৪. অজয় আর লীলার বিবাহিত জীবন

অজয় আর লীলার বিবাহিত জীবনে কিন্তু ইতিমধ্যে ঘটে গেছে অনেক ভাঙাগড়া, বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে জীবনের স্রোত। প্রথম ছটা মাস তারা দুজনে পরস্পরের মধ্যে মগ্ন হয়ে ছিল। বাইরের জগতের দিকে তাকাবার অবসর ছিল না, প্রবৃত্তিও বুঝি ছিল না। তারপর একদিন তারা সচেতন হয়ে উঠল। মেনে নিল, না, বাইরের জগতের দিকে চিরদিন পেছন ফিরে থাকা চলে না। দাম্পত্য জীবনের প্রবল আসক্তি তখন স্তিমিত হয়ে এসেছে। প্রাখর্য কমেছে, স্থির হয়ে গেছে প্রদীপের মৃদু অকম্পিত শিখার মতই। নতুন করেই অজয় কাজের মধ্যে নিজেকে ড়ুবিয়ে দিয়েছে। তার জন্যে লীলা এতটুকু অসুবিধে বোধ করেনি। ঘর-সংসারের হাজারো কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছে, আস্বাদন করেছে স্বামী-প্রেমের মধুরতাটুকু। শুধু সমরের কথাটা মনে হলেই একটা বিঁধে থাকা কাঁটা বুকের কোথায় যেন খচখচ করে ওঠে। বিবেক তার কুণ্ঠিত ছিল বলেই পারতপক্ষে সে সমরের নাম উল্লেখ করত না। শুধু একটি দিনই কথায় কথায় অজয়কে বলেছিল, তোমার বন্ধু সমরবাবুটির বিচিত্র ব্যবহারের কথা আমি কোনদিনই ভুলতে পারব না। কেন যে সেদিন অমন অভদ্রের মত ব্যবহার করেছিলেন।

অজয় একটুখানি চুপ করে থেকে মৃদু কণ্ঠে বলেছিল, হয়তো বেচারা বড় বেশি ভালবেসেছিল তোমায়, তাই সহজ মনে পরাজয়টা সে মেনে নিতে পারেনি।

প্রতিবাদের সুরে লীলা বলে উঠল, না, আমার তা মনে হয় না। নিশ্চয়ই অন্য কোন কারণ আছে।

আর কি কারণই বা থাকতে পারে?

তা আমি জানি না। তবে

তবে ওর সম্বন্ধে আর কোন আলোচনা আমাদের না করাই ভাল, লীলা। তার কণ্ঠস্বরে এমন একটা কিছু ছিল, যার পর লীলা সত্যিই স্বামীর সামনে সমরের নাম আর কোনদিন উল্লেখ করেনি।

পরিশ্রমটা বড় বেশি করছিল বলেই ভেতরে অজয়ের স্বাস্থ্যটা ভেঙে পড়েছিল। প্রথম দিকে লীলা সেটা লক্ষ্য করেনি। করল যেদিন, সেদিনই শঙ্কিত কণ্ঠে বলল, এরকম ভাবে অবহেলা করাটা তো ঠিক নয়। একজন ডাক্তার দেখাও।

অকারণে অজয় যেন আহত জন্তুর মতই গর্জন করে উঠল, ডাক্তার! শহরে কোন ডাক্তার নেই। ছিল একজনই—সে চলে গেছে। কোথায় তা ভগবানই জানেন।

লীলা আর কোন প্রতিবাদ করেনি। তাই বলে নিরস্ত্রও হতে পারেনি। মরীয়া হয়েই শেষ পর্যন্ত সে শ্বশুরের শরণাপন্ন হল।

ব্যবসাটা পুরোপুরি ছেলের হাতে ছেড়ে দিয়ে বৃদ্ধ মিঃ সেন অবসর নিয়েছিলেন। জীবনে তাঁর শুধু একটিই আনন্দ ছিল। কাগজের পাতায় দূর গ্রামাঞ্চলে বাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপন হাতড়ে বেড়ানো। সেদিনও বসে তাই করছিলেন। পাশেই চায়ের খালি পেয়ালা, সামনে টেবিলের ওপর দৈনিক আর মাসিক-পত্রের স্তুপ। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।

লীলা ঘরে ঢুকে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। একটু ইতস্তত করে মৃদু কণ্ঠে বললে, বাবা, আপনার ছেলের শরীর নিয়ে তো রীতিমত ভাবনার কথা হয়ে দাঁড়াল।

মুখ তুললেন মিঃ সেন। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, কেন, কি হয়েছে মা?

লীলা তাঁর কাছে কিছুই গোপন করল না। ডাক্তার দেখানোয় অজয়ের আপত্তির কথাও জানাল।

মিঃ সেন সবটুকু শুনে গেলেন। পরে শান্ত কণ্ঠেই বললেন, কিচ্ছু ভাবনা কর না, লিলি! আমাকে শুধু একটু সময় দাও।

তা নয় দিচ্ছি। কিন্তু যা করবার, তাড়াতাড়ি করতে হবে বাবা। দেরি করলে হয়তো হাতের বাইরে চলে যাবে।

ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছিল সে, মিঃ সেন তাকে ফিরে ডাকলেন, শোন, শোন লিলি, এই ছবিখানা দেখ দিকিনি—

হাতের কাগজখানা তিনি পুত্রবধূর সামনে মেলে ধরলেন। পাহাড়ের চুড়োয় অবস্থিত একটা বাড়ির ফোটো। তলায় শীঘ্রই বিক্রয় হইবে।

শ্বশুরের কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়ে লীলা ছবিখানা দেখে বলে উঠল, বাঃ! চমৎকার তো। ঠিক যেন স্বপনপুরীর রাজপ্রাসাদ।

কাগজখানা মুড়ে ফেলে মিঃ সেন গম্ভীর মুখে বললেন, ঠিক বলেছ মা, আমারও সেই মত।

দিন সাতেক পরে রাত্রে খাওয়ার টেবিলে বসে মিঃ সেন ছেলেকে বললেন, তোমার ব্যবসা চালাবার রীতিনীতি আমার পছন্দ হচ্ছে না বাবু!

অজয় বিস্মিত দৃষ্টি মেলে বাপের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তুমি সব গোলমাল পাকিয়ে ফেলছ! ব্যবসা হবে ঋজু—সরল। বক্সিং তো কিছুদিন লড়েছ, নক-আউটটা বোঝ না?

অজয় গম্ভীর হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, কি বলতে চাইছেন বাবা?

কিছু না। কিছুদিন আমি আবার ব্যবসাপত্তর দেখব। যে জট পাকিয়েছ, সেটাকে আবার সোজা পথে চালাব।

যা খুশি আপনার! বলে অজয় টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

মিঃ সেন এবার পুত্রকে ছেড়ে পুত্রবধূকে ধরলেন, তোমার স্বাস্থ্যটাও তো খুব ভাল যাচ্ছে না, লিলি?

শ্বশুরের চাতুরীটা সে বুঝতে পেরেছিল বলেই সেও মিথ্যার আশ্রয় নিল।

অভিনয়ের ভঙ্গিতে বলল, কি জানি বাবা, মাঝে মাঝে এমন কুঁড়েমি লাগে! কিছুদিন ধরে রাত্রে ভাল ঘুম হচ্ছে না।

যেতে গিয়েও অজয় দরজায় গোড়ায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। মনে মনে সে লজ্জিত হয়ে উঠেছিল। লীলার শরীর ভাল যাচ্ছে না, এটা সে আগে ধরতে পারেনি বলে অভিযোগের সুরে সে স্ত্রীকে বলল, তুমি তো কই কোনদিন বলনি, লীলা?

লীলা হাসি চেপে বলল, ও এমন কিছু না। এমনি মাঝে মাঝে

মিঃ সেন তাড়াতাড়ি কণ্ঠে জোর দিয়ে বলে উঠলেন, না, না, এসব উড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয়। হ্যাঁ, তোমাকে যে বাড়ির ফটোখানা দেখিয়েছিলাম, মনে আছে, লিলি? সেই যে পাহাড়ের চুড়োর ওপর?

হ্যাঁ, বাবা।

সেটা কিনে ফেলেছি মা। জায়গাটা খুব স্বাস্থ্যকর, আর বেশ নির্জন। আমার ইচ্ছে, তোমরা সেখানেই কিছুদিন থেকে আসো। তদারকি করবার জন্য একজন সরকার রেখেছি। কোনরকম অসুবিধে হবে না।

লীলা নিরীহের ভঙ্গিতে বলে উঠল, আমার তো যাবার খুবই ইচ্ছে বাবা, কিন্তু– সে ফিরে তাকাল স্বামীর দিকে।

অজয় ভারী গলায় বলল, ঠিক আছে।

তাই হবে বাবা। আমরা কিছুদিনের জন্যে বেড়িয়ে আসব।

মিঃ সেন হাসি চেপে পুত্রবধুর দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকালেন শুধু।

.

পাকদণ্ডী পথ বেয়ে গিরমহলে পৌঁছতে হলে নিশ্বাস ঘন হয়, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন যায় বেড়ে। তবু চড়াই ভাঙতে ভাঙতে লীলা একেবারে আনন্দে উপচে পড়ল। তারই ছোঁয়া বুঝি লাগল অজয়কেও। সেও রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠল।

দুজনেই এসেছে তারা। সঙ্গে কোন ঝি-চাকর আনেনি। সরকার ভজহরি ঠিক করে রেখেছে। রোজ সকালে দেহাত থেকে একজন মেয়ে এসে তাদের বাসন মেজে রান্নাবান্না করে দিয়ে যাবে। এখানকার জীবনে বোধ করি তার বেশি কিছু প্রয়োজনও হবে না।

অনেকখানি উঁচুতে উঠে এসে লীলা ফেলে-আসা গ্রামখানার দিকে একবার ফিরে তাকাল। এখান থেকে সেটাকে কুশলী শিল্পীর হাতে-আঁকা একখানা নিখুঁত ছবি বলেই মনে হচ্ছে।

আনন্দে খিলখিল করে হেসে উঠল লীলা। অজয় বললে, এত যখন ভাল লাগছে তোমার, তখন বেশ তো, মাঝে মাঝে গ্রামে যাওয়া যাবে। কিছু বন্ধু বান্ধবও জোগাড় হবে।

লীলা কিন্তু ততক্ষণে একখানা পাথরের ওপর বসে পড়েছে। অজয় গিয়ে তার পাশে বসতে বসতে বলল, কি হল লীলু, ক্লান্ত নাকি?

না গো, উপভোগ করছি।

তার চেয়ে কাঁধে যখন একবার করেছি তখন এইটুকুও না হয় বয়ে নিয়ে যেতে দাও।

সত্যিই সে দুহাত দিয়ে শুন্যে তুলে নিল লীলাকে, বুকের ওপর কিছুটা বা চেপেই ধরল।

খুশিতে খিলখিল করে হেসে উঠল লীলা। বাঁ হাত বাড়িয়ে স্বামীর গলাখানা চেপে ধরে কৃত্রিম কণ্ঠে বলল, এই, কি হচ্ছে দুষ্টু! শিগগির নামিয়ে দাও, কেউ হয়তো দেখে ফেলবে।

এই মিষ্টি হুকুমটুকু শোনবার কোন আগ্রহ দেখা গেল না অজয়ের। বাকি পথটুক সে লীলাকে বয়েই নিয়ে চলল।

বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ভজহরি আর সেই দেহাতী মেয়েটি তাদের অভ্যর্থনা করবার জন্যে।

শীর্ণ দীর্ঘ দেহ ভজহরি। বয়সের ভারে একটু বা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। মাথার চুলে তুষারমৌলি হিমালয়ের শুভ্রতা। নতুন মনিব আর তাঁর স্ত্রীকে সঙ্গে করে সে ভিতরে নিয়ে চলল।

সাবেকী আমলের বাড়ি। অসংখ্য বড় বড় ঘর, চওড়া চওড়া বারান্দা। ছাদটা একেবারে পাহাড়ের কিনারায় গিয়ে ঠেকেছে।

শ্রান্তি ক্লান্তি যেন ভুলে গেল লীলা। তখুনি কোমরে কাপড় জড়িয়ে ফেলল। তারপর অজয়কে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ব্যবস্থাপত্র করতে লাগল। সকালে কোথায় বসবে, কোথায় খাবে, ঘুমোবেই বা কোন্ ঘরে।

.

সে রাত্রে খাবার ঘরে বসে মায়া আর সমর দুজনেরই নজরে পড়ল গিরমহলে প্রাণের সাড়া জেগেছে। ঘরে ঘরে আলো সঞ্চারিত ছায়ামূর্তি।

আগন্তুকের খবরটা পাণ্ডের স্ত্রীর কাছ থেকে মায়া আগেই পেয়েছিল। তাই ভেতর ভেতর তার উত্তেজনা আর কৌতূহলের অন্ত ছিল না। এক সময় সেটা আর চাপতে না পেরে বলে উঠল, জানেন ডাক্তার রায়, গাঁয়ে যে হৈচৈ পড়ে গেছে!

সমর কোন কথা না বলে প্রসন্ন দৃষ্টিটা শুধু তুলে ধরল। মায়া বলে চলল, পাহাড়ের মাথায় বাড়িটায় লোক এসে গেছে।

কোন বিস্ময় প্রকাশ করল না সমর। নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল, দেখছি তো!

খোলা জানালার ভেতর দিয়ে মায়া আর একবার গিরমহলের দিকে তাকাল। চাঁদের আলোয় বাড়িখানা সত্যিই সুন্দর দেখাচ্ছে। রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে যেন। স্বতঃই মায়ার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে, তাই না?

হ্যাঁ, এই কালো জগতে সব সৎকাজই ঝকঝক্‌ করে। পরক্ষণেই মায়ার দিকে ফিরে শ্লেষের সুরে সমর বলল, সত্যি কিন্তু তা করে না, মিস দে।

কথাটা গায়ে মাখল না মায়া। নিজের খেয়ালেই বলে চলল, পাণ্ডের স্ত্রী বলছিলেন, অল্পবয়সী স্বামী স্ত্রী—হয়তো মধুচন্দ্র যাপন করতে এসেছেন। দেখতেও খুব সুন্দর। সর্বাঙ্গে নাকি শহরের ছাপ।

সমর মন্তব্য করল, যেমন গোড়ার দিকে আমাদের ছিল।

মায়া আবার কথাটা এড়িয়ে গেল। বলল, কি জানি, গাঁয়ের দিকে ওঁরা নামবেন কিনা। আলাপ করা যেত। নতুন মুখ যে কতদিন দেখিনি।

গম্ভীর দৃষ্টিতে সমর কতক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, আমার মনে হচ্ছে, এখানে আপনার মন টিকছে না। যদি সত্যিই তাই হয়

কড়া সুরে প্রতিবাদ করল মায়া, না, কক্ষনো না। খুব মন টিকছে আমার।

না টেকাটা অস্বাভাবিক নয়, মিস দে। শহরে মানুষ হয়েছেন আপনি; কাজেই শহরের আলো, শহরের রাস্তা, শহরের ফ্যাশনের জন্য মনটা কেঁদে উঠতে পারে বৈকি।

না, পারে না।

আপনি বলতে চান, এখানে সত্যিই আপনার ভাল লাগছে?

হ্যাঁ, লাগছে।

চিরকাল থাকতে পারেন?

পারি।

খাওয়া শেষ করে সমর চেয়ারে হেলান দিয়ে পড়ল। উত্তাপহীন কণ্ঠে বলল, না, সত্যিই আপনার প্রশংসা করতে হয়। কে জানে, আমাকেই হয়ত এখান থেকে একদিন চলে যেতে হবে।

মায়ার চোখে শঙ্কার ছায়া ফুটে উঠল। প্রায় আর্তনাদের সুরে সে বলল, আপনি—চলে যাবেন এখান থেকে?

মন যদি চায়, যেতে হবে বৈকি! আমার কাছে তো সব জায়গাই সমান। তবু ভারি খুশি হলুম আপনি এখানে থাকতে চান শুনে।

মায়া চকিতে উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। আবেগ কম্পিত কণ্ঠে বলল, কিসের টোপ গেলাতে চাইছেন আমায়?—আপনি জানেন আমি ভালবাসি

আচমকা থেমে পড়ে নিজেকে সামলে নিল সে।-আমি ভালবাসি এই গাঁকে, গাঁয়ের লোকদের কিন্তু এত নিষ্ঠুর আপনি কেন? আপনার কি ক্ষতি আমি করেছি? কান্না চাপতে চাপতে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

.

রাতের খাওয়া শেষ করে অজয় আর লীলা তখন বাইরের বারান্দায় বসে ছিল। অদূরে দাঁড়িয়ে সরকার ভজহরি বলছিল, আজকে এই বাড়িটার নাম গিরমহল হয়েছে বটে, কিন্তু বাবু, গোড়াতে এর নাম ছিল নিরাময়।

নিরাময়? অব্যক্ত কণ্ঠে লীলা বলে উঠল, অদ্ভুত নাম তো! আসলে এটা কি কোন হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য-নিবাস ছিল?

না, মা। বাড়িটার একটা ইতিহাস আছে। প্রথম যিনি এই প্রাসাদ তৈরি করেন, তাঁর সময় থেকেই এই নামটা চলে আসছে। দুশো বছরের মধ্যে গিরমহল হাতবদল হয়েছে অনেকবার, কিন্তু সে ইতিহাসটা আজো মরে যায়নি।

অজয় কৌতূহলের সুরে প্রশ্ন করল, ইতিহাসটা জানেন আপনি?

আজ্ঞে, এখানকার লোক যখন, তখন জানি না বলি কি করে!

লীলা মিনতির সুরে বলল, আমাদের বলুন না, সরকার মশাই!

এমন আগ্রহী শ্রোতা ভজহরি বোধ হয় বহুদিন পায়নি। তাই সে পরম উৎসাহে বলতে শুরু করল, বাড়িটা যিনি প্রথম তৈরি করান, তিনি এই তল্লাটে রাজাই ছিলেন বলতে পারেন। তাঁর স্ত্রী রানীসাহেবা খুব সুন্দর দেখতে ছিলেন। এখানে যখন ওঁরা বাস করতে আসেন তখন সঙ্গে করে রাজাসাহেব তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে এসেছিলেন। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁকে ছেড়ে একটা দিনও রাজাসাহেব থাকতে পারতেন না। কিন্তু সেই বন্ধু একদিন রানীসাহেবাকে নিয়ে পালিয়ে গেলেন। রাজাসাহেব কিছু বললেন না, কোন হৈচৈও করলেন না। শুধু একলা ঘরে বসে বসে দিনের পর দিন একটা তলোয়ারে শান দিতে লাগলেন। কিসের জন্যে? তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বাবু, যে, ওঁরা দুজন বন্ধু আর রানীসাহেবা ফিরে একদিন আসবেনই।

লম্বা পনেরো বছর পরে বন্ধুটি একলা ফিরে এলেন। রাজাসাহেবকে বললেন, একাই আমাকে আসতে হল বন্ধু, কারণ তোমার স্ত্রী মারা গেছে। অপরাধী আমি, আমায় শাস্তি দাও। যদি হত্যা করতে চাও, তাই কর। রাজাসাহেব কিন্তু বন্ধুকে হত্যা করেননি, বরং ভালবেসে বুকেই টেনে নিয়েছিলেন। রানীর কথা রাজার মনে রইল না। তারপর থেকে বরাবর একসঙ্গে ছিলেন ওই বাড়িতে। মারা যাবার আগে তিনিই বাবু বাড়িখানার নামকরণ করেন নিরাময়।

ভজহরি তার ইতিহাস শেষ করল। অজয় কিন্তু তার স্ত্রীর মুখের দিকে আর তাকাতে পারল না। কতক্ষণ অস্থির চরণে পায়চারি করে একসময় সরকারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, আপনার ইতিহাসের সঙ্গে বাড়ির নিরাময়নামের কোন সম্বন্ধ আছে কিনা বলতে পারেন?

আজ্ঞে না বাবু, তা পারব না। তবে গল্প যেটা চলে আসছে, সেইটাই আপনাদের বললাম।

অকস্মাৎ লীলার হাত ধরে টেনে তুলতে তুলতে অজয় বলল, চল শুয়ে পড়িগে। বড় ঘুম পাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *