৪. উজ্জ্বল রোদে সারা বুড়িগঙ্গা

উজ্জ্বল রোদে সারা বুড়িগঙ্গা যেন সোনা হয়ে আছে। ঢেউয়ের দোলায় উঠছে পড়ছে নৌকো, ছোট বড় নৌকো। দুপাশের ছড়ানো গ্রাম আর দূরে ঘন গাছের সারি আর খেত মাঠ—-জল রংয়ে আঁকা বিশাল একটা ছবির মত মনে হচ্ছে।

পৃথিবীতে এত আলো আছে, নাসিমা কি তা জানতো?

ছইয়ের পিঠে হেলান দিয়ে, শরীরের নিচে শীতল স্রোত প্রবাহ অনুভব করতে করতে নাসিমার মনে হলো, যে মুখটা ছাইমাখা হয়েছিল এতকাল, আজ হঠাৎ তা ধৌত হয়ে গেছে। পৃথিবী তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে তার এই রৌদ্র দিয়ে। বেবিও পাশের গলুইয়ে চুপচাপ বসে দাঁড় টানা দেখছিল।

দিনের আলোর এমন একটা জয়ী মনোভাব আছে যে রাত্রির সমস্ত চিন্তা, চেতনা আর সিদ্ধান্তকে হাস্যকর করে দিতে চায়। কাল রাতে নাসিমার যে সংলাপগুলো তাকে স্বপ্নের সংকেত এনে দিয়েছিল আজ তা মনে করে লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠছে বারবার বেবি।

নৌকোয় আসবার উদ্যোগটা ছিল নাসিমার।

কতদিন সাঁতার কাটিনি। এখানে সাঁতারের সুবিধে নেই, বেবি?

কি জানি। ভালো পুকুর তো নেই।

নদী? ভাড়া নৌকো মেলে না?

খুব।

তাহলে কাল চল। যাবে?

আজ তাই বেরুনো।

বেবির সঙ্গে সাক্ষাতের পর থেকে নাসিমা আশ্চর্য রকমে কদিন থেকে শান্ত হয়ে আছে। কেবল একটা মুক্তি, একটা পরমপ্রাপ্তি, দীর্ঘকাল ধরে কেবলি বঞ্চনার পর। সেই সুখ হীরে হয়ে আছে নাসিমার সত্তায়।

নাসিমা বাইরের উজ্জ্বল পৃথিবীর সঙ্গে বহুদিন পরে নিবিড় আত্মীয়তা অনুভব করছে আজ। পেছনে কত দূরে ফেলে এসেছে ঢাকা।

বেবি।

বেবি তখন এপাশে এসে বসলো। বসে চলমান দৃশ্যের দিকে মনোযোগী দৃষ্টি করে রইলো। কী ভাবছ?

কই কিছু না। দেখছি।

মিছে কথা। আমি জানি তুমি কী ভাবছ। বলব?

নাসিমা ব্যথা অনুভব করলো বেবি লুকোচ্ছে বলে। আসলে হয়ত বেবি লুকোয়নি কিছুই ওটা নাসিমারই একতরফা ধারণা। বেবির চুলে হাত দিয়ে কাল রাতে মুঠো করে ধরতে ধরতে সে একটা বিয়োগ অনুভব করেছে। তীব্র একটা বিয়োগ। কেন এই ব্যর্থতা? বেবির সমস্ত কিছু সঞ্চিত, উঘাটিত, মিলিত হোক তার অন্তরে। আর কোনো বাধা, কোনো দূরত্ব, কিছুই নয়। এমন কী দুরাশায় তার মনে হয়েছিল বেবি গলে গলে সুধা হয়ে যাক, আমি সেই সুধা পান করবো।

বেবি তার সমস্ত আদর আর প্রশ্নের মুখে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দিয়েছিল। কিন্তু তবু তার মনে হয়েছে, এই মুহূর্তে বেবি কী ভাবছে তা আমি কোনদিনই জানতে পাবো না। কিন্তু কেন? প্রশ্ন করে নি, কেননা, অভিজ্ঞতা তাকে বলেছে আমরা কত কম বলতে পারি, তুলনায় যা আমরা বলতে চাই। আর যদিও বা বলতে পারি, সেই প্রকাশের স্বরূপ কখনোই হয় না যথার্থ। তাই কী লাভ? যদি এমন হতো, যে আমার আপন তাকে কোনো প্রশ্ন না করে শুধু স্পর্শ দিয়ে স্পষ্ট করে জানতে পেতাম তার আত্মার প্রতিটি তরঙ্গ।

একেকটা মানুষ তার শরীরে নিজস্ব একটা পৃথিবী। একটা বিরাট আকর্ষণ তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে নতুন একটা সৌরকক্ষের দিকে—-পরস্পর সেই আকর্ষণ–কেন্দ্র থেকে ধার করা আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতে পারে কিন্তু যে কোনো কোণ থেকে মিলিত হওয়ার বাসনায় জ্বলে ছাই হয়ে শুধু নিশ্চিহ্নই হবে—- আর কিছু নয়। ব্যবধান কি তাই?

নাসিমা আখতার, আমরা কেউ উত্তর দেব না এই প্রশ্নের। একমাত্র যাকে তুমি শ্রদ্ধা জানাতে পারো তা মৃত্যু। একমাত্র যা তুমি অবলম্বন হিসেবে পেতে পারো তা মৃত্যু। একমাত্র যাকে তুমি নির্ভর করতে পারো তা মৃত্যু। আত্মার ভিতরে, পৃথিবীর জ্বলন্ত কেন্দ্রের মত, গুপ্ত, গতিমান মৃত্যুর অমর চক্র।

.

পাড়ে নেমে নাসিমা যেন হঠাৎ ছেলেমানুষ হয়ে গেল। এমন একটা চঞ্চলতা সে অনুভব করল তার শরীরে যা দুরন্ত বাতাসে কাঁপন লাগা পাতার অনুরূপ। নেমেই বলল, কী সুন্দর না?

উত্তরের অপেক্ষা করল না। চঞ্চল চোখে দৃষ্টি করতে লাগল চারদিকে, যেন মুহূর্তের সামান্যতম প্রাপ্তিকেও সে হারাতে চায় না। পায়ের স্যান্ডেল ছুঁড়ে ফেলে বলল, তুমি নাইবে না?

বারে, নইলে এলাম কেন?

বেবিরও তখন সেই লজ্জাটা হারিয়ে গেছে। তার তরুণ মুখ আরক্ত হয়ে উঠেছে রৌদ্রে। কথা বলতে বলতে সে শার্ট খুলে রাখলো। একে একে খুললো ট্রাউজার, ঘড়ি আর মোকাসিন। তারপর সবগুলো জড়িয়ে নৌকোয় ব্যাগের ভেতরে রেখে এলো। নৌকোটা এখান থেকে অনেক দূরে।

নাসিমা পানিতে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর আস্তে আস্তে ডুবতে লাগল তার শরীর। যখন শুধু গলা অবধি জেগে রইলো তখন বেবি দ্রুত দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার পাশে পানি আর রোদ ছিটিয়ে। টুক্ করে নাসিমা কপট বিরক্তিতে সরে গেল দূরে। আর তাকে ধাওয়া করলো বেবি। এক সময়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো দুজনে।

দিনের আলো আর বেবিকে বিব্রত করছে না। অন্য এক পৃথিবীতে কখন সে এসে দাঁড়িয়েছে। হাসতে হাসতে পানিতে হাসিতে একঠায় হয়ে গেছে নাসিমা।

এই বেবি!

নাসিমা একটা চাপড় দেয় কাঁধে আদর করে, কিন্তু মুখরেখায় ফুটিয়ে রাখে শাস্তি দেয়ার একটা প্রকট অভিব্যক্তি।

আমি তোমাকে কোনো মূল্যেই প্রতারিত হতে দেব না, বেবি।

বেবি তখন দ্রুত পানি ঠেলে হাঁপিয়ে তোলে নিজেকে। ফস ফস ডুব দেয় আর মুখ তোলে। বেবিকে আমি এত ভালোবেসেছি যে আমার হৃদয়ে তার কুলান হবে না।

.

পানিতে ভিজে দুজনের মুখ নতুন হয়ে উঠেছে। দুজনকে দেখাচ্ছে যেন দুটো বিরাট মাছ। নাসিমা বেবির পাশাপাশি সাঁতার দিতে থাকে।

বেবি।

উ।

বেবি।

বলো। বলো না?

না, কিছু বলবো না। তোর নাম ধরে শুধু ডাকব। ডাকব?

বেবি কিছু বললো না। এমনকি নাসিমার মুখে কখন যে সে তুমি থেকে তুই–তে রূপান্তরিত হয়ে গেছে তা বুঝতেও পারলো না। শুধু ভাবলো, নাসিমা তাকে এমন করে বেঁধে ফেলেছে যে আর কোনদিন তার বাঁধন থেকে সে মুক্ত হতে পারবে না।

বেবি, তুই দুষ্টু। ভারী দুষ্টু। দুষ্টু, দুষ্টু।

নাসিমা বেবির গায়ে পানি তুলে মৃদু আঘাত করতে করতে আধো চোখ বুজে উচ্চারণ করতে থাকে। আমার সব প্রীতি তোর জন্যে। স্পষ্ট অনুভব করতে লাগল তার হৃদয় পাত্র থেকে কী এক নামহীন তবল আধেয় আস্তে আস্তে নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। আর শূন্যতাটুকু ভরে উঠছে বেদনার মত মধুরতায়।

বেবি যেন পানিতে ভিজে ভিজে ছোট হয়ে যাচ্ছে।

বেবি উঠে এলো। তখনো পানিতে রইলো নাসিমা।

 বেবি তাকে ভুল বুঝবে না। এই বিশ্বাসে এখন তার মন নত হয়ে এলো। বেবিকে সে কিছুতেই হারাতে পারে না। বেবি প্রবীর নয়, আনিস নয়, বেবির জন্যেই যেন সে দীর্ঘকাল মৃত্যুর পর মৃত্যু পার হয়ে এসেছে। বেবি, আমার বেবি।

নাসিমা গা ভাসিয়ে দিয়ে রইলো পানিতে।

মনের সমস্ত জটিল গ্রন্থিগুলো যেন খুলে যাচ্ছে একের পর এক অপরূপ এই শীতলতায়। মনে হলো অনেক ওপরে উঠে গেছে, পৃথিবীর মালিন্য ছাড়িয়ে, বাইরের নিয়মের বর্শা এড়িয়ে ওপরে অনেক ওপরে—-তার নির্মম অহংকার নিয়ে আত্মীয়তায় প্রীত হয়ে উঠেছে তার আত্মা সেই ঊর্ধ্বের সঙ্গে।

শৈবাল লতার মত নাসিমা আখতার শীতল–সবুজ, ভাবনাহীন, প্রয়াসহীন, প্রসারিত, দীর্ঘ, প্রবাহিত, আকণ্ঠ হতে লাগল দুপুরের বুড়িগঙ্গায়।

একটা ছায়ায় বসে প্যাকেট থেকে লাঞ্চ খেলো তারা। দুজনে দুজনার জন্যে এত প্রস্তুত হয়ে উঠেছে যে বড় একটা কথা হলো না এই সময়ে। বেবির মন চলেছে একটা সরল রেখায় নিজের কাছে অস্পষ্ট উৎস থেকে উৎসারিত কৃতজ্ঞতায় সে তখন থেকে বিনম্র, বাকহীন। অন্যদিকে নাসিমা যখন ছায়াটায় এলিয়ে শুয়ে পড়ল আকাশের দিকে মুখ করে তখন তার মনে নতুন একটা রূপ গড়ে উঠছে কোমল আভার মত আস্তে আস্তে।

যে পৃথিবী আমি সৃষ্টি করতে চেয়েছি, তোমার নিষ্ঠুরতায় তা বারবার ভেঙ্গে গেছে। আমি সরে এসেছি। পালানো, শুধু পালানো। থুতু আর কাদার আলপনা ধৌত করে অমলিন হতে পারলাম না—-এড়াতে পারলাম না স্মৃতির নখব। পালানোর শক্তিটুকুও আজ আমার শেষ হয়ে গেছে। এক মুহর্তে যা সত্যি বলে আঁকড়ে ধরি, পর মুহূর্তে তা মিথ্যে হয়ে যায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়।

কেন একেকটা মানুষ হবে অমন নিষ্ঠুর? হয়ত আমাকে মরতে হবে তাই। কিন্তু আগুনে পুড়ে পুড়ে আমি খাঁটি সোনা হতে পারলাম না, হয়েছি ছাই করুণ একমুঠো ছাই। শুধু ছাই। বেবি, তুমি আমার বাহু ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যেও না।

.

আমাকে তোর কী মনে হয়, বেবি?

বেৰি গভীর চোখে তাকিয়ে রইল শুধু। নাসিমা তখন যোগ করল, আমাকে তুই ঘৃণা করবি? —-যেমন সবাই আমাকে করে?

না।

সত্যি। আমাকে দেখে তোর ভয় হয় না?

কেন?

আমি যে অমঙ্গল।

হোক। তুমি আমার মা।

নাসিমার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আলোর মত।

আমার গা ছুঁয়ে বল, সত্যি।

বেবি তাকে স্পর্শ করলো।

প্রথম দিনে মনে আছে তোর? তুই এসেছিলি তোর প্রফেসরকে খুঁজতে। আমি তোকে বসতে বললাম। তোকে দেখে অবধি আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল তুই আমার অনেকদিনের হারানো ছেলে। আমার সন্তান নেই আমার অংশ থেকে জন্ম নিয়েছে যে চেতনা, তুই যেন তার রূপ ধরে সেদিন সন্ধ্যেয় আমার দুচোখ আলো করে এসেছিলি। বলেছিলি তোর মা নেই। মারা গেছেন সেই ক—-বে। আমি যে তোর মা তুই কি তা তখন বুঝতে পারিসনি? আমার দুবাহু আকুল হয়ে উঠেছিল তোকে ধরে রাখবার জন্যে। তুই সেদিন খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলি, না?

নাসিমা যা ভাবছিল তা খানিকটা এমনি। কেবল শেষ কথাটা শব্দ হয়ে গড়িয়ে পড়ল ঠোঁট থেকে। বেবি শুধালো বুঝতে না পেরে, কবে?

কিছু না, বেবি। আমার হাতটা তুই ধরে থাক। বল, আমাকে তুই ফেলে যাবি না।

না, আমি যাবো না। আমি তোমার কাছে থাকব।

বেবি তার দুচোখ দিয়ে নীরবে এই অঙ্গীকার পাঠাল নাসিমাকে।

অনেকক্ষণ পরে নাসিমা বলল, লেখাপড়া শেষ করে বাসা নিতে পারবি না? আমি তখন তোর কাছে এসে থাকব। তারপর বউ আনব ঘরে। সোনার মত বউ।

বেবি লজ্জা পেল।

হ্যাঁ সত্যি, আমি কি মিছে বলছি? আমার কোল ভরে উঠবে তোদের পেয়ে। আমার আর কোনো ভাবনা থাকবে না। এত সুখ কি আমার সইবে, বেবি?

বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল নাসিমা।

বেবি চঞ্চল হয়ে উঠলো।

অশ্রু ঝরে পড়ছে নাসিমা চোয়ালের পাশ দিয়ে, শীর্ণ কণ্ঠনালির দুপাশে। কিন্তু কোনো বিকার নেই সারা মুখে।

বেবি মুছে দিতে চাইলো অশ্রু।

কাঁদছো কেন? এই তো আমি আছি।

আমাকে কাঁদতে দে, বেবি। এ আমার সুখের দিন।

.

তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে, সে টের পেল, মৃত্যু তার মুখ স্পষ্ট করে তুলেছে মনের অন্ধকার জানালায়। রক্তের ভিতর এই টের পাওয়া, ওপর থেকে যা বোঝা যায় না।

ঢাকায় ফিরে যখন এসেছিল তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। নাসিমা বলেছিল এ বেলাও বাইরে খেয়ে, তারপর বেড়িয়ে বাসায় ফিরবে। আসলে, বেবিকে সে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে চায় না। তাছাড়া, মতির মা–র হাসিটুকু তার কাছে বিষ হয়ে আছে কাল থেকে। ক্যাসবা–য় বসে ছিল ওরা। ঠিক তখন এই অনুভব।

বেবির কয়েকজন বন্ধু এসে ঢুকতেই চঞ্চল হয়ে উঠেছে বেবি। নাসিমা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে, এক মুহূর্তে বেবি আর বেবি থাকলো না—-পরিবর্তিত হয়ে গেল তার মুখ। আশঙ্কায় শুধিয়েছে, কী হলো?

কিছু না।

বলে বেবি চোর চাহনিতে তার বন্ধুদের দেখে নেয়।

বেবি কি ভয় পাচ্ছে ওদের দৃষ্টিকে? তুমি কি অনুতপ্ত হচ্ছ, বেবি?

নাসিমা চুপ করে খেতে লাগল। খেতে খেতে টের পেল বেবি তাকে দেখছে মাঝে মাঝে চোখ তুলে। আর তাকাচ্ছে দূরে, যেখানে ওর বন্ধুরা বসে হৈহৈ করছে।

বেবিকে ওরা যখন ডাকলো তখন বুকের স্পন্দন যেন মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল নাসিমার। মনে হলো পায়ের নিচে সিমেন্টে প্রাণ এসেছে—- সরে যেতে শুরু করেছে। নাসিমা জোর করে মেঝেয় পা স্থির রাখতে চেষ্টা করল।

সারাটা গা তার থরথর করে কেঁপে উঠতে চাইলো। আবার সেই মুহূর্তগুলো ফিরে আসছে, মেঝের মোজাইক যেন সরীসৃপের মত কিলবিল করছে। দূরে মেঝের শেষ সীমারেখা সমতল থেকে উঠে যেতে চাইছে ওপরে কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে তার নাম ধরে ডাকছে।

নাসিমা হাতের কাটা শক্ত করে ধরে এত জোরে যে লাগল নিষ্ঠুর দাগ বসে গেল করতলের কোমলে—-প্রাণপণ চেষ্টা করল স্থির হতে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল, না—-না।

স্থির হতে হতে শুনতে পেল বেবির কী একটা কথায় হো হো করে হেসে উঠলো ওরা। হাসিটা তীরের মত লকলক করে কাঁপতে কাঁপতে এসে পড়ে গেল তার টেবিলের ওপর।

বেবি ফিরে এলো।

কী বলল ওরা?

কিছু না।

আমার কথা?

বেবি নীরবে নড করল উত্তরে।

খুব সাধ হলো জানবার জন্যে বেবি ওদের কাছে তার কী পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু বেবি এখন এত একমনে খেয়ে চলেছে যে কোনো কথা সে তাকে শুধোতে পারল না। মনে মনে বলল, আমি জানতাম। তার অভিজ্ঞতা বলল, আমি জানতাম। তার অনেক মৃত্যু কাফন পরে উঠে এসে বলল, আমি জানতাম। সে নিজেকে অনুভব করল দ্রুত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। শিথিল হয়ে আসছে তার মুঠো।

বেবি, আমি তোমাকে শক্তি দেব। কেননা তোমাকে আমি কিছুতেই হারাতে পারি না।

মুখে বলল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, বেবি। কাল তোর যে জুতোটা পছন্দ হয়েছিল, আজ কিনে দেব, টাকা এনেছি।

জুতো কেনবার পর ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বেবি হাতঘড়ি দেখে বলল, রাত স’আটটা বাজে।

তা কী করবি এখন, যাবি?

সারাদিন তো বাইরে।

নাসিমা গলায় জোর এনে একটু দ্বিধার পর উচ্চারণ করে, থাক, যাবিনে এখন। পায়ে লাগছে?

জুতোর দিকে তাকিয়ে নাসিমা শুধোয়।

নাহ। বেশ হয়েছে।

কাল তোর চোখ দেখেই বুঝেছিলাম, পছন্দ করেছিস। আমাকে বলিসনি কেন? বললেই হতো।

তারপর একটু থেমে বেবির দিকে তাকিয়ে মাথা কাত করে বলে, চল একজিবিশনে যাই, যাবি?

সে তো কাল যাবে বলেছিলে।

নাসিমা যেন নিভে গেল।

আজ যাবি না তাহলে?

এই জুতো হাতে নিয়ে?

বেবি আবছা কৌতুকে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। হঠাৎ তার কী মনে হয়, কী একটা নামহীন কষ্ট হয়, বলে, দাঁড়াও দোকানে রেখে যাই। কাল এসে নিয়ে যাবো।

রিকশায় উঠে বসে ওরা। বেবি সিগারেট ধরায়। হুড তোলা আবরণে ওর অন্ধকার মুখ সিগারেটের লাল আগুনে থেকে থেকে জ্বলে ওঠে। মনে হয় জ্বলন্ত তার মুখ।

হাইকোর্টের মোড়ে বিশাল গাছগুলোর অন্ধকারে যখন তারা তখন নাসিমা হাত রাখলো

বেবির পিঠে। বেবি বহুক্ষণ পরে একটা স্বস্তি অনুভব করলো। কী উষ্ণ, চেনা চেনা আর নিবিড় তার হাত। কোন কথা বলল না সে। নাসিমা একটু পর বলল, বেবি, আমার কাছে তুই লুকোবি নে বল।

কী?

ওরা কী বলেছিল?

বলেছিল—-দূর, আমি বলতে পারবো না।

তুই কিছু বলেছিস?

না। কী বলব?

নাসিমা তখন একটা নিঃশ্বাস লুকোলো। অপসৃয়মাণ অন্ধকার আর দূরে দূরে বিজলি আলোর বৃত্তের দিকে তাকিয়ে ভাবল খানিক। তারপর খুব আবছা গলায় বলল, বেবি, মানুষকে আমি চিনি। ওদের স্বভাব শুধু আঘাত করা, আঘাতটাকে উপেক্ষা করতে পারলেই হলো। আর কিছু না। নিজের কাছে যেটা জরুরি মনে হয়, সেইটাই বড়। মানুষ আমাকে কম আঘাত দেয়নি, বেবি। লোকের দেখাটাকে বড় করে দেখলে ঠকতে হয়, নিজের কাছে অপরাধী হতে হয়—- পৃথিবীতে পাপ শুধু এইটেই।

বেবি চুপ করে শোনে। নাসিমা তার নিজেরই উচ্চারণকে বিশ্বাস করবার জন্যে মনে মনে আকুল হয়ে ওঠে।

পালানো, শুধু পালানো। আমার শক্তি নেই তাই বারবার আমি পালিয়ে আসি। মানুষের নিষ্ঠুরতাকে আমি ভয় পাই।

একবার আমি মেরুদণ্ড পেয়েছিলাম—- করাচিতে। কিন্তু মানুষ কত নির্ভরশীল। একটা আনন্দ, কিংবা বেদনা, এমনকি এই শরীরটার জন্যে প্রথমত আমরা জনক–জননীর ওপর নির্ভরশীল। এই দুঃসহ বন্ধনসূত্রকে কেউ কোনদিন এড়াতে পারবে না। নির্ভর করতে হয়েছিল আমাকেও, কিন্তু যার ওপরে আমি সেদিন নির্ভর করেছিলাম সে বঞ্চনা করলো। আমার সে মেরুদণ্ড মোমের মত নত হয়ে এলো সেই বঞ্চনার পর। আমাকে রিক্ত করে দিয়ে গেল।

বেবিকেও হারাতে হবে? শুধু আমি নই, তোমাকেও যে উপেক্ষা করতে হবে—-পারবে না তুমি? নাসিমা স্পর্শ দিয়ে ওকে উপলব্ধি করতে চায়। তার অসীম রিক্ততা প্রাচীন জাহাজের বিশাল পালের মত ফুলে ফুলে উঠতে থাকে তখন। প্রতীক চিহ্নের মত স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে সেই ধূসর থাবা। আছড়ায়। ফেটে পড়বার শক্তিটুকু যেন তার অন্তর্হিত হয়ে গেছে। শুকিয়ে গেছে রক্তের নদী। অতলে, আরো অতলে, নাসিমা। ক্লান্তির কালো চোখের আরো পেছনে।

.

অনেকক্ষণ ধরে ক্লিফটনের বালুতে পা ডুবিয়ে বসে থাকে নাসিমা আখতার। হাতের মুঠোয় দলা পাকানো মণিখালার চিঠি। চিঠিটার কথা এখন আর সে ভাবছে না মোটেই।

এক কাপ কাফির তৃষ্ণায় মন উতলা হয়ে ওঠে। ঘরে ফিরে গেলে নিজে বানিয়ে খাওয়া যেত দুপা সমুখে ছড়িয়ে গান শুনতে শুনতে। কিন্তু এত শীগগীর সে ফিরবে না। ফেরে না কোনদিনই। বরং জওয়াদের কাছ থেকে যতটা দূরে থাকা যায়, ভালো। জীবিকার জন্যে যে চাকরি করা তার, দিনের মেয়াদ শেষ হলে নাসিমা ব্যস্ত হয়ে পড়ে গোটা শহরটা নিয়ে। কোনদিন দোকানে দোকানে শো কেস দেখে কাটায় আবার কোনদিন সমুদ্রসৈকতে মানুষ, একেক দিন আবার উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ায় এ পাড়া থেকে সে পাড়া। জড়িয়ে পরবার ভয়। নেই, হোঁচট খাবার সম্ভাবনা নেই, এতে পাওয়ার বিনিময়ে দিতে হয় না কিছুই। অনেক বড় শহরে হারিয়ে যাওয়ার এই নেশা নাসিমার আজো কাটেনি।

বরং রেস্তোরাঁয় যাওয়া যাক। নাসিমা আখতার উঠে দাঁড়ায়।

রেস্তোরাঁয় বসে বসে মণিখালার চিঠির একটা উত্তর মনে মনে দাঁড় করায়। সেটা খানিকটা এমনি

আমি যখন পড়ানোর এই কাজটা নিয়ে করাচি আসি, তখনো তোমার মত নিইনি—-চাটগাঁয়। গিয়েছিলাম সেও আমার নিজেরই ইচ্ছেয়। তুমি যদি আরো বিশদ করে আমাকে জানতে মণিখালা, তাহলে বুঝতে পারতে, আমি আমার ইচ্ছেটাকে কতখানি শ্রদ্ধা করি। এ সব কথা। বলার উদ্দেশ্য তোমাকে আঘাত করা নয়, তুমি যা জানতে চেয়েছ এ তারই উত্তর।

তোমরা ঠিকই শুনেছ জওয়াদের সঙ্গে আমি আজ কয়েক মাস হলো থাকছি। আমাদের বিয়ে হয়নি। শুনে হয়ত অবাক হবে, বিয়ে হবেও না। আমি ওকে ভালোবাসি না। তবু আছি। শুনে হয়ত আহত হবে, আমাকে ঘৃণা করবে, কিন্তু আমি জানি আমি কী করছি।

তুমি হয়ত প্রশ্ন করবে, তাহলে জওয়াদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কী রকম? আমি যদি এর কোনো নাম দিই তোমরা বলবে বড় বড় কথা দিয়ে কুৎসিত ব্যাপারটাকে ঢাকছি তাই কোনো নাম দেব না। প্রেম মিথ্যে, মণিখালা যাকে আমি প্রেম বলে থাকি।

অনেক তো দেখলাম, নিজেকে নামিয়ে নিতে পারলাম না কিছুতেই। কিন্তু শেষ অবধি আমি তো আমার কাছে সত্যি?

না, মণিখালা, কানে আঙ্গুল দিয়ো না। আমি জওয়াদকে ভালোবাসি না, ওর মনে যদিও বা কখনো জন্ম নিতে চায় ভালোবাসা আমি তাকে নিষ্ঠুর হাতে দাবিয়ে দি। কেননা ওটাকে বাড়তে দিয়ে নিজে কষ্ট পেতে চাই না।

আরো আমার সুবিধে জওয়াদ–এর মাতৃভাষা সিন্ধি, ওর অনেক কথাই আমি বুঝতে পারব না। মনের কথাগুলোকে তাই আমার জন্যেও কখনোই ফেনিয়ে তুলে প্রকাশ করতে পারে না।

আমার সন্তানকে, যদি সে কোনদিন আসে, আমি ভালোবাসতে পারব এই আশা নিয়ে আছি। মিথ্যে প্রেমের মুখোশের জন্য আমার আর কোনো বাসনা নেই।

তোমাদের আমি কিছুতেই বোঝাতে পারব না, আমি কোনো পাপ করছি না। তাছাড়া বোঝানোর মত মনের দীপ্তিও এখন আমার নেই। জওয়াদ এর চেয়ে বেশি কিছু আমার কাছে চায়নি। অত্যন্ত সহজ, সরাসরি ছিল ওর প্রার্থনা। খুশি হয়েছিলাম আমাকে তা–ই নিযে থাকতে দাও। অনেক ভেবে দেখেছি মন আব শরীর, দুটোকে এক করে দেখলেই যত বিপত্তি—-যা আর দশজন দেখে থাকে। বিপত্তির সম্ভাবনা এখানে নেই বলেই জওয়াদকে নিয়ে আমি তোমাদের মুখোমুখি এত নির্ভীক।

আমাকে ভুলে গেলেই ভালো। আমার জন্য কাউকে ভাবতে হবে না। ইতি তোমাদের, নাসিমা।

বেরিয়ে এলো নাসিমা। ঘরে ফিরে দেখল জওয়াদ তখনো আসে নি।

নাসিমা খেয়ে নিয়ে নিজের কামরায় গিয়ে পড়তে বসলো কালকে যা পড়াতে হবে। জওয়াদ ফিরে এলো, টের পেল তাও। ফিরে এসে কোনদিন তাকে সে বিরক্ত করে না।

আজ জওয়াদ দরোজায় নক করলো।

আসতে পারি?

কাজ করছি।

প্লিজ।

এসো, এক মিনিটের বেশি বসতে পাবে না কিন্তু।

জওয়াদ এসে দাঁড়াল ঘরের মাঝখানে। জওয়াদের ভঙ্গিটাই অমনি। কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে বলল, নিঃশ্বাসের উষ্ণতা তার কাঁধের ওপর ছড়িয়ে, আসবে?

না।

জওয়াদ দ্বিতীয়বার আর অনুরোধ করে না। শুধু বলে, মে আই কিস? প্লিজ, জাস্ট এ পেক ডিয়ার।

অলরাইট।

গালের ওপর ঠোঁট চুঁইয়ে জওয়াদ উঠে দাঁড়ায়। বলে, সাম টাইম আই থিঙ্ক আই অ্যাম ইন লাভ উইথ ইউ।

শ–স্–স্। ডোন্ট লাই। নাউ গো ব্যাক, রাইট আউট অফ মাই ডোর।

জওয়াদ চলে যায়। জওয়াদ তাকে বিরক্ত করে না, এর জন্য সে অনেক কৃতজ্ঞ। জওয়াদকে তার সহোদরের মত মনে হয়।

সন্তান সম্ভাবনার কথা জওয়াদ জানতে পেরে অবধি কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে। ভালো করে। তাকাতে পারে না নাসিমার দিকে। নাসিমা মনে মনে কষ্ট পায়, কী হলো তোমার? মনে মনে স্থির করে তখন, জওয়াদকে ছেড়ে সে চলে যাবে। লোকটা যদি বিব্রত হয়ে থাকে, তাকে মুক্তি দেয়াই ভালো। মনে রাখব তাকে, আমার সন্তানের জন্য তার ওপর আমি নির্ভর করেছিলাম। ও যা নেবার নিয়েছে, আমার যা পাওয়ার পেয়েছি। আর কোনো সম্পর্ক না থাকাই ভালো।

চলে যাওয়ার কথাটা স্পষ্ট করে নাসিমা বলার আগেই জওয়াদ বুঝতে পেরেছিল। ক্ষুব্ধ একটা মুখভঙ্গি করে বলেছিল, জানি না কী তোমার হয়েছে। একেক সময় আমার মনে হয় তোমাকে আমার বড় প্রয়োজন। কোনদিন তুমি জানতে চাইলে না আমি তোমাকে ভালবেসেছি কিনা

প্রয়োজন এই শব্দটা তখন বড় সুদূর মনে হয়েছিল নাসিমার, এমন কি এর অর্থটাও যেন তার কাছে স্পষ্ট নয়। আর আরাম চেয়ারে শরীর এলিয়ে দূরে দরোজার কাছে দাঁড়ানো জওয়াদের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল অন্য কোনো মানুষের জন্য এই মানুষটার অনুভূতি সে শুনছে এক পরম আলস্যে। জওয়াদ বলে চলেছে,

—-আমাকে ছেড়ে যেও না। প্লিজ স্টে উইথ মি।

তখন আরো কষ্ট হয়েছিলো লোকটার জন্যে। অনেকদিন পরে নিবিড় করে কারো জন্যে কষ্ট হলো তার। আর সেই কষ্টটা কেমন ছায়া ছায়া, সচকিত।

আজ তার এই আসন্ন পূর্ণতার মুহূর্তে পৃথিবীর কোনো কোণে সামান্যতম কোন বেদনাও অসহনীয়। বলল, অলরাইট। ইফ ইউ ওয়ান্ট মি টু স্টে, আই উইল। ইউ মেড মি ব্রিদ এগেন, আই উড নেভার মেক ইউ আনহ্যাপি। ইয়েস আই উইল স্টে।

কৃতজ্ঞতায় শ্রদ্ধায় যে আমার মন আকণ্ঠ ভরে উঠেছে, জওয়াদ। কোনদিন তুমি জানতে চাওনি, জানবেও না, কেন আমি তোমার ক্ষুধার হাতে একদিন নিজেকে তুলে দিয়েছিলাম। আমার তৃষ্ণার রূপ তুমি কোনদিন বুঝতে পারবে না হয়ত।

আমি তোমাকে আর কাছে আসতে দেব না, দূর থেকে তুমি আমার প্রীতিভাজন হয়ে থাকবে।

জওয়াদ, আমাকে এখন একটু একা থাকতে দাও।

.

কিন্তু স্মৃতি একটা পশুর মত ছড়িয়ে পড়ে নিঃশব্দে, পায়ে পায়ে—-আলোতে, অন্ধকারে, পৃথিবীতে, পৃথিবীর অন্তিমে কোটি কোটি শূন্যতায়।

পৃথিবীতে মানবজন্মের পাওনা কি শুধু থুতু আর কাদা? আঘাতের পর আঘাত নাসিমাকে অদ্ভুত রকমে বিজ্ঞ করে দিয়ে গেছে।

.

সব উঁচু সিঁড়ি থেকে নিচে গড়িয়ে পড়তে পড়তে দুঃস্বপ্নের মত নাসিমার চোখে নেমে এলো জওয়াদের এই কদিন পালিয়ে বেড়ানো, যমকালো মুখ আর কপালের ত্রিশূল। মুখটা অস্পষ্ট হতে হতে অন্ধকার হয়ে গেল। শৈবালের মত থোকা থোকা অন্ধকারে ঢেকে গেল তার সমস্ত চেতনা।

বিকেলে নাসিমাকে জওয়াদ বলেছিল, কতদিন তোমার সঙ্গে বেরোইনি আজ বেরুবে?

এই সামান্য প্রশ্রয় দেয়ার লোভটুকু সে সামলাতে পারেনি। বলেছে, তুমি যদি চাও, বেশতো।

তারপর সেরে নিয়েছে স্বল্পপ্রসাধন। মাতৃত্বের বীজে ফুলে উঠেছে সে। অনেকক্ষণ ধরে শাড়িটা ঠিকমত পরে নিয়ে বলেছে, চল আমি তৈরি।

তারপর একটু ঠাট্টা করবার আগ্রহে কপট কণ্ঠে—- হোয়াই! ইউ লুক লাইক এ নটি বয়, ডিয়ার। ইউ শুড হ্যাভ কম্বড ইওর হেয়ার ডিসেন্টলি অ্যান্ড ইন দোজ ব্যাগি প্যান্টস! হেভেনস্!

জওয়াদ চকিতে নিজের দিকে তাকিয়ে দ্রুত কিন্তু সংক্ষিপ্ত হেসে উঠেছে। আজ কয়েকদিন হলো জওয়াদের হাসিগুলো এমনি সংক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে কেন যেন। বদলে নাসিমা কিন্তু হাসলো তার সারা শরীরে ঝিলমিল তুলে।

তারপর সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি নামতে গিয়ে ওই দুর্ঘটনা।

জ্ঞান যখন ফিরলো তখন বুকের ওপর ঝুঁকে পড়া ডাক্তারের মুখ দেখে চিৎকার করে উঠতে চেয়েছিল নাসিমা। মুখটা প্রথমে মনে হয়েছিল পাথরের ওজনের মত—- নত হয়ে আছে। বিপজ্জনক রকমে সূক্ষ্ম একটা সুতো থেকে। ডাক্তার তখন ডান হাত শূন্যে হাওয়ায় তুলে বলল, ডোন্ট রাইজ, মাদাম।

সেই হাতটা দৃষ্টি দিয়ে অনুসরণ করতে করতে ফিসফিস করে তখন সে উচ্চারণ করেছে, হোয়াই আই অ্যাম হিয়ার, ডক্টর?

ইউ ওয়ার ইল। ইটস অলরাইট নাউ। প্লিজ ডোন্ট টক। ইওর হাজব্যান্ড উইল কাম ইন দ ইভনিং।

আশ্চর্য রকমে কান্নার উৎস আজ তার শুকিয়ে গেছে। মথিত একটি মুহূর্ত অতিক্রম করে রুক্ষ কর্কশ, ফিসফিস কণ্ঠে সে বলল, আই নো ইটস নট অলরাইট, ডক্। ইউ কুড নট সেভ মাই বেবি।

.

জওয়াদ সেদিন বিকেলে আসেনি। এসেছে পরদিন। কিংবা কবে এসেছে তা আজ মনে পড়ে

নাসিমার। শুধু মনে পড়ে রাত্রে •ার্সের দেয়া দুধ মুখে দিয়ে হঠাৎ বিবমিষায় দুচোখে আঁধার দেখতে দেখতে তার আত্মা থেকে এক চিৎকার উঠেছে। তুমি কেন এমন করলে? তুমি কি ভয় পেয়েছিলে আমি তোমাকে নিষ্ঠুর একটা বিপদে ফেলব? তাই কি তোমার মুখোশ ছিল আমাকে ধরে রাখতে? তোমাকে আমি বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম।

নাসিমাকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল জওয়াদ।

.

রাতে নাসিমা উঠে এসে জওয়াদের কামরায় ঢুকলো। জওয়াদ ঘুমিয়ে আছে।

হঠাৎ হাসি পেল নাসিমার ঘুমোনো এই মানুষটার দিকে তাকিয়ে। ঘুমোলে এত অসহায়, এত উদ্যমহীন মনে হয় মানুষকে?

দৃষ্টি থেকে শেষ দ্বীপটি নিমগ্ন হয়ে গেলে থাকে শুধু মৃত্যুর মত বিশাল দিগন্ত। তখন যেদিকেই তুমি যাও, একই। কোনো প্রেক্ষিত নেই, ধ্রুব নেই—- আছে শুধু হওয়া এবং না—- হওয়ার ভয়াবহ মধ্যবিন্দু। হাসলো না নাসিমা আখতার। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুধু। এমন কি জওয়াদকেও সে যেন আর দেখছে না দেখতে পাচ্ছে না। আস্তে আস্তে কেমন অবাস্তব, অস্তিত্বহীন হয়ে আসছে সবকিছু। পেছনে সরে যাচ্ছে। জওয়াদ হঠাৎ চোখ মেলে তাকিয়ে চমকে উঠল ভূগ্রস্তের মত। কী ভীষণ দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করছে!

লাফ দিয়ে উঠে নাসিমার বাহুমূল ধরে ঝাঁকি দিয়ে সে বলল, নাসিমা নাসিমা।

নাসিমা তখনো তেমনি তাকিয়ে আছে। যেন এই স্পর্শ জড়িয়ে আছে কোনো পাথরের গায়ে। তখন ভয় পেল জওয়াদ। ভীষণ একটা ভয়ে তার মুঠো শিথিল হয়ে এলো। ঠিক সেই দম আটকানো মুহূর্তে নাসিমা স্বপ্নের মত উচ্চারণে বলল, ইউ আর অ্যাফ্রেড, লিটল বয়।

জওয়াদ হাত নামিয়ে নিল। মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ল, হোয়াট!

নাসিমা তখন ছেলেমানুষের মত দুহাত নাভিমূলের কাছে মুঠো করে ধরে শরীরটাকে সি সর মত দোলাতে দোলাতে বলল, মাই মাদার কেম টু মি টু নাইট। শি সে আই মাস্ট নট প্লে ইন দ সান। ইট ইজ সামার দেয়ার হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে

—-এভার সিন এ স্লিপিং টপ? মাই বিগ ব্রাদার ক্যান ডু দ্যাট। আই কান্ট। ক্যান ইউ? বাট ইউ আর অ্যাফ্রেড টু নাইট হাউ ক্যান ইউ।

নাসিমা খিলখিল করে হেসে উঠে হঠাৎ ভাবনায় ডুবে গেল। মাথাটা একটু বাঁকিয়ে দৃষ্টি দূরে সরিয়ে, অনেক সুদূরে, কী যেন ভাবতে লাগল।

হোয়াটস দিস ফান?

ইয়েস, বুলি মি—- ইয়েস, গো অন।

জওয়াদ এতক্ষণে তার চোখের তারা থেকে কী যেন আবিষ্কার করতে পারে। দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করতে চায়, ইউ আর নট হিউম্যান।

বলতে পারে না। আমতা আমতা করতে থাকে। এক পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। ভয় করতে থাকে, এ কার সঙ্গে এতকাল সে কাটিয়েছে? আজ নতুন করে যেন তাকে চিনতে পারল। ঠিক চিনতে পারল না, যাকে সে এতকাল চিনত সে বদলে গিয়ে এখন এমন একটা মানুষের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে যাকে সে কোনো দিনই দেখেনি। হঠাৎ নাসিমার মনে হলো লোকটা কালো ভীষণ ভয়াবহ কালো হয়ে যাচ্ছে

লুক হি ইজ অ্যাফ্রেড। নো নো নো।

চিৎকার করে জওয়াদের পায়ের কাছে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেল নাসিমা আখতারের থরথর করে কেঁপে ওঠা শরীর।

.

বেবির হাতের উষ্ণতায় নিজের করতল উত্তাপে রক্তিম করে তুলতে চায় নাসিমা। একজিবিশনে মেরি গো রাউন্ডের দ্রুতচক্র আলোর বিক্ষিপ্ততায় দাঁড়িয়ে নাসিমা আখতার বেবির দিকে তাকিয়ে বলে, আজ রাতে তুই আমার ওখানে থাকবি। কেমন?

লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা
১৯৫৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *