৪. অমিয়া

অমিয়া

‘এই, তোমার নাম কী?’

‘আমার নাম কল্যাণ। তোমার?’

খোকা হেসে লুটোপুটি খায়। হি হি হি হি। হা হা হা হা। তারপর আবার জিজ্ঞাসা করে,

‘এই, তোমার নাম কী?’

‘আমার নাম কল্যাণ। তোমার?’

খোকা আবার হেসে গড়াগড়ি যায়। হো হো হো হো। তারপর আবার সেই প্রশ্ন—

‘এই, তোমার নাম কী?’

‘আমার নাম কল্যাণ।’ সোম হাল ছাড়ে না। ‘তোমার?’

‘আমার নামও কল্যাণ।’ খোকা দাঁত বের করে চোখ অর্ধেক বুজে আধো আধো ভাষায় বলে।

সোম তাকে কোলে টেনে নিয়ে আদর করে। বলে ‘আমাদের দু-জনের এক নাম। না?’

‘হ্যাঁ। তোমার বাবার নাম কি কুণাল?’

সোম এই লজিকের কাছে হার মানল। বলল, ‘না।’

তখন খোকা জিজ্ঞাসা করল, ‘তবে তোমার নাম কল্যাণ হল কেন?’

এর আর উত্তর হয় না। সোম বলল, ‘তুমিই বলো না, আমার নাম কল্যাণ হল কেন।’

খোকা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ভাবল। জানালা দিয়ে দেখল একটা পায়রা। ভাবনা ভুলে দৌড়ে পালিয়ে গেল, ‘ধর ধর’ করতে করতে।

‘ওহে তোমার ছেলেটা তো ভয়ানক তুখোড়।’ কুণালকে ঘরে ঢুকতে দেখে সোম বলল, ‘প্রথমে আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিল, তারপর আমাকে লজিকে হারিয়েদিল।’

পুত্রের কৃতিত্বে কুণাল বিনীতভাবে গৌরব বোধ করল। বলল, ‘আগে এক পেয়ালা খাও। ওর দুষ্টুমির গল্প অষ্টাদশ পর্বেও শেষ হওয়ার নয়, ধীরে ধীরে শুনো পরে।’

আদর্শ স্বামী। স্ত্রীর শ্রমলাঘব করবার জন্য একটা আস্ত ট্রে বয়ে এনেছে—ওর মতো ক্ষীণকায় ব্যক্তির পক্ষে ওই এক গন্ধমাদন।

ললিতা এল খাবার হাতে করে। সে কত কী তৈরি করেছে। সমস্ত তার নিজের হাতের। সোম বলল, ‘জানো ললিতা, তোমার ছেলেটা কী সাংঘাতিক সেয়ানা। ও ছেলে বড়ো হলে মোক্তার হবে দেখো।’

‘হুঁ।’ ললিতা অভিমান করে বলল, ‘সেই আশীর্বাদ কোরো। মোক্তার! মোক্তার না দারোগা!’

‘কেন, মোক্তার পছন্দ হল না? কুণাল যদি মাস্টার না-হয়ে মোক্তার হত তাহলে কি তুমি তাকে নিরাশ করতে?’

‘যাও!’ ললিতা ধমক দিয়ে বলল, ‘খাও, খাও, বিলেতফেরতা বক্তিয়ার। বাপ মোক্তার হলে ছেলের উকিল হওয়া উচিত। বাপ উকিল হলে ছেলের ব্যারিস্টার হওয়া দরকার।’

কুণাল ফোড়ন দিল, ‘নইলে এভল্যুশন কিসের?’

‘সত্যি।’ ললিতাটা স্বভাবত সিরিয়াস। বলল, ‘মেয়ে বি এ পাস হলে লোকে খোঁজে জামাই আই সি এস। কেন?’

‘ওটাও কি হল এভল্যুশন?’ বলল সোম।

‘নিশ্চয়। পারিবারিক মর্যাদার এভল্যুশন।’ তারপর কী মনে করে ফিক করে হাসল। বলল, ‘ভবনাথবাবু যে এ বাড়িতে ধন্না দিতে দিতে ‘ভবধাম’ ছাড়তে বসেছেন, তাঁর একটা গতি করো।’

‘বাস্তবিক’ কুণাল ইতস্তত করতে করতে বলল, ‘তোমাকে বলতেও কেমন-কেমন লাগে, অথচ একই প্রোফেশনের লোক, আমাদের অল বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের পান্ডা।’

‘আমি জানি,’ সোম গম্ভীরভাবে বলল। ‘ভবনাথবাবু বাবাকেও চিঠি লিখেছেন। কী যেন তাঁর মেয়েটির নাম?’

‘অমিয়া।’

‘হ্যাঁ, অমিয়া, অমিয়ার একখানি ফোটোও পাঠিয়েছেন!’

‘তাহলে,’ ললিতার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘বলো তোমার পছন্দ হয়েছে কি না। হুঁ, হুঁ, বলতেই হবে।’

‘হায়।’ সোম কপট ক্ষোভ ব্যক্ত করল, ‘এই তো দুনিয়ার রীতি। তোমরা বিয়ের আগে পুরো দু-বছর প্রেম করলে। আমাদের কি প্রাণে সাধ আহ্লাদ নেই, রস কষনেই?’

ললিতা ভুরু কপালে তুলে বলল, ‘হয়েছে। ভবনাথবাবুর মেয়ের সঙ্গে প্রেম। জানো, ও বাড়িতে একখানা মাসিকপত্র পাবার জো নেই? পাঠ্যপুস্তক ব্যতীত বইও যদি পাও তবে সে স্বামী বিবেকানন্দের বই।’

‘ভবনাথবাবুর,’ কুণাল তার স্বাভাবিক নম্রতার সহিত বলল, ‘ডিসিপ্লিনেরিয়ান বলে নামডাক আছে। আর-এক যুগের মানুষ। এ কালের মহাস্বাধীন ছাত্ররাও তাঁর চোখের দিকে তাকালে একেবারে ভিজেবেড়ালটি।’

‘অথচ,’ সোম বলল, ‘এই ভবনাথবাবু মেয়ের বিয়ের জন্যে তাঁর প্রাক্তন ছাত্রবয়সির বাড়িতে ধন্না দিতে ইহধাম ছাড়তে বসেছেন।’

‘ইহধাম নয় গো।’ ললিতা শুধরে দিয়ে বলল, ‘ভবনাথবাবুর বাড়ির নাম ‘ভবধাম’। তাই ছাড়তে বসেছেন।’

সোম সশব্দে হেসে বলল, ‘বুঝেছি। তুমি একটা pun দিয়েছিলে! খোকার উপযুক্ত মা,’ ললিতা এতে পুলকিত হয়ে সোমের পাতে আরও পাঁচখানা লুচি তুলে দিল।

‘করো কী! করো কী!’

কিন্তু কে কার কথা শোনে।

‘স্কুলের বই লিখেই,’ কুণাল বলল, ‘ভবনাথবাবু তিন তিনটে ভবধাম বানিয়ে ফেললেন—কলকাতায়, পুরীতে, দার্জিলিঙে।’

‘ভেবে দেখ, কল্যাণদা,’ ললিতা বলল, ‘অমিয়াকে তিনি একটা-না একটা বাড়ি দেবেনই। বাকি দুটোতেও তুমি বিনা ভাড়ায় থাকতে পারবে। ভবধামে যত দিন আছো বাড়িওয়ালাকে খুব ফাঁকি দিলে। আর আমরা,’ সে মাথা দুলিয়ে সহাস সকরুণ স্বরে বলল, ‘আমরা তো ভগবানের চেয়ে ওকেই বড়ো বলে মানি। যেহেতু ভগবান যদি অবতাররূপে কলকাতায় বাসা করেন তাঁকেও বাড়িওয়ালার গঞ্জনা শুনতে হবে।’

‘তা হলে,’ সোম বলল, ‘দাঁড়ায় এই যে বাড়িওয়ালাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যে বাড়িওয়ালা শ্বশুর চাই। শ্বশুরকন্যার প্রেম সংসারী মানুষের পক্ষে অনাবশ্যক।’

‘প্রেমিক প্রেমিকাকে,’ ললিতা বলল, ‘রেল কোম্পানি কনসেশন টিকিট দেয় না, গয়লা দেয় না খাঁটি দুধ, মুদি তাগাদা দিতে ছাড়ে না, ধোপা ছাড়ে না তাগাদা দেওয়ার কারণ দিতে। রোগবীজাণুরা তেমনি আশ্রয় করে, পাগলা কুকুরে তেমনি তাড়া করে, মোটরওয়ালা তেমনি চাপা দেয়।’

সোম কুণালকে ফিস ফিস করে অথচ ললিতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, ‘বিয়ের পর ললিতা বিজ্ঞ হয়েছে দেখতে পাচ্ছি। আগে হলে বিয়েই করত না, অন্তত তোমাকে।’

‘যাও,’ বলে ললিতা গোসা করে থালা ও ট্রে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

খবর পেয়ে ভবনাথবাবু স্কুল থেকে ‘ভবধামে’ ফিরলেন না, সোজা এলেন সোমকে দেখতে।

রাশভারী মানুষ। আধখানা কথা মুখে রাখেন। বললেন, ‘দেখে এলে?’

সোম বলল, ‘আজ্ঞে?’

‘ইউরোপ দেখে এলে?’

‘আজ্ঞে।’

‘কোনটা ভালো? ওদেশ না-এদেশ?’

‘আজ্ঞে এদেশ।’

‘ঠিক বলেছ।’ যেন ক্লাসে ছাত্রের উত্তর শুনে পিঠ চাপড়ে দিলেন। ‘ঠিক। কেন এদেশ ভালো? (যেহেতু) এদেশ আমাদের দেশ। ‘এই দেশেতেই জন্ম (আমার) এই দেশেতেই মরি!’ ‘কোন (বিষয়ে) অনার্স?’

‘ইংরেজিতে।’

‘বেশ, বেশ। আমার অমিয়াও সেই (বিষয়ে) অনার্স। ভালো মেয়ে। রাঁধতে জানে। (কী কী) খেতে ভালোবাসো?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। খেতে ভালোবাসি।’

‘(কী কী) খেতে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। খেতে আর শুতে।’

তিনি বিষম কটমট করে তাকালেন। ‘কী বললে? (আবার) বলো।’

‘আজ্ঞে, খেতে ভালোবাসি।’

‘কী খেতে?’

‘চানাচুর।’

‘চানাচুর? রোসো, (অমিয়াকে) জিজ্ঞাসা করে দেখি। চানাচুর? (রোসো) জিজ্ঞাসা করে দেখি। আর কী (খেতে ভালোবাসো)?’

‘আলুর দম।’

‘হুঁ! ওদেশে মেলে না। আলুর দর কী রকম?’

সোম মুশকিলে পড়ল। কোনোদিন আলু কেনেনি। বলল, ‘একটা এক পেনি করে।’

‘পেনি তো আনা। এত!’

‘আজ্ঞে।’

‘ওদেশ ভালো নয়। Plain living নেই। (সুতরাং) High thinking নেই।’

সোম মনে মনে বলল, তাই কেউ Translation ও Essay Writing-এর বই লিখতে পারে না।

ভবনাথবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এরোপ্লেন?’

‘এরোপ্লেন কী? দর কত?’

‘না। চড়েছ?’

‘আজ্ঞে না।’

‘আহা (ওটা) বাকি রেখে এলে!’

‘হবে একদিন।’

‘না, না। বিয়ের পরে (হতে) পারে না। Crash করলে (বউ বিধবা হবে)।’ ভবনাথবাবু চিন্তা করে বললেন, ‘গান?’

‘আজ্ঞে।’

‘ভালোবাসো?’

‘আজ্ঞে।’

‘অমিয়া (গান) জানে। শ্যামা সংগীত। ওর নাম কী? ওই মুসলমান?’

‘কোন মুসলমান?’

‘ইসলাম। …নজরুল ইসলাম। ওর গান—(ভবনাথবাবু ঘাড় নাড়লেন)।’

‘কেন?’

‘কেন আবার? মুসলমান। গানেন অর্ধভোজনং। কে জানে কী খায়!’

সোম মনে মনে বলল, আমিও তো ওদেশে ও জিনিস খেয়েছি। অতি উপাদেয় গব্যপদার্থ, পঞ্চগব্যের অতিরিক্ত ষষ্ঠ গব্য। শুনেছি স্বামীজিও খেতেন।

এতক্ষণ কুণাল চুপ করে ছিল। মানুষটি সে মুখচোরা, কুণো, সংকোচশীল। ভবনাথবাবু তাকে বললেন, ‘একে (নিয়ে) একদিন আমাদের ওখানে (এসো)।’

‘যে আজ্ঞে।’

‘তোমার স্ত্রীও (আসুন)।’

‘তাঁকে বলব।’

‘আর সেই বাচ্চাটা (কোথায়)? (তাকে তো) দেখছিনে?’

‘খেলা করছে।’

‘উঁহু। (সব সময়) খেলা ভালো নয়। একটু একটু এ বি সি ডি শিখুক।’

‘মোটে তিন বছর বয়স।’

‘বলো কী! তিন বছর নষ্ট করেছে।…আচ্ছা উঠি! কাল রাত্রে ওখানেই (খাওয়াদাওয়া) হবে। আসি।’ তিনি নমস্কারের প্রতিনমস্কার করলেন।

ভবনাথবাবু প্রস্থান করলে ললিতা ছুটে এল। ‘কি কল্যাণদা। শ্বশুর পছন্দহল?’

‘শ্বশুরের পছন্দ হল কি না তাই ভাবছি।’

কুণালের মুখ ফুটেছিল। সে বলল, ‘ভয় পেয়ে গেছো তো?’

‘ভাবছি এই বাঘার সঙ্গে ইয়ার্কি খাটবে না। দাশুবাবুকে যা করে রেখে এসেছি আর সত্যেনবাবুকেও করেছি যেমন জব্দ!’

ললিতা ও কুণাল একত্রে জিজ্ঞাসা করল, ‘সে কেমন?’

সোম বলল সমস্ত কথা। শুনে ললিতা বলল, ‘অমন একটা পণ করা সংগত হয়নি। ও যে ভীষ্ম হবার পণ!’

‘কিন্তু তুমিই বলো, কুণাল যদি দুশ্চরিত্র হত ও তুমি যদি না-জেনে তাকে বিয়ে করতে, তবে কি তোমাদের অহরহ মনে হত না যে তার চেয়ে ভীষ্ম হওয়া ছিল ভালো।’

কুণাল লজ্জিত ও ললিতা কুপিত ভাবে পরস্পরের দিকে তাকাল। যেন ‘যদি’ নয়, সত্যি। তারপর ললিতা শুষ্ক হাসির সঙ্গে বলল, ‘তবু ভীষ্ম হবার চেয়ে সেভালো।’

‘কিন্তু কে চায় ভীষ্ম হতে। আমি আমার মনের মতো স্ত্রী পেলে রূপগুণ নির্বিচারে তৎক্ষণাৎ বিয়ে করি। প্রেমফ্রেম বাজে—কেবল সময়ক্ষেপ ও হৃদয়যন্ত্রণা।’

এবার প্রেমের পক্ষ নিয়ে ললিতা লড়াই করল। তখন সোম বলল, ‘তুমি তো বলেছ প্রেমিক প্রেমিকা God’s chosen people নয়, রেল কোম্পানি তাদের কনসেশন টিকিট দেয় না ইত্যাদি।’

‘কিন্তু,’ ললিতা বলল, ‘তুমিও তো বলেছো তোমার প্রাণে কি সাধ আহ্লাদ নেই, রস কষ নেই। তুমি দেখছি ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদলাও।’

‘যাক,’ কুণাল থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঝগড়া করে কাজ নেই। ভবনাথবাবু প্রেমেরও বিরোধী, পণেরও। কল্যাণ ওঁর কাছে কথাটা কীভাবে পাড়ে তাই দেখব আমরা।’

পরদিন ভবনাথবাবু তাঁর একমাত্র জীবিত পুত্র মনুর হাতে তাঁর স্বরচিত গ্রন্থের এক সেট উপহার পাঠালেন। একখানির নাম, Intelligent Children’s Guide to English Grammar and Idiom. তার ভূমিকায় আছে, ‘The author begs to acknowledge with fervent appreciation the labour of love bestowed by his beloved eldest daughter Miss Amiya Bose, B A student…’

আর একখানির নাম, 1000 Unseen Passages by Bhabanath Bose, B A Headmaster of…Institution (29 years’ experience), author of … (২৯ খানা কেতাব) and Miss Amiya Bose, B A (Hons).

তৃতীয় একখানা বইয়ের নাম Easy Conversations at Home and School. সেটার উৎসর্গ পত্র এইরূপ—‘To my dutiful eldest daughter Miss Amiyakana Bose on her passing the Matriculation Examination in the First Division.’

এতদিন যে সোম অমিয়কণার মতো বহু বিজ্ঞাপিত পাত্রীর পরিচয় পায়নি এই এক আশ্চর্য। এক Intelligent Children’s Guide-এরই ইতিমধ্যে ৭০০০ খানা বিক্রি হয়েছে। মনু বলল, ‘লোকে স্বদেশি পেলে বিদেশি কিনবে কেন? Nesfield-এর দফা রফা। ম্যাকমিলান বাবাকে কত offer করেছে জানেন?’

শুনে সোম মনুকে একটা সিগ্রেট offer করল। মনু কি তা নিতে পারে! ভবনাথবাবু জানতে পারলে তার দফা রফা। সোম বলল, ‘আমি কি আপনার বাবাকে বলতে যাচ্ছি? নিলেন, খেলেন, ফুরিয়ে গেল।’ একজন বিলেতফেরতা তাকে সমকক্ষ ভেবে সিগ্রেট নিতে বলছেন, গৌরবে তার বুক ফুলে উঠেছিল। সে একটা নিল, নিয়ে টান দিতেই তার মাথা ঘুরে গেল নেশায় এবং দম্ভে। দু-দিন পরে হয়তো এঁরই শালা হবে, খাতির করে কথা বলবে কেন? সে যা-তা বকতে শুরু করে দিল। সোমও তাকে প্রশ্রয় দিল। জিজ্ঞাসা করল, ‘অমিয়কণা আপনার বড়ো, না?’

‘হ্যাঁ—বড়ো। দেড় বছরের বড়ো আবার বড়ো। ওর নাম অমিয়কণা কবে হল? সে আমার জন্মের বহু পরে।’

‘কী রকম?’

‘ওকে আমরা টুলী বলেই ডাকতুম। যদিও ভালো নাম শুভঙ্করী। স্কুলে নাম লেখাবার সময় হেড মিসট্রেস বললেন, ও নাম রাখলে কেউ বিয়ে করবে না। তিনিই নামকরণ করলেন অমিয়কণা। তারপর সে নাম সংক্ষেপ করা হয়েছে, আজকাল আবার লম্বা নাম কেউ পছন্দ করে না।’

‘লম্বা নাকের মতো।’

‘হ্যাঁ—যা বলেছেন। আমার নাম ছিল জগদানন্দ বসু। আমি ওটাকে ছেঁটেকেটে করেছি জগদা বসু। তবু সকলে আমাকে মনু বলেই ডাকে।’

‘আমি কিন্তু জগদা বলে ডাকব।’

‘সৌভাগ্য!’

‘দেখুন জগদাবাবু, আপনি তো ধরতে গেলে আমার বন্ধুই—কেমন?’

‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। আপনি আমার Only best friend, মাইরি।’

‘নিন, আর একটা সিগ্রেট নিন। ‘না’ বলবেন না। বিলিতি নয়, ইটালিয়ান! অনেক যত্নে এনেছি কাস্টমস-এর চোখে ধুলো দিয়ে।’

মনু শ্রদ্ধায় ভক্তিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘তাহলে দিন। আপনার মতো বন্ধুর মহার্ঘ দান মাথায় করে নিই।’

সোম মনুর কানের কাছে মুখ নিয়ে সুর নামিয়ে বলল, ‘দেখুন জগদাবাবু, জগদাবাবু কেন বলি, জগদা, বন্ধুর জন্যে একটা কাজ করে দিতে হবে।’

জগদা তড়িৎস্পৃষ্টের মতো কান সরিয়ে নিল। পরমুহূর্তে কানটা আরও একটুখানি ঝুঁকিয়ে ব্যগ্রভাবে বলল, ‘হুকুম করুন।’

‘দেখ,’ সোম ইতস্তত করে বলল, ‘তোমাকে আমি বিশ্বাস না-করলে একথা বলতুম না।’

‘আমি শপথ করছি,’ জগদা দুই চোখে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, ‘যদি বিশ্বাস রক্ষা না করি তবে আমার দুই চোখ—হ্যাঁ, দুই চোখ কানা হয়ে যাবে।’

‘ছি, ছি,’ সোম বলল ‘শপথ কে চায়? মনের জোর।’

‘হ্যাঁ! মনের জোরে আমার সঙ্গে ক-জন পারে। জানেন আমি একটা ভূতুড়ে বাড়িতে তিন রাত ছিলুম। তেরাত্রিবাসের পর আমার চেহারা যা হয়েছিল, যদি দেখতেন তবে আমাকেই ভূত বলে ঠাওরাতেন।’

‘বেশ, বেশ। অমনি মনের জোর চাই।’ কিছুক্ষণ পরে সোম বলল, ‘আজ আমি আপনাদের ওখানে যাচ্ছি। আপনার দিদিকে দেখব। কিন্তু শুধু দেখলে তো হবে না। একটু কথাবার্তা কওয়া দরকার তাঁর সঙ্গে।’

‘এই কাজ! আচ্ছা, আমি—’

‘না, অত সোজা নয়। আমি চাই নির্জনে কথা বলতে। ঘরে অন্য কেউ থাকবে না, বাইরেও কেউ আড়ি পাতবে না।’

মনুর মুখ শুকিয়ে সরু হয়ে গেল। সিগ্রেট খসে পড়ল তার দুই আঙুলের ফাঁক দিয়ে। বাড়ি তো ওর নয়, বাড়ি ওর বাবার, ওর মা-র। তাঁদের কাছে কেমন করে অমন প্রস্তাব করবে? দিদিকে বলতে পারে, কিন্তু দিদিও তো মালিক নয়।

সোম বলল, ‘কি ভাই, পারবে না?’

‘আমাকে মাফ করবেন,’ জগদা অত্যন্ত কাতরভাবে বলল। ‘আমাদের বাড়িতে আশ্রিত অভ্যাগত নিয়ে ষোলো-সতেরো জন মানুষ, নিভৃত স্থান কোথায় পাব? তা ছাড়া who is to bell the cat?’

সোম ভেবে বলল, ‘আচ্ছা এমন হয় না? আমার বন্ধু ও তাঁর স্ত্রী যদি তোমাকে ও তোমার দিদিকে নিমন্ত্রণ করেন তোমরা আসবে?’

‘আমরা তো আসতে উৎসুক ও উদ্যত। কিন্তু বাবা বলেন,’ মনু চুপি চুপি বলল, ‘এঁদের বিবাহ অসিদ্ধ। এঁদের একজন বামুন, আর একজন কায়স্থ। এঁদের সন্তান হচ্ছে বর্ণসংকর, দোআঁশলা। এঁদের বাড়ি নিমন্ত্রণ অসম্ভব।’

সোমের ক্রোধে বাগরোধ হল। নিমন্ত্রণ গ্রহণ অসম্ভব! সোম লক্ষ করেছিল যে ভবনাথবাবু চা ছুঁলেন না। অথচ নির্বিকারমুখে নিমন্ত্রণ করে গেলেন। নিমন্ত্রণ গ্রহণ অসম্ভব। অথচ দৌড়াদৌড়ি, ধরাধরি, ধন্না—এসব সম্ভব। ওঃ! এই ভবনাথটাকেও শিক্ষা দিতে হবে দাশরথি ও সত্যেনের মতো।

‘আচ্ছা, তা হোক,’ সোম বলল, ‘নিমন্ত্রণ গ্রহণ নাই করলে। এমনি বেড়াতে আসতে দোষ কী? এই যেমন তুমি আজ এসেছ?’

‘তাও,’ মনু বলল, ‘আপনার জন্যে। কিন্তু আপনার জন্যে দিদি তো আসতে পারে না।’

সোম বলল, ‘হুঁ’।

অনেক ভেবে সোম একটাও ফন্দি বের করতে পারল না। মনুকে বলল, ‘আচ্ছা, ভাই জগদা; আমার জন্যে তোমার দিদি না আসুন, তুমি কিন্তু এসো কাল এইসময়।’

‘গুড ইভনিং, নমস্কার। এই যে, আসতে আজ্ঞা হোক,’ বলে যে সুপার-ভদ্রলোকটি সোমাদিকে অভ্যর্থনা করলেন, তাঁর নাম দ্বিজদাসবাবু, ভবনাথবাবুর কনিষ্ঠ। হাসিখুসি মানুষটি, বাঁটোয়ারায় তাঁর ভাগে পড়েছে হাসি আর তাঁর দাদার ভাগে পড়েছে রাশি অর্থাৎ রাশভারিত্ব। ‘আসুন, এইখানে বসুন। আহা, ওখানে কেন, এখানে। হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ। ডাবের জল খাবেন, না ঘোলের শরবত খাবেন? হলই বা শীতকাল। হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ। কিছু খাবেন না, তা কি হয়! এক পেয়ালা চা? চা যেকোনো সময় খাওয়া যায়, বাড়িতে খেয়ে এসেছেন বলে এখানে খাবেন না, ও কি একটা কথা হল কুণালবাবু?’

সোমের বন্ধু বলে কুণালেরই খাতির বেশি। ভবনাথবাবুদের ধারণা কুণাল যা বলবে সোম তাই করবে। কুণালের পছন্দ নিয়ে সোমের পছন্দ। তাই কুণালকে খামোখা দুটি ছোটো মেয়ে দুই পাশ থেকে দুই সখীর মতো পাখা করতে শুরু করে দিল। হিমেল হাওয়া লেগে সে বেচারার ইনফ্লুয়েঞ্জা হবার দাখিল। এমনিতেই তো রোগা মানুষ। পড়ে পড়ে চোখদুটির মাথা খেয়েছে, অশোকপুত্র কুণালের মতোই অন্ধ—চশমা খুলেনিলে।

সোমাদি যেঘরে বসলেন সেটার সিলিং ছাড়া কোনোখানে একটুও ফাঁক ছিল না। দেয়ালে দেয়ালে লম্বমান ফোটো, পট তৈলচিত্র ভবনাথপরিবার, দশমহাবিদ্যা, অমিয়কণা, স্বামীজি, পরমহংসদেব, দিল্লি দরবার, আশুতোষ মুখুজ্যে, মহাত্মা গান্ধী ইত্যাদি ইত্যাদি। নতুন ধুতির উপরে মিলওয়ালাদের নামাঙ্কিত যে সব দেবদেবীর ছবি থাকে সেগুলিও বাদ যায়নি। মেজের উপর একটি বৃহৎ পালঙ্ক—ভবানাথবাবুর বিবাহের। সেটি বোধ হয় অমিয়কণার বিবাহের যৌতুক হবে। আলমারি সিন্দুক বাক্স প্যাঁটরা ইত্যাদি ছাড়া টেবল চেয়ার তো আছেই, নইলে সোমাদি বসবেন কেমন করে? একটুখানি জায়গায় একটা ফরাশ পাতা ছিল। তার উপর ছিল একটি হারমোনিয়াম।

সোম ললিতার কানে কানে বলল, ‘এই বাড়ির জামাই হলে বাড়িভাড়া বাঁচতে পারে, কিন্তু প্রাণ বাঁচবে বলে বোধ হচ্ছে না।’

ললিতা সোমের কানে কানে বলল, ‘প্রাণের যিনি অধিক তিনি যদি থাকেন তবে প্রাণ গেলে ক্ষতি কী!’

ভবনাথবাবু তাঁর গৃহিণীকে ও অপরাপর কন্যাদেরকে চালন করে আনলেন, কেবল অমিয়া রইল রিজার্ভে। এঁদের সবাই কুণালকে ও ললিতাকে নিয়ে ব্যস্ত, সোমের প্রতি দৃষ্টি নেই কারুর। বেচারা সোম অভিমানে রাঙা হয়ে উঠল। ভাবল, কে এ বাড়িতে এই মুহূর্তে সর্ব প্রধান মানুষ? কে এই সংবর্ধনার নায়ক? কার একটা হাঁ কিংবা না-র উপর এদের আয়োজনের সার্থকতা অথবা ব্যর্থতা নির্ভর করছে? সে আমি।

ওরা সকলে মিলে কুণালকে ও ললিতাকে সমস্তক্ষণ কথা কওয়াল। বেচারা কুণাল যতবার বলে, ‘কল্যাণ যে বকোমধ্যে হংসোযথা হয়ে রইল, বকবক করছি বলে আমরা যেন বক,’ সোম ততবার একটা রহস্যময় হাসি হাসে। প্রীতিকণা, জ্যোতিঃকণা, নীহারকণারা তা দেখে চমৎকৃত হয়। ভবনাথবাবু বলেন, ‘কুণালবাবু, আপনার উপর এ বাড়ির যা কিছু আশাভরসা। (আপনি কল্যাণের) অভিন্নহৃদয় বন্ধু।’

ভবনাথের ভবার্ণবের তরণী বলেন, ‘ললিতা মা থাকতে আমি তো একরকম নিশ্চিন্ত হয়ে আছি। তোরা কেউ নিয়ে যা তো খোকামণিকে; ও ঘরে সমস্ত সাজানো রয়েছে, যেটা ওর পছন্দ হয় সেইটে ওর হাতে দে। যাবে না? মামণিকে ছেড়ে যাবে না? চলো তা হলে তোমার মাকেও নিয়ে যাই। এসো মা ললিতা, গরিবের বাড়িতে যখন পা দিয়েছ তখন দেখতে হবে সমস্ত।’

মনু কোথায় গেছল। এসে সোমের পিছনে দাঁড়িয়ে সোমের চোখ টিপে ধরল। ভবনাথবাবুর তা দেখে চোখ উঠল টাটিয়ে। তিনি তো জানতেন না যে মনু সোমের বন্ধু। বাবা যে ওখানে বসেছেন, তাড়াতাড়িতে মনুর ওদিকে নজর পড়েনি। সে যেন হঠাৎ সাপ দেখে লাফ দিয়ে পালাল। সোম পিছন ফিরে দেখল কেউ নেই। সে একটু আশ্চর্য হয়ে কার্যকারণ অনুধাবন করল।

দ্বিজদাসবাসু চায়ের তত্ত্ব নিচ্ছিলেন। ভৃত্যকে বললেন, ‘রাখ, ব্যাটা, ওখানে রাখ। ব্যাটা উল্লুক। সাতদিন ধরে ট্রেনিং দিচ্ছি, বিলেতফেরত জেন্টলম্যানকে কেমন করে চা দিতে হয়!’

দ্বিজদাসের হাসির মুখোশখানা এত অল্পেতে আলগা হয়ে আসে, তা কে ভেবেছিল!

ভৃত্যটির সদ্য পদোন্নতি হয়েছে। ছিল বাগানে ও মালী। হয়েছে খানসামা। পাগড়ির উপর একটা ‘B’ হরফ আঁটা। অর্থাৎ বোস সাহেবের খানসামা। পান খেয়ে দাঁতগুলিকে পাকা রঙে রাঙিয়েছে, হাতের তেলো কোদাল ধরতে অভ্যস্ত বলে সেখানে বড়ো বড়ো কড়া। উর্দিটা কার কাছ থেকে ধার করে এনেছে, গায়ে ঢিলে হয়েছে। হাতের আস্তিন বার বার গুটোতে হচ্ছে।

দ্বিজদাসবাবু আবার মুখোশ এঁটে বললেন, ‘হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। শীতকাল। কড়া হয়েছে? আর একটু দুধ দেবো? চিনি খান না? সব ঠিক আছে? হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ। ওরে ব্যাটা নন্দুরাম, যা যা, আরও দু-পেয়ালা নিয়ে আয়, ঝট করে—দাদার জন্যে, আমার জন্যে।’

ভবনাথ বললেন, ‘এত দেরি (হচ্ছে কেন)?’ চায়ের নয়, অমিয়ার।

দ্বিজদাস বললেন, ‘ওঁরা তো এখনও ওকে যথেষ্ট সজ্জিত বলে মনে করতে পারছেন না বিলেতফেরত জেন্টলম্যানের পক্ষে।’—ওঁরা মানে দ্বিজদাসের উনি, গৌরবে বহুবচন।

মনু পা টিপে টিপে কখন এসে সোমের কাছে বসেছিল। ভবনাথ হুকুম করলেন, ‘যা তো মনু।’

মনুকে যেতে হল না। অমিয়াকে দরজার কাছে পৌঁছে দিয়ে কে একটি মহিলা ঘোমটা টেনে দিয়ে ঝপ করে সরে গেলেন। গিয়ে একটু আড়াল থেকে উঁকি মারলেন।

সুপ্রসিদ্ধ অমিয়া বোস ফরাশের উপর বসলেন।

পা দুটিকে ভাঁজ করে বাঁদিকে রেখে ডানহাতের উপর ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়লেন। বাঁ হাতটি কখনো উঠে অবনত মুখের চিবুকে সংলগ্ন হল, কখনো নেমে ঊরুর উপর সংন্যস্ত রইল। দৃষ্টি তাঁর অধোগামী। ভুলেও সোমের অভিমুখ হল না।

সোম লক্ষ করল যে অমিয়ার চোখে চশমা নেই, মুখ নিটোল, শরীর সুঠাম। বিদুষীদের দেখলে যেমন বিতৃষ্ণা হয় অমিয়াকে দেখে তেমন হয় না। রং মলিন শ্যাম। ত্বক মসৃণ তৈলাক্ত।

তবে প্রাণের চাঞ্চল্য নেই, আছে একটা নির্জীব জড়তা তার প্রকৃতিতে। যাদু নেই তার চলনে, চাউনিতে, নড়নে-চড়নে, ভঙ্গিতে স্থিতিতে। সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে। তার বিদ্যা তাকে মুক্তির স্বাদ দেয়নি। পাহারা ও ডিসিপ্লিন মিলে তার স্বভাবকে নিষ্পিষ্ট ও শিষ্ট করেছে। তার বিশিষ্টতার অবশিষ্ট নেই।

সোমের তো কথা বলার কথা নয়, কথা বলার ভার কুণালের উপর। কুণাল ইতস্তত করে বলল, ‘মিস বোস, ইনি আমার বন্ধু মিস্টার কে কে সোম।’

অমিয়া সবাইকে একবার নমস্কার করেছিল। সোমকে একান্তভাবে নমস্কার করে আবার নতমুখী হল। না একটু হাসি, না একটা চাউনি। সোম এতক্ষণ বুদ্ধি আঁটছিল। বলল, ‘হাউ ডু ইউ ডু।’

অমিয়া পিতার দিকে তাকাল। পিতা কন্যাকে উৎসর্গ করে ‘Easy Conversations’-এর বই লিখেছেন। কিন্তু কাজের বেলায় ঢু ঢু।

সোম যেন কোনোদিন বাংলা বলে না, যেন কত বড়ো ইঙ্গবঙ্গ। বলল, ‘I’ve been reading your book, Miss Bose. How wonderful to meet the author of a book one’s been reading!’

মিস বোস নীরব, নিঃস্পন্দ। তাঁর বাবা তাঁর দিকে সংকেত করে বললেন, ‘Writing another.’

‘But, Miss Bose, how on earth do you manage to write?’

মিস বোস আবার পিতার মুখের পানে চাইলেন।

‘Oh, somehow,’ পিতা কন্যার হয়ে উত্তর দিলেন।

সোম কুণালের দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘Is she deaf or is shedumb?’

ভবনাথবাবু চটতে পারেন না, অথচ চটবার কথা। সহিষ্ণুভাবে বললেন, ‘No, no, not deaf and dumb. Only shy.’

দ্বিজদাস এতক্ষণ বিলেতফেরতের বিশুদ্ধ ইংরাজি শুনে তাজ্জব বোধ করছিলেন। ভ্রাতুষ্পুত্রীর সম্বন্ধে সাহেবের ওরূপ ধারণা তাঁকে লজ্জা দিল। তিনি বলে উঠলেন, ‘She is a Lakshmi girl, although learned like Saraswati.’

যাকে নিয়ে এত কান্ড সেও একটু উশখুশ করছিল। একেবারে পাষাণ তো নয়। সোম হাসি চেপে বলল, ‘Then she ought to marry a Vishnu man.’

ভবনাথ দ্বিজদাসের উপর চটলেন। সে কেন ফোপরদালালি করতে যায়। দিক এখন এর জবাব!

জবাব দিতে না-পেরে দ্বিজদাস দাদার দিকে কাতর দৃষ্টিপাত করলেন। দাদার মুখটা বিরক্তিতে বিকৃত। যেন ওল খেয়েছেন।

এই সময় ভবনাথ গৃহিণী সদলবলে প্রবেশ করলেন।

তিনি বললেন, ‘একটু গান হোক?’

দ্বিজদাস যেন বর্তে গেলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। গান হোক।’

ভবনাথ ফরমাশ করলেন, ‘তনয়ে তার তারিণী।’

অমিয়া হারমোনিয়ামের আওয়াজ দিয়ে আরম্ভ করল।

সোম বলল, ‘Please, Miss Bose, I can’t, I simply can’t stand thatinstrument.’

মিস বোস ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বাজনা থামালেন। তাঁর শরীর কাঁপতে থাকল। দ্বিজদাস বউদিদিকে বললেন, ‘আমি তো বলেছিলুম একটা পিয়ানো ভাড়া করতে। যাঁহা হার্মোনিয়াম তাঁহা পিয়ানো, হিন্দি হরফ শেখার মতো একটা দিন লাগে শিখতে।’

ভবনাথগৃহিণী বুঝতে পারেননি ইংরেজিতে সোম কী বলল। দেওরের কথা শুনে আন্দাজে বুঝলেন। সোমকে অনুনয় করে বলেন, ‘হাঁ বাবা। অত ধরলে চলবে কেন? আমরা গরিব বাঙালি গৃহস্থ, পিয়ানো কোথায় পাব বল? তবে তুমি যদি বলো যৌতুকের জন্যে একটা কিনব এখন। না জানি কোন দু-পাঁচশো টাকা না নেবে।’

সোম একপ্রকার কৃত্রিমস্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আপনি—যা—ভাবছেন—আমি তা—mean করিনি। I meant —তার মানে আমি mean করেছিলুম—হারমোনিয়াম বাদ্যযন্ত্র—আমার কানে—যন্ত্রণা করে।’

দ্বিজদাস দোভাষীর কাজ করল। বলল, ‘বউদি, উনি বলছেন হারমোনিয়ামটা না-বাজিয়ে অমনি গান করলে উনি শুনবেন।’

‘তবে তুমি যে পিয়ানোর কথা বললে?’

ভবনাথ এর উত্তর দিলেন। বললেন, ‘দ্বিজুটা বড়ো বাড়াবাড়ি (করছে)।’

দ্বিজদাস চুপ। আড়ালে থেকে দ্বিজদাসগৃহিণী মুখ টিপে টিপে হাসছিলেন।

হারমোনিয়ামের প্রথম আওয়াজ বাড়িশুদ্ধু মানুষকে এই ঘরে ছুটিয়ে এনে জুটিয়েছিল—সাপখেলানোর বাঁশির সুরের মতো, ভালুক নাচানোর ডুগডুগির বোলের মতো। হঠাৎ বাজনা থেমে যাওয়ায় চারিদিক থেকে অস্বস্তির গুঞ্জন উঠল।

সব কথা লিখতে গেলে মহাভারত হয়। সংক্ষেপ করি। অমিয়ার মা তাকে বললেন, ‘তুই অমনি গান কর।’

অমিয়ার বুক দুড়দুড় করছিল। যেন হারমোনিয়ামটাকে সোম তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। গানটাকেও হয়তো তার গলা থেকে ছিনিয়ে নেবে। হয়তো বলবে, ‘I can’t I simply can’t stand that noise.’ আরম্ভ করতে তার ভরসা হচ্ছিল না। আরম্ভ যদি-বা করলে তবু আরম্ভই হয়তো শেষ এই আশঙ্কায় সে কেবলি হোঁচট খেতে থাকল।

সোম তাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যে বলল, ‘Fine! Fine!’ তা সত্ত্বেও অমিয়ার আত্মবিশ্বাস উজ্জীবিত হল না। কয়েকটা কলি ডিঙিয়ে কোনোমতে সে সমে এসে ঠেকল।

সোম যখন বলল, ‘Encore’ তখন সে তার করুণ চোখ দুটি তুলে নিঃশব্দ মিনতি নিবেদন করল। সোম বলল, ‘Thank you, Miss Bose.’

ফেরবার পথে ললিতা বলল, ‘শুনলে তো, রান্নার অধিকাংশ অমিয়ারই হাতের। এমন মেয়ে দৈবে মেলে! যেমন বিদ্যায়, তেমনি স্বাস্থ্যে, তেমনি গানে, তেমনিরন্ধনে।’

সোম বলল, ‘রন্ধনের ভার অন্যের উপর দিয়ে পরিবেশনটা যদি স্বহস্তে করতেন তবে আমি ক্রন্দন করতুম না। কিন্তু ওই নন্দুরাম খানসামা—’

কুণাল বলল, ‘বিলেতফেরতের যথোপযুক্ত সৎকারের জন্যে ওঁরা চেষ্টার ত্রুটি করেননি।’

‘সৎকারই বটে,’ সোম বলল, ‘তবে তুমি ও ললিতা তো বিলেতফেরত নও, তোমাদের সৎকার অমনভাবে হল কেন জান?’

‘জানি,’ কুণাল সখেদে বলল।

‘রক্ত গরম হয়ে ওঠে না?’

‘ওঠা উচিত নয়।’

‘শুনছ ললিতা। তোমার স্বামীটি একটি অপদার্থ।’

‘যে দেশে,’ ললিতা বলল, ‘প্রত্যেকেই এক একটি পদার্থ সে দেশে একটি অপদার্থ থাকলে মন্দ হয় না। তুমিও যদি একটি অপদার্থ হতে আমি তোমার বোন বলে গর্ব অনুভব করতুম, কল্যাণদা।’

‘কেন, আমি অন্যায়টা কী করেছি!’

‘অমন ওরাং ওটাং-এর মতো ইংরেজি আওড়ালে অমিয়া কেন, যেকোনো বাঙালির মেয়ে বিপর্যস্ত হয়। ওর গানটাকে খুন করলে তুমি।’

‘তুমি ভাবছ ওর গান আরও ভালো ওতরালেই ও আর্টিস্ট হত?’ সোম হাসল। ‘আর্টিস্ট ছিল সুলক্ষণা, ওর ধাত আলাদা।’

‘গানে কাঁচা হলে কী হয়, কত বই লিখছে।’

‘বই লিখছে বলে কি ও একজন intellectual? ললিতা, আমি একটি চাষাণী পেলে বিয়ে করতে রাজি আছি, যদি পণের বাধা না থাকে। ললিতা, আমার কান্না পায় শিক্ষিতা মেয়েদের শ্রী দেখে! ভেবে দেখ ললিতা, অন্য কোনো সভ্য দেশে কি এমনটি সম্ভব? বি এ পাস করা বিদুষী মেয়ে পুত্তলিকার মতো ফরাসটার উপর জড়সড় হয়ে বসে রইল। কেন গেল সে গান করতে? কেন সে দৃপ্তকন্ঠে বলল না যে আমি গান জানিনে, আমি যা জানি তাই জানি—তারই দ্বারা আমার বিচার হোক।’

‘আজকাল,’ ললিতা বলল, ‘শুধু শিক্ষার বিচারের উপর নির্ভর করে কোনো বিবাহযোগ্যা মেয়ের অভিভাবক নিশ্চিন্ত হতে পারেন না! দেশের হাওয়া বদলেছে। শ্বশুড় শাশুড়িরাও চান যে বউ গান করুক বা না-করুক অন্তত জানুক, জানুক বা না জানুক অন্তত জানাক।’

‘কুসংস্কার! কুসংস্কার!’ সোম ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, ‘একটার পর একটা কুসংস্কার এদের চিত্ত দখল করছে, আর এরা ভাবছে ওরই নাম শিক্ষা, ওরই নাম সভ্যতা। আমি বর্বর হতে চাই ললিতা। আমি সাঁওতাল মেয়ে বিয়ে করব।’

‘তা হলে,’ কুণাল হেসে বলল, ‘আমরা তোমার বাড়ি খাব না। খেতে দেবে সাপ কি গোসাপ।’

‘তার মানে,’ সোম বলল, ‘তুমি আমার প্রতি সেই ব্যবহার করবে, যে ব্যবহার করছেন ভবনাথ তোমার প্রতি। ভবনাথত্ব দেখছি আপেক্ষিক।’

‘সেই জন্যেই,’ কুণাল বলল, ‘রক্ত গরম হয়ে ওঠা উচিত নয়। সাঁওতালরাও যাদের হনুমান বলে তাদের প্রতি আচরণে ভবনাথবাবুর মতো। সাঁওতালের মেয়ে হনুমান বিয়ে করছে এমন গল্প ওদের মধ্যে বহুল প্রচলিত।’

‘অতএব’, ললিতা হাসতে হাসতে বলল, ‘এই বিলিতি হনুমানটির বিয়ের আশা ছেড়ে দিলে ভুল করব, সাঁওতালের মেয়ে থাকতে।’

খোকা অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিল। বাড়ি পৌঁছে তার ঘুম ভেঙে গেল। সে বলল, ‘মামা।’

সোম বলল, ‘হুম হুম। আমি হনুমান আছে।’

খোকা বলল, ‘হনুমান আছে? কই হনুমান?’

সোম বলল, ‘হামি হনুমান।’

‘কই হনুমান কই?’

‘হুম হুম।’ বলে সোম তিন লাফ দিল।

‘হুম হুম।’ খোকা তার অনুকরণ করল।

‘ঘুমিয়ে পড়ো, ঘুমিয়ে পড়ো,’ বলতে বলতে ললিতা ছেলেকে ভিতরে নিয়ে গেল।

‘তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো হে,’ কুণাল বলল।

‘নাঃ। এই মেজাজ নিয়ে ঘুমালে দুঃস্বপ্ন দেখব। একটু খেলা করতে হবে। আমার পক্ষে যা খেলা অপরের পক্ষে তা লঙ্কাকান্ড। আমি যে বিলিতি হনুমান।’

‘আজ রাত্রেই?’

‘আজ রাত্রেই।’

‘সর্বনাশ! কী করবে তুমি?’

‘তোমার এখানে তো টেলিফোন নেই। আমার একটা টেলিফোন দরকার।’

পাশের বাড়িতে টেলিফোন ছিল। অনুমতি নিয়ে সোম ডেকে বলল, ‘দ্বিজদাসবাবুর সঙ্গে কথা বলতে পারি? আমি কল্যাণকুমার সোম।’

কল্যাণকুমার দ্বিজদাসকে স্মরণ করছেন এত লোকের মধ্যে। দ্বিজদাস খেতে খেতে উঠে ছুটে এলেন। ‘হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ। Good night, মিস্টার সোম।’

সোম বলল (ইংরেজিতে), ‘আপনাকে বিরক্ত করলুম বলে মাফ চাই।’

‘না, না, না, না। বিরক্ত কীসের?……….’

‘আজ আমি আপনাদের ওখানে সবাইকে জ্বালাতন করেছি এজন্যে আপনাদের সকলের কাছে আমি মার্জনাপ্রার্থী।’

‘হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ। সকলেই আপনার ব্যবহারে মুগ্ধ। মনু তো আপনাকে পূজা করছে। এমন অমায়িক নিরহংকার ভদ্রলোক বিলেতফেরতাদের ভিতর কেন, B N G S-দের ভিতরও দেখা যায় না।’

‘ধন্যবাদ। এখন একটা জরুরি কথা আছে।’

‘জরুরি কথা! জরুরি কথা!’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি বিশেষ কাজে ওই রাস্তা দিয়ে ট্যাক্সিতে করে যাচ্ছি।’

‘আচ্ছা।’

‘নামবার সময় হবে না।’

‘আচ্ছা।’

‘মিস বোস যদি দয়া করে এক মিনিটের জন্যে ট্যাক্সিতে আমার সঙ্গে দেখা করেন আমি তাঁকে কিছু বলব।’

‘হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ। অনায়াসে স্বচ্ছন্দ্যে।’

‘ধন্যবাদ, মিস্টার দ্বিজদাস।’

‘আর লজ্জা দেবেন না।’

ট্যাক্সি যখন ‘ভবধামের’ সামনে দাঁড়িয়ে ধ্বক ধ্বক ধ্বক ধ্বক করল তখন রাত এগারোটা। গায়ে একখানা শাল জড়িয়ে অমিয়া এসে ট্যাক্সির দরজার কাছে দাঁড়াল।

‘সে কী! আপনি দাঁড়িয়েই থাকবেন! তা হয় না।’ ইংরেজিতে এই কথা বলে সোম দরজাটা খুলে দিল—দিতে দিতে বলল, ‘একসকিউস মি। গায়ে লাগল?’

‘না না।’ বলে যন্ত্রচালিতের মতো অমিয়া উঠে এল। কোনো অন্যায় বা অশোভন কাজ করছে কি না ভাববার সুযোগ পেল না। তার পিছনে একটু ব্যবধানে দাঁড়িয়ে ছিলেন দ্বিজদাস, মনু, নীহারকণা, নন্দুরাম (তখন সে খানসামার সাজ খুলে ফেলেছে) ও অন্যান্য জনকয়েক। ভবনাথবাবুর মাথা ধরেছে, তিনি নামেননি।

সোম যেন নিমেষের মধ্যে ছোঁ মেরে অমিয়াকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওঁরা সাক্ষীগোপালের মতো দারুভূত হয়ে থাকলেন। যখন ওঁদের সংজ্ঞা ফিরল তখন দ্বিজদাস বললেন, ‘কই, টেলিফোনে তো অমন কোনো কথা হয়নি। কানে কি আমি কম শুনি? দাদাকে এখন আমি বোঝাব কী!’

ভবনাথবাবু আকাশ থেকে পড়লেন। যাতে ছাত থেকে না পড়েন সেজন্যে বাড়ির একটা কামরায় তাঁকে বন্দি করা হল। তিনি হুকুম করলেন পুলিশে খবর দিতে। কিন্তু গৃহিণী ও-হুকুম নাকচ করলেন। দ্বিজদাসকে তাঁর দাদা নির্বাসন দন্ড দিলে তাঁর বউদি তাঁকে পাঠালেন কুণালের ওখানে।

মনুর মনে পড়ল যে তার বন্ধু প্রস্তাব করেছিল তার দিদির সঙ্গে নির্জনে বাক্যালাপ করতে। এখন ওকথা সে মার কাছে খুলে বলল। মা বললেন, ‘ধেড়ে কেষ্ট! ঘটে একটু বুদ্ধি ছিল না যে মাকে ওকথা আগে বলি। বয়স যতই বাড়ছে লক্ষ্মী ততই ছাড়ছে, তিন বছর আই এ ফেল-করা ছেলের আর কত বুদ্ধি হবে!’

মনু বকুনি সইতে না-পেরে বাইসাইকেল চড়ে গৃহত্যাগী হল। দিদিকে যদি উদ্ধার করতে পারে তবেই সে গৃহপ্রবেশ করবে নতুবা—নতুবা কী?

‘ভবধাম’ যখন লন্ডভন্ড তখন ট্যাক্সিতে অমিয়াকে সোম সম্পূর্ণ সপ্রতিভভাবে বলছে, ‘Grand Hotel’-এ আগে কোনোদিন যাননি, না গেছেন মিস বোস?’ (পরিষ্কার বাংলায়)

অমিয়া তখন স্বপ্ন দেখছে এই তো তার স্বপ্নের রাজপুত্র। বিলেতফেরত, Grand Hotel-এ নিয়ে যায়। সে সলজ্জস্বরে বলল, ‘না।’ চেয়েছিল সে বাইরের দিকে।

‘তবে আপনি জীবনের কিছুই দেখেননি, মিস বোস। আপনার জীবনেরও আরম্ভ হয়নি।’

স্বপ্নে কথা বলতে লজ্জা কীসের? অমিয়া বলল, ‘না।’

দৈবক্রমে সেদিন ছিল Gala night. সোম সাপারের ফরমাশ দিয়ে অমিয়াকে বলল, ‘ভয় নেই। নিষিদ্ধ মাংস খেতে হবে না। কিন্তু মুশর্কিল এই ছুরি কাঁটা নিয়ে।’

এত আলো, এমন বাজনা, এরূপ নাচ,—অমিয়া কেমন দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। এত সাহেব-মেম সে একত্র দেখেনি। সস্ত্রীক গুটিকয়েক ভারতীয়—বোধ হয় পারসি কি গুজরাটি—তাদের মধ্যে ছিটানো।

সোম শুধালো, ‘নাচবেন?’

অমিয়া সবেগে ও সভয়ে মাথা নাড়ল!

সোম বলল, ‘ও কিছু নয়। আধঘণ্টা অভ্যাস করলে দুরস্ত হয়ে যাবে।’

অমিয়া কাঁদো কাঁদো সুরে বলল, ‘না।’

তখন সোম একটা লেকচার দিল! ‘মিস বোস, আপনারা শিক্ষিতা মেয়েরা এমন ক্ষীণজীবী কেন? কত ইংরাজি বই পড়লেন, প্রাণে কেন স্বাধীনতার হাওয়া লাগল না? ভাবছেন দেশ স্বাধীন হলে তারপর ব্যক্তি স্বাধীন হবে? ও যেন গাড়ি আগে চললে ঘোড়া পরে চলবে। স্বাধীন মানুষের দেশই হচ্ছে স্বাধীন দেশ—চলন্ত ঘোড়ার গাড়িই হচ্ছে চলন্ত গাড়ি।’

অমিয়ার তখন তর্ক করবার অবস্থা নয়। সে যে কী করেছে, কার সঙ্গে এসেছে, এসব ক্রমে ক্রমে তার ঠাহর হল। স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্রম নয়—সে গোঁড়া হিন্দু বাড়ির আইবুড়ো মেয়ে, এসেছে এ কোন নরকে। কেন তার মতিচ্ছন্ন হল? না, তার তো এতে মতি ছিল না। ক্রমে তার স্মরণ হল, মিস্টার সোম তাকে গাড়িতে উঠিয়ে এক দৌড়ে এখানে এনেছেন। কেন তিনি এমন কাজ করলেন? কেন তিনি বাবার অনুমতি নিলেন না? অন্তত তার নিজের সম্মতি?

সোম লক্ষ করল অমিয়ার দুই গাল বেয়ে অশ্রুজলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। তবু সে লেশমাত্র শব্দ করছে না। সোম ব্যঙ্গ করে বলল, ‘সাবালিকা শিক্ষিতা তরুণী বটে। গ্র্যাজুয়েট এবং গ্রন্থকর্ত্রী।’

অমিয়া অস্ফুট স্বরে বলল, ‘আমাকে বাড়ি নিয়ে চলুন।’

‘সে কী! এখনও খাওয়া হয়নি যে!’

অমিয়া ফিসফিস করে বলল, ‘খাব না।’

‘না খান। খাওয়া দেখুন।’

অমিয়া ফিসফিস করে আর্তভাবে বলল,—

‘বাড়ি যাব।’

‘বাড়ি তো আপনার আলাদিনের বাড়ি নয় যে আপনার অসাক্ষাতে উড়ে যাবে। আমি আপনাকে অভয় দিচ্ছি, আপনার বাড়ি পুড়েও যাবে না, পড়েও যাবে না।’

অমিয়া কাতর স্বরে বলল, ‘দয়া করুন।’

‘দয়া? দয়া তো আপনারই করবার কথা। আপনার বাড়ি খেয়ে এলুম, তার ঋণ শোধ করতে দিন।’

অমিয়া তবু বলল, ‘খাব না। যাব।’

‘আপনারা নিমন্ত্রণ করলেন, আমি নিমন্ত্রণ রক্ষা করলুম। আমার নিমন্ত্রণ আপনি রক্ষা না-করলে বুঝব আপনারা আমাকে হেয়জ্ঞান করেন! সেটা কি ভালো?’

অমিয়া তর্ক করল না, শুধু বলল, ‘যাব।’

অগত্যা সোম ফরমাশি খাবারের দাম চুকিয়ে দিয়ে অমিয়াকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল। বলল, ‘বাড়িও থাকবে, বাড়ির মানুষও থাকবেন, জীবনের দৈনন্দিন প্রক্রম থাকবে অক্ষুণ্ণ। থাকবে না একমাত্র আজকের রাতটি, রাত্রের একটি ছোটো ঘণ্টা, আর সেই ঘণ্টায় যে কয়টি কথা বলতে পারত একটি অচিন তরুণ সেই কয়টি কথা। অমিয়া দেবী, এখনও সময় আছে। ট্যাক্সিকে ঘুরতে বলব?’

বাড়ি পৌঁছে কী দেখবে তাই এতক্ষণ অমিয়ার কল্পনা অধিকার করেছিল, বিপরীত যাত্রার প্রস্তাব সেখানে প্রবেশ পেল না। অমিয়া ত্রস্তভাবে বলল, ‘না, না।’

ট্যাক্সি ছুটতে লাগল। ছুটতে লাগল পথের পাশের বাতি, ছুটতে লাগল সময়। সুযোগও ছুটতে লাগল।

সোম বলল, ‘আপনাকে আমার কিছু বলবার ছিল—নির্জনে। সেটা অ-বলা রইলে বিয়েও রয় অ-করা! সেই জন্যে আপনাকে নির্জন স্থানে নিয়ে গেছলুম—যেখানে জনতা সেইখানে নির্জনতা। আপনি নিজের বিয়ে নিজের হাতে ভাঙলেন। এরপর যদি আপনার বাবা আসেন বাড়ি চড়াও করে ঝগড়া বাধাতে কিংবা যান আদালতে মামলা করতে তবে আর কি ভাঙা বিয়ে জোড়া লাগবে? অমিয়া, এখনও সময় আছে।’

অমিয়া কেঁদে উঠল! উত্তর দিল না।

গাড়ি এসে বারান্দায় লাগল। অমিয়াকে নামিয়ে দিয়ে সোম বলল, ‘হাঁকাও।’

ললিতা ও কুণাল বাইরের ঘরে রাত জাগছিল। তাদের সঙ্গে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন দ্বিজদাসবাবু। কোন মুখে তিনি বাড়ি ফিরবেন? জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘কর্ণরোগের কোনো স্পেশালিস্টের নাম করতে পারেন? একবার দেখাই বাঁ কানটা। মিস্টার সোম আমাকে কী বললেন, আর আমি কী শুনলুম।’ এমন সময় সোম কপাটের কড়া নাড়ল। বলল, ‘কুণাল, জেগে আছ হে?’ পরিষ্কার বাংলা। দ্বিজদাস ভাবছিলেন আর-কেউ। কুণাল বলল, ‘বাঁচা গেল।’

সোম কুণালকে কী বলতে বলতে ঘরে ঢুকে দেখে—দ্বিজদাস। তিনিও সোমকে দেখে চমকালেন। ললিতা বলল, ‘কই, অমিয়া কই। ওকে কোথায় রেখে এলে?’

সোম নির্বিকার ভাবে বলল, ‘ওঁর বাপের বাড়িতে।’

‘যাওয়া হয়েছিল কোথায়?’ শুধালেন দ্বিজদাস।

‘রসাতলে।’ বলল সোম।

দ্বিজদাসের কেমন ধারণা দাঁড়িয়ে গেছল যে তিনি কানে কম শোনেন। রসাতল নামে কোনো পাড়া তো কলকাতায় নেই। ওটা রসা রোড।

‘রসা রোডে এমন কী কাজ ছিল এত রাত্রে, আর অমিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী!’ তিনি সবিস্ময়ে বললেন।

‘ওকথা জানি আমি আর জানেন অমিয়া। তৃতীয় ব্যক্তির নিকট প্রকাশনীয় নয়।’

ললিতা সাভিমানে বলল, ‘আমরাও শুনতে পাব না?’

কুণাল তাকে ইশারায় বলল, ‘চুপ চুপ।’

দ্বিজদাসবাবু অত্যন্ত দমে গেছলেন। পরের বাড়িতে অত বড়ো একজন বিলেতফেরতার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতে সাহস হবে কেন? তা ছাড়া লোকটিও তিনি গোবেচারি, মার্চেন্ট অপিসের কেরানি। সোমের উপর তাঁর অখন্ড বিশ্বাস ছিল, অমন জেন্টলম্যান কি কখনো অন্যায় কাজ করতে পারে? এতক্ষণ তিনি নিজের কানকে দোষ দিচ্ছিলেন, এখন দিলেন নিজের নীচ মনকে।

দ্বিজদাস উঠতে যাচ্ছিলেন, সোম তাঁর দিকে একটা সিগ্রেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনারা তো আমাদের বাড়িতে বা আমাদের হোটেলে চা পর্যন্ত খাবেন না। আমাদের ঋণশোধ হয় কী উপায়ে?’

পরম আপ্যায়িত বোধ করে দ্বিজদাস বসে পড়লেন। নিলেন সিগ্রেট। হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ। কুণাল বলল, ‘ডাবের জল কিংবা ঘোলের শরবত নেই, কিন্তু এক পেয়ালা চা হোক। কী বলেন দ্বিজদাসবাবু?’

‘না ভাই, অসময়ে আর কেন ও সব?’

‘চা তো যেকোনো সময় খাওয়া যায়।’—ওটা দ্বিজদাসেরই বচন।

দ্বিজদাস বললেন, ‘অনেকটা দূর যেতে হবে, তাও পদব্রজে। শীতের হাওয়ায় হি হি করবার আগে শরীরটাকে একটু—হেঁ হেঁ—করা ভালো।’

ললিতা গেল চা তৈরি করতে।

এমন সময় ‘খোলো, দরজা খোলো।’ ঘন ঘন কড়া নাড়া। দুডুম দুডুম কিল, দড়াম দড়াম লাথি। কেমন অতিথি এরা? দ্বিজদাস ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলেন। সোম ললিতা-কুণালের জন্যে উদ্বিগ্ন হল। পুলিশ নয় তো?

কুণাল দরজা খুলে না-দিলে ভবনাথবাবু দরজা ভাঙতেন। ‘এই যে কুণাল। এ মেয়ে আমার নয়। (এর) জাত ইজ্জত গেছে। ভবধামে (এর) ঠাঁই নেই। (একে) তোমার এখানে দিতে এলুম।’

ভবনাথের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী, তাঁর মেয়ে, তাঁর চাকর। কুণাল বলল, ‘আসুন, আপনারা দয়া করে বসুন একটু।’

ভবনাথ বললেন, ‘না। (তার) দরকার নেই।’

ললিতা কখন এসে ভবনাথপত্নীর হাত ধরেছিল। কান টানলে যেমন মাথা আসে তেমনি পত্নীকে টানলে পতি। বসবার ঘরে দ্বিজদাসকে আবিষ্কার করে ভবনাথ জ্বলে উঠলেন। ‘ভাই (হয়ে) তুই এই চক্রান্তে লিপ্ত?’ লক্ষ করলেন ভাইয়ের হাতে অর্ধদগ্ধ সিগ্রেট। ‘ফ্যাল ওটা’, বলে ভাইয়ের হাতের উপর কষিয়ে দিলেন এক ঘা। সিগ্রেটটা ছিটকে সোমের পায়ের কাছে পড়ল। সোম তার সিগ্রেটটাকে তারিফ করে টানছিল, ভবনাথের নাকের অদূরে ধোঁয়া ছাড়ল।

‘কী সায়েব,’ ভবনাথ বলেন সোমকে, ‘গ্র্যাণ্ড হোটেলে ষাঁড়ের মাথার ডালনা কেমন লাগল? ক-বোতল খুললেন?’

‘সেটা আপনার কন্যাকে জিজ্ঞাসা করেননি?’ বলল সোম।

‘যেমন দেবা তেমনি দেবী।’ (ওর) গায়ের গন্ধ শুঁকেই (বুঝেছি) কী পড়েছে পেটে। ‘ওয়াক—’

অমিয়ার চোখ খরগোশের মতো লাল। সে আবার চোখ মুছল।

‘দিব্যি গ্র্যাণ্ড হোটেলি গন্ধ!’ ভবনাথ বলতে থাকলেন। ‘যে মানুষের নাক আছে সেই বুঝবে।’—নাক দিয়ে শুঁ শুঁ করে শুঁকলেন। তার দ্বারা নাকের অস্তিত্ব সপ্রমাণহল।

ভবনাথপত্নীরও বিশ্বাস অমিয়া কিছু খেয়েছে। তিনি একটা প্রায়শ্চিত্তের প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু ভবনাথ বললেন, ‘প্রায়শ্চিত্ত কোরো কাল সকালে, আজ রাত্রে আমি ও মেয়েকে বাড়িতে জায়গা দিচ্ছিনে, কে জানে কাল ঘুম থেকে উঠে ওঁর মুখ দেখব সব আগে!’

সোম অমিয়ার অবস্থা দেখে সীনিকের মতো হাসছিল। মনে মনে বলছিল, ‘না খেয়ে এই। খেলে এর বেশি কী হত? বাড়ি যাব, বাড়ি যাব। কোনটা তোমার বাড়ি? ওটা না-এটা? ওঠো এখন এই বাড়িতে। কাল তোমাকে সত্যি সত্যি খাইয়ে আনব।’

ভবনাথবাবু বললেন, ‘আসি তা হলে, কুণাল। ও মেয়েকে (কোনো) আর্যসন্তান গ্রহণ করবে না। দেখো যদি তোমাদের সংকর সমাজে ওকে পাত্রস্থ করতে পারো।’

সোম কুণালকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কায়স্থ আবার আর্য নাকি?’

কুণাল হেসে বলল, ‘আমি তো জানতুম অর্ধেক মঙ্গল তিনি অর্ধেক কল্পনা।’

‘কী!’ ললিতা কৃত্রিম কোপ প্রকট করল।

‘বলছিলুম অর্ধেক মঙ্গল তুমি অর্ধেক কল্পনা।’

ললিতা প্রশমিত হল কিন্তু ভবনাথবাবু হলেন না। ‘জাত তুলে গালাগাল! তুমি বিলেত গিয়ে জাত দিয়ে এসেছ, লাঙ্গুলহীন শৃগাল, (তা বলে) আমি লাঙ্গুলহীনহব?’

সোম বলল, ‘না, না, আপনি আপনার লাঙ্গুলটিকে ধুতি দিয়ে ঢেকে সযত্নে রক্ষা করবেন।’

‘আসি কুণালবাবু, এ থাকল। দেখবেন।’ বলে ভবনাথবাবু সত্যিই গা তুললেন। সেইসঙ্গে অমিয়াও। হঠাৎ একটা পতনের শব্দ হল। সকলে চেয়ে দেখল অমিয়া তার বাবার পায়ে মাথা খুঁড়ছে। তার মা তাকে তোলবার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। ভবনাথ বলছিলেন, ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল।’

সোম খেপে গিয়ে বলল, ‘I challenge you—I Challenge you—I challenge yon to prove যে উনি গ্র্যাণ্ড হোটেলে গিয়ে কিছু মুখে দিয়েছেন?’

দ্বিজদাস একান্তে কুণালকে বললেন, ‘আমি তো ভেবেছিলুম রসা রোড।’

ভবনাথের ধারণা পৃথিবীতে একমাত্র তিনিই রৌদ্ররসের অধিকারী! সোমকে রাগান্বিত দেখে তিনি ভাবলেন, তাই তো, এ তো সামান্য লোক নয়। তিনি তোৎলাতে তোৎলাতে বললেন, ‘এ-এ-একই কথা। ঘা-ঘা-ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং।’

সোম যত না চটেছিল তার বেশি চটবার ভাণ করছিল। বলল, ‘Damn your ঘ্রাণেন। আপনি কোনোদিন ভোজনের বদলে ঘ্রাণ করে স্কুলে গেছেন? You oldbully!’

ভবনাথবাবু পিছু হটতে লাগলেন। তাঁর স্ত্রী এসে মাঝখানে দাঁড়ালেন। ইংরেজি bully কথাটা তাঁর কানে গুলির মতো শোনাল। দ্বিজদাসও অবলার সাহস দেখে সাহস পেলেন, সোমের দুটো হাত পিছন থেকে চেপে ধরলেন।

কুণাল বলল, ‘ছি, ছি, এ কী করছ কল্যাণ?’

ললিতা গিয়ে অমিয়াকে ধরাধরি করে তুলল।

সোম বলল, ‘ও মেয়েকে রেখে যেতে চান রেখে যান। কিন্তু কাল খোঁজ করলে ওর পাত্তা পাবেন না। শেষকালে খবরের কাগজে Amiya, come back ছেপে পুরস্কার ঘোষণা করতে হবে।’

চক্ষু বিস্ফারিত করে ভবনাথ বললেন, ‘অ্যাঁ!’—তাঁর বদনের ব্যাদান তাঁর নয়নের বিস্ফারণের সঙ্গে ম্যাচ করল।

সোম তাঁর অনুকরণ করে বলল, ‘হ্যাঁ।’ তখন ভবনাথবাবু একহাতে অমিয়ার হাত ধরে অন্য হাতটা গিন্নির দিকে বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘তুমি থেকে যেয়ো না। তোমার জন্যে (কাগজে) বিজ্ঞাপন দিতে (আমার) লজ্জা করবে।’

সোম ভেবেছিল আপদ চুকেছে, ভবনাথবাবুরা যেমন অপরিচিত ছিলেন তেমনি অপরিচিত হয়ে গেছেন। কিন্তু কই? পরদিন রবিবার, সোম ললিতাদের বেড়াতে নিয়ে যাবার উদ্যোগ করছে, বারংবার তাগিদ দিয়ে বলছে, ‘ললিতা, দেশে এত বড়ো নারী জাগরণ ঘটল, তবু তোমাদের মেয়েলি কাপড় পরার সময় সংক্ষেপ হল না।’

হেনকালে মনুর আবির্ভাব।

সোম একটু আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘কী বন্ধু, কী মনে করে?’

মনুও একটু আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘আমাকে যে আজ আসতে বলেছিলেন!’

‘ওঃ ঠিক, ঠিক। বাড়ির ওঁরা আসতে দিলেন?’

‘আমার আসা-যাওয়ার উপর কর্তৃত্ব করা,’ মনু স্পর্ধাভরে বলল, ‘বুঝলেন দাদা, শিবের আসাধ্য।’

‘নাও নাও, সিগ্রেট নাও।…তারপর ওদিকের খবর কী?’

‘খবর তো আপনিই ভালো জানেন। গ্র্যাণ্ড হোটেলে গেলেন, আমাকে নিলেন না! আমাকে নিলে কি এত কথা উঠত?’

‘যা বলেছ।’ সোম মনে মনে বলল, তোমাকে নিলে কথা উঠত না বটে, কিন্তু কথাটাও উঠত না।

যাক, ওসব দুদিন বাদে থেমে যাবে। মনু মুরুব্বিয়ানা ফলিয়ে গম্ভীরভাবে বলল, ‘অমন হয়ে থাকে, সংসার করতে গেলে অমন একটু আধটু শুনতে হয়, সইতে হয়।’ তারপর বলল, ‘বড়ো পিসিমা বাবাকে সেই কথা বোঝাচ্ছিলেন আজ সারা সকাল।’

‘বাবা বুঝলেন?’

‘বোঝা তো উচিত। বিয়ে যখন ধরতে গেলে হবেই তখন দুদিন আগে বরের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া ও হোটেলে খাওয়া খুব একটা গর্হিত কাজ নয়। অন্তত আমরা তরুণরা তো তাই বুঝি।’

‘তরুণরা কী বোঝেন,’ সোম প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের স্বরে বলল, ‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তরুণীরাও কি তাই বোঝেন?’

‘তরুণীদের কথা যদি বলেন,’ মনু মাতব্বরের মতো বলল, ‘আমাদের যুব-সমিতিতে আমরাই তরুণী সেজে বসে আছি। জগদা বসু, জ্যোৎস্না দত্ত, সান্ত্বনা পাল এসব নাম আমাদেরই।’

‘জগদা কেটে জগদম্বা করলেও তোমাকে আমার তরুণী বলে ভ্রম হবে না বন্ধু। অন্তত তোমার দিদি বলে। এখন বলো দেখি তোমার দিদি কী বুঝলেন?’

‘দিদির একটা স্বতন্ত্র মন আছে নাকি? বাবা যা বুঝবেন ও তাই বুঝবে। যা করাবেন বাবা ও করবে তাই।’

‘ধন্য ধন্য অমিয়া বসু। কিন্তু তুমি যে, বন্ধু আমার সঙ্গে ওঁর বিয়ে দিলে দুদিন বাদে, তুমি তো ওঁর বাবা নও, তোমার নির্দেশ উনি মানবেন কেন?’

মনু বিস্মিত হল। বিস্মিত ও জিজ্ঞাসু।

সোম বলল, ‘অর্থাৎ তোমার বাবা যে দুদিন বাদে আমার সঙ্গে ওঁর বিয়ে দেবেন এ তুমি কার কাছে জানতে পেলে?’

‘দেখবেন আমার কথা ফলে কি-না।’ মনু বলল সাহংকারে।

‘আহা!’ সোম বলল, ‘তুমি যত বড়ো জ্যোতিষী হও না-কেন, এই সোজা জিনিসটা তো বোঝো যে আমার মতো একটা চরিত্রহীন যুবককে তোমার দিদি স্বেচ্ছায় বিয়ে করবেন না? এবং এটা তো বিশ্বাস করতে পারো যে আমিও অনিচ্ছুককে বিয়ে করতেঅনিচ্ছুক?’

মনু হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ সোমকে নিরীক্ষণ করল।

‘কী নিরীক্ষণ করছ?’ সোম বলল, চরিত্রহীন কি-না তা কি চেহারায় লেখা আছে? তুমি কি জ্যোতিষের সঙ্গে সঙ্গে সামুদ্রিকও জানো?’

‘যাঃ!’ মনু উড়িয়ে দিল সোমের কথা। ‘যাঃ! আপনি কখনো চরিত্রহীন হতে পারেন?’

‘ধরো যদি হয়ে থাকি?’

‘তবে,’ মনু গম্ভীর হয়ে গেল। ‘তবে অবশ্য বিয়ে হতে পারে না!’

‘পারে না তো?’ সোম বলল, ‘আমিও তাই বলি। তাই আমার সিদ্ধান্ত। এখন তুমি যেমন করে পারো প্রসঙ্গটা তোমার দিদির কাছে পাড়লে ওঁকে একটা সুযোগ দেওয়া হয়। কে জানে হয়তো তিনি আমাকে যেমনটি পাচ্ছেন তেমনটি নিতে ইচ্ছুক হবেন। আর তিনি যদি ইচ্ছুক হন তবে আমি তাঁকে আবার একদিন লুট করে নিয়ে সোজাসুজি বিয়ে করে ফেলব। তারুণ্যের প্রথম সূত্র হচ্ছে গুরুজনকে—middle man-কে—eliminate করা।’

মনুর তখন মাথা ঘুরছিল। সে প্রথমে ঠাওরেছিল ওটা ঠাট্টা, তারপর ওটা একটা কল্পিত সমস্যা। ওটা—ওই চরিত্রহীনতা—যে সত্য তা কি মনু বিশ্বাস করতে চেয়েছিল? কিন্তু সত্য ওটা। বড়ো কুৎসিত সত্য। দিদির কাছে ওই কুৎসিত প্রসঙ্গ পাড়বে কেন সে? সে সবেগে মাথা নেড়ে বলল। ‘না, না, না, না, না।’ সোম যে লুট করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে, শেষের এ কথা তার কানে ঢুকল না। সে গোড়ার কথাটা নিয়ে মাথা নেড়ে বলতে থাকল, ‘না, না, না, না, না।’

সোম বুঝল উলটো। বলল, ‘আচ্ছা, না-হয় লুট করব না। প্রাজাপত্য বিবাহ যদি সম্ভব হয় তবে রাক্ষস বিবাহ কে চায়? কিন্তু গোড়ার কথাটা জরুরি। দিদিকে বলাচাই-ই।’

মনু বলল, ‘না।’

‘কী? বলা উচিত নয়?’

‘উচিত বই কী।’

‘তবে?’

‘আমি বলতে পারব না।’

সোম চুপ করে থাকল। তারপর ললিতাকে ডাক দিয়ে বলল, ‘তোমার কিন্তু বড্ড দেরি হচ্ছে। কুণালটার হল কী? লুকিয়ে কবিতা লিখছে না-তো?’

ললিতা নেমে বলল, ‘কই? কোথায় তিনি?’

খোকা ডাকল, ‘বাবা?’

সোম ডাকল, ‘ওহে!’

বোঝা গেল কুণাল তখন কোন ঘরে।

বলবে না বলে গেল মনু, কিন্তু বাড়ি পৌঁছে তার প্রথম কাজ হল মা-র কাছে হাজিরা দেওয়া। মা-কে বলল, ‘কাল তো তুমি আমাকে খুব বকে দিলে আগে তোমাকেও-কথা জানাইনি বলে। আজ কী জেনে এসেছি শুনবে?’

মা শুনে জিভ কাটলেন। তাঁর ধারণা ছিল কল্যাণ ছেলেটা একটু বেশি রকমের সাহেব, কাল তাঁর মেয়ের সঙ্গে সাহেবি ব্যবহার করেছে, হোক না-কেন তা অসামাজিক। আজ তিনি নিঃসন্দেহ বুঝলেন যে সাহেব নয় লম্পট। তার উদ্দেশ্য ছিল অমিয়ার ধর্ম নাশ করা।

যেই একথা মনে আসা অমনি সুর করে কেঁদে ওঠা।

কাল মেয়ের গান শুনতে যে সকল লোক জড়ো হয়েছিল আজ মায়ের কান্না শুনতেও সেই সকল লোক এল। ওরা শুধায়, ‘কী হয়েছে, টুলীর মা?’

টুলীর মা বলেন, ‘ওগো আমার কী হবে গো! ওরে আমার টুলী রে!’ কাঁদতে কাঁদতে আছাড় খেয়ে পড়েন। তাঁর দুঃখ দেখে সকলের চোখে জল। ছোটো ছোটো মেয়েরা বলে, ‘কেঁদ না মা, কেঁদ না।’ অথচ তারা নিজেরাই কেঁদে আকুল।

যা হয়ে গেছে তা নিয়ে এ পর্যন্ত টুলী ছাড়া অন্য কেউ চোখের জল ফেলেনি, টুলীর মা-ও বড়োজোর গম্ভীর হয়ে রয়েছিলেন। হঠাৎ এই অট্টকান্নার অর্থ কী! কেউ কাউকে এর উত্তর দিতে পারে না। সকলে ভাবে টুলীর মা বড়ো চাপা প্রকৃতির মানুষ, কিন্তু শেষপর্যন্ত সামলাতে পারলেন না। আশ্রিতা যাঁরা ছিলেন তাঁরা শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, ‘টুলীর মা-র মতো দুঃখিনী ক-জন আছে? আমরা তো দেখিনি বা শুনিনি।’ আত্মীয়া যাঁরা ছিলেন তাঁরা বলেন, ‘কেঁদে কী হবে, টুলীর মা, (বা দিদি, বা মাসিমা, বা কাকিমা) ভালোয় ভালোয় বিয়েটা তো হয়ে যাক।’

টুলীর মা প্রবোধ মানেন না। ‘ওগো আমার দুঃখের অবধি নেই গো! আমার টুলী রে!’—কাঁদতে কাঁদতে বিষম খান।

সবাই যখন তাঁর কান্নার জ্বালায় উক্ত্যক্ত তখন ভবনাথ ও দ্বিজদাস প্রায়শ্চিত্তের বিধান নিয়ে ফিরলেন। দুই ভাইয়ে আগের মতো সৌহার্দ্য। কাল সোমের হাত চেপে ধরে দ্বিজদাস ভবনাথের প্রাণ না-হোক মান রক্ষা করেছেন। লক্ষ্মণ সমান ভাই।

‘কী হয়েছে, টুলীর মা? কী হয়েছে!’

টুলীর মা এতক্ষণ কথাটা বহু কষ্টে চেপে রেখেছিলেন সব আগে স্বামীকে শোনাবেন বলে। আধখানা ভেঙে বলেন, ‘শুধু খাওয়া নয় গো!’

‘কী বলছ?’

‘ওগো শুধু খাওয়া নয় গো!’

ভবনাথ দ্বিজদাসের দিকে তাকালেন। ‘ভূতে পেয়েছে নাকি? ওঝা ডাকানো দরকার মনে করো?’

‘ওগো শুধু খাওয়া নয়। ওটা সাহেবি কাপড় পরা গুণ্ডা গো! আমার কী হবে!’

(তারপরে সহজ স্বরে)

‘কলকাতায় তো বেশ শান্তিতে ছিলুম। কিন্তু—’

(আবার রোরুদ্যমানভাবে)

‘টেগার্ট সাহেব চলে গিয়ে কত রাজ্যের গুণ্ডা যে এসেছে, আর কলকাতায় তিষ্ঠনো যায় না, তুমি এখান থেকে চলো।’

ভবনাথ বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, ‘টেগার্ট সাহেব বিলেত চলে গেছেন (বলে) আমিও বিলেত চলে যাব। বলে কী হে দ্বিজু!’

‘বউদি,’ দ্বিজদাস দোভাষীর কাজ করলেন, ‘দাদাকে কোথায় চলে যেতে বলছ? ভেঙে বলো।’

‘কাশী গো কাশী। তোরা সব যা এখান থেকে। যা তোরা।’

দ্বিজদাস তাদের খেদিয়ে নিয়ে গেলেন। তবু দুটো একটা লেপটে থাকল।

‘ওগো শুধু খাওয়া নয়। নাতি হবে।’

ভবনাথ লম্ফ দিয়ে বললেন, ‘কী!’

দ্বিজদাস কম্পমানভাবে বললেন, ‘ক ক কী!’

ভবনাথ দাপাদাপি করে বেড়ালেন। হাঁকতে লাগলেন, ‘আমার বন্দুক। আমার বন্দুক। আমার বন্দুক।’

তাঁর গৃহিণী সহসা প্রকৃতিস্থ হয়ে দ্বিজদাসকে বললেন, ‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছ কী, ঠাকুরপো? টুলীকে সরাও। নইলে তারই উপর গুলি চলবে।’

টুলীর উপর গুলি। একথা ভাবতেই দ্বিজদাস আঁতকে উঠলেন। দাদার সম্মুখীন হয়ে বললেন, ‘দাদা, লুঠি তো ভান্ডার, মারি তো গণ্ডার। আসুন গুণ্ডা মারতে যাই।’

দাদা বললেন, ‘কিন্তু বন্দুক?’

‘না, না, বন্দুক ঘাড়ে করে বেরোলে ধরে নিয়ে যাবে। আপনি মারবেন কিল আমি মারব লাথি, তা হলেই মরে যাবে।’

‘উহুঁ। আমি (মারব) লাথি, তুমি (মারবে) কিল।’

‘বেশ, তাই হবে।’

দু-ভাই ট্রামে চড়ে খুন করতে চললেন। ট্রামের অন্যান্য আরোহীরা কেমন করে জানবে যে এরা দু-জন হবু খুনে ও গবু খুনে। হায়! এমন কত খুনে যে নিরীহ ভদ্রলোকের বেশে নিরীহ ভদ্রলোকের পাশে বসে কার্যসিদ্ধির উপায় চিন্তা করতে করতে কার্যস্থলে যায়।

কিন্তু খুনের কাছ থেকেও ট্রাম কোম্পানি টিকিটের পয়সা চায়। এঁদের অতটা খেয়াল ছিল না। হড় হড় করে নামিয়ে দিল।

শুভকর্মের মতো অশুভকর্মেও বহু বিঘ্ন। পায়ে হেঁটে যাওয়ার বাধ্যতায় ভবনাথবাবুর উৎসাহ মন্দীভূত হল। অতখানি হাঁটলে লাথির জোর থাকবে না। দ্বিজদাসটা মনের সুখে কিলোবে, চড়াবে, গুঁতোবে, চিমটাবে, আর তিনি মারবেন মাত্র গোটাকয়েক দুর্বল লাথি। ‘না,’ তিনি ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘আমি (মারব) কিল-চড়, তুই (মারিস) লাথি।’

দ্বিজদাস কার্যকারণ বিনির্ণয় না-করতে পেরে আশ্চর্য হলেন। বললেন, ‘যে আজ্ঞে।’

কুণালের বাড়িতে পৌঁছে তাঁরা দেখলেন পাখি উড়ে গেছে। বাড়ি খালি।

ভবনাথ বললেন, ‘এখন কী করা যায়, দ্বিজু।’

দ্বিজদাস বললেন, ‘তাই তো।’

ভবনাথ বললেন ‘পার্কে (গিয়ে) একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক।’

ভবনাথ বললেন ‘সেটা ভালো।’

অশুভকর্মেও এত বিঘ্ন। অশুভকর্মের সংকল্প আর টেঁকে কই? ভবনাথ এতক্ষণ চিন্তার অবকাশ পেলেন। তখন দ্বিজদাস ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘দাদা, ভেবে কি দেখেছেন?’

‘কী?’

‘আপনার ও আমার ফাঁসি কি দ্বীপান্তর হলে আমাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যার কী দশা হবে?’

ভবনাথ বললেন, ‘হুঁ।’

‘আমি বলি,’ দ্বিজদাস ভয়ে ভয়ে প্রস্তাব করলেন, ‘আগে একবার বিয়ের জন্যে শাসানো যাক। তাতে যদি ফল না-হয়—’

‘তাহলে?’

‘তা হলে গুণ্ডা লেলিয়ে দিতে হবে।’

‘ঠিক বলেছ। কণ্টকেনৈব কণ্টকং। গুন্ডার পিছনে গুণ্ডা।’

বিশ্রাম করে দুই ভাই আবার কুণালের ওখানে চললেন। এবার দেখলেন আলো জ্বলছে।

‘দেখ, তুমি যদি ও মেয়েকে বিয়ে না করো—’ দ্বিজদাসের সোমকে ‘আপনি’ বলতেও অভিরুচি হল না।

‘বিয়েই তো করতে চাই।’ সোম বলল।

‘তবে?’ দ্বিজদাস আনন্দের আবেগে বুঝি মারা যান।

‘তবে তার আগে জানতে চাই তিনি আমাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক কি না।’

‘এক-শো বার ইচ্ছুক।’ দ্বিজদাস হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো হাসতে হাসতে কাঁদতে কাঁদতে কাঁপতে কাঁপতে বললেন।

‘আমি চরিত্রহীন একথা তিনি শুনেছেন?’

‘শুনতে হবে না। জেনেছেন।’

‘তার মানে?’

‘তার মানে তোমার কাজের দ্বারাই তোমার পরিচয়, ওহে ন্যাকারাম।’

ভবনাথ জুড়ে দিলেন, ‘ওহে নারকী।’

সোম বলল, ‘আপনারা এ সমস্ত কী সাজেস্ট করছেন?’

দ্বিজদাস বিশ্রী হেসে একটা অশ্লীল উক্তি করলেন। তা শুনে সোম তো হতবাক। ভবনাথ লজ্জিত বোধ করল। ভাগ্যক্রমে ললিতা ওখানে ছিল না। কুণাল পলায়ন করল।

দ্বিজদাস তাগাদা দিলেন। বললেন, ‘কি হে সুন্দর, বিদ্যাকে এখন তুমি ছাড়া আর কে বিয়ে করবে? বিদ্যা রাজি না-হয়ে পারে?’

সোম বলল, ‘কী করে আপনারা জানলেন? বলেছেন তিনি ওকথা?’

‘বলতে হয় না, বলতে হয় না। ‘Men may lie, but circumstances cannot’ আমি যে সেদিন জুরর হয়ে স্বকর্ণে শুনে এসেছি।’

এর উত্তরে কী বলতে পারে? সোম চুপ করে রইল।

দ্বিজদাস পুনশ্চ প্রশ্ন করলেন, ‘বলো ও মেয়েকে বিয়ে করবে কি না।’

‘যদি তিনি নিজমুখে বলেন ও আমি নিজের কানে শুনি যে আমার চরিত্রহীনতা সত্ত্বেও তিনি আমাকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক তবেই আমি তাঁকে বিবাহ করব, নতুবানয়।’

সোমের এই উক্তির পর দ্বিজদাস ও ভবনাথ পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়িকরলেন। ভবনাথ বললেন, ‘আচ্ছা।’

তখন দ্বিজদাসও বললেন, ‘আচ্ছা।’

তাঁরা সোমকে তাঁদের বাড়ি নিয়ে গেলেন। ডাকা হল অমিয়াকে। সে কেঁদে কেঁদে চোখের এক ফোঁটা জল অবশিষ্ট রাখেনি, কলঙ্কের ওপর কলঙ্ক তাকে অসাড় করে তুলেছে। প্রিয়তম পিতামাতার কাছ থেকে বারংবার অপমান ও অবিচার পেয়ে পেয়ে তার মনটা হয়ে উঠেছে কঠিন। তার রোখ চেপেছে সে বিয়ে করবে না।

সোম বলল, ‘অমিয়া দেবী, আপনাকে একটা কথা বলবার ছিল নিভৃতে। এখানে সুযোগ না-পাওয়ায় যেখানে সুযোগের অন্বেষণে আপনাকে নিয়ে গেলুম সেখানে আপনি স্থির থাকলেন না। আজ যেমন করে হোক আমার সেই কথাটা আপনার কানে পড়েছে। এখন যদি আপনি আমাকে বিয়ে করতে আন্তরিক ইচ্ছা প্রকাশ করেন তবে আমি আপনাকে সাধ্যানুসারে সুখী করবার দায়িত্ব নেব।’

অমিয়া বলল, ‘না।’

তা শুনে ভবনাথ চমকে উঠে ধমকে দিলেন। ‘না কী! হাঁ বল।’

দ্বিজদাস প্রতিধ্বনি করলেন, ‘হাঁ বল।’

অমিয়া তবু বলল, ‘না।’

ভবনাথ হুকুম করলেন, ‘বেতখানা নিয়ে আয় তো রে।’ দ্বিজদাস ইশারা করলেন। বেত এল।

ভবনাথ বেত নাচিয়ে বললেন, ‘বল হাঁ।’

অমিয়া বলল, ‘না।’

ভবনাথ বেত লাগাবেন এমন সময় সোম সেটা কেড়ে নিয়ে বিনাবাক্যব্যয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলল।

ভবনাথও বিনাবাক্যব্যয়ে সোমের পিঠে একটি ভাদ্র মাসের পাকা তাল স্থাপন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিজদাস তার পাছাকে ভুল করলেন ফুটবল বলে।

সোম নীরবে সইল।

ভবনাথ অমিয়াকে বললেন, ‘দেখলি তো? যতবার (তুই) ‘না’ বলবি (ততবার) এর পিঠে তাল পড়বে।’

‘আর এর পাছা হবে ফুটবল।’

অমিয়া বলল, ‘না।’

ভবনাথ ও দ্বিজদাস কথা রাখলেন। সোম এবারেও প্রতিবাদ করল না।

ভবনাথ ও দ্বিজদাস বললেন, ‘আবার?’

অমিয়া বলল, ‘না।’

ভবনাথ ও দ্বিজদাস এই নিয়ে সোমকে বার বার তিনবার মারলেন। সোম বেশি কিছু করল না। দ্বিজদাসের টাকের উপর বসাল একটি কিল, তিনি বসে পড়লেন। আর ভবনাথের দাঁতের উপর দিল একটু ঘুঁসি। তিনি হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

উভয়ের গৃহিণী ও সন্তানাদি এক পাল ভেড়ার মতো একসঙ্গে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করল। সোম দেখল আর অপেক্ষা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অমিয়াকে বলল, ‘আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধার সঞ্চার হয়েছে। ভরসা করি আপনার এই দৃঢ়তা আপনাকে বিপন্মুক্ত করবে। বিদায়।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *