1 of 2

৫৮. একটি সংক্ষিপ্ত সাম্রাজ্য

অধ্যায় ৫৮ – একটি সংক্ষিপ্ত সাম্রাজ্য

খ্রিস্টপূর্ব ৬০৫ থেকে ৫৮০ সালের মাঝে মিশর একটি সেনাবাহিনী গঠন করে, ব্যাবিলন জেরুজালেম ধ্বংস করে এবং দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার উন্মাদ হয়ে যায়।

ব্যাবিলনে যুবরাজ নেবুচাদনেজার সিংহাসনের দখল নিয়ে দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার’ নাম ধারণ করলেন এবং একসময় যে ভূখণ্ড অ্যাসিরীয়ার অধীনে ছিল, তার দখল নিতে উদ্যত হলেন।

বেশ কয়েক বছর তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। কারচেমিশে পরাজিত হওয়ার পর দ্বিতীয় নেচো দুর্বল হয়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন।

এশিয়া মাইনরের লিডিয়রা হুমকি হওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। যাযাবর স্কাইথিয়ানরা নিজেদের গুছিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়। গ্রিক শহরগুলো নিজেদের অন্তঃকোন্দলেই ব্যস্ত ছিল। ব্যাবিলনের ক্ষমতার প্রতি সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হুমকি হতে পারত মেদেস, যাদের ছিল নিজস্ব বাহিনীর পাশাপাশি পারস্যের বাহিনীর সমর্থন। তবে মেদেসের রাজা সিয়ারক্সেস একইসঙ্গে নেবুচাদনেজারের শ্বশুরও ছিলেন—এ কথা আমাদের ভুললে চলবে না!

নেবুচাদনেজার পশ্চিমা সেমাইটদের ভূখণ্ডে হামলার মাধ্যমে সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করলেন। তিনি জেরুজালেমের প্রাচীরের বাইরে সেনা মোতায়েন করলেন। ফলে, ইসরায়েলের জেহোইয়াকিম কিছুদিন আগে নেচোর (যিনি বস্তুত তাকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন) সঙ্গে তৈরি করা মৈত্রীর কথা ভুলে যেয়ে “৩ বছরের জন্য” ব্যাবিলনের মিত্র হলেন। ‘টু কিংস’-এর বয়ান মতে, ‘জেহোইয়াকিম নেবুচাদনেজারের প্রতিনিধি হিসেবে’ রাজ্য শাসন করতে লাগলেন।

জেহোইয়াকিমের এই অর্থপ্রদানের বিষয়টি কালক্ষেপণের কৌশল ছিল—যতদিন পর্যন্ত না তিনি অন্য কোনো রাজার সঙ্গে মৈত্রী তৈরি করতে পারছিলেন। কারচেমিশের যুদ্ধজয়ের পরেও ব্যাবিলনকে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হত না। কিন্তু তার রাজসভার ‘নবী’ বা প্রফেট হিসেবে পরিচিত (আমরা ধর্মীয় নেতা বলতে পারি) জেরেমাইয়াহ তাকে সতর্ক করলেন—নেবুচাদনেজার এসে এ অঞ্চলের দখল নেবেন। বিষয়টি শুধু অনিবার্যই ছিল না, এই পরিণতি স্বর্গ থেকে নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বললেন, “ব্যাবিলনের রাজা অবধারিতভাবেই এখানে আসবেন এবং এ ভূখণ্ড ধ্বংস করবেন, এবং মানুষ ও পশুপাখিকে এ অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন।”

ইসাইয়াহ একই ধরনের একটি সতর্কবাণী দিয়েছিলেন অ্যাসিরীয়ার সেন্নাশেরিবকে, প্রায় ১০০ বছর আগে। জেহোইয়াকিম এ সতর্কবাণীতে কান দিতে চাননি। যখন জেরেমাইয়াহর সতর্কতা সম্বলিত স্ক্রলটি (লম্বা কাগজের টুকরো) তাকে পড়ে শোনানো হয়, তিনি তখন একটি ছুরি দিয়ে সেটাকে ফালা ফালা করে কেটে ফেলেন এবং তার সিংহাসনের পাশে জ্বলতে থাকা আগুনের পাত্রে নিক্ষেপ করেন। তারপর তিনি তার পুরনো প্রভু দ্বিতীয় নেচোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে নেবুচাদনেজারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনায় নিয়োজিত হন। এতেও খুশি হননি জেরেমাইয়াহ। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, “ফারাও ও তার মানুষেরা একই, ধ্বংসের কাপ থেকে পান করবেন”। তিনি আরও বলেন, জেহোইয়াকিমের মরদেহকে বাইরে ছুড়ে ফেলা হবে, “যাতে দিনের তাপ ও রাতের শীতের সামনে সেটি উন্মুক্ত হয়”।

এই ভয়াবহ হুমকিতেও টলেননি তিনি। দ্বিতীয় নেচো প্রস্তুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাবিলনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন জেহোইয়াকিম। তিনি ব্যাবিলনকে নজরানা দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। নেচো মিশরের উদ্দেশে বাহিনী নিয়ে রওনা হলেন। নেবুচাদনেজার এই হুমকির মোকাবিলায় নিজেই এগিয়ে এলেন।

৬০২ সালে দ্বিতীয় নেচো আর নেবুচাদনেজারের বাহিনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হল। কিন্তু যুদ্ধে কোনো ফলাফল এল না। ব্যাবিলনের ক্রনিকল (যার কিছু অংশ নেবুচাদনেজারের আমলে লেখা হয়েছে) অনুযায়ী, পরের বছর (৬০১) আরেকটি যুদ্ধ হয়েছিল। ‘উভয় পক্ষ যুদ্ধক্ষেত্রে একে অপরের মুখোমুখি হয় এবং বড় আকারে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। নেবুচাদনেজার ও তার বাহিনী ব্যাবিলনে ফিরে যায়।’

নেবুচাদনেজার নয়, নেচোরও যুদ্ধের শখ মিটে গিয়েছিল। তিনি পশ্চিমা সেমাইটদের ভূখণ্ড ধরে রাখতে যেয়ে অনেক বেশি সেনা হারিয়েছিলেন। টু কিংস ২৪-এর মতে, ‘মিশরের রাজা আর কখনোই নিজ দেশ ছেড়ে সেনাবাহিনী নিয়ে বের হননি। কারণ, ব্যাবিলনের রাজা তার সব ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছিলেন। মিশরের ওয়াদি থেকে শুরু করে ইউফ্রেতিস নদ পর্যন্ত।’

যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়ে দ্বিতীয় নেচো তার নিজ দেশের দিকে নজর দেন। তিনি নীলনদের পূর্ব অংশ থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত খাল খনন করান। এটা অনেক বড় একটি কাজ ছিল। হেরোডোটাস বলেন, ‘এই খালটি এতটাই দীর্ঘ ছিল যে এর মধ্যদিয়ে নৌকা চালিয়ে যেতে ৪ দিন সময় লাগত। এবং এটি এত প্রশস্ত ভাবে খনন করা হয়, যাতে খুব সহজে ২টি ট্রাইরেম (প্রাচীন মিশরীয় যুদ্ধজাহাজ) পাশাপাশি চলতে পারে’। ট্রাইরেমের প্রস্থ মাত্র ১৫ ফুট, কিন্তু লোহিত সাগর পর্যন্ত ৩০ ফুট প্রশস্ত একটি খাল খনন করা কোনো সহজ কাজ ছিল না। নীলনদের প্রবেশমুখে তিনি পেলুসিয়াম নামে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন।

তিনি একটি নৌবাহিনী গড়ে তোলার জন্য দুই ধরনের ভাড়াটে সেনা ভাড়া করে এনেছিলেন। এইজিয়ান সমুদ্রের আশেপাশে আইওনিয়ান শহর থেকে গ্রিক নাবিক এবং হেরোডোটাসের মতে, ফিনিশীয় নাবিক, যারা খুব সম্ভবত টির, সিডন, অথবা কার্থেজ নগরের বাসিন্দা ছিলেন। তাদের সম্মিলিত সহায়তায় একটি নৌবহর নির্মাণ করেন মিশরের রাজা। এই বহরের বেশিরভাগ অংশজুড়ে ছিল প্রাচীন আমলের ট্রারেম। এ জাহাজগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হত, যাতে সেগুলো শত্রুপক্ষের জাহাজে জোরে ধাক্কা দিয়ে ধ্বংস করে দিতে পারত। এ জাহাজগুলোকে লোহিত সাগরের তীরে নোঙর করে রাখা হত। হেরোডোটাস দাবি করেন, একদল ফিনিশীয় নাবিককে লোহিত সাগর অনুসন্ধানী অভিযানে পাঠান দ্বিতীয় নেচো। তারা দক্ষিণ অভিমুখে জাহাজ চালাতে থাকেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ৩ বছর পর তারা ভূমধ্যসাগরের মুখে হেরকিউলেসের পিলারে এসে উপস্থিত হয়। তারপর তারা জাহাজ চালিয়ে ভূমধ্যসাগরের মধ্যদিয়ে নীলনদের বদ্বীপে ফিরে আসে। বস্তুত, তারা পুরো আফ্রিকা ঘুরে এসেছিলেন। এ সবই ছিল সাগর-ঘৃণাকারী মিশরীয়দের জন্য প্রচলিত প্রথাভঙ্গের বড় উদাহরণ। তবে দ্বিতীয় নেচো দূরদর্শী ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাম্রাজ্য গড়তে যুদ্ধ-বিগ্রহের চেয়ে বাণিজ্যের ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

একদিকে এসব চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটছিল মিশরে, আর অপরদিকে জুদাহ পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। জেহোইয়াকিম মিশরের সমর্থনের ভরসায় ছিলেন। কিন্তু এবার তিনি একা হয়ে পড়লেন।

জোসেফাস মন্তব্য করেন, ‘তিনি হতাশায় নিমজ্জিত হলেন, কারণ মিশর সেসময় যুদ্ধ করতে সাহস পাচ্ছিল না।’

ফলে জেহোইয়াকিম ব্যাবিলনের পাল্টা আক্রমণের অপেক্ষায় অস্বস্তির সঙ্গে অপেক্ষা করতে লাগল। ৪ বছর পর নেবুচাদনেজার তার বাহিনীর পুনর্গঠন করলেন। তারপর প্রথমে তিনি অন্যান্য হুমকির মোকাবিলা করলেন, যেমন আরবের উত্তরাঞ্চলীয় মরুভূমির যাযাবর বাহিনী। সেসময় শহরের অভ্যন্তরে কী ঘটছিল, তা আমরা জানতে পারি না। তবে খুব সম্ভবত জেরুজালেমের কর্মকর্তারা জেরেমাইয়াহরকে ব্যাবিলনের বিরুদ্ধাচরণের বিপদ সম্পর্কে বারবার সতর্ক করছিলেন। জেহোইয়াকিম ৫৯৭ সালে মারা যান। সেসময় তার বয়স ছিল মাত্ৰ ৩৬। এ সংবাদ পেয়েই তাৎক্ষণিকভাবে নেবুচাদনেজার জেরুজালেমের উদ্দেশে রওনা হন।

জেরুজালেমে জেহোইয়াকিমের তরুণ পুত্র জেহোইয়াচিন ক্ষমতা গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু জেহোইয়াকিমের মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহের মাঝেই নেবুচাদনেজার জেরুজালেমের প্রাচীরের বাইরে এসে উপস্থিত হলেন। ফলে নতুন রাজা, তার মা, পূর্ণ সভাসদ ও অভিজাত বংশীয় লোকজনসহ সকল কর্মকর্তা আত্মসমর্পণ করলেন। তাদেরকে বন্দি করা হলেও তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা হয়। নেবুচাদনেজারের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে তারা কোনো একধরনের দায়মুক্তি পেয়েছিলেন—যে কারণে কেউ তাদের কোনো ধরনের ক্ষতি করতে পারত না। ব্যাবিলনের নথি অনুযায়ী, জেহোইয়াচিন পরবর্তী ৪০ বছর ব্যাবিলনের রাজার সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ব্যাবিলনের রাজকোষ থেকে তাকে ভাতা দেওয়া হত।

জেরুজালেমের সেনাবাহিনীকে ব্যাবিলনে নিয়ে যাওয়া হলেও ছত্রভঙ্গ করা হয়নি। রাজকোষ ও সলোমনের মন্দির থেকে সব সোনাদানা লুট করে নেওয়া হলেও দালানগুলোর কোনো ধরনের ক্ষতি করা হয়নি। নেবুচাদনেজার এমনকি রাজপরিবারের সব সদস্যদেরও সরিয়ে নেননি। তিনি জেহোইয়াচিনের চাচা মাত্তানিয়াহ’র (মৃত রাজার ভাই) নতুন নাম দেন ‘জেদেকিয়াহ’। তিনি জেদেকিয়াহকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন। ইতিহাসবিদ জোসেফাস এই বন্দোবস্তের একটি সুন্দর নাম দেন। তিনি একে ‘লিগ অব মিউচুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্স (পারস্পরিক সহযোগিতার মৈত্রী)’ নামকরণ করেন। তবে বস্তুত, জেদেকিয়াহ ব্যাবিলনের নিয়োগ দেওয়া গভর্নর ব্যতীত কিছুই ছিলেন না।

তবে যে যা-ই বলুক না কেন, অল্পের ওপর দিয়ে বেঁচে গেছিল জেরুজালেম। পশ্চিমের একটি তৃতীয় শ্রেণির শক্তির নিয়ন্ত্রণভার ধরে রাখার চেয়েও আরও অনেক বড় বড় উদ্বেগের বিষয় ছিল নেবুচাদনেজারের সামনে। একজন মহান রাজা হিসেবে নিজের অবস্থানকে প্রতিষ্ঠা করা ও রক্ষা করার জন্য তার কাজের অভাব ছিল না। মেসোপটেমিয়ার রাজারা দুই হাজার বছর আগে যা করেছিল, তিনিও সেসব কাজে সময় দিলেন। তিনি তার নিজের গুণকীর্তন করে অসংখ্য শিলালিপি লেখানোর ব্যবস্থা করতে লাগলেন। একইসঙ্গে ব্যাবিলনে একের পর এক মন্দির নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করতে লাগলেন তিনি। ব্যাবিলন ছিল মারদুক দেবতার বাসস্থান। সেই মারদুকের প্রতি নেবুচাদনেজারের ভক্তি ছিল ব্যাবিলনের জয়যাত্রার আরেকটি নিদর্শন। নেবুচাদনেজারের একটি শিলালিপিতে বলা হয়, ‘হে মারদুক, আমার প্রভু। আশা করি, আমি ও আমার বংশধররা যেন সর্বদা আপনার বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে চিরকাল টিকে থাকতে পারি।’

নেবুচাদনেজার তার জীবদ্দশায় মারদুকের উদ্দেশে অনেক ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করেন; শেষ করেন অনেক প্রকল্প, যা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে। তিনি বেলের মন্দির ও অন্যান্য পবিত্র জায়গাগুলো সাজান। তিনি মারদুকের উৎসব উদযাপনের জন্য একটি ৭০ ফুট দীর্ঘ সড়ক তৈরি করেন, যেটি কেন্দ্রীয় মন্দির কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে ইশতার তোরণ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শহরের উত্তরপ্রান্তে এ সড়ক নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল যাতে নববর্ষের উৎসবের সময় দেবতারা এ পথ ধরে হেঁটে এগিয়ে যেতে পারেন। সড়কের দুই পাশের প্রাচীর নীল রঙে রাঙানো হয়েছিল, আর সেগুলোতে গর্জনরত সিংহের প্রতিকৃতি খোদাই করা হয়েছিল। ইশতার তোরণ ও এ-সড়কটি প্রাচীন ব্যাবিলনের পরিচায়ক স্থাপনা হিসেবে পরিচিত পায়—যদিও এগুলো ব্যাবিলনের ইতিহাসের একদম শেষের দিকের কীর্তি।

একইসঙ্গে নেবুচাদনেজার অন্তত ৩টি রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, যেগুলো স্বর্ণ ও রৌপ্যখচিত ছিল। এরকম এক প্রাসাদে তিনি একটি বাগান তৈরি করেছিলেন। তবে এই বাগানের ধ্বংসাবশেষ সুনির্দষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়নি। ইউফ্রেতিসের তীরে একটি রাজকীয় বাসভবনে দেয়াল, কক্ষ ও সুউচ্চ ছাদযুক্ত একটি জায়গাকে এর সম্ভাব্য অবস্থান হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। তবে জায়গাটা খুঁজে পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন আমলের লেখকের লেখায় এর বর্ণনা উঠে এসেছে। সিকুলাসের ডিওডোরাস তার বিবলিওথেকা হিস্টোরিকা সিরিজের তৃতীয় বইতে এই বাগানের সবচেয়ে সুপরিচিত বর্ণনাটি দেন।

“প্রাচীন আমলে এক রাজা ছিলেন, যিনি তার প্রিয়তমার জন্য এই বাগানটি নির্মাণ করেছিলেন। সেই উপপত্নী নারীটি পারস্য রাজ্যে জন্ম নিয়েছিলেন। তার দেশের মানুষদের মতো, তিনিও চাইতেন উচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করতে। এ কারণে তিনি তার রাজাকে কৃত্রিমভাবে এরকম একটি জায়গা তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ জানালেন।”

এ বাগানের প্রবেশপথটি ছিল একটি পাহাড়ের ওপর। একের পর এক দালান নির্মাণ করে বেশ খানিকটা উঁচুতে বাগানটি স্থাপন করা হয়। সেখান থেকে তাকালে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যেত। মাটিতে বেশকিছু কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছিল, যাতে দালানটি বাগানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। এই বাগানের প্রাচীরগুলো ২২ ফুট মোটা ছিল। বাআগানে সব ধরনের গাছগাছালি ছিল এবং সেচ দেওয়ার জন্য পানিরও ব্যবস্থা ছিল।

খুব সম্ভবত ‘পারস্যে জন্ম নেওয়া নারীটি’ আদতে পার্সি নয়, মেদিয়ান ছিলেন। তিনি ছিলেন মেদিয়ায়ন প্রধান রাজা সিয়ারক্সেসের মেয়ে অ্যামিতিস।

এই বাগানগুলোর নাম দেওয়া হয় ‘ঝুলন্ত বাগান’ এবং আজও তারা বিখ্যাত। প্রতিটি প্রাচীন ইতিহাসবিদ ব্যাবিলনের বর্ণনা দেওয়ার সময় ‘ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানের’ বা ঝুলন্ত বাগানের কথা বলেন। এসব খণ্ডচিত্র থেকে আমরা প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বাগান সম্পর্কে ভালো একটি ধারণা পাই।

এই দালানগুলো ছিল শান্তির প্রতীক, কিন্তু নেবুচাদনেজারের মনে আরও গুরুতর বিষয় কাজ করছিল। তিনি ব্যাবিলনের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য তার লোকদেরকে দ্বি-স্তরবিশিষ্ট প্রাচীর নির্মাণে নিয়োজিত করলেন। সেগুলো এতটাই বলিষ্ঠ হল যে, এর ঘনত্ব ২১ ফুটে যেয়ে দাঁড়ায়। এর সঙ্গে যোগ হল প্রতি ৬০ ফুট দূরত্বে ‘ওয়াচ টাওয়ার’ বা নিরাপত্তা চৌকি। একটি আংশিকভাবে খনন করা পরিখা শহরে এক অংশে সুরক্ষা দিচ্ছিল। নেবুচাদনেজার পুরো শহরজুড়ে একে বিস্তৃত করেন। একপর্যায়ে ব্যাবিলনকে তিনি ৪০ ফুট দীর্ঘ পানির বেল্ট দিয়ে ঘীরে ফেললেন, যাতে স্থলপথে হামলা করা অতটা সহজ না হয়। এরপর তিনি শহরের পূর্বপাশে আরও এক প্রাচীর নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে এটাকে গ্রিক সৈন্য জেনোফন ‘মেদিয়ান প্রাচীর’ নাম দেন। এটি ইউফ্রেতিস থেকে টাইগ্রিস পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যা বহু বছর আগে অ্যামোরাইটদের দূরে রাখার জন্য সুমেরীয় রাজা শু-শিনের নির্মাণ-করা সুরক্ষা বেষ্টনীর কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে এই প্রাচীরের লক্ষ্য ভিন্ন ছিল।

নিনেভেহ শহর পানিতে তলিয়ে যাওয়া বিষয়ে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ কারণে, বেরোসাস বলেন, “তিনি প্রাচীরগুলোর সংস্কার করলেন, যাতে কেউ শহরে হামলা চালালেও নদীর গতিপথ পরিবর্তন করতে না পারে”।

অ্যারিস্টটল মন্তব্য করেন, “নেবুচাদনেজারের অধীনে ব্যাবিলন একটি বিশাল আকারের শহরে রূপান্তরিত হয়। বলা হয়ে থাকে, পরিশেষে যখন ব্যাবিলনের ক্ষমতার হাতবদল হল, পুরো শহরের মানুষকে সেটা টের পেতে পুরো ৩ দিন সময় লেগে যায়।

তবে দালানের এত শানশওকত থাকা সত্ত্বেও, ধারণা করা হয়, আদতে নেবুচাদনেজার অতটা শক্তিশালী ছিলেন না। ৫৯৫ সালে তাকে একটি অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ দমন করতে হয়। সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিদ্রোহ দমন করতেই তার দুই মাস লেগে যায়। এক্ষেত্রে ধারণা করা যায়, নিরন্তর যুদ্ধ করতে করতে তার বাহিনী ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।

মিশরের প্রমাণও এক্ষেত্রে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।

ততদিনে দ্বিতীয় নেচোর জীবনাবসান হয়েছে। দুই বার নেবুচাদনেজারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও তিনি জয়লাভ করতে ব্যর্থ হন। বদ্বীপের বাইরের যুদ্ধের দুই বছর পর, ৫৯৫ সালে তিনি মারা গেলে মিশরের সিংহাসন চলে যায় নেচোর পুত্র সাম্মেটিকাস দ্বিতীয়র কাছে।

সাম্মেটিকাস দ্বিতীয়র মিশরীয় সামরিক বাহিনীতে একটি শক্তিশালী নৌবহরও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি এই নৌবহর শুধু বাণিজ্যে ব্যবহার করেননি, বরং প্রাচীন আমলের ফারাওদের মতো ক্ষমতা বিস্তারেও ব্যবহার করেন। তিনি নুবিয়ায় অভিযান চালান। এ শহরটি দীর্ঘদিন মিশরের ফারাওদের নাগালের বাইরে ছিল। তিনি সঙ্গে করে দুই ডিভিশন সেনা নিয়ে এসেছিলেন—মিশরের সেনাপতি আমাসিসের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন ও ভিন্ন এক সেনাপতির অধিনস্থ গ্রিক সেনাদল। তিনি নিজে আসওয়ানে থেকে গেলেও তার দুই ডিভিশন দক্ষিণের দিকে আগাতে লাগল। এই যুদ্ধের স্মৃতি গ্রিকদের আঁকা একটি গ্রাফিতিতে অমর হয়ে আছে। মিশরের ইতিহাস নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও, এ যুদ্ধের সঙ্গে তাদের নিজেদের সংযুক্তির কারণে এর ছবি-চিত্র স্থান পায় আবু সিমবেলে রামসেস দ্বিতীয়র সুবিশাল মূর্তির পায়ের উপর।

“এটা তারা লিখেছিলেন, যারা সাম্মেটিকাসের সঙ্গে নৌযাত্রায় গিয়েছিলেন। যারা বিদেশি ভাষায় কথা বলতেন, তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পটাসিমতো, আর মিশরীয়দের নেতা ছিলেন আমাসিস।”

নাপাতায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল এবং ৪ হাজার ২০০ নুবিয়ান হতাহত ও আটক হন। এসব অভিযানের খবর পেয়ে জেদেকিয়াহ সাম্মেটিকাস দ্বিতীয়র কাছে সংবাদ পাঠালেন : মিশর যদি নেবুচাদনেজারের বিরুদ্ধে হামলা চালায়, তাহলে জেরুজালেম তাদের সঙ্গে যোগ দিতে আগ্রহী। জোসেফাস বলেন, তিনি “মিশরীয়দের সঙ্গে নিয়ে বিদ্রোহ” করলেন, “এই আশায় যে তাদের সহায়তায় ব্যাবিলনীয়দের পরাভূত করা যাবে”।

নেবুচাদনেজার তখন দুর্বল অবস্থায় ছিলেন। সাম্মেটিকাস এই হামলায় যোগ দিতে রাজি হলেন। তিনি তার মিশরীয় ও গ্রিক ভাড়াটে সেনাদের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী নিয়ে প্রথাগত উপায়ে ভূমির উপর দিয়ে, বদ্বীপ পেরিয়ে এগোতে লাগলেন। ইতোমধ্যে ব্যাবিলনের বাহিনী জেরুজালেমের প্রাচীরে উপস্থিত হয়েছিল—কারণ জেদেকিয়াহ’র নজরানা সময়মতো পৌঁছেনি। এই অগ্রসরমান শত্রুকে দেখে তারা পিঠটান দিয়ে নিজ রাজধানীতে ফিরে গেলেন।

রাজসভার প্রফেট জেরেমাইয়াহ তখনো আসন্ন অমঙ্গলের ভবিষ্যদ্বাণী করে যাচ্ছিলেন। তিনি জেদেকিয়াহকে সতর্ক করলেন, এখনও সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি আসেনি। তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘আপনাকে সহায়তা দিতে এগিয়ে আসা ফারাওর বাহিনী তাদের নিজেদের দেশে ফিরে যাবে। তখন ব্যাবিলনীয়রা ফিরে আসবে। এমনটা ভেবে নিজেকে মিথ্যে আশা দেবেন না যে, ব্যাবিলনীয়রা আমাদের ছেড়ে দেবে। তারা (মিশর) যদি সমগ্র ব্যাবিলনীয় বাহিনীকেও পরাজিত করে, তবুও তাদের আহত ও দুর্বল সেনারা এসে আমাদের শহরকে জ্বালিয়ে দেবে।”

এই বক্তব্যকে বড় আকারে অনাস্থা ভোট হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু জেদেকিয়াহ তার কথা শোনেননি। বরং তিনি জেরেমাইয়াহকে একটি কারাগারে আটকে রাখেন, যেখানে কেউ তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেত না।

একজন সেনা, যথা কারণেই মন্তব্য করলেন, “তিনি সৈন্যদের নিরুৎসাহিত করছেন”। ইতোমধ্যে নেবুচাদনেজার মিশরীয়দের বিপক্ষে লড়লেন এবং তাদেরকে পরাজিত করলেন। তিনি তাদেরকে সিরিয়া পর্যন্ত তাড়া করলেন। সাম্মেটিকাস দ্বিতীয় নিজ দেশে ফিরে গেলেন। কয়েক সপ্তাহ পরেই ৫৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি মারা গেলেন। তার সিংহাসনে বসলেন তারই ছেলে এপ্রিস। তিনি তার পিতার ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি পণ করলেন, আর জীবনেও জেদেকিয়াহ বা তার কোনো বংশধর সাহায্য চাইলে আগাবেন না। পরবর্তীতে জেরেমাইয়াহ ও এজেকিয়েলের লেখা বর্ণনায় এমনটাই জানা গেছে। মহান রাজা নেবুচাদনেজারের বিরোধিতা করার দুঃসাহস দেখাননি এপ্রিস।

এরপর নেবুচাদনেজার জেরুজালেমের প্রাচীরের দিকে নজর ফেরালেন। দুর্গভিত্তিক শহর আজেকাহ ও লাচিশের নিয়ন্ত্রণ ছিল জেদেকিয়াহর বাহিনীর হাতে। এ শহরগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল সম্ভাব্য ব্যাবিলনীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা দেওয়ার জন্য। কিন্তু পর্যায়ক্রমে শহরদুটির পতন হল। দীর্ঘ সময় ধরে এই বেদনাদায়ক পরাজয়ের বিষয়টটি লাচিশে খুঁজে পাওয়া একটি মাটির পাত্র খোদাই-করা অবস্থায় পাওয়া যায়। এ অঞ্চলের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত সেনারা এসব বার্তা বিনিময় করেছিলেন। তারা নেবুচাদনেজারের হামলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। শুরুতেই আক্রান্ত হয়ে আজেকাহ।

এক বার্তায় লেখা ছিল, “আমার প্রভুকে জানাচ্ছি। আমরা আর আজেকাহর নিশানাগুলো দেখতে পাচ্ছি না।” অর্থাৎ, আজেকাহর পতন হয়েছে, সব আলো নিভে গেছে এবং পরবর্তীতে ব্যাবিলনের অন্ধকারাচ্ছন্ন জোয়ারে লাচিশও ভেসে যায়। ব্যাবিলনের বাহিনী অবশেষে জেরুজালেমে এসে পৌঁছায়।

দুই বছর ধরে চলল যুদ্ধ। জোসেফাসের বর্ণনায়, যুদ্ধের পাশাপাশি “দুর্ভিক্ষ ও মহামারি” আঘাত হেনেছিল। এই দুর্ভিক্ষই যুদ্ধের অবসানের মূল কারণ। ৫৮৭ সাল নাগাদ জেদেকিয়াহ অনুধাবন করলেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে’। তিনি দেশের জনগণের কথা ভুলে যেয়ে পালানোর চেষ্টা করলেন। টু কিংস-এর ইতিহাসবিদ বলেন, “দুর্ভিক্ষ এতটাই প্রকট ছিল যে মানুষের জন্য কোনো খাবার ছিল না।”

তারপর শহরের প্রাচীর ভেঙে পড়ল এবং রাজার বাগানের দুইটি প্রাচীরের কাছাকাছি অবস্থিত তোরণ দিয়ে রাতের আঁধারে সেনাবাহিনীর সকল সদস্য পলায়ন করল। ব্যাবিলনীয়রা পুরো শহরকে ঘিরে ফেললেও তারা জর্ডান উপত্যকার দিকে পালানোর চেষ্টা চালাল। ব্যাবিলনের বাহিনী রাজাকে তাড়া করে তাকে জেরিকোর সমতলভূমিতে আটক করল। ততক্ষণে তার সেনাবাহিনী তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। তিনি কোনো ধরনের বাধা না দিয়েই ধরা পড়লেন।

নেবুচাদনেজারের চরিত্রে আমরা অ্যাসিরীয় রাজাদের প্রথাগত নিষ্ঠুরতার তেমন কোনো প্রমাণ না পেলেও, এবারের ঘটনা ছিল ভিন্ন—তিনি প্রতিশোধের লেলিহান আগুনে ক্রোধান্বিত হয়ে পড়েছিলেন।

জেদেকিয়াহকে ধরে-বেঁধে তার সেনাঘাঁটিতে নিয়ে আসা হল। তিনি নির্দেশ দিলেন রাজার ছেলেদের (যারা তখনো শিশু ছিল) তার চোখের সামনে হত্যা করার। এরপরই জেদেকিয়াহর চোখ উপড়ে নিতে বললেন তিনি, যাতে তার দেখা শেষ দৃশ্যটি হয় তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ড।

অন্ধ জেদেকিয়াহকে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় ব্যাবিলনে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। তার সব প্রধান কর্মকর্তা ও পূজারিদের সেই একই সেনাঘাঁটির বাইরে পর্যায়ক্রমে হত্যা করা হয়। নেবুচাদনেজার তার বাহিনীর সর্বাধিনায়ককে জেরুজালেমে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। শহরের সব প্রাচীর ভেঙে ফেলা হয়; নাগরিকদের নির্বাসনে পাঠানো হয়। রাজার প্রাসাদ, সকল বাড়িঘর, রাজকোষ এবং সলোমনের মন্দির—সবকিছুকেই আগুনের শিখা গ্রাস করে নেয়। ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের অনেকে সমগ্র ব্যাবিলন জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থিতু হওয়ার চেষ্টা চালান। কেউ কেউ মিশরেও পালিয়ে যান। এভাবেই শুরু হয় এক বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর দুই হাজার বছরের ইতিহাস। জোসেফাস বলেন, “এভাবেই ডেভিড বংশের রাজাদের জীবনাবসান হল।”

ইতোমধ্যে নেবুচাদনেজারের শ্বশুর সিয়ারক্সেসের অধীনস্থ মিত্র মেদেসরা নিরবচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চালিয়ে এশিয়া মাইনরের দিকে আগাচ্ছিল। জেরুজালেমের পতন হতে হতে মেদেস লিদিয়ান সীমান্তে পৌঁছে যায়।

১০০ বছর আগে সিমেরীয়ানরা লিদিয়ার ওপর হামলা চালিয়েছিল। এরপরে থেকেই তারা নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করছিল। কিছু লিদিয়ান অভিবাসন করে থ্রেসে চলে গেছিল, এবং খুব সম্ভবত, আরও পশ্চিমেও গেছেন তারা। কিন্তু অনেরা সেখানে থেকে গিয়েছিল। গাইগেসের বংশধর আলিয়াত্তেস তখন লিদিয়ার রাজা। তার নেতৃত্বে লিদিয়ান বাহিনী মেদেসের বিপক্ষে যুদ্ধ লড়তে এগিয়ে এল। এ যুদ্ধে কোনো ফল এল না।

৫৯০ থেকে ৫৮৫ পর্যন্ত দুই বাহিনী হ্যালিস নদীর তীরে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করল। কেউ এ যুদ্ধে অপরের বিরুদ্ধে কোনো সুবিধা আদায় করতে পারেনি। হেরোডোটাস মন্তব্য করেন, এই ৫ বছরে “অনেকগুলো যুদ্ধ মেদেসের পক্ষে” গেলেও, “একই পরিমাণ যুদ্ধ লিদিয়ানদের পক্ষেও” যায়। ৫৮৫ সালে নেবুচাদনেজার এই অচলাবস্থার নিরসনে বিশেষ উদ্যোগ নেন। তিনি দুই পক্ষের সেনাদলের মাঝে যুদ্ধবিরতি চালু করার জন্য নাবোনিদাস নামে এক ব্যাবিলনীয় সেনা কর্মকর্তাকে পাঠান।

কূটনীতিবিদ হিসেবে নাবোনিদাস বেশ কার্যকর ছিলেন। দুই রাজা শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হলেন। আল্যাত্তের মেয়ে আরিয়েনিসের সঙ্গে সিয়ারক্সেসের ছেলে মেদিয়ান রাজপুত্র আস্তিয়াজেসের বিয়ে হল।

তবে বাস্তবে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হত নেবুচাদনেজার যদি লিদিয়ানদের পরাজিত করার জন্য মেদেসের কাছে সেনাবাহিনী পাঠাতেন। তবে, সিয়ারক্সেস ততদিন মেদেস ও পারস্যের রাজা হিসেবে ৪০ বছর পার করেছেন। তিনি ছিলেন একজন অসুস্থ ও বৃদ্ধ রাজা, যিনি যুদ্ধ বন্ধের জন্য সবধরনের উদ্যোগে রাজি ছিলেন। দুই পক্ষের চুক্তি ও রাজকীয় বিয়ের অনুষ্ঠানের পরপরই তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন এবং অল্পদিনের মাঝেই দেহত্যাগ করেন। আস্তিয়াজেস মেদেস ও পারস্যের রাজা হলেন। কিন্তু তিনিও যুদ্ধে ফিরে না যেয়ে নিজ স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফিরে যান।

নেবুচাদনেজারও অসুস্থ ছিলেন। খুব সম্ভবত এ কারণে তিনিও ব্যাবিলন থেকে বাহিনী পাঠাননি।

নেবুচাদনেজারের রাজত্ব, বিশেষত এর শেষভাগে অত্যন্ত রহস্যজনক কিছু ঘটনা ঘটে। এসব গোলযোগপূর্ণ সময়ের সবচেয়ে নিখুঁত বর্ণনা পাওয়া যায় ‘দ্য বুক অব দানিয়েলে’, যেখানে ব্যাবিলনে ধরে নিয়ে যাওয়া ৪ ইহুদি ব্যক্তির জীবন সম্পর্কে জানানো হয়। তাদেরকে নেবুচাদনেজারের কর্মকর্তারা ব্যাবিলনে আটকে রেখে ব্যাবিলনীয় হিসেবে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। এদের মাঝে একজনের নাম ছিল দানিয়েল। তাকে নেবুচাদনেজারের একটি স্বপ্নের ব্যাখা দেওয়ার জন্য ডেকে আনা হয়েছিল। রাজা স্বপ্নে রাতের বেলায় একটি সুন্দর সুন্দর পাতা ও ফল সমৃদ্ধ বিশাল গাছ দেখেছিলেন। এই গাছের নিচে অসংখ্য পশুপাখি ও ডালে ডালে পাখিরা আশ্রয় নিয়েছিল। স্বপ্নে তিনি আরও দেখেন এই সুন্দর গাছটিকে কেটে ফেলা হয়েছে, এর ছাল-বাকল উপড়ে এর গুঁড়িটিকে ব্রোঞ্জ দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।

অ্যাসিরীয় ও ব্যাবিলনীয় রাজা, উভয়ের কাছেই পবিত্র গাছ তাদের ক্ষমতার উৎস হিসেবে বিবেচিত। ফলে এ-ধরনের স্বপ্ন দেখে যারপরনাই শঙ্কিত হলেন নেবুচাদনেজার। এ ঘটনাকে অশনি সংকেত হিসেবে ধরে নিলেন তিনি। স্বপ্নের ব্যাখ্যাদাতা দানিয়েলও তার সঙ্গে একমত প্রকাশ করলেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী দিলেন, রাজা পাগলামিতে আক্রান্ত হবেন এবং কিছু সময়ের জন্য ক্ষমতাচ্যুত হবেন। অবধারিতভাবেই, ঠিক সেটাই হল। দানিয়েলের বর্ণনায়, “তিনি তার সম্প্রদায় থেকে দূরে চলে গেলেন এবং গরুর মতো ঘাস চিবিয়ে খেতে লাগলেন। তার সারাশরীর স্বর্গের শিশিরকণায় আর্দ্র হল এবং তার চুলগুলো ঈগল পাখির পালক এবং নখগুলো পাখির নখের মতো বড় হল।” তিনি ৭ বছর এ পরিস্থিতিতে ছিলেন।

পরবর্তীতে ইহুদিদের বর্ণিত বাইবেল-সংক্রান্ত বিভিন্ন বইতে এ ঘটনার বিশদ ব্যাখা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, রাজাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য প্রাণীতে রূপান্তর করা হয়েছিল। অনেক পরে লেখা কিছু বইতে নেবুচাদনেজারের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের শাস্তি হিসেবে এ রূপান্তরের কথা বলা হয়। আবার অপর এক বইতে বলা হয়, তিনি মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন, কিন্তু তিনি আংশিকভাবে পশুতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন।

“কেননা তার মাথা ও তৎসংলগ্ন অঙ্গগুলো ষাঁড়ের মতো ছিল, এবং তার পা ও তৎসংলগ্ন অংশগুলো সিংহের মতো হয়ে গেছিল, যা স্বৈরশাসকদের বৈশিষ্ট্য—তাদের পরবর্তী জীবনে তারা বন্য পশুতে পরিণত হন।”

এটা ছিল গিলগামেশের উপাখ্যানের পুরোপুরি বিপরীতধর্মী একটি গল্প, যেখানে বন্য মানুষ এনকিদু দেখতে মানুষের মতো ছিল, কিন্তু সে ক্ষেতখামারে ঘুরে বেড়িয়ে পশুর মতো ঘাস খেত। গিলগামেশের গল্পে (পৃথিবীর ইতিহাস : মহাপ্লাবন থেকে রোম সাম্রাজ্যের পতন-এর প্রথম খণ্ড দ্রষ্টব্য) এনকিদুর চরিত্রে একজন রাজার চরিত্রের স্বৈরতান্ত্রিক, সভ্যতাবিবর্জিত, ক্ষমতালিপ্সু ও অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশটি ফুটে উঠেছে। এ বিষয়গুলো এমন যে, এসবের সঙ্গে লড়াই করে জয়ী না হওয়া পর্যন্ত একজন রাজা তার দায়িত্বের উৎকর্ষে পৌঁছাতে পারেন না। গিলগামেশ ও এনকিদুর উপাখ্যানে একজন মানুষ ভালো রাজা তখনই হবেন (এবং তার ছায়ায় ঢাকা অংশটি মানবিক হবে), যখন তিনি বাধাহীনভাবে তার ক্ষমতার অপব্যবহারের লোভকে জয় করতে পারবেন। কিন্তু নেবুচাদনেজার সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে যান। তিনি ধীরে ধীরে একনায়কসুলভ হয়ে ওঠেন এবং একজন মহান রাজা থেকে পশুতুল্য অস্তিত্বের দিকে অগ্রসর হন।

প্রতিবেশীদের কল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করলেও, একটি সাম্রাজ্যের কেন্দ্র হিসেবে ব্যাবিলনের স্থায়িত্ব ছিল খুবই স্বল্প সময়ের জন্য। হাম্মুরাবি ছিলেন ব্যাবিলনের প্রথম মহান রাজা, আর নেবুচাদনেজার ছিলেন দ্বিতীয় I

দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার, যাকে নিয়ে আমাদের এই অধ্যায়ের আলোচনা—তিনি ছিলেন তৃতীয়, ও সর্বশেষ মহান ব্যাবিলনীয় রাজা। ব্যাবিলনের সঙ্গে সম্রাটের বিষয়টি ঠিক খাপ খায় না।

সুমেরীয়রা প্রাচীন আমলে শাসকগোষ্ঠী নিয়ে বিব্রত ছিলেন। সে একই প্রবণতার প্রত্যাবর্তন দেখি আমরা নেবুচাদনেজারের পাগলামির গল্পে। নেবুচাদনেজারও তার ‘ভেতরের পশুর’ দ্বারা আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। দানিয়েল এমন এক দেশে জন্ম নিয়েছিলেন, যেখানে শত শত বছর ধরে দেবতাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেয়ে রাজা নির্বাচন করা হত। তিনি এ গল্পের একটি ধর্মতাত্বিক যতি টানেন—মানুষ রাজা ও রাজত্বকে ভয় পায়, কারণ প্রতিটি মানুষই ক্ষমতালোভী, এবং এ লোভের কারণেই তাদের জীবনে দুর্দশা নেমে আসে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *