1 of 2

৫৫. মেদেস ও পারস্যবাসীরা

অধ্যায় ৫৫ – মেদেস ও পারস্যবাসীরা

খ্রিস্টপূর্ব ৬৫৩ থেকে ৬২৫ সালের মাঝে আশুরবানিপাল একটি পাঠাগার তৈরি করেন এবং এলাম ধ্বংস করেন। ইতোমধ্যে মেদেস ও পারস্য একীভূত হয়ে একটি জাতি তৈরি করে।

আশুরবানিপাল সাম্মেটিকাসকে উচিত শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হন। তবে এখানেই তার ‘ভূখণ্ড হারানো” থেমে থাকেনি। তার শাসনামলে অ্যাসিরীয়ার সীমান্ত কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়ে। আশুরবানিপাল একজন যোগ্য শাসক ছিলেন, কিন্তু তিনি সারগনের মতো হতে পারেননি—তার পক্ষে সম্ভব ছিল না তার সকল ক্ষমতা যুদ্ধযাত্রায় ঢেলে দিয়ে সারাক্ষণ সীমান্ত বড় করার খেলায় মেতে থাকা। তিনি অন্য একধরনের সমস্যায় ভুগছিলেন।

তিনিই প্রথম অ্যাসিরীয় রাজা ছিলেন না, যিনি কাদামাটির তৈরি ট্যাবলেটের সংগ্রহ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তবে তিনিই ছিলেন প্রথম রাজা, যার পুরো সাম্রাজ্যজুড়ে প্রশাসনের একটি বড় দায়িত্ব ছিল সকল গলি-ঘুপচি খুঁজে, সব ধরনের ট্যাবলেট খুঁজে নিয়ে আসা। তিনি এই কাজটি বেশ গুছিয়ে করেন। তিনি তার সাম্রাজ্যের যেকোনো প্রান্তে অবস্থিত পাঠাগারে তার সেনাদের পাঠাতেন। তারা সেখানে যেয়ে এসব ট্যাবলেটের তালিকা তৈরি করতেন এবং সবধরনের ট্যাবলেটের অনুলিপি সংগ্রহ করার ব্যবস্থা নিতেন। এসব ট্যাবলেটে তন্ত্র-মন্ত্র, ভবিষ্যদ্বাণী, চিকিৎসা প্রক্রিয়া, জ্যোতির্বিদদের পর্যবেক্ষণ, গল্প ও উপাখ্যান (যার মধ্যে ছিল প্রাচীন বীর গিলগামেশের ১ হাজার বছরের কীর্তির বয়ান), ইত্যাদি। একপর্যায়ে নিনেভেহ’র পাঠাগারে প্রায় ৩০ হাজার ট্যাবলেটের বিশাল সংগ্রহ গড়ে ওঠে। আশুরবানিপাল এই পাঠাগারকে তার শাসনামলের সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করতেন।

এসারহাদোন হয়তোবা মিশরের দখলদারিত্ব বজায় রাখতে পেরেছিলেন, কিন্তু আশুরবানিপালের এই অমর, চিরস্থায়ী কীর্তির ধারেকাছেও তিনি পৌঁছাতে পারেননি।

জাগতিক বিষয়গুলোতে তিনি এতটা পারদর্শিতা দেখাতে পারেননি। এলামাইট রাজা ব্যাবিলন আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এবং এলামের উত্তরে নতুন এক শত্রু আবারও হুমকিতে রূপান্তরিত হচ্ছিল।

সাম্মেটিকাস যে-বছর বিদ্রোহ করলেন, সে-বছরই এলামাইট রাজা টিউম্যান ও তার বাহিনী ব্যাবিলনের উদ্দেশে রওনা হল। ধারণা করা হয়, টিউম্যানকে একটি উষ্ণ অভ্যর্থনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ততদিনে আশুরবানিপাল ও তার ছোটভাই ও ব্যাবিলনের ভাইসরয় শামাশ-শুম-উকিনের মধ্যে কিছুটা দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। তবে শামাশ-শুম-উকিনের লেখানো প্রথমদিকের শিলালিপিগুলোতে আশুরবানিপালকে ভদ্রতা করে ‘আমার প্রিয় ভাই’ ও ‘পৃথিবীর চার চতুর্থাংশের রাজা’ হিসেবে অভিহিত করে তার সুস্বাস্থ্য ও শত্রুদের বিনাশ কামনা করা হয়।

তবে ব্যাবিলনে আশুরবানিপালের লেখানো প্রায় সমান সংখ্যক শিলালিপিতে দেখা যায়, তিনি দাবি করেছেন যে, এই শহরের বেশিরভাগ খুঁটিনাটি কাজ তিনিই তদারকি করেছেন, এবং তা বেশ কয়েক বছর ধরে। এই পরিস্থিতিতে, একটি এলামাইট সেনাদলের আগমন শুম-উকিনকে তার ভাইয়ের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে পারত।

যখন আশুরবানিপাল খবর পেলেন, এলামাইটরা রওনা হয়েছে, তিনি তার রাজসভার পুরোহিতদের দ্বারস্থ হলেন। তারা তাকে আশ্বস্ত করলেন যে, দেবতারা তার পক্ষেই আছেন। একথা শুনে তিনি টাইগ্রিস নদী পেরিয়ে এলামাইটদের নিজ ভূখণ্ডেই তাদের মোকাবিলা করলেন। তার বাহিনী এলামাইটদের ঠেঙিয়ে সুসা শহরে ফেরত পাঠাল। অসংখ্য এলামাইট প্রাণ হারালেন। আশুরবানিপাল দাবি করেন, তিনি এলামের নাগরিকদের লাশ দিয়ে নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং তাদের রাজা টিউম্যান পৈতৃক প্রাণ বাঁচাতে লেজ তুলে পালান।

প্রকৃত সত্য হল, এলামের রাজা টিউম্যান আহত হয়েছিলেন। তার জ্যেষ্ঠ সন্তান বাবার হাত ধরে এক জঙ্গলে পালিয়ে যান। কিন্তু পথিমধ্যে রাজাকে বহনকারী রথ ভেঙে পড়ে যায় এবং তিনি এর কাঠামোর নিচে চাপা পড়েন। টিউম্যান মরিয়া হয়ে তার ছেলেকে বলেন, ‘ধনুক হাতে তুলে নাও আর আমাদের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করো’। কিন্তু সে রথের ভাঙা লাঠি রাজাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়ার পাশাপাশি তার ছেলেকেও মারাত্মকভাবে আহত করেছিল। আশুরবানিপাল বলেন, ‘আসসুরের (দেবতা) কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে আমি তাদের হত্যা করলাম। আমি বাবার সামনে ছেলে, আর ছেলের সামনে বাবার শিরোচ্ছেদ করলাম।’

শিলালিপি থেকে আমরা আরও কিছুটা তথ্য পাই। আশুরবানিপাল কাটা- মাথাগুলো সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন এবং এগুলোকে তার বাগানে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। এই বাগানের সুসজ্জিত গাছগাছালির নিচে বসেই তিনি ও তার স্ত্রী মধ্যাহ্নভোজনে অংশ নিতেন। ইতোমধ্যে, শামাশ-শুম-উকিন শাসক হিসেবে টিকে রইলেন। মৃত টিউম্যানের সঙ্গে তার যোগসাজশের বিষয়ে কোনো প্ৰমাণ পাওয়া যায়নি।

প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে, অপর এক সেনাদল নিনেভেহ অভিমুখে যাত্রা শুরু করল।

কয়েক বছর আগেই মাদুয়া গোত্রগুলো নিজেদের সমন্বিত করে একটি মেদিয়ান রাজত্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। আশুরবানিপালের অভিষেকের কিছু সময় আগে মেদিয়ান গোত্রগুলোর মধ্যে দেইওসেস নামের এক বিচারক ন্যায়বিচার ও সততার জন্য বেশ সুনাম অর্জন করেন। তাকেই নেতা হিসেবে মেনে নেন মেদিয়ান রাজত্বের বাসিন্দারা।

হেরোডোটাস বর্ণনা করেন, ‘হাতে ক্ষমতা পাওয়ার পর দেইওসেস দাবি করেন, রাজত্বের জন্য নতুন একটি শহর নির্মাণ করা হোক এবং সকল কার্যক্রম সেখান থেকেই পরিচালনা করা হোক। এরপর কেন্দ্রীয় শহর একবাতানা নিৰ্মাণ করা হল এবং এটি উদীয়মান এক জাতির পরিচয় হয়ে দাঁড়াল।’

একবাতানা ছিল প্রাচীন আমলে নির্মিত শহরগুলোর মধ্যে এক অসামান্য কীর্তি। ওরন্তেস পর্বতমালার পূর্বদিকের ঢালে নির্মিত এই শহরকে ঘিরে ছিল ৭টি চক্রাকার প্রাচীর। প্রাচীরগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল, যাতে প্রতিটির শীর্ষে দাঁড়িয়ে পরবর্তী প্রাচীরের মাথা দেখা যায়। প্রাচীরের উপর বিশেষ রঙে রাঙানো অবস্থানে তিরন্দাজরা অবস্থান গ্রহণ করতে পারতেন। প্রাচীর ও রাজপ্রাসাদে সাদা, কালো, লাল, নীল ও কমলা রঙে রাঙানো হয়েছিল—একেক রঙে একেক ধরনের স্থাপনা বোঝানো হত। এছাড়া ষষ্ঠ ও সপ্তম (সর্বশেষ) প্রাচীর রুপা ও সোনায় মোড়ানো ছিল। রাজপ্রাসাদটিও স্বর্ণখচিত ছিল, সব মিলিয়ে প্রাচীন পৃথিবীতে একবাতানা ছিল এক দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা—সমুদ্র থেকে ৬ হাজার ফুট উপরে, পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত এই শহরটির রঙের বাহারে একে শিশুর খেলনা মনে হলেও আদতে এটি ছিল সকল শত্রুর জন্য বড় এক হুমকি।

খ্রিস্টপূর্ব ৬৭৫ সালে দেইওসেসের ছেলে ফ্রাওরতেস তার পিতার কাছ থেকে নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন।

একবাতানা থেকে ফ্রাওরতেস নিকটবর্তী শহর পারসুয়ায় আক্রমণ করলেন। সেখানে থাকতেন পারসিয়ান বা পারস্যবাসীরা, যারা তাদের সামন্তপ্রভু আচামেনেসের অধীনে একটি ঢিলেঢালাভাবে সমন্বিত রাষ্ট্র ছিল। তাদেরকে পরাভূত করে দাসরাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হল। হেরোডোটাস মন্তব্য করেন, ফ্রাওরতেসের পতাকার নিচে ‘দুই শক্তিশালী দেশ’ আসার পর তিনি ‘একের পর এক গোত্র’ দখলের মাধ্যমে এশিয়া দখল করার দিকে দৃষ্টি দিলেন। অবশেষে তিনি একজন রাজা হয়ে উঠেছিলেন।

৬৫৩ সালে ফ্রাওরতেস এমনকি, জংলি স্বভাবের সিম্মেরিয়ানদের সঙ্গেও জোট বাঁধতে সক্ষম হন। আশুরবানিপাল অ্যাসিরীয়ায় যেসব সমস্যায় ভুগছিলেন, সেগুলোর সুযোগ নিতে মেদেস, পারসিয়ান ও সিম্মেরিয়ানরা একতাবদ্ধ হল।

তবে এক্ষেত্রে হিসেবে গরমিল ছিল। সমীকরণে স্কাইথিয়ানদের ধরা হয়নি। আশুরবানিপালের বোনের সঙ্গে স্কাইথিয়ান রাজার বিয়ে হয়েছিল। এই ত্রিমুখী জোটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় স্কাইথিয়ান বাহিনী; অ্যাসিরীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর পাশাপাশি বুক পেতে দাঁড়ায় তারা। স্বভাবত সিম্মেরিয়ান, মেদেস ও পারসিয়ানদের বিদেয় করার পাশাপাশি ফ্রাওরতেসকেও হত্যা করতে সক্ষম হন স্কাইথিয়ান সেনাপতি মাদিউস। যুদ্ধের পর তিনি নিজেকে মেদেস ও পারস্যের রাজা হিসেবে ঘোষণা দেন।

পরের বছরেই শামাশ-শুম-উকিনের ভাইয়ের প্রতি ঘৃণার বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসে। তিনি ব্যাবিলনের সেনাদের কুতহাহ নামে অ্যাসিরীয়ার একটি চৌকিতে পাঠান। এটি ছিল ব্যাবিলনের ঠিক উত্তরে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি তার ভাইয়ের সেনাদের বের করে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন।

আশুরবানিপাল পালটা আক্রমণের উদ্দেশে তার নিজ বাহিনী জড়ো করলেন। তিনি বেশ উদ্বেগের সঙ্গে সূর্যদেবতা সামাশের কাছে কিছু প্রশ্ন রেখেছিলেন, যার নথিবদ্ধ প্রমাণও আজও টিকে রয়েছে—’শামাশ, মহান প্রভু! এলামাইটরা কি যুদ্ধে যোগ দেবে?’ এ প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁবোধক ছিল, এবং বাস্তবেও শামাশ-শুম-উকিনের বিদ্রোহকে আরও জোরদার করতে তারা সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। টিউম্যানের মৃত্যুর পর এলামাইট রাজ্যগুলোকে কোনো রাজা একীভূত করতে সক্ষম হননি। ধারণা করা হয়, সেনাবাহিনী নিজেরাই নিজেদের দেখভাল করছিল। শামাশ-শুম-উকিন নিজেকে ব্যাবিলনের প্রাচীরের নিরাপত্তায় লুকিয়ে রাখেন। আশুরবানিপাল খুব শিগগির তার দেবতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “শামাশ-শুম- উকিনের বাহিনী কি ব্যাবিলন ছেড়ে যাবে?’। এরপর আবারও তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘অ্যাসিরীয় বাহিনী কি শামাশ-শুম-উকিনের বিরুদ্ধে জয়ী হবে?’

এই বাহিনী যুদ্ধে জিতলেও এর জন্য অনেক বড় মূল্য চোকাতে হয়—৩ বছরের যুদ্ধে দুর্ভিক্ষ ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। বর্ণনা মতে, ‘তারা ক্ষুধার তাড়নায় তাদের পুত্র ও কন্যাদের মাংস ভক্ষণ করে। অবশেষে যখন শহরের পতন হল, আশুরবানিপালের সেনারা বিদ্রোহীদের ওপর কোনো ধরনের মায়া-মমতা দেখাননি। তার দাদা সেন্নাশেরিবের মতো, তিনিও মত দিলেন, ‘ব্যাবিলনে বিপদ ছাড়া আর কিছুই নেই।’

‘যারা বেঁচে রইলেন, তাদেরকে ঠিক সে জায়গায় আমি হত্যা করলাম, যেখানে সেন্নাশেরিবকে হত্যা করা হয়েছিল। এবং তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশগুলো আমি কুকুর, শূকর, নেকড়ে, ঈগল ও স্বর্গীয় পাখি এবং গভীর সমুদ্রের মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করলাম’, বলেন তিনি।

শামাশ-শুম-উকিন তার রাজপ্রাসাদে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করলেন। তিনি তার ভাইয়ের প্রতিহিংসা থেকে বাঁচতে এই ব্যবস্থা নেন।

আশুরবানিপাল সুষ্ঠু নিয়ম অনুযায়ী তার ভাইয়ের লাশ কবর দেওয়ার ব্যবস্থা নিলেন এবং তার এক প্রতিনিধিকে ব্যবিলনের পুতুল শাসক হিসেবে নিয়োগ দিলেন। এই লোকের নাম ছিল কানদালু। প্রায় ২০ বছর কানদালু এই দায়িত্বে ছিলেন। তবে তিনি কোনো প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। এ কারণে এই দীর্ঘ সময়ে ব্যাবিলনে কোনো রাজকীয় শিলালিপি লেখা হয়নি।

এরপর আশুরবানিপাল নতুন এক যুদ্ধে অংশ নিলেন। এটাই ছিল তার আমলে সাম্রাজ্য বিস্তারকারী একমাত্র সংঘাত। পূর্বদিকে এলামাইট সিংহাসনের যোগ্য উত্তরাধিকারী নির্বাচনে গৃহযুদ্ধ বেধে যায়। এর সুযোগ নিয়ে আশুরবানিপাল দুইবার তার সেনাবাহিনী নিয়ে টাইগ্রিস নদী পার হলেন। প্রতিবারই তিনি বড় আকারে হামলা চালালেন। এলামাইট শহরে আগুন লাগল এবং পুরো অঞ্চল আশুরবানিপালের দখলে এল।

সুসার মন্দির ও প্রাসাদ লুট করা হল। এক্ষেত্রে প্রতিহিংসাই ছিল মূল কারণ। আশুরবানিপাল নির্দেশ দিলেন, রাজকীয় কবরগুলো খুঁড়ে প্রয়াত রাজ-রাজড়ার হাড়গোড় বস্তাবন্দি করে নিয়ে যাওয়া হোক।

ভবিষ্যতে এলামের সিংহাসনের দাবিদার হতে পারেন, এরকম সব ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে নিনেভেহতে বন্দি করে রাখা হল। অসংখ্য এলামাইট নাগরিকদের তাদের মাতৃভূমি থেকে নির্বাসন দেওয়া হল। কিছু মানুষ জুদাহ শহরের উত্তরে ইসরায়েলের প্রাচীন এক অঞ্চলে আশ্রয় পেলেন।

তবে এতে তাদের জাতিগত পরিচয়ের খুব একটা ক্ষতি হয়নি। ২০০ বছর পর এ এলাকার প্রশাসক তার রাজার কাছে একটি চিঠি পাঠান। তিনি বলেন, ‘সুসার এলামাইট ও অন্যান্য মানুষ, যাদেরকে মহান আশুরবানিপাল নির্বাসন দিয়ে সামারিয়া ও ইউফ্রেতিসের আশেপাশের অন্যান্য জায়গায় পাঠিয়ে ছিলেন, তারা সবাই আমার পতাকার নিচে একতাবদ্ধ হয়েছে।’

রাজ্য শাসনের ব্যাপারে আশুরবানিপালের দুই ধরনের নীতি ছিল। ঝামেলাপূর্ণ অঞ্চলের ক্ষেত্রে হয় তিনি পূর্ণমাত্রায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাতেন অথবা তাদের অস্তিত্বকে পুরোপুরি অস্বীকার করতেন। মিশর অনেক দূরে থাকা ‘অস্বীকার’ হওয়ার সুবিধা পেয়েছিল। কিন্তু এলাম একেবারে নাকের ডগায় থাকায় তাদের ভাগ্য এতটা সুপ্রসন্ন ছিল না।

এলামের দখল নেওয়ার পরও এর উন্নয়নে কোনো কাজ করেননি আশুরবানিপাল, যেটা একটা বড় ভুল ছিল। তিনি কোনো শহর পুনর্নির্মাণ বা এর সংস্কার করেননি। তিনি অ্যাসিরীয়ার এই নতুন অঙ্গরাজ্যকে অরক্ষিত ও ভগ্ন অবস্থায় ফেলে রাখেন।

শুরুতে খুব সতর্কতার সঙ্গে পারস্যের সামন্তপ্রভু তেইসপেস প্রাচীন এলামাইট অঞ্চল আনশানে প্রবেশ করে এটিকে নিজের বলে দাবি করেন। এটা ছিল আশুরবানিপালের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। কিন্তু এ-অঞ্চলে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো চেষ্টাই তিনি চালাননি। তেইসপেস ছিলেন মাদিয়াস দ্য স্কাইথিয়ানের অধীনস্থ কর্মচারী। মেদেস ও পারস্য, উভয় রাজ্যের রাজা হওয়া সত্ত্বেও মাদিয়াস আপাতদৃষ্টিতে তেসপেসের এই বিদ্রোহী কার্যক্রমে কোনো বাধা দেননি।

৩ থেকে ৪ বছরের মাথায় তেইসপেস মারা গেলেন এবং পারস্যের দায়ভার তার পুত্র সাইরাসের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেলেন। বাবার মতো, ছেলেও মাদিয়াস দ্য স্কাইথিয়ানের পতাকার নিচে পারস্যের শাসন চালিয়ে গেলেন। তিনিও তার বাবার মতোই নিজেকে আনশানের রাজা হিসেবে অভিহিত করেন। আনশানকে আনুষঙ্গিক শহরের মর্যাদা দিয়ে মাদিয়াস তার শহর একবাতানার শাসন কার্যক্রম চালিয়ে গেলেন।

আশুরবানিপালের রাজত্বের শেষ কয়েক বছরে গোলযোগ অনেক বেড়ে যায়। এসময়ের শিলালিপিগুলো কেমন যেন ছন্নছাড়া, ভবিষ্যদ্বাণীগুলো অসম্পূর্ণ। তবে এলামের প্রতি তিনি তার যুগপৎ উদাসীনতার ধারা অব্যাহত রাখেন। হয়তো তিনি অসুস্থ ছিলেন, বা তার মাঝে দেখা দিয়েছিল পাগলামির লক্ষণ। খ্রিস্টপূর্ব ৬৩০ থেকে শুরু করে ৬২৭ পর্যন্ত তার পক্ষে নিয়ে পুত্র আশুর- এতিল্লু-ইলানি রাজ্য শাসন করেন।

সেসন, কাছাকাছি সব রাজ্য অ্যাসিরীয়দের কাছ থেকে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার তোয়াক্কা না করে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো চলছিল। মেদেস ও স্কাইথিয়ানরা উরারতু ভূখণ্ডে সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছিল। তারা একের পর এক পথ বন্ধ করে দিচ্ছিল এবং এসময় অসংখ্য দুর্গ বেহাত হয়ে যায়। প্রায় দুই হাজার বছর পর, মাটি খুঁড়ে বের করা উরারতুর নগরকেন্দ্রগুলোতে ছররা গুলির মতো অসংখ্য স্কাইথিয়ান তির গেঁথে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়। উরারতুর উত্তরের সীমান্তে তেইশাবানি শহরের (আধুনিক কালের কারমির ব্লার) ভেঙে পড়া কাঠের ছাদ আবিষ্কৃত হয়। এগুলোতেও পুড়ে যাওয়া স্কাইথিয়ান তিরের অগ্রভাগ, জ্বলে পুড়ে যাওয়া তির খুঁজে পাওয়া গেছে, যা থেকে ধারণা করা যায়, তিরের মাধ্যমেই শহরটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

পশ্চিম সেমাইটদের ভূখণ্ডে জেরুজালেমের রাজা জোসাইয়াহ অ্যাসিরীয়দের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে হামলা চালাচ্ছিলেন। মূলত যেসব জায়গা একসময় ইসরায়েলের অংশ ছিল, সেগুলোতেই তিনি এসব হামলা পরিচালনা করেন। তিনি অ্যাসিরীয়া থেকে নির্বাসিত জনগোষ্ঠীকে অপমান করার জন্য তাদের উপাসনালয়গুলোতে মৃত মানুষের হাড়গোড় ছড়িয়ে দিতেন।

ইতোমধ্যে স্কাইথিয়ান সেনাবাহিনী জুদাহ পেরিয়ে মিশরের উদ্দেশে রওনা হল। এ পর্যায়ে সাম্মেটিকাস তাদের সঙ্গে দরকষাকষিতে অবতীর্ণ হলেন। হেরোডোটাস বলেন, ঘুস ও স্তুতিবাক্যের সমন্বয়ে তিনি তাদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করলেন। এবং পারস্য উপসাগরের কাছাকাছি জায়গায় মেরোদাক-বালাদানের অভিশাপ তখনও সক্রিয় ছিল। মেরোদাক-বালাদানের বংশধর ও চালদিয়ান নেতা নাবোপোলাসসার তার নিজ বাহিনী নিয়ে পূর্বসূরিদের মতো ব্যাবিলনের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন।

তবে আশ্চর্যজনকভাবে, এত কিছু ঘটে যাওয়ার পর নিনেভেহ পুরোপুরি নীরব থেকে গেল।

অবশেষে ৬২৭ সালে আশুরবানিপাল মারা গেলেন। এরপর তার সাম্রাজ্যের প্রায় প্রতিটি অংশে গোলযোগ দেখা দিতে লাগল। আশুর-এতিল্লু-ইলাি অ্যাসিরীয়ার রাজা হলেন, কিন্তু তার ভাই নিজের আখের গোছাতে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাবিলনের দখল নিয়ে নিলেন।

ইতোমধ্যে নাবোপোলাসসার দক্ষিণদিক থেকে তার বাহিনী নিয়ে আগাতে লাগলেন; উদ্দেশ্য, ব্যাবিলনের সিংহাসন। পরবর্তী ৬ বছর ধরে নিনেভেহ-কেন্দ্রিক অ্যাসিরীয় বাহিনী, ব্যাবিলনের অ্যাসিরীয়রা ও নাবোপোলাসসারের মধ্যে এক ত্রিমুখী লড়াই চলতে লাগল।

এসব ভেজালের মধ্যে মেদিয়ানরা তাদের স্কাইথিয়ান অধিপতিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। প্রায় ২৮ বছর ধরে শোষিত হওয়ার পর তারা ঘুরে দাঁড়ায়।

স্কাইথিয়ানরা প্রশাসক হিসেবে খুবই দুর্বল ছিলেন—তাদের শক্তিমত্তার জায়গা ছিল যুদ্ধ। এই দুই যুগেরও বেশি সময়ে তারা খুবই অজনপ্রিয় হয়ে পড়ে। হেরোডোটাস মন্তব্য করেন, ‘তারা প্রজাদের কাছ থেকে শুধু কর আদায় করেই থেমে থাকতেন না। তারা ঘোড়ায় চড়ে মানুষের সহায়-সম্পত্তি লুট করতেও পিছপা হতেন না।’

এ-ধরনের আচরণের শিকার হয়ে ক্ষুব্ধ মেদেস তার স্কাইথিয়ান লোভকে কাজে লাগালেন। প্রয়াত ফ্রাওরতেসের ছেলে সায়ারক্সেস তখনো তার পিতার রাজত্বে বসবাস করতেন। কোনো এক কারণে স্কাইথিয়ানরা তাকে হত্যা করার কথা চিন্তা করেনি। হেরোডোটাসের মতে, সায়ারক্সেস তার স্কাইথিয়ান প্রভু ও তার দেহরক্ষীর সম্মানে এক ভোজের আয়োজন করেন। সেখানে তাদেরকে প্রচুর পরিমাণে মদ গিলিয়ে মাতাল করেন, এবং হত্যা করেন। হেরোডোটাসের শেষ কথা, ‘এভাবেই মেদেস তার রাজত্ব ফিরে পেল এবং আবারও (আগের) মানুষদের ওপর শাসন কায়েম করল’।

মেদেস ও পারস্যবাসীদের সর্বোচ্চ রাজার সম্মান পেলেন সায়ারক্সেস। তিনি প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে সেনাবাহিনীর সংস্কার ও পুনর্গঠন চালিয়ে এটিকে আরও শক্তিশালী করলেন। তিনি বিভিন্ন অস্ত্রের ব্যবহারে পারদর্শিতা অনুযায়ী পদাতিক বাহিনীকে বিভিন্ন ‘স্কোয়াড’ বা দলে বিভক্ত করলেন, যেমন বর্ণা যোদ্ধা, ঘোড়সওয়ার ও তিরন্দাজ। বড় আকারের প্রশিক্ষণ ও মহড়ার মাধ্যমে তিনি তাদেরকে প্রস্তুত করতে লাগলেন।

পশ্চিম অংশে গোলযোগ ছাড়া আর কিছুই রইল না। উত্তরে এলোমেলোভাবে যাযাবর গোত্র ও একটি মৃতপ্রায় উরারতিয়ান রাজত্ব হানাহানি করতে লাগল। মেদেস ও পারস্যবাসীদের পুরো অঞ্চলের দখল নেওয়া তখন ছিল শুধুই সময়ের ব্যাপার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *