বাইরের টান, ভেতরের চাপ
০১.
এ সময় কলকাতা থেকে একটা চিঠি পেলেন জীবনানন্দ সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছ থেকে। লিখেছেন তিনি বিশেষভাবে তার সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী। জীবনানন্দ এমনিতেই বান্ধবহীন মানুষ। সঞ্জয় তার পক্ষের নতুন যোদ্ধা। জীবনানন্দের নতুন ধারার কবিতাকে সবচেয়ে সোচ্চারভাবে স্বাগত জানাচ্ছেন তখন সঞ্জয়। জীবনানন্দেরও আগ্রহ হলো তার সঙ্গে দেখা করার। জানালেন কলকাতায় গেলেই জানাবেন তাঁকে। কিছুকাল পরেই সুযোগ ঘটল সে সাক্ষাতের। গ্রীষ্মের ছুটিতে জীবনানন্দ বরিশাল থেকে কলকাতা গেলেন তাঁর ছোট ভাই অশোকানন্দের বাড়িতে। অশোকানন্দ ইতিমধ্যে বিয়ে করেছেন বোন সুচরিতার বান্ধবী উপেন্দ্রকিশোর রায়ের নাতনি নলিনীকে। জীবনানন্দ সঞ্জয়কে চিঠি লিখে জানালেন তাঁর কলকাতা যাবার কথা, অশোকের ঠিকানা দিলেন। সেই ঠিকানা ধরে একদিন সঞ্জয় ভট্টাচার্য অশোকানন্দের বাড়িতে হাজির হলেন তার এক বন্ধুকে নিয়ে। বাড়ির সামনেই ছিলেন জীবনানন্দ। সঞ্জয় তার দিকে খুব একটা নজর দেননি। একপর্যায়ে বললেন, আমরা জীবনানন্দ দাশকে খুঁজছি। জীবনানন্দ ছোটখাটো, শ্যামলা, খানিকটা স্কুল অনাকর্ষণীয় মানুষ। সঞ্জয় দেখেননি তাঁকে আগে, জীবনানন্দের কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে যে চেহারার কথা ভেবেছিলেন তার সঙ্গে ঠিক মেলেনি।
সঞ্জয়ের প্রশ্নে জীবনানন্দ বললেন, আমিই জীবনানন্দ দাশ।
জীবনানন্দকে দেখে যে সঞ্জয় হতাশ হয়েছিলেন, সে কথা পরে প্রেমেন্দ্র মিত্রকে বলেছেন তিনি। বলেছেন, যে জীবনানন্দের কবিতা আমরা পড়েছি উনি সে লোক হতে পারেন না।
প্রেমেন্দ্র বলেছেন, ওই হচ্ছে জীবনানন্দ। কবিতা লিখবার সময় ওর চেহারা অন্য রকম হয়ে যায়।
.
অশোকানন্দের বাসায় জীবনানন্দ আর সঞ্জয় অনেক আলাপ করলেন সেবার। সঞ্জয় বললেন : আপনার কবিতাকে আমি অনুসরণ করছি বহুকাল। আমি মনে করি আপনার কবিতা একটা নতুন গভীর স্তরে এসে পৌঁছেছে, পরিণতির দিকে এগোচ্ছে।
জীবনানন্দ : কিন্তু অনেকেই তো পছন্দ করছেন না কবিতাগুলো। একটু জটিল হয়ে যাচ্ছে বোধ হয়।
সঞ্জয় : অনেকের কথা বাদ দিন। আমি তো একটা লেখায় লিখেছি যে জীবনের নতুন বস্তবতা, কবিতার নতুন ভাষা দাবি করে।
জীবনানন্দ : আপনার আলোচনা তো চমৎকার হয়েছে। আমার জন্য অনুপ্রেরণার।
সঞ্জয় বললেন, আমি আসলে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি মূলত যে কথাটা বলতে সেটা হচ্ছে যে আমরা আপনার একটা কবিতার বই প্রকাশ করতে চাই। আমাদের একটা প্রকাশনা আছে পূর্বাশা নামে, সেখান থেকেই প্রকাশ করব।
এ অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে জীবনানন্দ খুব খুশি হলেন। এযাবৎ সব বই-ই তিনি প্রকাশ করেছেন নিজের খরচে, এবার প্রথমবারের মতো একটা প্রকাশনা সংস্থা নিজ দায়িত্বে প্রকাশ করতে চাচ্ছে তাঁর বই, এ তো তার জন্য খুবই আনন্দের। জীবনানন্দ রাজি হলেন এবং বরিশাল ফিরে গিয়ে এ নিয়ে চিঠিতে আরও আলাপ করবেন জানালেন।
.
০২.
ইতিমধ্যে বরিশালে সর্বানন্দ ভবনের পরিবেশটা বদলে গেছে। জীবনানন্দের বাবা মারা গেছেন বছরখানেক হলো। একমাত্র ভাই বিয়ে করে কলকাতায় স্থায়ী হয়েছেন। তাঁর বোন সুচরিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যোগ দিয়েছেন কলকাতার কাছে তমলুকে সান্ত্বনাময়ী গার্লস স্কুলের শিক্ষক হিসেবে। তিনিও কলকাতাতেই থেকে যাবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কুসুমকুমারী প্রায়ই কলকাতায় গিয়ে কখনো ছেলের বাড়িতে কখনো মেয়ের কাছে থাকেন। তার অন্যান্য কাকা, জ্যাঠারাও চলে গেছেন কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরে। বাড়িতে আছেন লাবণ্য। পরিবারের অন্য সদস্যদের উপস্থিতিতে তাঁর একরকম ঢাল ছিল কিন্তু এই নতুন পরিস্থিতিতে তিনি বর্মবিহীনভাবে লাবণ্যর মুখোমুখি। লাবণ্যর সঙ্গে তার মানসিক যোগাযোগ সামান্যই।
এ ছাড়া দশ বছর শিক্ষকতা করবার পর শিক্ষকতার প্রতি একধরনের অনীহাও জেগেছে তার তখন। সব প্রতিষ্ঠানের মতোই ব্রজমোহন কলেজেও আছে নানা দলাদলি, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। তিনি সেগুলোর ভেতর জড়াননি। আর সেসবে জীবনানন্দ মোটেও পারদর্শীও নন, ফলে নানাভাবেই কোণঠাসা থেকেছেন কলেজে। তিনি চুপচাপ কলেজে এসে ক্লাস নিয়ে যেতেন, কারও সাতে-পাঁচে বিশেষ থাকতেন না। দেখা গেছে তার সহকর্মীরা কৌশলে আইএ, বিএ ক্লাসের যেসব বিষয় সবচেয়ে কঠিন এবং নীরস, সেগুলো পড়াতে দিয়েছেন তাকে, অন্যরা নিয়েছেন সহজ ক্লাসগুলো। জীবনানন্দ তাঁর মগ্নতা থেকে বেরিয়ে এসব নিয়ে কোনো ঝামেলা তৈরি করেননি। তাঁর দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
তার সহকর্মীরা জানতেন যে জীবনানন্দের কবিতা কলকাতার পত্রিকায় ছাপা হয়, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। তারা জীবনানন্দের কবিতার বিষয়ে যত না আগ্রহী ছিলেন, তার চেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন তার কবিতা নিয়ে কী ধরনের বিরূপ লেখালেখি হচ্ছে তা নিয়ে। বিশেষ করে, শনিবারের চিঠিপত্রিকায় জীবনানন্দকে নিয়ে সজনীকান্ত যেসব লেখা লিখছেন, সেগুলো কেউ কেউ আগ্রহ নিয়েই পড়তেন। তাঁর ইংরাজি বিভাগেরই শিক্ষক নরেন্দ্রলাল গঙ্গোপাধ্যায় জীবনানন্দকে ডাকতেন ঘাইহরিণী বলে। তার পেছনে বরাবর লেগে থাকতেন কলেজের আরেক শিক্ষক হেরম্ব চক্রবর্তী। শনিবারের চিঠিতে জীবনানন্দকে নিয়ে কিছু লেখা হলেই সেটা টিচার্স রুমে বেশ বড় বড় গলায় সবাইকে পড়ে শোনাতেন কলেজের হেরম্ব বাবু। একবার জীবনানন্দকে উদ্দেশ করে তিনি একটা কবিতা লিখলেন, নীল জলের শিঙিমাছ নামে। জীবনানন্দের উপস্থিতিতেই হেরম্ব বাবু টিচার্স রুমে পড়লেন সেই ব্যঙ্গ কবিতা। জীবনানন্দ চুপচাপ বসে শুনলেন, তারপর একসময় বেরিয়ে গেলেন টিচার্স রুম থেকে। জীবনানন্দকে অপদস্থ করে একধরনের মজা যেন পেতেন হেরম্ব বাবু।
একদিন বরিশালের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অবনীমোহন কুশারী জীবনানন্দকে নিমন্ত্রণ করলেন বজরায় নদীভ্রমণে। তিনি গেলেন। বজরায় গিয়ে দেখলেন সেখানে হেরম্ব বাবুও আছেন। তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের আগের পরিচিত। তারা বজরা নিয়ে আগুনমুখা নদী দিয়ে টিকিকাটা গ্রাম পার হয়ে চললেন মাথাভাঙ্গার দিকে। কিন্তু বজরায় উঠবার পর জীবনানন্দ টের পেলেন তাঁকে ডাকা হয়েছে আসলে অপমান করবার জন্য। হেরম্ব আর অবনী মিলে সারা পথ জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে নানা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে লাগলেন। তাঁকে বজরায় আটকে ক্রমাগত অপমান করে একধরনের নির্মম আনন্দ যেন পাচ্ছিলেন তাঁরা। জীবনানন্দ ঠিক কীভাবে ব্যাপারটা মোকাবিলা করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। শেষে বজরা গলাচিপা ঘাটে পৌঁছালে তিনি নেমে গেলেন এবং একাই আলাদাভাবে অন্য স্টিমারে বরিশাল ফিরলেন।
ছাত্রদের ভেতর তিনি তেমন জনপ্রিয় ছিলেন না। শামসুদ্দীন আবুল কালাম, নরেশ গুহ প্রমুখের মতো দু-একজন ভক্ত ছাত্র ছিল তাঁর, যাদের নিজেদের সাধনাও সাহিত্য, যারা ছিলেন তাঁর কবিতার গভীর পাঠক। কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা তার ক্লাস বিশেষ পছন্দ করত না। খুব উদ্দীপনার সঙ্গে যে তিনি ক্লাসগুলো নিতেন তা নয়, নিতেন নেহাত কর্তব্যের খাতিরে। শিক্ষকতার ভেতর তার তখন একটি ক্লান্তি এসে গিয়েছিল যেন। শামসুদ্দীন আবুল কালাম লিখছেন, একদিন ক্লাসে জেমস জিনসের দ্য ডাইয়িং সান পড়াচ্ছিলেন। ছেলেরা পেছনে হাই তুলছিল। তিনি একপর্যায়ে ছাত্রদের বললেন ইউনিভার্স শব্দটার মানে বোঝো? তারপর বললেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর আকাশে হাত উঠিয়ে গোল করে দেখাতে লাগলেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কাকে বলে, তারপর খুব জোরে জোরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে তার সেই বিখ্যাত বেখাপ্পা হাসি হাসতে লাগলেন।
এই সময়ে লেখা তাঁর চিঠিপত্রে, প্রবন্ধে, গল্পে, উপন্যাসে তিনি স্পষ্টই ঘোষণা করেছেন যে শিক্ষকতা ব্যাপারটা আসলে তিনি আর মোটেও উপভোগ করছেন না, আসলে কখনোই তিনি করেননি। তিনি এক চিঠিতে লিখেছিলেন, শিক্ষকতা আমার কখনোই ভালো লাগেনি।…এখনো অধ্যাপনা করতে হচ্ছে। কিন্তু মনে হয় এ পথে আর বেশীদিন থাকা ভালো না। যে জিনিস যাদের যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে সবই অসারতার নামান্তর নয় কি?
আর শিক্ষকতার পেশাটাকেও মর্মান্তিক মনে হয়েছে তাঁর, বিশেষ করে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়ে প্রবল ক্ষোভ ছিল তাঁর। শিক্ষা বিষয়ে এক প্রবন্ধে লিখেছেন, অনেক বেসরকারী কলেজের শিক্ষকেরা মোটামুটি গভর্নমেন্ট অফিসের লোয়ার ডিভিশনের কেরানীদের মত মাইনে পায় কিম্বা তার চেয়েও কম…আমি কেরানীদের সঙ্গে প্রফেসরদের তুলনা করলাম এই জন্য যে আমাদের দেশে অনেকেরই এমন একটি ধারণা আছে তথাকথিত ভদ্ৰসাধারণের ভেতর কেরানীরাই সবচেয়ে বেশী আর্থিক অবিচার সহ্য করে আসছে…নিজের কাজে তপ্ত প্রাইভেট কলেজের প্রফেসররা আজকাল ডোডোর মত দুর্লভ হয়ে পড়েছে।…
আরও লিখেছেন : দেড়শো একশো পঁয়ত্রিশ টাকা তো একজন মুটেও পায় আজকাল। ম্যাট্রিক, আইএ বিএ পাশ, ফেল, হুঁশিয়ার ছেলেরা কলকাতায় দুচার বছর ঘুরে একটু জমিয়ে নিতে পারলে তিনশো চারশো টাকায় সংসার অবলীলায় চালিয়ে নেয়। কিন্তু ও রকম সব আবছায়ার পথে প্রফেসর যাবেন না বলে তাঁকে একশো পঁয়ত্রিশ টাকা দিয়ে বুঝ দেবার রকমটা সমাজের কোন শুভানুধ্যায়ীর কাছেই খুব Straight বলে মনে হবে না।
তাঁর জলপাইহাটি উপন্যাসের এক জায়গায় লিখছেন, পে কমিশনের টাকা পেয়ে গভর্নমেন্টের জোয়ান পেয়াদারা ম্যাগনোলিয়া খাচ্ছে, একজিবিশনে যাচ্ছে, মেয়েমানুষকে চোরাবাজারের মাল পৌঁছিয়ে দিচ্ছে, স্ত্রীকে শেয়ালদার বাজারের মাছ তরকারী, লাইফ ইস্যুরেন্স করছে, সেভিংস ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলছে। বেশ ভালো কাজ করছে–কিন্তু…কিন্তু…ঘর নেই, চাল নেই, কাপড়ের পেছনের দিক ছিঁড়ে গেছে মাস্টারদের, তাদের স্ত্রীদের, এরা বেসরকারীজীবী বলেই এদের জন্যে কোনো কমিশন নেই–এরকম হতভাগা দেশে কোনো স্কুল কলেজ না থাকাই ভালো। সব পুলিশে যাক, সেপাই হয়ে যাক।
.
জলপাইহাটি উপন্যাসে মূল চরিত্র নিশীথও কলেজের অধ্যাপক। অধ্যাপকের জীবন নিয়ে এই তার মূল্যায়ন, কলেজের কাজটাকে মজুরির কথা বাদ দিয়ে, এমনি কাজ বা রুচি-রচনার দিক দিয়ে দেখতে গেলে, কোনোদিনই ভাল লাগেনি তার। সঙ্গে-সঙ্গে লাইব্রেরিতে নতুন কিছু-কিছু বই, প্রকৃতিতে এসে পড়ত রৌদ্রের ফোয়ারা, নীল উজ্জ্বল চক্রবাল, আকাশে হরিয়াল, ফিঙে, বক, বড়-বড় সুন্দরী ওয়াক পাখি, কলেজের ময়দান পেরিয়ে বন, শনের হোগলার ক্ষেত, অপরিমেয় কাশ হঠাৎ এক-আধটি নিখুঁত মুখসৌষ্ঠব, স্ত্রীলোকেরই, আরো দূরে বুনো হাঁসের জলা মাঠ, স্নাইপ, সকালের উড়িসুড়ি নিস্তব্ধতা তখন ভাল লাগত নিশীথের। ভাল লাগত বটে, কিন্তু কলেজের, বিশেষত মফস্বল কলেজের অধ্যাপকের পক্ষে বনের বেড়াল, ভাম, ভোদড়, সজারুর চরায়-চরায় ঘুরে বেড়ানো, বালিহাঁস মরাল, ওয়াক পাখিদের ওড়াউড়ি আসা-যাওয়া ভালবাসা দেখবার জন্য হাঁটুজল ভেঙে, সারাটা দিন ডুবজল গলাজলের দিকে ভেসে যাওয়া, সমস্তটা শরৎরৌদ্রের-শালিধানের-বরোজের উড়-উডু পান বনের ঝরঝরে দিনটাকে রাতের নক্ষত্ৰ নিৰ্বরে এসে নিস্তন করে রাখা, এসব কাজ মোটেও সম্মানজনক নয়, এসব নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে অধঃপতিত বিবেচিত হবে সে, কারুরই সায় পাবে না। এসব কাজ মানুষের পক্ষে সম্ভব, কিন্তু ওরা বলে অধ্যাপকের কাজ আলাদা, রুচি ভিন্ন, দায়িত্ব আর এক রকম। অধ্যাপক যে মানুষ নয় তা তো নয়। কিন্তু ছাঁকা মানুষ, পরিশ্রুত জলের মত, কুঁজো, কলসি কিংবা ওয়াটার কুলারের ভিতর। কী হবে ওরকম জল হয়ে। নিশীথ হতে চাচ্ছিল নিঝরের জল, কিংবা জল, সময়সীমার অব্যক্ত থেকে নিঃসৃত সাগরের। কলেজের কাজ ছেড়ে দেবে সে…
.
০৩.
তাঁর উপন্যাসের চরিত্রের মতো জীবনানন্দও তখন চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন। বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় চলে যাবেন কি না, তাও ভাবছেন। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক কালে কলকাতা ঘুরে তার ভেতর নানা রকম নতুন জীবনের আশার সঞ্চার হয়েছে। অশোকানন্দের স্ত্রী নলিনীকে চিঠিতে লিখলেন, এবার সুদীর্ঘ গ্রীষ্মের ছুটি কলকাতায় তোমাদের সঙ্গে কাটিয়ে খুবই আনন্দ লাভ করেছি। কলকাতায় গিয়ে নানা রকম অভিজ্ঞতা লাভ হল, সাহিত্যিক, ব্যবসায়িক ইত্যাদি নানারূপ নতুন সম্ভাবনার ইশারা পাওয়া গেল। এর আগে মাঝে মাঝে আমি ২/৩ দিনের জন্য কলকাতায় যেতাম কিন্তু নানা দিক দিয়ে কলকাতায় সামাজিক, সাহিত্যিক ও অন্যান্য ব্যাপারে যে এরকম সজীব পরিবর্তন এসেছে তা লক্ষ্য করার সুযোগ পাইনি।
সেবার বিশেষ করে সঞ্জয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তিনি বেশ চাঙা হয়ে উঠেছিলেন। জীবনানন্দের মনে হলো সঞ্জয় তাঁর কবিতার পরিবর্তনটাকে যেভাবে বুঝতে পারছেন আর কেউ তা পারছেন না। ব্যবসায়িক সম্ভাবনা বলতে সঞ্জয় যে তাঁর কবিতার বই প্রকাশ করতে আগ্রহ দেখিয়েছেন, সেটার কথাই বলেছেন তিনি। সেবার কলকাতায় গিয়ে সঞ্জয় ছাড়া আরও আজ্ঞা হয়েছে বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গেও। এসব অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁর মনে হয়েছে কলকাতায় সামাজিক, সাহিত্যিক ব্যাপারে একটা সজীব পরিবর্তন হয়েছে যেন। কলকাতা তাঁকে যেন একটু একটু আকর্ষণ করতে শুরু করেছে। এর কাছাকাছি সময়ে একবার বুদ্ধদেবকে। এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, কোলকাতার অলিগলি মানুষের শ্বাসরোধ করে বটে কিন্তু কলকাতার ব্যবহারিক জীবনে কর্মবহুলতার ঢের প্রয়োজন, কলকাতার এই স্বচ্ছন্দ পটভূমির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা চলে না আর…
সেবার পূজার ছুটিতে কলকাতায় গিয়ে ভাইয়ের স্ত্রী নলিনীর বান্ধবী লেখিকা বাণী রায়ের সঙ্গে অনেক আড্ডা হয়েছিল তাঁর। বাণী রায়ের লুক্রিশিয়া কবিতাটা খুব পছন্দ হয়েছিল তাঁর। কলকাতার কাছে বাণী রায়ের নিরিবিলি বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলেছিলেন, আপনার বাড়িটায় যদি থাকতে পারতাম তবে কি ভালোভাবেই না লিখতে পারতাম। লিখবার অবকাশ বা নির্জনতা পাই না। উপন্যাস লিখব ভাবছি। কত কি লিখবার আছে। আপনার ঘরটা যদি পেতাম…।
জীবনানন্দের ব্যাপারে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বাণী রায় লিখেছেন, সে সময় শহরের প্রাণকেন্দ্রে তিনি থাকার ইচ্ছা পোষণ করছিলেন, বরিশালের সংস্কৃতিবিহীন নির্জনতা তাঁর আর ভালো লাগছিল না। বাণী রায় মনে করেন, অনেক লোকের মাঝে নিঃসঙ্গ থাকতে পছন্দ করতেন তিনি। জীবনানন্দ জানতেন জনতা চমৎকার আড়াল তৈরি করতে পারে। মফস্বল শহরে ব্যক্তির আড়াল থাকে না।
এ কথা ঠিক যে বরিশাল জীবনানন্দের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা, তবু তিনি সে সময় বরিশালে যেন ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর পঠনপাঠন, তাঁর সাহিত্য আকাক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে কোনো সঙ্গ পাবার সম্ভাবনা তিনি বরিশালে দেখছিলেন না। কলকাতায় গিয়ে সঞ্জয়, বাণী, প্রেমেন্দ্র, বুদ্ধদেব এঁদের সাথে আড্ডা দিয়ে বরিশালে ফিরে এসে এই পরিমণ্ডলকে মনে হয়েছে আরও সংকীর্ণ। জীবনানন্দ একটা আপাদমস্তক সাহিত্যিক জীবনই খুঁজছিলেন। মানুষ যখন অন্য স্থানে অভিবাসনের প্রক্রিয়া শুরু করে, তখন সেই নতুন স্থান তাকে নানা কারণে টানে। সেই মুহূর্তে কলকাতার অনেক ব্যাপার তাঁকে টানছিল। পাশাপাশি অভিবাসনের জন্য যে জায়গায় মানুষ আছে, সেখানকার নানা ব্যাপার তাঁকে ভেতর থেকেও ঠেলতে থাকে। বরিশালের অনেক কিছুই তখন তাঁকে ভেতর থেকে ঠেলছে। ঠিক কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না তখন জীবনানন্দ।
.
চারিদিকে সার্কাসের ব্যথিত সিংহের হুংকার
০১.
এ সময় সঞ্জয় ভট্টাচার্যের উদ্যোগে পূর্বাশা প্রকাশনা থেকে বের হলো জীবনানন্দের নতুন কবিতার বই মহাপৃথিবী। সঞ্জয়কে সহায়তা করলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। সেটা ১৯৪৪ সাল। কৃতজ্ঞতায় বইটা জীবনানন্দ উৎসর্গ করলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রকে।
সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখলেন : মহাপৃথিবীতে আছে জীবনানন্দের জীবনের প্রৌঢ় পরিণতির কবিতা। কি সেই প্রৌঢ় পরিণতি? ইতিমধ্যে তিনি যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ দেখেছেন, নিজের জীবনে প্রেম অপ্রেম দেখেছেন, চাকরীর জীবন, বেকারত্বের জীবন দেখেছেন, নিজের লেখালেখির জোয়ার দেখেছেন, দেখেছেন খরাও, উপেক্ষা, অবহেলা দেখেছেন, আবার স্বাদ পেয়েছেন বিচ্ছিন্ন বন্ধুত্বেরও, দেখেছেন মৃত্যু। সব কিছু মিলিয়ে সেই প্রৌঢ়ত্বে জীবনের উদ্যম যেন হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি, ঠিক বুঝতে পারছেন না এর পরের গন্তব্য কি? জীবনের কেন্দ্রে যে বেদনা এ বিশ্বাস আরো জোরদার হয়েছে তার।
.
অভিজ্ঞতার এই চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জীবনানন্দের মনে তখন অনেক প্রশ্ন, আর্তি :
ঝাউফলে ঘাস ভরে–এখানে ঝাউয়ের নিচে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে;
কাশ আর চোরকাটা ছেড়ে দিয়ে ফড়িং চলিয়া গেছে ঘরে।
সন্ধ্যার নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন পথে কোন ঘরে যাবো।
কোথায় উদ্যম নাই, কোথায় আবেগ নাই,–চিন্তা স্বপ্ন ভুলে গিয়ে
শান্তি আমি পাবো?
রাতের নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন পথে যাবো?
রাতের নক্ষত্রের পর তিনি সিন্ধু সারসকে জানাচ্ছেন তার সিদ্ধান্ত :
জানো কি অনেক যুগ চলে গেছে? মরে গেছে অনেক নৃপতি?
অনেক সোনার ধান ঝরে গেছে জানো না কি? অনেক গহন ক্ষতি
আমাদের ক্লান্ত করে দিয়ে গেছে–হ্যারায়েছি আনন্দের গতি;
ইচ্ছা, চিন্তা, স্বপ্ন, ব্যথা, ভবিষ্যৎ, বর্তমান–এই বর্তমান
হৃদয়ে বিরস গান গাহিতেছে আমাদের-বেদনার আমরা সন্তান?
বিশ্বসংসার নিয়ে একটা গম্ভীর হতাশার ইঙ্গিত সেসব কবিতায় :
এদিকে কোকিল ডাকছে–পউষের মধ্যরাতে;
কোনো একদিন বসন্ত আসবে বলে?
কোনো একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার?
তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হয়ে যেতে দেখেছি,
তারা কিশোর নয়,
কিশোরী নয় আর;
কোকিলের গান ব্যবহৃত হয়ে গেছে।
সিংহ হুংকার করে উঠছে :
সার্কাসের ব্যথিত সিংহ,
স্থরিব সিংহ এক–আফিমের সিংহ–অন্ধ-অন্ধকার।
… … …
কোকিলের গান
বিবর্ণ এঞ্জিনের মতো খসে-খসে
চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।
হে পৃথিবী,
হে বিপাশামদির নাগপাশ,–তুমি
পাশ ফিরে শোও,
কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর।
জীবনানন্দের মনে হচ্ছে তেজ, আনন্দ, উজ্জ্বলতা সব হারিয়ে যাচ্ছে। এখন কোথাও যেন আর বসন্ত নেই, একসময় ছিল হয়তো, আবার হয়তো আসবে। কিন্তু এখন সব স্থবির। সার্কাসের সিংহের মতো। তেজ ছিল একসময় এখন আফিম খেয়ে ঝিমাচ্ছে, ব্যথিত, অন্ধ।
.
০২.
পুরোনো পৃথিবী যেন নষ্ট হয়ে গেছে, নতুন পৃথিবীর জন্ম হয়নি, আমরা একটা মাঝামাঝি অবস্থায় আটকে আছি :
আমরা মধ্যম পথে বিকেলের ছায়ায় রয়েছি
একটি পৃথিবী নষ্ট হয়ে গেছে আমাদের আগে;
আরেকটি পৃথিবীর দাবি
স্থির করে নিতে হলে লাগে
সকালের আকাশের মতন বয়স;
সে-সকাল কখনো আসে না ঘোর, স্বধর্মনিষ্ঠ রাত্রি বিনে।
এ সময় অদ্ভুত সব লোকের কথা মনে হয় জীবনানন্দের। তাঁর মনে পড়ে অনুপম ত্রিবেদীকে যে ভীষণভাবে দ্বিধাদীর্ণ এক মানুষ, জড় আর অজড় যাকে দুকান ধরে দুদিক থেকে টানে :
এখন শীতের রাতে অনুপম ত্রিবেদীর মুখ জেগে ওঠে।
যদিও সে নেই আজ পৃথিবীর বড়ো গোল পেটের ভিতরে
সশরীরে; টেবিলের অন্ধকারে তবু এই শীতের স্তব্ধতা
এক পৃথিবীর মৃত জীবিতের ভিড়ে সেই স্মরণীয় মানুষের কথা
হৃদয়ে জাগায়ে যায়; টেবিলে বইয়ের স্তূপ দেখে মনে হয়
যদিও প্লেটোর থেকে রবি ফ্রয়েড নিজ-নিজ চিন্তার বিষয়
পরিশেষ করে দিয়ে শিশিরের বালাপোশে অপরূপ শীতে
এখন ঘুমায়ে আছে–তাহাদের ঘুম ভেঙে দিতে
নিজের কুলুপ এঁটে পৃথিবীতে–ওই পারে মৃত্যুর তালা
ত্রিবেদী কি খোলে নাই? তান্ত্রিক উপাসনা মিষ্টিক ইহুদী কাবালা
ঈশার শবোখান–বোধিদ্রুমের জন্ম মরণের থেকে শুরু করে
হেগেল ও মার্ক্স : তার ডান আর বাম কান ধরে
দুই দিকে টেনে নিয়ে যেতেছিলো;
… … …
জড় ও অজড় ডায়ালেকটিক মিলে আমাদের দু-দিকের কান
টানে বলে বেঁচে থাকি–ত্রিবেদীকে বেশি জোরে দিয়েছিলো টান।
এই সব কবিতায় আসা সন্দেহের এই পৃথিবী ছাড়িয়ে এক মহাপৃথিবীর দিকে যেন যেতে চাইছে জীবনানন্দের মন।
.
সফলতা নিষ্ফলতার সমীকরণ
০১.
কিন্তু মহাপৃথিবী বইটা একেবারেই পছন্দ হলো না বুদ্ধদেবের। নতুন বান্ধব সঞ্জয় এসে হাত ধরলেন, পুরোনো বান্ধব এবার ছেড়ে দিলেন জীবনানন্দের হাত। এই প্রথম প্রকাশ্যে জীবনানন্দের বিরোধিতা করলেন বুদ্ধদেব বসু। একটা প্রবন্ধে বুদ্ধদেব লিখলেন, জীবনানন্দ দাশ কি লিখছেন আজকাল? এ প্রশ্ন সাধারণ পাঠক করতে পারেন, আমরা তার অদ্বিতীয় ভক্ত বলে বিশেষভাবে করতে পারি। অন্যদের বাদ দিয়ে বেছে বেছে তার নাম করলুম এই কারণে যে উদাহরণ হিসেবে তিনি সর্বলক্ষণ সম্পন্ন। জীবনানন্দ দাশ আমাদের নির্জনতম স্বভাবের কবি। এই নির্জনতার বিশিষ্টতাই তাঁর প্রাক্তন রচনাতে দীপ্যমান। মনে মনে এখনো তিনি নির্জনের নিঝর, তার চিত্ততন্ত্রী এখনো স্বপ্নের অনুকম্পায়ী। কিন্তু পাছে কেউ বলে তিনি এস্কেপিষ্ট, কুখ্যাত আইভরি টাওয়ারের নিখোঁজ অধিবাসী, সেইজন্য ইতিহাসের চেতনাকে তার সাম্প্রতিক রচনার বিষয়াভূত করে তিনি এইটেই প্রশ্ন করবার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন যে তিনি পিছিয়ে পড়েননি। করুণ দৃশ্য এবং শোচনীয়। এর ফলে তার প্রতিশ্রুত ভক্তদের চক্ষেও তার কবিতার সম্মুখীন হওয়া সহজ আর নেই। দুর্বোধ্য বলে আপত্তি নয়, নিঃসুর বলে আপত্তি, নিঃস্বাদ বলে।
বুদ্ধদেব জীবনানন্দকে যে প্রেক্ষাপটে খুঁজে পেয়েছিলেন, তাঁকে সেই প্রেক্ষাপটেই দেখতে চান নির্জন, স্বপ্নচারী, প্রকৃতিপ্রেমিক। কিন্তু জীবনানন্দ ইতিমধ্যে জীবনের ঘাট, আঘাটা পথে হেঁটে হয়েছেন অন্য মানুষ। বুদ্ধদেব এই নতুন জীবনানন্দকে আর চিনতে পারছেন না। জীবনানন্দ যে একটা নতুন চেতনার চরে পৌঁছেছেন, সেটা আর ধরতে পারছিলেন না বুদ্ধদেব বসু। ইতিমধ্যে বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দের চেয়েও খ্যাতিমান হয়ে উঠেছেন। অগণিত কবিতা, উপন্যাসের বই প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসুর বন্দীর বন্দনা কাব্যগ্রন্থের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন কিন্তু জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথকে দুই-দুইটা কবিতার বই পাঠানো সত্ত্বেও তিনি এক-দুই লাইনের মন্তব্য করেছেন মাত্র। বুদ্ধদেব বসু এমন বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন যে পত্রিকায় তাঁর বিয়ের সংবাদও বেরিয়েছিল, বেরিয়েছিল তাঁর সহসম্পাদক অজিতকুমার দত্তের বিয়ের খবরও। সেখানে কোন কোন সাহিত্যিক উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁদের নামের লিস্টও দেওয়া হয়েছিল পত্রিকায়। না, জীবনানন্দ সেখানে আমন্ত্রিত হননি। তিনি মনে কষ্ট পেয়েছিলেন তাতে, ডায়েরিতে সে কথা লিখেছেন, I remember Ajits marriage as published in papers in those days & also newspaper report of Budhdhas marriage–I was not invited though almost all important lit. figure were: I read the list of names in papers…
.
০২.
যদিও বুদ্ধদেব তাঁর বয়সে অনেক ছোট, ছিলেন জীবনানন্দের সাহিত্যের অনুরাগী, দীর্ঘদিন ছিলেন জীবনানন্দের কবিতার একনিষ্ঠ প্রহরী, তারপরও গোপনে বুদ্ধদেবের প্রতি একটা ঈর্ষা, সন্দেহ, প্রতিযোগিতার ব্যাপার ছিল জীবনানন্দের। সে ব্যাপারটা টের পাওয়া গেল তার সফলতা নিষ্ফলতাউপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পাওয়ার পর। এই উপন্যাসের তিনজন চরিত্র লেখালেখিকেই জীবনের ব্রত করতে চায়। তিনজনের মধ্যে নিখিল চরিত্রের সঙ্গে জীবনানন্দের মিলটা বোঝা যায়। অন্য দুজন চরিত্র বানেশ্বর এবং শঙ্করের সঙ্গে তার সে সময়কার পরিচিত সাহিত্যিকদের আদল আছে। বানেশ্বর চরিত্রটার ভেতর স্পষ্টতই আছে বুদ্ধদেব বসুর ছায়া। নিখিল বানেশ্বরের চেয়ে বয়সে বড়, তবে নিখিলের চেয়ে বানেশ্বরের সাহিত্যিক খ্যাতি বেশি। বানেশ্বর নানা রকম বইপত্র লিখে নাম এবং টাকা কামাচ্ছে। সেসব বই বেশ বাজার-চলতি। উপন্যাসের এক জায়গায় নিখিল বানেশ্বরকে বলছেন, সে এক দিন ছিলো বানেশ্বর বাবু, যখন আপনি একটা কাগজ চালাতেন–একটা কবিতা পাঠালেই সেটার সম্বন্ধে তিন পৃষ্ঠা মন্তব্য এমনি আমাকে লিখে পাঠাতেন। আপনার মত ডিভোশন নিয়ে কেউ আমার কবিতা পড়ে দেখেনি–আমার জিনিষ কেউ ছাপায়নি এত–আপনার কাছ থেকে আমি যথেষ্ট আস্কারা পেয়েছি–এ ঋণ আমি ভুলতে পারব না কোনদিন বানেশ্বর বাবু…
এখানে জীবনানন্দ আর বুদ্ধদেবের সম্পর্কের ছায়া স্পষ্টই।
তবে বানেশ্বর এখন যেসব গল্প-উপন্যাস লিখছে, নিখিল সেগুলোকে ছেলেমানুষি মনে করে। সেসব গল্পে শুধু প্রেম, যৌনতা এসব। যদিও বানেশ্বর বলে, এসব গল্প ছেলেমানুষি নয়, এসব গল্প লিখতে সাহস লাগে, সেই সাহস আপনার নেই।
জবাবে নিখিল বলে, কিন্তু আমার কুকুরের আছে, ফি বছর আষাঢ় শ্রাবণ মাসে দিনের আলোয় সকলের সামনে পিতা হবার নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টায় কোন দিনও তার দ্বিধা নেই–ভয় নেই–পশ্চাৎপরতা নেই; ঢিল মারলেও পালায় না।
বানেশ্বরের ওই ধরনের গল্প লেখা রাস্তার কুকুরের সংগম করার মতোই। ব্যাপার নিখিলের কাছে। স্মরণ করা যেতে পারে বুদ্ধদেব বসুর লেখা রজনী হলো উতলা নামে এক গল্প নিয়ে তখন অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল।
সফলতা নিষ্ফলতা উপন্যাসে দেখা যাচ্ছে, বানেশ্বর গল্প লেখার পর বসে মাস্টারবেট করে। বানেশ্বর বলে, গল্প তৈরী হয়ে গেছে–তারপর আমার গল্পের সমস্ত মেয়েমানুষের অভাব আমি না হয় আমার গল্পটা শেষ করে সব ভুলে গিয়ে এই সোফায় বসেই–সেই শরীরের আস্বাদটাই মিটিয়ে নিলাম।
নিখিল জানতে চায়, তারপরে একটা নিষ্কৃতি বোধ করেন নাকি?
কেন?
উপভোগ হলো অথচ দাম্পত্যের বোঝা বহন করতে হলো না।
বাস্তবিক স্ত্রী থাকলে একটা অলম্বুশের মত মনে হতো তাকে তখন।
বাইরে বেরিয়ে পয়সা খরচ করার চেয়েও।
বানেশ্বর একটা সিগারেট জ্বালাল, বলল, বাস্তবিক, স্ত্রী মেয়েমানুষের লাশের মতো একটা অলম্বুশ জিনিস বিছানায় পড়ে নেই বলে তখনই সবচেয়ে বেশী শান্তি বোধ করি।…আমি হুইস্কি সঙ্গে রাখি।…তারপর দুটো ডিম ফেটিয়ে খানিকটা সোডা পোর্টের সঙ্গে মিশিয়ে খাই…তারপর এক গ্লাস আন্দাজ নির্জলা সোডা হুইস্কি–
বানেশ্বরকে দেখা যায় সার্বিকভাবে ভোগী একজন চরিত্র হিসেবে। বানেশ্বর বলছে, এম এ পাশ করা হয়ে গেছে–লিখে নাম করেছি : জীবন এখন আয়েসও চায়–আমার চেয়ে অনেক নীচু দরের লোক অনেক বেশী আরাম করছে, তাদের সুন্দরী বউ-ফার্স্ট ক্লাস সোফা–সামবিম কার–টেবিলে হুইস্কি-কুষ্ঠের ভয়ে সোফায় ঘষড়াব না? জীবনে পেলাম কী তাহলে? নারীকে বুঝতে গিয়ে সিফিলিস গনোরিয়ার ভয় কোনও দিন কি আমাকে ঠেকাতে পেরেছে, নিখিল বাবু?
.
বানেশ্বরের বই বেশ বিক্রি হলেও তার সম্পর্কে পাঠকের কী ধারণা, সে বিষয়ে নিখিলের মত, বানেশ্বরকে মনে মনে অবিশ্যি এরা সকলেই ঠাট্টা করে–এর পদপ্রতিভা যে এক ঢিবি বালি দিয়ে তৈরী, নিভৃতে সকলেই তা জানে…
উপন্যাসে নিখিল বানেশ্বরের যখন প্রশংসা করে, তখন তাতে থাকে। একধরনের ব্যঙ্গ। নিখিল বলে, বানেশ্বরকে দেখেই প্রথম চমকালাম–তার চেহারার সৌন্দর্যের জন্য নয়–কিন্তু মনের সাধ ও সাহসের জন্য; সাহিত্যে এই জিনিসগুলো তাকে হাড়হাভাতে করে তুলেছে বটে–কিন্তু জীবনে তাকে বেশ আলাচানাচানাচুর মানুষ করে রেখেছে; আমি নোনতা ও ঝাল খুব ভালোবাসি; একটু একটু ঠান্ডা লেবুর রসও আছে, এমন হিমশান্তি দেয়।
.
০৩.
কেতকী কুশারী ডাইসন জীবনানন্দের সফলতা নিষ্ফলতা বইটাকে কেন্দ্র করে একটা বড়সড় বই লিখেছেন তিসিডোর নামে। কেতকী এই প্রস্তাবই করছেন যে সফলতা নিষ্ফলতা উপন্যাসটা জীবনানন্দ বুদ্ধদেবের ওপর ঈর্ষান্বিত হয়েই লিখেছেন। বুদ্ধদেব সফল আর জীবনানন্দ নিষ্ফল। কেতকী বলছেন, এই উপন্যাসের ভেতর দিয়ে জীবনানন্দের একটা অপরিচিত দিক আমাদের সামনে খুলে যায়, যেন চাঁদের উল্টো পিঠ। তার মনের অন্ধকার, মালিন্যময় দিক সেটা। কেতকী লিখেছেন, নিরাপত্তাবোধের এতটাই অভাব ছিলো তার মধ্যে যে অনুজপ্রতিম লেখকের অল্প একটু প্রতিষ্ঠাতেই তিনি এতদূর বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন? এ তো এক রকমের হীনম্মন্যতাবোধ।
কেতকী মনে করেন, বানেশ্বরের সাথে নিখিলেন সম্পর্কের যে ছবি জীবনানন্দ এঁকেছেন, তাতে তার ষ্টাটাস এ্যাংজাইটি প্রকাশ পায়। জীবনে, সাহিত্যে নিজের অবস্থা নিয়ে জীবনানন্দের একটা সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাহীনতার বোধ ছিল। আর এই যে বুদ্ধদেব আদলের চরিত্রটাকে নিয়ে তিনি ব্যঙ্গ করছেন, একে কেতকী ব্যাখ্যা করেছেন মনোবিজ্ঞানী গুস্তাফ ইয়ুংয়ের শ্যাডো তত্ত্ব দিয়ে। ইয়ুংয়ের ছায়াতত্ত্ব আসলে আমাদের ব্যক্তিত্বের অজানা অন্ধকার অলিগলি। জীবনে পথ নির্বাচনের একটা প্রয়োজন সবার থাকে কিন্তু একটা পথ বেছে নিলে অন্য পথগুলো আর পরিক্রমা করা হয় না। সেই অনির্বাচিত পথগুলো মিলিয়েই গড়ে ওঠে আমাদের ছায়া। নির্বাচিত পথ আমাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশকে একটা বিশেষ দিকে ঠেলে দেয়। যা হতে পারতাম কিন্তু হলাম না, যা কিছু করতে পারতাম কিন্তু করলাম না, আমাদের সেই অযাপিত জীবনই ছায়া হিসেবে দেখা দেয়। কেতকী লিখছেন, জীবনানন্দের ছায়া স্বত্তার মধ্যে যত রকমের নঙঅর্থক অনুভূমি জমে উঠেছিলো–অতৃপ্তি, অযাপিত জীবন, অভিমান, ক্রোধ, ঈর্ষা, চেয়ে না পাওয়া, আশাভঙ্গ, অক্ষমতার গ্লানিবোধ-সব যেন তিনি তৃণ থেকে বাণের মতো একটা একটা করে নামিয়ে তার স্বহস্তে প্রস্তুত কুশপুত্তলিকার দিকে ছুঁড়ে মেরেছেন। আর যাকে সুপরিকল্পিতভাবে এতগুলো বাণের লক্ষ করেছেন, শাণিত বিদ্রুপে তারই নাম রেখেছেন বানেশ্বর।
জীবনানন্দকে কেতকী বলেছেন জটিল, স্বরান্বিত, ব্যতিক্রমী, কমপ্লেক্স সমন্বিত, অনিশ্চয়তাবোধ দ্বারা আক্রান্ত, অন্তর্মুখী, কিছুটা ডিপ্রেসিভ, একাকিত্ব পীড়িত, দ্বন্দ্বদীর্ণ আধুনিক মনের মানুষ…
কথা সত্য বটে।
.
০৪.
জীবনানন্দের পক্ষের একসময়ের সেই একমাত্র যোদ্ধা বুদ্ধদেব বসু যখন জীবনানন্দকে মাঠে একা রেখে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেছেন, তখন জীবনানন্দের পক্ষে দাঁড়ালেন নতুন দুজন। একজন সেই সঞ্জয় ভট্টাচার্য, যিনি প্রকাশ্যে সরব রইলেন জীবনানন্দের পক্ষে। তিনি নিরুক্ত পত্রিকায় লিখলেন, যৌবনের শেষে স্থবিরতার পথে সত্যকে খুঁজতে এগিয়ে গেছেন জীবনানন্দ।…এখন আর চোখ তাঁর স্বপ্নমেদুর নয়, জিজ্ঞাসায় তা প্রখর।…দেখলেন, আজকের দিনের জীবন আমাদের জটিল সমস্যায় ঘেরা। বিংশ শতাব্দীর প্রশ্নসমাকীর্ণ জীবনকে যখন তিনি বুঝতে চাইলেন তখন তার ভাষা থেকেও স্বপ্নের সেই প্রাক্তন কোমল ঋজুতা ঝরে পড়েছে, এসেছে তাতে গদ্যভঙ্গি, মিশেছে জটিলতা…।
আর বেশ অপ্রত্যাশিতভাবে এই সময় জীবনানন্দ পেলেন আরেক অচেনা মেধাবী অনুরাগীকে। তিনি কোনো লেখক কবি নন, নেহাতই একজন অখ্যাত পাঠক। প্রভাকর সেন নামের এক পাঠকের চিঠি পেয়ে বেশ বিস্মিত হয়েছিলেন জীবনানন্দ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সদ্য এমএ পাস করা এই যুককের চিঠি তিনি পান বরিশালে বসে। জীবনানন্দের কবিতাকে তিনি কীভাবে বোঝেন, সে কথাই প্রভাকর চিঠিতে লিখে জানান জীবনানন্দকে। জীবনানন্দ অবাক হয়ে লক্ষ করেন, তাঁর কবিমানসকে ঠিক এভাবে এত গুছিয়ে এর আগে কেউ বিশ্লেষণ করেনি। প্রভাকর লিখেছেন, …আমার সাহিত্যিক জ্ঞান খুবই সীমাবদ্ধ ও কখনো তা পরীক্ষার নিয়মানুগ পথে আহরিত হয়নি। সুতরাং আপনার কবিতার রস সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করবার উপযুক্ত নিশ্চয়ই আমি নই। তবু আপনাকে পড়ে আপনার সম্বন্ধে যে কয়টি ধারণা আমার হয়েছে তা আমি যাচাই করে নিতে চাই আপনারই কাছ থেকে।
আমার প্রথম ধারণা হচ্ছে আপনার কবিতা লেখার পদ্ধতি সম্বন্ধে। আমার মনে হয় আপনি যখনি ভাবাক্রান্ত হন তখনি আমাদের দেশের অন্যান্য হাজার কবিদের মত কলম ধরেন না। সমগ্র ভাবটা বিভিন্ন আঙ্গিকের পোষাকে ভেবে অথবা অনুভব করে নেন একই অথবা বিভিন্ন সময়ে। যার ফলে আপনার কবিতার প্রত্যেকটি আঙ্গিক অন্য প্রত্যেকটি আঙ্গিককে স্পষ্ট করে ও সুমঞ্জস করে তোলে! এতে করে কোন একটা বিশেষ ছত্রের দাম হয়তো ক্ষুণ্ণ হয় কিন্তু সমস্ত নক্সাটার উজ্জ্বলতা চোখে পড়ে বেশী করে। সোজা কথা আপনার প্রত্যেকটি অক্ষর আপনার আবেগের সমান অংশীদার হয়ে ওঠে। এ ধারণা কি সত্যি? এ প্রশ্ন করলাম যে আমাদের যাবতীয় কবিরা এভাবে তাদের রচনা পদ্ধতিকে দেখেন না বলেই আমার মনে হয়…।
আমার দ্বিতীয় ধারণা আপনার কাব্যপ্রেরণার উৎস সম্বন্ধে। মনে হয় আপনার আধুনিক সব লেখাগুলির শিকড় রয়েছে নিরবধি কাল ও ধূসর প্রসূতির চেতনার মধ্যে। বিশেষ করে কাল চেতনার মধ্যে, যাকে বলা যেতে পারে ইংরাজি time consciousness আমার ধারণা কি সত্যি। আমি এ প্রশ্ন করলাম এই জন্য যে আমাদের দেশের খুব কম কবির মধ্যেই এই time consciousness, consciousness of time as a universe দেখা যায়। দেখা যায় না বল্লেই চলে। আর সেজন্যই মাফ করবেন আপনার কবিতা সাহিত্যের বড় বাজারে কাটে না, কাটে সাহিত্যের চোরা বাজারে যেখানে আমরা দুএকজন থাকি অনেক বেশী দাম দিয়ে, অনেক ক্ষতি স্বীকার করে, অনেক কাঁটায় ক্ষত বিক্ষত হয়ে পাহাড়ের চূড়ায় চড়বার জন্য তৈরী হয়ে, কৃষ্ণনীল সময়ের ডানায় নিজেদের ভয়ে ভয়ে বেঁধে নক্ষত্র থেকে কোটি আলোক বৎসরের সমুদ্র পাড়ি দেবার জন্য তৈরী হয়ে। বিশ্বাস করুন।
আমার তৃতীয় ধারণা আপনার ইতিহাস-দর্শন সম্বন্ধে। আমার মনে হয়, যেহেতু আপনি কালের উড়ে যাওয়া সম্বন্ধে সচেতন, কোন বিশেষ যুগকে বা বিশেষ ব্যবস্থাকে, এমনকি স্বয়ং মানুষকেও আপনার পক্ষে চরম ভেবে আঁকড়ে থাকা যুক্তিযুক্ত নয়। আঁকড়ে থাকতে চান কিন্তু বোধহয় পারেন না। তবু আপনি নিজে রক্তে মাংসে সৃষ্ট, মানুষী চেতনায় আপনি পরিপূর্ণ, সেজন্যই বোধহয় মানুষের ভবিষ্যতে বিশ্বাস করতে আপনার ভালো লাগে, ইচ্ছা হয়। আমার এ ধারণা কি সত্যি? আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য এই যে আমি দেখেছি আমাদের দেশে রবীন্দ্রোত্তর সমস্ত কবিরাই হয় জীবনের ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ আনাস্থা জানিয়েছেন (অবশ্য অত্যন্ত স্থল সীমাবদ্ধ ব্যবস্থার অর্থে) অথবা একেবারে সম্পূর্ণ আস্থা জানিয়েছেন (উক্ত অর্থে)। কেউ কাল প্রসৃতির পটভূমিকায় জীবনের সম্ভাবনাকে বিচার করেছেন বলে মনে হয় না।
চিঠিটা পড়ে জীবনানন্দের মনে হলো, তিনি যেন নিজেই নিজেকে নতুন করে চিনলেন। জীবনানন্দ প্রভাকরকে অনেক প্রশংসা করে চিঠির উত্তর দিলেন, এমনকি যেচে এই অচেনা পাঠককে অনুরোধ করলেন, তিনি যেন তার বইয়ের ওপর পত্রিকায় একটা রিভিউ লেখেন। চিঠিতে জীবনানন্দ লিখলেন, …আমার কাব্য আলোচনা করে আপনাকে ছাপাতে অনুরোধ করা যদিও আত্মরতি একরকম, তবুও সাহিত্যের বিশেষত আমার কবিতা সম্পর্কে এমন একজন শিল্পামোদী, সুস্পষ্ট বিশেষজ্ঞকে চুপ করে থাকতে দেখলে কুণ্ঠা বোধ করবো…
প্রভাকর জীবনানন্দকে নিয়ে কোনো আলোচনা লেখার সাহস পাননি, তবে জীবনানন্দ নিজেই প্রভাকরের কথাগুলো অনেকটুকুই ধার করে লিখেছেন একটা প্রবন্ধ, যাতে তিনি তাঁর কবিতার সত্তাকে ব্যাখ্যা করেছেন।
.
সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে
০১.
ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। ভারতে তখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তীব্র হয়েছে ভারত ছাড় আন্দোলন। ভারত স্বাধীন হবে এমন আলোচনা শুরু হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে চলছে নানা জটিলতা। চলছে গান্ধী, নেহরু, জিন্নাহর দ্বন্দ্ব। হিন্দু-মুসলমানের সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়ে যাবে কি না, তার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। হিন্দু-মুসলমানের ভেতর দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। এ সময় জীবনানন্দ বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে লাগলেন কলকাতায় চলে যাবেন কি না। তাঁর প্রধান আকর্ষণ কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। পরিস্থিতি বুঝবার জন্য এবং সম্ভাবনাগুলো যাচাই করার জন্য কলেজ থেকে দুই মাসের ছুটি নিয়ে জীবনানন্দ গেলেন কলকাতা। গিয়ে অশোকানন্দের বাড়িতে উঠলেন।
কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে, তিনি যখন কলকাতায়, ঠিক সেই সময়টাতে একদিন সেখানে এক বড় দাঙ্গা বাধল হিন্দু-মুসলমানে। সেদিন ছিল ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট। এক মারাত্মক দাঙ্গায় হিন্দু-মুসলিম উভয় পক্ষেই অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জীবনানন্দ পড়ে গেলেন সেই দাঙ্গার ভেতর। ক্রিক রো দিয়ে বাড়িতে ফিরছিলেন, হঠাৎ দেখলেন একদল লোক ছুরি, রামদা নিয়ে ছুটে আসছে, রাস্তার লোকজন সব দৌড়ে নানা দিকে পালাচ্ছে, আশপাশের বাড়ির দরজা-জানালা সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সামনে দিয়ে তখন একটা পুলিশ ভ্যান আসছে। লোকজন সব লুকিয়ে গেলেও জীবনানন্দ পরিস্থিতির আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। রাস্তায় আর কেউ নেই, ভ্যান এসে দাঁড়ায় তার সামনে। পুলিশ অফিসার তার বুকের ওপর বন্দুক ধরে বললেন, আই থিংক ইউ আর দ্য রিং লিডার অব দিস এরিয়া। জাস্ট গেট অন। পুলিশ তাকে ভ্যানে উঠিয়ে নিয়ে যায় থানায়। থানায় তাঁকে বসিয়ে রাখা হয়। জীবনানন্দ দেখলেন, থানায় তার মতো এমন আরও কয়েকজনকে ধরে এনে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলেন। একসময় জানতে চাইলেন, কতক্ষণ এখানে বসে থাকতে হবে? পুলিশ বলে, চুপচাপ বসে থাকেন, ওসি এলে তারপর ঠিক হবে। বিকেলে তাঁদের ধরে আনা হয়েছিল, সন্ধ্যার দিকে ওসি এলেন। সব পুলিশ শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। ওসি এসে দাঁড়ালেন গ্রেপ্তারকৃতদের সামনে। ওসি সবাইকে ভালো করে দেখতে গিয়ে চোখ পড়ল জীবনানন্দের দিকে। তাঁকে দেখেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে কাছে গিয়ে একেবারে পা ধরে প্রণাম করে বললেন, এ কী স্যার, আপনি এখানে কেন? জীবনানন্দ কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। বললেন, তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না। ওসি তখন তাঁর মাথার ক্যাপটা খুলে বলেন, আমার নাম আজহারুদ্দীন আহমেদ, আমি আপনার ছাত্র ছিলাম স্যার, বিএম কলেজে। জীবনানন্দ ঘটনা তাঁকে জানালেন। সেই ওসি অত্যন্ত বিব্রত হয়ে বললেন, আমি স্যার ওদের সবার হয়ে ক্ষমা চাইছি। আপনি আসুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।
হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সেই ঘোরকালে এক মুসলমান ওসির সুবাদে সেদিন মুক্ত হলেন জীবনানন্দ দাশ, নইলে হয়তো বনলতা সেনের কবিকে দাঙ্গার রিং লিডার হিসেবেই জেল খাটতে হতো। কিন্তু ওই দিনের এই দাঙ্গার ঘটনা জীবনানন্দকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। বরিশালে ফিরে লিখলেন :
মানুষ মেরেছি আমি–তার রক্তে আমার শরীর
ভরে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার
ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু
হৃদয়ে কঠিন হয়ে বধ করে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর
কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে
বধ করে ঘুমাতেছি
… … …
যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হয়ে
বলে যাবে কাছে এসে, ইয়াসিন আমি,
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ
আর তুমি? আমার বুকের পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে শুধাবে সে–রক্তনদী উদ্বেলিত হয়ে
বলে যাবে, গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার;
মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রিটের, এন্টালীর–
কোথাকার কে বা জানে;
… … …
অখণ্ড অনন্তে অন্তর্হিত হয়ে গেছে;
কেউ নেই, কিছু নেই–সূর্য নিভে গেছে।
.
০২.
দাঙ্গার ভেতর থেকে ফিরে আসার পর বরিশালে বসে জীবনানন্দ আবার দোলাচলে পড়ে গেলেন কলকাতায় যাবেন, না বরিশালে থাকবেন। দেশভাগ নিয়ে গান্ধী, নেহরু, জিন্নাহর বাদানুবাদ চলছে তখন। মানুষের ভেতরও তখন এই নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক। ভারতের নানা জায়গায় ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এই সময় নোয়াখালীতে বিরাট এক দাঙ্গা হলো। গান্ধী নিজে এলেন সেই দাঙ্গা থামাতে। বরিশালে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল যে এখানেও দাঙ্গা হবে। পূর্ব বাংলা মুসলমানদের দেশ হবে এই নিয়ে জোর আওয়াজ। হিন্দুরা আতঙ্কে রইল। চারদিকে গুজব উঠল যে বিহার থেকে হাজার হাজার মুসলমান সব পূর্ব বাংলায় ঢুকছে, তারা বরিশালের দিকেও আসছে। শোনা গেল, বিহারের মুসলমানরা এ অঞ্চলের হিন্দুদের আর থাকতে দেবে না। বিএম কলেজের হিন্দু শিক্ষকেরা অনেকেই কলকাতায় পাড়ি জমাতে শুরু করলেন তখন। জীবনানন্দ কলকাতায় যেতে চেয়েছিলেন শিল্প-সাহিত্যের একটা বড় প্রেক্ষাপটে পড়বার জন্য কিন্তু এভাবে আতঙ্কে পালিয়ে যাবার কথা তিনি ভাবেননি কখনো। এদিকে পরিস্থিতি যত ঘোলাটে হতে থাকল, কলকাতা থেকে ভাই অশোক, বোন সুচরিতা চিঠির পর চিঠি দিতে লাগলেন, তাগাদা দিতে লাগলেন যে বরিশালে থাকা আর মোটেও নিরাপদ নয়, তিনি যেন চলে আসেন কলকাতায়।
কিন্তু এভাবে তাড়া খেয়ে নিজের দেশ থেকে চলে যাবার জন্য জীবনানন্দ তখন মোটেও প্রস্তুত নন। এ সময় কলেজে পূজার ছুটি হলো। জীবনানন্দ কলকাতায় গেলেন লাবণ্য আর ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে। জিনিসপত্র তেমন কিছু সঙ্গে নিলেন না, কিন্তু সঙ্গে করে নিলেন তাঁর কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সেই ট্রাঙ্কগুলো, যেখানে গোপনে রেখে দিয়েছেন তাঁর অগণিত অপ্রকাশিত লেখার পাণ্ডুলিপি। মনে একটা আশঙ্কা ছিল, যদি আর আসা না হয়? কলকাতায় গিয়ে উঠলেন অশোকের বাড়িতে। সেখানে তার মা-ও আছেন। জীবনানন্দ ঠিক কলকাতায় থেকে যাবেন, তেমন সিদ্ধান্ত তখনো নেননি। কলকাতায় এসে বিএম কলেজে একটা ছুটির দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেন। বোঝা যায়, তিনি দুটো পথই খোলা রাখছেন। কলকাতায় কিছুদিন থেকে পরিস্থিতিটা বুঝতে চাইলেন। সুবিধা না হলে আবার বরিশাল ফিরে যাবেন, এমন ভাবছিলেন তখন। রামযশ কলেজে তাঁর ছুটি মঞ্জুর হয়নি কিন্তু বিএম কলেজে ছুটি মঞ্জুর হলো। কিন্তু জীবনানন্দ বরিশাল ছেড়ে আসুন, সেটা কুসুমকুমারী কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। এ সময় জীবনানন্দ ডায়েরিতে লিখেছেন : Mother however, does not like this idea-Mother hates the idea of working in Cal leaving BM College. 2) Purchasing land near Call or in W. Bengal leaving homeland & aunts lands at Barishal. 3) Showing any preference for other places & ways of life than led by my ancestors for generations at Barisal.
বিএম কলেজে চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় এসে কাজ করা, বরিশালের পূর্বপুরুষের ভিটা ছেড়ে কলকাতার পাশে কোনো জায়গা কেনার কথা ভাবতেই পারেন না মা। জীবনানন্দ একটা নোম্যানসল্যান্ডের ভেতর দিন পার করছেন তখন।
.
০৩.
জীবনানন্দ যখন এই দোলাচলে ভুগছেন, তখনই ভারতবর্ষে দুই শ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলো। স্বাধীন হলো ভারত। ব্রিটিশদের কারসাজি, ভারতীয় রাজনীতিবিদদের নানা দলাদলি, স্বার্থ মিলিয়ে তৈরি হলো একটা নয় দুটা দেশ। র্যাডক্লিফ সাহেব ইংল্যান্ড থেকে এসে ভারতের ম্যাপের ওপর পেনসিল দিয়ে দাগিয়ে দাগিয়ে নির্ধারণ করলেন দুটা দেশের ম্যাপ। একটা হিন্দুদের, অন্যটা মুসলমানের। বরিশাল পড়ল মুসলমানদের দেশে। সেখানে যেতে হলে তাঁকে এখন আটকাবে সীমান্তপ্রহরী। তিনি কি ফিরে যাবেন বরিশালে? ধৰ্মপরিচয় কখনো গুরুত্বপূর্ণ ছিল না তার কাছে। কিন্তু ধৰ্মপরিচয় তাঁর কাছে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াল তার নিজের দেশে যেতে। মুসলমানদের জন্য ঘোষিত দেশে গিয়ে তিনি কি নিরাপদে থাকতে পারবেন? কিছুদিন আগেই এক রক্তাক্ত দাঙ্গার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর। অথচ তিনি তো নিবিড় করে একদিন ডেকেছেন তাঁরই নিরন্ন মুসলিম প্রতিবেশীকে। শরৎচন্দ্রের সেই গফুর আর তার বলদ মহেশকে স্মরণ করে লিখেছেন :
‘গফুর’–নীরবে তাহাকে আমি ডাকিলাম, তবু
তবুও আমার কানে লেগে এই–এরকম বায়বীয় রোল
ততটা কৃত্রিম নয়, যতটা অসমীচীন-হিম
‘তোমার বলদ দুটো কই গেল’ ‘সে সব অনেকদিন আগে
মরে গেছে’–যেন কারু সহোদর মরে গেছে, অথবা হানিফা
নেই আর–তবুও কিছুই নেই বলে
কোথাও অন্য কিছু নেই বলে গফুরের মুখের ভিতরে
নিসর্গ নিজেই চুপে বিকেলের প্রান্তরের দোয়েলের মতো
নেমে এল….
এক নিরালম্ব মানসিক অবস্থায় কাটাতে লাগলেন জীবনানন্দ। তাঁর হাতে তখনো বিএম কলেজের ছুটির অনুমোদনের চিঠি। যত দিন গেল তিনি টের পেলেন যে দেশ তার হাতছাড়া হয়ে গেছে। তিনি হয়ে গেছেন অন্য এক দেশের বাসিন্দা। তিনি দেখলেন, এপারের মানুষ ওপারে আর ওপারের মানুষ এপারে জায়গা বদলের, সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছাড়ার এক মর্মান্তিক যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। জীবনানন্দ বিহ্বল হয়ে এই অভূতপূর্ব মানবস্রোত দেখতে লাগলেন। সীমানার দুপারে উদ্বাস্তু মানুষের ভিড়, নিলামে বিক্রি হচ্ছে বাড়িঘর, অচেনা পরিমণ্ডলে একে অপরকে আড়চোখে দেখছে। তিনি লিখলেন :
…দিনের আলোয় ঐ চারিদিকে মানুষের অস্পষ্ট ব্যস্ততা;
পথে ঘাটে ট্রাক ট্রামলাইনে ফুটপাতে,
কোথায় পরের বাড়ি এখুনি নিলেম হবে–মনে হয়,
জলের মতন দামে।
সকলের ফাঁকি দিয়ে স্বর্গে পৌঁছুবে
সকলের আগে সকলেই তাই…
বাংলার লক্ষ গ্রাম নিরাশায় আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল।
সূর্য অস্তে চলে গেলে কেমন সুকেশী অন্ধকার
খোঁপা বেঁধে নিতে আসে–কিন্তু কার হাতে?
আলুলায়িত হয়ে চেয়ে থাকে–কিন্তু কার তরে?
হাত নেই–কোথাও মানুষ নেই, বাংলার লক্ষ গ্রামরাত্রি একদিন
আলপনার, পটের ছবির মতো সুহাস্যা, পটলচেরা চোখের মানুষী
হতে পেরেছিলো প্রায়, নিভে গেছে সব।
… … …
আজকে অস্পষ্ট সব? ভালো করে কথা ভাবা এখন কঠিন;
অন্ধকারে অর্ধসত্য সকলকে জানিয়ে দেবার
নিয়ম এখন আছে; তারপর একা অন্ধকারে
বাকি সত্য আঁচ করে নেওয়ার রেওয়াজ
রয়ে গেছে, সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে…
ভালো করে কোনো কথা ভাবা তখন কঠিন হয়ে উঠেছে তার কাছে। কিন্তু জায়গা পাল্টালেই যে জীবন পাল্টায় না, সে কথা এক অশ্বথগাছের মুখ দিয়ে তিনি বলিয়েছিলেন অনেক আগেই :
বলিল অশ্বত্থ ধীরে : ‘কোন দিকে যাবে বলো–
তোমরা কোথায় যেতে চাও?
এত দিন পাশাপাশি ছিলে, আহা, ছিলে কত কাছে;
ম্লান খোড়ো ঘরগুলো–আজো তো দাঁড়ায়ে তারা আছে;
এইসব গৃহ মাঠ ছেড়ে দিয়ে কোন দিকে কোন পথে ফের
তোমরা যেতেছ চলে পাইনাকো টের।
বোঁচকা বেঁধেছো ঢের–ভোলো নাই ভাঙা বাটি ফুটো ঘটিটাও;
আবার কোথায় যেতে চাও?
… … …
এখানে তোমরা তবু থাকিবে না? যাবে চলে তবে কোন পথে?
সেই পথে আরো শান্তি–আরো বুঝি সাধ?
আরো বুঝি জীবনের গভীর আস্বাদ?
তোমরা সেখানে গিয়ে তাই বুঝি বেঁধে রবে আকাঙ্ক্ষার ঘর!…
যেখানেই যাও চলে, হয় নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;
এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধূসর
ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাধো গিয়ে আকাঙ্ক্ষার ঘর!
বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর।
ব্যথাবিচ্ছেদের ধূসর কাহিনি অনিবার্যভাবে দেখা দেবে জেনেও তাঁকে জায়গা বদল করতে হলো। থেকে যেতে হলো কলকাতায়।
.
০৪.
দেশভাগের পর কোনটা যে নিজের দেশ, এ নিয়ে মনে যে এক বায়বীয় অবস্থা তৈরি হয় জীবনানন্দের, সে ইঙ্গিত পাওয়া যায় এ সময় লেখা তাঁর উপন্যাস জলপাইহাটিতে। ভারতকে তখন বলা হতো ইউনিয়ন। তিনি যে নিশীতবাবুর কথা লিখেছেন তাতে স্পষ্টই তার ছায়া, নিশীতবাবু যে পাকিস্তান ছেড়ে ইউনিয়নে চলে গেছেন এটা আমাদের আবিষ্কার, তিনি নিজে জানলেন না যে। তিনি ইউনিয়নে গেছেন, তিনি যে পাকিস্তানে ছিলেন সে ধারণাও তার নেই। পাকিস্তান বা ইউনিয়ন বা কোনো পলিটিকস নয়, অন্য জিনিস তাঁকে বায়ুভূত করেছে। পাকিস্তান সৃষ্টি হবার অনেক আগে গত চার-পাঁচ বছর ধরেই তিনি কলকাতায় কাজের চেষ্টায় আছেন। তাঁর কলেজ তাঁকে তাঁর প্রাপ্য দেয়নি, তাঁর পরিবারও তাকে ঠকিয়েছে, এসব বিষয়ে শেষের দিকে তিনি খুব হদ্দ হয়ে উঠেছিলেন। কলকাতায় কেউ তাঁর চেঁকি কলে পাড় দিতে আসবে না–পড়ে থাকবে উেঁকিটা। এখানে বসে আমরা তাঁকে ইউনিয়নের শ্রীখোল মনে করে তবলায় চাটি মারছি। এসব মানুষ আজকের পৃথিবীতে প্রাপ্য তো দূরের কথা। কোনো পথই খুঁজে পান না।
তেমনি তাঁর বাসমতির উপাখ্যান উপন্যাসে লিখেছেন, ও–তুমি ভেবেছ পাকিস্তানে যাবে? প্রভাতবাবু এতক্ষণে হাঁচিটা খালাস করে ফেলে বললেন।
বাসমতি ত পাকিস্তানে পড়বে।
কিন্তু কলকাতাও?
..ফজলুল হক বলেছিলেন– প্রভাসবাবু পঁাতে চুরুট আটকে রেখে বললেন, কিন্তু কাশি এসে পড়ল তাঁর, কথাটা শেষ করতে পারলেন না তিনি, চুরুট টানাও থেমে রইল কিছুক্ষণ।
..ফজলুল হক বলেছিলেন প্রভাসবাবু বললেন, কলকাতার বাড়িগুলো মোছলমান রাজমিস্ত্রিরা তৈরি করেছে, অতএব কলকাতা শহরটা মোছলমানদের।
… স্বাধীন হচ্ছে ত দেশ।
স্বাধীন হচ্ছে।
বড় পৃথিবী তোমাদের।
বড় পৃথিবীর খোঁজ পাওয়া যাবে হয় ত দেশ স্বাধীন হলে, রমা বলল। হয় ত পাওয়া যাবে না। স্বাধীনতাকেই চার অক্ষরের অমৃত মনে করলে পাওয়া অসম্ভব। আমার ভয় হচ্ছে অনেকেই মনে করবে তাই।
.
স্বাধীনতাকে চার অক্ষরের অমৃত ভেবে যারা ফুর্তি করছে, তারা যে বিপদ টের পাচ্ছে না, সেটা তিনি বুঝেছেন। জলপাইহাটি উপন্যাসে লিখেছেন, আমাদের দেশ স্বাধীন হল বলে কয়েকটি লোক ছাড়া আর-কেউ কিছু সত্যি টের পেল না, এই কথা যে আমাদের দেশের আজকের প্রাঞ্জল সত্য, এই আমি বলছি…
এসব বিশৃঙখলার ভেতর ভারত যে স্বাধীন হলো, তা যে বিরাট কোনো সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে না, সে কথা ওই উপন্যাসেই লিখেছেন, …হ্যাঁ, ওদের; আর ওদের মতন ছোকরা আর বুড়োদের। কিন্তু আমাদের কোনো মীমাংসা হবে না। মীমাংসার ভার যাদের ওপরে বাংলাদেশের সে-সব অন্ধদের ত এখনই দেখছি আমি; রাতারাতি ভোল বদলাবে এরা! এদের আওতায় সমস্ত দেশ অন্ধ, খোঁড়া, নুলো, বোবায় ভরে যাবে টাকা চাকরি ব্যবসা, সবই ওদের; দেশ স্বাধীন হল বলে ভালা লাগবে আমাদের, কিন্তু অন্য সব দিক দিয়ে খুবই খারাপ লাগবে। সপরিবারে মরেও যেতে পারি। বাসমতীতে কলেজের কাজে থাকলে খেয়ে বেঁচে থাকার খানিকটা সম্ভাবনা আছে বটে, কিন্তু কলকাতায় গেলে সপরিবারে শেষে মারা যাব কিংবা টি-বিতে না খেতে পেয়ে; স্বাধীনতার কোনো সেবকও আমাদের দিকে ফিরে তাকাতে যাবে না।
এত সব বুঝেও তাঁর হাতে কলকাতায় থেকে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। নিজের ভিটেমাটি চিরদিনের জন্য ছেড়ে তখন শুরু হলো জীবনানন্দের উদ্বাস্তু জীবন।
.
অন্য এক বড় অন্ধকার
০১.
বরিশালে আর ফেরা হচ্ছে না, ফলে ব্রজমোহন কলেজের চাকরিটা তাঁর গেল। কলকাতায় তাহলে একটা কোনো জীবিকা দরকার। কলকাতায় চাকরি খোঁজার বিভীষিকা তার মনে আছে। একটা আতঙ্ক, দিশেহারা অবস্থা তখন। এ রকম একটা সময় তাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে এলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য আর পূর্বাশা পত্রিকার মালিক সত্যপ্রসাদ দত্ত। তারা এসে একদিন জীবনানন্দকে বললেন, আপনার জন্য একটা চাকরি জোগাড় করেছি, পত্রিকায়। আপনার ভালো লাগবে। সরকারি বড় কর্মকর্তা এবং সাহিত্যিক হুমায়ুন কবিরের উদ্যোগে নতুন একটা দৈনিক পত্রিকা তখন চালু হয়েছে স্বরাজনামে। স্বাধীন দেশের আবেগকে ধরতেই এমন একটা নাম দেওয়া হয়েছিল পত্রিকাটার। বেশ তোড়জোড়েই শুরু হয়েছিল সে পত্রিকা। সঞ্জয়ই বিশেষ করে হুমায়ুন কবির আর সত্যেন্দ্রনাথকে তদবির করে পত্রিকাটার রবিবাসরীয় সাহিত্য বিভাগের দায়িত্ব জীবনানন্দকে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেন। হুমায়ুন কবির জীবনানন্দের লেখার গুণগ্রাহী, ফলে তিনিও এ প্রস্তাব সাগ্রহেই গ্রহণ করেন। জীবনানন্দের বিকল্প কোনো কিছু ছিল না তখন, তা ছাড়া শিক্ষকতায় ফিরবার আগ্রহও বিশেষ ছিল না, বেকার অবস্থায় একবার সাংবাদিকতা করার কথাও ভেবেছিলেন। বিশেষ করে দায়িত্বটা সাহিত্য পাতার, ফলে সব মিলিয়ে মনে হলো চাকরিটা জুতসই হবে। জীবনানন্দ যোগ দিলেন স্বরাজ পত্রিকায়।
স্বরাজ-এ যোগ দিয়ে জীবনানন্দ বুঝলেন তাঁর এত দিনের কলেজে শিক্ষকতার পরিবেশের চাইতে পত্রিকার অফিসের পরিবেশ একেবারেই ভিন্ন। কলেজে নিজের মতো ক্লাস নিয়েছেন, কখনো টিচার রুমে বসেছেন, কখনো বসেননি, বাড়ি ফিরে গেছেন। কিন্তু পত্রিকা অফিসে সব সময় একটা হইহুলুস্থুল অবস্থা। প্রতিদিনের খবর ধরার মহাব্যস্ততা। যেন গরম তাওয়ায় রুটি ভাজা হচ্ছে। রুটি তাড়াতাড়ি নামিয়ে না নিলে পুড়ে যাবে নির্ঘাত। এখানে সবার ভেতর এই এখনই করে দিচ্ছি-জাতীয় একটা ভাব। একটা চটজলদি আবহ চারদিকে। নানা রকম লোকের আনাগোনা। জীবনানন্দের যে কাজ সেটা সাপ্তাহিক হলেও ওই রবিবাসরীয় পৃষ্ঠা ভরাতে সারা সপ্তাহই ব্যস্ত থাকতে হয় তাঁকে। পাতা ভরানো, লেখা জোগাড় এক সার্বক্ষণিক উদ্বিগ্নতার ব্যাপার। এ ধরনের ব্যস্তসমস্ত পরিবেশ, এমন টার্গেট ধরে কাজ করতে গিয়ে জীবনানন্দ বেশ হিমশিম খেতে লাগলেন। তা ছাড়া তিনি তখন কলকাতায় রিফিউজি, নানা বিশৃঙ্খলা তাঁর জীবনে।
স্বরাজ অফিসে চাকরি করতেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীও, যিনি জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতা পড়ে লিখেছিলেন তার ভেতর একটা আত্মঘাতী ক্লান্তি আছে। জীবনানন্দ সাধারণত নিজের লেখার পক্ষ নিয়ে কিছু লেখেন না। কিন্তু এই আত্মঘাতী ক্লান্তি কথাটার বিরোধিতা করে লিখেছিলেন। নীরেন্দ্রনাথকে সহকর্মী হিসেবে দেখে শুরুতে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলেন তিনি। এমনিতে পত্রিকার অচেনা পরিবেশ, তার ওপর সে অফিসে তাঁর এমন এক ঘোর সমালোচক বসে আছেন জেনে একটু সতর্ক হয়ে উঠেছিলেন জীবনানন্দ। নীরেন্দ্রনাথ একদিন অবশ্য নিজে থেকে এসেই আলাপ জমালেন, বললেন, জীবনানন্দ বাবু, আমি কিন্তু এখনো মনে করি আত্মঘাতী ক্লান্তিই আপনার বৈশিষ্ট্য কিন্তু এও বিশ্বাস করি যে ওই আত্মঘাতী ক্লান্তি নিয়েই আপনি মহৎ। জেনে রাখবেন আমি কিন্তু আপনার কবিতার বিরাট একজন ভক্ত।
জীবনানন্দ কোনো মন্তব্য করলেন না, সাবধানে তাঁর কথা শুনতে লাগলেন। নীরেন্দ্রনাথ বললেন, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না বোধ হয় আপনার। তাহলে শুনুন। এই বলে তিনি তাঁর মৃত্যুর আগে নামের লম্বা কবিতাটা আবৃত্তি করতে লাগলেন :
আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষসন্ধ্যায়,
দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল…
একপর্যায়ে জীবনানন্দ বললেন, থামু থামুন। এরপর তিনি কাঁধ কাঁপিয়ে তার সেই বিশেষ হাসিটা হাসতে লাগলেন। জীবনানন্দের টেবিলের ড্রয়ারে ধূসর পাণ্ডুলিপির একটা কপি ছিল, তিনি সেটা বের করে তাতে সই করে বইটা তখনই উপহার দিলেন নীরেন্দ্রনাথকে। সেদিন থেকে নীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে একটা সখ্য গড়ে উঠল তাঁর। অফিস পাঁচটা পর্যন্ত হলেও জীবনানন্দ চারটার দিকে নীরেন্দ্রের ডেস্কে গিয়ে বলতেন, চলুন বেরিয়ে পড়ি। পত্রিকা অফিস থেকে বের হয়ে জীবনানন্দ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচতেন। নীরেন্দ্রনাথকে নিয়ে রওনা দিতেন পূর্বাশা অফিসের দিকে। এই নির্বান্ধব শহরে সেখানে রয়েছে জীবনানন্দের বান্ধব সঞ্জয়। যেতে যেতে নীরেন্দ্রের সঙ্গে বরিশালের গল্প করতেন তিনি।
.
০২.
নীরেন্দ্রনাথ ছাড়া আর কারও সঙ্গে অফিসে জীবনানন্দ বিশেষ কথা বলতেন না। পত্রিকা অফিসের ওই হইচইয়ের ভেতরও জীবনানন্দ গুটিয়ে থাকতেন নিজের ভেতর। কিন্তু এটা টের পেতেন যে পত্রিকা অফিস তার কলেজ নয় যে স্রেফ নিজের ক্লাস নিয়ে চুপচাপ বাড়ি হাঁটা দিলে চলবে। এখানে সহকর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা না বললে, আচ্ছা না দিলে চলে না। এই যে অচেনা লোকজনের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তুলতে না পারার অক্ষমতা, সেটা নতুন করে পীড়া দিতে লাগল জীবনানন্দকে। তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেন যে তার মা-বাবা দুজনেই দারুণ কথক, তাহলে তিনি কোথা থেকে এই মুখচোরা স্বভাব পেলেন? স্বরাজ-এ যখন কাজ করছেন, সেই ১৯৪৭-এর ডায়েরির এক পাতায় লিখেছেন, My mother is a great 77 & my father never faltered when talking or lecturing…where from then have I inherited diffidence, faltering, taciturnity?….
My memory is short I cant talk logically & systamitcally for long, nor is it easy find the revent words, phrases & expressions of prose talking (or writing) quickly & all about many important matters of life. Though I read newspapers, journals & books not a little yet I find that even in armchair political, social matters other can talk & debate more clearly impressively & convincingly than me….
.
জীবনানন্দ ভাবছেন, মা ছিল দারুণ কথক, বক্তৃতা দিতে গেলে বাবা একবারের জন্যও আটকাত না অথচ আমার এই লজ্জা, দ্বিধা, সংশয় কোথা থেকে এল?…তিনি ভাবছেন তাঁর স্মৃতিশক্তি খুব কম। তিনি খুব গুছিয়ে, যৌক্তিকভাবে কথা বলতে পারেন না। এমনকি লেখাতেই জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সঠিক শব্দ, বাক্য সহজে খুঁজে পান না। ভাবছেন তিনি তো পত্রপত্রিকা, বই কম পড়েন না, তবু দেখেন যে সমাজ, রাজনীতি নিয়ে অন্যরা তার চেয়ে অনেক ভালো তর্কবিতর্ক করতে পারে। ডায়েরিতে এরপর তিনি লিখেছেন,
Mere reading & information & even memory dont make one a good talker–Memory & silent arguing out & training the mind in this way & actual practice of talking sedulously cultivated help a good deal no doubt–but at the same time one must have the heart to be interested in, delighted in or at least discover & appreciate the necessitiy of having to find in such matters–I have not the heart–My heart is for lonliness, money, women, writing poetry alone…
তিনি বুঝতে পারছেন, শুধু পড়াশোনা, তথ্য, এমনকি স্মৃতিশক্তি থাকলেই একজন ভালো কথক হতে পারে না। পড়াশোনা, এসব নিয়ে প্রশিক্ষণ হয়তো সাহায্য করতে পারে কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, এভাবে তর্কবিতর্ক করার আগ্রহ, উৎসাহ, উদ্দীপনা থাকা, সেটা তাঁর নেই, ওই তর্কবিতর্কে তাঁর মন নেই, তার মন তো পড়ে আছে একাকিত্ব, খুঁজছে টাকা, নারী আর চাইছে নির্জনে কবিতা লিখতে… ওই সময় এর কোনোটাই নেই তার হাতে।
জীবনানন্দের মজলিস গল্পটার এক চরিত্রের মুখে আজ্ঞা নিয়ে এই ভাবনার কথাই জানিয়েছেন। গল্পের সেই চরিত্র একটা বেশ রমরমা পার্টিতে এক কোনায় সোফায় বসে আছে। অংশগ্রহণ করতে পারছে না এই হইচইয়ে। বসে সে ভাবছে, মজলিসকে নিজের প্রাণের জিনিস করে নেবার মতো চরিত্রের সুন্দর সচ্ছলতা আমার নেই…গাইতে পারি না, বাজাতে পারি না, ইয়ার্কিতে এক হাত নেবার মতো প্রবৃত্তি মনের ভেতর খুঁজে পাই না, যে সমস্ত শস্তা সাধারণ কথাবার্তা ও হাসি তামাশা মজলিসের উপকরণ সেগুলোকে বেশ একটু উঁচুগ্রামে চড়িয়ে নিতে ইচ্ছা করে। মানুষের উপলব্ধি ও কল্পনার যে সমস্ত নিবিড় পরিচয় ভালো ভালো কাব্যে, বড় বড় উপন্যাসে পাই এইখানেও এক একবার সেই সবের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠি, অবসন্ন হয়ে পড়ি। যে কোন মুহূর্তেই উঠে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছা করে…
জীবনানন্দের মনের গড়নটাও এমন। তার মন যে উঁচুগ্রামে বাধা তার থেকে নিচে নামতে হলেই অস্বস্তিতে পড়ে যান তিনি। কিন্তু একজন অতি সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে সারাক্ষণ নিজের ওপর নজর রাখছেন তিনি, নিজেকে ব্যাখ্যা করছেন। সেলফ রিফ্লেক্সিভিটি একজন অগ্রসর ভাবনার মানুষেরই তো বৈশিষ্ট্য। তবে এ-ও ঠিক, এই অতি আত্মসচেতনতা তাঁকে বরাবর বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে অন্যদের কাছ থেকে।
.
০৩.
পরিপার্শ্ব থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বরাজ-এ চাকরিটা করছেন তিনি তখন। নিজের দেশ পুরোপুরি ছেড়ে আসা, নতুন চাকরি সব মিলিয়ে তার একটা বেতাল অবস্থা তখন। পত্রিকা অফিসের এই শশব্যস্ত পরিবেশের বিড়ম্বনা তো আছেই, এর ওপর আছে লেখা জোগাড় করার চাপ। এক সহকর্মী একদিন বললেন, এভাবে গজেন্দ্রগমনে চললে তো চলবে না জীবনানন্দ বাবু, এ তো আপনার কবিতা লেখার টেবিল নয়।
কলকাতার লেখক-জগতের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ক্ষীণ। লেখা জোগাড় করা এক কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াতে লাগল। এই কাজে টিকে থাকতে পারবেন কি না সন্দেহ জাগল তার। তিনি পালাবার পথ খুঁজতে লাগলেন। এ সময় তাঁর মনে পড়ল পুরোনো বন্ধু অচিন্ত্যকে। অচিন্ত্য তখন মুর্শিদাবাদের মুনসেফ। তাকে এক চিঠিতে লিখলেন, …আমার দোষ আমি সহজে কাউকে ধরা দিতে পারি না, কিন্তু তোমার ব্যক্তিত্বের সুপরিসর সরসতা ছিল আলাদা জিনিস। এই সজীবতা ও স্নেহ আজকের পৃথিবীর সব দিকেই সব বিভাগেই বিরল। সাহিত্যে হয়তো সাহিত্য আছে কিন্তু যে মানুষ তা সৃষ্টি করে সে সত্যিই প্রায় মানুষ নয়… স্বরাজে কাজ মন্দ ছিলো না। কিন্তু কোন কোন কারণে ভালো লাগছে না। অন্য কিছু পেলেই কিম্বা আগেই চলে যেতে হবে।…
.
০৪.
পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স জীবনানন্দের তখন। এই বয়সে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে, অন্য একটা দেশে উদ্বাস্তু হয়ে গিয়ে, নতুন ধরনের এক চাকরি নিয়ে, নতুন করে জীবন শুরু করা একটা দুর্বিষহ ব্যাপার। বরিশালের কলেজের চাকরিজীবনে শেষের দিকে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তিনি, এখানে এই স্বরাজ এর চাকরিতেও মানাতে পারছেন না নিজেকে। বেকারত্বের পুরোনো দুর্বিষহ স্মৃতি তাকে তাড়া করে। আবার কি সেই গহ্বরে পড়বেন? এই বয়সে? এদিকে লাবণ্য, মেয়ে মঞ্জু, ছেলে সমরকে নিয়ে ল্যান্সডাউন রোডের ছোট বাড়িটায় উঠে নতুন করে ওদের স্কুল, কলেজে ভর্তি করা, নতুন করে একটা সংসার শুরু করার ব্যাপক ঝক্কি, আছেন অসুস্থ মা। একটা শিক্ষিত উদ্বাস্তু পরিবারের মর্মান্তিক প্রাথমিক দিনগুলো কেমন হতে পারে ঋত্বিক ঘটক তার মেঘে ঢাকা তারা চলচ্চিত্রে আমাদের দেখিয়েছেন।
অসহায় আগেও অনেকবার জীবনানন্দ হয়েছেন, একভাবে বললে বরাবরই অসহায় তিনি কিন্তু এবার তার অসহায়ত্বকে মনে হতে লাগল অতলান্তিক। চেপে ধরা গভীর, গাঢ়, সীমাহীন হতাশার কথা ১৯৪৭-এর ডায়েরিতে লিখেছেন, One nights before sleeping, the all round frustrations of life.
1) Barisal home and BM college which can never be thought of…the hell days of college & students
2) Swaraj job: an equal hell in another colour.
3) Lansdowne RD: a terrible suffocating prison
4) Family: it brought here the suffocating prison & other all-round frustrations would be intencified on them too without relieving me in any way
5) Mother: who is dying
6) Brother: who seems now to be suffering enough & enough & now again a sort of fools paradise with wife seems to be in the offing (D&R)
7) Manju: who is dead to duty & khukis peculiar favours
8) Frustration in Lit. Love, Herdias daughters, 796101 679, Imaginary women, bus women & life impel me to evoke God…
কোনো এক নির্ঘুম রাতে জীবনের সব হতাশা নিয়ে ভাবছেন তিনি। ভাবছেন, বরিশালের বাড়ি ছিল নরক, স্বরাজ-এর চাকরিটাও একটি নরক, কলকাতার ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িটা একটা কারাগার, পরিবারের অন্য সদস্যরা মাথাব্যথার কারণ, মা মরতে বসেছে, ভাইটিও কষ্ট করছে অনেক, সে স্ত্রীকে নিয়ে একধরনের বোকার স্বর্গে আছে, মেয়েটা ঘরের কাজ করতে করতে মরতে বসেছে প্রায়, গম্ভীর হতাশা সাহিত্য নিয়ে, প্রেম নিয়ে, মনে চলছে নানা কাল্পনিক নারীর আনাগোনা।
ইতিমধ্যে স্বরাজ পত্রিকা অর্থসংকটে পড়ে গেল। পত্রিকা প্রকাশের জন্য ব্যাংক লোন নিয়েছিলেন হুমায়ুন, সে দেনা শোধ করায় জটিলতা দেখা দিল। কর্মীদের বেতন ঠিকমতো দিতে পারছিলেন না। জীবনানন্দ এমনিতেই চাকরিটা নিয়ে হাতাশায় ছিলেন, এ সময় স্বরাজ পত্রিকার চাকরিটা ছেড়ে দিলেন তিনি।
.
০৫.
এবার সত্যি গভীর গভীরতর খাদে পড়ে গেলেন জীবনানন্দ। আবার কোনো চাকরি নেই, আবার হাতে কোনো টাকাপয়সা নেই। একটা মানুষের কী করে এ অবস্থা হয় বারবার? কোনো এক ভয়ানক দুষ্ট নক্ষত্র তাঁকে যেন ধাওয়া করছে অবিরাম। একেবারে হতভম্ব, ভ্যাবাচেকা খাওয়া অবস্থা তার। নিজেও যেন হিসাব মেলাতে পারছেন না কী করে এসে পড়লেন এই পাতালে। তবু নিজের অবস্থাকে বরাবরের মতোই অক্ষরবন্দী করে চলেছেন তিনি। এ সময়ের এক কবিতায় লিখেছেন :
সামান্য লোক হেঁটে যেতে চেয়েছিলো স্বাভাবিকভাবে পথ দিয়ে
কি করে তা হলে তারা এরকম ফিচেল পাতালে
হৃদয়ের জনপরিজন নিয়ে হারিয়ে গিয়েছে?
কলকাতায় গিয়ে নতুন স্বাধীন ভারতে দেখছেন করিতকর্মারা কেমন দ্রুত এই অবস্থার সব সুবিধা লুটেপুটে নিচ্ছে। তাঁর এ সময় লেখা জলপাইহাটি উপন্যাসে লিখেছেন, চার দিকে কুড়ি-বাইশ বছরের ছোকরারা জিপে ছুট যাচ্ছে, ব্যাঙ্ক লুটছে, কালবাজার চিবিয়ে খাচ্ছে, বড়-বড় ব্যবসাদারি জোগাড় করছে নতুন ইউনিয়নে, জায়গা জমি কিনছে যাদবপুর বেহালায়, টালিগঞ্জ রিজেন্টপার্কে, বালিগঞ্জে দিব্যি ভিলা তুলে ফেলছে সব, মেয়েমানুষ নিয়ে কৃতকৃতার্থ হয়ে ফিরছে।
লিখেছেন, …চারদিককার ট্রাম, বাস, মোটর, ট্রাকের দুর্নিবার পৃথিবীতে অর্থসঞ্চয়ের কলাকৌশলটা দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলা দরকার তার, খুব তাড়াতাড়ি; তা হলেই সেও দ্রুত, একান্ত হয়ে যাবে এই অপ্রকৃতিস্থ মহানগরীর এই অনর্গল অপরিশ্রুত উল্লাসকে আশ্চর্য পরিশ্রুত তাণ্ডবে পরিণত করবার দুর্দান্ত সময়যন্ত্রের সঙ্গে। কিন্তু আটচল্লিশ উনপঞ্চাশ বছরেও ঢেকুর তুলে হাঁটতে-হাঁটতে যদি তাকে নিজের কায়দা-কানুন ঠিক করে নেবার কথা ভাবতে হয়, তা হলেই হয়েছে…
কিন্তু জীবনানন্দ কিছুতেই টাকা কামানোর কৌশলটা শিখে উঠতে পারছেন না, ওই আটচল্লিশ-উনপঞ্চাশ বছরেও সেঁকুর তুলে হাঁটতে হাঁটতে তাঁকে নিজের কায়দাকানুন ঠিক করে নেবার কথা ভাবত হচ্ছে।
বিশ্বযুদ্ধ থেমে গেলেও পৃথিবী থেকে অন্ধকার যে ঘোচেনি, মানচিত্র ভেঙে ভেঙে পৃথিবী যে হয়ে উঠছে আরও বিপজ্জনক, সে কথাই সে সময়ের কবিতায় লিখলেন জীবনানন্দ :
মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে :–
তবুও রয়েছে মহাসমরের তিমির
আমাদের আকাশ আলো সমাজ আত্মা আচ্ছন্ন করে।
প্রতিনিয়তই অনুভব করে নিতে হয় আলো; অন্ধকার
আকাশ : শূন্যতা, সমাজ : অঙ্গার,
জীবন : মৃত্যু, প্রেম : রক্তঝর্ণা;–জ্ঞান
এইসবের অপরিমেয় শববাহন শুধু, নিজেকেও বহন করছে।
.
তিনি উপলব্ধি করলেন, এতকাল তিনি আঁধার দেখেছেন, এবার যেন সম্মুখীন হয়েছেন আরও বড় অন্ধকারের :
আঁধার দেখেছি, তবু আছে অন্য বড় অন্ধকার;
মৃত্যু জেনেছি, তবু অন্য সম্মুখীন মৃত্যু আছে;
পেছনে আগাগোড়া ইতিহাস রয়ে গেছে, তবু
সেই মহাইতিহাস এখনো আসেনি তার কাছে
কাহিনীর অন্য অর্থ, সমুদ্রের অন্য সুর, অন্য আলোড়ন
হৃদয় ও বিষয়ের,মন এক অন্য দীপ্ত মন।
এ সময়ের আরেক কবিতায় তিনি লিখলেন, ‘চারিদিকে বিকলাঙ্গ অন্ধ ভীড়’। তাহলে কি আবার এই বিকলাঙ্গ অন্ধ ভিড়ের ভেতর কুকুর-বেড়ালের মতো পথে পথে ঘুরে আবার তাকে একটা চাকরি খুঁজতে হবে? নিজের দাম্পত্যকে অনেকটা সামাল দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, আবার কি শুরু হবে লাবণ্যর সেই ভূতে পাওয়া অবস্থা, তাকে কি সে আবার ধুলায় মিশিয়ে দিতে চাইবে?
.
সোনালি মেঘের ভেতর অদৃশ্য হতে হতে
০১.
ঠিক এই সময়টায়, সেই বড় অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার সেই দিনগুলোতে একটা সম্পূর্ণ নতুন কথা জীবনানন্দ লিখলেন তার ডায়েরিতে। এই সময়ের ডায়েরিতে দেখা গেল, তিনি স্পষ্ট করে আত্মহত্যার চিন্তা করছেন। অন্ধকারে কোনো দিন আর ঘুম থেকে না জাগার কথা লিখেছেন আগে কিন্তু এবার লিখলেন আত্মহননের কথা। ১৯৪৭-এ দেশভাগের সেই প্রাথমিক দিনে, কলকাতার উদ্বাস্তু জীবনে, স্বরাজ-এর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পূর্বাপর সময়ে তিনি ডায়েরিতে লিখলেন কী কী কারণে আত্মহত্যা করতে চান, এমনকি কোন পদ্ধতিতে আত্মহত্যা করবেন, সে কথাও, Almost every night I thought of ending lifes tangle by suicide… Reasons:1) Insecurity of Swaraj 2) Cal. House life extremely dreary & bitter 3) No security or Honour anywhere in the world 4) No woman–No Love–And I am quickly aging 5) Daughters of Herodias 6) Immense sense of frustration.
প্রতি রাতে আত্মহত্যার কথা ভাবছেন তিনি। আত্মহত্যার অনেকগুলো কারণ তখন তাঁর হাতে : স্বরাজ-এ অনিশ্চয়তা, কলকাতার বাড়ির তীব্র তিক্ততা, পৃথিবীর কোথাও কোনো সম্মান না থাকা, জীবনে কোনো নারী বা প্রেম না থাকা অথচ বয়স বেড়ে যাচ্ছে তার, ভাবছেন হেয়রাডিয়াসের কথা, হেরোডিয়াস এক মিথের চরিত্র, যে একাধারে প্রেমিক এবং নৃশংস। আরও লিখেছেন, ….before death making good provision for my family & mess which however seem to be impossible in the final analysis so I determine to commit suicide by drowining myself & the other 3 in the ocean… how I would pull them all mightily towards the great waves, how each of them in his or her individual way would protest vehemently & how my physical force & the great sense of frustration would trumph over everything else-Ranju, Manju, Labanya. …Other forms of suicide such as Euthanasia etc are welcome but violent forms are unwelcome-Again one should not die alone The ramnants of family will be immensely disgraced & anguished in that case
I remember of a school teacher who killed all his family members with an axe & then killed himself–But this is very crude solution–the best is ocean death in a sunny day (evening better than moring)
.
তিনি সাগরে ডুবে আত্মহত্যা করবেন ঠিক করেছেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে পরিবারের জন্য কোনো ব্যবস্থা করে যেতে পারবেন না বলে তাঁর দুই ছেলেমেয়ে আর লাবণ্যকে সহই সমুদ্রে ঝাঁপ দেবেন ভেবে রেখেছেন। তিনি এক এক করে ওদের সমুদ্রের বড় ঢেউয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। ওরা প্রত্যেকে নিজেদের মতো প্রতিবাদ করবে কিন্তু তার শক্তির কাছে ওরা পরাজিত হবে এবং তিনি ওদের সবাইকে নিয়ে সাগরে ডুবে মরবেন। ভয়ংকর মরবিড ভাবনা তখন পেয়ে বসেছে জীবনানন্দকে। ভেবেছেন উথেনেশিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুর কথা। লিখেছেন কোনো এক স্কুলশিক্ষকের কথা যে তার পরিবারের সবাইকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে নিজে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু এ ধরনের বীভৎস পদ্ধতিতে আত্মহত্যা তিনি অনুমোদন করছেন না। তবে একাও মরতে চান না তিনি, মরতে চান সবাইকে নিয়েই এবং সমুদ্রে ডুবে মরাই ভালো বলে ভাবছেন। এমনকি কখন সমুদ্রে ঝাঁপ দেবেন, সেটাও ভেবে রেখেছেন। ঠিক করেছেন কোনো এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনেই ডুবে মরবেন এবং সময় হিসেবে সকালের চেয়ে বিকেলটাই ভালো। এসব বিচিত্র ভাবনা তখন দখল করে রেখেছে তাঁকে।
তবে এই সিদ্ধান্ত তিনি আবার পরক্ষণেই স্থগিত রাখার কথা ভাবছেন। স্থগিত করবেন শুধু একটা কারণে, লেখা। মৃত্যুর আগে আরও কিছু বই লিখতে হবে তাকে। তাই লিখেছেন, …I cant do it before publishing some other books & dealing soundly with all my mess.
.
০২.
আত্মহত্যার অনুষঙ্গ তাঁর কবিতা, গল্পে আছে। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার মূল বিষয়ই তো আত্মহত্যা। যদিও সেই আত্মহত্যা নিয়ে একটা স্ববিরোধী অবস্থানে ছিলেন তিনি তখন। তাঁর কারুবাসনা উপন্যাসে অবশ্য সরাসরি আত্মহত্যার ইচ্ছার কথা আছে। সেখানে কারুবাসনার মূল চরিত্রের সঙ্গে তাঁর মায়ের এক অদ্ভুত কথোপকথন হচ্ছে, উপন্যাসের চরিত্র বলছে, মাঝে মাঝে মনে হয় দুএকজন মাড়োয়ারির পকেট কেটে নিলে পারি।
মা : এমন কথাও মনে হয় তোমার?
হ্যাঁ, অত্যন্ত অবসাদ বিষাদের সময় কিছুক্ষণের জন্য মনে হয় বৈকি। কোনো বড় লোকের বাড়ি ব্যাংক, মাড়োয়ারির টাকার ওপর লোভ জন্মায়। তাদের তো
অনেক আছে এত বেশী দরকার কি? হৃদয় মনের স্থূলতা পাশবিকতায় অর্থ জমিয়ে অর্থ খরচ করেই বা কী লাভ তাদের? আমাকে কিছু দিক-মানুষের ক্ষমা দাক্ষিণ্য বিধাতার হৃদয়হীনতা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাক-দেশে ফিরে যাই দু মুঠো খেয়ে বাঁচি, কবিতা লিখি… কিন্তু এ-ভাব শিগগিরই কেটে যায় আমার। দারিদ্র্যের সংগ্রামের ভিতর অজস্র নিপীড়িত আত্মা ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দেখি। চেয়ে দেখি কুষ্ঠ রোগী জীর্ণশীর্ণ কাঠের ঠেলাগাড়িতে বসে আছে তার ভিজে ফুটপাথের উপর এক পাশে কাদা-জলের মধ্যে আপাদমস্তক কাপড়ে মুড়ে একটি নারী পড়ে রয়েছে–দেবদারু গাছের ছায়ায় নয়, মেঘের সোনায় নয়, কিন্তু এই পথে-ঘাটে রাস্তায় পৃথিবীর আদি অসীম স্থিররূপ আবিষ্কার করি আমি। নিজের জীবনের বেদনাকে মুকুটের মত মনে হয়। বাদলের বাতাসে, আবছায়ায়, জনমানব, ট্রাম বাস, গাছের পাতাপপ্লব, পাখপাখালির কলরবে এক-একটা সন্ধ্যা বড় চমৎকার কেটে যায় আমার …কিন্তু তবুও আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে।
কার? তোমার? কেন?
চৌকাঠের সঙ্গে দড়ি ঝুলিয়ে কিংবা বিষ খেয়ে যে মরণ, সে রকম মৃত্যু নয়, আউটরাম ঘাটে বেড়াতে গিয়ে সন্ধ্যার সোনালী মেঘের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করে; মনে হয় আর যেন পৃথিবীতে ফিরে না আসি।
.
একবার পরিকল্পনা করেছেন সাগরে অদৃশ্য হয়ে যাবেন, এবার ভাবলেন অদৃশ্য হবেন মেঘের ভেতরে। কিন্তু শুধু কিছু নতুন লেখা লিখবেন বলে বাতিল করলেন সে পরিকল্পনা। মৃত্যু এবং লেখার ভেতর লেখাকে বেছে নিলেন তিনি।
.
চাই টলস্টয় আর গ্যেটের প্রশান্তি
০১.
ঝেঁপে আসুক অন্ধকার, না থাক চাকরি, না খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে হোক, তবু মরে যাবার আগে আরও কিছু লেখা তাঁকে লিখতে হবে, এমনই ভাবলেন জীবনানন্দ। ডুবতে বসা মানুষের কাছে ভেসে যাওয়া টুকরো কাঠ যেমন, লেখা তাঁর কাছে তাই। এ সময় তিনি খুব গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে লাগলেন কবিতার বদলে কথাসাহিত্য রচনার কথা। সেই ১৯৩০-এ বিয়ের পরপর যখন চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে গিয়েছিলেন, তখন একে একে অনেকগুলো গল্প-উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। মাঝখানে দীর্ঘদিন আর গল্প উপন্যাস লেখেননি। ১৯৪৮-এ এসে তার সেই নতুন পর্বের বেকারত্বের দিনে তাঁর মনে হলো আরও কিছু গল্প-উপন্যাস তাঁর লেখা বাকি রয়ে গেছে। মৃত্যুর আগে বিশেষ করে কয়েকটা উপন্যাস তাঁকে লিখে যেতে হবে। সেসব উপন্যাস লেখার জন্য নানা রকম প্রস্তুতির কথাও উল্লেখ আছে তাঁর সে সময়ের ডায়েরিতে। ডায়েরিতে লিখেছেন উপন্যাস লেখার রসদ জোগাড় করতে কলকাতার অলিগলি আনাচকানাচে আরও ভালোভাবে ঘুরে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। কিন্তু হাতে পয়সা নেই, পয়সার জন্য একটা নিয়মিত চাকরি করার কথা তাঁকে ভাবতেই হয়, ওদিকে স্বাস্থ্যও ভালো নেই, যৌবনের সেই শক্তি নেই, এসব ভেবে হতাশ লাগছে তাঁর, There are many other places, conmers, streets, lanes, blinds, houses, factories, footpaths and insides in Cal one oauth to go & spend attentive houres for experiences in novels etc. I lack of money for which I have to do routine job & I lack of health & youth frustrate me?
তিনি তার বয়স নিয়েও খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন তখন। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স তখন তার, ভাবছেন ৭০ বছর হতে আর মাত্র বছর বিশ বাকি। এর ভেতর বেশ কিছু উপন্যাস তাঁকে লিখে ফেলতে হবে। অন্তত ষাট বছর হওয়ার আগে এসব লেখা দরকার। তিনি মা-বাবাকে চোখের সামনে অথর্ব হয়ে যেতে দেখেছেন। ভাবছেন ওই পর্যায়ে যাবার আগে এমন সব লেখা শেষ করে ফেলা দরকার, যা তাকে টলস্টয় বা গ্যেটের প্রশান্তি দিতে পারে, Very often I have to remember my age: 47/48 or 49? (D&R) and 20/21 years to 70. And I have to write some novels & many other things before that or preferably before the deadline of 60-D&R. I find mother as I saw father blind, groping, shaking with palsy, incapaciateted, unable to do anything & before reaching that stage one will have to finish everything that may give one Tolstoys or Goethes satisfaction.
তাঁর আকাক্ষার উচ্চতাটা লক্ষ করবার মতো। তিনি বাংলা ভাষার এক অল্পপরিচিত লেখক কিন্তু নিজেকে স্থাপন করতে চাচ্ছেন বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ দিকপাল টলস্টয় বা গ্যেটের পর্যায়ে। অবশ্য ডায়েরির পরের অংশেই দেখা যাচ্ছে, এ নিয়ে নিজের ভেতরই সন্দেহ জাগছে তাঁর। ভাবছেন এসব হয়তো দুরাশা, এ স্বপ্ন হয়তো তাঁর জন্য নয়। ভাবছেন তাঁর এই সীমিত অভিজ্ঞতা, এই বেকারত্ব, দারিদ্র্য এসব বিবেচনা করে টলস্টয়ের মতো উপন্যাস লেখা কিংবা গ্যেটের মতো বহুমুখী সাহিত্য করার চিন্তা হয়তো বাদ দেওয়াই উচিত, But that grand achievement is not for me. Would it be better for me (in view of my lack of expereince & lack of opportunity for gathering it profusely & deeply & also my lack of jobless economic independence etc) to give up the idea of writing epic novels like Tolstoy etc. or of trying to be overwhelmingly many sided like Gothe etc.
ভাবছেন তার চেয়ে বরং হয়তো কবিতা আর কবিতার সমালোচনাতেই নিজেকে নিয়োজিত রাখা উচিত। এমনকি কিছু টাকাপয়সা রোজগারের চিন্তায় এবং খানিকটা নিজের গদ্য লেখার ক্ষমতা অন্যদের দেখাবার তাগিদে যে প্রবন্ধ, ছোটগল্প লিখতে শুরু করেছিলেন, সেটিও বাদ দেওয়া উচিত। গ্যেটে, টলস্টয়, শেক্সপিয়ার যদিও বহুমাত্রিক প্রতিভা, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি, কিটস তো শুধু কবিতাই লিখেছেন, এসব ভাবনার দোলাচল তখন তাঁর মনে, ..Concentrate on Poetry & criticism only (even to the exclusion of writing personal essays, short stories & Other Prose attempts meant for money & also for demonstrating that I am capable of good prose, a fact that people seem increasily to disbelieve?
Worthworth, Keats, Milton, Shelly, Dante etc were for Peotry only,
But Goethe, Tolstoy & Shakespear allure
কী লিখবেন, উপন্যাস না কবিতা? এ নিয়ে দ্বিধায় আছেন তিনি। উপন্যাস লেখার কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন আবার তাঁর মনে হচ্ছে উপন্যাস লিখতে গিয়ে শুধু শুধু সাহিত্য-জীবনটাকে বরবাদ করবেন কি না, I dont know what would be the proper literary line for me and attempt to write novels may mean heartless wastage & uncharted sabotage of my literary life.
.
তাঁর ব্যক্তিজীবনের সীমাহীন দুর্ভোগে তাঁর উদ্বিগ্নতা যতটুকু তার চেয়ে শতগুণ বেশি উদ্বিগ্নতা তাঁর লেখা নিয়ে। যেন প্রতিটা মুহূর্ত তাঁর জীবন থেকে নিলাম হয়ে যাচ্ছে, যেন তিনি মাথা দিয়ে আছেন কোনো গিলোটিনে, ধড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হবার আগে তাঁকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে লেখাবিষয়ক এই সব আকাশ পাতাল প্রশ্নের।
.
০২.
উপন্যাস লেখায় সময় দেবেন কি দেবেন না এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সুরাহা করতে না পেরে এ সময় তিনি দ্বারস্থ হয়েছিলেন প্রভাকর সেনের। প্রভাকর সেই তরুণ মেধাবী পাঠক, যিনি তাঁর কবিতা ব্যাখ্যা করে তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন। জীবনানন্দ তার অগ্রজ, সমসাময়িক কারও সঙ্গে তাঁর সাহিত্য বিষয়ে আলাপে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। খুঁজে নিয়েছিলেন তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, সাহিত্যে খ্যাতিহীন এক পাঠককে। প্রভাকরের সাহিত্যবোধের ব্যাপারে আস্থা ছিল তাঁর। জীবনানন্দ কলকাতার বিখ্যাত কফি হাউসে বসে প্রভাকরের সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁর উপন্যাস নিয়ে, With Pravakar I go to Coffee House. Talks about novels & novel writing. About my novels of 22/25 years ago-will they hit now?-Those novels a problem: what to do with them? Revise them? Have them fair copied (by relevant persons available in Cal. As stated by Dharamdas Mukhaerjee? How to fair copy? I have no Mrs. Tolstoy etc… Time might be better spent in writing new novles.
বিশ-পঁচিশ বছর আগে যে উপন্যাসগুলো লিখে তিনি ট্রাঙ্কে রেখে দিয়েছেন, সেগুলো কী করবেন তা নিয়ে আলাপ করেছেন প্রভাকরের সঙ্গে। উপন্যাসগুলোর ফেয়ার কপি করার কথা ভাবছেন। কিন্তু কে তাঁর লেখার ফেয়ার কপি করবে।
তার তো আর মিসেস টলস্টয় নেই। আমরা জানি, টলস্টয়ের স্ত্রী ওয়ার অ্যান্ড পিএর মতো ঢাউস উপন্যাস কপি করে দিয়েছিলেন। লাবণ্য তাঁর উপন্যাস কপি করে দেবে, এ তো তার কল্পনারও অতীত। নিজের লেখা নিজেকেই কপি করতে হবে কিন্তু তার চেয়ে বরং নতুন একটা উপন্যাস লেখাই ভালো–এসব ভাবছেন তিনি।
Tolstoys War and Peace the greatest novel-Manns Joseph. A Spanish writers, Three of life Dostoyevskys novel we all highly praised-He 2 weeks (day and night) for finishing Tolstoys War & Peace.
কফি খেতে খেতে জীবনানন্দ আর প্রভাকর টলস্টয়, দস্তয়ভস্কি, টমাস মান নিয়ে কথা বলেছেন। প্রভাকর রাত-দিন পড়ে দুই সপ্তাহে টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস শেষ করেছেন জানিয়েছেন। প্রভাকর সম্ভবত জীবনানন্দকে উপন্যাস লেখার ব্যাপারে উৎসাহিতই করেছেন। দেখতে পাচ্ছি, দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও স্বরাজ-এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯৪৮-এর সেই বেকারত্বের সময়টাতে তিনি টানা লিখে ফেলেছেন চারটা উপন্যাস। লিখেছেন কিছু গল্পও। বেকার হলে বিপদ তো চারদিকে, তবে এতে একটা বড় লাভ হয় জীবনানন্দের। জগৎ-সংসারে তার তখন কোনো কাজ নেই, তখন জোয়ার আসে তার মনের আসল কাজে, লেখায়। অখণ্ড সময় পেয়ে তিনি ঘোরগ্রস্তের মতো লিখতে থাকেন। সেই কালো ট্রাঙ্ক থেকে উদ্ধার করা উপন্যাসগুলো লেখার তারিখ লক্ষ করলে দেখা যায়, তিনি সেগুলো কোনো কোনোটা মাত্র তিন থেকে চার দিনের ভেতর টানা লিখে শেষ করেছেন। মনে হয় যেন লেখাগুলো তাঁর কলমের ডগায় এসে আটকে ছিল। একটা সুযোগ পেয়ে বন্যার ঢলের মতো নেমে এসেছে কলকল করে। সমাজ, সংসার, জীবন। ভেস্তে যাক, লিখে শেষ করতে হবে যা লিখতে চাই, এই তার পণ যেন তখন।
.
কোনো দিন ফুরোবে না শীত রাত
০১.
সে সময় যে উপন্যাসগুলো জীবনানন্দ লিখেছেন, তার ভেতর সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মাল্যবান। মাল্যবান উপন্যাসে প্লট বলতে তেমন কিছু নেই, বিশেষ কিছু ঘটেও এতে। এর আগে লেখা তাঁর সফলতা নিষ্ফলতা উপন্যাসে, উপন্যাস নিয়ে জীবনানন্দের ভাবনা এক চরিত্রের মুখে বলিয়েছিলেন, প্লট নতুন, কিংবা কোন
প্লটই থাকবে না, নতুন নভেলের মানুষদের গতিবিধির চেয়ে ভাবনাচিন্তার ওপরই জোর দেয়া বেশি, কাজের চেয়ে কথার উপর। যখন কোন প্লট থাকবে না, কাজও থাকবে কম, গল্পটা তখন একটা কথার সমুদ্র হয়ে দাঁড়াবে না শেষ পর্যন্ত? দাঁড়াক–মন্দ কি? গল্পের প্লট থাকা না থাকা নিয়ে একবার ডায়েরিতে লিখেছেন, জীবনটাই তো প্লটবিহীন, কেবল ষড়যন্ত্রকারীরাই প্লট করে।
মাল্যবান উপন্যাসে প্রচলিত অর্থে প্লট নেই। আছে এক রহস্যময় দাম্পত্যের বয়ান। মাল্যবান নামের এক যুবক, যে বেড়ে উঠেছে শহর থেকে দূরে, প্রকৃতি, গাছপালা, ছায়া অন্ধকার, নক্ষত্ররাশির ভেতর। সে উৎপলা নামের এক নারীকে বিয়ে করে, চাকরি নিয়ে এসেছে বড় শহরে। সেখানে তাদের দাম্পত্য কেটে গেছে বারোটা বছর। তাদের মনু নামে এক কন্যাসন্তান আছে। কিন্তু মাল্যবানের দাম্পত্য জীবন এক বিবমিষা জাগানো ব্যর্থতায় ভরা। যদিও মাল্যবানের চাকরিতেই সংসার নির্বাহ হয় কিন্তু সংসারে সার্বিক কর্তৃত্ব উৎপলার। তাদের দুই রুমের একটি বাড়ি, একটি নিচতলায়, আরেকটি ওপরতলায়। ওপরতলার খোলামেলা বড় রুমটায় থাকে উৎপলা, নিচের অন্ধকার ঘুপচি ঘরে মাল্যবান। ওপরের ঘরে মাঝে মাঝে নানা রকম পুরুষ আসা-যাওয়া করে, সেখানে গান-বাজনা-আড্ডা হয়, মাল্যবান একা থাকে নিচে। উৎপলা আর মাল্যবানের ভেতর শারীরিক সম্পর্কও হয় না। মাল্যবান মাঝেমধ্যে শারীরিক সম্পর্কের চেষ্টা করলে উৎপলা একরকম তাড়িয়ে দেয় তাকে। একসময় উৎপলার মেজদা তার পরিবার নিয়ে বেড়াতে এলে উৎপলা মাল্যবানকে বলে মেসে গিয়ে থাকতে। নিজের রুম ছেড়ে দিয়ে মাল্যবান গিয়ে ওঠে মেসে। মাল্যবানকে অবিরাম তীক্ষ্ণ, তীব্র আজেবাজে ভাষায় গালমন্দ করে উৎপলা। মাল্যবান সব সহ্য করে। মাল্যবান যেন তার নিজের সংসারে বন্দী এক চরিত্র। খুব আশ্চর্য মাল্যবানের ক্লীবতা আর অদ্ভুত উৎপলার আচরণ। বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের নারী চরিত্র সম্ভবত আর দ্বিতীয়টি নেই। এই দুজনের সম্পর্ক বেশ জটিল এবং রহস্যময়। জীবনানন্দ তাঁর আশ্চর্য ভাষাভঙ্গিতে তৈরি করেছেন এসব চরিত্র। উৎপলার কথা বলতে গিয়ে লিখছেন, এই বারটা বছর উৎপলার অনিচ্ছা-অরুচির বইটি-কাঁটা চাদা-কাঁটা বেত–কাটার ঠাসবুনোন জঙ্গলে নিজের কাজকামনাকে অন্ধ পাখির মত নাকেদমে উড়িয়েছে মাল্যবান। কত যে সজারুর ধাস্টামো, কাকাতুয়ার নষ্টামি, তেঁদড়ের কাতরতা, বেড়ালের ভেংচি, কেউটের ছোবল, আর বাঘিনীর থাবা এই নারীটির।
উৎপলার সঙ্গে মাল্যবানের দাম্পত্যের কথা লিখতে গিয়ে তিনি লিখছেন, মাল্যবানকে কেমন সহজ দিব্যতায় বিদায় দিয়ে, অথচ মাল্যবানকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, রুচির বিরুদ্ধে, অপ্রেমে, কামনার টানে, বেশি লালসায় রিরংসায় উৎপলার মতন একজন ভাল বংশের সুন্দর শরীরের নিচু কাণ্ডজ্ঞানের নিরেস মেয়েমানুষের কাছে ঘুরে-ফিরে আসতে হবে নিজের মৃত্যু পর্যন্ত কী নিদারুণভাবে, কেমন অধমের মত, কেমন হাতে-পায়ে ধরে মেয়েটির কখনো-বা ঘরের শান্তি কখনো বা বাইরের সুনাম রক্ষা করবার জন্যে, কখনো-বা লালসা, অতিক্বচিৎ প্রণয় এসে উৎপলার দিকে মাল্যবানকে হিঁচড়ে টানছে বলে।
কোনো কোনো দিন মাল্যবান তার নিচের ঘর থেকে মাঝরাতে ওপরের ঘরে গিয়ে উৎপলার বিছানার পাশের একটি চেয়ারে বসে। মশারির ভেতর ঢুকতে চায়, তাকে স্পর্শ করতে চায়। কিন্তু একেবারে কেরে উঠে উৎপলা বলে, আ গেল যা। রাত দুপুরে ন্যাবড়া করতে এলো গায়েন…
রোমান্টিকতার ছিটেফোঁটা সুযোগ দেয় না উৎপলা। অথচ তার ওপরতলার ঘরে অন্য পুরুষ আসে। গান-বাজনা করে। মাল্যবান কিছু বলতে পারে না। শুধু চেয়ে দেখে। বিশেষ করে, অমলেশ নামের এক মানুষ প্রায়ই আসে তার ঘরে। মাল্যবানকে পাত্তাই দেয় না। মাল্যবান অমলেশকে দেখে শুধু আর তাকে নিয়ে ভাবে। তার মনে হয় অমলেশের যেন দুটো ঠাঙের বদলে আটটা ঠাঙ, মাকড়সার মতো কেমন ল্যাং ল্যাং ল্যাং ল্যাং করছে সব সময়ই, কখনো গাঢ় সবুজ, কখনো লাল মাকড়সানীদের দেখছে বলে–সমস্ত জীবন ধরে।
এই নারীর কবল থেকে বেরিয়ে আসতে না পারার পরিণতি নিয়ে মাল্যবান ভাবছে,
জীবনের সঙ্গে একজন স্ত্রীলোককে জড়িয়ে নিয়ে–এ জড়িয়ে নেওয়ার সমস্ত নিহিতার্থের ছোব-পোড় গায়ে মেখে দধিতে কাদায় মূর্খতায় ওগরানো অম্বলে আগুনে অতৃপ্তিতে মণ্ডিত হয়ে কী হল সে।
জীবনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে এই দাম্পত্য জীবনেরও নানা রকম খাকতি দেখছে সে। ঝড়তি-পড়তি নষ্ট ফসল, পচা হাড়মাংসের গন্ধে ভরে উঠছে সব।
কেন উৎপলা এমন করে মাল্যবানের সঙ্গে? কারণ মাল্যবানের ভেতর একধরনের প্যাসিভনেস আছে, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, টাকাপয়সার সাফল্যের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই, এটাকেই বুঝি আঘাত করতে চায় উৎপলা।
অমলেশ যখন তার ওপরতলায় যায়, উৎপলা মাল্যবানকে বলে, ওকে এ বাড়িতে আসতে নিষেধ করে দিতে পারবে তুমি?…তুমি না হয় উপরে এসে কাল একটা বিহিত করে যেও।
উৎপলা জানে মাল্যবান তা পারবে না।
অমলেশ যখন ওপরে থাকে, মাল্যবান তখন ওপরে যায় না। মাল্যবান ভাবে, ‘উৎপলার ঘরে লোক কম–দুটি কি একটি-খুব সম্ভব একটি–তখন সে কিছুতেই ওপরে যায় না : মন দিয়ে করেছে, চোখ দিয়ে সকলের জীবনের সব তলানি আবিষ্কার করতে চায় না’।
মাল্যবানের এই নিষ্ক্রিয়তাকেই আঘাত করতে চায় উৎপলা। বলে, এক বেশ্যার সঙ্গেও যদি সমানভাগে তোমার সম্পর্কে আমার দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারতাম, তা হলে এতটা দম আটকে আসতো না।
কিন্তু মাল্যবানের এসব চাকরি, টাকাপয়সা, সাফল্য ভালো লাগে না।
‘টাকা, পারিবারিক সচ্ছলতা এগুলোকে এমন ঘাসের বিচি, ধুন্দলের বিচি, রামকাঁপাশের আঁটি বলে মনে হয় এক এক সময়।…মাটির নীচে গেঁড় আর কন্দ খাওয়া শুয়োরের মত (আপার গ্রেডের) অফিসগিরিই তার সব নয়…’
কিন্তু মাল্যবান তার এই আচরণকে নিয়ে আবার নিজেই কৌতুক করে। খেতে বসে উৎপলা যখন তাকে গালাগাল করছে, তখন মাল্যবান লেবুর খোসা দিয়ে এঁটো প্লেটে কার্টুন আঁকে।
গায়ে তেল মাখতে-মাখতে মাল্যবানের কখনো মনে হয়, কী জানি, আমার বদলে অন্য কোনো দশাসই পুরুষের স্ত্রী হলে এত দিনে উৎপলার আট-দশটি সন্তানের মা না হলে ছাড়ত না হয় ত।
উৎপলার ওপরের ঘরে যখন গান-বাজনা হয়, তখন মাল্যবান নিচের কলতলায় কাপড় কাঁচে, কোনো কোনো দিন বমি করে দেয়। মাল্যবান নিজেকে নিয়ে অদ্ভুত এক পরিস্থিতি তৈরি করে। নিজেকে নিয়ে এ ধরনের সেলফ মকারি করে সে।
উৎপলা, মাল্যবান দুই পৃথিবীর মানুষ। মাল্যবান কেন যে উৎপলাকে সহ্য করে, কেন এমন বশ্যতা মেনে নেয়, সেটা নিয়ে নিজেই ভাবে মাল্যবান। এই অন্ন আর যৌনতা ভরা পৃথিবীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার স্পৃহা, সাহস, রুচি হয় না। তার। তার মনে হয় সে একটি ফাঁদে পড়ে গেছে এবং এই ফাঁদকে সহ্য করাই। তার পরিণতি। উৎপলার এই অত্যাচার সহ্য করে সে, উৎপলাকে করুণা করে। এই করুণা করার ভেতর দিয়ে সে বরং তার মহত্ত্বকেই চর্চা করে যেন। জীবনানন্দ লেখেন, রাস্তায় নেমে মাল্যবানের মহাপুরুষদের মত মনে হল ভালবাসা বা কামনা নয়, করুণাই মানুষকে সমস্ত সৃষ্টির অগ্নিকারুকার্যের ভেতরে আপতিত শিশির-ফোঁটার মত খচিত করে রাখে।
নিজেকে অতিমানব মনে হয় তার কখনো কখনো।
সে, কোনো যৌন আকর্ষণ বা যৌনাতীত গভীর ভালবাসা-নারীকে ভালবাসা–এসব স্তর ও ফাঁদ উতরে গিয়ে একটা নির্জন অন্তর্ভেদী সমভিব্যাপী দয়ার উজ্জ্বলতায় কয়েক মুহূর্তের জন্যে যেন অতিমানুষের মত হয়ে উঠল মাল্যবান।
মাল্যবান রামায়ণের একটা পাহাড়ের নাম। এই পাহাড় ধৈর্যশীলতার প্রতীক।
মাল্যবানের মনে হয় উৎপলার কারণে তার জীবন আর দশটা পুরুষের মতো হয়নি। সেটাও সে উপভোগ করে, মাল্যবান ভাবে, রাতের বেলাটার তার তাদের মত কেটে যেত যদি উৎপলার মত একজন সত্তমা স্ত্রী এসে বাদ না সাধতো। উৎপলার সংস্পর্শে এসে জীবন ধাক্কা আঘাত উপলব্ধির ভেতর দিয়ে চলেছে। এ না হলে তার অফিসের মাইতি, দে, গুই বাবুদের মতো এড়িগেড়ি বাচ্চায় ঘর ভরে ফেলে, সিঁদুর থেবড়ানো, ফোকলা সেঁতো শাঁকচুন্নিদের নিয়ে ঘর করত। কিন্তু উৎপলাকে নিয়ে তার জীবন সে রকম নয় তো। ওদের মতো নয়, আরেক রকম।
অথচ এত বিরূপতা সত্ত্বেও আবার মাল্যবান উৎপলার কাছে যেতে চায়। তার সান্নিধ্য চায়। নিচতলায় মাল্যবান যখন বমি করে, তখন উৎপলা ওপর থেকে নেমে এসে তাকে বাতাস করে। তবু তাদের দূরত্ব ঘোচে না।
না, নয় বৎসরেও ঘরজোড়া স্নিগ্ধতা হল না, খড়খড়ে আগুন কড়ের চমৎকার। অগ্নি-ডাইনির মত হল মাল্যবানের বিয়ে আর বৌ, আর বিবাহিত জীবন।
.
০২.
তবে কি নারীর হৃদয়হীনতার কদর্যতা ফুটিয়ে তুলবার জন্যই জীবনানন্দ আয়োজন করে লিখেছেন মাল্যবান উপন্যাস? কী করে তা বলি, আমরা তো এ-ও দেখি যে নারীসত্তার প্রতি তাঁর তীব্র আকর্ষণ, শ্রদ্ধার কথা ছড়িয়ে আছে তার লেখায়। কবিতাতেই তিনি লিখেছেন, নারী, শুধু তোমাকে ভালোবেসে জেনেছি, নিখিল বিষ কতটা মধুর হতে পারে।
গভীর বিস্ময়ে তিনি তাকিয়েছেন নারীর প্রতি। নিরুপম যাত্রার প্রভাত তার প্রতিবেশী স্নিগ্ধ, বিচক্ষণ উষার দিকে তাকিয়ে বলছে, অন্ধকার রাতে কাঁঠাল হিজলের জঙ্গলের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে যেমন ভাল লাগে—এই মেয়েটিকেও তেমন লাগে–
একজন সুস্থ পুরুষ বিপরীত লিঙ্গের মাধুরী এবং মদিরার আবেশে যে আকর্ষণ বোধ করে, তা-ও অক্ষরবন্দী করেছেন তিনি। যেমন মন তেমন নারী শরীরের ঘনিষ্ঠতার অনুপুখে গেছেন :
তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতরে
কবেকার সমুদ্রের নুন…
.
নারীর চুলের ভেতরের ঘাম, জিবে সেই ঘামের নানা স্বাদ, যে নুন সমুদ্রের, এই নিবিড় শরীরী মাদকতার কথা লিখেছেন কবিতায়।
লিখেছেন পুরষের শরীরী উত্তেজনার কথাও :
মাঝে মাঝে পুরুষার্থ উত্তেজিত হলে–
(এরকম উত্তেজিত হয়)
উপস্থায়িতার মতন
আমাদের চায়ের সময়
এসে পড়ে আমাদের স্থির হতে বলে…
আবার শুধু পুরুষ হিসেবে নয়, একেবারে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে তার নাজুকতা আর শক্তির অদ্ভুত গল্প তিনি শুনিয়েছেন গভীর মমতায় লেখা এক নারীর জীবনের উপন্যাস কল্যাণীতে, যে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে চায়। যে মানুষের কথা তিনি লিখেছেন বিভা উপন্যাসে :
জীবন সম্বন্ধে ধারণা করতে গিয়ে পুরুষ ও নারী যদি ভিন্ন স্বভাবের জীবন হয়, তাহলে এ কথা ঠিক যে এমন অনেক নারী পুরুষ রয়েছে যারা নিছক নারী বা পুরুষ নয়, কিন্তু বিশেষভাবে ব্যক্তিগত মানুষ।
এমনকি নারীর হাতেই পৃথিবীর সামাজিক, অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটতে পারে এমন মতই তিনি দিয়েছেন তাঁর উপন্যাসের চরিত্রের মুখে, বলেছেন নারীর অর্থনীতির কথা। তার বাসমতি উপাখ্যান উপন্যাসের চরিত্র ফাটা বলে, ইকনামিস পুরুষদের শাস্ত্র ছিল। অনেকদিন থেকে ধস্তাধস্তি করে আসছে তারা। শেষ মার্ক্সে এসে সিদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়া সেটাকে প্রমাণিক সাফল্য দিচ্ছে–শুনে ভাল লেগেছিল। কিন্তু হল না কিছু। পুরুষদের হাতে এ শাস্ত্র মনের ভূমিতে বা সমাজ ভূমিতে খুব সম্ভব কোথাও সিদ্ধ হবার নয়। ইকনমিকস নিছক বিজ্ঞান নয়, কিন্তু এটা কী তাহলে?
এরপর ফাটা বলে অর্থনীতি শুশ্রষার ব্যাপার। শুশ্রূষায় নারীরা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ। ফাটা বলে, আজকের পৃথিবী এই শুশ্রষা চাইছে, জ্ঞানের ভেতর দিয়ে। দরকার একটি বিশেষ জ্ঞান-ইকনমিকস। কিন্তু একে এর আধুনিক অবস্থায় ফেলে রাখলে চলবে না, অনেক দূর এগিয়ে নিতে হবে, মানুষের সেবা শুশ্রষার বড় ব্যাপ্ত, প্রাণঘন সুর এর ভেতরে ফুটিয়ে তোলে। পুরুষরা কি তা পারবে?
.
০৩.
সত্যি বলতে, একাধারে শুশ্রূষাপরায়ণ আবার নির্মম আত্মপরায়ণ নারীর স্ববিরোধিতাকে জীবনানন্দ যেন মোকাবিলা করতে চেষ্টা করেছেন মাল্যবান উপন্যাসে। উপন্যাসটা শেষ হয় প্রায় এক পরাবাস্তব দৃশ্যে। দেখা যায় মাল্যবান আর উৎপলা দুজনে উপন্যাসে প্রথমবারের মতো এক বিছানায় গিয়ে শুয়েছে। তারপর উৎপলা মাল্যবানকে বলছে, ভোর হবে না আর, জানতে হবে না। দেখো শীতের রাত কিরকম শীত, খড়ের বিছনায় হাঁস হাসিনের শীতের রাত সত্যিই কী যেন চমৎকার লম্বা বলে আরো ভালো। সত্যি কোনদিন শেষ হবে না।
মাল্যবানের আশ্চর্য লাগছিল। কোনো দিনও যে জেগে উঠতে হবে না আর, শীত, যা সবচেয়ে ভালো, এই বিশৃঙ্খল অধঃপতিত সময় মাল্যবানের সময় ঘেঁষে থেকে যাবে অনিঃশেষ শীত ঋতুর ভেতর।…
কোনদিন শেষ হবে না রাতের?
না।
‘কোনদিন শেষ হবে না আমাদের রাতের, উৎপলা?
হবে না। হবে না।
শীতের রাত ফুরুবে না কোনদিন?
না।
কোনদিন ফুরুবে না শীত রাত, আমাদের ঘুম?
না, না, ফুরুবে না।
কোনদিন ফুরুবে না শীত, রাত আমাদের ঘুম?
ফুরাবে না। ফুরুবে না।
কোনদিন ফুরুবে না শীত, রাত, আমাদের ঘুম?
না, না, ফুরুবে না।
কোনদিন ফুরুবে না শীত রাত, আমাদের ঘুম?
ফুরুবে না। ফুরুবে না। কোনদিন।‘
এই দৃশ্য, এই সংলাপ মাল্যবানের স্বপ্নেই ঘটে যেন। এক বিচিত্র বিমূর্ততায় শেষ হয় উপন্যাস। মাল্যবান জটিল, নানা স্তরী উপন্যাস। বিষম দাম্পত্যের যে ফিরিস্তি সেটা মাল্যবানের একটা ওপরের খোলসমাত্র। এর ভেতর গোঁজা আছে ভোগ আর ভোগের নিস্পৃহ অবলোকনের দ্বৈধতার দর্শন। মুণ্ডক উপনিষদের একই গাছে বসা দুটা পাখির কথা উল্লেখ করা আছে। একটা পাখি ফল খাচ্ছে আর অন্য পাখিটা তার ফল খাওয়া দেখছে। এক পাখি এই জড় জগতের আকর্ষণে আবদ্ধ, আরেক পাখি কেবল দর্শক। একটা জীবাত্মা, আরেকটা পরমাত্মা। এই দুই পাখির মিলনই হচ্ছে মুক্তি। দুঃখ যন্ত্রণায় বিষাদে অপমানে লাঞ্ছিত হতে হতে মাল্যবান অগ্রসর হয় তারই দিকে যে তার দুঃখের কারণ।
.
০৪.
মাল্যবানের দাম্পত্যের সঙ্গে জীবনানন্দের দাম্পত্যের মিল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়, খুঁজে পেয়েছিলেন লাবণ্য। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর মাল্যবানের পাণ্ডুলিপি উদ্ধার হলে ভূমেন্দ্র এবং জীবনানন্দের ভাই অশোকানন্দ এটা বই আকারে প্রকাশ করতে চাইলে বাধা দিলেন লাবণ্য। বললেন, এ পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করা যাবে না। এক অদ্ভুত কারণ দেখালেন লাবণ্য। বললেন, জীবনানন্দ তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছেন এবং বলেছেন এ পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করা যাবে না। লাবণ্যর আসল অস্বস্তির কারণ লুকানো থাকেনি ভূমেন্দ্র এবং অশোকের কাছে। পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের পর মাল্যবান প্রকাশ করতে পেরিয়ে গেছে বিশ বছর।
সন্দেহ নেই, জীবনানন্দ-লাবণ্যর দাম্পত্য ছিল অসুখী, অসফল।
কবিতা, লেখালেখি জীবনানন্দের জীবনের, তাঁর সত্তার একেবারে গোড়ার ব্যাপার হলেও সিন্দবাদের মতো এই চিন্তাই বরাবর তাঁর ঘাড়ে চেপে থাকলেও, তাঁর ঘরের সবচেয়ে কাছের মানুষটার এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহই ছিল না। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর মানুষ জীবনানন্দ নামে লাবণ্য যে স্মৃতিকথা লিখেছেন, তাতে তিনি তাদের দাম্পত্যের বেশ একটা সতর্ক বয়ান দিয়েছেন। এই বই যখন লিখেছেন তখন জীবনানন্দের ব্যাপারে ক্রমশ আগ্রহ বাড়ছে পাঠক-পাঠিকাদের। লাবণ্য জীবনানন্দের সেই সামাজিক পরিচিতির কথা ভাবনায় রেখেছেন। সেই বইয়ে জীবনানন্দকে কবি বলে সম্বোধন করেছেন লাবণ্য, তাঁর কবিতার উদ্ধৃতিও দিয়েছেন কিন্তু জীবনানন্দ বেঁচে থাকতে তার কবিতার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখিয়েছেন বলে জানা যায় না। সেই বইয়ে নিজেই স্বীকার করেছেন যে কবিতার পৃথিবীর সাথে তাঁর কোনো যোগ নেই।
একদিনের একটা ঘটনার স্মৃতিচারণা করেছেন লাবণ্য। বরিশালের বাড়িতে একদিন লাবণ্য দুপুরে ঘুমিয়ে ছিলেন, জেগে দেখলেন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। বাইরে উঠানেই সকালবেলা শাড়ি, কাপড় নেড়ে দিয়েছিলেন। দেখলেন জীবনানন্দ আর তাঁর মেয়ে বাড়ির বারান্দায় বসে কবিতা নিয়ে কথা বলছেন। মেয়ে মঞ্জু তখন স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ে। তাদের চোখের সামনে সবগুলো কাপড় ভিজছে কিন্তু তাঁদের কোনো টনক নেই। জীবনানন্দের এই বেখেয়ালিপনায় মেজাজ বিগড়ে গেল তার। তাঁদের দুজনকে এ নিয়ে অনেক কথা শোনালেন। জীবনানন্দ বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি কি একদিনের জন্যও সংসারের একটু ওপরে উঠতে পারবে না? কোনো দিন এক মুহূর্তের জন্যও কবিতা নিয়ে একটু কথা বলবে না?
লাবণ্য ঘাড় ঘুরিয়ে যেতে যেতে বলেছেন, আমি ওসব কবিতার ধার ধারি না।
জীবনানন্দের সংসারের আনাড়িপনার নানা বয়ানই লাবণ্য দিয়েছেন সেই স্মৃতিচারণায়। তবে জানিয়েছেন ছেলেমেয়েদের জন্য একটা কাজই জীবনানন্দ খুব দক্ষতার সঙ্গে করতেন। সেটা হচ্ছে ছেলেমেয়েদের স্কুলের পেনসিল কেটে দেওয়া। নিখুঁত করে সন্তানদের পেনসিল কেটে দিতেন তিনি। এমন নিখুঁত পেনসিল কাটা লাবণ্য কখনো দেখেননি। মোটকথা, সংসারে তার কৃতিত্ব ওইটুকুই, সুন্দর করে বাচ্চাদের পেনসিল কেটে দেওয়া।
লাবণ্য ছিলেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। তখনকার সাধারণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘরের রেওয়াজ অনুযায়ী লাবণ্য গান-বাজনা শিখেছেন, ইডেন কলেজে নাটকও করেছেন। তিনি একসময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও আগ্রহী হয়েছিলেন। বিয়ের পরপর একবার বরিশালে তাঁদের বাড়িতে পুলিশও হানা দিয়েছিল। অবাক হয়েছিলেন জীবনানন্দ, পুলিশকে বলেছিলেন না, না, আপনারা ভুল করছেন, লাবণ্য রাজনীতি করতে যাবে কেন? পুলিশ বলেছিল, আপনি কি জানেন জীবনানন্দ বাবু, এরা ঢাকার মেয়ে, ডেঞ্জারাস। পরে বাড়ি তল্লাশি করে আইরিশ স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা বই পায় পুলিশ, তারা মনে করে এই তো যথেষ্ট প্রমাণ যে লাবণ্য সন্ত্রাসী। আসলে সেটা ছিল লাবণ্যর ব্রজমোহন কলেজের বিএর পাঠ্যবই। জীবনানন্দ পুলিশকে বহু কষ্টে তা বোঝাতে পেরেছিলেন। পুলিশ শেষে লাবণ্যকে ছেড়ে দিলেও সাবধান করে দিয়েছিল জীবনানন্দকে।
না, লাবণ্যর রাজনীতির কোনো সংশ্লিষ্টতার জন্য সাবধান থাকতে হয়নি জীবনানন্দকে। সাবধান থাকতে হয়েছে তার নানা সাংসারিক বঞ্চনাবোধকে সামাল দিতে। লাবণ্য নেহাত সরল, লাজুক, মুখচাপা কোনো নারী ছিলেন না। ছিলেন বুদ্ধিমতী এবং প্রগল্ভ নারী। ছাত্র অবস্থায় কিছু সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকলেও সেসব তাঁর জীবনের প্রধান কোনো অনুপ্রেরণা ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন একটা সচ্ছল সংসার, স্বামী হিসেবে চেয়েছেন একজন সাধারণ মানুষকে, যে স্ত্রীকে সময় দেবে, যার জীবন হবে সংসারকে কেন্দ্র করে। উনি এমন লোককে স্বামী হিসেবে চাননি, যার মাথার চারপাশে বোধ কাজ করে। তাদের এক পারিবারিক বন্ধু মিনু সরকার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেন, লাবণ্য বিস্তর কথা বলতেন, ব্রাহ্মসমাজের শীতল, শোভন জীবনযাপনের ভেতর লাবণ্যকে কিছুটা বেমানান লাগত। মিনু আরও জানাচ্ছেন, লাবণ্য তাঁকে একদিন বলেছেন, লেখক বলতে তিনি বোঝেন ডা. নিহাররঞ্জন গুপ্তকে। তিনি লাবণ্যর সম্পর্কে মামা। ডা. নিহাররঞ্জন গোয়েন্দা উপন্যাস লিখে বিস্তর খ্যাতি অর্জন করেছেন তখন। লাবণ্য বলেছেন, লিখলে তার মামার মতোই লেখা উচিত, যেমন নামডাক, তেমনি পয়সা। বলা বাহুল্য, লিখে নাম, পয়সা কোনোটিই জোটেনি জীবনানন্দের। মিনু নিজে যাকে বিয়ে করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সে ভদ্রলোকও কবিতা লেখে শুনে লাবণ্য মিনুকে বলেছিলেন, সাবধানে থাকিস…
.
জীবনের কাছে লাবণ্যের যা প্রত্যাশা তা ভিন্ন, জীবনানন্দের চেয়ে যোজন দূরত্বের। তাঁদের পরস্পরের মানসিক দূরত্ব ছিল ব্যাপক। একপর্যায়ে মাল্যবান এর উৎপলার মতোই তাঁদের দাম্পত্যেও ছিল না স্বাভাবিক শারীরিক কোনো নৈকট্য। জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা নির্বাচনে সাহায্য করেছেন যে বিরাম মুখোপাধ্যায়, তিনি জানাচ্ছেন, একবার জীবনানন্দ তাঁকে বলেছিলেন, স্ত্রী যদি আপনার আমন্ত্রণে ঘনিষ্ঠ হবার প্রস্তাবে সায় না দেয় কী করবেন, কী করা উচিত?
লাবণ্য ও জীবনানন্দ পরস্পর বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন কি? তাদের দাম্পত্যের ফসল তাঁদের দুটি সন্তান। বিচ্ছেদের পারিবারিক, বৈষয়িক, ধর্মীয় নানা জটিলতা আর পরিণতির কথা বিবেচনা করে তারা হয়তো সে পথে যাননি। বিরোধ সত্ত্বেও একটি সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছেন। একপর্যায়ে জীবনানন্দ আর লাবণ্যর দাম্পত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে নেহাত কর্তব্যপালন।
জীবনানন্দ তার অন্তিমকালে যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তখন ভূমেন্দ্র, সুচরিতা সারা রাত জেগে জীবনানন্দকে পাহারা দিলেও লাবণ্য কোনো দিন রাত জাগেননি। গেছেন হাসপাতালে কিন্তু দীর্ঘ সময় থাকেননি। যেদিন মারা গেলেন, সেদিন তার মরদেহ দেখতে সমসাময়িক অনেক লেখক-কবি এসেছিলেন। শবযাত্রা শুরু হবার আগে ল্যান্সডাউন রোডের সেই বাড়ির এক কোনায় দাঁড়িয়ে লাবণ্য ভূমেন্দ্রকে বলেছিলেন, তোমার দাদা তাহলে বাংলা সাহিত্যের জন্য অনেক কিছু রেখে গেলেন, আমার জন্য কী রেখে গেলেন বলো তো?
মোক্ষম প্রশ্ন। জীবনানন্দ বাস্তবিক লাবণ্য আর তার পরিবারের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি, ওই কিছু ধূসর পাণ্ডুলিপি ছাড়া। ওই পাণ্ডুলিপি রচনাই ছিল তাঁর জীবন। যদিও অবশ্য তিনি অবিরাম চেষ্টা করে গেছেন জীবন আর জীবিকার একটা সমীকরণ ঘটাতে। একটা ন্যূনতম বৈষয়িক বৃত্তান্ত তৈরি করতে। কিন্তু অক্ষর দিয়ে দ্বিতীয় একটা জীবন গড়ে তুলবার তীব্র ইচ্ছা তাঁকে বারবার অন্যমনস্ক করেছে। তিনি টের পেয়েছেন জীবনে একটু অন্যমনস্ক হলে জীবন তাকে ছাড় দেয় না। জীবনে যা কিছুকে মূল্যবান মনে করেছেন, চোখের সামনে সেগুলোকে ধূলিকণা হতে দেখেছেন। গভীর অসহায় বোধ করেছেন। জীবনের এই অসহায়ত্ব, এই শৃঙখল থেকে মুক্তির জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। তিনি। তাঁর বিভা উপন্যাসে একটা দৃশ্য আছে, যেখানে খাঁচার ভেতরের একটা পাখি খাঁচার শিক কাটবার চেষ্টা করছে। সেই পাখিটাকে দেখে উপন্যাসের চরিত্র বলছে, এই দেখ, আমরা প্রত্যেকেই এ রকম শিক কাটতে চেষ্টা করছি, কিছুতেই পারছি না। এমনি গভীর প্রতিবাদ করছি, শুনছে না, এমনি নিজের জীবনটাকে নিষ্ফলতার ফাঁকে-ফাঁকে আঁচড়ে কামড়ে খিঁচড়ে ফেলছি, অন্য কারু তাতে কিছু এসে যাচ্ছে না। তারপর অবসন্ন হয়ে জীবনের এক কোণে ঘাড় হেঁট করে পড়ে থাকছি। পাখিটার বেলা তুমি বরং এইসব তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছ। মাঝে মাঝে সান্ত্বনা দিতে যাচ্ছ। নিজে অন্তত বেদনা পাচ্ছ। কিন্তু আমাদের বেলা তোমার মতন সমবেদনাপরায়ণ বিলাসী শৌখিন তৃতীয় ব্যক্তিকে হাতের কাছে কোথাও হাতড়ে পাচ্ছি না।
জীবনানন্দ হাতের কাছে তাঁর জীবনসংগ্রামের একজন সমব্যথী খুঁজেছিলেন। লাবণ্য তা ছিলেন না। নিজের বৈষয়িক বঞ্চনার জন্য লাবণ্যর এই যে আন্তরিক আক্ষেপ, আমরা কি এর প্রতি সহানুভূতিশীল হব? নাকি লাবণ্য যে জীবনানন্দের শক্তির জায়গাটুকু ন্যূনতম অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে সমবেদনা থেকে বঞ্চিত করলেন, সে জন্য তাঁকেও প্রশ্নবিদ্ধ করব?