চাণক্য সূত্র – চতুর্থ অধ্যায়
অধনস্য বুদ্ধি র্নবিদ্যতে ॥১॥
হিতমপ্যধনস্য বাক্যং ন শৃণোতি ॥ ২॥
ধনহীনঃ স্বভাৰ্য্যয়া অবমন্যতে ॥ ৩॥
পুষ্পহীনং সহকারমপি নোপাসতে ভ্রমরাঃ ॥ ৪০
অনুবাদ : দরিদ্রের বুদ্ধি থাকে না। ১।
মর্মার্থ : অর্থাভাবই দরিদ্রতা, অর্থাভাবে পুরুষের ক্রমে বৃদ্ধি স্মৃতি, মেধা হ্রাস পেতে থাকে। ধনাভাবের চিন্তাই শক্তি নাশের হেতু। যার প্রচুর ধন আছে, তার অশন, বসন, পান, অবস্থানের চিন্তা না থাকাতে বুদ্ধি শক্তির ক্রমেই বিকাশ হয়। স্মৃতি, উৎসাহ, অধ্যবসায় বৃদ্ধি পায়। ১।
অনুবাদ : দরিদ্রের হিতকর বাক্যও কোনো লোক শুনে না। ২।
মর্মার্থ : দরিদ্র ব্যক্তি যদি হিত ও সদুপদেশপূর্ণ বাক্য বলে, তাও কেউ শুনতে চায় না। যার ধন নেই, তার বাক্যের কোনো মূল্য নেই। ধনী ধন দ্বারা নিজ বাক্যের অনুরূপ কার্য সাধন করতে সমর্থ। দীন ব্যক্তি তা পারে না। দারিদ্র্যদোষ পুরুষের সকল গুণকে আবৃত করে। ২।
অনুবাদ : ধনহীন পুরুষকে স্বীয় স্ত্রীও অবজ্ঞা করে। ৩।
মর্মার্থ : যার ধন আছে, তাকে ধনের আশায় সকলে আশ্রয় করে। ধন না থাকলে স্বীয় পুত্র ভার্ষাও অবজ্ঞাপূর্বক ত্যাগ করতে উদ্যত হয়। ধনবানকে ফকির, আমির সকলেই শক্তিমান বলে প্রীতি ও সম্ভ্রমের চক্ষে দেখে। সাংসারিক বিষয়ে ধনের মর্যাদা অধিক। অসদুপায়ে অর্জিত ও রক্ষিত ধনের গতি অসৎ পথেই হয়। অতএব সদু পায়ে ধন সঞ্চয় ও তার সৎপথে ব্যয় একান্ত প্রয়োজন।
অনুবাদ : সৌরভময় আম্রবৃক্ষ যদি পুষ্পহীন হয়, তাহলে ভ্রমরকুল নিকটেও যায় না। ৪।
মর্মার্থ : যার সমীপে যার স্বার্থসিদ্ধি হয়, সে তার সেবায় নিরত থাকে : কিন্তু স্বার্থসিদ্ধির সম্ভাবনা না থাকলে সে তার নিকটে যেতে প্রস্তুত নয়। যেমন পুষ্পহীন সৌরভযুক্ত সহকারে তরুর নিকট ভ্রমর যায় না। জলহীন জলাশয়ের নিকট পিপাসার্ত যায় না। সেরূপ বিচার ও দয়া প্রভৃতি গুণশূন্য প্রভুর নিকট ভৃত্য গমন করে না। ৪।
বিদ্যা ধনমধনানাম্ ॥ ৫॥
বিদ্যা চোরৈরপি ন হাৰ্য্যা ॥ ৬০
বিদ্যয়া খ্যাতিঃ ॥ ৭ ॥
যশঃ শরীর ন বিনশ্যতি ॥ ৮ ॥
যঃ পরার্থমুপসর্পতি স সৎপুরুষঃ ॥ ৯ ॥
অনুবাদ : দরিদ্রগণের বিদ্যাই ধন। ৫।
মর্মার্থ : যাদের অপার ধন নেই, বিদ্যামাত্র আছে, তাদের বিদ্যাই ধন। শাস্ত্রে অধ্যয়ন জনিত জ্ঞানই বিদ্যা নামে অভিহিত। ‘বিদ্যাধন’ জ্ঞাতিগণ বিভাগ করে নিতে পারে না, দান দ্বারা ক্ষয় হয় না, অতএব এই বিদ্যারত্ন মহাধন’ নামে খ্যাত। অতি হীন বা নিজন হতেও সুবিদ্যা গ্রহণ করবে, বিদ্বান সকলের শ্রদ্ধেয়। বিদ্যাভ্যাসে কারও অবহেলা করা উচিত নয়। ৫।
অনুবাদ : চোরও বিদ্যাকে অপহরণ করতে সক্ষম হয় না। ৬।
মর্মার্থ : চোর সকল ধন অপহরণ করতে পারে কিন্তু বিদ্যা হরণ করতে পারে না। বিদ্যা পাঠজনিত জ্ঞান বিশেষ, তা মানবের অন্তঃকরণে নিয়ত থাকে, অধ্যয়ন, অধ্যাপক, অভ্যাসে এবং পরস্পর আলোপে বিদ্যাশক্তি অতিমাত্রায় বর্ধিত হয়। দানে, উপদেশেও তাই হয়। ৬।
অনুবাদ : বিদ্যার দ্বারা অশেষ সুখ্যাতি লাভ হয়। ৬।
মর্মার্থ : শ্রম ও অর্থ ব্যয়পূর্বক বিদ্যা অর্জন করতে পারলে, সে বিদ্যা দ্বারা সমাজে অশেষ সুনাম অর্জন করা যায়। প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের দ্বারা সুযশ ও প্রচুর অর্থ সংগ্রহে সমর্থ হয়। বিদ্বান ব্যক্তি বহুতত্ত্ব আবিষ্কার করে লোকের হিত সাধন করে। ৭।
অনুবাদ : যশের শরীর কখনো বিনাশপ্রাপ্ত হয় না। ৮।
মর্মার্থ : যশের শরীর অর্থাৎ সুকীর্মি রূপদেহ মানবের মৃত্যুর পর বিনষ্ট হয়, যেহেতু লোকমুখে ও চিত্তে সর্বদা বিদ্যমান থাকে। যার কীর্তি বর্তমান থাকে, সে মৃত হয়েও জীবিত। কবি বলেছেন, যাদের কবিত্বসুধাপানে মানব হৃদয় নিরন্তর প্রফুল্ল, সেই সুপণ্ডিতগণ সতত জয়যুক্ত হন। যাদের যশঃশরীরে জরা মরণের ভয় নাই। ৮।
অনুবাদ : যে পার্থ সাধনে রত, সে ব্যক্তিই সৎ পুরুষ। ৯।
মর্মার্থ : স্বার্থ সাধন করা লোকের স্বাভাবিক কার্য, যে পরোপকারে তৎপর, সে ব্যক্তিই প্রকৃত সৎ পুরুষ নামে খ্যাত হয়। নিঃস্বার্থভাবে পরের হিত সাধন করা জগতে দুর্লভ, অতএব পরার্থপর ব্যক্তিই সৎপুরুষ। যেমন মলয়জ (চন্দন) কে দাহ, ছেদন, ঘর্ষণ করলেও সে সুগন্ধি ভিন্ন দুর্গন্ধ বিতরণ করে না, সকল সময়ে সুগন্ধিই বিতরণ করে, তদ্রুপ সৎপুরুষও সকল অবস্থায় অন্যের হিতসাধন করে। ৯।
ইন্দিয়াণাং প্রশমনকারণং শাস্ত্রম্ ॥ ১০ ॥
অকাৰ্যে প্ৰবৃত্তৌ শাস্রাঙ্কুশং নিবারয়তি ॥ ১১ ॥
নীচস্য বিদ্য নো পেতব্যা ॥ ১২
ন ম্লেচ্ছ ভাষণং শিক্ষেত ॥ ১৩ ॥
অনুবাদ : ইন্দ্রিয়গণের প্রশমনকারক শাস্ত্র। ১০।
মর্মার্থ : মানবের ইন্দ্রিয়গণ, স্বভাবতই বিষয়াভিমুখে ধাবিত হয়, যেমন যেমন বিষয়ের সঙ্গে সম্বন্ধে হয়, সে সেরূপ সুখ-দুঃখাদিরও ভোগ হয়। অতএব দুঃখজনক বিষয়ের সঙ্গে যাতে ইন্দ্রিয়গণের সম্বন্ধে না হয়, তার উপায় শাস্ত্রোপদেশ, শাস্ত্রে অসৎপথ হতে ইন্দ্রিয়গণকে নিবৃত্ত করার জন্য অসংখ্য উপদেশ আছে। সেই শাস্ত্র বাক্য লঙ্ঘনপূর্বক ইন্দ্রিয় বশগামী হয়ে পড়লে মানবকে প্রতিপদেই বিপন্ন হতে হয়। ১০।
অনুবাদ : অকার্যে প্রবৃত্ত পুরুষকে শান্ত্রাঙ্কুশ (বাক্য) নিবারিত করে। ১১।
মর্মার্থ : মানুষ স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বশবর্তী কিংবা মূর্খতাবশত গর্হিত কার্যে প্রবৃত্ত হয়ে স্বীয় ও অন্যের অনিষ্ট সাধন করে। যখন হৃদয়ে ন্যায় বিরুদ্ধ দুবৃস্তুতির উন্মেষ হয়, সে সময়ে শাস্ত্রবাক্যই স্নেহময়ী জননীবাক্যের ন্যায় কল্যাণপথে ফিরিয়ে আনে। যেমন বিপদগামী হস্তীকে অঙ্কুশ সুপথে আনয়ন করে। যার শাস্ত্রজ্ঞান নেই, তার প্রতিপদেরই বিপদ সম্ভাবনা। ১১।
অনুবাদ : নীচ প্রকৃতি লোকের বিদ্যা শিক্ষা করা উচিত নয়। ১২।
মর্মার্থ : কুর, হীন ব্যক্তির বিদ্যাভ্যাসে কোনো ফল হয় না, অপাত্রে কার্যভার ন্যস্ত করার ন্যায় হয়ে থাকে। যার নিত্যই দুরভসন্ধি, দুষ্কর্মে প্রবৃত্তি, গহিত আচরণ, তার বিদ্যাভাবে কোনো সুফল হয় না। সময়ে বিপরীত ফলও হতে দেখা যায়। যার সদাভিপ্রায়, সঙ্কর্ম, চরিত্র বল আছে, তারই বিদ্যা গ্রহণে সুফলের বিশেষ আশা থাকে। ১২।
অনুবাদ : স্নেচ্ছের ভাষা শিক্ষা করবে না। ১৩।
মর্মার্থ : শবর, পুলিমূ, কিরাতদের সাধারণ ম্লেচ্ছ বলে। তাদের আচরণ, ভাষা, জ্ঞান ও বুদ্ধির উৎকর্ষতা এবং নৈর্মল্য সাধক নয় বলে শিক্ষা করতে নিষেধ করেছেন। যে ভাষা শিক্ষা দ্বারা প্রতিভা ও জ্ঞানের প্রাচুর্য জন্মে না, মানবকে সমুন্নত করে না, সে ভাষা শিখবে না। ভাষ্য কথ্য, দেশ্য লেখ্য ভেদে নানা। ললিত বিস্তর মতে ভাষা চতুঃষষ্ঠি প্রকার। অন্যান্য গ্রন্থকারের মতেও ভাষা নানাবিধ। ১৩।
ম্লেচ্ছানমপি সুবৃত্তং গ্রাহ্যম্ ॥ ১৪ ॥
শত্রোরপি সদ্গুণ্যে গ্রাহ্যঃ ॥ ১৫ ॥
বিষাদপ্যমৃতং গ্রাহ্যম্ ॥ ১৬ ॥
গুণে ন মসর কর্তব্য ॥ ১৭ ॥
অনুবাদ : ম্লেচ্ছাগণের আচরিত সুবৃত্ত গ্রহণ করবে। ১৪।
মর্মার্থ : গুণ ও সারবস্তু গ্রহণে উচ্চ, নীচ ভাব গ্রহণ করা নীতি শাস্ত্রের অনভিপ্রেত। লঘুচাণক্যে উক্ত আছে, কুকুর হতেও গুণমাত্র গ্রহণ করবে। ম্লেচ্ছগণের নিকট হতে কৌশল ও সুশিক্ষা গ্রহণীয়। পুরাকালে বাণিজ্য ও ধনার্জন মানুষ ব্যপদেশে মহাসাগর পার হয়ে দ্বীপান্তরে গমন করতো। বেদ, স্মৃতি, পুরাণ প্রভৃতিতে তার নিদর্শন পাওয়া যায়, সে সকল প্রমাণ টীকাতে সংক্ষেপে উক্ত হয়েছে। গুণ ও সভৃত্তি শিক্ষায় কখনও পশ্চাৎপদ হবে না। গুণ দ্বারা তোক গৌরবান্বিত ও উচ্চপদস্থ হয়। ১৪।
অনুবাদ : শত্রুর নিকট হতেও সদ গুণ গ্রহণ করবে। ১৫।
মর্মার্থ : গুণ গ্রহণ বিষয়ে শত্ৰুমিত্র বিচার করা অনুচিত। শত্রুরও গুণ গ্রহণ করবে, মিত্রেরও দোষ দর্শন করবে। মহা ভারতে উক্ত আছে, শত্রু গুণ প্রকাশ করবে, গুরুজনেরও দোষ বলবে। সুধী ব্যক্তি, দোষগুণ বিচারে কোনোরূপ পক্ষপাত করবে না। প্রাচীন কবি বলেছেন, গুণের সম্মান সর্বত্রই হয়ে থাকে। গুণীগণের গুণসমূহেই সম্মানের আকর, তাদের বয়স বেশভূষণাদি নয়। শত্ৰু হীন, ক্রুর ব্যক্তি হতেও গুণ গ্রহণ করবে। ১৫।
অনুবাদ : বিষ দ্রব্য হতেও অমৃত গ্রহণ করবে। ১৬।
মর্মার্থ : যা মহোপকারী মহার্ঘ বস্তু তা বিষ হতেও গ্রহণ করবে, যেমন। রত্নতুল্য রমণী নীচকুল হতেও বিবাহহীন, কিন্তু সেরকম স্ত্রী দুর্লভ। সরূপ বিষ হতেও অমৃত কিংবা তত্সমান দ্রব্য আহরণীয়, যেমন সমুদ্র তল হতে এবং সর্প মস্তক হতে রত্ন সংগ্রহের যোগ্য। সেরূপ জনহিতকর কার্যে প্রাণপাত করে কার্য সাধনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। বিষ মিশ্রিত ঔষধ ব্যবহারে অমৃতরূপ প্রাণ রক্ষিত হয়। ১৬।
অনুবাদ : লোকের গুণ দেখে তাতে মাৎসর্য (দ্বেষ) প্রকাশ করবে না। ১৭।
মর্মার্থ : সর্বত্র গুণের সমাদর করা উচিত, তাতে স্বীয় ও পরের উন্নতি সমাজস্থিত বৃদ্ধি পায়। গুণের প্রতি অনাদর ও গুণীলোকের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করলে, স্বীয় অবনতি এবং সমাজের অকল্যাণ হয়। গুণের উকর্ষতা বৃদ্ধি ও তাতে বিশেষ উৎসাহ প্রদান না করলে কখনও কোনো সমাজ উন্নত হতে পারে না। গুণী ব্যক্তির অনিষ্ট সাধন করা সর্বদা গর্হিত। ১৭।
অবস্থায়া পুরুষ সম্মান্যতে ॥ ১৮০
স্থান-এব নবাঃ পূজ্যন্তে। ১৯ ॥
আৰ্য-বৃত্তমনুতিষ্ঠেৎ ॥ ২০ ॥
ন কদাপি মৰ্য্যাদামতিক্রমে ॥ ২১ ॥
অনুবাদ : অবস্থা দ্বারা পুরুষ সম্মানিত হয়। ১৮।
মর্মার্থ : সৎ অবস্থা দ্বারা লোক গৌরবান্বিত হয়, দুরবস্থায় পতিত হলে সমাজে দুষ্ট লোকের নিকট অবজ্ঞাত হয়, অতএব বিদ্যা, ধন, পরিজন, স্বাস্থ্য, গুণ দ্বারা যাতে লোক উন্নত হতে পারে, তা করা উচিত। গুণহীন ব্যক্তি প্রায়ই দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে বিপন্ন হয়, লোকে অবজ্ঞা করে।
অনুবাদ : যোগ্য স্থানে অবস্থিত লোক পূজিত হয়। ১৯।
মর্মার্থ : যার যা উপযুক্ত ও হিতকর স্থান, সেরূপ স্থানে অবস্থান করলে মানব গৌরবপ্রাপ্ত হয়। অযোগ্য ও পরকীয় স্থানে বাস করলে অবনতি এবং ক্লেশ ভাগী হতে হয়। যেমন গিরিগৃহে সিংহের বাসযোগ্য স্থান, লোকালয় তার বাসের অনুপযুক্ত। বিদ্যা ও জ্ঞানার্জনের স্থান বিদ্যালয় এবং বিদ্বৎগোষ্ঠী, রঙ্গালয় নয়। ‘পদ্ম যে সময় সরোবরে প্রস্ফুটিত হয়, তখন তার জল ও বিকাশক সূর্য এই উভয়ই সহায় হয়, সে পদ্ম যদি জল হতে উদ্ধৃত হয়, তবে তার পক্ষে জলক্লেকর এবং সূর্য শুষ্কতার হেতু নয়। স্থানের প্রাধান্য থাকলে অপ্রধানও শ্রেষ্ঠ হয়, যেমন রাজার আশ্রয়ে ক্ষুদ্রের মহত্ত্ব বদ্ধি পায়। ১৯।
অনুবাদ : আর্যগণের চরিত্র অনুসরণ করবে। ২০।
মর্মার্থ : আর্যগণ নিয়মানুসারে কর্তব্যপরায়ণ অর্থাৎ যা কর্তব্য তাই আচরণ করে, যা ন্যায়ত অকর্তব্য তার অনুষ্ঠান করে না, প্রকৃত আচারে অবস্থান করে তারা আর্য নামে অভিহিত। তাদের আচরণ অনুধাবন ও শিক্ষা করবে, তার দ্বারা উন্নত হওয়া সম্ভব। মানব, অসসঙ্গ ও অসদাচরণে অবনত এবং শক্তিহীন হয়। ২০।
অনুবাদ : কখনো মর্যাদা অতিক্রম করবে না। ২১।
মমার্থ : কোনো বিষয়ে কখনো কর্তব্যের সীমা লঙ্ঘন করা উচিত নয়। ন্যায়পথ অতিক্রম করলে ক্রমে সত্যের হানি, অসৎ বিষয়ে সাহস এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ প্রভৃতি দোষ জন্মাতে পারে। সত্যের মর্যাদা লঙ্ঘন করলে ক্রমে সকল প্রকার দুষ্প্রবৃত্তি মানসপটে জাগ্রত হয়। নিয়মপরায়ণ ব্যক্তি বিশ্বস্ত ও উন্নত হয়। সুতরাং মানুষকে জীবনে উন্নতি লাভ করে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে, সর্বাগ্রে সর্বাতভাবে নিয়মনিষ্ঠ হতে হয়। নিয়ম লঙ্ঘন করার অপর নাম অবনতির সোপানে পদক্ষেপ। ২১।
নাস্ত্যর্ঘঃ পুরুষ-রত্নস্য ॥ ২২ ॥
ন স্ত্রীরত্বসমং রত্নম্ ॥ ২৩ ॥
দুর্লভং রত্নম্ ॥ ২৪ ॥
অযশোভয়ং ভয়েষু ॥ ২৫ ॥
অনুবাদ : পুরুষরত্ব অমূল্য (অপর রত্নের মূল্য আছে, পুরুষত্বের মূল্য নেই)। ২২।
মর্মার্থ : রত্ন বণিকগণ সকল প্রকার রত্নের মূল্য অবধারণ করে থাকেন, পুরুষরত্নের মূল্য নির্ধারণ কেউ করতে পারে না। নীতিনিপুণ অশেষ প্রতিভাসম্পন্ন মহামতি বিজ্ঞানবিৎ পুরুষের মূল্য অবধারণ করা যায় না। পুরুষকে এ স্থলে কার্যকারিতার বিচারে রত্নের সঙ্গে তুলিত করে, রত্নের সঙ্গে অভেদ কল্পনা করা হয়েছে। এখানে বক্তব্য হলো যে, প্রকৃত পুরুষকারসম্পন্ন পুরুষরূপ যত্ন জগতে অত্যন্ত আদরণীয় তা সেরূপ পুরুষের মূল্যায়ন করা বণিকগুণসম্পন্ন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদৃশ পুরুষ দ্বারা অলৌকিক বহু কার্য সম্পাদন হতে পারে। ২২।
অনুবাদ : স্ত্রীর তুল্য অন্য কোনো রত্ন নেই। ২৩।
মমার্থ : বিভিন্ন জাতিতে যে যে শ্রেষ্ঠ, তাকে রত্ন বলা যায়, কিংবা স্বজাতি শ্রেষ্ঠত্ব রত্ন। সকল রত্নের মধ্যে স্ত্রীরই শ্রেষ্ঠ, তার সঙ্গে কোনো রত্নের তুলনা হয় না। বিষ্ণু পুরাণ মতে সজীব রত্ন সাত প্রকার, প্রাণহীণ রত্ন সাত প্রকার। যথা চক্র, রথ, মণি, খড়গ, চর্ম, কেতু, নিধি (এরা) নির্জীব রত্ন। ভার্যা, পুরোহিত; সেনাপতি, রথকার, পতি, অশ্ব, কলভ (২) এরা সজীব রত্ন। ২৩।
অনুবাদ : জগতে রত্ন অতি দুর্লভ। ২৪।
মর্মার্থ : ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে যে যে শ্রেষ্ঠ, তাকে রত্নসংজ্ঞায় অভিহিত করা হয়; যেমন রমণীরত্ন, পুরুষরত্ন, বিদ্যারত্ন, গজরত্ন প্রভৃতি। জগতে রত্ন অতি বিরল। সূর্যকান্ত, চন্দ্রকান্ত, নীলকান্ত, পদ্মরাগ, মরকতমণি প্রভৃতি দুর্লভ। এই রত্নবিবরণ, পরীক্ষা, গুণাদি শ্রীভোজরাজকৃত-যুক্তিকল্পতরু এবং গরুড় পুরাণে বিস্তৃতভাবে বর্ণিত আছে। সুতরাং এখানে বক্তব্য হলো যে, যেগুলো শ্রেষ্ঠ সেগুলো জগতে অল্প পরিমাণেই থাকে। শ্রেষ্ঠবস্তু কখনো সুলভ হয় না। ২৪।
অনুবাদ : সকল ভয়ের মধ্যে অপশের ভয় বিশেষ। ২৫।
মর্মার্থ : লোকের কার্যক্ষেত্রে নানা প্রকার ভয় আছে, তার মধ্যে অযশ বা দুর্নাম বিশেষ ভয়জনক। অপযশ লোককে ম্লানমুখ, অবসন্ন এবং ভীত করে। সময়ে অপদস্থ ও অবিশ্বস্ত হতে হয়। কর্মক্ষেত্রে অপযশের হাত থেকে অব্যাহিত লাভ করা কঠিন। বিখ্যাতজনের অপযশ মৃত্যুতুল্য হয়ে থাকে। তাই প্রতিটি মানুষের কর্তব্য-কর্মক্ষেত্রে এমনভাবে কর্ম সম্পাদন করতে হবে, যাতে কখনো লোকনিন্দা বা অপযশ না জন্মায়। যেমন মৃত মানুষকেও অমর করে, সেরূপ অপযশ জীবিতকে মৃত করে। ২৫।
নাস্ত্যলসস্য শাস্রাধিগমঃ ॥ ২৬
ন স্ত্রৈণস্য স্বর্গাবাপ্তিলম্বকৃত্যঞ্চ ॥ ২৭ ॥
স্ত্রিয়োহপি ণৈমবমন্যন্তে ॥ ২৮০
পুষ্প্যর্থিনঃ সিঞ্চন্তি অদ্ভিঃ পুষ্পতরম ॥ ২৯
অনুবাদ : অলস ব্যক্তির শাস্ত্রাৰ্থ জ্ঞান জন্মে না। ২৬।
মর্মার্থ : আলস্য শরীর ও ইন্দ্রিয়ের গুরুত্ব বোধ, এই দুই-এর অবসাদ উৎপন্ন হলে সকল কার্যে নিরুৎসাহ জন্মে। কার্যক্ষমতা হেতু তার কোনো বিষয়ে উন্নতির ও গৌরবের সম্ভাবনা থাকে না। কবি বলেছেন, মানবের আলস্য হতে বুদ্ধিমন্দতা, কার্যহীনতা, অবনতি, গৌরবনাশ প্রভৃতি ঘটে থাকে। অতএব উন্নতিকামী পুরুষ আলস্য পরিহার করবে। উদ্যমীকে যেমন লক্ষ্মী স্বয়ং আশ্রয় করে, সেরূপ উদ্যমহীন ব্যক্তিকে লক্ষ্মী স্বতঃই পরিত্যাগ করে। ২৬।
অনুবাদ : শ্রীতে অত্যাসক্ত জনের ধর্মকার্য ও স্বর্গলাভ হয় না। ২৭।
মর্মার্থ : অতিশয় ইন্দ্রিয়াসক্ত ব্যক্তির কামেচ্ছা ও আহারেচ্ছা বর্ধিত হয়। অতিমাত্রায় কাম চরিতার্থ করলে, দেহের প্রধান শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে শরীরকে কার্যক্ষম ও ধর্ম প্রবৃত্তি শূন্য করে ফেলে। অধিক পরিমাণে স্ত্রী সেবা করলে দেহ নানা কঠিন রোগের আকর হয় এবং দৌর্বল্য নিবন্ধন ঈশ্বরাধনার অভাবে স্বর্গলাভ হয় না। মানুষে অন্তর ষড়রিপুর মধ্যে কাম প্রথম ও প্রধান রিপু। তাই অভ্যুদয়কামী ও পরমার্থাভিলাষী মানুষের কামকে জয় করা একান্ত কর্তব্য। ২৭।
অনুবাদ : স্ত্রীগণও অতিশয় স্ত্রীপরায়ণ ব্যক্তিকে অবজ্ঞা করে। ২৮।
মর্মার্থ : স্ত্রৈণ ব্যক্তিকে দুর্বিনীত ও হীনশক্তি বলে স্ত্রী লোকেরাও অবজ্ঞা করে থাকে। ইল্লিয়াসক্ত করে কামুকতা বৃদ্ধি পেয়ে পুরুষকে শ্রীপরায়ণ করে, তার ফলে অকর্মণ্যতা নিবন্ধন সকল বিষয়ে অবজ্ঞাত হয়। ন স্ত্রী সেবা বিদন্ধৈ-কর্মনিপুণ দূরদর্শী ব্যক্তি অতিমাত্রায় স্ত্রীসেবা করবে না। ২৮।
অনুবাদ : পুস্পকামীগণ, জল দ্বারা পুষ্পতরুমূল সেচন করে থাকে। ২৯।
মর্মার্থ : যার যার দ্বারা (সে দ্রব্যের) প্রয়োজন সিদ্ধি হবে, সে সেই কার্যসিদ্ধির অনুকূল দ্রব্য সংগ্রহ করতে প্রবৃত্ত হয়। যেমন পুষ্পকামী ব্যক্তির পুষ্পিত তরুমূল সেচন করে। অপর যেকোনো জিনিস সেচন করলেই পুষ্পলাভের সম্ভাবনা থাকে না। যেমন ধেনুর সেবা করলে উপযুক্তকালে দুগ্ধ পাওয়া যায়, কিন্তু বৃষের সেবায় নয়। অতএব যে কাৰ্য্য সাধনের যা যোগ্যসামগ্রী, তাই গ্রহণীয়। ২৯।
অদ্রব্য-প্রযত্নো বালুকাপীড়নাদনন্যঃ ॥ ৩০ ॥
ন মহাজন-হাসঃ কর্তব্যঃ ॥ ৩১
ন নৰ্ম্মপরীহাস কর্তব্যঃ ॥ ৩২ ॥
কাৰ্য্য-সম্পদং নিমিত্তানি সুচয়ন্তি ॥ ৩৩ ॥
অনুবাদ : অযোগ্য দ্রব্য যত্ন করা কেবল বালুকা কণ্ডন মাত্র। ৩০।
মর্মার্থ : যার যা যোগ্য, তন্মিমিত্ত সেই উপযুক্ত দ্রব্যেরই অনুষ্ঠান করবে। যার যা অযোগ্য, তার প্রতি বিশেষ চেষ্টা ও উদ্যম করা কেবল বালুকা কণ্ডনের তুল্য, অর্থাৎ অনর্থক। যেমন ভণ্ডলাদি হাজার তৃষ ঘাটলেও চাল পাবে না। অযোগ্যের সেবা, বৃথা পরিশ্রম। মূল বক্তব্য হলো যে, যে কার্যের জন্য যা করা উচিত, তা না করে অন্য কিছু শত সহস্র করলেও আসল কার্যটি কোনোরূপেই সম্পন্ন হবে না। তাই প্রথমেই কার্যকারণ বিবেচ্য। ৩০।
অনুবাদ : মহাজনকে উপহাস করবে না। ৩১।
মর্মার্থ : যা শিক্ষার ও জীবন পথে চলার আদর্শ, তার প্রতি উপহাস করা অনুচিত। তাতে নিজের লঘুতা প্রকাশ পায়। নানাগুণমণ্ডিত গরিষ্ঠজনের সম্মান করলে সমাজে লোকের প্রবৃত্তি উচ্চতার প্রতি ধাবিত হয়। গুণের সমাদরই সামাজিক উন্নতির সোপান। মহাজন যে পথে গমন করে, সে পথই সকলের অনুসরণীয়। সুতরাং জ্ঞানে, গুণে, আচরণে যারা মহাজন নামে চিহ্নিত হয়েছেন, তাদের উপহাস করা নয়, অনুসরণ করা উচিত। ৩১।
অনুবাদ : মহাজনের প্রতি অবহেলা ও উপহাস করবে না। ৩২।
মর্মার্থ : প্রাজ্ঞ সজ্জনের প্রতি অবহেলা, ছলনা ও উপহাস করবে না। কারও কারও মতে শিক্ষিত বহুজনই মহাজন নামে প্রসিদ্ধ। প্রাচীন মতে, শিষ্টাচার-বিদ্যা ধর্ম প্রতিভা শক্তিমান ব্যক্তিই মহাজন নামে অভিহিত, এতাদৃশ ব্যক্তির প্রতি তুচ্ছতা ও পরিহাস করলে ন্যায়ের মর্যাদা থাকে না। পূর্বের সূত্রেই এ সম্পর্কে বলা হয়েছে। সেই কথাকে বোধ হয় বিশেষভাবে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই আবার উল্লেখ করা হচ্ছে যে, নিজেকে অভ্যুদয়ের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে পথনির্দেশের প্রয়োজন। সেই পথ নির্দেশ পাওয়ার জন্যই মহাজনকে অনুসরণ করা কর্তব্য। অতএব মহাজনকে অনুসরণের পরিবর্তে উপহাস অবজ্ঞা করলে মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। ৩২।
অনুবাদ : নিমিত্ত সকল কার্য সম্পদের সূচনা করে থাকে। ৩৩।
মর্মার্থ : নিমিত্ত (শুভাশুভ লক্ষণ) সমূহ কার্য সম্পদের জ্ঞাপন করে। কোনো কার্য আরম্ভ করার পূর্বে তার নিমিত্ত অর্থাৎ লক্ষণ প্রকাশ পায়। তার দ্বারা ভাবী কার্যের শুভাশুভ অনুমিত হয়। জ্যোতিষশাস্ত্রের অন্তর্গত শাকুন গ্রন্থে এই শুভলক্ষণ ও অশুভলক্ষণ নিরূপিত আছে। এতে রিষ্ট, নিমিত্ত, শাকুন দুর্লক্ষণ প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। সূক্ষ্মদশি ও পরিণামবিৎ ব্যক্তি কোনো বিশেষ কার্যে শুভাশুভ দর্শন করতে পারে। গীতায় অর্জন বলেছেন; আমি যুদ্ধের পূর্বে বিপরীত নিমিত্ত (অশুভ লক্ষণ) সকল দেখছি। ৩৭।
নক্ষত্রাদি নিমিত্তানি বিশেষয়ন্তি ॥ ৩৪ ॥
ন ত্বরিতস্য নক্ষত্র-পরীক্ষা ॥ ৩৫
পরিচয়ে দোষা ন ছাদ্যন্তে ॥ ৩৬।
স্বয়মশুদ্ধঃ পরানাশঙ্কতে ॥ ৩৭ ॥
অনুবাদ : গ্রহ, নক্ষত্র প্রভৃতির অস্বাভাবিক অবস্থা দর্শন দ্বারা অশুভ নিমিত্ত সকল বিশেষ ভাব জ্ঞাপন করে। ৩৪।
মর্মার্থ : আকাশে যখন নক্ষত্রপাত, ধূমকেতুগম গ্রহের অতিচার প্রভৃতি হয়, তার দ্বারা নানা প্রকার রিষ্ট সূচিত হয়। সেই নানা প্রকার উৎপাত দ্বারা লোকের রোগ, শোক, দুর্ভিক্ষ মারীভর প্রভৃতি দেখা দেয়। মৎস্য পুরাণ, ছন্দোগ পরিশিষ্ট, কৃত্য চিন্তামণি প্রভৃতি গ্রন্থে উক্ত নিমিত্তের শাস্তি উল্লিখিত আছে। সুনির্মল জলপান, স্নান, পুতভোজন, সংযম, গৃহ, পল্লী, গ্রাম পরিস্কৃতভাবে রাখলে উপসর্গজনিত উৎপাতের নিবৃত্তি হয়। ৩৪।
অনুবাদ : চঞ্চল বৃদ্ধির দ্বারা গ্রহ-নক্ষত্রাদির পরীক্ষা হতে পারে না। ৩৫।
মর্মার্থ : গ্রহ ও নক্ষত্রসমূহের গতি জানতে হলে জ্যোতিষ শাস্ত্রীয় সূক্ষ্মগণিত ও সূর্য সিদ্ধান্ত আর্য সিদ্ধান্ত প্রভৃতি গ্রন্থ সকল উত্তমরূপে জ্ঞাত হয়ে পরে, মানযন্ত্রের সাহায্যে স্থির বুদ্ধিতে নির্ণয় করতে হয়। সাধারণ জ্ঞান ও অস্থির বুদ্ধি দ্বারা তা পারা যায় না। ধ্রুব প্রোত ও চিত্রানক্ষত্রের অবস্থিতিকাল জ্ঞাত হতে হলে সূক্ষ্মগণিত এবং জ্যোতিষের সিদ্ধান্তে প্রগাঢ় জ্ঞান আবশ্যক। তাদৃশ শাস্ত্রদক্ষ, গণিতজ্ঞ ব্যক্তিই ভ পঞ্জরের পরীক্ষক হতে পারে। মূলকথা জ্যোতিষ শাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র প্রভৃতি জটিল শাস্ত্রগুলোর জ্ঞান আহরণ করতে হলে বিশেষ অধ্যবসায়ী হতে হবে। ৩৫।
অনুবাদ : কারও পরিচয় হলে তার দোষ আবৃত থাকে না। ৩৬।
মর্মার্থ : কোনো দ্রব্যের বা লোকের পরিচয় বিশেষভাবে জানা হলে তার আর কোনো দোষ ঢাকা থাকে না। দোষ ঢেকে ভাষার কৌশলে গুণের পরিচয় প্রদান করলে উত্তমরূপে পরিচয় হয় না। যাতে বিশেষ জ্ঞান জন্মে সেখানেই পদার্থের সম্যক পরিচয় লাভ হয়। সুতরাং ব্যক্তি বস্তু যাই হোক না কেন, তার স্বরূপটি বিশেষভাবে জানার প্রয়োজন। স্বরূপ জানতে পারলে তার দ্বারা প্রতারিত, যা বিভ্রান্ত হতে হয় না। ৩৬।
অনুবাদ : স্বয়ং অশুদ্ধ হেতু অন্যকেও অশুদ্ধ বলে আশক্ষা করে। ৩৭।
মর্মার্থ : অনেকের এরূপ স্বভাব যে, নিজের দোষ অপরিহার্য হলে সে অন্যকেও দোষযুক্ত বলে মনে করে। তা না করলে নিজের সঙ্গে সমতাসাধন করা হয় না, স্বয়ং দুষ্ট ও অন্য নির্দোষ হয়, অন্যের দোষ না থাকলেও দোষের আরোপ করে সমতা করা প্রয়োজন। ৩৭।
স্বভাবো দুরতিক্রমঃ ॥ ৩৮ ॥
অপরাধনুরূপো দন্ডঃ ॥ ৩৯ ॥
কথানুরূপং প্রতিবচনম্ ॥ ৪০ ॥
বিভবানুরূপমাভরণম্ ॥ ৪১ ॥
অনুবাদ : পদার্থ স্বীয় স্বভাব কখনো অতিক্রম করে না। ৩৮।
মর্মার্থ : যার যা স্বভাব, সে তা ছেড়ে থাকতে পারে না, এই বিষয়ে ভাস্করাচার্য বলেছেন, যেরুপ সূর্যের ও অগ্নির উত্তাপ, চন্দ্রালোকেও আকাশে প্রকাশ ও অবকাশ, পাষাণে কাঠিন্য বায়ুতে গতি, তদ্রুপ পৃথিবী অচল স্বভাব যে, তা বস্তুর স্বাভাবিক শক্তিরই বিচিত্রতা’। পদার্থ স্বীয় স্বভাব ত্যাগ করলে তার আর অস্তিত্ব থাকে না। যেখানে স্বভাবের বিপর্যয় দেখা যায়, সেখানে তা বস্তুর সংযোগে হয়। কিংবা নৈমিত্তিকভাবে সংঘটিত হতে পারে। এখানে মূল বক্তব্য হলো, মানুষ যেন তার সমানুমোদিত স্বভাবগুলো কখনো অতিক্রম না করে। ৩৮।
অনুবাদ : যার যেরূপ অপরাধ তদনুসারে দণ্ড প্রযোজ্য। ৩৯।
মর্মার্থ : চৌর্য, বলপ্রয়োগ, বলাকার, প্রতারণা, সমীহরণ, দস্যুতা, জীবননাশ প্রভৃতি অপরাধে যার যে পরিমাণ অপরাধ, তার তদ্রুপ দণ্ড বিহিত হওয়া একান্ত উচিত। অদণ্ড্যের দণ্ড দণ্ডাহের অদণ্ড, গুরু অপরাধে লঘু দণ্ড এবং কোনোরূপ অপরাধে দণ্ড না হওয়া–এর কোনটি সমাজের হিতকর নয়। যথাযোগ্য দণ্ডই সমাজের কল্যাণকর। সর্বদা দণ্ডের অভাবে মাস্যন্যায় দ্বারা সমাজ বিধ্বস্ত হয়। এখানে আবার সমাজ বিষয়ে রাজার ধর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে। যথাযথ দণ্ড প্রণয়ন করতে রাজা অসমর্থ হলে সমাজে তার কুফল প্রতিফলিত হয়। ৩৯।
অনুবাদ : কথার অনুরূপ প্রতিবচন হওয়া উচিত। ৪০।
মর্মার্থ : যার যেরূপ প্রশ্ন বা বাক্য হবে, তার প্রতি তদ্রুপ বাক্যানুসারে প্রতিবচন বা উত্তর চাই। এরূপ বাক্যের অন্যরূপ উত্তর হলে তাতে অর্থজ্ঞান হয় না। এবং বিবাদ ও বিতণ্ডা উপস্থিত হয়। যথার্থ বাক্যের প্রকৃত উত্তর হলে কোনোরুপ সন্দেহ ও বিবাদের শঙ্কা থাকে না। এইরূপ প্রশ্ন ও প্রতিবচন বিচারালয়েও হওয়া চাই, তা না হলে উত্তর দাতা শঠ বা দণ্ডাহ হবে। সামাজিক বিষয় হলে তাতে অসত্যের আরোপ হয়। অতএব বাক্যানুরূপ উত্তর বিধেয়। ৪০।
অনুবাদ : ধনের অনুরূপ অলঙ্কার হওয়া উচিত। ৪১।
মর্মার্থ : ধার যেরূপ ধন বা ঐশ্বর্য তার তদ্রুপ ভূষণ, যন্ত্রাদি হওয়া ভালো। ধনের পরিমাণ হতে অধিক আভরণ হলে তাতে সময়ে অর্থের অভাব ঘটে। প্রচুর ধন থাকতে অলঙ্কারের অভাব হলে তা গৌরবহানিকর হয়, তার দ্বারা সমাজে হাস্যাস্পদ হতে হয়। অতএব ধনের অবস্থানুসারে আঙ্কারাদি হওয়া যুক্তিযুক্ত। অর্থাৎ মানুষের সাধ্য অনুসারে ও যোগ্যতা অনুসারে চলা উচিত। না হলে অপরের আড়ম্বর দেখে নিজের যোগ্যতাতিরিক্ত পথে পা দিলে অবশ্যই পতিত ও ব্যর্থ হবেই। ৪১।
কুলানুরূপংবৃত্তম্ ॥ ৪২ ॥
কাৰ্যানুরূপ প্রযত্নঃ ॥ ৪৩
পাত্রানুরূপং দানম্ ॥ ৪৪
বয়োছনুরূপো বেশঃ ॥ ৪৫।
অনুবাদ : কুলের অনুরূপ চরিত্র (ব্যবহার) হয়ে থাকে। ৪২।
মমার্থ : যার বংশ মর্যাদা যেরূপ তার আচরণ, শীলতা, কার্য প্রভৃতি সেরূপ হয়। প্রশস্ত বংশজাত ব্যক্তির গুণাবলি ও কার্য, গৌরবকর ও হিতকর হয়। হীন কুলোম্ভব ব্যক্তির কার্যসমূহ নীচভাব প্রকাশ করে, তাতে উচ্চতা প্রায়ই ব্যক্ত হয় না। অতএব আভিজাত্য হিসেবেও লোকের শ্রেষ্ঠত্ব এবং লঘুতা ব্যক্ত হয়ে পড়ে। আবার পক্ষান্তরে লোকের ব্যবহার দ্বারা কুল মর্যাদা অনুমান করা যায়। ৪২।
অনুবাদ : কার্যের তুল্য তার প্রযত্ন করা বিধেয়। ৪৩।
মর্মার্থ : যে কার্যের যেরূপ সামগ্রী সাধন করা হয়, তদ্রূপ কার্যের প্রতি বিশেষ চেষ্টাও হয়। প্রকৃষ্টরূপে যত্ন দ্বারা সম্পূর্ণরূপে কার্য সিদ্ধ হয়। কার্যের প্রতিকূল সামগ্রী ও বিরুদ্ধ চেষ্টা কার্য সাধিত হয় না, তাতেই সূত্রে উক্ত হয়েছে যে, কার্যের উপযুক্ত চেষ্টা হওয়া প্রয়োজন। পূর্বে ২৯ ও ৩০ সূত্র প্রায় এ সম্পর্কে বলা হয়েছে। পুনরায় এখানে আরও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, কার্যের গুরুত্ব বিচার করে যত্নশীল হওয়া উচিত। ৪৩।
অনুদান : দান পাত্রের অনুরূপ হওয়া উচিত। ৪৪।
মমার্থ : দান, দেশ, কাল, পাত্রভেদে করা উচিত। অসময়ে অপাত্রে এবং অবস্থানে দানের কোনো ফল হয় না। দান দ্বারা সহজ উপায়ে লোক সমাজের হিত সাধন হয়। দান ভিন্ন বিদ্যা, শিল্প, ধর্মের উন্নতি হয় না। দান ভিন্ন–পঙ্গু, অন্ধ, অনাথ, দরিদ্র, নিরুপায়ের উপায়ন্তর নেই। দান দ্বারা পরোপকারে যেমন সাধিত হয়, তেমন অপার কীতি ও ধর্ম সঞ্চয় হয়। অপাত্রে দান দ্বারা বিপরীত ফল হয়। অতএব দান করার মুহূর্তে যাকে দান করা হবে, তার গুণ যোগ্যতা সম্পর্কে বিচার করা উচিত। অন্যথায় দানের ফল দেখতে পাওয়া যাবে না। ৪৪।
অনুবাদ : বয়সের অনুরূপ বেশ ধারণ করবে। ৪৫।
মর্মার্থ : বাল্য, যৌবনে, বার্ধক্য প্রভৃতি শারীরিক অবস্থানুসারে পরিচ্ছদ ও অলঙ্কার প্রভৃতি ধারণ করা উচিত। বালকের পক্ষে বৃদ্ধের পরিচ্ছদ, বৃদ্ধের পক্ষে বালকের বেশভূষা ধারণ করা সুশোভন নয়। তাতে শোভা বৃদ্ধি না হয়ে সুষমার বিপর্যয় হয়। বেশ, ভূষণ দ্বারা শারীরিক শোভা ও শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। অন্যথায় সমাজে উপহাসাস্পদ হতে হয়। তাই প্রবাদ আছে-বন্যরা বনে সুন্দর, শিশু মাত্রক্রোড়ে। তাই সুন্দর স্থান ও পরিস্থিতি অনুসারে সুন্দর হয়। ৪৫।
স্বাম্যনুকূলো ভূত্যঃ ॥ ৪৬
ভর্তৃ-বশবর্তিনা ভাৰ্য্যঃ ॥ ৪৭ ॥
গুরু-বশানুবর্তী শিষ্যাঃ ॥ ৪৮ ॥
পিতৃ-বশানুবর্তী পুত্রঃ ॥ ৪৯ ॥
অনুবাদ : ভুত্য, প্রভুর বশগামী হয়ে চলবে। ৬।
মর্মার্থ : যার অধীন হয়ে বহুকার্য করতে হয়, কখনো তার প্রতিকূল চলবে না। বিরুদ্ধভাবে চললে অধিপতির নিকটে কার্যের আশা করা বৃথা। প্রভু ও ভৃত্যের মধ্যে নিযোজ্য, নিয়োজকভাবে সকল সময়ে থাকা উচিত। স্বামীর আদেশ অনুসারে ভৃত্য ও অনুগত লোক কার্য নির্বাহ করবে। এভাবে উভয়ের কার্যের সৌকর্য থাকা উচিত। ৪৬।
অনুবাদ : ভার্যা, স্বামীর বশীভূত হবে। ৪৭।
মমার্থ : ভর্তা, স্বামী, পতি–একার্থবোধক শব্দ। পত্নী নিত্যই ভর্তার বশানুগ হয়ে চলবে। তদ্ভিন্ন গৃহস্থের গৃহস্থলীর কার্য শৃঙ্খলা, শান্তি, নীতি, ধর্ম স্থির থাকতে পারে না। স্ত্রীলোকের পাব্ৰিত্যই জীবনের প্রধান লক্ষ্য, এই মহব্রত সাধনের জন্যই পতিপরায়ণা হয়ে থাকতে হয়। পতিও তদ্রুপ পত্নীপরায়ণ না হলে মনুষ্যত্বের অপচয় হয়। নীতিশাস্ত্রে মানুষের ষড়বিধ সুখের মধ্যে বলা হয়েছে ‘প্রিয়া চ ভার্যা প্রিয়বাদিনী চ। ৪৭।
অনুবাদ : শিষ্য শুরুর বশীভূত হবে। ৪৮।
মর্মার্থ : অনুশাস্তা, জ্ঞানদাতা শিক্ষকের বশগামী হওয়া শিষ্যের পক্ষে একান্ত বিধেয়। তা না হলে সহজ উপায়ে বিদ্যালাভ করা সুকঠিন। গুরু প্রসন্ন হলে, তদ্বারা অতি কঠিন বিষয় সহজে আয়ত্ত করা যায়। শিষ্য সুশীল, বিনীত, মেধাবী বৃদ্ধিমান হবে। গুরু ও দয়ালু ধর্মজ্ঞ সুপণ্ডিত, প্রতিভাবান হওয়া উচিত। গীতায় যে বলা হয়েছে, শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞান–এই কথার মধ্য দিয়ে ও পরোক্ষভাবে শিষ্যকে গুরু বা শিক্ষকের থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ৪৮।
অনুবাদ : পুত্র, পিতার বশীভূত হবে। ৪৯।
মর্মার্থ : পুত্র পিতার অনুগত হলে পিতা পুত্র দ্বারা বিশেষ সুখী হন। পিতার নিকট নানাবিধ সুশিক্ষা লাভ করে সমাজে লব্ধপ্রতিষ্ঠ ও সুখী হতে সমর্থ। পিতৃধনে পুত্র অধিকারী হয়, অশেষ বিষয়ে পিতার নিকট পুত্র ঋণী। এখানেও লক্ষণীয়, নীতিশাস্ত্রে উল্লেখ আছে, মানুষের ষড়বিধ সুখের মধ্যে আছে ‘বশ্যশ্চ পুত্র। অতএব পিতার বশীভূত হওয়া মানুষের অত্যন্ত সুখের বিষয়। ৪৯।
স্বামিনি কুপিতে স্বামিনমেবানুবৰ্তেত ॥ ৫০ ॥
মাতৃ-তাড়িতো-বালো মাতরমেনুরোদিতি ॥ ৫১ ॥
স্নেহবতঃ স্বল্পোহপিরোষঃ ॥ ৫২ ॥
আত্মচ্ছিদ্রং নপশ্যতি পরিচ্ছদ্রমেব বালিশঃ ॥ ৫৩ ॥
অনুবাদ : স্বামী (প্রভু) ক্রদ্ধ হলে, তার কোপের শান্তির জন্য তারই আশ্রয় গ্রহণ করবে। ৫০।
মর্মার্থ : প্রভু, নায়ক, অধিপতি, স্বামী প্রভৃতি শব্দ একার্থবোধক। স্বামী কোনো কারণে ক্রদ্ধ হলে তার ক্রোধের শাস্তির জন্য অন্যের আশ্রয় গ্রহণ না করে তার সেবা, আনুগত্য বিনয়াদি দ্বারা ক্রোধের উপশম করবে। যেমন যে ভূমিতে লোক পতিত হয়, পুনঃ তাকেই আশ্রয় করে উঠতে হয়। ৫০।
অনুবাদ : মাতা কর্তৃক তাড়িত বালক মাতাকে আশ্রয় করে রোদন করে। ৫১।
মর্মার্থ : মানবের বা চির আশ্রয়ের বিষয় তার থেকে কষ্ট পেলেও তাকে ত্যাগ করবে না। যেমন স্বাভাবিক তিক্ত পিত্ত, তার উপশম তিক্ত সেবনেই হয়। সেরূপ সুখ দুঃখের পরম আশ্রয় রক্ষাকারিণী জননী যদি বালককে তাড়না করে, তাতে জননীকে আশ্রয় করেই শিশু রোদন করে থাকে। সুতরাং এই সূত্রটির গূঢ় অর্থ হলো, মানুষ যেভাবেই তাড়িত হয়ে যতই ধাবিত হোক, মূলত অবশেষে নিজের আশ্রয়কে অবলম্বন করতেই হবে। ৫১।
অনুবাদ : স্নেহশীল ব্যক্তির ক্রোধ ক্ষয়স্থায়ী, অহিতকর নয়। ৫২।
মর্মার্থ : স্নেহবান ব্যক্তি কোনো সময়ে রাগ প্রকাশ করলেও তা পরিমাণে অল্প হয়, তাদৃশ ক্রোধ দ্বারা কোনোরূপ অহিত হয় না। সুশিক্ষিত সজ্জত এবং মহাজনের কোপের দ্বারা জনসাধারণের অনিষ্ট হয় না। তাদের প্রসাদ অপেক্ষা ক্রোধ সামান্য। বিশেষ করে পিতা, মাতা, গুরুজন প্রকৃতি স্নেহশীলেরা যে কোপ প্রকাশ করেন, তা সন্তানদের কল্যাণ সাধনার কামনাতেই। তাই তাদের ক্রোধ তো অহিতকর নয়ই বরং হিতকর। ৫২।
অনুবাদ : মূর্খ ব্যক্তি, স্বীয় দোষ দেখতে পায় না, অন্যের দোষ অবলোকন করে। ৫৩।
মর্মার্থ : দোষগুণ বিচার করার শক্তি অজ্ঞ লোকের থাকে না, সেহেতু মূর্খ লোক নিজ দোষ গোপন করে অন্যের দোষই সর্বত্র প্রকাশ করে। তাতে স্বীয় দোষক্রমে বর্ধিত হয়ে অনিষ্ট সাধন করে ও মূর্খতা বৃদ্ধি পায়। তাদৃশ ব্যক্তি অবিশ্বাসের পাত্র। তাই মানুষ মাত্রই অপরের দোষ সন্ধান করা অপেক্ষা নিজের দোষ সন্ধান করা উচিত। উপরন্তু অপরের দোষ নির্ণয় থেকে দূরে থাকলে নিজেই মানুষের কাছে বুদ্ধিমান বলে পরিচিত হবে। ৫৩।
সোপচারঃ কৈতবঃ ॥ ৫৪ ॥
কাম্যৈর্বিশেষৈ রূপচরণমুপচারঃ ॥ ৫৫ ॥
অত্যুপচারঃ শঙ্কিত্তব্যঃ ॥ ৫৬ ॥
চির-পরিচিতানাং ত্যাগোদুষ্কর: ॥ ৫৭ ॥
স্বঃ সহস্রদদ্য কাকিনী শ্রেয়সী ॥ ৫৮ ॥
অনুবাদ : লোকের ধূর্ততা উপচার যুক্ত হয়। ৫৪।
মর্মার্থ : লোকের শঠতা নানা প্রকার কমনীয় উপচার দ্বারা শোভিত হয়। কপট ব্যক্তি আপাতমধুর বাক্য ও রমণীয় দ্রব্য দ্বারা লোককে মুগ্ধ করার নিমিত্ত যে সেবা করে, তাই উপচার নামে খ্যাত। ধূর্ত ঐভাবেই কার্য সাধনে সমর্থ। তার চাতুর্যও অসীম। ৫৪।
অনুবাদ : কাম্য বস্তু বিশেষের দ্বারা সেবার নাম উপচার।
মর্মার্থ : লোকে যে কাম্য বস্তু দ্বারা অপরের সেবা করে, সেই কাম্য বস্তু বিশেষকেই বলা হয় উপচার। উপচারকে আরও অন্যভাবে দেখানো যায়। যেমন উপচার, পূজার দ্রব্য, উপহার, কার্যোপকরণ, উৎকোচ এই সকল শব্দ একার্থবাচক। ব্যবহার ক্ষেত্রে তার পরিমাণ অধিক হলে মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়। কার্য সাধনের জন্য অনেক স্থলে প্রচুর উপচার সংগ্রহের প্রয়োজন। ৫৫।
অনুবাদ : শঠ ব্যক্তির প্রচুর উপচার আশঙ্কার আকর। ৫৬।
মর্মার্থ : ধূর্তের চাতুর্য ও ছলনার অভাব থাকে না। তার কার্য সাধন উপচার প্রচুর মাত্রায় থাকলে তা সুন্দর আস্পদ হবে। চিরপরিচিত লোকের ও প্রভূত উপচার মনে সন্দেহ উদ্রেকের হেতু। শঠ ব্যক্তির শঠতা সম্পাদনের জন্যই সমস্ত উপচার ব্যয়িত হয় বলেই তাদের উপচার আকাক্ষাজনক হয়। ৫৬।
অনুবাদ : দীর্ঘকালের পরিচিত ব্যক্তির কোনো বিষয় ত্যাগ করা দুর্ঘট। ৫৭।
মর্মার্থ : চিরপরিচিত বন্ধু, আত্মীয়, উপকারী ব্যক্তির উপচার, অনুরোধ, প্রার্থনা প্রভৃতি ত্যাগ করা অতি দুষ্কর। তাদৃশ স্থানে অনুরোধ প্রভৃতিতে লোককে বিষম সমস্যায় পড়তে হয়। সে সময় সুচিন্তা ও বিবেক পূর্বক কার্য করা উচিত। ৫৭।
অনুবাদ : পরদিবসে এক হাজার (কড়ি) লাভের আশা অপেক্ষা আজ এক কাকিনী (কুড়িটি কড়ি)-ও শ্রেয়। (২) হাজারটি দুষ্ট ঘোড়া হতে একটি গাভী শ্রেষ্ঠ। (৩) একটি দুষ্ট গাভী হাজারটি কুকুর হতেও প্রধান। ৫৮।
মর্মার্থ : আশ্রিত কিংবা পালিত দুষ্টবহু পশ্বাদি হতে শিষ্ট একটি পশুও শ্রেষ্ঠ, বহুদৃষ্ট গাভী, অশ্ব প্রভৃতি দ্বারা বহু ক্ষতির সম্ভাবনা; সুতরাং একজন শিষ্ট দ্বারা যে উপকার হয়, হাজার দুষ্ট দ্বারা তা হয় না। অথবা অদ্য দশটি কড়ি হস্তগত হওয়া না অপেক্ষা পরদিন এক হাজারের আশা করা বৃথা; যেহেতু তা এখনও করায়ত্ত হয়নি, না হতেও পারে। সকল বিষয়েই এভাবে বিচার করতে হয়। ৫৮।
শ্বো ময়ুরাদদ্য কপোতত বরঃ ॥ ৫৯
অতিসঙ্গে দোষমূৎপাদয়তি ॥ ৬০ ॥
সৰ্ব্বং জয়তি আক্রোধঃ ॥ ৬১ ॥
মতিমুস্তিষ্ঠন জয়তি ॥ ৬২ ॥
অনুবাদ : পরদিন ময়ূরের আশার থেকে আজ কপোতলাভও উত্তম (১) অথবা পরদিবস শ্রেষ্ঠ ময়ূর পাওয়ার আশা করা অপেক্ষা আজ কপোত লাভই ভালো (২) ৫৯।
মর্মার্থ : এই সূত্রটি পূর্বসূত্রের উদাহরণস্বরুপে উক্ত হয়েছে। কার্য বিশেষে ভবিষ্যৎ অধিক লাভের আশা হতে উপস্থিত অল্প লাভও উত্তম। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, কিন্তু উপস্থিত বিষয়ে কোনো ব্যাঘাত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ৫৯।
অনুবাদ : বহু লোকের সঙ্গে মিলিত হলে দোষ জন্মে। ৬০।
মর্মার্থ : সংসারে উত্তম, মধ্যম ও অধম প্রকৃতিভেদে নানারূপ লোক দেখতে পাওয়া যায়। বিচার না করে সমস্ত লোকের সঙ্গে মিলনে নানা প্রকার দোষ উৎপন্ন হয়ে তার দ্বারা নানাভাবে অনিষ্ট এবং অধঃপতন ঘটতে পারে। অতএব বিচার করে লোকের সঙ্গে মিলিত হবে। কারণ হীন ব্যক্তির সঙ্গে নিরন্তর মেলামেশায় হীনতা সংক্রমিত হয়। তাই বিচার করে দেখতে হয়, কে উত্তম আর কে অধম। কিন্তু মনস্বী ব্যক্তি নানা কার্যানুরোধ বহু লোকের সঙ্গে মিলিত হলে দোষ হয় না। ৬০।
অনুবাদ : ক্রোধহীন মানব সকল বিষয়ে জয়লাভ করে। ৬১।
মর্মার্থ : ক্রোধ মানবের শত্ৰু, ক্রোধ সম্বরণ করতে পারলে সকল বিষয়ে জয়ী হতে পারা যায়। ক্রোধভরে লোক নিজ ও পরের অনিষ্ট সাধন করে, বিবাদ এবং হিংসায় রত হয়ে অপরকে হত্যাও করতে পারে। ক্রোধশূন্য ব্যক্তি অন্যের আক্রোশ ও আক্রমণ থেকে বহু সময় অব্যাহতি পায়। বিশেষ করে ক্রোধের ফলে মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধিও লোপ পায়, আর বুদ্ধিনাশের ফলে ক্রোধী মানুষ কোনো কার্যে সফল হতে পারে না। ৬১।
অনুবাদ : উদ্যোগী পুরুষ কুমতিকে জয় করে। ৬২।
মর্মার্থ : যার উদ্যোগ, উৎসাহ ও সম্ভব আছে, সে কুবুদ্ধিকে জয় করতে পারে। অথবা কর্মঠ, উদ্যোগসম্পন্ন নিপুণ ব্যক্তি অপরের বুদ্ধিকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়। ক্রোধের উপশমে সম্পূর্ণরূপে বুদ্ধির বিকাশ হয়ে থাকে। তার ফলে কোনো দুষ্ট চিন্তা তার মনের মধ্যে স্থান পায় না। ৬২।
যদ্যপকারিণি কোপঃ কোপে কোপএব কর্তব্যঃ ॥ ৬৩ ॥
মতিমৎসু মূর্খ মিত্রগুরুবল্লভেষু বিবাদোন কর্তব্যঃ ॥ ৬৪ ॥
নাস্ত্যপিশাচমৈশ্বর্যম্ ॥ ৬৫ ॥
নাস্তি ধনবতাং কৰ্ম্মসু শ্ৰমঃ ॥ ৬৬ ॥
অনুবাদ : যদি অপকারী ব্যক্তির কোপ দেখা যায়, তবে তার প্রতি কোপ প্রকাশ করা উচিত। ৬৩।
মমার্থ : অনিষ্টচরণশীল পুরুষের ক্রোধ দেখতে পেলে তার প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করা উচিত। ক্রোধ অপেক্ষা অধিকভাবে আঘাত প্রভৃতির চেষ্টা করা অন্যায়। তাতে পরস্পরের সমতা থাকে না। লঘু অপরাধে গুরুদণ্ড হয়। নীতিশাস্ত্রে উক্ত আছে- উপকারী ব্যক্তির উপকার করবে, হিংস্রের প্রতি হিংসা প্রকাশ করবে। সাধারণত দেখা যায়, অনিষ্টকারীর প্রতি ক্রোধও যদি না হয়, তাহলে সে ভীরু অক্ষম ভেবে অনিষ্ট চরণে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু ক্রোধ দেখলে ভীত হয়ে আর অনিষ্ট করতে সাহস পায় না। ৬৩
অনুবাদ : মহামতি লোকের সঙ্গে এবং মূর্খ, মিত্র, গুরু, অধিপতির সঙ্গে বিবাদ করবে না। ৬৪।
মর্মার্থ : মহাজনের সঙ্গে এবং অজ্ঞ, বন্ধু, গুরু, অধিপতি প্রভৃতির সঙ্গে বিরোধে প্রবৃত্ত হলে মূর্খতা, অর্থনাশ, সভ্যতাহানি, পরাজয় প্রভৃতি অশেষ ক্লেশ ভোগ করতে হয়। এরূপ বিবাদে ক্ষতি ভিন্ন কোনোরূপ লাভের সম্ভাবনা দেখা যায় না। তাই বিবাদে প্রবৃত্ত হওয়ার পূর্বে বিচার করতে হয়, কাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে। বিবাদের মতো পরিস্থিতি সৃষ্ট হলেও প্রতিপক্ষ উক্ত শ্রেণীর ব্যক্তি হলে এড়িয়ে চলতে হয়। ৬৪।
অনুবাদ : ঐশ্বৰ্য্য, পৈশাচিক ভাবশূন্য হয় না। ৬৫।
মর্মার্থ : যেখানে অসীম ধন রত্নাদি বিদ্যমান, সেখানে ঐশ্বর্যের লীলা বিরাজ করে। সেখানে কম, ক্রোধ, দম্ভ, সর্প, বিলাস প্রভৃতি পৈশাচিক ভাব নিত্যই বিরাজ করে। বিপুল ঐশ্বর্যের আকরভূমি তামসিক প্রভাবশূন্য হওয়া দুর্ঘটনা। ঐশ্বৰ্য্য যদি তামসিক প্রভাবশূন্য হয়, তবে তা দিব্য সুখ প্রদান করে। সুতরাং মানুষের ধনমদে মত্ত হওয়া উচিত নয়। ৬৫।
অনুবাদ : ধনিগণের কাৰ্য্য সমূহে কোনো ক্লেশ হয় না। ৬৬।
মর্মার্থ : দরিদ্র বহুকষ্ট করেও কাৰ্য্য সাধন করতে পারে না। ধনিগণ অর্থবলে অনায়াসে বহুঁকাৰ্য্য সম্পাদন করে। বিনা পরিশ্রমে কাৰ্য্য সাধনে ধন একটি প্রধান উপকরণ। কিন্তু সুধীব্যক্তি প্রতিভা ও শ্রম দ্বারা কর্মসম্পাদন করে। তথাপি স্মরণীয় যে, প্রতিভার বিকাশের জন্যও অর্থের সহায়তা প্রয়োজন। যার জন্য কবি বলেছেন, দারিদ্রদোষ্যে গুণরাশিনাশী। ৬৬।
নাস্তি যানবতাং গতিশ্রমঃ ॥ ৬৭ ॥
যস্মিন কৰ্ম্মণি ষঃ কুশলঃ স তস্মিনিযোক্তব্যঃ ॥ ৬৮ ॥
আলোহময়ং নিগলং কলত্রম্ ॥ ৬৯ ॥
দুষ্কলত্রং মনস্বিনাং শরীর কর্যণম্ ॥ ৭০
অনুবাদ : যাদের যান (গাড়ি, ঘোড়া প্রভৃতি) আছে, তাদের গমনে পরিশ্রম নেই। ৬৭।
মর্মার্থ : যান, শকট, বাহনাদি থাকলে পজে গমনের কষ্টভোগ করতে হয় । অর্থ থাকলে ভাড়া দিয়েও যানাদি দ্বারা অনায়াসে গমন করা যায়। পদব্রজে নিয়মিত গমন দ্বারা যেরূপ স্বাস্থ্য ভালো থাকে, সেরূপ যানারোহণ গমনে থাকে না। দ্রুতগামী যান দ্বারা অচিরকাল মধ্যে বহু স্থানে যাওয়া ও অনেক কার্য অল্পকাল মধ্যে সম্পাদন করা যায়। আহারের অব্যবহিত পরে দ্রুতগমন করলে উদরাময় ও স্বাস্থ্যহানি ঘটে। অপরাহ্বে ও প্রাতঃভ্রমণে সুস্থতা বৃদ্ধি পায়। পূর্বের সূত্রের উদাহরণস্বরূপই এই সূত্রটি। অর্থাৎ অর্থ থাকলে যেমন সহজ কার্য সাধন করা যায়, সেইরূপ যান বাহন থাকলে সহজে যাতায়াত করা যায়। ৬৭।
অনুবাদ : যে ব্যক্তি যে কার্যে সুদক্ষ, তাকে সে কার্য নিযুক্ত করবে। ৬৮।
মর্মার্থ : অযোগ্যের কার্যে নিয়োগ, সর্বদা অনুচিত। অস্থানে যোগ্যের নিয়োগ, উপযুক্ত স্থানে অযোগ্যের নিয়োগ, এই উভয়ই অবৈধ, তার দ্বারা-কার্যের ব্যাঘাত ও অবিচার প্রকাশ পায়। অতএব যে যে কার্যে উপযুক্ত, তাকে সে কার্যেই নিযুক্ত করা উচিত। তা বৃহৎ চাণক্যে উক্ত আছে, যোগ্য স্থানেই ভৃত্য ও আভরণের নিয়োগ করবে, অযোগ্য স্থানে নয় ॥ ৬৮ ॥
অনুবাদ : স্ত্রী, মানবের অলোহময় শৃঙ্খল ॥ ৬৯ ॥ ..
মর্মার্থ : শৃঙ্খল বা বন্ধনরঞ্জু নানাবিধ তন্মধ্যে লোহ নির্মিত শৃঙ্খল অতি দৃঢ় ক্রেশদায়ক। মানবের পক্ষে সংসার ক্ষেত্রে স্ত্রী লোহভিন্ন বন্ধনবজু। এই বজ্র সংসারে মানবকে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ করে রাখে। অপর বন্ধনরঙ্কু। অচিরকাল মধ্যে খুলে যায়। বন্ধন পাশ লোহময়ই হোক কিংবা স্বর্ণময়ই হোক, সকল রজ্জ্বরই ক্লেশদায়কতা আছে। সংসারে স্ত্রী-রজু দ্বারা যে আবদ্ধ না হয়, সে বিশেষ সুখী। কুলস্ত্রী, পতিপরায়ণা দ্বারা আবদ্ধ হওয়া গৃহস্থের পক্ষে বিশেষ ক্লেশকর নয়। ৬৯।
অনুবাদ : দুঃশীলা স্ত্রী মনস্বী পুরুষের শরীর কর্ষণ করে থাকে। ৭০।
মর্মার্থ : স্ত্রী পতিপরায়ণা না হলে, সে মনীষী পুরুষেরও শারীরিক হানি করে। তা দ্বারা নিত্য নানরূপ ক্লেশ পেতে হয়। স্বাস্থ্যহানি, বিরোধ, অবিশ্বাস, গৃহকার্যে অশান্তি সংঘটিত হয়। দুশ্চরিত্রা স্ত্রী কালনাগিনীর সঙ্গে তুলিত হয়। তাই পতি ও পত্নীর মধ্যে বহু বিষয়ে সৌসাদৃশ্য এবং ঐক্য থাকা নিতান্ত প্রয়োজন। পতিব্রতা স্ত্রীই গৃহস্থালির শান্তির বিশেষ হেতু। গৃহকর্ম দক্ষতা পতিপরায়ণা স্ত্রী অতি মহনীয়া। ৭০।
অপ্রমত্তোদারা নিরীক্ষেত ॥ ৭১ ॥
স্ত্রিষু কিঞ্চিদপিন বিশ্বসেৎ ॥ ৭২ ॥
ন সমাধিঃ স্ত্রিষু লোকজ্ঞতা চ ॥ ৭৩ ॥
গুরুণাং মাতা গরীয়সী ॥ ৭৪ ॥
অনুবাদ : পুরুষ অতি সাবহিত হয়ে স্ত্রীকে দেখবে। ৭১।
মর্মার্থ : স্ত্রী দর্শন ও পালনকালে অতি প্রণিহিতভাবে পুরুষকে অবস্থান করতে হয়। প্রমত্তভাবে স্ত্রী দর্শন ও রক্ষণ করতে গেলে, প্রতিপদে অশান্তি ও বিপদের আশঙ্কা। প্রদত্ত পুরুষের কামাবেশ ও তার দ্বারা সঙ্কটে পতন নিশ্চিত। সাবহিত ব্যক্তির বিঘ্ন সম্ভাবনা বিরল। একথার মূখ্য অর্থ হলো, যে স্ত্রী চরিত্র অত্যন্ত চঞ্চল, তাই স্ত্রীকে অত্যন্ত সাবধানে রক্ষা করা উচিত। ৭১।
অনুবাদ : স্ত্রীসমূহকে বিশেষ বিশ্বাস করবে না। ৭২।
মমার্থ : স্ত্রী লোকের সারল্য, অদূরদর্শিতা, কোমল ভাব প্রভৃতি নিত্য বিদ্যমানহেতু বিশেষ ও কঠোরকার্যে তাদের বিশ্বাস করা উচিত নয়। কোনো গুরুতর কার্যের ভার বিশ্বাসপূর্বক অর্পণ করলে, সে কার্যে হানি হওয়ার অধিক সম্ভাবনা থাকে। যেমন কোনো বৃহৎ কার্য সম্পাদনে বালককে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা যায় না। স্ত্রীদিগের গোপনীতি বিষয়ে গোপন ধারণ, পোষণ করার শক্তি অতি বিরল। সুতরাং এখানে স্ত্রীকে সব সময় অবিশ্বাস করার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় বিষয়ে স্ত্রীকে নিয়োগ করা উচিত নয়। ৭২।
অনুবাদ : স্ত্রী লোকদিগের সমাধি ও লৌকিক অভিজ্ঞতা নেই। ৭৩।
মর্মার্থ : সমাধি (মনের বিষয় বিশেষে একাগ্রতা) ও লৌকিক বিষয়ে অভিজ্ঞতা পুরুষের ন্যায় স্ত্রী লোকদের মধ্যে দেখা যায় না, কোনো বিষয়ে মনের প্রণিধান করতে হলে, বিত্তের দৃঢ়তা এবং বলের প্রয়োজন হয়, তদ্রুপ লোকতত্ত্বে অভিজ্ঞ হতে হলেও প্রবল শক্তি চাই। কোমলচিত্ত মহিলাকুলের এই দুটির অভাব লক্ষিত হয়। অনেকের মধ্যে কখনো কারও হতেও পারে। তবে স্বভাবসিদ্ধ নয়। এ সূত্রটি পূর্বসূত্রের পরিপূরক। অর্থাৎ, এহেন স্ত্রী জাতির উপর গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত করা সমীচীন নয়। ৭৩।
অনুবাদ : গুরুগণের মধ্যে মাতা শ্রেষ্ঠা ৭৪।
মর্মার্থ : সকল গুরুজনের মধ্যে গর্ভধারণ, পালন, স্তন্যদান, স্নেহ, দয়া, ধর্ম, ত্যাগ, ক্রেশসহনাদি গুণে মাতা শ্রেষ্ঠা। পিতা হতেও গর্ভধারণ, স্তন্যদান গুণে জননী প্রধান। এই বিষয়ে নীতি ও ধর্মশাস্ত্র একমত। এখানে পূর্বোক্ত সূত্রগুলোর একটি বৈকল্পিক সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সমগ্র নারীর মধ্যে মাতার স্থান স্বতন্ত্র। ৭৪।
সর্বাবস্থায়ু মাতা ভর্তব্যা ॥ ৭৫
বৈরুপ্যমলঙ্কারেণচ্ছাদ্যতে ॥ ৭৬ ॥
স্ত্রিণাং ভূষণং লজ্জা ॥ ৭৭ ॥
বিপ্রাণাং ভূষণং বেদঃ ॥ ৭৮ ॥
সর্বেষাং ভূষণং ধর্মঃ ॥ ৭৯ ॥
অনুবাদ : সকল অবস্থায় জননীকে পালন করবে। ৭৫।
মর্মার্থ : শোক, তাপ, সৈন্য, অর্থাভাব, রোগ, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি অবস্থাতে যত্নপূর্বক জননীকে ভরণ-পোষণ, সেবাদি করবে। যেকোনো রূপ বিঘ্ন সঙ্কুল অবস্থাই উপস্থিত হউক না কেন, তাকে পরিহার করবে না। মানবের মাতৃঋণ অপরিশোধ্য। ৭৫।
অনুবাদ : দেহের বিরূপতা অলঙ্কারের দ্বারা আবৃত হয়। ৭৬।
মর্মার্থ : বস্তু সংস্কারের দ্বারা স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়। সংস্কার দোষকে দূর করে ও গুণান্তরের আধান করে। তদ্রুপ দেহের মালিন্য বিরূপতা প্রভৃতি ঢাকতে হলে বসনভূষণাদি দ্বারা করা যায়। অতএব বিরূপতার আবরণ এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধি অলঙ্কার প্রভৃতি দ্বারা সাধিত হয়। ৭৬।
অনুবাদ : স্ত্রীগণের লজ্জাই ভূষণ। ৭৭।
মর্মার্থ : সকল বস্তুরই অলঙ্কারের দ্বারা সুষমা বৃদ্ধি পায়। কোনো কোনো পদার্থের স্বাভাবিক গুণই তার চিরভূষণ হয়ে থাকে। মহিলাদের প্রধান অলঙ্কার লজ্জা। লজ্জাহীন মহিলা, বাহ্যভূষণ দ্বারা বহুভাবে অলঙ্কৃত হলেও তার প্রকৃত গৌরব থাকে না। পুরুষের চরিত্রে সত্য অধ্যবসায় প্রভৃতির মতো। ক্ষমা, পেলবতা, গৃহকর্মে দক্ষতা, দৃঢ়তা প্রভৃতি গুণও স্ত্রীদিগের একান্ত প্রয়োজন। ৭৭।
অনুবাদ : ব্রাহ্মণগণের অলঙ্কার বেদ। ৭৮।
মর্মার্থ : ঋক, যজু, সাম, অথর্ব এই চার বেদ ব্রাহ্মণগণের অলঙ্কারস্বরূপ, উপনয়নের পর উক্ত চারে বেদ ব্রাহ্মণ অধ্যয়ন করবে। বেদপাঠ, ব্রাহ্মণের বিশেষ তপস্যা। মনুর মতে বেদহীন ব্রাহ্মণ, কাষ্ঠ নির্মিত হস্তী ও চর্ম নির্মিত মৃগতুল্য। চারে বেদ অধ্যয়নে অশক্ত হলে, স্বীয় স্বীয় বেদ ও বেদাঙ্গ পড়বে। বেদপাঠের পর চতুর্দর্শন বিদ্যা অধ্যয়ন করবে। এখানে ব্রাহ্মণ শব্দ দ্বারা সমগ্র মানবজাতিকে বোঝায় এবং বেদ’ বলতে জ্ঞান। অতএব মানুষের প্রকৃত অলঙ্কার হলো জ্ঞান। ৭৮।
অনুবাদ : সকল মানবের ভূষণ ধর্ম। ৭৯।
মর্মার্থ : ধর্ম সকল লোকের অলঙ্কারস্বরূপ, ধার্মিক ব্যক্তি চরিত্রবান হয়। ধর্ম দ্বারা দয়া, দান, পরোপকার, সমাজের হিতসাধন করা যায়। ধর্মে কারও গুরুতর অনিষ্টের সম্ভাবনা থাকে না। ধার্মিক ব্যক্তি শক্তিমান ও আয়ুষ্মন কর্মঠ হয়। ধার্মিকগণ জগতের কল্যাণপথ আবিষ্কার করে। আগে বলা হয়েছে, জ্ঞান সকলের অলঙ্কার। এখানে বলা হচ্ছে, ধর্ম হলো অলঙ্কার। এই দুটি কথার সংগতি হলো যে, জ্ঞান থেকেই জন্মায় বা ধর্ম থেকেই জ্ঞান জন্মায়। অতএব এই দুটির একটি থাকলে অপরটিও থাকবে। ৭৯।
ভূষণানামতি ভূষণং বিনয়োবিদ্যা চ ॥ ৮০ ॥
অনুপ্ৰদ্ৰবং দেশমারসেৎ ॥ ৮১ ॥
সাধুজন বহুলোদেশঃ ॥ ৮২ ॥
রাজ্ঞোভেতব্যং সর্বকালম্ ॥ ৮৩ ॥
অনুবাদ : বিনয় এবং বিদ্যা সকল ভূষণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভূষণ। ৮০।
মর্মার্থ : অপরাপর অলঙ্কার দ্বারা যেরূপ সুষমা বৃদ্ধি পায় না, তা হতে বিনয় এবং বিদ্যারূপ ভূষণ দ্বারা অতিশয় শোভা বর্ধিত হয়, অতএব সকল ভূষণের মধ্যে কার্যক্ষেত্রে বিনয় ও বিদ্যাই মানবের শ্রেষ্ঠালঙ্কাররূপে প্রকাশ পায়। এখানেও পূর্বের কথার সঙ্গে সামঞ্জস্য হলো যে, ধর্ম ও জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিদ্যা ও বিনয়ের মাধ্যমে। তাই বিদ্যা ও বিনয় শ্রেষ্ঠ হিসাবে প্রতিভাত হয়। ৮০।
অনুবাদ : উপদ্রব শূন্য দেশে বাস করবে। ৮১।
মর্মার্থ : নিরূপদ্রব স্থানে বাস করলে মানবের স্বাস্থ্য, আয়ুর মনঃপ্রসাদ প্রভৃতি বৃদ্ধি পায়। অস্বাস্থ্যকর স্থানে বাস করলে অশান্তি, রোগ, ক্লেশ এবং শারীরিক, মানসিক, নৈতিক বিশেষ হানি ঘটে। অতএব উপদ্রবহীন স্থানে বসই শ্রেয় ॥৮১
অনুবাদ : যে দেশে বহু প্রাজ্ঞ ও সাধু বাস করে, সে দেশ শ্রেষ্ঠ। ৮২।
মর্মার্থ : দেশ নানাবিধ, পার্বত্য, নদীবহুল এবং গিরি-নদী বেষ্টিত নিমোন্নত দেশ। তন্মেধ্যে গিরি-নদী সমাসন্ন উচ্চ-নিম দেশই শ্রেষ্ঠ ও বাসের উপযুক্ত। যে দেশে রাজা, বিদ্বান, ঋণ দাতা, ধার্মিক সজল নদী নিত্য বিদ্যমান, সে দেশে বাস করবে। সাধারণ বাণিজ্য, জলবায়ু, সুনির্মল দেশই বাসের যোগ্য। বহু সজ্জনপূর্ণ জনপদই গ্রন্থকাব্যের অভিপ্রেত দেশ। কারণ পূর্বে যে নিরুপদ্রব দেশের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে, এখানে সেই দেশকে নির্দেশ করা হয়েছে। প্রজ্ঞাসম্পন্ন অধ্যুষিত দেশ সর্বদাই উপদ্রব রহিত হয়। তাই সে স্থানেই মানুষের বাস করা উচিত। ৮২।
অনুবাদ : সকল সময়ে রাজভয়ে ভীত থাকবে। ৮৩।
মর্মার্থ : প্রজাবর্গ সব সময় রাজাকে ভয় করবে, রাজা দণ্ডধর, দুষ্টের দমনকারী, শিষ্টের প্রতিপালক। নির্ভয় হয়ে কেউ রাজশাসন না মানলে, তার দণ্ড ও কারাক্লেশাদি ভোগ করতে হয়, সে সময় যে রাজ সিংহাসন হবে, সে অপরাধীর প্রতি দণ্ডবিধান করবে। অর্থা রাজার কর্তব্য যেমন প্রজাদের মনোরঞ্জন করে, সেরূপ প্রজাদেরও উচিত রাজার প্রতিটি নির্দেশকে শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করা। এখানে সেই শ্রদ্ধাকে ভয় শব্দ দ্বারা নির্দেশ করার অর্থ হলো যে অজ্ঞ ব্যক্তিকেও রাজাদেশ পালন করতে হয়। ৮৩।
ন রাজ্ঞঃ পরং দৈবতম ॥ ৮৪ ॥
সুদূরমপি দহতি রাজাগ্নিঃ ॥ ৮৫ ॥
রিক্তহস্তো ন রাজানমভিগচ্ছেৎ গুরুষ্ণনেবষ্ণ ॥ ৮৬ ॥
অনুবাদ : রাজা হতে শ্রেষ্ঠ দেবতা নেই। ৮৪।
মর্মার্থ : দেবতাকে কখনো দেখা যায় না, রাজা নররূপী দেবতা, অসীম শক্তি দ্বারা বিরাজিত, স্বচক্ষে দেখতে পাওয়া যায়। যেহেতু রাজা সুরেন্দ্রগণের অংশ শক্তি দ্বারা নির্মিত, সেহেতু স্বীয় প্রখর শক্তি দ্বারা সকল লোককে অভিভূত করতে সমর্থ। সকল বিপদে রক্ষক বলে রাজা নরলোকে দেবতাসদৃশ। সুতরাং দেবতার নির্দেশ জ্ঞানে প্রজাদের রাজাদেশ করা উচিত। এর দ্বারা রাজ্যে সুখ-শান্তি বিরাজ করে। ৮৪।
অনুবাদ : রাজ-ক্রোধানল অতিদূর পর্যন্ত দাহ করে। ৮৫।
মর্মার্থ : রাজার ক্রোধানলে পতিত হলে প্রজাবর্গের শারীরিক, আর্থিক দণ্ড ও সমূহ ক্ষতি হয়। অনেক সময় প্রজাকে এবং দুর্বল ব্যক্তিকে সমস্ত বিষয় হারিয়ে দেশান্তরিত হতে হয়। প্রবল রাজদ্রোহে প্রাণান্তও ঘটে থাকে, অতএব রাজা ক্রোধানল কখনই প্রজ্বলিত করবে না। প্রাজ্ঞগণ বলেছেন, ‘ভৌতিক অগ্নি পার্থিব দ্রব্যসকল দন্ধ করে, ব্রহ্মশাপ সকল বংশ উচ্ছেদ করে, দাবানাল বনসমূহ দগ্ধ করে, নৃপক্রোধাগ্নি সকল রাজ্য দন্ধ করতে সমর্থ। ৮৫।
অনুবাদ : শূন্য হস্তে রাজার নিকটে গমন করবে না। ৮৬।
মর্মার্থ : গুরু, দেবতা, রাজা, রোগী, শিশুদিগের নিকট শূন্য হস্তে গমন করা উচিত নয়, তার দ্বারা তাদের প্রীতি ও হর্যের উদ্রেক হয় না। দৃষ্টি মাত্র প্রসন্নতা এবং শুভ লাভের জন্য কোনো প্রীতিজনক বস্তু হাতে করে নিয়ে যাওয়া উচিত। তার দ্বারা স্থান বিশেষে অচিরকাল মধ্যে উদ্দেশ্যসিদ্ধি ও উভয়ের মধ্যে শান্তি আনয়ন করে। কার্যসিদ্ধির আশায় শক্তিহীন মানুষ সর্বশক্তিমান দেবতার কাছেও পূজায় উপকরণ হাতে নিয়ে যায়। সুতরাং নরদেবতা রাজার কাছে যেতে হলে, অবশ্যই কিছু না কিছু উপটৌকন নিয়ে যাওয়া উচিত। ৮৬।
অনুবাদ : শুরু ও দেবতাকে রিক্তহস্ত হয়ে দর্শন করবে না। ৮৭।
মর্মার্থ : পূর্বসূত্র উক্ত হয়েছে শূন্য হস্তে রাজার নিকটে যাবে না। এই সূত্রে অনুক্ত বিষয়ের পূরণ করে সূত্রকার বলেছেন গুরু এবং দেবতাকেও রিক্ত হস্তে দর্শন করবে না। আচার্য, শিশু, উদাসীন ভিক্ষু, রোগী প্রভৃতিকেও রিক্ত হস্তে আপ্যায়িত করবে না। ৮৭।
কুটুম্বিনা ভেতব্যম ॥ ৮৮ ॥
গন্তব্যঞ্চ সদা রাজকুলম্ ॥ ৮৯ ॥
রাজ পুরুষৈঃ সহ সম্বন্ধং কুৰ্য্যাৎ ॥ ৯০ ॥
রাজদাসী ন সেবিতব্যা ॥ ৯১ ॥
অনুবাদ : কুটম্ববর্গ হতে ভীত হবে। ৮৮।
মর্মার্থ : যার বহু পোষ্য, যাদের বহু আত্মীয়স্বজনের ভরণ-পোষণ করতে হয়, তাদের নিকটে ভীত হবে। যেহেতু তারা কখনো কোনো না কোনো বিষয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে অনিষ্টাচরণ করতে পারে। যথারীতি পোষণ করতে না পারলে দুর্নামের ভাগী হতে হয়। তাই সর্বদা তাদের সুখ-শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে ও মনস্তুষ্টি করতে নিজেকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ৮৮।
অনুবাদ : (কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্য) সকল সময়ে রাজসভায় গমন করবে। ৮৯।
মর্মার্থ : রাজসভায় গমন করলে স্বীয় বিদ্যা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতা জন্মে। স্বকার্য সাধনে ও কোনো জটিল বিষয়ের মীমাংসা করতে হলে, রাজসমীপে এবং রাজসভায় গমন একান্ত প্রয়োজন। রাজসভায় নিয়ত নানা গুণাক্রান্ত লোকের সমাবেশ হয়, তথায় প্রজাবর্গের নানা অভাবঅভিযোগের মীমাংসা হয়। তৎকালীন রাজসভায় ছিল প্রকৃত পরীক্ষাগার। রাজসভায় স্বীয় গুণ সমাদৃত হতো, তিনিই সমাজে গুণী হিসেবে শ্রদ্ধা ও সমাদর পেতেন। ৮৯।
অনুবাদ : রাজপুরুষগণে সহিত সম্বন্ধে স্থাপন করবে। ৯০।
মর্মার্থ : রাজ পুরুষগণের সহিত সম্বন্ধ স্থাপন করলে, নানা বিপদ হতে অনেক সময় উদ্ধার পাওয়া যায়। স্বীয় সম্মান ও কার্যসিদ্ধি হয়। বহু বিষয়ে আর্থিক উন্নতি এবং কার্য লাভের সম্ভাবনা থাকে। রাজামাত্য বিচারপতি, সভ্যবর্গ, নগরপাল, গ্রামাধ্যক্ষ প্রভৃতি রাজপুরুষ নামে খ্যাত। রাজসভায় গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হলে, প্রথমে রাজ পুরুষদের সঙ্গ স্থাপন করে তাদের বিশ্বাসভাজন হতে হয়। অন্যথায় রাজভবনে প্রবেশ করা দুষ্কর। ৯০।
অনুবাদ : রাজদাসীর সেবা (উপভোগ) করবে না। ৯১।
মর্মার্থ : যে দ্রব্যে রাজার প্রীতি ও প্রভুত্ব আছে, বিনা আদেশে তার গ্রহণ এবং ভোগ করা অন্যের পক্ষে উচিত নয়। তদ্রূপ রাজদাসী প্রভৃতি অন্যের সেবনযোগ্য নয়। রাজভোগিনী, দেবদাসী এবং পরস্ত্রী উপভোগ ও প্রীতি ব্যবহারের অযোগ্য। ৯১।
ন চক্ষুষাপি রাজানং নিরীক্ষেত ॥ ৯২ ॥
জনপদার্থং গ্রামস্ত্যজ্যতে ॥ ৯৩ ॥
পুত্রেগুণবতি কুটুম্বিনঃ স্বর্গ ॥ ৯৪ ॥
কুটুর্থং পুত্রস্ত্যজ্যতে ॥ ৯৫ ॥
অনুবাদ : চক্ষু দ্বারাও রাজাকে দেখবে না। (১) রাজধন চক্ষেও অবলোকন করবে না। (২)। ৯২।
মর্মার্থ : মনুও বলেছেন, রাজা সাধারণের কাছে দুর্লক্ষ। এ সমস্ত কথার মর্মার্থ হলো রাজ্যর চরিত্র অত্যন্ত দুর্ভেয়। তাই সাধারণের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে তার সঙ্গে আচার ব্যবহারে দোষত্রুটি কমানই সুলভ। সে কারণে রাজার দৃষ্টির অন্তরালে থেকে পত্রাদি দ্বারা প্রথমে আবেদন করা কর্তব্য। আবার সূত্রের অন্যরূপ পাঠে বলা হয়েছে, রাজধর্মে দৃষ্টি দেবে না। এটি সাধারণের প্রতি সাবধানবাণী। কারণ রাজধনমাত্রই মহামূল্য এবং লোভনীয়। তার প্রতি দৃষ্টিদান করলে অন্তরে লোভের সঞ্চার হওয়া সম্ভব। লোভ থেকেই যাবতীয় পাপ, আর পাপ থেকে আসে বিনাশ। তাই রাজভবনে নিত্য যাতায়াতের সুযোগ ঘটলেও রাজ ঐশ্বর্যে লোভ করা উচিত নয়। ৯২।
অনুবাদ : জনপদ লাভ হলে গ্রাম ত্যাগ করবে। ৯৩।
মর্মার্থ : মহদ বস্তু লাভ হলে ক্ষুদ্র দ্রব্য ত্যাগ করা উচিত। কোনো জনপদ, অর্থাৎ নগর লাভ হলে ক্ষুদ্র গ্রাম ত্যাগ করবে। নীতিবিদগণ বলেছেন, কুলরক্ষার নিমিত্ত এক জনতে ত্যাগ করবে, গ্রাম লাভ হলে বা তন্নিমিত্ত কুলত্যাগও করবে। জনপদের নিমিত্ত গ্রাম পরিহার করবে, আত্মরক্ষার নিমিত্ত পৃথিবীকেও ত্যাগ করবে। সর্বত্র মহলাভে ক্ষুদ্র দ্রব্য ত্যাগ যুক্তিসংগত। নীতিবিদদের উক্তিটি রক্ষাবিষয়ক হলেও তার দ্বারা পারস্পরিক আধিক্য সম্পর্কে বোধ জন্মায়। ৯৩।
অনুবাদ : পুত্র গুণবান হলে পিতা প্রভৃতি (যেন) স্বর্গ লাভ করে। ৯৪।
মর্মার্থ : পুত্র সচ্চরিত্র, বিদ্বান, ধনী হলে পিতা, মাতা স্বর্গতুল্য সুখের অধিকারী বলে মনে করে। নীতিবিদগণ বলেছেন, সুগন্ধি পুষ্পন্বিত এক বৃক্ষের দ্বারা কেমন সকল বন আমোদিত হয়, তদ্রুপ সুশিক্ষিত সৎপুত্রের দ্বারা সকল কুল উজ্জ্বল হয়। অন্যত্র উক্ত হয়েছে, দুঃখের অবসান হলে পুত্র গুণবান হয়। তাতে পরলোকেও দান শ্রদ্ধাদি দ্বারা আত্মীয়গণ প্রীত হয়। তাই মানুষ নিগুণ শতপুত্র অপেক্ষা একটি গুণী পুত্রকে অধিকভাবে কামনা করে। ৯৪।
অনুবাদ : কুটুম্বগণের রক্ষায় নিমিত্ত পুত্রকেও ত্যাগ করবে। ৯৫।
মর্মার্থ : একের দ্বারা বহুর উচ্ছেদ সম্ভব হলে, এরূপ স্থলে বহু রক্ষার্থ একের ত্যাগ যুক্তিযুক্ত। আত্মীয় বা পরিবারের রক্ষাৰ্থ পুত্রকে ত্যাগ করবে। কিন্তু বধ করবে না। যে পুত্র দ্বারা কুল রক্ষা হয়, সে পুত্র দ্বারা যদি কুল ধ্বংসের সম্ভব হয় তবে তাকে পরিত্যাগ করা উচিত। অথবা বহু সম্পদ ও বহু লোকের নিমিত্ত পুত্রকেও পরিহার করা উচিত, ইহা নীতিবাদিগণ বলেছেন। ৯৫।
আত্মার্থং সর্বং ত্যজতি ॥ ৯৬ ॥
গ্রামার্থং কুটুম্ব স্ত্যজ্যতে ॥ ৯৭ ॥
অতিলাভঃ পুত্রলাভঃ ॥ ৯৮ ॥
প্রায়েন হি পুত্রাযঃ পিতরমনবৃর্ত্তন্তে ॥ ৯৯ ॥
অনুবাদ : আত্মরক্ষার নিমিত্ত সকলকে ত্যাগ করবে। ৯৬।
মর্মার্থ : সংসারে আত্মার নিমিত্তই সকলের সমস্ত কার্য, আশা ভরসা। সকল সময় সকল উপায় দ্বারা আত্মরক্ষা করা উচিত। আত্মার বিপদ উপস্থিত হলে, সকল বিষয় পরিহার করে অগ্রে আত্মরক্ষা করতে হয়। নীতিজ্ঞগণ বলেছেন, ধন দ্বারা প্রভৃতি দ্বারা সতত আত্মাকে রক্ষা উচিত। যেহেতু জগতে আত্মা অপেক্ষা প্রিয় আর কিছু নেই। এবং মানুষের সমস্ত কার্য প্রেম, ভালোবাসা সবই আত্মকেন্দ্রিক। তাই সেরূপ আত্মাকে রক্ষা বিষয়ে অসাধাবনতা অপরাধ। ৯৬।
অনুবাদ : (বিশেষ) গ্রাম লাভ হলে কিংবা তার উদ্ধারর্থে কুটুম্ব ত্যাগ করবে। ৯৭।
মর্মার্থ : একটি গ্রাম লাভ হলে অথবা তার উদ্ধার সাধনের নিমিত্ত পরিজনকে ত্যাগ করা যেতে পারে। ইহাও বিশেষ লাভে সামান্য ত্যাগের উদাহরণ। বিপ্রাদি বর্ণ প্রায় প্রাকারও পরিখাদি শূন্য বহুলোকের বাসভূমি গ্রাম নামে অভিহিত হয়। ৯৭।
অনুবাদ : সকল লাভের মধ্যে পুত্রলাভ শ্রেষ্ঠ। ৯৮।
মর্মার্থ : পুত্র দ্বারা ঐহিক সুখ ও গৌরব, বংশরক্ষা, পারত্রিক ধর্মকার্য সাধন হয় বলে সকল লাভ হতে পুত্রলাভকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। পুত্রমুখ দর্শনে পিতা, মাতা ‘পুন্নাম’ নরক হতে উদ্ধার লাভ করে। পুত্রহীনের গৃহ অন্ধকারময় সৌধতুল্য। অপুত্রের পারত্রিক শুভগতি নেই। পুত্র দ্বাদশ প্রকার, সাত প্রকার, চার প্রকার শাস্ত্রে উক্ত আছে। কলিতে ঔরস ও দত্তক এই দুই প্রকার পুত্রের বিধান। বর্তমানে দত্তকপুত্রও প্রায় লুপ্ত। আর এই সূত্রের লক্ষ্য ঔরস্যজাত পুত্রই। ৯৮।
অনুবাদ : পুত্রগণ প্রায়ই পিতার অনুসরণ করে থাকে। ৯৯।
মর্মার্থ : পুত্রে পিতার গুণাবলি সংক্রামিত হয় বলে, পুত্র বহু বিষয়ে পিতার অনুসরণ করে, মাতার গুণাবলি কন্যা ধারণ করে থাকে। পিতা হতে অপত্যগণ স্নায়ু, অস্থি, মজ্জা প্রভৃতি উৎপত্তি কালে লাভ করে। মাতা হতে লোম, রক্ত, মাংস প্রভৃতি জন্মকালে প্রাপ্ত হয়। সেহেতু পুত্র কন্যাগণ পিতামাতার অনুবর্তন করে থাকে। আবার এ কারণেই সৎ ও গুণী পুত্র লাভ করার জন্য পিতাকে সংযত ও সঙ্কর্মে ব্যাহত হয়ে সদ্গুণ অর্জন করতে হয়। তা হলেই পুত্রও পিতার নাম অনুসরণ করে সজ্জন, গুণবান হয়ে উঠবে। ৯৯।
পুত্রা বিদ্যানাং পারং গময়িতব্যাঃ ॥ ১০০ ॥
দুর্গতেঃ পিতরৌ রক্ষতি স পুত্রঃ ॥ ১০১ ॥
কুলং প্রখ্যাপয়তি পুত্রঃ ॥ ১০২ ॥
যেন তত্ কুলং প্রখ্যাতং সঃ পুরুষ ॥ ১০৩ ॥
অনুবাদ : পুত্রগণকে নানা বিদ্যার পারঙ্গম করবে। ১০০।
মর্মার্থ : বিদ্যাহীন মানবজীবন রত্নরাজিখচিত তিমিরাবৃত সৌধের ন্যায়। বিদ্যা মানবগণের বিষয় তত্ত্বজ্ঞানে প্রধান চক্ষু। বিদ্যাচক্ষু যার নেই, সে চক্ষুষ্মন হয়েও অন্ধ। শাস্ত্রে চতুঃষষ্ঠি প্রকার বিদ্যার উল্লেখ দেখা যায়। সেকোনো একটা বিদ্যায় পারদর্শী হওয়া উচিত। বিদ্যাহীন মানবজীবন বহু বিপদেরও আকর। তাছাড়া একটি বিদ্যা গহন সংসারে জীবনযাত্রা নির্বাহ সব সময় সুখকর হয় না, তাই পিতার কর্তব্য, পুত্রকে একাধিক বিদ্যার পারদর্শী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। ১০০।
অনুবাদ : যে দুর্গতি হতে পিতামাতাকে রক্ষা করে সে পুত্র। ১০১।
মর্মার্থ : পিতা ও মাতার আত্মজাত পুত্র। তাই সকল সময় পিতামাতাকে রক্ষা করা তার কার্য। সেরূপ না করলে, সে যথার্থ পুত্রপদবাচ্য নয়। পুত্র না হয়ে যে পুত্রের তুল্য আচরণ করে, সে পুত্ৰপ্রতিনিধি। শাস্ত্রে নানাবিধ পুত্রের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়, তন্মধ্যে ঔরস পুত্রের সম্পর্কেই এই নির্দেশটি করা হয়েছে, পিতামাতা প্রতি ভক্তিভাব হওয়াই পুত্রের শ্রেষ্ঠ আদর্শ। ১০১।
অনুবাদ : পুত্র স্বীয়কুলকে বিখ্যাত করে। ১০২।
মর্মার্থ : সুধাকারের উদয়ে নভোল যেমন সম্পূর্ণ উদ্ভাসিত হয়। সেরূপ কুলজাত পুত্র, বিদ্যা-বিনয়-ধর্ম-মান-দান দ্বারা বংশকে প্রখ্যাত করে। মনীষী পুত্র দ্বারা দেশ, সমাজ ও গৌরবাম্বত হয়। তাই মানুষ মাত্রেই গুণবান পুত্র কামনা করে। তবে তার জন্য মাতা-পিতারও সংযত ও আদর্শবান হওয়া উচিত। ১০২।
অনুবাদ : যার দ্বারা স্বীয় কুল গৌরবিত হয়, সেই পুরুষ। ১০৩।
মর্মার্থ : সংসারে অনেকেই আসে ও কিছুদিন থাকে পরে চলে যায়, কিন্তু যে মানুষ জন্ম গ্রহণ করে স্বীয় গুণ, জ্ঞান, মান, দান দ্বারা স্বীয় কুলকে বিখ্যাত করে, সে শ্রেষ্ঠ পুরুষ নামে অভিহিত হয়। মহাকবিও বলেছেন, নাম গণনাকালে যার নাম উল্লেখের অগেই অঙুলি উন্নত হয়, সে পুরুষ সার্থক জন্ম। ১০৩।
নানপত্যস্য স্বর্গঃ ॥ ১০৪ ॥
যা প্রসূতে ভাৰ্য্যা ॥ ১০৫ ॥
তীর্থ সমবায়ে পুত্রবতীমনুগচ্ছেৎ ॥ ১০৬ ॥
ন তীর্থাভিগমনাদ্ ব্রহ্মচর্য্যৎ নশ্যতি ॥ ১০৭ ॥
অনুবাদ : পুত্র-কন্যাবিহীন ব্যক্তির স্বর্গলাভ হয় না। ১০৪।
মর্মার্থ : অপত্য শব্দ পুত্র ও কন্যা এই দুই-এর বোধক। অপত্য শূন্য ব্যক্তির ঔদ্ধদৈহিক কার্যের অভাবে স্বীয় লাভ হয় না। পুত্র মুখ দর্শনে পুন্নমনরক হতে ত্রাণ পাওয়া যায়। শত সুধাকর কিরণোজ্জ্বল সৌধবাস এবং অনন্ত রত্নরাজি সমৃদ্ধ হলেও পুত্রের অভাবে আশানুরূপ সুখের পূর্ণতা হয় না। লঘুচাণক্যে উক্ত আছে, পুত্রহীন গৃহ শূন্যপ্রায়। বিশেষত পুত্র-কন্যা দ্বারাই বংশ দ্বারা অবিচ্ছিন্ন থাকে। তাই অপত্যহীনতা আশু বংশনাশের দুর্ণিমিত্তস্বরূপ। ১০৪।
অনুবাদ : যে পুত্র কন্যা প্রসবে সমর্থ সে প্রকৃত ভার্যা। ১০৫।
মর্মার্থ : পুত্রকামী পুরুষ ভার্যা গ্রহণ করে, পুত্র ঐহিক সুখ ও ঔদ্ধদৈহিক কার্য সম্পাদন করে। কবি বলেছেন, যে স্ত্রী গৃহকার্যে নিপুণা, পতিপ্ৰাণ্য, প্রিয়বাদিনী, অপত্যবতী সেই প্রকৃত ভার্যা নামের যোগ্য। ভার্যা পুরুষের ত্রিবর্গ (ধর্ম, অর্থ ও কাম) সাধনের মূল। বিবাহের লক্ষণ কালেও বলা হয়েছে–পুত্রের জন্যই ভার্যা গ্রহণ করা। সুতরাং তা যদি না হয়, তাহলে বিবাহ ও ভার্যা গ্রহণ সবই বৃথা। ১০৫।
অনুবাদ : তীর্থসমূহে পুত্রবতী স্ত্রীর অনুগমন করবে। ১০৬।
মর্মার্থ : তীর্থ সজ্জনসমূহ, কাশী প্রভৃতি পুণ্যক্ষেত্র, গুরু সন্নিধান; জ্ঞানীব্যক্তি সমাগম জলাবতরণ, সদুপায়, ঋষিসেবিত জল, পবিত্র শাস্ত্র, দেবতায়তন, সমর প্রভৃতি এই সকল স্থানে পুত্রবতী ও অন্তসত্ত্বা স্ত্রীর অনুগমন করবে। তদ্ভিন্ন অবরোধশীলা স্ত্রী পতি, পিতা, ভ্রাতার সহিত তীর্থে, শ্মশানে, সমরে, মারীভয়ে, দুর্ভিক্ষে, বিপ্লবে, ভূকম্পাদিতে গমন করতে সমর্থ। ১০৬।
অনুবাদ : তীর্থাভিগমন করলে ব্রহ্মচর্য নষ্ট হয় না। (১) সতীর্থ (এক গুরুর নিকটে সহপাঠী), সতীর্থ বা সতীর্থা অভিগমনে ব্রহ্মচর্য নষ্ট হয়। (২) ১০৭।
মর্মার্থ : তীর্থে অভিগমন করলে ব্রহ্মচর্য নষ্ট হতে পারে। অভিগমন অর্থাৎ বিশেষ গমন। তীর্থ অর্থাৎ ধর্মক্ষেত্র, গুরু ধর্মোপদেশ স্থান, দেবালয়াদি প্রভৃতি স্থানে সতীর্থ বা সতীর্থাকে অভিগমন করলে ব্রহ্মচর্য নষ্ট হয়। অভিগমন অর্থাৎ স্ত্রী পুরুষের ঐয়িক সম্বন্ধে বিশেষ। ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ অষ্টবিধ মৈথুন পরিহার। ব্রহ্মচর্য বলে মানুষ আয়ুস্পন, মনস্বী, মহাজন, ধার্মিক হতে সমর্থ। তাই মানবজীবনে সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রথম সোপান হলো, ব্রহ্মচর্য পালন। অজিতেন্দ্রিয় মানুষ কখনো মহাজন পদবাচ্য হতে পারে না৷ ১০৭
ন পরক্ষেত্রে বীজং বিনিক্ষেপেৎ ॥ ১০৮ ॥
অনুবাদ : অন্যের ক্ষেত্রে বীজ নিক্ষেপ করবে না। (১) অপরের স্ত্রীতে সন্ততি-উৎপাদনের বীজ ত্যাগ করবে না। (২) ১০৮।
মর্মার্থ : অপরের ক্ষেত্রে স্বীয়ধান্যাদির বীজ বপন করা অনুচিত, যেহেতু সেও বীজবপ্তার ক্ষেত্রে পুনঃ বীজবপন করতে পারে, তাতে বিবাদ ও অনর্থপাত হওয়া সম্ভব। অথবা পরদারে সন্তানোৎপাদনের বীজ ত্যাগ করবে না। এই সূত্রটির মুখ্যার্থ হলে পরস্ত্রীতে কখনো আসক্ত হওয়া উচিত নয়। ব্রহ্মচর্যহানির এটি প্রথম সোপান। ১০৮।
চাণক্য সূত্রানুবাদে চতুর্থ অধ্যায় ॥ ৪৷