৪. নতুন ঘরকন্না

নতুন ঘরকন্না। নতুন সংসারের সহস্র অসুবিধে থাকা সত্বেও এর মধ্যে কেমন একটা অদ্ভুত আনন্দ আছে। হোটেলের অখাদ্য ডাল ভাত আর শাক বেগুনের চচ্চড়ি খেয়ে কি খুশি দু’জনে। আমার দিক থেকে এটুকু বলতে পারি, আমার দেশের সংসারের অবস্থা অসচ্ছল নয়, সুরবালা আমার খাওয়া-দাওয়ার দিকে সর্বদা নজর রাখতো, সুতরাং হোটেলের ডাল-ভাতের মতো খাদ্য আমার মুখ জীবনে ক’দিনই বা দেখেচে। কিন্তু তবুও তো খেলুম, বেশ আনন্দ করেই খেলুম।

পান্না উচ্ছিষ্ট পাতাগুলো ফেলে দিয়ে জায়গাটা ধুয়ে পরিষ্কার করে দিলে। বললে—পান নিয়ে এসো দু পয়সার। পয়সা দিচ্ছি—বলেই পেঁটরা খুলতে বসল।

আমি হেসে বললাম—শুধু পানের দাম কেন, তা হলে এক বাক্স সিগারেটের দাম দাও। ওর মুখ দেখে মনে হল ও আমার এ কথাটাকে শ্লেষ বলে ধরতে পারে নি, দিব্যি সরলভাবে একটা টাকা আমার হাতে তুলে দিয়ে বললে—টাকাটা ভাঙিয়ে পান সিগারেট কিনে এনো।

—কত আনবো?

—এক বাক্স আনবে, না, একসঙ্গে দু’বাক্সই না হয় আনো। আবার দরকার হবে তো?

—যদি কিছু ফেরৎ না দিই?

—কেন, আর কিছু কিনবে? তা যা তোমার মনে হয় নিয়ে এসো।

—কত টাকা আছে তোমার কাছে দেখি?

পান্না তোরঙ্গ থেকে একখানা খাম আর একটা পুঁটুলি বের করে গুনতে আরম্ভ করলে। চল্লিশ টাকা আর কয়েক আনা পয়সা দেখা গেল ওর পুঁজি। আমি বললাম—মোটে?

ও বেশ সরল ভাবেই বললে—এর মধ্যে আবার মুজরো করতে গেলেই হাতে পয়সা হবে।

—সে কি! তুমি আবার খেমটা নাচ নাচতে যাবে নাকি?

—যাবো না?

—তুমি আমার স্ত্রী পরিচয়ে এখানে এসে আসরে খেমটা নাচতে যাবে?

পান্না বোধ হয় এ কথাটা ভেবে দেখে নি, সে বললে—তবে আমার টাকা আসবে কোথা থেকে?

—দরকার কি?

—তুমি দেবে এই তো? কিন্তু আমি কত টাকা রোজগার করি, তুমি জানো? দেখেছিলে তো মঙ্গলগঞ্জে?

—কত?

—ছ’টাকা করে ফি রাত। নীলি নিত সাত টাকা।

—মাসে ক’বার নাচের বায়না পাও?

—ঠিক নেই। সব মাসে সমান হয় না। পাঁচ-ছ’টা তো খুব। দশটাও হত কোনো মাসে।

—তার মানে মাসে গড়ে ত্রিশ বত্রিশ টাকা, এই তো?

—তার বেশি, প্রায় চল্লিশ টাকা।

আমি মনে মনে হাসলাম। পান্না জানে না ডাক্তারিতে একটা রুগী দেখলে অনেক সময় পাড়াগাঁয়ে ওর বেশিও পাওয়া যায়। আমায় ভাবতে দেখে পান্না বললে—ধরো যদি নাচের বায়না না নিতে দাও তবে কলকাতার সংসার চালাবে কি করে? তোমরা পাড়াগাঁয়ের লোক, কলকাতার খরচ কি জানো? ষাট টাকার কমে মাস যাবে না। তুমি একা পারবে চালাতে?

আমার হাসি পেল। আমি বললাম—আমায় একটা কিছু বাজাতে শেখাবে?

—কি?

—এই ধরো বাঁশি কি ডুগি-তবলা। গানের দলে তোমার সঙ্গে বেরুতাম। দু’জনে রোজগার হত।

—ইস! ঠাট্টা হচ্চে বুঝি! গানের দলে ডুগি-তবলা বাজানোর দাম আছে, সে তোমার কর্ম নয়। আমি তো যেমন তেমন, নীলির নাচে বাজাতে পারা যার-তার বিদ্যেতে কুলোবে না। হাঁ গো মশাই, নীলি থিয়েটারে নাচতো, তা জানো?

—সখীর ব্যাচে তো? সে যে-কোনো ঝি নাচতে পারে। তাতে বিশেষ কি কৌশল বা কারিকুরি আছে?

পান্না হাসতে হাসতে বললে—তুমি নাচের কি বোঝো যে ওই সব কথা বলচো? আমরা কষ্ট করে নাচ শিখেছি, কত বকুনি খেয়ে, কত অপমান হয়ে তা জানো? কিসে কি আছে না আছে তুমি কিছুই জানো না।

—তোমার নাচের সরঞ্জাম সব এখানে আছে?

—নেই? ওমা, তবে করবো কি? সব আছে।

—আজ আমার সামনে নেচে দেখাবে না?

—ওবেলা। রাত্তিরে। একটু ঘুমুই। বড্ড ঘুম পাচ্চে।

পান্না ঘুমিয়ে পড়লো। আমি ওর নিদ্রিত মুখের দিকে চেয়ে থাকি। আমার বয়েস আর ওর বয়েস কত তফাৎ। আমি চল্লিশ, পান্না ষোলো বা সতেরো। এ বয়সের মেয়ে আমার মতো বয়সের লোকের সঙ্গে প্রেমে পড়ে?

নিশ্চয়ই এ প্রেম। পান্না আমাকে ভালো না বাসলে আমার সঙ্গে ঘর-দোর আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে পালিয়ে এল কেন? তা কখনো আসে? নারীর প্রেম কি বস্তু কখনো জানি নি জীবনে। সুরবালাকে বিবাহ করেছিলুম, সে অন্যরকম ব্যাপার। এ উন্মাদনা তার মধ্যে নেই। অল্পবয়সের বিবাহ, সুরবালা আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট—এ অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এক ধরনের সাংসারিক ভালোবাসা হতেই পারে, আশ্চর্য নয়। একটি পরম বিস্ময়ের বোধ ও তজ্জনিত উন্মাদনা সে ভালোবাসার মধ্যে ছিল না। সে তো আগে থেকেই ধরে নিয়ে বসেছিলাম—সুরবালা আমায় ভালোবাসবেই। ভালোবাসতে বাধ্য। এ রকম মনোভাব প্রেমের পক্ষে অনুকূল নয়। কাজেই প্রেম সেখান থেকে শতহস্ত দূরে ছিল।

কিন্তু জিনিসপত্রের কি করি?

জিনিসপত্র না হলে বড় মুশকিল। পান্না শুয়ে আছে শুধু মেজেতে একখানা চাদর পেতে। শতরঞ্জি নেই, কার্পেট নেই—একখানা মাদুর পর্যন্ত নেই। সংসার পাততে গেলে কত কি জিনিস দরকার তা কখনো জানতাম না। সাজানো সংসারে জন্মেছি, সাজানো সংসারে সংসার পাতিয়েছিলাম। এখন দেখছি একরাশ টাকা খরচ হয়ে যাবে সব জিনিস গোছাতে। কিছুই তো নেই। থাকবার মধ্যে আছে আমার এক সুটকেস, পান্নার এক টিনের পেঁটরা, তাতে ওর কাপড়-চোপড়। মাথায় দেবার একটা বালিশ নেই, জল খাবার একটা গ্লাসও নেই। দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম হল না।

.

পান্না ঘুম থেকে উঠলে আমি ওকে সব খুলে বলি।

পান্নার মুখ কি সুন্দর দেখাচ্চে! অলস, ঢুলুঢুলু, ডাগর ডাগর চোখ দু’টিতে তখনও ঘুম জড়ানো। ও কোনো কিছুই গায়ে মাখে না। হাসিমুখে আমোদ নিয়েই ওর জীবন। হেসে বললে—বেশ মজা হয়েচে, না?

—মজাটা কি রকম? এখুনি যদি জল খেতে চাই, একটা গ্লাস নেই! ভারি মজা!

—একটা কাঁচের গ্লাস কিনে নিয়ে এসো না? বাজারে পাওয়া যাবে তো?

—তবেই সব হল। তুমি কিছু বোঝো না পান্না। ঘরসংসার কখনো পাতাও নি। তোমার দেখছি নির্ভাবনার দেহ।

পান্না হঠাৎ পাকা গিন্নীর মতো গম্ভীর হয়ে গেল। বললে—তাই তো, কি করা যায় তাই ভাবচি।

রাত্রে পান্না বড় মজা করলে।

দেওয়ালের কাছে একটা শাড়ি পেতে আমাকে বললে—তুমি এখানে শোবে।

—তুমি?

—এইখানে দেওয়ালের ধারে।

—মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরের ব্যবধান। রাত্রে যদি তোমার ভয় করে?

—তোমার কথা আমি বুঝতে পারি নে বাপু, ভয় করবে কেন? কত জায়গাতে ঘুরবো আমি। কত জায়গায় ঘুরেচি মুজরো করতে।

—বড্ড সাহসিকা তুমি।

—নিশ্চয়ই সাহসিকা।

পান্না হেসে উঠল এবার।

—থাক বাপু, যাতে যার সুবিধে হবে সে তাই করুক।

আমি কিন্তু ঘুমুতে পারলুম না সারা রাত। পান্না আমার এত কাছে থাকবে, একই ঘরে, এ আমার কাছে এতই নতুন যে নতুনত্বের উত্তেজনায় চোখে ঘুম এলো না আমার।

দু’জনেই গল্প আরম্ভ করে দিলাম।

—কি রকম মুজরো করো তোমরা?

—যেমন সবাই করে। তোমার যেমন কথাবার্তা।

—বাড়ির জন্যে মন কেমন করচে?

—কেন করবে?

—বাড়ি ছেড়ে থেকে অব্যেস হয়ে গিয়েচে কিনা।

—আমি আর নীলি কত দেশ ঘুরেচি।

—কোন কোন দেশ?

—কেষ্টনগর, দামুড়, হুকো, চাকদা, জঙ্গিপুর আরও কত জায়গা!

—নীলির জন্যে মন-কেমন করচে?

—কিছু না।

—আমার কাছে থাকবে?

—কেন থাকবো না? তবে এলাম কেন?

আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারচি না, পান্না কি সব দিক দেখে-শুনে আমার কাছে এসেচে? আমার বয়েস কত বেশি ওর তুলনায়। আমার সঙ্গে সত্যি ওর ভালোবাসা হতে পারে?

কি জানি, এই রহস্যটাই আমার কাছে সব চেয়ে বেশি রহস্য।

নানা কথাবার্তায় এই কথাটা আমি পান্নার কাছ থেকে জানতে চাই। ওর মনোভাব কি, এ কথা ওই কি আমায় বলতে পারে?

সকাল হবার আগে পান্না আমায় বললে—একটু ঘুমুই?

—ঘুম পাচ্ছে?

—পাবে না? ফর্সা হয়ে এল যে পুবে!

—ঘুমোও না একটু।

একটু পরে ভোর হয়ে গেল।

পান্না তখন অঘোরে ঘুমুচ্ছে। ডান হাতে মাথা রেখে দিব্যি ঘুমুচ্চে ও, দেখে মায়া হল। মা ছেড়ে আত্মীয়স্বজন ছেড়ে ও কিসের আশায় চলে এল আমার সঙ্গে? পান্না ভদ্রঘরের কুলবধূ বা কুমারী নয়, গৃহত্যাগ করে চলে এসেচে আমার সঙ্গে।

আবার যখন অসুবিধে হবে, ও চলে যেতে পারবে, আটকাচ্চে কোথায়?

আমি চায়ের দোকানে চা খেয়ে পান্নার জন্যে চা নিয়ে এলাম।

পান্না উঠে চোখ মুছচে।

—ও পান্না?

পান্না এক কাণ্ড করে বসল। তাড়াতাড়ি উঠে মাথায় আঁচল দিয়ে আমায় এসে এক প্রণাম ঠুকে দিলে।

আমি হেসে উঠলুম। বলি, এ কি ব্যাপার?

—কেন? নমস্কার করতে নেই?

—থাকবে না কেন? হঠাৎ এত ভক্তি?

—ভক্তি করতে কিছু দোষ আছে?

—কি বলে আশীর্বাদ করবো?

—বলো যেন শীগগির করে মরে যাই।

—কেন, জীবনে এত অরুচি হল কবে?

—বেশিদিন বেঁচে কি হবে? তুমি তো বামুন?

—তাতে সন্দেহ আছে নাকি? তুমি কি জাত?

—বাবা ছিলেন ব্রাহ্মণ, মায়ের মুখে শুনেছি।

—ওসব ভুল কথা। তোমার মা বংশের কৌলীন্য বাড়াবার জন্যে ওই কথা বলেছেন। আমার বিশ্বাস হয় না।

—ভয় কিসের? আমি কি বলব আমায় বিয়ে কর?

—সে কথা হচ্চে না। আমি বলচি তুমি যে জাতই হও, আমার কাছে সব সমান। বামুনই হও আর তাঁতিই হও—চা খাবে না?

—চা এনেচ?

—খেয়ে নাও, জুড়িয়ে যাবে।

.

এইভাবে সেদিন থেকে আমাদের নতুন জীবনযাত্রা নতুন দিন নতুনভাবে শুরু হল। আমার হাতে নেই পয়সা। বাড়ি থেকে কিছু আনি নি, ভাঁড় নিয়ে এলুম জল খাবার জন্যে। সস্তায় দু’খানা মাদুর কিনে আনলুম। শালপাতা কুড়িদরে কিনে আনি দু’বেলা ভাত খাওয়ার জন্যে। পান্না তাতে এতটুকু অসন্তুষ্ট নয়। যা আনি, ও তাতেই খুশি। আমার কাছে মুখ ফুটে এ পর্যন্ত একটা পয়সাও চায় নি। বরং দিতে এসেচে ছাড়া নিতে চায় নি। অদ্ভুত মেয়ে এই পান্না!

.

রাস্তায় নেমে এদিক ওদিক চেয়ে দেখলাম কেউ কোনো দিকে নেই। কি জানি কেন, আজকাল সর্বদাই আমার কেমন একটা ভয়-ভয় হয়, এই বুঝি আমাদের গ্রামের কেউ আমাদের দেখে ফেললে, আমার এ সুখের সংসার একদিন এমনি হঠাৎ সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে ভেঙে যাবে।

আমার বুক সর্বদা ধড়ফড় করে ভয়ে। ভয় নানারকম, পান্নাকে হয়তো গিয়ে আর দেখতে পাবো না। ও যে ভালোবাসা দেখাচ্চে, হয়তো সব ওর ভান। কোনোদিন দেখব ও গিয়েচে পালিয়ে।

চা নিয়ে ফিরে এলুম। তখনও পান্নার চুলবাঁধা শেষ হয় নি।

পান্না বললে—খাবার কই?

—খাবার আনিনি তো?

—বাঃ, শুধু চা খাব?

—পয়সাতে কুলোলো কই? চার আনাতে কি হবে?

—পাউডারের কৌটোর মধ্যে যা ছিল সব নিয়ে গেলে না কেন? আবার যাও, নিয়ে এসো। একটা টাকা নিয়ে যাও।

টাকা নিয়ে আমি বেরিয়ে চলে গেলুম এবং গরম গরম কলাইয়ের ডালের কচুরি খান আট-দশ একটা ঠোঙায় নিয়ে ফিরলুম একটু পরেই। আমি সচ্ছল গৃহস্থঘরের ছেলে, নিজেও যথেষ্ট পয়সা রোজগার করেছি ডাক্তারি করে, কিন্তু এমনভাবে মাদুরের ওপর বসে শালপাতার ঠোঙায় কচুরি খেয়ে সেদিন যা আনন্দ পেয়েছিলাম, আমার সারা গৃহস্থ-জীবনে তেমন আমোদ ও তৃপ্তি কখনো পাই নি।

পান্নাকে বললাম, পান্না, পয়সা ফুরিয়ে যাচ্চে, কি হবে? বাসাখরচ চলবে কিসে?

ও হেসে বললে—বারে, আমার কাছে ত্রিশ-বত্রিশ টাকার বেশি আছে না?

—তুমি নিতান্ত বাজে কথা বলো। খরচের সম্বন্ধে কি জ্ঞান আছে তোমার? ওতে কতদিন চলবে?

—সোনার হার আছে, কানের দুল আছে।

—তাতেই বা ক’দিন চলবে?

পান্না একটু ভেবে বললে—তোমাকে ঠিকানা দিচ্চি, তুমি নীলির কাছে যাও। আমরা দু’জনে মিলে মুজরো করলে আমাদের চলে যাবে।

—সে হবে না।

—কেন?

—নীলির কাছে গেলেই তোমার মা জানতে পারবে।

—নীলিকে তুমি আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে বুঝিয়ে বলব।

—ঠিকানা দাও, আমি এখুনি যাবো।

সন্ধ্যার আগেই ঠিকানা অনুযায়ী নীলিকে খুঁজে বার করলাম। একটা বড় খোলার বস্তির একটা ঘরে নীলিমা ও তার বড় দিদি সুশীলা থাকে। আমাকে দেখে প্রথমতঃ চিনতে পারে নি নীলিমা। আমি সংক্ষেপে আমার পরচিয় দেওয়ার পরে সুশীলা এসে আমায় নিয়ে গেল ওদের ঘরের মধ্যে। দু’টো বড় বড় তক্তপোশ একসঙ্গে পাতা, মোটা তোশক পাতা বিছানা, কম দামের একটা ক্লকঘড়ি আছে ঘরের দেওয়ালে এবং যেটা সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, খানকতক ঠাকুর-দেবতার ছবি। সুশীলার বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে, মুখে বসন্তের দাগ না থাকলে ওর মুখ দেখতে একসময় মন্দ ছিল না বোঝা যায়।

সুশীলা থাকাতে আমার বড় অসুবিধে হল। সুশীলার অস্তিত্বের বিষয় আমি অবগত ছিলাম না, ওর সামনে সব কথা বলা উচিত হবে না হয়তো। নীলিকে নির্জনে কোনো কিছু বলবার অবকাশও তো নেই দেখছি। মুশকিলে পড়ে গেলাম। সুশীলা ভেবেছে আমি হয়তো ওদের জন্যে কোনো একটা বড় মুজরোর বায়না করতে এসেছি। ও খুব খাতির করে আমার সঙ্গে কথা বলতে লাগলো। বললে—চা খাবেন তো?

—তা মন্দ নয়।

—বসুন, করে নিয়ে আসি। নীলি, বাবুকে বাতাস কর।

—না না, বাতাস করতে হবে না। বোসো এখানে।

সুশীলা ঘর থেকে চলে গেলেই আমি সংক্ষেপে নীলিমাকে সব কথা বললাম। আমাদের ঠিকানাও দিলাম। নীলিমা অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। বললে—আপনি তো মঙ্গলগঞ্জের ডাক্তার ছিলেন?

—হ্যাঁ।

—আপনি ডাক্তারি করবেন না?

—কোথায় করবো? সে সুবিধে দেখচিনে।

—তবে চলবে কি করে?

—সে জন্যেই তো তোমাকে ডেকেছে পান্না। তুমি গিয়ে দেখা করতে পারবে? যাবে আমার সঙ্গে?

—কেন যাবো না?

—তোমার দিদি কিছু বলবে না তো?

—না না। দিদি কি বলবে? আমি এখুনি যাবো। তবে দিদিকে মিথ্যে কথা বলতে হবে। বলবেন, আমি মুজরোর বায়না করতে এসেছি, ওকে একবার পান্নার কাছে নিয়ে যাবো। পান্নাকে দিদি চেনে না।

—মিথ্যে কথা আমি বলতে পারবো না। তুমি যা হয় বলো।

সুশীলা চা নিয়ে এলে নীলিমা বললে—দিদি, বাবুর সঙ্গে আমাকে এখুনি এক জায়গায় যেতে হবে।

—কেন?

—বাবুর দরকার আছে। মুজরোর বায়না হবে এক জায়গায়। সেখানে যেতে হবে।

—যা। আমি সঙ্গে আসবো?

—না, তোমায় যেতে হবে না। বাবু আমায় পৌঁছে দিয়ে যাবেন।

—আজ রাতেই দিয়ে যাবো। ন’টার মধ্যেই।

—সেজন্যে কিছু নয় বাবু, সে আপনি নিয়ে যান না। তবে দু’টো টাকা দিয়ে যাবেন। খরচপত্তর আছে তো? ও গেলে চলে না।

—সে আমি ওর হাতেই দেবো এখন।

—না বাবু, টাকাটা এখুনি আপনি দিয়ে যান।

সুশীলার হাতে আমি টাকা দু’টো দিতে ও খুব অমায়িক ভাবে হাসলো। এরা গরিব, এদের অবস্থা দেখেই বুঝলাম। পান্নারা এদের কাছে বড়লোক। নীলিমা আমাকে বললেও সেকথা রাস্তায় যেতে যেতে। পান্না না হলে ওদের মুজরোর বায়না হয় না। এর প্রধান কারণ পান্না দেখতে অনেক সুশ্রী এর চেয়ে।

বাসায় ফিরে এলুম। নীলিমাকে দেখে পান্না খুব খুশি, আমায় বললে—চা খাবার কিছু নিয়ে এসো। শীগগির যাও—ওকে পান্না কি বলেচে জানিনে, চা খাবার নিয়ে ফিরে এসে দেখি নীলি কৌতূহলের সঙ্গে বার বার আমার দিকে চাইচে। আমায় বললে—এই অবস্থায় ওকে নিয়ে এসে রেখে দিয়েচেন?

—কেন?

—এ অবস্থায় মানুষ থাকে?

পান্না প্রতিবাদ করে বললে—আমি কিছু বলেছিলাম নীলি? আমি কিছু বলি নি। ও নিজেই ওসব বলচে। আমি বলি, কেন, বেশ আছি। তোর ওসব বলবার দরকার কি?

নীলি বললে—খাবি কি? চলবে কি করে?

—সেই জন্যেই তো তোকে ডাকা। মুজরোর যোগাড় কর। সংসার চালাতে তো হবে।

—তবে পুরুষমানুষ রয়েচে কি জন্যে? ও মা—

—ওর ওপর কোনো কথা বলবার তোমার দরকার কী নীলি? ধরো ও পুরুষমানুষকে আমি নড়তে দেবো না, আমাকে মুজরো করে চালাতে হবে। এখন কি দরকার তাই বলো।

ওর কথা শুনে নীলি অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইল। এমন কথা সে কখনো শোনে নি। আমিও যে শুনেচি তা নয়। এমন ধরনের কথা ওর মুখে! অভিনয় করচে বলেও তো মনে হয় না! বলে কি পান্না? নীলি বললে—বেশ, যা ভালো বুঝিস তাই কর। আমার কিছু বলবার দরকার কি?

—কি করবি এখন তাই বল?

—মুজরোর চেষ্টা করি। সাজ-পোশাক আছে?

পান্না হেসে বললে—সেজন্যে তোকে ভাবতে হবে না। আমার ট্রাঙ্কের মধ্যে সব গুছিয়ে এনেছি। ওই করেই যখন খেতে হবে।

নীলিকে আমি আবার পৌঁছে দিতে গেলাম। নীলিমা বললে—খুব গেঁথেচেন!

—মানে?

—মানে দেখলেন না? ও কি বলে সব কথা। ওর মুখে অমন কথা। পান্নাকে গেঁথেচেন ভালো মাছ। আমি ওকে জানি। ভারি সাদা মন। নিজের জিনিসপত্তর পরকে বিলিয়ে দেয়।

—তোমাকে কোনো কথা বলেচে আমার সম্বন্ধে।

এই কথাটির উত্তর শুনবার জন্যে আমি মরে যাচ্ছিলাম। কিন্তু এ কথার সোজাসুজি উত্তর নীলিমা আমায় দিলে না। বললে—সে কথা এখন বলব না। তবে আপনার ক্ষমতা আছে। অনেকে ওর পিছনে ছিল, গাঁথতে পারে নি কেউ। আমি তো সব জানি। হরিহরপুরে একবার মুজরো করতে গিয়েছিলাম, সেখানকার জমিদারের ছেলে ওর পেছনে অনেক টাকা খরচ করেছিল। তাকে ও দূর করে দিয়েছিল এক কথায়। তাই তো বলি, আপনার ক্ষমতা আছে।

নীলিমার কথা শুনে আমি যে কোনো স্বর্গে উঠে গেলাম সে বলা যায় না—ও অবস্থায় যে কখনো না পড়েছে তার কাছে। জীবনের এ সব অতি বড় অনুভূতি, আমি নিজে আস্বাদ করে বুঝেছি। মন এবং মনের বস্তু। টাকা না কড়ি না, বিষয় আশয় না, এমন কি যশমানের আকাঙ্ক্ষা পর্যন্ত না। ও সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে, নিজের সকল প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে পান্নাকে নিয়ে অকূলে ভেসেচি। ভেসে আজ বুঝতে পেরেচি, ত্যাগ না করলে বস্তুলাভ হয় না। আমার অনুভূতিকে বুঝতে হলে আমার মতো অবস্থায় এসে পড়তে হবে।

.

পান্না আমায় রাত্রে বললে—নীলি পোড়ারমুখী কত কি বলে গেল আমায়!

—কি?

—বললে, এ সব কি আবার ঢং। ও বাবু কি তোকে চিরকাল এমনি চোখে দেখবে? তুই নিজের পসার নিজে নষ্ট করতে বসেচিস—

—তুমি কি বললে?

—আমি হেসেই খুন।

আমাকে অবাক করে দিয়েচে পান্না। ওর শ্রেণীর মেয়েরা শুনেচি কেবলই চায়, পুরুষের কাছ থেকে শুধুই আদায় করে নিতে চায়। কিন্তু ও তার অদ্ভুত ব্যতিক্রম। নিজের কথা কিছুই কি ও ভাবে না।

আমার মতো একজন বড় ডাক্তারকে গেঁথে নিয়ে এল, এসে কিছুই দাবি করলে না তার কাছে, বরং তাকে আরও নিজেই উপার্জন করে খাওয়াতে চলেচে। এমন একটি ব্যাপার ঘটতে পারে আমি তাই জানতাম না। তার ওপর আমার বয়স ওর তুলনায় অনেক বেশি। দেখতেও আমি এমন কিছু কন্দর্প পুরুষ নয়। নাঃ, অবাক করেই দিয়েচে বটে।

.

পান্না নীলিমার সঙ্গে মুজরো করতে যাবে বেথুয়াডহরি, আমি বাসা আগলে তিন চার দিন থাকবো এমন কথা হল।

যাবার দিন হঠাৎ ও আমাকে বললে—তুমি চলো।

—সেটা ভালো দেখাবে?

—খুব দেখাবে। এই বাসাতে একা পড়ে থাকবে, কি খাবে, কি না খাবে। সেখানে হয়তো কত ভালো ভালো খাওয়া জুটবে। তুমি খেতে পাবে না?

—তাতে কি?

—তাতে আমার কষ্ট হবে না?

—সত্যি, পান্না?

—আহা-হা, ঢং!

পান্না ছাড়লে না। ওদের সঙ্গে আমায় যেতে হল বেথুয়াডহরি। ভালো কাপড় পরে যেতে পারবো না বলে আধময়লা জামা কাপড় পরে ওদের সঙ্গে গেলাম। সারা রাস্তায় ট্রেনে মহাফুর্তি। আমি যে ডাক্তার সে কথা ভুলে গিয়েচি। ওদের দলে এমন মিশে গিয়েচি যেন চিরকাল খেমটাওয়ালীর দলে তল্পিতল্পা আগলেই বেড়াচ্চি।

পান্না বললে—তুমি যে যাচ্ছ, তুমি নির্গুণ, যদি জানতে পারে?

—বয়েই গেল।

—ডুগি-তবলা বাজাতেও পারো না?

—কিছু না।

—তোমাকে আমি শিখিয়ে দেবো। ঠেকা দিয়ে যেতে পারবে তো অন্ততঃ। দলে একটা কিছু বাজাতে না জানলে লোকে মানবে কেন?

—শিখিও তুমি।

বেথুয়াডহরি গ্রামে বারোয়ারি যাত্রা হচ্চে। সেখানকার নায়েবমশায় উদ্যোগী। নায়েব মশায়ের নাম বঙ্কুবিহারী জোয়ারদার। বয়েস পঞ্চাশের ওপর, কিন্তু লম্বা-চওড়া চেহারা, একতাড়া পাকা গোঁফ, বড় বড় ভাঁটার মতো চোখ। প্রমথ বিশ্বাস বলে কোন জমিদারের এস্টেটের নায়েব। আমাকে বললেন—তোমার নাম কি হে?

আসল নামটা বললাম না।

—বেশ, বেশ। তুমি কি করো?

—আজ্ঞে আমি ভাত রাঁধি।

—ও, তুমি বাজিয়ে টাজিয়ে নও।

—আজ্ঞে না।

সন্ধ্যার আগে আসর হল। অনেক রাত পর্যন্ত পান্না আর নীলি নাচলে। পান্না নাচের ফাঁকে ফাঁকে আমার সঙ্গে এসে কথা বলে। জিজ্ঞেস করলে—কেমন হচ্চে?

—চমৎকার।

—তোমার ভালো লাগচে?

—নিশ্চয়ই।

—তুমি কিন্তু উঠো না। তা হলে আমার নাচ খারাপ হয়ে যাবে। নীলি কি বলচে জানো? বলচে তোমার জন্যেই নাকি আমার নাচ ভালো হচ্চে।

—ও সব বাজে কথা। ভাত রাঁধবো যে!

—না। ছিঃ, ওসব কি কথা?

—তোমরা নেচে গিয়ে তবে খাবে? ওরা চাল ডাল দিয়েচে। মাছ কিনে দিয়েচে। আমি রাঁধবো।

—কক্ষনো না। তোমায় যেতে দেবো না। নীলি আর আমি, রান্না করবো এর পরে।

নায়েবমশায় সামনেই বসে। আমার দিকে দেখি কটমটিয়ে চাইচেন, বোধ হল পান্না যে এত কথা আমার সঙ্গে বলচে এটা তিনি পছন্দ করচেন না। আট দশ টাকা প্যালা দিলেন নিজেই রুমালে বেঁধে বেঁধে—শুধু পান্নাকে।

একটু বেশি রাত হলে আমাকে একজন বরকন্দাজ ডেকে বললে—আপনাকে নায়েববাবু ডাকচেন।

আমি গেলাম উঠে। নায়েবমশায় আসরের বাইরে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে। আমায় বললেন—এই মেয়েটির নাম কি?

আমি বললাম—পান্না।

—তোমার কেউ হয়?

—না, আমার কে হবে?

নায়েবমশায় দেখি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েচে। আমার চেহারার মধ্যে সে যেন কি খুঁজচে। আমাকে আবার বললে—তুমি এখানে এসেচ রান্না করতে বলছিলে না?

—হুঁ।

—ক’টাকা পাও?

—এই গিয়ে সাত টাকা আর খোরাকী।

—বামুন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—আমাদের জমিদারী কাছারিতে রান্না করবে?

—মাইনে কত দেবেন?

—দশটাকা পাবে আর খোরাকী। কেমন?

—আচ্ছা, আপনাকে ভেবে বলব।

—এ বেলাই বলবে তো? এখুনি বলো। আমি বাসা হতে চা খেয়ে ফিরচি।

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

নায়েবের সামনে থেকে চলে এলাম। হাসি পেলেও হাসি চেপে রাখলাম। নায়েব ভেবেচে আমি ওর মতলবের ভেতরে ঢুকতে পারি নি। ও কি চায় আমার কাছে তা অনেকদিন থেকে বুঝেছি। পাচক সংগ্রহে উৎসাহ ও ব্যস্ততা আর কিছুই নয়, ওর আসল মতলবটা ঢাকবার একটা আবরণ মাত্র।

আমার অনুমান মিথ্যে হতে পারে না এ ক্ষেত্রে। একটু পরে কাছারির একজন বরকন্দাজ এসে বললে—চলো, নায়েববাবু ডাকচেন।

গিয়ে দেখি নায়েবমশায় চা খাচ্চেন, কাছারির কোণের ঘরে তক্তপোশের ওপর বসে। ঘরে আর কেউ নেই। আমায় দেখে বললেন—এসো, বসো। চা খাবে?

—আজ্ঞে, আপনি খান।

—খাও না একটু। এই আছে, ঢেলে নাও।

নায়েবমশায়ের হৃদ্যতায় আমার কৌতুক-বোধ হলেও কোনোমতে হাসি চেপে রাখি। নিত্য থেকে লীলায় নেমে দেখি না ব্যাপারটা কি রকম দাঁড়ায়। সত্যিকার রাঁধুনী বামুন তো নই আমি। চা খাওয়া শেষ করে নায়েবমশায়ের পেয়ালা নামিয়ে রাখবার জন্য হাত বাড়িয়ে বললাম—দিন আমার হাতে।

নায়েবমশায় সন্তুষ্ট হলেন আমার বিনয়ে। বললেন—না হে, তুমি বামুনের ছেলে, তোমার হাতে এঁটো পেয়ালাটা দেবো কেন? নাম কি বললে যেন?

আগে যে নামটা বলেছিলাম, সেটাই বললাম আবার।

—কি, ভেবে দেখলে? চাকরি করবে?

—মাইনে কম। আজ্ঞে ওতে—

—দশ টাকা মাইনে, কম হল হে? যাকগে, বারো টাকা দেব, দু’ মাস পরে। এখন দশ টাকাতে ভর্তি হও। এখানে অনেক সুবিধে আছে হে—জমিদারের কাছারি হাটে তোলাটা-আসাটা, পালাপার্বণে প্রজার কাছ থেকে পার্বণী দু’চার আনা, তা ছাড়া কাছারির ও রাধুনি বামুন, ইজ্জত কত?

অতিকষ্টে হাসি চেপে বললাম—আজ্ঞে, তা আর বলতে—

—রাজী?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, একটা কথা—

—কি?

—শোবো কোথায়?

নায়েব অবাক হবার দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন—শোবে কোথায়, তার মানে?

—মানে আমি একা ছাড়া কারো সঙ্গে শুতে পারি নে কিনা, তাই বলছি।

—বেশ, সেরেস্তায় শুয়ো। সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এখন একটা কথা বলি। তুমি তো বেশ বুদ্ধিমান লোক দেখচি। পান্না বলে ওই মেয়েটাকে আজ রাতে এই ঘরে পাঠাতে হবে তোমাকে। রাত দু’টোর পর, আসর ভেঙ্গে গেলে। এজন্যে তোমাকে আমি দু’টাকা বকশিশ করবো আলাদা। দেবে এনে?

—আপনি আমায় ভাবনায় ফেলেছেন বাবু। উনি আমার কথা শুনবেন কেন? তাছাড়া আমি ওদের দলের রসুইয়ের বামুন। একথা বলতে গেলে বেয়াদবি হবে না?

—তোমার সে দোর তো আগেই খুলে রেখে দিলাম বাপু। আমরা জমিদারি চালাই, আটঘাট বেঁধে কাজ করি। বেয়াদবি বলেই যদি মনে করে, চাকরিতে রাখবে না, এই তো? বেশ, কোনো ক্ষতি নেই। চাকরি তোমার হবেই কাল এখানে। আরও উপরি দুটো টাকা। তবে পান্নাকে বলবে, ওকেও আমি খুশি করবো। আচ্ছা, ও কত নেবে বলে তোমার মনে হয়?

—আজ্ঞে, ওসব খবর আমি কিছু রাখিনে। উনি আমার মনিব, ওসব কথা ওঁর সঙ্গে আমার কি হয়?

নায়েবমশায়ের মুখে একটি ধূর্ত লালসার ছাপ উগ্র হয়ে ফুটে উঠল। চোখ টিপে বললেন—তাতে তোমার ক্ষতিটা কি? চাকরি হয়েই গেল। কাকে দিয়ে বলাতে হবে বলো না? নিজে একটু চেষ্টা করে দ্যাখো। যাও, বুঝলে? না যদি সহজ হয় তবে—

এই পর্যন্ত বলে জোয়ারদার মশায় চুপ করলেন। একটা হিংস্র পশু-ভাব সে মুখে। আমার মন বললে এ সাপকে নিয়ে আর বেশি খেলিও না, ছোবল বসাবে। পান্নাকে সাবধান করে দিলাম সব কথা খুলে বলে। সে হেসে বললে—ও রকম বিপদে অনেক জায়গায় আমাদের পড়তে হয়েচে। তুমি সঙ্গে রয়েচ—ভয় কি? নীলি দিদিকে বলে দেখচি, ও যায় যাক। যেতে পারে ও, অমন গিয়ে থাকে জানি।

নায়েবকে এসে বললাম। তখনও আসর ভাঙ্গে নি।

তিনি বসে আছেন ছোট্ট কোণের ঘরটাতে। মুখে সেই অধীর লালসার ছাপ। অশান্ত আগ্রহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন—কি হলো? এসো ইদিকে।

—সে হল না।

—কি রকম?

—আপনাকে অন্য মেয়েটি যোগাড় করে দিচ্চি। ওর নাম নীলি, ও আসবে এখন।

—ওসব হবে না। ওকে আমার দরকার নেই। পান্নাকে চাই। দশ টাকার জায়গায় বিশ টাকা দেবো। বলে দিয়ে এসো। না যদি রাজী হয়, তুমি আমায় সাহায্য কর, বরকন্দাজ দিয়ে ধরে এনে কাছারি-ঘরে পুরে ফেলি! পারবে?

—আপনাকে একটা কথা বলি। ও বাজে ধরনের মেয়ে নয়। একটা শেষে কেলেঙ্কারি করে বসবেন। নীলি আসুক ঘরে, মিটে গেল। ওকে ঘাঁটাতে যাবেন না।

এত কথা বললাম এই জন্যে যে, জোয়ারদার মশায় প্রৌঢ় ব্যক্তি, পান্নার বাবা কিংবা জ্যাঠামশায়ের বয়সী। এ বয়সে ওর অমন লালসার উগ্রতা দেখে লোকটার ওপর অনুকম্পা জেগেচে আমার মনে। আমার দলের লোক, আমি ত সব ছেড়েচি ওই জন্যে। নেশা এমন জিনিস! তেমনি নেশা তো ওরও লাগতে পারে।

জোয়ারদার মশায় নাছোড়বান্দা। ওর ইচ্ছা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বেড়ে গিয়েছে যেই শুনেচে পান্নাকে পাবে না, অমনি পান্নাকে না পেলে আর চলবে না। ওকেই চাই, রাণী চন্দ্রমণিকে না।

আমি ওঁর সব কথা শুনে বললাম—ও আশা ছাড়ুন।

—কেন? ও কি? অর্ডিনারি একটা খেমটাওয়ালী তো?

—তাই বটে, তবে ও অন্যরকম।

—কি রকম?

—আপনাকে খুলে বলি। আমি মশাই নিতান্ত রাঁধুনী বামুন নই। আমি ডাক্তার। ওর জন্যে সব ছেড়ে এসেছি। ওর দলে থাকি নে, ওর সঙ্গে এসেছি—

নায়েব অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। বললেন—তাই আপনার মুখে অনেকক্ষণ থেকে আমি কি একটা দেখে সন্দেহ করেছিলাম। যাক মশাই, আপনি কিছু মনে করবেন না। বয়েস কত মশায়ের?

—চল্লিশ।

—এত?

—তাই হবে।

—আপনি এত বয়সে কি করে ওর সঙ্গে—ওর বয়েস তো আঠারোর বেশি হবে না।

হেসে বললাম, কি করে বলব বলুন। ওর কথা কি কিছু বলা যায়?

—কি ডাক্তার আপনি? পাশ করা?

—এম. বি. পাশ।

—সত্যি বলচেন?

নায়েবমশায় তড়াক করে চৌকি ছেড়ে লাফিয়ে উঠে আমার দু হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন—মাপ করবেন ডাক্তারবাবু। আমি চিনতে পারি নি। আমি আপনার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, একটা কথা বলি, বসুন এখানে। চা খাবেন? ওরে—

—না না, চায়ের দরকার নেই। বলুন কি বলবেন?

—হাত ধরে অনুরোধ করচি—উচ্ছন্নে যাবেন না। ছেড়ে দিন ওকে। ওর আছে কি? একটা বেশ্যা—নাচওয়ালী—

আমি বাধা দিয়ে বললাম—অমন কথা শুনতে আসি নি, ওকে সমালোচনা করবার দরকার কি আপনার? কি বলছিলেন তাই বলুন?

—জানি, জানি। ও নেশা আমিও জানি মশাই। এ বুড়ো বয়েসেও এখানো নেশা ছাড়ে না। ওতেই তো মরেছি। আপনি ভদ্রলোক, আপনাকে বলতে কি? ও নেশা থাকবে না। ওকে ছেড়ে দিন। প্র্যাকটিস করতে হয় ঘর দিচ্চি, এখানে প্র্যাকটিস করুন। সব জোগাড় করে দিচ্চি।

—আচ্ছা, আপনার কথা মনে রইল। যদি কখনো—

—না না, আপনি থাকুন এখানে। এদেশে ডাক্তার নেই। পান্নাকে নিয়েই থাকুন। আমার আপত্তি নেই।

—তা হয় না। সবাই টের পেয়ে গিয়েছে ও নাচওয়ালী। এখানে প্র্যাকটিস একার হতে পারে, ওকে নিয়ে হয় না।

—সব হয় মশাই। আমার নাম বঙ্কুবিহারী জোয়ারদার, মনে রাখবেন ডাক্তারবাবু। আপনাদের বাপ-মার আশীর্বাদে—আপনার নামটি কি?

—না, সেটা বলব অন্য সময়ে। বুঝতেই পারচেন।

—আপনাকে বলা রইল। যে পথে নেমেচেন, বিপদে পড়লে চিঠি দেবেন। আমি যা করবার করবো ডাক্তারবাবু।

যাবার সময় শেষরাত্রে নায়েবমশায় নিজে নৌকোয় এসে দাঁড়িয়ে আমাদের জিনিসপত্র তুলবার সব ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলেন। পান্নার সম্বন্ধে আর কোনো কথা মুখেও আনলেন না। আমাকে আর একবার আসতে বললেন, বার বার করে। কার মধ্যে যে কি থাকে!

পান্না নৌকোয় বললে—বুড়োটা ক্ষেপেছিল তাহলে?

—সেটা তোমার দোষ, ওর দোষ নয়।

—কি বললে শেষটাতে?

নীলি ঝঙ্কার দিয়ে বললে—তুই ক্ষ্যামা দে বাপু। একটু ঘুমুতে দে। নেকু, ওরা কি বলে তুমি জানো না কিনা? খুকি! চুপ করে থাক।

পান্না হেসে বললে—নীলিদির রাগ হয়েচে—হাজার হোক—

—আবার ওই কথা! ঘুমুতে দে। বক বক করতে হয় তোমরা নৌকোর বাইরে গিয়ে বকো।

নৌকোতে উঠে সকালের হাওয়ায় আমার ঘুম এল।

.

অনেকক্ষণ পরে দেখি পান্না আমায় ডেকে তুলচে। বেলা অনেক হয়েচে। নৌকো এসে স্টেশনের ঘাটে পৌঁচে গিয়েচে।

নীলি হেসে বললে—তাহলেই আপনি মুজরোর দলে থেকেচেন! তিন চার রাত জাগতে হবে অনবরত। ঘুমুতে পারবেন না মোটে, তবেই মুজরো করতে পারা যায়। আমাদের সব অভ্যেস হয়ে গিয়েচে।

গাড়িতে উঠে নিরিবিলি পেয়ে পান্না আমায় বললে—কত টাকা পেলাম বল তো?

—কি জানি?

—তোমায় দেব না কিন্তু—হুঁ হুঁ—

ছেলেমানুষের ভঙ্গিতে হাসিমুখে ঘাড় দুলিয়ে বলে।

আমিও হেসে বলি—দেখাও না, কেড়ে কি নিচ্চি?

—বিশ্বাস কি?

পান্না একটা রঙীন রুমালের খুঁট খুলে দেখালে, একখানা দশটাকার নোট আর খুচরো রুপোর টাকা গোটা বারো, একে একে গুনলে।

আমি বললাম—নীলির ভাগ আছে তো এতে?

—ওর ভাগ ওকে দিয়েচি। এ তো প্যালার টাকা। নীলিকে কেউ প্যালা দ্যায় নি তো।

—দ্যায় নি?

—আহা, কবে দ্যায়?

—তার মানে তুমি রূপসী বালিকা, তোমার দিকে সকলের চোখ?

—যাও!

—সত্যি, জানো না কি হয়েছিল কাল? নীলি বলে নি তোমায়?

—না। কি হয়েছিল গো?

—নায়েবের চোখ পড়েছিল তোমার দিকে।

—সে কি রকম?

ওকে সব খুলে বললাম। ও শুনে বললে—কত জায়গায় এ রকম বিপদে পড়তে হয়েচে। তবে তোমাকে নিয়ে এসেছিলুম কেন? সঙ্গে পুরুষ না থাকলে কি আমাদের বেরুনো চলে?

হেসে বললাম—ঢং কোরো না পান্না।

—সে কি?

—সব জায়গায় সতী ছিলে তুমিও! বিশ্বাস তো হয় না।

পান্না গম্ভীর মুখে বললে—না, তোমার কাছে মিথ্যে কথা বলব না। ভাবনহাটি তালকোলার জমিদার-বাড়িতে কি একটা বিয়ে উপলক্ষে আমরা গেলুম মুজরোতে। জমিদারের ভাইপোর বিয়ে। সেই বিয়ের নতুন বর, জমিদারের ভাইপো উঠল আমায় দেখে সেই রাত্তিরে। আমায় নৌকোতে করে সারা রাত নিয়ে বেড়ালে।

—বলো কি?

—তারপর শোনো। সেই লোক বলে—আমরা চলো যাই কলকাতায় পালিয়ে, নতুন বৌকে ফেলে। বিয়ে হয়েচে, তখনও বুঝি ফুলশয্যা হয় নি। বলো কত টাকা চাও বলো কত টাকা চাও,—আমাকে হাতে ধরে পীড়াপীড়ি। কত বোঝাই—শেষে না পেরে বলি হাজার টাকা মাসে নেবো। তখন কাঁদতে লাগলো। পুরুষমানুষের কান্না দেখে আমার আরও ঘেন্না হয়ে গেল। বলচে, আমার তো নিজের জমিদারি নয়, বাবা কাকা বেঁচে। হাজার টাকা করে মাসে কোথা থেকে দেবো? তবে নতুন বৌয়ের গায়ের তিন হাজার টাকার গয়না আছে, তুমি যদি রাজী হও, আজ শেষ রাত্তিরে সব গয়না চুরি করে আনবো। শুনে তো আমি অবাক! মানুষ আবার এমন হয় নাকি? পুরুষ জাতের ওপর ঘেন্না হয়ে গেল। নতুন বউ, তার গয়না নাকি চুরি করে আনবে বলচে! আমি সেই যে ফিরে এলাম, আর ওর সঙ্গে দেখা করি নি। বলে, নিজের গলায় নিজে ছুরি দেবে। আমি মনে মনে বলি, তাই দে।

—চলে এলে?

—তার পরের দিনই।

—কত টাকা তোমার হত!

—অমন টাকার মাথায় মারি সাত ঝাঁড়ু। একটা নতুন বৌ, ভালো মানুষের মেয়ে তাকে ঠকিয়ে তার গা খালি করে টাকা রোজগার? সে লোকটা না হয় ক্ষেপেছে, আমি তো আর তাকে দেখে ক্ষেপি নি? আমি অমন কাজ করবো?

পান্নার মুখে একথা শুনে খুব খুশি হলাম। পান্না যে আবহাওয়ায় মানুষ, যে বংশে ওর জন্ম, তাতে তিন হাজার টাকার লোভ এভাবে ত্যাগ করা কঠিন। ও যদি আমার কাছে মিথ্যে না বলে থাকে তবে নিঃসন্দেহে পান্না উঁচুদরের জীব।

বৌবাজারের বাসায় এসে নীলি চলে গেল। বিকেল বেলা। পান্না কলে কাপড় কেচে গা ধুয়ে এল। সত্যি, রূপসী বটে পান্না। সাবান মেখে স্নান করে ভিজে চুলের রাশ পিঠে ফেলে একখানা বেগুনি রংয়ের ছাপাশাড়ি পরে ও যখন ঘরে ঢুকলো, তখন তালকোলার জমিদারের ভাইপো তো কোন ছার, অনেক রাজা মহারাজের মুণ্ডু সে ঘুরিয়ে দিতে পারতো, এ আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি।

পান্না সেই রঙীন রুমালের খুঁট খুলে টাকাগুলো সব মেজেতে পাতলে। বললে—কত টাকা গো? এই দশ, এই পাঁচ—

—থাক, গুনচো কেন?

—তুমি নেবে না?

—এখন রাখো তোমার কাছে।

—খরচপত্তর তুমিই তো করবে।

—আমার বাক্স নেই। তোমার বাক্সে রাখো।

—তাহলে এক কাজ করো। টাকা নিয়ে বাজারে যাও, দু’টো চায়ের ডিসপেয়ালা, ভালো চা চিনি, এ বেলার জন্য কিছু মাছ আলু পটল আনো। মাছের ঝোল ভাত করি। একখানা পাপোশ কিনে এনো তো! যত রাজ্যির ধুলো সুদ্ধু ঘরে ঢোকো তুমি।

—তা আর বলতে হয় না।

—না হয় না, তুমি জুতো ঘরে নিয়ে ঢুকো না। পাপোশ একখানা এনো, ওখানে থাকবে। আর ধুনো এনো, সন্দেবেলা ধুনো দেবো।

—তুমি যে সাধু হয়ে উঠলে দেখচি। আবার ধুনো?

পান্না বিরক্তমুখে বললে—আহা, কি যে রঙ্গ করো! গা যেন জ্বলে যায় একেবারে। ও মুখ ঘুরিয়ে নাচের ভঙ্গিতে চলে গেল।

কি সুন্দর লাবণ্যময় ভঙ্গি ওর! চোখ ফেরানো যায় না। সত্যি, কোন স্বর্গে আমায় রেখেচে ও? ওকে পেয়ে দুনিয়া ভুল হয়ে গিয়েচে আমার। পূর্ব আশ্রমের কথা কিছুই মনে নেই। সুরবালা-টুরবালা কোথায় তলিয়ে গিয়েচে। বাজার করে একটা ছোট পার্কের বেঞ্চির ওপর বসে বসে এই সব ভাবি। এই বেঞ্চিটা আমার প্রিয় ও পরিচিত, অনেকবার ওর কথা ভেবেচি এটাতে বসে।

বাসায় ঢুকতে পান্না বললে—ওগো, আর একবার যেতে হবে বাজারে—

—কেন?

—দইওয়ালী এসেছিল, তোমার জন্যে দই কিনে রেখেচি। পাকা কলা নিয়ে এসো, খাবে।

আবার পাকা কলা কিনতে বেরুই। এতেও সুখ। আমি কত সচ্ছল অবস্থায় মানুষ, পান্না তার ধারণাও করতে পারবে না। সব ছেড়ে ওর কাছ থেকে টাকা নিয়ে দু’এক টাকার বাজার করচি, পায়ে জুতো ছিঁড়ে আসচে, গায়ে মলিন জামা—যে আমি দিনে তিনবার ধুতি-পাঞ্জাবি বদলাতুম, তার এই দশা। কিছু না। সংসার অনিত্য। প্রেমই বস্তু। তা এতদিনে পেয়েছি। বস্তুলাভ ঘটেচে এতকাল পরে। আর কিছু চাই না।

দুপুরবেলা পান্না রেঁধে বললে—খাবে কিসে?

—কেন, শালপাতায়?

—দোহাই তোমার, তোমার জন্যে অন্ততঃ একখানা থালা কিনে আনো।

—কিছু পয়সা দাও দেখি?

—কত?

—অন্ততঃ দশটা টাকা। দুখানা থালা কিনে আনি।

—এখন? আমার হাতে এঁটো। বাক্সে আছে। চাবি নিয়ে বাক্স খুলতে পারবে?

আমি হেসে বললাম—না পান্না, আমি নিজেই আনছি কিনে। আমার কাছে আছে।

ওর ধরন আমার খুব ভালো লাগলো। ও পয়সা দিতে চাইলে, কোনো প্রতিবাদ করলে না। ওর তো খরচ করার কথা নয়, খরচ করার কথা আমার। অথচ ও অকাতরে বাক্স খুলে পয়সা বার করে দিলে কেন? পান্না অন্য ধরনের মেয়ে, ওকে যতই দেখচি, ওকে অন্য জাতের মেয়ে বলে মনে হচ্চে। ওদের শ্রেণীর অন্য মেয়ের মতো নয় ও।

আমি দু’খানা এনামেলের থালা কিনে আনলাম। হাতে বেশি পয়সা নেই। পান্না দেখে হেসেই খুন। আমি শেষে কিনা এনামেলের থালা কিনে আনলাম? কখনো এ থালায় খেয়েছি আমি?

—খাই নি?

—হি-হি-হি—

—অত হাসি কিসের?

—জব্দ গো জব্দ। বড্ড জব্দ হয়েচ এবার।

—কিসের জব্দ?

—পয়সা ফুরিয়েচে তো হাতে? এবার নীলিকে খবর দাও। দু’জনে মুজরো করে আনি। না হলে খাবে কি? লবডংকা?

পান্না দুই হাতের বুড়ো আঙ্গুল তুলে নাচিয়ে অপূর্ব ভঙ্গিতে হেসে আবার গড়িয়ে পড়লো।

আমার কি যেন একটা হয়েচে, পান্না যা করে আমার বেশ ভালো লাগে, যে কথাই বলুক

বা যে ভঙ্গিই করুক। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর হেসে-লুটিয়ে-পড়া তনুলতার দিকে চেয়ে রইলাম। অপূর্ব সুশ্রী মেয়ে পান্না।

.

আর একটা কথা ভেবে দেখলাম বিকেলে একটা পার্কে নিরিবিলি বসে। আমার হাতে আর অর্থ নেই বা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি এ জিনিসটা পান্নার পক্ষে আদৌ প্রীতিপ্রদ নয়। কিন্তু এটাকে ও অতি সহজভাবেই মেনে নিয়ে তার প্রতিকারও করতে চাইলে। ও নিজে উপার্জন করে এনে খাওয়াবে আমাকে ভেবেচে নাকি? ও অতি সরল। কিন্তু এই সরলতা আমার পক্ষে সম্পূর্ণ অভিনব। আমি এর আস্বাদ পেয়ে ধন্য হলাম।

পান্নাকে আমি মনে মনে শ্রদ্ধা না করে পারলাম না। কেমন সহজ ভাবে ও আমার নিঃস্বতার বার্তাকে গ্রহণ করলো! কত সম্ভ্রান্ত ঘরের বিবাহিতা স্ত্রীরা এত সোজাভাবে স্বামীর ব্যাঙ্ক ফেল মারার বার্তাকে পরিপাক করতে পারতো না। পান্নার শালীনতা অন্য রকমের, ও বেশি কখনো পায়নি বলেই বেশি চায় না—তাই কি? এই অবস্থাটাই বোধ হয় ওর কাছে সহজ।

পান্না আমাকে ভালোবাসে নিশ্চয়ই। ভালো না বাসলে ও এমন কথা বলতে পারতো না। আমার বয়েস হয়েচে, একটি ষোড়শী সুন্দরী কিশোরী আমাকে অমন ভালোবাসবে, এ আমার পক্ষে বিশ্বাস করা শক্ত। সত্যি কি পান্না আমাকে ভালোবেসে ফেলেচে? না, বিশ্বাস করা শক্ত। একবার বিশ্বাস হয়, একবার হয় না।

পার্কের বেঞ্চিটার ও-কোণে একটা চানাচুর-ভাজাওয়ালা এসে বসল। আমায় বললে—বাবু, দেশলাই আছে? আমি তাকে দেশলাই দিলাম। চলে যা না কেন বাপু, তা নয়, সে আবার আমার সঙ্গে খোসগল্পে প্রবৃত্ত হয়, এমন ভাব করে তুললে। আমার কি এখন ওই সব বাজে কথা ভালো লাগচে?

আবার নির্জন হল পার্কের কোণ। আবার আমি বসে ভাবি।

পান্না আমাকে ভালোবাসে, ভালোবাসে, ভালোবাসে।…

কি এক অদ্ভুত শিহরণ ও উত্তেজনা আমার সর্বদেহে! চুপ করে বসে শুধু ওই কথাটাই ভাবি। শুধু ভেবেই আনন্দ। এত আনন্দ যে আছে চিন্তার মধ্যে, এত পুলক, এত শিহরণ, এত নেশা—এ কথাই কি আগে জানতাম? যেন ভাঙ খাওয়ার নেশার মতো রঙীন নেশাতে মশগুল হয়ে বসে আছি। জীবনে এরকম নেশা আসে চিন্তা থেকে, তাই বা কি আগে জানতাম?

সুরবালার সঙ্গে এতদিনের ঘরকন্না আমার ব্যর্থ হয়ে গিয়েচে।

ভালোবাসা কি জিনিস, ও আমাকে শেখায় নি।

যদি কখনো না জানতাম এ জিনিস, জীবনের একটা মস্ত বড় রসের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকতাম।

সুরবালার চিন্তা আমাকে কখনও নেশা লাগায় নি।

কিন্তু কেন? সুরবালা সুন্দরী ছিল না তা নয়। আমাদের গ্রামের বৌদের মধ্যে এখনো সুন্দরী বলে সে গণ্য। এখন তার বয়েস পান্নার ডবল হতে পারে, কিন্তু একসময়ে সেও ষোড়শী কিশোরী ছিল। কিন্নরকণ্ঠী না হলেও সুরবালার গলার সুর মিষ্টি। এখনো মিষ্টি। ষোড়শী সুরবালাকে আমি বিবাহ করেছিলাম। কিন্তু কিসের অভাব ছিল তার মধ্যে? অভাব কিসের ছিল তখন তা বুঝি নি। এখন বুঝতে পারি, পান্নার ভালোবাসা পেয়ে আমার এই যে নেশার মতো আনন্দ, এই আনন্দ সে দিতে পারে নি। নেশা ছিল না ওর প্রেমে। ওর ছিল কিনা জানি নে, আমার ছিল না। এত যে নেশা হয় তাই জানতাম না, যদি পান্নার সঙ্গে পরিচয় না হত। এর অস্তিত্বই আমার অজ্ঞাত ছিল।

রাস্তা দিয়ে মেলা লোক যাচ্চে। পার্কে মেলা লোক বেড়াচ্চে। এদের মধ্যে ক’জন লোক এমন ভালোবাসার আনন্দ আস্বাদ করেছে জীবনে? ওই যে লোকটা ছাতি বগলে যাচ্চে, ও বোধ হয় একজন স্কুল-মাস্টার। ও জানে ভালোবাসার আস্বাদ? ওর পাশের বাড়ির কোনো দুরধিগম্য সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে হয়তো ছাদে ছাদে দেখা—হয় না কি? হয়তো সেই জন্যে ও ছুটে ছুটে যাচ্চে বাসায়!

যদি না জানে ওর আস্বাদ, তবে ওরা বড্ড দুর্ভাগা। অমৃতের আস্বাদ পায়নি জীবনে।

ভালোবেসে আনন্দ নয়, ভালোবাসা পেয়ে আনন্দ। এ কোনো আইডিয়ালিস্টিক ব্যাপার নয়, নিছক স্বার্থপর ব্যাপার। একটু আস্বাদ করে আরও আস্বাদ করতে প্রাণ ব্যগ্র হয়ে পড়ে।

বেলা পড়লে উঠে বাসায় ফিরলুম। পান্না কি সত্যিই আছে? ও স্বপ্ন না তো? না, পান্না বসে চুল বাঁধচে। ওর সেই তোরঙ্গটা থেকে আয়না বের করেচে, দাঁত দিয়ে চুলের দড়ির প্রান্ত টেনে ধরেচে, বেশ ভঙ্গিটি করে।

চমকে উঠে বললে—কে?

পেছন ফিরে চাইতে গেল তাড়াতাড়ি।

আমি বললাম—দোর খুলে রেখেচ কেন? একলা ঘরে থাকো, যদি চোর ঢোকে? বন্ধ করে রেখো।

ও অপ্রতিভ হয়ে বললে—আচ্ছা।

—চুল বাঁধচো?

—দেখতে পাচ্চো না? চা খাবে তো?

—নিশ্চয়ই।

—চা-চিনি নিয়ে এসো। কিছুই নেই।

—পয়সা দাও।

—নিয়ে যাও আমার এই পাউডারের কৌটো খুলে। এই যে—

পয়সা নিয়ে নেমে গেলুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *