৪. একটি বকুল গাছের নিষ্পত্র শাখায়

একটি বকুল গাছের নিষ্পত্র শাখায় নূতন পত্রোদগম হইয়াছে, একটি কোকিল শাখায় বসিয়া ডাকিতেছে।

রাজপ্রাসাদের একটি কক্ষে সেই কোকিলের ডাক শোনা যাইতেছে। কক্ষটি প্রশস্ত ও মহার্ঘ উপকরণে সজ্জিত, রঙিন পক্ষ্মল আস্তরণে ভূমিতল আবৃত, তদুপরি কয়েকটি বৃহৎ উপাধান ন্যস্ত। একটি অর্ধগোলাকৃতি গবাক্ষ হইতে পুরভূমির বৃক্ষাদি এবং অবরোধের কিয়দংশ দেখা যাইতেছে। লৌহজালিকে পিনদ্ধবক্ষ একটি যবনী প্রতিহারী ধনুর্বাণ হস্তে দ্বারে পাহারা দিতেছে।

কক্ষটি মহারাজ সেনজিতের বিশ্রামগৃহ। কক্ষে আছেন স্বয়ং সেনজিৎ, বিদূষক বটুক ভট্ট এবং মহারাজের চারিজন বয়স্য। বটুক ভট্টের চূড়াকৃতি কেশে পাক ধরিয়াছে। তিনি সেনজিতের সহিত পাশা খেলিতেছেন। বয়স্যদের মধ্যে দুইজন বসিয়া তাম্বুল চিবাইতে চিবাইতে খেলা দেখিতেছেন; একটি বয়স্য ভূমি-শয়ান বীণার তন্ত্রীতে অলসভাবে অঙ্গুলি সঞ্চালন করিতেছেন, চতুর্থ বয়স্য করতালি দিয়া সঙ্গত করিতেছেন। মধু-অপরাহের আলস্যে সকলেই যেন একটু ঝিমাইয়া পড়িয়াছেন। কক্ষে স্ত্রীলোক কেহ নাই।

সহসা কক্ষের বাহির হইতে নারীকণ্ঠের সঙ্গীত ভাসিয়া আসিল। সকলে সচকিত হইয়া চারিদিকে চাহিলেন। কোন রমণী গান গায়? বটুক ভট্ট অধরে অঙ্গুলি রাখিয়া সকলকে নীরব থাকিতে ইঙ্গিত করিলেন, তারপর পা টিপিয়া টিপিয়া দ্বারের কাছে গিয়া বাহিরে উঁকি মারিলেন।

অলিন্দের এক প্রান্তে বাতায়নের সম্মুখে দাঁড়াইয়া যবনী প্রতিহারী আপন মনে গান ধরিয়াছে। তাহার নীল চক্ষু দুটির বিষণ্ণ দৃষ্টি দিগন্তের পানে প্রসারিত, যেন সুদুর স্বদেশের স্বপ্ন দেখিতেছে।

যবনীর গান শেষ হইলে কক্ষের মধ্যে রাজবয়স্যেরা উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন। যবনী লজ্জা পাইয়া চকিতে স্বস্থানে ফিরিয়া আসিল এবং তীর-ধনুক হাতে লইয়া দ্বারের পাশে ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া রহিল।

বটুক ভট্ট ফিরিয়া গিয়া রাজার সম্মুখে বসিলেন, ভর্ৎসনাপূর্ণ চক্ষে চাহিয়া বলিলেন—

ধিক বয়স্য! শত ধিক্ তোমাকে!

সেনজিৎ মৃদু বিস্ময়ে বলিলেন—কী হল বটুক!

বটুক ভট্ট বলিলেন—একটা যবনী প্রতিহারী বসন্তের সমাগমে তার প্রাণেও রঙ ধরেছে আর তুমি বয়স্য নীরস শকুনির মত বসে বসে পাশা খেলছ! ছিঃ!

কপট ক্রোধে বটুক ভট্ট পাশার গুটিকাগুলি দূরে নিক্ষেপ করিলেন। সেনজিৎ স্মিতমুখে বলিলেন—কি করতে বলো?

যাও, অন্তঃপুরে যাও, নুপুর-নিক্কণ শোনো, কঙ্কণ কিঙ্কিণীর ঝনৎকার শোনো। হায় হতোস্মি— বটুক ভট্ট ললাটে করাঘাত করিলেন।

সেনজিৎ বলিলেন—আবার কি হল?

ভুলে গিয়েছিলাম। মনে ছিল না যে তোমার অবরোধে স্ত্রীলোক নেই—অন্তঃপুর শুন্য খাঁ খাঁ করছে—কেবল হতভাগ্য কঞ্চুকীটা প্রেতের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। আহা, কঞ্চুকীর মুখ দেখলে পাষাণও বিদীর্ণ হয়। বটুক গভীর নিশ্বাস মোচন করিলেন।

সেনজিৎ বলিলেন—বয়স্য, দেখছি তোমার গায়েও বসন্তের হাওয়া লেগেছে। মদনোৎসবের আর বিলম্ব কত?

বটুক ভট্ট কহিলেন—মদনের সঙ্গে যার মৌখিক পরিচয় পর্যন্ত নেই, মদনোৎসবের সঙ্গে তার কী প্রয়োজন। বিল্বফল পাকলো কি না তাতে—ইয়ে—পরভৃতের কি লাভ?

সেনজিৎ হাসিয়া বলিলেন—ধন্য বটুক, তুমি আমাকে কাক না বলে কোকিল বলেছ। কোকিল কিন্তু ভারী গুণবান পক্ষী।

একজন বয়স্য বলিলেন—দোষের মধ্যে পরের বাসায় ডিম্ব প্রসব করে।

বটুক ভট্ট অঙ্গুলি তুলিয়া বলিলেন—এ বিষয়ে, বয়স্য, তোমার চেয়ে কোকিল ভাল।

কিসে?

কোকিল তো তবু পরগৃহে বংশরক্ষা করে, তুমি যে একেবারেই

বটুক ভট্ট হতাশাসূচক হস্তভঙ্গি করিলেন। সেনজিৎ ক্ষণকাল বিমনা হইয়া রহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে বলিলেন

দেখ বটুক, তোমাদের একটা গোপনীয় কথা বলি—নারীজাতিকে আমি বড় ভয় করি, তাই মদনোৎসবের সময় আমার প্রাণে আতঙ্ক উপস্থিত হয়। এই সময় নারীজাতি অত্যন্ত দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে।

বটুক ভট্ট বিমর্ষভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন—সে কথা সত্য। এই সময় স্ত্রীজাতি তাদের অস্ত্রশস্ত্র শানিয়ে পুরুষের দিকে ধাবিত হয়। আমার গৃহিণীর সাতটি সন্তান বয়সেরও ইয়ত্তা নেই, কিন্তু কয়েকদিন থেকে লক্ষ্য করছি তিনি আমার পানে তীব্র কটাক্ষ নিক্ষেপ করছেন।

বয়স্যেরা হাসিল, সেনজিৎ হাসি গোপন করিলেন।

বড় ভয়ানক কথা, বটুক। তবে আর তোমার ঘরে ফিরে গিয়ে কাজ নেই; আমার অন্তঃপুর শুন্য আছে, তুমি সেখানেই থাকো। এ বয়সে গৃহিণীর কটাক্ষ বাণ খেলে আর প্রাণে বাঁচবে না।

বটুক আরও মোহ্যমান হইয়া পড়িলেন। বলিলেন—তা হয় না বয়স্য। এই নিদারুণ বসন্তকালে দেশসুদ্ধ কোকিল পর-গৃহে ডিম্ব উৎপাদন করবার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে এসময় গৃহত্যাগ করলে অন্য বিপদ এসে জুটবে।

একজন বয়স্য প্রসঙ্গান্তর উত্থাপন করিলেন–মহারাজ, সত্য বলুন, পরিহাস নয়, স্ত্রীজাতির প্রতি আপনার বিরাগ কিসের জন্য। বিশেষ কোনও কারণ আছে কি?

সেনজিৎ লঘুস্বরে বলিলেন—রুচির অভাবই প্রধান কারণ। তাছাড়া, এই নারীজাতিই পুরুষের সকল দুঃখের মূল। ভেবে দেখ শ্রীরামচন্দ্রের কথা স্মরণ কর কুরু-পাণ্ডবের কাহিনী। এইসব উদাহরণ দেখে স্ত্রীজাতির কাছ থেকে দূরে থাকাই ভাল।

বয়স্য প্রশ্ন করিলেন—কিন্তু মহারাজ–বংশধর!

সেনজিতের মুখ হইতে লঘুতার সমস্ত চিহ্ন মুছিয়া গেল, তিনি গভীর ক্ষোভপূর্ণ চক্ষে বয়স্যের পানে চাহিলেন—

বংশধর! ভানুমিত্র, শিশুনাগ বংশে বংশধরের কথা চিন্তা করতে তোমার ভয় হয় না? এই অভিশপ্ত বংশে যে জন্মেছে সে-ই নিজের পিতাকে হত্যা করেছে। শুনেছি এ বংশে আমি ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। আমার ঐকান্তিক কামনা, আমার সঙ্গেই যেন এ বংশের শেষ হয়।

বয়স্যেরা নতমুখে নিরুত্তর রহিলেন। এই সময় বাহিরে প্রাসাদ-প্রাঙ্গণ হইতে তুর্যধ্বনি হইল; এই তুর্যধ্বনির অর্থ—কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তি রাজদর্শনে আসিয়াছেন। সেনজিৎ ঈষৎ বিরক্তভাবে চক্ষু তুলিলেন–

এ সময় কে দেখা করতে চায়? বটুক, তুমি দেখ গিয়ে বলবে আমি এখন বিশ্রাম করছি, কাল রাজসভায় দেখা হবে।

রাজকীয় কার্য করিতে যাইতেছেন তাই বটুক ভট্টের মুখ অত্যন্ত গম্ভীর ভাব ধারণ করিল; তিনি উত্তরীয়টি স্কন্ধে রাখিয়া মর্যাদাপূর্ণ পদক্ষেপে প্রস্থান করিলেন। সেনজিৎ উঠিয়া গবাক্ষের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন। বয়স্য চারিজন সঙ্কোচ বোধ করিয়া ঘরের চারিদিকে ইতস্তত ছড়াইয়া পড়িলেন।

এই সময় বটুক ভট্ট প্রায় মুক্তকচ্ছ অবস্থায় ফিরিয়া আসিলেন এবং আর্তকণ্ঠে মহারাজ। বলিয়া সেনজিতের আড়ালে আত্মগোপন করিবার চেষ্টা করিলেন।

সেনজিৎ সবিস্ময়ে বলিলেন—এ কি বটুক! কি হয়েছে?

মহারাজ, জঙ্ঘাবল প্রদর্শন করছি।

তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু পালিয়ে এলে কেন? কে এসেছে?

বটুক ভট্ট ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে বলিলেন—তা ঠিক বলতে পারি না। বোধ হয় দিব্যাঙ্গনা।

সেনজিৎ বিস্মিত হইলেন-দিব্যাঙ্গনা! স্ত্রীলোক?

বটুক ভট্ট সবেগে মুণ্ড নাড়িলেন—কদাচ নয়। উর্বশী হলেও হতে পারে, নচেৎ নিশ্চয় তিলোত্তমা। কিন্তু তার বক্ষে লৌহজালিক, রণরঙ্গিণী মূর্তি!

এই সময় যবনী প্রতিহারী দ্বারের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। সেনজিৎ তাহার পানে সপ্রশ্ন চক্ষু ফিরাইলেন।

প্রতিহারী বলিল—বৈশালী থেকে এক রাষ্ট্রদূতী এসেছেন—আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান।

সেনজিৎ ক্ষণেক নির্বাক থাকিয়া বলিলেন—রাষ্ট্রদূতী।—নিয়ে এস।

যবনী প্রস্থান করিল এবং ক্ষণকাল পরে উল্কাকে সঙ্গে লইয়া ফিরিয়া আসিল।

উল্কা দ্বারপথে দাঁড়াইয়া প্রথমেই সেনজিতের দিকে চাহিল; উভয়ের দৃষ্টি ক্ষণেক পরস্পর আবদ্ধ হইয়া রহিল। সেনজিৎ নিজের অজ্ঞাতসারেই উল্কার নিকটবর্তী হইলেন, সহজ সৌজন্যের সহিত গাম্ভীর্যমিশ্রিত স্বরে কহিলেন—

ভদ্রে, শুনলাম তুমি বৈশালী থেকে আসছ, তোমার কী প্রয়োজন?

উল্কা চিনিয়াছিল ইনিই সেনজিৎ, সে একটু অভিনয় করিল; সম্ভ্রমপূর্ণ অথচ দৃঢ়স্বরে বলিল— আমি পরমভট্টারক শ্ৰীমন্মহারাজ সেনজিতের দর্শনপ্রার্থিনী, তাঁর কাছেই আমার প্রয়োজন নিবেদন করব।

সেনজিৎ শান্তভাবে বলিলেন-আমিই সেনজিৎ।

উল্কার বিস্ময়োৎফুল্ল  চক্ষু ক্ষণেকের জন্য অর্ধনিমীলিত হইয়া আসিল; সে দুই পদ অগ্রসর হইয়া মহারাজের পদপ্রান্তে নতজানু হইয়া যুক্তকরপুট ললাটে স্পর্শ করিল। তারপর নিজ অঙ্গত্রাণের ভিতর হইতে জতুমুদ্রালাঞ্ছিত পত্র বাহির করিয়া মহারাজের হাতে দিল। বলিল

মহারাজ, আমি চিনতে পারিনি, ক্ষমা করুন। এই আমার পরিচয়পত্র

সেনজিৎ বলিলেন—স্বস্তি—স্বস্তি

উল্কা উঠিয়া দাঁড়াইল, সেনজিৎ জতুমুদ্রা ভাঙিয়া পত্র পাঠ করিতে লাগিলেন। বটুক ভট্ট সেনজিতের পিছনে লুকাইয়া ছিলেন, সন্তর্পণে গলা বাড়াইয়া দেখিলেন উল্কা একাগ্রচক্ষে সেনজিৎকে নিরীক্ষণ করিতেছে। তিনি আবার মুণ্ড টানিয়া লইলেন। অন্য বয়স্যেরা বিমুগ্ধ নেত্রে উল্কার পানে চাহিয়া রহিল।

সেনজিৎ লিপি পাঠ করিয়া বলিলেন—দেখছি, মিত্ররাজ্য লিচ্ছবি তোমাকে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি করে মগধের রাজসভায় পাঠিয়েছেন। তা ভাল। আমি তোমাকে স্বাগত সম্ভাষণ জানাচ্ছি। (ঈষৎ হাসিয়া) বৈশালীর রাষ্ট্রনায়কেরা একটি পুরাঙ্গনাকে প্রতিভূরূপে পাঠিয়েছেন এটা তাঁদের প্রীতির নিদর্শন সন্দেহ নেই, তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে এ রীতি কিছু নূতন।

উল্কা বলিল–মহারাজ, লিচ্ছবির প্রজাতন্ত্রে স্ত্রী-পুরুষের কোনও প্রভেদ নেই—সকলে সমান।

বটুক ভট্ট এইবার আত্মপ্রকাশ করিয়া বিদূষক-সুলভ চপলতা আরম্ভ করিলেন। বলিলেন—

শুধু তাই নয়, বৈশালীতে নিশ্চয় পুরুষের অভাব ঘটেছে, তাই তারা এই সুন্দরীকে পুরুষ সাজিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। বয়স্য, বৈশালী যখন মিত্ররাজ্য, তখন তোমারও উচিত মিত্রতার নিদর্শন স্বরূপ কিছু পুরুষ পাঠিয়ে দেওয়া। তাতে মিত্রতার বন্ধন আরও দৃঢ় হবে।

উল্কা অবজ্ঞাভরে বটুকের পানে চাহিল——মগধে পুরুষ প্রতিনিধির প্রয়োজন নেই বলেই বোধহয় মহামান্য কুলপতিরা এই পুরকন্যাকে পাঠিয়েছেন, নচেৎ লিচ্ছবিদেশে প্রকৃত পুরুষের অভাব নেই।

বটুক গম্ভীরভাবে দক্ষিণে বামে মাথা নাড়িলেন—

বৈশালিকে, লিচ্ছবিদেশে যদি প্রকৃত পুরুষ থাকত তাহলে কখনই তোমাকে মগধে আসতে দিত না।

উল্কা উত্ত্যক্ত হইয়া সেনজিতের পানে চাহিল। বলিল—মহারাজ, এই বিদূষক কি আপনার বাক-প্রতিভূ?

সেনজিৎ উত্ত্যক্ত স্বরে বলিলেন—আঃ বটুক, চপলতা সংবরণ কর, এখন চপলতার সময় নয়।

বটুক ভট্ট যেন রাজার তিরস্কারে ভয় পাইয়াছেন এরূপ অভিনয় করিয়া দূরে একটি উপাধানে ঠেস দিয়া বসিলেন। সেনজিৎ উল্কার দিকে ফিরিলেন—

ভদ্রে—

উল্কা মৃদু হাসিয়া বলিল—আয়ুষ্মন্, আমার নাম উল্কা।

বটুক ভট্ট ভয়ার্তভাবে চক্ষু ঘূর্ণিত করিলেন—

ওফ!

সেনজিৎ বলিলেন—ভাল—উল্কা, আবার তোমাকে স্বাগত সম্ভাষণ জানাচ্ছি। কাল থেকে সভায় অন্য পাত্রমিত্রদের সঙ্গে তোমার আসন হবে।

উল্কা সরল উৎকণ্ঠার অভিনয় করিয়া সেনজিতের কাছে সরিয়া আসিল—

মহারাজ, সভায় নিয়মিত উপস্থিত থাকা কি আমার অবশ্য কর্তব্য? রাজসভার শিষ্টতা আমি কিছুই জানি না, এই আমার প্রথম দৌত্য।

সেনজিৎ বলিলেন—সভায় উপস্থিত থাকা-না-থাকা পাত্রমিত্রের প্রয়োজন আর অভিরুচির ওপর নির্ভর করে। তোমার যখন ইচ্ছা হবে তখন সভায় আসতে পার।

ভাল মহারাজ।

যাহোক, বহুদূর পথ এসে তুমি আর তোমার পরিজন নিশ্চয় ক্লান্ত হয়েছ, আগে তোমাদের বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু পূর্বাহ্বে সংবাদ না পাওয়ায় তোমাদের সমুচিত বাসস্থানের ব্যবস্থা হয়নি।

বটুক অমনি চট্‌ করিয়া বলিলেন—

তাতে কী হয়েছে! মহারাজের অন্তঃপুর তো শুন্য, সেইখানেই অতিথি সৎকারের ব্যবস্থা হোক।

সেনজিৎ বিরক্ত মুখে বটুক ভট্টের পানে চাহিলেন। উল্কার চোখে বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল

মহারাজের অন্তঃপুর শূন্য! তবে কি

বটুক ভট্ট সশব্দে নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন—

কিছু নেই রানী উপরানী কিছু নেই।

উল্কা চোখের বিজয়োল্লাস গোপন করিয়া ক্লান্তির অভিনয় করিল। বলিল—

মহারাজ, আমরা সত্যই পথশ্রান্ত; যদি বাধা না থাকে আমি আর আমার সখীরা অবরোধেই আশ্রয় নিতে পারি। আমরা নারী, মহারাজের আশ্রয়ে থাকাই আমাদের পক্ষে শোভন হবে।

প্রস্তাব সেনজিতের খুব মনঃপূত হইল না, তিনি মস্তকের উপর দিয়া একবার করতল সঞ্চালিত করিয়া যবনী প্রতিহারীর দিকে ফিরিলেন—

যবনি, কঞ্চুকীকে ডেকে আনো।

কঞ্চুকী বোধহয় দ্বারের বাহিরেই অপেক্ষা করিতেছিল, তৎক্ষণাৎ প্রবেশ করিল। কঞ্চুকীকে পূর্বে চণ্ডের সভায় আমরা দেখিয়াছি, এখন বয়স আরও বাড়িয়াছে।

এই যে মহারাজ, আমি উপস্থিত।

সেনজিৎ বলিলেন—তুমি এসেছ! কাছেই ছিলে মনে হচ্ছে। যাহোক, ইনি আর এঁর সখীরা আপাতত অবরোধে থাকবেন, তার ব্যবস্থা কর।

কঞ্চুকী মহানন্দে বলিল—ধন্য মহারাজ। (উল্কাকে) দেবি, আসুন—আসুন আমার সঙ্গে

উল্কা গমনোদ্যতা হইয়া হাসিমুখে সেনজিতের দিকে ফিরিল এবং দুই করতল যুক্ত করিয়া বলিল—

জয়োস্তু মহারাজ।

দ্বারের পাশে যবনী প্রতিহারী দাঁড়াইয়া আছে, উল্কা কঞ্চুকীর অনুসরণ করিয়া দ্বারের নিকটে উপস্থিত হইল। এই সময় বটুক ভট্ট পশ্চাৎ হইতে একটি বাক্যবাণ নিক্ষেপ করিলেন—

বৈশালিকে, রাজকার্য তো বেশ সুচারুরূপে সম্পন্ন হল, এখন একটি কথা জানতে পারি কি?

উল্কা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া ভ্রূ তুলিল—

বটুক ভট্ট বলিলেন—বৈশালীর সকল সীমন্তিনীই কি সদাসর্বদা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে থাকেন? ভ্রূকুটির ভল্ল আর বক্ষের লৌহজালিক কি তাঁরা একেবারেই ত্যাগ করেন না?

উল্কার দুই চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল; সে ক্ষিপ্রহস্তে যবনী প্রতিহারীর তুণীর হইতে একটি তীর লইয়া ভল্লের ন্যায় বটুক ভট্টের শির লক্ষ্য করিয়া নিক্ষেপ করিল, বলিল—

তোমার মত কদাকার কিম্পূরুষ দেখলে বৈশালীর নারীরা অস্ত্রত্যাগ করে।

বটুক ভট্ট আর্তনাদ করিয়া উঠিলেন। উল্কা ভ্রূক্ষেপ না করিয়া কঞ্চুকীর সহিত প্রস্থান করিল। উল্কার নিক্ষিপ্ত শরটি বটুর ভট্টের চূড়াকৃতি কেশের মধ্যে প্রবেশ করিয়া আটকাইয়া গিয়াছিল, বটুক শর ধরিয়া টানাটানি করিতে লাগিলেন।

সেনজিৎ হাসিলেন—তোমার উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে। বৈশালীর মেয়েদের লক্ষ্যবেধ দেখছি অব্যর্থ। তুমি আর ওর সঙ্গে রসিকতা করতে যেও না।

বটুক ভট্ট কাতরস্বরে বলিলেন—না বয়স্য, আর করব না—এ বয়সে আগুন নিয়ে খেলা আর সহ্য হবে না। এখন দয়া করে তীরটা বার করে নাও

সেনজিৎ হাসিতে লাগিলেন, বয়স্যেরাও যোগ দিল।

***

রাজ অবরোধ। পৌর ভবনের একটি অংশ প্রাচীর পরিখা দ্বারা বেষ্টিত; ভিতরে বিস্তৃত ভূমির মধ্যস্থলে সুন্দর একটি ভবন। তাহাকে ঘিরিয়া নানা জাতীয় বৃক্ষ, পুষ্পেদ্যান, জলাশয়। একটি সুদৃশ্য সেতু পার হইয়া অবরোধে প্রবেশ করিতে হয়, অন্য পথ নাই।

কঞ্চুকী সেতু-মুখে দাঁড়াইয়া উল্কা ও তার সখীদের অভ্যর্থনা করিল, কয়েকটি কিঙ্করী মালা পানপাত্র লইয়া দাঁড়াইয়া ছিল, তাহারা উল্কা ও সখীদের গলায় মালা পরাইয়া দিল, সোনার পাত্রে স্নিগ্ধ পানীয় দিয়া সকলের তৃষ্ণা নিবারণ করিল। পুলকিত কঞ্জুকী সহর্ষে দুই হস্ত ঘর্ষণ করিতে করিতে পরিদর্শন করিতে লাগিল।

উল্কা ও বাসবী উদ্যানের একদিকে চলিল, সখীরা অন্যদিকে চলিল। সকলেরই চোখেমুখে বিস্ময় ও আনন্দ।

উল্কা ও বাসবী সরোবরের পাষাণ-তটে আসিয়া দাঁড়াইল। জলে অসংখ্য কমল ফুটিয়াছে। বাসবী ভিতরের কথা কিছু জানিত না, সে উল্কাকে নানা কৌতূহলী প্রশ্ন করিতেছে।

প্রিয় সখি, মহারাজকে কেমন দেখলে বল না!

উল্কার অধরে অর্থপূর্ণ কুটিল হাসি খেলিয়া গেল—

মহারাজ সেনজিৎ! কেমন আর দেখব? সাধারণ মানুষ—দোর্দণ্ডপ্রতাপ মহারাজ বলে মনেই হয়।

চেহারা কেমন?

সুকুমার যুবাপুরুষ।

কেমন কথা বলেন?

বেশ মিষ্টি। মানুষটি খুব নিরীহ—ক্ষাত্র তেজ কিছু দেখলাম না।

আচ্ছা প্রিয় সখি, ওঁকে তোমার বেশ লেগেছে?

উল্কা চকিত হইয়া বাসবীর দিকে চাহিল—

কেন বল দেখি?

বাসবী মুখ টিপিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল—না—অমনি—জানতে ইচ্ছে হল। বল না।

উল্কার ভ্রূর মাঝখানে একটি সূক্ষ্ম রেখা পড়িল, সে যেন ভাবিতে ভাবিতে বলিল—

মন্দ লাগল না—শিশুনাগ বংশের যে খ্যাতি শুনেছিলাম, সে রকম নয়। (মুখ কঠিন হইল) কিন্তু তা বলে আমার কর্তব্য আমি ভুলব না।

বাসবী না বুঝিয়া প্রশ্ন করিল—তোমার কর্তব্য! কোন কর্তব্য?

উল্কা আত্মসংবরণ করিয়া বলিল—এই—আমার রাষ্ট্রীয় কর্তব্য। মগধের রাজসভায় আমি বৈশালীর প্রতিনিধি, মহারাজ সেনজিতের সঙ্গে আমার তার বেশী সম্বন্ধ নেই।

বাসবী মনে মনে কল্পনার জাল বুনিতে আরম্ভ করিয়াছিল, সে একটু নিরাশ হইল, বলিল—

ও হাঁ—তা বটে।

বাসবীর মুখ দেখিয়া উষ্কা মনে মনে হাসিল। একটু দুষ্টামির সুরে বলিল—

আর একটা খবর জানিস? মহারাজ এখনও বিয়ে করেননি!

বাসবী আবার কুতুহলী হইয়া উঠিল— ওমা সত্যি! একটিও রানী নেই?

একটিও রানী নেই।

বাসবী অমনি জল্পনা শুরু করিল

বোধহয় মনের মত সুন্দরী পাননি তাই বিয়ে করেননি

তা হবে।

বাসবী উল্কার প্রতি ইঙ্গিতপূর্ণ কটাক্ষপাত করিল—

এবার বোধহয় মহারাজের বিয়ের ফুল ফুটবে।

উল্কা বলিল-তাই নাকি! কি করে জানলি?

বাসবী হাসিয়া উঠিল, তারপর উল্কার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলিল

মগধের তরুণকান্তি মহারাজ যদি আমার প্রিয় সখীকে ভালবেসে ফেলেন—আর নিজের রানী করেন তাহলে কিন্তু বেশ হয়! না প্রিয় সখি?

উল্কা অন্য দিকে মুখ ফিরাইল। সহসা তাহার গণ্ডদুটি রক্তিমবর্ণ ধারণ করিল।

***

দুই-তিন দিন পরে।

মগধের রাজসভায় সেনজিৎ সিংহাসনে আসীন। সভাসদগণ নিজ নিজ আসনে বসিয়াছেন। একজন মন্ত্রী রাজার পাশে দাঁড়াইয়া গত অহোরাত্রের প্রধান প্রধান সংবাদগুলি নিবেদন করিতেছেন। সুষ্ঠুভাবে রাজকার্য চলিতেছে। কেবল বটুক ভট্ট সিংহাসনের পাশে নিম্নাসনে বসিয়া সিংহাসনে মাথা রাখিয়া ঘুমাইতেছেন।

সেনজিৎ বলিলেন—আর কোনও সংবাদ আছে?

মন্ত্রী ইতস্তত করিয়া বলিল—আর-ভূতপূর্ব মহারাজ চণ্ড—কোনও অজ্ঞাত ব্যক্তি তাঁকে

সেনজিৎ সংক্ষেপে বলিলেন—শুনেছি।–আর কিছু?

মন্ত্রী বলিলেন—আর বিশেষ কোনও সংবাদ নেই আর্য। শুধু রাজহস্তী পুষ্কর

সেনজিৎ চকিতে মুখ তুলিলেন—পুষ্কর! কী হয়েছে তার?

মন্ত্রী বলিলেন—কাল থেকে পুষ্কর একটু চঞ্চল হয়েছে। তাকে হস্তিশালায় বেঁধে রাখতে হয়েছে—

বটুক ভট্ট পুষ্করের নাম শুনিয়া চক্ষু মেলিয়াছিলেন, এখন সেনজিতের প্রতি কটাক্ষ নিক্ষেপ করিলেন—

উঃ কী দুরন্ত এই বসন্তকাল! হাতিরও মন চঞ্চল হয়েছে!

এই সময় সভাসদগণের মধ্যে একটু চাঞ্চল্য দেখা দিল। তাঁহারা সভায় একটি বিশেষ প্রবেশদ্বারের দিকে যুগপৎ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। সভাধ্যক্ষ রাজপুরুষ দ্রুত দ্বারের অভিমুখে ধাবিত হইলেন। বটুক ভট্ট চকিতে সেই দিকে চাহিয়া সভ্য-ভব্য হইয়া বসিলেন। মহারাজ সেনজিৎও ঘাড় ফিরাইলেন।

উল্কা আসিতেছে। তাহার পরিধানে পুরুষবেশ, কিন্তু রণসজ্জা নয়। পরিপূর্ণ আত্মপ্রত্যয়ের সহিত সদর্পে পা ফেলিয়া সে সভায় প্রবেশ করিল। সভাধ্যক্ষ সসম্ভ্রমে তাহার নিকটে গিয়া বলিলেন

এই যে এদিকে—ইদো ইদো অজ্জা

উল্কা সভাধ্যক্ষের কথা গ্রাহ্য করিল না, একেবারে রাজার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। যুক্তকরপুটে রাজাকে প্রণাম করিয়া সম্মুখ পংক্তির একটি আসনে গিয়া বসিল।

সেনজিৎ হাত তুলিয়া বলিলেন—স্বস্তি।

সভাসদগণ কানাকানি করিতে করিতে অপাঙ্গদৃষ্টিতে উষ্কাকে দেখিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। একজন স্থুলকায় সভাসদ ঘাড় বাঁকাইয়া উল্কাকে দেখিতে গিয়া আসন হইতে পড়িয়া গেলেন। বটুক ভট্ট দেখিলেন—উল্কা যেখানে বসিয়াছে সে-স্থান তাঁহার নিকট হইতে বেশী দূর নয়। তিনি হামাগুড়ি দিয়া সিংহাসনের পশ্চাতে অদৃশ্য হইলেন।

সভাধ্যক্ষ রাজপুরুষ উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিলেন—

মিত্ররাষ্ট্র লিচ্ছবির প্রতিনিধি।

কিছুক্ষণ নীরবে কাটিল। তারপর মন্ত্রী আবার গলা খাঁকারি দিয়া অন্যান্য সংবাদ শুনাইবার উপক্রম করিতেছেন এমন সময় একজন দৌবারিক দ্রুতপদে সভায় প্রবেশ করিল; রাজার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া ত্বরান্বিত স্বরে বলিল—

মহারাজ, বাইরে বড়ই বিপদ উপস্থিত, রাজহস্তী পুষ্কর হঠাৎ উন্মত্ত হয়ে উঠেছে—শিকল ছিঁড়ে সে মাহুতকে পদদলিত করেছে

সভাসদগণ সভায় নিজ নিজ স্থানে দাঁড়াইয়া উঠিলেন।

দৌবারিক বলিল—পুষ্কর এখন সভা-প্রাঙ্গণে ছুটে বেড়াচ্ছে, যাকে সামনে পাচ্ছে তাকে আক্রমণ করছে।

বটুক ভট্ট সিংহাসনের পিছন হইতে গলা বাড়াইলেন—

আরে সর্বনাশ। যদি সভায় ঢুকে পড়ে।

সভাসদেরা আরও ভয় পাইয়া ইতস্তত ছুটাছুটি করিতে লাগিলেন। উল্কা কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত হইল না, নিজ আসনে স্থিরভাবে বসিয়া সেনজিতের আচরণ লক্ষ্য করিতে লাগিল।

সেনজিৎ সিংহাসন হইতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন, হাত তুলিয়া সভাসদগণকে আশ্বাস দিলেন— ভয় নেই, পুষ্কর সভায় প্রবেশ করতে পারবে না। তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো—আমি দেখছি— সিংহাসন হইতে নামিয়া সেনজিৎ দ্বারের দিকে চলিলেন। উদ্বিগ্ন মন্ত্রী রাজার পিছনে আসিতে আসিতে বলিলেন–

আয়ুষ্মন, আপনি কোথায় যাচ্ছেন!

বটুক ভট্ট ছুটিয়া আসিয়া রাজার হাত ধরিলেন—

বয়স্য, ক্ষ্যাপা হাতির সামনে যেও না। পুষ্কর ক্ষেপেছে, এখন তোমাকে চিনতে পারবে না—

সেনজিৎ বটুক ভট্টের স্কন্ধে হাত রাখিয়া মৃদু হাসিলেন।

ছি বটুক, এত ভয়! তোমরা বাতায়ন থেকে দেখ, পুষ্কর এখনি শান্ত হবে।

সেনজিৎ সভার দ্বার উত্তীর্ণ হইয়া প্রস্থান করিলেন। উল্কা আসন ছাড়িয়া বাতায়নের দিকে চলিল।

***

রাজসভার পুরঃপ্রাঙ্গণ। উন্মত্ত রাজহস্তী পুষ্কর বৃংহণধ্বনি করিতে করিতে অঙ্গনময় ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতেছে, তাহার পায়ে শৃঙ্খলের ছিন্নাংশ, গণ্ড হইতে মদস্রাব হইতেছে। মৃত হস্তীপকের। দলিত-পিষ্ট দেহ অঙ্গনের মাঝখানে পড়িয়া আছে। জীবন্ত মানুষ একজনও অঙ্গনে নাই।

সেনজিৎ অঙ্গনে প্রবেশ করিলেন, ধীরপদে পুষ্করের দিকে অগ্রসর হইলেন। সভাগৃহের বাতায়ন হইতে উল্কা রুদ্ধনিশ্বাসে দেখিতে লাগিল। সভাসদগণও অন্য অন্য বাতায়নে দাঁড়াইয়া পাণ্ডুর মুখে। রাজার অনিবার্য মৃত্যুর প্রতীক্ষা করিয়া রহিল।

সেনজিৎ কোমল তিরস্কারের কণ্ঠে ডাকিলেন—

পুষ্কর! পুষ্কর!

মত্ত হস্তী গর্জন করিয়া ঘুরিয়া দাঁড়াইল, তাহার ক্ষুদ্র আরক্ত চক্ষু ঘুরিতে লাগিল। সেনজিৎ কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া তাহার দিকে অগ্রসর হইয়া চলিলেন—

ছি পুষ্কর! দুরন্তপনা করতে নেই।

সভার বাতায়ন হইতে উল্কা নিস্পন্দ স্থিরচক্ষু হইয়া দেখিতে লাগিল। সেনজিৎ পুষ্করের আরও কাছে আসিলেন, পুষ্কর শুঁড় উদ্যত করিল। সেনজিৎ মৃদুকণ্ঠে হাসিলেন।

পুষ্কর! আমাকে চিনতে পারছিস না?

তিনি পুষ্করের গায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন। পুষ্কর একটু দ্বিধা করিল, তারপর শুড় নামাইল।

দুই চোখে অবিশ্বাস-ভরা বিস্ময় লইয়া উল্কা বাতায়ন হইতে দেখিতেছে। সেনজিৎ মৃদুকণ্ঠে পুষ্করের সহিত কথা বলিতে লাগিলেন, পুষ্কর শান্ত হইয়া শুনিল। সেনজিৎ আগে আগে হস্তীশালার দিকে চলিলেন, পুষ্কর দুলিতে দুলিতে তাঁহার পিছনে চলিল। সভাগৃহের বাতায়ন হইতে সভাসদগণের হর্ষধ্বনি ভাসিয়া আসিল।

***

দুই দণ্ড পরে। সভাগৃহ শূন্য হইয়া গিয়াছে, কেবল উল্কা একাকিনী নিজ আসনে বসিয়া আছে।

সেনজিৎ প্রবেশ করিলেন এবং উল্কাকে দেখিয়া বিস্ময়ভরে তাহার দিকে অগ্রসর হইলেন।

এ কি! সভা অনেকক্ষণ ভেঙে গেছে—তুমি এখনও এখানে!

উল্কা উঠিয়া দাঁড়াইল, লজ্জিত নতমুখে বলিল—আপনাকে একটি কথা বলবার জন্যে অপেক্ষা করছি মহারাজ।

সেনজিৎ ভ্রূ বলিলেন—কী কথা?

উল্কা আবেগভরে বলিল—মহারাজ, আমাকে ক্ষমা করুন; আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।

চিনতে পারিনি!

আমি ভেবেছিলাম আপনি নিরীহ—পৌরুষহীন—কিন্তু আজ আমার ভুল ভেঙেছে। আজ যা দেখলাম তা জীবনে কখনও ভুলব না। সাক্ষাৎ মৃত্যুর সামনে এমন অটল নির্ভীকতা—

সেনজিৎ স্মিতমুখে বলিলেন—মৃত্যুকে আমি ভয় করি না উল্কা।

উল্কা উদ্দীপ্তস্বরে বলিল—শুধু মৃত্যুকে! মহারাজ, জগতে এমন কিছু আছে কি—যাকে আপনি ভয় করেন?

সেনজিৎ বলিলেন—আছে বৈকি।

উল্কা অবিশ্বাস-ভরা কৌতুকে প্রশ্ন করিল—সে কী বস্তু মহারাজ?

সে বস্তু—নারী। বলিয়া সেনজিৎ প্রস্থান করিলেন। উল্কার মুখের কৌতুক-দীপ্তি নিবিয়া গেল; সে দাঁড়াইয়া অধর দংশন করিতে লাগিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *