অধ্যায় ৫৩ – চীনের ক্ষয়িষ্ণু রাজা
চীনে খ্রিস্টাব্দ ৭৭১ থেকে ৬২৮ সালের মাঝে বর্বরদের তাড়িয়ে রাজকীয় ক্ষমতা দখল করেন হেজেমন বা সর্বাধিনায়ক। ঝৌ সাম্রাজ্যের শেষ জীবিত সন্তান ও উত্তরাধিকারী পি’ইং পূর্বাঞ্চলে পালিয়ে যান। লোইয়াং অঞ্চলে তিনি থিতু হন।
এখানে এসে তিনি একটি জমজ শহর আবিষ্কার করেন। ঝৌ’র ডিউক ৩০০ বছর আগে এই শহরের গোড়াপত্তন করেন। তিনি পশ্চিমপাশে লোইয়াং-এর প্রাসাদ ও মন্দিরগুলো নির্মাণ করেছিলেন। ঝৌ রাজত্বের কেন্দ্র থেকে বিতাড়িত ও নির্বাসিত শ্যাং বংশোদ্ভূতরা মূলত পূর্বদিকের শহরতলিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
পশ্চিমের রাজকীয় বাসভবনে বসে পি’ইং তার সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করতে বসলেন। তার পশ্চিম ফ্রন্ট ধসে পড়েছে এবং বিভিন্ন ধরনের হানাদার এসে সেখানে বারবার আক্রমণ করছিল। আর অভ্যন্তরে, উচ্চাভিলাষী অভিজাতরা তার রাজত্বের অংশবিশেষ, কিংবা সুযোগ পেলেই পুরোটাই শাসন করার জন্য প্রস্তুত ছিল।
তিনি পশ্চিমদিক থেকে আসা হুমকির মোকাবিলা করার জন্য তার পুরনো রাজত্ব চি’ইন-এর কাছে সোপর্দ করেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে একে পরাজয় মনে হলেও এই সিদ্ধান্তের মাঝে ছিল কিছু পরিমাণ চাতুর্য। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি বস্তুত চি’ইনের ডিউক ও তার সেনাবাহিনীর ঘাড়ে বর্বরদের মোকাবিলার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছিলেন। এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি তার অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেওয়ার সুযোগ পেলেন।
প্রায় তাৎক্ষণিকভাবেই, শক্তিশালী সামন্তপ্রভুরা ছোট ছোট রাজত্বগুলোর দখল নিতে লাগলেন। সিমা কিয়ানের বর্ণনায় : ‘রাজা পিইং এর রাজত্বের সময়, সামন্তপ্রভুদের মাঝে শক্তিশালীরা দুর্বলদের দখল করে নেন। কি, চু, চি’ইন ও জিন সবচেয়ে ক্ষমতাবান হিসেবে আবির্ভূত হয়। ৫০০ বছর আগে, চীনে প্রায় ১ হাজার ৭৬৩ আলাদা আলাদা অঞ্চল ছিল। একটি মসৃণ পৃষ্ঠে পানির ফোঁটা ফেললে সেগুলো যেভাবে একত্র হয়ে যায়, ঠিক সেভাবেই ১২টি মূল ক্ষমতার কেন্দ্রে এই অঞ্চলগুলো বিভাজিত হয়েছিল। কি, চু, চি’ইন ও জিনের পাশাপাশি ইয়েন, লু, ওয়েই, উ, ইউয়েহ, সুং ও চেং নামের আরও ৭ রাজ্য আলাদাভাবে নিজেদের পরিচিতি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল। সর্বোপরি, লোইয়াংকে কেন্দ্ৰ করে গড়ে উঠেছিল ঝৌ ভূখণ্ড। এগুলোকে ঘিরে আরও প্রায় ১৬০টি ছোট ছোট অঞ্চল ছড়িয়ে ছিল। তাদের প্রত্যেকেরই ছিল প্রাচীরঘেরা শহর ও নিজস্ব শাসক।
পি’ইং-এর কাছ থেকে তার নাতির কাছে সিংহাসন যায়। পি’ইং-এর দীর্ঘ ও শান্তিপূর্ণ রাজত্বকালে তার পুত্রসন্তানরাও একে একে মারা যান। তার ৫০ বছরের শাসনামলে তেমন কোনো হুমকির মুখোমুখি হতে হয়নি তাকে। তবে তার মৃত্যুর পর ঘটনাপ্রবাহে আসে পরিবর্তন। ঝৌ ভূখণ্ডের চারপাশ ঘিরে থাকা অভিজাতরা আর রাজার কর্তৃত্ব মানতে রাজি ছিলেন না।
ঝৌ’র পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত ছোট রাজ্য চেং-এর পক্ষ থেকে প্রথম গোলযোগের সূচনা হয়। সিমা কিয়ান বলেন, ‘চেং-এর ডিউক চুয়াং রাজসভায় এলেন এবং রাজা হুয়ান তাকে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সম্মান দিলেন না।’
প্রথাগতভাবে, চেং-এর ঝৌ-এর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার কথা ছিল, কেননা চেং ও জিন; এই উভয় রাজ্যের শাসকরা এককালে ঝৌ শাসকদের সঙ্গে একই গোত্রের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও, এই দুটি রাজ্য ঝৌ ভূখণ্ডকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে ছিল।
তবে চেং রাজা খুবই খুঁতখুঁতে ছিলেন। যেই প্রচলিত ‘রীতির’ লঙ্ঘন হয়েছিল, তা আর কিছুই না, ডিউকের সার্বভৌমত্ব ও আলাদা ক্ষমতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেওয়া। নিঃসন্দেহে, রাজা হুয়ান তার দূর-সম্পর্কের এই আত্মীয়কে যথাযথ সম্মান না দেখিয়ে বড় ভুল করেছিলেন।
ডিউক চিয়াং এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে একটি রাজকীয় বাসভবন দখল করে নিজে ব্যবহার করা শুরু করলেন। চেং ও ঝৌ’র ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে বেশ খানিকটা দূরে, দক্ষিণে অবস্থিত একটি ছোট ও নিরপেক্ষ অঞ্চলে এই বাসভবনের অবস্থান ছিল। কিন্তু এই রাজপ্রাসাদে এসে রাজা উপাসনা করতেন। অর্থাৎ, চিয়াং একইসঙ্গে সু’র দখলও নিলেন এবং রাজার ধর্মীয় দায়িত্বকেও প্রশ্নবিদ্ধ করলেন। সে আমলে রাজার ভূমিকা মোটামুটি আলংকারিক হয়ে পড়েছিল; অল্প যে কয়টি দায়িত্ব তিনি ধরে রাখতে পেরেছিলেন, তার মাঝে অন্যতম ছিল উপাসনা। এ ঘটনার মাধ্যমে সেটাও বেহাত হয়ে গেল।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া দেখাতে রাজা হুয়ানের প্রায় ৮ বছর সময় লেগে গেল। তিনি তার সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করে ‘১৩তম বছরে চেং আক্রমণ করলেন’।
তবে এই হামলা কোনো কাজেই আসেনি। রাজা হুয়ান স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে তিরের আঘাতে আহত হয়ে পিছু হঠতে বাধ্য হন। ফলে চেং কোনো শাস্তি পেল না এবং সু তখনো শত্রুর হাতেই থেকে গেল। তবে চেং জাতি রাজার আধিপত্যকে অবজ্ঞা করে কিছুটা সুবিধা আদায় করে নিলেও তাদের ডিউক এ- বিষয়টি নিয়ে আর খুব বেশিদূর আগালেন না। চীনের রাজ্যগুলোকে এক সুতায় বেঁধে রাখার পেছনে অনুঘটক হিসেবে যে অল্প কয়েকটি বিষয় কাজ করত, তার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ‘স্বর্গের পুত্রের’ নিয়মতান্ত্রিক শাসন মেনে চলা। এই নীতি ছাড়া তাদেরকে একতাবদ্ধ করার মতো তেমন কিছুই ছিল না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই নিয়ম মোটামুটি সবাই মেনে চলতেন। সংঘবদ্ধ রাষ্ট্রের এই নিরাপত্তাব্যূহ না থাকলে উত্তর ও পশ্চিম দিক দিয়ে বর্বররা এসে একের পর এক রাজ্য ধ্বংস করে ফেলত।
রাজা হুয়ানের নাতি সি’র আমলে বর্বররা আবারো হামলা করতে উদ্যত হল। এই হামলাকারী গোত্রগুলোর নাম ছিল ই ও তি। এই দুই যাযাবর গোত্রের সদস্যরা পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করতেন। তারা কখনোই কোনো রাজা বা প্রভুর আধিপত্য স্বীকার করে নেয়নি। তাদের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য ঝৌ সামরিক বাহিনী মোটেও প্রস্তুত ছিল না। এসব ঘটনার প্রায় ২০০ বছর পরে লিখিত এবং তারও প্রায় ৩০০ বছর পর সংগৃহীত ‘গুয়ানজি’ নামক ঐতিহাসিক রচনায় বলা হয়, ‘স্বর্গের পুত্রের অবস্থান কোমল ও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সামন্তপ্রভুরা একে অপরকে আক্রমণ করার জন্য তাদের সব শক্তিমত্তা খরচ করে ফেলে। দক্ষিণের ই ও উত্তরের তি থেকে আসা বর্বররা কেন্দ্রীয় রাজ্যগুলোতে হামলা চালায়। তাদের প্রবল আক্রমণে এই রাজ্যগুলোর অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।’
এই ‘কেন্দ্রীয় রাজ্য’ বলতে মূলত চেং, ওয়েই, জিন আর ঝৌ-এর মূল ভূখণ্ডের কথা বলা হয়েছে। এ রাজ্যগুলো ছিল চীনের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে। কি রাজ্যের নতুন ডিউক যখন টের পেলেন তার ভূখণ্ডের পশ্চিমে অরাজকতার সৃষ্টি হচ্ছে, তখন তিনি এ সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হলেন। গুয়ানজিতে বলা হয়েছে, ‘তিনি মৃত্যুপথযাত্রীকে (রাজ্য) বাঁচিয়ে রাখতে চাইলেন। যার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে, তা তিনি টিকিয়ে রাখতে চাইলেন।
কি রাজ্যের ডিউক ছিলেন বয়সে তরুণ এক ব্যক্তি। তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে এই ক্ষমতা পেয়েছিলেন। মনে হতে পারে এই কেন্দ্রীয় রাজ্যগুলোর একতাবদ্ধ কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য ডিউক কি সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল, পুরোপুরি কৌশলগত কারণে তিনি এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি তার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে সমতলভূমির উত্তর-পূর্ব প্রান্তে চলে গেলেন, যেখান থেকে হোয়াং হো নদীর উৎপত্তি। তিনি শানতুং উপদ্বীপ পর্যন্ত তার বাহিনীকে ছড়িয়ে দিলেন। কি’র পশ্চিম সীমান্তে কোনো গোলযোগ দেখা দিলে তা ডিউকের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারত।
তবে খুব শিগগির এই তরুণ ডিউক বুঝতে পারলেন যে, রাজা সি কেন্দ্রীয় রাজ্যগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে অপারগ। সি সিংহাসনে বসার ৩ বছরের মাথায় এই ডিউক নিজেকে চীনের নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দিলেন। সিমা কিয়ান বলেন, ‘রাজা সি’র তৃতীয় বছরে, কি’র ডিউক হুয়ানকে প্রথমবারের মতো সর্বাধিনায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হল।’
বছরটি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬৭৯।
এই সর্বাধিনায়ক উপাধির আড়ালে ছিল চারপাশের রাজ্যগুলোর ওপর আধিপত্য স্থাপনের ঘোষণা। কিন্তু কি’র ডিউক তার এই ক্ষমতাকে ভালো কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজেদের মাঝে বিবাদে ব্যস্ত রাজ্যগুলোকে এক কাতারে এনে ই ও তি জাতির বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ করার চেষ্টা চালান। এই দুই জাতি ছাড়াও আরও বেশকিছু যাযাবর-গোত্রের মানুষ পার্বত্যভূমি থেকে পূর্বের উর্বর ঝৌ ভূমিগুলোর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল।
ডিউক ও তার মন্ত্রী কুয়ান চাং-এর নেতৃত্বে কি-সেনাবাহিনী অন্যান্য রাজ্যগুলোকে একাত্ম হওয়ার জন্য বাধ্য করার চেষ্টা করল। কি’র সেনাবাহিনীর প্রতাপে এই রাজ্যগুলো নিজেদের বিভেদ ভুলে যৌথবাহিনীতে সেনা পাঠাতে রাজি হল। উদ্দেশ্য, সব রাজ্যের সৈন্য মিলে সীমান্তের দিকে যাত্রা করবে এবং চিরতরে বর্বরদের আগ্রাসন বন্ধ করবে।
কি’র ডিউক কখনো রাজা হতে চাননি, বা তার নামের সঙ্গে এই উপাধি থাকুক, সেটাও চাননি। ঝৌ’র প্রতিনিধি এই সম্মান পাবেন—এতেই তিনি খুশি ছিলেন। তবে পশ্চিমে যেমন ‘রাজা’ মানেই ‘শাসক’, চীনের ব্যাপারটা সেরকম ছিল না। চাইলে কি’র ডিউক ‘রাজা’ না হয়েও চীন শাসন করতে পারতেন। আবার অপরদিকে, চীনের রাজার এমন এক ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় ক্ষমতা ছিল, যেটাকে চাইলেও ‘সর্বাধিনায়ক’ অবজ্ঞা করতে পারতেন না।
মাত্র ৫ বছর দেশ শাসন করার পর সি’র মৃত্যু হল। এরপর তার ছেলে ক্ষমতায় বসে আনুষ্ঠানিকভাবে কি’র ডিউককে ‘সর্বাধিনায়ক’ হিসেবে ঘোষণা করলেন।
এভাবে আরও একবার ডিউক হুয়ানকে চৈনিক রাজ্যগুলোর প্রধান সেনাপতি হিসেবে সম্মানিত করা হল। যৌথবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে বর্বরদের দমন করার জন্য তিনি এ সম্মান পেলেন। দীর্ঘদিন ধরে এই দায়িত্ব পালন করলেও এবার তিনি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেলেন। এবং এই স্বীকৃতি এল স্বয়ং রাজার কাছ থেকে। এভাবে প্রাচীন চীনে একধরনের দ্বিমুখী শাসনব্যবস্থার প্রচলন হলো, যেখানে একজন ধর্মীয় ও একজন সামরিক নেতার ভূমিকা পালন করছিলেন।
সি’র নাতি সিয়াং যে-বছরে অভিষিক্ত হলেন, সে-বছর সর্বাধিনায়ক হুয়ান নতুন একধরনের আগ্রাসনের মুখোমুখি হলেন।
ভাইয়ে-ভাইয়ে বিবাদের মাধ্যমে এই আগ্রাসনের সূত্রপাত ঘটে। রাজা সিয়াং-এর সৎভাই শু তাই সিংহাসনের দখল নিতে চেয়েছিলেন। ক্যুর জন্য তার দরকার ছিল সেনা। তিনি বর্বরজাতি তি ও জুং-এর কাছে মৈত্রীর প্রস্তাব পাঠান। তিনি যে পরিকল্পনা আঁটেন, সে অনুযায়ী তি’র দায়িত্ব হত বর্বরদের দখলে থাকা উত্তর ও ঝৌ ভূখণ্ডের মাঝামাঝি অবস্থিত জিন রাজ্যের ওপর সদলবলে হামলা চালানো। ইতোমধ্যে, জিন ভূখণ্ডের উপর দিয়ে জুং সেনাবাহিনী দ্রুতগতিতে ঝৌ রাজ্যের দিকে এগিয়ে যাবে। যেহেতু জিনের সেনারা তি’র সেনাদলের মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকবে, তাই তাদের জন্য এটা কোনো ব্যাপারই হবে না। জুংরা রাজপ্রাসাদে হামলা চালাবে, সিয়াংকে হত্যা করবে এবং শু তাই সিংহাসনে বসবেন—মোটামুটি এটাই ছিল মূল পরিকল্পনা
যখন রাজা সিয়াং এসব গোপন আলোচনার বিষয়ে জানতে পারলেন, তিনি তার সৎভাইকে গ্রেপ্তার ও হত্যার নির্দেশ দিলেন। সু তাই এই নির্দেশের আগা খবর পেয়ে সর্বাধিনায়কের কাছে পালিয়ে গেলেন এবং তার কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলেন।
তার এই অনুরোধ সর্বাধিনায়কের জন্য ব্রিতকর হয়ে দাঁড়াল, তিনি যদি শু তাইকে রক্ষা করতে অস্বীকার করেন, তাহলে প্রকারান্তরে তিনি স্বীকার করে নিচ্ছেন যে তিনি রাজার ক্ষমতাকে ভয় পান। আবার অপরদিকে, তাকে সুরক্ষা দিলে সেটা রাজার বিরুদ্ধাচরণের সমতুল্য হবে এবং সেক্ষেত্রে তার ওপর জানা- অজানা ভোগান্তি নেমে আসতে পারে (স্বর্গ ও মর্ত্য, উভয় দিক দিয়েই)।
তিনি একটি মধ্যম পন্থা অবলম্বন করলেন। শু তাই’র বিশ্বাসঘাতকতার পুরো বিষয়টিকে অবজ্ঞা করে সর্বাধিনায়ক তার দুই মন্ত্রীকে আলোচনা করার জন্য পাঠালেন। দুই মন্ত্রী যথাক্রম ঝৌ ও জুং এবং জিন ও তি’র মধ্যে সমঝোতা চুক্তি করার চেষ্টা চালালেন। ধারণা করা হয়, এই আলোচনা সফল হয়েছিল, কারণ শিগগির সব ধরনের হামলা বন্ধ হয়ে যায়। শু তাই এমন একটা ভাব ধরলেন যেন তিনি কোনোকিছুর সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন না। এভাবেই বড় একটি দুর্যোগ থেকে চীন রক্ষা পেল।
পশ্চিমে ক্ষমতা দখলের জন্য যে-ধরনের সংঘাত চলছিল, তা থেকে পূর্বপ্রান্তের ক্ষমতার লড়াই বেশ খানিকটা ভিন্ন ছিল। প্রাচীন পৃথিবীতে প্রাচ্যের রাজারা এক চক্রাকার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলেন। যে রাজা তাৎক্ষণিকভাবে অন্যের ভূখণ্ড দখলে উদ্যোগী হতেন না, তারাই প্রতিপক্ষের কাছে নিজ ভূখণ্ডের কিছু অংশ হারানোর ঝুঁকিতে পড়তেন। তারা কেউই একই ভাষায় কথা বলতেন না এবং তাদের উপাস্যও ভিন্ন ছিল। চীনের রাজ্যগুলোর মধ্যে দরকষাকষির ব্যাপারটা অনেকটা চাচাতো-মামাতো ভাইদের মধ্যে যুদ্ধের মতো ছিল। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে যতই যুদ্ধ করুক না কেন, গ্রীষ্মকালে সবাই একই জায়গায় ছুটি কাটাতে যেতেন। তাদের অনেকের গ্রীষ্মকালীন আবাসও একই ছিল। চীনের রাজাদের মধ্যে সাম্রাজ্য বিস্তারের উচ্চাভিলাষ পরিলক্ষিত হত, তবে তা পশ্চিমা রাজাদের বর্শা ও ঢালের যুদ্ধের মতো এতটা স্থুল ছিল না। চীনের সাম্রাজ্যবাদীরা সুযোগ পেলেই নিজেদেরকে বাকি বিশ্বের বিরুদ্ধে রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। যখনই কোনো বর্বর জাতি বা বাইরের শত্রুর আগমন হতো, তখনই তারা একাত্ম হয়ে সেই ঝুঁকির মোকাবিলা করতেন।
বর্বরদের বিরুদ্ধে ঝৌ ও জিন ভূখণ্ডের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ৬ বছর পর উল্লেখিত সর্বাধিনায়কের বর্ণিল জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তিনি কোনো উত্তরসূরি নির্ধারণ করে রেখে যাননি।
সর্বাধিনায়কের প্রয়াণের পর দৃশ্যপটে ক্ষমতার শূন্যতা দেখা দিল। রাজা সিয়াং এই সুযোগে সামরিক কর্তৃত্বের রাশ টেনে এই তথাকথিত ক্ষমতাকে আবারও রাজপ্রাসাদে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালালেন।
বলা যায় এই উদ্যোগে নেওয়ার জন্য তার হাতে একটি সুবর্ণ সুযোগ তুলে দেয় ক্ষুদ্র রাজ্য চেং। তারা রাজার এক দূতকে আটক করে কারাগারে পাঠানোর দুঃসাহস দেখায়। রাজা সিয়াং রাজক্ষমতার প্রতি এই অপমানের শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ ভুল কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি বর্বর জাতি তি’র নেতার মেয়েকে বিয়ে করে রানী বানানোর প্রস্তাব দিলেন। শর্ত, চেং রাজ্যকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তি’র সেনাবাহিনী তাকে সহায়তা করবে।
এসব ঘটনার ৩০০ বছর পর ‘স্প্রিং অ্যান্ড অটাম এনালস’ নামের গ্রন্থে রাজা সিয়াং-এর এক উপদেষ্টার সতর্কবাণী সম্পর্কে লেখা হয়। তিনি বেশ কাব্যিক ভাষায় তি সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিশ্বাস করার ব্যাপারটিতে নিরুৎসাহিত করেন।
রাজা সিয়াং এই সতর্কবাণীকে একেবারেই আমলে নেননি। সিমা কিয়ানের বয়ানে, ‘১৫তম বছরে রাজা চেং-এর বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনার জন্য তি বাহিনীকে পাঠালেন। একইসঙ্গে তিনি তি’র রাজকন্যাকে নিজের রানী হিসেবে বরণ করার জন্য প্রস্তুত হলেন।’
এরপর ঠিক কী হয়েছিল, তার বিস্তারিত বর্ণনা সিমা কিয়ানের বয়ানে নেই। খুব সম্ভবত এই অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। চেং রাজ্য অবিকৃত থেকে যায় এবং এই অভিযানের এক বছর পর রাজা সিয়াং তার নতুন স্ত্রীকে দূরে পাঠিয়ে দিতে মনস্থ করেন।
এই ঘটনার ফলাফল হিসেবে তি বাহিনী ঘুরে ঝৌ রাজধানীতে এসে হামলা চালাল। সিয়াং পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন।
তার সৎভাই শু তাই আবারও দৃশ্যপটে হাজির হলেন। তিনি তার ভাইয়ের ফেলে যাওয়া স্ত্রীকে বিয়ে করে রানী বানানোর প্রস্তাব দিলেন। এতে তি বেশ আনন্দের সঙ্গেই রাজি হল, কারণ শু তাই ছিলেন সে-ব্যক্তি যিনি তি জাতিকে ডেকে এনেছিলেন। রাজা হওয়ার পর শু তাই ইয়াংসি নদীর তীরে অবস্থিত ওয়েন শহরে নতুন রাজপ্রাসাদ তৈরি করলেন, যেটি তার ভাইয়ের পুরনো প্রাসাদ থেকে ৩০ মাইল দূরে ছিল।
তবে শু তাই’র সাম্রাজ্য বিস্তারের কৌশল তার ভাইয়ের চেয়ে কোনোদিক দিয়ে উন্নত ছিল না। রাজা সিয়াং গোপনে জিন রাজ্যে উপস্থিত হয়ে জিনদের নেতা ডিউক ওয়েনের দরবারে ধর্না দিলেন। তিনি বর্বরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার সহায়তা চাইলেন।
জিনের ডিউক সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন। তিনি ঝৌ রাজপ্রাসাদ থেকে তি সেনাবাহিনী বিতাড়ন করলে এবং নিজের হাতে শু তাইকে হত্যা করলেন। তি রাজকন্যার নিয়তি কী ছিল, তা আর জানা যায়নি।
তারপর তিনি তার নিজ সৈন্য ব্যবহার করে রাজা সিয়াংকে আবারও সিংহাসনে বসালেন। স্বভাবতই, সিয়াং জিনের ডিউক ওয়েনকে নতুন সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দিতে রাজি হলেন। এমনকি, তিনি জিন রাজ্যকে বেশ বড় আয়তনের উর্বর ভূমিও দান করলেন।
নতুন সর্বাধিনায়ক তার পেশিশক্তি প্রদর্শনে কোনো কার্পণ্য করেননি। তিনি তার পূর্বসূরির মতো চুপচাপ থাকেননি; কার্যত দেশের শাসনভার তার হাতেই ছিল। সর্বাধিনায়ক হওয়ার ৩ বছরের মাথায় তিনি রাজা সিয়াংকে ‘রাজকীয় আদেশ পাঠাতে শুরু করেন। সিমা কিয়ান বলেন, ‘১২তম বছরে জিনের ডিউক ওয়েন রাজা সিয়াংকে ডেকে পাঠালেন, এবং তিনি ওয়েনের কাছে এসে পৌঁছালেন। স্বর্গীয় রাজা ওয়েনের এলাকা পরিদর্শন করলেন।’
বস্তুত, পরিদর্শন করে সিয়াং বুঝতে পারলেন যে, সর্বাধিনায়কের হাতেই রয়েছে দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব; তিনি একেবারেই গুরুত্বহীন এক চরিত্রে পরিণত হয়েছেন।
দক্ষিণে অবস্থিত বিশাল রাজ্য চু তাদের নিজস্ব পরিকল্পনা আঁটছিল। জিন, চেং ও ঝৌ রাজধানীতে বারবার হামলা চালানো বর্বরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যই ছিল এই পরিকল্পনা। চু’র ডিউক উত্তর সীমান্ত জুড়ে এক সুবিশাল প্রাচীর নির্মাণের আদেশ দিলেন। এর নাম ছিল ‘চতুর্ভুজ প্রাচীর’। এই প্রাচীর একই সঙ্গে বর্বর ও নতুন সর্বাধিনায়কের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার বিরুদ্ধে তাকে সুরক্ষা দিয়েছিল। এই প্রাচীর তৈরির মাধ্যমে জিন সেনাবাহিনীর আগমনের পথ বন্ধ হয়। বিশেষত, সরাসরি ঝৌ ভূখণ্ডের পূর্বদিক থেকে চু অঞ্চলে আসার উপায় আর রইল না।
এ পরিস্থিতিতে চু আর জিন ঝৌ রাজা ও তার রাজত্বের মাথার ওপর দিয়ে যথাক্রমে উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে একে অপরের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতে থাকল। পূর্ব ও পশ্চিমে চি’ইন ও কি একে অপরের মুখোমুখি হল। আগের সর্বাধিনায়কের রাজ্য হিসেবে কি’র গুরুত্ব কমে গেলেও, তাদেরকে একেবারে ফেলনা মনে করারও কিছু ছিল না। চি’ইন-এর দখলে কিছু পশ্চিমা ঝৌ ভূখণ্ড ছিল। পূর্বদিকের ঝৌ শাসন এই শক্তিশালী রাজ্যগুলোর সমন্বয়ে গঠিত চতুর্ভূজে রূপান্তরিত হয়েছিল। সবার মাঝে থেকে দুর্বল ও ভীরু ঝৌ রাজা কাঁপতে লাগলেন।