৪. বেলা দশটার রোদ

বাইরে বেলা দশটার রোদ।

অতনুর বৌদি বললেন, কি গো ঠাকুরপো, আজ আর উঠবে না, চা-টা খাবে না নাকি?

এই যে উঠি। শরীরটা তেমন

অবনী ওদিক থেকে শুনতে পেয়ে বলে ওঠে, শরীর ভাল নেই, তা হলেই তো মুশকিল। আজ আবার ট্রেনে যাবে। ওদিকে আবার জগন্ময়বাবু এসে।

হ্যাঁ, সামনে কাকাবাবু আড়ালে জগন্ময়বাবু!

অতনু বেরিয়ে এল। কিছু প্রশ্ন করল না।

অবনীই আবার বলল, বলে গেলেন ওঁরা সবাই অফিসে বেরোচ্ছেন, কারুর ছুটি নেই। দীপু ছেলেমানুষ, তুমি একবার গিয়ে যেন ওঁর মেয়ের খোঁজ টোজ নাও। ডাক্তার হওয়ার জ্বালা। কর্তব্যের পরিধি বেড়েই চলে। কিন্তু হল কি মেয়েটার?

কি জানি। শেষ পর্যন্ত কি যে দাঁড়ায় বলা শক্ত!

অতনুর বৌদি বলে ওঠেন, আমার তো মনে হচ্ছে ওর আবার বিয়েথাওয়া দিলে রোগ সেরে যায়।

অতনু ঘুরে দাঁড়িয়ে একবার ওঁর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে, আপনি কেন ডাক্তার হলেন না তাই ভাবছি। দেশের একটা মস্ত বড় লোকসান!

.

আজ শুধু মা!

আজ সমস্ত সংসারের উপর শান্তিবারি। আজ সারা বাড়িতে পবিত্রতার হাওয়া। আজ পাগলী নীচে নেমে এসেছে। খুঁজছে মাকে।

আমার মা কই গো? আমার মাকে খুঁজে পাচ্ছি না।

শোনো কথা। এই তো তোর মা। সেজখুড়ি চিনিয়ে দেয়।

হ্যাঁ-হ্যাঁ, ওই তো আমার মা!

অমিতা ধুলোর ওপর বসে পড়ে ভাড়ার ঘরের মেজেয়। সামনে পড়ে থাকা তরকারির ঝুড়ি থেকে একটা বেগুন তুলে নিয়ে সেটা লোফালুফি করতে করতে বলে, আমার মা চা খেয়েছে?

জয়াবতী কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন, খেয়েছি মা। বুকের আগুনের জ্বালায় তো পেটের আগুনের জ্বালা চাপা পড়ে না। বুঝি-বা দ্বিগুণ বেড়ে ওঠে।

সেজগিন্নী অমায়িক মুখে বলেন, তবু বলব দিদি, তোমার ভাগ্যকে হিংসে না করে থাকা যায় না। তোমার পাগলছাগল মেয়ে, তাও ধড়ফড়িয়ে নেমে আসে মায়ের খাওয়া হল কিনা খোঁজ করতে। হাতের কাছে খাবার দেখতে পেলে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় থালা বোঝাই করে। আর আমার মাথাবুদ্ধিওলা মেয়ে, মা খেলো কি না খেলো, মরল কি বাঁচল, খোঁজও করে না।

জয়াবতী আহত স্বরে বলেন, আমার মেয়ে চিরদিন পাগল ছাগল ছিল না সেজবৌ! দুদিন আগেও সমগ্ৰ সংসার মাথায় করে বেড়িয়েছে।

আহা, সে আর কে অস্বীকার করেছে? এখনকার কথাই বলছি।

অমিতার দিকে আড়নজরে তাকিয়ে দেখেন ওঁরা, আজ কি একটু ভাল? একটু একটু করে কি ভাল হয়ে যাচ্ছে? এই ভাবেই সহজ হয়ে যাবে?

সেজখুড়ি স্নেহঢালা গলায় বলেন, কিছু খাবি রে অমিতা? খেতে ইচ্ছে করছে কিছু?

 অমিতা আস্তে মাথা নাড়ে।

 আহা না খেয়েই তো কাটছে। কত খিদে পেয়েছে বেচারার! কী খাবি বল?

অমিতা গম্ভীর ভাবে একটু এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলে, দেশলাই।

দেশলাই! দেশলাই খেতে চাইছে।

আর জয়াবতী কিনা আশায় বুক বাঁধছেন সেরে উঠছে বলে?

দেশলাই কি খাবার জিনিস অমি? সেজখুড়ি আবার মুক্তা অন্বেষণে রহস্যের সমুদ্রে ডুবুরি নামান, দেশলাই কেউ খায়?

খায় না? ও! তাহলে বালতি খাবো।

 জয়াবতী ডুকরে কেঁদে ওঠেন, অমি, আমি যে বড় আশা করছিলাম তুই সেরে উঠছিস।

কান্নার স্বরে আকৃষ্ট হয়ে না আসে, কি হল? আবার কি হল আপনার দিদি? তার কণ্ঠে বিরক্তি।

মেয়েটা খেতে চাইছে, তাই মা কাঁদছে। অমিতা ঘটনাটা বোঝায় প্রশ্নকারিণীকে।

 নন্দা শান্তভাবে বলে, কী খেতে চাইছে মেয়েটা?

অমিতা অম্লান বদনে বলে, বেগুনভাজা!

ও আমার কপাল, তুই কি বেগুনভাজা খেতে চেয়েছিলি? জয়াবতী ছোট জার কাছে হৃদয় জ্বালা ব্যক্ত করেন, জানো ছোট বৌ, বলে কি না দেশলাই খাবো, বালতি খাবো?

বেশ করেছে বলেছে! বাড়িসুদ্ধ সকলে মিলে ওর মুণ্ডু খাওয়া হয়েছে, ও আর এখন ও ছাড়া কি চাইবে? বলে গলাটা খাটো করে বলে, আপনাদের কথাবার্তাগুলো আর একটু বুদ্ধিমানের মত হওয়া উচিত। সব কিছুই খুঁচিয়ে তুললে বাড়ে, এ জ্ঞানটুকু অন্তত থাকলে ভাল হয়।

স্নেহময়ী সেজখুড়ি ততক্ষণে তৎপর হয়ে অমিতার হাতের বেগুনটা নিয়ে চারখানা করে কুটে হাঁক দেন, বামুনদি, এই বেগুন কখানা নিয়ে যাও তো, চট করে ভেজে দাও।

বলাবাহুল্য বামুনদির রান্নাঘরে অমিতার আহার নিষেধ। মহারাজজীর চরণে আত্মনিবেদিত এই সংসারটিতে অনাচার প্রবেশের ছিদ্রপথ নেই। এ যুগের মত বিধবার খাওয়ায় এলোমেলো ঘটে নি এখনো।

কিন্তু এখন যে সেজগিন্নী বামুনদিকে ডাকলেন, সে কি আচার আচরণ ভুলে গেছেন বলে? না কি মনে করলেন আর অমিতার বিচার কি? সমস্ত বিচার বিবেচনাই যখন হারিয়ে ফেলেছে।

জয়াবতী কান্না ভুলে তাড়াতাড়ি বলেন, বামুনদি আবার কোন্ হেঁসেলে

কিন্তু এ দুর্ভাবনার নিরাকরণ স্বয়ং অমিতাই করে দেয়। হঠাৎ ওগো বাবাগো! আমাকে বিষ খাওয়াচ্ছে, বলেই বেদম ছুট মারে অমিতা।

ভেতরে জ্ঞান আছে–সেজগিন্নী মন্তব্য করেন, বামুনদির হেঁসেলে খেতে নেই। তা বোধ রয়েছে।

তা রয়েছে। নন্দা ভুরু কুঁচকে বলে, পাগলের মধ্যেও ছিটেফোঁটা বোধ থাকে। থাকে না শুধু সহজদের।

সব সময় তুমি অমন হুল ফুটিয়ে কথা কও কেন বল তো ছোট বৌ? সেজগিন্নী তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠেন।

নন্দা কিন্তু নির্বিকার। হেসে উঠে বলে, পরীক্ষা করে দেখি, চামড়াটা কত মোটা।

হ্যাঁ, এমনি করেই প্রবাহিত হয়ে চলে একান্নবর্তীত্বের মাহাত্ম্যধারা। জগন্ময়ের সংসার পাড়ার লোকের দৃষ্টান্তস্থল।

.

ছোট ছেলেটার ভিজে মাথাটা ভাল করে মুছিয়ে দিচ্ছিলেন জয়াবতী। নিজে নাইতে পারে, নিজে মাথা ভাল করে মুছতে পারে না। এ যাবৎ ও ভারটা অমিতারই ছিল, আজ দুদিন পরে জয়াবতীর খেয়াল হয়েছে। টেনে ধরে মাথা মোছাচ্ছেন ঘষে ঘষে।

ছেলেটা বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, আঃ লাগছে যে!

লাগছে কি আবার! ভিজে মাথায় থাকলে অসুখ করবে না?

ছোড়দি তো লাগিয়ে দেয় না!

আর ছোড়দির কথা বলে কি হবে? ছোড়দি তো আমার মাথায় মুগুর মারলো।

মুগুর মারলো! ছেলেটা চমকে মায়ের মাথার দিকে তাকায়।

কি জানি হবেও বা। পাগলরা তো মানুষকে মারে ধরে! কিন্তু ছোড়দি কেন পাগল হল? সে তো রাস্তার ভিখিরিরা হয়।

জয়াবতী দুঃখের মধ্যেও দুঃখের হাসি হেসে বলেন, হাতে করে কি আর মারল? এই যে অসুখ করল এইটাই আমার পক্ষে মার।

ছেলেটা ম্লানভাবে বলে, ছোড়দি আর ভাল হবে না? পাগলই থেকে যাবে?

ভগবান জানেন। ভরসা তো দেখছি না।

তা হলে আমাদের কে পড়াবে?

আবার অন্য ব্যবস্থা দেখতে হবে, আত্মবিস্মৃত জয়াবতী আক্ষেপ ব্যক্ত করেন, মনে করেছিলাম, যা হল তা হল, তবু সংসারটার একটা সুব্যবস্থা হল। আমারও একটু গতরের আসান হচ্ছে, ওঁরও পয়সার দিকে সহসা বোধ করি চৈতন্য ফেরে জয়াবতীর। চুপ করে যান। আর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখেন কেউ শুনতে পেল কিনা।

কিন্তু শুনতে একজন পায়, সে নতুন বৌ রমলা। কি জন্যে সে এদিকে এসেছিল কে জানে।

 মিনিট খানেক সে বোধ করি পাথরের পুতুলের মতই দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর আস্তে কাছে এসে বলে, তিলককে পড়াতে আমিও তো পারি মা!

হঠাৎ জয়াবতীর যেন ব্রহ্মারন্ধ্রে জ্বালা ধরে যায়। ওঃ, সহৃদয় প্রস্তাব জানাতে এসেছেন। তার মানে আগাগোড়া কথা শুনেছেন। বৌয়ের উপর জয়াবতী আদৌ প্রসন্ন হতে পারেন নি। একে তো তার এক-ফোঁট্টা ছেলের হঠাৎ প্রেমের নায়ক হয়ে ওঠার আগাগোড়া দোষ সেই তার নায়িকাটির উপরই চাপিয়ে রেখেছিলেন, তার উপর বৌ আসতে না আসতেই এই দুর্বিপাক। বৌয়ের বাপের বাড়ি থেকেই কেউ কিছু করে দিল কিনা, এ সন্দেহের ধোঁয়াও মাঝে মাঝে মনের মধ্যে পাক খাচ্ছে।

ছেলের বৌকেও জয়াবতীর জায়েদের মতই একজন মনে হল, আর আপাতত তার কোন দোষ খুঁজে না পেয়ে ভিতরের ঝাঁজ প্রকাশ করলেন একটা অবান্তর কথায়। বলে উঠলেন, দ্যাওরদের নাম ধরে ডাকার রীতি এ বাড়িতে নেই বৌমা, ওকে তুমি ছোট ঠাকুরপো বলবে।

রমলা অন্যদিকে যতই চালাক হোক, সংসারে এখনও অনভিজ্ঞ, তাই হেসে বলে, নাইলে যাকে মাথা মুছিয়ে দিতে হয়, তাকে আবার ঠাকুরপো!

কিন্তু জয়াবতী এ পরিহাসে হাসেন না। ব্যাজার মুখে বলেন, আমি যখন শ্বশুরবাড়ি এসেছিলাম, আমার ছোট দ্যাওরকে ধরে ভাত খাইয়ে দিতে হত। তবুও তাকে ছোট ঠাকুরপো ডাকি বৌমা!

এবার আর বুঝতে অসুবিধে হয় না। রমলা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

জয়াবতী বলেন, দীপু কলেজ যাবে না?

কলেজ!

দীপক কলেজ যাবে, এমন অসম্ভব কোনও কথা রমলার মনের জগতে ছিল না। শুধু ভেবেছিল, আজ বাড়ির কর্তারা যে যার কর্মস্থানে রওনা দিয়েছেন, আর ছোড়দিও বেশি কাঁদছে না। অতএব হয়তো আজ দুপুরটা

এখন জয়াবতী সেই নিঃশঙ্ক চিত্তে ঢিল ছুঁড়লেন। বললেন দীপু কলেজে যাবে না?

 যে জয়াবতী জগন্ময়কে জুলুম করছিলেন, বাড়িতে থাকবার জন্যে।

রমলা মাথা নেড়ে বলে, জানি না।

জান না? সকাল থেকে তো ওপরেই রয়েছ বাছা! যাবার কোন উযুগ দেখলে না?

না তো।

তা জানি! আর কি পড়া লেখা হবে? জয়াবতী ভবিষ্যৎবাণী ঘোষণা করেন, এইবার সবই জলাঞ্জলি।

রমলা বোধকরি পতিনিন্দাটা বরদাস্ত করতে পারে না, তাই বলে ফেলে, ছোড়দির এইরকম–

ছোড়দি তো এখন পাগল হয়ে নাচতেই থাকবে, তার ছুতোয় কারুর কিছু বন্ধ রাখবার দরকার নেই।

যে জয়াবতীর কথায় মধু ঝরে, তার রসনায় এমন তিক্তরস? রমলা অবাক হয়ে যায়।

বিষণ্ণভাবে বলে, আচ্ছা বলছি গিয়ে।

বলবার কিছু নেই। যে যা ইচ্ছে করুক। শেষে তো দোষ হবে মার!

উল্টোপাল্টা কথায় হাঁপিয়ে উঠে রমলা সরে যায়।

আর ঠিক এই সময় জয়াবতীর এই তিক্ত মেজাজের সামনে এসে দাঁড়ায় অতনু।

আর আর অতনুকে দেখে হাতে চাঁদ পান না জয়াবতী। পান না পরম আশ্বাসের অভয়। বরং মনটা বিমুখ হয়ে ওঠে তার।

আবার ওর আসার কী দরকার ছিল?

 মেয়েটা যদি বা ঝোঁক বদলেছে।

আজ তো অমিতা শুধু মা। সেই সম্পদটুকু মুহূর্তে লুঠ করে নিতে পারে এই অতিভদ্র নিরীহ চেহারা দস্যুটা।

জয়াবতী ভাবেন, আজ ওর এ আক্কেল হওয়া উচিত ছিল, আর আসার কার নেই। দরকার থাকলে আমরাই ডেকে পাঠাতাম।

কিন্তু অতনু তার ছেলের বৌ নয় যে বিরক্তিটা প্রকাশ করে বসবেন। তাই শুকনো গলায় বলেন, এসো বাবা! আজই যাওয়ার ঠিক করলে তা হলে?

হ্যাঁ। আজ অবস্থা কেমন? রিপোর্ট কি বলছে?

জয়াবতী গতকালকের সমস্ত লজ্জার কলঙ্ক মুছে ফেলবার সুযোগ পেয়ে আত্মস্থ ভঙ্গিতে বলেন, আজ একেবারে অন্য রকম। আজ সকাল থেকে শুধু মা আর মা। আমার মা মরে গেছে বলে কেঁদেই নিল এক পালা। তারপর মা কোথা গেল, মা চা খেয়েছে কিনা, এই করে বেড়াচ্ছে।

গুড। অতনু বলে, খুব ভাল কথা। খেয়েছে কিছু? ডাক্তার অতনু ডাক্তারের মতন কথা বলবে বইকি।

জয়াবতী যদি বলতে পেতেন হ্যাঁ খেয়েছে, তাহলে বেঁচে যেতেন। কিন্তু একেবারে পুকুর চুরিটা করা শক্ত। তাই বলেন, ওই তো ওইটাই এখনো স্বাভাবিক হয় নি।

যেন আর সবটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

খাওয়ান! আপনিই একটু চেষ্টা করে খাওয়ান। আপনাকেই যখন ইয়ে করছে।

দেখি। বলে নীরস মুখে দাঁড়িয়েই থাকেন জয়াবতী। বলেন না, যাও না দেখে এসো।

কাল বলেছিলেন। কাল মনের মধ্যে নানা চিন্তার ওঠাপড়া ছিল। আজ হঠাৎ বিরূপতা আসছে। গতরাত্রে জগন্ময়ের সঙ্গে কথাবার্তায়, মনের অতি নিভৃতে যে ইচ্ছেটি অঙ্কুরিত হয়ে উঠছিল, সেটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। তাই আজ অন্য ভাব।

আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে জয়াবতীর, বেশ তো, তুমি যদি পাড়াপড়শীর মতই ব্যবহার কর, আমিও তাই করব! বাইরের উঠোন থেকে বিদায় দেবো। কেন, তুমি নিজে থেকে একবার প্রস্তাব করতে পারতে না? বলতে পারতে না, কাকীমা, ওকে আমার হাতে দিন। আমি ওকে সারিয়ে তোলবার চেষ্টা করব। ওকে-সুখী করব। তা নয়, রুগীর খবর নিয়ে মহানুভবতা দেখাতে এলেন! ঠিক আছে, খবরই নিয়ে যাও।

.

অতনু ভাবছে ওঁর মুখে আজ এমন অপ্রসন্নতা কেন? গতকালকের প্রতিক্রিয়া? এই বিরূপ মুখের দিকে তাকিয়ে কি বলা সম্ভব, কাকীমা, ওকে তো আপনারা রাখতে পারলেন না! ভেঙে ফেললেন ছড়িয়ে ফেললেন, সেই ভাঙা টুকরোগুলো আমায় দিন না। আমি চেষ্টা করে দেখি

কেউ কারুর মনের মধ্যেটা দেখতে পায় না, এই হচ্ছে পরমতম লাভ। কেউ কারুর মনের কথা বুঝতে পারে না, এই হচ্ছে চরমতম লোকন।

তবে আর অতনু দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে? চলে যাওয়াই তো উচিত।

বড় জোর বলা যায় দীপুর বৌ চলে গেছে নাকি?

যা বলা যায়, তাই বলে।

জয়াবতী বলেন, না, আজ আর কি যাবে? অষ্টমঙ্গলা হোক। আর এখনকার বৌরা বাপের বাড়ি যায় না কি? লজ্জার যুগ তো নয়!

লজ্জার যুগ নয়।

তবু নির্লজ্জের মত অবান্তরের ভূমিকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।

অতএব অতনুকে বলতে হয়, যাচ্ছি তাহলে। কাকাবাবু অফিস যাবার সময় বলে এসেছিলেন একবার খোঁজ নিতে–

কাকাবাবু!

উনি? উনি বলেছিলেন খোঁজ নিতে? উনি গিয়েছিলেন তোমার কাছে?

হ্যাঁ ওই অফিস যাবার সময়

সহসা অনেকক্ষণের নিস্তব্ধ হয়ে থাকা বাড়িটা ঝনঝনিয়ে ওঠে, আমার মা কোথা গেল? আমার মা?

ওই দেখ।

জয়াবতী গর্বে, পুলকে, ব্যাকুলতায়, ব্যস্ততায় ধুপ ধুপ করতে করতে ছোটেন।

কিন্তু অতনু?

সে কি ওঁর পিছন পিছন ছুটবে? নাকি পড়শীর অধিকারহীন নিরুপায়তায় তাকিয়ে থাকবে? না দাঁড়িয়ে থাকবে ওই স্বরটুকু আবার কি বলে শোনবার জন্যে?

হঠাৎ নন্দা এসে দাঁড়ায়।

বিনা ভূমিকায় বলে, তুমি তো ইচ্ছে করলেই একটু সাহস দেখাতে পারো অতনু?

কি বলছেন? চমকে প্রশ্ন করে অতনু।

বলছি তুমি তো ইচ্ছা করলেই অমিতাকে বিয়ে করতে পারো।

এটা কি!

ব্যঙ্গ! অকারণ নিষ্ঠুরতা!

অতনুর মন বোঝার ছল? কথার জাল ফেলে তুলে আনবার চেষ্টা অতলে তলিয়ে থাকা সেই মনকে?

একটু বুঝি কঠিন হয়ে যায় অতনু। স্থির স্বরে বলে, ইচ্ছে করলেই পারা যায় এই আপনার বিশ্বাস?

নিশ্চয়। ইচ্ছের জোর থাকলে কী না হতে পারে? আমি তো কাল থেকে কেবল ভাবছি, তুমি এটা বলছ না কেন?

বললেই সে বলাকে মূল্য দেওয়া হবে!

না হয় অধিকারের জোর খাটাবে।

অধিকার! অধিকার কোথায়?

সহসা হেসে ওঠে না। বলে, সেটাও বলে বোঝাতে হবে? না, তোমাকে বোঝাতে আসাই দেখছি বিড়ম্বনা হয়েছে। বলে চলে যায় না।

এই ধরন নন্দার। কথাটা ছুঁড়ে মেরেই চলে যায়। তাকিয়ে দেখে না তার প্রতিক্রিয়াটা কি হল। হয়তো প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিঃসংশয় বলেই দেখে না।

অতনু কি নন্দার নির্দেশে কান দেবে? বিনা দ্বিধায় এগিয়ে গিয়ে

ঝন ঝন ঝন!

 কণ্ঠস্বর নয়, কাঁচের বাসন ভাঙার শব্দ।

পাগলিনী চেঁচাচ্ছে, সেই শব্দের সঙ্গে বলছে, তুমি চলে যাও। তুমি থাকবে না। তুমি মহাদির মা। তুমি ওকে তাড়িয়ে দিলে, ওকে মারলে।

অতনুদা! অতনুদা!

দোতলার বারান্দা থেকে ঝুঁকে ডাকে দীপক, আপনি আছেন? উঃ বাঁচলাম! শীগগির ওপরে আসুন। ভয়ানক কি রকম করছে।

তাহলে এখন যাওয়া চলে।

 বাড়ির বড় ছেলে বিপদে পড়ে ডাকছে। বাড়ির কর্তা ভার দিয়ে গেছেন।

.

 খালি পায়ে নয়, খালি পায়ে নয়, চটি পরে! রমলা সাবধান করে দেয়, ওঘরে কাঁচের গ্লাস ভেঙে ছড়াছড়ি।

যাচ্ছি না এক্ষুনি ওঘরে, আবার কি হল? বহু কণ্ঠের বহু উচ্চারিত প্রশ্নটাই আবার উচ্চারণ করে অতনু।

কি জানি। সকাল থেকে তো খুব খারাপ ছিলেন না। নীচে থেকে বোধহয় আপনার গলার সাড়া পেয়ে মাকে কি বলেছেন। মা বললেন, চলে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যস! ওকে তুমি তাড়িয়ে দিয়েছ–বলে রেগে কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে

দেখছি আমিই শনি হয়ে এসেছিলাম এবার!

রমলা একবার চোখ তুলে দেখেই চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর বলে, যাবেন না ওঘরে?

তাই ভাবছি। তাতে হিত করব না অহিত করব বুঝতে পারছি না।

তা অবিশ্যি সত্যি, রমলাও বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে না তার শাশুড়ির মনোভাব। কিন্তু অমিতার ঘর থেকে দীপক আবার ডেকে উঠেছে অতনুদা!

ও ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়ায় অতনু।

.

চারিদিকে ভাঙা কাঁচের টুকরো, তার মাঝখানে মেঝেয় লুটোচ্ছে অমিতা! ওকে তোমরা খালি খালি তাড়িয়ে দাও, ওকে মার। তাই তো ও চলে যাবে। অনেক দূরে চলে যাবে।

জয়াবতী শুধু ওর বিপর্যস্ত মাথাটা সামলাচ্ছেন।

মত্ততায় অস্বাভাবিকতা আসে। কিন্তু অস্বাভাবিকতারও মাদকতা আছে বইকি! তার নেশাও বাড়াতে বাড়াতে বাড়ে। নইলে কি করে পারে সুস্থ সহজ লোকে দু বাহু তুলে নগর সংকীর্তন করতে?

স্নায়ু শিরা সব টান টান হয়ে উঠেছে। ওকে আর সহজে রাশে আনা যাবে না। ও স্নায়ুকে নিস্তেজ করে দিতে হবে, শিথিল করে দিতে হবে।

দীপু, আমার বাড়ি থেকে ওষুধের ব্যাগটা আনিয়ে দিতে পারবি? একটু চট করে।

আমিই যাচ্ছি।

তুই আর কেন এই রোদ্দুরে? চাকর টাকর কাউকে বৌদিকে বললেই

 থাক না, আমিই যাচ্ছি।

বাবা অতনু! জয়াবতী আর বিরস নেই। আবার কাতর হয়ে উঠেছেন।

অতনু ইসারায় কথা বলতে বারণ করে। ঘরে ঢুকে নীচু হয়ে আস্তে আস্তে কাঁচের টুকরোগুলো তুলতে চেষ্টা করে।

সহজ কথা বলা খুব শক্ত। কিন্তু শক্ত কাজ করতে পারাই তো পৌরুষের মহিমা।

ইস! এমন সুন্দর কাটগ্লাসের গ্লাসটা ভাঙল! আচ্ছা এক আহ্লাদী মেয়ে হয়েছে বটে আপনার?

জয়াবতী কথার এ টোনে মর্মাহত হন। এই কি হালকা রঙ্গরসের সময়?

 হতাশ ক্ষুব্ধ গলায় বলেন, আর গেলাস! আমার কপালটাই ভেঙে চুরমার করে দিল!

ওর কি সাধ্যি যে আপনার কপালে হাত দেয়? নিজের কপালই ভাঙছে।…অমিতা, মুণ্ডুটা মাটিতে ঘষে ঘষে সত্যিই যে ভাঙবার জোগাড় করছ, কি হচ্ছে ওটা?

জয়াবতী ক্রমশ শিথিল হয়ে যাচ্ছেন, বলে ফেলতে যাচ্ছেন, ওর ভাঙা কপালখানা জোড়বার ভার তুমি নিতে পারো না অতনু? মিলিটারীর ডাক্তার বলে শুধু ভাঙা হাত পাই জুড়বে? জুড়তে পারবে না ভাঙা অদৃষ্ট?

অতনু ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, বলে ফেলতে যাচ্ছে, কাকীমা, পাগলটাকে আমার হাতে তুলে দিতে পারেন না? দেখি ওর পাগলামি সারিয়ে দিতে পারি কিনা। মনে করুন না এইটাই বিধাতার নির্দেশ ছিল। তাই

এই যে অতনুদা, আপনার ব্যাগ।

জোরে জোরে এসেছে দীপক। ভারী ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে।

অতনু তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয়।

তারপর খুলে দেখে পরীক্ষা করে। কোন্ কোন্ ওষুধ মজুত আছে। মরফিয়া ইনজেকশন দেবে, উত্তেজিত স্নায়ুকে বশে আনতে?

না না, ছুঁচ ফোঁটাতে পারবে না অতনু ওর ওই শীর্ণ হয়ে যাওয়া ফ্যাকাশে হাতে।

তোমার সেদিনের সেই ঘুমের ওষুধটা আর নেই?

 আছে, সেটাই দেব। খাবার জল চাই একটু।

বৌমা! ডাকলেন জয়াবতী।

দুর্ভাগ্যক্রমে চট করে সাড়া পাওয়া গেল না। জয়াবতী তীব্র বিরক্তির সঙ্গে উঠে পড়লেন।

হুঁ! আমি আবার ফরমাস করব! সে সুখ ফুরিয়েছে। এখন এই রকমই হবে, চেঁচিয়ে মরে গেলেও কেউ শুনতে পাবে না। ভারী দেহ নিয়ে দুমদুম করতে করতে নীচে নামেন জয়াবতী।

সঙ্গে সঙ্গে দীপকও ব্যস্ত হয়ে নামে, আহা তুমি কেন? আমিই না হয় এনে দিচ্ছি। সিঁড়ি উঠলে তোমার

আমার কিছু হবে না বাবা, এ হচ্ছে মাষকড়াই, এতে পোকা ধরে না।

 জয়াবতী খাবার জলের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে দীপক এসে পৌঁছে জল ঢালছে।

আমি নিয়ে যাচ্ছি জল। তুমি একটু জিরিয়ে তবে

কিন্তু দীপকই কি বৌ হঠাৎ কোন্ দিকে গেল, সেটা না দেখে যাবে? বৌকে আবার মা ডাকবেন কিনা কে বলতে পারে? তখন?

আশ্চর্য, মাকে তো কখনো ভীতিকর মনে হত না! বৌ আসার পর থেকেই মাকে এত ভয় করছে কেন দীপকের?

.

ভয়! ভয়!

ভয় বস্তুটা বোধকরি প্রেমের সহোদর অনুজ। তাই প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে তার গতিবিধি।

 তাই এত ভয় অতনুর।

 কিন্তু অমিতারও তো ছিল কত ভয়। সব ভয় ঘুচিয়ে এ কী নির্ভীক হয়ে উঠল সে!

 হঠাৎ নির্জন হয়ে গেছে ঘরটা। হঠাৎ শুধু অতনু আর অমিতা।

অতনু দ্রুত ব্যগ্র-স্বরে ডাকে, অমিতা!

অমিতা শুধু চোখটা খুলে তাকায়। লাল লাল ফুলো ফুলো চোখ।

অমিতা ওঠো, উঠে বোসো। আমার একটা কথা শুনতে হবে তোমায়।

কিন্তু উন্মাদিনী কেন সহজ সুরে সাড়া দেবে? তাই সে বলে ওঠে, শুনবো না শুনবো না, কারুর কথা শুনবো না আমি।

শুনতেই হবে।

দৃঢ়স্বরে বলে ওঠে অতনু, যাবার আগে সেই কথাটা শোনা চাই আমার।

না না, তুমি যাবে না। মাটি থেকে মাথা তোলে পাগলী।

যাব না? না গেলে চলবে?

 চলবে। তুমি শুধু এখানে বসে থাকবে।

অতনু হঠাৎ ওর দুই বাহুমূল চেপে ধরে ওকে গায়ের জোরে উঠিয়ে বসিয়ে আরও দৃঢ়স্বরে বলে, শুনবে তুমি স্থির হয়ে?

কেন স্থির হবো? আমি যে পাগল হয়ে গেছি? দেখতে পাচ্ছ না আমার দশা? সহসা একেবারে কাণ্ডজ্ঞানশূন্যের মতই কাজ করে বসে অমিতা।

অতনুর কোলের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কেঁদে ওঠে, বলছি চলে গেলে মরে যাব। তবু

.

অতনু কী করবে?

অতনু ওই কান্নায় ভেঙে পড়া পাখীর মত শরীরটুকু নিবিড় করে চেপে ধরবে? ওর সমস্ত শূন্যতা ভরিয়ে দেবে হৃদয়ের উষ্ণতায়?

না কি ঝড়ে এসে পড়া মরা পাখীর মত টেনে ফেলে দেবে ওটাকে কোল থেকে? স্পর্শ থেকে?

না, ঠেলে ফেলে দেয় না। শুধু ঠেলে তুলে দেয় অতনু সেই ডানাভাঙা পাখীটাকে।

তুলে দিয়ে ওর দুটো কাঁধ চেপে ধরে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে একবার ওর চোখের দিকে চেয়ে চাপা কঠিন স্বরে বলে, মিছিমিছি এরকম করছ কেন? তোমার তো কিছু হয় নি।

রোগিণী কেঁদে ওঠে না, কেঁপে ওঠে। কেঁপে উঠে বলে, আবার আমায় বকছে! আমার এত কষ্ট!

থামো!

অতনু বুঝি নতুন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতে চায়? তাই ওর কাঁধ দুটোয় ঝাঁকুনি দিয়ে তীব্রস্বরে বলে, থামো! এ রকম করতে লজ্জা হচ্ছে না? কিছু তো হয় নি তোমার!

ওমা, এত কষ্ট, তবু বলছে কিছু হয় নি! চীৎকার করে নয়, গেঙিয়ে গেঙিয়ে বলে অমিতা।

অতনুর কি নেশা লেগেছে? কতটা কঠোর হওয়া যায় তার পরীক্ষা করছে? সেইটাই ওর চিকিৎসাপদ্ধতি?

নইলে কেন অমন রূঢ় হয়ে ওঠে, রুক্ষ হয়ে ওঠে।

 সবাইকে ঠকাতে পারো, আমায় ঠকাতে পারবে না। আমি জানি তোমার কোনও অসুখ করে নি! সব তুমি ইচ্ছে করে করছ।

পাগলী একবার চোখ তুলে তাকায়। যন্ত্রের মতো উচ্চারণ করে, ইচ্ছে করে করছি?

করছই তো? শুধু শুধু মিথ্যে পাগলামি করে গালে মুখে চুনকালি মাখছ। তোমার লজ্জা করছে না, আমার যে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।

আমার জন্যে তোমার মাথা কাটা যায়?

যায় না?

সহসা স্থির হয়ে যায় অমিতা। শান্ত হয়ে যায়। বুঝি একেবারে সহজ হয়ে যায়।

আচ্ছা আর করব না।

ঠিক বলছ?

ঠিক বলছি, ঠিক বলছি।

শান্ত হয়ে যাওয়া মানুষটা আবার হঠাৎ উদ্বেল হয়ে ওঠে। বুঝি নেশার ঘোর কেটেও কাটে নি। লেগে আছে মস্তিষ্কের কোষে কোষে। তাই বলে, শুধু তুমি একবার আদর কর।

ভয়ঙ্কর একটা উদগ্র বাসনাকে স্নায়ুর মধ্যে নিষ্পেষিত করে ফেলতে ভয়ঙ্কর একটা পরিশ্রম হয় না? সেই পরিশ্রমে আলোড়িত হয়ে ওঠে না রক্তমাংসের একটা মানুষ?

হয় বইকি! কিন্তু সে আলোড়ন কি ধরা পড়তে দেওয়া হবে? প্রশ্রয় দেওয়া হবে নিন্দনীয় একটা অসামাজিক ইচ্ছেকে?

না, প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। তাই বলতে হয়, তাতে লাভ?

 লাভ, লাভ? ভয়ঙ্কর লাভ! করো না গো একটু আদর। এতদিন পরে এসে শুধু বকছ আর বকছ। আবার কোলের উপর উপুড় হয়ে পড়ে সে।

অতনু কি ভুলে যাবে কাকে বলে অসঙ্গত, আর কাকে বলে অসামাজিক?

কিন্তু কি করে ভুলবে?

 দরজায় যে ছায়া পড়েছে।

দীর্ঘছায়া। সাড়ে তিন হাত মানুষের ছায়া কি চৌদ্দ হাত? একুশ হাত? একশো হাত?

 ছায়ার ভিতরে কিছু নেই, অসার বলেই নিজেকে এত বাড়িয়ে তুলতে পারে?

তাই সামান্য একটা সাড়ে তিনহাত মাপের মানুষের ছায়ায় লুপ্ত হয়ে যায় জগতের সমস্ত মমতা, সমস্ত করুণা, সমস্ত প্রেম! লুপ্ত না হলে কেমন করে অমন চেঁচিয়ে উঠল অতনু?

ফের? ফের ওই রকম মিথ্যে মিথ্যে পাগলামী হচ্ছে? কী বললাম এতক্ষণ? ভাবো! মনের জোর দিয়ে ভাববা–আমার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। আমি ভালো আছি।

দরজার ছায়া ঘরের মধ্যে এসে পড়েছে। একটা নয় দুটো।

অতনু পাখী পড়াচ্ছে।

কই বললে না? বল, আমি ভাল আছি। আমি ঠিক আছি।

হি হি হি! আমি ভাল আছি! আমি ভাল আছি! দাঁড়িয়ে উঠে ঘরের মধ্যেই একটা ঘুরপাক খেয়ে নিয়ে হেসে উঠেই উন্মাদিনী হঠাৎ চীৎকার করে ওঠে, এটা আবার কেন এল? এই রাক্ষুসীটা? তাড়িয়ে দাও তাড়িয়ে দাও ওটাকে। ঘাড় মটকে রক্ত খেতে আসছে।

অতনু একবার দীর্ঘছায়ার মালিক দুটোর মধ্যে একটার মুখের দিকে তাকায়। অনেকটা দূর থেকে ছুটে এসেছে যে অমিতার জন্যে হৃদয়ভরা ভালোবাসা নিয়ে।

কালো আর কঠিন হয়ে উঠেছে সে মুখ অবিশ্বাস্য অপমানে। অবিশ্বাসও যে ষোলআনা! দরজার বাইরে থেকে দেখে নি সে সেই কোলে আছড়ে পড়ার দৃশ্য? মনে মনে কি বলে নি ওঃ পাগল সেজে বৃন্দাবনলীলা চলছে?

ওই অবিশ্বাস আর অপমানে কঠিন কালো হয়ে যাওয়া মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে অতনু বলে ওঠে, তোমার মতন মিথ্যে পাগলদের উচিত শাস্তি হচ্ছে কি জানো?

না, শাস্তির পদ্ধতিটা আর বলা হয় না, মিথ্যে পাগল পাগলীটা জানি দেখাচ্ছি বলে নিজেকে ভয়ঙ্কর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সকলের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে বিদ্যুতের বেগে ছুটে উঠে যায় ছাতে।

অমিতা! অমিতা!

পিছনে দ্রুত ধাওয়া করছে মানুষ। তার থেকে এগিয়ে চলেছে মানুষের কণ্ঠের অমানুষিক আর্তনাদ।

অমিতা! অমিতা!

পায়ে পড়ি তোমার, অমন করে ঝুঁকো না।

কিন্তু কে কান দেবে সেই আর্তনাদে? কে ফিরবে সেই ডাকে?

মিথ্যে-পাগলের অপবাদে দিশেহারা হয়ে যে সত্যি উন্মাদিনী হয়ে উঠেছে, তার কি আর ফিরবার উপায় আছে? পাগল হয়ে গিয়েই যে প্রমাণ করতে হবে তাকে, সে পাগল হয়েছিল।

.

অসতর্কে ছাত থেকে পড়ে গেলে হয়তো বা বেঁচেও যায় মানুষ। ভেঙে-চুরে হাড় গুড়ো হয়েও বেঁচে থাকে।

কিন্তু উন্মত্ত আবেগের টান টান স্নায়ু শিরা নিয়ে ইচ্ছে করে ঝাঁপিয়ে পড়লে সে স্নায়ু শিরা কি অটুট থাকে?

না, থাকে না। ছিঁড়ে যায়।

তবু চেষ্টা করতে হবে বইকি। ত্রুটি হয় না সে চেষ্টার। সমস্ত বুদ্ধি আর বিবেচনার ত্রুটি ঢাকা পড়ে যায় যাতে, সেই রকম চেষ্টার।

মেয়ের বিয়েতে যত খরচ হয়েছিল জগন্ময়ের, তার বেশি খরচ হয়ে যায় ঘণ্টাকয়েকের ত্রুটিহীন চেষ্টায়।

ডাক্তার আসে, অ্যাম্বুলেন্স আসে, আত্মীয় আর বন্ধুজনে ছেয়ে যায় বাড়ি। তারপর হাসপাতালে গিয়ে পড়ে সমগ্র সংসার।

পাড়ার লোকে হায় হায় করে বলতে থাকে, ওমা ওদের ছাতে যে এখনো বিয়ের ম্যারাপের বাঁশ বাঁধা!

না, নিজ নিজ কর্তব্যের ত্রুটি কেউ করে না।

পুলিশের কর্তব্য পুলিশ করে। জেরায় জেরায় উৎখাত করে ঘরবার সবাইকে, বাড়িতে কারও সঙ্গে কোনও শত্রুতা ছিল কি না। কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল কি না। এই একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে একতা আছে কি না। অল্পবয়সী বিধবা মেয়ে, ভিতরে অন্য কোনও ব্যাপার ছিল কি না।

বাড়ির ডাক্তার আর সেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, তাঁরাই রক্ষা করলেন। তারাই গেরস্থকে উদ্ধার করলেন এই জেরার হাত থেকে।

সার্টিফিকেট দিলেন মস্তিষ্ক বিকৃতির।

 একজন মরেছে বলে তো আর সংসারসুদ্ধ সকলের মরলে চলবে না! বাঁচতে হবে।

পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে হবে। লোকলজ্জার হাত থেকে বাঁচতে হবে।

.

অনেকগুলো ঘণ্টা পরে সহসা চোখ মেলে অমিতা। ব্যান্ডেজে ঢাকা আধখানা চোখ।

বাবা!

মা, ওমা, এই যে আমি। হাহাকার করে ওঠেন জগন্ময়।

কেন আমি অফিস চলে গেলাম মা! কেন তোকে কোলে করে বসে থাকলাম না!

আঃ কী করছেন– নার্স ঠেলে নিয়ে যায়, এইজন্যে খারাপ কেসে আমরা পেসেন্টের আত্মীয়দের অ্যালাউ করি না।

মাকে দেখতে চান?

না। শুধু ক্ষমা!

জড়িয়ে জড়িয়ে বলে মৃত্যুপথযাত্রিণী।

একটু পরে আবার নিঃশ্বাসের মত আস্তে উচ্চারণ করে, অতনু!

আর লজ্জা করবার সময় নেই!

 এরপর নিজেকে চাবুক মেরে মেরে দেখবে অতনু, গায়ে তার মানুষের চামড়া আছে কিনা।

কিন্তু আর কি হবে দেখে?

 অতনু!

বল! বল কি বলবে? বিছানার কাছে মুখ নামিয়ে আনে অতনু। নামিয়ে আনে সেই নিঃশ্বাসের মত মৃদু স্বরে শক্তির সীমানার মধ্যে।

বড় ক্লান্তিতে একটা নিঃশ্বাস ফেলে অমিতা। তারপর জড়ানো জড়ানো ক্লান্তস্বরে বলে, তোমার কথাই ঠিক। আমার কিছু হয়নি। আমি মিছিমিছি–

কেন এমন করেছিলে অমিতা? কেন এমন করেছিলে? আমায় এমন ভয়ঙ্কর শাস্তি দিলে কেন?

.

নেভার আগে প্রদীপের মত মৃত্যুনীল মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে, জব্দ করলাম তোমায়।

 অমিতা! অমিতা!

কিন্তু অমিতা বুঝি ততক্ষণে বাইরের জগতের সঙ্গে লেনদেন চুকিয়ে ফেলেছে। হারিয়ে ফেলেছে সাড়া দেবার শক্তি।

লোভ…লোভ…নেশা…নেশা!…মহাদি তুমি যদি না আসতে!.আমি মরতে চাই নি।…আমি পাগল হতে চাই নি।…অতনু…তুমি কেন?

ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসে কণ্ঠস্বর…থেমে যায় অর্থহীন অসংলগ্ন কথা।

জগন্ময় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে পারেন, জয়াবতী পারেন মাথা খুঁড়তে, কাকা খুড়িরা ঘন ঘন চোখ মুছতে পারে, দীপক পারে আকুল হয়ে মৃতার বিছানায় মুখ মাথা ঘষতে, অতনু কিছুই পারে না।

অতনু শুধু কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে খাটের বাজু ধরে।

যা পারে তাই করে অতনু। জ্বালাকরা শুকনো চোখে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকে নীল হয়ে যাওয়া ওই মুখটার দিকে, যে মুখ থেকে মাত্র কিছু ঘণ্টা আগে উচ্চারিত হয়েছিল, বেশ, আর পাগলামী করব না। শুধু তুমি একবার আদর করো।

জীবনের সমস্ত কিছুর বিনিময়েও একটা চলে যাওয়া মুহূর্তকে ফিরিয়ে আনা যায় না।

 কিন্তু যদি যেত? অতনু কি ওর সেই অসামাজিক ইচ্ছাটাকে পূরণ করতে করতে পারতো?

পারতো না।

 পারলে, এখনই কি ওই চূর্ণবিচূর্ণ মৃত্যুবিবর্ণ দেহখানাকে বুকের মধ্যে ভরে নিতে পারতো না? নিজের দেহের সমস্ত স্নায়ু শিরা অস্থি মজ্জা মুচড়ে মুচড়ে দেওয়া যন্ত্রণাটাকে প্রকাশ করতে পারতো না উদ্দাম উন্মত্ত এক আদরের মূর্তিতে?

দুরন্ত সেই বাসনা তো লক্ষ বাহু মেলে ছুটে গিয়ে আছড়ে পড়তে চাইছে ওই দেহটার কাছে।

তবু কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অতনু।

কাঠ হয়েই দাঁড়িয়ে রইল শেষ পর্যন্ত, যতক্ষণ না মৃত্যুর মাশুল শোধ করা হল।

.

না, শোকে কেউ মরে না।

মা নয়, বাপ নয়, ভাই নয়, প্রেমাস্পদ নয়। অনেক ঝড় আর অনেক ঝঞ্ঝার পর আবার এক সময় যখন বাড়ি ফিরল সবাই, তখন আর শোক করবারও ক্ষমতা নেই কারুর।

সবাই এক গ্লাস করে শরবৎ খেয়ে শুয়ে বাঁচল।

অতনুর আবার শুয়ে পড়বারও জো নেই। জো নেই শুয়ে পড়ে থাকবার। ছুটি ফুরিয়েছে। তাকে চলে যেতে হবে।

এঁরা বললেন, আমাদের সঙ্গে ভাগ্য জড়িয়ে তুমিও অনেক ভুগলে বাবা, বলবার আর কিছু নেই। শুধু বলছিলাম, আর দুদিন বিশ্রাম করে যাওয়া যায় না?

অতনু শুকনো গলায় বলল, না।

ও বাড়িতে দাদা বৌদি বললেন, আর দুটো দিন থেকে গেলে কি খুব ক্ষতি হত?

অতনু বলল, হ্যাঁ।

পরের দুর্ভাগ্যে তোমারও তো কম দুর্ভোগ গেল না, চোখমুখ একেবারে বসে গেছে। ট্রেনে একটু খেয়ো ভাল করে।

খাব।

 পৌঁছনো চিঠিটা দিতে বেশি দেরি কোর না, ভাবনায় থাকছি।

দেরি করবো কেন?

সত্যিই তো, দেরি করবে কেন?

এ পর্যন্ত কখন কোন্ সময় অতনু অস্বাভাবিক আচরণ করেছে? কেই বা করে?

অতনুর মত যারা সুস্থবুদ্ধি সহজ সাংসারিক নিয়মের মানুষ হয়?

একজন মরে যাচ্ছে বলেই যে কোনও অনিয়ম করা চলবে, তা তো আর সংসারের নীতি নয়।

অতনু যদি নিয়ম ভাঙতো, নীতি ভাঙতো, বিধিব্যবস্থার ব্যবস্থাকে জলাঞ্জলি দিত, তাহলে অমিতা বাঁচতো।

কিন্তু কী লাভ হতো সেই বাঁচায়? কে মূল্য দিত সেই জীবনকে?

মৃত্যু মহৎ, মৃত্যু সুন্দর, মৃত্যু সমস্ত ভালমন্দের উপর সমাপ্তির রেখা টেনে দিয়ে যায়, তাই মৃত্যুর চরণে জীবনের সমস্ত শ্রদ্ধার অর্ঘ্য। জীবন জানে মৃত্যুর হাতেই আছে সেই অমৃত, যা অমরত্ব এনে দেয়।

অমিতাকে বাঁচালে প্রতিদিনের তিল তিল মৃত্যুতে অমিতার মূর্তি বিকৃত হতো, কুৎসিত হয়ে উঠতো, ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে গিয়ে মূল্য হারাত।

মৃত্যু তাকে এক জ্যোতির্বলয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে রেখে গেল, সেখানে অমিতা ক্ষয়হীন সৌন্দর্যের মধ্যে বেঁচে থাকবে।

.

না, অতনু এসব কথা ভাবছে না।

অতনু অন্যকথা ভাবছে।

অতনু চলন্ত ট্রেনে বসে ধূ ধূ বিস্তৃত প্রান্তরের পানে চেয়ে শুধু বিগত সেই খানিকটা সময়কে বারবার উল্টেপাল্টে দেখছে।

অতনু যদি সেই নির্মমতার অভিনয়টুকু না করতো! মানুষ নিজেকেই সবচেয়ে ভালবাসে বইকি। তাই অমিতার মৃত্যুর চেয়েও দুঃসহ হয়ে উঠছে অতনুর, অমিতা তাকে পরম নিষ্ঠুর ভেবে গেল বলে!

কিন্তু এমনও তো হতে পারে, সবটাই অতনুর ভুল, অমিতা পাগলই হয়েছিল। পাগল না হলে কেউ পাগলের আচরণ করতে পারে?

অতনু কি পারছে ট্রেনের দরজাটা খুলে ওই ছুটন্ত প্রান্তরটায় ঝাঁপিয়ে পড়তে? যেমন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অমিতা তিনতলার সেই ছাদটা থেকে?

পারছে না। অতনু পারছে না। ভয়ঙ্কর দুরন্ত সেই ইচ্ছের প্রলোভনকে জয় করে বসে আছে স্থির হয়ে হয়তো একটু পরে হাতের বইখানা খুলে ধরে পড়তে শুরু করবে।

তাছাড়া আর কি?

পাগল না হলে কেউ পাগলের আচরণ করতে পারে? অতনু হচ্ছে সেই স্বাভাবিকদের দলে, যারা মরবার মন্ত্রও জানে না, বাঁচবার মন্ত্র আবিষ্কার করতে শেখে নি! যারা উন্মাদ ইচ্ছের দুরন্ত আবেগকে প্রশমিত করতে পারে, শুধু হয়তো চোখের সামনে একটা বই খুলে ধরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *