1 of 2

৫০. পুরনো শত্রুরা

অধ্যায় ৫০ – পুরনো শত্রুরা

৭৮৩ থেকে ৭২৭ সালের মাঝে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হয়। কিন্তু আবারও তিগলাথ-পিলেসার তৃতীয় একে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে।

৭৮৩ সালে শালমানেসার চতুর্থ অ্যাসিরীয়ার সিংহাসনে বসেন এবং ৯ বছর শাসন করেন। প্রথাগত অ্যাসিরীয় চরিত্রের বাইরে যেয়ে তিনি খুব স্বল্প পরিমাণে গর্ব ও অহংকার প্রদর্শন করেন। অল্প কিছু শিলালিপিতে রক্ষণাত্মক ভাষায় লেখা বিজয়গাথার উল্লেখ রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, তিনি তার শাসনামলের বেশিরভাগ সময়টি পার করেছেন অ্যাসিরীয়া থেকে হামলাকারীদের দূরে রাখার কাজে। সেসময় আরামিয়ানদের একটি রাজ্যের রাজধানী ছিল দামাসকাস, যেটি ‘সিরিয়া’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। সিরিয়ানরা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, তারা অ্যাসিরীয়ার সীমান্তে হামলা চালাতেন। সিরিয়ানদের সঙ্গে এক চূড়ান্ত লড়াইয়ে শালমানেসার চতুর্থ বাধ্য হয়ে ইসরায়েলের রাজা জেরোবোয়াম দ্বিতীয়র সঙ্গে মিত্রতা তৈরি করতে বাধ্য হন।

উত্তরে তিনি নতুন এক ঝামেলার মুখে পড়লেন। অ্যাসিরীয়ার পর্বতের উপরদিক থেকে হুরিয়ান জাতির মানুষরা তার জন্য মাথাব্যথার কারণ হলেন। এই হুরিয়ানরা এককালে মিটান্নি সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। তারা ছোট ছোট উপজাতীয় রাজত্ব তৈরি করেছিল। মিটান্নি সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে অ্যাসিরীয়রা হুরিয়ানদের ওপর সমানে লুটপাট চালিয়ে গেছেন। তাদের কাছে অনুন্নত জাতি হুরিয়ানরা ছিল ধাতু, কাঠ ও দাসের সহজ উৎস। কয়েক শতাব্দী আগে শালমানেসার প্রথম তাদের ৫১টি উপনিবেশে হামলা চালিয়ে সম্পদ লুণ্ঠন ও তাদের তরুণদের অপহরণ করার দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘তাদের তরুণ ব্যক্তিদের আমি বেছে নিই এবং আমার সেবায় তাদেরকে নিয়োজিত করি।’

পাহাড়ের নিচের দিক থেকে আসা নিরন্তর হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষরা নিজেদের মধ্যে মৈত্রী তৈরি করতে বাধ্য হল। তারা শিলালিপি লেখার জন্য অ্যাসিরীয়দের লিপি ধার করে আনল। তাদের রাজারাও অ্যাসিরীয় রাজকীয় রীতিনীতি মেনে চলা শুরু করে। অর্থাৎ, তারা নিজেদের রাজত্বকে শত্রুরাজত্বের আদলে গড়ে তুলতে লাগল অ্যাসিরীয়রা তাদেরকে ‘উরারতু’ নাম দিলেন। এখনও এই নামের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় এই জাতির প্রাচীন আবাস, সেই ‘আরারাত পর্বতে’। অ্যাসিরীয় সেনাদলের কাছে উরারতুর সেনাবাহিনী কিছুই ছিল না। তবে অ্যাসিরীয়রা উরারতু পর্বতের প্রবেশপথগুলোকে সুরক্ষিত রাখা বিশাল আকৃতির দুর্গগুলোতে কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন করতে পারেনি।

৫০.১ অ্যাসিরীয়া ও তাদের প্রতিপক্ষরা

পশ্চিম ও উত্তরের ফ্রন্ট, উভয় যুদ্ধক্ষেত্রেই শালমানেসার চতুর্থ পর্যুদস্ত হলেন এবং ব্যাবিলনের কর্তৃত্ব হারালেন। এ ঘটনায় যারপরনাই বিব্রত হলেন তিনি। শহরটি অ্যাসিরীয় প্রশাসকের অধীনে বারবার আগ্রাসনের মুখোমুখি হচ্ছিল। চালদিয়ান সামন্তপ্রভুদের একটি দল শহরটির শাসনভার নেওয়ার জন্য মারামারি শুরু করলেন। ইতোমধ্যে প্রাণ নিয়ে পালালেন অ্যাসিরীয় প্রশাসক।

অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের অন্যান্য দূরদূরান্তের প্রদেশগুলোতে এই প্রশাসক বা গভর্নররা রাজাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো শাসন চালাতে লাগলেন। মারি শহরের গভর্নর কালেহ তার কাহিনিকারের বর্ণনায় নিজের মেয়াদের দিন-তারিখ লিখে গেছেন, কিন্তু সেখানে রাজার কোনো উল্লেখ নেই। শালমানেসার চতুর্থ’র সন্তানের আমলে একাধিক গভর্নর স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করেন, যার ফলে অ্যাসিরীয় সেনারা বাধ্য হয়ে সেসব শহরের উদ্দেশে রওনা হন। শালমানেসারের নাতি ক্ষমতায় আসতে আসতে উরারদের রাজা গর্বসহকারে ঘোষণা দেন, তিনি অ্যাসিরীয়া ভূখণ্ড দখল করে ফেলেছেন।

উরারতু তার শাসনাধীন অঞ্চল দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। এমনকি, এককালে অ্যাসিরীয়ার অংশ ছিল, এমন ভূখণ্ডও তিনি দখল করেন। তবে এই ভূখণ্ড আরও পশ্চিমে ছিল। এসব নতুন ভূমিতে সর্বোচ্চ চূড়াগুলোর উপর তারা দুর্গ বানিয়েছিল। তারা ছিলেন পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ। উচ্চভূমিতে দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকাতে না-পারা পর্যন্ত তারা খুশি হতেন না। ততদিনে হিট্টিটদের প্রাচীন ভূখণ্ডের বেশিরভাগ অংশই উরারদের দখলে চলে গেছে। উরারতুর রাজা সারদুরি প্রথম অ্যাসিরীয়দের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য পূর্বের মাদা ও পারসুয়া গোত্রের সঙ্গে জোট বাঁধার উদ্যোগ নিলেন।

তখন ক্ষমতায় ছিলেন শালমানেসার চতুর্থ’র নাতি আশুর-নিরারি পঞ্চম। এই জোটবদ্ধ শত্রুর বিরুদ্ধে খুব বেশিকিছু করার সামর্থ্য ছিল না তার, এবং স্বভাবতই তিনি ব্যর্থ হন। আসসুরের ভেতরের প্রাচীরগুলো ছিল শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ প্রতিরক্ষা। তার আমলে, অবহেলা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই প্রাচীর ধসে পড়তে শুরু করে। কোনো কর্মকর্তা, গভর্নর বা রাজা এই প্রাচীরের সংস্কার বা পুনর্নির্মাণের আদেশ দেননি। বরং প্রাচীর থেকে ভেঙে পড়া পাথর সংগ্রহ করে আসসুরের বাসিন্দারা নিজেদের ঘরবাড়ি তৈরি ও সেগুলোকে আরও শক্তিশালী করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

কালেহতে খুব সম্ভবত পরিস্থিতি কিছুটা ভালো ছিল। কালেহর গভর্নরের নাম ছিল পুল। তিনি তার শাসনামলের ৭ বছর পর রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেন।

পুল খুব সম্ভবত রাজার দূরসম্পর্কের চাচাতো বা মামাতো ভাই ছিলেন। এ কারণেই তাকে রাজকীয় শহরটির দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে আশুর-নিরারি পঞ্চম রক্তসম্পর্কের কারণে বিশেষ কোনো আনুগত্য আশা করে থাকলে সে আশায় গুড়ে বালি পড়ে। তার হিসাব ভুল হয় এবং পুল তার আত্মীয়র দুর্বলতার সুযোগ নেন। তিনি তার নিজস্ব সমর্থক ও আশুর-নিরারি পঞ্চমের যেসব সভাসদ তাকে পছন্দ করতেন না, তাদের সবার সহায়তায় তাকে ও তার পরিবারের সব সদস্যকে হত্যা করেন। তিনি ৭৪৬ সালের শুরুর দিকে সিংহাসন দখল করেন। সিংহাসনে বসে তিনি নতুন নাম নেন। তিনি এমন একটি নাম নেন, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অ্যাসিরীয়দের অসংখ্য গৌরবগাথা। তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে ‘তিগলাথ-পিলেসার’ নাম নিলেন তিনি।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাবিলনে একজন নতুন ও শক্তিশালী রাজা ক্ষমতা দখল করেছিলেন—নাবোনাসসার। একজন চালদিয়া হওয়া সত্ত্বেও নাবোনাসসার ব্যাবিলনের নিয়ন্ত্রণ নিলেন। তারপর তিনি সব বিদ্রোহ দমন করে বিভিন্ন শাসকের মধ্যে থাকা মতভেদের অবসান ঘটালেন। গ্রিকদের ঐতিহাসিক বচন মতে, নাবোনাসসারের নেতৃত্বে ব্যাবিলন বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং এসময় জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি দেখা যায়।

গ্রিকরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের উদ্ভাবক হিসেবে চালদিয়ানদের ব্যাপারে এতটাই সুনিশ্চিত ছিলেন যে, তারা তাদের ভাষায় ‘জ্যোতির্বিদ’ ও ‘চালদিয়ান’ শব্দদুটিকে একই অর্থে ব্যবহার করতে লাগলেন। এই চর্চা প্রাচীন পৃথিবীতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণেই সম্ভবত দ্য বুক অব দানিয়েলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, প্রায় ২০০ বছর পর ব্যাবিলনের রাজা নেবুচাদনেজার দ্বিতীয়র যখন কোনো বিষয়ে উপদেশ প্রয়োজন হত, তখন তিনি তার রাজত্ব থেকে ‘চালদিয়ান’ ও আরও কিছু জ্ঞানী ব্যক্তিদের রাজসভায় আহ্বান করতেন।

তিগলাথ-পিলেসার তৃতীয় অনেক বছর সিংহাসনে থাকলে ব্যাবিলনের কাহিনিকাররা যুদ্ধ-বিগ্রহের বর্ণনার পরিবর্তে টেবিলের মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আহরণ করা জ্ঞান, প্রতিদিনের আবহাওয়ার বর্ণনা, তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর পানির মাত্রা, শস্য ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপকরণের দামের ওঠানামা—এসবের হিসেব রাখতেন। এ সবই একটি শান্তিপূর্ণ রাজ্যের ইঙ্গিত দেয়, এবং একইসঙ্গে আমরা এটাও জানতে পারি যে, এ শহরের বাসিন্দাদের হাতে নিজেদের উন্নয়ন করার দিকে মনোযোগ দেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় ছিল।

অ্যাসিরীয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরপরই তিগলাথ-পিলেসার তৃতীয় দক্ষিণে ব্যাবিলনের উদ্দেশে রওনা হলেন। তিনি নিজেকে নাবোবাসসারের মিত্র হিসেবে উপস্থাপন করলেন। ইতোমধ্যে তিনি উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে আসা শত্রুদের সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিলেন। দক্ষিণে আরেকটি প্রতাপশালী শত্রু তৈরি করার কোনো ইচ্ছাই তার ছিল না।

তিগলাথ-পিলেসার তৃতীয়র প্রস্তাব মেনে নিলেন নাবোনাসসার। ব্যাবিলনের নতুন রাজাকে বিদ্রোহী চালদিয়ান ও আরামিয়ানদের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য তিগলাথ-পিলেসার তৃতীয় অ্যাসিরীয় সেনা পাঠালেন।

কিন্তু চালদিয়ান ও আরামিয়ান নেতারা তিগলাথ-পিলেসারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করলেন; তাকেই পাঠাতে লাগলেন উপঢৌকন—নাবোনাসসারকে নয়। তিগলাথ-পিলেসার তার নিজের কাহিনিকারের বর্ণনায় গর্ব সহকারে বলেন, “আমি ব্যাবিলনীয়ার নিম্ন সাগরের উপকূলীয় শহরগুলোকে আমার ভূখণ্ডের অংশ করে নিলাম। এগুলো অ্যাসিরীয়ার অংশ হল। আমি আমার নিজস্ব খোঁজা গভর্নরকে সেখানে শাসক হিসেবে পাঠালাম।”

ব্যাবিলনের উত্তরে আরামিয়ানদের দমন করার পর সেখানে তিগলাথ- পিলেসার তৃতীয় ‘কার আসসুর’ (আসসুরের প্রাচীর) নামে নতুন এক শহর তৈরি করলেন। বস্তুত, এ শহরটি ছিল যেসব যাযাবর ব্যাবিলনে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তাদেরকে ঠেকানোর জন্য নির্মিত শহর। কিন্তু বাস্তবতা হল, এটি ব্যাবিলনীয়ায় অ্যাসিরীয়দের ঘাঁটিতে রূপান্তরিত হল। এই শহর চালাতেন অ্যাসিরীয় কর্মকর্তারা, এর সুরক্ষা দিতেন অ্যাসিরীয় সেনা এবং এখানে বসবাসও করতেন অ্যাসিরীয় নাগরিকরা। তিগলাথ-পিলেসারের বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘আমি একে কার আসসুর নাম দিই। আমি সেখানে বিদেশি ভূখণ্ডের লোকদের স্থান দিই, যারা আমার বশ্যতা স্বীকার করেছে। আমি তাদের কাছ থেকে উপঢৌকন সংগ্রহ করি এবং তাদেরকে অ্যাসিরীয়ার বাসিন্দা হিসেবে বিবেচনা করি।’ এরপর তিগলাথ-পিলেসার তৃতীয় দেশে ফিরে নিজেকে (এর আগে শামসি-আদাদ পঞ্চমও একই কাজ করেছিলেন) ‘সুমের ও আক্কাদের রাজা’ হিসেবে ঘোষণা দেন।

অপরদিকে, দক্ষিণাঞ্চলের নাবোনাসসার চুপচাপ ছিলেন। যতক্ষণ অ্যাসিরীয় রাজা তাকে বিরক্ত না করে নিজের দেশ শাসন করতে দিচ্ছিলেন, ততক্ষণ অন্যেরা কী কী খেতাব গ্রহণ করল বা কী নিয়ে গর্ব করতে লাগল, সে বিষয়গুলো নিয়ে তিনি একেবারেই মাথা ঘামাচ্ছিলেন না। তিগলাথ-পিলেসার তৃতীয়, অপরদিকে নাবোনাসসারের ব্যাবিলনের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি নিয়েও চিন্তিত ছিলেন না। তার অন্য জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। তিনি চেয়েছিলেন দূরবর্তী প্রদেশগুলোতে বিদ্রোহী গভর্নরদের হটিয়ে নিজের লোক বসানো। নতুন এই গভর্নরদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল তার কাছে নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠানো। তিনি এই কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য ঘোড়সওয়ারদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন, যাতে দ্রুত এসব প্রতিবেদন রাজপ্রাসাদে পৌঁছায়।

নিজের দেশকে একধরনের নিয়ম-নীতির মাঝে আনতে পেরে তিনি উত্তরের দিকে মনোযোগ সরালেন। ঐদিকে এককালে অ্যাসিরীয়ার অংশ ছিল এরকম কিছু প্রদেশে ঘাঁটি গেড়েছিল উরারতুরা। তারা দক্ষিণ-পশ্চিমের কারচেমিশ পর্যন্ত নিজেদের প্রভাব ছড়াতে সক্ষম হয়েছিল। দক্ষিণের শহর আরভাদ চুক্তিমতে অ্যাসিরীয়ার মিত্র ছিল। কিন্তু তারাও উরারতুর সঙ্গে যোগ দেয়।

তিগলাথ-পিলেসার এই শহরে হামলা চালালেন। দীর্ঘদিন ধরে চলা সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অনেক মানুষ হতাহত হলেন। দুই বছরের প্রাণান্তকর এই যুদ্ধের পর অবশেষে আরভাদের পতন হল।

তিগলাথ-পিলেসারের নথি থেকে আমরা জানতে পারি, তিনি ৭৪০ সালের পুরোটা সময় আরভাদে বসবাস করেন। এই দখলীকৃত শহরটিকে তিনি উরারতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সামরিক সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করেন। খুব অল্প সময়ের মাঝে তিনি কিউ ও কারচেমিশকে উরারতুর দখল থেকে ছিনিয়ে নেন।

৭৩৫ সাল নাগাদ অ্যাসিরীয়রা উরারতুর একেবারে কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে যান। বাধ্য হয়ে রাজা সারদুরি প্রথম ও তার বাহিনী আরও উত্তরে, রাজধানীর দিকে সরে যান। তিগলাথ-পিলেসারের দাবি, ‘আমি তাদের মরদেহ দিয়ে পাহাড়ের প্রতিটি গিরিসংকট ও চূড়া ঢেকে দিয়েছিলাম।

তিগলাথ-পিলেসার তৃতীয় আরও জানান, ‘নিজের জীবন বাঁচাতে সারাদুরি রাতের আঁধারে পালিয়ে গেল এবং তাকে আর কখনো দেখা গেল না। ইউফ্রেতিসের ওপর নির্মিত সেতু ধরে, তার নিজ রাজত্বের সীমান্ত পর্যন্ত আমি তাকে ধাওয়া করলাম।’

সেখানেই থামলেন তিনি। সারদুরি পরবর্তীতে নিজের আখের গুছিয়ে নিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট, কিন্তু স্বাধীন একটি উরারতু শাসন করতে লাগলেন। এই অঞ্চলটি একসময় তার মূল রাজত্বের উত্তর-অংশ ছিল। দক্ষিণের অংশটি অ্যাসিরীয়ার দখলে রইল।

বস্তুত তিগলাথ-পিলেসার নামধারী তৃতীয় রাজা সমগ্র অঞ্চলের মানচিত্রকে নতুন করে তৈরি করলেন। তার এই রাজত্বকে নতুন একটি দেশ বলাই শ্রেয়। তার নতুন প্রদেশের অংশ হল পূর্বাঞ্চলের ফ্রিজিয়ান গোত্র, যারা এশিয়া মাইনরের কেন্দ্রে বসবাস করছিল। পূর্বের এই শত্রুর মোকাবিলায় পশ্চিমের গোত্রগুলো জোট বাঁধল। তারা ফ্রিজিয়ান রাজত্বে একত্র হল। এভাবে তিগলাথ-পিলেসার নতুন একটি রাষ্ট্র তৈরি করলেন, যার প্রথম প্রকৃত রাজার অস্তিত্ব মূলত মহাকাব্যগুলোতেই শুধু পাওয়া যায়। তার নাম মাইডাস।

মাইডাস যিনিই হন না কেন, তার সিংহাসনে উত্তরণের গল্পটি পৌরাণিক কাহিনিতে প্রবেশ করে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সময়কালে—আলোচ্য সময়সীমা থেকে যা আরও ৪০০ বছর পরের ঘটনা। ফ্রিজিয়ায় এসে আলেকজান্ডার একটি প্রাচীন ঘোড়ায়-টানা গাড়ির দেখা পেলেন। তাকে জানানো হয়, এই ‘ওয়াগনের’ মালিক ছিলেন ফ্রিজিয়ার প্রথম রাজা। ফ্রিজিয়ার মানুষদের তখন কোনো রাজা ছিল না। তারা একজন ভবিষ্যদ্বক্তা ওরাকলের কাছে এসে জানতে চাইলেন, দেশটির রাজা কার হওয়া উচিত। ওরাকল উত্তর দিলেন, প্রথম যে ব্যক্তিটি ওয়াগন চালিয়ে সেখানে এসে পৌঁছবেন, তিনিই স্বর্গের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হবেন। খুব শিগগির মাইডাস নামের একজন চাষিকে দেখা গেল এই ওয়াগনটি চালিয়ে এগিয়ে আসতে। তৎক্ষণাৎ তাকে রাজা বানানো হল। কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে তিনি তার সেই ওয়াগনটিকে জিউসের উদ্দেশে উৎসর্গ করলেন।

হেরোডোটাসের বর্ণনা অনুযায়ী, মাইডাস ডেলফির ওরাকলের কাছে উপঢৌকন পাঠান। এর আগে পর্যন্ত গ্রিক নন এরকম কেউ কখনো তাকে উপঢৌকন পাঠাননি।

অন্যান্য কালজয়ী ঘটনা মতে, সাইম থেকে একজন গ্রিক নারীকে নিয়ে এসেছিলেন মাইডাস।

এই দুইটি গল্প থেকে একটি বিষয় উন্মোচিত হয়, সেটা হচ্ছে, ফ্রিজিয়ানরা ততদিনে রাজা মাইডাসের অধীনে একটি সুশৃঙ্খল জাতি হিসেবে বসবাস করছিল। তাদের রাজধানীর নামও ছিল মাইডাস (বস্তুত, মাইডাস একটি প্রথাগত রাজকীয় উপাধিতে পরিণত হয়)। এছাড়াও, তারা এশিয়া মাইনরের উপকূলের আইওনিয়ান শহরগুলোর সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে বাণিজ্য শুরু করে।

এই বাণিজ্যিক কার্যক্রম খুব অল্প সময়ের মাঝে ফ্রিজিয়াকে একটি ধনী রাষ্ট্রে পরিণত করে। মাইডাসের নাম আমরা শুনেছি মূলত সেই গল্প থেকে, যেখানে বলা হয়েছে, তার স্বর্ণালি ও জাদুকরি ছোঁয়ায় সবকিছু স্বর্ণে পরিণত হয়। এই গল্পের মাঝে অন্তর্নিহিত আছে আইওনিয়ান বণিকদের ফ্রিজিয়ান রাজাদের ধনসম্পদ নিয়ে মুগ্ধতা ও ঈর্ষার ছাপ। গল্পের দুঃখজনক অংশে তার এই ক্ষমতা একই সঙ্গে আশীর্বাদ ও অভিশাপ হিসেবে আবির্ভূত হয় (মাইডাসের হাতের ছোঁয়া লেগে তার নিজের মেয়েও স্বর্ণে রূপান্তরিত হয়)।

ফ্রিজিয়ার প্রবৃদ্ধি হতে লাগল। আর অপরদিকে, তিগলাথ-পিলেসার তার পুরনো শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়তে লাগলেন। তিনি পূর্বাঞ্চলে সেনা অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহী পারসুয়া ও মাদা শহর আবারও দখল করে নিলেন। এসব বিজয়ের পর তিনি বিপদসংকুল পশ্চিমের দিকে নজর দিলেন।

যখন ইসরায়েলের রাজা মেনাহেম টের পেলেন অ্যাসিরীয় সেনারা তার দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে, তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি না নিয়ে শত্রুর কাছে ৪০ টন রুপা পাঠালেন। উদ্দেশ্য, তাদের কিনে নেওয়া।

জুদাহ আরও বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করলেন। তৎকালীন ডেভিড-বংশের রাজা আহাজ প্রথমে সলোমনের মন্দিরে লুটতরাজ চালালেন। তারপর সেখান থেকে পাওয়া সব পবিত্র উপকরণ তিগলাথ-পিলেসারের কাছে পাঠিয়ে তার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিলেন। এরপর তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই এ অ্যাসিরীয়ার মিত্র হওয়ার প্রস্তাব দিলেন।

এরপর শুরু হল যুদ্ধ। ইসরায়েলের উত্তর অংশের বেশিরভাগ ভূখণ্ড অ্যাসিরীয়ার কাছে চলে গেল। তিগলাথ-পিলেসার সিরিয়ার দখল নিলেন। ইসরায়েল ও জুদাহও তার নিয়ন্ত্রণে রইল। ঝামেলাপূর্ণ পশ্চিমে আর কোনো ঝামেলা রইল না।

এ যাবৎ তিগলাথ-পিলেসার ব্যাবিলনের প্রতি ন্যূনতম পর্যায়ের মনোযোগও দেননি। কিন্তু ততদিনে প্রতিবেশী দেশটির রাজা নাবোনাসসারের মৃত্যু হয়েছে এবং শহরটি গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। তিগলাথ-পিলেসার মাত্রই দামাসকাসের বিরুদ্ধে অভিযান শেষ করেছেন। তিনি ব্যাবিলনের করুণ অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারলেন, এবং সিদ্ধান্ত নিলেন এই প্রাচীন রাজত্বকে নিজের করে নেবেন।

তিগলাথ-পিলেসার ব্যাবিলনের উত্তর সীমানা পার হলেন এবং তাইগ্রিস নদীর তীর ধরে রাজধানীর উদ্দেশে আগাতে লাগলেন। এ পর্যায়ে দেশবাসী দুই ভাগে বিভক্ত হল।

ব্যাবিলনের শহরগুলো নিজেদের মাঝে বিবাদে জড়িয়ে পড়ল। এক দল প্রস্তাব দিলেন, অ্যাসিরীয় সম্রাটের পদতলে নিজেদের ছুড়ে দেওয়ার—তাতে ধনসম্পদ ও মানসম্মান গেলেও পৈতৃক প্রাণ অন্তত বাঁচবে। কিন্তু আরেকদল স্বাধীনতার জন্য তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার অর্থহীন ও অসম্ভব সংকল্পে অটুট থাকতে চাইলেন। ব্যাবিলনের উত্তরের শহরগুলো অ্যাসিরীয়াপন্থী হিসেবে আবির্ভূত হল। এই শহরগুলো অ্যাসিরীয়ার দক্ষিণ সীমান্ত সংলগ্ন ছিল। স্বভাবতই তাদের মাঝে অ্যাসিরীয়ার প্রভাব বেশি ছিল। তবে এক্ষেত্রে যে-বিষয়টি প্রকাশ পায় তা হল, এ অঞ্চলের মানুষরা তাদের সিংহাসনের দখলের জন্য হামলা চালাতে থাকা সেমিটিক চালদিয়ানদের তুলনায় অ্যাসিরীয় শাসক, তাদের রীতিনীতি ও দেবদেবীদের প্রতি বেশি অনুরক্ত ছিল।

এ ব্যাপারটা সম্পর্কে জানতে পেরে তিগলাথ-পিলেসার এক অগ্রবর্তী দল হিসেবে কিছু কর্মকর্তাকে ব্যাবিলনে পাঠালেন। তাদের ওপর নির্দেশ ছিল, ব্যাবিলনের নাগরিকদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের আনুগত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। তারা তাদের প্রতিবেদনগুলো খুব শিগগির তিগলাথ-পিলেসারের কাছে পাঠালেন। এই চিঠিগুলো ১৯৫২ সালে আবিষ্কৃত হয়।

“হে আমার রাজা, আমার প্রভুর প্রতি এই চিঠি, আপনার ভৃত্য সামা বুনাইয়া ও নাবুইএটের পক্ষ থেকে। আমরা ২৮ তারিখে ব্যাবিলনে এসে পৌঁছাই এবং মারদুক ফটকের সামনে অবস্থান নিই। আমরা ব্যাবিলনীয়দের সঙ্গে কথা বলেছি এবং জানিয়েছি, ‘কেন তোমরা চালদিয়ানদের পক্ষে যেয়ে আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছ?’ তাদের জায়গা তাদের নিজ চালদিয়ান গোত্রের সদস্যদের মাঝে। ব্যাবিলন, চালদিয়ানদের প্রতি অনুরাগ দেখাচ্ছে (এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার)! আমাদের রাজা ব্যাবিলনের নাগরিক হিসেবে আপনাদের অধিকার সম্পর্কে অবগত আছেন।

নাগরিকরা বলে উঠলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস হয় না যে রাজা নিজে এখানে আসবেন।’ কিন্তু তারা কথা দিলেন, যদি রাজা নিজে আসেন, তাহলে নাগরিকরা সবাই তার বশ্যতা স্বীকার করে নেবেন।

সামাস-বুনাইয়া ও নাবুইএটের খুব সুন্দর করে ব্যাবিলনীয়দের বোঝাতে পেরেছিলেন যে তাদের উচিত উন্নত গোত্র অ্যাসিরীয়ার সঙ্গে থাকা, চালদিয়ানদের সঙ্গে অন্য।

ব্যাবিলনের সিংহাসন দখল করে রাখা চালদিয়ান সামন্তপ্রভু পালিয়ে গেলেন। তিগলাথ-পিলেসার শহরের ভেতর দিয়ে প্রবল বেগে এগিয়ে আরও দক্ষিণের শহর সাপিয়াতে এসে পৌঁছালেন। সেখানে সেই চালদিয়ান গোত্রপ্রধান লুকিয়ে ছিলেন। এই শহরের ছিল ৩টি প্রাচীর। একটি ১৫ ফুট উঁচু এবং অপর দুটি আরও উঁচুতে অবস্থিত ছিল। অ্যাসিরীয় কাহিনিকারদের লেখায় এই যুদ্ধের যে বর্ণনা আছে, তার সঙ্গে টোলকিয়েনের লর্ড অব দ্যা রিংস-এর হেল্মস ডিপের যুদ্ধের কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে ফলাফল পুরো উল্টো; হামলাকারীরা প্রতিরোধকারী বাহিনীকে পরাস্ত করে।

উঁচু প্রাচীরের উপরে বসে থাকা তিরন্দাজরা অ্যাসিরীয় বাহিনীকে তিরের আঘাতে বেশ যন্ত্রণা দিতে পারলেও তারা অ্যাসিরীয় মুহুর্মুহু হামলার মুখে টিকতে পারেনি। তাদের মরদেহগুলো শহরের চারপাশ দিয়ে বয়ে চলা নালার উপর স্তূপ করে রাখা হয়। ক্রন্দনরত নারী ও শিশুদের ধরে নিয়ে নির্বাসনে পাঠানো হয়।

তিগলাথ-পিলেসার এরপর বীরদর্পে, বিজয়ীর বেশে ব্যাবিলনে প্রবেশ করলেন। তিনি নিজেকে রাজা হিসেবে ঘোষণা দিলেন এবং ব্যাবিলনের মহান দেবতা মারদুকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। সময়টা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৭২৮ সাল—নতুন বছর উদ্যাপনের উৎসবের সময়।

চালদিয়ানরা সাপিয়ার পতনে যারপরনাই ভীত হয়ে পড়েছিল। দ্রুতগতিতে তারা ব্যাবিলনে এসে নতুন রাজাকে সম্মান জানালেন।

তাদের মাঝে ছিলেন একজন স্থানীয় গোত্রপ্রধান, যার নাম মেরোদাক- বালাদান। তার বিষয়ে তিগলাথ-পিলেসার আলাদা করে উল্লেখ করেন, তিনি ছিলেন, ‘সমুদ্রবেষ্টিত ভূখণ্ডের রাজা, যিনি কোনো রাজা, এমনকি আমার পিতার কাছেও বশ্যতা স্বীকার করেননি এবং তাদের পায়ে চুমু খাননি।’

তবে এবার তিনিও আনুগত্য প্রকাশ করলেন। উপঢৌকন হিসেবে নিয়ে এলেন দারুণ সব উপহার, যেমন স্বর্ণের নেকলেস, দামি পাথর, দামি কাঠের গুঁড়ি, রঙিন কাপড় ও গবাদি পশু।

মুখে মেরোদাক-বালাদান অ্যাসিরীয়ার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলেও তার মনে ছিল অন্য কথা। তবে তখনো তিগলাথ-পিলেসারের একথা জানার কোনো উপায় ছিল না।

তিনি তখন আনন্দ-উল্লাসের চরম শিখরে পৌঁছে গেছেন। একইসঙ্গে ব্যাবিলন ও অ্যাসিরীয়ার রাজা হয়ে তিনি প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে নতুন করে পাওয়া ক্ষমতা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করলেন। সিপ্পার, নিপপুর, ব্যাবিলন, বরসিপ্পা, কুথা, কিশ, দিলবাত ও এরেখ শহরে তিনি বড় আকারে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তিনি বলেন, ‘আমি মহান দেবতাদের উদ্দেশে খাঁটি উৎসর্গ অর্পণ করলাম। তারা আমার এই উৎসর্গ মেনে নিলেন। এই বিস্তৃত (ব্যাবিলনের) ভূখণ্ডকে আমি নিজের দখলে নিয়েছি এবং এর ওপর নিজের সার্বভৌমত্ব ছড়িয়ে দিয়েছি।’

তিনিই ছিলেন প্রথম অ্যাসিরীয় শাসক, যিনি ব্যাবিলনের রাজার তালিকার অংশ হতে পেরেছিলেন। ব্যাবিলনীয়রা তাকেই প্রথম বহিরাগত হিসেবে নিজেদের শাসকের স্বীকৃতি দেন।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ব্যাবিলন কিংবা অ্যাসিরীয়া—এই দুই দেশের কোনোটির ওপরই তার কোনো বৈধ দাবি ছিল না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *