যেন ব্যাপারটা প্রথমে ঠিক বিশ্বাসই করতে পারেনি। তাই প্রথম কয়েক মুহূর্ত সে বিভোর হয়ে তাকিয়েছিল সে-দিকে। তারপর তার বুকের মধ্যে চড়াৎ করে উঠল।

হঠাৎ সুখেনের চোখ পড়ল চেয়ারের ওপরে রাখা রিভলবারটার দিকে। সেটা তুলে নিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এসে সে বিকৃত গলায় বলল, খুন করব! আজ দু-জনকেই খুন করব!

ওরা দু-জনে ছিটকে সরে গেল দু-পাশে। সূরষলাল উঠে দাঁড়াবার আগেই গুলি চালাল সুখেন।

সিমেন্টের মেঝেতে সেই গুলির শব্দ হল প্রচন্ড গুলি সূরযলালের গায়ে লাগেনি।

সূরযলাল লাফিয়ে উঠে সুখেনকে ধরার চেষ্টা করল কিন্তু সুখেন ততক্ষণে রিভলবারটা ঠিকভাবে ধরে লক্ষ্য স্থির করছে। সূরযলাল চেঁচিয়ে বলল, দাঁড়ান! এ কী করছেন? একটা কথা শুনুন! সুখেন আবার গুলি করতে যাওয়ার আগেই করবী এসে তার সামনে দাঁড়াল, হাত তুলে বলল, কী করছ দাঁড়াও! সূর্য অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল আমি ওর কপালে জল দিয়ে–

সুখেন উন্মত্তের মতন বলল, সরে যাও! আমি নিজের চোখে দেখেছি।

আমি আগে ওকে মারব। তারপর তোমাকেও—

করবী সূরযলালকে সম্পূর্ণ আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি ভুল দেখেছ। পাগলামো কোরো না—তুমি খুনের দায়ে পড়বে–

আমার ফাঁসি হোক। কিছু যায় আসে না। আমি ভুল দেখেছি? আমি চিরকালই ভুল দেখি। সরে যাও–

না, আমি সরব না। তুমি আমাকে মারো আগে। সূরয তুমি চলে যাও —

সর হারামজাদি—

না, আমি সরব না। তুমি আমাকে মারতে চাও মারো–-।

করবীর এইটুকু বিশ্বাস আছে যে, সুখেন কিছুতেই তার ওপর গুলি চালাতে পারবে না। যত অন্যায় করুক, তবু করবীর ওপর সুখেনের সাংঘাতিক দুর্বলতা। সুখেন পিস্তলটা হাতে ধরে, সরে যাও, সরে যাও করছে, কিন্তু গুলি চালাতে পারছে না। তার হাত কাঁপছে। করবী এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে সুখেনের দিকে। অসম্ভব তার মনের জোর, এগোতে এগোতে সে বলছে, সূরয তুমি পালিয়ে যাও, তুমি পালিয়ে যাও।

প্রথম গুলির আওয়াজ শুনে হরিনাথও জেগে উঠেছিল। সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বিস্ফারিত চোখে। সে আছে সুখেনের পেছন দিকে। করবী তাকে চোখের ইশারায় বলার চেষ্টা করল, পেছন থেকে সুখেনের হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নিতে। কিন্তু হরিনাথের সে সাহস নেই।

করবী সুখেনের একেবারে কাছে এসে হাত বাড়িয়ে বলল, ওটা আমাকে দিয়ে দাও।

সুখেন বলল, সরে যাও! খুন করে ফেলব। একদম খুন করে ফেলব আজ! হারামজাদি–

সূরলাল পালিয়ে যায়নি। সে বলল সুখেনদাদা, ওটা রেখে দিন। আমি আপনাকে সব কুছ বলছি। মাথা খারাপ করবেন না–

সুখেন বলল, আমি তোমাকে খুন করব, শয়তান কাঁহাকা!

করবী বলল, তা হলে আগে আমাকে মারো। আমাকে মারছ না কেন? এই তো আমি এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছি–

তোমাকেও মারব। দু-জনকেই একসঙ্গে। আগে ওই কুত্তাটাকে–

তারপর একমুহূর্তের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটে গেল। সুখেন করবীকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতে গিয়েও পারল না। করবীই ধরে ফেলেছে তাকে, অন্য হাত দিয়ে করবী খপ করে কেড়ে নিতে গেল রিভলবারটা, সুখেন সেটা সরিয়ে জোরে চেষ্টা করতেই গুলি ছুটে গেল। গুলি ফুড়ে গেছে সুখেনের গলা দিয়ে। ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল সে। রিভলবারটার শব্দ হল ঠক করে।

হরিনাথ তক্ষুনি দৌড়ে এসেছে বাইরে। একটি কথা না বলে হরিনাথ ছুটতে লাগল মাঠ ভেঙে। সূরযলাল এগিয়ে এল, করবীর কাছে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, মর গেয়া তুমি মেরে ফেললে? একদম মেরে ফেললে?

করবী হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে সুখেনের পাশে। সুখেনের প্রাণ বেরিয়ে গেছে গুলি লাগার সঙ্গেসঙ্গে। আর একটা কথাও সে উচ্চারণ করতে পারেনি। গলার ক্ষত থেকে, মুখ থেকে রক্ত তখনও বেরোচ্ছে গলগল করে। একটু আগে মানুষটা এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, এখন আর তাকে চেনাই যায় না।

করবী মুখ নীচু করে বলল, এ কী? মরে গেল? একদম মরে গেল?

সূরযলাল বলল, তুমি রিভলবারটা কেড়ে নিতে পারলে না শুধু? তুমি ওকে মারলে কেন?

করবী রক্তহীন বিবর্ণ মুখে সূরযলালের দিকে তাকাল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, আমি মেরে ফেললাম? আমি তোমাকে বাঁচাতে চাইলাম, আমি তোমাকে বাঁচিয়ে দিলাম—এখন তুমি বলছ, আমি মেরে ফেলেছি?

পাগলের মতন হয়ে গেল করবী, সূরযলালের গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার বুকে গুম গুম করে কিল মারতে লাগল। সূরযলাল অতিকষ্টে তাকে ধরে ঝাঁকানি দিয়ে শান্ত করল একটু, তারপর দু-জনেই ঝুঁকে পড়ে পরীক্ষা করল, দেখল সুখেনের দেহ। মৃত্যু সম্পর্কে সন্দেহ করার কোনো উপায়ই নেই। ওরা দু-জনে ঘোরলাগা চোখে তাকাল পরস্পরের দিকে! করবী বলল, সব শেষ। আমার এখন কী হবে?

সূরযলাল করবীকে ধরে দাঁড় করাল। তারপর বলল, চলো, আমরা জলদি এখান থেকে চলে যাই।

করবী বলল, চলে যাব? তারপর ওর কী হবে?

সেসব পরে ব্যবস্থা করলেই হবে। এখন চলো—

কিন্তু সূরযলালের চেয়ে করবীর বুদ্ধি বেশি। সে বুঝতে পেরেছিল, এইভাবে পালিয়ে বাঁচা যায় না। পালাবার আগে একটা কিছু প্ল্যান ঠিক করে নিতে হবে।

ততক্ষণে চৌকিদার রামদাস এসে কাছে দাঁড়িয়েছে। সূরযলাল বলল, আমাদের বাঁচতেই হবে। তারপর রামদাসের দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলল, একটা কথা ফাঁস করবি তো তোর জবান ছিড়ে দেব!

এরপর করবী আর সূর্যলাল একসঙ্গে বাঁচবার চেষ্টা করেছে। কেউ কারুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি।

কথা থামিয়ে আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলাম। ভালো করে একটা টান দিয়ে বললাম, এর পরের ব্যাপার তো বোঝাই যাচ্ছে। মৃতদেহটা সরানোই ওদের প্রধান কাজ ছিল। কিন্তু ডাকবাংলোর আশেপাশে কোথাও পুঁতে ফেলতে সাহস করেনি। ডাকবাংলোর কাছে খোঁজাখুঁজি হবেই। জিপগাড়িটা নিয়েও মুশকিল, ওটা সরাতেই হবে, কিন্তু কেউ গাড়ি চালাতে জানে না। সব কিছু ধুয়ে মুছে ওরা পরিষ্কার করে রাখল। ডেডবডিটা লুকিয়ে রাখল খাটের নীচে। ঠিক হল, পরের রাত্তিরে সব ব্যবস্থা হবে। করবী ওইখানেই রয়ে গেল, সূরযলাল গেল সব ব্যবস্থা করতে। সূরযলাল আর না ফিরতেও পারত। সূরযলালের টাকাপয়সা আছে। অনেক। ওইসব জায়গায় টাকাপয়সার জোরে অনেক কাজ হাসিল করা যায়। সূর্যলাল টাকা দিয়ে লোকের মুখ বন্ধ করে নিজে যদি সব কিছু অস্বীকার করত তা হলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা খুব সহজ হত না। কিন্তু সূরযলাল তা করেনি। সে ফিরে এসেছিল। ইতিমধ্যে কর্নেল সেন সেখানে হাজির হয়েই সব গোলমাল পাকিয়ে দিলেন। একে উনি মিলিটারির লোক—এবং ওঁর সঙ্গেও রিভলবার। ওঁকে কিছুতেই নিরস্ত করা গেল না। আমার ধারণা, কর্নেল সেন যখন প্রথম ডাকবাংলোটাতে হাজির হন, তখন করবী চৌকিদারের ঘরেই লুকিয়ে ছিল। কি, ঠিক বলছি?

কর্নেল সেন বললেন, তোমার বর্ণনা মোটামুটি ঠিক বলেই মনে হয়। অন্তত বেশ বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে। কিন্তু তুমি বলছ, খুনটা আসলে অ্যাকসিডেন্ট? ওরা কেউ খুন করেনি?

রঞ্জন বলল, ভেরি আনলাইকলি! সুনীল যেভাবে চরিত্রগুলো এঁকেছে, তাতে মনে হয়, ধরা পড়লেও ওরা কেউ চট করে সুখেনকে খুন করবে না। তার কোনো দরকার ছিল না। রিভলবারটা যদি ওখানে না থাকত—আচ্ছা, রিভলবারে কারুর হাতের দাগ পাওয়া যায়নি?

কর্নেল সেন বললেন, সে হাতের দাগের কোনো মূল্য নেই। ওদের তো ও-সম্পর্কে আইডিয়া নেই—তাই রিভলবারটা ওরা সবাই ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। সবারই হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। সুতরাং ও-থেকে কিছু প্রমাণ করা যায় না।

মাধবী বলল, অ্যাকসিডেন্ট-ট্যাকসিডেন্ট বাজেকথা! আমি বলছি, ওই করবীই খুন করেছে। আগে থেকে প্ল্যান করেই খুন করেছে।

আমি হাসলাম। রঞ্জন বলল, তোমার করবীর ওপর খুবই ঘেন্না দেখছি। এখনও তুমি ভাবছ, ওই করবীই নিজের হাতে ইচ্ছে করে তার স্বামীকে খুন করেছে? আমার কিন্তু মেয়েটাকে অত খারাপ মনে হয় না। তা ছাড়া, স্বামীকে খুন করার দরকার কী? ও তো অনায়াসেই সুখেনকে ছেড়ে সূরযলালের সঙ্গে থাকতে পারত। অনেক বিবাহিতা মেয়েরা করে না এ-রকম? এজন্য কী খুন করার দরকার হয়?

মাধবী জিজ্ঞেস করল, মামাবাবু, আপনি এবার সত্যি করে বলুন তো, ওই মেয়েটাই খুন করেনি?

কর্নেল সেন বললেন, প্রকৃতপক্ষে ওদের দুজনের মধ্যে কে খুন করেছে, তা শেষ পর্যন্ত কিছুতেই প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। সুনীলের অ্যাকসিডেন্টের থিয়োরিটাই ঠিক হতে পারে। এমনকী আত্মহত্যা করাও অসম্ভব নয়। করবী আর সূরযলাল দু-জনেই শেষপর্যন্ত বলে গেছে যে, সুখেন আত্মহত্যা করেছে। এইকথা থেকে একচুলও নড়েনি। রিভলবার থেকে দুটো গুলি খরচ হয়েছিল। একটা গুলি সুখেনই ছুড়েছিল সূরযলালের দিকে। গায়ে লাগেনি। সূরযলাল রিভলবারটা কেড়ে নিয়ে আত্মরক্ষার জন্য গুলি করে এ-রকম একটা থিয়োরিও প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল। তাতে সূরযলালের ওপর ঠিক হত্যার অভিযোগ আসত না, কিন্তু সূরযলাল সে-কথা কিছুতেই স্বীকার করেনি। সে বার বার বলেছে, সুখেন আত্মহত্যা করেছে তার বা করবীর ওতে কোনো হাত নেই। মৃতদেহটা লুকোবার চেষ্টা করেছিল কেন? ওরা ভয় পেয়ে মাথা গুলিয়ে ফেলেছিল—এই ওদের বক্তব্য।

বিচারের সময় ওদের যদি দেখতে তোমরা। করবী আর সূরযলাল পরস্পরের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকত, শুধু, যেন পরস্পর এক সাংঘাতিক বন্ধনে বাঁধা। আর কারু সঙ্গে একটাও কথা বলত না, কোনোরকম অপরাধী বা অনুতপ্ত বা ক্ষমাপ্রার্থীর ভাব ছিল না তাদের মধ্যে! সরকার পক্ষের উকিল ওদের জেরা করে করে একেবারে ছিড়েখুঁড়ে ফেলতে চেয়েছে। এমনসব জঘন্য অভিযোগ এনেছে দু-জনের নামে যে, তা কল্পনা করা যায় না। সূরযলাল আরও তিন-চারটি দুশ্চরিত্রা মেয়ের সঙ্গে নাকি কত কী কান্ড করেছে—এসব কথাও বলেছে করবীর সামনে, তবু ওরা এক চুলও বিচলিত হয়নি। পরস্পরের নামে কক্ষনো কোনো দোষারোপ করেনি। শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মতন দু-জনে দু-জনের দিকে তাকিয়ে থাকত।

মাধবী জিজ্ঞেস করল, শেষপর্যন্ত ওদের শাস্তি হয়নি?

কর্নেল সেন বললেন, হ্যাঁ হয়েছিল। খুনের অভিযোগ অবশ্য প্রমাণিত হয়নি। অন্যান্য সব কারণ মিলিয়ে করবীর জেল হল তিন বছর, আর সূরযলালের পাঁচ বছর। করবী আড়াই বছর পরেই ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল। সূরযলাল তখন আবার একটা ভুল করে। এমনিতে ছটফটে স্বভাবের মানুষ, করবী জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার খবর নিশ্চয়ই কোনো উপায়ে ওর কাছে পৌঁছেছিল। ও তখন জেল থেকে পালাবার চেষ্টা করে। ধরাও পড়ে যায়। তাতে ওর শাস্তি বেড়ে যায় আরও কয়েক বছর। জানি না আর কোনো দিন ওদের দুজনের দেখা হয়েছে কি না।

করবী জেলের বাইরে ঘুরে বেড়াবে আর ও জেলের মধ্যে বন্দি থাকবে, এই চিন্তা বোধ হয়, সূরযলালের কিছুতেই সহ্য হচ্ছিল না।

একটুক্ষণ আমরা সবাই চুপ করে রইলাম। রঞ্জন বলল, আচ্ছা মামাবাবু, একটা জিনিস লক্ষ করেছেন? সুনীল এমনভাবে করবী আর সূরযলালদের কথা বলে গেল, যেন ও, একেবারে সব সময় ওখানে উপস্থিত ছিল ওদের সঙ্গে…ডায়ালগ পর্যন্ত।

আমি বললাম, ওটা লেখকদের লাইসেন্স! কোনো ছেলে আর মেয়ে যখন কোনো নির্জন জায়গায় বসে কথা বলে, তখন কি কোনো লেখক আড়ালে থেকে তাদের কথা শোনে? কিংবা তাদের পাশে গিয়ে বসে থাকে? তবু, ওদের সেই নির্জনে বসে থাকা ও কথাবার্তা হুবহু ফুটিয়ে তোলা হয় কী করে? লেখকরা মানুষের চরিত্র স্টাডি করে। তারপর সেই চরিত্র অনুযায়ী লেখকরা তাদের প্রেমের দৃশ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করে। আমি ওদের ব্যাপার ঠিক বানাইনি, বলতে বলতে এমনিই মনে আসছিল, যেন হুবহু হত্যাকান্ডটা দেখতে পাচ্ছিলাম। এবং সত্যিকথা বলতে কী জানিস, করবী মেয়েটার ওপর আমার খানিকটা সহানুভূতিও এসে যাচ্ছিল।

মাধবী ভঙ্গি করে বলল, তা তো আসবেই! পুরুষ তো!

কর্নেল সেন বললেন, করবী মেয়েটির মধ্যে অসাধারণ একটা কিছু ছিল। তাকে নিছক একটা খারাপ মেয়ে বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শহরে থেকে শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ পেলে ও হয়তো বড়ো একটা কিছু করতে পারত। এই ধরনের মেয়েকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে অনেক বড়ো বড়ো কান্ড ঘটে। ওর প্রতি খানিকটা সহানুভূতি থাকা অস্বাভাবিক নয়। আমারও বোধ হয় একটু একটু আছে—যদিও আমার জন্যই ওরা ধরা পড়েছিল।

তোমাদের আর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। করবীর সঙ্গে আমার আর একবার দেখা হয়েছিল। ওই ঘটনার বছর পাঁচেক পর। লছমনঝোলায় এক মহিলাকে আমার হঠাৎ খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। গঙ্গার ঘাটের একেবারে শেষধাপে জলে পা দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন— লাল পাড়ের গরদের শাড়ি পরা, একগোছা চুল পিঠের ওপর ছড়ানো। বোধ হয় ওই চুল দেখেই আমি চিনতে পারলাম। করবী। ওকে দেখে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমার জন্যই ওর জীবনে একটা বিপর্যয় এসেছে। আমাকে ওর পছন্দ করার কথা নয়। আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। ডেকে বললাম, এই যে শুনুন!

তখন তার চেহারা একটুও খারাপ হয়নি, আকর্ষণীয়। মুখ ফিরিয়ে তাকাল আমার দিকে। আমাকে চিনতে না পারার কথা নয়, কিন্তু সেরকম কোনো ভাব দেখালো। চোখের দিকে তাকিয়ে রইল দু-এক পলক, বড়ো অদ্ভুত সেই দৃষ্টি। তারপর জলের মধ্যে নেমে গেল। জান তো, ওখানকার গঙ্গায় কীরকম স্রোত, তারমধ্যেই সাঁতার কেটে দূরে চলে গেল অবলীলাক্রমে। আমি কোনো কথা বলার সুযোগ পেলাম না।

তবে, আমার ধারণা ওই মেয়ে যেখানেই থাকবে, আশপাশের লোকের জীবনে বিপদ ডেকে আনবে। কিছুদিন বাদেই লছমনঝোলায় একজন ব্যবসায়ী খুন হয়। আমার বিশ্বাস করবী সেই ব্যাপারের সঙ্গেও জড়িত। সেবারে অবশ্য আমি আর গোয়েন্দাগিরি করতে যাইনি।

তারপর তো অনেক বছর কেটে গেছে-করবী বেঁচে থাকলে এখন তার যথেষ্ট বয়েস। কিন্তু এখনও আমার মাঝে মাঝে তার সেই চেহারাটা মনে পড়ে। সেই সকাল বেলা স্নান করার পর চুল খোলা, জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর।

রঞ্জন উঠে গিয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে দিল। বাইরে তাকিয়ে বলল, ভোর হয়ে এসেছে। আলো ফুটেছে।

কর্নেল সেনও উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, তাহলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ানো যাক! অনেকদিন সূর্য ওঠা দেখিনি।

2 Comments
Collapse Comments

অসাধারণ

অলীক মুখোপাধ্যায় October 21, 2023 at 3:20 am

দিকশূন্য পুরের ঠিকানা টা বলতে পারেন?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *