৪. নাটুকে অনেক কথা

নাটু আর দুযা ছাড়া সকলেই উঠিয়া চলিয়া গেল। ইচ্ছা হইতেছিল, নাটুকে অনেক কথা বলি। কিন্তু কিছুই বলিতে ইচ্ছা হইতেছে না। বলিবার কিছু আছে বলিয়াও মনে হয় না। তাহাকে কাজকর্মের বিষয়, বিভিন্ন স্থানে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া যৎপরোনাস্তি বুঝাইয়াছি। মুরশিদাবাদ নবাবের রাজস্ব বিভাগে ইস্তফা দেওয়ায়, সেখানে তাহার আর যাইবার দরকার নাই। ইস্তফা দিবার কারণ ছিল, ক্রমেই কোম্পানির সাহেবদের সংস্পর্শ। আমাদের দুইটি পূর্ণ ও একটি অর্ধ তালুক রহিয়াছে, তাহা বর্ধমান রাজার অধীন। তালুকের খাজনা বর্ধমান রাজসরকারেই জমা দিতে হয়। নবাবি আমলে, মোগল বাদশার অধীনে বর্ধমান পরগনা ছিল সরকার শরিদাবাদের অন্তর্গত। সরকার শরিদাবাদে ছাব্বিশটি পরগনা ছিল। সরকার সাতগাঁয়ের অধীনে ছিল উত্তরে পলাশি পরগনা হইতে ভাগীরথীর উভয় তীর ব্যাপিয়া। বন্দর সাতগাঁ, হুগলি জেলা ইহার অন্তর্গত ছিল। পরগনা ছিল সাকুল্যে তেতাল্লিশটি। পিতামহের সময়ে সরকার শরিদাবাদ ও সরকার সাতগাঁয়ের প্রায় তিরিশটি পরগনার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল আমার। ইহা হইতেই আমাদের বংশের উন্নতি হইয়াছিল।

প্রপিতামহ ইহার সূত্রপাত করিয়া গিয়াছিলেন। পিতামহ তাহা পূর্ণমাত্রায় কার্যকরী করিয়াছিলেন। নবাব সরকারের রাজস্ব এবং নিজের ভূমি সম্পত্তির রাজস্ব, যথাযথ আদায় ও জমা খুব একটা সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়াছে, অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষায় বেশি ভূসম্পত্তি ক্রয় করিয়া খাজনা জমা দিতে না পারিয়া অনেক ভদ্র ব্রাহ্মণ সন্তানকেও কারাবাস করিতে হইয়াছে। পিতামহ খুবই সতর্ক ও নির্লোভী ব্যক্তি ছিলেন। সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনওই কোনও বড় পরগনা খরিদ করেন নাই। আয় বেশি হইলেই দায়িত্ব বাড়িয়া যায়। সেইজন্য তিনি আস্তে আস্তে একশো-দেড়শো অথবা দুইশো মৌজা অন্তর্গত পাঁচটি তালুক কিনিয়াছিলেন। নবাবের রাজস্ব বিভাগের কাজের সঙ্গে এই তালুকসমূহের আদায় খরচ ও সদর জমা আদৌ সহজসাধ্য ছিল না। তাঁহার তিন পত্নীর সকলেরই পুত্র অপেক্ষা কন্যা সন্তান বেশি ছিল। প্রথম পক্ষে কোনও পুত্রই ছিল না। দ্বিতীয় পক্ষে দুই পুত্র, তৃতীয় পক্ষে একমাত্র পুত্র আমার পিতা। পিতামহ এই তিন পুত্রকে যথাযথ শিক্ষা দিয়া নিজের সহযোগীরূপে গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। তাঁহাদের সকলকেই মুরশিদাবাদ ও বিশেষ করিয়া কাটোয়ায় যাইতে হইত। নবাবি আমলে কাটোয়ার মাটিরগড় দৌলতখানায় খাজনার টাকা জমা দেওয়া হইত। পিতামহ কাটোয়ায় গঙ্গার ধারে একটি বাড়ি করিয়াছিলেন। সৈদাবাদেও একটি ছোট বাড়ি করিয়াছিলেন। আদিবাড়ি বলিতে হুগলির বর্তমান নিজস্ব তালুক গ্রামেরই বাড়ি। ইহার বিশদ স্থান পরিচয় দিতে চাহি না। কুন্তী নদীর তীরে সামান্য জমিজমা ও বাড়ি প্রবৃদ্ধ পিতামহ নিজের সঞ্চয়ে করিয়াছিলেন। তিনি যশোর হইতে নবদ্বীপে আসিয়াছিলেন। নৈয়ায়িক পণ্ডিত হিসাবে তাঁহার যথেষ্ট সুখ্যাতি হইয়াছিল। বৃদ্ধবয়সে, মুরশিদকুলি খাঁ তাঁহাকে এই সামান্য ভূসম্পত্তি দান করিয়াছিলেন। তিনি এখানে একটি চতুষ্পঠী করিয়াছিলেন। সম্ভবত এই সূত্র হইতেই প্রপিতামহের মন নবাব সরকারের কাজের প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল। পিতামহের মনে তিনিই বীজ পুঁতিয়াছিলেন। আজ আমাদের বন্দ্যোঃ বংশের যাহা কিছু সবই সেই বীজের পরিণত রূপ।

পিতামহ বাঁচিয়া থাকিতেই আমার এক জ্যাঠামশায়ের মৃত্যু হয়। এক জ্যাঠাইমা তাঁহার সঙ্গে সহমরণে গমন করিয়াছিলেন। তখন আমার বারো বছর বয়স। পিতামহ যখন তাঁহার পুত্রদের উপযুক্ত বিবেচনা করিয়াছিলেন, তখন সম্পত্তি ভাগ করিয়া দিয়াছিলেন। মৃত জ্যাঠামশাইয়ের পুত্রদের দুইটি তালুক এবং সৈদাবাদের বাড়িটি দিয়াছিলেন। অন্য এক জ্যাঠামশায় ও আমার পিতাকে তিনটি তালুক সমান ভাগে ভাগ করিয়া দিয়াছিলেন। পরে আমার পিতা আর একটি তালুক কিনিয়াছিলেন। পিতামহ প্রত্যেক তালুকেই পুকুর কাটাইয়া, ঠাকুর দালান তুলিয়া, বাসস্থান নির্মাণ করিয়াছিলেন। অতএব সম্পত্তি বিভাগের সময় জ্যাঠামশাই ও তাঁহাদের সন্তানদের সেই সব নির্দিষ্ট বাসস্থান দিয়া গিয়াছেন। দুই জ্যাঠামশাইয়ের বংশধরেরা এখন বর্ধমানের দুই ভিন্ন পরগনায় নিজেদের তালুকে সেই সব বাসস্থানে বাস করিতেছেন। আমার পিতাকে হুগলির বর্তমান বসতবাড়িটি দিয়াছিলেন। গঙ্গার ধারের বাড়ি বাগান আমাকে দিয়াছিলেন। তিনি তাঁর শেষ জীবন কাটোয়ায় গঙ্গাতীরের বাড়িতে যাপন করিয়াছিলেন।

আমার পিতার বিষয়কর্মে শেষ দিকে আর তেমন উৎসাহ ছিল না। ইংরাজদের প্রতাপ বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যেন ক্রমেই ভীত হইয়া পড়িতেছিলেন। যে কারণে তিনি আমার ও শ্যামকান্তির উপরে সমস্ত কাজের দায়িত্ব দিয়া নিজের যৎসামান্য আয়ের জন্য বংশবাটির রাজবাড়িতে কাজ লইয়াছিলেন। ইতিমধ্যে আমার আড়াইটি তালুকই বর্ধমান রাজের অধীনে চলিয়া গিয়াছিল। পূর্বের পরগনাগুলি অন্যভাবে বিভক্ত হইয়া গিয়াছিল। বর্ধমানের রাজার প্রতি দিল্লির দরবার প্রসন্ন ছিল। ইংরাজেরাও ছিল। ফলে সরকার শরিদাবাদ ও সরকার সাতগাঁ সবই বর্ধমান জিলার অন্তর্গত হইয়াছিল। ১৮৬৪ শকাব্দে (১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দ) বর্ধমান জিলা জরিপ করা হইয়াছিল। তাহাতে দেখা গিয়াছিল, বর্ধমান জিলার অন্তর্গত উত্তরে রাজশাহি, বীরভূম, দক্ষিণে মেদিনীপুর, হুগলি, পূর্বে গঙ্গা, মেদিনীপুরের পশ্চিমাংশ পূর্ণ এবং পাছেটি। বর্ধমান নামে জিলা, আসলে একটি বিশাল রাজ্যই বলিতে হইবে। ইহার ভিতর তিনটি প্রধান নগর, বর্ধমান, ক্ষীরপাই ও বিষ্ণুপুর।

ইহাতে নিশ্চয়ই কোম্পানি হস্তক্ষেপ করিয়াছিল। দুই বৎসর আগেই গোটা জিলার রাজকর ছিল সাড়ে তেতাল্লিশ লক্ষ টাকা। ১৮৬৮ শকাব্দে (১৭৯০ খ্রিস্টাব্দ) রাজা কীর্তিচন্দ্র কোম্পানিকে বত্রিশ লক্ষ টাকা সম্ভবত অধিক রাজকর দিয়াছিলেন। আমার পিতার ভয়ের আর একটি কারণ ছিল। তাঁহার বিশেষ পরিচিত বর্ধমান রাজবাড়ির রাজা তেজচন্দ্রের মায়ের মোক্তার, লাঙুলপাড়া নিবাসী রামকান্ত রায়ের অপমান ও লাঞ্ছনা। এই রামকান্ত রায়ের পৈতৃকবাড়ি হুগলির পশ্চিমাংশে রাধানগরে ছিল। ইনি ভূরসুট পরগনা কোম্পানির নিকট হইতে ন’ বছরের জন্য ইজারা নিয়াছিলেন। তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র জগমোহন ইহার জামিন হন। পরে, জগমোহনের নামেও মেদিনীপুরের বেতোয়া পরগনায় একটি বড় তালুক ক্রয় করা হইয়াছিল। রাজস্ব মিটাইবার মেয়াদ শেষের আগেই দেখা গেল, পিতা-পুত্র উভয়েরই খাজনা বাকি পড়িয়াছে। রামকান্ত রায় হুগলির দেওয়ানি জেলে আটক হইয়াছিলেন, জগমোহন মেদিনীপুরের জেলে পাঁচ বছর বন্দি ছিলেন। জগমোহনের দ্বিতীয় সহোদর রামমোহনের সঙ্গে তখন কোম্পানির সম্পর্ক খুবই ভাল ছিল, কয়েকজন সাহেবের সঙ্গে যথেষ্ট প্রীতিও ছিল। ইহাদের আর এক বৈমাত্রেয় ভাই রামলোচন রাধানগরের বাড়িতেই থাকিতেন। কিন্তু রায় পরিবারের যখন ঘোর দুর্দিন, লাঞ্ছনা ও অপমানে জর্জরিত, তখন রামমোহন একটির পর একটি সম্পত্তি ক্রয় করিয়া নিজের ভাগ্যকে ফিরাইতেছিলেন। ইদানীং শোনা যায়, ইনি খ্রিস্টান ও আল্লার অনুগামী, পৌত্তলিকতা ত্যাগ করিয়া একেশ্বরবাদী হইয়াছেন।

যাহাই হউক, রামকান্ত রায়ের এই পুত্র সম্পর্কে আমিও কিছু কিছু কথা জানিতাম। রামকান্ত রায় অতিশয় সৎ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি পুত্রদের সকলকে সমান ভাবে সমস্ত সম্পত্তি দান করিয়াছিলেন। এই ঘটনা, বর্ধমান রাজবাড়িতে কর্ম গ্রহণের পূর্বে। সেই সময় রামমোহন পিতার নিকট, গৃহের বিগ্রহ সেবার অঙ্গীকার করিয়াই সম্পত্তি প্রাপ্ত হন। অথচ পরে যখন একেশ্বরবাদী হন, তখন তিনি পিতৃসম্পত্তি ত্যাগ করেন নাই। তাঁহার সঙ্গীয় ব্যক্তিগণ বলিয়া থাকেন, দেশের ধর্মবিশ্বাসের দুরবস্থার জন্যই তিনি। একেশ্বরবাদ প্রচার করিয়াছিলেন। ফারসি ভাষায় তাঁহার একটি পুস্তক, তুহফাৎ-উল-মুয়াহিদীন আমি পাঠ করিয়াছি। উহা কি কেবলই আমাদের অন্ধবিশ্বাসকে দূর করিবার জন্য? বস্তুত এই ব্যক্তি অনেক আগে হইতেই মুসলমানি ধ্যান লইয়াছিলেন। সাহেবরা আসিয়া সেই ধ্যান আরও বাড়াইয়া দিল। তাঁহার পিতা যখন দেনার দায়ে জেল খাঁটিতেছিলেন, দাদা জগমোহন একই কারণে জেলে পচিয়া মরিতেছিলেন, তখন ইনি দুই-তিন সাহেবকে টাকা কর্জ দিয়া, সুদে আসলে টাকা জমাইতেছিলেন। মুসলমান ও খ্রিস্টানদের সঙ্গে যুগপৎ সম্পর্ক রফা করিয়া, নামে ও বেনামিতে প্রচুর সম্পত্তি করিতেছিলেন। পিতা বা অগ্রজকে কোনও রকম সাহায্য করেন নাই। জগমোহন কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামমোহনের নিকট সকাতর ভাবে অর্থ প্রার্থনা করেন। তখন তিনি অগ্রজকে এই শর্তে এক হাজার টাকা ঋণ দিয়াছিলেন যে, এক বছরের মধ্যে সুদ সমেত টাকা ফিরাইয়া দিবার তমসুক লিখিয়া দিতে হইবে। অগ্রজ তাহাই স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন। কালের গতির সঙ্গে সঙ্গতি রাখিয়া এই রূপেই বিষয়ী ব্যক্তিগণ নিজের অর্থ প্রতিপত্তি বাড়াইয়া থাকে। রামমোহনও তাহাই করিয়াছিলেন। ইহা ব্যতীত তিনি ইংরাজদের বহু ইষ্ট করিয়াছিলেন। ভুটানে যাইয়া রাজাদের গুপ্ত সংবাদ সংগ্রহ করিয়া, ইংরাজদের কৃতজ্ঞভাজন হইয়াছেন। নেপালের যুদ্ধের সময়, ভুতানের রাজার সংগে ইংরাজদের বন্ধুত্ব সৃষ্টি করিয়াছিলেন। নবাবশাহি অস্তমিতপ্রায়, ইংরাজরা প্রবল প্রতাপে অগ্রসর হইতেছে। এই উভয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করিয়া এই ব্যক্তি যে-ভাবে অর্থ সঞ্চয় করিয়াছেন, তাঁহাকে কী করিয়া শুদ্ধ অন্তরে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধাচারণে বিশ্বাস করিব। শুনিয়াছি, তিনি তাহার মা ও ভ্রাতাদের সংশ্রব ত্যাগ করিয়াছেন। এই সব ঘটনায় আমার পিতা ভীত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তিনি নবাব সরকারের চাকরি ত্যাগ করিয়া বাঁশবেড়িয়ার রাজার কাজ লইয়াছিলেন। সম্পত্তি বাড়াইবার লোভ ত্যাগ করিয়াছিলেন।

আমার মনে উভয়সংকট উপস্থিত হইয়াছিল। নবাবশাহির পরিণাম, পূতিগন্ধময় পরিবেশ সহিতেছিল না। ঘুষখোর অত্যাচারী সাহেবদের প্রতি একটা বিজাতীয় ঘৃণা পুঞ্জীভূত হইয়াছিল। রামকান্ত বন্দ্যোর পুত্র রামমোহনের ন্যায় আনুগত্যবোধও আমার ছিল না। এক্ষণে পৌত্তলিকতা বা একেশ্বর, আমার কাছে সবই মিথ্যা। সমস্ত জগৎ সংসার আমার সামনে নতুন এক রূপ লইয়া উপস্থিত হইয়াছে। এই রূপের গর্ভে কী বিরাজ করিতেছে, আমি জানি না। শুধু ইহাই অনুভব করিতেছি, তেত্রিশ কোটি দেবতা বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব আমার মধ্যে আর নাই। নানা জিজ্ঞাসা ও অসহায় দৃষ্টি মেলিয়া আমি ভবিষ্যতের দিকে তাকাইয়া আছি।

যাই হোক, রামকান্ত রায়ই আমার পিতার মনে এ রকম ভীতির সৃষ্টি করিয়াছিলেন। কিন্তু আমার পিতামহ বহু পূর্ব হইতেই আমাকে ও শ্যামকান্তিকে সাবধান করিয়া দিয়াছিলেন। তিনি বারে বারেই বলিতেন, অতি লোভ ভাল নহে। সম্পত্তি বাড়াইতে অসুবিধা নাই, উহা বজায় রাখা কঠিন। বিশেষত বর্তমানের ইংরেজ কোম্পানির রাহুর গ্রাস সম্পর্কে তিনি আমাদের সর্বদা সতর্ক থাকিতে বলিতেন।

পিতামহের কতগুলি কথা আমি কখনওই ভুলিব না। তিনি বলিতেন, আমরা এদেশিরা দীর্ঘকাল পরাধীন হইয়া আছি। অপরের দোষ নহে, ইহা আমাদেরই চরিত্রহীনতা ও কাপুরুষতার ফল। তথাপি মুসলমান রাজারা যখন এ দেশ দখল করিয়াছিল, তখন পিছনে তাহারা নিজেদের স্বদেশ বলিয়া কিছু রাখিয়া আসে নাই। ইহারা রাজশক্তির দ্বারা আমাদের উপর যৎপরোনাস্তি অত্যাচার করিয়াছে, কিন্তু এ দেশকেই নিজেদের স্বদেশ বলিয়া জ্ঞান করিয়াছে। সিংহাসনের লোভে ইহারা পিতৃহন্তা ভ্রাতৃঘাতী হইতেও দ্বিধা করে না। ইহা সকল দেশে, সকল জাতির মধ্যেই আছে। আমাদের স্বাধীন হিন্দু যুগেও ছিল। কিন্তু মুসলমানরা এ দেশকেই স্বদেশ জানিয়া, নিজেদের মঙ্গল বিধানে আমাদেরও কিছু মঙ্গল করিয়াছে। এমন কী ধর্মের দিক হইতে রাজপুরুষেরাও হিন্দুয়ানি একেবারে বিসর্জন দিতে পারে নাই।

কিন্তু ইংরাজেরা এখানে আসিয়াছে কেবল লুঠ করিতে। এ দেশ তাহাদের কাছে বিদেশ, তাহাদের লক্ষ্য নিজেদের স্বদেশের উন্নয়ন। পলাশির যুদ্ধের পরে তাহারা রাক্ষসবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছে। লুঠতরাজ, দরিদ্র রায়তদের প্রহার, নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনায় দাঁড়াইয়াছে। তাহারা বিনা মাশুলে সকল দ্রব্য ক্রয় করে, বিক্রয় করিতে হইলে অধিক মাশুল গ্রহণ করিয়া থাকে। কেহ প্রতিবাদ করিলে নবাবের

বাবারও ক্ষমতা নাই, তাহাকে রক্ষা করে। নবাব তাহাদের হাতের ক্রীড়নক মাত্র। মীরকাশিমের দুরবস্থা ইহা আরও পরিষ্কার করিয়া দিয়াছে। দিল্লির সনদে বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি পাইয়া তাহাদের লোভ ও নিষ্ঠুরতা চরমে উঠিয়াছে। এ সমস্ত ব্যাপারে তাহাদের যাহারা সাহায্য করিয়াছে, তাহারা নিজেদের সচ্চরিত্র, ভদ্র, গুণী বলিয়া দাবি করে। আমি বুঝি না, সিরাজদ্দৌলা অপেক্ষা নবকৃষ্ণ, জগৎশেঠ, কৃষ্ণচন্দ্রের ন্যায় ব্যক্তিরা কী গুণের গুণনিধি। নবাবের অত্যাচারের প্রতিশোধ লইতে তাহারা ইংরাজকে শাসনক্ষমতা দিয়াছে। নবাবের অপেক্ষা ইংরাজরা কোন দিক হইতে ভাল? নবাবদের তবু একটা আভিজাত্যবোধ ছিল। কোম্পানির সাহেবদের তাহাও নাই। প্রকৃতপক্ষে ইহারা এক শ্রেণীর দেশত্যাগী হৃদয়হীন ভাগ্যান্বেষী নীতি-জ্ঞানহীন অর্থপিপাসু। মানিতে হইবে, উহাদের বুদ্ধি অতি কুটিল, বেপরোয়া। যোদ্ধা হিসাবে উহারা এমন কিছু দুর্ধর্ষ নহে। নবাবের সকল রকম দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করিয়াছে, নবাব-বিরোধীদের সাহায্যে যুদ্ধে জিতিয়াছে। অবশ্য উহাদের বানিয়া দূরদৃষ্টিও আছে। শুনিয়াছি উহাদের দেশে নানা প্রকার যন্ত্রাদি প্রস্তুত হইয়াছে। তাহাতে আমাদের কী লাভ? দেশের যে-সব ব্যক্তি কোম্পানির সঙ্গে হাত মিলাইয়াছে, তাহারা কে-ই বা সৎ? উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য সাহেবদের চাটুকারিতা করিয়া কিছু প্রসাদ পাইয়াছে। ইহাদের আভিজাত্যবোধই বা কীসে আছে। এই সব। ইংরাজ-প্রভুভক্ত, নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিয়া, নিজেদের উদর পূর্তি করিতেছে। দেশের ব্যবসায়ী বণিকরা দরিদ্র রায়তরা সশঙ্কিত জীবনযাপন করিতেছে।

আমাদের দুর্ভাগ্য, দিল্লি ও বাংলা বিহার উড়িষ্যা নিজেদের উচ্ছঙ্খলতায় ও বিবাদে মগ্ন থাকিয়া, বিশ্বাসী অনুচরদের ষড়যন্ত্রে ও বিশ্বাসঘাতকতায় ইংরাজদের কাছে পর্যদস্ত হইয়াছে। দুর্ভিক্ষ লাগিয়াই। আছে, লাগিয়া থাকিবেও। কারণ দেশের সমস্ত সম্পদ ইংরাজরা তাহাদের স্বদেশে লইয়া যাইতেছে। তাহাদের রাজারানি আছে, শুনিয়াছি শাসন পরিচালনার জন্য সেখানে জনপ্রতিনিধিরা আছে। উহা তাহাদের বিষয়। তাহাদের স্বদেশের বিষয়। কিন্তু এ দেশকে অবাধে লুণ্ঠন করিয়া নিজের দেশের পুষ্টিসাধন করিতেছে। ইহারা অত্যন্ত চতুর, চরিত্রে নিষ্ঠুর, নীচাশয়। লোভের জন্য যে কোনও অপকর্ম করিতে ইহাদের কিছুমাত্র দ্বিধা নাই। ইহারা কোনও সুকর্ম করিলেও জানিবে, পিছনে নিশ্চয়ই নিজেদের স্বদেশের কোনও সুসারের গূঢ় কারণ রহিয়াছে।

এ সমস্ত কথাই আমি নাটুকে বলিয়াছি। সতর্ক করিয়াছি, কিন্তু কালগতি ভিন্ন। নাটু কলিকাতায় যাইবার ইচ্ছা পোষণ করে। সে যাহা ইচ্ছা করিতে পারে, আমার আর বলিবার কিছু নাই। তালুক-মুলুক সংসার-সমাজ স্ত্রী-পুত্র সকলই আমার পিছনে পড়িয়া রহিল। এই পৃথিবীতে আমি এখন এক নতুন আগন্তুক। অতীত থাকিয়াও নাই। ভবিষ্যৎ অজানা। মনে হইতেছে, কোন অলক্ষ্য হইতে এই পৃথিবীতে আমি নিক্ষিপ্ত হইয়াছি।

.

প্রকৃতপক্ষে বিচার করিলে মানুষের জন্মই এক প্রকার এইরূপ। আমি দৈবক্রমে আজ ইহা উপলব্ধি করিতেছি। জীবধর্মে আমার জন্ম হইয়াছে, কিন্তু আমার জীবনের নিয়ামক আমি নহি। জন্মসূত্রেই মানুষ এই পৃথিবীতে আগন্তুক মাত্র। তাহার ইচ্ছায় কিছুই ঘটে না। যে সংসারে ও পরিবেশে সে জন্মায়, তাহার স্রোতে সে ভাসিয়া চলে। এই ভাসিয়া চলার গতিপথ, তাহাকে নানা দিকে প্রবাহিত করিতেছে। সে ইহাকে নিজের কর্মফল জানিয়া, জীবনকে সেই স্বরূপে দেখিতেছে। কিন্তু তাহা আদৌ তাহার কর্মফল নহে। তাহার নিয়তি তাহাকে চালিত করিতেছে।

সারাটা দিন ও রাত্রির মধ্যে অনেক বারই ইচ্ছা হইল, নাটুকে লক্ষণার ও তাহার সন্তান দুইটির বিষয়ে কিছু বলি। নিজের সহোদরদের বিষয়ে সে উদাসীন থাকিবে না, বা তাহাদের বঞ্চিত করিবে না। কিন্তু বৈমাত্রেয় ভাইদের বঞ্চিত করা কিছু আশ্চর্যের নহে। লক্ষণার বয়স এখন তেইশ। তাহার প্রথম পুত্রটির বয়স এখন এগাররা। দ্বিতীয় পুত্রটির সাত।

কিন্তু কিছু বলা নিরর্থক। নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝিতেছি, নিয়তির দ্বারা তাহাদের জীবন চালিত হইবে। মানুষ মাত্রের জীবনই একরূপ। নাটুর জীবনও তাহার নিয়তির দ্বারা চালিত হইতেছে। এই উপলব্ধির পরে আর আমার অতীতের ভূমিকা লইয়া তাহাকেও কিছু বলিবার নাই। তথাপি সারা রাত্রি নির্বিঘ্নে নিদ্রা যাইতে পারলাম না। গত রাত্রের মতোই বারে বারে স্বপ্ন দেখিলাম। স্বপ্নের মধ্যে ইন্দুমতী ও লক্ষণাকে বেশি দেখিলাম। তাহাদের প্রতি আমার আকর্ষণ পূর্ণমাত্রায় রহিয়াছে। সত্য বলিতে কী, মনের গূঢ় আকাঙ্ক্ষা অতি বিচিত্র। বিষয়কৰ্ম বা সন্তানসন্ততিদের স্বপ্ন বিশেষ দেখিলাম না। কখনও ইন্দুমতীকে, কখনও লক্ষণাকে স্বপ্নের মধ্যে কামোল্লাসে আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিতেছিলাম। বিবিধ শৃঙ্গারে ও রমণে লীলা করিতেছিলাম। কখনও দেখিতেছিলাম, ইন্দুমতীর কামনা-উদ্বেল বাহুপাশে আলিঙ্গিত হইয়া তাহার টাড়বালা (ব্রেসলেট) আমার কাঁধে ঈষৎ ক্ষতের রেখা আঁকিয়া দিয়াছে। লক্ষণাকে তাহার কটিদেশের রুপার শিকলি টানিয়া আকর্ষণ করিতে গিয়া শিকলি ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছি এবং সান্ত্বনা দিতেছি, স্বর্ণকারের কাছে গিয়া শীঘ্রই উহা জোড়া লাগাইয়া আনিব। কখনও দেখিতেছিলাম, প্রভাতে শয্যাত্যাগের আগেই লক্ষণা বা ইন্দুমতী আমার মুখ বুক ও বাহু হইতে তাহাদের অঙ্গের সিন্দুর ও কাজলের দাগ মুছাইয়া দিতেছে।

এমন নহে যে, আমি অতিমাত্রায় ইন্দ্রিয়াসক্ত বা স্ত্রৈণ ছিলাম। কামাসক্ত ব্যভিচারীও ছিলাম না। ইন্দুমতী ও লক্ষণা মুরশিদাবাদ ও বর্ধমান গমনকালে ঠাট্টা করিয়া বারাঙ্গনাদের কুহকে জড়াইয়া না পড়িবার জন্য সতর্ক করিয়া দিত। তাহাদের চোখে আমি সুপুরুষ ছিলাম। নগরের নাগরীরা যেন ওত পাতিয়া বসিয়া থাকিত। পাছে আমাকে তাহারা বশ করে, সেইজন্য শিশুতুল্য জ্ঞান করিয়া আমার বাঁ হাতের কনিষ্ঠ আঙুলে দাঁতে দংশন করিয়া, বুকে মুখামৃত (থুথু ছিটাইয়া দিত। কিন্তু উভয়ে ভালই জানিত, রমণী বলিতে তাহারা দুইজন আমার একমাত্র কামনার ধন ছিল।

রাত্রের অগভীর নিদ্রায় বারে বারে তাহাদের স্বপ্ন দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম, নিয়তিচালিত উপলব্ধির মধ্যেও ইন্দুমতী ও লক্ষণা আমার প্রাণের গভীরে আন্দোলিত হইতেছে। ইহা আমার কাছে। বিস্ময়কর বোধ হইল। দৈনন্দিন জীবনে তাহাদের সংসারের কাজ, গৃহদেবতার পূজার আয়োজনে রত, সন্ধ্যায় গা ধুইয়া নতুন সজ্জায় সজ্জিত, ধূপদীপ মাঙ্গলিক লইয়া ব্যস্ত, স্বপ্নের মধ্যে তাহাও দেখিতেছিলাম। অধিকাংশ স্বপ্ন তাহাদের দুইজনকে ঘিরিয়া আমার নিদ্রার ঘোরে আবর্তিত হইতেছিল। অথচ পূর্বে এইরূপ কখনও হয় নাই। আমার জীবন তো কেবল তাহাদের লইয়া অতিবাহিত হইত না। বরং কর্মোপলক্ষে বছরের অনেকগুলি দিন বাহিরে কাটাইতে হইত। জমিদারদের ন্যায় গৃহে বসিয়া কেবল কর্মচারীদের দ্বারা কাজ মিটিত না। গৃহে থাকিলেও সদা সর্বদাই বিষয় কাজে ব্যস্ত থাকিতে হইত। অথচ, মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে যখন এত কালের জীবন অতীত হইতে চলিয়াছে, তখন স্বপ্নের মধ্যে তাহারাই বারে বারে আসিয়া আমাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিতেছে। জীবনের এই রহস্য বুঝিতে পারিলাম না।

.

রাত্রি প্রভাত হইল। ত্রিবেণী সারা রাত্রিই জাগিয়া থাকে। সারা ভারত হইতে বারো মাস এখানে তীর্থযাত্রীদের ভিড়। বিশেষ করিয়া উড়িষ্যাবাসীদের ভিড় সর্বাপেক্ষা বেশি। পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরাও এই পুণ্যভূমি মুক্তবেণীতে স্নানের জন্য বারোমাস যাওয়া-আসা করে। স্নানযোগ থাকিলে তো কথাই নাই। অধোদয় যোগে এখানে যে বিশাল ভিড় হয় তাহা গঙ্গার ধার ধরিয়া ক্রোশ পর্যন্ত তীর্থযাত্রীতে ভরিয়া যায়। কার্তিক মাসে প্রত্যহ প্রাতঃস্নান একটি আবশ্যিক পালনীয় ধর্ম। সেইজন্যই এখন বহুলোকের ভিড়। ব্যবসা বাণিজ্যের আগের অবস্থা না থাকিলেও এখনও মুরশিদাবাদ বর্ধমান হইতে আগত মালবাহী নৌকা ও জাহাজ এখানে নোঙর করে। তাহা ছাড়া, গঙ্গাযাত্রী আমি একলা নহি। প্রতি দিনই গঙ্গাযাত্রী আসিতেছে। বাঁধানো ঘাটে জায়গা না পাইলে, আশেপাশে অনেক চালাঘর প্রস্তুত করিয়া গঙ্গাযাত্রীদের রাখা হয়। ইহারই মধ্যে অন্তর্জলির জন্যও দুই-এক নারী পুরুষকে সর্বদাই দেখা যায়।

আমি অপরিচিত, স্থানীয়, বিদেশি বহিরাগতদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছি। আমাকে লইয়া তাহাদের আলোচনার শেষ নাই। অধিকাংশের চোখে আমি কৃপার পাত্র। কাহারও মতে পূর্বজন্মের পাপের ফল ভোগ করিতেছি। এ সকলই আমার নিকট উৎপাত বোধ হইতেছে। অন্তরে ক্রোধ ও উত্তেজনার উদ্রেক হইতেছে। কিন্তু তাহা প্রকাশ করিলে সকলে আমাকে উন্মাদ ভাবিবে। মনে করিবে সংসার সমাজ হইতে পরিত্যক্ত হইয়া আমার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিয়াছে।

সর্বাপেক্ষা উৎপাতের বিষয় হইল, কয়েকজন পরিচিত ব্যক্তিদের লইয়া। যাহারা আমাকে চিনিতে পারিয়াছে, তাহারা আমার প্রতি করুণাবশত নানা প্রকার আক্ষেপ করিতেছে। আমার বংশ ধন সম্পত্তি লইয়া আলোচনা করিতেছে। আহা, ইহার কী বা বয়স। স্বাস্থ্য অতি উত্তম দেখাইতেছে। মৃত্যুর কোনও লক্ষণই নাই। কুলীনকুলমণি, লক্ষ্মীর বরপুত্র, গৃহে না-জানি কত পত্নীরা রহিয়াছে।

আমি ইহাদের মনে মনে গালি দিতেছিলাম। ইচ্ছা হইতেছিল, ইহাদের মুণ্ডচ্ছেদ করি, লাথি মারিয়া দূর করি।

এই তীর্থে সকলেরই আগমন হইয়া থাকে। বৈদ্যরা ওষুধের ঝুলি লইয়া ঘুরিতেছে। ব্রাহ্মণরা স্নান-তর্পণের মন্ত্র পড়াইবার জন্য ও পারলৌকিক কাজের আশায় ঘুরিতেছে। তাম্বুলী মালাকারেরা ফুল। ও মালা লইয়া ফিরিতেছে। নাপিতরা তাহাদের পেটিকা লইয়া সকলের কাছে যাইতেছে। এমনকী দু-এক বৈদ্য আমাকে এখনও চিকিৎসা করিয়া ওষুধ দিতে চাহিতেছে। বিদ্রূপ করিতে ইচ্ছা হইলেও চুপ করিয়া রহিলাম। উহাতে বিবাদের সৃষ্টি হইবে। ইহারা সকলেই আপন আপন জীবিকার কারণে এই মহাশ্মশান ও তীর্থে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। সকলেই বাঁচিতে চাহে। ইহারা বাঁচিবার জন্যই এই জনারণ্যে হাঁকিয়া ফিরিতেছে। ভিড় ও কোলাহলের অন্ত নাই।

ইহারই মধ্যে আমি সরস্বতীর জঙ্গল ঘুরিয়া আসিয়া গঙ্গায় ডুব দিয়া স্নান করিলাম। আজ আমার কাহারও সাহায্যের দরকার হইল না। শরীরে দুর্বলতা বোধ প্রায় নাই। স্বাভাবিক সুস্থ বোধ করিতেছি। আমার সঙ্গে সকলেই স্নান করিল। সকলেরই বিশেষ তাড়া। শ্যামকান্তি ভবতারণ খুড়া ও নাটু স্নানের পরে গায়ত্রী জপ করিল। আমি করিলাম না। গতকালও করি নাই। আজ ভবতারণ খুড়া জিজ্ঞাসা করিল, তর্পণ গায়ত্রী কিছুই করিলে না। উত্তর দিবার প্রয়োজন বোধ করিলাম না। ভবতারণ খুড়াও আর কিছু জিজ্ঞাসা করিল না।

নাটু কাঁদিতে আরম্ভ করিয়াছিল। তার মধ্যে শ্যামকান্তি ও পরমেশ ভট্টাচার্য প্রাতঃকালীন খাদ্যসমূহ লইয়া আসিল। ইহাদের সঙ্গে আজ আমার শেষ আহার। খাওয়া শেষ হইলে, শ্যামকান্তি জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি কলিকাতায় যাইবেন?

আমি মাথা নাড়িয়া বলিলাম, না, আর যেখানেই যাই, কলিকাতায় যাইব না। পরমেশ ভট্টাচার্য বলিল, যেখানেই যান, আপনার অর্থের প্রয়োজন। তাহার কী ব্যবস্থা করা যাইবে। আপনি এখানে কয়েক দিন থাকিলে টাকা আনিবার ব্যবস্থা করা যায়।

ভাবিলাম, টাকার প্রয়োজন আছে। কিন্তু এককালীন বেশি টাকা লইয়া আমি কোথায় কী করিব। টাকা যখন নিঃশেষ হইয়া যাইবে তখনই বা কী করিব। আমি যখন পরিত্যক্ত হইয়াছি, তখন টাকাও আমাকে ত্যাগ করিয়াছে। আমি জানি, পরমেশ ভট্টাচার্য কেন টাকার কথা বলিতেছে। আমার ন্যায় গঙ্গাযাত্রী ব্যক্তিরা বাঁচিয়া উঠিয়া কোথাও গিয়া বাসস্থান নির্মাণ করিয়া থাকে। আমার সেই রূপ কোনও ইচ্ছা নাই। বলিলাম, আমার বেশি টাকার দরকার নাই। তোমাদের কাছে গঙ্গাযাত্রা, দাহ ও শ্মশানকার্যের জন্য যদি কিছু টাকা থাকে, তাহা আমাকে দাও। তাহাতেই আমার চলিবে।

ইহা যথার্থ অভিমানের কথা নহে। ক্রোধে ও ঘৃণায় আমার অন্তর মথিত হইতেছিল। নতুন করিয়া অর্থবিত্তসহ জীবনে প্রতিষ্ঠালাভের কোনও আকাঙ্ক্ষা আমার আর নাই। নাটু উৎকণ্ঠিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কীরূপে জীবন ধারণ করিবেন।

বলিলাম, যে রূপে মরিয়া বাঁচিয়া উঠিলাম, সে রূপেই জীবনধারণ করিব। তোমাদের কাছে অর্থ-বস্ত্র কিছু থাকিলে তাহাই আমাকে দিয়া যাও। যেখানে আমার আর প্রত্যাগমনের অধিকার নাই, সেখানকার কিছুই আর আমি দাবি করিব না। সেইজন্যই কেবল মাত্র গঙ্গাযাত্রা ও শ্মশানকার্যের জন্য যাহা কিছু আনিয়াছ, আমাকে তাহাই দাও।

নাটু সকলের দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় জিজ্ঞাসু চোখে তাকাইল। কেহই কিছু বলিতে পারিতেছে না। একমাত্র পরমেশ ভট্টাচার্য অবশেষে বলিল, মহাশয় যাহা বলিতেছেন, তাহাই করা উচিত।

তখন নাটু ও শ্যামকান্তি ধুতির কোমরে গোঁজা থলি বাহির করিয়া সমুদয় অর্থ আমাকে দিল। উভয়ের কাছে সর্বসমেত কিছু খরচাসহ পঞ্চাশটি ফরাকাবাদি সনাতি টাকা ছিল। সনাতি অর্থাৎ সনওয়াতি, পোদ্দারের নিকট ভাঙাইতে গেলে সন মোতাবেক কিছু কম মূল্যে ভাঙাইয়া দেয়। এক সনের মুদ্রিত টাকার দাম পরের সনে কিছু কমিয়া যায়। ইহা পোদ্দারের কারসাজি মাত্র, অন্যথায় ভাঙানো যায় না। কেহ কেহ এই টাকাকে ফরাককাবাদী টাকাও বলে। কারণ ফরক্কাবাদের নতুন টাকশালে ইংরাজ কোম্পানি এই টাকা প্রস্তুত করে। নাটু ও শ্যামকান্তির টাকার থলিতে সিন্দুর মাখানো ছিল। টাকা ছাড়া, থলির মধ্যে সিন্দুর লাগানো কড়ি, সুপারি, কয়েকটি ধান ও দূর্বা ছিল। আমি টাকা, ও ভাঙানো খুচরা মুদ্রাগুলি লইয়া তাহাদের থলি ফিরাইয়া দিলাম।

নাটু তাহার থলিটি আমাকে রাখিতে বলিল। আমি মনে মনে হাসিলেও বলিলাম, উহা তোমার সৌভাগ্যের থলি, তোমার কাছেই রাখো। গতকালের পোয়া শুকনো বস্ত্রটি আমি পরিয়াছিলাম। ইহা একটি পুরনো চন্দ্রকোণা ধুতি। সম্ভবত গঙ্গাযাত্রার প্রাক্কালে ইন্দুমতী বা লক্ষণা হাতের সামনে ধুতিটি পাইয়া আমার কোমরে জড়াইয়া দিয়াছিল। গতকালের খুইয়াঁ বস্তুটি দুই পাইক হাতে ধরিয়া শুকাইবার চেষ্টা পাইতেছে। নাটু আমাকে আরও দুই খণ্ড বস্ত্র দিল। ইহা প্রায় শাটির তুল্য। মসৃণ ও পরিচ্ছন্ন। বুঝিতে অসুবিধা হইল না, আমার মুখাগ্নি ও দাহকর্মের পরে স্নান করিয়া সে এই বস্ত্র কাছা লইবার জন্য সঙ্গে আনিয়াছিল। তাহার আর প্রয়োজন হইল না, অতএব ইহা আমার বরাতেই জুটিল। অতিরিক্ত একটি নতুন গামছাও সে আমাকে দিল। সেই সঙ্গে গতকালের ধোয়া শুকনো নিমাস্তিনটিও (হাফ হাতা পাঞ্জাবি বিশেষ) দিল। আমি সেইটি গায়ে পরিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমাদের নৌকা কোথায় রাখিয়াছ?

নাটু বলিল, উত্তরে জামাই জাঙ্গালের বাঁকে। দু ঘরের বাহিরে সিঁড়ির ওপর গঙ্গার দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল। আমি উঠিয়া দাঁড়াইলাম। নাটু ধরিতে আসিল, প্রয়োজন হইল না। বলিলাম, পাইকদের বলো, আর কাপড় শুকাইবার সময় নাই। আমি সবই এই গামছায় বাঁধিয়া লইতেছি।

নাটুকে বলিতে হইল না। পাইকরা আসিয়া বলিল, কাপড়টি অর্ধেক শুকাইয়াছে। তাহারাই গামছার এক অংশে অর্ধেক ভিজা কাপড়টি, বাকি অংশে নাটুর কাছা লইবার বস্ত্র দুই খণ্ড বাঁধিয়া দিল। টাকাগুলি আমি আগেই কোমরের কষিতে খুঁজিয়াছিলাম। আমাকে যে খট্টা ও বিছানায় লইয়া আসা হইয়াছিল, রাত্রি পোহাইবার আগেই তাহা শ্মশানের ডোম আসিয়া লইয়া গিয়াছে। আমি বাঁচিয়া উঠিবার পর হইতেই আমার শ্মশানযাত্রা শয্যার প্রতি সে লক্ষ রাখিয়াছিল। বলিয়াছিল, মুদ্দার কড়ি যখন পাইলাম না, তখন ইহাই যথেষ্ট অর্থাৎ প্রতি মৃতদেহ পিছু তাহার কিছু প্রাপ্তি থাকে। আমি বাঁচিয়া উঠিয়া তাহাকে বঞ্চিত করিয়াছি।

আমি বলিলাম, এখন ভরা কোটাল জোয়ার রহিয়াছে, তোমরা আর বিলম্ব করিও না। যাত্রা করো। আমি নিজেই দুযাকে ডাকিলাম। দু কাঁদিতেছিল। কাছে আসিয়া বলিল, বড় কর্তাদাদা, আমি আর ফিরিয়া যাইতে চাহি না। আপনার এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী। আমাকে দেখাইয়া গ্রামের সকলে বলিবে, আমিই কুস্তিযুদ্ধে আপনার সর্বনাশ ঘটাইয়াছি। আমাকে আপনার সঙ্গে রাখুন।

আমি তাহাকে বলিলাম, আমার সঙ্গে কেহ যাইবে না। মরিলেও যাইত না। তোকে ফিরিতে হইবে। তোকে কেহ দোষ দিবে না, বলিবে ইহা বেদো বন্দ্যোঃ-র ভাগ্য। আমার কথার অবাধ্যতা করিস না, চলিয়া যা।

সম্ভবত আমার কণ্ঠস্বর কঠোর শুনাইল। দু আর আপত্তি করিল না। আমার পায়ে মাথা ঠেকাইয়া সকলের আগে চলিয়া গেল। ভবতারণ খুড়া আর পরমেশ ভট্টাচার্য ছাড়া সকলেই আমাকে প্রণাম। করিল। আমিও তাহাদের সঙ্গে চলিলাম, ভবতারণ খুড়া আমার দুর্বল শরীরের কথা বলিয়া আপত্তি করিল। আমি হাসিয়া বলিলাম, খুড়া, এখন তোমাকে টানিয়া লইয়া গঙ্গায় ডুবাইতে পারি। আমাতে এখন প্রেত ভর করিয়া আছে। বাক্যব্যয় না করিয়া তাড়াতাড়ি চলল।

ভবতারণ খুড়ার মুখে ভীতির অভিব্যক্তি ফুটিয়া উঠিল। সে আর কথা না বলিয়া দ্রুত চলিতে লাগিল। চারিপাশে প্রচণ্ড ভিড়। খড় ও শনের অতি নিচু ছোট ছোট দোচালা খুপরির ছড়াছড়ি। স্নানযাত্রীরা এই সব ঘরে আশ্রয় লইয়াছে। উঁচু পাড়ে, সারবন্দি গোরুর গাড়ি দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। মাল বোঝাই ও খালাস যুগপৎ চলিতেছে। পশ্চিমের আরও উচ্চে হাটখোলা, বহুতর দোকানপাট। আমি সকলের সঙ্গে জামাই জাঙ্গালের বাঁধের রাস্তা দিয়া উত্তরে চলিলাম। বেশি দূর যাইতে হইল না। এক পোয়া ক্রোশেরও কম, জাঙ্গালের নীচে জঙ্গল ও গাছপালা ভাসাইয়া ভরা কোটালের জল তীব্র বেগে বহিতেছে। দুইটি নৌকা দুই গাছে দড়ি দিয়া বাঁধা ছিল। একটিতে হোগলার ছই। উহা আমাদের। ব্যবহারের জন্য। আর একটি জেলে ডিঙ্গি। ইহাও আমাদের। কুন্তী নদীতে মাছ ধরিবার জন্য ব্যবহার করা হয়। আমি নিজেও অনেক বার এই জেলে ডিঙ্গিতে করিয়া কুন্তী নদীতে মাছ ধরিয়াছি। ভাসিতে ভাসিতে গঙ্গায় আসিয়াছি।

মাঝিরা সকলেই আমার পরিচিত। তাহারা আমার দিকে ভয়বিস্মিত চোখে যেন অলৌকিক কিছু দর্শন করিতেছে। ভবতারণ খুড়া মাঝিদের নৌকা তীরে লাগাইতে বলিল। মাঝিরা নৌকার দড়ি খুলিয়া লগি ঠেলিয়া, নৌকা দুইটিই তীরে লাগাইল। আবার সকলে আমার দিকে চাহিল। আমি নাটুর হাত ধরিয়া তাহাকে বাঁধের ঢালুতে নামাইয়া দিলাম। শ্যামকান্তি কিছু বলিতে চাহিল, পারিল না। কান্নায় স্বর বন্ধ হইল। দু সকলের আগে জেলে ডিঙ্গিতে লাফাইয়া পড়িল। একে একে সকলেই নৌকায় উঠিল। অনেকগুলি বড় বড় গাছ থাকায় মাঝিদের সুবিধা ছিল। তাহারা গাছ আঁকড়াইয়া ধরিয়াছিল। সকলে উঠিবার পরে মাঝিরা গাছ ছাড়িয়া, লগি ঠেলিয়া দিল। নৌকা জলে ডুবিয়া যাওয়া জঙ্গল হইতে গঙ্গার স্রোতে গিয়া পড়িল। দেখিতে দেখিতে নৌকা দ্রুত উত্তরে ভাসিয়া চলিল।

মনে হইল, আমার হৃৎপিণ্ড বুক ঠেলিয়া গলার কাছে আসিতেছে। চোখ ঝাপসা হইয়া যাইতেছে। অলক্ষ্য হইতে নিক্ষিপ্ত সংসারে নব আগন্তুকের উপলব্ধিকে অতীত এই মুহূর্তে যেন ভাঙ্গিয়া চুরিয়া দিতে চাহিল। আমার চোখের সামনে গ্রাম গৃহ সংসার ঘর, মা, ইন্দুমতী লক্ষণা পুত্র-পৌত্র দাসদাসী সকলের মুখগুলি ভাসিয়া উঠিল। কাল বসিয়া থাকিবে না, সংসার নিশ্চল থাকিবে না, জীবন স্তব্ধ হইবে না। সকলই তাহার আপন নিয়মে চলিবে। তথাপি একটা তীব্র শোকের অনুভূতি আমাকে গ্রাস করিতে চাহিল। আমি শ্বাসরুদ্ধ করিয়া হৃদয়ের এই অহেতুক আবেগকে দমন করিতে চেষ্টা করিলাম।

.

জামাই জাঙ্গালের তীরে ঘন বৃক্ষের অন্তরালে, দুইটি নৌকাই অদৃশ্য হইল। গামছার পুঁটলি দিয়া আমি চোখ মুছিলাম। কিন্তু গঙ্গার দিকে তাকাইয়া রহিলাম। আস্তে আস্তে আমার চোখের সামনে হইতে, পূর্ব মুহূর্তের সকল চিত্র মুছিয়া যাইতে লাগিল। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ক্রমে আমি আপনাকে খুঁজিয়া পাইতে লাগিলাম। সকলে সকলের সহিত সম্পর্ক খুঁজিয়া ফিরিতেছে। কিন্তু সকলেই একাকী এবং সকলেই তাহার নিয়তির দ্বারা চালিত হইতেছে। কেহ কাহারও জীবনের নিয়ামক নহে। এই উপলব্ধির মধ্যে, বেদান্তের সংসারের অনিত্যতা ভাবনা আমাকে কোনও সান্ত্বনা দিতে পারিতেছে না। কেহ কাহারও নহে। এই যদি সত্য, তবে জন্মাইলাম কেন। যদি জন্মাইলাম, তবে নিয়তির হাতের ক্রীড়নক হইলাম কেন। ভাবিয়া অন্তরে সেই ক্রোধ ও ঘৃণা জাগিয়া উঠিয়া, এক প্রকারের বিবমিষা সৃষ্টি করিল। বমনোদ্রেক হইল অথচ বমন হইল না। কেবল বারে বারে থুৎকার দিলাম, এবং ধীরে ধীরে একটা বিরক্ত বৈরাগ্যের ভাব আসিয়া আমাকে এই বিশ্বসংসারের প্রতি সমস্ত কৌতূহল নিবারণ করিয়া, একটা অনীহা সৃষ্টি করিল।

এই জামাই জাঙ্গাল (সড়ক বা রাস্তা) ত্রিবেণী হইতে মহানাদ পর্যন্ত গিয়াছে। শুনিয়াছি, গঙ্গার বাঁধ তৈরির জন্য, এই সুদীর্ঘ জাঙ্গালটি উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দদেব তৈরি করাইয়াছিলেন। ঘাট গঙ্গাযাত্রার ঘরও তাঁহারই তৈরি। সেইজন্য উড়িষ্যাবাসীদের কাছে ত্রিবেণী অধিক খ্যাতনামা তীর্থ। এখানে পুণ্য করিতে আসিয়া তাহারা নিজেদের রাজার গৌরবও অনুভব করে। দেখিতেছি, এই কার্তিকের স্নানযাত্রা উপলক্ষে তাহাদের ভিড় এদিকেও ছড়াইয়া পড়িয়াছে। গোলপাতা শন ও খড়ের নিচু দোচালা খুপরি করিয়া প্রভাতের স্নানশেষে, রান্নার আয়োজন চলিতেছে।

সহসা মহানাদের জীয়তকুণ্ডের কথা আমার মনে পড়িল। উহা নাকি দেবখাত নামে খ্যাত। উহার জল সিঞ্চনে মৃতও প্রাণ ফিরিয়া পাইত। মুসলমানরা আসিয়া, কুণ্ড স্পর্শ করিয়া দেবখাতের জীবনদায়িনী শক্তিকে নাকি নষ্ট করিয়াছে। মানুষ এইরূপ ভাবিতে ভালবাসে, বিশ্বাস করিতে চাহে, আর প্রবাদকে প্রচার করিয়া থাকে। এক বার ভাবিলাম, এই পথে হাঁটিতে আরম্ভ করি। পরে মনে হইল, এই পথে কুন্তী নদী অতিক্রম করিতে হইবে। এই পথে যাইব না। ত্রিবেণীর ঘাটের দিকেই ফিরিয়া গেলাম। যাইতে যাইতে নিমাস্তিনের খোলা বুকে হাত পড়িতে পৈতার স্পর্শ পাইলাম। উহা তৎক্ষণাৎ টানিয়া ছিঁড়িয়া পাশের জঙ্গলে নিক্ষেপ করিলাম। এখন আমার আর কোনও জাত নাই, গঙ্গাযাত্রা করিয়া বাঁচিয়া উঠিয়াছি। লোকে প্রেত বিবেচনা করিবে। আমি মূর্তিমান অমঙ্গল। কিন্তু পৃথিবীতে নতুন আগন্তুক আমি একজন মানুষ মাত্র। আর কোনও পরিচয় নাই। অতীতের কোনও সংস্কার বিশ্বাসও নাই।

.

তিন রাত্রি ত্রিবেণীতে আমিও স্নানযাত্রীদের সঙ্গে বাস করিলাম। ইতিমধ্যে একজন নরসুন্দরকে ডাকিতেই সে আগ্রহ সহকারে তাহার কাঠের ছোট পেটিকা খুলিয়া বসিল। আমি তাহার কাছে সীসক (আয়না) চাহিলাম। সে আমাকে একটি কাঁসার উজ্জ্বল মসৃণ দর্পণ দিল। আমি আমার মুখ দেখিলাম। কয়েক দিনের দাড়ি গজাইয়াছে। এমন কিছু বেশি দিনের নহে। সচরাচর তিন দিন অন্তর নরসুন্দর ক্ষৌর কাজ করিত। আমার দুই-চারিটি কেশ পাকিলেও, গোঁফ দাড়ি কিছু বেশি পাকিয়াছিল। তাহার দর্পণটি যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন, তথাপি জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমার পুরনো সীসক নাই, বিলাতি আয়নাও নাই? আজকাল তো সকলে তাহাই ব্যবহার করে। জবাবে নরসুন্দর জানাইল, কোনও এক প্রতিবেশী শ্যালককে বিলাতি আয়না আনিবার জন্য টাকা দিয়াছিল। সে শ্যালক (ব্যাঙ্গার্থে) সেই যে কলিকাতায় গিয়াছে আর ফিরিয়া আসে নাই। বলিয়া সে ব্যস্ত হইয়া কাঁচি কাকই ক্ষুর ইত্যাদি বাহির করিল। আমি তাহাকে একটি পয়সা দিয়া বলিলাম, আমার চুল দাড়ি কাটিবার প্রয়োজন নাই।

নরসুন্দর হতাশ হইল। বিরক্ত হইয়া আমার হাত হইতে দর্পণটি লইয়া পেটিকায় ভরিয়া বিড়বিড় করিতে করিতে চলিয়া গেল। আমার মাথার চুলগুলি জট পাকাইয়াছে। কয়েক দিন আঁচড়ানো হয় নাই। দুর্বল বোধ না করিলেও মুখে একটা ক্লিন্নতার ছাপ পড়িয়াছে। চোখ দুইটি ঈষৎ লাল, কোলগুলি বসিয়া গিয়াছে। তিন দিনই জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের গৃহের কাছাকাছি এক বার করিয়া ঘুরিয়া আসিয়াছি। তাঁহার মৃত্যুর পরে টোলের আর সেই চেহারা নাই। সরস্বতীর সাঁকোর কাছে গিয়া ওপারের দিকে তাকাইয়া দেখিয়াছি। অদূরেই বংশবাটি, লক্ষণার পিত্রালয়। এই পথে অনেক বারই গিয়াছি। লক্ষণার সেই প্রথম দর্শনে হতচকিত বিমূঢ় পলায়নের চিত্র চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিয়াছিল। তেরো বছরের কিশোরীটি এখন তেইশ বছরের যৌবনের ভারে মন্থরগামিনী আর এক সৌন্দর্য পাইয়াছে।

তিন দিনই, পূর্ববঙ্গের ও উড়িষ্যাবাসীদের কাছে মূল্য দিয়া খাইতে চাহিয়াছিলাম। কেহ নিতান্ত ভিক্ষুক ভাবে নাই। তবে মূল্য না লইয়া খাইতে দিয়াছিল। স্থানীয় লোকেরা বাঙ্গাল ও ওড়িয়াদের লইয়া ঠাট্টা তামাশা করিতে ছাড়ে না। আমিও ছাড়িতাম না। বাঙ্গাল ও ওড়িয়াদের লইয়া ঠাট্টা তামাশা করা আমাদের এদেশীয়দের কৌতুক করা স্বভাবজাত। ভাষাই ইহার কারণ। এখন আর আমার মনে সে রকম কোনও প্রবৃত্তি নাই।

তিন দিন এই ভিড় ও কোলাহলের মধ্যে কাটাইবার কারণ কোনও গন্তব্য স্থির করিতে পারিতেছিলাম না। কিন্তু আমার কোনও গন্তব্য নাই। কোনও এক দিকে গেলেই হইল। তথাপি কোন পথে যাইব, তাহা স্থির করিতে পারিতেছিলাম না। পশ্চিমে দুইটি বড় জাঙ্গাল রহিয়াছে। একটি হাওড়া হইতে দিল্লি পর্যন্ত সাবেকি পাঠান বাদশার রাস্তা। আমরা শাহি জাঙ্গাল বলিয়া থাকি। নামে শের শাহ, আসলে বিভিন্ন অঞ্চলের অধীন ফৌজদাররাই এই শাহি জাঙ্গাল তৈরি করিয়াছে। কিন্তু কাশ্মীর পথটি রাণী অহল্যাবাঈ নিজ ব্যয়ে তৈরি করিয়াছিলেন। উহা হরিপাল চাঁপাডাঙ্গা আরামবাগ বিষ্ণুপুরের দিকে গিয়াছে। সাতগাঁ হইতে যে বাদশাহি সড়কটি মুরশিদাবাদের পশ্চিম দিক দিয়া পুরনো গৌড়ের দিকে গিয়াছে, সেই রাস্তায় অনেক বার গিয়াছি। প্রকৃতপক্ষে গঙ্গার এই পশ্চিম তীরের কোনও রাস্তা দিয়া উত্তরে যাইতে ইচ্ছা নাই। সকলই আমার পরিচিত পথঘাট। সাতগাঁও সেলিমাবাদ মাদারুণ এই সব অঞ্চলে পরিচিত লোকের অভাব নাই। আমি উহা পরিত্যাগ করিতে চাহি।

শেষপর্যন্ত গঙ্গার পূর্ব তীরে যাওয়া স্থির করিলাম। একটি তীর্থযাত্রীবাহী বড় নৌকা চতুর্থ দিন ভোরের গোনে (জোয়ারে) চাকদহে যাইতেছিল। আমি সেই নৌকাতেই আরোহণ করিলাম। মাঝিদের সঙ্গে আগেই কথা হইয়াছিল। পূর্বতীরের এ সব অঞ্চল আমার কাছে অপরিচিত। অতএব পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হইবার সম্ভাবনা নাই।

ভোরের দিকে এই প্রথম হেমন্তের সামান্য কুয়াশা পূর্বের আকাশ আচ্ছন্ন করিয়াছিল। সূর্যোদয়ে সামান্য বিলম্ব হইল। আকাশ রাঙ্গা হইল। নদীর জলের রং বদলাইল। ঈষৎ উত্তরের বাতাস মাঝে মাঝে আসন্ন শীতের আভাস দিতেছে। দক্ষিণ বাতাস থাকিলে নৌকার পাল খাটানো হইত। স্রোতের টান থাকিলেও দুই মাঝি দাঁড় বাহিতেছিল। আর এক মাঝি হাল ধরিয়া বসিয়া ছিল। আমি পূর্ব দিকের আকাশ গ্রাম ও অরণ্য দেখিতেছিলাম। ইচ্ছা করিয়াই পশ্চিম দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া রাখিয়াছিলাম। কিন্তু এক দণ্ড চলিবার পরে আর পারিলাম না। পশ্চিম দিকে ফিরিয়া তাকাইলাম। কুন্তী নদীর মোহনা আমার চোখে পড়িল। অথচ ফিরিয়া চাহিব না ভাবিয়াছিলাম। কিন্তু দেহ যেন আমার ঘাড় ধরিয়া মুখ ফিরাইয়া দিল। আবার আমার চোখের সামনে, সেই গ্রাম গৃহ পরিবারের মুখগুলি ভাসিয়া উঠিল।

অন্যমনস্ক হইয়া কখন মুখ ফিরাইয়াছি জানি না। আমার দৃষ্টি মাঝিদের বাহিত দাড়ের ওপর নিবদ্ধ রহিয়াছে। দেখিতেছি, দাঁড় দুইটি জলে ডুবিতেছে উঠিতেছে। বারংবার এইরূপে ডুবিয়া উঠিয়া এক সময়ে মাঝি ক্ষণিকের জন্য ক্ষান্ত দিল। ঈড় তুলিয়া রাখিয়া পেট কোমরের কাছে কাপড়ে রাখা কয়েক মুঠা চিড়া মুড়ি চিবাইল। নিজেদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা বলিল। আবার দাঁড় বাহিতে লাগিল।–সহসাই আমার মনে হইল মাঝি নিয়তির ন্যায় দাঁড়গুলিকে বাহিতেছে। আর দাঁড়গুলি দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জীবনের মতো উঠিতেছে পড়িতেছে। তাহাদের বিরাম নাই। একমাত্র মাঝির ইচ্ছায় ক্ষণিকের জন্য সুস্থির হইতে পারিতেছে।

দাঁড় জড় বস্তু। মানুষের জীবনের সঙ্গে তাহার তুলনা চলে না। ইহা আমার মানসিক অবস্থার একটা কুহক হইবে। তবু মনে হইল, দাঁড়গুলি জীবন্ত মানুষের ন্যায়, যাহাদের অপরে চালনা করে অথচ যেন তাহার নিজস্ব অস্তিত্ব রহিয়াছে। আমার অন্তরে একটা ক্ষুব্ধ বিষাদের সঞ্চার হইল।

দ্বিপ্রহরের অনেক আগেই নৌকা চাকদহে পৌঁছাইল। একটি বাঁধানো ঘাটে বিস্তর নরনারী স্নান। করিতেছিল। ঘাটের সংলগ্ন একটি গঙ্গাযাত্রীর ঘরও রহিয়াছে। ত্রিবেণী এত নিকটে থাকিতে এই। গঙ্গাযাত্রীর ঘরে কে মুমূর্ষকে লইয়া আসিবে। ত্রিবেণীতে মরায় পুণ্য আছে। অবশ্য চাকদহেরও যথেষ্ট নাম ডাক আছে। যশোহর খুলনা হইতে আগত গঙ্গাস্নানযাত্রী ও আমার মতো গঙ্গাযাত্রীদের এখানেই লইয়া আসে। গঙ্গার জল স্পর্শই মূল বিষয়। পূবপারের যাত্রীরা ত্রিবেণীকে অপর তীর ভাবিয়া দূর জ্ঞান করে। যাহাদের তীর্থ বিষয়ে আকাঙ্ক্ষা বেশি, তাহারা ত্রিবেণীর ঘাটে যায়। এখন দেখিতেছি, চাকদহ বেশ জনপূর্ণ সম্পন্ন স্থান।

সম্ভবত গ্রামের কোনও সম্পন্ন ব্যক্তি ঘাট সংলগ্ন গঙ্গাযাত্রীর ঘর নিজেদের পরিবারের জন্য করিয়াছে। আজকাল অর্থশালী ব্যক্তিরা অনেকেই এইরূপ প্রকাশ করিয়া থাকে। অন্য দিকে আর একটি উচ্চ প্রাচীরের বেষ্টনী দেখিয়াই বোঝা যায় উহা কোনও ধনী পরিবারের স্ত্রীলোকদের স্নানের ঘাট। গঙ্গার জলে শাল কাঠের খুঁটি পুঁতিয়া চারিদিকে বাঁশ ও কঞ্চি ঘিরিয়া অন্তরাল সৃষ্টি করা হইয়াছে। ঘাটের এই পর্দাপোষের কারণ, যাহাতে পরিবারের স্ত্রীলোকদের স্নান কেহ দেখিতে না পায়।

আমাদের বাড়ি কুন্তী নদীর ধারে। এইরূপ ঘাট আমাদেরও আছে। সেই ঘাট আমার চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিল। ঘাটে যাইবার প্রাচীর সংলগ্ন দরজা আছে। দরজার দুই পাশে প্রাচীর ঘেরা। আমাদের পরিবারের সুবিধা, স্ত্রীলোকদের দোলায় (ডুলি) বা মাহাপায় (পালকি বিশেষ করিয়া ঘাটে যাইতে হয় না। সীমানার পাঁচিলের ধারেই নদী। গঙ্গা হইতে দূরে যাহারা থাকে তাহাদের পরিবারের স্ত্রীলোকদের দোলায় বা মাহাপায় করিয়া ঘাটে আসিতে হয়।

চাকদহ সম্পন্ন গ্রাম। হাটও বড়, বিশেষত শস্যের আমদানি বিস্তর হইয়া থাকে। গঙ্গার তীরে, অনেকগুলি বড় বড় মালবাহী নৌকা দেখিয়াছি। নৌকায় মহাজনরা এই সব অঞ্চলে আসিয়া নগদ মুল্যে শস্য ক্রয় করিয়া কলিকাতায় লইয়া যায়, সেখানে অধিক মুল্যে বিক্রয় করিয়া থাকে। কিন্তু মুরশিদাবাদ, কাশিমবাজার বা কাটোয়ার মতো এখানে স্বর্ণকার বা বস্ত্র ব্যবসায়ীদের ভিড় নাই। নদীতীরে মাল বোঝাই করিয়া রাখিবার গুদাম ঘরও নাই। বিদেশি মহাজনরা হাটের আড়তদারদের সঙ্গে দর কষাকষি করে। আর কৃষকরা শস্য লইয়া আড়তদারের মুখ চাহিয়া বসিয়া থাকে। এই সময়ে আউস ধান্যের বিক্রয় বেশি। মূল্য নিরূপণের অধিকার তাহার নাই। সবই ব্যবসায়ীর হাতে। কৃষকরা কৃপার পাত্র, আড়তদারদের হাতে-পায়ে ধরিয়া এক-আধ পয়সা মূল্য বাড়াইবার জন্য ব্যাকুল।

ইহা আমার অজানা কিছু নহে। কয়েকটা দিন হাটেই থাকিয়া গেলাম। রাঁধিয়া খাইবার প্রয়োজন বোধ করি নাই। আড়তদারদের মালবাহীদের কিছু চাউল দিতে তাহারাই খাইতে দিয়াছে। তাহারা নিজেরাই রাঁধিয়া খায়। আমি মালবহনের কাজ করিতে চাহিয়াছিলাম। অপরিচিত মানুষকে আড়তদারেরা বিশ্বাস করিতে পারে নাই। মালবাহীরাও আমাকে অপরিচিত জানিয়া নানা প্রকার প্রশ্ন করিয়াছে। আমার পরিচয় নিবাস চাকদহে আগমনের কারণ ইত্যাদি বহুতর কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে আমি অনায়াসেই মিথ্যা বলিয়াছি। জাতিতে তিলি বিসূচিকায় সমস্ত পরিবারের লোক উৎসন্ন হইয়াছে। আমি গৃহত্যাগ করিয়া তীর্থযাত্রা করিয়াছি। তাহারা আমাকে পুরোপুরি অবিশ্বাস করে নাই। কেবল একজন মালবাহী একত্রে কলাপাতা পাতিয়া খাইতে বসিয়া সহসাই এক দিন বলিয়া উঠিল, তোমার ডান হাতের দুই আঙ্গুলে দাগ দেখিয়া মনে হয়, তুমি আংটি পরিতে।

আমি অন্তরে চমকাইয়া উঠিলেও সহাস্যে উত্তর দিয়াছিলাম, নানা রোগ ব্যাধিতে গ্রামের ওঝা আমাকে মধ্যমায় ও অনামিকায় তামা ও লোহার দুইটি মন্ত্রপূত আংটি দিয়াছিল। যখন পরিবারের সকলেই বিসূচিকায় (ওলাউঠা কলেরা) উৎসম্নে গেল, তখন আর নিজেরও বাঁচিয়া থাকিতে ইচ্ছা হয় নাই। সেই কারণে মন্ত্রপূত তামা-লোহা ত্যাগ করিয়াছি। তথাপি তাহারা আমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতে পারে নাই। বলিয়াছিল, তোমার কথাবার্তা শুনিতে আমাদের অপেক্ষা ভিন্নতর, যেন সদ্বংশজাত কর্তা ব্যক্তিদের ন্যায়। আমি উত্তর দিয়াছিলাম, উহা সঙ্গগুণ মাত্র। লেখাপড়া কিছুমাত্র জানি না।

ক্রমে তাহাদের অবিশ্বাস বাড়িতে পারে, এবং এখানে আমার অন্ন জুটিবার মতো কর্মসংস্থানও হইবে না, এইসব ভাবিয়া স্থান ত্যাগ করিলাম। স্থান ত্যাগ করিবার পূর্বে, আমি একটি অদ্ভুত কাজ করিলাম। এক কৃষক মাত্র এক মন আউস ধান লইয়া আসিয়াছিল। কথায় কথায় জানিলাম, সে নিতান্ত নিরুপায় হইয়া ওই ধান বিক্রয় করিতে আসিয়াছে। জমিদারের শ্রাবণী প্রণামী দিতে গিয়া, এক পেয়াদার কাছ হইতে চারি আনা কর্জ করিতে হইয়াছিল। এই কার্তিকে সুদসমেত তাহা বারো আনায় দাঁড়াইয়াছে। না দিতে পারিলে, সে তাহার আমনের ধান কাটিয়া লইয়া যাইবে। অথচ এই ধানই তাহার পরিবারের শেষ খাদ্য। কুটিবার অবকাশ হইল না। ভাগ্যে যাহাই থাকুক, এই ধান বিক্রয় করিয়া, অনাহারে থাকিয়াও তাহাকে পরবর্তী ফসল তোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হইবে।

ইহা সমস্ত দেশের গ্রামে গ্রামে প্রতি দিন শত সহস্র ঘটিতেছে। আমার পাইক পেয়াদারা অনেক প্রজাকে সর্বস্বান্ত করিয়াছে। ওই কর্মকে আমরা আত্মরক্ষার অধিকার বলিয়াই মনে করিতাম। কিন্তু তখন নিয়তির কথা মনে আসে নাই। এখন মনে হইল, এই লোকটি তাহার নিয়তির দ্বারা চালিত হইতেছে। সেই দাঁড়ের কথাই আমার মনে আসিল। নিয়তি আমার কাছে কুচক্রী ছাড়া আর কিছু নহে। একমাত্র দুর্ভাগাদের প্রতিই তাহার অমোঘ আঘাত আসিয়া পড়ে।

এই প্রথম আমার মনে হইল, নিয়তির বিরোধিতা করাই শ্রেয়। অলক্ষ্যে থাকিয়া সে সমাজে সংসারে নানা কারণ ও ঘটনার মধ্যে নিজের কার্যক্রম চালাইয়া যাইতেছে। নির্বিকারত্ব ও বিষাদের পরিবর্তে, আমার মনে বিদ্বেষ জাগিয়া উঠিল। আমি কৃষকটিকে তাহার প্রাপ্যের অধিক এক টাকা দিয়া ধান কিনিলাম। অবশ্য ইহার মধ্যে আমারও একটু উদ্দেশ্য ছিল। আমি তাহার গৃহে যাইতে ইচ্ছা প্রকাশ করিলাম। বলিলাম, তোমার সংসারে আমার দ্বারা কোনও সুসার হইলে, আমাকে কয়েক দিন দুই মুষ্টি অন্ন দিও।

কৃষকটি প্রথমে অতিমাত্রায় বিস্মিত হইয়া, কিংকর্তব্যবিমূঢ় চোখে আমার দিকে তাকাইয়া রহিল। জীবনে এই রকম প্রস্তাব কাহাকে কেহ দেয় নাই। আমি মালবাহীদের যে রূপ পরিচয় দিয়াছিলাম, ইহাকেও সেই রূপই দিলাম। লোকটি আমার প্রস্তাবে রাজি হইল। আমি তাহার সঙ্গে চলিলাম। সে উত্তর-পূর্বে গ্রাম জঙ্গলের ভিতর দিয়া প্রায় চারি ক্রোশ হাঁটিয়া চলিল। জীবনে কখনও এত অধিক পথ হটি নাই। বিশেষ করিয়া জঙ্গলের মধ্য দিয়া চলিতে কষ্ট হইতেছিল।

কৃষকটি ও তাহার স্ত্রী ছাড়া ঘটনাটি কেহ জানিতে পারিল না। আমিই তাহাকে কাহাকেও কিছু প্রকাশ করিতে নিষেধ করিয়াছিলাম। সে গৃহে ফিরিয়া আগে স্ত্রীকে সকল কথা বলিল। আমি কিছুটা সন্দিগ্ধ ছিলাম, তাহার স্ত্রী ঘটনাটিকে একটি অলৌকিক উৎপাত ভাবিয়া চিৎকার শুরু করিয়া দিবে। কিন্তু সে তাহা করিল না। ঘোমটার আড়াল হইতে, দরিদ্র বধূটি আমাকে কয়েক বার দেখিল। তাহার বয়স বিশ বাইশের বেশি নহে। সন্তান সংখ্যা চার। উলঙ্গ শিশুগুলি নিতান্তই কুকুর শাবকের মতো হাসিয়া কাঁদিয়া গড়াগড়ি দিয়া খেলিতেছিল। স্বামী স্ত্রী উভয়েই আমার প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিল। পরের দিনই কৃষক জমিদারের পেয়াদার পণ মিটাইয়া ফিরিয়া আসিল।

কিন্তু তিন দিন অতিক্রম করিতেই, কৃষক করজোড়ে জানাইল, সে আর আমাকে অন্নমুষ্টি দিতে অক্ষম। তাহার প্রতিবেশীরাও নানা রকম প্রশ্ন করিতেছে। কারণ, এই সময়ে চাষের কোনও কাজ নাই, অথচ সে কী কাজে একটি লোককে ঘরে রাখিয়া খাওয়াইতেছে। ঘরে আমি স্থান পাই নাই। একটি মাত্র খড়ের চালার ঘর। দুগ্ধবতী গাভী নাই, কেবল চাষের এক জোড়া বলদের জন্য একটি ভাঙ্গা চালা। তাহারই এক পাশে কৃষক বধূটি তাহার রান্নাবান্না করে। সেই ঘরেই আমি তিন রাত্রি যাপন করিয়া বিদায় হইলাম। সম্ভবত আমার নিয়তি অলক্ষ্যে হাসিতেছিল। আমার অন্তর ক্রোধে জ্বলিতেছিল। কিন্তু কৃষক দম্পতির প্রতি আমার মনে কোনও বিদ্বেষ আসে নাই। তাহার মতো গরিব কৃষকের পক্ষে, অসময়ে একটি লোককে গৃহে রাখার কোনও কারণ থাকিতে পারে না।

.

এইভাবেই চলিয়া মাসখানেক পরে বহরমপুরে উপস্থিত হইলাম। বহরমপুর হইতে, গ্রামান্তরের ভিতর দিয়া মুরশিদাবাদে যাইবার রাস্তাটি আমার পরিচিত। এক রাত্রি বহরমপুর থাকিয়া, মুরশিদাবাদের দিকে রওনা হইলাম। অথচ মুরশিদাবাদ যাইবার কোনও অভিপ্রায় আমার নাই। অবশ্য এখন আর আমাকে দেখিয়া কেহ চিনিতে পারিবে না। চুল দাড়িতে আসল মুখাবয়বটির পরিবর্তন। ঘটিয়াছে। ইতিমধ্যে ধান পাকিয়াছে। মুরশিদাবাদ যাইবার পথে, মাঠে ধানের বোঝা মাথায় করিয়া লোকের গৃহে পৌঁছাইয়া, অন্ন সংস্থান করিলাম। ধান কাটিতে যাইনাই, তাহা হইলে আমার কৃষিকাজের অকর্মণ্যতা প্রকাশ হইয়া পড়িত।

নাটুর দেওয়া সাত-আট টাকার বেশি খরচ হয় নাই। ভিক্ষাবৃত্তিও অবলম্বন করি নাই। পথ চলিতে, সর্বত্রই গৃহস্থের দ্বারে উপস্থিত হইয়া, কাজের বিনিময়ে খাদ্য গ্রহণ করিয়াছি। ঘেসুড়ের সঙ্গে সারা দিন ঘাস কাটিয়া, তাহাদের সঙ্গেই ঘাস বিক্রয় করিয়া, শুড়ির প্রাঙ্গণে গিয়া গুড়জাত নিকৃষ্ট মদ্য পান। করিয়াছি। মত্তাবস্থায় তাহাদের সঙ্গে নৃত্য করিয়াছি, অশ্লীল গান করিয়াছি। মানুষের বাসের অযোগ্য, তাহাদের ভাঙা দাওয়া, ছিন্ন খড়ের চালের ঘরে বাস করিয়াছি। তাহাদের স্ত্রীরাও সুরাপানে অভ্যস্ত। আমরা যাহাকে সতীত্বের নীতিবোধ বলিয়া জানি, তাহাদের স্ত্রীরা সেই সব নীতিবোধের তেমন মূল্য দেয় না। হাড়ি নোম প্রতিবেশীরাও তাহাদের সঙ্গে যোগ দেয়। প্রতি দিন ভরা পেট খাইবার নিশ্চয়তা কাহারও নাই। কোনও কারণে বিবাদ উপস্থিত হইলে, ইহাদের স্ত্রীরা হেন বাক্য নাই, যাহা উচ্চারণ করে না। পুরুষরা যতক্ষণ সম্ভব, সহ্য করে, তারপরে স্ত্রীদের ধরিয়া পিটাইতে আরম্ভ করে। স্ত্রীরা পলাইয়া যায়।

সমাজের এই চিত্র আমার চোখে নতুন নহে। কিন্তু ইহাদের সংস্পর্শ হইতে বহু দূরে থাকিয়াছি। ইহারা আমার কাছে এক রকম অপরিচিত অজ্ঞাত, ইহাদের অস্তিত্বের বিষয় কখনও ক্ষণিকের জন্যও মনে আসিত না। অথচ দেখিলাম, আমি অনায়াসেই ইহাদের সান্নিধ্যে আসিয়াছি, ইহাদের মতো জীবনযাপন করিয়াছি। পথে চলিতে, ইহা সাময়িক ঘটনা মাত্র। উহাদের অন্ন ব্যঞ্জন মুখে লইতে বমনোদ্রেক হইয়াছে। কিন্তু অবস্থান্তরে আমি সমস্ত বিকারমুক্ত হইয়াছি। অতীত বলিয়া কিছুই রাখিতে চাহি নাই। আমাকে দেখিয়া এখন কেহ বিশ্বাস করিবে না, বৎসরের একটি দিনে মা আমাকে সোনার থালায় অন্ন পরিবেশন করিতেন। সেই দিনটি বিশেষ তিথি-নক্ষত্রে মিলিত আমার জন্মদিন।

পিতামহ সাতটি সোনার থালা, তাঁহার চারি পত্নীর সন্তানদের ভাগ করিয়া দিয়াছিলেন। আমাকে দুইটি দান করিয়াছিলেন। আমার পিতা বা আমি আর সোনার থালা গড়াইতে পারি নাই। স্ত্রীদের এবং পুত্রবধূদের কিছু অলংকার দিতে পারিয়াছি। সে সবই এখন আমার কাছে অতীত। নাটুদের বিদায় দিয়া, জামাই জাঙ্গালে দাঁড়াইয়া আমি গলার যজ্ঞোপবীত ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছিলাম। সেই দিন হইতে আমি সমস্ত বর্ণ বিভাগ ত্যাগ করিয়াছি। পরিচয় দানের জন্য কেবল রাশ্যাশিত রমাকান্ত নামটি রাখিয়াছি। বাকি পদবি উপাধি জাত সকলই ত্যাগ করিয়াছি। আমি আমার সমাজ সংসার হইতে পরিত্যক্ত হইয়াছি। সেই সমাজ সংসারের তুল্য অন্য কোথাও আমি আর যাইব না।

দুই মাস কাটিয়া গেল। আমি দরিদ্র সমাজে অন্ত্যজদের সঙ্গে মিশিয়া দেখিলাম, আমাদের প্রাণের ও মনের শক্তি অপেক্ষা ইহাদের শক্তি অনেক প্রবল। ইহারা নিয়তির কথা চিন্তা করে না। জীবনকে তাহাদের নিজেদের স্বরূপেই দেখিতেছে, বাঁচিবার আপ্রাণ চেষ্টায় প্রতিটি দিন বাহিত করিতেছে। শাস্ত্রকারদের নিকট হইতে ইহারা দূরে থাকে। ব্রাহ্মণ দেখিলে ভক্তি করিয়া প্রণাম করে, কিন্তু তাহাদের অন্তরে ইহার কোনও অনুভূতি নাই। কেবল ইজারাদার, পত্তনিদার পোদ্দার পেয়াদা পাইকদের এবং স্থানীয় থানাদারদের ইহারা যমতুল্য ভয় পায়। মুসলমানের পরিবর্তে ফিরঙ্গরা নবাব হইয়াছে, ইহাই জানে। এবং ফিরঙ্গ নবাবের হুকুম পালন করিতে, তাহাদের মতে যমের অরুচি, ইজারাদার পাটোয়ার তালুকদার–যাহা আমিও ছিলাম–আর তাহাদের চেলাচামুণ্ডারা কোনও রকম অত্যাচার করিতেই। বাকি রাখে না। কোম্পানির বিনশুল্কে বাণিজ্যের ইহাই অনিবার্য ফল।

সেই জন্যই বলিতেছিলাম, আমাকে আর কেহ এখন চিনিতে পারিবে না। জামদানে দোলাই (জামা বিশেষ) চন্দ্রকোণা ধুতি জোব্বা চোগা চাপকান পরিহিত বৈদূর্যকান্তি রায় প্রকৃতই মরিয়াছে। একটি নিমাস্তিন, মৃতদেহ সৎকারের খুইয়া (খাদি) ধুতি, নাটুর কাছা লইবার বস্ত্র দুই খণ্ড ইতিমধ্যেই রং বদলাইয়াছে। পুরানো চন্দ্রকোণা ধুতি, যাহা পরাইয়া আমাকে গঙ্গাযাত্রা করানো হইয়াছিল, তাহা ছিন্ন ও জীর্ণ হওয়ায়, ধুতির পরিবর্তে গায়ে চাঁদরের মতো ব্যবহার করি। কখনও বা মাথায় বাঁধি। ইতিপূর্বে মুরশিদাবাদ বা বর্ধমান রাজবাড়িতে রাজস্ব বিভাগে যাইবার সময় যে পাগ (পাগড়ি) ব্যবহার করিতাম, এখন মাথায় জড়ানো ছিন্ন ময়লা ধুতিটি জড়াইয়া নিজের মনেই হাসি। চুলে তেল নাই, চিরুনির ব্যবহার নাই। দাড়ি বাড়িয়াছে। আমি এখন শত সহস্রের মধ্যে মিশিয়া গিয়াছি। ইহাই যদি নিয়তির চালনা হয়, হউক। আমি নির্বিকার উদাস চিত্তে অনায়াস জীবনযাপন করিতেছি।