1 of 2

৫১. অ্যাসিরীয়া ও ব্যাবিলনের রাজারা

অধ্যায় ৫১ – অ্যাসিরীয়া ও ব্যাবিলনের রাজারা

খ্রিস্টপূর্ব ৭২৬ থেকে ৭০৫ সালের মধ্যে মিশর আবার একীভূত হয়, ইসরায়েল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং সারগন দ্বিতীয় মোটামুটি সমগ্র পৃথিবী দখল করে নেন।

‘মারদুকের আশীর্বাদ’ নেওয়ার ঠিক ২ বছর পর, ৭২৬ সালে তিগলাথ- পিলেসার দ্বিতীয় মারা গেলেন। তিনি প্রায় ২০ বছর অ্যাসিরীয়ার সিংহাসনে বসেছিলেন। তিনি তার ছেলে শালমানেসার পঞ্চমের হাতে একটি সুরক্ষিত সীমান্ত ও অ্যাসিরীয়া ও ব্যাবিলনের শাসনভার রেখে গেলেন। তবে উপসাগরের মাথায় সেই অনিচ্ছুক চালদিয়ান গোত্রপ্রধান মেরোদাক-বালাদান নীরবে শক্তি সঞ্চয় করে যাচ্ছিলেন।

শালমানেসার পঞ্চমের আমলে তেমন কোনো শিলালিপি খোদাই করা হয়নি। তবে এটুকু জানা যায় যে তিনি চালদিয়ানদের পক্ষে থেকে আসা হুমকির বিষয়টি একেবারেই টের পাননি। তিনি মূলত দেশের পশ্চিমাঞ্চলের দিকে নজর দিচ্ছিলেন। কোনো এক বিচিত্র কারণে দেশের এই অংশটিকে পুরোপুরি নিজের দখলে নেওয়ার নেশায় মত্ত ছিলেন তিনি। নিঃসন্দেহে এতে সফল হলে তিনি তার পিতাকে টেক্কা দিতে পারতেন, কারণ তিনি শুধু ফিনিশীয় ও ইসরায়েলিদের কাছ থেকে উপঢৌকন পেতেন এবং এই দুই রাজ্যকে প্রতিনিধি-রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করতেন—তারা অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল না। তিগলাথ-পিলেসার ইসরায়েলকে অধীনস্থ রাজ্যে পরিণত করেছিলেন; শালমানেসার পঞ্চম একে নিশ্চিহ্ন করেই তবে ক্ষান্ত দিলেন।

এই অকাজ(!) করার পেছনে তার কিছু যুক্তি ছিল। ইসরায়েলের তৎকালীন রাজা ছিলেন একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা, যার নাম হোশিয়া। শালমানেসারের বয়ানে, ‘তিনি বছরের পর বছর অ্যাসিরীয়ার রাজাকে নজরানা দিলেও এখন আর দিচ্ছেন না।’ শালমানেসার পঞ্চমের গুপ্তচররা তাকে খবর দিলেন যে হোশিয়া ‘মিশরের রাজা সো-র কাছে প্রতিনিধি’ পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ, ইসরায়েল অ্যাসিরীয়ার সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং তারা মিত্রের খোঁজ করছিল।

আবারও একীভূত হওয়ার কারণেই মিশর আবারও পশ্চিমা সেমাইটদের যুদ্ধে যোগ দিতে সক্ষম হয়। কারকার-এর যুদ্ধের পর প্রায় ১০০ বছর পেরিয়ে গেছিল। মিশর উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম—এরকম চারটি ভিন্ন ভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে বেশ কয়েকজন ফারাও ও ৩টি ভিন্ন ভিন্ন রাজধানী শহরের উৎপত্তি হয়। থেবেস, তানিস ও কেন্দ্রের বদ্বীপ শহর লিওন্তোপোলিস। সাময়িকভাবে হেরাক্লিওপোলিস ও হার্মোপোলিসেও রাজার উদ্ভব হয়। এছাড়াও, আরও ১৫টি পরিবার রাজা, প্রভু, অধিপতিসহ আরও নানারকমের খেতাব নিজেদের নামের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছিল। ইতিহাসবিদ মানেথো এই এলোমেলো পরিস্থিতি সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করার চেষ্টা চালান। তিনি এই রাজাদের ২২, ২৩ ও ২৪ রাজবংশের সদস্য হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করার চেষ্টা চালান। তবে বাস্তবতা হল, এরা সকলেই একইসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন শহরে বসে তাদের নিজ নিজ শহর শাসন করছিলেন। ২২তম রাজবংশের স্থানীয় শক্তিমত্তা থেকেই উদ্ভব হয় ২৫তম রাজবংশের আধিপত্যের।

মিশরের উত্তর অঞ্চলের গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে নীলনদের উভয় পাশে অবস্থিত দক্ষিণের ভূখণ্ডগুলো বেশ উপকৃত হয়। এ অঞ্চলের মিশরীয়-অধ্যুষিত অংশটির নাম ছিল ‘কুশ’ এবং সামগ্রিকভাবে, দেশটির নাম ছিল নুবিয়া। এ এলাকাটি দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন বেশ কয়েকজন মিশরীয় সামন্তপ্রভু। কিন্তু বাস্তবে তারা কেউই এদিকে বিশেষ নজর দিচ্ছিলেন না।

মিশরের একাধিক রাজবংশের উদ্ভবের কাল আসতে আসতে আফ্রিকার বেশকিছু স্থানীয় গোত্র ও তাদের সঙ্গে বসবাসরত মিশরীয়রা মিলে নুবিয়ান জাতি গঠন করে। তাদের কোনো ভাইসরয় বা বড়লাট ছিল না। তাদের ছিল নিজস্ব একজন রাজা। তারা নিজেদেরকে ‘নাপাতা’ জাতি হিসেবে পরিচয় দিতেন। জেবেল বারকাল নামের একটি রাজপ্রাসাদ থেকে এই দেশটিকে শাসন করা হত। তবে তাদের মাঝে মিশরীয়দের প্রভাব অনেক প্রকট ছিল। তারা আমুন দেবতার উপাসনা করতেন এবং নুবিয়ান শাসকরাও প্রাচীন মিশরীয়দের মতো ভাই-বোনের বিয়েতে আপত্তি করতেন না।

বছরটি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৭২৭। শালমানেসার পঞ্চম তার পিতার সিংহাসনে বসার ঠিক এক বছর আগের কথা সেটি। সেসময় নাপাতার রাজা ছিলেন একজন স্থানীয় নুবিয়ান, যার নাম ছিল পিয়ানখে। তিনি ২০ বছর সিংহাসনে থাকার পর জানতে পারলেন সাইস, তানিস, হেরাক্লিওপোলিস, হেরমোপোইলস ও লেওনতোপোলিস শহর নাপাতার ধারাবাহিক উন্নতিতে অস্বস্তিতে পড়ে একটি জোট তৈরি করেছে। তাদের উদ্দেশ্য, মিশরের সীমান্তকে আবারও নুবিয়ানদের অঞ্চলের দিকে ঠেলে দেওয়া।

তিনি এই জোটের বিরুদ্ধে লড়ে জয়ী হলেন এবং এর ইতিবৃত্তান্ত লিখে রেখে গেলেন। তিনি লিখলেন : আমুন দেবতা মিশরের প্রকৃত রাজা পিয়ানখের ওপর তার আশীর্বাদ বর্ষণ করলেন আর বাকি সব গোত্রপ্রধান ও রাজা তার সামনে মাথা নত করলেন।

পিয়ানথে তার শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করতে চাইতেন না। বরং তিনি চেয়েছিলেন মিশর হোক বেশ কয়েকটি রাজত্বের সমন্বয়ে গঠিত একটি বড় সাম্রাজ্য এবং তিনি এই বড় রাজ্যের অধিপতি থাকবেন।

দোর্দন্ডপ্রতাপ অ্যাসিরীয়দের বিরুদ্ধে এরকম একটি সুসংহত মিশরকেই মিতা হিসেবে চেয়েছিল ইসরায়েল।

তবে ইসরায়েলের প্রতিনিধিরা যে মিশরের কাছে ধর্না দিয়েছিলেন, সেটি পিয়ানখের মিশর নাও হয়ে থাকতে পারে। সেসময় মিশরের বিভিন্ন অঞ্চলে পিয়ানখের প্রতিনিধি হিসেবে ‘স্থানীয় রাজাদের’ দৌরাত্ম্য ছিল। খুব সম্ভবত, ইসরায়েলিরা বদ্বীপ অঞ্চলের রাজা অসোরকোন চতুর্থের দরবারে হাজির হয়েছিল। হোশিয়া খুব সম্ভবত মিশরের জটিল শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন কিছু জানতেন না। বস্তুত, মিশরের শাসনভার সে-মুহূর্তে ঠিক কার হাতে ছিল, সেটা কেউই ভালো করে জানতেন না। পিয়ানখেও সম্ভবত খবর পাননি যে, ইসরায়েল থেকে রাষ্ট্রদূতরা মৈত্রী নিয়ে কথা বলতে এসেছেন।

হোশিয়ার আর্জি যার কানেই যাক, তিনি তাতে সাড়া দেননি। মিশরের এই সফরের পরিণতি ছিল খুবই করুণ।

শালমানেসার পঞ্চম ইতোমধ্যে টির শহরের অবাধ্য আচরণ ও দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা যুদ্ধ নিয়ে বিরক্ত ছিলেন। যেসব শহর ইতোমধ্যে তার পিতার বশ্যতা স্বীকার করেছে, তাদের কাছ থেকে নতুন করে কোনো ধরনের ঝামেলা তার কাম্য ছিল না। কাহিনিকারের বর্ণনায়, ‘অ্যাসিরীয়ার রাজা সমগ্র ভূখণ্ডে হামলা চালালেন। তিনি ইসরায়েলের রাজধানী সামারিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন এবং টানা ৩ বছর ধরে সেখানে হামলা করতে লাগলেন।’

এ পর্যায়ে এসে অ্যাসিরীয়দের বর্ণনা থমকে যায়। আবার যখন তাদের বর্ণনা শুরু হয়, ততদিনে শালমানেসারে পঞ্চম মাত্র ৫ বছর শাসন করার পর মৃত্যুবরণ করেছেন। জীবদ্দশায় তিনি একইসঙ্গে দুইটি যুদ্ধে অংশ নিচ্ছিলেন। সারগন দ্বিতীয় নামে নতুন এক রাজা ক্ষমতা দখল করেছেন।

যদি শালমানেসার পঞ্চম যুদ্ধে মারা যেয়ে থাকতেন, তাহলে রাজসভার লেখকরা খুব সম্ভবত সেকথা ফলাও করে প্রচার করতেন। খুব সম্ভবত, তার উত্তরসূরি সারগন দ্বিতীয় ছিলেন তিগলাথ-পিলেসারের কনিষ্ঠ সন্তান। তিনি তার ভাইয়ের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেন। শালমানেসার পঞ্চমের দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধগুলো সেনাবাহিনীতে তাকে অজনপ্রিয় করে তুলেছিল। এছাড়াও, তিনি আসসুরের মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে কায়িক শ্রমে নিয়োজিত করেও নিন্দার ভাগীদার হন।

এ ঘটনার পরিণতি শুভ হয়নি।

সারগন দ্বিতীয় আসসুরের নাগরিকদের কর রেয়াত সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। এভাবে তিনি তার ভাইয়ের ‘আকস্মিক মৃত্যুর’ বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। তার আনুষ্ঠানিক বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি দেশের নাগরিকদের বললেন, ‘শালমানেসার মহাবিশ্বের রাজাকে ভয় পেতেন না।’

“তিনি তার শহরের বিরুদ্ধে অশুভ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিজের দুই হাত প্রসারিত করতেন। তিনি তার নাগরিকদের ওপর সামন্তবাদী করের বোঝা চাপাতেন, এবং তা খুবই রূঢ়তার সঙ্গে। তিনি তাদেরকে প্রজা নয়, বরং ভৃত্যের দৃষ্টিতে দেখতেন। ফলে দেবতাদের প্রভুর হৃদয়ে রাগের সঞ্চার হয় এবং তিনি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। আমি, সারগন, মাথা উঁচু করে রাখতে পেরেছি প্রভুর সামনে। আমি আসসুরকে করের বোঝা, যেকোনো অজুহাতে ‘যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া’, রাজপ্রাসাদের জন্য বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করা, অ্যাসিরীয়ার মন্দিরের উদ্দেশে নজরানা দেওয়া সহ আরও অনেক কিছু থেকে মুক্তি দিয়েছি।”

দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই চলার পরেও যেসব যুদ্ধের কোনো ফল আসছিল না, তিনি দ্রুত সেগুলোর নিষ্পত্তি ঘটান। তার শাসনামলের প্রথম বছরে, খ্রিস্টপূর্ব ৭২১ সালে তিনি সামারিয়া দখল করেন। সেখানে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছিল। তারপর এক অভূতপূর্ব নিষ্ঠুরতার নিদর্শন রেখে তিনি ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেন। তিনি হোশিয়াকে গ্রেপ্তার করে হাজতে পাঠান। তারপর ইসরায়েলিদের নিজ ভূখণ্ড থেকে নির্বাসনে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেন। এটা ছিল যেকোনো বিদ্রোহী রাজ্যের প্রতি অ্যাসিরীয় রাজাদের সাধারণ প্রতিক্রিয়া।

নির্বাসন ছিল একধরনের গণহত্যা। তবে এখানে কোনো ব্যক্তি নয়, বরং একটি জাতিসত্তার অপমৃত্যু ঘটত।

সারগনের নিজস্ব শিলালিপি অনুযায়ী, তিনি প্রায় ২৭ হাজার ২৯০ ইসরায়েলি নাগরিককে তাদের মাতৃভূমি থেকে নির্বাসন দিয়েছিলেন। এই নির্বাসিত জনগোষ্ঠী এশিয়া মাইনর থেকে শুরু করে মেদেস অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ইসরায়েলের এই নাগরিকরা ‘হারিয়ে যাওয়া ১০ গোত্র’ নামে পরিচিতি পায়। তবে তারা হারিয়ে যাননি, বরং আব্রাহাম ও ইয়াহওয়েহ’র বংশধর হিসেবে তাদের পরিচয় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে, কারণ তারা বাধ্য হন নতুন, জঙ্গলে ঘেরা জায়গায় বসতি গড়তে।

উত্তরের রাজত্বে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা ইসরায়েলিরা বারবার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নির্বাসিত জনগোষ্ঠীদের হামলার মুখে পড়তে লাগলেন। এই নির্বাসিত ইসরায়েলি ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীরা পরবর্তীতে মিলেমিশে নিজেদের একটি অনন্য সংস্কৃতি তৈরি করলেন। বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্রের এই মানুষগুলোকে ‘সামারিটান’ বলা হতো। ইহুদিরা তাদেরকে নিচু দৃষ্টিতে দেখতেন।

এবং এখানেই এর শেষ নয়। সিরিয়ার আরামিয়ান ও হামাথ গোত্র অ্যাসিরীয় রাজার বিরুদ্ধাচরণ করল। সারগন দ্বিতীয় কারকার শহরে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন।

১০০ বছর আগে কারকারে বড় আকারের যুদ্ধের পর এটাই ছিল সেখানে ঘটা সবচেয়ে বড় সংঘাতের ঘটনা। তবে এবার যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিল না। হামাথের রাজাকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আসসুরে নিয়ে যাওয়া হল। সিরিয়ার নেতা ‘দৌড়ে পালালেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি এমন এক মেষপালক যার সব মেষ (ভেড়া) তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ স্বভাবতই, সারগন কারকারে লুটতরাজ চালালেন এবং একে আগুনে পুড়িয়ে দিলেন।

পশ্চিমের পূর্ণ দখল নিশ্চিতের পর তিনি ভূমধ্যসাগর পার হলেন এবং সাইপ্রাস দ্বীপে এসে পৌঁছালেন। এখানে কিছু আইওনিয়ান গ্রিক ও উপকূল থেকে আসা ফিনিশীয় নাগরিক বসবাস করছিলেন। তিনি তাদের কাছ থেকে জোর করে উপঢৌকন আদায় করলেন। তিনি একইসঙ্গে নিনেভেহ’র উত্তর-পূর্বে নতুন রাজধানী দুর-শাররুকিনের (‘সারগনের শহর’) গোড়াপত্তন করলেন। এ জায়গাটা ছিল টাউরাস পর্বতমালার কাছাকাছি একটি জায়গায়, যেখানে তখনো উরারতুরা বিচরণ করত।

উরারতু সৈনিকরা বেশ বড় আকারের ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিল। তারা খুব সহজেই পাহাড়ের উপর থেকে নেমে এসে আক্রমণ করে আবারও দ্রুত তাদের দুর্গে ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু তাদেরকে এই পার্বত্য জায়গা দিয়ে ধাওয়া করা বেশ দুরূহ একটি বিষয় ছিল। ততদিনে উরারতু একটি বেশ আধুনিক (সে আমলের বিচারে) ও সুরক্ষিত রাজত্বে রূপান্তরিত হয়েছে। সারগনের বর্ণনায় উরারতুর রাজা রুসাসের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। তার নির্মাণ-করা অসংখ্য খাল ও কুয়ার কথা সারগন উল্লেখ করেন। এছাড়াও, তার বর্ণনায় স্থান পেয়েছে রুসাসের অতি-উন্নত জাতের ঘোড়া লালনপালনের বর্ণনা। এই ঘোড়াগুলোকে অত্যন্ত সুরক্ষিত উপত্যকায় বড় করা হতো, এবং যতদিন পর্যন্ত না যুদ্ধের জন্য তাদের প্রয়োজন হত, ততদিন এই ঘোড়াগুলো লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যেত। এছাড়াও, সামগ্রিকভাবে এই জাতির উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত টহল-চৌকি, বড় আকারে তেলের সঞ্চয়—এ সবকিছুই উঠে এসেছে বিস্তারিত বর্ণনায়। রাজত্বের এক অংশ থেকে আরেক অংশে কোনো বার্তা পৌঁছানোর জন্য খুব দ্রুত পাহাড়ের চূড়ায় আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা ছিল। একটি চূড়ায় সেই বিশেষ ধরনের আগুন জ্বলতে দেখলে পরবর্তী চূড়ায় আগুন জ্বালানো হত—এভাবেই রাজত্বের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় বিপদ-সংকেত চলে যেত।

সারগনের ভাষায়, ‘পাহাড়ের চূড়ায় তারার মতো’ জ্বলজ্বল করত এই আগুন। ফলে যেকোনো আগ্রাসনের সংবাদ পায়ে-হাঁটা বা ঘোড়ায় চাপা বার্তাবাহকের চেয়ে অনেক দ্রুত সারা রাজত্বে ছড়িয়ে যেত।

৭১৪ সাল নাগাদ সারগন পার্বত্য অঞ্চলে হামলা চালানোর জন্য প্রস্তুত হলেন। এই বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানের নেতৃত্ব তিনি নিজেই দিলেন। সরাসরি উত্তরে উরারতিয়ানদের শক্তিমত্তার অঞ্চলে না যেয়ে তিনি তার বাহিনীকে ঘুরিয়ে নিয়ে পূর্বদিকের জাগরোসের দিকে নিয়ে গেলেন। তিনি চেয়েছিলেন সেখানকার অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমির সুবিধা নিয়ে উরারতুর দুর্বল পূর্ব-সীমান্ত দিয়ে হামলা চালাবেন।

সারগন নিজেই এই অভিযানের বর্ণনা লেখেন। তার লেখনী ছিল চিঠির মতো; তিনি আসসুর দেবতা ও তার স্বর্গীয় বান্ধবদের কাছে একটি আনুষ্ঠানিক, রাজকীয় চিঠি পাঠিয়ে তার সব যুদ্ধের বর্ণনা দেন—যেগুলোতে তিনি আসসুরের পক্ষ নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। নিঃসন্দেহে এই চিঠিগুলো জনসম্মুখে, জোরগলায় পড়ে শোনানোর যোগ্য’ যাতে সবাই এর অর্থ অনুধাবন করতে পারে।

‘এরপর আমরা এমন এক উঁচু পর্বতে এলাম, যেখানে সবধরনের গাছ জন্মায়। সেই পাহাড়ি তাণ্ডবের মাঝে, সবার মনে কালো ছায়ার মতো ভীতির সঞ্চার হয়। বড় বড় সিডার গাছের ছায়া সূর্য রশ্মিগুলোকে আটকে দেয়।

বহু বছর আগে গিলগামেশ যে সিডার বনে গেছিলেন, এই পাহাড়ি ঢালের ওপর অবস্থিত গাছগুলোও সেরকমই ছিল। এখানে এমন এক শত্রু লুকিয়ে ছিল, যে আরও অনেক বেশি ভয়াবহ ছিল—কারণ তাকে দেখা যেত না।

সারগন তার লোকদের এই বনের গাছ কেটে সামনে আগানোর নির্দেশ দিলেন। কর্মীরা তামার তৈরি কুঠার হাতে কাজে নেমে পড়লেন। একপর্যায়ে তারা পূর্বের সমতলভূমিতে এসে পৌঁছালেন। সেখানে তাদের মেদেসের সঙ্গে দেখা হল। এই জাতি চুক্তির শর্ত (ও কিছুটা ভীতি) থেকে তাদেরকে পানি ও খাদ্য দিয়ে সহায়তা করতে এগিয়ে এল।

সেনাবাহিনীর রসদ ও সরঞ্জাম পরিপূরণের পর সারগন তার সেনাবাহিনীকে নিয়ে উত্তরে উরারতিয়ান সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করতে গেলেন। বর্তমান যুগে যে শহর তাবরিজ নামে পরিচিত, সেখান থেকে কিছুটা দক্ষিণে পাহাড়ি ঢালে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হল। এই যুদ্ধক্ষেত্র নির্বাচনের পেছনে সারগন বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন। এটি ছিল দক্ষিণের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেশ দূরে, এবং এখানে শত্রুপক্ষকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ছিল না কোনো সুবিশাল দুর্গের সারি। তবে এ জায়গায় পৌঁছাতে অ্যাসিরীয় বাহিনীকে প্রায় ৩০০ মাইল পথ পাড়ি দিতে হয়। গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যে গভীর বন এবং খাড়া পাথুরে রাস্তার মধ্যদিয়ে এগোতে যেয়ে সারগনের বাহিনীর খাবার ও পানির সঞ্চয় প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসে।

আসসুরের ক্লান্ত সেনাদল বহুদূর থেকে সুবিধাজনক যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছালেও সেখানে তাদের কার্যক্রম ছিল খুবই ধীরগতির। প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে তারা পর্যুদস্ত হতে লাগল। তাদের ক্লান্তি দূর করার জন্য সারগনের কাছে কোনো খাবার, পানি বা সঞ্জীবনী মন্ত্র ছিল না। ফলে ধীরে ধীরে সেনাদলে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে লাগল।

নিজের ফাঁদে নিজেই পড়লেন সারগন। তিনি তার লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছালেন, কিন্তু সেখানে যেয়ে নিজেকে পুরোপুরি ক্ষমতাহীন হিসেবে আবিষ্কার করলেন। ইতোমধ্যে রুসাসের নেতৃত্বাধীন উরারতিয়ান সেনাবাহিনী তার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য জমায়েত হয়েছে।

সারগনের বাহিনী রুসাসের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে রাজি হল না। জিদ করে একাই রওনা হলেন সারগন; সঙ্গে ছিল তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী বাহিনী। রুসাসের বাহিনীর সবচেয়ে কাছের অংশে তিনি এক আত্মঘাতী উন্মাদ হামলা চালালেন। মজার বিষয় হল, তার এই মরিয়া হিংস্রতা দেখে রুসাসের বাহিনীর ঐ অংশটি ছত্রভঙ্গ হয়ে পরাজয় বরণ করল। সারগনের নিজের ভাষ্যমতে, এরকম বীরদর্পে, একক উদ্যোগে শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করতে দেখে তার বাহিনী সিদ্ধান্ত বদলে তার পেছনে এসে যোগ দেয় এবং স্বভাবতই, উরারতিয়ান বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।

এই পিছে হটা একপর্যায়ে পলায়নে রূপান্তরিত হয়। অ্যাসিরীয় বাহিনী মনোবল হারানো, ছত্রভঙ্গ শত্রুকে ধাওয়া করতে করতে উরমিয়া হ্রদ পর্যন্ত নিয়ে যায়। সেখান থেকে তারা তাদের নিজেদের ভূখণ্ডে পালানোর চেষ্টা করে। রুসাস এমনকি তার নিজের রাজধানী শহর তুরুশপাকেও বাঁচানোর কোনো চেষ্টা করলেন না। তিনি নিকটবর্তী পর্বতে আত্মগোপন করলেন।

এ পর্যায়ে সারগনের লেখকরা ঘোষণা দেন, হঠাৎ করেই অ্যাসিরীয় বাহিনী ঘুরে বাড়ির পথে রওনা হল। হয়তো তিনি সন্দেহ করেছিলেন, বিপক্ষের রাজাকে আরও দূরে, অজানা ও গভীর গাছে আচ্ছাদিত অঞ্চলে ধাওয়া করতে গেলে এবার সেনাবাহিনী স্থায়ীভাবে বিদ্রোহ করে বসবে।

পরিবর্তে সারগন তার বাহিনী নিয়ে দক্ষিণদিক দিয়ে পেছাতে লাগলেন। পথে মুশাশির শহরে লুটপাট চালালেন। সেখানে উরারতিয়ানদের প্রধান দেবতার মূল মন্দিরের অবস্থান ছিল। এই খবর যখন আত্মগোপনে থাকা রুসাসের কানে পৌঁছাল, তখন তিনি দুঃখ করে জানালেন, আসসুরের শক্তিমত্তা তাকে পরাভূত করেছে। সারগনের শিলালিপিতে লেখা ছিল, ‘এবং সে তার নিজেরই লোহার তৈরি ছুরি নিজের বুকে বসিয়ে আত্মহত্যা করল, এবং একটি ঘৃণ্য শূকরের মতোই তার জীবনাবসান হল।’

এভাবেই উত্তরের ঝামেলাপূর্ণ রাজত্ব নিজ দখলে নেওয়ার পর সারগন নিজ ভূখণ্ডের দিকে জয়যাত্রা শুরু করলেন। সময়টা ছিল নভেম্বর মাস। উরারতুর অবশিষ্ট ছত্রভঙ্গ বাহিনীকে পরাভূত করতে হলে তাকে শীতের মৌসুমে পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালানোর ঝুঁকি নিতে হত। তবে তিনি সে বোকামি আর করেননি। মাত্র ৬ মাসের মাথায় উরারতু অভিযানের অবসান হল।

এ পর্যায়ে তিনি নিজেকে দিগ্বিজয়ী হিসেবে দেখতে পেলেন। মিশর ও ইথিওপিয়া থেকে এল রাষ্ট্রীয় দূত, পৃথিবীর দূরদূরান্ত থেকে এল তার সাফল্যের স্বীকৃতি। এমনকি। ‘দিলমানের রাজার কাছ থেকেও এল প্রতিনিধি ও উপঢৌকন। সারগনের ভাষায়, দিলমানের বাসিন্দারা ‘মাছের মতো জীবনযাপন’ করতেন। এই রূপকের মাধ্যমে তিনি সম্ভবত আরবের সাবিয়ান গোত্রের মানুষের কথা বুঝিয়েছিলেন, যাদের রানী প্রায় ২০০ বছর আগে রাজা সলোমনের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন। একমাত্র দক্ষিণের কিছু ভূখণ্ড ছাড়া সারগন প্রায় সমগ্র পৃথিবীর অধিপতি হিসেবে আবির্ভূত হলেন।

ইতোমধ্যে, ব্যাবিলনীয়াতে নতুন এক নাটক চলছিল।

বিত-ইয়াকিনদের চালদিয়ান গোত্রপ্রধান মেরোদাক-বালাদান উর শহরে নিজের বিশ্বস্ত অনুসারী জমায়েত করছিলেন। শালমানেসার পঞ্চমের মৃত্যুর পরপরই মেরোদাক-বালাদানের দীর্ঘদিনের অপেক্ষার শেষ হয়। তিনি ব্যাবিলন অভিমুখে তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যান, তার সকল শত্রুকে বিনষ্ট ও বিতাড়ন করে রাজার সিংহাসন দখল করেন। তিনি এক দশকেরও কম সময়ে ৩ বার অ্যাসিরীয়ার সিংহাসনের হাতবদল হতে দেখেছিলেন, এবং মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন যে সারগন দ্বিতীয়র শাসনামলেও তিনি বহাল তবিয়তে টিকে থাকবেন। এ বিষয়টিকে নিশ্চিত করতে তিনি পূর্বদিকে দূত পাঠালেন। অ্যাসিরীয়ার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সংঘাতে এলামাইটদের সমর্থন পেতে তিনি তার ব্যক্তিগত ধনসম্পদের একটি বড় অংশ খরচ করলেন।

তার একজন বাইরের মিত্র খুব দরকার ছিল। মেরোদাক-বালাদান ক্ষমতা দখল করলেও দেশবাসীর পূর্ণ সমর্থন তার পেছনে ছিল না, বিশেষত উত্তরাঞ্চলে। সেখানকার ব্যাবিলনীয়রা অ্যাসিরীয়ার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতেন এবং চালদিয়ানদের অপছন্দ করতেন। মেরোদাক-বালাদান এমন একটি কৌশল অবলম্বন করার চেষ্টা করলেন, যেটি নেপোলিয়ন প্রায় কয়েক হাজার বছর পর সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করেছিলেন। ঘোষণা দিলেন, তিনিই দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন এবং তিনি এক প্রাচীন ব্যাবিলনীয় প্রথার পুনঃস্থাপন করেছেন, যেটি উত্তরাঞ্চলের হানাদারদের আগ্রাসনে পদদলিত হয়েছিল। অ্যাসিরীয়রা তাৎক্ষণিকভাবে শহরের প্রাচীরের বাইরে চলে আসলে এই কৌশল কাজে আসত না। কিন্তু সারগন তখন পশ্চিমে, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তার মিশরীয় ও আরব মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা এবং শত্রু উরারতুর মোকাবিলায় ব্যস্ত ছিলেন। প্রায় এক দশক মেরোদাক-বালাদানের দিকে তাকানোর সময়ও ছিল না তার। এ সময়টা চালদিয়ান রাজা ব্যাবিলনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কাজে ব্যয় করেন। ব্যাবিলনের প্রায় পুরো অংশই তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়।

খ্রিস্টপূর্ব ৭১০ সাল নাগাদ সারগন অবশেষে দক্ষিণে নজর দেওয়ার অবকাশ পেলেন। প্রথমেই তিনি এলামের প্রতি আগ্রহী হলেন। এলামের রাজা ছিলেন এক সাবেক ও অভিজ্ঞ সেনাপতি। তার আরেক পরিচয়, তিনি মেরোদাক-বালাদানের মিত্র। কিন্তু ততদিনে এই অভিজ্ঞ রাজা মারা গেছেন; রাজ্যের শাসনভার গেছে শাতরুক-নাহহুনতের হাতে। সুযোগ বুঝে ব্যাবিলন জয়ের পথে প্রথম ধাপ হিসেবে সারগন দ্বিতীয় পূর্বে এগিয়ে এসে এলাম আক্রমণ করে বসলেন।

শাতরুক-নাহহুনতে লেজ তুলে পালালেন বললেও কম বলা হবে! ব্যাবিলনের সীমান্তবর্তী এলামকে অকেজো করে দিয়ে সারগন নিশ্চিত করলেন, এ পথে মেরোদাক-বালাদানকে বাঁচানোর জন্য কোনো এলামাইট সহায়তা আসবে না। এরপর তিনি দক্ষিণে যেয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ব্যাবিলনের দিকে আগাতে লাগলেন। এই ধূর্ত কৌশল নিশ্চিত করল, মেরোদাক-বালাদান তার এলামাইট মিত্রদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেন এবং একই সঙ্গে তার জন্য উপসাগরের পথ ধরে নিজ দেশে ফিরে যাওয়াও অনেক বিপজ্জনক হয়ে পড়ল, কেননা, সে মুহূর্তে সারগনের সেনারা ব্যাবিলনের তুলনায় তাদের নিজেদের দেশ বিট-ইয়াকিনের বেশি কাছে ছিল। ফলে মেরোদাক- বালাদান উত্তরেও যেতে পারছিলেন না। অনুমিতভাবেই, ব্যাবিলনের উত্তরাঞ্চলীয় শহরগুলোতে সারগন উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলেন। ‘তুমুল জয়ধ্বনি’ করতে করতে তারা সারগনের জন্য ফটক খুলে দিতে লাগল।

সারগনের লেখকরা আরও জানান, মেরোদাক-বালাদান টের পেলেন যে, যুদ্ধ শুরুর আগেই তিনি হেরে গেছেন। তাই তিনি ভাবলেন, পুরো বাহিনী নয়, ছোট ও বিশ্বস্ত একদল দেহরক্ষী নিয়ে এলামে পালিয়ে যাবেন। রাতের আঁধারে অ্যাসিরীয় ঘাঁটির পাশ দিয়ে চুপচাপ বের হয়ে যাবেন। এমনটাই ছিল তার পরিকল্পনা।

কবিতার ছন্দে এ ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

যখন মেরোদাক-বালাদান জানলেন ব্যাবিলনে আসসুরের জয়ের বিষয়ে—নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হলেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠতম সমর্থকদের তিনি বিশেষ দূত হিসেবে রাতের আঁধারে এলামে পাঠালেন। দূতরা এলামাইটদের শাতরুক-নাহহুনতের কাছ থেকে একটি বিশেষ উপকার চাইলেন। তারা উপহার হিসেবে মেরোদাক-বালাদানের নিজস্ব রাজকীয় আসবাবপত্র দিলেন। এর মাঝে ছিল একটি রুপার তৈরি খাট, সিংহাসন, টেবিল, হাত-মুখ ধোয়ার জন্য ব্যবহৃত বিশেষ রাজকীয় পাত্র, তার নিজের গলার হার এবং আরও অনেক কিছু।

সারগন বলেন, “সেই ‘এলামাইট তস্কর’ মেরোদাক-বালাদানের উপহার সাগ্রহে গ্রহণ করলেন, কিন্তু আমার সামরিক শক্তির ভয়ে মেরোদাক-বালাদানের প্রস্তাবে রাজি হলেন না। তার জন্য এলামে আসার পথ বন্ধ করে দিলেন এবং তাকে ভুলেও ওই পথে পা না-মাড়ানোর উপদেশ দিলেন।”

শাতনাক-নাহহুনতে হয়তো যথার্থই একজন ‘তস্কর’ ছিলেন, কিন্তু তিনি এই ঘটনাক্রমে থেকে বেশ লাভবান হলেন। একদিকে মেরোদাক-বালাদানের ধনসম্পদের মালিক হলেন, আবার অপরদিকে অ্যাসিরীয় রাজার রুদ্ররোষেও পড়লেন না।

আশ্রয় না পেয়ে বাধ্য হয়ে মেরোদাক-বালাদানকে ঘুরে বিট-ইয়াকিনের দিকে রওনা হতে হল। যথারীতি, তিনি যা আশঙ্কা করেছিলেন, ঠিক তাই হল। তার নিজ শহরেই তিনি হামলার শিকার হলেন। তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেও কূল রক্ষা করতে পারলেন না। সারগনের বর্ণনায়, তিনি প্রাচীর ‘উঁচু করলেন’, সেগুলোকে আরও শক্তিশালী বানালেন এবং শহরের চারপাশে নালা কেটে সমুদ্রের পানি দিয়ে সেগুলোকে ভরে তুললেন।

অল্প সময়ের মাঝেই নৌকা ভাসিয়ে এই পানিপথ অতিক্রম করল অ্যাসিরীয় বাহিনী এবং সকল প্রতিরোধের অবসান হল। সারগন গর্ব-সহকারে বললেন, ‘আমি এটাকে পুড়িয়ে দিলাম, আর সব প্রাচীর ও দালান গুঁড়িয়ে দিলাম।’

এরপর সারগন দ্বিতীয় নিজেও নেপোলিয়নের মতো এক বড়সড় উৎসবের আয়োজন করলেন। মারদুকের উদ্দেশে নিবেদিত এই উৎসবে তিনি ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাওয়ার দাবি করলেন, এবং নিজেকে ব্যাবিলনের প্রকৃত রাজা হিসেবে অভিহিত করলেন। তিনি ব্যাবিলনের প্রাচীন ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিলেন। ততদিনে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা বিভিন্ন শাসকের নানামুখী শাসনব্যবস্থায় শশব্যস্ত ব্যাবিলনীয়রা বুঝতেই পারছিলেন না তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য ঠিক কী ছিল। তেমন প্রতিবাদ না করে তারা সারগনকে ‘চালদিয়ান হানাদারদের বিতাড়নকারী’ সর্বেসর্বা হিসেবে মেনে নিলেন।

এ পর্যায়ে এসে, সারগন ইসরায়েলের প্রতি যে-ধরনের আচরণ দেখিয়ে এসেছেন, সে তুলনায় চালদিয়ান বংশোদ্ভূত রাজার প্রতি তার আচরণ খুবই সাংঘর্ষিক। মেরোদাক-বালাদানের শিরশ্ছেদ না করে তিনি তার আত্মসমর্পণ মেনে নিলেন এবং তাকে বিট-ইয়াকিনের প্রতিনিধি-রাজা হিসেবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। পরবর্তীতে তার এই সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয়। অনুমান করা যায়, সারগন দ্বিতীয় পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না যে ইসরায়েলিদের মতো চালদিয়ানদেরও এত সহজে পরাভূত করা যাবে। এ-কারণে তিনি তার তথাকথিত রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলের শেষ প্রান্তটুকুর বিশ্বস্ততার পরীক্ষা নিলেন না। মেরোদাক- বালাদান যথেষ্ট ভয় পেয়েছে ধরে নিয়ে তিনি নিজ রাজধানীতে ফিরে গেলেন।

দক্ষিণে নামকাওয়াস্তে উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও সারগন তার সব শত্রুর বিরুদ্ধে নিরঙ্কুশ বিজয় উদযাপনের জন্য জাঁকজমকের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। সারগন শহরে তার নব্যনির্মিত প্রাসাদের দেয়ালে বড় বড় ছবিতে তার মহানুভবতা ও বীরত্বের নিশানা দেখানো হল। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সারগন, এই একীভূত রাজত্বের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন নতুন সীমানা, নতুন রাজধানী ও সদ্যপ্রাপ্ত বিপুল ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যাসিরীয়ার দ্বিতীয় পর্বের অধিপতি ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *