৫. একমাত্র কন্যা

একমাত্র কন্যা। হৃদয়ের সকল সুষমা দিয়ে যাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে। যার মায়া আর মমতা হোরসীসকে উতালা করে রাখত সেই মেয়েকে হারিয়ে হোরসীস পাগল হয়ে গেল। তার চিন্তাশক্তি যেন হঠাৎ বিকল হয়ে গেল। সে ভাবতে লাগল, এটা পাদ্রীদের কাণ্ড। তারাই ষড়যন্ত্র করে রোজীকে ছেড়ে দিয়েছে আর আমার মেয়েকে হত্যার নীল নক্সা তৈরী করেছে। পাদ্রী ও তার সহচরদের মাঝেই সকল প্যাঁচ। এরাই সকল অনিষ্টের মূল। সুতরাং এদের আর ক্ষমা করা যায় না। প্রতিশোধ এদের থেকে নিতেই হবে।

আদরের মেয়েকে হারিয়েছে, জীবনের সকল সঞ্চয় মহামূল্যবান অলঙ্কারগুলো হারিয়েছে। হোরসীস এখন প্রতিশোধ স্পৃহায় অধীর, অস্থির। ধর্মের অনুশাসনের কথা সে একেবারেই ভুলে গেল। পল্লী থেকে তিন চার মাইল দূরে রোমান সৈন্যদের একটি ক্যাম্প। সেখানে একজন সেনা অফিসার, একজন সহকারী ও বেশ কিছু সৈন্য অবস্থান করে। নীল নদের তীরে এ ধরনের বহু ক্যাম্প বিদ্যমান। এ ক্যাম্পের সৈন্যদের দায়িত্ব তারা চারদিকে টহল দিবে ও খবরাখবর রাখবে যে, নীল নদে কোন মেয়েকে বিসর্জন দেয়া হয় কি না। এ ধরনের কোন সংবাদ পেলেই তারা সেখানে ছুটে যায়। উদ্যোক্তাদের গ্রেফতার করে এনে আইনের হাতে সোপর্দ করে। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের রাজকীয় আইনে এ অপরাধ হত্যার মতই গুরুতর। কোন ক্রমেই এদের ক্ষমা করা হয় না।

হঠাৎ হোরসীসের অন্তরে সেই ক্যাম্পের কথা মনে হল। আর সাথে সাথে প্রতিশোধের আগুন যেন তার হৃদয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হোরসীস সেই ক্যাম্পের দিকে ছুটে গেল। ক্যাম্পের অফিসারকে বলল, তাদের পাদ্রী তার মেয়েকে জোর করে নিয়ে গিয়ে নীল নদে বিসর্জন দিয়েছে।

রোমান অফিসার একথা শুনে ক্ষেপে উঠল। কী! এতো বড় সাহস। আমরা জীবিত থাকতে ধর্মের নামে এ অনাচার! নির্মমভাবে মানব হত্যা! মানবতার এ কলঙ্ককে কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। সাথে সাথে সে বেরিয়ে পড়তে প্রস্তুত হল।

হোরসীসের এবার হুশ ফিরে এসেছে। ভাবল, সমাজে থাকতে হলে সামাজিক অনুশাসন মানা ছাড়া উপায় নেই। অন্যথায় সবাই তাকে বয়কট করবে। তাই সকলের উপর এই রোমান আপদ চাপিয়ে দিতে হবে। হোরসীস অফিসারকে বিনয়ের সাথে বলল, হুজুর! আপনি যদি এভাবে গিয়ে পল্লীতে তুলকামাল কাণ্ড ঘটান তাহলে পল্লীর খ্রিস্টানরা আর আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। হুজুর! আমাকে ওরা মেরে ফেলবে। হোরসীসের কণ্ঠে কান্নার গমক ফুটে উঠল। হোরসীস বলল, হুজুর! আমি এখন একাকী ফিরে যাই। বেশ কিছু সময় পর আপনি আসুন। আমার সাথে আপনি এমনভাবে কথা বলবেন যেন আমিও আমার মেয়ের হত্যার কাজে শামিল ছিলাম।

বুদ্ধিমানের জন্য ইংগিত যথেষ্ট। অফিসারটি সবকিছু বুঝে ফেলল এবং হোরসীসকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। হোরসীস আশা নিরাশায় দুলতে দুলতে বাড়িতে ফিরে এল এবং বিষয়টি গোপন রাখল। এমন কি তার স্ত্রীকেও বলল না।

***

দ্বিপ্রহরের পর লোকেরা দেখল, পল্লীর দিকে কয়েকটি ঘোড়া ছুটে আসছে। দূর থেকে তারা ঘোড়ার পদধ্বনি শুনতে পেল। বিশ পঁচিশটি বাড়ি নিয়ে ছোট্ট একটি পল্লী। যারা বাইরে ছিল তারা আড়ালে সরে দাঁড়াল। আর ঘরের লোকেরা উঁকি দিয়ে বাইরে তাকাল। দেখল, রোমান ক্যাম্পের সৈন্যরা আসছে। তারা প্রায়ই আসে। পল্লীর খবরাখবর নেয়। আবার চলে যায়। কিন্তু আজকে তাদের আসার ভাব দেখে সবার হৃদয় দুরুদুরু করে কেঁপে উঠল।

তারা দেখল, অফিসারের ঘোড়াটি আগে আগে আসছে আর তার পিছনে আসছে প্রায় বিশজন সৈন্য। সবাই সশস্ত্র। যেন অভিযানে বেরিয়েছে। সৈন্যরা পল্লীটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। অফিসার ঘোষণা করল, কোন পুরুষ ও মহিলা পলায়নের চেষ্টা করবে না। সবাই বাড়ি ছেড়ে উন্মুক্ত এই মাঠে চলে এস।

পল্লীর লোকেরা ভয় পেয়ে গেল। তারা মিসরী খ্রিস্টান। রাজকীয় খ্রিস্টান ধর্মের তারা ঘোর বিরোধী। তাছাড়া গত রাতেই তাদের গ্রামের হোরসীসের মেয়েকে নীল নদে বিসর্জন দেয়া হয়েছে। সাম্রাজ্যের আইনে তা মারাত্মক অপরাধ। তবে কি সৈন্যরা হোরসীসের মেয়ের কথা জেনে ফেলেছে?

রোমান অফিসারটি বলল, হোরসীস কে? যেই হও সামনে চলে আস। হোরসীস সামনে এগিয়ে এল। অফিসার ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়াল। অন্যান্য সৈন্যকে ঘোড়া থেকে নেমে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াতে নির্দেশ দিল।

অফিসার একটু রুক্ষ ভাষায় বলল, তুমি কি গতরাতে তোমার মেয়েকে নীল নদে উৎসর্গ করেছো?

হোরসীস সবাইকে বুঝাতে চাইল যে, সে এ সম্পর্কে কিছুই জানে না। রোমানদের কাছে সে কিছুই বলেনি। তাই বলল, না তো এমন কিছু তো ঘটেনি।

অফিসার ক্ষিপ্ত হওয়ার ভান করে বলল, আচ্ছা, তাই নাকি। তাহলে তোমার মেয়েকে নিয়ে এস। শোন, আমি জানি তোমার এক মেয়ে ছিল। আমি সন্দেহ বশে আসিনি। বিষয়টি নিশ্চিতভাবে জেনেই তবে এসেছি। যদি তুমি সত্য বলে থাক, তাহলে তোমার মেয়েকে এখানে হাজির করে সত্যতা প্রমাণ করো। আমি তোমাকে অবকাশ দিচ্ছি।

কিছুক্ষণ পরে ষোল সতের বছরের এক সুন্দরী মেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে রোমান অফিসারের সামনে দাঁড়াল। বলল, আমি তার মেয়ে। আমি বাড়িতে ছিলাম না। কিছু মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে অন্য বাড়ির ছাদের উপর থেকে দেখছিলাম যে কি হচ্ছে? এক ব্যক্তি দৌড়ে গিয়ে আমাকে বলল, আপনারা আমার পিতার উপর মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি আমাকে নীল নদে উৎসর্গ করেছেন। তাই আমি ছুটে এলাম।

অফিসারটি মুচকি হাসল। যেন বুঝে ফেলেছে যে তার সাথে তিরস্কার করা হচ্ছে। তাকে বেকুব বানানো হচ্ছে। অফিসারটি এক ব্যক্তিকে ডেকে কাছে এনে জিজ্ঞেস করল, এই মেয়ের পিতা কে?

ভয়ভীতি ছাড়াই লোকটি বলল, হোরসীস।

অফিসারটি আরেকজন লোককে ডেকে ঐ একই কথা জিজ্ঞেস করল। লোকটি বিস্মিত কণ্ঠে বলল, আপনার কাণ্ড দেখে আমি বিস্মিত ও মর্মাহত। আপনিকি আমাদের এতোই নির্বোধ মনে করেন যে, আমরা কে কার সন্তান তাও জানি না। এ মেয়েটি হোরসীসের। ওর নাম আইনী।

তারপর অফিসার গ্রামের সকল লোককে জিজ্ঞেস করল। পল্লীর সবাই সমকণ্ঠে বলল, আমরা সবাই জানি যে এটা হোরসীসের মেয়ে।

রোমান অফিসার বুঝতে পারল না যে, এরা চোখের ইশারায় নিজেদের কর্তব্য ঠিক করে নিয়েছে। কারণ তারা যদি মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হয় তাহলে আর তাদের রক্ষা নেই, হয়তো শাস্তি স্বরূপ তাদের গোটা পল্লী আগুনে ভস্ম হতে পারে। ভয়াবহ অন্য কিছু ঘটতে পারে। তাদের অবস্থা দেখে সে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। তার মনে হল, হয়তো হোরসীস তার ব্যক্তিগত কোন আক্রোশ পূরণের জন্য তাকে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। সে ক্রোধে অধির হয়ে খপ করে হোরসীসের বাহু ধরে টানতে টানতে একদিকে নিয়ে গেল। অগ্নিঝরা কণ্ঠে বলল, তোর অন্তরে যে বদমায়েশী আছে তা বল। যদি না বিলস তাহলে এখানেই সবার সামনে তোর শির উড়িয়ে দেয়া হবে।

হোরসীস কাঁপতে কাঁপতে মৃদু কণ্ঠে বলল, হুজুর যদি আমি সত্য কথা বলি তাহলে এরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমি সত্য বলব, তবে এদের হাত থেকে আমাকে বাঁচানো আপনার দায়িত্ব।

অফিসারটি বলল, সত্য বল।

হোরসীস বলল, এ মেয়েটি তার নয়। এটা অমুকের মেয়ে। মেয়ের মায়ের নাম পর্যন্ত বলে দিল।

এ পল্লীটি নীল নদের তীরের এক জেলে পল্লী। স্থানটি বেশ উঁচু। এখানে এসেই নদীটি বাঁক নিয়েছে। তাই এখানে স্রোত খুব বেশী ও ভয়ঙ্কর। এখানে মেয়েদের নদী বক্ষে উৎসর্গ করা হয়। ফলে প্রচণ্ড ও ভয়ঙ্কর স্রোতে কেউ আর বাঁচতে পারে না।

রোমান অফিসার মেয়ের পিতা মাতাকে ডেকে আনল। জিজ্ঞেস করল, এ কার মেয়ে উভয়ে উত্তরে বলল, হোরসীসের মেয়ে। ধর্মের ব্যাপারে তারা এতো অন্ধ যে, দুচারটি কথা বলার পরই মেয়ের মা ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু মন্দ কথা বলে ফেলল। একথাও বলল, আপনারা আমাদের অপমানিত আর অপদস্ত করার জন্যই বার বার আসেন।

অফিসারটি এবার রহস্য উন্মোচন করার জন্য নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করল। সে মেয়েটিকে ধরে নিয়ে গিয়ে নীল নদের একেবারে উঁচু তীরে দাঁড় করিয়ে দিল। দুজন সৈন্যকে নির্দেশ দিল, তারা যেন মেয়েটিকে তীর থেকে একটু দূরে দাঁড় করিয়ে তার ডান ও বাম পার্শ্বে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সে পল্লীর লোকদের বলল, আমি এখনই এই মেয়েকে নীল নদে নিক্ষেপ করব। যদি তার মা তাকে বাঁচাতে চায় তাহলে যেন সে তাকে এসে নিয়ে যায়। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, তার মাতাপিতার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না। আমি তোমাদের চিন্তা করার কিছু অবকাশ দিচ্ছি। তাড়াহুড়োর কোন দরকার নেই। ভালভাবে বুঝে নাও।

মেয়েটি নীলনদের তীরে দাঁড়িয়ে আছে। তার দুপার্শ্বে দু সৈন্য। রোমান অফিসারটি পল্লীবাসীদের ও মেয়েটির মাঝে পায়চারী করছে। অফিসার তথ্য উদ্ধারে দারুণ ব্যবস্থা নিয়েছে। কারণ, কোন মাতাই সহ্য করতে পারবে না যে, তার সন্তানকে তার চোখের সামনে এ নদীর এই ভয়ঙ্কর স্রোতের মাঝে নিক্ষেপ করা হবে আর সে নির্বিচার চিত্তে তা দেখবে। আসল পিতামাতার মতো তো হোরসীস ও তার স্ত্রীর স্নেহ মায়া ও মমতা হতেই পারে না। তাই এটাই আশা করা হচ্ছিল, মেয়েটির মা ছুটে এসে তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় লুটিয়ে পড়বে। তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু যা ঘটল তা কেউ কল্পনায়ও কখনো ভাবেনি।

হঠাৎ সবাই বিস্মিত নয়নে দেখল, পল্লীর এক পার্শ্ব থেকে এক ঘোড়া ধূলা উড়িয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে এল। সবাই সেদিকে তাকিয়ে রইল। অশ্বারোহী রোমান বাহিনীর একজন উচ্চ পদস্থ সৈন্য। চোখের পলকে তার ঘোড়াটি মেয়েটির দিকে ছুটে গেল।

অশ্বারোহী চিৎকার করে আওয়াজ দিল, আইনী হুশিয়ার! মেয়েটি দেখল, ঘোড়াটি তার দিকে ছুটে এসেই অশ্বারোহী হাত প্রসারিত করে তাকে তার পশ্চাতে তুলে নিতে চাচ্ছে। মেয়েটি চোখের পলকে তার পশ্চাতে উঠে বসল। ঠিক তখন যে সৈন্য দুজন দুপাশে দাঁড়িয়ে ছিল ঘোড়ার সামনে এসে দাঁড়াল। সে তাদের এমনভাবে আঘাত করল যে তাদের একজন নদীবক্ষে গিয়ে পড়ল। আরেকজন ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল।

তারপরই ঘোড়া উল্কার গতিতে ছুটে চলল। মেয়েটি দুহাতে অশ্বারোহীর কোমর ধরে আছে আর ঘোড়া ছুটে চলছে। রোমান সৈন্যদের ঘোড়া অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। আফিসার তার পশ্চাদ্ধাবন করতে নির্দেশ দিলেন।

নির্দেশ পেয়ে কয়েকজন সৈন্য ছুটে গিয়ে ঘোড়ায় চড়ল। ঘোড়া ছুটল পিছু পিছু। কিন্তু ইতিমধ্যে সে ঘোড়া বহু দূর চলে গেছে। দূর থেকে শুধু তার পদধ্বনি শোনা যায়। ধূলি বালু উড়িয়ে সে বহুদূর চলে গেছে। পশ্চাদ্ধাবন করে আর কোন লাভ নেই। কারণ সামনে পাহাড়ী পথ ও ঝোঁপ ঝাড়। রোমান সৈন্যরা আরো কিছু দূর গিয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে এল।

***

রোমান এ সৈন্যের নাম ইবনে সামির। যুবক, সুশ্রী, অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী। সে যখনই টহল দিতে বেরুত তখনই এ পল্লীতে এসে উপস্থিত হত। একদিন এক নির্জন পথে আইনী ও ইবনে সামির মুখোমুখী হল। ইবনে সামির পথ রোধ করে দাঁড়াল। আইনীর চোখে মুখে ভূবন মোহিনী মৃদু হাসির ঝলক ফুটে উঠল। তারপরই তার নিষ্পাপ নির্মল চেহারায় ভয়ভীতির ছাপ ফুটে উঠল।

আইনী মিষ্টি ভাষায় বলল, আপনি রোমান সৈন্য তাই-না? আপনারা যা খুশি তাই করতে পারেন। আমাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উত্থাপন করাই যথেষ্ট যে আমরা মিসরী খ্রিস্টান। রাজকীয় খ্রিস্টান ধর্মকে আমরা মানি না। আচ্ছা আপনি কি আমাকে তুলে নিয়ে যাবেন?

এতক্ষণ পর্যন্ত ইবনে সামিরার অন্তরে একটি রোমান রোমান ভাব বিরাজমান ছিল। আত্ম অহংকারে বিভোর ছিল। কিন্তু আইনীর মার্জিত সুমিষ্ট কথা ও নমনীয় ভাব তার হৃদয়কে প্রভাবিত করল। সে পথ ছেড়ে দিল। কিন্তু আইনী পালিয়ে না গিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

ইবনে সামিরার কণ্ঠে এবার কথা ফুটে উঠল। বলল, আইনী! আমি তোমার নাম জানি। দূর দূর থেকে তোমাকে দেখি। পছন্দ করি। আমার বদ নিয়ত থাকলে তোমাকে তুলে নেয়া আমার জন্য কোন মুশকিল বিষয় নয়। আমি তোমার পিতা-মাতাকে যে কোন সময় ক্যাম্পে ডেকে নিতে পারি। তাহলে তুমিও স্বেচ্ছায় ক্যাম্পে ছুটে আসবে।

ইবনে সামিরের কথায় আইনী মুগ্ধ হল। কথার আবেশে আইনী যেন তার প্রেমের জালে পা দিল। এরপর কয়েকবার আইনী ইবনে সামিরের সাথে সাক্ষাৎ করেছে। ইবনে সামিরা আইনীকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, সে কিছুতেই তার ইজ্জত ও মর্যাদায় আঘাত করবে না। বরং সে তার ইজ্জত ও মর্যাদার এক বিশ্বস্ত প্রহরী।

একদিন আইনী ইবনে সামিরের সাথে সাক্ষাৎ করলে ইবনে সামির বলল, আজ আমি তোমাকে আমার জীবনের এক রহস্যময় কথা বলব। আমার বিশ্বাস, এখন তুমি আর আমার ক্ষতির চিন্তা করতে পারবে না। আমি তোমাকে এতটুকু বিশ্বাস করি। আসলে আমি রাজকীয় খ্রিস্টান ধর্মের বিশ্বাসী নই। সম্রাট হিরাক্লিয়াস আর পাদ্রী কীরাসের ধর্মমতকে আমি মানি না। আমার অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হলেন মহান পাদ্রী বিন ইয়ামীন। তিনি মেয়েদের নীল নদে বিসর্জনের পক্ষপাতী নন। তিনি এর ঘোর বিরোধী।

ইবনে সামিরা আর আইনী উভয়ে খ্রিস্টান। ইচ্ছে করলেই দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। কিন্তু ইবনে সামিরা মনে করে আইনীর পিতা মাতার অনুমতি নেয়াটা জরুরী বিষয়। একদিন সে আইনীর পিতামাতার সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছে। তখন তারা একে অপরের দিকে রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিরব থেকেছে। কিছুক্ষণ পর আইনীর পিতা বলেছে, আমি ভেবে চিন্তে আইনীকে আমার মতামত বলে দিব। আইনীর থেকে তা জানতে পারবে।

পরদিন ইবনে সামিরা টহল দেয়ার নামে পল্লীতে এলে আইনী পল্লীর বাইরে নির্জনে গিয়ে তার সাথে মিলিত হল। বলল, না, ইবনে সামিরা! আমার পিতামাতার কেউ এতে রাজি নয়। তারা বলছেন, ফৌজের লোকদের বিশ্বাস করা যায় না। তাছাড়া ফৌজের লোকেরা রাজকীয় খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী হয়।

ইবনে সামিরা বলল, আমার ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপারে তুমি তাদের কিছু বলছ?

আইনী বলল, হ্যাঁ, আমি তাদের বলেছি, ইবনে সামিরা রাজকীয় খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী নয়। সে মহা পাদ্রী বিন ইয়ামীনের অনুসারী। আমাদের মতই তার ধারণা বিশ্বাস। আমার কথা শুনে পিতা বলেছেন, তাহলে সে মিথ্যা বলেছে। ফৌজের কোন লোকই হিরাক্লিয়াসের মনোনীত পাদ্রী ছাড়া অন্য কোন পাদ্রীর অনুসরণ করতে পারে না। তারপর পিতা আমাকে বলেছে, তুমি ইবনে সামিরার সাথে আর দেখা সাক্ষাৎ করবে না।

ইবনে সামিরা বলল, সে যাই হোক। কিন্তু তোমার ফয়সালা কি?

উত্তরে আইনী বলল, আমার অন্য কোন ফয়সালা হতেই পারে না। আমি আন্তরিকভাবে ধর্মীয় ক্ষেত্রে কোন দল, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ে বিশ্বাসী নই। আমি আমার পিতামাতার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার চেষ্টা করব। তারা যদি না মানে তাহলে আমি তোমার নিকট চলে আসব।

***

আইনী তার পিতামাতার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। ঠিক তখন এ কাণ্ড ঘটল। ইবনে সামিরা দেখল, আইনীকে হোরসীসের মেয়ে বানিয়ে অফিসারের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। ইবনে সামিরা তা দেখে নিরব রইল।

তারপর যখন অফিসার আইনীকে নিয়ে নীল নদের তীরে দাঁড় করিয়ে দিল এবং ঘোষণা করল, যারা এ মেয়ের পিতামাতা তারা যেন এগিয়ে আসে অন্যথায় তাকে নীল নদে নিক্ষেপ করা হবে। ইবনে সামিরা দেখল, আইনীর প্রকৃত পিতামাতা এখন আর সামনে আসবে না। আর হোরসীসও সত্য বলবে না। ফলে রোমান অফিসারটি বাধ্য হয়ে তাকে নীল নদে নিক্ষেপ করবে। তখন ইবনে সামিরা সবার অজান্তে পল্লীতে চলে গেছে। দৌড়ে গিয়ে তার ঘোড়ায় লাফিয়ে উঠেছে। তারপরই ছুটে এসে আইনীকে নিয়ে ঝড়ের বেগে উধাও হয়ে গেছে।

রোমান অফিসারটি রাগে ক্রোধে অধীর হয়ে গেল। সে দেখল, হোরসীসও তার স্ত্রীর চেহারায় বেদনা বা আক্ষেপের কোন আলামত নেই। নির্বিকার প্রশান্ত তাদের চেহারা। কিন্তু তাতেকি হবে। কারা যে মেয়েটির পিতামাতা তা তো জানা যাচ্ছে না। কিন্তু যারাই পিতামাতা হোক তাদের তো এখন স্থির থাকার কথা নয়। তারা কিভাবে মেনে নিতে পারে যে, তাদের মেয়েকে এক সৈন্য নিয়ে পালিয়ে গেছে। এতো কিছুতেই সহ্য করা যায় না।

ইতিমধ্যে অফিসারটির দিকে আইনীর পিতা এগিয়ে এল। বলল, যে সৈন্যটি আমার মেয়ে আইনীকে নিয়ে পালিয়ে গেছে সে কে? কি তার পরিচয়? এতক্ষণ পর অফিসার সঠিক তথ্য উদ্ধার করতে পেরে ক্রোধে আগুন হয়ে গেল। সাথে সাথে নির্দেশ দিল এ পল্লীতে আগুন লাগিয়ে দাও।

অফিসারের নির্দেশ শুনে সবাই হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। অনেকেই কাঁদতে কাঁদতে তার পায়ে লুটিয়ে পড়ল। অফিসার সবাইকে নিরব হতে নির্দেশ দিল। বলল, সবার হয়ে তোমাদের মধ্য থেকে একজন কথা বল।

কিন্তু সবাই বলল, হুজুর! আমরা অশিক্ষিত মূর্খ মানুষ। কুলি মজুর জেলে। ধর্মের বিষয় সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। পাদ্রীরা আমাদের যা বলে আমরা তাই মেনে নেই। কোন পিতামাতাই তার যুবতী কন্যাকে নীল নদে নিক্ষেপ করতে চায় না। কিন্তু হুজুর আমাদের তো কিছুই করার নেই। পাদ্রীর নির্দেশ আমাদের বাধ্য হয়ে মানতে হয়। আমরা নিরূপায়। আমরা জুলুমের শিকার। ঐ পাদ্রীরা এসব ঘটায়।

রোমান অফিসার বলল, আমিও তোমাদের মতই খ্রিস্টান। কিন্তু আমি ঐ নীল নদে মানব সন্তান বিসর্জন দেয়াকে পাপ ও অমার্জনীয় অপরাধ মনে করি। আমরা যেখানে বিশ্বাস করি যে, হযরত ঈসা (আ.) মৃতদের জীবিত করেছেন সেখানে আমরা কীভাবে ঈসা (আ.)-এর নামের দোহাই দিয়ে জীবিতকে মারতে পারি? ঈসা (আ.) তো জীবনেও কাউকে হত্যা করেন নি। বরং তিনি কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করেছেন। দুনিয়ার মানুষের মাঝে ক্ষমা, ভালবাসা, আর প্রেমের কথা বলে গেছেন। হিংসা, বিদ্বেষ, হত্যা ইত্যাকার অপরাধ বর্জনের আহবান জানিয়েছেন। তোরমা কি জান না আমাদের খোদা কে? আমাদের খোদা ঐ মহান সত্ত্বা যার পরিচয় হযরত ঈসা (আ.) আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। নীল নদী আমাদের খোদা নয়। এটা কখনো হতে পারে না যে, খোদা একজন নিষ্পাপ নির্দোষ মানুষের হত্যা দেখে আনন্দিত ও বিমুগ্ধ হবেন!

তারপর অফিসারটি হোরসীসকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমার সাথে মিথ্যা বললে কেন?

হোরসীস বলল, আমার মাত্র একটি সন্তান ছিল। আমি আমার সে মেয়েটিকে আদর সোহাগ দিয়ে লালিল পালিত করেছি। কিন্তু তারা বড় পাদ্রীর নির্দেশে তাকে নীল নদীবক্ষে বিসর্জন দিয়েছে। হুজুর আমি কখনো আপনাকে এ কথা বলতাম না। কিন্তু দেখছি, আমার একার অপরাধে আপনি আমাদের পল্লীটি জ্বালিয়ে দেবেন। তাই বলতে বাধ্য হলাম। যদি আমার এ অপরাধের কারণে পল্লীর লোকেরা আমাকে গাদ্দার হিসাবে চিহ্নিত করে ও শাস্তি দিতে চায়, তাহলে আমি তা মাথা পেতো বরণ করে নিব।

অফিসার গম্ভীর কণ্ঠে বলল, এ ভয় তুমি অন্তর থেকে দূর করে দাও। আমার উপস্থিতিতে কেউ তোমাকে কিছু বলতে পারবে না। আমি তোমাদের প্রশংসা করতে বাধ্য হচ্ছি। তোমাদের মাঝে ঐক্যের দুর্লভ এক গুণ রয়েছে। আমি তেমাদের এ ঐক্যকে অটুট রাখতে চাই। তোমাদের পল্লী কেউ জ্বালাতে পারবে না। তবে যদি এ পল্লীর কোন যুবতাঁকে আবার নদীবক্ষে উৎসর্গ করা হয় তাহলে সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিধান মতে তোমাদের শাস্তি দেয়া হবে।

জনৈক ব্যক্তি বলল, হুজুর! আমরা তো আমাদের বড় পাদ্রীর নির্দেশ মেনে চলি। অফিসার তখন বড় পাদ্রীর নাম ধাম ও ঠিকানা জেনে নিল। তার সাথে কারা কারা এ কাজের সাথে জড়িত তাদের নাম ঠিকানাও জেনে নিল। হোরসীস জেলে পল্লীর সর্দার বাবাজ্বীর কথাও বলে দিল ও তার ঠিকানাও দিয়ে দিল।

সাথে সাথে রোমান অফিসারটি সকল সৈন্যকে একত্রিত করে বড় পাদ্রীর পল্লীর দিকে ঘোড়া ছুটাল। পল্লীতে বড় পাদ্রীকে ও তার সাঙ্গপাঙ্গকে পেয়ে তাদের গ্রেফতার করল। তারপর সে রাতেই জেলে পল্লীর সর্দার বাবাজ্বীকেও গ্রেফতার করে আনল।

***

পরদিন সেই রোমান অফিসার ঘোড়ায় চরে আবার সেই পল্লীতে গিয়ে উপস্থিত। আজ তার সাথে উচ্চ পদস্থ আরেক জন সামরিক অফিসার রয়েছে। তাদের পশ্চাতে রয়েছে বড় পাদ্রী, পাদ্রীর তিন চারজন অনুসারী, জেলে পল্লীর বাবাজ্বী। এদেরকে শিকলে বেঁধে আনা হয়েছে। তাদের পায়ে লোহার বেড়ী লাগান। পল্লীর সবাইকে বাইরে একত্রিত করা হল। শিকলাবদ্ধ সবাইকে নীল নদের ঐ উঁচু স্থানে নিয়ে দাঁড় করানো হল যেখান থেকে নীল নদে কুমারী মেয়েদের উৎসর্গ করা হয়।

উচ্চ পদস্থ সামরিক অফিসারটি বজ্র নিনাদ কণ্ঠে বলল, তোমরা এই লোকগুলোকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখ। এবারই তো ঐ লোক যারা ঐ স্থান থেকে এক কুমারী মেয়েকে নীল নদে নিক্ষেপ করে বিসর্জন দিয়েছিল। তারপর হোরসীসের মেয়েকেও বিসর্জন দিয়েছে।

হোরসীসের কণ্ঠ শোনা গেল, বলল, হ্যাঁ তারাই।

আরো দুতিন জন বলল, হ্যাঁ তারাই।

অফিসারটি ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, সবাই বল, এবার সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ তারাই।

অফিসারটি ইংগিতে কি যেন বলল। অমনি একজন সৈন্য ছুটে গিয়ে তাদের পায়ের ভেড়ী ও হাতের শিকল খুলে তাদের নীল নদের তীরে দাঁড় করিয়ে দিল। অন্য কয়েকজন সৈন্যের হাতে তীর ও ধনুক ছিল। অফিসারের ইশারায় তারা ধনুকে তীর যোজনা করল। তারপর আবার ইশারা করা মাত্র ধনুকগুলো থেকে সাঁ সাঁ করে তীর উড়ে এসে তীরে দাঁড়ানো সকলের শরীরে বিদ্ধ হল। তাদের কয়েকজন আর্ত চিৎকার করে নীল নদে ধপাস করে পড়ে গেল। দুএকজন বেঁকে তীরে লুটিয়ে পড়ল। তাদেরকে সৈন্যরা পা দিয়ে লাথি মেরে পানিতে ফেলে দিল।

ঠিক তখন ইবনে সামির ও আইনী ঘোড়ায় চড়ে বহু দূরের এক বালুকাময় প্রান্তর অতিক্রম করছে। আইনী ইবনে সামিরের পিছনে ঘোড়ায় বসে আছে।

আইনী বলল, আমার শুধুমাত্র পিতামাতার কথা মনে পড়ে। আর তখন হৃদয় অস্থিরতায় ছটফট করতে থাকে। মনে হয় রোমান সৈন্যরা তাদের মেরে ফেলেছে।

ইবনে সামির বলল, আইনী! জীবনকে সফল করতে হলে কিছুতো কোরবানী দিতেই হয়। আমারো তো পিতামাতা আছে। তা সত্ত্বেও আমি আমাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলাম। ধরা পড়লেই আমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া হবে। আমি সেনা বাহিনীর আইনের বিরুদ্ধাচরণ করেছি। দুজন সৈন্য হত্যা করে তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়েছি। এখন আর পিছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। সামনের দিকে ছুটে চল। আমি তোমাকে মহা পাদ্রী বিন ইয়ামীনের নিকট নিয়ে যাচ্ছি। তিনি হয়তো বাঁচার কোন পথ দেখিয়ে দিবেন।

ইবনে সামির বিন ইয়ামীনের ঠিকানা জানত। কারণ সে বিন ইয়ামীনের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করত।

***

সম্রাট হিরাক্লিয়াস মহাপাদ্রী কীরাসকে যে কোন ধরনের নির্যাতন নিপীড়ন করে রাজকীয় খ্রিস্ট ধর্মকে গির্জায় প্রতিষ্ঠিত করার শক্তি ও ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছিল। পাদ্রী কীরাসের আঙ্গুলী হেলনে কেঁপে উঠত রোমান সৈন্য আর সেনাপতিরা। সকলে অবলীলায় তার নির্দেশ মানত। ধর্মীয় বিষয়ে সৈনিকরা তার হুকুমে নিরপরাধ নিষ্পাপ ব্যক্তিদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাত। নির্যাতনে নিপীড়নে রাজকীয় খ্রিস্টান ধর্ম মানতে বাধ্য হত।

কীরাস যদি শুনতে পেত, অমুক গির্জার পাদ্রী তার নির্দেশ মানে না। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের দেয়া ধর্মমতের বিরোধীতা করে। ব্যস্ এতটুকু সংবাদ-ই যথেষ্ট। তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসত তার বন্দীশালায়। তারপর হয়তো কাউকে বিবস্ত্র করে তার শরীরে জ্বলন্ত অঙ্গার ঠেসে ধরত। বা ফুটন্ত পানি শরীরে ঢেলে দিয়ে ঝলসে দিত। ফলে সে হিরাক্লিয়াসের প্রণীত ধর্ম মানতে বাধ্য হত।

গণমানুষের সামনে প্রকাশ্যে এমন কঠিন শাস্তি দিয়ে মানুষের মনে ভয়ভীতি আর আতঙ্ক সৃষ্টি করত। অপর দিকে হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে গোপন তৎপরতা চলছে পাদ্রী বিন ইয়ামীনের নেতৃত্বে। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ত তার নির্দেশ নামা। সাম্রাজ্যের চরদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মিসরের ঘরে ঘরে তা পৌঁছে যেত। সাম্রাজ্যের উঁচু-উঁচু পদে বিন ইয়ামীনের ভক্তরা নিরবে কাজ করত। জনমত সৃষ্টি করত। রোমান সৈন্যদের মাঝেও অনেকে বিন ইয়ামীনের ভক্ত। তার ধর্মদর্শনে বিশ্বাসী। ইবনে সামির তাদেরই একজন। তার বিশ্বাস, সম্রাট হিরাক্লিয়াসের হাত থেকে বাঁচতে হলে বিন ইয়ামীনের নিকট যেতে হবে। তিনিই তার এ সমস্যার সমাধান দিতে পারবেন।

***

আরো এক রাত ও একদিন ইবনে সামির ও আইনীকে পথেই কাটাতে হল। পরদিন তারা পাদ্রী বিন ইয়ামীনের নিকট গিয়ে পৌঁছল।

বিন ইয়ামীন দূরদর্শী। হাজার অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক। ইবনে সামিরকে দেখে হেসে হেসে বলতে লাগল, ইবনে সামির! কি করে এলে? আর এই মেয়েটি কে?

তার কণ্ঠ থেকে মায়াময় মিষ্টতা ছড়িয়ে পড়ল। মনে হল যেন ইবনে সামিরের পথের সকল ক্লান্তি আর অবসাদ দূর হয়েছে গেছে।

ইবনে সামির মাথা নীচু করে বলল, হুজুর! আমিতো আমার আকীদা বিশ্বাসের জন্য উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু করতে পারিনি। তবে এ মেয়েটির জীবন রক্ষার জন্য আর আমার হৃদয়ে সুপ্ত আকাক্ষা বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল। আপনার দোয়ার বদৌলতে বেঁচে আসতে পেরেছি।

বিন ইয়ামীনকে ঘটনা বিস্তারিত শুনাল।

ঘটনা বর্ণনা শেষ হলে বিন ইয়ামীন শির দুলিয়ে বলল, খারাপ কিছু তো করনি। তুমি তোমার মহব্বতকে জীবিত রাখতে আর তোমার প্রেমাস্পদকে উদ্ধার করতে যে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে সত্যই তা প্রশংসনীয়। তুমি কিছুদিন আত্মগোপন করে থেকো।

ইবনে সামির বলল, আত্মগোপন করে তো থাকতেই হবে। কিন্তু নির্মা হয়ে বসে থাকতে চাই না। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের মনগড়া ঐ ধর্মমতকে উৎখাত করতে কিছু একটা করতেই হবে। আমি কি করব, আমাকে তার নির্দেশ দিন। আমি যে কোন কুরবানী দিতে প্রস্তুত।

বিন ইয়ামীন তখন কিছু পাদ্রীয়ানা তাত্ত্বিক কথাবার্তা শুরু করল।

ইবনে সামির বলল, সম্মানিত মহামান্য মহাপাদ্রী! আমি মূর্খ। ধর্মীয় জ্ঞান বলতে কিছুই নেই আমার। তাই আপনার জটিল ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা বুঝার সামর্থ আমার নেই। আমি একজন সৈনিক। যুদ্ধ, হত্যা আর রক্তপাত আমার কাজ। সহীহ আকীদা-বিশ্বাস ও ধর্মমত প্রচার ও প্রসারের জন্য কাকে হত্যা করতে হবে, কাকে শাস্তি দিতে হবে, এ ধরনের নির্দেশ আমাকে দিন। আমি তা দক্ষতার সাথে পালন করতে পারব।

বিন ইয়ামীনের রহস্যময় কথা। বলল, সবকিছুর আগে এখন তোমাকে নিজের বাঁচার কথাই চিন্তা করতে হবে। তুমি সেনাবাহিনীর বিধান লঙ্ন করে যে অপরাধ করেছে তার যে কি শাস্তি তা তোমার জানা আছে। এখন আত্মগোপন করে থাক। কিছুদিন কেটে গেলে তোমাকে ছদ্মবেশে কাজে লাগান হবে।

ইবনে সামির বলল, আমি একটি কথা বলতে চাই। সম্রাট হিরাক্লিয়াস ধর্মকে অপমান করে যে শিক্ষা ইতিমধ্যে পেয়েছে তা থেকে কিন্তু সে একটুকুও গ্রহণ করেনি। গোটা শাম তার করতল মুক্ত হয়ে গেল। মুসলমানরা একটার পর একটা দুর্ভেদ্য শহর পদানত করে নিল। তার বাহিনীর অর্ধেকের চেয়ে বেশী সৈন্য রণাঙ্গনে কচুকাটা হয়ে শেষ হয়ে গেল। এখন যে সৈন্যগুলো তার অধীনে আছে তাদের মাঝে মুসলমানদের এমন ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে যে, যদি কেউ কৌতূহল বশতঃ একথা ছড়িয়ে দেয় যে, মুসলমানরা মিসর আক্রমণে এগিয়ে আসছে, ব্যস্ এ সংবাদ শুনেই মিসরের বাহিনীর কণ্ঠ শুকিয়ে যাবে। পালাই পালাই করে নিমিষে সেনা ক্যাম্প শূন্য হয়ে যাবে।

বিন ইয়ামীন বলল, ইতিহাস জ্বলন্ত সাক্ষ্য। কাল প্রবাহে যে কেউ ধর্ম নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চেয়েছে সে-ই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ইসলামের মত খ্রিস্টবাদ এমন এক ধর্ম যে ধর্ম সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। সম্রাট হিরাক্লিয়াস সেই আসমানী কিতাবকে বিকত করেছেন। অহঙ্কারে মদমত্ত হয়ে ধর্মকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছেন। সে এখন দিশেহারা। আমি দিব্য চোখে দেখছি, মিসর তার হাত থেকে ছুটে যাচ্ছে। ধর্মানুসারীদের এভাবে দলে-উপদলে বিভক্ত করলে অন্ধকার ভবিষ্যৎ ধেয়ে আসবে।

ইবনে সামির বিজ্ঞেস করল। মুসলমানরা কি মিসর আক্রমণ করতে যাচ্ছে।

বিন ইয়ামীন বলল, ইতিমধ্যে হয়তো তারা মিসরের উপকণ্ঠে পৌঁছে যেত। কিন্তু মুসলমানদের উপর এমন এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের আযাব এসেছে যার কারণে গোটা আরবের লোকেরা অনাহারে মৃত্যুবরণ করছে। আমি সর্বদা সেখানের সংবাদ পাচ্ছি। দুর্ভিক্ষ শেষ না হলে মুসলমানরা মিসর আক্রমণ করবে না।

ইবনে সামির বলল, মহামান্য পাদ্রী! আমার মনে হঠাৎ একটি চিন্তা উঁকি দিয়েছে। মুসলমানরা যদি মিসর আক্রমণ করে তাহলে তো আমাদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু আমি চিন্তা করেছি, যেভাবে মুসলমানরা সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে তাদের দুশমন মনে করে ঠিক সেভাবে তারাও তো আমাদের দুশমন। তাহলে কি আমরা সে সময় সম্রাট হিরাক্লিয়াসের অফাদারী করব?

বিন ইয়ামীনের কণ্ঠ অত্যন্ত গম্ভীর শোনা গেল। বলল, হ্যাঁ, এ বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। শামের তিনজন মুসলমান গুপ্তচর আমার নিকট এসেছিল। তারা নিজেদেরকে খ্রিস্টান বলে প্রকাশ করেছিল। কিন্তু আমি বুঝে ফেলেছিলাম যে, তারা গুপ্তচর। তারা আমার থেকে জানতে এসেছিল, যদি মুসলমানরা মিসর আক্রমণ করে তাহলে খ্রিস্টানরা যুদ্ধের আগেই সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে না যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায়? তাদের খলীফা বা সিপাহ সালারের উদ্দেশ্য, প্রথমে হিরাক্লিয়াসকে মিসর থেকে তাড়িয়ে দেয়া হোক, তারপর মুসলমান ও খ্রিস্টানরা পরস্পরে নিজেদের বিরোধ মীমাঙসা করে নিবে।

তোমার প্রশ্নের উত্তর হল, যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে তখন মিসরের খ্রিস্টানরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখবে। তবে এটা এখন আমার শেষ ফয়সালা নয়।  একথা সত্য যে, মিসরীয়দের কিছুতেই সম্রাট হিরাক্লিয়াসের পাশে দাঁড়ানো উচিত নয়।

কেউ একজন যুবতী মেয়কে নিয়ে পালিয়ে এসেছে এটা খ্রিস্টান সমাজে কোন অপরাধের বিষয় নয়। তা নিয়ে ইবনে সামিরের কোন মাথা ব্যথাও নেই। কিন্তু দুজন সৈন্যকে হত্যা করে পালিয়ে আসা এক গুরুতর অপরাধ। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তাই ইবনে সামিরকে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতেই হবে।

***

আরবের সেই দুর্ভিক্ষের কারণে সব পরিকল্পনা যেন ভণ্ডুল হয়ে গেল। আমর ইবনে আস (রা.)-এর মনে একবারও আর মিসর আক্রমণের কথা উদয় হয় না। দুর্ভিক্ষগ্রস্থ আরবদের খাবার সংগ্রহ করা ও কাফেলা বোঝাই করে তা পাঠানোই এখন তার প্রধান দায়িত্ব। ইরাক ও শামের গভর্নররা এখন একাজেই ব্যস্ত। এভাবে নয় মাস কেটে যাওয়ার পর তাঁরা সংবাদ পেল, আল্লাহ্ তাআলা রহমেরত বারি বর্ষণ করেছেন। আরবদের মাঝে আবার স্বস্তি ফিরে এসেছে। রুক্ষ ও জ্বলে পুড়ে প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া বাগানগুলোতে আবার সজীবতা ফিরে এসেছে। খেজুর গাছের কাণ্ডে কাণ্ডে আবার কাদি দেখা দিয়েছে। গাছের ডালে ডালে আবার পাখিরা গান ধরেছে।

এ সংবাদ শুনে ইরাক ও মিসরের গভর্নররা শান্ত হল। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। আবার আত্মচিন্তা তাদের মাঝে ফিরে এল। রাবেয়াকে সে বারই আমর ইবনে আস (রা.) ওয়াইসের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। ওয়াইসের সাথে তার দুজন সাথী যারা মিসর গিয়ে বিন ইয়ামীনের সাথে সাক্ষাৎ করেছিল সে গুপ্তচর দুজনও শামেই থাকত। দুর্ভিক্ষ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) আমর ইবনে আস (রা.)-এর নিকট বার্তা পাঠালেন যেন মিসরে প্রেরিত গুপ্তচর তিন মুজাহিদকে তারেদ স্ব স্ব স্থানে প্রেরণ করা হয়। ওয়াইস আলেপ্পার অধিবাসী। আলেপ্পার মুজাহিদ বাহিনীর সে একজন সদস্য ছিল। তাই সে আলেপ্পায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ পেল। মিসর থেকে ফিরে আসার পরই রাবেয়া বার বার ওয়াইসের নিকট বিনীত আবেদন করত যেন তাকে তার পিতামাতার সাথে দেখা করা সুযোগ দেয়া হয়।

ওয়াইস তাকে বলত, সে যেন তার পিতামাতা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করার জন্য এতো অস্থির ও উতলা না হয়। কারণ তারা তাকে দেখে আনন্দিত হবে না। তারা তার ইসলাম গ্রহণকে সহজে মেনে নিতে পারবে না। যেমন আমার পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনরা তা সহজে মেনে নিতে পারেনি।

এ সবকিছু শোনার পরও রাবেয়ার নারী মন পিতামাতার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। সে প্রায়ই ওয়াইসকে বলে, আমি অবশ্যই আমার পিতামাতার সাথে সাক্ষাৎ করব। এর এক কারণ হল তারা আমার পিতামাতা। দ্বিতীয়ত আমার ইচ্ছে হয়, আমি তাদের নিকট ইসলাম ধর্মের দাওয়াত পৌঁছাই। রাবেয়ার এ কথা শুনে ওয়াইস হাসত। সে হাসি ছিল রহস্যময়।

সিপাহ সালারের নির্দেশে ওয়াইস আলেপ্পায় ফিরে এলে রাবেয়াও তার সাথে আলেপ্পায় চলে এল। এবার যেন তার আনন্দ কেউ ধরে রাখতে পারবে না। রাবেয়ার প্রত্যয়, সে এবার অবশ্যই তার পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়দের সাথে সাক্ষাত করবে এবং ইসলামের সৌন্দর্য, কমনীয়তা তাদের সামনে তুলে ধরে তাদের ইসলাম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করবে।

***

আলেপ্পায় পৌঁছে ওয়াইস রাবেয়াকে তার বাসায় নিয়ে গেল। আগে ওয়াইসের কোন বাসা ছিল না। ছাউনীতে মুজাহিদদের সাথে থাকত। কিন্তু রাবেয়াকে বিয়ে করে সাথে নিয়ে এলে তার জন্য একটি ছোট্ট বাসা বরাদ্দ করা হয়। সে বাসায় ওয়াইস রাবেয়াকে নিয়ে উঠে। আলেপ্পায় পৌঁছার পর রাবেয়া তার পিতামাতার সাথে দেখা করতে অস্থির ব্যাকুল হয়ে গেল। তাই একদিন ওয়াইস রাবেয়াকে নিয়ে রওয়ানা দিল। কিন্তু যাওয়ার প্রাক্কালে রাবেয়াকে বুঝিয়ে বলল যে, আমি তোমর সাথে যাব কিন্তু প্রথমেই তোমাদের বাড়িতে প্রবেশ করব না। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব। যদি তোমার পিতামাতা আমাকে সানন্দে গ্রহণ করতে পারেন তাহলেই আমি অন্দরমহলে প্রবেশ করব। তাই তুমি প্রথমে পরিস্থিতি অনুধাবন করে আমাকে সংবাদ দিবে।

বাড়িতে পৌঁছে ওয়াইস বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। রাবেয়ার বয়স কম। অভিজ্ঞতাও অল্প। কিশোর কিশোরীদের মত আনন্দের আতিশয্যে লাফাতে লাফাতে সে বাড়িতে প্রবেশ করল। বাড়ির লোকেরা তাকে দেখে প্রথমে ভয় পেয়ে গেল। কারণ তারা জানে, রোজী পাগল হয়ে চলে গেছে। এক বৎসরের চেয়ে বেশী সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই সে মৃত্যুবরণ করেছে। রোজী কখনো ফিরে আসতে পারে না। এ হয়তো তার প্রেতাত্মা!

রাবেয়া অন্দর মহলে প্রবেশ করে পিতামাতা ও অন্যান্যদের দেখে বলল, আপনারা কেমন আছেন? আমি এখনো জীবিত আছি। বরং আগের চেয়ে অনেক ভাল অবস্থায় আছি।

মা মেয়েকে দেখে অস্থির কণ্ঠে দুহাত প্রসারিত করে বলল, হায় আমার রোজী! তুই এখনো দুনিয়াতে আছিস!

রাবেয়া বলল, মা, আমি আর তোমাদের সেই রোজী নই। আমি রাবেয়া হয়ে গেছি। আমি মুসলমান। আমার স্বামী বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে ভিতরে ডেকে আনছি।

মেয়ের কথা শুনে মায়ের প্রসারিত হাত নীচে নেমে এল। সে তার ইসলাম গ্রহণ করাকে মেনে নিতে পারল না। কিন্তু রাবেয়ার মনে তখন আনন্দের। ফল্গধারা। বাড়ির লোকেরা তার ইসলাম গ্রহণের কথা যে মেনে নিতে পারছে না, তা সে বুঝতে পারল না। সে তখনই ছুটে বাইরে চলে গেল এবং ওয়াইসকে হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির ভিতর নিয়ে এল। ওয়াইস মনে করল, রাবেয়া তার পিতামাতার অনুমতেক্রমেই তাকে ভিতরে আনছে, সে প্রতিবাদ না করে ভিতরে চলে এল।

ভিতরে প্রবেশ করেই ওয়াইস দেখতে পেল রাবেয়ার পিতা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওয়াইস মুসাফাহা করার জন্য দুহাত প্রসারি করে দিল। কিন্তু রাবেয়ার পিতা হাত প্রসারিত করল না। রাবেয়ার মা তাচ্ছিল্যের সাথে ওয়াইসের দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। রাবেয়ার এক বড় ভাই ও তার স্ত্রী বাড়িতে ছিল। তারাও ওয়াইসের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল।

ওয়াইস দারুণ মর্মাহত ও বেদনার্ত হয়ে বলল, রাবেয়া! দেখলে তো? আমি যা বলেছিলাম তাই তো হচ্ছে। তাদের শুনাও, আমি তোমাকে কোথায় পেয়েছি। আর কিভাবে আমি তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করেছি। জামাতার সাথে কি আচরণ করতে হয় এ সৌজন্যবোধটুকুও তাদের নেই।

রাবেয়ার পিতার নিরস কণ্ঠ শোনা গেল। বলল, আমি তোমাকে জামাতা বানাইনি। তুমি ভ্রষ্ট। আমার মেয়েকেও তুমি ভষ্টতার শিকার করেছে। তাই আমরা তোমার সাথে ভাল আচরণ করতে পারছি না। তুমি পথহারা বিভ্রান্ত।

লজ্জা ও ক্রোধে রাবেয়ার চেহারা লাল হয়ে গেল। পিতামাতা, ভাই ও ভাবীর আচরণে সে একেবারে অধীর হয়ে পড়ল। কিন্তু পরক্ষণেই সে তার মনকে শক্ত করে তুলল। তার চেহারায় কেমন যেন কাঠিন্য কাঠিন্য ভাব ছড়িয়ে পড়ল। পরিস্থিতির মুকাবিলা করতে সে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেল। কিন্তু তবুও সে একেবারে প্রশান্ত হতে পারেনি। ক্রোধ মিশ্রিত কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, আপনারা আগে আমার কথা শুনুন। আমার জীবনের উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে গিয়েছিল তা অনুধাবন করুন। আল্লাহ্ তাঁর তিন ফেরেস্তা দ্বারা কিভাবে আমাকে উদ্ধার করালেন তাও শুনুন।

সবাই বসে পড়ল। রাবেয়া ওয়াইসকে তার পাশে বসাল। তারপর তার উপর দিয়ে যে লোমহর্ষক ভয়াবহ ঝড় বয়ে গেছে তা একের পর এক বর্ণনা করল। রাবেয়া বলতে বলতে যতই অগ্রসর হতে লাগল তার পিতামাতা ও পরিজনের অবস্থা ততই স্বাভাবিক হতে লাগল। সবশেষে এসে রাবেয়া বলল, আমি এমন অসহায় ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম যে আমার মৃত্যু ছাড়া বাঁচার উপায় ছিল না। ঠিক তখন ওয়াইস ও তার সঙ্গীদ্বয় ফেরেস্তার মত সেখানে উপস্থিত হয়ে আমাকে উদ্ধার করল। তারা ইচ্ছে করলে আমার সাথে যা তা করতে পারত। কিন্তু তারা আমার সাথে ফেরেস্তার মত আচরণ করেছে।

তাই আমি তাদের চরিত্রগুণে বিমুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছি। আম্মাজান! আপনার নিশ্চয় স্মরণ আছে, আমি এক সময় ওয়াইসকে হৃদয় থেকে কামনা করতাম, যখন সে রবিন ছিল। কিন্তু যখনই শুনতে পেলাম, রবিন ওয়াইস হয়ে গেছে। খ্রিস্ট ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, ঠিক তখনই আমি তাকে ত্যাগ করেছিলাম। আমি বলতে চাচ্ছি, মুসলমানদের যে চরিত্র তা আর কোন জাতির মাঝে নেই। হতেও পারে না। মিসরে গিয়ে দেখুন। খ্রিস্টান বাদশাহ হিরাক্লিয়াস খ্রিস্টানদের রক্তে মিসরের মাটি রঞ্জিত করছে। সেখানের প্রধান সমস্যাই হলো প্রকৃত ও নির্ভেজাল খ্রিস্টধর্ম কোনটি তা নির্ণয় করা সম্রাট হিরাক্লিয়াসের খ্রিস্টধর্ম না জনসাধারণ যে ধর্ম পালন করছে তা?

রাবেয়া তার মনের কথা একের পর এক বলে যাচ্ছে আর ওয়াইস নিরবে। বসে আছে। ঘরের লোকেরা সবাই চুপচাপ শুনছে। সবশেষে রাবেয়া বলল, আমি তো অন্য এক ইচ্ছে নিযে আপনাদের নিকট এসেছি। আমি চাচ্ছি, আপনারা সবাই মুসলমান হয়ে যান।

রবিয়ের পিতার কণ্ঠে আগুনের হলকা। বলল, চুপ কর। কোন মুসলমানদের কথা তুমি বলছো? সে মুসলমান তো এখন আর নেই যাদের স্বভাব চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে অমুসলমানরা মুসলমান হত। ইসলাম মদ পানকে এমনভাবে হারাম করেছে যেমনিভাবে শূকরের গোশতকে হারাম করেছে। কিন্তু এখানে কিছু মুসলমান আছে যার মদ পান করা শুরু করে দিয়েছে। তারা মদ পানকে হালাল মনে করে।

প্রতিবাদী কণ্ঠে ওয়াইস বলল, আপনার একথা আমি মানি না। আপনি বরং এটা বলুন যে, আমার ও আপনার মেয়ের ইসলাম গ্রহণ করাকে আপনি ভাল মনে করছেন না। মুসলমানদের নিয়ে মিথ্যা কথা বলবেন না। মিথ্যা অপবাদ দিবেন না।

রাবেয়ার পিতার দৃঢ় কণ্ঠ। এটা অপবাদ নয়। আমি তোমাকে এমন বহু মুসলমান দেখিয়ে দিতে পারব। আমি তাদের তোমাকে অবশ্যই দেখাব। 

ওয়াইস বলল, হতে পারে এটা তাদের ব্যক্তিগত পাপাচার। তাই বলে, ইসলাম ধর্ম বা খলীফা বা অন্যান্য মুসলমানরা মুসলমানকে তা পান করার অনুমতি প্রদান করে না। আর ইসলাম এসব বৈধ মনে করে না।

রাবেয়ার পিতা দৃঢ়তার সাথে বলল, কিছুদিন পর তুমি নিজেই তা শুনবে, দেখবে। এ ধরনের মদখোরদের কোন বিচার এখন আর হচ্ছে না। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য মুসলমানরাও মদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। তারাও মদ পান শুরু করেছে। মদ সকল পাপের উৎস। মদ পান করলে মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। হাজার রকমের পাপ তখন তার থেকে প্রকাশ পেতে থাকে। যদি এ জাতি মদ পানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তাহলে তাদের ঐ সব স্বভাব চরিত্র নিঃশেষ হয়ে যাবে যার আকর্ষণে অমুসলমান বিমুগ্ধ চিত্তে মুসলমান হচ্ছে।

ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করার কারণে ওয়াইসের মত রাবেয়াও অতিষ্ঠ ও বিরক্ত হয়ে উঠল। শৈশব কাল থেকে রাবেয়া তার পিতাকে দেখে এসেছে ধর্মের ব্যাপার তার পিতা নিরাপোষ। খ্রিস্ট ধর্ম তার শিরায় শিরায় সর্বদা তোলপাড় সৃষ্টি করত। তাই সে চাইল, তার পিতার মিথ্যাচার এখানেই শেষ করে দেয়া দরকার। সে তার পিতাকে বলল, আব্বাজান! আমি আবারো ওয়াইসকে নিয়ে আপনার নিকট হাজির হব। আপনি কি আমাকে তার অনুমতি প্রদান করছেন?

পিতার কণ্ঠস্বর এবার অত্যন্ত উত্তাল মনে হল। বলল, শোন, আমার ঘরের দরজা তোমাদের জন্য চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। তোমরা যদি আবার খ্রিস্ট ধর্মে ফিরে আস তাহলে তোমাদের জন্য আমার হৃদয় ও গৃহের দরজা সর্বদা অবারিত পাবে।

ওয়াইস আর বসে থাকতে পারল না। দাঁড়িয়ে বলল, আমরা আর কখনো ভুলেও আপনার দরজায় আসব না। তারপর রাবেয়াকে তুলে নিয়ে বলল, চল রাবেয়া! আমি আমার লাঞ্ছনা ও অপমান সহ্য করতে পারি কিন্তু ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র অপবাদ ও মিথ্যচার সহ্য করতে পারি না। আমি এখানের আরো কিছু খ্রিস্টানকে মুসলমান বানিয়ে নিব।

এতক্ষণ রাবেয়ার বড় ভাই নিরব ছিল। কোন কথা বলেনি। এবার সে একটু ক্ষীপ্ত কণ্ঠেই বলল, তুমি হয়তো কিছুতেই তা করতে পারবে না। রোজী! তাকে ইসলামের প্রচার থেকে থামিয়ে রাখবি। নইলে

ভাই! আমি রোজী নই। আমি রাবেয়া। তিনি তার ধর্মের জন্য যা ভাল মনে করেন করবেন। আমি তাতে বাধা দিতে পারি না।

ওয়াইস ও রাবেয়া সেখান থেকে আহত হৃদয়ে চলে এসেছে। ফিরে আসার সময় রাবেয়ার ভাই অগ্নিদৃষ্টিতে অপলক নেত্রে তাদের দিকে চেয়ে রইল। সে চোখে ছিল অপমান ও যন্ত্রণার আগুন।

***

ওয়াইস শুধুমাত্র বীর যোদ্ধাই নয়। অত্যন্ত বুদ্ধিমান, চৌকস, দূরদর্শী। তাছাড়া চর বৃত্তিতে তার প্রচুর সুনাম। কিন্তু সেদিনের ঘটনায় সে রাবেয়ার ভাইয়ের মতিগতি বুঝতে পারেনি। সেদিন বিতর্কের শেষের দিকে অত্যন্ত রুক্ষ ভাষায় তার ভাই হুমকির স্বরে বলেছিল, তাকে ইসলাম প্রচার থেকে থামিয়ে রাখবি। নইলে…..একথার মর্ম কি? ইঙ্গিত কি? সে বিষয়টি ওয়াইস লক্ষ্য করেনি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলার পথে ওয়াইস রাবেয়াকে বলল, আর কখনো আমি তোমাকে এখানে নিয়ে আসব না।

রাবেয়ার কণ্ঠে একরাশ বেদনা। বলল, আমি ভাবতেও পারিনি আমার পিতামাতা আমার সঙ্গে এমন আচরণ করবে। তবে একটি কথা স্মরণ রাখবে, আমার পিতা যাই করুন তিনি ধর্মভীরু। কিন্তু আমার ভাই ভাল মানুষ নয়।

ওয়াইসের কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর। বলল, সে আমার কি করতে পারবে। আমাকে কোথায় পাবে!

রাবেয়া যদিও ওয়াইসকে বলেছে যে, তার ভাই ভাল মানুষ নয়। তবে কেমন ভয়ঙ্কর ও দুরন্ধর তা সে ধারণা করতে পারেনি। রাবেয়ার এ ভাই মুসলমানদের ঘোর দুশমন। রোমানদের সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে কয়েকবার মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু এতে তার বিশ্বাস হয়ে গেছে যে, মুখোমুখি যুদ্ধে কখনো মুসলমানদের সাথে পেরে উঠা সম্ভব নয়। তাই সম্মুখ যুদ্ধ ত্যাগ করে সে এবার কূট কৌশলের পথ ধরেছে। গোপনে ধ্বংসাত্মক কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে। ইতিমধ্যে সে কয়েকজন সাঙ্গ-পাঙ্গও জোগার করে নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম শুরু হয়নি। হবে হচ্ছে করতে করতে সময় চলে যাচ্ছিল। রাবেয়া ও ওয়াইসকে দেখে তার সে আগুন যেন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।

অবশ্য ধর্মের আকর্ষণেই যে তার এ অবস্থা এমন নয়। এর পশ্চাতে একটি ব্যর্থতাও কাজ করছিল। তা অনেক আগের কথা। বিয়ের অনেক আগে এক অনিন্দ্য সুন্দরীর সাথে তার ভাব জমেছিল। প্রেমের সেই অঙ্কুরটি এক সময় মহিরুহের রূপ ধারণ করেছিল। পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার জন্য তারা ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু এর মাঝে এক তুফান এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। রাবেয়া ও শারীনার মত সেও এক মুজাহিদের কথাবার্তা আর আচার-আচরণে বিমুগ্ধ-বিমোহিত হয়ে পড়েছিল। এমন কি মুসলমানও হয়ে গিয়েছিল। এবং রাবেয়ার ভাইকে ত্যাগ করে সে মুজাহিদের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিল।

এখন রাবেয়াকে এক নও মুসলিমের পাশে দেখে তার পূর্বের প্রেমের স্মৃতি কথা মনে পড়ে গেল। সাথে সাথে এক ভয়ঙ্কর জিঘাংসা ভাব তার হৃদয়ে লকলকিয়ে উঠল। ওয়াইস ও রাবেয়া চলে যাওয়ার পর পরই সে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেছে। সে তার দুই অনুসারীকে ডেকে ওয়াইস ও রাবেয়ার কথা শুনাল। সব শেষে বলল, ওয়াইস চায় এ গাঁয়ে ইসলাম প্রচার করবে।

এক অনুচর বলল, এতো বড় স্পর্ধা! এতো দুঃসাহস! হুকুম দাও দোস্ত কি করতে হবে? আমাদের গায়ে ইসলাম প্রচারের মজা তাকে দেখিয়ে দিব!

রাবেয়ার ভাই গলার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, কতল। আমরা আজ পর্যন্ত ইসলামের অগ্রযাত্রায় সামান্য বাঁধা সৃষ্টি করতে পারিনি। আমরা শুধুই পরিকল্পনার পর পরিকল্পনা করে আসছি। এবার বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হতে হবে।

হত্যার ব্যাপারে তারা একমত। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু কিভাবে কোথায় তা করতে হবে, এ ব্যাপারে বেশ কিছুক্ষণ শলাপরামর্শ হল। অবশেষে তারা হত্যার এক পদ্ধতি বের করল। কে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ধোকায় ফেলে অকুস্থলে নিয়ে আসবে তাও নির্ধারিত হয়ে গেল।

এরপর চার পাঁচ দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু তারা ওয়াইসকে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলতে পারেনি। কারণ ওয়াইস নিজের কর্তব্য কাজে দারুণ। ব্যস্ত। কারো সাথে কথা বলারও তার ফুরসত নেই।

***

 একদিন বিকালে পড়ন্ত বেলায় ক্লান্ত শ্রান্ত ওয়াইস বাড়িতে ফিরছে। হঠাৎ পথিমধ্যে এক ব্যক্তি এসে সালাম দিয়ে সামনে দাঁড়াল। বলল, ভাই! আপনাকে আমি অনেক দিন ধরে চিনি। কিন্তু আপনার সাথে আমার পরিচয় হয়নি। একটি জরুরী কাজে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। শহরের বাইরে ঐ পথ দিয়ে একটু দূরে গেলেই আমাদের গ্রাম। সেখানে আমার প্রচেষ্টায় কয়েকজন খ্রিস্টান মুসলমান হতে ইচ্ছে করেছে। আপনাকে অবশ্যই আমার সাথে যেতে হবে। সন্ধ্যায় তারা পথের বাঁকে থাকবে। সন্ধ্যার পর আমরা সেখানে যাব। তাদের মুসলমান বানিয়ে কিছু মৌলিক শিক্ষা দিয়ে তবে আপনাকে ফিরতে হবে।

ইসলামের জন্য যে প্রাণ উৎসর্গিত সে প্রাণ কি এমন এক কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে? এ ব্যাপারে গড়িমসি করতে পারে? তাই সাথে সাথে ওয়াইস প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। অগ্র পশ্চাৎ কিছুই সে ভাবল না।

আবীর ছড়াতে ছড়াতে সূর্য নিষ্প্রভ হয়ে পশ্চিমাকাশে অদৃশ্য হয়ে গেল। মাগরিবের নামাযের পরই লোকটি এসে হাজির। ব্যস্ত তার কণ্ঠ। বলল, চলুন, চলুন। দেরি হয়ে গেছে। রাতে রাতে আবার আপনাকে ফিরতে হবে যে। ঝটপট তৈরী হয়ে বের হয়ে এল ওয়াইস। কথা বলতে বলতে তারা চলতে লাগল।

***

কিছুক্ষণ চলার পর তারা শহরের বাইরে চলে এল। চারদিকে আবছা আবছা অন্ধকার। মেঠো পথ ধরে তারা কিছুদূর যাওয়ার পর পথের বাঁকে এসে উপস্থিত হল। কিন্তু কেউ সেখানে নেই। চারদিক নিরব নিস্তব্ধ। লোকটি বলল, হয়তো তারা এখনো এখানে এসে পৌঁছে নি। আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। এর মধ্যেই তারা চলে আসবে। কিছুক্ষণ তারা বসে রইল। না কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। লোকটি দারুণ অস্থির হয়ে পড়ল। বারবার এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। মাঝে মাঝে বিড় বিড় করে কি যেন বলছে। কিন্তু জনমানবের কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। ওয়াইস বলল, ভাই! আর তো অপেক্ষা করা যাচ্ছে না। যদি তারা সত্যই ইসলাম গ্রহণ করতে চায় তাহলে কাল তাদের সাথে করে নিয়ে এসো। আমি তাদের আমার চেয়ে বড় কারো নিকট নিয়ে যাব।

ষড়যন্ত্রকারী এই ব্যক্তি একাকীকিছু করতে সাহস পেল না। তা ছাড়া তার সাথে তো কোন অস্ত্র ও নেই। সে চালাকী করে কথার ছলে আরো কিছুক্ষণ ওয়াইসকে ধরে রাখল। কিন্তু না, কারো কোন সাড়াশব্দ নেই। তাই নিরাশ হয়ে ওয়াইস ফিলে এল।

বাড়িতে প্রবেশ করেই ওয়াইস দেখল রাবেয়া বিমর্ষ বদনে বসে আছে। চোখে তার বিন্দু বিন্দু অশ্রু। ওয়াইসকে দেখেই ছুটে এসে বলল, ওগো! চলনা একটু বাড়িতে যাই। আমার ভাইটি মৃত্যুশয্যায় ছটফট করছে। এইতো কিছুক্ষণ আগে আমাদের এক প্রতিবেশী এইদিক দিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। আমাকে ভাইয়ের সংবাদ দিয়ে গেল। বলল, তোমার ভাই দুদিন যাবৎ জরাক্রান্ত। কেউ বলতে পারছে না কি হয়েছে। মাথা আগুন। কলসির পর কলসি পানি ঢালছে কিন্তু কোনই উপকার হচ্ছে না। আজ সকাল থেকে প্রলাপ বলছে। দুপুর থেকে অজ্ঞান। হতে পারে আজ রাতই তার জীবনের শেষ রাত।

ওয়াইস নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, তুমি যেতে চাইলে আমি বাধা দিব না। আর যদি আমাকে সাথে নিয়ে যেতে চাও তাহলে আমিও যাব।

ওরা রাবেয়াকে যদিও অপমান করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল, কিন্তু তার হৃদয় কেন যেন ভাইয়ের নাম শোনা মাত্র বিচলিত হয়ে উঠল। সাথে সাথে সে ওয়াইসকে নিয়ে তার বাড়ির পথে রওয়ানা হয়ে গেল। গিয়ে দেখে, উঠানে লোকের ভিড়। ভিড় ঠেলে সে সামনে অগ্রসর হল। কেউ তাকে কিছু বলল না। ঘরে প্রবেশ করে দেখে, ভাইয়ের শয্যা পাশে তার পিতামাতা ও ভাবী কাঁদছে। ভাই রাবেয়াকে দেখার পূর্বে ওয়াইসকে দেখল। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তারপর চোখ খুলে কিছুক্ষণ বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে থেকে হঠাৎ একটি হেঁচকি দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। মাথা এক পার্শ্বে হেলে পড়ল। মৃত্যুবরণ করল।

ওয়াইস জানত না, এ লোকিটই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। আর সে তার ষড়যন্ত্রে আটকেও গিয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা বোঝা মুশকিল।

রাবেয়ার দুচোখ দিয়ে অশ্রুর ধারা নেমে এল। বেশ কিছুক্ষণ কাঁদল। কিন্তু তার পিতামাতা তার প্রতি বা ওয়াইসের প্রতি ফিরেও তাকাল না। রাবেয়া আবার বেদনাহত হৃদয় নিয়ে ফিরে আসল।

পরদিন শুনতে পেল, রাবেয়ার ভাইয়ের এক বন্ধুও অজানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। দুদিন পর সেও মারা গেল। তারপর ঐ ব্যক্তিও একই রোগে আক্রান্ত হল যে ওয়াইসকে হত্যার জন্য নির্ধারিত স্থানে নিয়ে গিয়েছিল। দুদিন পর সেও মারা গেল। ওয়াইসকে যারা হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল একে একে তিনজনই মৃত্যুবরণ করল। অথচ ওয়াইস এ ব্যাপারে কিছুই জানল না।

***

কিন্তু এই ব্যাধি শুধুমাত্র এ তিনজনের মাঝে সীমিত রইলো না। বরং তা আলেপ্পার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। ঘর ঘর থেকে জানাযা বের হতে লাগল। চিকিৎসকরা অপারগ হয়ে গেল। মহামারির ভয়ে মানুষ স্তব্ধ হয়ে গেল। যে ব্যক্তি এ রোগে আক্রান্ত হয় দুই বা তিন দিনের মধ্যেই সে মৃত্যুবরণ করে। চিকিৎসকদের অবিরাম চেষ্টা সত্ত্বেও এ রোগ দূর হল না, উত্তরোত্তর তা গোটা শামে ছড়িয়ে পড়ল। ফিলিস্তিনের আমওয়াস নামক গ্রামে সর্বপ্রথম এ মহামারী শুরু হয়। তাই আমওয়াস ব্যাধি নামেই তা পরিচিত।

দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পেতে না পেতেই আবার ইসলামী জগতে দেখা দিল মহামারী। তখন ছিল ১৮ হিজরী মুতাবেক ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ। এ মহামারীর কারণে খিলাফতের ভিত কেঁপে উঠল। মুজাহিদদের ছাউনীতে ছাউনীতে এ মহমারী ছড়িয়ে পড়ল। অসংখ্য মুজাহিদ দেখতে দেখতে ইনতেকাল করল।

সম্রাট হিরাক্লিয়াস এ সংবাদ পেল। এবার আর তার আনন্দ ধরে রাখে কে? সাথে সাথে সভাসদদের ডেকে পাঠাল। বলল, মুসলমানদের পরাজয়ের এই হল মোক্ষম সুযোগ। মোসাহেবের দল তার অভিমত সমর্থন করল। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিযুক্ত প্রধান পাদ্রী কীরাস সম্রাটের প্রতিজ্ঞার কথা শুনল। সম্রাটের নিকট এসে বলল, শাহানশাহে রোম! শুনতে পেলাম, আপনি শাম আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। আপনার পরিষদও নাকি তা সমর্থন করেছে।

সম্রাট হিরাক্লিয়াস স্থির কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ, মহাপাদ্রী। শুধু শামই নয়, গোটা আরব আমি পদানত করতে চাচ্ছি। কিছুদিন আগে তারা দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত হয়ে একেবারে দুর্বল নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। এখন আবার তাদের উপর আরেক আযাব আপতিত হয়েছে। মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ মরছে। অনেক যোদ্ধা ও সালারও মারা গেছে। তাই ভাবছি, এটাই আক্রমণের মোক্ষম সুযোগ।

কীরাস কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল, যদি আপনার ক্ষতির কোন আশঙ্কা না থাকতো তাহলে আমিও আপনার কথা সমর্থন করতাম। কিন্তু আপনি আমার বাদশাহ্। আমার উপর আপনার অনুগ্রহের সীমা নেই। তাছাড়া আপনার সাথে আমার এক প্রবল আন্তরিক সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই যে পথে আমি আপনার ক্ষতির আশঙ্কা দেখব সে পথে চলতে আমি আপনাকে বারণ করব।

মহমান্য সম্রাট! আপনার একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করে আমরা আমাদের অর্ধেক সৈন্য হারিয়েছি। অবশিষ্ট যারা প্রাণে বেঁচে মিসরে এসে আশ্রয় নিয়েছে তাদের অন্তর থেকে এখনো আরবদের ভয় দূর হয়ে যায়নি। সেনা শিবিরে এখনো অনেকে দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠে। তাই বলছিলাম, যদি এ অবশিষ্ট সৈন্যদের আপনি মহামারীর হাতে নিঃশেষ করতে চান তাহলে তাদের শামে পাঠান। আপনি কি একথা ভেবে দেখছেন না, মুজাহিদ শিবিরগুলোও যে মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এ মহামারী আমাদের সৈন্যদের কি খাতির করবে? কাল পর্যন্ত আমি যে সংবাদ পেয়েছি তাতে জানতে পেরেছি, মুসলমানদের বেশ কিছু সালারও ইতিমধ্যে মহামারীতে মারা গেছে।

সম্রাট হিরাক্লিয়াস কীরাসের কথায় একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। চেহারার আনন্দ আনন্দ ভাবটা কোথায় মিলিয়ে গেল। একটা বিমর্ষ ভাব চেহারায় ছড়িয়ে পড়ল। অতঃপর ধীরে ধীরে তার মাথাটি দুলে উঠল। বলল, আচ্ছা মহাপাত্রী কীরাস! তোমার কথাই আমার যুক্তিসঙ্গতি মনে হচ্ছে। এবারের মত আমি শাম আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকছি।

***

আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.) মহামারীর এ দুঃসংবাদ পাওয়ার পূর্বেই শামে যাওয়ার ইচ্ছে করেছিলেন। মহামারীর সংবাদ পাওয়ার পর তিনি বেচাইন হয়ে গেলেন। শামে গিয়ে স্বচক্ষে মহামারীর অবস্থা দেখে কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন। তাঁর সাথে অনেককে শামে যাওয়ার হুকুম দিয়ে নিজে তৈরী হয়ে গেলেন। শামের পথে মদীনা থেকে একটি কাফেলা রওনা হয়ে গেল।

তাঁরা আরবের প্রান্ত সীমায় এক তাঁবুতে গিয়ে পৌঁছলেন। হযরত ওমর (রা.) যাওয়ার আগেই শামের সর্বত্র সালারদের নিকট সংবাদ পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি শামের অবস্থা স্বচক্ষে দেখে কার্যকারী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য শামের পথে রওয়ানা হয়েছেন। শামে অবস্থানরত সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.), সালার ইয়াজিদ ইবনে আবী সুফিয়ান, সুবাহবিল ইবনে হাসানা আরো অনেকে এসে তাঁবুতে হযরত ওমর (রা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তারা এক যোগে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমাদের অনুরোধ, আপনি আর সামনে অগ্রসর হবেন না। শামের আকাশে বাতাসে মরণ ব্যাধীর জীবাণু জড়িয়ে আছে। মৃত্যু ছাড়া তা থেকে বাঁচার আর কোন উপায় নেই। তারা তাঁকে মহামারীর ভয়াবহতার বিস্তারিত বিবরন তার নিকট তুলে ধরলেন।

হযরত ওমর (রা.) দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, এখানে এসে গতি ফিরিয়ে দেয়া আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি যদি এখান থেকে ফিরে যাই তাহলে মহামারীতে যারা ইন্তেকাল করেছে তাদের রূহের সামনে আমি লজ্জায় দাঁড়াতে পারব না। আমি মুসলিম ভাইদের এ মহাবিপদে ফেলে ফিরে যেতে পারি না।

আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.) স্বীয় মতে অটল অনড়। সালারগণ তাকে নানাভাবে বুঝালেন। বললেন, এখন এ সঙ্গীন মুহূর্তে যদি আমীরুল মুমিনীনের কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে ইসলামী জগতের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। যে ক্ষতিপূরণ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। হযরত ওমর (রা.) তাদের কোন কথাই কানে তুললেন না। অবশেষে তিনি উপস্থিত সবার নিকট থেকে পরামর্শ চাইলেন। তখন সেখানে বেশ কিছু বর্ষীয়ান সাহাবী উপস্থিত ছিলেন। পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রেও তারা দুদল হয়ে গেলেন।

কেউ কেউ বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের কল্যাণ কামিতার জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য শামে যাচ্ছেন। তাই ভবিষ্যতে কি হবে বা হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা করার কোন অর্থ হয় না। ভাগ্যে যা আছে তা ছাড়া অন্যকিছু হবে না। নির্ভয়ে আপনি শামে যান।

অন্য সকলে বললেন, না, হে আমীরুল মুমিনীন! যে স্থানে ধ্বংস, বরবাদী ও মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই নেই সে স্থানে আমীরুল মুমিনীন এর যাওয়া কিছুতেই উচিত হবে না। আল্লাহ্ তাআলা আকল ও বুদ্ধি এজন্যই দিয়েছেন যে, যে কাজই আমরা করব তা ভেবে চিন্তে করব। হুট করে কিছু করা ঠিক নয়।

হযরত ওমর (রা.) দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। কি করবেন কিছুই স্থির করতে পারলেন না। অনেক চিন্তা ভাবনার পর কুরাইশ বংশের ঐসব সাহাবীকে ডাকলেন যারা মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলের সাথে ছিলেন এবং তখন তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) সেখানে ছিলেন। তাদের ডেকে তিনি পরামর্শ চাইলেন।

সিদ্ধান্ত হলো, আমীরুল মুমিনীন এখন তার কাফেলার সবাইকে নিয়ে মদীনায় ফিরে যাবেন। এই ফয়সালার পর হযরত ওমর (রা.)-এর মন স্থির হল। তিনি নির্দেশ দিলেন, আগামীকাল সকালে কাফেলা মদীনার পথে রওয়ানা হয়ে যাবে। সবাই যেন সফরের প্রস্তুতি নিয়ে নেয়।

এ ক্ষেত্রে ইতিহাস বিশারদগণ এক চমৎকার ঘটনা উল্লেখ করেছেন। আবু উবায়দা (রা.) শুরু থেকেই এমন পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন, যেন হযরত ওমর (রা.) শামে না যান। মদীনায় ফিরে যান। কিন্তু কখন যে তার মত পাল্টে গেছে তা জানা নেই। মদীনার দিকে যাত্রা শুরুর আগে হযরত আবু উবায়দা (রা.) অকপটে হযরত ওমর (রা.)-কে বললেন, হে ইবনে খাত্তাব! আল্লাহর ফয়সালা থেকে পালিয়ে যাচ্ছো?

এ কথা শোনার সাথে সাথে হযরত ওমর (রা.)-এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আবু উবায়দা (রা.)-এর দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, হে ইবনে জাররাহ! যদি একথাটি অন্য কেউ বলত,….. হ্যাঁ আমি আল্লাহর এক ফয়সালা থেকে অন্য ফয়সালার দিকে যাচ্ছি। আবু উবায়দা (রা.) নিরব হয়ে গেলেন। ঠিক তখনই আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বর্ষীয়ান সাহাবী, দূরদর্শী। উপস্থিত হয়েই বুঝে ফেললেন মুহূর্তকাল পূর্বে এখানে কি ঘটেছে। মৃদু হেসে তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যদি তোমরা শুনতে পাও, অমুক স্থানে মহামারী দেখা দিয়েছে তাহলে সে স্থানে যেয়ো না। আর যদি তোমরা এমন স্থানে থাক যেখানে মহামারী দেখা দিয়েছে। তাহলে তোমরা সে স্থান ছেড়ে পালিয়ে এসো না। কারণ হয়তো তুমি তোমার সাথে এ মহামারী নিয়ে আসবে আর তা অন্য স্থানেও ছড়িয়ে পড়বে। রাসূলের বাণী শোনার পর হযরত ওমর (রা.)-এর মন একেবারে প্রশান্ত হয়ে গেল। দ্বিধা দ্বন্দ্বের আর কোন চিহ্ন বাকি রইল না। নিশ্চিন্ত মনে তিনি মদীনায় ফিরে এলেন।

মদীনায় পৌঁছার পর তার মনের আকাশে নানা চিন্তা ভিড় করতে লাগল। মুহূর্তকালের জন্য তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন না। ঘুরে ঘুরে শামের কথা মনে পড়ে। শামের জনগণকে কিভাবে মহামারী থেকে বাঁচানো যায় শুধু তারই চিন্তা করেন। আবু উবায়দা (রা.)-এর কথাই বারবার তার হৃদয়পটে উদ্ভাসিত হয়। আবু উবায়দা (রা.) একজন সুদক্ষ সিপাহ সালার। তাকে রক্ষার কথাই বারবার মনে পড়ে। মদীনায় ফিরে আসার সময় তিনি আবু উবায়দা (র.)-কে বলেছিলেন, চলুন, আমাদের সাথে মদীনায়। কিছুদিন সেখানে থেকে আসুন। কিন্তু আবু উবায়দা (রা.) অত্যন্ত দৃঢ় ও স্থির কণ্ঠে বলেছিলেন, আমি আমার সাথীদের মৃত্যুর মুখে ছেড়ে চলে যেতে পারি না। তারপর বললেন, আমি আল্লাহর ফায়সালা থেকে পালিয়ে যেতে পারি না।

মদীনায় পৌঁছে ভেবেচিন্তে তিনি আবু উবায়দা (রা.)-এর নিকট পত্র লিখে একজন অশ্বারোহী বার্তাবাহককে পাঠিয়ে দিলেন। লিখে পাঠালেন, আমি এক জরুরী বিষয়ে তোমার সাথে সরাসরি আলোচনা করতে চাই। পত্র পওয়া মাত্র মদীনায় চলে আসবে।

আবু উবায়দা (রা.) পত্র পাঠ করে ভাবনার জগতে হারিয়ে গেলেন। দূর নিকট অনেক কিছু ভাবরেন। তারপর উত্তরে লিখলেন, যে বিষয়ে আপনি আমার সাথে পরামর্শ করতে চাচ্ছেন তা মুলতবী হতে পারে। কিন্তু আমি এখানে মুসলিম বাহিনীর সিপাহ সালার। আমি আমার বাহিনীকে এ মহাবিপদের মাঝে ফেলে কোথাও যেতে পারি না। আমি আমার সাথীদের ছেড়ে যেতে পারি না। আমি এখানেই আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষায় থাকব।

হযরত ওমর (রা.) পত্র পাঠ করার পর ভাবাবেগে ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। তার চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু-প্রবাহিত হতে লাগল। উপস্থিত লোকদের একজন ত্রস্ত কণ্ঠে বলল, আমীরুল মুমিনীন! আবু উবায়দার কোন কিছু ঘটেনি তো? হযরত ওমর (রা.)-এর কণ্ঠস্বর জড়িয়ে এল। কান্নামাখা কণ্ঠে বললেন, না…..তবে মনে হচ্ছে সে আমাদের রেখে চলে যাবে।

তারপর হযরত ওমর (রা.) আবু উবায়দা (রা.)-এর পত্রটি উপস্থিত লোকদের পাঠ করার জন্য দিলেন। তারপর বহু চিন্তা-ভাবনার পর তিনি আবু উবায়দা (রা.)-এর নিকট আরেকটি পত্র লিখে পাঠালেন। হে আবু উবায়দা! নিচু অঞ্চল ত্যাগ করে উঁচু স্থানে চলে যাও। মুজাহিদদেরও তোমার সাথে নিয়ে যাও। হযরত আবু উবায়দা (রা.) হযরত ওমর (রা.)-এর পরামর্শ মোতাবেক আমল করার কথা চিন্তা করছিলেন। ঠিক তখনই তিনি মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। তৃতীয় দিনে তিনি ইন্তেকাল করলেন। যেদিন তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন সেদিনেই মুয়ায ইবনে জাবাল (রা.)-কে তার স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। অবস্থা এতো ভয়াবহ ছিল যে, এ মহামারীতে মুয়ায (রা.)-এর দুই যুবক পুত্র ইন্তেকাল করেছিলেন। কিছুদিন পর তিনিও ইন্তেকাল করলেন। ইন্তেকালের আগে তিনি আমর ইবনে আস (রা.)-কে তার স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন।

আমর ইবনে আস (রা.) সিপাহসালার হওয়ার সাথে সাথে মহামারী আক্রান্ত সকল এলাকার লোকদের নির্দেশ দিলেন, তারা যেন জনবসতি ত্যাগ করে পাহাড়ে চলে যায়। সাথে সাথে সবাই ঘরবাড়ি ফেলে পাহাড়ে চলে গেল। তারপর থেকে মহামারীর প্রকোপ কমে এল। ধীরে ধীরে তা শেষ হয়ে গেল। কয়েক মাসের এ মহামারীতে পঁচিশ হাজার মুসলমান ইন্তেকাল করল। যে সব সালার এতে ইন্তেকাল করেছেন তারা হলেন, আবু উবায়দা, মুয়ায ইবনে জাবাল, ইয়াযীদ ইবনে আবী সুফিয়ান, হারেস ইবনে হিশাম, সুহাইল ইবনে আমর, উতবা ইবনে সুহাইল (রা.) সহ আরো অনেকে। হারেস ইবনে হিশাম (রা.)-এর বংশের সত্তর জন এবং খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-এর বংশের চল্লিশ জন মুসলমানও ইন্তেকাল করেছেন।

***

রাবেয়ার পিতা রাবেয়া ও ওয়াইসকে বলেছিল, শামে কিছু মুসলমান মদ হালাল মনে করে প্রকাশ্যে মদ পান শুরু করেছে। তখন ওয়াইস কঠোর ভাষায় তার প্রতিবাদ করেছিল। তারা বলেছিল, আপনি মুসলমানদের উপর মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন। আর এটা ইসলামের প্রতি আপনার বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ। আসলে রাবেয়ার পিতা মিথ্যা কথা বলেনি। তার কথার পিছনে কিছু বাস্তবতাও ছিল।

ঐতিহাসিকরা বলেন, মুসলমানরা শাম পদানত করলে আরবের কিছু গোত্র শামের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। শামের খ্রিস্টানরা তখন মুসলমানদের বশ্যতা মেনে নেয়। কিন্তু দুষ্টমতি কিছু খ্রিস্টান মুসলমানদের ধ্বংস সাধনের অন্য পন্থা অবলম্বন করল। তারা তাদের সুন্দরী রূপসী কন্যাদের মাধ্যমে ভুলিয়ে ভালিয়ে মুসলমানদের মদ পানে অভ্যস্থ করে তুলে।

পরহেজগার মুসলমানরা তাদের মদ পান করতে দেখে নিষেধ করলে তারা বলত, কুরআন মদ পানকে হারাম করেনি। কুরআন বলেছে, তোমরা কি এসব বস্তু পরিহার করবে না? তার অর্থ হল, আল্লাহ্ মদের বিষয়টি বান্দাদের জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছেন। বান্দা তা পরিহার করতেও পারে। আবার ইচ্ছে করলে গ্রহণও করতে পারে। দলীল হিসাবে তারা আরেকটি যুক্তি উপস্থাপন করে বলে, দেখ না প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর যুগে মদ পান করার কারণে কাউকে শাস্তি দেয়া হয়নি!

মদের ব্যাপারটি নিয়ে শামের কয়েকজন লোকে বাড়াবাড়ি করছিল। সিপাহ সালার আবু উবায়দা (রা.) বিষয়টি অবহিত হলেন। তিনি এ ব্যাপারটি তদন্ত করে তার সত্যতা যাচাই করলেন। মদ পানকারীদের বিভ্রান্তিকর প্রমাণ পেশের কথাও শুনতে পেলেন। তিনি দারুণ বিস্মিত হলেন। কিন্তু নিজে কোন ফয়সালা করলেন না। আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.)-এর নিকট বিষয়টি বিস্তারিত লিখে তার বিধান চেয়ে পাঠালেন।  ১ ১৪১

হযরত ওমর (রা.) বিষয়টি অবহিত হয়ে নিয়মানুসারে সাহাবীদের পরামর্শ সভা আহ্বান করলেন। উপস্থিত হলেন মদীনায় অবস্থানরত বিজ্ঞ সাহাবীগণ। বিষয়টি শোনার পর প্রত্যেকে নিজ নিজ মত ব্যক্ত করলেন। হযরত আলী (রা.) বললেন, মদ পান করলে মানুষ বুদ্ধিশক্তি হারিয়ে ফেলে। ফলে মুখে যা আসে তাই বলে। আল্লাহর রাসূল ও কুরআনের ব্যাপারেও তারা অকপটে মিথ্যা বলতে পারে।

হযরত আলী (রা.)-এর একথা শোনার পর হযরত ওমর (রা.)-এর মুখ দিয়ে হঠাৎ অবলীলাক্রমে বেরিয়ে এল, তাহলে মদ পানের শাস্তি হল তাকে আশিটি চাবুক মারা!

তখন হযরত ওমর (রা.) আবু উবায়দা (রা.)-এর নিকট লিখে পাঠালেন, যারা মদ পান করে তাদের ধরে আন। যদি তারা মদ পানকে হালাল মনে করে তবে তাদের হত্যা করে দাও। আর যদি তারা স্বীকার করে যে, মদ পান করা হারাম তবে তাদের প্রত্যেককে আশিটি চাবুক মার। এটাই মদ পানের শাস্তি।

আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.)-এর নির্দেশ পেয়ে আবু উবায়দা (রা.) তালাস করে করে সব মদ পানকারীকে ধরে আনালেন। হয়তো তারা বুঝে ফেলেছিল যে, যদি তারা বলে যে মদ পান করা হালাল তাহলে তাদের হত্যা করা হবে। তাই তাদের কেউ বলল না যে, মদ পান করা হালাল। সবাই এক বাক্যে বলল, মদ পান করা হারাম।

তারপর আবু উবায়দা (রা.) বললেন, হে মুসলিম ভাইয়েরা! তোমাদের উপর আল্লাহর কোন না কোন শাস্তি আসবে। আমি তোমাদের প্রত্যেককে আশিটি করে চাবুক মারার শাস্তি দিচ্ছি। তারপর তাদের প্রত্যেককে শাস্তি প্রদান করা হল। তারপর শামের কোন মুসলমান মদ পান তো দূরের কথা, মদের নামগন্ধ নেয়ারও সাহস পায়নি।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *