৫৫. ডিলানিপুরের কুঠি

৫৫.

ডিলানিপুরের কুঠিতে বন্দা নওয়াজ খান অন্তরীণ হয়ে আছেন।

চিফ কমিশনারের নির্দেশে চারজন আমর্ড গার্ড কুঠিটার চারপাশে পাহারা দিচ্ছে। এই কুঠি থেকে যাতে নওয়াজ খান বেরিয়ে পড়তে না পারেন, তার পাকা বন্দোবস্ত করা হয়েছে।

বাইরে থেকে পুলিশগুলো নওয়াজ খানের ওপর লক্ষ্য রাখছে। কুঠিবাড়ি থেকে বাইরে বেরুবার আর উপায় নেই।

.

ডিলানিপুরের এই কুঠি থেকে ফিনিক্স উপসাগরটাকে দেখা যায়।

এখন দুপুর। উপসাগরটা জ্বলছে। ওপারে হ্যারিয়েট পাহাড়ের চুড়োটা জ্বলছে। আকাশে পাটকিলে রঙের খণ্ড খণ্ড মেঘগুলি জ্বলছে।

উপসাগর, মেঘ কি হ্যারিয়েট পাহাড় দেখছিলেন না নওয়াজ খান। চেয়ারের হাতলে মাথা রেখে ভাবছিলেন। আবারও তিনি ব্যর্থ হয়ে গেলেন। থিবোর যুদ্ধের পর যে-আগুন তিনি জ্বালাতে পারেন নি, এবারও তা জ্বলল না। এতকাল তার মনে হত, আন্দামান দ্বীপের এই কুৎসিত, জঘন্য মানুষগুলোকে কোনোদিনই দেশ-কাল সম্বন্ধে ধারণা দেওয়া যাবে না। এই বিচিত্র জীবগুলো নারী আর নেশার বাইরে কিছুই বোঝে না। দেশের মাহাত্ম, আজাদীর মহিমা, এসব এদের কাছে দুর্বোধ্য ধাঁধার মতো।

এই দ্বীপের অপদার্থ, হীন মানুষগুলোকে প্রথম প্রথম ঘৃণা করতেন নওয়াজ খান। যখন বুঝলেন ঘৃণা দিয়ে এদের শুধু দূরেই সরিয়ে রাখা হবে, তখন প্রাণ ভরে মিশতে শুরু করলেন। আন্দামান উপনিবেশের এক মাথা থেকে আর এক মাথা পর্যন্ত প্রতিটি গাঁও-এ, প্রতিটি বিজন আর টাপুতে তিনি ঘুরে বেড়াতেন।

এতকাল মনে মনে তার অভিযোগ ছিল, উপনিবেশের মানুষগুলো তাকে বুঝতে চায় না। কিন্তু আজ একেবারেই ভিন্ন কথা মনে হচ্ছে। এদের সঙ্গে মিশেছেন, এটা খুবই সত্য। কিন্তু তার আর এই মানুষগুলোর মধ্যে কোথায় যেন বিরাট একটা ফারাক ছিল।

আজ নওয়াজ খানের মনে হচ্ছে, দীর্ঘকাল এইদ্বীপে কাটিয়েও এই মানুষগুলোকে তিনি নিজেই বুঝতে পারেন নি। যে ভাষা এরা বোঝে সেটা শেখা হয় নি।

নিজের ভাষায়, নিজের নিয়মে তিনি এই মানুষগুলিকে বোঝাতে চেয়েছিলেন। তাঁর ভাষা, তাঁর বক্তব্য এরা বুঝতে চায় নি। সেসব বোঝার মতো মনই নয় এদের।

যে-মন আদৌ তৈরি নয়, সে-মনের ওপর আজাদী, ইংরাজের জুলুম এবং দেশ-কাল সম্বন্ধে বিরাট বিরাট তত্ত্ব চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন নওয়াজ খান। মানুষগুলো তো এসব বোঝেই নি, উপরন্তু ইংরাজের সঙ্গে লড়াই করার কথা শুনে ভয় পেয়েছে।

বড় দুঃখ হচ্ছে নওয়াজ খানের, ভয়ানক আপশোশ হচ্ছে।

এতকাল একসঙ্গে কাটিয়েও মানুষগুলোকে তৈরি করে নিতে পারলেন না। এদের অজ্ঞতা এবং সংস্কার ঘোচাতে পারলেন না। এজন্য তিনি বার বার ব্যর্থ হয়ে গেছেন। সিপাহী বিদ্রোহের যে-আগুন নিয়ে তিনি আন্দামানে এসেছিলেন, হাজার চেষ্টা করেও তিনি এদের মধ্যে তা জ্বালিয়ে তুলতে পারলেন না।

ডিলানিপুরের এই কুঠিতে অন্তরীণ থেকেও নওয়াজ খান খবর পেয়েছেন, পরশু এখানে জাহাজ এসে ভিড়েছে। বাংলা দেশ থেকে এবার আজাদী লড়াইর বন্দিরা এসেছে। নওয়াজ খানের ইচ্ছা ছিল, এরা এসে পড়ার আগেই তিনি ভূমিকা তৈরি করে রাখবেন, যার ওপর দাঁড়িয়ে নতুন কালের স্বাধীনতার সৈনিকরা এই দ্বীপে কাজ করতে পারে।

ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের যোদ্ধা হিসাবে নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারলেন না নওয়াজ খান।

বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপটাকে বড় ভালোবেসে ফেলেছেন নওয়াজ খান। খুনী-ঠগ জালিয়াতের এই ঘৃণিত, ধিকৃত আন্দামানকে নিয়ে তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে একটা গৌরবময় অধ্যায় যোগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার যাবতীয় উদ্যম বিফল হয়ে গেল।

নিজের ব্যর্থতার কথাটাই ভাবছিলেন নওয়াজ খান। এর কারণটা যতই খতিয়ে দেখছিলেন ততই দুঃখ হচ্ছিল তার। এতকাল এই দ্বীপে থেকেও এখানকার মানুষগুলোকে স্বাধীনতা-সংগ্রামের উপযোগী যে করে তুলতে পারেন নি, এই কথাটা বুঝতে বড় দেরি হয়ে গিয়েছে। আবার নতুন করে এই মানুষগুলোর মধ্যে গিয়ে যে দাঁড়াবেন, তার আর উপায় নেই। তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। শুধু গৃহবন্দিই নয়, আজ সকালেই নওয়াজ খান খবর পেয়েছেন, এই দ্বীপ থেকে তাকে চলে যেতে হবে।

দিন পাঁচেকের মধ্যেই এখান থেকে জাহাজ ছাড়বে। সেই জাহাজেই নওয়াজ খানকে মেইনল্যাণ্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

চেয়ারের হাতলে মাথা রেখে নওয়াজ খান ভাবছিলেন। নানা চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

আব্বাজান–খুব নরম গলায় কে যেন ডাকল।

আস্তে আস্তে মাথা তুললেন নওয়াজ খান। দেখলেন, দরজার কাছে রোশন দাঁড়িয়ে আছে। রোশনকে দেখলেই নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয় তার। তখন অন্য কিছু আর ভাবতে পারেন না। চিন্তাশক্তি কেমন যেন বিকল হয়ে যায়।

নওয়াজ খান ডাকলেন, আয় রোশন, কাছে আয়।

পাশে এসে দাঁড়াল রোশন।

রোশনের মুখের দিকে ভালো করে তাকাতেই চমকে উঠলেন নওয়াজখান। চোখ দুটো লাল। গালে চোখের জলের শুকনো দাগ। মনে হল, এই ঘরে আসার আগে রোশন কাঁদছিল। তার একটা হাত ধরে আরো একটু কাছে টানলেন নওয়াজ। বললেন, কাঁদছিলি রোশন?

রোশন জবাব দিল না। জানালার ফাঁক দিয়ে দূরের উপসাগরটার দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে রইল।

বুক তোলপাড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন নওয়াজ খান। বললেন, তোর জীবনটা আমিই বরবাদ করে দিলাম রোশন। সব কসুর আমার।

এবারও কোনো কথা বলল না রোশন, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

রোশনকে দেখলেই সব কিছু ভুলে যান নওয়াজ খান, অস্থির হয়ে ওঠেন। রোশনের বিষণ্ণ, করুণ মুখটার কাছে আজাদীর চিন্তা, দেশ-কাল সম্বন্ধে বিরাট বিরাট ভাবনাগুলি নিতান্তই তুচ্ছ হয়ে যায়।

রোশনের বিষাদ বা দুঃখের জন্য নওয়াজ খানই দায়ী। তিনিই তো অনেক আশা নিয়ে সুন্দর খানের সঙ্গে রোশনের শাদি দিয়েছিলেন। কিন্তু আশা মিটল কই?

সিপাহী বিদ্রোহের যে-আগুন বুকের মধ্যে নিয়ে এই দ্বীপে এসেছিলেন নওয়াজ খান, তারই একটা ঝলক সুন্দর খানের মধ্যে দেখেছিলেন তিনি। সুন্দরের সাজার মেয়াদ ফুরোবার পর রোশনের সঙ্গে শাদি দিয়ে তাকে এই দ্বীপে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এই সুন্দর খানকে নিয়ে এইদ্বীপের বাসিন্দাদের মনে সিপাহী বিদ্রোহের সেই আগুনটা জ্বালিয়ে তুলবেন।

রোশনের সঙ্গে সুন্দরের শাদি হয়ে গেল।

শাদির কিছুদিন পর একবার মেইনল্যাণ্ডে গেল সুন্দর খান। যাবার আগে বলল, কয়েকদিনের মধ্যেই সে পোর্ট ব্লেয়ার ফিরে আসবে, কিন্তু আর ফিরল না।

তারপর কয়েকটা বছর কেটে গেল। এই দ্বীপে যতবার জাহাজ এসেছে, আশায় আশায় ততবারই জাহাজ ঘাটায় গিয়েছেন নওয়াজ খান। কত মানুষই না মেইনল্যাণ্ড থেকে এসেছে, কিন্তু সুন্দর খান আর আসে নি। বেদরদী, বেইমান।

বার বার রোশনকে তিনি স্তোক দিয়েছেন, এই জাহাজেই সুন্দর আসবে। কিন্তু বার বার নিরাশ হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সাহস করে রোশনের মুখের দিকে তাকাতে পারেন নি নওয়াজ খান। এই শান্ত, বিষণ্ণ মেয়েটির মুখে কোথায় যেন ক্ষমাহীন অভিযোগ আঁকা রয়েছে।

হঠাৎ রোশন বলল, আব্বাজান, চিফ কমিশনার তো আপনাকে মেইনল্যাণ্ডে পাঠিয়ে দেবে।

হাঁ, তাই তো শুনছি।

আৰ্বাজান, আমিও আপনার সাথ যাব।

রোশনের মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখলেন নওয়াজ খান। মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে বললেন, হ রোশন, তুইও যাবি। মেইনল্যান্ডে গিয়ে বেইমানটাকে খুঁজে বার করতে হবে। করতেই হবে।

.

৫৬.

লখাই যেদিন পোর্ট ব্লেয়ার এসেছিল, তার পরদিন তাদের তুষণাবাদ ফিরে যাবার কথা। কিন্তু রোগ পরীক্ষা করে ডাক্তার সাহেব লখাই আর দুজন কুলিকে তুষণাবাদে যেতে দিল না। পোর্ট ব্লেয়ারে পুরো দুটো দিন কাটিয়ে ইঞ্জেকশান নিতে হল লখাইদের। অন্য কুলিদের নিয়ে চারজন বুশ পুলিশ আগেই তুষণাবাদ চলে গিয়েছে। আজ সকালে লখাই আর দুটো কুলিকে নিয়ে বাকি পুলিশ দুজন রওনা হল।

.

এখন বিকেল।

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা সড়ক যেখানে দুভাগে ভাগ হয়ে বাঁয়ে পোর্ট মোয়াট এবং ডাইনে তুষণাবাদের দিকে গিয়েছে, সেখানে চলে এল লখাইরা।

দু’দিন ইঞ্জেকশান নিয়েও সুরাহা হয় নি। অন্য অন্য দিনের মতো যথারীতি পালাজ্বরটা এসে পড়ল।

ভোরবেলায় লঙ ফেরিতে ডাণ্ডাস পয়েন্টে এসে হাঁটতে শুরু করেছিল। এখন বেলা ফুরিয়ে আসছে। জ্বরের দাপটে পুঁকতে ধুঁকতে এগিয়ে চলেছে লখাই। পা আর চলতে চায় না। গাঁটে গাঁটে খিচ ধরে গিয়েছে। পথেই বসে পড়ে লখাই।

বুশ পুলিশ দুটো খেঁকিয়ে উঠল, কি রে কুত্তা, বসে পড়লি যে?

কাঁপা কাঁপা, দুর্বল গলায় কোনোক্রমে লখাই বলতে পারল, আর হাঁটতে পারছি না সিপাইজি। জ্বরটা বড্ড বে-কায়দা করে ফেলেছে।

শালে হারামীর বাচ্চা, তোর জন্যে আমরা দাঁড়িয়ে থাকব নাকি?

জবাব দেওয়ার শক্তিটুকু পর্যন্ত লখাই হারিয়ে ফেলেছে। জ্বরের ঘোরে বসে থাকতে পারছিল না। এবার শুয়ে পড়ল।

বুশ পুলিশ দুটো কী যেন ভেবে নিল। তারপর বলল, আমরা এগুচ্ছি। একটু জিরিয়ে চলে আসবি। বদ মতলব নেই তো রে কুত্তা?

এবারও জবাব দিল না লখাই, চুপচাপ পড়ে রইল।

কুলি দুটোকে নিয়ে বুশ পুলিশরা তুষণাবাদ চলে গেল।

অনেকক্ষণ আচ্ছন্নের মতো পড়ে ছিল লখাই। জ্বরের প্রথম ধাক্কাটা সামলে যখন সে উঠে বসল, রোদের তেজ আর নেই। জঙ্গলের মাথায় বিষণ্ণ একটু আলো আটকে রয়েছে শুধু।

আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল লখাই। এখনও জ্বরের ঘোর কাটেনি। মাথা টলছে, চোখদুটো জ্বালা জ্বালা করছে।

একবার তুষাবাদের পথটার দিকে তাকাল লখাই। আর একবার ঘুরে বাঁ দিকে যে-সড়কটা পোর্ট মোয়াটের দিকে গিয়েছে, দৃষ্টিটা সেখানে এনে ফেলল।

হঠাৎই বিন্দির কথা মনে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অস্থির হয়ে উঠল লখাই।

আশ্চর্য! দুটো দিন পোর্ট ব্লেয়ার থাকার সময় সোনিয়া ছাড়া দুনিয়ার আর কারোর কথা ভাবে নি লখাই। বিন্দিকে একরকম ভুলেই ছিল সে।

লখাই হচ্ছে সেই জাতের মানুষ, হাতের সামনে যখন যাকে পায়, তাকে নিয়েই মেতে ওঠে। বিন্দির কথা ভাবতে ভাবতে পোর্ট মোয়াটের পথ ধরে এগিয়ে চলল সে।

কখন সন্ধে পার হয়ে গিয়েছে, আর কখন যে হাঁটতে হাঁটতে মঙ ফা’র ঝুপড়ির সামনে এসে পড়েছে, লখাইয়ের খেয়াল ছিল না।

মঙ ফা’র ঝুপড়ির সামনে সেই গোলমোহর গাছদুটোর পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল লখাই। মঙ ফা তাকে এখানে আসতে বারণ করে দিয়েছিল। সেই কথাটা একবার ভাবল, একটু ইতস্তত করল। কী কববে, ঠিক বুঝে উঠতে পারল না।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে লখাই। তারপর মরিয়া হয়ে ডাকে, মঙ ফা, মঙ ফা–

ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল। চমকে সামনের দিকে তাকাল লখাই। ঝাঁপ খুলে লণ্ঠন হাতে যে বেরিয়ে এসেছে সে মঙ ফা নয়, বিন্দি।

এক মুহূর্ত অবাক তাকিয়ে রইল বিন্দি। আরপর বলল, তুমি!

হাঁ।

আমাকে বাঁচাবাব ব্যবস্থা করতে পেরেছ?

ফস করে নিজের অজান্তেই লখাইর মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে গেল, হাঁ।

ভেতরে এস।

বিন্দি যেন জাদু করেছে। আচ্ছন্নের মতো তার পেছন পেছন ঝুপড়ির ভেতরে গিয়ে ঢুকল লখাই।

বিন্দি বলতে লাগল, ভালোই হয়েছে। মঙ ফা শয়তান মাইনে আনতে ডাণ্ডাস পয়েন্টে গিয়েছে। ফিরতে অনেক রাত হবে।

লখাই জবাব দিল না। জ্বরের দাপট সামলে এতটা পথ হেঁটে এসেছে। এখন মনে হচ্ছে, ফের জ্বরটা নতুন করে আসছে।

মাথা আর খাড়া রাখতে পারছে না লখাই। সামনের একটা মাচানের ওপর শুয়ে পড়ল সে।

লণ্ঠনটা মুখের কাছে এনে আঁতকে উঠল বিন্দি। লখাইর মুখটা টস টস করছে, চোখদুটো টকটকে লাল, কেমন যেন ঘোর ঘোর দৃষ্টি ফুটে রয়েছে সে-চোখে।

লখাইর কপালে একটা হাত রেখে চেঁচিয়ে উঠল বিন্দি, ইস, গা যে পুড়ে যাচ্ছে! ওঠ ওঠ, ভালো করে শোও।

মাচানের ওপর লখাইকে শুইয়ে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিল বিন্দি। তারপর কপালে জলপটি দিতে বসল।

আচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যেও বিন্দির নতুন একটা রূপ দেখতে পেল লখাই।

শিয়রের পাশে বসে জলপটি দিচ্ছে বিন্দি। জ্বরের তাপ পটির জলটুকু মুহূর্তে শুষে • নিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে পটিটা ভিজিয়ে দিচ্ছে বিন্দি।

জলপটি দিতে দিতে সরু সরু আঙুলগুলো লখাইর চুলের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে মাথাটা । আস্তে আস্তে টিপে দিচ্ছে। আবার কখনও পাখা দিয়ে বাতাস করছে।

জীবনে নারীর একটি মাত্র স্বাদই পেয়েছে লখাই। সে স্বাদ তীব্র, উত্তেজক, ঝঝাল। যে-নারী কামার্ত দেহ দিয়ে পুরুষকে মাতিয়ে তোলে, একমাত্র সেই জাতের মেয়েমানুষের আস্বাদই সে পেয়েছে। কিন্তু এই প্রথম তার মনে হচ্ছে, শুধু ভোগ আর উত্তেজনার জন্যই নয়, জীবনে নারীর অন্য প্রয়োজনও আছে। বিন্দির সেবায় লখাইর জ্বরতপ্ত দেহটা যেন জুড়িয়ে আসছে।

সবার মধ্যেই বুঝিবা একটা করে স্পর্শাতুর মানুষ আছে। একটু মমতা, একটু স্নেহ, সামান্য একটু সেবার জন্য সেটা কাঙাল হয়ে থাকে।

এমন যে পাষণ্ড, দুর্দান্ত লখাই, তার বুকের ভেতরও সেই মানুষটা এতকাল ঘুমিয়ে ছিল। বিন্দির শুশ্রূষায় এই প্রথম সেটা জেগে উঠেছে।

এখন আর জলপটি দিচ্ছে না বিন্দি। আস্তে আস্তে কপালে হাত বুলিয়ে চলেছে। চোখ বুজে বিন্দির সেবাটুকু শুষে নিচ্ছে লখাই। বড় ভালো লাগছে তার। বিচিত্র এক সুখ তার দেহ আর মনের ওপর ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো ঝরছে যেন।

জীবনে এক-একটা সময় আসে, মানুষ যখন জুড়োতে চায়, জিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটু আশ্রয় খোঁজে। একটু শান্তি, একটু স্নেহের জন্য লালায়িত হয়ে ওঠে।

এতকাল উত্তেজনা, ভোগ এবং মত্ততার খাত ধরেই জীবনটাকে ছুটিয়ে নিয়ে এসেছে লখাই। এখন বিন্দির হাতের মিঠে সেবাটুকু নিতে নিতে তার মনে হল, একটু জুড়নো দরকার। বিন্দির সেবা তার কাছে জীবনের নতুন একটা মহিমা, নতুন একটা অর্থ এনে দিয়েছে। মনে হল, শুধু নেশা আর উত্তেজনাই নয়, মত্ততা আর উদ্দাম ভোগই নয়, এই সবের বাইরেও জীবনের অন্য জাদু আছে।

এতক্ষণ চোখ বুজে ছিল লখাই। এবার তাকাল। দেখল, কপালে হাত বুলাতে বুলোতে একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে বিন্দি। বিন্দির দুচোখের কালো মণিতে গভীর উদ্বগ ফুটে রয়েছে।

লখাইকে চোখ মেলতে দেখে একটু ঝুঁকল বিন্দি! বলল, এখন কেমন লাগছে?

লখাই জবাব দিল না। বিন্দির মুখের দিকে তাকিয়ে আগের কথাটাই ভাবছিল সে। হঠাৎই তার মনে হল, বিন্দিকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করলে কেমন হয়?

বিন্দি আবার জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে?

খুব ভালো। আস্তে আস্তে উঠে বসল লখাই। জ্বরের তাড়সটা অনেক কমে এসেছে।

বিন্দি বলল, তোমার জ্বরের গতিক দেখে আমার ভয় ধরে গিয়েছিল। খুব চিন্তা হচ্ছিল।

চিন্তা হচ্ছিল? কেন?

হবে না! যা জ্বর, যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়! টানা টানা দু’টি সরল চোখে উদ্বগ ফুটে ওঠে বিন্দির।

কেউ যে তার জন্যে ভাবে, তার জ্বরের দাপট দেখে কেউ যে অস্থির হয়ে ওঠে, সে-কথা জীবনে এই প্রথম জানলো লখাই।

দিনকয়েক আগে লখাইকে কানখাজুরায় কেটেছিল। বেহুশ হয়ে পড়ে ছিল সে। ‘বীটে’র ঝুপড়িতে তাকে ফেলে রেখে কুলি-জবাবদার-ফরেস্ট গার্ডরা চলে গিয়েছিল। সেদিন মনে হয়েছিল, মরে যাবে। সে মরুক বাঁচুক, সেজন্য কারোর মাথাব্যথা নেই। মরে গেলে দু ঠ্যাং ধরে পাহাড়ের একটা খাদে হয়তো ফেলে দিত তাকে। জীবনের একটা নিষ্ঠুর, নিদারুণ চেহারা দেখে সেদিন ভয় পেয়ে গিয়েছিল লখাই। মনে হয়েছিল, সে বড় একা। এত বড় পৃথিবীতে তার কেউ নেই। কিন্তু আজ সে প্রথম জানলো, তার ভালমন্দ ভাববার মতো মানুষ পৃথিবীতে অন্তত একজনও আছে। এটা ভেবেই মনটা অদ্ভুত আনন্দে ভরে গেল।

অনেকক্ষণ পর লখাই বলল, আমার জন্যে ভেবো না। ডর নেই, আমি মরব না।

বিন্দি জবাব দিল না।

হঠাৎ লখাই বলল, আমি তোমার কে যে ঘরে ঢুকিয়ে এমন যত্ন করলে?

শান্ত স্বরে বিন্দি বলল, তুমি আমার কেউ না। তবে এই দ্বীপে তুমিই পেরথম মানুষ, যে আমাকে বাঁচার কথা শুনিয়েছে।

খানিকটা চুপচাপ।

তারপর বিন্দি গম্ভীর গলায় বলল, আমাকে বাঁচাবে পুরুষ?

বুকের ভেতরটা হঠাৎ তোলপাড় হয়ে যায় লখাইর। সে বলে, বাঁচাব।

অনেকক্ষণ সব কথা হারিয়ে অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে বসে রইল বিন্দি। তারপর আস্তে বলল, এই নরক থেকে কে আমাকে গিয়ে যাবে?

শিগ্‌গির।

লখাই জানে না, কেমন করে, কবে মঙ ফা’র হাত থেকে সে বিন্দিকে উদ্ধার করতে পারবে। তবু সে মেয়েটাকে ভরসা দিল। যে-নারী জীবনে নতুন স্বাদ নতুন অর্থ এনে দিয়েছে, বুঝিবা তাকে হতাশ করতে লখাইর মন সায় দিল না।

ফিশফিশ করে বিন্দি বলল, সেদিন তোমাকে আমার সারা জীবনের কথা বলেছি। আড়ি পেতে মঙ ফা সব শুনেছে। তুমি যত তাড়াতাড়ি পার এখান থেকে আমাকে বাঁচাও। নইলে মঙ ফা আমাকে শেষ করে ফেলবে।

.

বেশ রাত করেই মঙ ফা ফিরল। ঝুপড়ির ভেতর লখাইকে দেখে তার মাথায় খুন চেপে যায়। বেড়ার গা থেকে একটি বর্মী দা নামিয়ে চিল্লাতে লাগল, শালে, কুত্তার বাচ্চে, তোকে বলেছিলাম না এখানে আর আসবি না? ভাগ হারামী, আভী ভাগ–

নিরুপায় ভঙ্গিতে একবার মঙ ফা, একবার বিন্দির মুখের দিকে তাকাতে লাগল লখাই।

লখাইর গলার কাছে দায়ের ফলাটা চেপে রেখে লাথি মারতে মারতে তাকে ঝুপড়ির বাইরে বার করে দিল মঙ ফা। তারপর ঝাঁপটা এঁটে বন্ধ করে দিল।

আশ্চর্য! আজ রাগ, উত্তেজনা কি আক্রোশ কিছুই হল না লখাইর। তুষণাবাদের দিকে যেতে যেতে অন্য একটা কথা ভাবছিল সে। ভাবছিল, দরিয়ার সঙ্গিনী সেই সোনিয়াকে কোনোদিনই পাওয়া যাবে না। চান্নু সিংয়ের সঙ্গে তার শাদি হবে। সোনিয়াকে পাবে না। এজন্য এখন আপশোশ কি দুঃখ নেই। কিন্তু যেমন করে পারুক, বিন্দিকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করবে সে।

.

৫৭.

পিয়ারীলালের মারফত সোনিয়া খবর পাঠিয়েছিল। সেই খবর অনুযায়ী ডেপুটি কমিশনারের অফিসে গিয়ে চান্নু সিং শাদির বন্দোবস্ত পাকা করে ফেলেছে।

ঠিক হয়েছে, আজ বিকেলে এসে সোনিয়াকে নিয়ে যাবে চান্নু সিং।

.

সকাল থেকেই সোনিয়ার পেছনে লেগেছে এতোয়ারী। তাকে ঘষে মেজে সাজিয়ে গুজিয়ে খুবসুরত করে তুলেছে।

আজ সোনিয়ার শাদি। এর আগে সোনিয়ার শাদি আর একবার ঠিক হয়েছিল, কিন্তু রামপিয়ারীর হাতে জখম হওয়ার ফলে শাদিটা ভেঙে যায়।

কোত্থেকে খানিকটা সাজিমাটি যোগাড় করেছে, তা এতোয়ারীই জানে। তাই দিয়ে সোনিয়ার মাথা ঘষেছে। লম্বা লম্বা চুলে একটা বড় খোঁপা বেঁধে হাওয়াই বুটির ফুল গেঁথে দিয়েছে। চোখের কোলে সুর্মার সরু টান মেরেছে। শুকনো কাপড় দিয়ে সোনিয়ার মুখখানা ঘষে লাল করে ফেলেছে।

সবচেয়ে ভাল শাড়িটা আগেই ধুয়ে রেখেছিল সোনিয়া। কুঁচি দিয়ে দুটো ফেরতা মেরে সেটা নিজেই সে পরে ফেলল।

এবার সোনিয়ার মুখখানা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল এতোয়ারী। দেখতে দেখতে তার গলায় মুগ্ধ স্বর ফুটল, সুরত যা খুলেছে, চান্নুর শির আবার না খারাপ হয়ে যায়!

সোনিয়া অস্ফুট একটা শব্দ করল।

এতোয়ারী নিজের খেয়ালেই বলে যায়, তোকে পেলে চান্নু বিলকুল ভেড়ুয়া বনে যাবে।

সোনিয়া জবাব দিল না। কী যেন সে ভাবছে।

এবার এভোয়ারী আস্তে আস্তে ডাকল, এ সোনিয়া—

হাঁ।

কী ভাবছিস?

কুছু না।

কুছু না বললেই হবে! আমি জানি তুই চান্নুর কথা ভাবছিস।

উত্তর দিল না সোনিয়া। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইল।

সোনিয়ার মুখের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল এতেয়ারী। বলল, শরম কি রে বহীন! আজ তো তুই চান্নুর কথা ভাববিই। আমিও এক রোজ চার কথা ভেবেছিলাম। গলার স্বরটা হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল এতোয়ারীর। চোখে ব্যথাতুর দৃষ্টি ফুটে উঠেছে তার। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল সে। কেশে গলাটাকে স্বাভাবিক করে ফেলল, শোন বহীন, পুরানা কথাটাই আবার বলছি। নিজের জিন্দেগীতে অনেক ঠেকে আমি এটা শিখেছি। কী শিখেছি জানিস?

কী?

শিখেছি, পুরুষ ছাড়া আওরতের গতি নেই। চাম্বুকে তুই ভালোবাসবি, তাকে পুরা দিলটা দিয়ে দিবি। দেখবি, জিন্দেগী সুখের হবে।

দুপুর পার হয়ে গিয়েছে। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ আগে রোদের তেজ সইতে না পেরে যে পাখিগুলো আকাশ ছেড়েদ্বীপের দিকে উড়ে গিয়েছিল, আবার তারা আকাশে ফিরে এসেছে।

একটু পরই বিকেল হয়ে যাবে। আর বিকেল হলেই সোনিয়াকে নিতে আসবে চান্নু সিং।

আজ সোনিয়ার শাদি। কয়েদিনীরা নানা ধরনের যৌতুক দিয়েছে সোনিয়াকে। কেউ দিয়েছে পুঁতির মালা, কেউ চুলের কাটা, কেউ একটু সুর্মা। মেইনল্যাণ্ড থেকে আসার সময় লুকিয়ে চুরিয়ে কেউ খানিকটা আতর এনেছিল। তার থেকে কিছুটা দিয়েছে সোনিয়াকে। হাবিজা দু’মাস পেটি অফিসারনী হয়ে আড়াই টাকা মাইনে পেয়েছিল। তার থেকে আট আনা দিয়েছে। এতোয়ারী পুরো পাঁচটা টাকাই দিয়ে দিয়েছে। আরো কে যে কী দিয়েছে, ভালো করে লক্ষ করে নি সোনিয়া।

এতোয়ারী সমস্ত উপহার একটা কাপড়ে বেঁধে পুঁটুলি করে দিয়েছে।

দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে গেল। এখনো চান্নু সিং এসে পৌঁছয় নি।

সাউথ পয়েন্ট জেলের সব কয়েদিনী সোনিয়াকে ঘিরে বসে আছে, রং-তামাশার কথা বলছে, দিল্লাগী করছে। কেউ আবার সোনিয়ার সঙ্গে চান্নু সিংয়ের নাম জড়িয়ে অশ্লীল রসিকতার বান ডাকিয়ে দিচ্ছে।

কোনো দিকে খেয়াল নেই সোনিয়ার। বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্থির হয়ে উঠেছে সে। কেননা বেলা হেলে গেলে সেই ব্যথাটা ওঠে। রসদ্বীপের সিকমেনডেরায় গিয়ে সুই (ইঞ্জেকশান) নিয়ে নিয়ে তলপেটের যে-যন্ত্রণাটা দাবাতে পারে নি, যে-যন্ত্রণাটা দাবানোর জন্য চান্নু সিংয়ের সঙ্গে তার শাদির ব্যবস্থা হয়েছে, এখন সমস্ত তলপেট জুড়ে সেটা চিন চিন করে উঠল। শক্ত ইটের মতো মাংসের একটা ডেলা নরম তলপেটটাকে তোলপাড় করে ওঠানামা করতে লাগল।

কষ্টটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। সোনিয়া জানে, ব্যথার দাপটে একটু পরই তার দেহটা বেঁকে দুমড়ে যাবে। কাটা কবুতরের মতো দাপাতে দাপাতে বেহুশ হয়ে পড়বে সে।

রোজই বিকেলের দিকে যখন যন্ত্রণাটা শুরু হয়, তখনই রামপিয়ারীর কথা মনে পড়ে সোনিয়ার। আজও পড়ল।

আশ্চর্য! সকাল থেকে এখন পর্যন্ত রামপিয়ারীর সঙ্গে একবারও দেখা হয় নি। সাউথ পয়েন্ট জেলের সব কয়েদিনীই তার কাছে বসে আছে। একমাত্র রামপিয়ারীই আসে নি।

ঘুম ভাঙার পর থেকে শাদির ব্যাপার নিয়ে মেতে ছিল সোনিয়া। দেহখানা ঘষামাজা করা, সাজগোজ করা, কয়েদিনীদের তামাশা, রং রসিকতা–এমনি নানা ব্যাপারে ডুবে ছিল। রামপিয়ারীর কথা মনেই পড়ে নি। কষ্ট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্থিরতাও বাড়ছে সোনিয়ার। হঠাৎ সে উঠে পড়ল। তারপর উন্মাদের মতো কয়েদখানাটার এক মাথা থেকে আর এক মাথায় ছুটে বেড়াতে লাগল।

শেষ পর্যন্ত তাত-ঘরের পেছনে এসে রামপিয়ারীকে খুঁজে পেল সোনিয়া। তার কোলের ভেতর মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

দু’হাতে সোনিয়ার মুখটা তুলে শান্ত গলায় রামপিয়ারী বলে, কাঁদছিস কেন ছোঁকরি? ফুর্তি কর। আজ না চান্নুর সাথ তোর শাদি!

না না, আমার শাদি হবে না।

এত সাজগোজ করেছিস, কয়েদিনীদের সাথ এত হল্লাগুলা, তামাশা-দিল্লাগী করছিলি, আর এখন বলছিস, শাদি হবে না! যা যা, ভাগ–সোনিয়াকে ঠেলে সরিয়ে দিল রামপিয়ারী।

দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল সোনিয়া, বেদরদী, তোমার দিলে আমার জন্য একটুও মহবৃত নেই। আমি যে পেটের ব্যথায় মরে যাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছ না?

আমি কী করব? শাদি হবে তোর। শাদি হলেই পেটের দরদ সেরে যাবে।

না না–

যন্ত্রণাটা শতগুণ বেড়ে গেছে। সেই নিরেট মাংসের ডেলাটা তলপেট জুড়ে ছোটাছুটি করছে। যন্ত্রণার দাপটে সোনিয়ার শরীর ধনুকের মতো বেঁকে দুমড়ে যেতে লাগল।

সোনিয়া গোঙাচ্ছে, ককাচ্ছে, কাতরাচ্ছে, ছটফট করছে। আর মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠছে, দরদে মরে গেলাম টিণ্ডালান। থোড়েসে আফিং দাও।

নির্বিকার বসে থাকে রামপিয়ারী। আস্তে আস্তে সে বলে, বললাম তো চান্নুর সাথ শাদি হলেই দরদ সেরে যাবে।

না, চান্নুর সাথ শাদি হবে না।

সচ?

জরুর সচ্। রামজি কসম।

আফিম নিয়েই বসে ছিল রামপিয়ারী। ছোট একটা ডেলা পাকিয়ে সোনিয়ার মুখে গুঁজে দিল সে।

আফিমের নেশায় তলপেটের ব্যথা আস্তে আস্তে ভোতা হয়ে আসে। অনেকক্ষণ আচ্ছন্নের মতো বসে থাকে সোনিয়া।

সোনিয়র মুখের দিকে তাকিয়ে আছে রামপিয়ারী। তার মুখে দুর্বোধ্য, সূক্ষ্ম হাসি ফুটে বেরিয়েছে। সে জানত, সোনিয়া তার কাছে আসবেই।

.

আজও চান্নু গাড়ি নিয়ে এসেছে।

এর আগেও একদিন এসেছিল চান্নু। সেদিন রামপিয়ারীর হাতে জখম হওয়ার জন্য সোনিয়াকে নিয়ে যেতে পারে নি। আজ সোনিয়া নিজেই তাকে ফিরিয়ে দিল।

.

৫৮.

এখন বিকেল। জঙ্গলে এখনও ‘ফেলিং’-এর কাজ চলছে।

লখাই জবাবদারি করছিল। একটা হাত ধরে টানতে টানতে তাকে ঝুপড়িতে নিয়ে এল জগদীপ। বলল, তোর সাথ কথা আছে লখাই।

কী কথা?

তোকে হামেশাই যা বলি সেটা হল, তিন বছর ডি-কুনহা সাহিবকে আওয়াবিল পাখির বাসা দিতে পারলে একটা মোটর বোট মিলবে। ইয়াদ আছে?

হাঁ হাঁ—

কাল তিন বছর পুরা হয়েছে। আমি একটা মোটর বোট পেয়েছি।

সত্যি।

হাঁ হাঁ, সচ্‌। একটু থেমে ফিশফিশ করে জগদীপ বলল, আমি আর এক রোজও আন্দামানে থাকব না। আজই ভাগব। সেই শাদিকরা কুত্তীর বাচ্চীটাকে কোতল না-করা পর্যন্ত দিল আমার জুড়োবে না।

সত্যি বলছিস, ভাগবি! লখাই চমকে উঠল।

হাঁ হাঁ, জরুর। ঝুপড়ির বাইরে গিয়ে চারপাশ একবার ভালো করে দেখে এল জগদীপ। তারপর বলতে শুরু করল, তুই চল আমার সাথ। তুই সাচ্চা দোস্ত, তাই তোকে নিতে চাইছি। চল–

আমি! প্রায় আঁতকে উঠল লখাই।

হাঁ হাঁ, তুই। তামাম জিন্দেগীতে এমন সুযোগ আর পাবি না লখাই। এখন না ভাগলে সারা জিন্দেগী কয়েদ খেটে মেরতে হবে।

কপালের দু’পাশে তামার তারের মতো সরু সরু রগগুলি উত্তেজনায় যেন ছিঁড়ে পড়ছে। হৃৎপিণ্ডটা হাজার গুণ জোরে লাফাচ্ছে। কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম দেখা দিয়েছে। কী যে করবে, লখাই বুঝে উঠতে পারল না। ক্ষীণ গলায় বলল, ভাগতে গিয়ে যদি ধরা পড়ে যাই?

আন্দামানে এমন কোঈ শালে নেই, যে আমাদের ধরতে পারবে। জগদীপ বলতে লাগল, এখনই আমাদের পালাতে হবে। ঝুপড়িতে কেউ নেই। শিবরাম শালা বুশ পুলিশের ক্যাম্পে গিয়েছে। ফরেস্ট গার্ড আর কুলিরা জঙ্গল সাফ করছে। কেউ আমাদের দেখতে পাবে না। চল–

সাঁড়াশির মতো কঠিন থাবায় লখাইর একটা হাত ধরে টানতে টানতে সামনের হাওয়াই বুটির জঙ্গলে ঢুকল জগদীপ।

লখাইর ওপর তার নিজের কোনো ইচ্ছাই এখন কাজ করছে না। জগদীপ যেন তাকে জাদু করেছে। তার সঙ্গে আচ্ছন্নের মতো জঙ্গল ভেদ করে ছুটতে লাগল লখাই।

অনেকটা যাবার পর সন্ধে নামল।

এবার অনেকটা ধাতস্থ হয়েছে লখাই। একটু দাঁড়িয়ে টেনে টেনে হাঁপাতে লাগল সে। বলল তা হলে আমরা ভেগেই যাচ্ছি?

পাশে দাঁড়িয়ে জগদীপও হাঁপাচ্ছিল। সে খেঁকিয়ে উঠল, ভাগছিস, আর শালে বুঝতে পারছিস না? কুত্তা কঁহাকা!

জগদীপের গালাগাল গায়ে মাখল না লখাই। সে অন্য কথা ভাবছে। যে-নারী তার জীবনে নতুন স্বাদ এবং অর্থ এনে দিয়েছে, তার মুখটা চোখের সামনে ফুটে উঠছে।

হঠাৎ লখাই বলল, ভাগতেই যদি হয়, বিন্দিকে নিয়ে ভাগব।

জগদীপ চমকে উঠল, বিন্দি আবার কে?

শুনে কী হবে? আমার সাথ চল। নিজের চোখেই দেখবি।

কোথায় যাব তোর সাথ?

পুট মুটে–

পোর্ট মোয়াটে মঙ ফা’র ঝুপড়ির সামনে লখাইরা যখন এসে দাঁড়াল, রাত বেশ গাঢ় হয়েছে।

ঝুপড়ির সামনে এক টুকরো বাঁশ পড়ে ছিল। সেটা হাতে তুলে এক মুহূর্তে কী যেন ভাবল লখাই। তারপর ডাকল, আই মঙ ফা, আঁই–

ক্যাঁচ করে ঝুপড়ির ঝাঁপটা খুলে গেল। এক হাতে দা, আর এক হাতে লণ্ঠন নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল মঙ ফা। এক চোট অশ্রাব্য খিস্তি দিয়ে সে বলল, হারামীর বাচ্চে, আবার এসেছিস! আজ তোকে খতমই করে ফেলব।

দা’টা বাগিয়ে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল মঙ ফা।

মঙ ফা কিছু করবার বা বুঝবার আগেই বাঁশের খণ্ডটা দিয়ে তার মাথায় প্রচণ্ড ঘা বসিয়ে দিল লখাই। খুলিটা চড়াৎ করে ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। চিৎকার করে লুটিয়ে পড়ল মঙ ফা। তার হাতের লণ্ঠনটা হাত পাঁচেক দূরে ছিটকে পড়ল।

মঙ ফা’র গালাগাল আর চেঁচামেচি কানে যেতে ভোলা ঝাপের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল বিন্দি।

মঙ ফা’র হাতের লণ্ঠনটা চুরমার। চারপাশ আন্ধকার। আকাশ থেকে মরা মরা খানিকটা চাঁদের আলো এসে পড়েছে। সেই আলোতে বিন্দিকে চিনে ফেলতে এতটুকু অসুবিধা হল না লখাইর।

লখাই ডাকল, শিগগির এস বিন্দি।

কোথায় যাব?

বাঁচতে চেয়েছিলে না?

হ্যাঁ।

তবে দেরি কোরো না। এস—

আর একটা কথাও বলল না বিন্দি। তর তর করে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে লখাইর পাশে এসে দাঁড়াল।

একদৃষ্টে বিন্দির দিকে তাকিয়ে রয়েছে জগদীপ। তার চোখজোড়া যে ধক ধক করছে, ফ্যাকাশে চাঁদের আলোতে লখাই তা টেরও পেল না।

জগদীপ বলল, চল।

লখাই, জগদীপ এবং বিন্দি–মঙ ফা’র ঝুপড়ি পেছনে ফেলে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তিনজন ছুটতে লাগল।

.

আগে আগে চলেছে জগদীপ। সে-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দৌড়তে দৌড়তে রাত ফুরিয়ে গেল।

ভোরবেলায় লখাইরা একটা খাড়ির মুখে পৌঁছে গেল। সমুদ্র এখানে ছোট একটা উপসাগরের আকারে দ্বীপের ভেতর ঢুকে পড়েছে। কুয়াশা আর তরল অন্ধকারের একটা স্তর দ্বীপ, অরণ্য এবং সমুদ্রকে জড়িয়ে আছে।

সমুদ্র ফঁড়ে হিম-বাতাস উঠে আসছে। জঙ্গলের মধ্যে একদল বকরা হরিণ ডেকে উঠল।

একটু পরই রোদ উঠবে। খাদ্যের খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হবে, তাই সিন্ধুশকুনগুলো ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। কোথায় কোন দিকে আজ পাড়ি জমাবে, বুঝিবা ডানা নেড়ে নেড়ে তা ভেবে নিচ্ছে।

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ওরা সারা রাত দৌড়েছে। এতটা সময় পেটে কিছু পড়ে নি। তা ছাড়া যে কোনো মুহূর্তে ধরা পড়ার ভয় আছে। দুশ্চিন্তায়, উত্তেজনায়, ক্লান্তিতে হাঁপ ধরে গিয়েছে। মাটিতে বসে তিনজনে জোরে জোরে শ্বাস টানতে থাকে। হাত-পা ছিঁড়ে পড়ছে তাদের।

খানিকটা জিরোবার পর জগদীপ বলল, আর বসে দরকার নেই। এবার ওঠ লখাই। রোদ ওঠার আগেই ভাগতে হবে। দরিয়ায় গিয়ে পড়লে, যত পারিস জিরোবি। হঠাৎ গলাটা খাদে ঢুকিয়ে বিড় বিড় করতে লাগল জগদীপ, একবার মাঝ-দরিয়ায় পৌঁছতে পারলে কোনো শালেকে এ-জিন্দেগীতে আমাদের ধরতে হবে না।

বিন্দি আর লখাই উঠে পড়ল। জগদীপের পেছন পেছন পাথুরে মাটির খাঁজে খাঁজে পা রেখে একেবারে জলের কিনারে নেমে এল।

লখাই কি বিন্দি এতক্ষণ দেখতে পায় নি। অন্ধকার আর কুয়াশায় দেখার উপায়ও ছিল না। এবার চোখে পড়ল, খাড়ির কিনার ঘেঁষে ছোট একটা মোটর বোট ঢেউয়ে দোল খাচ্ছে।

প্রথমে বিন্দিকে মোটর বোটে তুলে দিল জগদীপ। তারপর নিজে উঠল।

লখাইও পিছু পিছু উঠে আসছিল। জগদীপ তাকে উঠতে দিল না। বলল, মোটর বোটের রশিটা খুলে উঠবি।

মোটর বোটটাকে পাড়ের একটা গাছের সঙ্গে কাছি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল।

লখাই কাছিটা খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোটে স্টার্ট দিল জগদীপ। ভট ভট শব্দ করে সেটা দরিয়ার দিকে ছুটে চলল।

লাফ মেরে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল লখাই। দুই হাতে বোটটাকে ধরে বেয়ে বেয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু ওপরে ওঠার আগেই লাথি মেরে তাকে জলে ফেলে দিল জগদীপ।

মোটর দিয়ে লখাইকে এই নির্জন খাড়িতে ফেলে দূরন্ত গতিতে দূরে, আরো দূরে চলে যেতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছে লখাই।

মোটর বোট থেকে বিন্দির চিৎকার ভেসে আসছে, বাঁচাও, বাঁচাও

চোখের সামনে দিয়ে মোটর বোট বিপুল সমুদ্রে গিয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে ছোট জলযানটা উঁচু দূরে, আরো দূরে উধাও হয়ে গেল।

দুচোখে অফুরন্ত হতাশা আর বুকের ভেতর অদ্ভুত এক কষ্ট এবং ক্রোধ নিয়ে যেদিকে মোটর বোটটা চলে গিয়েছে সেদিকে তাকিয়ে রইল লখাই।

মঙ ফা’র কাছ থেকে বিন্দিকে কেড়ে এনেছিল লখাই। লখাইর কাছ থেকে বিন্দিকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল জগদীপ।

এমন করেই বুঝি এই বর্বর দ্বীপের মহিমা অক্ষুণ্ণ থাকে।

তোরাব আলির সঙ্গে একদিন এই দ্বীপ থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল লখাই। কিন্তু ঝড়ের সমুদ্রের ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে সেদিন পালাতে পারে নি। বিন্দিকে নিয়ে পালাবার জন্য আজ এখানে এসেছিল। কিন্তু আজও পালানো গেল না।

এই দ্বীপই বুঝি দুবার কারসাজি করে লখাইকে পালাতে দিল না।

দ্বীপের মনে কী আছে, কে জানে।

.

৫৯.

একসময় সকাল হয়ে গেল।

অগাধ সমুদ্র থেকে উঠে এসে সূর্যটা আকাশের গা বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠে আসছে। কুয়াশা আর অন্ধকারের লেশমাত্র নেই।

সামনের দিকে যতদূর তাকানো যায়, বিপুল সমুদ্র। অফুরন্ত জলরাশির পার নেই, কূল নেই, সীমা পরিসীমা নেই। অনেক, অনেকদূরে যেখানে আকাশটা ধনুরেখায় সমুদ্রে নেমে গিয়েছে, সেখানে ধু ধু একটা রেখা নজরে পড়ে।

সকালের আলোতে সমুদ্রে যতদূর নজর চলে, পাতি পাতি করে খুঁজতে লাগল লখাই। কিন্তু মোটর বোটটার চিহ্ন নেই কোথাও।

বিন্দিকে নিয়ে জগদীপের বোট এই নিঃসীম সমুদ্রে কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছে, কে তার হদিস দেবে!

বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক শূন্যতা পাক খেয়ে খেয়ে ফিরছে। অসহ্য কষ্টে শ্বাস আটকে আসতে থাকে।

বিন্দি তার জীবনে নতুন একটা স্বাদ, নতুন একটা মাধুর্য এনে দিয়েছিল। বিন্দিকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে চেয়েছিল লখাই। কিন্তু জগদীপ তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল।

হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল লখাই। নারীর জন্য জীবনে এই প্রথম কদল সে।

এতকাল মেয়েমানুষকে শুধুমাত্র ভোগের জিনিস হিসাবেই ব্যবহার করেছে। প্রয়োজন মিটে গেলে তাকে ছেঁড়া কানির মতো ছুঁড়ে ফেলে দিতে তার বাধে নি। একটু দুঃখ, একটু

অনুতাপ, কি সামান্য একটু ব্যথাও বোধ করে নি সে।

কোনো নারীর জন্য এই প্রথম বেদনা বোধ করে লখাই। কেঁদে কেঁদে বুকের ব্যথা খানিকটা হালকা করে ফেলল সে।

বেলা চড়তে শুরু করেছে। সূর্যটা আরো ওপরে উঠ এসেছে।

এতক্ষণে তুষণাবাদের ‘বীটে’র কথা মনে পড়ল তার।

কাল সারা রাত প্রবল উত্তেজনায় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে এসেছে। উত্তেজনার সঙ্গে মেশানো ছিল তীব্র উৎকণ্ঠা। পেটে এক টুকরো রোটি কি এক ফোঁটা জলও পড়ে নি। এখন খিদে আর তেষ্টায় সমস্ত শরীর ঝিম ঝিম করছে।

চারদিকে একবার তাকাল লখাই। খাড়িটা আশ্চর্য নির্জন। কোথাও মানুষজন নেই। ম্যানগ্রোভের ঘন জঙ্গল খাড়িটার ওপর ঝুঁকে রয়েছে।

একটা কথা খেয়াল হতেই লখাই চমকে উঠল। এই খাড়িটা তার অচেনা। আগে কোনোদিন সে এখানে আসে নি। কাল রাত্তিরে কোন পথ দিয়ে যে জগদীপ তাকে নিয়ে এসেছিল, লখাই জানে না।

সব দিক ভাল করে দেখে মোটামুটি একটা আন্দাজ করে নিল লখাই। মনে হল, কাল রাতে উত্তর দিক থেকে তারা এসেছিল।

সমুদ্রের উপকূল ধরে উত্তর দিকে এগুতে লাগল লখাই।

সমুদ্রের পাড়ে নিবিড় ম্যানগ্রোভ বন। তার ভেতর দিয়ে চলা দুষ্কর। তাই মাঝে মাঝে উপকূল ছেড়ে যেখানে জঙ্গল একটু ফাঁকা ফাঁকা সেখানে ঢুকছে লখাই।

চলতে চলতে কাটার ঘায়ে, ডালপালার খোঁচায় চামড়া ছিঁড়ে যাচ্ছে। খাবলা খাবলা মাংস উঠে যাচ্ছে। রক্ত ঝরছে। জোঁকের পেটে কত রক্ত যে যাচ্ছে, কে তা বলবে।

একসময় জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলল লখাই। উপকূলটা আর খুঁজে পেল না। একবার পুবে একবার পশ্চিমে, ডাইনে বাঁয়ে, উন্মাদের মতো ঘুরতে ঘুরতে একটা জাহাজ নজরে পড়ল।

জাহাজটাকে নিশানা করে টলতে টলতে ধুঁকতে ধুঁকতে শেষ পর্যন্ত সেখানে এসে লখাই পৌঁছল, সে জায়গাটা তুষণাবাদ নয়, এবারডিন জেটি। এতক্ষণ যে-জাহাজটাকে নিশানা করে হাঁটছিল, এবার চেনা গেল। ওটা এলফিনস্টোর জাহাজ।

.

এখন বিকেল।

এবারডিন জেটিতে আজ খুব ভিড়। সমস্ত আন্দামানদ্বীপটা যেন ভেঙে পড়েছে জেটির ওপর।

একপাশে কিছুক্ষণ আচ্ছন্নের মতো বসে রইল লখাই। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে জেটির ভিড়ে মিশে গেল। পাশের একটা লোককে ডেকে জিজ্ঞেস করল, জেটিতে আজ এত ভিড় কেন?

লোকটা বলল, আজ নওয়াজ খান সাহিব মেইনল্যাণ্ডে চলে যাচ্ছে।

মেইনল্যাণ্ডে যাচ্ছে কেন?

আরে বুদ্বু, তুই কি এখানে ছিলি না! আন্দামানের সবাই এ-কথাটা জানে। কিছু শুনিস নি? লোকটার গলায় করুণার সুরই যেন ফুটল, নওয়াজ খান সাহিব যে এই দ্বীপে এংরাজবালার সাথ লড়াই বাধাতে চায়। এই কসুরেই চিফ কমিশনার সাহিব তাকে মেইনল্যাণ্ডে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল লখাই।

একটু পর পুলিশের গাড়িতে রোশনকে সঙ্গে নিয়ে নওয়াজ খান এসে পড়লেন।

চারপাশের লোকগুলো বলতে লাগল, আদাব, আদাব–

করুণ, ব্যথাতুর চোখে একবার সবগুলো মানুষের দিকে তাকালেন নওয়াজ খান। কপালে হাত ঠেকিয়ে সবাইকে আদাব জানালেন।

জেটির পাশে একটা মোটর বোট বাঁধা ছিল। রোশনকে নিয়ে সেটায় উঠলেন নওয়াজ খান।

মোটর বোটটা তৈরিই ছিল, নওয়াজ খান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে স্টার্ট দিল। শব্দ করতে করতে এলফিনস্টোন জাহাজের পাশে গিয়ে ভিড়ল।

কিছুক্ষণ পর কড় কড় শব্দে এলফিনস্টোন জাহাজের নোঙর উঠল। আরো খানিকটা পর দুলতে দুলতে বিরাট জলযান উপসাগর থেকে খোলা দরিয়ার দিকে চলে গেল।

আঠার শ’ আটান্নতে যে-কারণে এই দ্বীপে এসেছিলেন নওয়াজ খান, তিপ্পান্ন বছর পর ঠিক সেই কারণেই এই দ্বীপ ছেড়ে তাকে চলে যেতে হল।

.

নওয়াজ খানকে আগে একদিনই মাত্র দেখেছে লখাই। তবু তার এই চলে যাওয়ার জন্য বড় কষ্ট হচ্ছে।

বিন্দিকে হারিয়ে কষ্ট পাওয়ার কারণ আছে। কিন্তু নওয়াজ খানের চলে যাওয়াতে লখাই কেন যে কষ্ট পাবে তা সে নিজেই জানে না। তবে এটা বুঝতে পেরেছে, বিন্দিকে হারাবার পর যে-দুঃখ, আর নওয়াজ খান চলে যাওয়াতে যে-দুঃখ–এই দুটো দুঃখ মিলে তার বুকের মধ্যে এক অসহ্য ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে। এ হচ্ছে সেই ব্যথা, মানুষ প্রিয়জনকে হারিয়ে যা পায়।

জীবনে প্রথম প্রিয়জন হারাবার কষ্ট পেল লখাই। এবারডিন জেটির একপাশে এখনো নিঝুম দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। হঠাৎ কে যেন কাঁধের ওপর হাত রাখল। চমকে পেছন দিকে ঘুরল লখাই। দেখল–ভিখন আহীর।

ফিশফিশ করে ভিখন বলল, বিলকুল সত্যনাশ হয়ে গিয়েছে। পুলিশ তাকে ধরবার জন্যে তামাম আন্দামান ছুঁড়ে বেড়াচ্ছে।

কেন?

তুই নাকি কাল বিকেলে তুষণাবাদের ‘বীট’ থেকে ভেগেছিস?

হাঁ।

আরে বাপ রে বাপ, এটা কী করেছিস লখাই দাদা! তুই জানিস না ভাগোয়া কয়েদি ধরা পড়লে জেলার সাহেব তার জান তুড়ে দেয়।

জানি। শান্ত গলায় লখাই বলল। বলেই সামনের দিকে এগিয়ে চলল।

ভিখনও পেছন পেছন আসছে আর বলছে, কোথায় যাচ্ছিস লখাই দাদা?

ধরা দিতে।

হে ভগোয়ান, জরুর তোকে ফাঁসিতে লটকে দেবে। ভিখন কেঁদেই ফেলল।

লখাই উত্তর দিল না, ভিখনের দিকে ফিরেও তাকাল না। সোজা সেলুলার জেলের দিকে এগুতে লাগল।

.

৬০.

ষাট

এই দ্বীপে থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল লখাই। সেই হিসাবে সে ভাগোয়া কয়েদি। আইনত ভাগোয়া কয়েদির যা সাজা, তা লখাইর প্রাপ্য। কিন্তু নিজে ধরা দেওয়ার জন্যই হোক, আর যে-কোনো কারণেই হোক, সাজাটা তেমন মারাত্মক হল না।

দু’দিন খানা বন্ধ রাখা হয়েছিল, দু’দিন চড়ানো হয়েছিল ডাণ্ডাবেড়িতে। একদিন টিকটিকিতে (বেত মারার স্টাণ্ডে) চড়িয়ে পঁচিশ ঘা বেতও মারা হয়েছিল। এতেই নিস্তার পেয়ে গিয়েছে লখাই। তবে তার আন্দামান রিলিজটা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে দু’মাস বিশ দিন তাকে সেলুলার জেলে আটকে থাকতে হবে।

দু’দিন ডাণ্ডাবেড়িতে ঝুলে আর দু’দিন উপোস দিয়ে আর পঁচিশ ঘা বেত খেয়ে শরীরের হাল এমন হয়েছিল যে পুরো পনেরোটা দিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে নি লখাই। আজ অনেকটা সুস্থ হয়েছে সে।

.

কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধে নামবে।

রোদে এখন আর তেজ নেই। সেলুলার জেলের মাথায় খানিকটা ঝাপসা আলো এখনো আলগাভাবে লেগে আছে।

এটা ছ নম্বর ব্লকের পনেরো নম্বর সেল। সেলটা বাইরে থেকে তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। গরাদ ধরে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে লখাই।

পাশের সেলের দেওয়ালে দুম দুম শব্দ হচ্ছে। লখাই জানে, বাংলা দেশে থেকে যারা আজাদীর লড়াই করে এই দ্বীপে সাজা খাটতে এসেছে, তাদেরই একজনকে রাখা হয়েছে। পাশের সেলটায়। বিশ পঁচিশ দিন হল সে ওখানে আছে।

দুম দুম শব্দটা ক্রমাগত বাড়ছে। বোঝা যায়, পাশের সেলের কয়েদিটা দেওয়ালে কপাল ঠুকছে। এই বিশ পঁচিশ দিনের মধ্যেই বন্দিত্বের জ্বালা অসহ্য হয়ে উঠেছে তার।

এখন কারোর কথা ভাবার মতো মনের অবস্থা নয় লখাইর। উদাস চোখে বাইরে তাকিয়েই থাকে সে।

সেন্ট্রাল টাওয়ারের চূড়ায় একটা সাগরপাখি বসে রয়েছে। থেকে থেকে পাখিটা ডানা ঝাঁপটায়। ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে একসময় অনেক উঁচুতে মহাশূন্যে উড়ে যায়।

সাগরপাখিটাকে দেখছিল লখাই। সেটা ছোট হয়ে যাচ্ছে। আরো ছোট হতে হতে কখন যেন আকাশে মিশে গেল।

লখাই ভাবছিল, ওই পাখিটার মতো মানুষও কি সব ভার মুক্ত হয়ে উড়তে উড়তে আকাশ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না? সুষ্ঠু, সুন্দরভাবে ভাবতে শেখেনি লখাই।

যেভাবেই ভাবুক, হয়তো সে এই কথাটাই ভাবছিল। মানুষ কি বর্বরতা এবং পশুত্ব। মুক্ত হয়ে পাখির মতো হালকা হতে পারে না?

একসময় পাখির ভাবনাটা ছেড়ে দিল লখাই। অন্য একটা চিন্তা তার মনটাকে জুড়ে বসল।

এখন এই অলস, উদাস মনে নিজের জীবনের নানা ঘটনা ঘুরে ঘুরে আসছে লখাইর। আজকাল একটু নিঃসঙ্গ হলে আগাগোড়া নিজের কথাই ভাবতে থাকে সে।

জীবনে কত বিচিত্র মানুষ, কত বিচিত্র ঘটনাই না সে দেখল। ভিখন আহীরকে দেখল, জাজিরুদ্দিন বিরসাকে দেখল, লা ডিন, নওয়াজ খান, সোনিয়া, বিবিবাজারের মোতি ঢুলানি, পরাঞ্জপে, কপিল প্রসাদ, শরীয়তুল্লা–কত মানুষ! অনেককে আবার চোখেও দেখে নি। পরোক্ষে থেকেও তারা তার জীবনে ছাপ ফেলেছে।

কত মানুষ দেখেছে, কত ঘটনা দেখেছে! লখাই ভাবতে চেষ্টা করল, জীবন কি শুধুমাত্র এই সব ঘটনা আর মানুষের সমষ্টি? মন ঠিক সায় দিল না।

জীবনে বহু নারী ভোগ করেছে লখাই, প্রচুর নেশা করেছে। লালসা-উত্তেজনা-নেশা এবং ভোগের খাত ধরেই জীবনটাকে ছুটিয়ে এনেছে সে।

লখাই ভাবছে, উত্তেজনা-ভোগ-লালসা, শুধু এসবের মধ্যেই কি জীবন রয়েছে? এবারও মনের সায় মিলল না।

লখাইর মনে হল, অসংখ্য মানুষ, অজস্র ঘটনা, কাম-লালসা-মত্ততা–এসবের বাইরে আরো একটা কী যেন আছে। যেটা না হলে জীবনের স্বাদ পুরাপুরি পাওয়া যায় না।

সেটা যে কী, আজকের লখাই জানে না। কিন্তু অনেক দিন পরের অনেক পরিণত আর এক লখাই জেনেছিল। সেটা হল উপলব্ধি। বিন্দির কাছে গিয়ে নিজের অজান্তে উপলব্ধির স্বাদ পেয়েছিল লখাই।

বিন্দিকে সে পায় নি। একদিন তাকে হয়তো সে ভুলে যাবে। তাকে না পাওয়ার ব্যথাটাও হয়তো আর থাকবে না। কিন্তু বেঁচে থাকার যে স্বাদটা সে রেখে গিয়েছে, সেটা বার বার পাওয়ার জন্য নতুন করে জীবনটাকে শুরু করবে লখাই।

জীবনের অন্য একটা মহিমা খুঁজে পেয়েছে সে।

.

জীবন কী?

উপলব্ধিই তো জীবন। লখাইর মনে সেই উপলব্ধিই জন্মাতে শুরু করেছে।

.

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *