অধ্যায় ৪৮ – নতুন জনগোষ্ঠী
খ্রিস্টপূর্ব ৮৫০ সালের ৫০ বছর পর অ্যাসিরীয়া তাদের প্রতিবেশীদের ওপর আক্রমণ চালায়।
জেহু আত্মসমর্পণ করার অল্পদিনের মাঝেই ব্যাবিলনের বর্ষীয়ান রাজার মৃত্যু হয় এবং তার ২ সন্তান সিংহাসন নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। ফলে অ্যাসিরীয়ার শালমানেসার জন্য তার দক্ষিণের প্রতিবেশীকে আক্রমণ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হল।
তবে তিনি এতে রাজি হননি। বরং তিনি সিংহাসন দখল করতে সহায়তা করার জন্য জ্যেষ্ঠ রাজপুত্রের কাছে সেনা পাঠান। শালমানেসারের শাসনামলের অষ্টম বছরে বড় রাজপুত্র মারদুক-জাকির-শুমির বিরুদ্ধে তার ছোটভাই বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
অ্যাসিরীয় সেনাদের অগ্রসর হতে দেখেই বিদ্রোহী রাজপুত্র লেজ তুলে পালালেন। ‘শেয়ালের মতো, প্রাচীরের একটি গর্ত দিয়ে তিনি পালালেন। অ্যাসিরীয়রা তাকে ধরে আনলেন। শালমানেসার বলেন, ‘রাজপুত্র ও তার সঙ্গে থাকা বিদ্রোহী সেনা-অধিনায়কদেরও ধরে নিয়ে আসা হল এবং আমি তাদেরকে তলোয়ার দিয়ে কচুকাটা করলাম।’
বিদ্রোহ দমনের পর শালমানেসার বিভিন্ন উপহার নিয়ে ব্যাবিলন সফরে এলেন এবং মারদুক-জাকির-শুমির মেয়ের সঙ্গে তার নিজের ২য় পুত্রের বিয়ের বন্দোবস্ত করলেন। তিনি তার নিজের রাজপ্রাসাদে পাথরে খোদাই করা একটি ছবি আঁকার ব্যবস্থা করলেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, তিনি এবং মারদুক-জাকির- শুমি হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। দুই রাজা একই উচ্চতায়, সম্মানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন।
শালমানেসারের ব্যাবিলনে হামলা চালানোর সঙ্গে সামরিক দুর্বলতার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি তার শাসনামলের বেশিরভাগ সময় নিরন্তর যুদ্ধযাত্রায় ব্যয় করেছেন। অ্যাসিরীয় রেনেসাঁ আমলের রাজারা প্রাচীন ও বিখ্যাত শহর ব্যাবিলন- আক্রমণে বিশেষভাবে অনিচ্ছুক ছিলেন, কারণ তারা ব্যাবিলনের মূল দেবতা মারদূকের বিরাগভাজন হতে চাইতেন না। শালমানেসার তৃতীয় ব্যাবিলন পেরিয়ে পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম ও আরও দক্ষিণে সেনা পাঠাতে লাগলেন। ফলে খুব শিগগির ৩টি নতুন জাতি তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হল।
পারস্য উপসাগরের একেবারে মাথার দিকে ৫টি সেমাইট গোত্র কিছু অঞ্চল দখল করেছিল, যেগুলো এককালে সুমেরের দক্ষিণপ্রান্তের অংশ ছিল। বিট- আমুকান্নি গোত্র পুরনো সুমেরীয় শহর উরুকের কাছাকাছি অঞ্চলটি দখল করেছিল। বিট-ডাক্কুরি গোত্র আরও উত্তরে, ব্যাবিলনের কাছে অবস্থান নেয়। পরিশেষে, বিট-ইয়াকিন গোত্র উর ও পারস্য উপসাগরের সীমান্তে অবস্থিত নলখাগড়ায় আচ্ছাদিত অঞ্চলের দখল নিয়েছিল। এই ৩টি গোত্রের সুরক্ষায় আরও ২টি ছোট গোত্রও এসব এলাকায় বসবাস করছিল। সামগ্রিকভাবে, অ্যাসিরীয়রা এই ৫টি গোত্রকে ‘চালদিয়ান’ নামে চিনতেন।
তারা ব্যাবিলনের রাজাকে নামকাওয়াস্তে নজরানা দিত। তাদের ব্যাবিলনের বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়ার ব্যাপারটি মোটামুটি আলংকারিক ছিল; তারা স্বাধীনভাবেই থাকত।
মারদুক-জাকির-শুমিকে তার সিংহাসন ফিরে পেতে সাহায্য করার পর শালমানেসার তৃতীয় ব্যাবিলনের দক্ষিণ সীমান্তে পৌঁছে গেলেন। তিনি চালদিয়ান গোত্রগুলোকে তার বশ্যতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য করলেন। এই গোত্রগুলো তার জন্য নজরানা পাঠাল। এই নজরানা সামান্য ছিল না। চালদিয়ানরা সোনা, রুপা, হাতির দাঁত ও চামড়া পাঠাল, যা থেকে ধারণা করা যায়, তারা উপসাগরের মাধ্যমে অনেক দূরদূরান্তের (এমনকি ভারতও) বণিকদের সঙ্গে বাণিজ্য করে অভ্যস্ত ছিল। শালমানেসারের এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল ব্যাবিলনকে সহায়তা করা, কারণ চালদিয়ানরা রাজার ছোটভাইয়ের বিদ্রোহের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। তবে এই সুযোগে তিনি চালদিয়ানদের দমন করার পাশাপাশি উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের সীমান্তের দখল নিয়ে নেন। ফলে ব্যাবিলনের সীমানা বাড়ানোর সুযোগ কমে যায়।
৮৪০ সালের দিকে শালমানেসার ইউফ্রেতিসের উত্তরদিক দিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ে আগাতে থাকেন। এ পর্যায়ে পশ্চিমদিকে ঘুরে থে আরামিয়ানদের দখলে থাকা ভূখণ্ড পার হয়ে যান। সেখানে ভূমধ্যসাগরের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে ছিল কিউ নামে একটি ছোট রাজত্ব।
কিউ নতুন দেশ হলেও এর বাসিন্দারা ছিলেন একটি প্রাচীন জনগোষ্ঠী। ৩০০ বছর আগে হিট্টিটদের রাজধানী হাউসাস আগুনে পুড়ে যায় এবং হিট্টিট জনগোষ্ঠী ছত্রভঙ্গ হয়। তাদের পুরনো রাজত্বের কেন্দ্রটি বসফরাস প্রণালি পেরিয়ে দক্ষিণ ইউরোপ থেকে আসা একদল মানুষের দখলে চলে গেছিল। তারা এশিয়া মাইনরে থিতু হয়ে গর্ডিয়াম নামে একটি রাজধানী শহর তৈরি করে। তাদের নতুন নামকরণ হয় ফ্রিজিয়ান। হিট্টিটরা তাদের উপকূলীয় এলাকাও মাইসেনীয়দের কাছে হারিয়ে ফেলে। ডোরিয়ানদের আগ্রাসনে এই ঘটনা ঘটে। ডোরিয়ানরা এশিয়া মাইনরের পশ্চিম প্রান্তে ও দক্ষিণ উপকূলের আশেপাশে বসতি তৈরি করে।
ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়া হিট্টিটরা আবারও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে তাদের আদি বাসস্থানের কাছাকাছি একটি অঞ্চলে জমায়েত হয়। এই একটা জায়গাকে তারা তখনও নিজ-ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করতে পারত। এখানে তারা হিট্টিট দেবতার উপাসনা করত এবং তারা ছোট ছোট স্বাধীন, নব্য-হিটিট রাজত্বের অংশ হিসেবে প্রাচীরে ঘেরা শহরের আশেপাশে বসবাস করতে লাগল। এ-ধরনের শহরের মধ্যে ইউফ্রেতিসের উত্তরে অবস্থিত কারচেমিশ ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী।
নিও-হিট্টিট রাজত্ব কিউ-এর খুব বেশি সামরিক সক্ষমতা ছিল না, কিন্তু তাদের অবস্থান ছিল কৌশলগত দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। টাউরাস পর্বতমালার ভেতর দিয়ে যাওয়া পথের ওপর অবস্থিত এই শহরটি ছিল এশিয়া মাইনরে প্রবেশের সবচেয়ে বিকল্প এবং একইসঙ্গে এখান থেকে পর্বতের উত্তরে অবস্থিত রুপার খনিতে যাওয়াও সহজ ছিল। শালমানেসার কিউ রাজত্বে হামলা চালালেন। রাজধানী শহরে প্রবেশ করে তিনি রূপার খনিগুলোর মালিকানা বুঝে নিলেন।
তারপর তিনি পূর্বদিকে নজর দিলেন। সবসময়ের মতো, তখনও টাইগ্রিসের অপরপারের এলামাইটরা নিরন্তর হুমকির উৎস ছিল। তবে এলামাইটদের রাজারা দেখলেন যে অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যাবিলনের চেয়ে অ্যাসিরীয়া অনেক বড় আকারের হুমকি। এ কারণে তারা যুদ্ধের আগে তারা ব্যাবিলনের রাজাদের সঙ্গে মৈত্রী তৈরি করল। শালমানেসারও ব্যাবিলনের বন্ধু ছিলেন। তবে প্রাচীন আমলে বন্ধুর বন্ধুও যে আপনার বন্ধু হবে, সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। শালমানেসার ধরেই নিলেন ব্যাবিলন ও এলামের মধ্যে জোট হওয়া অ্যাসিরীয়ার প্রতি একধরনের হুমকি।
শালমানেসার আনুষ্ঠানিকভাবে এলামকে তার সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো চেষ্টা চালাননি। তবে তিনি এর শহরগুলোর কাছ থেকে নজরানা চেয়ে বসলেন। এলামাইটদের সাম্রাজ্যে কয়েকটি অ্যাসিরীয় হামলা শহরগুলোকে এই নজরানা দিতে প্রণোদিত করল। শালমানেসার তার নিজের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করার জন্য জাগরোস পর্বতমালায় একটি অভিযান চালালেন। এলামের উত্তর প্রান্তে যেসব লোকজন বসবাস করতেন, তাদেরকে বশীভূত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। এই হামলার পর তিনি এলামের ২ সীমানা দখলে রাখার দাবি জানাতে পারলেন।
উত্তরের পর্বতের বাসিন্দারা খুব সম্ভবত প্রায় ১ হাজার বছর আগে সেই একই যাযাবর গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাদের একটি অংশ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভারতবর্ষে চলে গেছিল। শালমানেসারের কাহিনিকারের বর্ণনা থেকে ২টি গোত্রের নাম জানা যায়। জাগরোসের ঠিক অপরদিকে এলামের পশ্চিমপ্রান্তে বসবাসরত পারসুয়া এবং মাদা, যারা তখনও উত্তরাঞ্চলে যাযাবরের মতো ঘুরছিল।
শালমানেসারের বিরুদ্ধে পারসুয়া বা মাদা, কেউই তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। তিনি পার্বত্য এলাকার ২৭ জন গোত্রপ্রধানের সমর্থন নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। তিনি এই অভিযানকে তেমন কোনো গুরুত্ব দেননি। পারসুয়া ও মাদা গোত্র শালমানেসার ও এলামাইটদের মাঝে থাকা ন্যূনতম পর্যায়ের বাধা হিসেবে বিবেচিত হল। আরও প্রায় ১০০ বছর পর গ্রিকরা তাদের ভিন্ন নামে নামকরণ করে : পার্সিয়ান (পারস্যবাসী) ও মেদেস।
শালমানেসার তৃতীয় ৮২৪ সালে মারা যান। তার নিজের ছেলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। মৃত্যুশয্যায় শালমানেসার সেই বিদ্রোহী পুত্রকে ত্যাজ্য ঘোষণা করে দ্বিতীয় পুত্র শামসি-আদাদকে (ব্যাবিলনীয় রাজকন্যার স্বামী) উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচন করেন। বিদ্রোহ দমনের আগেই তিনি মারা যান। শামসি-আদাদ পঞ্চম আনুষ্ঠানিকভাবে রাজার পদের দাবিদার হলেও ভাইয়ের সমর্থকরা তাকে কোণঠাসা করে ফেলে। বাধ্য হয়ে নিজের দেশ থেকে পালিয়ে যান তিনি।
শামসি-আদাদ পঞ্চমের নিজের বর্ণনায়, এটি বিশাল আকারের বিদ্রোহ ছিল। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই আসসুর-দানিন-আপ্লি, তার পিতা শালেমানেসারের আমলে খারাপ মানুষের মতো আচরণ করলেন। তিনি বিদ্রোহ ও অশুভ চক্রান্তে মেতে উঠলেন আর পুরো জাতিকে যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিলেন। তিনি উত্তর ও দক্ষিণের সমস্ত অ্যাসিরীয়াকে এই বিদ্রোহে শামিল করলেন। ২৭টি শহরে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল। বিশ্বের ৪টি অঞ্চলের রাজা শালমানেসারের বিরুদ্ধে, আমার পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মাতলেন আমারই ভাই।’
এ-ধরনের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো শক্তিমত্তা শুধু তার শ্বশুর, ব্যাবিলনের রাজারই ছিল। শামসি-আদাদ ব্যাবিলনে পালিয়ে গেলেন এবং মারদুক-জাতির-শুমির কাছে সাহায্য চাইলেন। ব্যাবিলনের রাজা এতে সম্মত হলেন এবং বৈধ অ্যাসিরীয় রাজাকে ক্ষমতা ফিরে পেতে সহায়তা করার জন্য বাহিনী পাঠালেন।
তবে মারদুক-জাকির-শুমির বিবেচনায় ভুল ছিল। তিনি তার জামাতার ওপর পুরো বিশ্বাস রাখতে পারেননি। তিনি ব্যাবিলনীয় যোদ্ধা পাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে শামসি-আদাদকে একটি চুক্তি সাক্ষর করতে বাধ্য করেন। এই চুক্তিটি অলংকারিক হলেও এতে তাকে ‘ব্যাবিলনের শ্রেষ্ঠত্ব’ মেনে নিতে হয়েছিল। চুক্তিটি এমন ভাবে লেখা হয়েছিল, যাতে শামসি আদাদকে রাজার উপাধি দিতে না হয়। এই চুক্তি মতে শুধুমাত্র মারদুক-জাকির-শুমি রাজার মর্যাদা পান। এমনকি, এই চুক্তি চূড়ান্ত করার সময় সব কার্যক্রম শুধুমাত্র ব্যাবিলনীয় দেবতাদের সামনেই করা হয়। অ্যাসিরীয় দেবতারা সেখান থেকে পুরোপুরি অনুপস্থিত ছিল।
চুক্তির বিষয়বস্তু মনঃপূত না হলেও নিজের সিংহাসন ফিরে পাওয়ার অভিলাষে এতে স্বাক্ষর করলেন শামসি-আদাদ। তিনি শ্বশুরের কাছ থেকে পাওয়া সেনাদের একত্রিত করলেন এবং তার নিজ শহরে হামলা চালালেন। তিনি প্রাচীর ভেঙে আসসুরের দখল ফিরে পেলেন।
শামসি-আদাদ পঞ্চম তার সিংহাসন ফিরে পেলেন। তিনি মারদুক-জাকির- শুমিকে দেওয়া কথা রাখলেন। হয় তিনি এককথার মানুষ ছিলেন অথবা ব্যাবিলনের দেবতাদের ভয়ে ভীত ছিলেন। তবে যখন মারদুক-জাকির-শুমি মারা গেলেন এবং তার ছেলে মারদুক-বালাসসু-ইকবি ক্ষমতায় আরোহণ করলেন, তখন শামসি-আদাদ এক বিশেষ পরিকল্পনা আঁটলেন। তিনি এমন একটি উদ্যোগ নিলেন, যা এর আগে কোনো অ্যাসিরীয় রাজা কল্পনাও করেননি—ব্যাবিলনে হামলা চালানো।
মারদুক-বালাসসু-ইকবির অভিষেকের কয়েক বছরের মধ্যেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রত হলেন শামসি-আদাদ। শামসি-আদাদ সেনা জমায়েত করলেন এবং দক্ষিণের দিকে রওনা হলেন। তবে সরাসরি না যেয়ে টাইগ্রিসের তীর ধরে দুলকি চালে আগাতে লাগলেন। এ থেকে মনে হতে পারে, আসন্ন হামলার বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তিনি তার শালাকে বাড়তি সময় দিচ্ছেন। তিনি পথিমধ্যে বেশকিছু গ্রামে হামলা চালান এবং একপর্যায়ে যাত্রাবিরতি নিয়ে সিংহশিকারেও মেতে ওঠেন। এসময় তিনি মোট ৩টি সিংহকে হত্যা করেন।
কিছু চালদিয়ান ও এলামাইট মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে মারদুক-বালাসসু-ইকবি তার বিরুদ্ধে লড়তে এলেন। তবে এই মৈত্রী বেশিক্ষণ টেকেনি। শামসি আদাদের কাহিনিকারের বর্ণনা মতে :
‘সে আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এগিয়ে এল, এবং আমি তার সঙ্গে লড়লাম। আমার হাতে তার পরাজয় এল। আমি তার ৫ হাজার সেনার গলা কেটে ফেললাম, ২ হাজার সেনাকে আটক করলাম। সঙ্গে ১০০ রথ, ২০০ ঘোড়া, তার রাজকীয় তাঁবু, তাঁবুর ভেতরে রাখা খাট—এসব আমি তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলাম।’
এ থেকে বোঝা যায়, অ্যাসিরীয় সেনারা ব্যাবিলনের একেবারে অভ্যন্তরে ঢুকে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। আটক যুদ্ধবন্দিদের মধ্যে ব্যাবিলনের রাজাও ছিলেন।
শামসি-আদাদ তার প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাবিলনে একজন পুতুল-রাজা নিয়োগ দিলেন। তিনি ছিলেন ব্যাবিলনের একজন সাবেক সভাসদ। তার দায়িত্ব ছিল প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাবিলন শাসন করা; রাজা হিসেবে নয়। তবে এই দায়িত্বে খুব একটা লাভবান হতে না পেরে তিনি বিদ্রোহ করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন।
এক বছরের কম সময়ের মধ্যে শামসি-আদাদকে ব্যাবিলনে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। এবার তিনি সেই প্রতিনিধি রাজাকে গ্রেপ্তার করে অ্যাসিরীয়ায় পাঠালেন।
এ পর্যায়ে এসে শামসি-আদাদ পঞ্চম নিজেকে ‘সুমের ও আক্কাদের রাজা হিসেবে ঘোষণা দিলেন। এক্ষেত্রে তিনি একটি সূক্ষ্ম কৌশলের আশ্রয় নিলেন। নিজেকে ব্যাবিলনের রাজা দাবি না করে বরং তিনি ব্যাবিলনের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করলেন। তিনি বোঝালেন, যে একমাত্র অ্যাসিরীয়াই গুরুত্বপূর্ণ। তারাই ব্যাবিলনীয় কৃষ্টি ও দেবতাদের রক্ষক। এভাবে তিনি তার শ্বশুরের কাছ থেকে আসা অপমানের শোধ নিলেন।
অল্পদিন পরেই, খুব কম বয়সে শামসি-আদাদের মৃত্যু হল। ৮১১ সালে, প্রায় ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তিনি তার সন্তান আদাদ-নিরারি তৃতীয়র কাছে ক্ষমতা অর্পণ করে চলে গেলেন চিরতরে। তবে আদাদ-নিরারি তখনও অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন। ফলে শামসি-আদাদের রানী, ব্যাবিলনের রাজকন্যা সাম্মু- আমাত সিংহাসনে বসলেন। অ্যাসিরীয়ার শাসক হবেন একজন নারী- বিষয়টি অবিসংবাদিত ছিল। নজিরবিহীন এ ঘটনার গুরুত্ব সাম্মু-আমাত খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি নিজের সিংহাসনে আরোহণের বর্ণনা দিয়ে একটি স্টেলে (পাথরের ট্যাবলেটে ইতিহাস খোদাই করে রাখা) তৈরি করেছিলেন, যেখানে তিনি অনেক যন্ত্রণা সহকারে প্রতিটি প্রাক্তন অ্যাসিরীয় রাজার সঙ্গে নিজের যোগসূত্রের বর্ণনা দেন। তিনি শুধু শামসি-আদাদের রানী ও আদাদ-নিরারির মা-ই ছিলেন না, বরং একই সঙ্গে ‘৪ প্রদেশের রাজা, শালমানেসারের পুত্রবধূও’ ছিলেন।
সাম্মু-আমাতের ক্ষমতাগ্রহণের ঘটনাটি এতটাই চমকপ্রদ ছিল যে, তা সমসাময়িক অন্যান্য জাতির ইতিহাসেও স্থান করে নিয়েছে। গ্রিকরা তার কথা খুব ভালো করেই স্মরণ করেছে। তারা তাকে ‘সেমিরামিস’ নাম দেয়। গ্রিক ইতিহাসবিদ তেসিয়াস বলেন, সাম্মু- আমাত একজন মৎস্যদেবীর কন্যা ছিলেন এবং তার লালনপালন করেছিল ঘুঘুপাখিরা। তিনি অ্যাসিরীয়ার রাজাকে বিয়ে করেছিলেন এবং নিনিয়াস নামে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। গ্রিকদের মতে, সেমিরামিস ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ মাধ্যমে শাসনভার গ্রহণ করেন।
প্রাচীন এই উপাখ্যানে আদাদ-নিরারির নামকে নিনিয়াস হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং এটাই একমাত্র গল্প বা সূত্র নয়, যা থেকে ধারণা করা যায় যে কোনো সহজ-সরল উপায়ে রানী ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এখানে নিঃসন্দেহে কিছু পরিমাণ ছল-চাতুরীর ঘটনা ঘটেছে। অপর এক গ্রিক ইতিহাসবিদ দিওদোরাস জানান, সেমিরামিস তার স্বামীকে রাজি করিয়েছিলেন যাতে ৫ দিনের জন্য তিনি দেশ শাসন করার সুযোগ পান। এই ৫ দিনে তিনি ‘দেখিয়ে দেবেন’ যে তিনিও শাসক হিসেবে পটু।
শামসি-আদাদ রাজি হলেন, এবং স্ত্রীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। তখন তিনি তাকে ফাঁসি দিয়ে পাকাপাকিভাবে ক্ষমতা দখল করে নিলেন।
ততদিনে গ্রিক শহরগুলো তিনটি আলাদা আলাদা ভাগে বিভক্ত হয়েছে।
৩০০ বছর আগে ডোরিয়ানদের আগ্রাসনে গ্রিসের মূল ভূখণ্ডের মাইসেনীয় শহরগুলো বিলীন হয়ে গেছিল। তবে সেগুলো পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়নি। মাইসেনীয় সভ্যতার যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা খুঁজে পাওয়া যেত আর্কেডিয়া নামের একটি জায়গায়।
কিছু মাইসেনীয় গ্রিক জনগোষ্ঠী মিশরে চলে গেছিল আর বাকিরা এইজিয়ান সাগর পেরিয়ে এশিয়া মাইনরের উপকূলে চলে যায়। এখানে তারা সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে। স্মিরনা, মিলেতাস, এপহিসাস ও অন্যান্য গ্রাম ধীরে ধীরে শহরে রূপান্তরিত হয়। মাইসেনীয়া ও এশিয়ার ভাষার সংযোগে একটি ভিন্নধর্মী কৃষ্টির উদ্ভব হয়, যাদেরকে আমরা আইওনিয়ান নামে ডাকব। এই আইওনিয়ান গ্রিকরা ডোরিয়ানদের আগ্রাসনের সময় কাছাকাছি দ্বীপগুলোতে সরে গেছিল। তারা লেসবোস, চিওস ও সামোস সহ আরও কয়েকটি দ্বীপে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে গ্রিসের পূর্ব উপকূলে ফিরে যায় তারা।
ইতোমধ্যে পেলোপোন্নেজিয়ান উপদ্বীপের দক্ষিণ ও পূর্ব অংশে ডোরিয়ানরা তাদের নিজেদের ঘাঁটি গড়ে তোলে। তারা আরও দক্ষিণে ক্রিট, রোডস ও কারপাথোস দ্বীপেও বসবাস করতে শুরু করে। ডোরিয়ানদের বাচনভঙ্গি মূল ভূখণ্ডের মাইসেনীয়দের বাচনভঙ্গি থেকে বেশ ভিন্ন ছিল। আবার আইওনিয়ানদের মুখের ভাষা ছিল অপর একধরনের।
৩টি গোত্রই কম-বেশি একই জাতির অংশ। আইওনিয়ানদের পূর্বপুরুষ মাইসেনীয় ছিল। আর মাইসেনীয় আর ডোরিয়ানরা এসেছিলেন একই ইন্দো- ইউরোপীয় জাতি থেকে। উভয় জাতিই কয়েকশো বছর আগে গ্রিক উপদ্বীপে আগত যাযাবরদের অংশ ছিল। পরবর্তীতে গ্রিকরা দাবি করে, ডোরিয়ানরা হেরাক্লিসের সন্তানদের কাছ থেকে এসেছে। তাদেরকে মাইসেনীয়ার জন্মস্থান থেকে জোর করে বিতাড়ন করা হয়েছিল এবং তারা আবারও তাদের ভূখণ্ডের দখল নিতে ফিরে এসেছিল।
কিন্তু তখনো সেখানে কোনো ‘গ্রিসের’ অস্তিত্ব ছিল না, শুধু মাইসেনীয় (অথবা ‘আর্কেডিয়ান’; তাদের পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা রাখতে), আইওনিয়ান ও ডোরিয়ানরা ছিলেন। গ্রিক উপদ্বীপও ছিল ‘পশ্চিমা সেমাইটদের’ ভূখণ্ডের মতো (ইসরায়েলি ও আরামিয়ান রাজত্বের আগে) স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রাজা ও গোত্র- প্রধানদের ভূখণ্ড।
ডোরিয়ানদের আগ্রাসন ততদিনে দূর-অতীতের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গ্রিক উপদ্বীপের শহরগুলো একটি অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছল। এ সময় তারা খুব সম্ভবত শত্রু নয়, বরং মিত্রের ভূমিকা পালন করেছে। তারা একে অপরের কৃষ্টি ও ভাষা ভাগ করে নেয়। আনুমানিক ৮০০ সালের দিকে (খ্রিস্টপূর্ব) এই একক কৃষ্টিগত পরিচয়ের কারণে জাতিগুলো বেশকিছু ঐতিহ্য ভাগ করে নিতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে সবাই মূলত মাইসেনীয় হিসেবেই নিজেদের চিহ্নিত করতে শুরু করে। একপর্যায়ে এই সমগ্র উপদ্বীপকে একই ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে দাবি করা হয় পূর্বে আলোচিত দুই মহাকাব্য, ইলিয়াড ও ওডিসিতে।
এই মহাকাব্যের রচয়িতা ছিলেন একজন আইওনিয়ান নাগরিক, যার নাম হোমার। তিনি খুব সম্ভবত এশিয়া মাইনরের শহর স্মিরনা অথবা চিওস দ্বীপ থেকে এসেছিলেন। হোমার কে ছিলেন, তা নিয়ে আজও বিতর্ক চলমান রয়েছে। কারো কারো মতে, হোমার নামে এককভাবে কোনো কবি ছিল না, বরং বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান কবির সমন্বিত নাম ছিল হোমার। তবে পুরো মহাকাব্যটি এমনভাবে লেখা হয়েছে, যাতে মনে হয় একজন কবি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ঘটনাগুলো বর্ণনা করছেন।
কেউ জানে না এই কবিতাগুলো কে বা কারা লিখে রেখেছিল। গ্রিকদের অন্ধকার যুগে শুধু মাইসেনীয়রা লেখালেখি করত। এবং তারাও খুব বেশি কিছু লেখেনি। তবে যখনই লেখা হোক না কেন, বর্ণিত ঘটনাগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সালের আগের কথা বলেছে।
শুধু ইলিয়াড ও ওডিসি নয়, গ্রিক পুরাণের বেশিরভাগ অংশটুকুই একটি ‘মাইসেনীয় ভৌগোলিক মানচিত্রের’ ওপর লেখা হয়েছে। শূকরের দাঁত দিয়ে বানানো শিরস্ত্রাণ ও বর্ম এবং ধনসম্পদের বর্ণনা থেকে ডোরিয়ানদের কথা জানা যায়। অপরদিকে, এই গল্পগুলোতে বিদেশি জায়গার এমন সব বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, যেটি মাইসেনীয়দের আমলের সঙ্গে খাপ খায় না। এমনকি, এই মহাকাব্যের ভাষারও জন্ম হয় অষ্টম শতাব্দীতে। ট্রয়ের রাজা প্রিয়ামের নামটি হিট্টিট সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি কিউদের ব্যবহৃত নব্য-হিট্টিট ভাষার অংশ।
ট্রয় এবং যেসব বীর তাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তাদের উপাখ্যানটি ডোরিয়ান, আর্কেডিয়ান ও আইওনিয়ানদের একটি পৌরাণিক অতীত এনে দিল, যেটি সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। ইলিয়াডে, আগামেমননের আহ্বানে প্রতিটি শহর থেকে জাহাজ পাঠানো হয়। এর আগে গ্রিকরা কখনোই এ-ধরনের ঐক্য দেখাতে সক্ষম হয়নি। এই গল্পের মাধ্যমে গ্রিক শহরগুলোর মধ্যে সমন্বিত হয়ে কাজ করার একটি প্রবণতা আমরা লক্ষ করতে পারি।
ইলিয়াডে আমরা প্রথমবারের মতো একটি শব্দ সম্পর্কে জানতে পারি, যেটি ছিল ‘বারবারো-ফোনোই”। এর অর্থ ‘অদ্ভুত বক্তা’। বস্তুত গ্রিকদের এই ত্রিমুখী চক্রের বাইরের মানুষদেরকে এই শব্দ দিয়ে বোঝানো হয়েছিল। অর্থাৎ, যারা গ্রিকদের ভাষা বুঝতেন, তারা ছাড়া বাকি সবাই অদ্ভুত বক্তা।
গ্রিকদের মনে আরও একটি চিন্তা এখান থেকে স্থান পেতে শুরু করে। মানুষ চিন্তা-চেতনা কিছুটা বাইনারি পদ্ধতিতে কাজ করে। এ অঞ্চলের মানুষ ভাবতে লাগলেন, ‘গ্রিক অথবা গ্রিক না (বাইনারি ১ ও ০’র মতো)’।
এভাবে মানুষকে গ্রিক বনাম অ-গ্রিক হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করার বিষয়টি এভাবেই শুরু হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ৮০০ সালে গ্রিক শহরগুলোর মধ্যে থাকা বিভাজনমূলক পরিস্থিতি এর পেছনে অনেকাংশে দায়ী। এই শহরগুলোর মাঝে ছিল না কোনো ধরনের রাজনৈতিক সমতা, তাদের প্রত্যেকের ছিল আলাদা আলাদা লক্ষ্য এবং জীবনযাত্রাতেও ছিল না তেমন কোনো মিল। ভিন্ন ভিন্ন শহর, ভিন্ন রাজা, ভিন্ন ধরনের ভূখণ্ড; কিন্তু তারা সবাই গ্রিক ভাষার এক বা একাধিক ধরনে কথা বলতেন। এক শহরের বাসিন্দা অন্য শহরের ভাষা মোটামুটি ভালোই বুঝতে পারতেন। মুখের ভাষা ও কিছুটা কাল্পনিক বা পৌরাণিক অতীতই তাদেরকে এক সুতায় বেঁধেছিল।